- বইয়ের নামঃ হিমু মামা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অবসর
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, দর্শন
টগরদের বাড়িতে ধুন্ধুমার কাণ্ড
[জানি না এই বইটি ‘হিমু সমগ্র’ ক্যাটাগরির মধ্যে রাখা ঠিক হলো কি না। কারণ এটা ঠিক হিমু সিরিজের বই নয়, তবে কিছুটা হিমু সংক্রান্ত। হয়তো এ কারণেই এই ক্যাটাগরিতে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। ভাল হত যদি হুমায়ূন আহমেদের ‘কিশোর সমগ্র’ বলে একটা আলাদা ক্যাটাগরি করা যেত, তাহলে এটাকে ‘কিশোর সমগ্র’-এর মধ্যে রাখা যেত।–এভারগ্রীন বাংলা কর্তৃপক্ষ]
টগরদের বাড়িতে আজ সন্ধ্যায় ধুন্ধুমার কাণ্ড হবে।
একজনকে ‘ছেঁচা’ দেয়া হবে। সেই একজন ভয়ঙ্কর একটা অপরাধ করেছে। এমন ভয়ঙ্কর অপরাধ যে বাড়ির সবার মুখ গম্ভীর। ছেঁচা দেয়ার আয়োজন সকাল থেকেই চলছে। আনুষ্ঠানিক শাস্তি তো, আয়োজন লাগে। ছেচা দেবেন টগরের বড় চাচা, চৌধুরী আজমল হোসেন।
চৌধুরী আজমল হোসেন ছোটখাটো মানুষ। একসময় হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। এখন করেন না। বছর খানেক আগেও তার মাথাভর্তি সাদা চুল ছিল। এখন সব পড়ে গেছে। টগরের খুব ইচ্ছা করে তাকে টাকালু চাচা ডাকতে। সেটা সম্ভব না। চৌধুরী আজমল হোসেন সব সময় হাসি হাসি মুখ করে থাকেন। নিচু গলায় কথা বলেন। তাকে দেখে মনে হয় তিনি বেশ আনন্দে আছেন। তারপরও সবাই তাকে ভয় পায়। টগরের ধারণা, এ বাড়ির আসবাবপত্রও তাকে ভয় পায়। যে ইজিচেয়ারে তিনি বেশির ভাগ সময় শুয়ে থাকেন (মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়েন)। সেই ইজিচেয়ার তাকে ভয় পায়। যে বইটা তিনি পড়েন সেই বইটাও ভয় পায়। ইজিচেয়ারে শোয়ার সময় যে টুলে তিনি পা তুলে রাখেন সেই টুলও তাঁকে ভয় পায়।
চৌধুরী আজমল হোসেন এ বাড়ির প্রধান বিচারক। টগরদের বাড়ির যে কোনো অন্যায়ের বিচার তিনি করে থাকেন। তার কথার ওপর কথা বলার সাহস কারোরই নেই। শুধু একজনের আছে, তিনি টগরের দাদিয়া। তবে তার খুব শরীর খারাপ বলে তিনি বেশির ভাগ সময় বিছানায় শুয়ে থাকেন। কারো সঙ্গেই কথা বলেন না। কেউ তাঁর ঘরে ঢুকলে তিনি কড়া গলায় বলেন, এ চায় কী? এই ছাগলা কী চায়? এ আমার ঘরে ঢুকছে কী জন্য? আমার ঘরে কি সোনার খনি আছে?
আজ যাকে ছেঁচা দেয়া হবে সে টগরের ছোট মামা। তার নাম শুভ্ৰ। খুবই ভালো ছাত্র। এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে। ফার্স্ট-সেকেন্ড কিছু একটা হবে। অবশ্যই হবে। কিছু ছেলেমেয়ে আছে যারা পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড না হয়ে থাকতে পারে না। পরীক্ষা দিলেই হয়। ফার্স্ট না হয়। সেকেন্ড শুভ্ৰ হলো সে রকম। সে এসএসসি পরীক্ষাতে ঢাকা বোর্ডে ফার্স্ট হয়েছিল। সব পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছে। চোখ ট্যারা এক ছেলে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে, এ রকম ছবি। শুভ্র ট্যারা না। তবে ছবি তোলার সময় সে কিছু একটা করে দুটা চোখের মণি একসঙ্গে নিয়ে আসে। ছবি ডেভেলপ করলে দেখা যায় সে ট্যারা। শুভ্ৰ যে পরীক্ষা দিলেই ফার্স্ট-সেকেন্ড হয় এই প্রতিভায় টগর মুগ্ধ না। সে মুগ্ধ ছোট মামার ট্যারা হবার ক্ষমতা দেখে।
যে ভয়ঙ্কর অপরাধের কারণে শুভ্ৰকে আজ সন্ধ্যায় শাস্তি দেয়া হবে তা হলো, গত বুধবার সকাল এগারোটায় হলুদ পাঞ্জাবি পরে সে হিমু হয়ে গেছে। টগরকে ডেকে বলেছে এখন থেকে আমাকে ছোট মামা ডাকবি না। হিমু মামা ডাকবি।
হিমু হওয়া ব্যাপারটা ঠিক কী টগর জানে না।
এইটুকু শুধু জানে, যারা হিমু হয় তাদের খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। কটকট হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরতে হয় এবং বেশির ভাগ সময় জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলতে হয়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মিষ্টি করে হাসতে হয়।
হিমু হওয়া এমন কোনো বড় অপরাধ বলে টগরের মনে হচ্ছে না। তবে বড়দের কাছে নিশ্চয়ই বিশাল অপরাধ। তা না হলে এমন আয়োজন করে বিচারসভা বসবে না। বড় চাচা নিজে এসে বলে গেছেন, শুভ্ৰ! তুমি আজ ঘর থেকে বের হবে না। সন্ধ্যার পর তোমার সঙ্গে কথা আছে।
টগরের ছোট মামা বলল, কী কথা, এখন বলুন।
বড় চাচা বললেন, কথা সবার সামনে হবে। সবাইকে সন্ধ্যার পর থাকতে বলেছি।
আমি কি কোনো অন্যায় করেছি?
ন্যায় করেছ নাকি অন্যায় করেছ সেই বিবেচনাও তখন হবে। ন্যায়-অন্যায় একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। তোমার কাছে যা ন্যায় অন্যের কাছেই হয়তো তা অন্যায়।
শুভ্ৰ গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছে, সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত আমি যেখানে বসে আছি সেখানে বসে থাকব। নড়াচড়া করব না। সন্ধ্যা হবার পর আমাকে ডেকে নেবেন।
চৌধুরী আজমল হোসেন বললেন, তোমাকে এখানে বসে থাকতে হবে না। তোমার যেখানে ইচ্ছা তুমি সেখানে যেতে পার। শুধু সন্ধ্যাবেলা আমার ঘরে চলে আসবে। তোমার যা বলার তখন শুনব।
শুভ্র বসে আছে তার ঘরের বেতের চেয়ারে। তার বসার ভঙ্গির মধ্যে মূর্তি-মূর্তি ভাব। টগর জানে তার ছোট মামা এই যে বসে আছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত বসেই থাকবে। হিমুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকার কাজ খুব ভালো পারে। এটা তাদের পারতে হয়।
শুভ্রের ঘর আগে অনেক সাজানো-গোছানো ছিল। খাটে ফোমের বিছানা ছিল। বিছানায় যশোরের সূচের কাজ করা নীল চাদর ছিল। টিভি ছিল, ভিসিডি প্লেয়ার ছিল, গান শোনার জন্য মিউজিক সিষ্টেম ছিল। এখন কিছুই নেই। খাটের ওপর মাদুর বিছানো। মাদুরের নিচে তোশক পর্যন্ত নেই। বালিশও নেই। কারণ হিমুরা আয়েশ করে ফোমের বিছানায় ঘুমোবে না। নিয়ম নেই। তারা যেখানে—সেখানে ঘুমিয়ে পড়বে। মাথার নিচে বালিশ থাকবে না। প্রয়োজনে তারা থান ইটের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমোবে। শুভ্ৰ অবিশ্যি মাথার নিচে থান ইট দেয় না, বড় একটা ডিকশনারি দেয়। ডিকশনারির নাম বঙ্গীয় শব্দকোষ।
টগর তার মামার খুবই ভক্ত। অনেক কিছু সে তার মামার কাছে শিখেছে। কিছুদিন আগে শিখল পাঁচ নম্বরি ফুটবলের সাইজ বুদ্বুদ বানানো। জায়ান্ট সাইজ বাবল বানানোর নিয়ম হলো—আধ বালতি পানিতে তিন কাপ ডিসওয়াশিং লিকুইড সাবান মেশাতে হবে, তরকারির চামচে এক চামচ গ্লিসারিন মেশাতে হবে। তারপর চার-পাঁচ টুকরা বরফ মিশিয়ে পানিটা ঠাণ্ডা করতে হবে। এখন কাগজের নল বানিয়ে সেই নল পানিতে চুবিয়ে ফুঁ দিলেই বিশাল বড় বড় বুদ্বুদ হবে। এই বুদ্বুদ ফট করে মরে যাবে না। অনেকক্ষণ ঘরের বাতাসে ঘুরঘুর করবে।
শুভ্ৰ বুদ্বুদ বানানো ছাড়াও এখন টগরকে শেখাচ্ছে কী করে ছবি তোলার সময় ট্যারা হওয়া যায়। জিনিসটা বেশ কঠিন। কপালের শিরায় হ্যাঁচকা টানের মতো দিতে হয়। তারপর তাকিয়ে থাকতে হয় নাকের ডগার দিকে। টগর এখনো শিখে উঠতে পারেনি। তার সময় লাগছে।
টগর, ছোট মামার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মামাকে সে অত্যন্ত পছন্দ করে বলেই তার খুব খারাপ লাগছে। কেউ হিমু হলেই তার জন্য বিচারসভা বসাতে হবে? হিমু হওয়া কি খারাপ? হিমুরা তো কিছু করে না, শুধু হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘোরে।
শুভ্র বলল, কিছু বলবি?
টগর বলল, চা খাবে মামা? বুয়াকে বলে তোমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসি? কড়া করে। চিনি বেশি দিয়ে।
শুভ্র বলল, চা-ফা লাগবে না। হিমুদের এত আয়েশ করে চা খাওয়ার নিয়ম নেই।
হিমুরা চা খায় না?
খায়। রিকশাওয়ালা বা ঠেলাওয়ালাদের সঙ্গে খায়। অ্যারেস্ট হলে থানার ওসি বা কনষ্টেবলের সঙ্গে খায়।
হিমুরা অ্যারেস্ট হয়?
বলিস কী, অ্যারেক্ট হবে না? হিমুদের জীবনের একটা অংশ কাটে জেল— হাজতে। পুলিশের গুতা, বুটজুতার লাগি তাদের নিত্যসঙ্গী। কোনো অপমানই তাদের গায়ে লাগে না।
টগর, ইতস্তত করে বলল, এখন কি তোমার ভয় লাগছে, মামা?
শুভ্র বলল, ভয় লাগবে কেন?
টগর বলল, এই যে আজ সন্ধ্যায় তোমার বিচার হবে, এই জন্য? তোমাকে হয়তো এ বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
শুভ্ৰ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দিক বের করে। সব ঠাই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর ফিরি খুঁজিয়া। হিমুরা পৃথিবীর কোনো কিছুকে ভয় পায় না। হিমুদের প্রথম যে জিনিসটা জয় করতে হয় তার নাম হলো ভয়।
তুমি ভয় জয় করেছ?
সব ভয় এখনো জয় করতে পারিনি। যেমন ধরা উড়ন্ত তেলাপোকা এখনো ভয় পাই। অন্ধকার ঘরে ঘুমাতে পারি না। বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এই দুটা ছাড়া বাকি ভয় মোটামুটি জয় করে ফেলেছি। তুই এখন আমার সামনে থেকে যা তো!
যাব কেন?
তোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। অকারণে কথা বলাও হিমুদের জন্য নিষিদ্ধ। সামনে থেকে যা। তবে এক কাপ চা এনে দিতে পারিস। তোর কাছ থেকে চায়ের কথা শোনার পর থেকে চা খেতে ইচ্ছা করছে। হিমুদের উচিত খাদ্যবিষয়ক সমস্ত লোভ জয় করা। এখনো পারছি না।
টগর বলল, তুমি যে এতক্ষণ ধরে এক জায়গায় বসে আছ, তোমার খারাপ লাগছে না?
শুভ্র বলল, খারাপ লাগার ব্যাপারটাই হিমুদের মধ্যে নেই। কোনো কিছুতেই তাদের খারাপ লাগে না। প্রচণ্ড শীতে তারা খালি গায়ে বরফের চাঙের ওপর শুয়ে থাকতে পারে। আবার কম্বল গায়ে দিয়ে চৈত্র মাসের রোদে হাঁটাহাটি করতে পারে। ঠাণ্ডা-গরম হিমুদের কাছে কোনো ব্যাপার না। হিমুরা শারীরিক বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
টগর বলল, মামা, আমাকে কবে হিমু বানাবে?
শুভ্ৰ বিরক্ত গলায় বলল, তোর এখনো অনেক সময় লাগবে। সামান্য ট্যারা হওয়া শিখতে পারলি না। হিমু হবি কীভাবে? যা চা নিয়ে আয়।
টগর রান্নাঘরের দিকে গেল। টগরের মা সুলতানা মুরগির মাংস নিয়ে কী যেন করছেন। দুজন কাজের বুয়া তাকে সাহায্য করছে। সুলতানাকে খুবই হাসিখুশি দেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই নতুন ধরনের কিছু রান্না করছেন। নতুন ধরনের রান্নাবান্না করার সময় তাকে খুবই হাসিখুশি দেখায়। তার জীবনের শখ তিনি একটা রেস্টুরেন্ট দেবেন। রেস্টুরেন্টের নাম উনুন। সেই রেস্টুরেন্টে স্পেশাল আইটেম ছাড়া অন্য কোনো আইটেম থাকবে না।
সুলতানা স্পেশাল আইটেম রান্না খুব পছন্দ করেন। প্রায়ই তিনি স্পেশাল কিছু না কিছু বানাচ্ছেন। বেশির ভাগ সময়ই জিনিসটা হয়- অদ্ভুত এবং খেতে বিস্বাদ। টগরের বাবা চৌধুরী আলতাফ হোসেন এমনিতে খুব হাসিখুশি মানুষ। একেবারেই রাগেন না। শুধু সুলতানা নতুন কিছু রান্না করেছেন শুনলে চট করে রেগে যান। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া যা হয় নতুন রান্না নিয়ে হয়। যেমন টগরের বাবা কোনো একটা খাবার মুখে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, এটা কী? এই বস্তুটার নাম কী?
সুলতানা হাসিমুখে বললেন, ডেজার্ট। আপেল দিয়ে কানানো ডেজার্ট। আমেরিকানরা বলে, অ্যাপল টার্ট।
ডেজার্ট তাহলে ঝাল কেন?
সামান্য গোলমরিচ দিয়েছি, এই জন্য বোধ হয় ঝাল হয়েছে। এরকম রাণী রাগী চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? খেতে ইচ্ছা না হলে খেও না।
মিষ্টি জাতীয় একটা খাবার রান্না করছ, এর মধ্যে ঝাল কেন? ঝাল দিয়ে কেউ মিষ্টি রান্না করে?
চিৎকার করছ কেন? বললাম তো খেতে ইচ্ছা না হলে খাবে না। তোমাকে তো আমি সাধাসাধি করছি না।
ঝাল রসগোল্লা, মিষ্টি গরুর মাংসের কালিয়া এইসব বন্ধ করে নরমাল কোনো রান্না রাঁধতে পার না? সাধারণ ভাত-মাছ, আলুভর্তা, ডাল।
সাধারণ খাবার তো রোজই হচ্ছে। দু-একটা স্পেশাল রান্না হবে না?
না, হবে না। আবার যদি স্পেশাল কিছু রান্না করো, আমি অবশ্যই বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাব।
একেবারে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ, চলে যেতে হবে। বনে-জঙ্গলে থাকব। ঘাস-লতা-পাতা খাব। তোমার টার্ট-ফার্ট খেতে পারব না।
রান্না নিয়ে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে টগর অভ্যস্ত। এই ঝগড়া দেখতে তার ভালো লাগে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে সে সব সময় বাবার পক্ষ নেয়। যদিও ছোট ছেলেদের উচিত মায়ের পক্ষ নেয়া। ছেলেরা নেবে মায়ের পক্ষ, মেয়েরা নেবে বাবার পক্ষ । এটাই নিয়ম। টেগরের নিয়ম মানতে ভালো লাগে না। আশপাশে যত বেশি অনিয়ম হয় টগরের ততই ভালো লাগে।
রান্নাঘরে মায়ের আনন্দিত মুখ দেখে টেগরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে এত বড় বিচারসভা বসবে অথচ কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। মা কেমন হাসাহাসি করতে করতে মুরগির মাংস ছানাছানি করছেন। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু বানাচ্ছেন।
সুলতানা টগরের দিকে তাকিয়ে বললেন, রান্নাঘরে ঘুরঘুর করিস না তো! ছেলেপুলেকে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করতে দেখলে আমার খুবই বিরক্তি লাগে। ঘণ্টাখানেক পরে আয়, মুরগির মাংসের মিষ্টি কাবাব খাইয়ে দেব। নতুন রেসিপি। কাশ্মিরে এইভাবে মুরগির মাংস রান্না হয়।
টগর, বলল, আমি মিষ্টি কাবাব খাব না।
খাবি না কেন, অবশ্যই খাবি। রসমালাই দেখলে হামলে পড়িস, মুরগির মিষ্টি কাবাব খেতে পারবি না? বাবার স্বভাব দেখি পুরোটা পেয়েছিস। সামনে থেকে যা, ঘুরঘুর করিস না।
আমি ঘুরঘুর করছি না, কাজে এসেছি।
কী কাজ?
ছোট মামা চা খাবে। চা দাও।
সুলতানা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ফাজিলটার নাম মুখে আনবি না। ওকে চা খাওয়াতে হবে না। ওর হিমুগিরি আগে বের হোক, তারপর চা। গা থেকে হলুদ পাঞ্জাবি খুলে কানে ধরে দশবার উঠবোস করবে তারপর ফরমাশ দিবে।
হিমু হওয়া তো দোষের কিছু না, মা।
দোষের না গুণের তা নিয়ে তোর সঙ্গে তর্ক করতে পারব না। দুই আঙুল ছেলে, আমার সঙ্গে তর্ক করতে এসেছে। যা সামনে থেকে।
টগর অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, এমন করছ, কেন মা? দাও না এক কাপ চা বানিয়ে। চিনি—দুধ বেশি।
সুলতানা কঠিন গলায় বললেন, সামনে থেকে যাবি নাকি মুরগিমাখা হাতে একটা থাপ্পড় খাবি?
টগর রান্নাঘরের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। ছোট মামা বেচারা চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে, অথচ তাকে সে চা দিতে পারছে না। খুবই খারাপ ব্যাপার। টগর দ্রুত চিন্তা করছে কোনো একটা বুদ্ধি বের করা যায় কি না। তার মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসছে না। যখন কোনো বুদ্ধির দরকার হয় না। তখন মাথায় নানা রকম বুদ্ধি আসে আর যখন প্রয়োজন হয় তখন কোনো বুদ্ধিই আসে না।
টগর, ছোট মামার ঘরে চলে এল। মামা ঠিক আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে, তবে চোখ বন্ধ। সে চোখ না খুলেই বলল, আমার চা কই?
টগর। এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবারো ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার কাছে মনে হলো সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত সে এই কাজই করবে। একবার নিজের ঘরে ঢুকবে। ছোট মামা বলবেন, চা কই? সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। আবার ঢুকবে। আবার বের হবে। আবার ঢুকবে। আবার বের হবে। আসা-যাওয়া চলতেই থাকবে।
ছোট মামার ঘর থেকে বের হয়ে একসময় কী মনে করে যেন টগর দাদিয়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। টগরের দাদিয়া তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, এ চায় কী? এই ছাগলা কী চায়? আমার ঘরে ঢুকছে কী জন্য? আমার ঘরে কি সোনার খনি আছে?
টগর বলল, দাদিয়া, আমি টগর। আমি তোমার ঘরে ঢুকিনি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
তুই আমার দরজার সামনে দিয়া একবার যাস একবার আসস। তুই তাঁতের মাকু হইছস? তোর ঘটনা কী?
কোনো ঘটনা নাই।
কেউ তোরে বকা দিছে? তুই কি আমারে নালিশ করতে চাস?
