- বইয়ের নামঃ মতিচূর (২য় খণ্ড)
- লেখকের নামঃ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
- প্রকাশনাঃ সুচয়নী পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
নূর-ইসলাম
মিসিস এনি বেশান্তের “ইসলাম” শীৰ্ষক বক্তৃতা পাঠ করিলে বাস্তবিক মোহিত হইতে হয়। “ইসলাম” শব্দের সমভিব্যাহারে মিসিস বেশান্তের নাম শুনিয়া আপনারা কেহ ভীত হইবেন। না। প্ৰথমে আমারও আশঙ্কা হইয়াছিল যে, তিনি হয়ত তাহার “থিয়োসফী” ধর্ম্মের মহিমা প্রচার করিতে গিয়া আমাদের একমাত্র সম্বল ইসলামের উপর, খানিকটা হাত সাফ করিয়া লইয়াছেন। কিন্তু বক্তৃতা পাঠ করিয়া আমার সে ভ্রান্তি দূর হইল। হাত সাফ করা ত অতি দূরে-ইহার প্রতি পত্র-প্রতি ছত্র সুপক্ক আঙ্গুরের ন্যায় অতি মিষ্ট ভক্তিরসে পরিপূর্ণ। তিনি নূর-ইসলাম (বা ইসলাম-জ্যোতির) এমন উজ্জ্বল জ্যোতিৰ্ম্ময় চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন যে তাহার তুলনা হয় না।—এমনকি প্রিয় বঙ্গভাষায় ইহার মৰ্ম্মোদ্ধার করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিতেছি না।
তবে কথা এই যে, অনুবাদ করিবার মত ক্ষমতা ও বিদ্যাবুদ্ধি সকলের থাকে না–বিশেষতঃ আমার ন্যায় লোকের তাদৃশ চেষ্টা! তাহাতে আবার আমি বহু চেষ্টা করিয়াও মিসিস এনি বেশান্তের মূল ইংরাজী বক্তৃতা-পুস্তিকাখনি সংগ্ৰহ করিতে পারি নাই। আমাকে উহার উর্দু অনুবাদের উপরই নির্ভর করিতে হইতেছে। অনুবাদক মহোদয় অতি উচ্চ (সুফিধৰ্ম্ম ভাবপূর্ণ) ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন! সুতরাং আমি যদি ঐ অনুবাদের অনুবাদ করিতে গিয়া লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হইয়া, নিজের ভাব ব্যক্ত এবং বিকৃত ভাষা ব্যবহার করিয়া ফেলি, সে ত্রুটি মাৰ্জনীয় বলিয়া ভরসা করি।
আর একটি কথা,–মিসিস এনি বেশান্তি যেমন হজরতের নাম উল্লেখ করিতে অত্যধিক সম্মানের ভাষা ব্যবহার না করিয়া, ভক্তের সরল ভাবপূর্ণ ভাষা প্রয়োগ করিয়াছেন, অনুবাদক মোঃ হাসেনউদ্দিন সাহেবও তদ্রুপ করিয়াছেন; যথা “আব ওহ মহম্মদ সিরফ মহম্মদ হি না রহা বালকে ওহ পয়গম্বরে আরব হুয়া” ইত্যাদি। ভাব ও ভাষার স্বাভাবিক সৌন্দৰ্য্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে আমিও অনুবাদক মহাশয়ের প্রথা অনুসরণ করিতে বাধ্য হইয়াছি। আর দিবাকরের সমুজ্জ্বল কান্তি দেখাইবার জন্য, অন্য আলোকের প্রয়োজন হয় না; পুষ্পের সৌন্দৰ্য্য-বদ্ধনের নিমিত্ত অলঙ্কারের প্রয়োজন হয় না। যাহা হউক, আশা করি, আমি আড়ম্বরপূর্ণ সম্পমানসূচক শব্দের বহুল প্রয়োগ বজ্জন করায় দোষী হই নাই।
এখন আপনারা মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করুন, মিসিস বেশান্ত কি বলিতেছেন :
ভদ্ৰ মহোদয়গণ!
প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণ সমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে-ধৰ্ম্ম! ধৰ্ম্ম ব্যতিরেকে মানুষ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি কিম্বা সভ্যতা লাভ করিতে পারে না। যে দেশের সমুদয় অধিবাসী একই ধৰ্ম্মবলম্ববী, যে দেশে সকলে একই ভাবে একই ঈশ্বরের পূজা করে-তাহাকে সকলে একই নামে ডাকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির মনোভাব একই সূত্রে গ্রথিত থাকে, সে দেশ অত্যন্ত সৌভাগ্যশালী, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার মতে যে দেশে এক ঈশ্বরকে লোকে বিভিন্ন নামে ডাকে; একই ঈশ্বরের উপাসনা বিবিধ প্ৰণালীতে হয়; একই সৰ্ব্বশক্তিমান ঈশ্বরের নিকট লোকে বিভিন্ন ভাষায় প্রার্থনা করে, তথাপি সকলে ইহাই মনে করে যে, আমরা সকলে একই গন্তব্যস্থানে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়াছি, এবং এইরূপ পার্থক্যের মধ্যে একতা থাকে; যদি কোন দেশের ঐ অবস্থা হইত, (কিন্তু অদ্যপি এমন কোন ভাগ্যবতী দেশের বিষয় জানা যায় নাই।)—আমার মতে সে দেশ নিশ্চয়ই ধর্ম্মে প্রধান হইত।
অন্যান্য দেশেও বিভিন্ন ধৰ্ম্ম এবং ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্মবিশ্বাসী লোক আছে, কিন্তু ভারতবর্ষ এই আদর্শের অদ্বিতীয় দেশ-ইহার তুলনা এ ভারত নিজেই। এ দেশে এত স্বতন্ত্ৰ ধৰ্ম্ম এবং এত পৃথক বিশ্বাসের লোক বাস করে যে, মনে হয় যেন ভারতবর্ষে সমস্ত পৃথিবীর ধৰ্ম্ম-মতসমূহের প্রদর্শনী-ক্ষেত্র। এবং এই দেশই সেই স্থান, যেখানে পরস্পরের একতা, মিত্রতা এবং সহানুভূতির মধ্যে ধর্ম্মের সেই আদর্শ–যাহাকে আমি ইতঃপূৰ্ব্বে বাঞ্ছনীয় বলিয়াছি—পাওয়া যাইতে পারে।
আপনাদের স্মরণ থাকিতে পারে, তিন চারি বৎসর পূৰ্ব্বে আমি আপনাদিগকে চারিটি প্রধান ধৰ্ম্মের, অর্থাৎ বৌদ্ধ, খ্ৰীষ্টীয়, হিন্দু এবং অনল-পূজার বিষয় বলিয়াছিলাম, কিন্তু তিনটি শ্ৰেষ্ঠ ধাম্পের্মর, অর্থাৎ ইসলাম, জৈনমত, এবং শিখধর্ম্মের আলোচনা রহিয়া গিয়াছিল। এই তিন ধর্ম্ম-যাহা ভারতবর্ষের প্রধান সাতটী ধর্ম্মের অন্তৰ্গত-ইহাদের পরস্পরে। এত অনৈক্য দেখা যায় যে, ইহারা একে অপরের রক্ত-পিপাসু হইয়া উঠে এবং দুইজনের মনের মিলনের পক্ষে এই ধৰ্ম্ম-পাৰ্থক্য এক বিষম অন্তরায় হইয়া আছে।
আমার আন্তরিক বাসনা এই যে, ভারতবর্ষ হেন দেশে যদি সকলে চক্ষু হইতে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের আবরণ উন্মোচন করিয়া ন্যায়চক্ষে দৃষ্টিপাত করতঃ চিন্তা করিয়া দেখেন, তবে তাহারা বুঝিতে পরিবেন যে “আমরা প্রকৃতপক্ষে একই প্রভুর উপাসনা বিভিন্ন প্ৰণালীতে করিতেছি—একই প্রভুকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ও ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকিতেছি।”
[“পুরাও পুরাও মনস্কাম,-
কাহারে ডাকিছে অবিশ্রাম
জগতের ভাষাহীন ভাষা?”–
–ডা. ববীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“সকলে তাঁরেই ডাকে,
আমি যাঁরে ডাকি,–
রাঙ্গা রবি নিয়া বুকে
ঊষা ডাকে সোণামুখে
গোধূলি বালিকা ডাক
শ্যাম ছটা মাখি।”–
–মানকুমারী দেবী।]
আর, একই স্থান হইতে আমরা আসিয়াছি এবং সেইখানে পুনরায় যাইতেছি। ইহার ফল এই হইবে যে, একে অপরের সহিত নিতান্তু আন্তরিক ও প্রকৃত ভ্ৰাতৃভাবে মিশিতে পরিবে। একের দুঃখে অপারে দুঃখিত হইবে-সমুদয় ভারতবাসী একই জাতি বলিয়া পরিগণিত হইবার অধিকার প্রাপ্ত হইবে। অধিকন্তু জগতের বড় বড় শক্তিপূঞ্জ ভারতসন্তানকে একজাতি বলিয়া স্বীকার করিবে। যখন হিন্দু মুসলমানে, পারসী-খ্ৰীষ্টানে, জৈন-য়ীহুদীতে এবং বৌদ্ধশিখে প্ৰেমপূৰ্ণ হৃদয়ে আলিঙ্গন হইবে, তখন আমি মনে করিব যে, ধর্ম্মের জয় এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের পবিত্র নাম শান্তিপ্রদ হইয়াছে।
অদ্য আমি ইসলাম-সম্বন্ধে দুই চারি কথা বলিব এবং আগামী কল্য ও পরশ্ব অবশিষ্ট দুই ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে, এবং অনন্তর সমুদয় ধৰ্ম্মের প্রকৃত মৰ্ম্ম-সারতত্ত্ব অর্থাৎ সেই থিয়োসকী (ব্ৰহ্মজ্ঞান বা “এলমে-এলাহী”) সম্বন্ধে আলোচনা করিব, যাহাতে প্ৰত্যেক ধৰ্ম্মবিশ্বাসের সারভাগ আছে এবং যাহা সকলের উপর একই প্রকার অধিকার রাখে-যাহাকে কোন বিশেষ ব্যক্তি তাহার নিজস্ব বা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ধৰ্ম্ম বলিতে পারে না; বরং তদ্বিপরীত যে কোন ধৰ্ম্মবিশ্বাসের অধিকারী বলিতে পারে যে, ইহাই আমারও ধৰ্ম্ম। আদ্য সমিতির সম্ববাৎসরিক অধিবেশন দিনে আমার এই প্রার্থনা যে, বিশ্ব-সংসারের সমুদয় ধৰ্ম্মগুরুদের পবিত্ৰ-আত্মা আমাদের ও আমাদের কাৰ্যকলাপের প্রতি র্তাহাদের আশীৰ্ব্বাদপূর্ণ দৃষ্টিপাত করুন-যেন তাহাদের শিষ্যমণ্ডলী একজন অপরকে ভাল বাসিতে পারেন। আমীন!
ইসলাম
কোন ধৰ্ম্ম পরীক্ষা করিতে হইলে, আমাদিগকে চারিটি বিষয় সম্পবন্ধে চিন্তা করিতে হয়। সৰ্ব্বপ্রথম সেই ধর্ম্মের উৎপত্তির ইতিহাস, যাহার প্রভাব তাঁহাতে (সেই ধর্ম্মে) লুক্কায়িত থাকে। দ্বিতীয়, তাহার প্রকাশ্য বা বাহ্যিক মত অথবা শাখা পল্লব, যাহার সহিত সাধারণে সম্পর্ক রাখে। তৃতীয়, ধৰ্ম্মের দর্শন, যাহা বিদ্বান এবং সুশিক্ষিত লোকদের জন্য। চতুৰ্থ, ধর্ম্মের গৃঢ় রহস্য, যাহাতে সাধারণতঃ মালবের আপনি অহং বা অস্তিত্বজ্ঞানের ভাণ্ডারের সহিত মিশিবার স্বাভাবিক ইচ্ছা প্ৰকাশ পায়। আমি এই কষ্টিপাথরে ইসলামকে পরীক্ষা করিয়া আপনাদিগকে দেখাইতে চাই যে, সৰ্ব্বপ্রথমে আরব ও শামদেশের অবস্থার প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া দেখুন, সে দেশের কি দশা ছিল।
খ্ৰীষ্টীয় যষ্ঠ শতাব্দীতে যখন সমস্ত আরব, শাম ও আজমদেশে অসভ্যতার ঘোর অন্ধকারে কুসংস্কারের প্রবল ঝঞ্চানিল বহিতেছিল; যুদ্ধকলহ ও পরস্পরের রক্তারক্তি এক দলকে অন্য দল হইতে পৃথক করিতেছিল; হিংসা দ্বেষ এমন প্রবল ছিল যে, একই বিষয়ের ঝগড়া কয় পুরুষ পৰ্যন্ত চলিত;(1) যথা এক ব্যক্তি কোন বিষয় লইয়া অন্য একজনের সহিত বিবাদ করিল, অনন্তর শত বৎসর পরে একের পৌত্র অপরের পৌত্রকে শুধু এই অজুহাতে হত্যা করিত যে, “ইহার পিতামহ আমার পিতামহের শত্রু ছিল!” ইহা সেই আরব দেশসেখানে কেবল এই কথায় যুদ্ধ আরম্ভ হইত যে, “তোমার উষ্ট্র আমার উষ্ট্রকে অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইল কেন?” বাস, এই সামান্য কারণে রক্তনদী প্রবাহিত হইত-শবরাশি স্তূপীকৃত হইত! এ সেই আরব দেশ-যেখানে নিষ্ঠুর পিতা, মাতার ক্রোড় হইতে শিশু কন্যাকে কাড়িয়া লইয়া গৰ্ত্ত খনন করিয়া তাহাতে জীবন্ত প্রোথিত করিয়া আসিত। আর নিরুপায় মাতা আপন স্বাভাবিক মাতৃস্নেহপূর্ণহৃদয়ের অসহ্য বেদনা লইয়া মরমে মরিয়া থাকিত। স্ত্রীলোক হওয়ার দরুণ পাষণ্ড স্বামীর ঐ নিম্পর্মম অত্যাচারে আপত্তি করিতে পারে, এতটুকু ক্ষমতাও তাহার ছিল না। কাহাকেও জামাতা বলিতে না হয়, এইজন্য কন্যা হত্যা করা হইত। ইহা সেই দেশ, যেখানে ঘূণিত পৌত্তলিকতা বিরাজমান ছিল—ঘরে ঘরে নতুন দেবতা; এক ঠাকুর আবার অন্য ঠাকুরের প্রাণের শত্রু। প্রতিমার সম্প্ৰমুখে নরবলিদান” ত নিত্য ক্রীড়া ছিল; যেখানে মানবজাতির প্রতি স্নেহ মমতার পরিবৰ্ত্তে বিলাসিতা ও আত্মপরায়ণতা পূর্ণ মাত্রায় রাজত্ব করিত। যে কোন প্রবল ব্যক্তি আপন দুৰ্ব্বল প্রতিবেশীকে বিনা কারণে কিম্বা অতি সামান্য কারণে হত্যা করিয়া ফেলিত; তাহার ঐ দুহিব্রুয়ায় বাধা দিবার লোক ত দূরে থাকুক, একটি কথা জিজ্ঞাসা করিবারও কেহ ছিল না।
তদানীন্তন আরবে বিলাসিতার ও অন্যান্য “মকারাদি” কুক্রিয়ার অন্ত ছিল না; এক স্বামী ভেড়া ছাগল প্রভৃতি পশুর ন্যায় অসংখ্য ভাৰ্য্যা গ্ৰহণ করিত; আর এই বিষয়ে গীেরব করা হইত। যে অমুক ধনী ব্যক্তি এত অসংখ্য স্ত্রীর স্বামী। ঈশ্বরের সৃষ্টি-স্ত্রীজাতি এমন জঘন্য দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধা ছিল যে, তাহারা নিতান্ত অসহায় গৃহপালিত পশুর ন্যায় জীবন যাপন করিত। মোটের উপর এমন কোন নিকৃষ্ট পাপ ও জঘন্য দোষ নাই, যাহা তৎকালীন আরবে না ছিল।
সেই স্বাৰ্থ, অত্যাচার ও আত্মপরতার পূতিগন্ধময় জলবায়ু পরিবেষ্টিত এক কোরেশগহে একটি শিশু (সে পবিত্র শিশুরত্নের উদ্দেশে সহস্র দরুদ!) জন্মগ্রহণ করিলেন, র্যাহার পিতা তাঁহার জন্মের কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই ইহধাম পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। আর তিনিও সেইরূপ পিতা ছিলেন, যিনি তদীয় পিতৃকর্তৃক কোন প্রতিমার সম্পমুখে নরবলিরূপে আনীত হইয়াছিলেন, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ দেবালয়ের সেবিকার কৃপায়-সে যাত্রা রক্ষা পাইয়াছিলেন।(2) এই শিশু এমন একটি হতভাগিনী দুঃখিনী নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি ইনি ভূমিষ্ঠ হইবার পূৰ্ব্বেই বিধবা হইয়াছিলেন,-আর দারুণ বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া কয়েক মাস পরেই এ অবোধ দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিঃসহায় অবস্থায় ফেলিয়া স্বামীর অনুগমন করেন। ইহার ফলে এই পিতৃমাতৃহীন শিশু কিছুদিন স্বীয় পিতামহ কর্তৃক প্রতিপালিত হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাহার পিতামহও কয়েক বৎসর পরে দেহত্যাগ করিলেন। তখন সেই অসহায় বালক বয়োপ্রাপ্ত হওয়া পৰ্যন্ত, স্বীয় পিতৃব্য আবু তালেবের আশ্রয়ে রহিলেন। ইহা ত অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে, এইরূপ বিপদগ্ৰস্ত পিতৃমাতৃহীন সহায়সম্পদশূন্য একটি অজ্ঞান বালক যে শিক্ষাদীক্ষা হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকিবেন, ইহাই স্বাভাবিক। বাস্তবিক কাৰ্য্যতঃও তাঁহাই হইয়াছিল। শিক্ষা, বা অধ্যয়ন বলিতে একটি অক্ষরের সঙ্গেও তাঁহার পরিচয় হয় নাই, নীতি বা আচার নিয়মের অনুশাসনের বাতাস পৰ্যন্ত তাহাকে স্পর্শ করে নাই। তথাপি তাহার শৈশবকাল, অতি পবিত্র জীবনের উচ্চ আদর্শ ছিল। তাঁহার নিম্পর্মল জীবনে মানবের বাঞ্ছনীয় যাবতীয় সদগুণরাজিযথা, দয়া, সৌজন্য, প্রেম, ধৈৰ্য্য, নম্রতা, বিনয়, শান্তিপ্রিয়তা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি স্বভাবতঃ বিরাজমান ছিল। তিনি নানা গুণে সকলের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিয়াছিলেন।
বাল্যজীবন অতিক্রম করিয়া তিনি কৈশোরে উপনীত হইলেন। এখন জীবিকা-অৰ্জ্জনের নিমিত্ত তিনি আপন কোন বিধবা আত্মীয়ার গৃহে কৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে বাধ্য হইলেন। উক্ত বিধবা খাদিজা বিবি তাহাকে পণ্যদ্রব্যসহ বাণিজ্য উপলক্ষে শামদেশে প্রেরণ করিতেন। এই বিষয়কর্ম্মে খজিদাবিবি দেখিতে পাইলেন যে তাহার এই নূতন কৰ্ম্মচারী অতিশয় ধৰ্ম্মভীরু, ন্যায়পরায়ণ, মিতব্যয়ী এবং অতি বিশ্বাসী। অতঃপর তিনি ইহার সহিত পরিণীত হন।
ইহা স্মরণ রাখা কৰ্ত্তব্য যে, এই নবীন যুবক যাহার নাম মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওসাল্লাম) ছিল, সে সময়ে পয়গম্বর হন নাই। আর তাঁহার পত্নী হজরত খাদিজাও তাঁহার ধৰ্ম্মবিশ্বাসের অনুবৰ্ত্তিনী ছিলেন না; তিনি স্বয়ং অল্পবয়স্ক তরুণ এবং তাঁহার জায়া তদপেক্ষা দ্বিগুণ বয়োজেষ্ঠা ছিলেন। কিন্তু বিবাহের পর তাহারা এমন সুখের দাম্পত্য জীবন ভোগ করিয়াছিলেন যে, পৃথিবীতে তেমন মধুর দাম্পত্যজীবনের উচ্চ আদর্শ আর কেহ দেখাইতে পারিয়াছে কি না সন্দেহ–আর তেমনই ভাবে তাঁহাদের বিবাহ জীবনের পূর্ণ ২৬ বৎসর অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর হজরত খাদিজার মৃত্যু হইল। অতঃপর পয়গম্বর সাহেবের স্বভাব চরিত্র ও কাৰ্যকলাপ সৰ্ব্বদাই অতি প্ৰশংসনীয় ছিল। যখন তিনি মক্কার সন্ধীর্ণ গলিকুচাতে যাতায়াত করিতেন, সে সময় তত্ৰত্য ক্ৰীড়ারত অবোধ শিশুগণ তাঁহার পদযুগল জড়াইয়া ধরিত, আর তিনি সততই তাহাদের সহিত স্নেহসিক্ত মিষ্টভাষায় কথা বলিতেন, তাহদের মস্তকে হস্তামর্শন করিতেন। কেহ কখনও শুনে নাই যে, তিনি প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছেন। তিনি সৰ্ব্বদা বিপদগ্ৰস্তের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকিতেন; বিধবা ও পিতৃহীন শিশুদের সান্তুনা ও প্ৰবোধ দান তাহার নিত্য কম্পর্ম ছিল। প্রতিবেশিবৰ্গ তাহাকে “আমীন” (বিশ্বস্ত) বলিয়া ডাকিত। “আমীন” শব্দের অর্থ বিশ্বাসভাজন-এমন উচ্চ ভাবপূর্ণ উপাধি কেবল শ্রেষ্ঠ হইতে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিই বিশ্ব জগতের নিকট প্রাপ্ত হইতে পারেন। এখন আপনারা একটু চিন্তা করিয়া দেখুন ত; যে ব্যক্তির বাহ্যিক জীবন জগতেব পক্ষে এমন উপকারী এবং সুখ শান্তিপ্রদ ছিল, তাহার আভ্যন্তরীণ জীবন কেমন হইতে পারে। অহো! (সত্য তত্ত্বজ্ঞান লাভের নিমিত্ত) তাহার আন্তরিক ব্যাকুলতার বন্যাস্রোতেব তাড়না তাঁহাকে বনে বনে ও জনপ্রাণিগৃন্য মরুভূমি ভাসাইয়া লইয়া যাইত। তিনি কতৰ্ধার দিবানিশি অনশনে অনিদ্রায় বিপৎসস্কুল পৰ্ব্বতকন্দিরে বাস করিতেন। তিনি যে ভাবে আত্ম-বিস্মৃত হইয়া ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ঈশ্বর-অনুসন্ধান করিতেন, তাহা বৰ্ণনা করিবার উপযুক্ত ভাষা দুর্লভ; অথবা ইহার মৰ্ম্ম কেবল তাহারাই বুঝিতে পারেন, র্যাহারা একাগ্রচিত্তে খোদার পথে আত্মসমৰ্পণ করিয়াছেন।
ক্রমে হজরত মোহাম্মদের (দঃ) এই প্রকার ধ্যান-আরাধনা এত বৃদ্ধি পাইল যে, তিনি লোকালয় পরিত্যাগ পূর্বক দূরে-অতি দূরে-ঘোর অরণ্যে চলিয়া যাইতেন; দুৰ্গম ও ভয়ঙ্কর গিরিগুহায় মাসাধিককাল পৰ্যন্ত বাস করিতেন—সেখানে শুধু সিজদায় (নতশিরে) পড়িয়া অনবরত রোদন ও বিলাপ ব্যতীত তাঁহাব অন্য কোন কাজ ছিল না। এমনকি তিনি অনু্যন পঞ্চদশ বর্ষ এই ভাবে যাপন করিলেন-অবশেষে সেই শুভ মুহূৰ্ত্ত আসিল, যখন দৈববাণী তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “উঠ! খোদায় পাকের (পবিত্র ঈশ্বরের) নাম উচ্চারণ কর!” কিন্তু তিনি বুঝিতে পারিলেন না, সে শব্দ কাহার; অথবা ঐ আকাশবাণী বাস্তবিকই বিশ্বাসযোগ্য দৈববাণী কি না? কারণ তিনি বেশ জানিতেন যে, তিনি নিরক্ষর লোক ছিলেন। তাঁহার সন্দেহ হইত যে, ইহা হয়ত তাঁহার ভ্রম বা আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র-কিম্বা তাঁহার অহংজ্ঞান তাহাকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত ঐ রূপ শব্দ করিতেছে; এবং সম্ভবতঃ ইহা সেই দৈববাণী নহে, যাহা স্বয়ং খোদাতালার নিকট হইতে পয়গম্বরগণ শুনিতে পাইতেন, যাহাকে “এলহাম” কিন্বা “অহি” বলে।
অবশেষে আর একরার যখন তিনি ঈশ্বর-চিন্তায় অত্যন্ত আকুল ছিলেন, সহসা তাঁহার চতুস্পার্শ্ব এক অলৌকিক স্বগীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, আর সেই আলোকরশির মধ্যে একটী জ্যোতিষ্মান মূৰ্ত্তি দেখা দিয়া বলিলেন, “যাও, সত্য নাম উচ্চারণ কর।” একরার সাহসে ভর করিয়া সভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি কাহাকে ডাকিব?” ইহার উত্তরে স্বৰ্গদূত তাঁহাকে ঈশ্বরের একত্ত্ব, ফেরেশতাদের রহস্য, পৃথিবীর সৃষ্টি এবং মানবজাতির অস্তিত্ব বিষয়ে শিক্ষাদান করিলেন এবং তাঁহাকে সেই দায়িত্বপূর্ণ গুরুতর কৰ্ম্মভারের (পয়গম্বরীর) কথাও বলিলেন, যে জন্য তাঁহার জন্ম হইয়াছে। অর্থাৎ দেবদূত বলিয়া দিলেন যে, তাহাকে বিশ্ব জগতের ধর্ম্মপথ প্ৰদৰ্শক এবং উপদেষ্টার কার্য্যভার সমর্পণ করা হইয়াছে।
এদিকে দেবদূত অদৃশ্য হইলেন, ওদিকে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) যিনি এখন হইতে আরব দেশের পয়গম্বর নামে অভিহিত হইবেন, অত্যন্ত অস্থির ও ভীতি বিহবল চিত্তে গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন এবং অদ্ধ অচৈতন্য অবস্থায় ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িলেন। পতিপ্ৰাণা সতী হজরত খাদিজা উপযুক্ত শুশ্রুষা সহকারে তাঁহার তাদৃশ বিহবলতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রত্যুত্তরে পয়গম্বর সাহেব আনুপূর্বিক সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করিয়া বলিলেন, “বোধ হয় ইহা, আমার মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ।” ইহাতে পতিপরায়ণ সাধবী রমণী অতিশয় সান্তনাপূৰ্ণ মধুর বচনে তাহার নিস্তেজ হৃদয়ে বল সঞ্চার করিয়া বলিলেন, “না, না, তুমি সত্যবাদী- বিশ্বাসী—“আমীন”; প্রতিজ্ঞা পালনে যত্নবান; পিতৃহীনের প্রতি স্নেহ বৰ্ষণ কর; দরিদ্র, আতুর ও বিধবার প্রতি দয়া করিয়া থাক—এমন লোককে বিশ্বপাত কখনই অকালে নষ্ট করবেন না। প্ৰভু খোদাতালা কখনও বিশ্বাসী ভক্তদিগকে প্রবঞ্চনা করেন না। উঠ, এখন সেই দৈববাণী—প্রকৃত সত্য দৈববাণীর প্রত্যাদেশ অনুসারে কাৰ্য্য কর।”
সেই পুণ্যবতী মহিলা, যিনি সৰ্ব্ব প্রথমে পয়গম্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন,— এমনই সঞ্জীবনীসুধা পূর্ণ প্ৰবোধ বাক্যে র্তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন যে তিনি-যিনি নিজের দুর্বলতায় জড়ীভূত ও নিরুদ্যম হইয়া সম্পূর্ণ পরাজয় স্বীকার করিয়া বসিয়া ছিলেন,(3) এখন পূর্ণ সাহসে ও উৎসাহপূর্ণ হৃদয়ে, একেবারে উঠিয়া দাড়াইলেন! আর সে মোহাম্মদ কেবল মোহাম্পমদ মাত্রই রহিলেন না-বরং প্রবল প্ৰতাপশালী পয়গম্বর হইয়া গেলেন। তিনি একটা অসভ্য, অরাজক দেশকে শান্তিপূর্ণ এবং একটা জনপ্রাণীবিরল নগণ্য উপদীপকে এক মহা সাম্রাজ্যে পরিণত করিয়া তুলিলেন। তাহার শিষ্যমণ্ডলী ইউরোপে ধৰ্ম্ম ও জ্ঞানের আলোক লইয়া গেলেন, এই দুইটী বস্তু সেখানে প্রায় ছিলই না। তাঁহার অনুবৰ্ত্তিগণ পৃথিবীতে বড় বড় সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থান করিলেন। তাহারা সমবিশ্বাসীগণ এমন নিষ্ঠার সহিত এলাহীর ধ্যান ও স্মরণে নিমগ্ন হইলেন যে, তাহার আদর্শ অন্য কোন ধৰ্ম্মে পাওয়া সম্ভবপর কি না সন্দেহ। কারণ আপনারা একটু চিন্তা করিলে এবং ন্যায়চক্ষে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাইবেন যে, অন্য কোন ধৰ্ম্ম এমন নাই, যাহাতে এমন অকপটহাদয় সত্যবিশ্বাসী লোক পাওয়া যায়। এই জ্ঞান বিশ্বাস তাহারা (মুসলমানেরা) আরবদের পয়গম্বর হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে।
যদি বেন সাহেবের কথামত ইহাই সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় যে, সাধারণ আচার ব্যবহার হইতে ধর্ম্মবিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহা হইলে আপনারা ঐ ধর্ম্মের অনুবৰ্ত্তিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন এবং ভাবিয়া দেখুন, তাহার (হজরতের) বাক্যসমূহ তাঁহার শিষ্যবর্গের হৃদয়ে কেমন স্পষ্টভাবে অঙ্কিত রহিয়াছে। মুসলমানেরা আরবের পয়গম্বর হইতে যে শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাতে তাহাদের বিশ্বাস এমন সুদৃঢ় যে, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ স্থান পায় না।
একজন মুসলমান-যদ্যপি এমন কোন স্থানে এমন কতকগুলি লোক দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, যাহারা তাহাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের ছুরিকায় খণ্ড খণ্ড করে এবং তাহার পরগাস্বরের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে—নমাজে মস্তক অবনত করিতে কিছুমাত্র লজ্জিত বা কুষ্ঠিত হয় না।(4)
আপনারা আরও একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন, পয়গম্বরের সুপারিশের (শাফাআতের) প্রতি তাহাদের বিশ্বাস কেমন অটল যে, তাহারা মৃত্যুভয় একেবারে জয় করিয়া ফেলিয়াছে। আফ্রিকার দরবেশবৃন্দের সৎসাহসের তুলনা কেহ আমাকে দেখাইতে পারেন কি?-র্যাহারা ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু তোপ-কামানের সম্পমূখে স্থিরভাবে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাড়াইবার জন্য এমনই আনন্দের সহিত অগ্রসর হইতেন, যেন বরযাত্রিরূপে কোন বিবাহ সভায় যাইতেছেন। এবং যে পৰ্য্যন্ত তাঁহাদের দলের কয়েক ব্যক্তি শক্রসেনা পৰ্যন্ত পেঁৗছতে না পারিতেন, সে পৰ্যন্ত দলে দলে কামানে ধ্বংস হইতেন। সে কোন উদ্দীপনা ছিল, যাহা তাঁহাদিগকে এমন ভীষণ মৃত্যুমুখে লইয়া যাইত? তাহা কেবল পয়গম্বরের-কোরআনের মহিমা, এবং ইসলামপ্রেম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, (তাহাদের) এই ভক্তি পৃথিবীতে ভবিষ্যতেও অটল রহিবে, বরং বৰ্ত্তমান যুগ অপেক্ষা ভবিষ্যতে আরও উজ্জ্বল আলোক বিকীর্ণ করবে। (আমীন!)
