আমার হাসিতে ভদ্রলোক বিভ্রান্ত হলেন। তৃষ্ণাও খানিকটা বিভ্রান্ত হলো। মানুষকে বিভ্রান্ত করা মজার ব্যাপার। প্রকৃতি এই বিষয়টা সবসময় করে। মানুষকে রাখে বিভ্রান্তির ভেতর।
রশীদ টেলিফোন ধরেছেন। নিচুগলায় কথা বলছেন। নিচুগলার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি। তৃষ্ণাও পাচ্ছে, সে চকচকে চোখে বিপুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রশীদ বললেন, আতর মিয়া বলে কাউকে চেনো? একটা চোখ বড়। একটা ছোট। থুতনিতে কাটা দাগ।
জবাবে ওপাশ থেকে কী বলা হলো তা আমরা শুনলাম না, তবে রশীদ খানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, বলো কী! না না, আমি কোনো ঝামেলায় যাব না। ঝামেলায় যাওয়ার আমার প্রয়োজন কী? আচ্ছা রাখি।
রশীদ খান হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আবহাওয়া যথেষ্ট শীতল। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটা, তারপরেও রশীদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আমি বললাম, আপনার কেবিনে যে মেয়েটা আছে সে কে?
আমার স্ত্রী।
তাহলে যান, কেবিনে ফিরে যান। ভাবির সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করুন। সময় বেশি নাই, লঞ্চ ড়ুবে যাবে। একসঙ্গে মৃত্যুর প্রস্তুতি নেওয়ার একটা ব্যাপারও আছে।
রশীদ নড়লেন না। যেখানে ছিলেন সেখানে বসে রইলেন। তার পকেটের মোরগ আবার ডেকে উঠল, কোঁকর কোঁ।
আমি বললাম, আপনার আসল স্ত্রী টেলিফোন করেছেন। টেলিফোন ধরুন। মহা বিপদের বিষয়টা তাকে জানান।
তৃষ্ণ বিক্ষিত গলায় বলল, আপনি কে টেলিফোন করেছেন তা ধরতে পারেন?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, মাঝে মাঝে পারি। সবসময় না।
যে টেলিফোন করেছে তার নামও কি বলতে পারেন?
বেশিরভাগ সময় পারি না, তবে এখন বলতে পারব। যে মহিলা টেলিফোন করেছেন তার নাম ময়না।
রশীদ খান ভয়াবহ চমক খেলেন। একবার বড় ধরনের চমক খেলে পরপর আরও দুবার খেতে হয়। এই জন্যেই প্রবচন দানে দানে তিনদান। রশীদ খান দ্বিতীয় চমক খেলেন। আতর আবার ফিরে এসেছে। তার সঙ্গে এক তরুণী। তরুণী ভয়ে আতঙ্কে থারথার করে কাঁপছে।
জোগাড় করেছি। লঞ্চের মালিকের পুলা ডাইল খায়া বমি কইরা বমির উপর পইড়া ছিল। আমি বললাম, পিস্তল কই রাখছেন, বাইর করেন। দেরি করবেন। না। দেরি করলে পেটে পাড়া দিয়া বাকি বমি বাইর করব। বলেই পেটে পাড়া দিলাম। সাথে সাথে জিনিস চলে আসল আমার হাতে। যন্ত্র ভালো, মেড ইন ইতালি।
আমি বললাম, সঙ্গের মেয়েটা কে?
