মাইক্রোবাসের দরজা খুলল। ঐ লোক বের হলো। কেড়ে দৌড় দিল। পেছনে পেছনে কুকুর দুটা ছুটে গেল। সেও ধরাশায়ী হলো।
মানুষের বিপদ দেখে পুলিশ এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা ঘটল না। পুলিশ দুজনও উল্টোদিকে দৌড় দিল।
বস্তার ভেতর থেকে আতর মিয়াকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হলো। আতর মিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হিমু ভাই। আপনি মানুষ না অন্য কিছু! এখন থেকে আমি আপনার কেনা গোলাম।
কুকুর দুটিাকে ইলিশ মাছ উপহার দিয়ে আমি কেনা গোলাম নিয়ে হাঁটা দিলাম। মধ্যযুগে মুনিবরা কেনা গোলাম নিয়ে হাঁটত। যুগের অভ্যাস বদলায় না। এই যুগেও আমি কেনা গোলাম নিয়ে হাঁটছি।
তৃষ্ণার কাছে ফিরে এসেছি
তৃষ্ণার কাছে ফিরে এসেছি। সে ভোল পাল্টেছে। শাড়ির বদলে জিন্সের প্যান্ট, গাঢ় হলুদ রঙের ফুলহাতা জামা। গলায় হলুদ পাথরের মালা। আগেরবার চোখের পাতা নীল ছিল। এখন হলুদ। এর মধ্যে চোখে রঙ করাও শেষ।
মেয়েরা ভয়ঙ্কর দুর্যোগেও সাজ ঠিক রাখতে ভোলে না।
আতর মিয়া আমার সঙ্গে নেই। সে নাকি পাঁচ মিনিট পরে আসবে। রুস্তমকে টাইট দিতে পাঁচ মিনিট লাগবে। পুরো টাইট দিবে না। স্কুর দুই প্যাঁচের টাইট। ঘাঁচ ঘাচং।
আমাকে দেখে তৃষ্ণা কেবিন থেকে বের হয়ে এসে কোমল গলায় বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
জীবনানন্দ দাশ। আমাদের নানানভাবে প্রভাবিত করেছেন। এতদিন কোথায় ছিলেন?-বাক্যটি নানানভাবে ব্যবহৃত হয়। প্ৰতিবারই শুনতে ভালো লাগে।
আমি বললাম, ভয় লাগছে?
তৃষ্ণা বলল, ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। আপনাকে দেখে ভয় কমেছে। সত্যি কমেছে। আপনি আর যেতে পারবেন না। এখানে থাকতে হবে।
পাশের কেবিনের মেয়ের কান্না থেমেছে?
হ্যাঁ, তবে মাঝে মাঝে ফোঁপানোর শব্দ হচ্ছে। এবং যথারীতি মোরগ ডাকছে।
আমি বললাম, মহা বিপদের সময় পশুপাখি ডাকাডাকি করে শুনেছি, মোরগ মনে হয়। সেই কারণেই ডাকছে।
কেবিনের ভেতর মোরগ আসবে কেন?
তাও কথা।
বাঁ-পাশের কেবিনের দরজা খুলে এক ভদ্রলোক বের হলেন। তাঁর গায়ে আলজেরিয়া ফুটবল দলের জার্সির মতো ক্লিপিং সুন্টুট। মুখে ফ্রেঞ্চকাটি দাড়ি। ভদ্রলোক ভয়ে চিমশা মেরে গেছেন। তাঁর ফ্রেঞ্চকাট দাড়িগোঁফ ঝুলে গেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হচ্ছে বলতে পারেন?
আমি বললাম, ঝড় হচ্ছে।
ঝড় হচ্ছে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমাদের করণীয় কী?
মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা ছাড়া তেমন কিছু করণীয় নেই। গণ তওবার আয়োজন হচ্ছে। তওবায় সামিল হতে পারেন। তওবা পড়ানোর জন্যে যোগ্য মাওলানার সন্ধানে কিছুক্ষণের মধ্যে বের হব। ইচ্ছা করলে আপনিও আমার সঙ্গে আসতে?ilo। In Search of Godo-র মতো In Search of মাওলানা।
You are talking nonsense!
