জানি না।
তৃষ্ণ পীর সাহেবের দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, আচ্ছা শুনুন। আপনি কি একটা বিয়ে পড়াতে পারবেন? আমরা দুজন বিয়ে করব, কাজি পাচ্ছি না।
পীর সাহেব বললেন, বিয়ে পড়াতে পারব। কিন্তু এখন পারব না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিয়ে পড়ানো যায় না। এই মোসালা অনেকেই জানে না। ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, ঝড়-তুফান-এসবের মধ্যে বিয়ে হবে না।
কেন?
এগুলা হচ্ছে রোজ কেয়ামতের ছোট ছোট নমুনা। রোজ কেয়ামতে যেমন বিয়ে হবে না, এখনো হবে না। ঝড়তুফান কামুক, বিয়ে পড়ায়ে দিব! দেনমোহর ঠিকঠাক করুন। আপনার হাতে ক্যামেরা না?
জি।
এই রকম একটা ক্যামেরা আমার স্ত্রীর ছিল। শৌখিনদার মেয়ে ছিল। খামাখা ছবি তুলত। জ্বিন কফিল যখন তারে খুন করে তখনো তার হাতে ক্যামেরা। আমার স্ত্রী ছবি তোলার মধ্যে ছিল। জ্বিন কফিল তার ঘরে ঢুকেছে। এইটাও সে ক্যামেরায় ধরেছে। আজিব মেয়েছেলে।
তৃষ্ণা কিছু বুঝতে না পেরে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, জ্বিন কফিলের বিষয়টা তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব।
পীর সাহেব বললেন, এই দুনিয়ায় কিসিম দুইটা। জ্বিন এবং ইনসান। বুঝায়। বলার কিছু নাই।
আমি বললাম, আপনার স্ত্রীর ক্যামেরায় কি জিনের ছবি উঠেছে?
উঁহু, আমার ছবি উঠেছে। জ্বিন আমার রূপ ধরে তার ঘরে ঢুকেছে। জিনের এই ক্ষমতা আছে। আপনারা দুজন এখন যান, এশার নামাজের সময় পার হয়ে গেছে। এখন নামাজ আদায় করব। সামান্য দেরি হয়েছে। ওসি সাহেবের কানে ফায়ারিং হবে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। ফায়ারিং এখনো হয় নাই। মন বলতেছে নামাজে দাঁড়াব আর ফায়ারিংটা হবে। জ্বিন কফিলের বদমাইসি। একটা মজার জিনিস দেখতে চাই, সে আমারে দেখতে দিবে না।
তৃষ্ণা বলল, ফায়ারিং কী? ইনার কথাবার্তা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তৃষ্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাতাসের প্রবল ধাক্কায় লঞ্চ ডানদিকে কাত হয়ে গেল। পীর কুতুব বিকট ধ্বনি দিলেন-আল্লাহু আকবর!
ঝপাং শব্দ হলো, পীর কুতুবি ওসি সাহেবকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পুলিশদের মধ্যে যে ব্যাপক চাঞ্চল্য আশা করেছিলাম, তা দেখা গেল না। একজন শুধু পানিতে ছয় ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আলোও নিভে গেল। টর্চ বৃষ্টির পানিতে ভিজেছে। কিছুক্ষণ আলো দিয়ে সে নিভে যাবে এইটাই নিয়তি।
ঘটনার আকস্মিকতায় তৃষ্ণা হতভম্ব। সে বিড়বিড় করে বলল, এরা তো ড়ুবে যাবে।
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, পীর কুতুবি ড়ুববেন না। তিনি ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মোহনা পার হবেন। ওসি সাহেব ড়ুবে যাবেন। আমার ধারণা এর মধ্যে ড়ুবেও গেছেন।
তৃষ্ণা বিড়বিড় করে বলল, কী সর্বনাশ!
আমি বললাম, সর্বনাশ তো বটেই। তোমার কাজিও কিন্তু ভেসে চলে যাচ্ছে। কাজি যার গৈ। কাজি যার গৈ।
যারা গৈ যারা গৈ করছি কেন?