ভদ্ৰ মহোদয়গণ! এখন আমি আরবীয় পয়গম্পবরের সত্যনিষ্ঠা সম্পবন্ধে একটি প্রমাণ আপনাদের সম্পমুখে উপস্থিত করিতেছি। তাহা এই যে—পয়গম্বরের “নবুয়তে” সৰ্ব্বপ্রথমে বিশ্বাস করিয়াছিলেন তাঁহার সহধৰ্ম্মিনী—যিনি তাহার গাৰ্হস্থ্য জীবনের সমুদয় রহস্য অবগত ছিলেন, আর তাঁহার অতি অন্তরঙ্গ আত্মীয়া ছিলেন বলিয়া তাহার আশৈশব জীবনের স্বভাব-চরিত্র সমুদয় উত্তমরূপে জ্ঞাত ছিলেন। এই যদি আপনারা বিবেচনা করিয়া দেখেন, তবে, পয়গম্ববরের সত্যপরায়ণতা সম্প্ৰবন্ধে অতি জ্বলন্ত প্ৰমাণ পাইবেন। আপনারা নিজেরাই বেশ জানেন যে, কোন বিজ্ঞ বক্তৃতানিপুণ ব্যক্তি কোন সভা সমিতিতে গিয়া বেশ ঝাড়া দুই ঘণ্টা উৎকৃষ্ট বক্তৃতা প্রভাবে শ্ৰোতৃবৰ্গকে মোহিত ও চমৎকৃত করিয়া স্বমতে তাঁহাদের বিশ্বাস জন্মাইতে পারে- যেহেতু সে সময় লোকে তাহাকে কেবল বক্তৃতা—মঞ্চেই দেখে; তাহার আভ্যন্তরীণ জীবনের অবস্থা কিছু জানে না। কিন্তু ইহা বড় কঠিন, এমন কি অসম্ভব যে নিজের স্ত্রী, কন্যা, জামাতা প্রভৃতি অতি নিকটবতী আত্মীয়গণ তাহার সত্যতার সাক্ষ্যদান করে– যদি সে ব্যক্তি বাস্তবিক তদ্রােপ নিম্পর্মল ও সত্যপর না হয়। আমাদের মতে ইহারই নাম “পয়গম্বর” এবং সত্য বলিতে কি এমন বিশ্বব্যাপী জয়লাভ হজরত মসিহের (যীশুর) ভাগ্যেও ঘটে নাই।(5)
আরবীয় পয়গম্ববরের আত্মীয়বান্ধবদের মধ্যে কেবল তাহার পিতৃব্য আবু তালেবই (?) এমন ছিলেন, যিনি কেবল নিজের একওঁয়ে গোড়ামীর জন্য তাঁহার ধৰ্ম্মমতে (প্ৰকাশ্যে) বিশ্বাস করেন নাই। তিনি সম্প্রান্ত কোরেশ বংশের দলপতি ছিলেন বলিয়া আপন পুরাতন পৈতৃক ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দেওয়া নিজের জন্য মানহানিকর বোধ করিতেন; নতুনবা তাঁহার কায্যকলাপে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইত যে, তিনি পয়গম্বরের ধৰ্ম্মে সম্পূর্ণ বি ছিলেন। কারণ তিনি রাসুলোল্লাহকে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছিলেন, “হে পিতৃব্যপ্ৰাণ! তুমি অসঙ্কোচে আপন কৰ্ত্তব্য পালন করিতে থাক; আমার জীবদ্দশায় কাহার সাধ্য যে, তোমার দিকে কটাক্ষপাত করে?” একদিন আবু তালেব স্বীয় পুত্র হজরত আলীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর ধৰ্ম্ম বিশ্বাস কি? আর তুই মোহাম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে কি মনে করিস?” হজরত আলী অত্যন্ত সম্পমান। অথচ উৎসাহের সহিত উত্তর করিলেন, “পিতৃদেব! আমি একমাত্র অদ্বিতীয় আল্লাহকেই পূজনীয় মনে করি, এবং মোহাম্মদকে আল্লাহতালার প্রকৃত প্রেরিত বলিয়া মানি। আব এই জন্য পয়গম্বরের সংশ্ৰব পরিত্যাগ করিতে স্বীকৃত হইব না।”
ঈদৃশ উত্তর শ্রবণে পিতার অসন্তুষ্টি হইবারই সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু তাহা তো হইল না! বরং তিনি বলিলেন, “পিতৃ-প্ৰাণ-পুত্তলি! আমি তোমাকে অতিশয় সন্তুষ্ট চিত্তে তাহার শিষ্যত্ব গ্রহণ ও তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে অনুমতি দিতেছি। যেহেতু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি তোমাকে সুপথ ছাড়া কুপথে পরিচালিত করিবেন না।”
নবুয়তের (পয়গম্বরী প্রাপ্তির) তিন বৎসর পর্যন্ত পয়গম্বর সাহেব নীরবে, বিনা আড়ম্ববরে আপনি মিশনের কার্য্য করিতেছিলেন। সে সময় তাহার প্রতি বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা মাত্র ৩০ জন ছিল। অতঃপর তিনি প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতা করিলেন, তাহাতে আল্লাহতালার একত্বের বিষয় অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বর্ণনা করিয়াছিলেন, এবং নরবলিদান, বিলাসিত ও সুরাপান যে অতি কদৰ্য্য, তাহাও বিশদরূপে বুঝাইয়া বলিয়াছিলেন। তাহার ঐ বক্ততার গুণে অনেকের হৃদয়ে বিশ্বাসের জ্যোতি প্ৰদীপ্ত হইল এবং তাঁহার শিষ্য সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল। কিন্তু ইহার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবন্ধকতা-বহ্নিও পয়গম্বর সাহেবের বিরূদ্ধে দেশময় প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিল। বিরোধী দলের হস্তে পয়গম্বর সাহেব যত প্রকার লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও নিগ্ৰহ ভোগ করেন, সাধারণ মানব তাহা কিছুতেই সহ্য করিতে পারিত না।
বিধর্ম্মী শত্ৰুগণ পয়গম্ববর সাহেবের ভক্ত, বিশ্বাসী লোককে যখন যেখানে দেখিতে পাইত, তমুহূৰ্ত্তেই হত্যা করিত। কাহারও প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করিত। কাহাকে বা হস্ত পদ শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া সূৰ্য্যের দিকে মুখ করিয়া মরুভূমিতে উত্তপ্ত বালুকার ড্রপরে শয়ান করাইয়া তাঁহার বক্ষের উপর প্রস্তর চাপা দিয়া বলিত, “তুই মোহাম্মদ ও তাহার আল্লাহকে অস্বীকার কর।” কিন্তু এত যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাঁহারা মোহাম্মদের কলেমা পড়িতে পড়িতে অকাতরে প্রাণত্যাগ করিতেন!
একদা কোন দুরাত্মা জনৈক মুসলমানকে ধরিয়া তাহার দেহ হইতে খণ্ড খণ্ড মাংস কাটিয়া ফেলিতেছিল, আর বলিতেছিল, “এ তুই যদি নিজের পুত্র পরিবারের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে ঘরে থাকিতিস, আর তোর স্থলে তোর মোহাম্মদ এইরূপ ছিন্নদেহে ভূমে লুটাইয়া ছট্ফট্ করিত তবেই বেশ ভাল হইত!” কিন্তু সেই সত্য ধৰ্ম্মপ্রাণ মুসলমান মৃত্যু পর্যন্ত এই একই উত্তর দিতেছিলেন, “আমার গৃহ, পুত্র কলাত্র-সুখ স্বাচ্ছদ্য, সমুদয় হজরৎ রসুলের পদতলে উৎসর্গ হউক। আমার সম্মুখে যেন তাহার চরণ কমলে একটি কন্টকও বিদ্ধ না হয়।”(6)
অবশেষে বিরোধী শত্ৰুগণ পয়গম্বর সাহেব ও তদীয় শিষ্যবৰ্গকে এত অধিক ক্লেশ দিতে লাগিল যে, তাহারা শেষে রসূলের ইঙ্গিতে দেশান্তরে গিয়া আশ্ৰয় লইতে বাধ্য হইলেন। পয়গম্বর সাহেবের একদল যখন শত্রু-তাড়নায় ব্যস্ত হইয়া হাবশ (আবিসিনীয়া) দেশে গেলেন, তখন শক্রিগণও তাঁহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া সে দেশে উপস্থিত হইল, এবং তত্ৰত্য খ্ৰীষ্টান রাজাকে অনুরোধ করিল যে, গকে উহাদের হন্তে সমর্পণ করা হউক। রাজা তখন হতভাগ্য প্রবাসী দিগকে ডাকিয়া তাহদের অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাহারা বলিলেন, “রাজন! আমরা অজ্ঞতা ও মূর্খতার সমুদ্র নিমগ্ন ছিলাম, আমরা ঘূণিত পৌত্তলিক ছিলাম; আমাদের জীবন দুৰ্দান্ত পশুপ্রকৃতি নরপিশাচের ন্যয় নীচ ও জঘন্য ছিল; নরহত্যা আমাদের দৈনন্দিন ক্রীড়া ছিল; আমরা জ্ঞানান্ধ, ঈশ্বরদ্রোহী ও ধৰ্ম্মজ্ঞান বিবজ্জিত ছিলাম; পরস্পরের প্রতি স্নেহশ্ৰীতি বা মনুষ্যত্বের নামগন্ধ আমাদের মধ্যে ছিল না; অতিথি সেবা কিম্বা প্রতিবেশীর প্রতি কৰ্ত্তব্য পালন বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম; আমরা ‘জোর যার মুলুক তার ব্যতীত অন্য বিধিনিয়ম জানিতাম না। আমাদের ঐই ঘোর দুরবস্থার সময় আল্লাহুতালা আমাদের মধ্যে এমন একজন মানুষ সৃষ্টি করিলেন-যাহার সত্যতা, সাধুতা এবং সরলতার উজ্জ্বল চিত্র আমাদের হৃদয়পটে অঙ্কিত রহিয়াছে; সেই ব্যক্তি আমাদিগকে এই শিক্ষা দিয়াছেন যে, “আল্লাহ এক, সৰ্ব্ব কলঙ্ক হইতে পবিত্র, কেবল তাঁহারই উপাসনা করা আমাদের অবশ্য কৰ্ত্তব্য; আমাদিগকে সত্য অবলম্বন এবং মিথ্যা বর্জন করিতে হইবে; প্রতিজ্ঞা পালনে বিশ্বজগতের প্রাণিবৃন্দের প্রতি স্নেহ মমতা প্রদর্শনে, প্রতিবেশীর প্রতি কৰ্ত্তব্য পালনে যেন বিমুখ না হই; যেন স্ত্রীজাতির প্রতি সদ্ব্যবহার করি, পিতৃহীনের সম্পত্তি আত্মসাৎ না করি; নিয়ম মত দৈনিক উপাসনা ও উপবাস (রোজা) ব্ৰত পালনে অবহেলা না করি।” রাজন! আমরা এই ধৰ্ম্মে বিশ্বাস রাখি এবং এই শিক্ষা গ্ৰহণ করিয়াছি।”
ভদ্ৰ মহোদয়গণ! পয়গম্বর সাহেবের শিষ্যবর্গের বিশ্বাস এবং ধৰ্ম্মমত এমনই উচ্চ ছিল যে, তাহারা প্ৰাণ হেন প্রিয় বস্তু করতলে লইয়া বেড়াইতেন! আমি আরবীয় পয়গম্ববরের সত্যতা ও অকপট হৃদয়ের প্রমাণ স্বরূপ আর একটি বিষয় আপনাদের শ্রবণগোচর করিতেছি।
একদা পয়গম্বর সাহেব আরবের কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন, এমন সময় একজন অন্ধ তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “হে খোদার রসূল! আমাকে পথ দেখাইয়া দাও, আমি সত্য পথ লাভ করিবার আশায় আসিয়াছি।” পয়গম্বর সাহেব বাক্যালাপে অন্যমনস্ক থাকাবশতঃ তাহার উক্তি শ্রবণ করেন নাই। সে পুনরায় উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিল, “হে রসুলোল্লাহু! আমার কথা শুন, ধৰ্ম্মপথ দেখাও!” তদুত্তরে তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তির সহিত তাহাকে অপেক্ষা করিতে ইঙ্গিত করিলেন। কিন্তু ইহাতে সে অন্ধ ক্ষুন্নচিত্তে চলিয়া গেল। পর দিবস পয়গম্বরের প্রতি যে “অহি” (দৈবাদেশ) আসিয়াছিল, যাহা অদ্যপি কোরআনে লিপিবদ্ধ আছে এবং চিরকাল থাকিবে, তাহার মৰ্ম্ম এই:
“রসুলের নিকট এক অন্ধ আসিল, কিন্তু সে (রাসুল) অবজ্ঞা করিল ও তাহার কথায় ভ্ৰক্ষেপ করিল না। তুমি কি করিয়া জান যে, সে পাপমুক্ত হইবে না, উপদেশ গ্রহণ করিবে না এবং সেই উপদেশ সে উপকৃত হইবে না? যে ব্যক্তি ধনী, তাহার সহিতই তুমি সসম্প্রম সম্ভাষণ করিতেছ, যদ্যপি সে বিশ্বাসী (ইমানদার) না হইত, তজ্জন্য তুমি অপরাধী হইতে না। কিন্তু যে ব্যক্তি স্বয়ং সরল হৃদয়ে সত্য ও মুক্তির অন্বেষণে আসিল, তাহার প্রতি মনোযোগ করিলে না। (ভবিষ্যতে যেন আর কখনও এরূপ না হয়)।”
ঐ দৈবা।দেশ পয়গম্বর সাহেবের মনে অত্যন্ত ফলপ্ৰদ হইয়াছিল। তদবধি যখনই তিনি উক্ত অন্ধকে দেখিতেন, তখনই বলিতেন, ইহার আগমন শুভ। যেহেতু ইহারই উপলক্ষে আল্লাহ আমাকে শাসন করিয়াছেন। পয়গম্বর সাহেব উক্ত অন্ধকে অত্যন্ত আদর যত্ন করিতেন এবং দুইবার তাহাকে মদিনায় কোন উচ্চপদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ফল কথা এই যে, পয়গম্বর সাহেব কেবল অপরকেই উপদেশ দিতেন না, বরং নিজের আত্মাকে উপদেশ গ্রহণের নিমিত্ত সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক প্ৰস্তুত রাখিতেন।
সচরাচর যেরূপ প্ৰত্যেক পয়গম্পবরের সহিত হইয়া আসিয়াছে, সেইরূপ আরবীয় পয়গম্বরের বিরুদ্ধেও সাধারণের বৈরিতারূপ ঝঞ্চানিল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ধৰ্ম্ম সংক্রান্ত শক্ৰতা সাধনের নিমিত্ত পয়গম্বর সাহেব ও তদীয় শিষ্যমণ্ডলীর বিরুদ্ধে নূতন বিপদের সূত্রপাত হইতে লাগিল! অবশেষে অবস্থা এমন ভীষণ হইয়া দাড়াইল যে পয়গম্বর সাহেব সমুদয় মুসলমানকে আপন আপন প্ৰাণ লইয়া যত্রতত্র পলায়ন করিতে অনুমতি দিলেন। তখন হজরতের নিকট মাত্র একজন ব্যতীত আর কেহই রহিল না। কিন্তু পয়গম্পবর সাহেব স্বীয় কৰ্ত্তব্য তেমনই নিভীক চিত্তে পালন করিতে থাকিলেন। এই সঙ্কট সময়ে তাহার আরিকুল তাহার প্রাণ বিনাশের সুযোগ অন্বেষণ করিতে লাগিল। তাহার পিতৃব্য আবুতালেব আর সাহা করিতে না পারিয়া তাহাকে ডাকিয়া সয়েহে বলিলেন, “হে পিতৃব্য-প্ৰাণ! কথা শুন, অমূল্য প্রাণ এমন অবহেলায় হারাইস না। আরবের রক্ত পিপাসু খঞ্জরাসমূহ তোরই জন্য শাণিত হইতেছে! তুই নিবৃত্ত হ’, তোর বক্তৃতা বন্ধ কর।”
তাঁহার কথায় পয়গম্বর সাহেব অতি সাহসের সহিত যে উত্তর দিয়াছিলেন, তাহা চিন্তা করিবার উপযুক্ত বটে। তিনি বলিলেন :
“পিতৃব্যদেব! আমি নিরুপায়। আমি ত কিছুই করি না, কে যেন আমার দ্বারা করাইতেছে। যদি বিধৰ্ম্মীগণ আমাকে এক হস্তে সূৰ্য্য অপর হস্তে চন্দ্র দান করিয়া বলে, “তুমি আপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ কর, তবু নিশ্চয় জানিবেন, আমি এ কার্য হইতে বিরত হইব নাযে পৰ্য্যন্ত ঈশ্বরের সেরূপ ইচ্ছা না হয়। অথবা আমি আমার এই সাধনার নিমিত্ত প্ৰাণত্যাগ করিব। তবে যদি আপনি নিজের জন্য ভয় করেন ত বলুন, আমি এই মুহূৰ্ত্তে আপনাকে ছাড়িয়া অন্যত্র যাই—আমার আল্লাহ আমার সঙ্গে থাকিবেন।” এই বলিয়া পয়গম্বর সাহেব সাশ্রুনিয়নে গমনোদ্যত হইলেন।
কিন্তু পিতৃব্যের স্নেহের উৎস উথলিয়া উঠিল, তিনি ব্যস্তভাবে বলিলেন, “প্ৰাণাধিক! আমি তোকে কিছুতেই ছাড়িব না। তোর অরিকুল হইতে তোকে রক্ষা করিব। তুই নিৰ্ভয়ে আপন কাজ কর।”
কিন্তু ভদ্ৰ মহোদয়গণ! আরবীয় পয়গম্বরের এই স্নেহময় পিতৃব্য আর অধিক দিন তাহার সঙ্গে থাকিতে পারেন নাই। সেই ঘোর দুর্দিনে তিনি দেহত্যাগ করিলেন। আর এই বৎসরই তাহার পতিপ্ৰাণা বনিতা খাদিজা বিবিও প্ৰেম-পাশ ছিন্ন করিয়া অনন্ত ধামে প্ৰস্থান করিলেন। এই সময় বাস্তবিক পয়গম্পর্বর সাহেবের পক্ষে অতি কঠোর শোক ও বিপদাকীর্ণ পরীক্ষার সময় ছিল। রসূলের শত্রুপক্ষ এই সময় প্রবল হইতে প্রবলতর হইল। (আহা! বিপদ কখনও একা আইসে না)।
ক্রমে অবস্থা এমন ভয়ানক হইল যে, পয়গম্বর সাহেব মক্কা পরিত্যাগ করিতে প্ৰস্তুত হইলেন। তখন হজরত আলী এবং আবুবকর সিদীক-মাত্র এই দুইজন ব্যতীত, তাহার নিকট আর কেহই ছিল না। তমোময়ী নিশীথে পয়গম্বর সাহেব ত আবুবকরকে সঙ্গে লইয়া মদিনা অভিমুখে যাত্রা করিলেন, এদিকে হজরত আলী তাঁহার শয্যায় শয়ন করিয়া রহিলেন যাহাতে শত্ৰুগণ নিশ্চিন্ত থাকে। মোহাম্মদ সাহেবের অরাতিকুল যথাকলে উন্মুক্ত কৃপাণ হস্তে তথায় উপস্থিত হইল; বস্ত্রাবরণ উন্মোচন করিয়া দেখিল, একি! এ ত মোহাম্মদ (দঃ) নহেন! এ যে আলী শয়ান রহিয়াছেন! উহারা তাহাকে কিছু না বলিয়া পয়গম্বর সাহেবের মস্তক আনয়নের নিমিত্ত বহুমূল্য পুরস্কার ঘোষণা করিল।
পয়গম্বর সাহেব যৎকালে একমাত্র সঙ্গী আবুবকর সিদীক সহ গমন করিতেছিলেন, তখন আবুবকর অত্যন্ত ব্যাকুল চিত্তে কহিলেন, “হে হজরত! আমরা ত মাত্র দুইজন!” তিনি উত্তর করিলেন, “না, না! আমরা তিন জন-ইহাদের একজন অতিশয় প্রতাপশালী— সমুদয় বিশ্বজগৎ এক দিকে, আর তিনি একা এক দিকে।” আবুবকর সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন, “হজরত! সে তৃতীয় জন দ্বারা আপনি কাহাকে বুঝাইতে চাহেন? ” উত্তর হইল, “সেই সৰ্ব্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত সঙ্গে আছেন।” এ কথায় আবুবকর নিশ্চিন্ত হইলেন।
পয়গম্বর সাহেব মদিনা নগরে উপস্থিত হইলেন। সেখানে তিনি আশাতীত যত্ন ও সমাদরে গৃহীত হইলেন। শত শত সমাজ-নেতা অগ্রসর হইয়া, তাহাকে আমন্ত্ৰণ করিয়া লাইতে আসিলেন, এবং তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন। হজরতের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অনুচরবর্গও ক্রমে ক্ৰমে মদিনায় আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু পয়গম্বরের বিপক্ষগণ সেখানেও তাঁহাকে নিশ্চিন্ত মনে তিষ্ঠিতে দিল না। তাহারা এবার সৈন্য সামন্ত সংগ্ৰহ করিয়া পয়গম্বর সাহেবকে আক্রমণ করিল। তখন পয়গম্বর সাহেবও কেবল আত্মরক্ষা কলেম্প স্বীয় ক্ষুদ্র যোদ্ধৃদল লইয়া বাহিরে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে প্রার্থনা করিলেন :
“জগৎপাতা! তুমি সমস্তই দেখিতেছি, এবং সবিশেষ অবগত আছ। অদ্য যদি আমার ক্ষুদ্র সেনাদল বিনষ্ট হইয়া যায়, তবে তােমার সত্য নাম প্রচার করিবার লোক আর কেহ থাকিবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তুমি সত্যের সহায় হইবে।”
অবশেষে এই প্রথম রক্ত প্রবাহিনী যুদ্ধ-যাহা বন্দরের যুদ্ধ নামে বিখ্যাত—হইয়া গেল। ওদিকে ত সহস্ৰ সহস্ৰ যোদ্ধা ধরাশায়ী হইল, এদিকে একশত বীরও ক্ষয় হইয়াছিল কি না। সন্দেহ। কাৰ্য্যতঃ ইহা সুস্পষ্টই বোধ হইতেছিল যে, মুসলমানদের পক্ষে কোন অদৃশ্য শক্তি যুদ্ধ করিতেছিল, তাই স্বল্প সময়ের মধ্যেই মোসলেমগণ সম্পূর্ণ জয়লাভ করিলেন। পয়গম্বর সাহেবের জীবনে এই প্রথম রক্তপাত-যাহা তিনি অনন্যোপায় হইয়া করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নতুবা তিনি এমন দয়ার্দ্রহৃদয় ও বিশ্বপ্রেমিক ছিলেন যে, দুৰ্দ্ধৰ্ষ লোকেরা তাঁহাকে ভীরু ও কাপুরুষ বলিত। এইরূপে কয়েকরার আরবের মোসলেম-বিদ্বেষিগণ মহা সমারোহে যুদ্ধায়োজন লইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করে, এবং পয়গম্বর সাহেব শুধু আত্মরক্ষাশিষ্যমণ্ডলীর প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত যুদ্ধ করিতে বাধ্য হন। পরস্তু সৰ্ব্বদা সত্য ও ঈশ্বরের অনুগ্রহ তাহার সঙ্গে থাকায় বিজয়ের উপর বিজয় লাভ করিতে থাকিলেন। এবং অযাচিত প্রভুত্ব লাভ করিলেন। এমনকি তিনি স্বাধীন রাজার ন্যায় সমগ্র আরব উপদ্বীপে রাজত্ব করিতে লাগিলেন।
এই সময় পয়গম্বরের অতীত ও বৰ্ত্তমান জীবনে বিশেষ পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হইল। পূৰ্ব্বে লোকে তাহার প্রতি অত্যাচার করিলে তিনি তাহার প্রতিশোধ না লইয়া তাহাদের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করিতেন। এখন তিনি সৈন্য সেনানী ও যথাবিধি সমর্যায়োজন রাখিতে বাধ্য হইলেন-যাহা একজন সম্রাটকে করিতে হয়। এবং অপরাধীকে শাস্তিদান করিতেও হইত। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তিনি অতি উচ্চ আদর্শের দয়া ও ন্যায় বিচার প্রদর্শন করিয়াছেন।
পয়গম্বর সাহেবের জন্মের পূর্বের অর্থাৎ যে সময়কে আরবীয় মুসলমানদের মূর্খতার যুগ বলা হয়, যুদ্ধে ধৃত বন্দীগণের প্রতি এমন নৃশংস নিৰ্য্যাতন করা হইত যে, তাহার তুলনা নিতান্ত অসভ্য বৰ্ব্বর জাতির মধ্যেও পাওয়া কঠিন। কিন্তু পয়গম্বর সাহেবের সময়ে যুদ্ধে ধৃত বন্দীদিগের প্রতি যেরূপ সদয়, সুভদ্র ব্যবহার করা হইত, তাহার আদর্শ অদ্যপি কোন অতি সভ্য দেশ ও সমাজে পাওয়া যাইবে কি না, সন্দেহ। একদা রণযাত্রাকালে তাঁহাদের সমভিব্যাহারে এক দল বন্দী ছিল। খাদ্য সামগ্ৰীতে (রাসাদে) আটা অল্প ছিল বলিয়া সংবাদ পাওয়া গেল; তচ্ছবিনে রসুলোল্লাহ আদেশ দিলেন যে, বন্দীদিগকে রুটী দান করা হউক, আর স্বাধীনেরা খৰ্জ্জুর ভক্ষণ করুক। (কি মহত্ত্ব!)
আর এক বারের ঘটনা এই যে, যুদ্ধ জয়ের পর, লুষ্ঠিত দ্রব্য যখন বণ্টন করা হইল, তখন পয়গম্বর সাহেব স্বীয় নিকটবৰ্ত্তী প্রিয় সহচরবৃন্দকে ভাগ লইতে দিলেন না। ইহাতে তাহারা ক্ষুব্ধ হইয়া পরস্পর আলোচনা করিতে লাগিলেন। পয়গম্বর সাহেব তাহা অবগত হইয়া, সহচরদের ডাকিয়া বলিলেন, “বন্ধুগণ! তোমরা জান, পূৰ্ব্বে তোমরা কিরূপ বিপন্ন ছিলে, আল্লাহ তোমাদের বিপন্মুক্ত করিয়াছেন; তোমরা একে অপরের রক্ত পিপাসু ছিলে, প্ৰভু তোমাদিগকে এখন ভ্রাতৃপ্রেম দান করিয়াছেন; তোমরা কোফরের (অধৰ্ম্মেীর) অন্ধকারে কারারুদ্ধ ছিলে, তিনি বিশ্বাসের নিম্পর্মল জ্যোতিতে তোমাদের মন আলোকিত করিয়াছেন। তাহার এই সকল অনুগ্রহপূরস্কার কি তোমরা প্রাপ্ত হও নাই?” তাহারা এক বাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ আমাদের অবস্থা বাস্তবিক এইরূপই ছিল, এবং এখন যে সুখ সম্পদ ভোগ করিতেছি, আল্লাহতালারই অনুগ্রহে এবং আপনার দয়ায় আমাদের ভাগ্যে ঘটিয়াছে।” তিনি উহাদের কথায় বাধা দিয়া বলিলেন, “না, নাং বল যে কেবল খোদার অনুকম্প ছিল। আর যদি তোমরা এইরূপ বলিতে ত’ আমিও সাক্ষ্য দিতাম। আমার সম্বন্ধে তোমরা ইহা বলিতে পার যে, তুমি এখানে পলায়ন করিয়া আসিয়াছ, আমরা তোমায় আশ্রয় দিয়াছি; তুমি দুঃখচিন্তা ভারাক্রান্ত ছিলে, আমরা তোমায় সাত্ত্বনা দিয়াছি।” (এ কথায় তাহারা কোন উত্তর দিলেন না। তাঁহাদিগকে মৌনাবলম্বন করিতে দেখিয়া) পুনরায় পয়গম্বর সাহেব বলিলেন, “হে প্রিয় সহচরবৃন্দা! লুষ্ঠিত দ্রব্যের বিনিময়ে কি তোমরা আমাকে পাইতে ইচ্ছা কর না? খোদার কসম! খোদার সমস্ত রাজ্য বিপক্ষে দাড়াইলেও মোহাম্মদ আপনি সহচরদের পক্ষে থাকিবে, যে হেতু তাঁহারা বিনা স্বার্থে-শুধু ঈশ্বরোদেশে কষ্ট স্বীকার করিতেছেন।”
পয়গম্বর সাহেবের এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার সুফল এমন হইল যে, উক্ত সহচরীগণর্যাহারা মরিতে মারিতে নিভীক, শৌৰ্য বীৰ্য্যে সিংহ-তুল্য জাতি ছিলেন, এক্ষণে দর বিগলিত ধারায় অশ্রু বিসৰ্জন করিতে লাগিলেন এবং বলিলেন, “হে রসুলাল্লাহু! আমাদের বাৰ্ত্তমান। অবস্থায় সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হইয়াছি।”
আমার হিন্দু ভ্রাতৃগণ! আপনারা বাস্তবিক আরবীয় পয়গম্বরের অবস্থা কিছুমাত্র অবগত নহেন। আপনারা এ অলৌকিক ঐশিক শক্তি দেখিতে সক্ষম নহেন, যাহা তাঁহার সহস্ৰ সহস্র শিষ্যকে কষ্ট স্বীকার তা তুচ্ছ—মৃত্যুর সম্পমুখীন করিয়াছে; যাহা কোটী কোটী লোকের অন্তরে ঈশ্বর প্ৰেম অঙ্কিত করিয়াছে আপনারা আরবীয় পয়গম্ববরের নিরহঙ্কার ভাবও আত্মত্যাগের বিষয় একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন ত! তিনি অনুবৰ্ত্তিগণকে এই শিক্ষাই দিয়াছেন যে তাঁহাকে যেন কেহ দেবতা কিম্বাবা অমাধারণ ব্যক্তি বলিয়া জ্ঞান না করে। তিনি বার স্বার বলিয়াছেন, “আমি তোমাদেরই মত মানুষ, এইমাত্র প্রভেদ যে, আমি তাহার (খোদার) দূত, তাহার সংবাদ তোমাদিগকে পেঁৗছাই।” পয়গম্বর সাহেবের নিরভিমান ও সরলতার প্রমাণ এতদপেক্ষা অধিক আর কি হইতে পারে। যে সময় তিনি রাজাধিরাজ সম্রাট ছিলেন, তখন স্বহস্তে আপন জীর্ণবস্ত্রে চীর সংলগ্ন করিতেন-ছিন্ন পাদুকা স্বহস্তে সেলাই করিতেন! তাহার শান্ত স্বভাব সম্বন্ধে তদীয় ভূত্য আনাস বলিয়াছেন, “আমি দশ বৎসর তাঁহার নিকট ছিলাম, তিনি কদাচ অপ্রিয় বচন কহিবেন দূরে থাকুক, আমার ‘তুই’ পর্য্যন্ত বলেন নাই।” (হাদীস শরীফে তুই শব্দের উল্লেখ নাই), ভ্রাতৃগণ! এমনই আড়ম্বর-শূন্য জীবন ছিল সেই সম্রাটের, যিনি ইচ্ছা করিলে পরিচর্য্যার জন্য সহস্রাধিক দাস দাসী রাখিতে পারিতেন!