না।
বকা দিলে আমারে তার নাম কি। আমি ব্যবস্থা নিব। আমি যতদিন বাঁইচ্যা আছি ছোট পুলাপানের ওপরে বকা চলাব না। কে তোরে বকছে? তোর মা? ডাক দেখি তোর মারে।
মা বকে নাই।
তাইলে বকছে কে? তোর বড় চাচা? হে মাথা ছিলা বান্দর হইয়া বকা মাষ্টর সাজছে? যারে তারে-হ্যামকি ধমকি? ডাক তারে।
দাদিয়া আমাকে কেউ বকে নাই।
না বকলে সামনে থাইক্যা যা। ত্যক্ত করিস না।
টগর দাদিয়ার ঘরের সামনে থেকে চলে এল। আর তখনি তার ভেতর থেকে দুঃখ দুঃখ ভাবটা পুরোপুরি চলে গেল। কারণ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। কীভাবে ছোট মামার জন্য এক কাপ চা জোগাড় করা যায় সেই বুদ্ধি। দাদিয়ার সঙ্গে কথা না বললে মাথায় এই বুদ্ধি আসত না। ভাগ্যিস সে কথা বলেছিল।
টগর রান্নাঘরে মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, মা, চুলা কি বন্ধ?
সুলতানা বললেন, চুলা বন্ধ না খোলা এটা দিয়ে তোর কী দরকার? শুধু শুধু বিরক্ত করা।
টগর, বলল, শুধু শুধু বিরক্ত করছি না। দাদিয়া চা খেতে চাচ্ছেন।
সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, বলিস কী, ওনার কি শরীর ঠিক হয়েছে নাকি?
টগর বলল, শরীর ঠিক হয়েছে কি হয়নি। আমি জানি না। দাদিয়ার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, দাদিয়া বললেন, টগর, এক্ষুনি তোর মাকে গিয়ে বল আমাকে কড়া করে এক কাপ চা দিতে। চিনি বেশি।
চিনি বেশি কী জন্য? ওনার ডায়াবেটিস। উনি তো চায়ে চিনিই খান না।
আমাকে যেটা বললেন, আমি সেটা তোমাকে বললাম। হয়তো অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর দাদিয়ার চিনি খেতে ইচ্ছা করছে। তুমি এক্ষুনি চা বানিয়ে আমার হাতে দাও। দাদিয়া আমাকে চা নিয়ে যেতে বলেছেন। অন্য কেউ নিয়ে গেলে চলবে না। উনি রাগ করবেন।
রাগ করবেন কেন?
রাগ করবেন। কারণ অসুখ থেকে ওঠার পর থেকে বড়দের কারোর মুখ দেখতে দাদিয়ার ইচ্ছা করছে না। শুধু ছোটদের মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে। বড়দের মুখ দেখলেই রাগ লাগছে।
দাঁড়া, চা নিয়ে যা।
টগর জানে তার নামে দুটো পাপ লেখা হয়ে গেছে। মিথ্যা কথা বললে এমনিতেই পাপ হয়। সেই মিথ্যা মায়ের সঙ্গে বললে পাপ ডাবল হয়ে যায়। তবে এই পাপ কাটানোর বুদ্ধি টগরের আছে। এখন কোনো একটা ভালো কাজ করতে হবে। পাপ এবং পুণ্যতে যেন কাটাকাটি হয়ে যায়।
ভালো কাজ কী করবে তা সে ঠিক করে ফেলেছে। তার বড় বোন নীলুর টেবিল থেকে তার অঙ্ক বইটা চুরি করে কোথাও লুকিয়ে রাখবে। আগামীকাল নীলুর অঙ্ক পরীক্ষা। বই খুঁজে না পেয়ে সে অস্থির হয়ে পড়বে। একসময় কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন সে বইটা বের করে নীলুকে দেবে। এটা একটা ভালো কাজ। এই ভালো কাজে আর আগের মন্দ কাজে কাটাকাটি হয়ে যাবে। মাইনাস ওয়ান প্লাস ওয়ান সমান সমান জিরো।
শুভ্ৰ চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, টগর, চা-টা ভালো হয়েছে।
বাসার চা কখনো ভালো হয় না। আশ্চর্যজনকভাবে এটা হয়েছে।
থ্যাঙ্কস! টগর বলল, ছোট মামা, তোমাকে আজ কী শাস্তি দেবে তুমি জানো?
না।
আমার মনে হয় বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
তা দেবে না। তবে আমি নিজেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব।
কেন?
হিমুরা এক বাড়িতে বেশি দিন থাকতে পারে না। তাদের পথে পথে বেশি ঘুরতে হয়। জোছনা হলে বনে-জঙ্গলে গিয়ে জোছনা দেখতে হয়। বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়।
তাতে কী লাভ?
গাধার মতো কথা বলিস না তো টগর। মানুষ হয়ে জন্মেছিস মানুষের মতো কথা বলবি। হিমুরা কি লাভ-লোকসান হিসাব করে চলে? তারা কি বিজনেসম্যান? ব্রিফকেস হাতে নিয়ে ঘুরবে। কারো সঙ্গে দেখা হলেই হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে তেলতোলে মুখে হাসবে। যা আরেক কাপ চা নিয়ে আয়। এবারেরটাও যেন আগের মতো হয়।
আর চা না খেলে হয় না? বেশি চা খাওয়া তো ভালো না।
তোকে জ্ঞানীর মতো কথা বলতে হবে না। তোকে চা নিয়ে আসতে বলেছি নিয়ে আয়। চা খেতে খেতে একটা রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করব।
কী রহস্য?
আমি যে হিমু হয়ে গেছি, এটা তোর বড় চাচা কীভাবে জানল?
টগর বলল, এই বাড়িতে ওনার অনেক স্পাই আছে। বাড়ি গিজগিজ করছে স্পাইয়ে।
শুভ্র বলল, তাই তো দেখছি। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা চা নিয়ে আয়।
টগর অনাগ্রহের সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হলো। তার কেন জানি মনে হচ্ছে দ্বিতীয়বার চা চাইতে গেলেই সব ধরা পড়ে যাবে। টগরের বুক টিপটিপ করছে। এর মধ্যে নীলু আবার অতিরিক্ত রকমের হৈচৈ শুরু করেছে, আমার অঙ্ক বই, আমার অঙ্ক বই। বাড়ি মাথায় তোলার মতো চিৎকার। টগরের খুবই বিরক্তি লাগছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেই কি বই পাওয়া যাবে! যখন সময় হবে বই আপনা-আপনি চলে আসবে।
নীলুর চিৎকার শুনে বড় চাচা বের হয়ে এসেছেন। তিনি নীলুকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। লক্ষণ ভালো মনে হচ্ছে না। বড় চাচার যে বুদ্ধি তিনি নীলুর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললে বুঝে ফেলতে পারেন, অঙ্ক বই পাওয়া যাচ্ছে না। কেন। কাজেই এখন যেটা করতে হবে তা হলো, অঙ্ক বইটা এনে আগের জায়গায় রেখে দিতে হবে। বেশি দেরি করা যাবে না। টগর তা-ই করল। যেখানকার বই সেখানে।
টগর অঙ্ক বই নীলুর পড়ার টেবিলে রেখে বড় চাচার ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। তার উদ্দেশ্য বড় চাচার সঙ্গে নীলুর কথাবার্তা যদি কিছু শোনা যায়। আড়াল থেকে অন্যের কথা শোনা খুবই অন্যায়। বিরাট পাপ হয়। এই কাজটা টগরের করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। আড়াল থেকে কথা শোনার পাপ কাটান দেয়ার জন্য ছোটখাটো কোনো পুণ্য করতে হবে। পাপ করলেই পুণ্য করে সব সমান সমান রাখা। সে বড় চাচার ঘরের দরজার ওপাশে দাঁড়াল।
নীলু ফোঁপাচ্ছে। ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। বড় চাচা বললেন, ফোঁপানি বন্ধ করা নীলু। বই পাওয়া যাচ্ছে না, এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার না যে তার জন্য ফুঁপিয়ে কাঁদতে হবে। রাজ্য ছেড়ে রাজা বনবাসী হলেও কোনো রানী এভাবে কাঁদে না।
নীলু ফোঁপানি বন্ধ করল।
কী বই পাওয়া যাচ্ছে না?
অঙ্ক বই। আমি অঙ্ক করছিলাম। মাঝখানে দশ মিনিটের জন্য বাথরুমে হাত-মুখ ধুতে গিয়েছি। ফিরে এসে দেখি বই নেই।
বই হাওয়া হয়ে গেছে?
হুঁ।
তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
না।
বই খুঁজে না পাওয়ার ঘটনা তো তোমার ক্ষেত্রে আগেও ঘটেছে। কিছুদিন পর পরই তো শুনি তোমার এই বই পাওয়া যাচ্ছে না, ওই বই পাওয়া যাচ্ছে না।
জি।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর যখন সবাই হাল ছেড়ে দেয়। তখন আবার বই খুঁজে পাওয়া যায়।
জি।
রহস্যটা কী?
জানি না বড় চাচা।
তোমার পড়ার ঘরে যাও, দেখো বই আবার ফিরে এসেছে কি না।
জি আচ্ছা।
যদি বই ফিরে না আসে তাহলে ড্রাইভারকে নিউমার্কেটে পাঠাও, সে বই কিনে আনবে। বইয়ের শোকে মরাকান্না কাঁদতে হবে না। বই মারা যায়নি। বই জীবিত আছে।
জি আচ্ছা।
আমার ধারণা, বই নিয়ে এই রসিকতা কে করছে তা আমি বুঝতে পারছি। তুমি টগরকে একটু আমার কাছে পাঠাও।
বড় চাচার কথা শুনে টগরের বুক ধক করে উঠল। কী সর্বনাশ, কাজটা যে সে করেছে এটা কি বড় চাচা ধরে ফেলেছেন? টগর অতি দ্রুত তার গোপন জায়গায় চলে গেল। এই মুহূর্তে বড় চাচার সামনে পড়ার কোনো মানে হয় না।
এ বাড়িতে টগরের একটা গোপন জায়গা আছে। গোপন জায়গার খবর এ বাড়ির কেউই জানে না। টগরের ধারণা, কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না।
গোপন জায়গাটায় ছাদের সিঁড়িঘর দিয়ে যেতে হয়। সিঁড়িঘরের সঙ্গের যে বাথরুম সেই বাথরুমের ফলস সিলিং হলো টগরের গোপন জায়গা। ফলস সিলিং বানানো হয়েছিল। টুকিটাকি জিনিস রাখার জন্য। টগর সব পরিষ্কার করেছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে সে জায়গাটা সুন্দর করে সাজিয়েছে। ছাদের মতো জায়গাটায় চাদর বিছানো আছে। বালিশ আছে। পানির বোতল, চিপস সবই আছে। অনেক গল্পের বই আছে। গুজ বামের দশটা বই, হেরি পটারের দুটো। অনেকগুলো লেগোর সেট আছে। একটা আছে মেকানো সেট। ছবি আঁকার জন্য খাতা আছে, পেনসিল আছে।
এসব ছাড়াও কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স আছে। বাক্সটার ওপরে লাল মার্কার দিয়ে লেখা :
THIEF BOX
চোরবাক্স
এই বাক্সে টগর কিছু চুরি করা জিনিস অল্প কিছু দিনের জন্য লুকিয়ে রাখে। যেমন তার বাবাকে কে যেন একটা লাইটার দিয়েছিল। বোতাম টিপলেই আগুন বের হয় এবং বাজনা বাজে। এই লাইটারটা টগর চুরি করে এনে তার থিফ বক্সে রেখে দিল। কিছু দিন লাইটার নিয়ে খেলে আবার একসময় বাবার কোটের পকেটে রেখে দিল। টগরের বাবা খুবই অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড, লাইটারটা পাওয়া গেছে। কাজের বুয়া দুজনকে খামাখা সন্দেহ করেছি। ছি-ছি! আমার পকেটেই ছিল।
চোরবাক্সে কোনো জিনিসই টগর বেশি দিন রাখে না। শুধু দাদিয়ার দাঁতের পাটি এক সপ্তাহ রেখে দিয়েছিল। চারদিকে এমন হৈচৈ শুরু হলো! সবার এক কথা, দাঁত কে নেবে? দাঁত কি চুরি করার জিনিস? দাঁত কে নিল। এই বিষয়ে অনেক থিওরি বের হলো। টেগরের বাবা বললেন, ইঁদুরের কাণ্ড। ইঁদুর নিয়েছে। এই শুনে সুলতানা বললেন, এত বড় দাঁত কি ইঁদুরের মুখে লাগবে? ইঁদুর কেন নেবে।
টগরের বাবা সুলতানার কথা শুনে রেগে গিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে রসিকতা করবে না। প্লিজ।
সেই দাঁত এক সপ্তাহ পর টগর রেখে দিল বড় চাচার টেবিলের ড্রয়ারে। এই নিয়েও কম হৈচৈ হলো না। ড্রয়ারে দাঁত এল কোথেকে? নানা গবেষণা, নানা আলোচনা। গুজগুজ ফিসফিস মিটিং। বাড়িতে হৈচৈ হলে টেগরের ভালো লাগে। তবে সে খুব ভালো করেই জানে তার পাপ হচ্ছে। এই পাপ কাটান দেয়ার জন্য তাকে পুণ্য করতে হবে। সে তখন পুণ্য করে।
পাপ-পুণ্যের হিসাব রাখার জন্য তার একটা খাতা আছে। খাতার নাম পাপ-পুণ্য খাতা। খাতায় পাপগুলো লেখা থাকে লাল মার্কারে। পুণ্যগুলো সবুজ মার্কারে।
টগর জানালার শিকে পা রেখে তার গোপন জায়গায় ওঠে, সিলিংয়ের দরজা লাগিয়ে দেয়। একবার ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলে কারোর বোঝার সাধ্যও থাকে না যে এখানে কেউ আছে। জায়গাটা একটু অন্ধকার। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার চোখে সয়ে যায়।
টগর তার গোপন জায়গায় বসে আছে। তার হাতে বড় একটা খাতা। এটা ‘পাপ-পুণ্য খাতা’ না, অন্য খাতা। এই খাতায় তাদের বাড়ির প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে কিছু লেখা আছে। লেখাগুলো টগরই লিখেছে। কিছু দিন পর পর সে লেখাগুলো পড়ে। সামান্য কাটাকাটি করে। আজ খাতাটা সে নিয়েছে আরো নতুন কিছু তথ্য যোগ করার জন্য। ছোট মামা যে গত সপ্তাহে হিমু হয়ে গেছে, এই কারণে আজ তার বিচার হবে এই তথ্য খাতায় লেখা নেই। টগর খাতার লেখা পড়তে শুরু করল। সে পড়াশোনায় খুব ভালো।
সব পরীক্ষায় A পায়। বড় হয়ে সে Mad Scientist হবে।
টগর
It is me,
Standard six student.
খুব বুদ্ধিমান ছেলে। অতি ভালো। মিষ্টি স্বভাব। সে সবাইকে ভালোবাসে। তার কোনো খারাপ গুণ নেই। সপ্তাহে একদিন সে আঁ আঁ করে সবাইকে বিরক্ত করে। কারণ ঐ দিন তার গানের টিচার আসেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে তাকে গান শেখান।
নীলু
My sister
Standard seven student
বুদ্ধি নেই। মন্দ। ঝগড়াটে স্বভাব। তার কোনো ভালো গুণ নেই।
দাদিয়া
My Grandma
Age: 75
Name : Fatima Begum
VERY GOOD LADY
দাদিয়া খুব ভালো। She is A+। দাদিয়া ছোটদের কখনো বকা দেন না। খুবই খারাপ। সবার ধারণা, উনি বেশি দিন বাঁচবেন না। কিন্তু আমি জানি দাদিয়া অনেক দিন বাচবেন। তবে দাদিয়া যেদিন মারা যাবেন সেদিন এই বাড়িতে মজার একটা ঘটনা ঘটবে। দাদিয়া যে লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমান সেই লেপ টুকরা টুকরা করে কেটে সবাইকে এক টুকরা করে উপহার দেয়া হবে। ঘটনাটা খুব অদ্ভুত লাগলেও অদ্ভুত না। কারণ দাদিয়ার লেপে আছে টাকা। তিনি যখনই টাকা পেয়েছেন, লেপের ভেতর সেলাই করে রেখে দিয়েছেন। সবাই মনে করে এই লেপে কম করে হলেও এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা আছে। কাজেই লেপের একটা টুকরা পাওয়া মানে অনেকগুলো টাকা পাওয়া। আমি যে টুকরা পাব সেখান থেকে টাকা বের করে লেগো কিনব।
বড় চাচা
My uncle
Name: Chowdhury Ajmol Hossain
VERY ANGRY PERSON
আমার বড় চাচা খুবই রাগী। রাগের জন্য নোবেল প্রাইজ দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে তিনি অবশ্যই নোবেল প্রাইজ পেতেন। He is A+ in hot temper। তবে তিনি যে রাগী তা তাকে দেখে বোঝা যায় না। কারণ তিনি সব সময় হাসি হাসি মুখ করে থাকেন।
বড় চাচা বাসায় যতক্ষণ থাকেন। ততক্ষণ বই পড়েন। তিনি থাকেন এই বাড়ির দোতলায়। এ জন্য ছোটরা কেউ দোতলায় যায় না। তিনি বিয়ে করেননি। ভাগ্যিস বিয়ে করেননি। বিয়ে করলে তার ছেলেমেয়ে হতো। সেই ছেলেমেয়েরা তাকে ভয় করত। এই পৃথিবীতে ভয় পাওয়া ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেড়ে যেত।
টগর এই পর্যন্ত পড়ে খাতা নামিয়ে পাপ-পুণ্য খাতাটা নিল। আড়াল থেকে বড় চাচার কথা শুনে যে পাপ করা হয়েছে, সেটা লিখে ফেলা দরকার।
পাপ নং ২১৩
আড়াল থেকে বড় চাচার কথা শুনেছি।
এর পাশেই সে লিখল :
পুণ্য নং ২১৩
আড়াল থেকে বড় চাচার কথা শোনার পর পাপ কাটান দেয়ার জন্য এই পুণ্যটা করা হবে। এখনো করা হয়নি। তবে আজই করা হবে। বড় চাচার ঘর থেকে যে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নেয়া হয়েছে সেটা কোনো এক ফাঁকে বড় চাচার ড্রয়ারে রেখে দেয়া হবে। তিনি হারানো ম্যাগনিফাইং গ্লাস পেয়ে আনন্দ পাবেন। এতে পুণ্য হবে। মানুষকে আনন্দ দেয়াতেই পুণ্য।
টগর পাপ-পুণ্যের খাতা থিফ বক্সে রেখে সাবধানে তার গোপন জায়গা থেকে বের হয়ে এল। সে ভেবেছিল তার জন্য বাড়িতে খোঁজাখুঁজি পড়বে। দেখা গেল সে রকম কিছু না। কেউ তাকে খুঁজছে না। সে নীলুর ঘরে গেল। নীলু আনন্দিত গলায় বলল, এই টগর, আমি অঙ্ক বইটা পেয়েছি।
টগর, বলল, কোথায় পেয়েছিস?
যেখানে হারিয়েছিলাম। সেখানেই পেয়েছি। আমার কী ধারণা জানিস? আমার ধারণা কোনো ভূতের কাণ্ড। এই বাড়িতে ভূত আছে। কাজের বুয়ারও তাই ধারণা। সে নাকি ভূত দেখেছে। আমি ঠিক করেছি একদিন প্লানচেট করে ভূত আনব।
কবে?
আমার পরীক্ষার পরে। ক্লাসের বন্ধুদের বলব। রাতে সবাই আমার সঙ্গে থাকবে। রাত বারোটার পর ভূত নামানো হবে। তুই থাকবি?
আমি ভূত-ফুত বিশ্বাস করি না।
ভূত যখন তোর কান মলে দেবে তখন বিশ্বাস করবি।
টগর বলল, আজ যে ছোট মামার বিচার হবে তুই জানিস?
নীলু বলল, জানি।
বিচার দেখবি না?
