–গান তো হলো, কিন্তু কথা? কথা কিসের আবার?
হরি মুহুরি বললে–সে সব অনেক কথা, সব কথার মানে বুঝতে পারিনি। কখনও আবার একজন মেয়েমানুষের নাম ধরে ডাকে, আবার কখনও…
–মেয়েমানুষ? মেয়েমানুষ মানে? চরিত্র খারাপ নাকি লোকটার?
হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে তা বলতে পারবো না, তবে যে-মেয়েটার নাম ধরে ডাকছিলেন তার নামটা ভারি নতুন–
–কী রকম?
হরি মুহুরি বললে–নয়ন। কখনও নয়ন বলছিলেন, কখনও আবার নয়নতারা–মনে হলো নিশ্চয়ই কোনও মেয়েমানুষের নাম হবে। রাত্তির বেলা ঘুমোতে ঘুমোতে মেয়েমানুষের নাম ধরে কথা বলে, পীরিতের গান গায়, এ তো ভালো লক্ষণ নয় কর্তামশাই, আপনি কেন অমন লোককে আড়তে ঠাঁই দিলেন বুঝতে পারছি নে, কাজটা কি ভালো হলো?
রসিক পাল তখন আর কিছু বললেন না। মনে মনে ভাবতে লাগলেন। এতদিন সংসারে বাস করে এসে এত লোক চরিয়ে তিনি কি শেষকালে ভুল করলেন নাকি! হরি মুহরির কথার কোনও সোজা উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন–ঠিক আছে, তুমি একবার ওঁকে আমার গদিতে পাঠিয়ে দিও তো–
গদিবাড়িতে রসিক পাল রোজ সকালে এসে কয়েক ঘণ্টা বসেন। সেই সময়ে খাতক পাওনাদার পাড়া-প্রতিবেশী নানা রকম লোক নানা আর্জি নিয়ে তাঁর কাছে আসে। কেউ টাকা খয়রাতি চায়, কেউ শুধু মুখটা দেখাতে আসে। তারপর আসে ব্যাপারীরা। কারবারের লেনদেন নিয়ে কথাবার্তা হয় সেই সময়। রসিক পাল মশাই তখন কুঁড়োজালির মধ্যে হাত পুরে মালা জপ্ করেন আর মুখে কথা চলে। রসিক পালের সব কাজই ঘড়ি ধরা। সকাল বেলা উঠেই গঙ্গাস্নান। তখন ঘড়িতে ভোর ছ’টা! পাল মশাইকে দেখেই সবাই বুঝতো তখন ঘড়িতে ছটা বেজেছে। কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা তার কোনও ব্যতিক্রম হতো না। তারপর গদিবাড়িতে এসে যখন বসতেন তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় আটটা। তারপর যখন ঘড়িতে সকাল নটা তখন একবার হাঁচবেন।
এরকম ঘড়ি মিলিয়ে কাজ বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু সেই লোকেরই একদিন সকাল ন’টার সময় হাঁচি পড়লো না।
সে এক বিস্ময়কর কাণ্ড! ঘটনাটা দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। এ কী হলো! এমন তো হয় না! সকলেই বুঝলো এবার একটা কিছু সর্বনাশ ঘটবে।
রসিক পাল হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন–হরি–
এক ডাকেই আড়ত থেকে হরি মুহুরি এসে হাজির। হরি মুহুরি আসতে পাল মশাই বললেন–হরি, একবার বলাই ডাক্তারকে ডাকো দিকিনি। বলবে আমার শরীর খারাপ, আমি এখুনি বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি–