আরবীয় পয়গম্বর যে “মিশনের জন্য জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহ সমাধা করিলে পর সেই (দারুণ) সময় আসিল, যখন একদিন (মৃত্যুর কিছুদিন পূৰ্ব্বে) রোগক্লিষ্ট অবস্থায় তিনি বহু কষ্টে নমাজের নিমিত্ত মসজিদে আনীত হইলেন। (নামাজ শেষ হইলে) তিনি আপন পীড়িত ক্ষীণ কণ্ঠ যথাশক্তি উচ্চ করিয়া বলিলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা সাধারণে ঘোষণা করিয়া দাও, যদি আমি এ জীবনে কাহারও প্রতি অত্যাচার অবিচার করিয়া থাকি, তবে সে অদ্য আমা হইতে প্ৰতিশোধ লউক, পরলোকের জন্য যেন স্থগিত না রাখে। যদি কাহারও কিছু প্রাপ্য থাকে, সে ঋণ শোধের নিমিত্ত আমার ঘরদ্বার তাহাকে সমর্পণ করিতেছি। অদ্য আমি সকল প্রকার জবাবদিহির জন্য উপস্থিত আছি।”
একজন বলিল, হজরতের নিকট তাহার ত্রিশ “দেরেম’ পাওনা আছে, তাহা রসুলোল্লাহ তম্মমুহূৰ্ত্তে শোধ করিলেন।(7) এই তাঁহার মসজিদে শেষ আগমন। অতঃপর ৬৩২ খৃষ্টাব্দে ৮ই জুন আরবীয় পয়গম্বর নশ্বর মৃন্ময় দেহত্যাগ করলেন, যাহাতে অতি উচ্চ অনন্তধ্যমে গিয়া স্বীয় প্রতিষ্ঠিত ধর্ম্মের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে পারেন। এই জীবন অতি উচ্চ, পবিত্র বিস্ময়কর এবং বাস্তবিক খোদার পয়গম্ববরেরই যোগ্য ছিল। (অবশ্য, সাধারণ মানবের জীবন এরূপ হওয়া অসম্ভব)।
ভদ্ৰ মহোদয়গণ! এখন আমি আপনাদিগকে আরবীয় পয়গম্ববরের প্রতি যে সব অন্যায় দোষারোপ করা হয়, তাহার বিষয় বলিতেছি। অনভিজ্ঞতা ও ন্যায়ান্যায় জ্ঞানাভাবে, অথবা শুধু কুসংস্কারবশতঃ রসূলের প্রতি ঐসব দোষারোপ করা হইয়া থাকে। তাহার একতম দোষ এই বলা হয় যে, তিনি র শেষভাগে সৰ্ব্বশুদ্ধ ৯জন মহিলার পাণিগ্রহণ করেন। তিনি বিবাহ করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আপনারা কি আমাকে বুঝাইয়া দিতে পারেন যে, সেই ব্যক্তি, যিনি ২৪ বৎসর বয়ঃক্রম পৰ্যন্ত কোন প্রকার “মকারাদি” কু অবগত ছিলেন না, পরে নিজের অপেক্ষা অনেক অধিক বয়স্ক একটি বিধবার পাণিগ্রহণ করিয়া তাঁহারই সহিত অতি সুখে জীবনের ২৬টি বৎসর যাপন করিলেন; তিনি শেষ বয়সে, যখন মানুষের জীব নিৰ্ব্বাপিত প্রায় হয়, শুধু আত্মসুখের জন্যই যে কতকগুলি বিবাহ করিবেন, তাহা কি সম্ভব? যদি ন্যায় বিচারের সহিত বিবেচনা করেন, তবে আপনারা বেশ জানিতে পরিবেন।– সে বিবাহের উদ্দেশ্য কি ছিল। প্ৰথমে দেখিতে হইবে, তাহারা (হিজরতের পত্নিগণ) কোন শ্রেণীর কুলবোলা ছিলেন, আর কেনই বা তাঁহাদের রসুলের প্রয়োজন ছিল।—কতিপয় নারী এরূপ ছিলেন যে তাঁহাদের বিবাহের ফলে রসুলের পক্ষে ‘নূর-ইসলাম’ প্রচারের সুবিধা হইল। আর কয়েকজন। এরূপ ছিলেন যে, বিবাহ ব্যতীত তাহদের ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অন্য কোন উপায় ছিল না।
আরবীয় পয়গম্ববরের প্রতি আর একটি দোষারোপ এই করা হয় যে, তিনি রক্তপাতের প্রশ্রয় দিতেন এবং কারণে অকারণে কাফের হত্যা করিতে আদেশ দিতেন। এখন এ সম্পবন্ধে আপনারা আমার বক্তব্য শ্রবণ করুন। যখন আইনের দুই দফা প্রায় একই প্রকার হয় অর্থাৎ একটি কোন সৰ্ত্তের অধীন এবং অপরটি সত্তাবিহীন তখন সৰ্ত্তহীন ধারাও সৰ্ব্বদা সৰ্ত্তাধীন ধারা বলিয়াই মানিতে হয়। মুসলমানদের শাস্ত্রকারগণ সৰ্ব্বদা এ বিষয়ের সম্মান রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন এবং কোরআনের বচনসমূহেও একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যথা একস্থলে বলা হইয়াছে, “কাফেরকে হত্যা কর,” এবং অপর স্থলে বলা হইয়াছে, “হত্যা কর, যদি তাহারা তোমাদের ধৰ্ম্মকর্ম্মে বাধা দেয়।” এখন আমি আপনাদিগকে সেই মূল্যবচনসমূহের-যাহা রসূলের প্রতি প্রত্যাদেশ হইয়াছে, শাব্দিক অনুবাদ শুনাইতেছি। আমি নিজের ভাষায় বলিব না, কারণ যদি আপনারা মনে করেন যে আমি তাহাদের (মুসলমানদের) ধৰ্ম্মপ্রচার করিতেছি। তবে শ্রবণ করুন :
“যদি তাহারা তোমাদের প্রতি শত্রুতচরণ হইতে নিবৃত্ত হয়, তবে যাহা হইয়া গিয়াছে, ক্ষমা করা যাউক। কিন্তু যদি তাহারা তোমাদিগকে আক্রমণ করিতে অগ্রসর হয়, তবে পূৰ্ব্ববৰ্ত্তী পয়গম্বরদের প্রতি বিরুদ্ধাচরণের নিমিত্ত যেরূপ শাস্তি দেওয়া গিয়াছে সেইরূপ শাস্তি ভোগ করবে। এজন্য উহাদের সহিত যুদ্ধ করা যে পৰ্যন্ত উহারা পৌত্তলিকতা রক্ষার নিমিত্ত তোমাদের বিরুদ্ধাচরণে নিবৃত্ত না হয় এবং অদ্বিতীয় খোদার ধৰ্ম্মকে অমান্য করে, যুদ্ধ করিতে থাকে। আর যদি তাহারা মানে তবে নিশ্চয় জানিও আল্লাহ তাহদের কার্য্যকলাপ পৰ্য্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু যদি তাহারা সত্যাধর্ম্মের বিরোধী হয় তবে আল্লাহ তোমাদের সহায় হইবেন। তিনি সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ অভিভাবক এবং সাহায্যকৰ্ত্তা।”
আর একটি বিষয়, যাহা পয়গম্বরকে উপদেশ দানের নিমিত্ত কোরআনে অবতীর্ণ হইয়াছে, আপনাদের শ্রবণগোচর করিতেছি :
“মনুষ্যদিগকে নাম মৃদু ভাষায় যুক্তি সহকারে উপদেশ দিয়া আল্লাহতালার ধৰ্ম্মপথে আহবান করা; তাহদের সহিত অতিশয় ধৈৰ্য্য, ও গান্তীৰ্য্যের সহিত সদয়ভাবে তর্ক কর, কেন না। উহাদের কে সত্য পথ ভুলিয়া ভ্রান্ত হইয়াছে এবং কে সত্যপথে আছে তাহা আল্লাহ সবিশেষ অবগত আছেন। যদি তুমি প্রতিশোধ লও। তবে লক্ষ্য রাখিও যে তাঁহা তোমার প্রতি যে অত্যাচার অনাচার হইয়াছে (ন্যায় বিচার অনুসারে) তাহার সমান হয়; আর যদি তুমি প্রতিশোধ না লইয়া সহ্য কর তবে সাবের (সহিষ্ণু) ব্যক্তির পক্ষে আরও ভাল কথা। সুতরাং ভাল হয় যদি শক্ৰদের প্রপীড়ন ধীরতার সহিত সহ্য কর। কিন্তু স্পমরণ রাখিও তোমার কাৰ্যকলাপ তবেই সফল হইবে, যখন তাহার সহিত আল্লাহতালার অনুগ্রহ মিশ্রিত থাকিবে। কাফেরদের ব্যবহারে দুঃখিত হইও না, এবং উহাদের চাতুরী শঠতায়ও ব্যতিব্যস্ত হইও না, কারণ আল্লাহ তাহারেই সাহায্য করেন—যাহারা সাধু ও ন্যায়পরায়ণ হয় এবং তাহাকে ভয় করে।”
আর একটী উপদেশ শ্ৰবণ করুন; -“ধৰ্ম্ম কম্পম ব্যাপারে কাহারও প্রতি অত্যাচার করিও না; যদি সে ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্রহণ করে তবে বুঝিও আল্লাহ তাহাকে সৎপথ প্রদর্শন করিয়াছেন, আর যদি ধৰ্ম্ম স্বীকার না করে তবে আর কি করা-তোমার কাজ ত কেবল উপদেশ দান ও প্রচার করাই ছিল।”
আরও শ্রবণ করুন,-পয়গম্বর সাহেব কাফেরের কিরূপ বর্ণনা করিয়াছেন, “কাফের তাহারাই যাহারা ন্যায় বিচারের বিপরীত কাৰ্য্য করে; পাপী কেবল তাহারাই যাহারা ইসলাম ধৰ্ম্মের বাহিরে।” ইহাতে সুস্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে ইসলাম ধৰ্ম্মের বৃত্তি তত সঙ্কীর্ণ নহে যে কেবল পয়গম্বর সাহেবের শিষ্যবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে।
আর একস্থলে (প্রত্যাদেশ) আসিয়াছে যে “যদি তাহারা তোমাদের বিরোধী হইয়া যায় কিন্তু তোমাদের সহিত যুদ্ধ কলহ না করে আর তোমাদের সহিত বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করে
ভুল হাদিগকে হত্যা করা কিবা তাহাদের বশীভূত করিতে চেষ্টা করা ঈশ্বরাদেশের বিরুদ্ধ।
উপস্থিত মহোদয়গণ আপনারা কি বলিতে পারেন যে ইহা ন্যায় বিচারের কথা হইবে যে আমরা পয়গম্বর সাহেবের তাদৃশ মিলনপ্ৰয়াসী শান্তিসূচক বচনসমূহের প্রতি-যাহা সেরূপ যুদ্ধ কলহ এবং অত্যাচারের যুগে বলা হইয়াছিল, একটু মনোযোগ না করি, আর কেবল ঐ সকল বচন, যাহা তিনি কোন এক ক্ষুদ্র সৈন্যদলকে প্রবল শত্রুর সম্পমুখীন হইবার সময় উৎসাহিত করিবার জন্য বলিয়াছিলেন, সেগুলিকে ধরিয়া লই? আর আমার মতে যে কোন সেনাপতি এরূপ স্থলে থাকিতেন, তিনি এতদপেক্ষা অধিক যোগ্যতার কাজ আর কি করিতেন?
বেশ, এখন আপনারা সেই শান্তিপ্রিয়তা শিক্ষার আর একটি দৃষ্টান্ত, যাহা পয়গম্বর সাহেবের স্বকীয় ব্যবহারে দেখা যায়, একটু সমালোচনা করিয়া দেখুন ত অত্যাচার এমন কোন ছিল না, যাহা পয়গম্ববরের প্রতি করা হয় নাই,–আর তিনি তাহা ক্ষমা না করিয়াছেন; কোন নিৰ্য্যাতন এমন হয় নাই যাহা তিনি ক্ষমা করিতে প্ৰস্তুত না ছিলেন। হে ভ্ৰাতৃগণ! কোন ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা জানিতে হইলে তাহাকে ঠিক সেইভাবে দেখুন যে অবস্থায় তিনি বাস্তবিক থাকেন, কুসংস্কারের চশমা পরিয়া দেখিবেন না।
প্রত্যেক ধৰ্ম্মেই কিছু না কিছু দোষ জমিয়াই থাকে; সমস্ত সাধু প্রকৃতি লোকের কাৰ্যকলাপে কোন না কোন দোষ থাকেই, বিধৰ্ম্মী এবং মূখ শিষ্য একে আর বুঝিয়া থাকে। কোন ধৰ্ম্ম দেখিতে হইলে সেই ধৰ্ম্মাবলম্ববীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তিকে দেখা উচিত; তাহা না করিয়া কোন নরাধমকে দেখিয়াই তাঁহাকেই দৃষ্টান্ত বলিয়া ধারণা করা অন্যায়। তবেই আমরা একে অপরকে ভ্ৰাতার ন্যায় ভালবাসিতে শিখিব এবং বন্য অসভ্যদের মত একে অপরকে ঘূণার চক্ষে দেখিব না।
আমার দুঃখ হইতেছে যে সময়াভাবে আমি ইসলামের শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় সম্বন্ধে কিছু বলিতে পারিলাম না। যদিও সে বিষয়টিও আপনাদের ভাল লাগিত কিন্তু তাহা তত প্রয়োজনীয় নয় বলিয়া আমি এস্থলে সে বিষয় পরিত্যাগ করিলাম।
প্ৰত্যেক ধর্ম্মেই বাহ্যিক অবস্থার পরে দর্শন থাকে। যদি এ সময় ইসলামের বাৰ্ত্তমান অবস্থায় আমরা তাহার স্বল্পতা দেখিতেছি, (তাহাতে বিশেষ ক্ষতি নাই) কারণ, আমরা যখন সেই সময়ে-যখন ইসলামের জ্যোতি আরম্ভ হইয়াছিল, দৃষ্টিপাত করি তাহার গুণ ব্যাখ্যার উপযুক্ত ভাষা ও শব্দ পাই না।
এখন আপনারা বিবেচনা করিয়া দেখুন, আরবীয় পয়গম্বর তের শত (১৩০০) বৎসর পূৰ্ব্বে শিক্ষার উপকারিতা সম্বন্ধে কি বলিয়াছিলেন -“বিদ্যা শিক্ষা কর; যে বিদ্যা শিক্ষা করে সে নিম্পর্মল চরিত্র হয়; যে বিদ্যার চর্চা করে সে ঈশ্বরের স্তব করে; যে বিদ্যা অন্বেষণ করে সে উপাসনা (এবাদত) করে; যে উহা শিক্ষা দেয় সেও উপাসনা করে; শিক্ষাই সুপথ প্রদর্শন করে; শিক্ষাই নিৰ্জ্জনে নিৰ্ব্বাসনে প্রকৃত বন্ধুর কাজ করে; বনবাসে সাত্মনা প্রদান করে; বিদ্যা আমাদিগকে উন্নতির মাৰ্গে লইয়া যায় এবং দুঃখে সহানুভূতি প্রকাশ করে। বন্ধু সভায় বিদ্যা আমাদের অলঙ্কার স্বরূপ; শত্ৰু সম্পমূখে অস্ত্র স্বরূপ।(8) বিদ্যার দ্বারা আল্লাহতায়ালার বিপন্ন দাস পুণ্যের সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়।”
পয়গম্বর সাহেবের নিম্নোক্ত বচনসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে আমি ভক্তিপ্রেমে অভিভূত হইয়া পড়ি। তিনি বলিয়াছেন, “বিদ্বানের (লিখিবার) মসী শহীদ (ধৰ্ম্মৰ্থ সমরশায়ী)-দের রক্তাপেক্ষাও অধিক মূল্যবান।” ভ্রাতৃগণ! বিদ্যার গৌরব বর্ণনা। এতদপেক্ষা অধিক আর কি হইতে পারে?
হজরত আলী যিনি পয়গম্বর সাহেবের প্ৰিয় জামাতা ছিলেন, আর র্যাহার সম্পবন্ধে পয়গম্বর সাহেব বলিয়াছেন যে “আলী ইসলামে বিদ্যা জ্ঞানের দ্বার স্বরূপ।” মুসলমানদের মধ্যে হজরত আলীই প্ৰথমে এলমে-এলাহী প্রচার আরম্ভ করেন। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে হজরত আলীর যে সকল বক্তৃতা আছে তাহা পাঠের উপযুক্ত। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহের সময়ও (যুদ্ধক্ষেত্রে) ধৰ্ম্ম বক্তৃতা (খোতবা) পাঠ করিতেন।
বিদ্যার প্রশংসা বিষয়ে আলীর রচনাবলী হইতে কয়েকটি আমি এখানে উদ্ধৃত করিতেছি :
“অন্তর আলোকিত করিবার জন্য সুশিক্ষা উজ্জ্বল রত্ন; সত্য তাহার (বিদ্যার) লক্ষ্য; ঈশ্বরতত্ত্ব (এলহাম) তাহার পথ প্রদর্শক; বুদ্ধি (সুবোধ?) তাহাকে গ্রহণ করে; বানরের ভাষায় বিদ্যায় যথোচিত প্ৰশংসা হইতে পারে না।”
ওদিকে মুসলমানেরা দেশসংক্রান্ত কৰ্ত্তব্যসাধনে মগ্ন ছিলেন, এদিকে হজরত আলীর শিষ্যবৰ্গ শিক্ষা বিস্তার করিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁহারা যেখানেই যাইতেন শিক্ষার মশাল সঙ্গে লইয়া যাইতেন, তাহার ফলে এই হইল যে খৃষ্টীয় চতুৰ্দশ শতাব্দী পৰ্যন্ত ইসলামের শিশুদের হন্তেও শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রদীপ দেওয়া হইয়াছিল। যেখানে তাঁহারা দেশ জয় করিতেন, সেইখানেই পাঠশালা ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতেন। ইহার প্রমাণস্বরূপ কাহেরা, বাগদাদ, হিসপ্যানিয়া এবং কার্ডাভার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রদর্শন করিতেছি।(9)
ইংলণ্ডের লোকদিগকে মুসলমানরাই তাহাদের বিস্মৃত বিদ্যার বর্ণমালার পুস্তকাবলী অধ্যয়ন করাইয়াছিলেন। তাঁহারা জ্যোতিষ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছেন, ভারতবর্ষের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক পুস্তকের অনুবাদ করাইয়াছেন; রসায়ন এবং অঙ্কশাস্ত্রের পুস্তকাবলী রচনা করিয়াছেন।
জনৈক পোপ (দ্বিতীয় মিস্লউটিয়ার) যিনি খ্ৰীষ্টীয় ধৰ্ম্মের অতি উৎকৃষ্ট পণ্ডিত ও গুরু ছিলেন, তিনি মুসলমানদেরই কার্ডাভা মাদ্রাসায় অঙ্কশাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছিলেন। এই কারণে লোকে তাঁহাকে বিধর্ম্মী বলিয়া জনসমাজে অপদস্থ করিয়াছিল এবং তাঁহাকে “শয়তানের বাচ্চা” বলিয়াছিল। ইহাতে স্পষ্টই জানা যায় সে সময় ইউরোপের খ্ৰীষ্টীয় বিভাগ কেমন ঘোর মুখতায় তমসাচ্ছন্ন ছিল, আর কেবল ইসলামের অনুবৰ্ত্তিগণই তাহাদিগকে (ইউরোপীয়দিগকে) জ্ঞানের আলোকরশ্মি দেখাইতেছিলেন।
মুসলমানেরা শিল্প এবং আবিষ্কারেও পশ্চাৎপদ ছিলেন না। অনুবীক্ষণ যন্ত্র তাহারাই নিম্পর্মাণ করেন; পৃথিবীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের পরিমাণ র্তাহারাই স্থির করেন। গ্ৰীকদের নিকট হইতে র্তাহারা অঙ্কবিদ্যালাভ করেন; সঙ্গীত ও কৃষিবিদ্যাকে তাহারা উন্নতির চরম সীমায় উপনীত করিয়াছিলেন। তাহারা এই পৰ্য্যন্ত করিয়াই নিশ্চিন্তু ছিলেন না, বরং ধর্ম্মের দর্শন তত্ত্বের অতি সূক্ষ্ম আলোচনা করিয়া “ফানাফিল্লাহ’র গুঢ় তত্ত্বে উপনীত হইয়াছেন। তাঁহারা প্রচার করিলেন যে আল্লাহ অদ্বিতীয় এবং সমুদয় মানবজাতি এক জাতীয় (মানবের মধ্যে জাতিভেদ নাই)। আর এই বিধান তাহারা অতি মনোরম ভাষায় বুঝাইয়াছেন।
হে হিন্দু ভ্রাতৃগণ! আপনারা যদি ঐ শাস্ত্রবিধানসমূহের বিষয় চিন্তা করেন ত আপনারা উহাকে প্রকৃত (আসল) বেদান্ত স্বরূপ পাইবেন; মুসলমানদের মধ্যে পূর্ণ ছয় শত বৎসর পৰ্যন্ত শিক্ষা উন্নতির দিকে অগ্রসর হইয়াছিল। অদ্য যদি আমার মুসলমান ভ্রাতৃগণ নিজেদের ঐ সকল জগন্মান্য পূৰ্ব্বপুরুষদের রচিত শিক্ষা সংক্রান্ত পুস্তকাবলী আধুনিক প্রচলিত ভাষায় অনুবাদ করিয়া লয়েন এবং সৰ্ব্বসাধারণে ঐ শিক্ষা প্রচার করেন তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাহারা ইসলামী দর্শনকে সমস্ত জগতের শীর্ষস্থানে তুলিতে সক্ষম হইবেন। আর ইসলামের আবালবৃদ্ধবনিতা— (কচি কচি শিশুগণ)ও ইসলামী দর্শন কণ্ঠস্থ করিতে পরিবে। (যেমন হিন্দুগণ এখন আপন বেদান্ত প্রচারে মনোযোগী হইয়াছেন)। আপনারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন যে তাহারা ইসলামের প্রকৃত গৌরব সৃষ্টি জগৎকে দেখাইবার জন্য কিরূপে ধর্ম্মের সেবা করিয়াছেন।
হজরত মোহাম্মদ, হজরত ঈসা, রাজদশত, মুসা, মহর্ষি বুদ্ধদেব—সকলে একই অট্টালিকায় আছেন। তাহারা এক জাতি হইতে অন্য জাতিকে ভিন্ন মনে করেন না। আর আমরা যে তাঁহাদের সামান্য শিষ্য, তাহাদের শিশু সন্তান-আমাদের উচিত যে তাঁহাদের বিশ্বপ্রেমের সারাতত্ত্ব লাভ করি। প্রেম দ্বারাই তাহারা আমাদের নিকটবৰ্ত্তী হন। পয়গম্বর মোহাম্মদ সাহেব’ স্বেচ্ছায় স্বীয় শিষ্যের নিকটবৰ্ত্তী হন না, যে পৰ্য্যন্ত শিষ্য মনের কঠোরতা দূর না করে এবং তাহার হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার না হয়।
হে আমার মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ! পয়গম্বর সাহেব যেমন আপনাদের সেইরূপ আমাদেরও আপন। যত পয়গম্বর মানবজাতির কল্যাণের নিমিত্ত জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, সকলের উপরই আমাদের দাবী (হক) আছে। আমরা তাহাদিগকে ভালবাসি, তাহদের সম্পমান করি এবং তাঁহাদের সম্পমূখে অতি নম্নভাবে ভক্তি সহকারে মস্তক অবনত করি।
খোদার নিকট এই প্র্যর্থনা করি যে তিনি সকলেরই আল্লাহ;- তিনি আমাদিগকে এইরূপ বুঝিবার শক্তি দান করুন যে তাহার নামের জন্য যেন আমরা পরস্পরে ঝগড়া না করি।–আমাদের শিশুসুলভ দূৰ্ব্বল অধরে যে নামই উচ্চারিত হউক না কেন-কিন্তু তিনিই ত অদ্বিতীয় এবং সকলেরই উদ্দেশ্য (উপাস্য) একমাত্র তিনিই।(10)
——————
1. আশ্চর্য্যের বিষয়, এই সভ্যযুগেও বঙ্গীয় মুসলমানদের ঘরে ঐরূপ বংশানুক্রমে চিরস্থায়ী বিবাদ দেখা যায়। এইজন্য আমরা কলিকাতা হাইকোর্টে “Hereditary enemy” শব্দ শুনিতে পাই। আহা! কবে আমাদের প্রতি খোদাতালার রহমৎ হইবে!
2. হিজরতের পিতামহ আবদুল মুত্তালিব যে স্বীয় পুত্র হজরত আবদুল্লাকে প্রস্তরমূৰ্ত্তির নিকট বলিদান করিতে গিয়েছিলেন, এ কথার সত্যতায় আমার একটু দ্বিধা বোধ হয়। আলেম ফাজেলগণ দয়া করিয়া আমার সন্দেহ ভঞ্জন করিলে বিশেষ বধিত হইব। বাঙ্গালা “আমির হামজা” পুঁথিতে দেখিয়ছি, – (হজরত আবদুল মুত্তালিবের অন্য পুত্র হজরত আমির হামজা পিতাকে বলিলেন)-
“কাফেরে খাজনা দিবে মোছলমান হৈয়া।
আমি এয়ছা বেটা তবে কিসের লাগিয়া।।”
3. ইহা মিসিস বেশান্তের অতিশয়োক্তি। (আল-এসলাম সম্পাদক)
4. মিসিস এনি বেশন্তের বর্ণিত মুসলমান কি আমরাই? ছিঃ! ছি:! ধিক আমাদের! আমরা মুসলমান নামের কলঙ্ক। বঙ্গদেশে দড়ি ও কলসী একেবারে নাই কি?
