- বইয়ের নামঃ মতিচূর (২য় খণ্ড)
- লেখকের নামঃ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
- প্রকাশনাঃ সুচয়নী পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
নূর-ইসলাম
মিসিস এনি বেশান্তের “ইসলাম” শীৰ্ষক বক্তৃতা পাঠ করিলে বাস্তবিক মোহিত হইতে হয়। “ইসলাম” শব্দের সমভিব্যাহারে মিসিস বেশান্তের নাম শুনিয়া আপনারা কেহ ভীত হইবেন। না। প্ৰথমে আমারও আশঙ্কা হইয়াছিল যে, তিনি হয়ত তাহার “থিয়োসফী” ধর্ম্মের মহিমা প্রচার করিতে গিয়া আমাদের একমাত্র সম্বল ইসলামের উপর, খানিকটা হাত সাফ করিয়া লইয়াছেন। কিন্তু বক্তৃতা পাঠ করিয়া আমার সে ভ্রান্তি দূর হইল। হাত সাফ করা ত অতি দূরে-ইহার প্রতি পত্র-প্রতি ছত্র সুপক্ক আঙ্গুরের ন্যায় অতি মিষ্ট ভক্তিরসে পরিপূর্ণ। তিনি নূর-ইসলাম (বা ইসলাম-জ্যোতির) এমন উজ্জ্বল জ্যোতিৰ্ম্ময় চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন যে তাহার তুলনা হয় না।—এমনকি প্রিয় বঙ্গভাষায় ইহার মৰ্ম্মোদ্ধার করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিতেছি না।
তবে কথা এই যে, অনুবাদ করিবার মত ক্ষমতা ও বিদ্যাবুদ্ধি সকলের থাকে না–বিশেষতঃ আমার ন্যায় লোকের তাদৃশ চেষ্টা! তাহাতে আবার আমি বহু চেষ্টা করিয়াও মিসিস এনি বেশান্তের মূল ইংরাজী বক্তৃতা-পুস্তিকাখনি সংগ্ৰহ করিতে পারি নাই। আমাকে উহার উর্দু অনুবাদের উপরই নির্ভর করিতে হইতেছে। অনুবাদক মহোদয় অতি উচ্চ (সুফিধৰ্ম্ম ভাবপূর্ণ) ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন! সুতরাং আমি যদি ঐ অনুবাদের অনুবাদ করিতে গিয়া লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হইয়া, নিজের ভাব ব্যক্ত এবং বিকৃত ভাষা ব্যবহার করিয়া ফেলি, সে ত্রুটি মাৰ্জনীয় বলিয়া ভরসা করি।
আর একটি কথা,–মিসিস এনি বেশান্তি যেমন হজরতের নাম উল্লেখ করিতে অত্যধিক সম্মানের ভাষা ব্যবহার না করিয়া, ভক্তের সরল ভাবপূর্ণ ভাষা প্রয়োগ করিয়াছেন, অনুবাদক মোঃ হাসেনউদ্দিন সাহেবও তদ্রুপ করিয়াছেন; যথা “আব ওহ মহম্মদ সিরফ মহম্মদ হি না রহা বালকে ওহ পয়গম্বরে আরব হুয়া” ইত্যাদি। ভাব ও ভাষার স্বাভাবিক সৌন্দৰ্য্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে আমিও অনুবাদক মহাশয়ের প্রথা অনুসরণ করিতে বাধ্য হইয়াছি। আর দিবাকরের সমুজ্জ্বল কান্তি দেখাইবার জন্য, অন্য আলোকের প্রয়োজন হয় না; পুষ্পের সৌন্দৰ্য্য-বদ্ধনের নিমিত্ত অলঙ্কারের প্রয়োজন হয় না। যাহা হউক, আশা করি, আমি আড়ম্বরপূর্ণ সম্পমানসূচক শব্দের বহুল প্রয়োগ বজ্জন করায় দোষী হই নাই।
এখন আপনারা মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করুন, মিসিস বেশান্ত কি বলিতেছেন :
ভদ্ৰ মহোদয়গণ!