যারা গৈ হচ্ছে ভেসে চলে যাচ্ছে।
তাতে তোমার এত আনন্দ কেন? মুসলমানদের বিয়েতে কাজিও লাগে না। আমি বইতে পড়েছি কবুল কবুল বললেই হবে।
তৃষ্ণর কথা শেষ হওয়ার আগেই গুলির শব্দ হলো।
পুলিশ চারজন লাফ দিয়ে উঠল। তাদের মুখ ফ্যাকাসে। গুলি কী বস্তু পুলিশ সবচেয়ে ভালো জানে। গুলির শব্দে আতঙ্কে তারাই সবার আগে অস্থির হয়।
তৃষ্ণা বলল, গুলি কোথায় হয়েছে?
পুলিশের একজন বলল, আমার বন্দুক থেকে মিস ফায়ার হয়ে গেছে ম্যাডাম।
তৃষ্ণা বলল, আপনা-আপনি গুলি হয়ে গেছে মানে কী? মানুষ মারা যেতে পারত।
যার বন্দুক থেকে গুলি হয়েছে সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, আল্লাহপাকের হুকুম ছাড়া কারও মৃত্যু হবে না। আপা। চিন্তার কিছু নাই।
আমরা তাকিয়ে আছি কুতুবির দিকে। কুতুবি কিছুক্ষণের মধ্যেই লঞ্চের আড়ালে চলে গেলেন।
পুলিশদের একজন হাঁপ ছাড়ার মতো করে বলল, সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা!
লঞ্চের নিয়ন্ত্রণ এখন আতর মিয়ার হাতে
লঞ্চের নিয়ন্ত্রণ এখন আতর মিয়ার হাতে। তার ক্ষমতার উৎস ভীত এবং ক্ষুধার্ত যাত্রী। বিপদে মানুষের ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়, চিন্তাশক্তি কমতে থাকে। লঞ্চ ডানদিকে কাত হয়েছে, যে-কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটবে। সেদিকে নজর না দিয়ে যাত্রীরা খেতে বসে গেছে। আজ রাতের খাওয়া ফ্রি। আতর মিয়ার সে রকমই নির্দেশ! খাওয়া নিয়ে ভালো হৈচৈ হচ্ছে। নতুন করে ডিম ভাজা হচ্ছে। অনেকেই ডিম ভাজা খাবে। কাঁচামরিচে ঝাল নাই কেন—এই নিয়েও তৰ্ক-বিতর্ক হচ্ছে। বেঞ্চে সবার জায়গা হয় নি। অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতে প্লেট নিয়ে খাচ্ছে! মুরগির গিলা-কলিজার একটা লুকানো হাঁড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই নিয়ে উল্লাস হচ্ছে। যাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, তারাও এক হাতা করে গিলা-কলিজা নিচ্ছে।
এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ফাঁসির আসামিরাও শেষ খাবার আগ্রহ নিয়ে খায়। কোন আইটেম কীভাবে রাঁধতে হবে তাও বলে দেয়। সরিষার তেল দিয়ে ইলিশ মাছ অল্প আঁচে কড়া করে ভাজতে হবে। মাছ থেকে যে তেল উঠবে সেই তেল এবং সরিষার তেল আলাদা করে বাটিতে দিতে হবে। ইলিশ মাছের সঙ্গে রসুনের কোয়া থাকতে হবে।
ক্ষমতাচুত রুস্তম ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তার দৃষ্টি আতর মিয়ার দিকে। আতর মিয়া তার লম্বা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে আবার পকেটে রেখে দিয়েছে। রুস্তম বুঝতে পারছে না পিস্তলটা আসল নাকি খেলনা। আজকাল খেলনা পিস্তলগুলি অবিকল আসলের মতো বানাচ্ছে। হাতে না নেওয়া পৰ্যন্ত আসল নকল বোঝার উপায় নেই। রুস্তমের কাছে মনে হচ্ছে নকল। নকল না। হলে পকেটে লুকিয়ে রাখত না। সারাক্ষণ হাতে রাখত।