চা খাওয়াও। পয়সা কিন্তু দিতে পারব না।
কাওছার হতভম্ব গলায় বলল, পয়সার কথা তুললেন এর থাইক্যা জুতা দিয়া দুই গালে দুইটা বাড়ি দিতেন।
আমি ওস্তাদ ও শাগরেদকে দেখিয়ে বললাম, আমার দুজন গেস্ট আছে। এদেরও চা দাও।
কাওছার মিয়া তার সবকটা দাঁত বের করে বলল, আর কী খাইবেন কন।
আর কিছু লাগবে না।
ছিরগেট? ছিরগেট আইন্যা দেই?
দাও।
কাওছার মিয়া দোকানের ছেলেটাকে পান-সিগারেট আনতে পাঠাল। তিনশালা বেনসন। তিনটা মিষ্টি পান, জর্দা আলিদা।
ওস্তাদ ও শাগরেদ পুরোপুরি থমকে গেল। তবে চলে গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। এখন তাদের চোখ আমার হাতে-ধরা মানিব্যাগের দিকে। আমি চায়ের কাপ তাদের দিকে বাড়িয়ে বললাম, ভাই, চা খান অনেকক্ষণ আমার পিছনে পিছনে ঘুরছেন, নিশ্চয়ই টায়ার্ড।
ওস্তাদ বললেন, চা খাব না।
শাগরেদও সঙ্গে সঙ্গে বলল, চা খাব না।
কাওছার মিয়া চোখ কপালে তুলে বলল, হিমু ভাইয়া চা সাধতেছে, আর চা খাইবেন। না! কন কী আফনে? আচায্য ঘটনা! ধরেন, চা নেন।
ওস্তাদ ও শাগরেদ। দুজনেই শুকনোমুখে চায়ের কাপ তুলল। কাওছার মিয়া তার বেনসন সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আফনাদের পরিচয়?
ওস্তাদ ও শাগরেদ। মুখ-চাওয়াচাউয়ি করছে। আমি তাদের পরিচয়দান থেকে রক্ষা করলাম। কাওছারকে বললাম, শোনো কাওছার মিয়া। আমি একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছি। মানিব্যাগে টাকার পরিমাণ ভালোই, ত্রিশ-পয়ত্ৰিশ হাজার তো বটেই। টাকাটা দিয়ে কী করা যায় বলো তো!
কাওছারের মুখ হা হয়ে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, খাইছে রে! আমি ওস্তাদ ও শাগরেদের দিকে তাকালাম। তারা মনে হচ্ছে দুঃখে কেঁদে ফেলবে। আমি তাদের দিকে মানিব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, ভালো করে দেখুন তো কোনো ঠিকানা-লেখা কাগজ আছে কি না। আর টাকাটাও গুনে দেখুন। ঠিকানা পাওয়া গেলে চলুন দিয়ে আসি। এতগুলি টাকা একা একা নিয়ে যাওয়া ঠিক না। আমার নাম হিমু, আপনাদের পরিচয়টা কী?
ওস্তাদ বিড়বিড় করে বললেন, আমার নাম মোফাজল। আর এ জহিরুল।
ঠিকানা পাওয়া গেছে?
টুকরা কাগজ অনেক আছে–কোনটা ঠিকানা কে জানে!
ঐ দেখে দেখে বের করে ফেলব। আপনাদের কাজ না থাকলে চলুন আমার সঙ্গে। কাজ আছে?
না।
তা হলে মানিব্যাগটা আপনার পকেটে রাখুন। আমার পাঞ্জাবির পকেট নেই। আপনাদের পাওয়ায় আমার সুবিধাই হলো।
মোফাজ্জল আমার দিকে তাকিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল। আমি তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে তার চেয়েও বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলাম। বিচিত্ৰ হাসি, বিচিত্ৰ হাসিতে কাটাকাটি।
কাওছার উৎসাহের সঙ্গে বলল, টেকাটা আগে গনেন। কত টেকা?
জহিরুল টাকা গুনছে। বেশ আগ্রহের সঙ্গেই গুনছে। কাওছার বলল, আরেক দফা চা দিমু হিমু ভাই?
