ঘরের মধ্যে একটা ছোট তক্তপোষ। তের টাকায় কিনে এনেছিলেন চৌবেড়িয়ার বাজার থেকে। তার ওপর একটা মাদুর। যখন এখানে এসেছিলেন তখন কিছুই সঙ্গে আনেন নি। তাঁর কিছু থাকলে তবে তো সঙ্গে আনবেন। নবাবগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠে একবার শুধু তিনি সুলতানপুরে গিয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে কেষ্টনগর। কেষ্টনগর থেকে নৈহাটি। আর তারপর ভাসতে ভাসতে কলকাতা হয়ে একেবারে এই এখানে। এখানে তখন কে-ই বা ছিল! একেবারে যেন পৃথিবীর ওপিঠ। না আছে একটা হাট, আর না আছে একটা স্কুল।
প্রথম আশ্রয় পেলেন পালেদের আড়তে। রসিক পাল ধার্মিক মানুষ। তিনি আপাদমস্তক ভালো করে নজর দিয়ে দেখলেন। বললেন–আপনার নাম?
সদানন্দ চৌধুরী!
ব্রাহ্মণ না কায়স্থ?
ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণ শুনে খুব খাতির করে বসতে বললেন। তারপর নানা খবরাখবর নিলেন। কোথায় বাড়ি, পিতার নাম কী, কী উদ্দেশ্যে চৌবেড়িয়ায় আগমন, বিদ্যা কতদূর। সব শুনে বললেন–ঠিক আছে, আপনি যখন এসে পড়েছে তখন আর কোনও ভাবনা নেই, আপনি এখানে থাকুন–
রসিক পাল মশাই চৌবেড়িয়ার বনেদী কারবারী। পাট, তিসি, তিল মেস্তার কারবার করে তিনি বড়লোক হয়েছেন। বিরাট আড়ত ছিল তাঁর। সেই আড়তে বসে তিনি কারবার করতেন আর মহাজনী কারবারের নামে নানা লোককে সাহায্যও করতেন। চৌবেড়িয়া গ্রামের সাধারণ মানুষ পাল মশাইকে ছাড়া তাদের জীবনযাপনের কথা কল্পনাও করতে পারত না। বাড়িতে উৎসবে-অনুষ্ঠানে বিবাহে, শ্রাদ্ধে, অন্নপ্রাশনে, পৌষ-সংক্রান্তিতে সব ব্যাপারেই রসিক পাল মশাই-এর কাছে এসে হাজির হতো। বলতো– যাবেন পাল মশাই, আপনি গিয়ে একবার পায়ের ধুলো দেবেন–
সেই রসিক পালের বড় ইচ্ছে হয়েছিল চৌবেড়িয়াতে একটা স্কুল হোক। গ্রামের ছেলেদের বাইরের গ্রামে গিয়ে লেখাপড়া করতে হয়, এটা তাঁর ভালো লাগতো না। নিজে তিনি লেখাপড়ার ধার ধারতেন না। কিন্তু তার জন্যে তাঁর দুঃখ ছিল। ছেলেদের কলকাতার হোস্টেলে রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছে বরাবর। কিন্তু গ্রামে স্কুল করতে গেলে মাস্টার দরকার। এমন মাস্টার চাই যার সময় আছে ছাত্র পড়াবার। কিন্তু তেমন বেকার লোক কোথায় পাবেন? কে মাস্টারি করতে রাজি হবে?
তা শেষ পর্যন্ত এই সদানন্দ চৌধুরীকে পেয়ে গেলেন। রসিক পালের আড়তে অনেক লোক খাওয়া-দাওয়া করে। ব্যাপারীরা কাজে কর্মে আড়তে এলে তাদেরও খাওয়া-শোওয়ার বন্দোবস্ত রাখতে হয়। সদানন্দ সেখানেই থাকুক।
কিন্তু সদানন্দ হাত-জোড় করলে। বললে–তার চেয়ে পাল মশাই আমি বরং স্বপাক আহারের ব্যবস্থা করি। আমার চাল-ডাল-নুন-তেলের ব্যবস্থাটা শুধু আপনি করে দিন। আমি বরং মাইনেই নেব না–
রসিক পাল তাজ্জব হয়ে গেলেন কথা শুনে। বললেন–মাইনে নেবে না?
