হুঁ।
তুই ওদের টেলিফোন নাম্বার পকেটে নিয়ে ঘুরছিস কেন?
পকেটে করে ঘুরছি না–তোমার এখানে আসা যখন ঠিক করেছি তখন মনে হয়েছে তুমি ওদের টেলিফোন নাম্বার চাইতে পার, তাই মনে করে নিয়ে এসেছি।
ভালো করেছিস।
তুমি কি সত্যি মিরপুর পর্যন্ত হেঁটে যাবে?
হুঁ। ঘণ্টা দুএক লাগবে–এটা কোনো ব্যাপারই না।
আমি হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিলাম। মনে হচ্ছে আজকের দিনটি হবে আমার জন্যে কর্মব্যস্ত একটি দিন।
পথে নেমেই শুনি কোকিল ডাকছে। তার মানে কী? শীতকালে কোকিল ডাকছে।
কেন?
বাদল।
হুঁ।
কোকিল ডাকছে শুনছিস।
হুঁ।
ব্রেইন-ডিফেক্ট কোকিল— অসময়ে ডাকাডাকি করছে।
হুঁ।
তুই কি ঠিক করেছিস হুর বেশি কিছু বলবি না?
কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
কোকিল সম্পর্কে একটা তথ্য শুনিবি?
বলো।
কোকিলের গলা কিন্তু এমিতে খুব কৰ্কশ। সে মধুর গলায় তাঁর সঙ্গীকে ডাকে মেটিং সিজনে। তখনই কোকিল-কণ্ঠ শুনে আমরা মুগ্ধ হই।
ভালো।
তোর কি একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না?
না।
পথে হাটার নিয়ম জানিস?
হাঁটার আবার নিয়ম কী, হাঁটলেই হলো।
সবকিছুর যেমন নিয়ম আছে–হাঁটারও নিয়ম আছে। হাঁটতে হয় একা একা। বলতো কেন?
জানি না।
দুজন বা তারচেয়ে বেশি মানুষের সঙ্গে হাঁটলে কথা বলতে হয়। কথা বলা মানেই হাঁটার প্রথম শর্ত ভঙ্গ করা। হাঁটার প্রথম শর্ত হচ্ছে–নিঃশব্দে হাটা।
হুঁ।
দেখার চেষ্টা না করা। ইংরেজিতে Glance— চট করে তোকানো, Look না।
হুঁ।
হাঁটার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে পথে কোথাও থামা চলবে না। কাজেই তুই চট করে। দাঁড়িয়ে পড়বি না।
আচ্ছা।
পেছন দিকে তাকানো চলবে না।
আচ্ছা।
তোর কি একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?
বাদল জবাব দিল না। আমি বললাম, বাদল, তুই হাঁটার চতুর্থ শর্ত ভঙ্গ করছিস।
চতুর্থ শর্তটা কী?
তুই মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছিস। হাঁটার সময় মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটা চলবে না।
ও আচ্ছা।
তোর হাঁটতে কষ্ট হলে রিকশা নিয়ে নিই।
কষ্ট হচ্ছে না।
আচ্ছা, তুই একটা প্রশ্নের জবাব দে। খুব সহজ প্রশ্ন। রিকশাওয়ালাদের রিকশায় প্যাডেল চাপাতে হয়। এই কাজটা করার জন্যে তাদের সবচে ভালো পোশাক হচ্ছে ফুলপ্যান্ট কিংবা পায়জামা। পুরানো কাপড়ের দোকানে সস্তায় ফুলপ্যান্ট পাওয়া যায়। রিকশাওয়ালারা কিন্তু কেউই ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পরে না। তারা সবসময় পরে লুঙ্গি। । এখন বল, কেন? খুব সহজ ধাঁধা।
জানি না কেন। ধাঁধা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না।
কী নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে?
কোনোকিছু নিয়েই ভাবতে ইচ্ছা করছে না।
চোখের কতকগুলি প্ৰতিশব্দ বলা তো! প্রথমটা আমি বলে দিচ্ছি–আঁখি।
বললাম তো হিমুদা, ধাঁধার খেলা খেলতে ইচ্ছা করছে না।
আহা আয়-না একটু খেলি! বল দেখি চোখ, আঁখি…তারপর?
চোখ, আঁখি, নয়ন, নেত্র, অক্ষি, লোচন…
গুড, ভালোই তো বলেছিস!
