সদানন্দ বললে–কেন, এখন নয় কেন? এখন ঘুম ভাঙেনি বুঝি তাঁর?
হরি মুহুরি বললে–ঘুম? ঘুম কর্তামশাই-এর ভোর চারটেয় ভেঙেছে, তারপর ছটার সময় গঙ্গাস্নান করেছেন, তারপর আহ্নিক সেরে আটটায় গদিবাড়িতে এসে বসেছেন–
সদানন্দ বললে–তা এখন তো সাড়ে আটটা, এখন যাই–
না, এখন না। ন’টা বাজুক, নটার সময় কর্তামশাই হাঁচবেন—
–হাঁচবেন?
–হ্যাঁ।
–হাঁচবেন মানে?
হরি মুহুরি এই বেকুফকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়লো। বললে–আরে আপনি কি বাংলা কথাও বোঝেন না? হাঁচি মশাই হাঁচি। সর্দি হলে যে-হাঁচি মানুষ হাঁচে সেই হাঁচি। আপনি কখনও হাঁচেন না?
সদানন্দ বললে–হাঁচবো না কেন?
–সেই রকম কর্তামশাইও হাঁচেন। ঠিক ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ন’টার সময় ঘড়ি মিলিয়ে হাঁচেন।
সদানন্দ তখন চৌবেড়িয়াতে নতুন। তাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল–একেবারে ঘড়ি ধরে ন’টার সময়?
হরি মুহুরির তখন হাতে অনেক কাজ। সে কথার উত্তর দেবার সময় ছিল না তার। সে নিজের কাজে চলে গিয়েছিল আড়তঘর ছেড়ে। তারপর আড়তঘরের ঘড়িতে যখন ন’টা বাজলো ঢং ঢং করে তখন সদানন্দ সবে উঠতে যাচ্ছে এমন সময় পাশের গদিবাড়ি থেকে একটা বিকট হাঁচির শব্দ এলো। একেবারে ঘর-কাঁপানো কান-ফাটানো হাঁচি। ঘড়ির সঙ্গে সদানন্দ আর একবার মিলিয়ে দেখে নিলে হাঁচির টাইমটা। তারপর গদিবাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
পাল মশাই-এর ডান হাত তখন কুঁড়োজালির ভেতরে মালা জপতে ব্যস্ত আর বাঁ হাত দিয়ে কাগজপত্র দেখছেন আর সামনে বসা লোকদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমন সময় সদানন্দকে দেখেই বাঁ হাতের খাতাটা সরিয়ে পাশে রাখলেন।
বললেন–এই যে, এসো এসো, বোস
সদানন্দ তক্তপোশের ওপর পাতা মাদুরের ওপর পা গুটিয়ে বসলো। যারা এতক্ষণ সামনে ছিল তার একটু নড়ে-চড়ে সরে বসলো।
বলি, তুমি যে সঙ্গীত-সাধনা করো তা তো আমাকে আগে বলোনি, তোমার দেশ কোথায়, দেশে কে কোথায় আছেন, কে নেই সব বলেছ আর আসল কথাটাই বলো নি তো। তুমি গানের চর্চাও করো নাকি আবার?
গান! সদানন্দ কথা বলতে গিয়ে একটু থমকে গেল। বললে–গান?
–হ্যাঁ হ্যাঁ গান। হরি মুহুরি সব বলেছে আমাকে। আড়তঘরে ঘুমোতে ঘুমোতে তুমি গান গেয়েছ, নয়নতারার সঙ্গে কথা বলেছ, আরো কী কী সব করেছ, ও সব বলেছে আমাকে। তুমি কি কবির দলে ছিলে নাকি?
সদানন্দ লজ্জায় পড়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারলে না।
পাল মশাই আবার বললেন–তোমার চেহারা দেখে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি তুমি গান গাইতে পারো। আমি ভেবেঝিলুম অভাবে পড়ে এখানে এসেছ, আমার কাছে আশ্রয় চাও, তাই তোমাকে ইস্কুলের কথা বলেছিলুম। গাঁয়ের ছেলেরা লেখা-পড়া করতে পারে না…তা নয়নতারা তোমার কে?
সদানন্দ বললে–নয়নতারা? আমি বলেছি?