5. অল্পদিন হইল-মুসলমান গ্ৰন্থকাবগণ ইংরাজী ভাষায্য এসলাম-সম্বন্ধে পুস্তক পুস্তিকা লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন, ইহার পূৰ্ব্বে ইউরোপে এসলাম সম্বন্ধীয় সমস্ত জ্ঞাতব্যই খ্ৰীষ্টান মিশনের এজেন্সী হইতে সংগ্ৰহ করা হইত-কাজেই অজ্ঞ ইউরোপ এসলামের নামে একেবারে শিহরিয়া উঠিত। এই অল্পদিনের চেষ্টায় কিরূপ ফল হইয়াছে, এই বক্তৃতা হইতেই তাহার আভাষ পাওয়া যাইতেছে। লর্ড হেড্রলি, খাজা কামালুদ্দিন, মিঃ, এহয়-উন-নাসর পর্কিনসন প্রভৃতি মুসলমান লেখকগণের চেষ্টায় ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের কিরূপ মত পরিবর্তন হইতেছে, “Islamic Review” পত্র পাঠ করিলে তাহা সম্যক অবগত হওয়া যাইতে পারে। আল-এসলাম-সম্পাদক।
6. মিসিস বেশান্ত এখানে দুইটী ঘটনা ভ্রমক্রমে এক বর্ণনার ভিতর ফেলিয়াছেন। অমুসলমানের পক্ষে এইরূপ ভ্ৰম মার্জনীয় (আল এসলাম–সম্পাদক)
7. মিসিস এনি বেশান্তি এ স্থলে “আক্কাসের তাজিয়ানৱ” বিষয় উল্লেখ করেন নাই; আমার মনে হয় এজন্য “প্রতিশোধ” বিষয়টি অঙ্গহীন ও অসম্পূর্ণ রহিয়াছে। সে তাজিয়ানার কথা এই :
কোন এক দিন হজরত কোন কারণে আক্কাস নামে এক ব্যক্তিকে এক ঘা কোড়া মাবিয়াছিলেন। অদ্য সেই আক্কাস মসজিদে আসিয়া সেই কোডার প্রতিশোধ পাইবোব দাবী কবিল, তখন বসূল, তাহার হস্তে কশাঘাত গ্ৰহণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। ইহা দেখিয়া উপস্থিত সহচরবৃন্দ ও আত্মীযবান্ধবগণ অত্যন্ত শোকসন্তপ্ত ও উদ্বিগ্ন হইলেন; যেহেতু হজরত এমন পীড়িত অবস্থায় কোড়াব আঘাত কিছুতেই সহ্য করিতে পরিবেন না। র্তাহারা অনুনয বিনয় কবিয়া আক্কাসকে নিবৃত্ত হইতে, অথবা রসুলের পবিবৰ্ত্তে তাঁহাদের গাত্রে একাধিক কোড়া মারিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু আক্কাস তাহাদের কোন কথায় কৰ্ণপাত কবিল না। তখন তাহাবা অতিশয় অধীব হইয়া ক্ৰন্দন ও বিলাপ কবিতে লাগিলেন,-নিষ্ঠুর আক্কাস করে কি? হায় হায, বসুল হত্যা করিবে; হজরত কিন্তু অবিচলিত চিত্তে আক্কাসকে তাহার আকাঙ্গিক্ষত প্রতিশোধ লহঁতে ইঙ্গিত কবিলেন। সে বলিল, “হজরত! আমি নগ্ন পণ্ঠে আপনার কোড়ার আঘাত পাইয়াছিলাম।” এতচ্ছবণে রসূলে করিম তৎক্ষণাৎ গাত্রবস্ত্র উন্মোচন করিয়া নগ্নদেহে কশাঘাত গ্ৰহণ করিতে প্ৰস্তুত হইলেন। বলি, আজ পর্যন্ত জগতে কেহ ঐরূপ ঋণ পবিশোধ করিতে পাবিয়াছে কি? আমার বিশ্বাস বসুলকে গাত্র বস্ত্র মোচন কবিতে দেখিযা স্বর্গদূত (ফেরেশতা) পর্যন্ত কম্পিত হইয়াছিলেন! এরূপ। মাহাত্ম্যু আরও কোন মহাপুরুষ দেখাইতে পারিয়াছেন কি? আক্কাস অবশ্য রসূলকে কোড়া মারিবার অভিপ্ৰায়ে আসিয়াছিল না, তাহার উদ্দেশ্য ছিল হজরতের পবিত্র পৃষ্ঠ চুম্বন করা। সে উদ্দেশ্য সফল হইল-ত্রুদনের রোলের মধ্যে ভক্তির জয় জয়কার ঘোষিত হইল।
–লেখিকা।
8. সুশিক্ষার কল্যাণে শত্রু জয় করা যায় একথা ধ্রুব সত্য। ঐ কারণেই বোধ হয় নারী বিদ্বেষী মহাশয়গণ স্ত্রী শিক্ষায় আপত্তি করেন। যেহেতু তাহা হইলে স্ত্রীলোকের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়! শুনিয়াছি, করটীয়ার প্রসিদ্ধ জমিদার মরহুম জমবরদন্নেসা খানম সাহেবা নাকি বলিয়াছেন, “এখন মরদের হাতে কলম; একবার জানোনার হাতে কলম দিয়া দেখা।” ইংরাজী প্রবচন বলে। “Pen is mightier than sword” –লেখিকা
9. আমাদের সদাশয় বৃটিশ প্ৰভুৱা দাবী করেন যে তাহারা অনুগ্রহপূর্বক ভারতবর্ষ জয় করিযাছেন বলিয়াই আমরা (বৰ্ব্বারবা) শিক্ষার আলোক প্রাপ্ত হইয়াছি। আর আমরাও নত মস্তকে স্বীকার করিয়া বলি যে,-“ইয়ে হয় আহলে মগরেবকে বরকৎ কদমকী” (ইহা পশ্চিম দেশবাসিদিগের শ্ৰীচরণের প্রসাদ)। কিন্তু মিসিস বেশান্ত ত বলেন যে শিক্ষা বিস্তার বিষয়ে মুসলমানেরাই ইউরোপের শিক্ষা গুরু।
10. এই সকল বিষযেব সহিত আমাদের মতানৈক্য নাই। মিসিস এনি বেশান্তি মহোদয়া থিওসোফীী একজন লর প্রতিষ্ঠ প্রচারক ও শিক্ষা গুরু। তিনি নিজের শিক্ষা ও ধর্ম্মের দিক দিয়া এসলামের সমালোচনা করিয়াছেন, ইহাতে তাঁহার সব কথার সহিত আমাদের মতের মিল থাকিতে পাবে না। এসলামেী প্রকৃত স্বকাপ এখনও বহুস্থলে অপ্রকাশিত বহিয়াছে। আমরা যদি যথাযথভাবে ঐ স্বরূপটা জগতের সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারি, তাহা হইলে প্রত্যেক ন্যায়দর্শী ও সত্যানুসন্ধিৎসু হৃদয়ই তাহার নিকট আত্মদান করিতে বাধ্য হইবে। আল্লার খেরিত সমস্ত ধৰ্ম্মপ্রচারক যাহারা মানবজাতির কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে আগমন করিয়াছেন, মুসলমান মাত্রেরই মান্য ও নমস্য। তাহাদিগের উপর বিশ্বাস না কবিলে কেহ মুসলমানই হইতে পারে না। আর আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রে যে সকল পয়গম্বরের নামোল্লেখ হইয়াছে, তাহা বাদে আরও অনেক পয়গম্বর আছেন, যাহাঁদের নাম হজবত মোহাম্মদ (দঃ) কে জ্ঞাত করা হয় নাই। অধিকন্তু প্ৰত্যেক দেশ ও প্রত্যেক জাতির নিকট প্রেরিত পুরুষগণ আসিযাছেন ও স্বর্গের বাণী শুনাইয়াছেন, এই সমস্ত কথার প্ৰত্যেকটিই কোরআন শরীফের স্পষ্ট আয়াৎ দ্বারা প্রতিপন্ন হইতেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে আমরা মিসিস মহোদয়ার মন্তব্যের পূর্ণ সমৰ্থন কবিতেছি। (আল। এসলাম-সম্পাদক।)
সুলতানার স্বপ্ন
(বর্তমান লেখিকার Sultana’s Dream গত ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে Indian Ladies Magazine-এ প্রকাশিত হইয়াছিল।)
একদা আমার শয়নকক্ষে আরামকেদারায় বসিয়া ভারত-ললনার জীবন সম্বন্ধে চিন্তা করিতেছিলাম–আমাদের দ্বারা কি দেশের কোনো ভালো কাজ হইতে পারে না?–এইসব ভাবিতেছিলাম। সে-সময় মেঘমুক্ত আকাশে শারদীয় পূর্ণিমার শশধর পূর্ণগৌরবে শোভমান ছিল; কোটি লক্ষ তারকা শশীকে বেষ্টন করিয়া হীরক-প্রভায় দেদীপ্যমান ছিল। মুক্ত বাতায়ন হইতে কৌমুদীস্নাত উদ্যানটি স্পষ্টই আমার দৃষ্টিগোচর হইতেছিল। এক-একবার মৃদুস্নিগ্ধ সমীরণ শেফালি-সৌরভ বহিয়া আনিয়া ঘরখানি আমোদিত করিয়া দিতেছিল। দেখিলাম, সুধাকরের পূর্ণকান্তি, সুমিষ্ট কুসুমের সুমিষ্ট সৌরভ, সমীরণের সুমন্দ হিল্লোল, রজতচন্দ্রিকা, ইহারা সকলে মিলিয়া আমার সাধের উদ্যানে এক অনির্বচণীয় স্বপ্নরাজ্য রচনা করিয়া ফেলিয়াছে। তদ্দর্শনে আমি আনন্দে আত্মহারা হইলাম, যেন জাগিয়াই স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম! ঠিক বলিতে পারি না আমি তন্দ্রাভিভূত হইয়াছিলাম কি না–কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, আমার বিশ্বাস আমি জাগ্রত ছিলাম।
সহসা আমার পার্শ্বে একটি ইউরোপীয় রমণীকে দণ্ডায়মানা দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। তিনি কী প্রকারে আসিলেন, বুঝিতে পারিলাম না। তাঁহাকে আমার পরিচিতা ‘ভগিনী সারা’ (Sister Sara) বলিয়া বোধ হইল। ভগিনী সারা ‘সুপ্রভাত’ বলিয়া আমাকে অভিবাদন করিলেন! আমি মনে মনে হাসিলাম–এমন শুভ্র জোছনাপ্লাবিত রজনীতে তিনি বলিলেন, ‘সুপ্রভাত।’ তাঁহার দৃষ্টিশক্তি কেমন? যাহা হউক, প্রকাশ্যে আমি প্রত্যুত্তরে বলিলাম–
‘আপনি কেমন আছেন?’
‘আমি ভালো আছি, ধন্যবাদ। আপনি একবার আমাদের বাগানে বেড়াইতে আসিবেন কি?’
আমি মুক্তবাতায়ণ হইতে আবার পূর্ণিমাচন্দ্রের প্রতি চাহিলাম–ভাবিলাম, এ সময় যাইতে আপত্তি কী? চাকরেরা এখন গভীর নিদ্রামগ্ন; এই অবসরে ভগিনী সারার সমভিব্যাহারে বেড়াইয়া বেশ একটু আনন্দ উপভোগ করা যাইবে। দার্লিলিং অবস্থানকালে আমি সর্বদাই ভগিনী সারার সহিত ভ্রমণ করিতাম। কত দিন উদ্ভিদকাননে (বোটানিকাল গার্ডেনে) বেড়াইতে বেড়াইতে উভয়ে লতাপাতা সম্বন্ধে–ফুলের লিঙ্গ নির্ণয় সম্বন্ধে কত তর্কবিতর্ক করিয়াছি, সে-সব কথা মনে পড়িল। ভগিনী সারা সম্ভবত আমাকে তদ্রূপ কোনো উদ্যানে লইয়া যাইবার নিমিত্তে আসিয়াছেন; আমি বিনাবাক্যব্যয়ে তাঁহার সহিত বাহির হইলাম।
ভ্রমণকালে দেখি কী–এ তো সে জোছনাময়ী রজনী নহে!–এ যে দিব্য প্রভাত! নগরের লোকেরা জাগিয়া উঠিয়াছে, রাজপথে লোকে লোকারণ্য! কী বিপদ! আমি দিনের বেলায় এভাবে পথে বেড়াইতেছি! ইহা ভাবিয়া লজ্জায় জড়সড় হইলাম–যদিও পথে একজনও পুরুষ দেখিতে পাই নাই।
পথিকা স্ত্রীলোকেরা আমার দিকে চাহিয়া হাস্য পরিহাস করিতেছিল। তাহাদের ভাষা না বুঝিলেও ইহা স্পষ্ট বুঝিলাম যে, তাহাদের উপহাসের লক্ষ আমিই। সঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম–
‘উহারা কি বলিতেছে?’ উত্তর পাইলাম,–“উহারা বলে যে, আপনি অনেকটা পুরুষ ভাবাপন্ন।
‘পুরুষভাবাপন্ন। ইহার মানে কি?’
‘ইহার অর্থ এই যে, আপনাকে পুরুষের মত ভীরু ও লজ্জানম্র দেখায়।’
‘পুরুষের মত লজ্জানম্র!’ এমন ঠাট্টা! এরূপ উপহাস ত কখন শুনি নাই। ক্রমে বুঝিতে পারিলাম, আমার সঙ্গিনী সে দার্জিলিংবাসিনী ভগিনী সারা নহেন–ইঁহাকে কখনও দেখি নাই! ওহো! আমি কেমন বোকা–একজন অপরিচিতার সহিত হঠাৎ চলিয়া আসিলাম। কেমন একটু বিস্ময়ে ও ভয়ে অভিভূত হইলাম। আমার সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চিত ও ইষৎ কম্পিত হইল। তাঁহার হাত ধরিয়া চলিতেছিলাম কিনা, তিনি আমার হস্তকম্পন অনুভব করিয়া সস্নেহে বলিলেন–
‘আপনার কি হইয়াছে? আপনি কাঁপিতেছেন যে!’
এরূপে ধরা পড়ায় আমি লজ্জিত হইলাম। ইতস্তত করিয়া বলিলাম, ‘আমার কেমন একটু সংকোচ বোধ হইতেছে; আমরা পর্দানশীন স্ত্রীলোক, আমাদের বিনা অবগুন্ঠনে বাহির হইবার অভ্যাস নাই।’
‘আপনার ভয় নাই–এখানে আপনি কোন পুরুষের সম্মুখে পড়িবেন না। এ দেশের নাম ‘নারীস্থান’ (১) এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন।’
ক্রমে নগরের দৃশ্যাবলী দেখিয়া আমি অন্যমনষ্ক হইলাম। বাস্তবিক পথের উভয় পাশ্বস্থিত দৃশ্য অতিশয় রমনীয় ছিল।
সুনীল অম্বর দর্শনে মনে হইল যেন ইতিপূর্বে আর কখন ও এত পরিষ্কার আকাশ দেখি নাই। একটি তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তর দেখিয়া ভ্রম হইল, যেন হরিৎ মখমলের গালিচা পাতা রহিয়াছে। ভ্রমনকালে আমার বোধ হইতেছিল, যেন কোমল মসনদের উপর বেড়াইতেছি,-ভূমির দিকে দৃকপাত করিয়া দেখি, পথটি শৈবাল ও বিবিধ পুষ্পে আবৃত! আমি তখন সানন্দে বলিয়া উঠিলাম, ‘আহা! কি সুন্দর!
ভগিনী সারা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি এ সব পছন্দ করেন কি?’ (আমি তাঁহাকে ‘ভগিনী সারা’ই বলিতে থাকিলাম এবং তিনিও আমার নাম ধরিয়া সম্বোধন করিতেছিলেন।)
‘হ্যাঁ এসব দেখিয়ে বড়ই চমৎকার। কিন্তু আমি এ সুকুমার কুসুমস্তবক পদদলিত করিতে চাই না।’
‘সেজন্য ভাবিবেন না, প্রিয় সুলতানা! আপনার পদস্পর্শে এ-ফুলের কোন ক্ষতি হইবে না। এগুলি বিশেষ এক জাতীয় ফুল ইহা রাজপথেই রোপন করা হয়।’
দুই ধারে পুষ্পচূড়াধারী পাদপশ্রেণী সহাস্যে শাখা দোলাইয়া দোলইয়া যেন আমার অভ্যর্থনা করিতেছিলাম। দূরাগত কেতকী-সৌরভে দিক পরিপূরিত ছিল। সে সৌন্দর্য ভাষায় ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য–আমি মুগ্ধ নয়নে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে বলিলাম, ‘সমস্ত নগরখানি একটি কুঞ্জভবনের মত দেখায়! যেন ইহা প্রকৃতিরানীর লীলাকানন! আপনাদের উদ্যান-রচনা-নৈপুণ্য অত্যন্ত প্রশংসনীয়।’
‘ভারতবাসী ইচ্ছা করিলে কলিকাতাকে ইহা অপেক্ষা অধিক সুন্দর পুষ্পোদ্যানে পরিণত করিতে পারেন।’
‘তাঁহাদিগকে অনেক গুরুতর কার্য করিতে হয়, তাঁহারা কেবল পুষ্পবনের উন্নতিকল্পে অধিক সময় ব্যয় করা অনাবশ্যক মনে করিবেন।’
‘ইহা ছাড়া তাঁহারা আর কী বলিতে পারেন? জানেন তো অলসেরা অতিশয় বাক্পটু হয়!’
আমার বড় আশ্চর্যবোধ হইতেছিল যে, দেশের পুরুষেরা কোথায় থাকে? রাজপথে শতাধিক ললনা দেখিলাম, কিন্তু পুরুষ বলিতে একটি বালক পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হইল না। শেষে কৌতূহল গোপন করিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘পুরুষেরা কোথায়?’
উত্তর পাইলাম, ‘যেখানে তাহাদের থাকা উচিত সেইখানে, অর্থাৎ তাহাদের উপযুক্ত স্থানে।’
ভাবিলাম, তাহাদের ‘উপযুক্ত স্থান’ আবার কোথায়–আকাশে না পাতালে? পুনরায় বলিলাম, ‘মাফ করিবেন, আপনার কথা ভালোমতো বুঝিতে পারিলাম না। তাহাদের ‘উপযুক্ত স্থানের’ অর্থ কী?’
‘ওহো! আমার কী ভ্রম!–আপনি আমাদের নিয়মআচার জ্ঞাত নহেন, এ-কথা আমার মনেই ছিল না। এদেশে পুরুষজাতি গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকে।’
‘কী! যেমন আমরা অন্তঃপুরে থাকি, সেইরূপ তাঁহারাও থাকেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তদ্রূপই।’
‘বাহ্! কী আশ্চর্য ব্যাপার!’ বলিয়া আমি উচ্চহাস্য করিলাম। ভগিনী সারাও হাসিলেন। আমি প্রাণে বড় আরাম পাইলাম;–পৃথিবীতে অন্তত এমন একটি দেশও আছে, যেখানে পুরুষজাতি অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ থাকে! ইহা ভাবিয়া অনেকটা সান্ত্বনা অনুভব করা গেল!
তিনি বলিলেন, ‘ইহা কেমন অন্যায়, যে নিরীহ রমণী অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকে, আর পুরুষেরা মুক্ত, স্বাধীনতা ভোগ করে। কী বলেন, সুলতানা, আপনি ইহা অন্যায় মনে করেন না?’
আমি আজন্ম অন্তঃপুরবাসিনী, আমি এ-প্রথাকে অন্যায় মনে করিব কিরূপে? প্রকাশ্যে বলিলাম–‘অন্যায় কিসের? রমণী স্বভাবত দুর্বলা, তাহাদের পক্ষে অন্তঃপুরের বাহিরে থাকা নিরাপদ নহে।’
‘হ্যাঁ, নিরাপদ নহে ততদিন–যতদিন পুরুষজাতি বাহিরে থাকে। তা কোনো বন্য জন্তু কোনো একটা গ্রামে আসিয়া পড়িলেও তো সে গ্রামখানি নিরাপদ থাকে না। কি বলেন?’
‘তাহা ঠিক; হিংস্র জন্তুটা ধরা না-পড়া পর্যন্ত গ্রামটি নিরাপদ হইতে পারে না।’
‘মনে করুন, কতকগুলি পাগল যদি বাতুলাশ্রম হইতে বাহির হইয়া পড়ে, আর তাহার অশ্ব, গবাদি–এমনকি ভালো মানুষের প্রতিও নানাপ্রকার উপদ্রব উৎপীড়ন আরম্ভ করে, তবে ভারতবর্ষের লোকে কী করিবে?’
‘তবে তাহারা পাগলগুলিকে ধরিয়া পুনরায় বাতুলাগারে আবদ্ধ করিতে প্রয়াস পাইবে।’
‘বেশ! বুদ্ধিমান লোককে বাতুলালয়ে আবদ্ধ রাখিয়া দেশের সমস্ত পাগলকে মুক্তি দেওয়াটা বোধহয় আপনি ন্যায়সঙ্গত মনে করেন, না?’
‘অবশ্যই না! শান্তশিষ্ট লোককে বন্দি করিয়া পাগলকে মুক্তি দিবে কে?’
‘কিন্তু কার্যত আপনাদের দেশে আমরা ইহাই দেখিতে পাই! পুরুষেরা ____ করে, নানা প্রকার দুষ্টামি করে, বা অন্তত করিতে সক্ষম, তাহারা দিব্য স্বাধীনতা ভোগ করে, আর নিরীহ কোমলাঙ্গী অবলারা বন্দিনী থাকে। আপনারা কিরূপে তাহাদিগকে মুক্তি দিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন?’
‘জানেন, ভগিনী সারা! সামাজিক বিধিব্যবস্থার উপর আমাদের কোনো হাত নাই। ভারতে পুরুষজাতি প্রভু–তাহারা সমুদয় সুখসুবিধা ও প্রভূত্ব আপনাদের জন্য হস্তগত করিয়া ফেলিয়াছে, আর সরলা অবলাকে অন্তঃপুর রূপ পিঞ্জরে রাখিয়াছে! উড়িতে শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া দেওয়া হয়–তদ্ব্যতীত সামাজিক রীতিনীতির কতশত কঠিন শৃঙ্খল পদে পদে জড়াইয়া আছে।’
‘তাই তো! আমার বলিতে ইচ্ছা হয়–‘দোষ কার, বন্দী হয় কে!’ কিন্তু বলি, আপনারা ওসব নিগড় পরেন কেন?’
‘না পরিয়া করি কী? জোর যার মুলুক তার’; যাহার বল বেশি, সেই স্বামিত্ব করিবে–ইহা অনিবার্য।’
‘কেবল শারীরিক বল বেশি হইলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না। সিংহ কি বলেবিক্রমে মানবাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে? তাই বলিয়া কি কেশবী মানবজাতির উপর প্রভুত্ব করিবে? আপনাদের কর্তব্যের ত্রুটি হইয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনারা সমাজের উপর কর্তৃত্ব ছাড়িয়া একাধারে নিজের প্রতি অত্যাচার এবং স্বদেশের অনিষ্ট দুই-ই করিয়াছেন। আপনাদের কল্যাণে সমাজ আরও উন্নত হইত–আপনাদের সাহায্য অভাবে সমাজ অর্ধেক শক্তি হারাইয়া দুর্বল ও অবনত হইয়া পড়িয়াছে।’
‘শুনুন ভগিনী সারা! যদি আমরাই সংসারের সমুদয় কার্য করি, তবে পুরুষেরা কী করিবে?’
‘তাহারা কিছুই করিবে না–তাহারা কোনো ভালো কাজের উপযুক্ত নহে। তাহাদিগকে ধরিয়া অন্তঃপুরে বন্দি করিয়া রাখুন।’
‘কিন্তু ক্ষমতাশালী নরবরদিগকে চতুষ্প্রাচীরের অভ্যন্তরে বন্দি করা কি সম্ভব, না সহজ ব্যাপার? আর তাহা যদিই সাধিত হয়, তবে দেশের যাবতীয় কার্য যথা রাজকার্য, বাণিজ্য ইত্যাদি সকল কাজই অন্তঃপুরে আশ্রয় গ্রহণ করিবে যে!’
এবার ভগিনী সারা কিছু উত্তর দিলেন না, সম্ভবত আমার ন্যায় অজ্ঞান তমসাচ্ছন্ন অবলার সহিত তর্ক করা তিনি অনাবশ্যক মনে করিলেন।
ক্রমে আমার ভগিনী সারা গৃহতোরণে উপনীত হইলাম। দেখিলাম, বাড়িখানি একটি বৃহৎ হৃদয়াকৃতি উদ্যানের মধ্যস্থলে অবস্থিত। এ ভাবটি কী চমৎকার!–ধরিত্রী জননীর হৃদয়ে মানবের বাসভবন। বাড়ি বলিতে একটি টিনের বাঙ্গালা মাত্র; কিন্তু সৌন্দর্যে ও নৈপূন্যে ইহার নিকট আমাদের দেশের বড় বড় রাজপ্রসাদ পরাজিত। সাজসজ্জা কেমন নয়নাভিরাম ছিল; তাহা ভাষায় বর্ণনীয় নহে–তাহা কেবল দেখিবার জিনিস।
আমরা উভয়ে পাশাপাশি উপবেশন করিলাম। তিনি সেলাই করিতে আরম্ভ করিলেন; একটি খঞ্চিপোষে রেশমের কাজ করা হইতেছিল। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমিও সেলাই জানি কি না। আমি বলিলাম,–
‘আমরা অন্তপুরে থাকি, সেলাই ব্যতীত অন্য কাজ জানি না।’
‘কিন্তু এদেশের অন্তঃপুরবাসীদের হাতে আমরা কারচোবের কাজ দিয়া বিশ্বাস করিতে পারি না।’ এই বলিয়া তিনি হাসিলেন, ‘পুরুষদের এতখানি সহিষ্ণুতা কই, যে তাহারা ধৈর্যের সহিত ছুঁচে সুতা পরাইবে?’
তাহা শুনিয়া আমি বলিলাম, ‘তবে কি কারচোবের কাজগুলি সব আপনিই করিয়াছেন?’ তাঁহার ঘরে বিবিধ ত্রিপদীর উপর নানাপ্রকার সলমা চুমকির কারুকার্যখচিত বস্ত্রাবরণ ছিল।
তিনি বলিলেন, ‘হাঁ, এ-সব আমারই স্বহস্ত প্রস্তুত।’
‘আপনি কিরূপে সময় পান? আপনাকে তো অফিসের কাজও করিতে হয়, না? কি বলেন?’
‘হাঁ। তা আমি সমস্তদিন রসায়নাগারে আবদ্ধ থাকি না। আমি দুই ঘণ্টায় দৈনিক কর্তব্য শেষ করি।’
‘দুই ঘণ্টায়! আপনি এ কী বলেন?–দুই ঘণ্টায় আপনার কার্য শেষ হয়! আমাদের দেশে রাজকর্মচারীগণ–যেমন মাজিস্ট্রেট, মুন্সেফ, জজ প্রমুখ প্রতিদিন ৭ ঘণ্টা কাজ করিয়া থাকেন।’
‘আমি ভারতের রাজপুরুষদের কার্যপ্রণালী দেখিয়াছি। আপনি কি মনে করেন যে, তাহারা সাত-আট ঘণ্টাকাল অনবরত কাজ করেন?’
‘নিশ্চয়, বরং এতদপেক্ষা অধিক পরিশ্রমই করেন।’
‘না প্রিয় সুলতানা। ইহা আপনার ভ্রম। তাঁহারা অলসভাবে বেত্রাসনে বসিয়া ধূমপানে সময় অতিবাহিত করেন। কেহ আবার অফিসে থাকিয়া ক্রমাগত দুই-তিনটি চুরুট ধ্বংস করেন। তাঁহারা মুখে যত বলেন, কার্যত তত করেন না। রাজপুরুষেরা যদি কিছু করেন, তাহা এই যে, কেবল তাঁহাদের নিম্নতম কর্মচারীদের ছিদ্রান্বেষণ। মনে করুন একটি চুরুট ভস্মীভূত হইতে অর্ধঘণ্টা সময় লাগে, আর কেহ দৈনিক ১২টি চুরুট ধ্বংস করেন, তবে সে ভদ্রলোকটি প্রতিদিন ধূমপানে মাত্র ছয় ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন।’
তাই তো। অথচ ভ্রাতৃমহোদয়গণ জীবিকা অর্জন করেন, এই অহঙ্কারেই বাঁচেন না। ভগিনী সারা সহিত বিবিধ প্রসঙ্গ হইল। শুনিলাম, তাঁহাদের নারীস্থান কখনো মহামারী রোগে আক্রান্ত হয় না। আর তাঁহারা আমাদের ন্যায় হুলধর মশার দংশনেও অধীর হন না! বিশেষ একটি কথা শুনিয়া আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম–নারীস্থানে নাকি কাহারও অকাল-মৃত্যু হয় না। তবে বিশেষ কোনো দুর্ঘটনা হইলে লোকে অপ্রাপ্ত বয়সে মরে, সে স্বতন্ত্র কথা। ভগিনী সারা আবার হিন্দুস্থানের অসংখ্য শিশুর মৃত্যু সংবাদে অবাক হইলেন! তাঁহার মতে যেন এই ঘটনা সর্বাপেক্ষা অসম্ভব! তিনি বলিলেন, যে প্রদীপ সবেমাত্র তৈল সলিতা যোগে জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, সে কেন (তৈল বর্তমানে) নির্বাপিত হইবে। যে নব কিশলয় সবেমাত্র অঙ্কুরিত হইয়াছে, সে কেন পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্বে ঝরিবে!
ভারতের প্লেগ সম্বন্ধেও অনেক কথা হইল, তিনি বলিলেন, ‘প্লেগ-টেলেগ কিছুই নহে–কেবল দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত লোকেরা নানা রগের আধার হইয়া পড়ে। একটু অনুধাবন করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, গ্রাম অপেক্ষা নগরে প্লেগ বেশি–নগরের ধনী অপেক্ষা নির্ধনের ঘরে প্লেগ বেশি হয় এবং প্লেগে দরিদ্র পুরুষ অপেক্ষা দরিদ্র রমনী অধিক মারা যায়। সুতরাং বেশ বুঝা যায়, প্লেগের মূল কোথায়–মূল কারণ ঐ অন্নাভাব। আমাদের এখানে প্লেগ বা ম্যালেরিয়া আসুক তো দেখি!’
তাই তো, ধনধান্যপূর্ণা নারীস্থানে ম্যালেরিয়া কিংবা প্লেগের অত্যাচার হইবে কেন, প্লীহা-স্ফীত উদর ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট বাঙ্গালায় দরিদ্রদিগের অবস্থা স্মরন করিয়া আমি নীরবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলাম।
অতঃপর তিনি আমাকে তাঁহাদের রন্ধনশালা দেখাইবার জন্য লইয়া গেলেন। অবশ্য যথাবিধি পরদা করিয়া যাওয়া হইয়াছিল! একি রন্ধনগৃহ, না নন্দনকানন! রন্ধনশালার চতুর্দিকে সবজিবাগান এবং নানাপ্রকার তরিতরকারির লতাগুল্মো পরিপূর্ণ; ঘরের ভিতর ধূম বা ইন্ধনের কোনো চিহ্ন নাই–মেজেখানি অমল ধবল মর্মর প্রস্তর নির্মিত; মুক্ত বাতায়নগুলি সদ্যপ্রস্ফুটিত পুষ্পদামে সুসজ্জিত। আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলাম–
‘আপনারা রাঁধেন কিরূপে? কোথাও তো অগ্নি জ্বালিবার স্থান দেখিতেছি না।’
তিনি বলিলেন, ‘সূর্যোত্তাপে রান্না হয়।’ অতঃপর কীপ্রকারে সৌরকর একটি নলের ভিতর দিয়া আইছে, সেই নলটা তিনি আমাকে দেখিইলেন। কেবল ইহাই নহে, তিনি তৎক্ষণাৎ একপাত্র ব্যঞ্জন (যাহা পূর্ব হইতে তথায় রন্ধনের নিমিত্ত প্রস্তুত ছিল) রাঁধিয়া আমাকে সেই অদ্ভুত রন্ধনপ্রণালী দেখাইলেন।
আমি কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনারা সৌরোত্তাপ সংগ্রহ করেন কী প্রকারে?’