হিমুদা, খিদে লেগে গেছে।
খিদে ব্যাপারটা কেমন ইন্টরেস্টিং দেখেছিস–তোর যত ঝামেলা, যত সমস্যাই থাকুক, খিদের সমস্যা সবসময় সবচেয়ে বড় সমস্যা।
ফিলসফি করবে না। ফিলসফি ভালো লাগছে না।
খিদের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় জনিস।
না।
খুব সহজ উপায়। বাহাতুর ঘণ্টা কিছু না-খেয়ে থাকা–পানি পর্যন্ত না। বাহাতুর ঘণ্টার পর এক চামুচ বা দুচামুচ পানি খাওয়া যেতে পারে। বাহাতুর ঘণ্টা পার করার পর দেখবি খিদেবোধ নেই–শরীরে ফুরফুরে ভাব। মাথার ভেতরটা অসম্ভব ফাঁকা। মাঝে মাঝে ঝনঝন করে আপনা-আপনি বাজনা বেজে ওঠে। আলোর দিকে তাকালে
নানান রঙ দেখা যায়–তিনকোণা কাচের ভেতর দিয়ে তাকালে যেমন রঙ দেখা যায়
তেমন রঙ।
তুমি দেখেছ?
হুঁ।
কিতদিন না-খেয়ে ছিলে?
বাহাতুর ঘণ্টা থাকার কথা, বাহাতুর ঘণ্টা ছিলাম।
বাহাতুর ঘণ্টা থাকার কথা তোমাকে কে বলল?
বাবা বলেছিলেন। আমার গুরু হচ্ছেন আমার পিতা। মহাপুরুষ বানাবার কারিগর। তোর কি খিদে বেশি লেগেছে?
হুঁ।
কী খেতে ইচ্ছে করছে?
যা খেতে ইচ্ছে করছে তা-ই খাওয়াবে?
আমি কি ম্যাজিশিয়ান নাকি, তুই যা খেতে চাইবি— মন্ত্র পড়ে তা-ই এনে দেব?
তুমি ম্যাজিশিয়ান তো বটেই–অনেক বড় ম্যাজিশিয়ান। অন্যরা কেউ জানে না, আমি জানি। আমার বাসি পোলাও খেতে ইচ্ছে করছে।
বাসি পোলাও মানে?
গতরাতে রান্না করা হয়েছে। বেঁচে গেছে, ফ্রিজে রেখে দেয়া হয়েছে। সেই বাসি। পোলাওয়ের সঙ্গে গরম-গরম ডিমভাজা।
খুব উপাদেয় খাবার?
উপাদেয় কি না জানি না। একবার খেয়েছিলাম, সেই স্বাদ মুখে লেগে আছে। মাঝে মাঝে আমার এই খাবারটা খেতে ইচ্ছা করে। বাসি পোলাও তো আর চাইলেই পাওয়া যায় না। তবে তুমি চাইলে পাবে।
আমি চাইলে পাব কেন?
কারণ তুমি হচ্ছে মহাপুরুষ।
মহাপুরুষরা বুঝি চাইলেই বাসি পোলাও পায়?
বাদল জবাব দিল না। আমি বললাম, আয় লাক ট্রাই করতে করতে যাই। রেসিডেনশিয়াল এরিয়ার ভেতর ঢুকে যাই। সব বাড়ির সামনে দাঁড়াব। কলিংবেল টিপব–বাড়ির মালিক বের হলে বলব, আমরা একটা সার্ভে করছি। সকালবেলা কোন বাড়িতে কি নাশতা হয় তার সার্ভে। ইনকাম গ্রুপ এবং নাশতার প্রোফাইল।
কী যে তুমি বল!
আরো আয় দেখি!
তুমি কি সত্যি সিরিয়াস।
অবশ্যই সিরিয়াস। তবে সার্ভের কথা বলে শুধুহাতে উপস্থিত হওয়া চলবে না। কাগজ লাগবে, বলপয়েন্ট লাগবে। তুই বলপয়েন্ট আর কাগজ কিনে দে।
আমার ভয়-ভয় লাগছে হিমুদা।
ভয়ের কিছু নেই, আয় তো!
প্রথম যে-বাড়ির সামনে আমরা দাঁড়ালাম সেই বাড়ির নাম উত্তরায়ণ। বেশ জমকালো বাড়ি। গেটে দারোয়ান আছে। গেটের ফাঁক দিয়ে বাড়ির মালিকের দুটো গাড়ি দেখা যাচ্ছে। একটা গাড়ি মনে হয় কিছুদিনের মধ্যে কেনা হয়েছে। ঝকঝক করছে।