জহিরুল টাকা গোনায় ব্যস্ত। সে কিছু বলল না। মোফাজ্জল উদাস গলায় বলল, দাও।
আমরা রাত দুটার দিকে ঝিকাতলার এক টিনের বাড়ির দরজায় প্রবল উৎসাহে কড়া নাড়তে লাগলাম। আমরা কড়া নাড়ছি বলা ঠিক হচ্ছে না। আমি কড়া নাড়ছি, বাকি দুজন চিমশামুখে দাঁড়িয়ে আছে। এরা আমাকে ছেড়ে চলেও যাচ্ছে না, আবার সঙ্গে থাকার কোনো কারণও বোধহয় খুঁজে পাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ কড়া নাড়ার পর এক ভদ্রলোক বের হয়ে এলেন। পঞ্চাশ-ষাট হবে বয়স। মাথার চুল ধবধবে শাদা। ভদ্রলোক মনে হয় অসুস্থ। কেমন উদভ্ৰান্ত দৃষ্টি। আমাদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছেন, কিন্তু চোখের পলক ফেলছেন না। আমি বললাম, আপনার কি কোনো মানিব্যাগ হারিয়েছে?
ভদ্রলোক কিছু বললেন না, শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, মানিব্যাগে অনেকগুলি টাকা ছিল। আমার ধারণা আপনারই মানিব্যাগ।
ভদ্রলোক বাড়ির ভিতরের দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত গলায় ডাকলেন, মীরা মীরা!
মীরা বের হয়ে এল। আমি হিমু না হয়ে অন্য কেউ হলে তৎক্ষণাৎ মেয়েটির প্রেমে পড়ে যেতম কী মিষ্টি যে তার মুখ্য মনে হচ্ছে এইমাত্র সে গোসল করে চোখে কাজল দিয়ে এসেছে। সব রূপবতী মেয়ের চোখ বিষণ্ণ হয়। এই মেয়ের চোখও বিষণ্ণ।
ভদ্রলোক বললেন, মা, তোকে আমি বলেছিলাম না। টাকাটা পাওয়া যাবে? এখন বিশ্বাস হলো?
মীরা তাকাল আমার দিকে। আমি বললাম, ভালো আছেন?
মীরা ভুরু কুঁচকে ফেলল। আমি মোফাজলের দিকে তাকিয়ে বললাম, মানিব্যাগ দিয়ে দিন। মোফাজ্জল কঠিন গলায় বলল, মানিব্যাগ যে উনাদের তার প্রমাণ কী?
আমি উদাস গলায় বললাম, প্রমাণ লাগবে না। মীরা,তুমি টাকাটা গুনে নাও।
মীরার কোঁচকানো ভুরু আরও কুঁচকে গেল। আমার মতো অভাজন তাকে তুমি করে বলবে তা সে মেনে নিতে পারছে না। মানিব্যাগ-সংক্রান্ত জটিলতা না থাকলে সে নিশ্চয়ই শুকনো গলায় বলত, আমাকে তুমি করে না বললে খুশি হবো।
মোফাজ্জল অপ্ৰসন্ন মুখে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। এরকম অগ্ৰীতিকর কাজ সে মনে হয় তার জীবনে আর করেনি। মোফাজলের চেয়েও বেশি মন-খারাপ হয়েছে তার টেণ্ডল জহিরুলের। জহিরুল মনে হয় মনের দুঃখে কেঁদেই ফেলবে।
ভদ্রলোক আবারও মীরাকে বললেন, বলেছিলাম না। সব টাকা ফেরত পাব, বিশ্বাস হলো? তুই তো কেঁদে অস্থির হলি। নে, টাকাটা গুনে দ্যাখ। সাঁইত্রিশ হাজার নয়শো একুশ টাকা আছে।
মীরা বলল, গুনতে হবে না।
ভদ্রলোক বললেন, আহা, গুনে দ্যাখ-না!
আমি বললাম, মীরা, তুমি সাবধানে গুনতে থাকো। আমরা চললাম।
শুরুতেই তুমি বলয় মেয়েটা রেগে গেছে তাকে আবারও তুমি বলে আরও রাগিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলাম।