আমি বললাম, আমরা স্ট্যাটিসটিক্যাল বুরো থেকে এসেছি। বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
অ্যাপনার নাম?
হিমু।
কার্ড দেন।
আমার সঙ্গে কার্ড নেই। আমরা ছোট কর্মচারী, আমাদের সঙ্গে তো কার্ড থাকে। না। আপনি ভেতরে গিয়ে খবর দিন। বলবেন স্ট্রাটিসটিক্যাল বুরো।
দারোয়ান ভেতরে চলে গেল। বাদল বলল, ভয়-ভয় লাগছে হিমুদা। শেষে হয়তো পুলিশে দিয়ে দেবে। মারধোর করবে।
ভয়ের কিছু নেই।
তোমার খালি পা। খালি পা দেখেই সন্দেহ করবে।
মানুষ চট করে পায়ের দিকে তাকায় না। তাকায় মুখের দিকে। তা ছাড়া আমাদের ভেতরে নিয়ে বসাবে। তখন খালিপায়ে বসলে ভাববে স্যান্ডেল বাইরে খুলে এসেছি।
তোর মন-স্যাতসেঁতে ভাবটা কি এখন দূর হয়েছে?
হুঁ।
একটা উত্তেজনার মধ্যে তোকে ফেলে দিয়েছি। যাতে আঁখি মেয়েটির চিন্তা থেকে আপাতত মুক্তি পাস।
দারোয়ান এসে বলল, যান, ভিতরে যাইতে বলছে।
আমরা রওনা হলাম। বাদল ভালো ভয় পেয়েছে। তার চোখেমুখে ঘাম। তবে সে আঁখির হাত থেকে এখন মুক্ত।
আমাদের বসালো ড্রয়িংরুমের পাশে ছোট একটা ঘরে। এটা বোধহয় গুরুত্বহীন মানুষদের বসার জন্যে ঘর। দেশ থেকে লোক আসবে–এখানে বসবে। বিল নিতে আসবে, বসবে এই খুপরিতে।
এক ভদ্রলোক গম্ভীরমুখে ঢুকলেন। বয়স্ক লোক। সকালবেলায় হঠাৎ-যন্ত্রণায় তিনি বিরক্ত। বিরক্তি চাপার চেষ্টা করছেন, পারছেন না।
আপনাদের ব্যাপারটা কী?
সোসিওলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা সমীক্ষা চালাচ্ছি। সমীক্ষাটা হচ্ছে ঢাকা শহরের মানুষদের ব্রেকফাষ্টের প্রোফাইল।
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, কিসের প্রোফাইল? কোন পরিবারে কী ধরনের নাশতা খাওয়া হয়। এর উপর একটা জেনারেল সন্টাডি। আজ। আপনাদের বাসায় কী নাশতা হয়েছে, আপনি কী খেয়েছেন?
সকালে তো আমি নাশতাই খাই না। একটা টেষ্ট খাই আর এক কাপ কফি খাই
আমি গম্ভীর মুখে কাগজে লিখলাম— টোষ্ট, কফি।
কফি কি ব্ল্যাক কফি?
না, ব্ল্যাক কফি না, দুধ-কফি।
বাড়িতে নিশ্চয়ই অন্য সবার জন্যে কোনো-একটা নাশতা তৈরি হয়েছে, সেটা কী?
দাঁড়ান, আমার ভাগ্নিকে পাঠাই। ও বলতে পারবে। এই জাতীয় স্টাডির কথা প্ৰথম শুনলাম। যেসব সন্টাডি হবার সেসব হচ্ছে না— নাশতা নিয়ে গবেষণা!