–হ্যাঁ, গান গেয়েছ, নয়নতারার নাম ধরে কথা বলেছ। ঘুমোতে ঘুমোতে তোমার গান গাওয়ার অভ্যেস আছে বুঝি?
সদানন্দ কোনও উত্তর দিলে না। আর উত্তর দেবেই বা কী? উত্তর দেবার কিছু থাকলে তবে তো উত্তর দেবে?
–কী গানটা যেন বললে–হরি মুহুরি। দাঁড়াও মনে করি। ছোটবেলায় আমিও গানটা—শুনেছি–
আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
কারো মুখে যদি শুনিতাম ॥
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম ॥
লজ্জায় মাথা কাটা গেল সদানন্দর। পাল মশাই গানের কলিগুলো বলছেন আর আশেপাশের সবাই শুনছে।
রসিক পাল মশাই আবার বলতে লাগলেন–কিন্তু বাপু, তোমায় বলে রাখছি গান-টান করলে তো আমার চলবে না। গান গাইতে ইচ্ছে করে অন্য জায়গায় চেষ্টা দেখ। আমি গান-টান বিশেষ পছন্দ করি নে। আর গান যদি ভক্তিমূলক গান হয় তাও বুঝি। এসব গান তো চাপল্যের গান হে কী বলল, তোমরা কী বলে?
রসিক পাল সকলের দিকে চেয়ে তাদের মতামত চাইতে তারাও সবাই একবাক্যে বললে–হ্যাঁ কর্তামশাই, আপনি তো হক কথাই বলেছেন–
–ওই দেখ, সবাই আমার কথায় সায় দিলে। আমি অন্যায্য কথা কখনও বলিনে, তা জানো?
তারপর বাঁ হাত দিয়ে আবার হিসেবের খাতাটা কাছে টেনে নিলেন। খাতকরা যে প্রাণের দায়ে তাঁর অন্যায্য কথাতেও সায় দিতে বাধ্য এ-কথা সদানন্দর পক্ষে মুখ ফুটে বলা অন্যায়। তাই আর সে কোনও কথা বললে না। চুপ করে রইল।
রসিক পাল মশাই খাতার হিসেবে মনোযোগ দিতে দিতে এতবার বললেন–যাও, তুমি এবার যাও–
সদানন্দ আর সেখানে বসলো না। তক্তপোশ থেকে উঠে সোজা গদিবাড়ির বাহিরে চলে গেল। রসিক পালের তখন আর ও-সব কথা ভাববার সময় ছিল না। মুহূর্তে হিসেবের গোলকধাঁধার মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন। রসিক পাল আর নরনারায়ণ চৌধুরীদের কাছে হিসেবটাই ছিল সব। হিসেবই ধর্ম, হিসেবই অর্থ, হিসেবই ছিল মোক্ষ কাম এবং সব কিছু হিসেব করতে করতেই নরনারায়ণ চৌধুরী একদিন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়লেন। তখন আর উঠতে পারেন না তিনি।
মনে আছে তখনও পাল্কী করে কালীগঞ্জের বৌ আসতো দাদুর কাছে। সদানন্দ দেখতে পেলেই পাল্কীর কাছে দৌড়ে আসতো। বেশ ফরসা মোটাসোটা মানুষ, সাদা থান পরা। অমন ফরসা মেয়েমানুষ সদানন্দ আর জীবনে দেখেনি। নয়নতারাও ফরসা। সদানন্দর মা, হরনারায়ণ চৌধুরীর স্ত্রী, তিনিও ফরসা। কিন্তু কালীগঞ্জের বৌ শুধু ফরসা নয়, দুধে-আলতায় মেশানো ফরসা। গায়ের রং-এর দিকে একবার চাইলে কেবল চেয়েই দেখতে ইচ্ছে করে। পাল্কীটা উঠোনে থামতেই কালীগঞ্জের বৌ নামতো। মুখের ওপর একগলা ঘোমটা দিয়ে বাড়ির ভেতরে বারান্দায় ঢুকতো। সঙ্গে থাকতো একজন ঝি। ঝি আগে আগে চলতো আর পেছনে কালীগঞ্জের বৌ। চলতে চলতে একেবারে সিঁড়ি দিয়ে সোজা দোতলায় দাদুর ঘরে চলে যেত।