ভাবছো।
কিছুই ভাবছে না, আমি নিয়ে আসছি। ফুপা কি বাসায় আছেন?
বাসায় থাকবে না তো যাবে কোথায়? একটা অজুহাত পেয়েছে ছেলের বিয়েবোতল নিয়ে ছাদে চলে গেছে। বাড়ি ভরতি লোকজন। নাজানি কী ভাবছে।
তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে ফুপু! শাড়ি কি কোনো নতুন কায়দায় পরেছ? মোটাটা অনেকটা ঢাকা পড়েছে!
সত্যি বলছিস?
অবশ্যই সত্যি বলছি।
রিনাও বলছিল। আমাকে নাকি স্লিম লাগছে। তুই কথা বলে সময় নষ্ট করিস না তো! তোর বন্ধুদের নিয়ে আয়, আমি খাবার গরম করছি।
বন্ধুরা কিছু খাবে না। ফুপু, ওরা খেয়ে এসেছে। আমি বাদলের সঙ্গে খাব, ওরা ছাদে বসে ফুপার সঙ্গে গল্প করবে।
ফুপা আমাকে দেখে আনন্দে অভিভূত হলেন। মাতালরা একটা পর্যায়ে যে-কোনো ব্যাপারে আনন্দে অভিভূত হয়। তার এখন সেই অবস্থা চলছে। ফুপার মনেই নেই যে তিনি আমাকে আসতে নিষেধ করেছেন।
আরে হিমু হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! তোর কথাই ভাবছিলাম।
ফুপা, এরা হলো আমার দুই বন্ধু, একজন মোফাজ্জল, আর একজন জহিরুল। ফুপা মধুর গলায় বললেন, তোমরা কেমন আছ? তুমি করে বললাম, কিছু মনে কোরো না। আবার হিমু হলো আমার ছেলের মতো, সেই হিসেবে তোমরাও আমার ছেলে। হা হা হা, দাঁড়িয়ে আছ কেন, খুব ঠাণ্ডা তো, এইজন্যেই দুফোঁটা হুইস্কি খাচ্ছি। তার উপর ছেলের বিয়ে–মহা আনন্দের ব্যাপার! মেয়ের বিয়ে হলে কষ্টের ব্যাপার হতো। মেয়ের বিয়ে মানে মেয়ের বিদায়। ছেলের বিয়ে মানে নতুন একটা মেয়ে প্রাপ্তি। এই উপলক্ষে সামান্য মদ্যপান করা যায়। ঠিক না?
জহিরুল বলল, এই দিন যদি মাল না খান খাবেন কবে।
এই ব্যাপারটাই তো তোমাদের ফুপুকে বোঝাতে পারছিলাম না। শরৎচন্দ্রের দেবদাস পড়ে মেয়েরা ধরেই নিয়েছে মদ একটা ভয়াবহ ব্যাপার। পরিমিত মদ্যপান যে হার্টের কত বড় অষুধ তা এরা জানে না। টাইম পত্রিকায় একটা আর্টিকেল ছাপা হয়েছে, সেখানে পরিষ্কার লেখা—যারা পরিমিত মদ্যপান করে তাদের হার্ট অ্যাটাকের রিস্ক অর্ধেক কমে যায়। তোমরা কি একটু খেয়ে দেখবো?
মোফাজ্জল বলল, জি না, জি না। আপনি মুরুব্বি মানুষ।
লজ্জা করবে না তো, খাও। এত বড় একটা আনন্দ-উৎসবে আমি একা একা বসে। আছি। তোমরা আসায় তাও কথা বলার লোক পাচ্ছি। হিমু যা তো, দুটা গ্লাস এনে দে। বোতল আরেকটা লাগবে। আমার ঘরে চলে যা। বুকশেলফের তিন নম্বর তাকে বইগুলোর পেছনে একটা ব্ল্যাক ডগের বোতল আছে। এইসব জিনিস একা খেয়ে কোনো আনন্দ নেই–তাই না তফাজল?
স্যার, আমার নাম মোফাজল।
স্যার বলছি কেন? আমি হিমুর ফুপা, তোমারও ফুপা। এই যে শুটকা ছেলেটা তারও ফুপা। তোমার নাম যেন কী?
জহিরুল।
শুটিকা ছেলে বলায় রাগ করনি তো?