অতি সত্য কথা বলেছেন।
লঞ্চ কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য কী করছে? লঞ্চের মালিকপক্ষের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।
মালিকপক্ষের এখন আর কেউ নাই। আমরা সবাই মালিক আমাদের এই লঞ্চের রাজত্বে। মালিকের খোঁজখবর না করে একটা কাজ করতে পারেন। কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে একটা দোয়া পড়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। যা ঘটবে ঘুমের মধ্যে ঘটবে। দোয়াটা হচ্ছে—আল্লাহুমা বি ইছমিকা আমতু ওয়া আহইয়া। এর অর্থ হে আল্লাহু! তোমার নামেই আমি মৃত্যুর কোলে অর্থাৎ নিদ্রায় যাইতেছি এবং জীবিত হইব। তবে এই দফায় জীবিত হওয়ায় সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ফাজলামি করছেন? আমি কে আপনি জানেন? আমি ডক্টর জিলুর খান। হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট অব বায়োকেমিস্ট্রি। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব লালমাটিয়া।
ঢাকা শহরে এখন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছড়াছড়ি। ধানমণ্ডির কোনো কোনো গলিতে তিনটা-চারটা করে ইউনিভার্সিটি। মাঝারি সাইজের বাড়ি ভাড়া করে। ইউনিভার্সিটি বানানো হয়। বাড়ির গ্যারাজ হয়। ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের অফিস। সেই অফিসে এসি থাকে। বেশির ভাগ সময় এসি থেকে গরম বাতাস বের হয়। ফ্যান চললে ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের আরাম হতো, কিন্তু এসি-তে যে ইজ্জত ফ্যানে তা নেই।
আমি বললাম, স্যার ভালো আছেন? ভেতরে এসে বসুন। লঞ্চ দুলছে, যেকোনো সময় আপনি পড়ে যাবেন। যেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা দেখেও ভয় লাগছে। রেলিং ধরে দাঁড়ান।
তুমি কি লঞ্চের কেউ?
জি স্যার। আমি যাত্রীদের চা, পান-সিগারেট এইগুলা কেবিনে কেবিনে দেই। আমাকে কেবিন বয় বলতে পারেন। রাতের খানা কি খাবেন? এনে দিব? মেন্যু হলো—
ডাল-খাসি
ইলিশ মাছ ইলিশ
মাছের ডিম ডিম
সবজি
মসুর ডাল।
ডক্টর জিলুর খান বস্তিওয়ালা ভাইদের ভাষায় চলে গেলেন। খ্যাক খ্যাক করে বললেন, হারামজাদা কেবিন বয়। তুই ফাইজলামি শুরু করেছিস কী জন্যে? যা মালিকপক্ষের কাউকে ডেকে আন।
স্যার! এইটা আমার ডিউটিতে পড়ে না। তারপরেও যেতাম। লঞ্চে মালিক পক্ষের একজন আছেন। তিনি অসামাজিক কর্মে ব্যস্ত আছেন। তাঁকে ডাকার সাহস আমার নাই, কারণ তার সঙ্গে একটা লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। সারেঙ আছেন। উনার ব্রেইন কাজ করছে না। উনি শুধু বলছেন, যার গৈ, চানপুর যার গৈ। যার গৈ কথাটার অর্থ হচ্ছে—চলে যায়। চানপুর যার গৈ অৰ্থাৎ চাঁদপুর চলে যায়। লঞ্চ যখন ড়ুবে যাবে তখন তিনি বলবেন, লঞ্চ যার গৈ। শ্রাবণ যার গৈ মানে হচ্ছে শ্রাবণের দিন চলে যায়।
ডক্টর জিল্লুর খান বললেন, হারামজাদা। থাপড়ায়ে আমি তোর দাঁত ফেলে দেব।