ভগিনী বলিলেন, ‘কিরূপে সৌরকর আমাদের করায়ত্ত হইয়াছে, তাহার ইতিহাস শুনিবেন? ত্রিশ বৎসর পূর্বে যখন আমাদের বর্তমান মহারানি সিংহাসনপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি ত্রয়োদশ বর্ষীয়া বালিকা ছিলেন। তিনি নামত রানি ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী রাজ্য-শাসন করিতেন।
‘মহারানি বাল্যকাল হইতেই বিজ্ঞানচর্চা করিতে ভালোবাসিতেন। সাধারণ রাজকন্যাদের ন্যায় তিনি বৃথা সময় যাপন করিতেন না। একদিন তাঁহার খেয়াল হইল যে, তাঁহার রাজ্যের সমুদয় স্ত্রীলোকই সুশিক্ষাপ্রাপ্ত হউক। মহারানির খেয়াল–সে খেয়াল তৎক্ষণাৎ কার্যে পরিণত হইল! অচিরে গভর্মেন্ট পক্ষ হইতে অসংখ্য বালিকা স্কুল স্থাপিত হইত। এমনকি পল্লিগ্রামেও উচ্চশিক্ষার অমিয় স্রোত-প্রবাহিত হইল। শিক্ষার বিমল জ্যোতিতে কুসংস্কাররূপ অন্ধকার তিরোহিত হইতে লাগিল, এবং বাল্যবিবাহ প্রথাও রহিত হইল। একুশ বৎসর বয়ঃক্রমের পূর্বে কোনো কন্যার বিবাহ হইতে পারিবে না–এই আইন হইল। আর এক-কথা–এই পরিবর্তনের পূর্বে আমরাও আপনাদের মতো কঠোর অবরোধে বন্দিনী থাকিতাম।’
‘এখন কিন্তু বিপরীত অবস্থা!’ এই বলিয়া আমি হাসিলাম।
‘কিন্তু স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে ব্যবধান সেই প্রকারই আছে! কতদিন তাহারা বাহিরে, আমরা ঘরে ছিলাম; এখন তাঁহারা ঘরে, আমরা বাহিরে আছি! পরিবর্তন প্রকৃতিরই নিয়ম! কয়েব বৎসরের মধ্যে আমাদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হইল; তথায় বালকদের প্রবেশ নিষেধ ছিল।
‘আমাদের পৃষ্ঠপোষিকা স্বয়ং মহারানি–আর কি কোনো অভাব থাকিতে পারে? অবলাগণ অত্যন্ত নিবিষ্টচিত্তে বিজ্ঞান আলোচনা আরম্ভ করিলেন। এই সময় রাজধানীর ___ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা প্রিন্সিপ্যাল একটি অভিনব বেলুন নির্মাণ করিলেন, এই বেলুনে কতকগুলি নল সংযোগ করা হইল। বেলুনটি শূন্যে মেঘের উপর স্থাপন করা গেল–বায়ুর আর্দ্রতা ঐ বেলুনে সংগ্রহ করিবে উপায় ছিল–এইরূপে জলধরকে ফাঁকি দিয়া তাঁহার বৃষ্টিজল করায়ত্ত করিলেন। বিদ্যালয়ের লোকেরা সর্বদা ওই বেলুনের সাহায্যে জলগ্রহণ করিত কি না, তাই আর মেঘমালায় আকাশ আচ্ছন্ন হইতে পারিত না। এই অদ্ভুত উপায়ে বুদ্ধিমতী লেডি প্রিন্সিপ্যাল প্রাকৃতিক ঝড়বৃষ্টি নিবারণ করিলেন।’
‘বটে? তাই আপনাদের এখানে পথে কর্দম দেখিলাম না।’ কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিলাম না–নলের ভিতর বায়ুর আর্দ্রতা কিরূপে আবদ্ধ থাকতে পারে; আর ঐরূপে বায়ু হইতে জল সংগ্রহ করাই বা কিরূপে সম্ভব। তিনি আমাকে ইহা বুঝাইতে অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু আমার যে বুদ্ধি–তাহাতে আবার বিজ্ঞান রসায়নের সঙ্গে আমাদের (অর্থাৎ মোসলেম ললনাদের) কোনো পুরুষে পরিচয় নাই। সুতরাং ভগিনী সারার ব্যাখ্যা কোনোমতেই আমার বোধগম্য হইল না। যাহা হউক তিনি বলিয়া যাইতে লাগিলেন।
‘দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই জলধর বেলুন দর্শনে অতীব বিস্মিত হইল–অতিহিংসায় (২) তাহারা উচ্চাকাঙ্খা সহস্রগুণ বর্ধিত হইল। প্রিন্সিপ্যাল মনস্থ করিলেন যে, এমন কিছু অসাধারণ বস্তু চাই, যাহাতে কাদম্বিনী বিজয়ী বিদ্যালয়কে পরাভূত করা যায়। কেবল ইহাই নহে, তাঁহার প্রচুর পরিমাণে ঐ উত্তাপ সংগ্রহ করিয়া রাখিতে এবং ইচ্ছামত যথাতথা বিতরণ করিতে পারেন।
‘যৎকালে এদেশের রমণীবৃন্দ নানাবিধ বৈজ্ঞানিক অনুশীলনে নিযুক্ত ছিলেন, পুরুষেরা তখন সৈনিক বিভাগের বলবৃদ্ধির চেষ্টায় ছিলেন। যখন নরনারীগণ শুনিতে পাইলেন যে, জেনানা বিশ্ববিদ্যালয়দ্বয় বায়ু হইতে জল গ্রহণ করিতে এবং সূর্যোত্তাপ সংগ্রহ করিতে পারে, তাহারা তাচ্ছিল্যের ভাবে হাসিলেন। এমনকি তাঁহারা বিদ্যালয়ের সমুদয় কার্যপ্রণালীকে ‘স্বপ্নকল্পনা’ বলিয়া উপহাস করিতেও বিরত হন নাই।’
আমি বলিলাম, ‘আপনাদের কার্যকলাপ বাস্তবিক অত্যন্ত বিস্ময়কর। কিন্তু এখন বলুন দেখি, আপনারা পুরুষদের কী প্রকারে অন্তঃপুরে বন্দি করিলেন? কোনোরূপ ফাঁদ পাতিয়াছিলেন নাকি?’
‘না এদেশের পুরুষদের বাহুবলে পরাস্ত করা হয় নাই।’
‘হাঁ ইহা অসম্ভব বটে, কারণ পুরুষের বাহু নারীর বাহু অপেক্ষা দুর্বল নহে, তবে?’
‘মস্তিষ্ক-বলে।’
‘তাহাদের মস্তিষ্কও তো রমণীয় তুলনায় বৃহত্তর ও গুরুতর। না–কী বলেন?’
‘মস্তিষ্ক গুরুতর হইলেই কী? হস্তীর মস্তিষ্কও তো মানবের তুলনায় বৃহৎ এবং ভারী, তবু তো মানুষ হস্তীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছে।’
‘ঠিক তো। কিন্তু কী প্রকারে কর্তারা বন্দি হইলেন, এ-কথা জানিবার জন্য আমি বড় উৎসুক হইয়াছি। শীঘ্র বলুন, আর বিলম্ব সহে না।’
‘স্ত্রীলোকের মস্তিষ্ক পুরুষের অপেক্ষা ক্ষিপ্রকারী, এ-কথা অনেকেই স্বীকার করেন। পুরুষ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার পূর্বে অনেক ভাবে–অনেক যুক্তিতর্কের সাহায্যে বিষয়টি বোধগম্য করে। কিন্তু রমণী বিনাচিন্তায় হঠাৎ সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যাহা হউক, দশ বৎসর পূর্বে যখন সৈনিক বিভাগের কর্মচারীগণ আমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদিকে ‘স্বপ্নকল্পনা’ বলিয়া উপহাস করিয়াছিলেন, তখন কতিপয় ছাত্রী তদুত্তরে কিছু বলিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্ত উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেড প্রিন্সিপ্যালদ্বয় বাধা দিলেন। তাঁহারা বলিলেন যে, তোমরা বাক্যে উতর না দিয়া সুযোগ পাইলে কার্য দ্বারা উত্তর দিও। ঈশ্বর কৃপায় এই উত্তর দিবার সুযোগের জন্য ছাত্রীদিগকে অধিক দিন অপেক্ষা করিতে হয় নাই।’
‘ভারি আশ্চর্য!’ আমি অতিআনন্দে আত্মসম্বরণ করিতে না পারিয়া করতালি দিয়া বলিলাম, ‘এখন দাম্ভিক ভদ্রলোকেরা অন্তঃপুরে বসিয়া ‘স্বপ্নকল্পনায়’ বিভোর রহিয়াছেন।’
সারা বলিয়া যাইতে লাগিলেন–
‘কিছুদিন পরে কয়েকজন বিদেশী লোক এদেশে আসিয়া আশ্রয় লইল। তাহারা কোনোপ্রকার রাজনৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত ছিল। তাহাদের রাজা ন্যায়সঙ্গত সুশাসন বা সুবিচারের পক্ষপাতী ছিলেন না, তিনি কেবল স্বামিত্ব ও অপ্রতিহত বিক্রম প্রকাশে তৎপর ছিলেন। তিনি আমাদের সহৃদয়া মহারানিকে ঐ আসামি ধরিয়া দিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু মহারানি তো দয়াপ্রতিমা জননীর জাতি–সুতরাং তাঁহার আশ্রিত হতভাগ্যদিগকে ক্রুদ্ধ রাজার শোণিত-পিপাসা নিবৃত্তের জন্য ধরিয়া দিলেন না। প্রবল ক্ষমতাশালী রাজা ইহাতে ক্রোধান্ধ হইয়া আমাদের সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হইলেন।
‘আমাদের রনসজ্জাও প্রস্তুত ছিল, সৈন্য সেনানীগণও নিশ্চিন্ত ছিলেন। তাঁহারা বিরোচিত উৎসাহে শত্রুর সম্মুখীন হইলেন। তুমুল সংগ্রাম বাঁধিল, রক্তগঙ্গায় যেন ডুবিয়া গেল! প্রতিদিন যোদ্ধাগণ অম্লানবদনে পতঙ্গপ্রায় সমরানলে প্রাণ বিসর্জন দিতে লাগিল।
‘কিন্তু শত্রুপক্ষ অত্যন্ত প্রবল ছিল, তাহাদের গতিরোধ করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। আমাদের সেনাদল প্রাণপণে কেশরীবিক্রমে যুদ্ধ করিয়াও শনৈ শনৈ পশ্চাদবর্তী হইতে লাগিল, এবং শত্রুগণ ক্রমশ অগ্রসর হইল।
‘কেবল বেতনভোগী সেনা কেন, দেশে ইতর-ভদ্র–সকল লোকই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইল। এমনকি ৬০ বৎসরের বৃদ্ধ হইতে ষোড়শবর্ষীয় বালক পর্যন্ত সমরশায়ী হইতে চলিল। কতিপয় প্রধান সেনাপতি নিহত হইলেন; অসংখ্য সেনা প্রাণ হারাইয়া অবশিষ্ট যোদ্ধাগণ বিতাড়িত হইয়া পৃষ্ঠপ্রদর্শনে বাধ্য হইল। শত্রু এখন রাজধানী হইতে মাত্র ১২/১৩ ক্রোশ দূরে অবস্থিত। আর দুই-চারি দিবসের যুদ্ধের পরেই তাহারা রাজধানী আক্রমণ করিবেন।
‘এই সঙ্কট সময়ে সম্রাজ্ঞী জন-কতক বুদ্ধিমতী মহিলাকে লইয়া সভা আহ্বান করিলেন। এখন কি কর্তব্য ইহাই সভার আলোচ্য বিষয় ছিল।
‘কেহ প্রস্তাব করিলেন যে, রীতিমতো যুদ্ধ করিতে করিতে যাইবেন, অন্যদল বলিলেন যে, ইহা অসম্ভব–কারণ একে তো অবলারা সমরনৈপুণ্যে অনভিজ্ঞ তাহাতে আবার কৃপান, তোষাদান, বন্দুক ধারণেও অক্ষমা; তৃতীয়া দল বলিলেন যে, যুদ্ধনৈপুণ্য দূরে থাকুক–রমণীর শারীরিক দুর্বলতাই প্রধান অন্তরায়।’
মহারানি বলিলেন, ‘যদি আপনারা বাহুবলে দেশরক্ষা করিতে না পারেন, তবে মস্তিষ্কবলে দেশরক্ষার চেষ্টা করুন।’
সকলে নিরুত্তর, সভাস্থল নীরব। মহারানি মৌনভঙ্গ করিয়া পুনরায় বলিলেন, ‘যদি দেশ ও সম্ভ্রম রক্ষা করিতে না পারি, তবে আমি নিশ্চয় আত্মহত্যা করিব।’
‘এইবার দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডি প্রিন্সিপ্যাল (যিনি সৌরকত করায়ত্ত করিয়াছেন) উত্তর দিলেন। তিনি এতক্ষণে নীরবে চিন্তা করিতেছিলেন–এখন অতি ধীরে গম্ভীরভাবে বলিলেন যে, বিজয় লাভের আশাভরসা তো নাই–শত্রু প্রায় গৃহতোরণে। তবে তিনি একটি সঙ্কল্প স্থির করিয়াছেন–যদি এই উপায় শত্রু পরাজিত হয়, তবে তো সুখের বিষয়। এই উপায় ইতিপূর্বে আর কেহ অবলম্বন করে নাই–তিনি প্রথমে এই উপায়ে শত্রু জয়ের চেষ্টা করিবেন। এই তাঁহার শেষ চেষ্টা–যদি এই উপায়ে কৃতকার্য হওয়া না যায়, তবে অবশ্য সকলে আত্মহত্যা করিবেন। উপস্থিত মহিলাবৃন্দ দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, তাঁহারা কিছুতেই দাসত্ব-শৃঙ্খল পরিবেন না। সেই গভীর নিস্তব্ধ রজনীতে মহারানির সভাগৃহ অবলাকণ্ঠের প্রতিজ্ঞা ধ্বনিতে পুন পুন প্রতিধ্বনিত হইল। প্রতিধ্বনি ততোধিক উল্লাসের স্বরে বলিল, ‘আত্মহত্যা করিব!’ সে যেন ততোধিক তোজোব্যঞ্জক স্বরে বলিল, ‘বিদেশীয় অধীনতা অস্বীকার করিব না।’
‘সম্রাজ্ঞী তাঁহাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিলেন যে লেডি প্রিন্সিপ্যালকে তাঁহার নূতন উপায় অবলম্বন করিতে অনুরোধ করিলেন।
লেডি প্রিন্সিপ্যাল পুনরায় দণ্ডায়মান হইয়া সসম্ভ্রমে বলিলেন, ‘আমরা যুদ্ধযাত্রা করিবার পূর্বে পুরুষদের অন্ত;পুরে প্রবেশ করা উচিত। আমি পরদার অনুরোধে এই প্রার্থনা করি।’ মহারানি উত্তর করিলেন, ‘অবশ্য! তাহা তো হইবেনই।’
‘পর দিন মহারানির আদেশপত্রে দেশের পুরুষদিগকে জ্ঞাপন করা হইল যে অবলারা যুদ্ধযাত্রা করিবেন, সেজন্য সমস্ত নগরে পর্দা হওয়া উচিত। সুতরাং স্বদেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার অনুরোধে পুরুষদের অন্তঃপুরে থাকিতে হইবে।
‘অবলার যুদ্ধযাত্রার কথা শুনিয়া ভদ্রলোকেরা প্রথমে হাস্যসম্বরণ করিতে পারিলেন না। পরে ভাবিলেন, মন্দ কী? তাঁহারা আহত এবং অত্যন্ত শ্রান্তক্লান্ত ছিলেন–যুদ্ধে আর রুচি ছিল না, কাজেই মহারানির এই আদেশকে তাঁহারা ঈশ্বরপ্রেরিত শুভআশীর্বাদ মনে করিলেন। মহারানিকে ভক্তি সহকারে নমস্কার করিয়া তাঁহারা বিনাবাক্যব্যয়ে অন্তঃপুরে আশ্রয় লইলেন। তাঁহাদের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, দেশরক্ষার কোনো আশা নাই–মরণ ভিন্ন গত্যন্তর নাই। দেশের ভক্তিমতী কন্যাগণ সমরচ্ছলে মৃত্যু আলিঙ্গন করিতে যাইতেছেন, তাহাদের এই অন্তিম বাসনায় বাধা দেওয়ার প্রয়োজন কী? শেষটা কী হয়, দেখিয়া দেশভক্ত সম্ভ্রান্ত পুরুষগণও আত্মহত্যা করিবেন।
‘অতঃপর লেডি প্রিন্সিপ্যাল দুই সহস্র ছাত্রী সমভিব্যাহারে সমরপ্রাঙ্গনে যাত্রা করিলেন–‘
আমি বাধা দিয়া বলিলাম, ‘দেশের পুরুষদিগকে তো পরদার অনুরোধে জেনানায় বন্দি করিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে পরদার আয়োজন করিলেন কিরূপে? উচ্চ প্রাচীরের ছিদ্র দিয়া গুলিবর্ষণ করিয়াছিলেন নাকি?’
‘না ভাই! বন্দুক-গুলি তো নারী যোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল না–অস্ত্রদ্বারা যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা থাকিলে আর বিদ্যালয়ের ছাত্রীর প্রয়োজন ছিল কি? আর শত্রুর বিরুদ্ধে পরদার বন্দোবস্ত করিবার আবশ্যক ছিল না–যেহেতু তাহারা অনেক দূরে ছিল; বিশেষত তাহারা আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেই অক্ষম ছিল।’
আমি রঙ্গ করিয়া বলিলাম–‘হয়তো রণভূমে মূর্তিমতী সৌদামিনীদের প্রভাদর্শনে তাহাদেরই নয়ন ঝলসিয়া গিয়াছিল–‘
‘তাহাদের নয়ন ঝলসিয়াছিল সত্য, কিন্তু সৌদামিনীর প্রভায় নয়–স্বয়ং তপনের প্রখর কিরণে।’
‘বটে? কী প্রকারে? আর আপনারা বিনাঅস্ত্রে যুদ্ধ করিলেন কিরূপে?’
‘যোদ্ধার সঙ্গে সেই সূর্যোত্তাপ-সংগ্রহের যন্ত্র ছিল মাত্র। আপনি কখনো স্টিমারের সার্চলাইট (search light) দেখিয়াছেন কি?’
‘দেখিয়াছি।’
‘তবে মনে করুন, আমাদের সঙ্গে অন্যূন দ্বি-সহস্র সার্চলাইট ছিল–অবশ্য সে যন্ত্রগুলি ঠিক সার্চলাইটের মতো নয়, তবে অনেকটা সাদৃশ্য আছে, কেবল আপনাকে বুঝাইবার জন্য তাহাকে ‘সার্চলাইট’ বলিতেছি। স্টিমারের সার্চলাইটে উত্তাপের প্রখরতা থাকে না, কিন্তু আমাদের সার্চলাইটে ভয়ানক উত্তাপ ছিল। ছাত্রীগণ যখন সেই সার্চলাইটের কেন্দ্রীভূত উত্তাপরশ্মি শত্রুর দিকে পরিচালিত করিলেন–তখন তাহারা হয়তো ভাবিয়াছিল, একি ব্যাপার! শত-সহস্র সূর্য মর্ত্যে অবতীর্ণ। সে উগ্র উত্তাপ__ আলোক সহ্য করিতে না পারিয়া শত্রুগণ দিগ্বিদিগ্ জ্ঞানশূন্য হইয়া পলায়ন করিল। নারীর হস্তে একটি লোকেরও মৃত্যু হয় নাই–একবিন্দু নরশোণিতেও বসুন্ধরা কলঙ্কিত হয় নাই–অথচ শত্রু পরাজিত হইল। তাহারা প্রস্থান করিলে পর তাহাদের সমুদয় অস্ত্রসস্ত্র সূর্যকিরণে দগ্ধ করা গেল।’
আমি বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া বলিলাম, ‘যদি বারুদ দগ্ধকালে ভয়ানক দুর্ঘটনা হইয়া আপনাদের কোনো অনিষ্ট হইত!’
‘আমাদের অনিষ্টের সম্ভাবনা ছিল না, কারণ বারুদ ছিল বহুদূরে। আমরা রাজধানীতে থাকিয়াই সার্চলাইটের তীব্র উত্তাপ প্রেরণ করিয়াছিলাম। তবু অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য জলধর বেলুন সঙ্গে রাখা হইয়াছিল। তদবধি আর কোন প্রতিবেশী রাজা-মহারাজা আমাদের দেশ আক্রমণ করিতে আইসেন নাই।’
‘তারপর পুরুষ-প্রবরেরা অন্তঃপুরের বাহিরে আসিতে চেষ্টা করেন নাই কি?’
‘হাঁ, তাঁহারা মুক্তি পাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কতিপয় পুলিশ কমিশনার ও জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এই মর্মে মহারানি সমীপে আবেদন করিয়াছিলেন যে, যুদ্ধে অকৃতকার্য হওয়ার দোষে সমর বিভাগের রাজকর্মচারীগণই দোষী, সেজন্য তাঁহাদিগকে বন্দি করা ন্যায়সঙ্গত হইয়াছে, কিন্তু অপর রাজপুরুষেরা তো কদাচ কর্তব্যে অবহেলা করেন নাই, তবে তাঁহারা অন্তঃপুর কারাগারে বন্দি থাকিবেন কেন? তাঁহাদের পুনরায় স্ব-স্ব কার্যে নিযুক্ত করিতে আজ্ঞা হউক।’
‘মহারানি তাঁহাদিগকে জানাইলেন যে, যদি আবার কখনো রাজকার্যে তাহাদের সহায়তার আবশ্যক হয়, তবে তাঁহাদিগকে যথাবিধি কার্যে নিযুক্ত করা হইবে। রাজ্যশাসন ব্যাপারে তাঁহাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত তাঁহারা যেখানে আছেন, সেইখানে থাকুন।
আমরা এই প্রথাকে ‘জেনানা’ না বলিয়া ‘মর্দানা’ বলি।’
আমি বলিলাম, ‘বেশ তো। কিন্তু এক-কথা–পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট ইত্যাদি তো ‘মর্দানায়’ আছেন, আর চুরি ডাকাতির তদন্ত এবং হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি অত্যাচার অনাচারের বিচার করে কে?’
‘যদবধি ‘মর্দানা’ প্রথা প্রচলিত হইয়াছে, তদবধি এদেশে কোনোপ্রকার পাপ কিংবা অপরাধ হয় নাই, সেইজন্য আসামি গ্রেফতারের নিমিত্ত আর পুলিশের প্রয়োজন হয় না–ফৌজদারি মোকদ্দমার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটেরও আবশ্যক নাই।’
‘তাই তো আপনারা স্বয়ং শয়তানকেই (৩) শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছেন, আর দেশে শয়তানি (৪) থাকিবে কিরূপে। যদি কোনো স্ত্রীলোক কখনো কোনো বেআইনি কাজ করে, তবে তাহাকে সংশোধন করা আপনাদের পক্ষে কঠিন নয়। যাহারা বিনারক্তপাতা যুদ্ধ জয় করিতে পারেন–অপরাধ ও অপরাধীকে তাড়াইতে তাঁহাদের কতক্ষণ লাগিবে?’
অতঃপর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘প্রিয় সুলতানা! আপনি এখানে আরও কিছুক্ষণ বসিবেন, না আমার বসিবার ঘরে চলিবেন?’
আমি সহাস্যে বলিলাম, ‘আপনার রান্নাঘরটি রানির বসিবার ঘর অপেক্ষা কোনো অংশে নিকৃষ্ট নয়। কিন্তু কর্তাদের কাজ বন্ধ করিয়া এখানে আমাদের বসা অন্যায়; আমি তাঁহাদের যে-দখল করিয়াছি বলিয়া হয়তো তাঁহারা আমাকে গালি দিতেছেন।’
আমি ভগিনী সারা বসিবার ঘরে যাইবার সময় ইতস্তত উদ্যানের সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করিয়া বলিলাম–‘আমার বন্ধুবান্ধবেরা ভারি আশ্চর্য হইবেন, যখন আমি দেশে গিয়া নারীস্থানের কথা বলিল–নন্দনকাননতুল্য নারীস্থানে নারীর পূর্ণ আধিপত্য, যৎকালে পুরুষেরা মর্দানায় থাকিয়া রন্ধন করেন, শিশুদের খেলা দেন, এক-কথায় যাবতীয় গৃহকার্য করেন। আর রন্ধনপ্রণালী এমন সহজ ও চমৎকার, যে, রন্ধনটা অত্যন্ত আমোদজনক ব্যাপার। ভারতে যে সকল বেগম খানম প্রমুখ বড়ঘরের গৃহিণীরা রন্ধনশালার ত্রিসীমায় যাইতে চাহেন না, তাঁহারা এমন কেন্দ্রীভূত সৌরকর পাইলে আর রন্ধনকার্যে আপত্তি করিতেন না।’
ভারতের লোকেরা একটু চেষ্টা করিলেই সূর্যোত্তাপ লাভের উপায় করিতে পারেন। বিশেষ একখণ্ড কাচ (convex glass) দ্বারা যেমন রবিকর একত্রিত করিয়া কাগজাদি দগ্ধ করা যায়, সেইরূপ কাচবিশিষ্ট যন্ত্র নির্মাণ করিতে অধিক বুদ্ধি ও টাকা ব্যয় হইবে না।’
‘জানেন ভগিনী সারা। ভারতবাসীর বুদ্ধি সুপথে চালিত হয় না–জ্ঞানবিজ্ঞানের সহিত আমাদের সম্পর্ক নাই। আমাদের সবকার্যের সমাপ্তি বক্তৃতায়, সিদ্ধি করতালি লাভে। কোণো দেশ আপনা হইতে উন্নত হয় না, তাহাকে উন্নত করিতে হয়। নারীস্থানে কখনও স্বর্ণবৃষ্টি হয় নাই–কিংবা জোয়ারের জলেও মণিমুক্তা ভাসিয়া আইসে নাই।’
তিনি হাসিয়া বলিলেন, ‘না।’
‘তবেই দেখুন, ত্রিশ বৎসরে আপনারা একটা নগণ্য দেশকে সুসভ্য করিলেন আর প্রকৃতপক্ষে দশ বৎসরেই আপনারা এদেশকে স্বর্গতুল্য পুণ্যভূমিতে পরিণত করিতে পারিলেন। আর আমরা একটা সুসভ্য রত্নগর্ভা দেশকে ক্রমে উন্নত করিব দূরের কথা–বরং ক্রমশ তাহাকে দীনতমা শ্মশানে পরিণত করিতে বসিয়াছি।’
‘পুরুষের কার্যে আর রমণীর কার্যে এই প্রভেদ। আমি যে বলিয়াছিলাম পুরুষেরা কোনো ভালো কাজ সুচারুরূপে করিবার উপযুক্ত নয়, আপনি বোধ হয় এতক্ষণে সে কথাটা বুঝিতে পারিলেন।’
‘হাঁ এখন বুঝিলাম, নারী যাহা দশ বৎসরে করিতে পারে, পুরুষ তাহা শত শত বর্ষেও করিতে অক্ষম। আচ্ছা ভগিণী সারা, আপনারা ভূমিকর্ষণাদি কঠিন কার্য করেন কিরূপে?’
‘আমরা বিদ্যুৎসাহায্যে চাষ করিয়া থাকি। চপলা আমাদের অনেক কাজ করিয়া দেয়–ভারী বোঝা উত্তোলন ও বহনের কার্যও সে-ই করে। আমাদের বায়ুশকটও তদ্দ্বারা চালিত হয়। দেখিতেছেন, এদেশে রেল-বর্ত্ম বা পাকা বাঁধ সড়ক নাই, কেবল পদব্রজে ভ্রমণের পথ আছে।’
‘সেইজন্য এখানে রেলওয়ে দুর্ঘটনার ভয় নাই–রাজপথেও লোকে শকটচক্রে পেষিত হয় না। যে-সব পথ আছে, তাহা তো কুসুমশয্যা বিশেষ। বলি, আপনারা কখনো কখনো অনাবৃষ্টিজনিত ক্লেশ ভোগ করেন কি?’
‘দশ-এগার বৎসর হইতে এখানে অনাবৃষ্টিতে কষ্ট পাইতে হয় না। আপনি ঐ যে বৃহৎ বেলুন এবং তাহাতে নল দেখিতে পাইতেছেন–উহা দ্বারা আমরা ইচ্ছা বারিবর্ষণ করিতে পারি। আবশ্যকমতো সমস্ত শস্যক্ষেত্রে জলসেচ করা হয়। আবার জলপ্লাবনেও আমরা ঈশ্বর কৃপায় কষ্টভোগ করি না। ঝঞ্ঝাবাত এবং বজ্রপাতেরও উপদ্রব নাই।’
‘তবে তো এদেশ বড় সুখের স্থান। আহা মরি! ইহার নাম ‘সুখস্থান’ হয় নাই কেন? আপনারা ভারতবাসীর ন্যায় ঝগড়াকলহ করেন কি? এখানে কেহ গৃহবিবাদে সর্বস্বান্ত হয় কি?’
‘না ভগিনী। আমাদের কোঁদল করিবার অবসর কই? আমরা সকলেই সর্বদা কাজে ব্যস্ত থাকি–প্রকৃতির ভাণ্ডার অন্বেষণ করিয়া নানাপ্রকার সুখস্বচ্ছন্দতা আহরণের চেষ্টায় থাকি। অলসেরা কলহ করিতে সময় পায়–আমাদের সময় নাই। আমাদের গুণবতী মহারানির সাধ–সমস্ত দেশটাকে একটি উদ্যানে পরিণত করিবেন।’
‘রানির এ-আকাঙ্খা অতি চমৎকার। আপনাদের প্রধান খাদ্য কী?’
‘ফল।’
‘ভালো কথা, আপনারাই তো সব কাজ করেন, তবে পুরুষেরা কী করেন?’
‘বড় বড় ফল কারখানায় যন্ত্রাদি পরিচালিত করেন, খাতাপত্র রাখেন–এক-কথায় বলি, তাঁহারা যাবতীয় কঠিন পরিশ্রম অর্থাৎ যে-কার্যে কায়িকবলের প্রয়োজন সেইসব কার্য করেন।’
আমি হাসিয়া বলিলাম–‘ওহ্। তাঁহারা কেরানি মুটে মজুরের কাজ করিয়া থাকেন।’
‘কিন্তু কেরানি ও শ্রমজীবী বলিতে ঠিক যাহা বুঝায় এদেশের ভদ্রলোকেরা তাহা নহেন। তাঁহারা বিদ্যা, বুদ্ধি, সুশিক্ষায় আমাদের অপেক্ষা কোনো অংশে হীন নহেন। আমরা শ্রম বণ্টন করিয়া লইয়াছি–তাঁহারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, আমরা মস্তিষ্কচালনা করি। আমরা যে-সকল যন্ত্রের উদ্ভাবনা বা সৃষ্টি কল্পনা করি, তাঁহারা তাহা নির্মাণ করেন। নরনারী উভয়ে একই সমাজদেহের বিভিন্ন অঙ্গ–পুরুষ শরীর, রমণী মন।’
‘তা বেশ। কিন্তু ভারতবাদী পুরুষেরা এ-কথা শুনিলে খড়্গহস্ত হইবেন। তাঁহাদের মতে তাঁহারা একাই এক সহস্র–‘তনমন’ সব তাঁহারা নিজেই। আমরা তাঁহাদের ‘ছাই ফেলিবার জন্য ভাঙাকুলা’ মাত্র। আপনাকে আর-একটি কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া থাকতে পারিতেছি না, আপনারা গ্রীষ্মকালে বাড়িঘর ঠাণ্ডা রাখেন কিরূপে? আমরা তো বৃষ্টিধারাকে স্বর্গের অমিয় ধারা মনে করি।’
‘আমাদের সুস্নিগ্ধ বৃষ্টিধারার অভাব হয় না। তবে আমরা পিপাসী চাতকের ন্যায় জলধরের কৃপা প্রার্থনা করি না, এখানে কাদম্বিনী আমাদের সেবিকা–সে আমাদের ইচ্ছানুসারে শীতল ফোয়ারায় ধরণী সিক্ত করিয়া দেয়। আবার শীতকালে সূর্যোত্তাপে গৃহগুলি ঈষৎ উত্তপ্ত রাখা হয়।’
অতঃপর তিনি আমাকে তাঁহার স্নানাগার দেখাইলেন। এ-কক্ষের ছাদটা বাক্সের ডালার মতো। ছাদ তুলিয়া ফেলিয়া ইচ্ছামতো বৃষ্টিজলে স্নান করা যায়। প্রত্যেকের গৃহপ্রাঙ্গণে বেলুনের ন্যায় বৃহৎ জলাধার আছে–আদি বেলুনের সহিত ঐ জলাধারগুলির যোগ আছে। আমি মুগ্ধভাবে বলিলাম, ‘আপনারা ধন্য। স্বয়ং প্রকৃতি আপনাদের সেবাদাসী, আর কী চাই! পার্থব সম্পদে তো আপনারা অতিশয় ধনী, আপনাদের ধর্মবিধান কিরূপ–জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?’