জি না।
তোমার ফুপুকে দেখার পর পৃথিবীর যে-কোনো মানুষকেই আমার কাছে শুটিকা মনে হয়। একবার কী হয়েছে শোনো। প্লেনে করে চিটাগাং যাচ্ছি–সে দেখি প্লেনের সিটে ঢেকে না। হাস্যকর ঘটনা। এয়ার হোস্টেস, আমি দুজনে মিলে ঠেলাঠেলি। এখনও মনে করলে লজীয় মরে যাই।
আমি নিচে চলে এলাম। মোফাজ্জল আর জহিরুলকে নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই। তারা মনের সুখে ব্ল্যাক ডগ খেতে পারবে। ফুপা যত্ন করে মুখে তুলে তুলে খাওয়াবেন। বোতল শেষ হলেও কোনো সমস্যা নেই। বিচিত্র সব জায়গা থেকে নতুন নতুন বোতল বের হবে। শেষের দিকে সিচুয়েশন আউট অভ হ্যান্ড হয়ে যাবার সম্ভাবনাও অবিশ্যি আছে। এক মাতাল হয় বিষন্ন প্রকৃতির, দুই মাতাল হয় মিত্রভাবাপন্ন–তিন মাতাল সর্বদাই ভয়াবহ।
খাওয়া শেষ করে আমি বাদলের ঘরে গিয়ে বসেছি। বাদলের গায়ে সিন্ধের পাঞ্জাবি, হাতে রাখি। চোখেমুখে লজ্জিত একটা ভাব। বিবাহ নামক অপরাধ করতে যাচ্ছে এই কারণে সে যেন ছোট হয়ে আছে। তাকে দেখাচ্ছেও খুব সুন্দর। বিয়ের আগে-আগে শুধু যে মেয়েরই সুন্দর হয়ে যায় তা না, ছেলেরাও সুন্দর হয়। আমি বদলের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি।
বাদল, তোকে খুব সুন্দর গায়ের রঙও তো মনে হয় খোলতাই হয়েছে।
বাদল হাসিমুখে বলল, হলুদ দিয়ে ডলাডলি করে গায়ের চামড়া তুলে ফেলেছে, রঙ তো খোলতাই হবেই।
বিয়ে হচ্ছে যার সঙ্গে সেই মেয়েটার নাম কী?
পুরানা ধরনের নাম–আঁখি।
মেয়েটা কেমন?
জানি না কেমন। কথা হয়নি তো!
খুব সুন্দর?
সবাই তো তা-ই বলছে।
তুই বলছিস না?
বাদলা লজ্জা-লজ্জা গলায় বলল, আমি বলছি।
তোর খুব ভালো একটা দিনে বিয়ে হচ্ছে। ২২ ডিসেম্বর। অদ্ভুত।
২২ ডিসেম্বর কি খুব শুভদিন হিমুদা?
বৎসরের সবচেয়ে লম্বা রাতটা হলো ২২ ডিসেম্বরের রাত। তোরা দুজন গল্প করার জন্যে অনেক সময় পাবি। এই কারণেই শুভ।
বাদল লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, আঁখির সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলব সেটাই বুঝতে পারছি না! বোকার মতো হয়তো কিছু বলব, পরে সে এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে।
করুক-না হাসাহাসি! তোর যা মনে আসে তুই বলবি। দুই-একটা কবিতা টিবিতা মুখস্থ করে যা।
কী কবিতা?
প্রেমের কবিতা।
প্রেমের তো অনেক কবিতা আছে, কোনটা মুখস্থ করব সেটা বলো।
কোনটা বলব, আমার তো দুই-তিন লাইনের বেশি কোনো কবিতা মনে থাকে না।
দুই-তিন লাইনই বলো। এক সেকেণ্ড দাঁড়াও–আমি কাগজ-কলম নিয়ে আসিলিখে ফেলি।
বাদল গম্ভীর ভঙ্গিতে বলপয়েন্ট আর কাগজ নিয়ে বসেছে। আমি কবিতা বলব, সে লিখে মুখস্থ করবে, বাসররাতে তার স্ত্রীকে শোনাবে। হাস্যকর একটা ব্যাপার, কিন্তু আমার কেন জানি হাস্যকর লাগছে না। বাদল বলল, কই, চুপ করে আছ কেন, বলো!