আমার বিচার দেখার শখ নেই। তা ছাড়া ছোটরা বিচারে থাকতেও পারবে না। বিচার-ফিচার আমার ভালোও লাগে না। আমি যে বইটা ফেরত পেয়েছি এতেই আমি খুশি।
নীলুকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে। নীলুর আনন্দ দেখে টেগরের ভালো লাগছে। নীলু যত আনন্দিত হবে টেগরের পুণ্য হবে তত বেশি। আজ মনে হয়। পাপের চেয়ে পুণ্য বেশি হয়েছে।
সন্ধ্যার পর বিচারসভা বসার কথা।
বিচারসভা বসতে বসতে আটটা বেজে গেল। খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা, টগরকে ডাকা হয়েছে বিচারসভায়। তার মতো ছোট মানুষকে বিচারসভায় কেন ডাকা হয়েছে কে জানে? টগর বসেছে বড় চাচার খাটে। ছোট মামাও একই খাটে বসেছেন। তবে অনেকখানি দূরে। তিনি এমনভাবে বসেছেন যে টগর তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না।
বড় চাচা আধশোয়া হয়ে তার বড় ইজিচেয়ারে বসেছেন। তার মাথার নিচে বালিশ। পায়ের ওপর পাতলা চাদর। আরাম আরাম ভাব।
টগরের বাবা-মা বসেছেন। পাশাপাশি বেতের চেয়ারে। চেয়ার দুটো বড় চাচার ঘরে থাকে না। বিচারসভা যখন বসে তখন আনা হয়। টগরের বাবার মনে হয় কোনো কাজ আছে। তিনি কিছুক্ষণ পর পর হাতের ঘড়ি দেখছেন। টগরের মা সুলতানা হাই তুলছেন। সুলতানা শুধু রান্নাবান্নার সময় হাই তোলেন না। অন্য যেকোনো সময় হাই তোলেন। সুলতানার চিন্তা-ভাবনা বিচারসভাতে নেই। তাঁর মন পড়ে আছে। মুরগির মিষ্টি কাবাবে। মিষ্টি কাবাব বানানো হয়েছে। তিনি ঠিক করে রেখেছেন বিচারসভা শেষ হওয়ার পর সবাইকে সেই কাবাব খেতে দেয়া হবে। বিচারসভার শেষে কাবাব খাওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকবে কি না এটা নিয়েই তিনি চিন্তিত।
টগরের বাবা বললেন, ভাইজান, বড়দের মধ্যে টগর কেন? ওকে যেতে বলি?
বড় চাচা বললেন, না। ওকে আমার প্রয়োজন।
এই বলেই তিনি চোখ বন্ধ করালেন। বাইরের কেউ উপস্থিত থাকলে মনে করত। উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাকে যারা ভালোমতো চেনে তারা জানে যে এটা তার একটা স্টাইল। জটিল কোনো কথা বলার আগে ঘুম ঘুম ভাব করবেন। হালকা নাকডাকা টাইপ শব্দও করবেন। সবাইকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে হঠাৎ ইজিচেয়ারে উঠে বসবেন।
টগর, সেই বিশেষ সময়ের অপেক্ষা করছে। তার ইচ্ছা করছে ছোট মামার মুখের ভাবটা দেখতে, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তার মুখ দেখা যাচ্ছে না এবং তিনি একবারও টগরের দিকে তাকাচ্ছেন না। টগর যেটা করতে পারে তা হচ্ছে সে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে উঠে এসে ছোট মামার পাশে বসতে পারে। কাজটা করা ঠিক হবে কি না সে বুঝতে পারছে না। বড় চাচা তাতে বিরক্ত হতে পারেন এবং বিরক্ত হয়ে বলতে পারেন, তোমার এখানে থাকার দরকার নেই। তুমি যাও, পড়াশোনা করো। টগর মনে-প্ৰাণে বিচারসভায় থাকতে চাচ্ছে।
ইজিচেয়ারে বড় চাচা হঠাৎ নড়ে উঠলেন। চোখ মেললেন। সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে দৃষ্টি স্থির করলেন টগরের মুখের ওপর।
গম্ভীর গলায় বললেন, টগর আছিস?
টগর, বলল, জি বড় চাচা।
তুই তোর ছোট মামা সম্পর্কে আমাকে গোপনে কী বলেছিস তা আবার বল, সবাই যেন শুনতে পায়।
টগর, হকচকিয়ে গেল। ছোট মামার হিমু হওয়ার সব খবর সে বড় চাচার কাছে সাপ্লাই করেছে। বড় চাচা যে এরকম মিটিং করে তার কথা ফাঁস করে দেবেন তা সে ভাবেনি। সবাই তাকাল তার দিকে। ছোট মামাও তাকালেন। তার চোখে বিস্ময়।
বড় চাচা বললেন, চুপ করে আছিস কেন, বল।
টগর বিড়বিড় করে বলল, ছোট মামা হিমু হয়ে গেছে।
কী হয়ে গেছে?
হিমু।
টগর লক্ষ করুল সবাই ছোট মামার দিকে তাকাচ্ছে। শুধু ছোট মামা তাকিয়ে আছে তার দিকে। বড় চাচা বললেন, হিমু হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা বল শুনি।
টগর, বলল, আমি বলব?
বড় চাচা বললেন, প্রথমে তুমি বলবে। তারপর হিমু সাহেবের মুখ থেকে শুনব। ইংরেজিতে একে বলে, লিসেনিং ফ্রম দি হর্সেস মাউথ।
টগর বলল, হিমুদের হলুদ পাঞ্জাবি পরতে হয়। আর খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়।
বড় চাচা বললেন, কেন?
টগর, বলল, কেন সেটা হিমুরা জানে। আমি তো হিমু না। আমি জানি না।
টগরের বাবা বললেন, ভাইজান, বাদ দিন তো। হিমু হওয়া মনে হচ্ছে বাচ্চাদের একটা খেলা।
বড় চাচা বললেন, বাচ্চাদের খেলা বলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তুমি বোধ হয় জানো না হিমু কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে এই বাড়ির ছাদে কয়েক টন মাটি তোলা হয়েছে।
কী বলছেন, ভাইজান?
বড় চাচা শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুভ্ৰ! কী পরিমাণ মাটি তোলা হয়েছে তুমি একটা আন্দাজ দিতে পারবে?
শুভ্র বলল, প্রতিদিন দুশ টাকা করে আমি দুজন লেবার রেখেছি। এরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাদে মাটি তুলেছে। কতটুকু মাটি হয়েছে আমি জানি না।
মাটি কেন তোলা হয়েছে?
জোছনা দেখার জন্য।
বুঝতে পারলাম না। একটু বুঝিয়ে বলো।
শুভ্র বলল, হিমুদের জোছনা দেখতে হয়। সাধারণ মানুষের জোছনা দেখা আর হিমুদের জোছনা দেখা এক না। তারা বিশেষভাবে জোছনা দেখে। যেমন পুকুরে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে শুধু মাথা বের করে জোছনা দেখে। কিংবা মাটিতে গর্ত করে সেই গর্তে মাথা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে জোছনা দেখে।
ছাদে মাটি নেয়া হচ্ছে গর্ত বানিয়ে জোছনা দেখার জন্য?
জি।
হলুদ পাঞ্জাবির ব্যাপারটা কী?
হলুদ হলো বৈরাগ্যের রঙ। আগুনের রঙ। আগুন যেমন খাদ পুড়িয়ে সোনাকে শুদ্ধ করে, এই পোশাকও তাই করে।
বড় চাচা হাত তুলে শুভ্রকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার যুক্তিতে ভুল আছে। আগুন শুধু খাদ পোড়ায় না। আগুন সব কিছুই পোড়ায়। আর তুমি বলছি হলুদ বৈরাগ্যের রঙ, আগুনের রঙ। আমি যদি বলি হলুদ বিষ্ঠার রঙ, তাহলে কি ভুল হবে? বিষ্ঠা কী তা নিশ্চয়ই জানো। বিষ্ঠা হলো গু। প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল গু। যার ইংরেজি নাম শিট।
টগরের খুবই হাসি পাচ্ছে। সে চেষ্টা করছে না হেসে থাকতে। বড়দের কথার মাঝখানে ছোটরা হেসে ফেললে বড়রা খুবই রাগ করে।
বড় চাচা বললেন, শুভ্ৰ, শোনো, তোমাকে আমি বুদ্ধিমান ছেলে হিসেবে জানতাম। স্মার্ট ছেলে হিসেবে জানতাম। তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি যে বুড়িগঙ্গার পানিতে ধুয়ে-মুছে চলে গেছে তা জানতাম না। তুমি নির্বোধের মতো আচরণ করছি।
শুভ্র বলল, হলুদ পাঞ্জাবি পরছি এই জন্যই কি আমি নির্বোধ?
খালি পায়ে হাঁটছ এই জন্য নির্বোধ। ময়লা-আবর্জনাভর্তি রাস্তাঘাট। এর মধ্যে খালি পায়ে হাঁটার অর্থ হলো, ইচ্ছা করে শরীরে ময়লা মাখা। বুঝতে পারছ কী বলছি?
শুভ্ৰ চুপ করে রইল। হঁহা-সূচক মাথা নাড়ল না। অর্থাৎ সে যে বোকামি করছে এটা বুঝতে পারছে না। বড় চাচা বললেন, হিমু ঘটনাটা কী আমি তা কিছুই বুঝতে পারছি না। যাই হোক শুভ্ৰ, তুমি যেটা করবে, হিমুর ঘটনাটা কী, তুমি কেন হিমু হতে চাচ্ছি—তা সুন্দর করে লিখে ফেলবে। আমি লেখাটা পড়ব। পড়ার পর তোমার সঙ্গে আরেকটা মিটিং হবে।
টগরের বাবা বললেন, ছাদে যে মাটি তোলা হয়েছে সেই মাটির কী হবে? বড় চাচা বললেন, মাটি অবশ্যই নামিয়ে ফেলা হবে। তবে এই মুহূর্তে না। হিমুর ব্যাপারটা আমি আগে জেনে নেই। তারপর।
শুভ্ৰ বলল, আমি কি এখন যেতে পারি?
বড় চাচা বললেন, হ্যাঁ, যেতে পারো।
সুলতানা বললেন, আমি মুরগির মিষ্টি কাবাব বানিয়েছিলাম। কাশ্মিরের রেসিপি। কাশ্মিরের হাউসবোটে এই কাবাব আমি খেয়েছিলাম। এখনো তার স্বাদ মুখে লেগে আছে। ওদের কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে এসেছি। কাবাব সার্ভ করে দেই? শুভ্ৰ! কাবাব খেয়ে তারপর যেখানে ইচ্ছা যা।
শুভ্ৰ সুলতানার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, আপা, তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি। তুমি মনে কষ্ট পাও এমন কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু হিমুরা সত্যি কথা বলে। তাতে যদি কেউ মনে কষ্টও পায় তারপরও বলে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক হিমুদের কাছে কোনো ব্যাপার না। আপা শোনো, তুমি যে পরীক্ষামূলক খাবারগুলো বানাও তার সবই অখাদ্য। কেউ খায় না। খাবারগুলো ফ্রিজে থাকে তারপর ফেলে দেয়া হয়। একটা দরিদ্র দেশের খাবার তুমি এইভাবে নষ্ট করতে পারো না। তোমার মািনরক্ষার জন্য তোমার এই অখাদ্য মিষ্টি মুরগির কাবাব অনেকেই মুখে দেবে। আমারও একটুকরা মুখে দেয়া উচিত। কিন্তু হিমুরা কারো মানরক্ষার জন্য কিছু করে না। আমি একটা টুকরাও মুখে দেব না।
টগর সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিও না। এবং বাবাও খাবে না।
টগরের বাবা ছেলের কথায় সায় দিয়ে দ্রুত মাথা নাড়লেন।
বড় চাচা ছোট্ট একটা পিস মুখে দিয়ে বললেন, খেতে খারাপ হয়নি তো! ভালোই হয়েছে। তবে মিষ্টি বেশি হয়েছে, আমার আবার ডায়াবেটিসের ভাব আছে। মিষ্টি খাওয়া ঠিক হবে না। এই বলে যে ছোট্ট পিসটা মুখে নিয়েছিলেন সেটা সিঙ্কে ফেলে দুবার কুলি করে ফেললেন।
টগরের বাবার সামনে যখন কাবাবের প্লেট ধরা হল তখন তিনি সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই বস্তু তুমি নিজে খেয়েছ?
সুলতানা বললেন, না।
তুমি খাওনি কেন?
যে রান্না করে সে খেতে পারে না।
চএর পর থেকে যে বস্তু তুমি রান্না করবে তা আগে নিজে আধা প্লেট খাবে তারপর সার্ভ করবে।
ছোট মামা ঠিক আগের জায়গায় ফিরে গেছেন। ঝিম ধরে বসে আছেন। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি রেগে আছেন। টগর খুব ভালো করে জানে রেগে যাওয়া মানুষের আশপাশে থাকা ঠিক না। তারপরও সে ছোট মামার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গলার স্বর যথাসম্ভব করুণ করে বলল, ছোট মামা, তুমি কি রাগ করেছ?
না।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছে।
তুই ঠিক ধরেছিস। মনের ভেতর থেকে রাগটা সরিয়ে দিয়েছি। শরীর থেকে সরাতে পারিনি। পুরোপুরি হিমু এখনো হতে পারিনি। পুরোপুরি যারা হিমু। হয় তারা কোনো কিছুতেই রাগ করে না।
টগর, বলল, কেউ যদি কোনো কারণ ছাড়া গালে ঠাস করে চড় মারে তাহলেও হিমুরা রাগ করে না?
আসল হিমুদের রাগ করা উচিত না।
তাদের কী করা উচিত?
যে চড় দিয়েছে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে এমন কিছু বলা উচিত যা শুনলে পিলে চমকে যায়।
সেটা কী রকম?
সেটা কী রকম এখন বলতে পারছি না। এখন মাথায় আসছে না। যাই হোক, তুই এখন আমার সামনে থেকে যা। আমাকে হিমুর ওপর একটা রচনা লিখতে হবে। পয়েন্টগুলো ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। তুই বাতি নিভিয়ে হাওয়া হয়ে যা।
মশার ওষুধ দেব, ছোট মামা? তোমাকে মশা কামড়াচ্ছে।
কামড়াক। মশা-মাছি প্রকৃতির অংশ। বেঁচে থাকার অধিকার তাদেরও আছে। আমরা যদি হাঁস-মুরগি মেরে রোজ খেতে পারি ওরা কেন আমাদের সামান্য রক্ত খেতে পারে না। মশার কামড়ে হিমুরা বিচলিত হয় না।
টগর আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, বাঘের কামড়ে কি হিমুরা বিচলিত হয়?
শুভ্ৰ জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল।
রচনার নাম ‘হিমু’
শুভ্ৰ ভেবেছিল বিশ থেকে পঁচিশ পৃষ্ঠার বিরাট এক রচনা লিখবে। রচনার নাম ‘হিমু’। রচনায় অনেক পয়েন্ট থাকবে। কবিতার উদ্ধৃতি থাকবে। উপসংহার থাকবে। লিখতে গিয়ে দেখল, সব এক পৃষ্ঠায় হয়ে গেছে। অনেক চিন্তা করেও এর বেশি সে কিছু লিখতে পারছে না।
চৌধুরী আজমল হোসেন শুভ্রের হাত থেকে লেখাটা নিলেন। পর পর দুবার পড়লেন। কিছুক্ষণ শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার পড়লেন।
হিমু।
কে, কী ও কেন
হিমু হলো উপন্যাসের একটি চরিত্র।
কী?
সে পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে। খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে।
কেন? হিমু সত্যের অনুসন্ধান করে। হলুদ পাঞ্জাবি এবং খালি পা তার বাইরের ব্যাপার। ভেতরে সে সত্য-অনুসন্ধানী।
শুভ্ৰ বলল, আমি যাই?
বড় চাচা বললেন, আচ্ছা যাও। তুমি কি নিশ্চিত হিমু সম্পর্কে যা বলার সব বলা হয়েছে? কিছু বাদ যায়নি?
একটা ব্যাপার শুধু বাদ পড়েছে।
সেটা কী?
হিমুদের কিছু সুপার ন্যাচারাল ক্ষমতা তৈরি হয়। তারা ভবিষ্যৎ বলতে পারে।
তুমি পারো?
না। কারণ আমি পুরোপুরি হিমু হতে পারিনি।
পারছ না কেন?
পারছি না কারণ হিমুর কর্মকাণ্ডগুলো আপনারা করতে দিচ্ছেন না। ছাদে গিয়ে জোছনা দেখতে পারছি না। কলঘরের হাউসে পানি ভর্তি করে সেই পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে থাকলেও কাজ হতো। সেটাও করা যাবে না।
হাউসের পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে থাকলে তুমি ভবিষ্যৎ বলতে পারবে?
পুরোপুরি হিমু হওয়ার দিকে এগোতে পারব। হিমু হয়ে যাবার পর অবশ্যই ভবিষ্যৎ বলতে পারব। ভবিষ্যৎ বলা হিমুদের জন্য কোনো ব্যাপার না।
বড় চাচা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলেন। তারপর গলা উচিয়ে বললেন, ঠিক আছে পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকে। ছাদে গর্ত খুঁড়ে বসে থেকে জোছনা দেখতে পারো। অনুমতি দিলাম। সুপার ন্যাচারেলে ক্ষমতা তৈরি হবার পর আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।
টগরের প্রাইভেট স্যার এসেছেন। স্যারের নাম রকিবউদ্দিন ভূইয়া। স্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন। রিটায়ার করার পর বড়লোকের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ান। তাকে গাড়িতে করে নিয়ে আসতে হয় এবং দিয়ে আসতে হয়। ঘড়ি দেখে তিনি এক ঘণ্টা দশ মিনিট পড়ান। দশ মিনিট বাড়তি পড়ানোর কারণ মাঝখানে তিনি দশ মিনিটের জন্য পড়া বন্ধ রাখেন। এই দশ মিনিট তিনি খুব ঠাণ্ডা (বরফ মেশানো) লেবুর শরবত খান। একটা পান খান। পান খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে থাকেন। এই সময় কোনোরকম শব্দ করা যাবে না।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া অতি কঠিন শিক্ষক। যখন হেডমাষ্টার ছিলেন তখন তার নাম ছিল পিসু-হেড়ু। কারণ তার হুঙ্কার শুনলে ছোট ক্লাসের ছাত্ররা প্যান্টে পিসু করে দিত। হেডমাষ্টার থেকে প্রাইভেট মাস্টার হওয়ার পর তাকে আর কেউ ভয় পায় না। ছাত্রদের ভয় দেখানোর অনেক চেষ্টা তিনি করেছেন (চোখ বড় বড় করে তোকানো, চাপা গলায় হুঙ্কার) কোনোটাতে কিছু
श्8 न्ा।
টগরের স্যার দশ মিনিটের ব্রেক নিয়েছেন। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে আছেন। তার চোখ ছাত্রের দিকে। তবে তিনি কিছু দেখছেন না। কারণ তার চোখ বন্ধ। শুধু মুখ নড়ছে। কারণ তিনি পান চিবোচ্ছেন। যদিও এই সময় তার সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ। তারপরও টগর কথা বলল, স্যার, আজকে কিন্তু আমাকে আগে আগে ছেড়ে দিতে হবে।
রকিবউদ্দিন চোখ মেললেন। চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, টগর, তোমাকে না বলেছি আমার রেস্ট পিরিয়ডে কোনো কথা বলবে না?
ভুলে গেছি, স্যার।
কেন তুলে গেছ?
স্যার, আজকে আমার মাথায় খুব টেনশন। আমার ছোট মামা হিমু হয়ে গেছেন। পানির হাউসে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন। এই জন্য আমার খুব টেনশন হচ্ছে। সব কিছু ভুলে যাচ্ছি।
টেনশন বানান করো।
T-E-N-S-I-O-N।
হয়েছে। এখন বলো তোমার ছোট মামা কী হয়েছেন?
হিমু হয়েছেন। পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
জি না। হিমু হয়েছেন। হিমু হলে এইসব করতে হয়। গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে থাকতে হয়। মাটিতে গর্ত করে গর্তে বসে জোছনা দেখতে হয়।
পাকা বেত দিয়ে দশটা বাড়ি দিলে ঠিক হয়ে যেত। দেশ থেকে বেত উঠে গেছে তো, এই জন্যই এত সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইংরেজিতে একটা বাগধারা আছে, স্পেয়ার দি ব্রড, স্পয়েল দি কিড়। গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবে বসে আছে! ফাজিল!
