আমিও জানতাম না।
হিমুদা!
হুঁ।
তুমি কাউকে দেখে তাঁর ভবিষ্যৎ বলতে পার?
আমার নিজের ভবিষ্যৎ বলতে পারি-তন্মন্যেরটা পারি না।
তোমার ভবিষ্যৎ কী?
বলা যাবে না।
হিমুদা।
হুঁ?
তুমি কি জানতে এ-বাড়িতে আজ নাশতা হচ্ছে বাসি পোলাও?
জানতাম না।
মীরা ঢুকেছে। তার হাতে ট্রে। ট্রে ভরতি খাবার। মীরার পেছনে একটা কাজের মেয়ে।তার হাতেও ট্রে। শুধু যে বাসি পোলাও এসেছে তা না, পরোটা এসেছে, গোশত এসেছে। ছোট ছোট গ্রাসে কমলার রস। মীরা বলল, আপনারা চা খাবেন, না কফি খাবেন?
আমি বাদলকে বললাম, কী খাবি বল।
বাদল বলল, কি কি কফি।
বাদলকে তোতলামিতে ধরে ফেলেছে।
মীরা আমার সামনে বসল। তার বসার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে নিজেকে তৈরি করে এসেছে। কী কী বলবে সব ঠিক করা। নাশতা নিয়ে ঢোকার আগে সে নিশ্চয়ই মনেমনে রিহার্সেল দিয়েও এসেছে। মীরা বলল, আপনার নাম হিমু? উনি হিমুদা বলে ডাকছিলেন।
আমার নাম হিমু।
ঐ রাতে আপনাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। আসলে আমি আর বাবা আমরা দুজনেই ভেবেছিলাম টাকাটা কখনো পাওয়া যাবে না। বাবা অবিশ্যি বারবারই বলছিলেন টাকাটা ফেরত পাওয়া যাবে। তবে এটা ছিল নিজেকে সান্তুনা দেয়ার জন্যে কথার কথা। আপনি যখন সত্যি সত্যি মানিব্যাগ নিয়ে উপস্থিত হলেন তখন আমরা এতই হতভম্ব হয়ে গেলাম যে আপনাকে ধন্যবাদ দিতে পর্যন্ত ভুলে গেলাম। আপনি যেমন হুট করে। উপস্থিত হলেন তেমনি হুট করে চলেও গেলেন। তখন বাবা খুব হৈচৈ শুরু করলেন, মানুষটা গেল কোথায়, মানুষটা গেল কোথায়? বাবা খুব অল্পতে অস্থির হয়ে পড়েন। তখন তার ব্লাডপ্ৰেশারও বেড়ে যায়। তিনি খুবই অস্থির হয়ে পড়লেন। আপনাদের খুঁজে বের করার জন্যে রাত আড়াইটার সময় ঘর থেকে বের হলেন।
বল কী!
আমার বাবা খুব অস্থির প্রকৃতির মানুষ। তার সঙ্গে কথা না বললে বুঝতে পারবেন। না। উনি রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত আপনাদের খুঁজে বেড়ালেন। আমি একা একা ভয়ে অস্থির।
একা, কারণ আমাদের সংসারে দুজনই মানুষ। আমি আর আমার বাবা। যা-ই হোক, বাবা বাসায় ফিরেই বললেন, মীরা শোন, আমি নিশ্চিত টাকা নিয়ে যারা এসেছিল তারা মানুষ না, অন্যকিছু।
আমি বললাম, অন্যকিছু মানে?
বাবা বললেন, অন্যকিছুটা কী আমি নিজেও জানি না। আমাদের দৃশ্যমান জগতে মানুষ যেমন বাস করে, মানুষ ছাড়া অন্য জীবরাও বাস করে। তাদের কেউ এসেছিলেন। বাবা এমনভাবে বললেন, যে, আমি নিজেও প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। সেই কারণেই আপনাকে দেখে এমন চমকে উঠেছিলাম।
ও আচ্ছা।
এখন আপনাকে একটা অনুরোধ করছি, আপনি দয়া করে বাবার সঙ্গে দেখা করুন। বাবার মন থেকে ভ্রান্ত ধারণা দূর করুন। আজ কি যেতে পারবেন?
