ফাউস্টের সেই পবিত্র প্রেমের শিখাটিই বুঝি দু’চোখের দৃষ্টি-প্রদীপে ধরে পৃথিবীর অন্ধকার পায়ে পায়ে পার হয়ে সদানন্দও তার লক্ষ্যস্থলের দিকে হেঁটে চলছিল। আর ওদিকে তখন কলকাতার অভিজাত পল্লী থিয়েটার রোডের এক সুরম্য সৌধে পড়ে-পাওয়া বিপুল অর্থে কেনা সুখের কুষ্ঠব্যাধিতে ভুগছিল নয়নতারা।
দিব্য প্রেমের পবিত্র আলোটি নিয়ে আজ থেকে এক হাজার নয়শ তিয়াত্তর বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন প্রথম Positive good man. তিনিও ওই সদানন্দর মতই পৃথিবীর পথে পথে সেদিন হেঁটে চলেছিলেন। তিনিও মানুষের কল্যাণই চেয়েছিলেন। মানুষের কল্যাণের জন্যে তিনি তাঁর সারা জীবনের তপস্যার ফল মানুষকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। সে-তপস্যার ফল মানুষের কী কী কল্যাণ করেছে সদানন্দর মতন তিনিও তা দেখতে বেরিয়েছিলেন তখন। হাঁটতে হাঁটতে একদিন তিনি সেদিনের থিয়েটার রোডের এক সুরম্য সৌধে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রাজকীয় উৎসবে সেখানে তখন ফরিশীয় পুরোহিতরা সকলে উপস্থিত–দীয়তাং ভূজ্যতাংএর রব উঠছে চারদিকে। হঠাৎ তারই মধ্যে এক ছন্নছাড়া ছিন্নবাস মানুষের উপস্থিতি যেন সব কিছু হঠাৎ তছনছ করে দিলে। কেউ তাঁকে সহ্য করতে পারলে না, কেউ তাঁকে স্বীকার করতেও চাইলে না–এমন কি নয়নতারাও না। কেবল সমবেত পাপের হিংস্র ক্রোধ মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ছুটে এল তাঁর দিকে–তাকে রক্তাক্ত করে ছাড়ল। নিহত মানুষটির সেই রক্তে স্নান করে তখন পবিত্র হল নয়নতারা। নয়নতারার সুখের কুষ্ঠব্যাধি মিথ্যের খোলসের মতন সেই মুহূর্তেই খুলে পড়ল তার শরীর থেকে। প্রেমে জ্যোতিষ্মতী হয়ে উঠল সে। পাপের পাথর চাপা সত্য তখন মুক্তি পেল কণ্ঠে নয়নতারা নির্দ্বিধায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করল—’ইনি আমার স্বামী’।
কিন্তু একালের যীশু তখনও চিৎকার করে বলে চলেছে—’আমি তোমাদের মতন হতে পারি নি, তোমরা আমার সেই অক্ষমতার বিচার কর, তোমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে না পারার অপরাধের বিচার কর। আমি আসামী, আমি হাজির হয়েছি।’
অনুরূপ আর এক কণ্ঠস্বর শুনি আমরা ইয়োনেসকোর “গণ্ডার” নাটকের নায়কের মুখে—”I’m the last man left, and I’m staying that way until the end, I’m not capitulating.”