রকিবউদ্দিন প্রায় আবারো চোখ বন্ধ করলেন। চোখ বন্ধ করে চাপা গলায় স্কুলজীবনে তাঁর এই চাপা গলাটাই নিচের ক্লাসের ছাত্ররা বেশি ভয় পেত) বললেন, রেস্ট পিরিয়ডে তুমি আমাকে ডেকেছ এই জন্য তুমি আরো পনেরো মিনিট এক্সট্রা পড়বে। শাস্তি।
টগর বলল, জি আচ্ছা, স্যার।
ম্যাথ পড়াব।
জি আচ্ছা।
ম্যাথমেটিকস বানান করো।
M-A-T-H-E-M-A-T-I-C-S।
অ্যারিথমেটিকস বানান করো।
A-R-I-T-H-M-E-T-I-C-S।
হয়েছে। এখন বলো, ম্যাথমেটিকস এবং অ্যারিথমেটিকস—এই দুয়ের মধ্যে প্ৰভেদ কী?
জানি না স্যার।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া দুঃখিত গলায় বললেন, বেত মারার শাস্তি উঠে গেছে। শাস্তিটা যদি থাকত। তাহলে ম্যাথমেটিকস এবং অ্যারিথমেটিকসের প্রভেদ না জানার জন্য পাকা চিকন বেতের দুটো বাড়ি খেতে।
বেতের শাস্তি উঠে গেছে কেন, স্যার?
উঠে গেছে। কারণ পৃথিবী থেকে ভালো ভালো জিনিস সবই উঠে যাচ্ছে। আদব-কায়দা উঠে যাচ্ছে। মুরবিদের প্রতি সম্মান উঠে যাচ্ছে। শিক্ষকদের প্রতি ভয় উঠে যাচ্ছে। তার বদলে আসছে—ড্রাগ, গলা পর্যন্ত পানিতে শরীর ড়ুবিয়ে বসে থাকা। তোমার এই ছোট মামার সঙ্গে কথা বলা যাবে?
জি, যাবে।
কষে একটা থাপ্লড় দিতে পারলে ভালো হতো। এক থাপ্পিড়ে খবর হয়ে যেত। সেটা তো আর সম্ভব না। থাপ্পড়ের বদলে দু-একটা শক্ত কথা বলব। থাপ্পড়ের ইংরেজি কী?
স্ল্যাপ।
ম্যাপ বানান বলে।
S-L-A-Pl
হয়েছে। এখন থেকে পাঁচ মিনিট আমি চোখ বন্ধ করে রেস্ট নিব। পাচ মিনিট পর তুমি আমাকে ডাকবে।
জি আচ্ছা, স্যার।
হিমু যে হয়েছে তার নাম কী?
ওনার নাম শুভ্ৰ। গায়ের রঙ ফর্সা তো, এই জন্য তার নাম রাখা হয়েছে শুভ্র।
গায়ের রঙ কালো হলে কী নাম রাখত? কয়লা? যত সব ফাজলামি কথা। যাই হোক যাওয়ার সময় চিজটাকে দেখে যাব।
জি আচ্ছা, স্যার।
আর তোমার বাবাকে বলবে, আজ তোমাদের গাড়িটা আমার একটু বেশি সময়ের জন্য দরকার। বাসায় ফেরার সময় বড় মেয়ের বাসা হয়ে যাব।
জি আচ্ছা।
বড় মেয়েকে দেখতে যাব। এর ইংরেজি কী বলো?
আই উইল ভিজিট মাই এলডেষ্ট ডটার।
মোটামুটি হয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করছি, তুমি এই ফাঁকে তোমার বাবার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে রাখো। কোন পারমিশন বুঝতে পারছ তো? তোমাদের গাড়ি কিছুক্ষণ বেশি রাখব সেই পারমিশন।
বুঝতে পারছি, স্যার। পারমিশন বানান করতে হবে?
না, বানান করতে হবে না।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া ছাত্রের দিকে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন ।
টগরদের বাড়ির চৌবাচ্চাঘর মূলত কাপড় ধোয়া এবং বাসন মাজার কাজে ব্যবহার করা হয়। চৌবাচ্চা ভর্তি করা হয় পানিতে। সারা দিন সেই পানি ব্যবহার করা হয়। আজ দুপুর থেকে বাসন মাজা এবং কাপড় ধোয়া বন্ধ। চৌবাচ্চায় গলা ডুবিয়ে শুভ্র বসে আছে। কাজের মেয়েরা শুরুতে খুব উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। এখন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শুভ্র মামা চুপচাপ পানিতে বসে আছে এই দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না।
হেডমাষ্টার রকিবউদ্দিন ভূইয়া যখন টগরকে নিয়ে চৌবাচ্চাঘরে ঢুকলেন তখন রাত আটটা বাজে। তিনি শুভ্রকে দেখে কিছুক্ষণ। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। শুভ্র বলল, কেমন আছেন, স্যার?
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, ভালো। তুমি বয়সে অনেক ছোট, তোমাকে তুমি করে বলি—কোনো অসুবিধা আছে?
কোনো অসুবিধা নেই।
এসএসসি পরীক্ষায় তুমিই তো ফার্স্ট হয়েছিলে?
জি স্যার।
পেপারে ছবি দেখেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল চোখে সমস্যা আছে। চোখ তো দেখি ঠিক আছে।
জি স্যার!
কতক্ষণ ধরে পানিতে আছ?
সকাল নটার সময় নেমেছি, এখন বাজছে রাত আটটা—এগারো ঘণ্টা।
শীত লাগছে না।
প্রথম যখন নেমেছিলাম তখন শীত শীত লাগছিল। এখন লাগছে না।
আরাম লাগছে?
আরাম লাগছে না। আবার বেআরামও লাগছে না। সমান সমান অবস্থা।
পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে লাভ কী?
আপনি যে শুকনায় হাঁটাহঁটি করছেন তাতেই বা লাভ কী?
হেডমাষ্টার সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি সামান্য হ’কচাকিয়ে গেছেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শুভ্ৰ বলল, আশপাশের জগৎকে নানাভাবে অনুভব করা যায়। আমি পানির ভেতর বসে জগৎকে অনুভব করার চেষ্টা করছি।
ও!
আদিপ্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল পানিতে। সমুদ্রের পানিতে। যে কারণে আমাদের শরীরের পুরোটাই আসলে পানি। রক্তের ঘনত্ব এবং সমুদ্রের পানির ঘনত্বও এক। সমুদ্রের পানিতে যে অনুপাতে সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং পটাশিয়াম ক্লোরাইড থাকে, মানুষের রক্তেও ঠিক সেই অনুপাতেই সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং পটাশিয়াম ক্লোরাইড আছে। এই কারণেই মানুষ সব সময় পানিতে নামতে চায়।
ও!
পৃথিবীর প্রাচীন অনেক সভ্যতায় পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকার ব্যাপারটা আছে।
ও!
প্রাচীন ইনকা সভ্যতার কথা। আপনি নিশ্চয়ই জানেন। তারা তাদের সম্রাটকে জানত সূর্যের সন্তান হিসেবে। তারা বিশেষ বিশেষ দিনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত পানিতে গলা ডুবিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রপাঠ করত।
ও!
হিন্দুরা স্নানের সময় গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সূর্যমন্ত্র পাঠ করে।
জি আচ্ছা, স্যার।
আর তোমার বাবাকে বলবে, আজ তোমাদের গাড়িটা আমার একটু বেশি সময়ের জন্য দরকার। বাসায় ফেরার সময় বড় মেয়ের বাসা হয়ে যাব।
জি আচ্ছা।
বড় মেয়েকে দেখতে যাব। এর ইংরেজি কী বলো?
আই উইল ভিজিট মাই এলড়েষ্ট ডটার।
মোটামুটি হয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করছি, তুমি এই ফাঁকে তোমার বাবার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে রাখে। কোন পারমিশন বুঝতে পারছ তো? তোমাদের গাড়ি কিছুক্ষণ বেশি রাখব সেই পারমিশন।
বুঝতে পারছি, স্যার। পারমিশন বানান করতে হবে?
না, বানান করতে হবে না।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া ছাত্রের দিকে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
টগরদের বাড়ির চৌবাচ্চাঘর মূলত কাপড় ধোয়া এবং বাসন মাজার কাজে ব্যবহার করা হয়। চৌবাচ্চা ভর্তি করা হয় পানিতে। সারা দিন সেই পানি ব্যবহার করা হয়। আজ দুপুর থেকে বাসন মাজা এবং কাপড় ধোয়া বন্ধ। চৌবাচ্চায় গলা ড়ুবিয়ে শুভ্র বসে আছে। কাজের মেয়েরা শুরুতে খুব উকিঝুকি দিচ্ছিল। এখন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শুভ্র মামা চুপচাপ পানিতে বসে আছে এই দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না।
হেডমাষ্টার রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া যখন টগরকে নিয়ে চৌবাচ্চাঘরে ঢুকলেন তখন রাত আটটা বাজে। তিনি শুভ্ৰকে দেখে কিছুক্ষণ। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। শুভ্ৰ বলল, কেমন আছেন, স্যার?
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, ভালো। তুমি বয়সে অনেক ছোট, তোমাকে তুমি করে বলি—কোনো অসুবিধা আছে?
কোনো অসুবিধা নেই।
এসএসসি পরীক্ষায় তুমিই তো ফার্স্ট হয়েছিলে?
জি স্যার।
পেপারে ছবি দেখেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল চোখে সমস্যা আছে। চোখ তো দেখি ঠিক আছে।
ও!
স্যার, আপনাকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। কী নিয়ে চিন্তা করছেন?
হেডমাষ্টার সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, তুমি পানিতে কতক্ষণ থাকবে?
শুভ্র বলল, কতক্ষণ থাকব কোনো ঠিক নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে উঠে পড়তে পারি। আবার ধরুন মাসখানেকও থাকতে পারি।
ও!
হিমুদের কাছে সময় বলে কিছু নেই। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সব তাদের কাছে একাকার।
ও!
হেডমাস্টার সাহেব তাকিয়ে আছেন। শুভ্র বলল, স্যার, আপনি কি কিছু বলবেন?
হেডমাষ্টার সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, কী বলব বুঝতে পারছি না। মনে হয় কিছু বলার ছিল।
বলুন।
মনে পড়ছে না।
মনে পড়লে বলবেন। আমি পানিতেই আছি।
ও!
শুভ্র বলল, জলচিকিৎসার নাম কি শুনেছেন?
ও!
প্রাচীন ভারতে জলচিকিৎসার ব্যাপার ছিল। বৈদিক চিকিৎসকরা জলচিকিৎসার ব্যবস্থা দিতেন। অনেক ক্রনিক ব্যাধি এই চিকিৎসায় আরাম হতো। ইউনানী চিকিৎসায় রক্তক্ষরণ ব্যবস্থা যেমন ছিল, জলচিকিৎসাও ছিল। ইউনানী চিকিৎসা কী বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। গ্রিক চিকিৎসা।
জলচিকিৎসায় বাত কি সারে?
বাত ব্যাধি অবশ্যই সারে।
কতক্ষণ থাকতে হয় পানিতে?
যত বেশি সময় থাকবেন, চিকিৎসা ততই ভালো হবে। জলের প্রাণীরা দীর্ঘায়ু হয় এটা তো নিশ্চয়ই জানেন?
জানি না তো।
কচ্ছপের কথা। ধরুন। কচ্ছপ তিন শ সাড়ে তিন শ বছর বাঁচে। পানিতে বাস করে বলেই বাঁচে।
হুঁ।
স্যার, আপনার কি বাত আছে?
গেঁটেবাত আছে।
জলচিকিৎসার ব্যাপারটা মাথায় রাখতে পারেন, স্যার।
হুঁ।
রকিবউদ্দিনকে খুবই চিন্তিত মনে হলো। টগর তাকে গাড়ি পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে গেল। রকিবউদ্দিন টগরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছোট মামার কথা রাখতেও পারছি না। আবার ফেলে দিতেও পারছি না। চিন্তার উদ্রেককারী বিষয়।
টগর বলল, জি স্যার, চিন্তার উদ্রেককারী।
চিন্তার উদ্রেককারী ইংরেজি কী?
জানি না স্যার।
থট প্রভোকিং। তুমি পড়ার টেবিলে যাও, থট প্রভোকিং এই সেনটেন্সটা পঞ্চাশবার লেখো। তাহলে আর ভুলবে না। প্রভোক থেকে এসেছে প্রভোকিং। প্রেজেন্ট কনটিনিউয়াস। ডিকশনারি থেকে প্রভোক বানান শিখে রাখবে।
জি আচ্ছা, স্যার।
টগর, পঁচিশবার থট প্রভোকিং লেখার সময় তার দাদিয়া তাকে ডেকে পাঠালেন।
দাদিয়া বাঁশের চোঙায় পান ছেঁচছিলেন। টগরকে দেখে পান ছেঁচা বন্ধ করে বললেন, এইসব কী শুনতাছি?
টগর বলল, কী শুনছ?
তোর ছোট মামার নাকি মাথা আউল হইছে। পানির মধ্যে ড়ুব দিয়া আছে।
মাথা আউলা হয়নি দাদিয়া। উনি হিমু হয়েছেন।
টগরের দাদিয়ার মাথায় একবার যে কথা ঢুকে যায় সেটাই থাকে। কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে তা দূর করা যায় না। তিনি পান ছেঁচতে ছেঁচতে বললেন, মাথা কি পুরোপুরি গেছে?
মাথা ঠিক আছে, দাদিয়া।
ছোটবেলায় দেখছি আমরার গোরামের জলিল মুনশির মাথা খারাপ হইছিল। হে অবশ্যি পানিত থাকত না। সারা শইল্যে প্যাঁক মাইখ্যা বইস্যা থাকত। প্যাঁক চিনস?
চিনি।
তরার শুদ্ধ ভাষায় প্যাঁকরে কয় কেদো।
কেদো না দাদিয়া, কাদা।
ওই একই কথা। কেদো আর কাদা একই জিনিস। তারপর শোন, জলিল মুনশি কী করত। কেউ তার ধার দিয়া গেলে সুন্দর কইরা বলত, ভাইসব, একটু প্যাঁক খাইবেন? খাইয়া দেখেন সোয়াদ আছে। কিছু আমার সামনে বইস্যা খান আর কিছু বাড়িতে নিয়া যান। পুলাপানরে দিবেন।
টগর বলল, কেউ কি সেই কাদা খেত?
দাদিয়া নড়েচড়ে বসলেন। ছেঁচা পান খানিকটা মুখে দিয়ে বললেন, অখন শোন আসল গল্প। মানুষ জাত বড়ই আজব জাত। একজন দুইজন কইরা সেই প্যাঁক খাওয়া শুরু করল।
কেন?
তারা ভাবল জলিল মুনশি পীর হইয়া গেছে। পীর-ফকির এই করম করে। মাইনষেরে প্যাঁক-কাদা গু-গোবর খাইতে বলে। বছর না ঘুরতেই জলিল মুনশির নাম হইল প্যাঁক বাবা। দূর-দূরান্তের মানুষ তার কাছ থাইক্যা প্যাঁক নিতে আসে। তার সামনে বসে প্যাঁক খায়। মাটির হাঁড়িতে কইরা প্যাঁক নিয়া যায় পুলাপানরে খাওয়াইতে।
বলো কী।
দুনিয়া বড় আজবরে টগর। দুনিয়া বড় আজব। দুনিয়া আজব। দুনিয়ার মানুষ তারচেয়েও বড় আজব।
দাদিয়া, প্যাঁক বাবা কি এখনো মানুষকে প্যাঁক খাওয়াচ্ছেন?
আরে না। অনেক দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে তার কবরে মাজার শরিফ করেছে। লোকে বলে প্যাঁক বাবার মাজার। চৈত্র মাসের সাত তারিখ উরস হয়। উরসের দিন প্যাঁক বাবার ভক্তদের জন্য বিরাট পিতলের হাঁড়িতে তেল মরিচ, পেঁয়াজ রসুন দিয়া মাটি রান্না হয়। ভক্তরা ভক্তি নিয়া খায়।
তুমি কোনো দিন খেয়েছ দাদিয়া?
আমি কি বোকা যে মাটি খাব। তয় তোর দাদা খেয়েছে। তার কাছে শুনেছি খাইতে নাকি ভালো। মাষকলাইয়ের ডাইলের মতো স্বাদ।
টগর বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, আরেকটা গল্প বলো দাদিয়া।
টগরের দাদিয়া অতি বিরক্ত হয়ে বললেন, বিনা অজুতে বিছানায় উঠছস। নাম বিছনা থাইক্যা। অনেক গফ করছি। আর না।
সুলতানা বেশি রাত জগতে পারেন না। নটা থেকে তার হাই উঠতে থাকে। চেষ্টা করেন সাড়ে নটার মধ্যে শুয়ে পড়তে। বেশির ভাগ সময়টা বিছানায় যেতে রাত দশটা বেজে যায়। আজ এগারোটা বেজে গেছে। তিনি এখনো ঘুমুতে যেতে পারেননি। কারণ শুভ্র এখনো চৌবাচ্চার পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছে। রাতের খাবার সেখানেই খেয়েছে।
টগরের বাবা আলতাফ হোসেন শুভ্রের চৌবাচ্চার ব্যাপারটা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মোটামুটি বড় ধরনের ঝগড়া করেছেন। ঝগড়া শুরু হয়েছে খাবার টেবিলে। সূত্রপাত করেছে টগর। তিনি দেখলেন টগর কিছু খাচ্ছে না। তিনি তার স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বললেন, বাবা তুমি খাবে না?
টগর, বলল, না।
খাবে না কেন?
খিদে হয়নি?
টগর, বলল, আমি ছোট মামার সঙ্গে চৌবাচ্চায় ডিনার করব। আলতাফ হোসেন সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে বললেন, সে কি এখনো চৌবাচ্চায়? এখনো পানিতে খাবি খাচ্ছে?
টগর বলল, খাবি খাচ্ছে না বাবা। পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন।
এই যন্ত্রণা কতক্ষণ চলবে?
টগর বলল, এখনো বলা যাচ্ছে না, বাবা। তিন-চার মাসও চলতে পারে। হিমুদের তো কোনো টাইম টেবিল নেই।
নীলু ভাত মাখতে মাখতে বলল, তিন-চার মাস পানিতে থাকলে মামার গায়ে মাছের মতো আঁশ গজিয়ে যাবে, তাই না। বাবা?
আলতাফ হোসেন জবাব দিলেন না। তিনি খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন। নীলু বলল, আচ্ছা বাবা, ছোট মামা যদি চার মাস পানিতে থাকে, তাহলে কি গিনেজ বুক অব রেকর্ডে মামার নাম উঠবে?
আলতাফ হোসেন বললেন, উঠবে কি না জানি না, তবে পাগলামির যদি কোনো বুক অব রেকর্ডস থাকে। সেখানে অবশ্যই উঠবে। তোমার বড় চাচা কি জানেন সে এখনো পানিতে?
টগর বলল, জানেন। উনি রাত আটটার সময় একবার দেখে এসেছেন।
কিছু বলেননি?
না।
কিছুই বলেননি?
বড় চাচা শুধু বলেছেন, কেমন চলছে জল-খেলা?
ছোট মামা বলেছেন, ভালো চলছে।
আলতাফ হোসেন গভীর মুখে খাওয়া শেষ করলেন। শোয়ার ঘরে গিয়ে সুলতানাকে বললেন, কিছু মনে কোরো না, পাগলামিটা কি তোমাদের বংশগত ব্যাধি?
সুলতানা বললেন, তার মানে?
এই যে একজন গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে আছে। শোনা যাচ্ছে সে এই অবস্থায় চার মাস থাকবে।
সুলতানা বললেন, শুভ্ৰ এই কাজটা করছে বলে তুমি পুরো বংশ তুলে গালি দেবো? শুভ্র ছাড়া আর কেউ কোনো পাগলামি করেছে। আমি করেছি?
তুমি তো বলতে গেলে প্রতিদিনই করো।
প্রতিদিন কী কবি?
মাংসের হালুয়া বানাও। মাছের মিষ্টি মোরব্বা। রসগোল্লা দিয়ে ঝাল তরকারি। কাঁচা মরিচের আইসক্রিম।
সুলতানা। থমথমে গলায় বললেন, কবে করলাম এইসব?
রোজই তো করো। মাথার দোষ না থাকলে কেউ এই জাতীয় রান্না করতে পারে না। সুস্থ মাথায় এ ধরনের রেসিপি আসতে পারে না।
আমি অসুস্থ, আমি মেন্টাল পেশেন্ট আর তোমরা সবাই সুস্থ?
আলতাফ হোসেন জবাব দিলেন না। তার ক্ষীণ সন্দেহ হলো, রাগারগিটা বেশি হয়েছে। সুলতানা বললেন, জবাব দিচ্ছ না কেন? আমি এবং আমার ভাই আমরা দুজন উন্মাদ আর তোমরা সুস্থ মাথা সুস্থ মনের অধিকারী একদল সুপার হিউমেন বিয়িং। তোমাদের মতো সুপার মানুষদের সঙ্গে তো আমার বাস করা সম্ভব না। আমি এক্ষুনি বিদায় হচ্ছি।
কোথায় যাবে?
কোনো একটা পাগলা-গারিদ খুঁজে বের করব। পাগলা—গারদে ভর্তি হয়ে যাব। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো।
রাতদুপুরে কোথায় যাবে? পাগলামি কোরো না তো।
আমি পাগল, আমি তো পাগলামি করব। তোমার মতো সুস্থামি করতে পারব না। গাড়ি বের করতে বলো।
তুমি বলো। আমাকেই ড্রাইভার ডেকে আনতে হবে কেন।
বেশ, আমিই বলছি। আপনার বিশ্বাস না হলে টগর আর নীলুকে জিজ্ঞাস করুন। ওদের সামনেই বলেছে। সুলতানা গাঁটগট করে শোয়ার ঘর থেকে বের হলেন। পনেরো মিনিটের মধ্যে সুটকেস গুছিয়ে তার শাশুড়ির কাছে বিদায় নিতে গেলেন। সুলতানা কঁদো কঁদো গলায় বললেন, মা আমি চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। পায়ের কাছে মাথা কুটলেও ফিরব না। আমাকে কিনা পাগল বলে।
ফাতেমা বেগম অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে কে পাগল বলেছে?
টগরের বাবা বলেছে।
ফাতেমা বেগম উৎসাহিত গলায় বললেন, তাহলে শোনো এক পাগলের গফ। নাম জালাল মুনশি। পরে তার নাম হয়ে গেল প্যাঁক বাবা পীর। আমি তখন ছোট…
সুলতানা বললেন, মা, এই গল্প আমি অনেক দিন শুনেছি। আর শুনতে পারব না। গল্প শোনার মুড আমার নেই। আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি।
আচ্ছা মা, যাও আল্লাহ হাফেজ।
সুলতানা টগর ও নীলুর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ধরা গলায় বললেন, বাবারা শোনো, আমি চলে যাচ্ছি। এই বাড়িতে আবার ফিরে আসব সেই সম্ভাবনা নাই বললেই হয়। তোমরা ভালো থেকো। ঠিকমতো পড়াশোনা কোরো। দুইজনই লক্ষ্মী হয়ে থাকবে। কেমন?
টগর বলল, তুমি এখন যাবে?
হ্যাঁ, এখনি যাব। তোমরা দুই ভাইবোন। যদি এখন আমাকে আটকাবার জন্য কান্না শুরু করো তাতেও লাভ হবে না। আমি ফাইন্যাল ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি। বাবারা কান্দবে না। প্লিজ।
টগর ও নীলু দুজনের কারোরই কান্না আসছে না। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া মায়ের জন্য নতুন কিছু না। মাসে এক-দুইবার এই ঘটনা ঘটবেই। একই ঘটনার ফল দুই ভাইবোনের জন্যই শুভ। মা বাড়ি ছেড়ে গেলে পরদিন স্কুলে যেতে হয় না। টগরের স্কুল যে খুব অপছন্দ তা না, তবে আগামীকাল স্কুলে যেতে না হলে খুব ভালো হয়। আগামীকাল চৌবাচ্চায় ছোট মামার দ্বিতীয় দিন পার হবে। দ্বিতীয় দিনে অনেক মজা হওয়ার কথা।
সুলতানা বললেন, যাই বাবারা?
দুই ভাইবোন একসঙ্গে বলল, আচ্ছা।
আনন্দে তাদের চোখ চিকমিক করছে।
সুলতানা বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে শুভ্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
শুভ্ৰ চৌবাচ্চার দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছে। তার হাতে একটা ইংরেজি বই। বইটার নাম Straw Dogs. সে বেশ মন দিয়ে বই পড়ছে। বই পড়ার সুবিধার জন্য একটা টেবিল ল্যাম্প আনা হয়েছে।
সুলতানা কলঘরে ঢুকে কড়া চোখে শুভ্রের দিকে তাকালেন। শুভ্র বলল, এই ভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
সুলতানা বললেন, তুই কি পানিতেই থাকিবি উঠবি না?
শুভ্ৰ বলল, কেন উঠাব না। অবশ্যই উঠব।
কখন উঠবি?
সময় হলেই উঠব। এখনো সময় হয়নি।
সময় কখন হবে?
তা বলতে পারছি না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছ। সমস্যা কী? তোর কারণে তোর দুলাভাই আমাকে পাগল বলেছে।
শুভ্র বলল, এতে তো রাগ করার কিছু নেই। তোমার কারণে যদি দুলাভাই তোমাকে পাগল বলতেন তাহলে রাগ করার বিষয় থাকত।
সুলতানা বললেন, তুই যে কী পরিমাণ যন্ত্রণা করছিস তা তুই জানিস না।
শুভ্র বলল, আমি তো কোনো যন্ত্রণাই করছি না। নিজের মনে পানিতে বসে আছি। তোমরা গায়ে পড়ে যন্ত্রণা টেনে আনছ।
শুধুমাত্র তোর কারণে আমি আজ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ঐ বাড়িতে আর ফিরব না।
শুভ্ৰ হেসে ফেলল।
সুলতানা বললেন, হাসছিস কেন?
হাসছি কারণ তুমি কাল দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসবে। তোমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া এবং বাড়িতে ফিরে আসা রুটিন কর্মকাণ্ড।
আমার সবই রুটিন আর তোর সব কিছু রুটিন ছাড়া?
শুভ্ৰ মিষ্টি করে হাসল।
সুলতানা বললেন, হাসবি না। আমার কথার জবাব দে।
শুভ্র বলল, জবাব দেব না। কারণ তুমি রেগে আছ। হিমুরা রাগত মানুষদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে না। তারা রাগত মানুষদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।
শুভ্ৰ আবারো হাসল।
সুলতানা কলঘর থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে উঠলেন।
চৌধুরী আজমল হোসেন
আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাতটা পঁচিশ মিনিট।
চৌধুরী আজমল হোসেন ঝিম ধরে তার বিখ্যাত ইজিচেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে (ইজিচেয়ারের হাতলে) এক কাপ চা। তিনি এখনো চায়ের কাপে চুমুক দেননি। চা ঠাণ্ডা হয়ে উপরে সব পড়ে গেছে। ইজিচেয়ারের অন্য হাতলে আজকের খবরের কাগজ। সেই কাগজের ভাঁজ এখনো খোলা হয়নি।
প্রথম কাপ চা খাওয়ার ঠিক আধঘণ্টা পরে তিনি দ্বিতীয় কাপ চা খান। সাতটা ত্ৰিশ মিনিটে কাজের মেয়ে সফুরা দ্বিতীয় চা নিয়ে ঢুকল। তিনি সফুরার দিকে তাকিয়ে বললেন, শুভ্ৰ কি এখনো পানিতে?
সফুরা ভীত গলায় বলল, জি খালুজান।
কী করে?
চা খায়।
সারা রাত পানিতে ছিল?
জি।
রাতে ভাত খেয়েছিল?
জি না, রুটি মাংস। আপনার নাশতা কখন দিব খালুজান?
আজ কী বার?
বিষ্যুদবার।
বৃহস্পতিবারে কি আমি নাশতা খাই?
জে না। খালুজান আমার ভুল হয়েছে।
মানুষ ভুল করবেই। ভুল থেকে মানুষ শিখবে সেটা হলো মানবধর্ম। তুমি ভুল করেই যাচ্ছ। ভুল থেকে কিছু শিখতে পরছ না। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তুমি যাও।
বৃহস্পতিবার চৌধুরী আজমল হোসেনের উপাস দিবস। সপ্তাহে একদিন তিনি এই উপাসব্রত পালন করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কিছু খান না।
দুপুরে একটা কলা এবং এক স্নাইস রুটি খান। রাতে চায়ের কাপে এক কাপ দুধ।
শুক্রবার তার মৌন দিবস। এই দিবসে সূর্য উদয় থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত তিনি কারো সঙ্গে কথা বলেন না। গত দু বছর ধরে এই জিনিস চলছে।
সফুরা বলল, চা কি ফিরত নিয়া যামু খালুজান?
বৃহস্পতিবারে দুপুরের আগে কখনো কিছু খেয়েছি?
জে না।
তাহলে তুমিই বলো ইজিচেয়ারের হাতলে কাপের পর কাপ জড়ো করার কোনো যুক্তি আছে? ঠিক আছে তুমি যাও।
সফুরা পালিয়ে বাঁচল। চৌধুরী আজমল হোসেন আরো কিছুক্ষণ ঝিম-ধরা ভাব নিয়ে চেয়ারে বসে থাকলেন। শুভ্রর সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। কী বলবেন তা মাথায় গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন। একটা বুদ্ধিমান ছেলে কোনোরকম কারণ ছাড়া পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে আছে। এই বিষয়টা তঁাকে প্রচণ্ড বিরক্ত করছে। বিরক্ত মানুষ লজিক দিতে পারে না। তাকে লজিক দিয়ে শুভ্রকে তার হাস্যকর কাণ্ডকারখানা বুঝিয়ে দিতে হবে। এলোমেলোভাবে শুভ্রর সঙ্গে কথা বললে হবে না। নিজেকে তার খানিকটা এলোমেলো লাগছে।
সাতটা চল্লিশ মিনিটে তিনি ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠলেন। তিনি নিজেকে পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছেন।
শুভ্ৰ চৌবাচ্চায় পা ছড়িয়ে বসে বেশ আরাম করেই চা খাচ্ছে। সে টগরের বড় চাচার দিকে হাসিমুখে তাকাল।
শুভ্র, কেমন আছ?
জি, ভালো আছি।
রাতে পানিতেই ছিলা?
জি।
ঘুম ভালো হয়েছে?
ঘুম ভালো হয়নি। হওয়ার কথাও না। ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়েছে। তবে শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই।
তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলার জন্য এসেছি। তোমার কি সময় আছে?
অবশ্যই আছে। আপনি বসুন। আপনি আসবেন, আমি জানতাম। আমি আপনার জন্য চেয়ার আনিয়ে রেখেছি।
চৌধুরী সাহেব ভুরু কুঁচকে দেখলেন চৌবাচ্চার ডান দিকে একটা বেতের চেয়ার। ইজিচেয়ার ছাড়া এই একটি চেয়ারেই তিনি বসেন। তিনি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকার এই ব্যাপারটা যে হাস্যকর তা কি তোমার মনে হয় না?
শুভ্র বলল, সব মানুষই এমন কিছু কাজ করে যা অন্যের কাছে হাস্যকর মনে হয়।
উদাহরণ দাও।
আপনাকে দিয়েই উদাহরণ দিই। আপনি মৌন দিবস করেন, উপাস দিবস পালন করেন, এসব দিবস পালন অন্যের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে।
আমি এসব দিবস উদ্দেশু নিয়ে পালন করি। শরীরের পরিপাক যন্ত্রকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য উপাস দিবস। মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার জন্য মৌন দিবস। তোমার এই পানি দিবসের উদ্দেশ্য কী?
এটা ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে ফেলে, শরীরে ও মনে তার প্রভাব লক্ষ্য করাই আমার উদ্দেশ্য।
কিছু লক্ষ্য করেছ?
জি।
কী লক্ষ্য করলে তুমি বলো আমি শুনি।
আমি লক্ষ্য করছি যে আমার শরীর হালকা হয়ে যাচ্ছে। ওজন কমে যাচ্ছে।
তার মানে কী?
এটা ব্যক্তিগত অনুভূতির ব্যাপার। অনুভূতি আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না।
তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতে চাচ্ছি।
বুঝতে হলে আমার অবস্থানে আপনাকে আসতে হবে।
পানিতে নামতে বলছ?
জি।
আজমল হোসেন উঠে দাঁড়ালেন। তার মেজাজ খুবই খারাপ, তারপরও নিজেকে সামলালেন। শান্ত গলায় বললেন, এই বিষয়ে পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
টগর ও নীলুনাশতা খেতে বসেছে। দুজনই আনন্দিত। আজ তাদের স্কুলে যাওয়া বাতিল হয়েছে। মা বাড়িতে নেই। নটা-সাড়ে নটার মধ্যে বাবাও থাকবেন না। নীলু। তার প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছে। সারা দিন টিভি অন থাকবে এবং কার্টুন চ্যানেল চলতে থাকবে, তবে সে যে সারা দিন কার্টুন দেখবে তা না। যখন ইচ্ছা! হবে দেখবে, ইচ্ছা না হলে চলে যাবে। গল্পের বই পড়বে। মায়ের ওয়ারড্রোব থেকে একটা শাড়ি এনে পরবে। সফুরা বুয়া পরিয়ে দেবে। ঠোটে লিপষ্টিক দিয়ে সাজবে। তার কানে এখনো ফুটো করা হয়নি। ফুটো থাকলে কানো দুল পরত। নীলুর হঠাৎ মনে হলো, ফুটো করে ফেললে কেমন হয়?
টগরকে বললে সে একটা না একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে। এসব ব্যাপারে তার খুব মাথা খেলে।
টগর, আজ সারা দিন কী করবে তা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি। তবে বেশির ভাগ সময় ছোট মামার সঙ্গে কাটাবে তা প্ৰায় নিশ্চিত। তার ইচ্ছা ছোট মামার সঙ্গে পানিতে নেমে যাওয়া। মা থাকলে নামা যেত না। এখন সেই সমস্যা নেই। পানিতে বসে গল্পের বই পড়তে পারলে ভালো হতো। একটা কোনো বুদ্ধি কি বের করা যায় যে, গল্পের বইটা পানিতে ড়ুবিয়ে রাখা যাবে কিন্তু বই নষ্ট হবে না।
দাদিয়ার ঘরে হৈচৈ হচ্ছে। ছোটখাটো সমস্যাতেই হৈচৈ হয়। আজ মনে হয় বড় কোনো সমস্যা। দাদিয়া সমানে চিৎকার করছেন। টগর নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল, দাদিয়ার কী হয়েছে?
নীলু বলল, তার পান ছেচার যন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
যন্ত্রটা তো সব সময় তার বালিশের কাছেই থাকে। এটা কে নিবে?
নীলু বলল, আমাদের বাড়িতে ভৌতিক কিছু আছে। কয়েক দিন পরে এই যন্ত্রটাই অন্য কোনোখানে পাওয়া যাবে। তোমার মনে নাই দাদিয়ার দাঁত পাওয়া যাচ্ছিল না, তারপর পাওয়া গেল বড় চাচার দ্রুয়ারে। এইগুলা সব ভূতের কাণ্ড।
টগর বলল, ভূত এরকম করবে। কেন?
নীলু বলল, ভূতরা এসব করে খুব মজা পায়। মানুষদের ঝামেলায় ফেলতে পারলেই তাদের আনন্দ।
ছোট চাচার কাছে যাওয়ার আগে টগর দাদিয়ার ঘরে উঁকি দিল। করুণ মুখ করে বলল, দাদিয়া, কী হয়েছে?
দাদিয়া চেঁচিয়ে উঠলেন, দেখ না কী হইছে, চোর। আমার পান-ছেঁচনি নিয়া গেছে।
টগর, বলল, তোমার ঘর ভর্তি এত ভালো ভালো জিনিস। সব ফেলে চোর কেন তোমার পান-ছোঁচনি নিবে?
চোর কী জন্য নিছে সেইটা চোর জানে। আমি কী জানি?
কখন থেকে পাও না?
সকালে একবার পান খাইলাম, তার পরে আর নাই। যা এখন সামনে থাইক্যা যা। অখন কেউ কথা কইলেই ত্যক্ত লাগে। সারা দিন পান না
টগর, বড় চাচার ঘরে উঁকি দিল। আজ বুধবার বড় চাচার উপাস দিবস এটা টগরের মনে আছে। উপাস দিবসে বড় চাচার মেজাজ খারাপ থাকে। টগরের ধারণা মেজাজ খারাপ থাকার কারণ চা না খাওয়া। দাদিয়ার যেমন পান খেতে না পারলে মেজাজ খারাপ থাকে, বড় চাচারও সে রকম চা খেতে না পারায় মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ মানুষের ঘরে না ঢোকা ভালো। বৃহস্পতিবার বড় চাচার ঘরে ঢুকতে তার ভালো লাগে। সেদিন তার মৌন দিবস। ঘরে ঢুকে হৈচৈ করলেও বড় চাচা কিছু বলেন না। মাঝে মাঝে শুধু রাগী চোখে তাকিয়ে থাকেন। হাত ইশারা করে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলেন। টগর এমন ভঙ্গি করে যেন সে ইশারা বুঝতে পারছে না।
সে বড় চাচার ঘরে উঁকি দিল। বড় চাচা সঙ্গে সঙ্গে ডাকলেন, টগর।
টগর বলল, জি।
এসো, ভেতরে এসো।
টগর ঘরে ঢুকল।
বড় চাচা বললেন, তোমার ছোট মামার সঙ্গে কি আজ সকালে তোমার
দেখা হয়েছে?
টগর বলল, জি না।
তোমার এত খাতিরের মানুষ। সকাল থেকে পানিতে পড়ে আছে, এখনো দেখা করনি কারণটা কী?
টগর, বলল, মা নিষেধ করে গেছেন।
টগরের এই কথাটা মিথ্যা। মা কিছুই বলে যাননি। টগর যে এখনো ছোট মামার কাছে যায়নি তার কারণ আছে। দাদিয়ার পান-ছেচনি ছোট মামার চৌবাচ্চায় ড়ুবে আছে। সেটা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত চৌবাচ্চার ধারে-কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। কাজটা টগর করেছে গত রাতে। দাদিয়ার পানের ছেচনি অতি গোপনে চৌবাচ্চায় ফেলে এসেছে। দাদিয়া টের পাননি। ছোট মামাও বুঝতে পারেননি।
টগরের এই কাজের একটাই উদ্দেশ্য, মজা করা। পান-ছেচনি কোথাও নেই, পাওয়া গেল চৌবাচ্চায়। সেখানে গেল কীভাবে? সবাই তা নিয়ে নানান গবেষণা করবে। গবেষণা করে কিছুই বের করতে পারবে না। মজা এইখানেই।
দাদিয়ার স্মৃতিশক্তি খারাপ হওয়ায় একটা বড় সুবিধা হয়েছে। তিনি বলছেন আজ সকালেও পান-ছোঁচনি দিয়ে পান খেয়েছেন। কাল রাতে যে টগর তার ঘরে অনেকক্ষণ ছিল এটাও হয়তো তার মনে থাকবে না।
তোমার মা তোমাকে নিষেধ করে গেছেন?
জি বড় চাচা।
মায়ের কথা শোনা কর্তব্য, তারপরও আমি চাচ্ছি যে তুমি তোমার ছোট মামার কাছে যাবে। তার সঙ্গে কথা বলবে। সে আসলে কী ভাবছে তা জেনে এসে আমাকে জানাবে।
স্পাইদের মতো?
স্পাইদের মতো বলা ঠিক হবে না। স্পাইগিরি কোনো ভালো কাজ না। তার মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রাখা এখন আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আজকের দিনটা দেখে ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করব।
টগর চিন্তিত গলায় বলল, ছোট মামা কি পাগল হয়ে গেছেন?
বড় চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে পাগল হয়নি। তবে অন্য সবাইকে পাগল বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
টগর বলল, হিমুদের তাই নিয়ম।
হিমুদের তাই নিয়ম মানে?
হিমুরা নিজেরা ঠিক থাকে, তবে তাদের আশপাশে যারা থাকে তারা বেঠিক হয়ে যায়।
কে বলেছে?
ছোট মামা বলেছেন।
বড় চাচা গম্ভীর গলায় বললেন, হুম।
আর তখনি হৈচৈ উঠল, পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে। পান-ছেঁচনি পাওয়া গেছে। পানির চৌবাচ্চায় পাওয়া গেছে। বড় চাচা টগরকে পাঠালেন পুরো ঘটনা জেনে তাকে জানাতে। টগর খুবই আগ্রহের সঙ্গে ছুটে গেল।
চৌধুরী আজমল হোসেন চিন্তিত মুখে দোতলার বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। পান-ছেচনি চুরি যাওয়া এবং উদ্ধারের ঘটনা কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। তার মা পান-ছোঁচনি শেষ ব্যবহার করেন আজ ভোরে ফজরের নামাজের পর। দ্বিতীয়বার যখন ব্যবহার করতে যান তখন দেখা যায় বালিশের কাছে পানছেচনি নেই। এই সময়ের ভেতর তার ঘরে কেউ ঢোকেনি। যে পান-ছোঁচনি নিয়েছে সেই বা কেন এত জায়গা থাকতে চৌবাচ্চায় রাখবে। সেই চৌবাচ্চায় যেখানে একজন গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে আছে। যে কেউ শুনলে ভাববে ভৌতিক কাণ্ড।
নীলু তার মায়ের ঘরের আয়নার সামনে বসে আছে। সে এখনো সাজতে শুরু করেনি। কান ফুটো করার চিন্তাটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। তবে এই কান ফুটানোয় সে এখন আর টগরকে রাখতে চাচ্ছে না। নিজে নিজেই করতে চাচ্ছে। শুধু সাহসে কুলাচ্ছে না। সে একটা বুদ্ধি বের করেছে, বাবার স্ট্যাপলারে কানের লতি ঢুকিয়ে চাপ দেবে। গত বছর মায়ের সঙ্গে সে কান ফুটো করতে গিয়েছিল। সেখানে দেখেছে। এরকম একটা যন্ত্র দিয়েই কান ফুটো করা হয়। নীলু। বাবার পেপার স্ট্যাপলারটা এনে মায়ের ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে রাখল। যদি সাহসে কুলায় তাহলে সে কাজটা করবে। তার মনে হচ্ছে না যে সাহসে কুলাবে।
টগর গেছে কলঘরে। সে ছোট মামার সঙ্গে গল্প করছে।
ছোট মামা, ভূত বলে কি কিছু আছে?
শুভ্ৰ বলল, অবশ্যই আছে।
তবে যে সবাই বলে, ভূত বলে কিছু নেই!
বললেই হবে? ভূত আছে। প্রেতি আছে। শাকচুন্নি স্কন্ধ কাটা সবই আছে তবে তারা আছে মানুষের মনে। বাস্তবে নেই। এ জন্যই বাস্তবে কখনো ভূত পাওয়া যায় না, শুধু ভূতের গল্প পাওয়া যায়।
তাহলে আমাদের বাসায় ভৌতিক কাণ্ডগুলো কীভাবে ঘটছে?
কী ভৌতিক কাণ্ড?
যেমন ধর, দাদিয়ার র্দাতের পাটি চুরি গেল, পাওয়া গেল অন্য একটা জায়গায়। পান-ছোঁচনি চুরি গেল, পাওয়া গেল চৌবাচ্চায়।
আপাতত ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
সত্যি!
অবশ্যই সত্যি। তোর দাদিয়ার পান-ছেচনি নিশ্চয়ই হেঁটে হেঁটে চৌবাচ্চায় আসেনি। কোনো একজনকে আনতে হয়েছে।
সেই কোনো একজন কি ভূত?
ভূত হবে কেন?
টগর চিন্তিত গলায় বলল, আচ্ছা ছোট মামা, হিমুরা কি ভূত-প্ৰেত এসব বিশ্বাস করে না?
হিমুরা কঠিনভাবে কোনো কিছু বিশ্বাস করে না, আবার অবিশ্বাসও করে না। হিমুদের জগতের অবস্থান বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে।
কিছু তো বুঝতে পারছি না!
বয়স হোক। বয়স হলে বুঝবি। এখন সামনে থেকে যা। আর বকবক করতে ভালো লাগছে না।
টগর বলল, তুমি কত দিন পানিতে থাকবে?
শুভ্র বলল, জানি না।
জানি না, কারণ আমি হিমু। হিমুরা আগে থেকে কিছু ঠিক করে রাখে না। তারা ভাবে যখন যা হওয়ার হবে, আগে থেকে ঠিক করে রাখাব কিছু নেই। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে পানি থেকে উঠে পড়তে পারি, আবার পাঁচ বছরও থাকতে পারি।
কত বছর বললে?
পাঁচ বছর।
টগর, বড় চাচার কাছে গেল। ছোট মামার সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তা বড় চাচাকে জানাতে হবে। সে এখন বড় চাচার স্পাই। স্পাইদের খবর আদান-প্ৰদান করতে হয়।
আজমল হোসেন পড়ার টেবিলের সামনে বসে আছেন। তাকে দুপুরের খাবার দেয়া হয়েছে। একটা কলা, এক স্নাইস রুটি। তিনি যখন কলার খোসা ছাড়াতে শুরু করেছেন তখন টগর চুকাল। শুকনো মুখে বলল, বড় চাচা, আমি ছোট মামার কাছে গিয়েছিলাম। উনি কত দিন পানিতে থাকবেন জিজ্ঞেস করলাম, ছোট মামা বললেন, পাঁচ বছর থাকবেন।
কত বছর থাকবে?
পাঁচ বছর।
কী বললি? পাঁচ বছর! পাঁচ বছর পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে?
জি।
আচ্ছা, ঠিক আছে, তুই যা। যা ভেবেছিলাম অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।
টগর, বড় চাচার ঘর থেকে চলে গেল, তবে পুরোপুরি গেল না, ঘরের বাইরে থেকে জানালার পর্দার ফাক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল। বড় চাচ পােচ বছরের কথা শুনে চিন্তায় অস্থির হয়েছেন। হাত-পা শক্ত করে চেয়ারে বসে আছেন। দুপুরের খাবার খেতে পারছেন না। এক শ পারসেন্ট সত্যি কথা টগর অবিশ্যি বলেনি। ছোট মামা বলেছেন, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে পানি থেকে উঠতে পারি, আবার পাঁচ বছর পরও উঠতে পারি। টগর প্রথম অংশ বলেনি। শেষটা বলেছে। এতে তার নিশ্চয়ই অর্ধেক পাপ হয়েছে। অর্ধেক পাপের জন্য আজ দিনের মধ্যেই কোনো এক সময় অর্ধেক পুণ্য করে ফেলতে হবে। তার কাঁধে যে দুই ফেরেশতা আছে তারা পাপ-পুণ্যের হিসাব অবশ্যই রাখছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে সেও রাখছে। ওদের হিসাবটা দেখতে পারলে ভালো হতো।
টগর লক্ষ করল, বড় চাচা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। রওয়ান হয়েছেন বাথরুমের দিকে। বাথরুমে ঢুকে কেউই সঙ্গে সঙ্গে বের হয় না। কিছু সময় নেয়। এই সময়টা কি টগর কাজে লাগাতে পারে? এখন অতি দ্রুত সে যদি বড় চাচার ঘরে ঢুকে তার কলা এবং পাউরুটির স্নাইসটা খেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে, তাহলে বড় চাচার অবস্থাটা কী হবে? তিনি ঘরে ঢুকে দেখবেন কেউ একজন তার দুপুরের খাবার খেয়ে গেছে। কে খেয়েছে তিনি বের করতে পারবেন না। তার কাছে মনে হবে ভৌতিক কাণ্ড।
টগরের বুক ধুকধুক করছে। এমন ধুকধুক করছে যে তার মনে হচ্ছে বাথরুম থেকেও বড় চাচা বুকের ধুকধুকনি শুনে ফেলবেন। সে কলাটা খেয়ে ফেলল। কলার খোসা পিরিচে রেখে দিল। পাউরুটি পুরোটা খেতে পারল না, সামান্য থেকে গেল। বড় চাচা বাথরুম থেকে বের হওয়ার আগেই সে ফ্যামিলি, রুমে চলে গেল। সেখানে টিভি চলছে। টম এবং জেরির চিরদিনের ছোটাছুটি। এই ছোটাছুটি দেখতে তার খুবই বিরক্তি লাগে। সে যদি বিড়ালটা হতো তাহলে অনেক আগেই ইন্দুরটাকে ধরে ফেলত। তবে ইঁদুরটাকে মেরে ফেলত না। তাকে শান্ত গলায় বলত, আমার সঙ্গে চালাকি করবি না। আমি চালাকি পছন্দ করি না।
বড় চাচার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। টগর অতিরিক্ত মনোযোগের সঙ্গে টম-জেরির পাতানো খেলা দেখছে। ভাবটা এ রকম যে, কে এসে তার পেছনে দাঁড়িয়েছে তা সে ধরতেই পারছে না।
টগর!
জি বড় চাচা।
তুমি কি কিছুক্ষণ আগে আমার ঘরে ঢুকেছিলে?
টগর বলল, না বড় চাচা! আপনি যে আমাকে ডেকেছেন তা শুনতে পাইনি।
তোমাকে আমি ডাকিনি। না ডাকলেও তো তুমি মাঝে মাঝে যাও, সেভাবে গিয়েছ কি না?
জি না।
নীলু কোথায়?
আমি জানি না, কোথায়।
ওকে খুঁজে বের করে আমার ঘরে পাঠাও।
কী হয়েছে বড় চাচা?
কিছু হয়নি। তোমার বাবা কি অফিসে চলে গেছেন?
হুঁ।
তাকেও একটু দরকার ছিল। আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই টেলিফোন করে আনাচ্ছি।
বড় চাচা, কিছু কি হয়েছে?
বললাম তো কিছু হয়নি। একজন পানিতে ড়ুবে আছে, সেটাই কি অনেক বড় কিছু না!
টগর লক্ষ করল, বড় চাচা খুবই চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বের হলেন। এত চিন্তিত হতে তাকে আগে কখনো দেখা যায়নি।
চৌধুরী আজমল হোসেন আসলেই চিন্তিত। এ বাড়িতে মাঝে-মধ্যে জিনিস হারায়, আবার অদ্ভুত অদ্ভুত সব জায়গায় জিনিস পাওয়া যায়। এ ঘটনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তবে আজকের দুপুরের খাবার বলতে গেলে চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল, এটা কেমন কথা! তিনি বাথরুমে ঢুকেছেন, চোখে-মুখে পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়েছেন, এই সময়ের মধ্যে ব্যাপারটা কীভাবে ঘটল? টগর-নীলু। এই কাজ করবে না। তারা কোনো খাবারই খেতে চায় না। কুকুর-বিড়ালের কাণ্ড কি হবে? এই বাড়িতে কুকুর-বিড়াল নেই। বাইরে থেকে বিড়াল আসতে পারে। কিন্তু বিড়াল কি কলা খাবে? মাংসাশী প্রাণীরা ফলমূল খায় না। তাহলে এর মানে কী?
বড় চাচা যেমন চিন্তিত, নীলুও তেমনি চিন্তিত। পেপার স্ট্যাপলারটা তার হাতে আসার পর থেকে হাত নিশপিশ করছে কানের লতিতে ঘ্যাচাং করে একটা চাপ দিতে। কিছুক্ষণ আগে সে ইয়েস-নো লটারি করেছে। একটা কাগজে সে লিখেছে ইয়েস, আরেকটা কাগজে লিখেছে নো। সে চোখ বন্ধ করে বিসমিল্লাহ বলে একটা কাগজ তুলেছে। যেটা উঠবে, সে তা-ই করবে। কাগজে উঠেছে, নো। কাজটা তার করা ঠিক না।
কিন্তু মন থেকে দূর করতে পারছে না। নীলু ঠিক করল সে একটা ফাইনাল লটারি করবে। ফাইনাল লটারিতে পঞ্চাশটা কাগজে লেখা হবে ইয়েস, পঞ্চাশটায় লেখা হবে নো। সেখান থেকে সে একটা কাগজ তুলবে। সেই লটারিতে যা উঠবে তা-ই সে করবে। না উঠলে না। হ্যাঁ উঠলে হ্যাঁ।
টগর তার গোপন জায়গায় বসে আছে। আজ অনেক কিছু ঘটে গেছে তার বিবরণ লেখা হয়নি। ‘পাপ-পুণ্য খাতা’য় পাপ-পুণ্যের হিসাব লিখে রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে না লিখলে পরে ভুলে যেতে পারে। কাঁধের ফেরেশতারা এই জন্য পাপ-পুণ্যের বিবরণ সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলেন। মোটেও দেরি করেন না। টগর লিখল :
পাপ নং ২১৪
বড় চাচার সঙ্গে দুবার মিথ্যা কথা বলেছি। একবার অর্ধেক মিথ্যা। আরেকবার পুরো মিথ্যা। তিনি যখন বলেছেন, টগর, তুমি কি আমার দুপুরের খাবার খেয়েছ? তখন আমি বলেছি, না। এতে অর্ধেক মিথ্যা বলা হয়েছে।
পুণ্য নং ২১৪
আমি রান্নাঘর থেকে কিছু চাল এনে উঠানে ছিটিয়ে দিয়েছি। কয়েকটা কাক এসে সেই চাল খেয়েছে। এতে আমার পুণ্য হয়েছে। পশুপাখির প্রতি মমতা দেখালে পুণ্য হয়।
পাপ নং ২১৫
আমি বড় চাচার দুপুরের খাবার গোপনে খেয়ে ফেলেছি। এতে পাপ হয়েছে। পাপ বেশি হয়েছে নাকি কম হয়েছে তা বুঝতে পারছি না।
পুণ্য নং ২১৫
বড় চাচার খাবার তাকে না বলে খেয়ে ফেলায় যে পাপ হয়েছে, খাবার খাওয়াতে পুণ্য হয়েছে। ছোটরা ফলমূল খেলে তাদের শরীর ভালো থাকে। শরীর ভালো রাখা পুণ্যের কাজ।
‘পাপ-পুণ্য খাতা’ বন্ধ করে টগর অন্য খাতা খুলল। এই খাতায় পুরো দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা লেখা থাকে। দিন এখনো শেষ হয়নি, তবে ঘটনাগুলো অতি দ্রুত ঘটছে। সঙ্গে সঙ্গে লিখে না রাখলে অবশ্যই তালগোল পাকিয়ে যাবে।
হিমু মামা
হিমু মামা এখনো চৌবাচ্চায়। তিনি এখন পর্যন্ত তেইশ ঘণ্টা পার করেছেন। চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার পর তিনি চৌবাচ্চার পানিতে লবণ মেশাবেন। সমুদ্রের পানিতে যতটা লবণ থাকে তার চেয়েও বেশি লবণ দেওয়া হবে। তাতে পানির ঘনত্ব বেড়ে যাবে। তখন ভেসে থাকতে সুবিধা হবে। ড্রাইভার ইদারিসকে ৯২০ কেজি লবণ কিনতে পাঠানো হয়েছে। হিমু মামা হিসাব করে বের করেছেন, চৌবাচ্চায় ৯২০ কিউবিক ফিট পানি আছে। প্রতি কিউবিক ফিট পানির জন্য এক কেজি করে লবণ। কিউবিক ফিটের হিসাবটা আমি ছোট মামার কাছ থেকে জেনেছি। এক ফুট দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার একটা কিউবে যতটা পানি থাকে তাকে বলে এক কিউবিক ফিট।
বড় চাচা
বড় চাচা আজ খুব চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। কারণ, কে যেন তার দুপুরের খাবার খেয়ে ফেলেছে। কে খেয়েছে এটা বের করার তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন। এখনো বের করতে পারেননি। তার ধারণা, কোনো বিড়াল এসে খেয়েছে। তবে বিড়াল কলা খায় না। বিড়ালের আঙুল নেই বলে সে কলার খোসাও ছাড়াতে পারে না। ঘটনা আসলে কী হয়েছে তা জানার জন্য তিনি প্ৰত্যেক ঘরের টেবিলে কলা এবং এক স্নাইস করে রুটি রেখেছেন। আমাদের সবার দায়িত্ব লক্ষ রাখা, কী হয়। তিনি নিজেও কিছুক্ষণ পর পর সব ঘরে গিয়ে দেখছেন, কী হয়। সফুরা বুয়ার ধারণা, আমাদের এই বাড়িতে জিনের আসর হয়েছে। সব কাণ্ডকারখানা জিন করছে। তাদের গ্রামের বাড়িতেও নাকি মাঝে মাঝে এ রকম জিনের আসর হয়। সেই জিন অতি দুষ্ট। তারা ক্ষেত থেকে মাটির চাক্কা তুলে মানুষের ওপর ছুড়ে মারে।
নীলুর ধারণা এটা কোনো জিন না। এসবের পেছনে আছে Playful ‘poltergiest’ অর্থাৎ মজার ভূত।
নীলু একটা মুভিতে দেখেছে, বাড়িতে এ রকম ভূতের উপদ্রব হয়। তখন Ghost Buster এনে ভূত তাড়াতে হয়।
দাদিয়ার ধারণা, এই বাড়িতে খারাপ বাতাস লেগেছে। খারাপ বাতাস কী তা আমি এখনো জানি না। একসময় দাদিয়াকে জিজ্ঞেস করে জানব।
টগর লেখা শেষ করে কিছুক্ষণ ট্যারা হওয়া প্র্যাকটিস করল। ট্যারা হওয়ার প্র্যাকটিস করার জন্য সে একটা আয়না রেখেছে। ছোট মামা বলেছেন, ট্যারা হওয়ার প্র্যাকটিস আয়না দেখে করতে হয়। টগরের ধারণা, সে এখন ট্যারা হতে পারে, তবে বেশিক্ষণ পারে না। ছোট মামা অনেকক্ষণ ট্যারা হয়ে থাকতে পারেন।
টগর তার গোপন আস্তানা থেকে নেমেই শুনল, রকিবউদ্দিন স্যার এসেছেন। স্টাডিরুমে বসে আছেন। রকিবউদ্দিন স্যারের এ সময় আসার কথা না। তিনি আসেন সন্ধ্যার পর, তাও সব দিন না। সপ্তাহে চার দিন। মাঝে মাঝে স্যার টাকা ধার করার জন্য অসময়ে আসেন। আজো মনে হয় এই জন্যই এসেছেন। তবে স্যার আজ টাকা পাবেন না, কারণ মা বাড়িতে নেই। স্যারকে টাকা ধার দেন শুধু মা। মা টাকা ধার দেন বলেই হয়তো মায়ের বানানো ভয়ঙ্কর খাবারগুলো স্যার খুব আগ্রহ নিয়ে খান এবং বলেন, অসাধারণ হয়েছে! শাহি খানা।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া টগরকে দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, কেমন আছ টগর?
টগর, বলল, স্যার, ভালো আছি। মা বাড়িতে নেই। স্যার।
তোমার মায়ের কাছে আসিনি। অন্য একটা কাজে এসেছি। তোমার মামা কোথায়? তার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।
স্যার, ছোট মামা পানিতে।
বলো কী, এখনো পানিতে! জ্বর আসে নাই?
না। ছোট মামা বরং অনেক ভালো আছেন।
তোমার মামার সঙ্গে গতকাল জলচিকিৎসা নিয়ে কথা বলে ভালো লেগেছে। ভাবলাম, আজ যেহেতু হাতে কোনো কাজ নাই, বিষয়টা নিয়ে ভালোমতো আলাপ করি। আমার বাতের ব্যথাও বেড়েছে।
স্যার, আপনি কি জলচিকিৎসা করবেন? মামার সঙ্গে পানিতে নামবেন?
আরে না। কী বলো তুমি! আমি পানিতে নামব কেন? আমার তো ভীমরতি হয়নি।
পানিতে এখন লবণ দেয়া হয়েছে। লবণ-পানিতে নামলে চিকিৎসা ভালো হবে স্যার।
রকিবউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে বললেন, লবণ কেন দেয়া হয়েছে?
পানির ঘনত্ব যেন সমুদ্রের পানির ঘনত্বের মতো হয় সে জন্য। এতে শরীর ভেসে থাকবে।
হুঁ, আর্কিমিডিসের সূত্র। ভালো কথা, চৌবাচ্চার পানি কি ঠাণ্ডা?
মনে হয় না। পানি ঠাণ্ডা হলে মামা এতক্ষণ থাকতে পারতেন না।
তা ঠিক বলেছে। আমি একটা কথা অবিশ্যি ভাবছি।
কী কথা স্যার?
ধরো, আমি যদি ঘণ্টাখানেক জলচিকিৎসা করি, মানে, আমি যেখানে থাকি সেখানে চৌবাচ্চা নাই। জলচিকিৎসার জন্য চৌবাচ্চাটা জরুরি। তাই না?
অবশ্যই জরুরি। কোনো অসুবিধা নাই স্যার। জলচিকিৎসা করেন।
খালি গায়ে নামতে হয় কি না, তুমি জানো?
স্যার, আমি জানি না। জলচিকিৎসা তো আমি কখনো করিনি।
বলো দেখি, জলচিকিৎসার ইংরেজি কী?
জানি না। স্যার।
Water treatment. একটা কাগজে পঞ্চাশবার লেখো Water treatment। আমি যাই, তোমার ছোট মামার সঙ্গে কথা বলে দেখি। চৌবাচ্চায় দুজনের জায়গা হবে?
হবে স্যার।
গুড, ভেরি গুড।
চৌধুরী আজমল হোসেনের দীর্ঘদিনের রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। উপাস দিবসের দুপুরের কলা-পাউরুটি উধাও হওয়ার পর তিনি নিয়ম ভঙ্গ করে ভারপেট ভাত-মাছ-মাংস খেয়েছেন। দিবানিদ্রার অভ্যাস তার কোনোকালেও ছিল না। আজ বিছানায় শুয়ে লম্বা ঘুম দিলেন। সন্ধ্যাবেলায় স্বপ্ন দেখে ঘুম ভািঙল। সেই স্বপ্নও বিচিত্র স্বপ্ন। তিনি চৌবাচ্চায় গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে আছেন। তার সমস্ত শরীর মাছের, শুধু মাথাটা মানুষের। পত্রিকার লোকজন তার ছবি তুলছে। ইন্টারভিউ নিচ্ছে। টিভি ক্যামেরার ক্রুও চলে এসেছে। দাড়িওয়ালা এক উপস্থাপক, দেখতে খানিকটা যুবক বয়সের রবীন্দ্রনাথের মতো, তাকে প্রশ্ন করছে। তিনি আবার আগ্রহের সঙ্গে সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
আপনার খাদ্য কী?
মানুষ যা খায় আমিও তা-ই খাই। ভাত-মাছ, ফলমূল।
কত দিন হলো আপনি পানিতে আছেন?
পাঁচ বছর।
আপনার শরীর কি আগেই মাছের মতো ছিল, নাকি পরে শরীরে আঁশ গজিয়েছে?
সঠিক বলতে পারছি না।
মৎস্যজীবন কি আপনার ভালো লাগছে?
জি, ভালো লাগছে, তবে ছোট জায়গা তো! আমাকে বড় কোনো পুকুরে বা নদীতে ছেড়ে দিলে আমি আরো ভালো থাকব বলে আমার ধারণা।
আপনি কি দর্শকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
অবশ্যই বলব। কেন বলব না!
দয়া করে ইংরেজি এবং বাংলা, দুই ভাষাতেই কথা বলুন। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়বে। সেখানে আপনি যদি বাংলায় কথা কম বলে ইংরেজি বেশি বলেন, তাহলে ভালো হয়। আরেকটা কথা, আপনি যখন কথা বলবেন তখন আপনার লেজটা নাড়াবেন, লেজ দিয়ে পানিতে বাড়ি দেবেন। তাহলে দৃশ্যটা দৃষ্টিনন্দন হবে। তবে বেশি শব্দ করবেন না। তাহলে আপনার কথা শোনা যাবে না। আপনি কি রেডি?
জি রেডি।
লাইটস, ক্যামেরা রোলিং অ্যাকশান!
অ্যাকশানে তিনি লেজ দিয়ে পানিতে প্ৰচণ্ড বাড়ি দিলেন।
এই শব্দে তার নিজের ঘুম ভেঙে গেল।
শব্দের উৎস লেজের বাড়ি না, টগর দাড়াম করে দরজা খুলে ঢুকেছে। সে খুবই উত্তেজিত। উত্তেজনায় সে সামান্য তোতলাচ্ছে।
বড় চাচা, চলে গেছে!
কী চলে গেছে?
কলা।
কী বলছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। গুছিয়ে বলো।
তিনটা টেবিলে আপনি প্লেটে করে কলা-পাউরুটি রেখেছিলেন। পাউরুটি ঠিকই আছে। শুধু কলা নেই। তিনটা প্লেটে শুধু পাউরুটি পড়ে আছে। বড় চাচা, এটা কি কোনো ভৌতিক কাও?
আজমল হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আজ কী বার?
বুধবার।
আজ তোমার টিচার আসার কথা না?
স্যার এসেছেন।
যাও পড়তে বসে। ভৌতিক ঘটনার অনুসন্ধান তোমাকে করতে হবে না। আমি দেখছি, ব্যাপারটা কী। তুমি নীলুকে নিয়ে পড়তে বসো। মা বাড়িতে নেই, এই সুযোগে তোমরা সারা দিন ছোটাছুটি, হৈচৈ করেছ। এখন স্যারের কাছে পড়তে বসবে।
জি আচ্ছা। চেয়ার-টেবিল কি কলঘরে নিয়ে যেতে বলব?
তার মানে কী? চেয়ার-টেবিল কলঘরে নিতে হবে কেন?
স্যার তো চৌবাচ্চায় বসে আছেন।
বড় চাচা হতভম্ব হয়ে বললেন, চৌবাচ্চায় বসে আছেন মানে!
উনি দুপুরে এসেছেন। তখন থেকেই চৌবাচ্চায় আছেন। ছোট মামার সঙ্গে গল্প করছেন। পান খাচ্ছেন। বড় চাচা, চেয়ার-টেবিল কি কলঘরে নিতে বলব? টেবিল না নিয়ে শুধু চেয়ার নিলেও হয়।
আজমল হোসেন গম্ভীর গলায় বললেন, তোমাদের আজ পড়তে বসতে হবে না। সামনে থেকে যাও। তোমার মাকে টেলিফোন করে এক্ষুনি বাড়িতে আসতে বলো।
এখানে যে ভূতের উপদ্রব্ব, সেটা কি মাকে বলব?
তাকে বলবে যে বড় চাচা তোমাকে এক্ষুনি আসতে বলেছে। তোমার বাবা কোথায়? তাকে তো আমি দুপুরেই টেলিফোন করে আসতে বললাম।
বাবা এসেছিল। আপনি ঘুমুছিলেন বলে আপনাকে আর জাগাইনি।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
টিভি দেখতে পারি বড় চাচা?
যা ইচ্ছা করো। আমার সামনে থেকে যাও। সফুরাকে বলে আমাকে চা দিয়ে যেতে।
টগর ঘর থেকে বের হতেই নীলু চুকাল। বড় চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে দাদিয়া ডাকে। এক্ষুণি যেতে বলেছে।
চৌধুরী আজমল হোসেন চিন্তিত মুখে মায়ের ঘরের দিকে রওনা হলেন। কোনো একটা সমস্যা বাড়িতে অবশ্যই হচ্ছে। সমস্যার শুরুটা কোথায়? চৌবাচ্চায়? রকিবউদ্দিন ভূইয়ার মতো সিরিয়াস টাইপ একজন হেডমাষ্টার কেন চৌবাচ্চায় গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে? হারানো কলা তিনটা এখন কোথায়? চৌবাচ্চার পানিতে? পান-ছেঁচনি তো সেখানেই পাওয়া গিয়েছিল।
টগরের দাদিয়া পা ছড়িয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসেছেন। তার হাতে পান-ছোঁচনি। তিনি আগ্রহের সঙ্গে পান ছেচে যাচ্ছেন। তঁর মুখ হাসি হাসি। যেন মজার কোনো একটা ঘটনা কিছুক্ষণ আগে ঘটেছে। সেই স্মৃতি তার মাথায়। তাঁর হাসিখুশি অবস্থান বিপজ্জনক। এর মানে তিনি কারো ওপর রেগে আছেন। চরম রাগ।
আজমল হোসেন মায়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, আজ। আপনার শরীর কেমন?
ফাতেমা বেগম পান ছেচা বন্ধ করে কঠিন গলায় বললেন, তুই পাইছস কী? মানুষ মারতে চাস?
মানুষ কেন মারব?
শুভ্ৰ যে পানিতে ড়ুব দিয়া আছে, তারে তুলনের ব্যবস্থা নিছস? তুই এই বাড়ির ‘পরধান’। তুই দেখবি না? এমন ভালো একটা ছেলে। যেমন লেখাপড়ায়, তেমন আদব-কায়দায়। হে পইড়া আছে পানিতে।
তোলার ব্যবস্থা করছি।
ব্যবস্থা আবার কী? এক্ষণ যা। হাতে ধইরা টান দিয়া তোল।
মা শুনেন, হাত ধরে টান দিয়ে যদি তুলি তাহলে আবারো কোনো একদিন সে পানিতে থাকতে চলে যাবে কিংবা এই ধরনের উদ্ভট কিছু কাণ্ড করবে। পানি থেকে তোলার আগে তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে যে, ব্যাপারটা হাস্যকর পাগলামি ছাড়া কিছু না। তার মাথা থেকে হিমুর ভূত দূর করতে হবে।
কী ভূত?
হিমুর তৃত।
তারে কি ভূতে ভর করছে? মুনশি—মওলানা ডাইক্যা আন। ভূতের চিকিৎসা করব মুনশি-মওলানা।
সেই ভূত না মা, অন্য ধরনের ভূত। আপনি বুঝবেন না।
আমি বুঝব না কী জন্যে? না বুঝলে বুঝাইয়া দে। তাঁরা বুঝদার মানুষ। ভূত-পেতনি এই বাড়িতে যে আছর করছে, এইটা সত্য। আমার পান-ছোঁচনি নিয়া গেল। আবার ফিরত পাইলাম। মাগরেবের নামাজের ওয়াক্তে দেখি আমার চাদরের নিচে তিনটা সাগর কলা।
আপনার চাদরের নিচে তিনটা কলা?
এইগুলা কিছু না। এইগুলা ভূতের মজাক। মানুষ যেমন মজাক করে, ভূত-পেরতও করে। আইজ রাখছে কলা, কাইল রাখব। অন্য কিছু।
ভূত বলে কিছু নাই মা। এই যন্ত্রণাগুলো মানুষই করছে। কে করছে, কী জন্য করছে। আমি সেটা বের করে ফেলব।
ভূত-পেত-জিন-পরী এইগুলা নাই?
না, মা।
দুই পাতা বই পইড়া বিরাট লায়েক হইছস? কত আচানক ঘটনা চাইরিদিকে ঘটে, সব আপনা-আপনি ঘটে?
সব আচানক ঘটনারই ব্যাখ্যা আছে। এমন কিছু এই পৃথিবীতে ঘটে না, যার ব্যাখ্যা নাই।
বাপরে বাপ, তুই তো বিরাট জ্ঞানী হইছস!
আজমল হোসেন মায়ের ঠাট্টার একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নীলুর বিকট চিৎকার শোনা গেল। সে এক চিৎকারে বাড়িঘর কাঁপিয়ে ছুটে এসে দাদিয়ার ঘরে ঢুকল। তার বাম কান দিয়ে ফোটা ফোটা রক্ত পড়ছে। বাম কানে একটা স্ট্র্যাপলারের পিন লাগানো। ষ্ট্যাপলারের পিন শক্ত হয়ে কানের লতিতে লেগে আছে।
আজমল হোসেন কঠিন গলায় বললেন, কে করেছে এই কাজ? কে কানে ষ্ট্যাপলার মেরেছে, টগরি? নিশ্চয়ই টগরের কাজ।
নীলু। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, না।
তাহলে করেছেটা কে?
আমি চুপচাপ বসে গল্পের বই পড়ছিলাম, হঠাৎ দেখি কাণে স্ট্যাপলার।
আশপাশে কেউ ছিল না?
না, বড় চাচা।
নীলুর দাদিয়া বললেন, আলাপ-আলোচনা পরে কর। আগে এই জিনিস কান থাইক্যা বাইর কর। এইটা যে জিন-ভূতের কাজ, তুই বুঝস না? অত বোকা তো তুই ছোটবেলায় ছিলি না।
মৌন দিবস
আজ শুক্রবার।
টগরের বড় চাচার মৌন দিবস। টগরের জন্য বিরক্ত দিবস। কারণ বাড়ির প্রধান ব্যক্তি যদি গভীর মুখে কথা বন্ধ করে বসে থাকেন তখন অন্যদের কথা কম বলতে হয়। টগর যদি একটু উচু গলায় কথা বলে আমনি মা এসে বলবেন, চুপ। চুপ।।
শুক্রবার ছুটির দিন। কার্টুন চ্যানেলে কার্টুন দেখা যায়। সেই কার্টুনও দেখতে হয় লো ভল্যুমে। ছুটির দিন হৈচৈ শব্দ ছাড়া কার্টন দেখে কোনো মজা আছে।
তবে আজ ভিন্ন কিছু হতে পারে। টগরের ছোট মামা এখনো চৌবাচ্চায়। এমন বিরাট ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে কি বড় চাচা তার মৌন দিবস পালন করতে পারবেন। তা মনে হয় না।
শুভ্রর ঘটনাও চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনরা দেখতে আসছেন। তাদের সঙ্গে ছোট বাচ্চাকাচ্চা যারা আসছে তারা কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। টগরের দায়িত্ব বাচ্চাকাচ্চাদের ভয় ভাঙিয়ে কাছে নিয়ে যাওয়া। বড়রা আগ্ৰহ নিয়ে অনেক প্রশ্ন-ট্রশ্নও করছেন। কিছু কিছু প্রশ্নের জবাব টগর দিচ্ছে। যেমন শুভ্রের দূর সম্পর্কের এক খালা বললেন, পানিতে ছয়-সাত দিন পড়ে থাকলে লাভ কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে টগর বলেছে, এটা হিমুদের সাধনা। এই সাধনা করলে হিমুরা পাওয়ার পায়।
পাওয়ার পায় মানে কী?
টিভিতে দেখেন না। সুপারম্যানদের পাওয়ার আছে। এই রকম পাওয়ার।
আকাশে উড়তে পারবে?
পারতেও পারে। আত্মীয়স্বজন যারা দেখতে আসছেন তাদের বেশির ভাগই এত বড় ঘটনা নিয়ে ঠাট্টা—তামাশা করছেন। কেউ কেউ আজেবাজে রসিকতাও করছেন। যেমন এক ভদ্রলোক বললেন, তা হিমু বাবাজী পিসাব-পায়খানা কোথায় করছে? চৌবাচ্চাতেই। পানির রঙও মনে হল পাঞ্জাবির রঙের মতো হলুদ!
সুলতানা বাবার বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। তার রাগ পড়ে গেছে। এখন তিনি রান্নাঘরে। আত্মীয়স্বজন আসছে নতুন ধরনের কোনো আইটেম রান্না করলে তারা আগ্রহ করে খাবেন। তিনি বানাচ্ছেন মিষ্টি চটপটি। চটপটির সব আইটেম থাকবে সঙ্গে তেঁতুলের রসের বদলে টেবিল চামচে।কয়েক চামচ মধু দিয়ে দেবেন। তেঁতুলের পানি আলাদা দেয়া থাকবে। যারা মধুর সঙ্গে তেঁতুল মেশাতে চান তারা তেঁতুল মেশাবেন।
টগরের বাবা আলতাফ সাহেবকে একটু পর পর টেলিফোন ধরতে হচ্ছে। পরিচিত অপরিচিত লোকজন টেলিফোন করে হিমু হবার বিষয়ে জানতে চাচ্ছে। তিনি সবার সঙ্গেই শুরুতে ভদ্র ব্যবহার করছেন। যেমন পত্রিকা অফিস থেকে একটা টেলিফোন এলো–
আমি দ্বিতীয় আলো পত্রিকা থেকে বলছি।
বলুন।
এটা কি শুভ্ৰদের বাড়ি?
জি।
আমরা খবর পেয়েছি শুভ্র গত এক বছর ধরে পানিভর্তি চৌবাচ্চায় বাস করছে।
ঘটনা কি সত্যি?
আংশিক সত্যি। আজ তৃতীয় দিন সে পানিতে আছে।
আমরা খবর পেয়েছি তিনি যে চৌবাচ্চায় বাস করছেন সেই চৌবাচ্চার পানি ছাড়া আর কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করছেন না।
এই সব উদ্ভট খবর কোথে কে পাচ্ছেন?
আমরা তো নিউজ কালেকশন সিক্রেট আপনাকে বলব না। আমরা সত্য খবর ছাপাতে চাই। আপনি এ ব্যাপারে আমাকে সাহয্য করুন।
আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করছি। পুরো ব্যাপারটা ছেলেমানুষি খেলা ছাড়া আর কিছুই না।
আপনার সবাই মিলে কেন এই খেলাটা দেখছেন জানতে পারি। একটা শিশুকে তিন দিন ধরে পানিতে চুবিয়ে রেখেছেন।
শিশুকে পানিতে চুবোব কী জন্য?
তাহলে কাকে চুবিয়েছেন।
চুপ!
কী আশ্চর্য গালাগালি করছেন নাকি?
থাপ্পড় খাবি।
আপনি কি বলেছেন থাপ্পড় খাবি?
হ্যাঁ বলেছি। থাপ্লড় দিয়ে তোর দাঁত ফেলে দেব। বদমাশ।
বদমাশ তো আপনি। চারদিকে হৈচৈ ফেলা দেখার জন্য অবুঝ এক শিশুকে তিন দিন ধরে পানিতে ড়ুবিয়ে রেখেছেন।
আলতাফ সাহেব ঝটি করে টেলিফোন নামিয়ে রেখেছেন। কিছুক্ষণ পর আবার টেলিফোন ধরতে হয়েছে। এবার অপরিচিত। কেউ না। পরিচিতজন। টেলিফোন করেছেন নিউইয়র্ক থেকে। আলতাফ সাহেবের বন্ধু। নিউইয়র্কের বাংলাদেশ মিশনে কাজ করেন।
হ্যালো আলতাফ। আমি নিউইয়র্ক থেকে মারুফ।
কেমন আছ মারুফ।
আমি তো ভালোই আছি তোমার খবর বল। তোমার এক আত্মীয় নাকি উভচর মানবে পরিণত হয়েছে।
কী মানব?
উভচর মানব। এমফিবিয়ান ম্যান। বেশির ভাগ সময় সে পানিতে বাস করছে। শুকনায় পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি থাকতে পারে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
খবরটা সত্যি না।
আমি তো ইন্টারনেটে খবরটা দেখলাম।
কীসে দেখেছ?
ইন্টারনেটে।
যে বাড়িতে এমন প্রবল ঝামেলা হচ্ছে সে বাড়ির কর্তব্যক্তি মৌনব্ৰত পালন করতে পারেন না। টগরের বড় চাচা সকাল এগারোটা দশ মিনিটে মৌনব্ৰত ভঙ্গ করে ছোট ভাইকে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর মুখে বললেন, কী করা যায় বল তো।
আলতাফ হোসেন বললেন, আপনি অনুমতি দিলে কানে ধরে টেনে তুলি। একটাকে কানে ধরে তুললে অন্যটাও ভয় পেয়ে উঠে পড়বে।
অন্যটা মানে। টগরের স্যারও পানিতে?
উনি কাল রাত এগারোটার দিকে চলে গিয়েছিলেন। এখন আবার এসেছেন।
পানিতে নেমেছে?
আমি যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ পানিতে নামেনি। এখন ফাঁক পেয়ে নেমে গেছে বলে আমার ধারণা। ভাইজান এখন আপনি বলেন-শুভ্ৰকে কান ধরে টেনে তুলব?
না।
না কেন?
তাকে পানিতে নামার অনুমতি আমিই দিয়েছিলাম। কাজটা সে করছে অনুমতি নিয়ে। এখন তাকে কান ধরে তোলা যায় না।
তাহলে আমরা করব কী?
একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলা দরকার। সাইকিয়াট্রিস্ট আসুক। সে কথা বলে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শুভ্ৰকে চৌবাচ্চ থেকে তুলুক। নীলুর কানের অবস্থা কী?
অবস্থা ভালো। এখন ব্যথা করছে না।
তার কানে এই ঘটনা ঘটল কীভাবে?
ভাইজান আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ক্ষীণ সন্দেহ জিন ভূতের একটা ব্যাপার থাকতে পারে। জগতে অনেক রহস্যময় ব্যাপার তো ঘটে।
আমার সঙ্গে ফালতু কথা বলবে না।
ফালতু কথা কোনটা বললাম? ঘটনা যা ঘটছে তার এক্সপ্লেনেশন কী?
এখন সামনে থেকে যাও। আজ আমার মৌনব্ৰত আর তুমি ক্রমাগত কথা বলাচ্ছ।
আলতাফ হোসেন বারান্দায় বসলেন আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুলতানা তার বিশেষ চটপটি নিয়ে উপস্থিত হলেন। হাসিমুখে বললেন খেয়ে দেখ তো কেমন হয়েছে।
কোনো কথাবার্তা ছাড়াই আলতাফ সাহেব এক চামচ চটপটি মুখে দিলেন। সুলতানা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সিরিয়াস কোনো ব্যাপার হবে বোঝা যাচ্ছে। আলতাফ হোসেন চটপটির বাটি ছুড়ে মারবেন। এমন সম্ভাবনাও আছে। এই ভেবে আগে থেকেই সস্তা ধরনের বাটি দেয়া হয়েছে।
আলতাফ হোসেন প্রথম চামচের পর দ্বিতীয় চামচ মুখে দিলেন। তারপর তৃতীয় চামচ। সুলতানা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেমন হয়েছে?