সদানন্দ বললে—না–
–তাহলে তোমার খরচ চলবে কেমন করে?
সদানন্দ বললে–আমার তো খরচের কিছু দরকার নেই। আমি নেশা-ভাঙ করি না, চা খাই না, পান-তামাক-বিড়ি কিছুরই দরকার হয় না আমার। মাছ-মাংস খাওয়া আমার নিষেধ। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত আর আলুভাতে পেলেই আমার চলে যাবে–
রসিক পাল অনেক কাল ধরে অনেক লোক চরিয়ে বুড়ো হয়েছে। এমন কথা কারো মুখে কখনও শোনেননি। আবার ভালো করে আপাদ-মস্তক দেখে নিলেন সদানন্দর। তাঁর মনে হলো এখনও যেন তাঁর অনেক দেখতে আর অনেক শিখতে বাকি।
বললেন–আচ্ছা, আজ রাত্তিরটা তো আড়ত-বাড়িতে থাকো, তারপর কাল যা-হয় করা যাবে–
বলে তিনি সেরাত্রের মত বাড়িতে বিশ্রাম করতে চলে গেলেন। আড়তের ক্যাশবাক্সে চাবি পড়লো। চাবি নেবার আগে হরি মুহুরিকে বললেন–ওই লোকটাকে একটু যত্ন-আত্তি কোরো হরি, লোকটা ভালো মনে হচ্ছে–
হরি মুহুরিই সদানন্দের সব বন্দোবস্ত করে দিলে। পরের দিন রসিক পাল হরি মুহুরিকে জিজ্ঞেস করলেন–কালকে রাত্তিরে ওই ছোকরার কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
হরি মুহুরি রসিক পালের আড়তের পুরোন লোক। আড়তে বহু লোকের আনাগোনা দেখেছে, বহু লোকের তদবির তদারক করেছে।
বললে–আজ্ঞে অসুবিধে হবে কেন? অসুবিধে হবার কথা তো নয়।
–কী খেতে দিয়েছিলে?
–আজ্ঞে ভদ্দরলোক কিছুই খান না। বলতে গেলে উপোস। উপোসই এক রকম।
–কী রকম?
–আজ্ঞে, একখানা রুটি আর সিকি বাটি ডাল। আর কিছু নিলেন না।
–মাছ হয়নি কাল?
–আজ্ঞে হয়েছিল, কিন্তু উনি মাছ-মাংস-ডিম কিছুই ছোঁন না।
–শোওয়ার কোনও অসুবিধে হয়নি? নতুন জায়গা তো!
–অসুবিধে হলে কি আর গান গাইতেন?
–গান?
রসিক পাল অবাক হয়ে গেলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন–গান? কী গান?
হরি মুহুরি বললে–ঘুমোতে ঘুমোতে অনেকের গান গাওয়া যেমন অভ্যেস থাকে তেমনি আর কি।
–কী, গানটা কী?
হরি মুহুরি বলল কবির গান আজ্ঞে–ছোটবেলায় হরু ঠাকুরের কবির গান শুনেছিলুম, সেই গান
–হরু ঠাকুরের কোন্ গান?
হরি মুহুরি গানটা বললে–
আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।
শ্যামের পীরিতি গরল মিশ্রিত,
কারো মুখে যদি শুনিতাম ॥
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম ॥
রসিক পাল সাদাসিধে মানুষ। কবি নয়, কিছু নয়, সহজ সাধারণ মানুষের গানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গায়, পাগল নাকি হে?
হরি মুহুরি বললে–গানও করতে লাগলেন আবার কথাও বলতে লাগলেন। সারা রাত গান আর কথার জ্বালায় আমাদের কারো ঘুম হয়নি কর্তামশাই–