***
বিমল মিত্র তাঁর এই উপন্যাসে যে বিশাল জগৎ সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিটি ঘটনা এবং প্রতিটি চরিত্র এমনই বিশ্বাসযোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী যে আমরা আমাদের অজ্ঞাতসারেই এই জগতের সামিল হয়ে যাই কিংবা কখন যেন, কেমন করে যেন, এ জগৎ আমাদেরই জগৎ হয়ে ওঠে। সব কিছুর মধ্যে এখানে আমরা আমাদের নিজেদেরই দেখতে পাই, আমরা অবহিত হয়ে উঠি। আর এমন করে যিনি আমাদের আত্ম-অবহিত করে তোলেন, নিঃসন্দেহে তিনি আমাদেরই লেখক, আমাদের প্রিয় লেখক।
যজ্ঞেশ্বর রায়
৯ এপ্রিল ১৯৭৩
১. মহড়া
“আমি অতি সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের কথা আজকালকার ক্ষমতালোভী মানুষেরা শুনিবে কিনা জানি না। ক্ষমতা পাইবার লোভে মানুষ যখন আজকাল যে-কোনও অন্যায় আচরণ করিতে প্রস্তুত সেই সময় আমার মত সাধারণ মানুষের কাহিনী শুনিবার মত লোক নাই জানিয়াও আমি আমার এই জীবন লিখিতে বসিয়াছি। এই অবিশ্বাসের যুগেও আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোথাও-না-কোথাও একজন বিশ্বাসী-প্রাণ মানুষ আছে। সে মানুষ এখনও সততা এবং সত্যবাদিতাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে ধর্মকে, বিশ্বাস করে ভালবাসাকে এবং বিশ্বাস করে ঈশ্বরকে। এই তিন শক্তিকে যে বিশ্বাস করে না তাহার জন্য আমার একাহিনী নয়। তাহারা আমার এই কাহিনী না পড়িলেও আমি দুঃখ করিব না। ঈশ্বর যদি একজন যিশুখৃষ্টের জন্য হাজার-হাজার বছর অপেক্ষা করিতে পারেন, তাহা হইলে আমার মত নগণ্য লোক একজন সৎ পাঠকের জন্য লক্ষ-লক্ষ বছর অনায়াসেই অপেক্ষা করিতে পারিব। আমার বয়স এখন..”
এই পর্যন্ত লিখেই সদানন্দবাবু থামলেন। বয়েসটা হিসেব করতে হবে। বয়েস কত হলো তাঁর? ভাবতে ভাবতে সদানন্দবাবু ভাবনার তলায় তলিয়ে গেলেন। কম দিন তো হলো না। অত দিনের সব কথা মনে রাখা কি সহজ! অথচ মনে করতেই হবে। মনে না করতে পারলে জীবনী লেখা ব্যর্থ হবে। সব কথাই তাঁকে খুলে লিখতে হবে। কোথাও কথা গোপন করা চলবে না তাঁর। যে-জীবন থেকে সরে এসে তিনি এখানে এই চৌবেড়িয়াতে নির্বাসনদণ্ড ভোগ করছেন সেই ফেলে আসা জীবনের কথা তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে আবার মনে করতেই হবে। আবার তাঁর ফেলে আসা জীবনটাকে আগাগোড়া পরিক্রমা করতে হবে।
তাঁর সেই ছোটবেলার কথাটাও তিনি মনে করতে চেষ্টা করলেন।
তিনি লিখতে লাগলেন—“আপাতদৃষ্টিতে সেই ছোট বেলা হইতেই আমার কোনও অভাব ছিল না। যাহাকে সংসারী লোক অভাব বলে তাহা আমার ছিল না। আমি নবাবগঞ্জের প্রবল-প্রতাপ জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পৌত্র, আর হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সদানন্দ চৌধুরী, যাহা চাহিতাম তাহাই পাইতাম। চাহিয়া না পাওয়ার দুঃখ যে কী ভীষণ অসহনীয় তাহা আমাকে কখনও বুঝিতে হয় নাই। অথচ সেই আমার কপালেই না-চাহিয়া সব পাওয়ার বিপর্যয় যে এমন মর্মান্তিক ট্রাজেডি হইয়া দাঁড়াইবে তাহা আমি সেই অল্প বয়সে উপলব্ধি করিতে পারি নাই।”
লিখতে লিখতে সদানন্দবাবুর ভাবতে বড় ভালো লাগলো। নবাবগঞ্জের সেই বাড়িটা, সেই গাছ-পালা-পুকুর, সেই বারোয়ারি-তলা, আর সেই চণ্ডীমণ্ডপ। কথাগুলো যেন ভোলা যায় না। অথচ ভুলতেই তো চেয়েছিলেন তিনি। ভোলবার জন্যেই তো এই চৌবেড়িয়া গ্রামে এসেছিলেন।