যাহা হউক ঐ সকল কৃত্রিম পর্দা কম (moderate) করিতে হইবে। অনেক পরিবারে মহিলাগণ ঘনিষ্ঠ কুটুম্ব ব্যতীত অপর কাহারও বাটী যাতায়াত করেন না। ইহাতে পাচ রকমের স্ত্রীলোকের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইতে পারে না বলিয়া তাঁহারা একেবারে কুপমণ্ডুক হইয়া থাকেন। অন্তঃপুরিকদের পরস্পর দেখা শুনা বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুরুষেরা যেমন সকল শ্রেণীর লোকের সহিত আলাপ করিয়া থাকেন, আমাদেরও তদ্রপ করা উচিত। অবশ্য যাহাদিগকে আমরা ভদ্র-শিষ্ট বলিয়া জানি, কেবল তাহদের সঙ্গে মিশিব,—তাঁহারা যে কোন ধৰ্ম্মাবলম্বিনী (য়িহুদী, নাসারা, বুৎপরস্ত বা যাই) হউন, ক্ষতি নাই। এই যে “গয়ের মজহব” বিশিষ্ট স্ত্রীলোকের সহিত পর্দা করা হয়, ইহা ছাড়িতে হইবে। আমাদের ধৰ্ম্ম ত ভঙ্গপ্রবণ নহে, তবে অন্য ধম্পর্মাবলম্বিনী স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা হইলে ধৰ্ম্ম নষ্ট হইবে, এরূপ আশঙ্কার কারণ কি ?
আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না। তবে সে জন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস (practice) চাই ; বিনা অভ্যাসে কোন কাজটা হয় ?
সচরাচর বোরকার আকৃতি অত্যন্ত মোটা (coarse) হইয়া থাকে। ইহাকে কিছু সুদৰ্শন (fine) করিতে হইবে। জুতা কাপড় প্রভৃতি যেমন ক্রমশঃ উন্নতি প্রাপ্ত হইয়াছে, সেইরূপ বোরকারও উন্নতি প্রার্থনীয়। যে বেচারা (বোরকা) সুদূর আরব হইতে এদেশে আসিয়াছে, তাহাকে হঠাৎ নির্ব্বাসিত করিলেই কি আমরা উন্নতির সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় উঠিব?
সম্প্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ, সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই—শিক্ষার অভাবে হইয়াছে। সুশিক্ষার অভাবেই আমাদের হৃদয়বৃত্তিগুলি এমন সঙ্কুচিত হইয়াছে। ললনাকুলের ভীরুতা ক্রমে বালকদের হৃদয়ে সংক্রামিত হইতেছে। পঞ্চম বর্ষীয় বালক যখন দেখে যে তাঁহার মাতা পতঙ্গ দর্শনে মূচ্ছিতা হন, তখন কি সে ভাবে না যে পতঙ্গ বাস্তবিকই কোন ভয়ানক বস্তু?
এইখানে বলিয়া রাখি যে কীট পতঙ্গ দেখিয়া মূর্চ্ছা যাওয়ার দোষে কেবল আমরা দোষী নহি। সুসভ্য ইংরাজ রমণীও এ অপবাদ হইতে মুক্তি পান না। “গালিভরের ভ্রমণ” নামক পুস্তকে (“Gullivers Travels”এ) দেখা যায়, যখন ডাক্তার গালিভর “ব্ৰবডিঙ্গন্যাগ” (Brobdingnag) দের দেশে গিয়া শস্যক্ষেত্রে সভয়ে বিচরণ করিতেছিলেন, তখন একজন ব্ৰবডিঙ্গন্যাগ তাহাকে হাতে তুলিয়া লইয়া আপন স্ত্রীকে দেখাইতে গেল ! ইংরাজ-ললনা যেমন কীট পতঙ্গ বা মাকড়সা দেখিয়া ভীত হন, ব্ৰবডিঙ্গন্যাগ রমণীও তদ্রপ ডাক্তার গালিভরকে দেখিয়া ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিল ! ! কারণ দীর্ঘকায়া ব্ৰবডিঙ্গনব্যাগ রমণী ডাক্তারকে একটি ক্ষুদ্র কীট-বিশেষ মনে করিয়াছিল!! তাই বলি পদ ছাড়িলেও পতঙ্গভীতি দূর হয় না !
পতঙ্গ-ভীতি দূর করিবার জন্য প্রকৃত সুশিক্ষা চাই—যাহাতে মস্তিষ্ক ও মন উন্নত (brain ও mind cultured) হয়। আমরা উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে সমাজও উন্নত হইবে না। যতদিন আমরা আধ্যাত্মিক জগতে পুরুষদের সমকক্ষ না হই, ততদিন পর্যন্ত উন্নতির আশা দুরাশা মাত্র। আমাদিগকে সকলপ্রকার জ্ঞানচর্চ্চা করিতে হইবে।
শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি। অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বাৰ্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দূরদর্শী ভ্রাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে ইহাতে তাহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে। তাই তাঁহারা জাগিয়া ও উঠাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন। আমি ইতঃপূৰ্ব্বেও বলিয়াছি যে “নর ও নারী উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারবে না।” এখনও তাহাই বলি। এবং আবশ্যক হইলে ঐ কথা শতবার বলিব ।
এখন ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই—তাঁহারা যে টাকার শ্ৰাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন, ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান-ভূষণে অলঙ্কতা করিতে চেষ্টা করিবেন। একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তক পাঠে যে অনিৰ্ব্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলঙ্কার পরিলে তাঁহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর-শোভন অলঙ্কার ছাড়িয়া জ্ঞান-ভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ অমূল্য অলঙ্কার :
“চোরে নাহি নিতে পারে করিয়া হরণ,
জ্ঞাতি নাহি নিতে পারে করিয়া বণ্টন,
দান কৈলে ক্ষয় নাহি হয় কদাচন,
এ কারণে বলে লোকে বিদ্যা মহাধন।”
আমি আরো দুই চাবি পংক্তি বাড়াইয়া বলি :
অনলে না পারে ইহা করিতে দহন,
সলিলে না পারে ইহা করিতে মগন,
অনন্ত অক্ষয় ইহা অমূল্য রতন,—
এই ভূষা সঙ্গে থাকে যাবত জীবন !
তাই বলি অলঙ্কারের টাকা দ্বারা “জেনানা স্কুলের” আয়োজন করা হউক। কিন্তু ভগ্নীগণ যে স্কুল লাভের জন্য সহজে গহনা ত্যাগ করবেন, এরূপ ভরসা হয় না। দুঃখের কথা কি বলিব, —আমার ভগ্নীদিগকে বোধ হয় এক প্রকার গৃহ-সামগ্রীর মধ্যে গণনা করা হয়! তাই টেবিলটা যেমন ফুল পাতা দিয়া সাজান হয় ; জানালার পর্দাটা যেমন ফুলের মালা, পুতির মালা বা তদ্রপ অন্য কিছু দ্বারা সাজান হয়, সেইরূপ গৃহিণী আপন পুত্র-বধূটিকেও একরাশি অলঙ্কার দ্বারা সাজান আবশ্যক বোধ করিয়া থাকেন । সময় সময় ভ্রাতাগণ আমাদিগকে “সোণ-রূপা রাখিবার স্তম্ভ (stand) বিশেষ” বলিয়া বিদ্রপ করিতেও ছাড়েন না ! কিন্তু “চোরা না শুনে ধরম কাহিনী” ।