‘আমাদের ধর্ম–প্রেম ও সত্য। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসিতে ধর্মত বাধ্য এবং প্রাণান্তেও সত্যত্যাগ করিতে পারি না। যদি কালেভদ্রে কেহ মিথ্যা বলে…’
‘তবে তাহার প্রাণদণ্ড হয়?’
‘না, প্রাণদণ্ড হয় না। আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টিজগতের জীবহত্যায়, বিশেষত মানবহত্যায় আমোদবোধ করি না। কাহারও প্রাণনাশ করিতে অপর প্রাণীর কী অধিকার? অপরাধীকে নির্বাসিত করা হয়, এবং তাহাকে এদেশে কিছুতেই পুনঃপ্রবেশ করিতে দেওয়া হয় না।’
‘কোনো মিথ্যাবাদীকে কখনো ক্ষমা করা হয় না কি?’
‘যদি কেহ অকপট হৃদয়ে অনুতপ্ত হয়, তাহাকে ক্ষমা করা যায়।’
‘এ-নিয়ম অতি উত্তম। এখানে যে ধর্মই রাজত্ব করিতেছে। ভালো, একবার, মহারানিকে দেখিতে পাইব কি? যিনি করুণাপ্রতিমা, নানা গুণের আধার, তাঁহাকে দেখিলেও পুণ্য হয়।’
‘বেশ চলুন।’ এই বলিয়া ভগিনী সারা যাত্রার আয়োজন করিতে লাগিলেন। একখণ্ড তক্তায় দুখানি আসন স্ক্রু দ্বারা আঁটা হইল। পরে তিনি কতিপয় গোলা আনিলেন। গোলা কয়টি দেখিতে বেশ চক্চকে ছিল, কোন্ ধাতুতে গঠিত তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না, আমার মনে হইল উৎকৃষ্ট রোপ্য-নির্মিত বলিয়া। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার ওজন কত। আমি জীবনে কোনোদিন ওজন হই নাই, কাজেই নিজের গুরুত্ব আমার জানা ছিল না, ভগিনী বলিলেন, ‘আসুন তবে আপনাকে ওজন করি। ওজনটা জানা প্রয়োজন।’
আমি ভাবিলাম, একি ব্যাপার! যাহা হউক ওজনে আমি একমণ ষোল সের হইলাম। শুনিলাম, তিনি আটত্রিশ সের মাত্র। তবে ভগিনী সারার অপেক্ষা আর কোনো গুণে না হউক আমি গুরুত্বে বেশি তো।
তারপর দেখিলাম, ঐ চক্চকে গোলার ছোটবড় দুইটি গোলা এই তক্তায় সংযোগ করা হইল। আমি প্রশ্ন করিয়া জানিলাম, সে-গোলা হাইড্রোজেন পূর্ন। তাহারই সাহায্যে আমরা শূন্যে উত্থিত হইব। বিভিন্ন ওজনের বস্তু উত্তোলনের নিমিত্ত ছোটবড় বিবিধ ওজনের হাইড্রোজেন গোলা ব্যবহৃত হয়। এখন বুঝিলাম, এইজন্য আমার ওজন অবগত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। অতঃপর এইরূপ বায়ুযানে দুইটি পাখার মতো ফলা সংযুক্ত হইল, শুনিলাম ইহা বিদ্যুৎ দ্বারা পরিচালিত হয়। আমরা উভয়ে আসনে উপবেশন করিলে পর তিনি ঐ পাখার কল টিপিলেন। প্রথমে আমাদের ‘তখ্তে রওয়াঁ’খানি (৫) ধীরে ধীরে ৭/৮ হাত ঊর্ধ্বে উত্থিত হইল, তারপর বায়ুভরে উড়িয়া চলিল। আমি ভাবলাম, এমন জ্ঞানেবিজ্ঞানে উন্নত দেশের অধীশ্বরীকে দেখিতে যাইতেছি, যদি আমার কথাবার্তায় তিনি আমাকে নিতান্ত মূর্খ ভাবেন–এবং সেইসঙ্গে আমাদের সাধের হিন্দুস্থানকে ‘মূর্খস্থান’ মনে করেন? কিন্তু অধিক ভাবিবার সময় ছিল না–সবে তখ্তে রওয়াঁ শূন্যে উড়িতে আরম্ভ করিয়াছে আর অমনই দেখি আমরা চপলাগতিতে রাজধানীতে উপনীত। সেই বায়ুযানে বসিয়াই দেখিতে পাইলাম, সখী-সহচরী পরিবেষ্টিতা মহারানি তা৬হার চারি বৎসর বয়স্কা কন্যার হাত ধরিয়া উদ্যানে ভ্রমণ করিতেছেন। সমস্ত রাজধানী যেন একটি বিরাট কুসুমকুঞ্জ বিশেষ। তাহার সৌন্দর্যের তুলনা এ-জগতে নাই।
মহারানি দূর হইতে ভগিনী সারাকে চিনিতা পারিয়া বলিলেন, ‘বা! আপনি এখানে।’ ভগিনী সারা রানিকে অভিবাদন করিয়া ধীরে ধীরে তখ্তে রওয়াঁ অবনত করিলে আমরা অবতরণ করিলাম।
আমি যথারীতি মহারানির সহিত পরিচিতা হইলাম। তাঁহার অমায়িক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হইলাম। আমার আশঙ্কা ছিল, তিনি আমাকে কী যেন মন করিবেন, এখন সে ভয় দূর হইল। তাঁহার সহিত রাজনীতি সম্বন্ধে বিবিধ প্রসঙ্গ হইল। বাণিজ্য-ব্যবসায় সম্বন্ধেও কথা উঠিয়াছিল। তিনি বলিলেন যে, ‘অবাধ বাণিজ্যে তাহার আপত্তি নাই, কিন্তু যে-সকল দেশে রমণীবৃন্দ অন্তঃপুরে থাকে অথবা যে-সব দেশে নারী কেবল বিবিধ বসন ভূষণে সজ্জিতা হইয়া পুত্তলিকাবৎ জীবনে বহন করে, দেশের কোনো কাজ করে না, তাহারা বাণিজ্যের নিমিত্ত নারীস্থানে আসিতে বা আমাদের সহিত কাজকর্ম করিতে অক্ষম। এই কারণে অন্য দেশের সহিত আমাদের বাণিজ্য-ব্যবসায় চলিতে পারে না। পুরুষেরা নৈতিক জীবনে অনেকটা হীন বলিয়া আমরা তাহাদের সহিত কোনোপ্রকার কারবার করিতে ইচ্ছুক নহি। আমরা অপরের জমিজমার প্রতি লোভ করিয়া দুই-দশ বিঘা ভূমির জন্য রক্তপাত করি না, অথবা একখণ্ড হীরকের জন্যও যুদ্ধ করি না–যদ্যপি তাহা কোহেনুর অপেক্ষা শতগুণ শ্রেষ্ঠ হয়, কিংবা কাহারও ময়ূরসিংহাসন দর্শনেও হিংসা করি না। আমরা অতল জ্ঞানসাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি। প্রকৃতি মানবের জন্য তাহার অক্ষয় ভাণ্ডারে যে অমূল্য রত্নবাজি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে আমরা তাহাই ভোগ করি। তাহাতেই আমরা সন্তুষ্টচিত্তে জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ দিই।’
মহারানির নিকট বিদায় লইয়া আমি সেই সুপ্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় দেখিতে গেলাম, এবং কতিপয় কলকারখানা, রসায়নাগার এবং মানমন্দিরও দেখিলাম।
উপরোক্ত দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ পরিদর্শনের পর আমরা পুনরায় সেই বায়ুযানে আরোহণ করিলাম। কিন্তু সেই আমাদের তখতে রওয়াঁখানি ঈষৎ হেলিয়া ঊর্ধ্বে উঠিতে লাগিল, আমি কী জানি কিরূপে আসনচ্যুত হইলাম–সেই পতনে আমি চমকিয়া উঠিলাম। চক্ষু খুলিয়া দেখি, আমি তখনো সেই আরামকেদারায় উপবিষ্ট।
———–
(১) “পরিস্থান” শব্দের অনুকরণে “নারীস্থান” বলা হইল। ইংরাজিতে “লেডি ল্যাণ্ড” বলা গিয়াছে।
(২) হিংসা বৃত্তিটা কি বাস্তবিক বড় দোষণীয়? কিন্তু হিংসা না থাকিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছা হয় কই? এই হিংসাই তো মানবকে উন্নতির দিকে আকর্ষণ করে। তবে দেশকাল ভেঙে ঈর্ষায় পতন হয়, সত্য। তা যে-কোনো মনোবৃত্তির মাত্রাধিক্যেই অনিষ্ট হয়; সকল বিষয়েরই সীমা আছে।
(৩) পুরুষ জাতিকে।
(৪) পাপ।
(৫) ইংরেজিতে ‘Travelling throne’ বলা যাইতে পারে।
সৌরজগৎ
কারসিয়ঙ্গ পৰ্ব্বতের একটি দ্বিতল গৃহে অপরাহ্নে গওহর আলী স্ত্রী ও কন্যাদলে পরিবেষ্টিত হইয়া অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিয়াছেন। তাঁহার নয়টি কন্যা যে ভাবে তাহাকে পরিবেষ্টন করিয়া বসিয়াছে, তাহা দেখিয়া স্বতঃই এ পরিবারটিকে সুখী ও সৌভাগ্যশালী বলিয়া মনে হয়। সৰ্ব্বকনিষ্ঠা দুহিতা মাসুমা তাহার। সৰ্ব্বজ্যেষ্ঠ সহোদরা কওসরের ক্ৰোড়ে, এবং অবশিষ্ট শিশুগুলি পিতামাতার দুই পার্শ্বে ছোট ছোট পাদপীঠে বসিয়াছে।
এইরূপে ভাগ্যবান গহওর আলী তারকাবেষ্টিত সুধাংশুর ন্যায় শোভা পাইতেছেন। কওসর পিতামহের অতি আদরের পৌত্রী। তিনি সাধ করিয়া ইহার নাম “কওসর” রাখিয়াছেন। কাওসর শব্দের অর্থ স্বগীয় জলাশয়, যেমন মন্দাকিনী।১
যে কক্ষে তাহারা উপবেশন করিয়াছেন, সেটি কতক মুসলমানী ও কতক ইংরাজী ধরণে সজ্জিত; নবাবী ও বিলাতী ধরণের সংমিশ্রণে ঘরখানি মানাইয়াছে বেশী। ত্রিপদীর (টিপায়ের) উপর একটি ট্রেতে কিছু জলখাবার এবং চা-দুগ্ধ ইত্যাদি যেন কাহার অপেক্ষায় রাখা হইয়াছে।
গওহর আলীর হন্তে একখানি পুস্তক; তিনি তাহা পাঠ করিয়া সকলকে বুঝাইয়া দিতেছেন। তাঁহাদের আলোচ্য বিষয় ছিল, বায়ু। বায়ুর শৈত্য, উষ্ণতা, লঘুত্ব, গুরুত্ব; বায়ুতে কয় প্রকার গ্যাস আছে; কিরূপে বায়ু ক্ৰমান্বয়ে বাষ্প, মেঘ, সলিল, এবং শীতল তুষারে পরিণত হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রোতৃবর্গ বেশ মনোযোগসহকারে শ্রবণ করিতেছে; কেবল সপ্তম দুহিতা সুরেয়া নানাপ্রকার প্রশ্ন দ্বারা পিতার ধৈৰ্য্যগুণ পরীক্ষা করিতেছে! কখনও ছবি দেখিবার জন্য পিতার হস্ত হইতে পুস্তক কাড়িয়া লইতেছে! পিতা কিন্তু ইহাতে বিরক্ত না হইয়া বরং আমোদ বোধ করিয়া হাসিতেছেন।
গৃহিনী নূরজাহাঁ একরার ঐ ট্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, “ভাই এখনও আসিলেন না; চা ত ঠাণ্ড হইতে চলিল।”
গওহর। তোমার ভাই হয়ত পথে লেপচাদরের সঙ্গে খেলা করিতেছেন!
বালিকা। রাবেয়া বলিল, “আমরা তাঁহাকে দ্বিতীয় বেঞ্চের নিকট অতিক্রম করিয়া আসিয়াছি। এইটুকু পথ তিনি এখনও আসিতে পারিলেন না?”
সুরেয়া। বাব্বা! বেন কি অল্প পথ? আমি ত হাঁটিতে না পারিয়া আয়ার কোলে চড়িয়া আসিলাম।
রাবেয়া। ঈশ! আমি একদৌড়ে দ্বিতীয় বেঞ্চ হইতে এখানে আসিতে পারি।
গওহরও কন্যাদের কথোপকথনে যোগ দিয়া বলিলেন, “আগে এক দৌড় আসিতে পারিয়া দেখাও, পরে বড়াই করিও। কোন কাজ করিতে পারার পূৰ্ব্বে পারি’ বলা উচিত নহে!”
কওসর। এখান হইতে দ্বিতীয় বেঞ্চ প্রায় দুই মাইল হইবে, না আব্বা?
গও। কিছু বেশী হইবে। যাহা রউক, রাবু যখন বলিয়াছে, তখন তাহাকে অন্ততঃ একরার একদৌড়ে সে পৰ্যন্ত যাইতেই হইবে!
আখতার। রাবু একদৌড়ে যাইবে, না পথে বিশ্রাম করিবে, তাহা জানিবার উপায় কি?
গও। (বিস্ফারিত নেত্রে) জানিবার উপায়? রাবু যতদূর পর্যন্ত গিয়া ক্লান্তি বোধ করিবে, তথা হইতে ফিরিয়া আসিয়া পরাজয় স্বীকার করিবে। সে নিজেই বলিবে, সে কতদূর গিয়াছিল। আমার কন্যা কি মিথ্যা বলিবে?
রাবু। (সোৎসাহে) না আব্বা! আমি মিথ্যা বলি না—বলিবও না।
আখ। আমি বেশ জানি, তুমি মিথ্যা বল না; তবে যদি মিথ্যা বাহাদুরির লোভে একটি ছোট মিথ্যা বলিয়া ফেলিতে!
রাবু। (সগৰ্ব্বে) মিথ্যা বলার পূৰ্ব্বে মরিয়া যাওয়া ভাল!
গও। ঠিক! তোমরা কেহ একটি মিথ্যা বলিলে আমার মর্ম্মে বড়ই ব্যথা লাগিবে। আশা করি, তোমরা কেহ আমাকে কখন এরূপ কষ্ট দিবে না।
কতিপয় বালিকা সমস্বরে বলিয়া উঠিল,–“আমরা মিথ্যা না,-আমরা কষ্ট না,” অথবা কি বলিল ঠিক শুনা গেল না!
এমন সময় সিঁড়িতে কাহার পদশব্দ শুনা গেল। কওসর ও মাসুমা ব্যতীত অপর বালিকা কয়টি “মাম্মা আসিলেন” বলিয়া পলায়ন তৎপরা হইল। গওহর নয়িমাকে ধরিয়া বলিলেন, “সেজন্য পলাইস কেন মা?”
নায়িমা। ও বাব্বা! আমি না-মাম্মা! (অর্থাৎ আমি থাকিব না-মাম্মা বকিবেন)। ইতঃমধ্যে জাফর আলী গৃহে প্রবেশ করিলেন। পলায়মানা বালিকাদের দেখিয়া গওহরকে সহাস্যে বলিলেন, “Solar system (সৌরজগৎ)টা ভাঙ্গিয়া গেল কেন?”২
গও। তুমি ‘ধূমকেতু আসিলে যে! নূরজাহী লাতার নিমিত্ত চা প্রস্তুত করিতে অগ্রসর হইয়া গওহরকে বলিলেন, “তুমি একটু সর, ভাইকে অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিতে দাও।”
জাফর। না। আমি অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিব না। যে ক্লান্ত হইয়াছি, আমার সর্বাঙ্গ ঘৰ্ম্মাসিক্ত হইয়াছে। আমি এইখানেই বসি।
কওসর জলখাবারের ট্রেটা আনিয়া জাফরের সম্প্ৰমুখে রাখিল, এবং তাঁহার ললাটে ঘৰ্ম্মবিন্দু দেখিয়া স্বীয় বসনাঞ্চলে মুছিয়া দিল।
জাফর এক পেয়ালা চা শেষ করিয়া ভগিনীর হস্তে পেয়ালা দিয়া বলিলেন, “নুরু। আর এক পেয়ালা চা দে!?
গও। তোমার ভুল হইল। পেয়ালাটি লইবার জন্য র্তাহাকে এতদূর আসিতে হইল, ইহা অন্যায়! তুমি উঠিয়া গিয়া তাহাকে পেয়ালা দিতে পারিতে!
নূরজাহাঁ অধোমুখে মৃদুহাস্য করিলেন। কওসরের খুব জোরে হাসি পাইল বলিয়া সে প্ৰস্থান করিল, এবং মাতার সাহায্যের নিমিত্ত বদরকে তথায় পাঠাইয়া দিল।
জাফ। দেখ ভাই! তোমার সাহেবীটা আমার সহ্য হয় না। তুমিই কি একমাত্র বিলাত ফেবতা?
গও। না, তুমিও বিলাত ফেরতা! তোমার গালি শুনিয়া আমোদ হয়, সেইজন্য সাহেবীভূতের দোহাই দিই! সে যাহা হউক, তোমার আসিতে এত বিলম্ব হইল কেন? পথে পাহাড়ীদের সহিত গলপ করিতেছিলে না কি?
জাফ। ভুটিয়াদের সহিত গল্প করিব কি, উহাদের ভাষাই বুঝি না; যে ছাই “কান্ছু যানছু” বলে!
বদর তাহার পাহাড়ী ভাষায় অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বলিল, “যানছুমানে যাওয়া।” নূরজাহাঁ তাহাকে বলিলেন, “ইহাদের গল্পে যোগ দিয়া তোমার কাজ নাই মা! যাও তুমি কওসরের নিকট।”
গও। তবে কেন বিলম্বব হইল?
জাফ। প্রথম বেঞ্চে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছিলাম। তথা হইতে সমস্ত কারসিয়ঙ্গ সহরটা ত বেশ দেখা যায়। বাজার ষ্টেশন, কিছুই বাদ পড়ে না।
নূরজাহী। হাঁ, ঐখানে বসিলে ধরা খানা সরা। তুল্য বোধ হয়!
গও। আর যেদিন ইহারা পদব্রজে “চিমনী সাইড”(৩) পৰ্য্যন্ত আরোহণ ও তথা হইতে অবতরণ করিয়াছিলেন, সেদিন ইহাদের যে আনন্দ হইয়াছিল!-সম্ভবতঃ পোট আর্থার এবং বালটিক ফ্লট জয় করিয়াও জাপানীদের তত উল্লাস হয় নাই!!
নূর। জাপানীরা তত উল্লসিত হইবে কি রূপে? তাহাদের কার্য্য এখনও যে শেষ হয় নাই। আর আমরা ত পদবজে ১২ মাইল ভ্ৰমণের পর গন্তব্য স্থানে পৌঁছিয়ছিলাম!
জাফ। এখন বাকী আছে শ্ৰীমতীদের বেলুন আরোহণ করা!
গও। সময়ে তাহাও বাকী থাকিবে না!
জাফ। তুমি সপরিবারে ইংলণ্ড যাইবে কবে?
গও। যখন সুবিধা যাইবে!
জাফ। হঁ-কন্যাগুলি অক্সফোর্ড বিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়া এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হইবে! সাধে কি তোমাদের সৌরজগৎ বলি। তোমার দুহিতা কয়টি গ্রহ, আর তুমি সূৰ্য্য! উহাদের নামও ত এক একটি তারকার নাম-মুশতরী, জোহরা, সুরেয়া!(৪) তবে কেবল মঙ্গল, বুধ, শনি এ নামগুলি বাধ দেওয়া হইয়াছে কেন?
নূর। ভাই! তোমরা নিজেরা ঝগড়া করিতে বসিয়া মেয়েদের নাম লইয়া বিদ্রপ কর কেন? আর এ নাম ত আমরা রাখি নাই, স্বয়ং কৰ্ত্তা রাখিয়াছেন। তাঁহার পৌত্রীদের নাম, তিনি যেরূপ ইচ্ছা রাখিবেন, তাহাতে আমাদের কিছু বলিবার অধিকার কি?
জাফরকে আরও অধিক ক্ষেপাইবার জন্য গওহর বলিলেন, “কেবল ইংলণ্ড কেন, আমেরিকা যাইবারও ইচ্ছা আছে,-কাওসর “নায়েগারা ফলস, দেখিতে চাহে।”
জাফ। তোমার এ সাধ অপূর্ণ থাকিবে। কাওসারকে আর ‘নায়েগারা” প্রপাত দেখাইতে হইবে না।
গও। কেন?
জাফ। আগামী বৎসর সে তোমার ক্ষমতার বাহির হইবে। গও। আমার হাতের বাহির হইলেই বা কি, জামাতাসহ যাইব।
জাফ। জামাতা তোমারই মত কাণ্ডজ্ঞানহীন মুর্থ হইলে ত?
গও! তুমি তাঁহাকে অধিক জান, না। আমি?
জাফ! আমি সিদ্দিককে যতদূর জানি, তাহাতে আশা রাখি, তিনি তোমার মত forward (অগ্রগামী) নহেন।
গও। আমিও আশা রাখি তিনি তোমার মত backward (পশ্চাদগামী) নহেন! তিনি নিশ্চয়ই কওসরকে নায়েগারা প্ৰপাত দেখাইবেন!
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
“মাম্মা আকরার সহিত তজ্জন গজ্জন করিতেছেন, চল আমরা শুনি গিয়া,” এই বলিয়া বদর আখতারকে টানিতে লাগিল।
আখতার। আমরা সেখানে গেলে মাম্মা গজ্জন ছাড়িয়া গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিবেন।
বদর। আমরা তাহার সম্প্ৰমুখে যাইব না-পাশ্বের ঘরে লুকাইয়া শুনিব।
কওসর। ছি বদু! লুকাইয়া কিছু শুনা উচিত নহে; সাবধান!
বদর। (ব্যগ্রভাবে।) তবে আমি যে দুই একটি কথা শুনিয়া ফেলিয়াছি, তাহার উপায় কি?
কও। যাহা হইবার হইয়াছে। আর কখন এরূপ দোষ করিও না।
আখ। মাসুমা ত ঘুমাইয়াছে; যাও নায়িমু! তুমিও ঘুমাও গিয়া।
নমিয়া। না, আমি ধুম্না।(৫)
আখ। তবে আমি আর তোমায় কোলে রাখিব না!
কও। চল এখন আমরা পড়াশুনা করি গিয়া। যাও ত বোন মুশতরী, তুমি দেখিয়া আইস, আমাদের পড়বার ঘরে অগ্নিকুণ্ডে কয়লা, আগুন —সব ঠিক আছে কি না।
জোহরা। আমরা ডাউহিল স্কুলে পড়তে গেলে খুব ছুটী পাইব, না?
আখ। আরে! আগে যা ত ডাউহিল স্কুলে, তারপর ছুটী লইস।
বদর। আগে পাগলা ঝোরার(৬) জলে ভাল করিয়া মুখখানা ধো!
রাবু। কেন আপা! আমাদের স্কুলে যাওয়া হইবে না কেন? তোমরাই তিনজনে যাইবে না-তোমরা বড় হইয়াছ। আমরা কেন যাইব না?
কও। ওরে, মাম্মা যাইতে দিলে হয়!
রাবু। মাম্মাটা ভাললোক নহেন,-তাহার চক্ষু দেখিলে আমার যে ভয় হয়! এখন তিনি আসিয়াছেন, কেবল আমাদের স্কুলে যাওয়ায় বাধা দিতে!
সুরেয়া। আমি ত স্কুলে যাইবই—
জোহ। হাঁ, তুই একাই যাইবি-তুই বড় সোহাগের মেয়ে কি না!
বদ। রাবু! তোরা পাগলা কোরার নিম্পর্মল জলে বেশ ভাল করিয়া মুখ ধুইস! আমরা তিনজন টেকনিকাল স্কুলে ভর্ত্তী হইব।
রাবু! তোমাদের মাম্মা বাধা দিবেন না?
কও। বাধা দিয়াছিলেন; এখন রাজী হইয়াছেন।
জোহ। আপা! সেখানে কেবল ‘নানা’ আছে, ‘নানা’ নাই?
বদ। না, সে স্কুলে ‘নানা’ নাই—কেবল একদল ‘নানী’ আছেন!
এখানে ‘নানা’ অর্থে নান শব্দের পুংলিঙ্গ বুঝিতে হইবে। দুষ্ট বালিকারা সেন্ট হেলেনাস টেকনিকাল স্কুলের নানুদিগকে ‘নানী’ বলে! তা তাহাদের সূতি খুন মাফ!! এই স্কুলে বালিকাদিগকে রন্ধন, সূচিকম্পর্ম ও নানাপ্রকার বুনন গাঁথনি (যাবতীয় ফ্যানসী ওয়ার্ক) শিক্ষা দেওয়া হয়।
জোহরা সাদরে আখতরের হাত ধরিয়া বলিল, “আপা! তুমি আমার পুতুলের জন্য খুব সুন্দর শাল তৈয়ার করিয়া দিও?”
সুরেয়া কওসরের কণ্ঠবেষ্টন করিয়া বলিল, “আর তুমি অনেক মিঠাই তৈয়ার করিও।”
রাবু। হাঁ, তাহা হইলে তুমি খুব মিঠাই খাও! (সকলের হাস্য)।
মুশতরী আসিয়া জানাইল পাঠগৃহে সব প্রস্তুত। অতঃপর সকলে সেই কক্ষে গেল।
কওসর শিক্ষয়িত্রীর আসন গ্ৰহণ করিয়া গভীর ভাবে সকলকে সম্বোধন করতঃ বলিল, “আব্বা যে সন্ধ্যার সময় আমাদিগকে বায়ুর বিষয় বলিলেন, তাহার কোন কথা তোমরা কে বুঝিতে পার নাই? যে না বুরিয়া থাক, আমাকে জিজ্ঞাসা কর, আমি বুঝাইয়া বলি।”
মুশ। আব্বা হওয়ার কথা বলিয়াছেন। ইন্দ্ৰধনুর বিষয় ত কিছু বলেন নাই। আমি কালি তাহাকে ইন্দ্ৰধনুর কথা জিজ্ঞাসা করিব।
জোহ। আমি আব্বাকে বলিব, আমায় একটা ইন্দ্ৰধনু আনিয়া দিতে।
সুরে। আমিও ইন্দ্ৰধনু লইব।
বয়োজ্যেষ্ঠার হাসিল। মুশতরী বলিল, “ওরে, ইন্দ্ৰধনু কি ধরা যায়?”
রাবু। ইন্দ্ৰধনু ধরা যায় না। সত্য,-কিন্তু যে উপায়ে বায়ু ধরিয়া কাচের নলে বন্ধ করা যায়, পরীক্ষা করা যায়, সেইরূপে ইন্দ্ৰধনুকে ধরাও অসম্ভব নহে।
কও। এ অকাট্য যুক্তি! (সকলের হাস্য)।
রাবু। কেন, মন্দটা কি বলিলাম? আখ। না রাবু! কিছু মন্দ বল নাই। টেলিফোন, গ্রামোফোন-ফনোগ্রাফ ইত্যাদিতে মানুষের কণ্ঠস্বর ধরা গিয়াছে ও ধরা যায়, তবে ইন্দ্ৰধনু ধরা আর শক্তটা কি?
আবার হাসির গররা উঠিল।
কও। চুপ! চুপ! মাম্মা শুনিলে বলিবেন, “এইরূপে বুঝি পড়া হইতেছে?”
মুশ। (কষ্টে হাস্য সম্বরণ) আব্বা তা আমরা হাসিলে কিছু বলেন না?
রাবু। না, বরং তিনিও হাসেন।
বদ। তোরা আর এক কথা শুনিয়াছিস? জাহেদ ভাই ও হুরন বুকে মাম্মা প্রহার করিয়া থাকেন!
জোহ। সত্য নাকি? বাবা! তবে আর আমি মাম্মার বাড়ী যাইব না। যখন নিজের ছেলে মেয়েকে মারেন, তখন আমাদের ত আরও মারিবেন।
সুরে। আব্বা তা আমাদের কখনও মারেন না।
রাবু। আমাদের আকরা ভাল, মাও ভাল, কেবল মাম্মাটি ভাল নহেন।
বদ। দাড়া! আমি মাম্মাকে বলিয়া দিব!
আখ। রাবুতাঁহার মুখের উপর বলিতে ভয় করে কবে?
কওসর। বাস্! এখন চুপ কর!
বদ। বায়ুর বিষয় ভালরূপ বুঝিলাম কি না, সে সম্বন্ধে প্রশ্ন কর না, বড়। আপা?
কও। আমি কাল দিনের বেলায় মেঘমালা দেখিযা ও দেখাইয়া প্রশ্ন করিব। তোমরা এখন
আমাকে প্রশ্ন করিয়া ভাল করিয়া বুঝিয়া লও।
রাবু। আমি কাল পেটাশিয়াম জলে ফেলিয়া তামাসা দেখিব।
মুশ। পেটাশিয়াম জলে ফেলিলে কি তামাসা হইবে?
বদ। কেন তোমার মনে নাই?-উহা জলে ফেলিবামাত্র আগুন জ্বলিয়া উঠিবো!
মুশ। হাঁ, মনে পড়িল। আমি খেলা করিব, সোডিয়াম ও গরমজল লইয়া।
নায়িমা। (নিদ্রাবেশে চক্ষু কচলাইতে কচলাইতে) আল আমি? আমি তি থেলিব?
মাধ। সেহাস্য) তোমার এখন ‘থেলিয়া’ কাজ নাই। চল, তোমায় শয্যায় রাখিয়া আসি।
রাবু। মুশতরী! তোমার আগুন অপেক্ষা আমরা আগুনের রঙ বেশী সুন্দর হইবে!
মুশ্। কেন? সোডিয়াম গরম জলে ফেলিলে বেশী সুন্দর হলদে রঙের আগুন বাহির হইবে?
কও। তোমরা ঝগড়া ছাড়া আর কিছু জান না? রাবুই বড় দুষ্ট-ওই ঝগড়া আরম্ভ করে!
রাবু। ক্ষমা কর, বড় আপা। এখন কাজের কথা বলি। আমরা যে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় তুষার দেখি, উহাও কি পূৰ্ব্ব অবস্থায় বায়ু ছিল?
কও। হঁয়; এবং এখন আবার উপযুক্ত উত্তাপে বাপীভূত হইতে পারে।
রাবু। তবে সূর্যোত্তিাপে গলিয়া যায় না কেন?
কও। গলে বইকি? ঐ বরফ অল্প উত্তাপে স্থানভ্রষ্ট হইয়া নদীর মত বহিয়া যায়; তাহাকে ইংরাজীতে “গ্লেসিয়ার” বলে। আব্বা উহার নাম দিয়াছেন “নীহারনদী”।
রাবু। বাঃ! বরফের নদী ত বড় সুন্দর দেখাইবো! চল আমরা একদিন কাঞ্চনজঙ্ঘার নিকট গিয়া নীহারানদী দেখিয়া আসি।
বদ। বটে? কাঞ্চনজঙ্ঘা বুঝি খুব নিকট?
