আমি বললাম, লিখে ফ্যাল–
এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয় না।
নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে পাহাড় তাকে সয় না।
এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয় না।
কেমন করে ফুলের কাছে রয়
গন্ধ আর বাতাস দুই জনে…
এভাবে হয়, এমন ভাবে হয়।
বাদল বলল, এটা কার কবিতা, তোমার?
পাগল হয়েছিস? আমি কবিতা লিখি নাকি? এই কবিতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের।
কতদিন পর তোমাকে দেখছি, কী যে অদ্ভুত লাগছে।
অদ্ভুত লাগছে?
হু, লাগছে। আঁখির সঙ্গে বেশি গল্প হবে তোমাকে নিয়ে।
ওকে নিয়ে আবার খালিপায়ে হাঁটতে বের হবি না তো?
অবশ্যই বের হব। আমি পরব হলুদ পাঞ্জাবি, ওকে পরাব হলুদ শাড়ি। তারপর…
তারপর কী?
সেটা বলতে পারব না, লজ্জা লাগছে। হিমুদা শোনো, তোমার জন্যে আমি খুব সুন্দর একটা গিফট এনেছি। আন্দাজ করো তো কী?
আন্দাজ করতে পারছি না।
একটা খুব দামি স্লিপিংব্যাগ নিয়ে এসেছি। তুমি তো যেখানে—সেখানে রাত কাটাও— ব্যাগটা থাকলে সুবিধা–ব্যাগের ভেতর ঢুকে পড়বে। স্লিপিংব্যাগের কালার তোমার পছন্দ হবে না। মেরুন কালার। অনেক খুঁজেছি–হলুদ পাইনি।
বাদল স্লিপিংব্যাগ নিয়ে এল। বোঝাই যাচ্ছে–অনেক টাকা দিয়ে কিনেছে।
হিমুদা, পছন্দ হয়েছে?
খুব পছন্দ হয়েছে।
ব্যাগটা থাকায় তোমার খুব সুবিধা হবে। ধরো তুমি জঙ্গলে জোছনা দেখতে গিয়েছ। অনেক রাত পর্যন্ত জোছনা দেখলে-ঘুম পেয়ে গেলে কোনো-একটা গাছের নিচে ব্যাগ রেখে তার ভেতর ঢুকে গেলে।
আমারও ইচ্ছে করছে। হিমুদা চলো, কাছেপিছের কোনো-একটা জঙ্গলে চলে যাই—
জয়দেবপুরের শালবনে গেলে কেমন হয়?
বিয়ের আগে তোর কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। বিয়ে হয়ে যাক, তারপর তুই আর আঁখি, হিমু ও হিমি…
আমি বাক্যটা শেষ করার আগেই রণরঙ্গিনী মূর্তিতে ফুপু ঢুকলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে খরখরে গলায় বললেন, তুই কাদের বাসায় নিয়ে এসেছিস? বাঁদর দুটোকে জোগাড় করেছিস কোথায়?
আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, কেন, ওরা কী করেছে?
দুটোই তো ন্যাংটো হয়ে ছাদে নাচানাচি করছে। তোর ফুপাও নাচছে।
বলো কী!
তুই এক্ষুনি এই মুহুর্তে এদের নিয়ে বিদেয় হবি।
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। আমার বগলে বাদলের আনা মেরুন রঙের স্লিপিংব্যাগ।
ফুটপাতে যারা ঘুমায় দেখা যাচ্ছে তাদের কিছু নীতিমালা আছে। তারা জায়গা-বদল করে না। ঘুমুবার জায়গা সবার যে নিউ মার্কেটের পাশে ঘুমায় সে যদি সন্ধ্যাবেলায় বাসাবোতে থাকে–সেও হেঁটে হেঁটে নিউ মার্কেটের পাশে এসে নিজের জায়গায় ঘুমুবে।
কাজেই বস্তা-ভাইকে খুঁজে বের করতে আমার অসুবিধা হলো না। দেখা গেল সাত দিন আগে তারা যেখানে ঘুমুচ্ছিল এখনও সেখানেই ঘুমুচ্ছে। পিতা এবং পুত্র চটের ভেতরে ঢুকে আরামে নিদ্রা দিচ্ছে। আমি তাদের ঘুম ভাঙালাম। বস্তা-ভাইয়ের পুত্রের বয়স খুবই কম। চার-পাঁচ বছর হবে। কাঁচা ঘুম ভাঙায় সে খুবই ভয় পেয়েছে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বললাম, এই গাবলু, তোর নাম কী?
