মোফাজ্জল ক্রুদ্ধ গলায় বলল, এতগুলো টাকা ফেরত পেয়েছে তার কোনো আলামত নাই। শালার দুনিয়া! লাথি মারি এমন দুনিয়ারে!
জহিরুল বলল, এক হাজার টাকা বখশিশ দিলেও তো একটা কথা ছিল কী বলেন ওস্তাদ। বখশিশ, না দেওয়াটা অধৰ্ম হয়েছে।
আমি বললাম, বখশিশ, পেলে কী করতেন?
জহিরুল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, কী আর করতাম-মাল খাইতাম। গত চাইরদিনে তিন আঙ্গুল পরিমাণ বাংলা খাইছি। তিন আঙ্গুল বাংলায় কী হয়। কন। তিন আঙ্গুল মাল ইচ্ছা করলে একটা মশাও খাইতে পারে। মাল খাওয়া তো দূরের কথা, আজ সারাদিনে ভাতও খাই নাই। আপনার পিছে পিছে বেফিকির হাঁটতেছি। আইজি যত হাঁটা হাঁটছি একটা ফকিরও অত হাঁটা হাঁটে না।
মোফাজ্জল বিরক্তমুখে বলল, চুপ কর। এত কথার দরকার কী। হিমু ভাইয়া বিদায় দেন, আমরা এখন যাই।
যাবেন কোথায়?
জানি না কই যাব।
আমার সঙ্গে চলেন, মাল খাওয়াব।
মোফাজল সরু চোখে তাকিয়ে রইল। সে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝামাঝি বাস করা খুবই কষ্টকর। মোফাজল আছে সেই কষ্টে।
কী, যাবেন?
সত্যি মাল খাওয়াবেন?
হুঁ।
কী খাওয়াবেন–বাংলা?
বাংলা ইংরেজি জানি না, তবে খাওয়াব।
চলেন যাই।
মোফাজ্জল অনিচ্ছার সঙ্গে হাঁটছে। তবে জহিরুলের চোখ চকচক করছে। কিছু মানুষ আছে যাদের জন্মই হয় শিষ্য হবার জন্যে। জহিরুল হলো সেই মানুষ এরা কখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি বাস করে না। এরা বাস করে বিশ্বাসের জগতে। যে যা বলে তা-ই বিশ্বাস করে।
জহিরুল বলল, হিমু ভাই, আপনেরে আমার পছন্দ হয়েছে।
কেন?
জানি না কেন।
মাল খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছি। এইজন্যে?
হইতে পারে। আপনের পকেটে সিগারেট আছে হিমু ভাই? একটা সিগারেট দেন। ধরাই।
আমার পাঞ্জাবির পকেটই নেই, আবার সিগারেট।
সত্যই আপনের পাঞ্জাবির পকেট নাই!
পাঞ্জাবির পকেট যে নেই তা আমি দেখলাম। মোফাজ্জ্বল বলল, টাকা পয়সা কই রাখেন? পায়জামার সিক্রেট পকেটে?