ভালো।
সত্যি ভালো?
সত্যি ভালো নাতো কি মিথ্যা ভালো?
সুলতানা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। টগরের বাবা বাটি প্রায় শেষ করে এনেছেন। শেষ পর্যন্ত একটা আইটেম তাহলে হিট করেছে। এই আইটেমের একটা সুন্দর নাম দেয়া দরকার। একে চটপটি অবশ্যই বলা যাবে না।
শুভ্র হিমু সেজেছে বলেই এই চটপটি তৈরি হয়েছে। হিমু নামের সঙ্গে মিল রেখে এর একটা নাম দিতে হয়। এই জিনিস আরেক দফা রাধতে হবে। সুলতানা দ্বিতীয় দফা রান্না চাপিয়ে খাদ্যটার নাম দিয়ে দিলেন। এর নাম হিমুপটি।
দুপুরে লেখা টগরের ডায়েরি।
হিমুপটি
মা আজ যে চটপটি বানিয়েছে তার নাম হিমুপটি। এই চটপটি খেতে মিষ্টি। তবে কেউ ইচ্ছা করলে মিষ্টির সঙ্গে টক দিতে পারে। হিমুপটি খেতে ভালো হয়েছে। বড়রা সবাই খেয়েছে। আমি এখনো খাই নি। মনে হয় খাব না।
হিমু মামা
আজ থেকে ছোট মামাকে আমি হিমু মামা ডাকছি। কারণ তিনি তো এখন প্রায় হিমু হয়েই গেছেন। বাকি আছে শুধু গর্ত করে জোছনা দেখা। ছাদে মাটি তোলা আছে। পূর্ণিমার সময় গর্ত করে ছোট মামা। ঢুকে যাবেন। ছোট মামার সঙ্গে আমিও গর্তে ঢুকব। মনে হয় রকিব স্যারও ঢুকবেন।
রকিব স্যার এখনো হিমু মামার সঙ্গে পানিতে বসে আছেন। মনে হয় তিনি খুব মজা পাচ্ছেন। রকিব স্যারের জন্য আমি কলঘরে যেতে পারছি না। কারণ আমাকে দেখলেই তিনি ইংরেজি ট্রানস্লেশন ধরছেন।
বাবা রকিব স্যারের ওপর খুব রাগ করছেন। একটু পর পর বলছেন, গাধাটা এখনো পানিতে? শুভ্রের মাথা না হয় খারাপ হয়ে গেছে। গাধাটার মাথা খারাপ হল কেন?
স্যারকে গাধা বলা ঠিক না। স্যারদের সম্মান করতে হয়।
টেলিফোন
আজ টেলিফোনে আমি অনেক মজা করেছি। টেলিফোনে মজা করলে পাপ হয় কি না। আমি জানি না। মজাতে সবাই আনন্দ পায়। আনন্দ পাওয়া ভালো। কাজেই পাপ কেন হবে?
টিভি অফিস থেকে এক ভদ্রলোক টেলিফোন করেছিলেন। প্রথমেই তিনি বললেন, তুমি কে?
আমি বললাম, আমার নাম টগর।
তুমি কোন ক্লাসে পড়?
সিক্সথ গ্রেডে পড়ি।
শোনা খোকা তোমাদের বাসায় কে নাকি অনেক দিন হল পানিতে বাস করে। সত্যি নাকি?
জি।
কত দিন হল?
পাঁচ বছর।
বল কি? সত্যি?
জি।
কেন পানিতে বাস করছে?
উনি মাছ হয়ে গেছেন তো এই জন্য! মাছদের পানিতে থাকতে হয়।
মাছ হয়ে গেছেন মানে কী?
অর্ধেকটা মাছ অর্ধেকটা মানুষ। মাছ মানব।
খোকা শোন, মাছ হয়ে গেছে বলতে কী মিন করছে? দেখতে মাছের মতো হয়ে গেছে?
আপনাকে কী বললাম! মাছ মানব। অর্ধেকটা মাছ অর্ধেকটা মানুষ। আমি এখন তাকে ডাকি মাছ মামা।
আমি ফটোগ্রাফার নিয়ে আসছি ছবি তুলব।
ফটোগ্রাফার নিয়ে এলো লাভ হবে না।
কারণ মাছ মামাকে বড় একটা পানির ড্রামে ভরে নিয়ে গেছে।
কোথায় নিয়ে গেছে?
রাজশাহী। উনার বাড়ি রাজশাহীতে। সেখানে তাদের বড় পুকুর আছে। মাছ মামাকে পুকুরে ছেড়ে দেবে।
কখন নিয়ে গেছে?
আজ সকালে। আমারও যাবার কথা ছিল। আগামীকাল আমার ইংরেজি পরীক্ষা এই জন্য যেতে পারিনি।
রাজশাহীর যে বাড়িতে তোমার মামাকে পাঠানো হয়েছে তার ঠিকানা জান?
জানি। বলব?
একটু দাড়াও কলামটা বের করি।
আমি ভদ্রলোককে ঠিকানা বললাম। ছোট মামার বাড়ির ঠিকানা বললাম। আমার ধারণা টেলিভিশনের এই ভদ্রলোক ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে রাজশাহী চলে যাবেন।
সাইকিয়াট্রিস্ট
আজ রাতে আমাদের বাসায় সাইকিয়াট্রিস্ট আসবেন। হিমু মামার চিকিৎসা করে তাঁকে পানি থেকে তুলবেন। সাইকিয়াট্রিস্ট হল পাগলের ডাক্তার। সাইকিয়াট্রিস্টের নামের বানান আমি জানি। ডিকশনারি দেখে শিখেছি–Psychitrist.
টগরদের বাড়িতে সাইকিয়াট্রিস্ট
রাত নটা। টগরদের বাড়িতে সাইকিয়াট্রিস্ট এসেছে। ভদ্রলোকের নাম এম শামসুল হক। নামের শেষে পিএইচডি আছে।
টগর দূর থেকে এই পিএইচডিওয়ালাকে দেখেছে। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি জ্ঞানী। জ্ঞান তার কথাবার্তা এবং চেহারায় ঝরে পড়ছে। ভদ্ৰলোকের হাসির মধ্যেও জ্ঞান-জ্ঞান ভাব আছে। মাথা সামান্য নিচু করে হাসেন। হাসির সময় চশমার ফাক দিয়ে তাকান। যার দিকে তাকিয়ে হাসেন তার বুক সামান্য হলেও ধক করে ওঠে। সে হাসি দেখে মনে করে, তার সব গোপন কথা এই ভদ্ৰলোক জেনে ফেলেছেন। অন্তত টগরের সে রকমই মনে হচ্ছে।
ভদ্ৰলোক তার দিকে তাকিয়ে তার বিখ্যাত হাসি হেসে বললেন, তোমার নাম কী খোকা?
টগর।
তুমি ট্যারা নাকি?
টগর সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঠিক করে বলল, হ্যাঁ।
ট্যারা হওয়া সে এখন মোটামুটি শিখেছে। বাড়িতে নতুন কাউকে দেখলেই ট্যারা হয়ে তার দিকে তাকায়। সাইকিয়াট্রিস্টের দিকে তাকানো বোধ হয় ঠিক হয়নি। সে সামনে থেকে সরে গেল, তবে বেশি দূরে গেল না। আশপাশেই থাকল। ভদ্রলোক কোন পদ্ধতিতে ছোট মামার মাথা থেকে হিমু ভূত দূর করেন তা ভালোমতো দেখার আগ্রহ টগরের প্রবল। ভদ্রলোকের কাণ্ডকারখানা পছন্দ হলে সে নিজেও বড় হয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট হবে।
চৌধুরী আজমল হোসেন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে আলাদা বসেছেন। ঘরে আর কেউ নেই। জানালার পর্দার ওপাশে টগার দাঁড়িয়ে। এখান থেকে দুজনকে দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কথাবার্তা তেমন শোনা যাচ্ছে না।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, শুভ্ৰ নামের রোগীটির যে মনোবিকার ঘটেছে, সেটা চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু না। একে বলে ডিলিউশান। তার ধারণা হয়েছে, সে হিমু নামক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।
ডিলিউশান কেন হয়েছে?
ডিলিউশান তৈরির নানা কারণ থাকতে পারে। রোগীর সঙ্গে ভালোমতো কথা না বলে তা বলা যাবে না। তবে আমরা সবাই কিছু না কিছু ডিলিউশন নিয়ে বাস করি। বিরাট বড় মিথ্যাবাদীর মনেও ডিলিউশন তৈরি হয় যে সে মিথ্যাবাদী না, সত্যবাদী। যা বলছে সবই সত্যি বলছে।
এই জিনিস দূর করার উপায় কী?
শরীরের রোগের চিকিৎসা ডাক্তাররা ওষুধপত্র দিয়ে করেন। শরীরের রোগের নির্দিষ্ট ওষুধ আছে। সেখানে মনের রোগ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না। একেক জনের জন্য এই রোগ একেক রকম। চিকিৎসার ধরনও সেই জন্যই নানা রকম। যে ডিলিউশানে ভুগছে, প্রথমে তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। যে সাইকিয়াট্রিস্ট এই কাজটা পারবেন, তিনিই শুধু রোগীর চিকিৎসা করতে পারবেন।
আপনি সেই বিশ্বাস অর্জন কীভাবে করবেন?
শুভ্ৰ নামধারী যে ডিলিউশানে ভুগছে আমি তা স্বীকার করে নেব। সে যখন বলবে, আমি হিমু। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলব। অবশ্যই তুমি হিমু। ভালো কথা, আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো হিমু জিনিসটা কী?
আমিও ঠিকমতো জানি না জিনিসটা কী।
অসুবিধা নেই, আমি জেনে নেব। তারপর অগ্রসর হব সেই পথে।
চলুন, আপনাকে নিয়ে যাই।
না, আপনারা কেউ যাবেন না। আমি একা তার সঙ্গে কথা বলব।
আজমল হোসেন বললেন, শুভ্রর কাছে যাওয়ার আগে আরেকটা ছোট্ট কথা বলি। শুভ্ৰ পানিতে নামার পর থেকে এ বাড়িতে কিছু ভৌতিক ঘটনা ঘটছে, তার কি কোনো ব্যাখ্যা আপনার কাছে আছে?
অবশ্যই আছে। কেউ যখন ডিলিউশানে আক্রান্ত হয় তখন তার ছায়া আশপাশের সবার ওপর খানিকটা হলেও পড়ে। যেকোনো একটা ভৌতিক ঘটনার কথা বলুন, আমি তার ব্যাখ্যা দেই।
আজমল হোসেন বললেন, আমার নিজের কথাই বলি। আমি দুপুরবেলা এক স্লাইস রুটি আর একটা কলা খাই। আমাকে এই ঘরে খাবার দিয়ে গেছে। আমি ঘরেই আছি। ঘর থেকে বের হইনি। হঠাৎ দেখি কলা-রুটি কোনোটাই নেই। উধাও। কলার খোসাটা শুধু পড়ে আছে।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, কলা এবং রুটি আপনি নিজেই খেয়ে ফেলেছেন। বাসার ঝামেলায় আপনার মন ছিল বিক্ষিপ্ত। কখন খেয়েছেন সেটা ভুলে গেছেন। সাইকিয়াট্রিস্টের ভাষায় একে বলে সাময়িক এমনেশিয়া।
আমি নিজেই খেয়েছি?
অবশ্যই। যদি ভাত-মাছ খেতেন। হাতে ঝোল লেগে থাকত। সেখান থেকে বুঝতে পারতেন। আপনি নিজেই খাবারটা খেয়েছেন। যেহেতু খাবারটা ছিল শুকনা, হাতে কিছু লেগে ছিল না।
আপনার ধারণা আমি নিজে খেয়ে তুলে গেছি?
ব্যাখ্যা তো দিলাম। ব্যাখ্যা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না?
আপনি যা বলছেন তা হতে পারে। শুভ্ৰকে পানি থেকে তুলতে আপনার কতক্ষণ লাগবে।
আধঘণ্টার বেশি লাগার তো কথা না। অবস্থাটা দেখি। আপনারা কেউ আমার সঙ্গে যাবেন না। প্লিজ। কেউ যেন উঁকিঝুঁকিও না দেয়।
সাইকিয়াট্রিস্ট এম শামসুল হক পিএইচডি কলঘরে ঢুকে একটা ধাক্কার মতো খেলেন। তিনি ভেবেছিলেন অল্পবয়সী একটা ছেলে চৌবাচ্চার পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে। অথচ দেখা যাচ্ছে থলথলে মোটাসোটা এক বৃদ্ধ বসে আছে। বৃদ্ধের মাথার সব চুল সাদা।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, কেমন আছেন?
জি জনাব, ভালো আছি।
কতক্ষণ আছেন। পানিতে?
অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল।
আপনার নামটা কি আমি জানতে পারি?
রকিবউদ্দিন ভূইয়া।
সাইকিয়াট্রিস্টের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি শুনেছেন পেশেন্টের নাম শুভ্ৰ। এখন পেশেন্ট বলছে তার নাম রকিবউদ্দিন ভূইয়া। এ রকম অবশ্য হয়। ডিলিউশনের পেশেন্ট নিজের নাম নিয়েও বিভ্রান্ত হয়। একেক সময় নিজেকে একেক রকম কল্পনা করে।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, হিমু বলে কাউকে চিনেন? হিমু নাম শুনেছেন?
আগে কোনো দিন শুনি নাই। পানিতে নামার পরে শুনেছি।
সাইকিয়াট্রিস্ট মনে মনে হাসলেন। রোগ কতদূর অগ্রসর হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পানিতে নেমেই সে হিমুর সন্ধান পেয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর মতো গলায় বললেন, হিমু সম্পর্কে কিছু বলুন শুনি।
রকিবউদ্দিন বললেন, পানিতে নামেন তারপর বলব। দুইজন দুই জায়গায় থেকে কীসের কথা?
পানিতে নামতে বলছেন?
হুঁ। নেমে দেখেন আরাম লাগবে। শরীর হালকা হয়ে যাবে। শরীরের ভিতরই বাস করে মন। যেহেতু শরীর হালকা সেই কারণে মনও হবে হালকা।
এইসব কি আপনার কথা?
জি না। হিমুর কথা। হিমুর আরো অনেক কথা জানি। পানিতে নামেন বলব। শুভ্ৰ থাকলে সে গুছিয়ে বলতে পারত। সে কিছুক্ষণ আগে উঠে গেল।
সাইকিয়াট্রিস্ট আবারো মনে মনে হাসলেন। ডিলিউশানের গতি-প্রকৃতি ধরা পড়ছে। এখন এই লোক শুভ্রের নাম নিচ্ছে। শুভ্ৰ উঠে গেছে, সে বসে আছে। সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীকে প্যাচে ফেলাবার ভঙ্গিতে বললেন। শুভ্র? শুভ্ৰ কে?
সে হিমু।
শুভ্ৰ, হিমু আর আপনি একই মানুষ, না? চট করে জবাব দেবেন না। ভেবেচিন্তে বলুন।
জি না। এক মানুষ হব কেন?
আমি যদি বলি আপনি শুভ্র আবার আপনিই হিমু। পানির এক রূপ বরফ, আরেক রূপ বাম্প। আপনি সাপ আবার আপনিই ওঝা।
আপনি বললে তো হবে না। আমি কী, সেটা আমি জানি।
না, আপনি জানেন না। যাই হোক বুঝিয়ে বলছি।
বুঝিয়ে বলার আগে পানিতে নামেন। তারপর যত ইচ্ছা বুঝান।
নামছি। নামছি।
আজমল হোসেন ইজিচেয়ারে বি॥ম ধরে বসে আছেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। তিনি খবর পেয়েছেন। শুভ্ৰ পানি থেকে উঠেছে। নিজের ঘরে বসে চা খাচ্ছে। তবে সাইকিয়াট্রিস্ট নেমে পড়েছে পানিতে। সে পানিতেই আছে।
পরিশিষ্ট (টগরের লেখা ডায়েরির অংশ)
পরিশিষ্ট
[টগরের লেখা ডায়েরির অংশ]
আমাদের বাড়িতে যে ভৌতিক উপদ্রব হয়েছিল তার রহস্য ভেদ হয়েছে। সব করেছে নীলু। সে মার কাছে স্বীকার করেছে সে নিজেই ষ্ট্যাপলার দিয়ে তার কান ফুটো করেছে। তাকে নিয়ে গতকাল রাতে বিচারসভা বসেছিল। বড় চাচা তাকে বলেছেন, মা নীলু, তোমাকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি। তুমি যদি তোমার সব অপরাধ স্বীকার করে তাহলে আমার স্নেহের পরিমাণ আরো বাড়বে। তুমি অনেক দিন থেকে একটা ওয়াকম্যান চাচ্ছিলে, আমি নিজে সেই ওয়াকম্যান কিনে দেব। মা, এখন বলো তুমি কি তোমার দাদিয়ার পান-ছেঁচনি লুকিয়ে রেখেছিলে?
নীলু সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ। [সে এটা বলল, বড় চাচার বেশি স্নেহ পাওয়ার জন্য এবং ওয়াকম্যানটা পাওয়ার জন্য।]
বড় চাচা বললেন, তুমি যে অপরাধ স্বীকার করেছ এতে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। মা, এখন বলো তুমি নিজেই কি তোমার অঙ্ক বই লুকিয়ে রেখে বলেছ বই খুঁজে পাচ্ছ না?
হ্যাঁ।
কেন এই কাজটা করলে?
আমি জানি না, বড় চাচা।
আর কখনো এ ধরনের কাজ করবে?
না?
আমার ঘর থেকে কলা এবং পাউরুটি তুমিই তো সরিয়েছিলে। তাই না, মা?
হ্যাঁ, আমি।
তোমার সত্যবাদিতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো। আমি এক্ষুনি তোমাকে ওয়াকম্যান কিনে দেব।
থ্যাঙ্ক য়্যু, বড় চাচা।
নীলু তার ওয়াকম্যান পেয়েছে। আমাকে হাত দিতে দেয় না। এমন পাজি মেয়ে।
ছোট মামা হিমু হওয়া কিছু দিনের জন্য বাদ রেখেছে। কারণ সামনেই তার পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলেই সে হিমু হওয়ার সেকেন্ড পার্টে যাবে। সেকেন্ড পার্টে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তে ঢুকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে হবে। সমস্ত শরীর থাকবে গর্তের ভেতর। গর্তের ওপর শুধু মাথাটা বের হয়ে থাকবে। ছোট মামা বলেছে জোছনা দেখার সময় আমি তার সঙ্গে থাকতে পারি।
আমি একবার ভেবেছিলাম বড় হয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট হব। এখন ঠিক করেছি সাইকিয়াট্রিস্ট হব না। কারণ সাইকিয়াট্রিস্ট হলে সবাই আমাকে গাধার বাচ্চা গাধা বলে গালি দিবে।
আমাদের বাসায় যে সাইকিয়াট্রিস্ট এসেছিলেন তাকে আমাদের বাসার সবাই গাধার বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে। কারণ তিনি এসেছিলেন ছোট মামার চিকিৎসা করতে। তার বদলে তিনি পানিতে ড়ুবে রকিব স্যারের চিকিৎসা করেছেন। তিনি সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টা পানিতে ছিলেন। তিন ঘণ্টা পর স্যারকে নিয়ে পানি থেকে উঠলেন। পানি থেকে উঠে ভেজা কাপড়ে বড় চাচার ঘরে ঢুকে বললেন, রোগ অত্যন্ত কঠিন পর্যায়ে আছে। তবে অনেকটা সামলে ফেলেছি, আর দশটা সেশন পার করলেই উনি বুঝতে পারবেন উনি আসলে রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া না, ওনার আসল নাম শুভ্ৰ।
বড় হয়ে আমি কী হব সেটা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ছোট মামাকে জিজ্ঞেস করে ঠিক করে ফেলতে হবে। আমাদের স্কুলের সবাই ঠিক করে ফেলেছে বড় হয়ে কে কী হবে। শুধু আমিই এখনো ঠিক করতে পারিনি। ছোট মামার সঙ্গে যখন হিমু হওয়ার ট্রেনিং নেব তখন ঠিক করে ফেলব।
আসল কথা লিখতে ভুলে গেছি, আমি এখন ট্যারা হতে পারি। অনেকক্ষণ থাকতেও পারি। স্কুলে এখন সবাই আমাকে ডাকে ট্যারা টগর!