রাবু। নিকট না হউক, আমরা কি পথ চলিতে ভয় করি? একদিন চিমনী সাইডে উঠিয়াছিলাম–তাহা কি অল্প পথ ছিল? পাচ ছয় মাইল আরোহণ ও অবতরণ কি সামান্য ব্যাপার? আবার সেদিন ডাউহিল ও ঈগলস ক্ৰেগের সন্ধিস্থলে নামিয়াছিলাম।
বদ। ডাউহিলের সন্ধিস্থলে অবতরণ করিয়া কেমন ক্লান্ত হইয়াছিলে, মনে নাই?
কও। রাবুত বলিয়াছিল, আমি আর হাঁটিতে পারি না; আমাকে ফেলিয়া যাও! আমায় ভল্লুকে খায় খাইবে!
রাবু। ডাণ্ডিটা(৭) সময়ে না পাওয়া গেলে আসিতেই পারিতাম না।
কও। আব্বাই ডাণ্ডির বন্দোবস্ত করিয়া গিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন, অৰ্দ্ধপথে বন্দু ও রাবুর বীরত্ব প্রকাশ পাইবে!
বদ। আমি ত ভাই রাবুর মত অহঙ্কার করি না যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পৰ্যন্ত পদব্ৰজে যাইতে পারিব, একদৌড়ে দ্বিতীয বেঞ্চ অতিক্রম করিব। হাঁ, ভাল কথা! আমি যে সেই ঈগেলস ক্ৰেগের সন্ধিস্থলের বিজন অরণ্য হইতে ফুল আনিয়াছিলাম, তাহা কোথায় রাখিয়াছি? মনে ত পড়ে না।
কও। ফুলগুলি বনে ফিরিয়া গিয়া থাকিবে।
বদ। তবে তুমি তুলিয়া রাখিয়াছ! আর ভাবনা নাই।
কও। তোমার ফুল কিরূপ ছিল? আমার সংগৃহীত কুসুমরাজি হইতে তাহা বাছিয়া লাইতে পার?
বদ। বেশ পারি—সে ফুল বকুল ফুলের মত। গন্ধ ও আকৃতি বকুলের, কেবল বর্ণ পীত।
রাবু। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর যে ক্রেপের ওড়নার মত পাতলা মেঘের গাঢ়গোলাপী বেগুনী চাদর দেখিতে পাই, তাহা কোথা হইতে আইসে?
কও। সূৰ্য্যের উত্তাপে ঐ জমাট তুষার হইতে যে বাষ্প উখিত হয়, তাহাই মেঘের ওড়না রূপে কাঞ্চনের চুড়া বেষ্টন করিয়া থাকে।
আখ। আমি ভাবিয়াছিলাম, কাঞ্চনের ওড়নাগুলি বানারস হইতে আইসে!
সুরেয়া ধীরে ধীরে কওসরের নিকট আসিয়া বলিল, “বড়। আপা! আমাকে ইন্দ্ৰধনু দিবে না?”
কও। (সুরেয়ার মুখ চুম্বন করিয়া) আমি কাল তোমায় ইন্দ্ৰধনু দিব।
বদ। সে কি! তুমি ইন্দ্ৰধনু ধরিবে কেমন করিয়া?
কও। ঝাড়ের কলমে (ক্রিকোণ কাঁচ খণ্ডে) ইন্দ্ৰধনু দেখা যায় তা জানিস না?
বদ। তবে ত ইন্দ্ৰধনু ধরিয়া দেওয়া বড় সহজ! হা হা!
আখ। বড় আপা যে “কম্পতরু”! তিনি দিতে না পারেন কি?
কও। “কল্পতরু নহে’,-“কল্পলতা” বলিতে পার!
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অপরাহ্নে নূরজাহী চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া জাফর ও গওহরের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন।
মাতার অঞ্চল ধরিয়া মুশতরী বলিল, “কেন মা, আজি এখন কেন আমরা বেড়াইতে বাহির হইব না?”
নূরজাহঁ। সকালে তোদের মাম্মা ভিকাটারীয়া স্কুল দেখিতে গিয়াছিলেন, এখন তিনি বিশ্রাম করিবেন। তাঁহাকে এক রাখিয়া আমরা কিরূপে যাইব?
জোহরা। কেন? মাম্মা একা থাকিতে ভয় করিবেন না কি? তুমি না যাও, আমরা আকরার সঙ্গে যাইব।
কৰ্ত্তা সে কক্ষে প্রবেশ করিবা মাত্র মুশতরী ও জোহরা তাহাদের দরখাস্ত পেশ করিল। গুণাবলিলেন, “বেণ চল— অধিক দূৰ যাইব না, কেবল ঈগেলস, ক্রেগে গিয়া ফিরিয়া আসি।
জোহ। না, আব্ববা। ঈগেলস, ক্রেগ না! সে দিকে বড় জোঁক।
মুশ। না, ও জোঁকের ক্ষেত্রে গিয়া কাজ নাই।
গও। ছি! তোরা জোঁক দেখিয়া ভয় করিস? (জাফরের পদ শব্দ শুনিয়া) আচ্ছা চুপ কর! তোদের মাম্মাকেও লইয়া যাইব। তাঁহাকে অগ্ৰে যাইতে বলিয়া আমরা পশ্চাতে থাকিব।
জোহ। (আনন্দে করতালি দিয়া) সে বেশ হইবে! পথে জোক থাকিলে পূৰ্ব্বে তাঁহাকে ধরিবে।
মুশ। চুপ চুপ! মাম্মা !–
ইতঃমধ্যে জাফর আসিয়া চায়ের টেবলে যোগদান করিলেন।
গও। ভাই! আজ আর একটু বেড়াইবে না?
জাফ। না, আমার পা বড় ব্যথা করিতেছে।
গও। তবু আজ একটু না হীটলে কাল তুমি একেবারে খোড়া হইয়া যাইবে। বেশী নহে— চল এই ঈগেলস, ক্ৰেগ পৰ্য্যন্ত।
জাফ। আমি যে বুট পরিতে পারিব না।
গও। বুট পরিবার দরকার কি, শ্লিপার লইয়াই চল না? সে ত প্রস্তরসঙ্কুল পথ নহে; ঘাসের উপর চলিবে।
রাবু (জনান্তিকে) শ্লিপর পরিয়া গেলে জোক ধরিবার পক্ষে সুবিধা হইবে। (বালিকাদের হাস্য)।
জাফ। (বালিকাদের প্রতি) ছি! হাসিস কেন? তোরা বড় বে-আদব। কেন নূরু, তুই কি একটা ধমক দিতেও পারিস না?
নূর। দোষ বুঝাইয়া না দিলে ওরা ধমক মানে না।
গও। বিনাদোষে বিনাকারণে ধমক মানিবেই না কেন? হাসিলে দোষ কি?
জাফ। বাস। গওহর, তুমিই মেয়েদের মাথায় তুলিয়াছ।
গও। আচ্ছা, এখন তোমার যাওয়া ঠিক হইল ত?
জাফ। না-পথ কি বড় ঢালু? উপরে উঠতে হইবে, না, নীচে যাইতে হইবে?
গও। পথত একটু ঢালু হইবেই-এখানে সমতল স্থান কোথা পাইবে?
জাফ। তবে আমি যাইব না-এ প্ৰকাণ্ড শরীর লইয়া গড়াইতে চাই না!
গও। ছি! তুমি পাথুরে পথকে ভয় কর, ঢালুপথে গড়াইতে চাও না,-ইহা তোমার womanishness (স্ত্রীভাব)।
নূর। “womanish” শব্দে আমি আপত্তি করি। “ভীরুতা’ কাপুরুষতা” বল না কেন?
জাফ। পিপীলিকার পক্ষ হইলে শূন্যে উড়ে। স্ত্রীলোকে শিক্ষা পাইলে পুরুষদের কথার প্রতিবাদ করে,-সমালোচনা করে। তুমি কি গওহরকে ভাষা শিক্ষা দিবে?
গও। স্ত্রীলোকেরা আমাদের অনুপযুক্ত কথার প্রতিবাদ করেন, আমাদের গল্পের অংশ গ্রহণ করেন, ইহা ত অতি সুখের বিষয়।
জাফ। তুমি এখন মুর্থ।–তোমারই পক্ষপাতিত্ব করিয়া নূরুকে ধমক দিলাম, আর তুমি উল্টা আমারই কথার প্রতিবাদ করা?
গও। প্রবলের পক্ষ সমর্থনের আবশ্যকতা নাই। তুমি তোমার ভগিনীর পক্ষপাতিতা করিবে, ইহাই স্বাভাবিক এবং সমুচিত। .
নূর। ভাই আমার মত বা পক্ষ সমর্থন করিবেন কেন? আমি বেচারী তাহার কি কাজে লাগি?-আমি কি তাঁহাকে মোকদ্দমায় সৎ পরামর্শ দিতে পারি? আমি কি তাঁহার জমীদারী দাঙ্গার সময় পাঁচ সাত জন লাঠিয়াল পঠাইয়া সাহায্য করিতে পারি?
গওহর হাসিলেন। জাফর অন্য কথা তুলিলেন;–
“সত্যই নূরু এবার আমার সঙ্গে যাইবে না? আমি ভাবিয়ছিলাম, আগামী বৎসর যাইতে পরিবে না, তখন কাওসরুর বিবাহের ধূমধামে ব্যস্ত থাকিবে। এবার যাইবে না কেন? তুমি গুরুজী এই শিক্ষা দিয়াছ না কি?”
আবার প্রবলবেগে হাসি পাওয়ায় বালিকাদল পলয়ান করিল।
গও। দোহাই তোমার! আমি কিছু শিক্ষা দিই নাই। উনি ত প্রতি বৎসর তীর্থদর্শনের ন্যায় তোমার সহিত পিত্ৰালয়ে যাইতেন। এবার কেন। যাইতে অনিচ্ছুক, উহাকেই জিজ্ঞাসা কর।
জাফ। বল নূরু! কোন যাইবে না?
নূর। আমি রাবুদের ডাউহিল স্কুলে ভৰ্ত্তি করিবার চেষ্টায় আছি।
স্কুল শব্দ শুনিবা মাত্র জাফর বিস্ময়ে চমকাইয়া উঠিলেন,-“কি বলিলে? স্কুলে মেয়ে ভৰ্ত্তি করিবে? এখনও ভারত হইতে মুসলমানের নাম বিলুপ্ত হয় নাই—এখনও মুসলমানসমাজ ধ্বংস হয় নাই! এখনই মেয়েরা স্কুলে পড়বে? এ প্রথম অভিশাপ আমারই ভাগিনেয়ীদের উপর? প্ৰথম অধঃপতন আমাদেরই?”
গও! তুমি ভালরূপে কথাটা না শুনিয়াই বিলাপ আরম্ভ করিলে? ডাউহিল স্কুলে কেবল বালিকারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়। সেখানে সাত আট জন শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত আছেন। তথায় পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাদৃশ বিদ্যালয়ে কন্যা পাঠাইলে দোষ কি?
নূর। সে স্কুলে পুরুষ মোটেই নাই। মেথরাণী ও আয়াই স্কুল গৃহের যাবতীয় কাৰ্য্য করে। কেবল বাবৰ্চি ও খানসাম্য পুরুষ। পাচকের সঙ্গে স্কুলগৃহের কোন সম্বন্ধ নাই। কেবল রন্ধনশালা হইতে খানা বহিয়া আনে দুই তিনজন চাকর। প্রধানা শিক্ষয়িত্রীর সহিত আমি কথা ঠিক করিয়াছি যে ঐ খাদ্যদ্রব্য বহিবার জন্য যদি আমি উপযুক্ত চাকরাণী দিতে পারি, তবে তিনি তাহাদিগকেই নিযুক্ত করিয়া পুরুষ কয়টিকে বরখাস্ত করিবেন। উক্ত শিক্ষয়িত্রীটি অতিশয় ভদ্রলোক-তিনি আমাদের পর্দার সম্মান করিয়া থাকেন। সমস্ত স্কুলটি ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিলাম,-কোথাও একটিও চাকর ছিল না।
জাফ। তোমরা বল-আমি শুনি!! আর ঐ স্কুলের পাশ্বেই যে বালকদের স্কুল। ছুঢ়ীর সময় বালক বালিকারা একত্রে খেলা করিবে
গও। বালক স্কুল হইতে বালিকা স্কুলের ব্যবধান এক মাইলেরও অধিক; এমত স্থলে তাহারা একত্ৰে খেলিবে কিরূপে?
জাফ। যদি তোমার চক্ষে কোন পীড়া না হইয়া থাকে। তবে ষ্টেশনের নিকট দাড়াইলেও দেখিবে,-উভয় স্বৰূলের চূড়া পাশাপাশি।
নূরজাহী হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। গওহর সহাস্যে বলিলেন, “তোমার অভিজ্ঞতার বলিহারি যাই! আজি তুমি ভিক্টোরিয়া স্কুল পরিদর্শন করিয়া এই অভিজ্ঞতা অৰ্জ্জন করিয়াছ?”
জাফ। আমি স্কুলের ভিতর যাই নাই।
গও। (সবিস্ময়ে) তবে সকালে তিন ঘণ্টা তমি কোথায় ছিলে?
জাফ। তৃতীয় বেঞ্চে কতকক্ষণ বসিয়াছিলাম। তারপর স্কুল সীমানায় প্রবেশ করিয়া দেখি, পথ আর ফুরায় না। একজন পথিককে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, স্কুল পৌঁছতে আরও ১৫ turn (পেচ) বাকী। (অর্থাৎ পথত সোজা নহে, আঁকাবঁকা; তাই আরও ১৫ বার মুক্সিল স্থা পুঞ্জয়া যাইবে)। তখন আমি ভাবলাম, আজি আর পথ শেষ হইবে না, তাই ফিরিয়া আসিলাম।
নূরনহাঁ আবার হাসিলেন। আর গওহর বলিলেন, “বাস! মোল্লার দৌড় মসজিদ পৰ্য্যন্ত! তুমি প্রায় স্কুলের দ্বারদেশ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছ, ভিক্টোরিয়া অথচ ডাউহিল স্কুল সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছ। তুমি কি জান ब्लिन् কোথায়? স্কুলগৃহের যে যুগল চূড়া দেখা যায়, উহা এক ভিক্টোরিয়া স্কুলেরই। স্কুলটি কি তুমি সামান্য গ্রাম্য পাঠশালা মনে করিয়াছ? উহা এক প্রকাণ্ড অট্টালিকা,–এবং উহা অনেকখানি স্থান ব্যাপিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে। বালকদের জীড়া প্রায়শই ত প্রায় পাঁচ বিঘা জমী!
নূর। এবং ডাউহিল স্কুল উহা অপেক্ষাও প্রকাণ্ড। একটি কক্ষে পঞ্চাশটি বালিকার শয্যা দেখিলাম; এবং প্রত্যেক পর্য্যঙ্ক অপর পর্য্যঙ্ক হইতে দুই হাত ব্যবধানে। এখন আন্দাজ কর ত কক্ষটা কত বড়?
জাফ। অতবড় ঘর এ প্রস্তরসঙ্কুল দেশে নির্ম্মাণ করা কি সহজ না সম্ভব?
নূর। সহজ না হউক সম্ভব তা বড় বড় অট্টালিকা নিৰ্ম্মিত হইয়াছে তা। প্রথমে একটা টেনিস কোর্ট দেখিয়া আমার চক্ষে ধাধা লাগিয়াছিল। কতগুলি কঠিন প্রস্তরের মস্তক চূর্ণ করিয়া ঐ সমতল প্রাঙ্গণখনি নিশ্চির্মত হইয়াছে, তাহা আমরা সহজে ধারণা করিতে পারি না। কেবল প্রস্তর ভাঙ্গিতে হয় নাই, স্থানবিশেষে জোড়া দিয়া ভরাটও করিতে হইয়াছে। অতখানি স্থান যে একেবারে গৰ্ত্তশূন্য ছিল, তাহা হইতে পারে না। একদিকে মহাশিল্পীর পর্বত-রচনা কৌশল, অপর দিকে তাঁহারই প্রদত্ত মানববুদ্ধির পূর্ণ বিকাশ-উভয়ের মিশামিশি বড় চমৎকার বোধ হয়।
গও। ভাই! তুমি দিনকতক এখানে থাক, তাহা হইলে তুমিও কবি হইতে পারিবে! কুবিত্ব-জ্ঞান-রহিত অবলার মরুতুল্য হৃদয়েও যখন কবিত্ব-কুসুম ফুটিয়াছে
জাফ। আমি নুরুর অপেক্ষা কম Prosaic (অকবি) নাহি!! আমরা উভয় ভ্রাতা vefisserfjq Prosaic!
গও! কিন্তু এখানকার জলবায়ুএমন যে—
“বারেক দর্শন পেলে চিরমূক কথা কয়!
… মহামুর্থ কবি হয়!”
জাফ। কিন্তু তাহাতে লাভ কি? কবিত্বটা মস্তিক্ষেকের রোগবিশেষ! আমাদের কুলকামিনীরা পাহাড়ে ময়দানে বেড়াইয়া কবি হয়, ইহা কখনই বাঞ্ছনীয় নহে!
গও। তবে কি বাঞ্ছনীয়?
জাফ। বাঞ্ছনীয় এই—তাহারা সুচারুরূপে গৃহস্থলী করে, রাধে, বাড়ে, খাওয়ায়, খায়, নিয়মিতরূপে রোজা-নমাজ প্ৰতিপালন করে।
গও। নিমজ কাহার উদ্দেশ্যে?
জাফ। (আরক্তলোচনে) কাহার উদ্দেশ্যে?–খোদাতালার উদ্দেশে!
গও। বেশ ভাই ঠিক বলিয়াছ। তুমি অবশ্যই জান, একটা পারস্য বয়েৎ আছে-“চিত্র দেখিয়া চিত্রকরকে স্মরণ কর।“ আর ইনি এখনই মহাশিলপী বলিয়া কাহার প্রশংসা করিলেন?
জাফ। মহাশিল্পী ত ঈশ্বরকে বলা হইয়াছে।
গও। তবে কবিত্ব ধর্ম্মের বিরোধী হইল কিসে? ঈশ্বরের সৃষ্টি যতই অধিক দেখা যায়, ততই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির বৃদ্ধি হয়। চক্ষু কৰ্ণ, যথাবিধি খাটাইয়া সৃষ্টি-জগতের পরিচয় না। লাইলে স্রষ্টাকে ভালমতে চিনিবে কিরূপে? পৰ্ব্বতচূড়ায় দাড়াইলে আপনা হইতেই হৃদয়ে ভক্তি-প্রস্রবণ উচ্ছসিত হয়,-তখন অজ্ঞাতে হৃদয়-তন্ত্রে বাজিয়া উঠে
“সেই অদ্বিতীয় কবি আঁকিয়া এমন ছবি
আপনি অদৃশ্য হয়ে আছেন কোথায়?”
জাফ। আমি ভালমতে বাঙ্গালা বুঝি না।
গও। তবে বল—“জর্মীচমন গুল-”(৮)
জাফ। (বাধা দিয়া) রাখ এখন তোমার কবিতা! কন্যাগুলি নিশ্চয় স্কুলে যাইবে?
গও। নিশ্চয়! কওসর, আখতার ও বন্দুর স্কুলে পড়বার সময় গত হইয়াছে, সেজন্য বড় আক্ষেপ হয়।
জাফ। তবে নূরজাহীকেও ভৰ্ত্তি কর! গও। আমার আপত্তি নাই! ইনি ত বলেন যে “শিং কটাইয়া বাছুর দলে মিশিতে ইচ্ছা হয়”।
জাফ। (সহোদরার প্রতি) মিশিলেই পার! তোমারও একান্ত ইচ্ছা নাকি শ্ৰীমতীদের খ্ৰীষ্টান করা??
নূর। মেয়েরা খ্ৰীষ্টান হইবে কেন? আমি অহঙ্কারের সহিত বলি,-আমার মেয়েরা ধৰ্ম্মভ্ৰষ্ট হইতে পারে না ইহারা খাটি সোনা-অনলে সলিলে ধ্বংস হইবে না।
গও। আমিও সাহঙ্কারে বলি, তোমার স্ত্রীর বিশ্বাস (ইমান) টলিতে পারে, কিন্তু আমার স্ত্রীর বিশ্বাস অটল!
জাফ। আমার স্ত্রীর বিশ্বাস অস্থায়ী হইল কিসে?
গও। যেহেতু তিনি আপনি ধর্ম্মের কোন তত্ত্বই অবগত নহেন। কেবল টিয়া পাখীর মত নমাজ পড়েন, কোন শব্দের অর্থ বুঝেন না। তাহাকে যদি তুমি স্বর্ণপিঞ্জরে আবদ্ধ না রাখ তবে একরার কোন মিশনারী মেমের সহিত দেখা হইলেই তিনি মনে করিবেন, “বাঃ! যিশুর কি মহিমা!” সুতরাং সাবধান! যদি পোর ত লৌহসিন্দুকে বন্ধ রাখিও।
জাফ। আর নুরু বুঝি নমাজে ব্যবহৃত শব্দসমূহের অর্থ জানে?
গও। জানেন কিনা পরীক্ষা কর! তুমি কি মনে কর এই কুড়ি বৎসরের বিবাহিত জীবনেও আমি আমার অর্দ্ধাঙ্গীকে আমার ছায়াতুল্যা সহচরী করিয়া তুলিতে পারি নাই?
জাফ। তবে দেখ নুরু যে স্কুলে পড়ে নাই সে জন্য কি আটকোহয়াছে? তবে মেয়েগুলার মাথা খাও কেন?
গও। আমাদের পূর্বপুরুষেরা রেলপথে ভ্ৰমণ করেন নাই, টেলিগ্রাফে সংবাদ পাঠান নাই, সেজন্য তাঁহাদের কিছু আটকাইয়াছিল কি? তবে আমরা টেলিগ্রাম পাঠাই কেন, রেলগাড়ীতে উঠি কেন?
জাফ। আমাদের তা ওসব আবশ্যক হয়।
গও। যাহা আমাদের জন্য আবশ্যক, তাহা আমাদের মহিলাদের জন্যও প্রয়োজন। তাহারা আমাদের আবশ্যক-অনুযায়ী বস্তুই ত যোগাইয়া থাকেন। গ্রাম্য চাষার স্ত্রীরা জরির কাজ জানে না, আচার মোরব্বা প্ৰস্তুত করিতে জানে না। কারণ চাষীদের তাহা আবশ্যক হয় না। ইউরোপীয়া কামিনীরা পান সাজিতে জানে না, কারণ ইউরোপীয় পুরুষদের তাহা আবশ্যক হয় না। আবার আমাদের কুলবালারা চাষা স্ত্রীদের মত ধান ঝাড়িতে জানেন না, যেহেতু আমাদের তা প্রয়োজন হয় না। ক্রমে আমরা কারি, কাটলেট, পুডিং খাইতে শিখিতেছি আমাদের গৃহিণীরাও তাহা রাধিতে শিখিতেছেন। আমাদের ছাড়া তাঁহাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কই? এবং তাঁহাদের ছাড়া আমাদেরও নিরপেক্ষ অস্তিত্ব কই? স্কুল কলেজের শিক্ষা যেমন আমাদের আবশ্যক, তদ্রুপ তাঁহাদেরও প্রয়োজন। তোমার পারিবারিক জীবন অপেক্ষা আমার গাৰ্হস্থ্য জীবন অধিক সুখের, ইহা তুমি অবশ্যই স্বীকার করিবে? তোমার সমস্ত সুখ দুঃখ তোমার স্ত্রী কখনই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন না।
জাফ। তাহা না পারুন; কিন্তু তিনি আমার মতের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেন না। আমি যদি দিনকে রাত্রি বলি, তিনিও বলেন,-“হা, দিব্য জ্যোৎস্না।” আবার যদি আমি অমাবস্যা রাত্রিকে দিন বলি, তিনিও বলিবেন,-“হ্যা, রৌদ্র বড় প্রখর।”
গও। সাবাস! (সকলের হাস্য)
জাফ। তা’ না ত কি! স্বামী-স্ত্রীর মত এক না হইলে দিবানিশি রুষ-জাপান যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকিতে হয়।
গও। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মত এক হইল কই? তুমি যেরূপ বলিলে তাহাতে কেবল তোমারই মত প্ৰকাশ পায়, তাঁহার ত মতামত জানাই যায় না। তিনি কদাচ নিজ মত ব্যক্তি করেন না। এবার যখন কোন পশুশালায় যাইবে অনুগ্রহ করিয়া পশুগুলির সমক্ষে কোন বিশেষ মত প্রকাশ করিও, আর পশুগুলি উত্তর না দিলে বা মাথা নাড়িলে বুঝিয়া লইও, পশুগণ তোমার সহিত একমত হইয়াছে।
জাফ। শুন, আর একটি কাজের কথা বলি; আগামী বৎসর ত কাওসরুর বিবাহ, এখন তাহাকে লইয়া তোমরা পাহাড় পৰ্ব্বতে বেড়াও, বরপক্ষীয় লোকেরা শুনিলে কি বলিবে?
নূর। বরপক্ষের ইহাতে আপত্তি নাই, জানি।
গও। বর ত শিমলাতেই কাজ করেন। আর স্বামীর সহিত স্ত্রী বেড়াইবে, পিতার সহিত কন্যা বেড়াইবে, তাহাতে অন্য লোকের আপত্তি করিবার অধিকার?
জাফ। বেশ, মঙ্গলময় তোমাদের মঙ্গল করুন। বরটিও তোমাদের মনোমত পাইয়োছ। তাহা হইলে দেখিতেছি আমার নির্বাচিত পাত্রের সহিত আখতরের বিবাহ দিবে না।
গাও। না। কওসরের ভাবী দেবরের সহিত আখতরের বিবাহ হইবে।
জাফ। তবে উভয় কন্যার বিবাহ একই সঙ্গে দাও না কেন?
গও। তাহা হইলে ভালই হইত। কিন্তু সে ছেলেটি এখন বিলাতে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
হিমালয়ের ক্রোড়স্থিত টুঙ্গ নামক স্থানে একটি ঝরণার ধারে কয়েক ব্যক্তি বসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন। তাঁহাদের মধ্যে যে সৰ্ব্বাপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠা, সে বলিল,-“মেজ আপা! দেখি ত এই ঝরণা কোথা হইতে আসিয়া ভীমবেগে আবার কোথায় চলিয়াছে! তুমি বলিতে পার শেষে কোথায় গিয়াছে?”
আখতার। না, রাবু! আমি তা জানি না শেষে কোথায় গিয়াছে। আসিয়াছে ঐ পাহাড়ের পাষাণ বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া।
রাবু। সামান্য জলধারা পাষাণ বিদীর্ণ করিল কিরূপে? তাহা কি সম্ভব?
কওসর। ঐ জলধারা কেবল পাষাণ বিদীর্ণ করিয়াছে, তাহাঁই নহে; কত প্ৰকাণ্ড প্রস্তর খণ্ড উহার চরণতলে গড়াইতে গড়াইতে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া বালুককণায় পরিণত হইয়াছে।
প্রকাণ্ড প্রস্তর বালুকায় পরিণত হওয়ার কথাটা রাবু সহজে ধারণা করিতে না পারিয়া পিতাকে জিজ্ঞসা করিল, সত্য আব্বা?
গওহর কথা কহিবার পূৰ্ব্বে জাফর বলিলেন, “হাঁ সত্য। তোরা য়েমন পিতৃক্ৰোড়ে নির্ভয়ে ক্রীড়া করিত, ঐ নির্ঝরগুলি সেইরূপ পাষাণময় পিতৃবক্ষে নৃত্য করিতেছে—পিতা তবু অটল! হিমাদ্রিও ঠিক গওহরেরই মত সহিষ্ণু! আর শোন, ষ্টিমার হইতে যে বিশালকায়া জাহ্নবী দেখিয়াছিস, এইরূপ কোন একটা শিশু নিবন্ধুরই তোহর উৎস।”
রাবু। (আনন্দ ও উৎসাহের সহিত) তবে মাম্মা! বলুন ত ইহার কোনটা গঙ্গার উৎস?
জাফ। গঙ্গার উৎস এখানে নাই।
কও। কি ভাবিতেছ আখতার?
আখ। ভাবিতেছি,-এই ক্ষীণাঙ্গী ঝরণাগুলি হিমালয়ের হৃদয়ে কেমন গভীর হইতে গভীরতম প্ৰণালী কাটিয়া কলকলস্বরে স্রষ্টার স্তবগান গাহিতে গাহিতে চলিয়াছে! বিরাম নাই-বিশ্রাম নাই-আলস্য ঔদাস্য নাই–অনন্ত অবারিত গতিতে চলিয়াছে!
রাবু। মেজ আপা! আমিও একটি নদীর উৎস আবিষ্কার করিলাম!
আখ। বটে?
কও। কি আবিষ্ককার করিয়াছিস বল ত?
রাবু। কারসিয়ঙ্গের পাগলা ঝোরাই পাগলা নদীর উৎস।
আখ। দূর পাগলি!
বদর। রাবু কিন্তু কথাটা একেবারে অসঙ্গত বলে নাই,-ক্রিস্রোতা নদী ত এই দাৰ্জিলিঙ্গের আশপাশেই–
কও। ধন্য তোমাদের গবেষণায়। বদু ত বেশ পণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছে!
বদু। যদি গবেষণায় ভুল হইয়া থাকে, তবে ওকথা থাক; আর এক মজার কথা বলি,— বেশ খেয়াল করিয়া দেখ ত, পাহাড়ের বুকের ভিতর দিয়া রেলপথ কেমন আঁকিয়াৰ্যাকিয়া গিয়াছে—একদিকে সুউচ্চ পৰ্ব্বত, অন্যদিকে নিমস্থিত অনুচ্চ পাহাড়ের স্তুপ-একটির পর অপরটি ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মত দেখায়! ইহাকে পৰ্ব্বত-তরঙ্গ বলিলে কেমন হয়?
কও। বেশ ভাল হয়। সমুদ্রের ঢেউয়ের কথা তোমার মনে আছে বোন?
বাদু। না দিদি! মনে ত পড়ে না।
রাবু। মাম্মা! আমি ঐ ঝরণার জল স্পর্শ করি গিয়া?
জাফ। যাবি কিরূপে? অবতরণের পথ যে দুৰ্গম।
রাবু। আপনি অনুমতি দিন,-আমি যেমন করিয়া পারি, যাইব। সেজ। আপা! তুমিও
বাদু। না, তুমি একাই যাও।
জাফর অনুমতি দিলেন। রাবু অতি কষ্টে অগ্রসর হইল; শেষে এক প্রকাণ্ড প্রস্তর তাহার গতিরোধ করিল। সেটি অতিক্রম না করিলে জলস্পর্শ করা হইবে না। উপর হইতে কওসর শাসাইল, “দেখিস কাপড় ভিজে না যেন।” প্রায় হামাগুড়ি দিয়া অতি সাবধানে রাবু সে প্রস্তর অতিক্রম করিল! শীতল জল অঞ্জলি ভরিয়া লইয়া খেলা করিতে লাগিল।
তদর্শনে বন্দুর একটু হিংসা হইল। সে রেলিং-এর ধারে দাড়াইয়া বলিল,-“কিলো রাবু! স্বর্গে পঁহুছিয়াছিস যে? তোর আনন্দের সীমা নাই! তুই তবে থাক ঐখানে,-আমরা bळ्ळि!”