তারপর ডাক্তার এলো। পাল মশাইকে পরীক্ষা করলো। হয়ত ওষুধ-বিষুধও দিলে। কী ওষুধ দিলে ডাক্তার তা কারো জানবার কথা নয়। কেন ঘড়িতে ঠিক ন’টা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাঁচি সেদিন পড়লো না, ডাক্তারি-শাস্ত্রে তার নিদান আছে কিনা তাও কেউ জিজ্ঞেস করলে না। কিন্তু দু’দিন পরে আবার সবাই দেখলে ঠিক ঘড়িতে যখন কাঁটায়-কাঁটায় ছ’টা তখন তিনি গঙ্গাস্নানে চলেছেন। তারপর ঠিক আটটার সময় গদিবাড়িতে এসে বসলেন। আর ঠিক তারপর যখন ন’টার ঘরে ঘড়ির বড় কাঁটাটা ছুঁয়েছে তখন ‘হ্যাচ-চো’ শব্দে তাঁর হাঁচি পড়লো। তখন সবাই নিশ্চিন্ত।
সদানন্দর ঠাকুরদাদা নরনারায়ণ চৌধুরীরও ঠিক এমনি ঘড়ির কাঁটা ধরা কাজ ছিল। নদীতে স্নান করে এসে বসতেন কাছারি-ঘরে। তখন কৃষাণ, খাতক, পাওনাদার, গ্রামের আরো পাঁচ-দশজন গণ্যমান্য লোক এসে বসতো। বিরাট কাছারি-ঘর। কাছারি-ঘরের পেছনে ঢাকা বারান্দা। সেই বারান্দার লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে নরনারায়ণ চৌধুরী দোতলায় উঠতেন। দোতলায় ছিল তাঁর শোবার ঘর। সেই শোবার ঘরের মধ্যেই ছিল তাঁর লোহার সিন্দুক।
সদানন্দ একদিন বলেছিল–দাদু, তোমার কত টাকা!
টাকা! শুধু টাকা নয়, থাক্ থাক্ নোট। তার পাশে হীরে পান্না চুনি মুক্তো! আরো কত দামী-দামী জিনিস।
নরনারায়ণ যখন সিন্দুক খুলেছিলেন তখন দেখতে পাননি যে তাঁর নাতি কখন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন সদানন্দর বয়েস পাঁচ কি ছয়। পাঁচ ছ’ বছর বয়েস থেকেই নাতি যেন কেমন সব লক্ষ্য করতো। সব জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, সব জিনিস সম্বন্ধে কৌতূহল দেখাবে। বলবে–তোমার দাড়ি সাদা কেন দাদু?।
কর্তাবাবু বলতেন–একে নিয়ে তো মহা মুশকিল হলো দেখছি–ওরে কে আছিস, কোথায় গেলি সব–
দীনু চৌধুরী বাড়ীর পুরনো ভৃত্য দীননাথ। দীননাথ এসে তখন নাতিকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেত।
কর্তাবাবু বলতেন–যা দীনু, ওকে নিয়ে পুকুরের হাঁস দেখা গে যা–
সত্যিই তখন অনেক কাজ নরনারায়ণ চৌধুরীর। একগাদা লোক কাছারি বাড়িতে। টাকাকড়ির কথা হচ্ছে তখন খাতকদের সঙ্গে। সুদের কড়াক্রান্তির চুলচেরা হিসেব। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেই লোকসান হয়ে যাবে দাদুর। টাকার ব্যাপারে নরনারায়ণ চৌধুরীর কাছে সব কিছু তুচ্ছ। অন্য সময়ে দাদুর খুব ভালোবাসা। অন্য সময়ে নাতি না হলে দাদুর চলে না। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেন–সদা কোথায় গেল, সদাকে দেখছি নে যে–
রসিক পাল মশাইকে দেখে সদানন্দর সেই কর্তাবাবুকেই মনে পড়তো কেবল। ঠিক তেমনি কারবার, ঠিক তেমনি ব্যবহার।
.
পরের দিন হরি মুহুরি এল।
বললে–কেমন আছেন বাবু, ঘুম হয়েছিল তো?
সদানন্দ বললে—হ্যাঁ–
–আপনাকে কর্তামশাই একবার ডেকেছেন গদিবাড়িতে—
কথাটা শুনেই সদানন্দ সোজা গদি বাড়িতে যাচ্ছিল। হরি মুহুরি বললে–না না, এখন যাবেন না। এখন নয়–