আতর হাই তুলতে তুলতে বলল, এর নাম সীমা। প্রফেসর সাহেবের ছাত্রী। স্যারের সঙ্গে ভ্রমণের জন্য এসেছিলেন। সুযোগ বুঝে লঞ্চের মালিকের ছেলের কেবিনে উনাকে ঢুকায়ে দিল। যে ভ্রমণের জন্যে উনি এসেছিলেন, সেই ভ্ৰমণই উনার হয়েছে। স্যারুের বদলে লঞ্চ মালিকের ছেলে কন্দেরের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন।
সীমা ফুঁপিয়ে উঠল। আতর বলল, সিস্টার! আপনার সারা শরীর বমিতে মাখামাখি। আগে টয়লেটে যান। সাবান দিয়ে ভালোমতো সিনান করে স্যারের কাছে যান। বিদ্যা শিক্ষা নেন।
তৃষ্ণা বিস্মিত দৃষ্টিতে সীমার দিকে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা বলল, আপনার কাছে একসাট্রা ড্রেস না থাকলে আমার কাছ থেকে নিতে পারেন। আপনার গা থেকে বমির বিকট গন্ধ আসছে।
আমি বললাম, মেয়েটাকে কাপড় দিয়ে চল আমরা লঞ্চটা ঘুরে দেখি। এখানকার পরিস্থিতি ঠান্ড হোক।
তৃষ্ণা বলল, আপনি না বললেও আপনি যেখানে যাবেন আমি আপনার পেছনে পেছনে যাব। আজ রাতের জন্য আমি হব মেরীর little lamb. লঞ্চ দুলছে। ভীতিকর দুলুনি না, আরামদায়ক দুলুনি। বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। আমি তৃষ্ণকে নিয়ে পরিদর্শনে বের হয়েছি। তৃষ্ণার হাতে খেলনার মতো দেখতে ভিডিও ক্যামেরা। এই মেয়েটির ভয়ডর এখন যে চলে গেছে তা বোঝা যাচ্ছে। মহা বিপর্যয়ের ছবি তুলতে পারার আনন্দেই এখন সে আনন্দিত।
তৃষ্ণা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, হিমু! আমরা মহা বিপদে আছি, কিন্তু আমার ভালো লাগছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে। আমি স্পিলবার্গের কোনো ছবিতে অভিনয় করছি। ছবির শেষ দৃশ্যে লঞ্চ ড়ুবে যাবে, আমরা দুজন একটা কাঠের মৃত্যুক্ত ধরে ভেসে থািকব।
আমি বললাম, অভিনেত্রী, মন দিয়ে শুনুন। হাঁটার সময় রেলিং ধরে হাঁটুন। আপনার ক্যামেরা কিন্তু ভিজে যাচ্ছে।
এটা ওয়াটারপ্রািফ ক্যামেরা, ভিজলেও কিছু হবে না। স্কুবা ডাইভিং-এ এই ক্যামেরা ব্যবহার হয়।
তাহলে তো কথাই নেই, লঞ্চ যখন ড়ুবে যাবে আপনিও ড়ুববেন এবং তখনো ছবি তুলবেন।
লঞ্চ ড়ুববে না। আমার মন বলছে ড়ুববে না। আমি আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই লিখব। রিডার্স ডাইজেক্ট-এ একটা আর্টিকেলও লিখব। আপনি রিডার্স ভাইজেক্ট পড়েন?
না।
আমার একটা লেখা রিডার্স ডাইজেদ্ষ্টে ছাপা হয়েছিল। Life নামে ওদের একটা সেকশন আছে। সেখানে মজার মজার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঘটনা ছাপা হয়। আমারটাও ছাপা হয়েছিল। একশ ডলার পেয়েছিলাম। শুধু আমার নাম ভুল ছেপেছে। লিখেছে। Tritima, Bangladesh. রিডার্স ডাইজেস্ট্রটা আমার সুটকেসে আছে। আমি আপনাকে পড়তে দেব। পড়বেন তো?
পড়ব।
আপনার প্রবল ESP. ক্ষমতা। তাই না?
জানি না।
আমারও ESP ক্ষমতা আছে। যারা আমার ঘনিষ্ঠ, তারা আমার এই ক্ষমতার বিষয়ে জানে।
জানারই কথা।
আপনি আমার একটা কথাও বিশ্বাস করছেন না। আপনার উপর আমার রাগ লাগছে। এখানে একটু দাঁড়ান। আপনাকে জরুরি কিছু কথা বলব।
এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে আপনি ভিজে যাবেন। বৃষ্টির ছাঁট আসছে।