ভদ্রলোক চলে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যে-মেয়েটি ঢুকল সে মীরা। গভীর রাতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কুড়িয়ে পাওয়া মানিব্যােগ এই মেয়েটির হাতেই দিয়েছি। তবে এমন জমকালো বাড়িতে নয়। মেয়েটি আমাকে চিনতে পারল না। সেও ভদ্রলোকের মতোই বিরক্তমুখে বলল, আজ এ-বাড়িতে কোনো নাশতা হয়নি। গতরাতে বাড়িতে একটা উৎসব ছিল। বড়মামার পঞ্চাশতম জন্মদিন। সেই উপলক্ষে পোলাও রান্না হয়েছে। অনেক পোলাও বেঁচে গেছে। উীপ ফ্রিজে রাখা ছিল। সকালে সে-পোলাও
গরম করে দেয়া হয়েছে।
আমি সহজ গলায় বললাম, আমরা দুজন কি সেই বাসি পোলাও খেয়ে দেখতে পারি? পোলাওয়ের সঙ্গে ডিমভাজা।
বাদল চোখমুখ শুকনো করে ফেলল। মীরা তাকাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে।
আমি বললাম, তারপর মীরা, তুমি ভালো আছ?
মীরা এখনও তাকিয়ে আছে।
আমাকে চিনতে পারছি তো? ঐ যে তোমাকে টাকা দিয়ে এলাম সাঁইত্রিশ হাজার নয়শো একুশ টাকা?
মীরা পুরো হকচকিয়ে গেছে। মেয়েরা হতচকিত অবস্থা থেকে চট করে উঠে আসতে পারে। মীরা পারছে না। মেয়েটি মনে হয়। সহজ-সরল জীবনে বাস করে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তেমন যোগ নেই তার জীবনে হকচকিয়ে যাবার ঘটনা তেমন ঘটেনি।
মীরা, আমাকে চিনতে পারছ তো?
হুঁ।
ভেরি গুডা আমাদের নাশতা দিয়ে দাও। খেয়ে চলে যাই। সন্ট্যাটিসটিক্যাল ডাটা সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। এসব ধাপ্লাবাজি। আমরা আসলে নাশতা খেতে এসেছি।
ও আচ্ছা।
আসল কথা বলতে ভুলে গেছি, নাশতা একজনের জন্যে আনবে, শুধু বাদলের জন্যে। আমি একবেলা খাই। বাদলের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি। এ হচ্ছে আমার ফুপাতো ভাই। পিএইচ.ডি. করার জন্যে কোথায় যেন গিয়েছে। জায়গাটা কোথায় রে বাদল?
বাদল মাথা নিচু করে ছিল। সে মাথা নিচু করে ক্ষীণস্বরে বলল, কানাডা।
অপরিচিত মানুষের সামনে বাদল একেবারেই সহজ হতে পারে না। মেয়েদের সামনে তো নয়ই। বিশেষ করে মেয়ে যদি সুন্দরী হয় তা হলে বাদলের জিহবা জড়িয়ে যায়। তোতলামি শুরু হয়। রাতে মীরা মেয়েটাকে যত সুন্দর দেখাচ্ছিল দিনে তারচেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে।
ভেতর থেকে ভারি গলায় কে যেন ডাকল— মীরা মীরা!
মনে হয় শুরুতে যে-ভদ্রলোক এসেছিলেন তিনিই ডাকছেন। সকালে কী নাশতা হয় তার তালিকা দিতে মীরার এত দেরি হবার কথা না। মীরা বলল, আপনারা বসুন। আমি আসছি।
বাদল মাথা তুলল। তার কানটান লাল হয়ে আছে। বিয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে, বিয়ে হলে বাদল তো মনে হয়। সারাক্ষণ কান লাল করে বসে থাকত। পার্মানেন্ট তোতলা হয়ে যেত। কেমন আছিসরে বাদল? জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিত–ভাভা ভাল।
হিমুদা।
হুঁ।
এই মেয়েটাকে তুমি চেন?
হুঁ।
আশ্চর্য তো!
আশ্চর্যের কী আছে! সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকতে পারে না?
সেইজন্যে আশ্চর্য বলছি না। অন্য কারণে আশ্চর্য বলছি।
কী কারণ?
বাসি পোলাও খেতে চেয়েছি–তুমি এই বাড়িতে নিয়ে এলে। এই বাড়িতে আজই বাসি পোলাও নাশতা।
একে বলে কাকতালীয় যোগাযোগ।
কাকতালীয় না–এর নাম হিমুতালীয়। তোমার যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে তা আমি গোড়া থেকেই জানি–তবে ক্ষমতোটা যে এত প্ৰবল তা জানতাম না।