স্যার, বিস্কুট দুটা যে আমাকে দিলেন, ভালো ছিল। খেয়ে আনন্দ পেয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
ওয়েলকাম।
আপনার জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করছে। আপনার অপছন্দের লোকজন কেউ থাকলে বলবেন, কামড় দিয়ে আসব।
তার দরকার নেই।
স্যার, আপনার কাছে একটা প্রশ্ন ছিল, অভয় দিলে বলি।
বলো।
আপনারা আমাদের নেড়ি কুত্তা বলেন কেন? নেড়ি শব্দটার অর্থ কী?
নেড়ির বুৎপত্তি জানতে চাও?
জি। কুকুর সমাজে প্রায়ই এটা নিয়ে আলোচনা হয়। গোল রাস্তা বৈঠক হয়। আপনারা করেন গোল টেবিল, আমরা টেবিল পাব কোথায়? আমরা গোল রাস্তা বৈঠক করি।
ভালো তো।
স্যার, যাচ্ছেন কোথায় জানতে পারি? ভাববেন না। আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানতে চাচ্ছি। কোনো কষ্ট না। কৌতূহল।
টপ টেরর আয়না মজিদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
যদি আপনি চান আমি তাকে কামড়ে ধরি, আমাকে ইশারা দিবেন। ঝাপ দিয়ে পড়ব।
সামান্য দুটা বিস্কুটের জন্যে এতটা করবে?
বিস্কুট দুটা সামান্য, কিন্তু বিস্কুটের পেছনের মমতা অসামান্য। এইজন্যেই কবি বলেছেন—
ভালোবেসে যে সামান্য দেয়
তারে দিও তুমি শতগুণে।
বন্ধু সে তোমার অতি প্রিয় সে
এই কথা বলে মনে মনে।
কোন কবি বলেছেন?
আমাদের কুকুর সমাজের কবি। আমাদের সমাজে বড় বড় কবি-সাহিত্যিক আছেন। এই কবিতাটি যিনি লিখেছেন তার নাম পিঠপোড়া ভুলো। গরম মাড় ফেলে উনার পিঠ পুড়িয়ে দিয়েছিল। এটা নিয়েও তার কবিতা আছে—
পিঠ পুড়িয়েছ তাতে কী হয়েছে
মন পোড়াতে পেরেছ কি?
অসাধারণ কবিতা না স্যার?
হ্যাঁ। উনি থাকেন কাথায়?
কোথায় থাকেন কাউকে বলেন না। কবি-সাহিত্যিক তো, নির্কুকরতা পছন্দ করেন। আপনাদের যেমন নির্জনতা, আমাদের হলো নির্কুকরতা। যেখানে কোনো কুকুর নেই সেখানে দেখা যাবে উনি উদাস মনে বসে আছেন।
ঠিকানামতো উপস্থিত হয়েছি। একতলা বাড়ি। রেলিং আছে। দরজায় কলিংবেল নেই, পুরনো আমলের মতো আংটা লাগানো। দরজার কড়া নাড়া হয়েছে। দরজা খুলেছে। যিনি দরজা খুলেছেন তার হাতে ম্যাচের কাঠি। কাঠি দিয়ে দাঁত খোচাচ্ছেন। গায়ের রঙ আলকাতরার কাছাকাছি। ছয়ফুটের মতো লম্বা। অতিরিক্ত লম্বা মানুষ মেরুদণ্ড বাঁকা করে খানিকটা ঝুঁকে থাকে। উনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে সবুজ রঙের লুঙ্গি। কালো স্যান্ডো গেঞ্জি। কালো মানুষের দাঁত ঝকঝকে সাদা হয়। ইনার দাঁত কুকুরের দাঁতের মতো হলুদ এবং চোখা ধরনের। তবে চোখের সাদা অংশ অতিরিক্ত সাদা।
আমি বললাম, ভাই সাহেব, ভালো আছেন? আপনি কি খোকন ভাই? লাম্বু খোকন?
তুমি কে?
আমার নাম হিমু। আর আমার সফরসঙ্গীর নাম টাইগার।
চাও কী?
