আমি বললাম, কেউ যদি প্রবলভাবে বিশ্বাস করে আমার এই ক্ষমতা আছে তাহলে প্রকৃতি তাকে সেই ক্ষমতা দিয়ে দেয়। কেউ যদি মনে করে আমার মিরাকল ঘটানোর ক্ষমতা আছে, তাহলে প্রকৃতি এই ক্ষমতা তাকে দিয়ে দেয়।
মিরাকল কিন্তু ঘটে। আমার জীবনে কয়েকবার ঘটেছে। শুনতে চাও?
চাই।
চা খেতে খেতে শুনবে? আমার ফ্রাস্কে চা আছে।
চা খাওয়া যেতে পারে।
তৃষ্ণা চা বানাতে বানাতে বলল, দুটা মিরাকল আমার জীবনে ঘটেছে। আজকেরটা হবে তৃতীয়।
আজকের কোন মিরাকল?
তৃষ্ণা জবাব দেওয়ার আগেই লঞ্চের সামনের দিক থেকে হৈচৈ, চেচামেচি শুরু হলো। আমরা দুজনই ছুটে বের হলাম। তৃষ্ণর হাতে ভিডিও ক্যামেরা। তেমন কোনো দৃশ্য হলে ভিডিও করে ফেলবে।
ভিডিও করার মতোই দৃশ্য। কাঠের তক্তা ধরে দুজন ভাসছে। একজন পীর কুতুবি, অন্যজন ওসি সাহেব। বাতাসের ধাক্কায় তারা লঞ্চের দিকে ফিরে আসছে।
তৃষ্ণা বলল, ওরা দুজন যে কাঠের টুকরা ধরে ভেসে ভেসে আসছে এটাকে কি তুমি মিরাকল বলবে না?
আমার জবাব দেওয়ার আগেই পীর কুতুবির ক্লান্ত গলা শোনা গেল, জ্বিন কফিলের বদমাইশি। আমি সাঁতরায়া পাড়ে উঠতে পারতাম। বদ জ্বিন আমারে এক কাঠের টুকরা ধরায়া দিল। তাকায়া দেখি কাঠের টুকরার অন্যদিকে ওসি সাহেব।
তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই দুজনকে লঞ্চে তোলা হলো। ওসি সাহেব পানি খাব বলেই অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। পীর কুতুবি স্বাভাবিক গলায় বললেন, একটা গামছা দিয়ে কেউ আমার মাথাটা মুছায়ে দেন। আর এক কাপ হট টি দেন। দেশি বেনসন সিগারেট থাকলে ধরায়ে আমার ঠোঁটে দেন।
পীর কুতুবির প্রতিটি নির্দেশ পালিত হলো।
সবাই এই দুজনকে ঘিরে আছে। লঞ্চ ড়ুবে যাওয়ার চিন্তা এখন মাথায় নেই। মানুষ টেনশন বেশিক্ষণ নিতে পারে না। পীর কুতুবি এবং ওসি সাহেব কিছুক্ষণের জন্যে হলেও সবার টেনশন দূর করেছেন।
পীর কুতুবি বললেন, ওসি সাহেবের শার্টের পকেটে হাতকড়ার চাবি আছে। চাবি দিয়ে হাতকড়া খুলেন। কতক্ষণ আর বান্ধা থাকব? হাত তুলে মোনাজাত করতে হবে। হাত বান্ধা অবস্থায় মোনাজাত কবুল হয় না।
কুতুবির হাতকড়া খুলে দেওয়া হলো। তিনি বললেন, হাজেরান ভাই ও বোনেরা! এখন জিকিরা হবে। জিকির ছাড়া আমাদের উদ্ধার নাই। সবাই বামদিকে বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলবেন, আল্লাহ। হাত নামিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলবেন, ইহঁ। বড় পীর সাহেব আব্দুল কাদের জিলানি সাহেব এইভাবে জিকির করতেন।
জিকির শুরু হয়ে গেছে। আমি তৃষ্ণকে নিয়ে চলে আসব তখন দেখি ডিরেক্টর শাকুর ভাই চোখের ইশারায় আমাকে ডাকছেন। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। শাকুর ভাই বললেন, আপনার সঙ্গের মেয়েটা কে?
ওর নাম তৃষ্ণা।
চেহারা ছবি, ফিগার তো মারাত্মক।
কথা সত্য।
তাকে জিজ্ঞেস করে দেখেন তো ভিডিও নাটকে অভিনয় করবে। কি না। রাজি হলে পারুলির ক্যারেক্টর পেয়ে যাবে। নাটক চ্যানেল আইতে ইনশাল্লাহ প্রচার হবে। চ্যানেল আইয়ের একজন ক্যামেরা ক্রু আমার আপন মামাতো ভাই। তার মাধ্যমেই যোগাযোগ হবে।
আমি জিজ্ঞেস করে দেখব।
আপনার কি মনে হয়। রাজি হয়ে যাবে?
আমি বললাম, মহা বিপদে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। রাজি হয়ে যেতে পারে।
ভাই, একটু চেষ্টা চালান।
তৃষ্ণার কোলে ল্যাপটপ
তৃষ্ণার কোলে ল্যাপটপ। ভিডিও ক্যামেরায় যেসব ছবি তোলা হয়েছে তা ঢুকানো হচ্ছে ল্যাপটপে। সেখানেই এডিটিং হবে। হল্যান্ডের এক ভিডিও ফিল্ম ফেষ্টিবলে পাঠানো হবে। ফেষ্টিবলের নাম R Byte. সেখানে শুধু সত্যি ঘটনা নিয়ে বানানো ছবির প্রদর্শনী হয়। তৃষ্ণর ধারণা প্রথম পুরস্কার সে পেয়ে যাবে। পুরস্কারের অর্থমূল্য দশ হাজার ইউরো।
আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে মহাবিপদ নিয়ে কিছু ইন্টারভ্যু নিয়ে আসা। ফাঁকে ফাঁকে এইসব ইন্টারভ্যু যাবে। ভিডিও ক্যামেরা কীভাবে চালাতে হয়, টেলিলেন্স কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সব শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ইন্টারভ্যু নেওয়া শুরু করেছি। প্রথমেই সারেঙের অ্যাসিসটেন্ট হাবলু।
হাবলু
হাবলু, ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে কথা বলো।
জি আচ্ছা।
তোমার কি ধারণা লঞ্চ ড়ুবে যাবে?
ড়ুবিতে পারে, সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। উনার ইচ্ছা হলে ড়ুববে। উনার ইচ্ছায় ভাইস থাকবে। আবার উনি ইচ্ছা করলে লঞ্চ আসমানে উড়াল দিবে।
আসমানে উড়াল দিবে?
অবশ্যই। স্যার, উড়ালপঙ্খি গান শুনছেন? ও আমার উড়ালপঞ্জিখরে ফিল্মের গান?
না।
শুনবেন? পুরাটা জানি।
এই সময় উড়ালপঞ্জিখ শোনাবে?
আপনে বললে শুনাব। ভিডিওতে একটা স্মৃতি থাকল।
পুরো গান শোনাতে হবে না। চার লাইন শোনালেই হবে।
হাবলু গানের চার লাইন গাইল! মুগ্ধ হয়ে শুনবার মতোই গান।
সারেং খালেক
বিস্ময়ের কথা সারেঙের জ্বর নেমে গেছে। এখন তিনি বিছানায় আধাশোয়া। তার হাতে সিগারেট। শরীর যে এখন সুস্থ তার বড় প্রমাণ হাতের সিগারেট। অসুস্থ শরীর নিকোটিন নিতে পারে না।
কেমন আছেন?
আমি তো ভালোই আছি। লিঞ্চ যায় যায়।
এখন আমরা আছি কোথায় বলতে পারেন?
কিছুই বলতে পারি না।
কম্পাস নাই?
লঞ্চ যাচ্ছে দক্ষিণে। এটা বলার জন্য কম্পাস লাগে না। ঘুরপাক খেতে খেতে সাগরে গিয়ে পড়বে।
ডুববে না।
স্টিল বডি ড়ুববে কেন?
টাইটানিকেরও স্টিল বডি ছিল। টাইটানিক ড়ুবে গেছে।
টাইটানিক কী লঞ্চ আমি জানি না, তয় এই লঞ্চ ড়ুববে না। লঞ্চের একতলা মালামাল ভর্তি। বাতাসের ধাক্কায় লঞ্চ কান্ত হয়ে পড়বে না। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান। ঘুম থেকে উঠে দেখবেন সব ঠিকঠাক। আমি আঠার বছরের সারেং। পানির হিসাব, ঝড়ের হিসাব, লঞ্চের হিসাব আমার জানা।