আমি হাসিমুখে বললাম, আমার কোনো সিক্রেট পকেট নেই। আমি সঙ্গে কখনো টাকা পয়সা রাখি না।
মোফাজল আবারও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি জগতে চলে গেল। আগের অবস্থা, আমার কথা বিশ্বাসও করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। সে দারুণ অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। তবে জহিরুল আমার কথা বিশ্বাস করেছে।
আমি তাদের নিয়ে বাদলদের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। এত রাতে কারোরই জেগে৷ থাকার কথা না, কিন্তু আমি জানি তারা সবাই জেগে আছে।
আমার মন বলছে–প্রবলভাবেই বলছে। কিছু-কিছু সময় আমার ইনটিউশন খুব কাজ করে।
আমি বড় ফুপার কাছে প্ৰতিজ্ঞা করেছি। বাদলের ত্ৰিসীমানায় থাকব না। নির্বিঘ্নে বাদলের বিয়ে হয়ে যাবে। এখন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে রাত আড়াইটায় দুই উটকো লোক নিয়ে উপস্থিত হলে ঘটনা কী ঘটবে কে জানো বড় ফুপা ব্যাপারটা খুব সহজভাবে নেবেন বলে মনে হয় না। তবে সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে তিনি ইতিমধ্যে বোতল নিয়ে ছাদে চলে গেছেন। কারণ আজ বৃহস্পতিবার। ফুপার মদ্যপান-দিবস। বোতল নিয়ে বসার জন্যে সুন্দর অজুহাতও আছে–ছেলের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। এই তো সেদিন ছোট্ট একটা ছেলে ছিল, শীতের দিনে বিছানায় পিপি করে কাদো-কাঁদো গলায় বলত, মা, কে যেন পানি ফেলে দিয়েছে। সে আজ বিয়ে করে বউ আনতে যাচ্ছে। এ তো শুধু আনন্দের ঘটনা না, মহা আনন্দের ঘটনা। সেই আনন্দটাকে একটু বাড়িয়ে দেবার জন্যে সামান্য কয়েক ফোটা দিয়ে গলা ভেজানো।
বড় ফুপা দ্রবীভূত অবস্থায় থাকলে কোনো সমস্যা হবে না। মোফাজ্জল এবং জহিরুল এরাও ভাগ পাবে। মদ্যপায়ীরা মদের ব্যাপারে খুব দরাজদিল হয়। দশটা টাকা ধার চাইলে এরা দেবে না, কিন্তু তিন হাজার টাকা দামের বোতলের পুরোটা আনন্দের সঙ্গে অন্যকে খাইয়ে দেবে।
যা ভেবেছি তা-ই।
বাড়ির সব বাতি জ্বলছে। হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আনন্দ উছলে পড়ছে। খোলা জানালায় সেই আনন্দ উছলে বের হয়ে আসছে। হাসির শব্দ হৈচৈয়ের শব্দ, ছোট বাচ্চাদের কান্নাকাটির শব্দ। আমি কলিংবেলে হাত রাখার আগেই দরজা খুলে গেল। বড় ফুপু দরজা খুললেন। তার পরনে লাল বেনারসি, ইদানীংকার ফ্যাশানের মতো কপালে সিঁদুর। বড় ফুপুহাসিমুখে বললেন, কী রে হিমু, তুই এত দেরি করলি? তোর জন্যে বাদল এখনও না খেয়ে বসে আছে।
আমি হাসলাম। দেরি করার অপরাধে খুবই লজ্জিত। এই টাইপের হাসি। ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছি না। বাদলের বিয়ে হয়ে গেল নাকি? বিয়ে বোধহয় না। মনে হচ্ছে গায়ে-হলুদ। ফুপুর কপালে হলুদ লেগে আছে।
আশ্চৰ্য, একটা দিন সময়মতো আসবি না, আমি কি রোজই ছেলের বিয়ে দেব? গায়ে-হলুদের এমন জমজমাট অনুষ্ঠান–আর তুই নেই। বাদল অস্থির হয়ে আছে তোর জন্যে। ঝিম মেরে আছিস, ব্যাপার কী? কথা বলছিস না কেন?
তোমাকে আসলে চিনতেই পারিনি। এইজন্যেই চুপ করে ছিলাম। মাই গড, তোমাকে তো দারুণ লাগিছে! কে বলবে তোমার ছেলের বিয়ে! মনে হচ্ছে তোমারই বিয়ে হয়নি।
পাম-দেয়া কথা বলবি না তো। দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়, ভেতরে আয়।
আমি গলা নিচু করে বললাম, ফুপু, আমার দুজন গেষ্ট আছে, ওদের নিয়ে আসব?
ওরা কোথায়?
রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি। বাড়িতে ঢুকতে দাও কি না-দাও জানি না তো!
তোর কি বুদ্ধিশুদ্ধি দিনদিন চলে যাচ্ছে নাকি? আমার ছেলের বিয়েতে তুই বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবি না তো কি পাড়ার লোকের বিয়েতে আসবি আর তোর আক্কেলটাই-বা কীরকম রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখলি কোন হিসাবে–ওরা নাজানি কী