নূরজাহীও ডাকিলেন, “আয় মা! বেলা যায়।” সকলে আরও কতকাদূর অগ্রসর হইলেন। ইহারা টুক্ত হইতে পদব্ৰজে কারসিয়ঙ্গ চলিয়াছেন।
পথে দুই তিনজন পাহাড়ী তাহাদিগকে দেখিয়া পথ ছাড়িয়া দিয়া একদিকে দাড়াইল। গওহর জাফরকে বলিলেন, “দেখিলে ভাই ইহাদের শিভালরী (অবলার প্রতি সম্মান প্রদর্শন)?”
জাফ। ইহা উহাদের অভ্যাস, অনেকে সময় স্ত্রীলোকেরাও আমাকে সুপথ ছাড়িয়া দিয়া পথিপার্শ্বে দাড়ায়।
নূর। যেহেতু তাহারা “নীচেকা আদমি”কে দুর্বল মনে করে। জাফ। আমি কিন্তু স্ত্রীলোকের নিকট দুর্বলতা স্বীকার করি না। গও। যে সবল তাহার নিকট দুর্বলতা স্বীকার করায় দোষ কি? জাফ। যাহাই হউক, স্ত্রীলোককে আমি কায়িক বলের শ্ৰেষ্ঠতা দিব না!
গও। কেন দিবে না? “Give the devil even his due” (শয়তানকেও তাহার প্রাপ্য স্বত্ব দান কর)।
জাফ। কিন্তু আমি রমণীকে তাহার প্রাপ্য স্বত্ব দিতে অক্ষম!
গও। তবে একরার শর্টকাট পথে কোন পাহাড়িনীর সহিত race (বাজী) দৌড়িতে চেষ্টা করা দেখি!
জাফ। শর্টকাটো? তাহা মানুষের অগম্য! নূর। তবে ঐ দুৰ্গম পথে যাহারা পৃষ্ঠে দুই মণ বোঝা সহ অবলীলাক্রমে আরোহণ ও অবরোহণ করে, তাহাদের নিকট দুর্বল বলিয়া পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করা কেন?
এস্থলে পাৰ্ব্বত্য শর্টকাট পথের একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। প্রস্তুর সন্ধুল গড়ানিয়া খাড়া সংক্ষিপ্ত পথকে short cut বলে। শর্টকাট পথ বড়ই দুৰ্গম; কোথাও উচ্চ প্রস্তর, কোথাও গৰ্ত্ত, কোথাও এমন ঢালু যে পা রাখা যায় না। পাথর কাটিয়া ভাঙ্গিয়া অশ্বাদি, গাড়ী ও (“নীচেকা”) মানুষের জন্য গবৰ্ণমেন্ট যে অপেক্ষাকৃত সমতল, কিন্তু ক্ৰমোচ্চ সুগম পথ নিম্পর্মাণ করিয়াছেন; তাহাকে স্থানীয় ভাষায় “সরকারী সিটক” বলে। ঐ সরকারী সর্টকগুলি অনেক দূর আঁকিয়াবাকিয়া যায়। সচরাচর গুর্থ ও ভুটিয়াগণ সরকারী ঘুরাও পথে না চলিয়া শর্টকাটে যাতায়াত করে। কারণ যেখানে শর্টকাটে পাঁচ মিনিটে যাওয়া যায়, সেইখানে সরকারী সটীক দিয়া গেলে প্রায় ২০/২৫ মিনিট লাগে এবং সাতবার ঘুরিতে হয়।
নূরজাহাঁ পুনরায় বলিলেন, “এই অশিক্ষিত পাহাড়ীদের শিভালরী। অবশ্য অবশ্য প্ৰশংসনীয়।”
গও। উহাদের নিকট আমাদের ভদ্রতা শিক্ষা করা উচিত। আমরা বৃথা ভদ্রতা ও সভ্যতার বড়াই করি।
নূর। আর একটা বিষয় লক্ষ্য করিয়াছ, ভাই? পাহাড়ী বা ভুটিয়া স্ত্রী পুরুষ-কেহই ভিক্ষা করে না।
জাফ। তাহদের ভিক্ষার প্রয়োজন হয় না বলিয়া।
গাঁও। প্রয়োজন না হওয়াও ত প্ৰশংসনীয়।
এইরূপ কথাবাৰ্ত্তায় তাহারা পথ-ক্লান্তি ভুলিতেছিলেন। কারসিয়ঙ্গ ক্টেশনের নিকটে আসিয়া কওসর বলিল,-“কি রাবু! বড় ক্লান্ত না কি?”
রাবু। না, মোটেই না।
জাফ। আরও এক মাইল যাইতে হইবে, জনিস?
ক্রমে তাহারা একটা বেঞ্চের নিকট আসিলেন। তথায় কয়েকজন গুখা বসিয়াছিল, তাহারা ইহঁদিগকে দেখিয়া সসম্প্রমে আসন ত্যাগ করিল। নূরজাহাঁ বলিলেন, “একটু বসা যাউক”।
জাফ। না, চল আর বেশী দূর নাই।
বাদু। হাঁ মাস্মা! বসুন না! ঐ দেখুন আকাশে আগুন! স্বাক্ষর পশ্চিমে চাহিয়া দেখিলন, সতাই আকাশে আগুন লাগিয়াছে। সবই যেন অগ্নিময়।
আখ। দেখ আপা! কাঞ্চনজঙ্ঘায়ও আগুন লাগিয়াছে!
জাফ। বাস্তবিক বড় চমৎকার দৃশ্য তা! এখান হইতেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দুইতিনটি শৃঙ্গ দেখা যায়! অস্তমানরবির সোণালী কিরণে সত্যই সে কাঞ্চনকান্তি লাভ করিয়াছে। বোধ হয় যেন দিনমণি পশ্চিম গগনে আত্মগোপন করিতে যাইতেছে—আর সুকুমার মেঘগুলি তাহার পশ্চাতে ছুটয়াছে। প্রদোষে এমন শোভা হয়, পূৰ্ব্বে লক্ষ্য করি নাই। ওদিকে অলকমালা রাঙ্গাকিরণে স্নান করিয়া স্বর্ণবৰ্ণ লাভ করিতেছে! মৃদুমন্দ সমীরণ যেন তাহাদের সহিত লুকাচুরি খেলিবার ছলে মেঘমালাকে ইতস্ততঃ বিক্ষপ্ত করিতেছে!
গও। সালাম ভাই! তুমিই ত বল কবিত্ব মস্তিষ্কের রোগ রোগ বিশেষ!
জাফ। যে এখানকার জলবায়ুতে ঐ রোগটা আছে। পূর্ববঙ্গের জলবায়ুতে ম্যালেরিয়া, হিমালয়ের জলবায়ুতে কবিত্ব।
গও। কেবল কবিত্ব নহে, বৈরাগ্য-যোগশিক্ষা ইত্যাদিও! এইখানে বসিয়া স্রষ্টার লীলাখেলা দেখ–তোমার সান্ধ্য-উপাসনার ফল প্রাপ্ত হইবে! এখানে নিজের ক্ষুদ্রত্ব বেশ স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করা যায়।
নূর। বলিতে কি, অভ্যাসমত উপাসনায় এমন ভাবের আবেগ, ভক্তির উচ্ছাস থাকে না। গও। আর আমরা যে সামাজিক নিয়মের বশবৰ্ত্তী হইয়া স্ত্রীলোকদের এমন উপাসনাঅর্থাৎ স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্ৰ্য দর্শন স্বইতে বঞ্চিত রাখি, ইহার জন্য ঈশ্বরের নিকট কি উত্তর দিব? যে চক্ষুর কাৰ্য্য দর্শন করা, তাহাকে চিরঅন্ধ করিয়া রাখি-ধিক আমাদের সভ্যতায়! ইনি না কি এখানে আসিবার পূৰ্ব্বে কখনও উষার প্রথম আলোক ও সূৰ্য্যোদয় দেখেন নাই।
জাফ। সম্ভবতঃ আমিও দেখি নাই-সেজন্য আমি ত একরারও বিলাপ করি না! গও। কিন্তু তুমি মাঠে বাহির হইলেই দেখিতে পাইতে; তোমার গতি ত অবারিত। আর মনে রাখিও, যথাসাধ্য জ্ঞানেন্মেষ ধর্ম্মেরই এক অঙ্গ।
জাফ। জ্ঞান বৃদ্ধি হইলে লোক নাস্তিক হয়, এইজন্য কুলললনাবৃন্দকে জ্ঞান হইতে দূরে রাখা আবশ্যক।
গও। যত অভিশাপ কুলবালার উপর! ইহা তোমার বিষম ভ্ৰম; জ্ঞানের সহিত ধৰ্ম্মের বিরোধ নাই। বরং জ্ঞান ধর্ম্মের এক প্রধান অঙ্গ।
আরও অনেক কথা হইল। এদিকে বালিকার দলও নীরব ছিল না। আখতার মৃদুস্বরে বলিল, “দেখ আপা! ওদিকে দূরে উচ্চ গিরিচূড়ে চায়ের শ্যামল ক্ষেত্রগুলি সান্ধ্য রবিকিরণের তরল স্বর্ণবর্ণে স্নান করিয়া কেমন সুন্দর দেখাইতেছে! আবার কেমন ধীরে ধীরে ঈষৎ ধূমল বর্ণের বাষ্পরূপী ওড়নায় নিজ নিজ স্বর্ণকায় আবৃত করিতেছে!”
কও। ঠিক বলিয়াছ, বোন। আমিও তাঁহাই ভাবিতেছিলাম। সৃষ্টিকৰ্ত্তার কি অপোর মহিমা! তাঁহার শিল্পনৈপুণ্যের বলিহারি যাই!
বাদু। চল এখন বাসায় যাই! আখ। যাওয়ার জন্য এত ব্যস্ততা কেন, দিদি?
বদু। আর এখানে থাকিয়া কি দেখি্বে? ঐ দেখা ক্ৰমে সন্ধ্যা সমাগমে বুঝি শীত বোধ হওয়ায় চা-বাগানগুলি অন্ধকার লেপে শরীর ঢাকিতেছে! আর ত কিছুই দেখা যায় না!
কও। চা-বাগানের শীত বোধ হউক না হউক, বন্দুর শীতবোধ হইতেছে! কারণ বদু ভ্ৰমক্রমে শাল আনে নাই।
সকলে বাসা অভিমুখে চলিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যার পর গওহর আলী দুহিতাদিগের পাঠগৃহে বসিয়া তাহাদিগকে পড়াইতেছেন। পাঠ শেষ * হইলে তিনি অৰ্দ্ধঘণ্টাকাল তাহদের সহিত গল্প করেন। গঙ্গাপচ্ছলে তিনি তাহাদিগকে কখন ঐতিহাসিক কখন ভৌগোলিক বিষয়ে শিক্ষা দিয়া থাকেন। অদ্য তাঁহাদের আলোচ্য বিষয় সৌরজগৎ।
মুশতরী। ভাল কথা, আব্বা! মাম্মা কেন আমাদিগকে সীের-চক্ৰ বলেন? আমরাও কি আকাশে ঘুরি?
গও। তিনি বিদ্রাপ করিয়া আমাদের সৌরজগৎ বলেন। কিন্তু আইস আমরা ঐ বিদ্রািপ হইতে একটা ভাল অর্থ বাহির করিয়া লই।
কও। জান না? আঁস্তাকুড়ের আবর্জনার ভিতরও অনেক সময় মূল্যবান বস্তু লুক্কায়িত, থাকে!
গও। হ্যা, অদ্য আমরা ঐ বিদ্রুপ-আবর্জনা হইতে একটা মূল্যবান জিনিষ বাহির করিতে চেষ্টা করি। কওসর! তুমি চেষ্টা করিবে, মা?
কও। আপনিই চেষ্টা করুন।
গওহর আরম্ভ করিলেন, “বলিয়াছি ত প্রত্যেক গ্রহই নিয়মমত সূৰ্য্যকে প্রদক্ষিণ করিয়া থাকে। সূৰ্য্যকে প্ৰদক্ষিণ করা যেমন গ্ৰহগণের কৰ্ত্তব্য, তদ্রুপ তাহাদিগকে আলোক প্রদান ও তাহাদের প্রত্যেকটিকে যথাবিধি আকর্ষণ করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেরুদণ্ডের উপর ঘোরা সূৰ্য্যের কৰ্ত্তব্য। এই সৃষ্টিজগতের প্রত্যেকে আপনি আপন কৰ্ত্তব্য পালন করিতেছে। কাহারও কৰ্ত্তব্য সাধনে ত্রুটি হইলে সমষ্টির বিশৃঙ্খলা ঘটে।
“মনে কর প্রত্যেক লোকের গৃহই একটি সৌরজগৎ এবং গৃহস্থের আত্মীয় স্বজনেরা ঐ সৌরপরিবারের এক একটি গ্রহ। গ্রহদের কৰ্ত্তব্য গৃহস্থের অবস্থানুসারে তাহারই মনোনীত পথে চলা। এবং গৃহস্থেরও কৰ্ত্তব্য পরিবারস্থ লোকদিগকে স্নেহরশ্মিদ্বারা আকর্ষণ করা, তাহাদের সুখস্বচ্ছন্দতার প্রতি দৃষ্টি রাখা—এমনকি (দারিদ্র্যবশতঃ) খাদ্যের অপ্রতুলতা হইলে, প্রথমে শিশুদের, অতঃপর আশ্ৰিত পোষ্যবৰ্গকে আহার করাইয়া সৰ্ব্বশেষে তাহার ভোজন করা উচিত। যদি এই পরিবারের একটি লোকও স্বীয় কৰ্ত্তব্যপালনে অবহেলা করে, তবে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়া পরিবারটি নানা প্রকার অশান্তি ভোগ করবে।
“যেমন কোন গ্রহ যদি আপন কক্ষকে অতিক্রম করিয়া দূরে যায়। তবে সূৰ্য্যের আকর্ষণ বিমুক্ত হইলে, সে অন্য কোন গ্রহের সহিত টক্কর খাইয়া নিজে চূর্ণ হইবে এবং অপর গ্রহকেও বিদপগ্ৰস্ত করিবে। সুতরাং যাহার যে কক্ষ, তাহাকে সেই কক্ষে থাকিয়া স্বীয় কৰ্ত্তব্যবৰ্ত্তে চলিতে হইবে।”
ঠিক এই সময় জাফর আসিয়া বলিলেন, “সালাম ভাই! পথে আসিয়াছ। আমিও ত তাহাই বলি, যাহার জন্য যে সীমা নির্দিষ্ট আছে, সে তাহা অতিক্রম করিলে বিশজখলা ঘটিবে। সমাজরূপ সৌরজগৎ স্ত্রীরূপ গ্রহদের জন্য যে সীমা নির্দিষ্ট করিয়াছে সে সীমা উল্লঙ্ঘন করা স্ত্রীলোকদের উচিত নহে।”
গও। মাফ কর ভাই! আমাকে আগে আমার বক্তব্য বলিতে দাও! তুমি আসন গ্ৰহণ কর।
আখতার। (জনাস্তিকে কওসরকে) মাম্ম কথা বলিবার ভঙ্গীও জানেন না! “সমাজরূপ সৌরজগৎ” আর “স্ত্রীরূপ গ্ৰহ” বলা হইল!
কও। তাই ত! সমাজটু নিজে সৌরজগৎ হইলে গ্রহদের সীমা নির্দিষ্ট করিবার অধিকার কি? ঈশ্বর স্বয়ং সকলের সীমা নির্দেশ করিয়াছেন। আচ্ছা এখন উহাদের কথা শুনি।
জাফর আসন গ্রহণ করিলে পর বালিকারাও আসন গ্ৰহণ করিল। জাফরকে দেখিয়া ইহারা সসম্প্রমে আসন ত্যাগ করিয়াছিল।
গওহর বলিয়া যাইতে লাগিলেন, “কেবল অবলারা সীমা অতিক্ৰম করিলে বিশৃঙ্খলা ঘটে। ইহাই নহে, পুরুষেরাও স্বীয় কক্ষ লঙ্ঘন করিলে বিশৃঙ্খলা ঘটে।”
জাফ। পুরুষদের গন্তব্যপথ ত সীমাবদ্ধ নহে-তাহাদের আর কক্ষচ্যুত হওয়া কি?
গও। পুরুষেরাও স্বেচ্ছাচারী হইতে পারে না। তাহাদেরও কৰ্ত্তব্য আছে। তুমি কি স্ত্রীপুত্রকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলিয়া কোথাও যাইতে পার?
জাফ। না।
গও। তবে কিরূপে বল, তোমার পথ সীমাবদ্ধ নহে?
জাফ। তবু আমার যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে।
গও। কৰ্ত্তব্যে অবহেলা করিবার ক্ষমতা নাই।
মুশ। আব্বা! আমরা ত সকলেই নিজ নিজ কৰ্ত্তব্য কাৰ্য্য করি, কিন্তু নয়ীমু ও মাসুমা ত কিছু করে না?
রাবু। তাহারা এত ছোট যে তাহাদের কৰ্ত্তব্য কিছুই নাই।
গও। তাহাদেরও কৰ্ত্তব্য আছে বই কি? নয়ীমুর কৰ্ত্তব্য যথানিয়মে আহার নিদ্রা পালন করা ও খেলা করা। মাসুমার কৰ্ত্তব্য খাওয়া, নিদ্রা যাওয়া, হাসা এবং দৌড়াইতে শিখা।
রাবু। ঈশ! ভারী ত কৰ্ত্তব্য! উহারা ও কাজ না করিলে আমাদের এখানে এমন কি বিশৃঙ্খলা ঘটিবে?
কও। উহারা এখনও তোমাদের মত দুষ্টমী শিখে নাই; তাই উহারা যথানিয়মে স্ব স্ব কৰ্ত্তব্যপালন করে। যদি মাসুমা না হাসে বা নয়ীমা না খায়। তবে বুঝিতে হইবে তাহাদের অসুখ হইয়াছে। তখন তাহাদের শুশ্রুষার জন্য আমাদিগকে ব্যস্ত থাকিতে হইবে।
গও। তাহাদের চিকিৎসার জন্য ব্যস্ত থাকিলে আমাদের দৈনিক কাৰ্য্যে বিশৃঙ্খলা ঘটিবে কি না?
রাবু। ই-বুঝিলাম!
গও। আর এক কথা মনোযোগের সহিত শুন। আমি বলিয়াছি, গ্ৰহমোলা স্ব স্ব কক্ষে থাকিয়া সূৰ্য্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই প্ৰদক্ষিণ কাৰ্য্যে গ্রহদের সাদৃশ্য ও একতা আছে—অর্থাৎ সকলেই ঘুরে, এই হইল সাদৃশ্য। কিন্তু তাই বলিয়া যে সকল গ্রহই একই সঙ্গে উঠে, একই সঙ্গে বসে তাহা নহে! (জাফরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া) তাহাদের আবার ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে। জাফর ভাই যে বলেন, সৌরপরিবারের অবলারােপ গ্ৰহদের ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নাই, ইহা তাঁহার ভ্রম।
জাফ। ভ্ৰম নহে-ঠিক কথা। অবলাকে কোন প্রকার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নহে। তুমি হয়ত মাদ্রাজের Christian Tract Societyর প্রকাশিত Indian Reform সম্বন্ধীয় পুস্তিকাসমূহ হইতে এ স্বাধীনতার ভাব গ্রহণ করিয়াছ! খৃষ্টধৰ্ম্ম প্রচারকগণ যাহা বলেন, তোমার নিকট তাহা অভ্রান্ত সত্যরূপেই পরিগণিত হইয়াছে।
গও। আমি আজি পৰ্য্যন্ত উক্ত পুস্তিকার একখানিও পাঠ করি নাই। খৃষ্টানদের নিকট কিছু শিখিতে যাইব কেন? ঈশ্বর কি আমাকে বুদ্ধি দেন নাই? আর আমি ত এই কারসিয়ঙ্গ, শৈলে আছি, এই সময় তুমি আমার বাড়ী অনুসন্ধান কর গিয়া, যদি আমার বাড়ীতে “Christian Tract Societyর প্রকাশিত পুস্তিকা” একখানিও দেখিতে পাও, তবে আমি তোমাকে হাজার (১০০০) টাকা দিব!
জাফ। হাজার টাকার বাজী?
গও! হাঁ-লাগাও বাজী-এক হাজার নূতন টাকা! আর যদি পুস্তিকা না পাও তবে তুমি দিবে ১০০০ টাকা!
জাফ। না, বাজী এইরূপ হউক যে হারজিত-উভয় অবস্থাতেই তুমি টাকা দিবে! হা! হা-হা!
গও। বাস! ঐ খানেই বীরত্বের অবসান!
এই সময় নূরজাহাঁ আসিয়া কওসরের পার্শ্বে উপবেশন করিলেন।
বদর। আকরা, গ্রহদের “ব্যক্তিগত” স্বাধীনতা কেমন? গও। যেমন সূৰ্য্যের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করিতে বুধের প্রায় তিন মাস, শুক্রের আট মাস, বৃহস্পতির ১২ বৎসর এবং শনির ৩০ বৎসর লাগে। ইহাই তাঁহাদের ব্যক্তিগত পার্থক্য বা স্বাধীনতা। শনিগ্রহকে কেহ আরক্তনেত্ৰে আদেশ করিতে পারে না যে “তোমাকেও বুধের মত ৩ মাসেই সূৰ্য্যের চতুর্দিকে ঘুরিতে হইবে।”! এবং এতদ্ব্যতীত আরও অনেক বৈষম্য আছে; তাহা তোমরা এখন বুঝিতে পরিবে না।
কও। আর অতি কথা এককালে বলাও ত সম্ভব নহে।
গও। হঁয়, সম্ভবও নহে। এইরূপ মানবের সৌরপরিবারেরও পরস্পরের মধ্যে কতকগুলি সাদৃশ্য আছে এবং কতকগুলি বৈসাদৃশ্যও আছে।
জাফ। যথা গওহর আলীর সহিত আমার চক্ষুকর্ণের similarity (সাদৃশ্য) আছে এবং মতামতের dissimilarity (বৈসাদৃশ্য) আছে! (সকলের হাস্য।)
কও। তরুলতার গঠন প্ৰণালীর প্রতি দৃষ্টি করিলেও আমরা বৈষম্য ও সাদৃশ্য পাশাপাশি বিদ্যমান দেখিতে পাই। বন্দু! সেদিন তোমাকে নানাজাতীয় fernএর (ঢেকি গুলোর) সাধারণ আকৃতিগত সাদৃশ্য এবং পত্রগত সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখাইয়াছিলাম মনে আছে ত?
বদু। হাঁ। ঠিক এক রকমের দুইটি পাতা বাহির করিতে পারি নাই।
গও। তাই তা। জাফর ভাই যেমন মনে করেন সংসারে তিনি ছাড়া আর কেহবিশেষতঃ স্ত্রীলোক কথা কহিবে না! তিনি ব্যতীত আর কেহ স্কুলে পড়িবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, ইহা প্রকৃতির নিয়ম নহে।
জাফ। আমি কি লোককে কথা বলিতেও নিষেধ করি?
গও। নিষেধ করা না বটে, কিন্তু তুমি এমন ভাবে বলা আরম্ভ কর যে আর কাহারও কথা কহিবার সুবিধা হয় না। ইনি তোমাকে তিন দিন কন্যাদের বালিকা স্কুলে পড়বার কথা বলিতে চেষ্টা করিয়াছেন—তুমি একদিনও ধৈৰ্য্যের সহিত শুন নাই। তুমি যে ভাবে মহিলাদের কথায় বাধা দিয়া নিজের বাগিতা প্রকাশ কর, তাহা তোমার ন্যায় বিলাত ফেরতার পক্ষে কদাচি শোভনীয় নহে।
জাফ। আমি অধিক কথা বলি, তোমরাও বল না কেন?
গও। আমরা অত বকিতে পারি কই? আমি দুইশত টাকা পুরস্কার দিব, যদি কেহ তোমাকে বাগযুদ্ধে পরাস্ত করিতে পারে!
নূর। কেবল বাগযুদ্ধ নহে-বাগাডাকাতিও বটে।
জাফ। নূরু! তুইও বিপক্ষে গেলি? নূর। না, ভাই! ক্ষমা করা,-আমি ত এখন কিছু বলি নাই! গও। টিক,-বাগিতা, বাকচাতুৰ্য্য, বাকচৌৰ্য্য, বাগড়াকাতি এবং বাগযুদ্ধে যে ব্যক্তি আমার জাফর দাদাকে পরাস্ত করিবে, সে ২০০ টাকা পুরস্কার পাইবে!
নূর। সভয়ে আর একটি কথা বলি,—ভাই দুই ঘণ্টা ধরিয়া কথা বলেন, কিন্তু কি যে বলেন, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য!
গও। কেবল বকেন—লক্ষ্য ছাড়িয়া দিয়া কখন দক্ষিণে, কখন বামে, কখন সম্মুখে, কখন পশ্চাতে-ন্যানাস্থানে ঘুরেন! কিন্তু বকেন! অপরের বক্তব্য শুনেন না, কেবল নিজে বকেন! যাহা হউক, ইহা স্বভাবের নিয়ম নহে। জাফর দিনকে রাত্রি বলিলে যে তাঁহার বাড়ীর সকলকেই “দিব্য জ্যোৎস্না” বলিতে হইবে, ইহা ঈশ্বরের অভিপ্রেত নহে। অবলাদেরও চক্ষুকৰ্ণ আছে, চিন্তাশক্তি আছে, উক্ত শক্তিগুলির অনুশীলন যথানিয়মে হওয়া উচিত। তাহাদের বাকশক্তি কেবল আমাদের শিখান বুলি উচ্চারণ করিবার জন্য নহে।
জাফ। উঠ এখন; আজি যথেষ্ট বকিলে।
গও। আর দুই এক কথা বলিতে দাও-তোমার কথা নহে। সৌরচক্রের গ্রহমালা যেমন সূৰ্য্যকে লক্ষ্য করিয়া আপন কক্ষে ভ্ৰমণ করিতেছে, তদ্রুপ আমাদেরও উচিত যে সত্যঅর্থাৎ ঈশ্বরে লক্ষ্য রাখিয়া, তাহার উপর অটল বিশ্বাস সহকারে নির্ভর করিয়া স্ব স্ব কৰ্ত্তব্য পথে চলি। যে কোন অবস্থায় সত্য ত্যাগ করা উচিত নহে-সত্যভ্ৰষ্ট হইলেই অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী। সত্যরূপ কেন্দ্রে ধ্রুব লক্ষ্য রাখিতে হইবে।
কও। আমরা সকলেই সৌরপরিবারের এক একটি ক্ষুদ্র তারা, পরমেশ্বর আমাদের সূৰ্য্য।
গও। ঠিক। এবং যাহারা উক্ত সৌরপরিবারের ন্যায় সুখে জীবন অতিবাহিত করে, তাহারা ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র।
কও। পরস্পরে একতা থাকাও একান্ত আবশ্যক।
গও। হাঁ, -কিন্তু এই ঐক্য যেন সত্যের উপর স্থাপিত হয়। একতার মূলে একটা মহৎ গুণ থাকা আবশ্যক।
জাফ। আমি বলি, একতার ভিত্তি ন্যায় বা প্ৰেম হইলে আরও ভাল হয়।
গও। ন্যায়পরায়ণতা এবং প্রেমও সদগুণ বটে, কিন্তু উহাদের মাত্ৰাধিক্যে আবার অনিষ্টের সম্ভাবনা। যেমন সময় সময় কঠোর ন্যায় কোমল প্রেমের বিরোধী হয়; আবার প্রেমের আধিক্য ন্যায়কে দলিত করে। বিচারক অত্যন্ত দয়ালু হইলে চলে না, আবার ন্যায়বিচারে প্রকৃত প্রমাণ অভাবে অনেক সময় নিৰ্দোষীর দণ্ড হয়। সত্যের কিন্তু অপর পৃষ্ঠা নাই-উহা স্বচ্ছ সুনিৰ্ম্মল। এই জন্য বলি,—একতার ভিত্তি সত্য হউক। জাফ। বেশ! নমাজের সময় হইল,-চল এখন তোমার কক্ষে!
গও। চল! নমাজে কিন্তু তুমি ইমাম হইবে।
জাফ। না, তুমি ত আমার শ্রেষ্ঠতা স্বীকার কর না,-সুতরাং তুমি ইমাম হইবে।
গও। তবে মনে রাখিও,—সকল বিষয়ে আমি নেতা, তুমি অনুবর্ত্তী।
জাফ। না, তাহা হইবে না!
গও। তবে “ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অবলম্ববন কর।
জাফ। তথাস্তু! তুমি তোমার কক্ষে উপাসনা কর,—আমি আমার কক্ষে।
জাফর ও গওহর চলিয়া গেলে পর বদর বলিল, “মাম্মা আমাদিগকে সৌরজগৎ বলিয়া বিদ্রুপ না করিলে এত কথা জানিতে পারিতাম না।”
আখ। ঠিক! অদ্য আব্বা আমাদের জন্য কয়লা হইতে কোহেনুর বাহির করিয়াছেন।
কও। মনে রাখিও—আমরা সকলে সৌরপরিবারের তারা!
————–
১. বালিকাদের নাম ও বয়স জানিয়া বাখিলে পাঠিকার বেশ সুবিধা হইবে। কওসবের ১৮, আখতাবের ১৬, বদরের ১৪, রাবেয়ার ১২. মুশতবীর ১০, জোহরার ৮, সুরেয়ার ৬, নয়িমার ৪, এবং মাসুমার বয়স ২ বৎসর।
২. পুরুষদের কথোপকথনে দুই একটি ইংরাজী শব্দের ব্যবহার পাঠিকারা ক্ষমা করিবেন। ব্রাকেটের ভিতর শব্দগুলির অনুবাদ দেওয়া গেল।
চিমনী সাইড, স্থান বিশেষ; তথায় চায়ের কারখানায় এক প্ৰকাণ্ড চিমনী নির্মিত হইয়াছিল। সাধারণের বিশ্বাস সেই চিমনীর নিকটবৰ্ত্তী স্থানই কারসিয়ঙ্গেব সৰ্ব্বোচ্চ স্থান।
৪. অর্থাৎ বৃহস্পতি, শুক্র ও কৃত্তিকা নক্ষত্র।
৫. তিন চারি বৎসরের শিশুরা প্রায় কবর্গ স্থলে তবর্গ উচ্চারণ করে। গল্পের স্বাভাবিক ভাব রক্ষার্থে আমরাও নয়িমার ভাষায়। তবর্গ ব্যবহার করিলাম।
৬. পাগলা ঝোরা কারসিয়ঙ্গের বৃহত্তম ঝরণা।
৭. ডাণ্ডি, বাহন বিশেষ; ইহা শিবিকাব ন্যায় মানুষের স্কন্ধে বাহিত হয়।
৮. অর্থাৎ “ধারণী কানন ফুল-বাকী অংশত উচ্চারিতই হয় নাই।