প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণ সমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে-ধৰ্ম্ম! ধৰ্ম্ম ব্যতিরেকে মানুষ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি কিম্বা সভ্যতা লাভ করিতে পারে না। যে দেশের সমুদয় অধিবাসী একই ধৰ্ম্মবলম্ববী, যে দেশে সকলে একই ভাবে একই ঈশ্বরের পূজা করে-তাহাকে সকলে একই নামে ডাকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির মনোভাব একই সূত্রে গ্রথিত থাকে, সে দেশ অত্যন্ত সৌভাগ্যশালী, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার মতে যে দেশে এক ঈশ্বরকে লোকে বিভিন্ন নামে ডাকে; একই ঈশ্বরের উপাসনা বিবিধ প্ৰণালীতে হয়; একই সৰ্ব্বশক্তিমান ঈশ্বরের নিকট লোকে বিভিন্ন ভাষায় প্রার্থনা করে, তথাপি সকলে ইহাই মনে করে যে, আমরা সকলে একই গন্তব্যস্থানে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়াছি, এবং এইরূপ পার্থক্যের মধ্যে একতা থাকে; যদি কোন দেশের ঐ অবস্থা হইত, (কিন্তু অদ্যপি এমন কোন ভাগ্যবতী দেশের বিষয় জানা যায় নাই।)—আমার মতে সে দেশ নিশ্চয়ই ধর্ম্মে প্রধান হইত।
অন্যান্য দেশেও বিভিন্ন ধৰ্ম্ম এবং ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্মবিশ্বাসী লোক আছে, কিন্তু ভারতবর্ষ এই আদর্শের অদ্বিতীয় দেশ-ইহার তুলনা এ ভারত নিজেই। এ দেশে এত স্বতন্ত্ৰ ধৰ্ম্ম এবং এত পৃথক বিশ্বাসের লোক বাস করে যে, মনে হয় যেন ভারতবর্ষে সমস্ত পৃথিবীর ধৰ্ম্ম-মতসমূহের প্রদর্শনী-ক্ষেত্র। এবং এই দেশই সেই স্থান, যেখানে পরস্পরের একতা, মিত্রতা এবং সহানুভূতির মধ্যে ধর্ম্মের সেই আদর্শ–যাহাকে আমি ইতঃপূৰ্ব্বে বাঞ্ছনীয় বলিয়াছি—পাওয়া যাইতে পারে।
আপনাদের স্মরণ থাকিতে পারে, তিন চারি বৎসর পূৰ্ব্বে আমি আপনাদিগকে চারিটি প্রধান ধৰ্ম্মের, অর্থাৎ বৌদ্ধ, খ্ৰীষ্টীয়, হিন্দু এবং অনল-পূজার বিষয় বলিয়াছিলাম, কিন্তু তিনটি শ্ৰেষ্ঠ ধাম্পের্মর, অর্থাৎ ইসলাম, জৈনমত, এবং শিখধর্ম্মের আলোচনা রহিয়া গিয়াছিল। এই তিন ধর্ম্ম-যাহা ভারতবর্ষের প্রধান সাতটী ধর্ম্মের অন্তৰ্গত-ইহাদের পরস্পরে। এত অনৈক্য দেখা যায় যে, ইহারা একে অপরের রক্ত-পিপাসু হইয়া উঠে এবং দুইজনের মনের মিলনের পক্ষে এই ধৰ্ম্ম-পাৰ্থক্য এক বিষম অন্তরায় হইয়া আছে।
আমার আন্তরিক বাসনা এই যে, ভারতবর্ষ হেন দেশে যদি সকলে চক্ষু হইতে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের আবরণ উন্মোচন করিয়া ন্যায়চক্ষে দৃষ্টিপাত করতঃ চিন্তা করিয়া দেখেন, তবে তাহারা বুঝিতে পরিবেন যে “আমরা প্রকৃতপক্ষে একই প্রভুর উপাসনা বিভিন্ন প্ৰণালীতে করিতেছি—একই প্রভুকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ও ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকিতেছি।”
[“পুরাও পুরাও মনস্কাম,-
কাহারে ডাকিছে অবিশ্রাম
জগতের ভাষাহীন ভাষা?”–