বুঝতে পারছি না। আজ আমাদের অনেক কাজ।
কী কাজ?
বাঁদর দেখার জন্যে চিড়িয়াখানায় যেতে হবে। হাতির পিঠে চড়তে। এ জানি বাই এলিফ্যান্ট-টাইপ ব্যাপার। আঁখি নামের একটা মেয়েকে খুঁজে বের করতে হবে। ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বেশ, কাল আসুন।
দেখি পারি কি না।
আপনি আমার বাবার অবস্থাটা বুঝতে পারছেন না। একটা ভুল ধারণা তার মনে ঢুকে গেছে। এটা বের করা উচিত।
আমি হাসিমুখে বললাম, কোনটা ভুল ধারণা, কোনটা শুদ্ধ ধারণা সেটা চট করে। বলাও কিন্তু মুশকিল। এই পৃথিবীতে সবকিছুই আপেক্ষিক।
আপনি নিশ্চয়ই প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন না যে আপনি মানুষ না, অন্যকিছু?? আমি আবারও হাসলাম। আমার সেই বিখ্যাত বিভ্ৰান্ত-করা হাসি। তবে বিংশ শতাব্দীর মেয়েরা অনেক চালাক, যত বিভ্রান্তির হাসিই কেউ হাসুক মেয়েরা বিভ্রান্ত হয় না। তা ছাড়া পরিবেশের একটা ব্যাপারও আছে। বিভ্রান্ত হবার জন্যে পরিবেশও লাগে। আমি যদি রাত দুটায় হঠাৎ করে মীরাদের বাসায় উপস্থিত হই এবং এই কথাগুলি বলি কিছুক্ষণের জন্যে হলেও সে বিভ্রান্ত হবে।
এখন ঝলমলে দিনের আলো। আমাদের নাশতা দেয়া হয়েছে। কফি পটভরতি। কফির পীট থেকে গরম ধোয়া উড়ছে। এই সময় বিভ্ৰান্তি থাকে না।
বাদল মাথা নিচু করে বাসি পোলাও খাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাসি পোলাও-এর মতো বেহেশতি খানা সে এই জীবনে প্ৰথম খাচ্ছে।
আমরা চিড়িয়াখানায় গেলাম।
বদরদের বাদাম খাওয়ালাম। তাদের লাফালাফি বাঁপাঝাঁপি দেখলাম। তারপর হাতির পিঠে চড়লাম। দশ টাকা করে টিকিট। তারপর গেলাম শিম্পাঞ্জি দেখতে। শিম্পঞ্জি দেখে তেমন মজা পাওয়া গেল না। কারন তাঁর অবস্থা বাদলের মতো। খুবই বিমর্ষ। আমরা একটা কলা ছুড়ে দিলাম–সে ফিরেও তাকাল না। বাঁদরগোত্রীয় প্রাণী অথচ কলার প্রতি আগ্রহ নেই–এই প্রথম দেখলাম। বাদলকে বললাম, চল জিরাফ দেখি।
বাদল শুকনো গলায় বলল, জিরাফ দেখে কী হবে!
জিরাফের লম্বা গলা দেখে যদি তোর মনটা ভালো হয়।
আমার মন ভালো হবে না। আমি এখন বাসায় চলে যাব।
যা, চলে যা। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। সন্ধ্যাবেলা সব পশুপাখি একসঙ্গে ডাকাডাকি শুরু করে–ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার।
কোনো ইন্টারেস্টিং ব্যাপারে। আমি এখন আর আগ্ৰহ বোধ করছি না।
তা হলে যা, বাড়িতে গিয়ে লম্বা ঘুম দে।
তুমি আঁখিকে টেলিফোন করবে না?
করব।
এখন করো। চিড়িয়াখানায় কার্ডফোন আছে। আমার কাছে কার্ড আছে।
তুই কি ফোন-কার্ড সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? এ-পর্যন্ত ঐ বাড়িতে কবার টেলিফোন করেসিস?
দুবার।
তোর সঙ্গে কথা বলেনি?
না।