গাবলু জবাব দিল না। বাবার কাছে সরে এল। বাবা বিরক্তমুখে বলল, আফনের কী বিষয়? চান কী?
আমি হাসিমুখে বললাম, আমাকে চিনতে পারছেন না! আমি হচ্ছি। আপনাদের সহনিদ্রক। একসঙ্গে ঘুমালাম–মনে নেই? শেষরাতে জ্বর উঠে গেল। আপনি রিকশা ডেকে–আমাকে ধরাধরি করে তুলে দিলেন।
মনে আছে। আফনে চান কী?
কিছু চাই না। আপনাদের সঙ্গে ঘুমাব-অনুমতি চাচ্ছি।
অনুমতির কী আছে? গভমেন্টের জায়গা। ঘুমাইতে ইচ্ছা হইলে ঘুমাইবে।
আমি তাদের পাশে আমার স্লিপিংব্যাগ বিছালাম। পিতা এবং পুত্র দুজনেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ব্যাগের জিাপার খুলে আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, এই জিনিসটার নাম স্লিপিংব্যাগ। এর অনেক সুবিধা-ভেতরে ঢুকে জিপর লাগিয়ে দিলে শীত লাগবে না, মশা কামড়াবে না। বৃষ্টির সময় ভিজতে হবে না। চোর এসে তুলে নিয়ে চলে যেতে পারবে না। চোর যদি নিতে চায় আমাকে সুদ্ধ নিতে হবে।
বস্তা-ভাই তার বিস্ময় সামলাতে পারল না। ক্ষীণস্বরে বলল, এই জিনিসটার দাম কীরকম ভাইজান?
আমি ঘুম-ঘুম গলায় বললাম, জানি না। বলেই জিপর লাগিয়ে দিলাম। স্লিপিংব্যাগটা আমি আসলে এনেছি। এই দুজনকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেবার জন্যে। হিমুরা স্লিপিংব্যাগ নিয়ে পথে হাঁটে না। আমি ঠিক করেছি। বাকি রাতটা স্লিপিংব্যাগে ঘুমুব। সকালে ব্যাগ থেকে বের হয়ে এক কাপ চা খাব। তারপর পিতা এবং পুত্রকে ব্যাগটা উপহার দিয়ে চলে যাব। আহা, এই দুজন আরাম করে ঘুমােক। ছেলেটার চেহারা খুব মায়াকাড়া। কী নাম ছেলেটার? আচ্ছা, নামটা সকালে জানলেও হবে। এখন ভালো ঘুম পাচ্ছে। সামান্য দুশ্চিন্তাও হচ্ছে বাদলদের বাড়ি থেকে মোফাজ্জল এবং জহিরুলকে নিয়ে আসা হয়নি। এরা এতক্ষণে কী কাণ্ড করছে কে জানে। মনের আনন্দে ছাদ থেকে লাফিয়ে না পড়লেই হয়।
স্লিপিংব্যাগটা আসলেই ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে।
ভাইজান ও ভাইজান!
কী?
আমার ছেলে আফনের এই জিনিসটা একটু হাত দিয়া ছুইয়া দেখতে চায়।
উহু, ময়লা হবে। হাত যেন না দেয়।
জ্বে আচ্ছা।
ছেলের নাম কী?
সুলায়মান।
ছেলের মা কোথায়?
সেইটা ভাইজান এক বিরাট হিস্টুরি।
থাক বাদ দিন, বিরাট হিস্টুরি শোনার ইচ্ছা নেই, ঘুম পাচ্ছে।
ভাইজান!
হুঁ।
জিনিসটার ভিতরে কি দুইজন শোয়া যায়?
তা যায়। বড় করে বানানো।