আয়না ভাইকে টাকা দিতে এসেছি। দুই লাখ টাকা আছে আমার কাধের ব্যাগে। দরজা খুললে একটা পাসওয়ার্ড বলার কথা। পাসওয়ার্ড বললে আপনি ভেতরে নিয়ে বসাবেন। পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি। কাজেই আপনার হাতে টাকা দিয়ে চলে যাই।
আসে ভেতরে।
টাইগার কি যাবে আমার সঙ্গে, না বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে?
তোমাকে আসতে বলেছি তুমি আসো। বাজে প্যাচাল বন্ধ।
অনেকক্ষণ হলো বসে আছি। আমার জন্যে চা এসেছে। গরম সমুচা এসেছে। সমুচা ঘরে তৈরি এবং সুস্বাদু। সাইজে ছোট। পুরোটা একসঙ্গে মুখে দেয়া যায়।
যে ঘরে আছি তার আসবাবপত্র বলতে চারটা প্লাষ্টিকের চেয়ার। এক কোনায় ডাবল তোষক বিছানো। তোষকের উপর কম্বল, একটা জাম্বু সাইজ কোলবালিশ। কোলব্যালিশের ওয়াড় লাল সিস্কের। কেউ একজন তোষকে রাত কাটিয়েছে। চাদর এলোমেলো। তোষকের পাশে চায়ের কাপে বেশ কিছু সিগারেটের টুকরা ভাসছে। পাশেই পিরিচে মুরগির হাড়গোড়। সেখানে পিপড়া এবং মাছির মহোৎসব। একটা পিরিচে আধখাওয়া নানরুটি। পিপড়া মাছি কেউ সেদিকে যাচ্ছে না।
ভাই সাহেব, টাইগারকে কিছু খেতে দিয়েছেন? সে সমুচা খুবই পছন্দ করে বলে আমার ধারণা।
লঘু ভাই জবাব দিলেন না। চোখভর্তি সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। আয়না মজিদের কি আসতে দেরি হবে? দেরি হলে শুয়ে রেষ্ট নেই। বিছানা তো করাই আছে।
কথা কম। NO Sound.
No sound কেন? sound অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে sound থেকে। Big Bang. হিন্দু মিথলজি আবার এটাকে সাপোর্ট করছে। হিন্দু মিথলজিতে বলে ব্ৰহ্ম বিকট চিৎকার দিলেন। বিকট চিৎকার হলো নাদ। সেই নাদের কারণে ব্ৰহ্মাণ্ড তৈরি হলো।
চুপ।
আপনি চুপ বলে চিৎকার করলেন। লঘুনাদ করলেন। এর ফলে আমি চুপ করে গোলাম।
আর একটা কথা বললে থাবড়ায়ে দাঁত ফেলে দিব।
এই সময় লম্বু খোকনের একটা টেলিফোন এলো। তিনি কোনো কথা বললেন না। টেলিফোন কানে দিয়ে রাখলেন। কথাবার্তা শেষ হলে চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন, ঘর থেকে বের হলেন। দরজা বন্ধ করলেন। তালা লাগানোর আওয়াজ পেলাম। তার মানে বেশ কিছু সময়ের জন্যে আমাকে এখানে থাকতে হবে। এখন বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে কোনো বাধা নেই। আজকের দিনটাও ঘুমানোর জন্যে ভালো। মেঘলা আকাশ। বাতাসে হিম।
আমি আয়োজন করেই ঘুমুতে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। অনেক দিন পর বাবা স্বপ্নে দেখা দিলেন। তার পরনে হাফপ্যান্ট। মাথায় নীল টুপি, গলায় মাফলার। কাধে জন্ম নিবন্ধনের ব্যাগ।
এই হিমু, তোর জন্ম নিবন্ধনটা করে ফেলি। ফরম ফিলাপ কর।
ফরম তুমি ফিলাপ করো। আমার বিষয়ে তো তুমি সবচে বেশি জানো।
বাবা বিছানায় বসে ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বের করতে করতে বললেন, অসময়ে শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ?