–ওর কোনও দোষ নেই তো তবে দোষ কার?
উত্তরটা দিলে সদানন্দ। বললে–সব দোষ আমার, আমাকে আপনি অ্যারেস্ট করুন, আমাকে আপনি ফাঁসি দিন, আমিই আসামী, আমি মানুষকে বিশ্বাস করেছিলুম, আমি মানুষকে ভালবেসেছিলুম, আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলুম, আমি নিজের টাকা মানুষের উপকারের জন্যে পরকে দান করে দিয়েছিলুম। আজকের মানুষের চোখে এর চেয়ে বড় পাপ আর নেই। সেই বড় পাপই আমি করেছিলুম–
কথাটা বলে নয়নতারাকে ঠেলে দিয়ে সদানন্দ নিয়ে মিস্টার সামন্তর দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলে।
কিন্তু নয়নতারা তখনও সকলের দিকে চেয়ে অনুনয়-বিনয় করে বলে চলেছে–না মিস্টার সামন্ত, আপনি একে ছেড়ে দিন, আপনারা ইচ্ছে করলে সব করতে পারেন, এর জন্যে যত টাকা খরচ হয় সব আমি দেব, একে ছেড়ে দেবার জন্যে আমি আমার সব কিছু দিতে প্রস্তুত বলুন আপনারা কী চান, কত টাকা চান?
কিন্তু সদানন্দ তার কথা অগ্রাহ্য করে বলতে লাগলো–না না, নয়নতারার কোনও কথা সত্যি নয়, নয়নতারা আমার কেউ নয়, আমিও নয়নতারার কেউ নই, আমার একমাত্র পরিচয় আমি আসামী, আমি মানুষকে বিশ্বাস করেছিলুম, আমি মানুষকে ভালবেসেছিলুম, আমি মানুষের শুভকামনা করেছিলুম। আমি চেয়েছিলুম মানুষ সুখী হোক, আমি চেয়েছিলুম মানুষের মঙ্গল হোক, কিন্তু আজ এই পনেরো বছরে জানলুম মানুষকে বিশ্বাস করা, মানুষকে ভালবাসা, মানুষের শুভকামনা করা পাপ, আমি তাই আজ পাপী, আমি তাই আজ অপরাধী, আমি তাই আজ আসামী, আমাকে আপনারা আমার পাপের শাস্তি দিন, আমাকে ফাঁসি দিন–
বলে নয়নতারাকে ঠেলে দিয়ে এবার সদানন্দ নিজেই এগিয়ে চললো। পুলিসের লোক তাকে ধরে নিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে চলতে লাগলো।
মিস্টার সেন তখনও হতবাক। বললেন মিসেস ব্যানার্জি, সত্যি বলুন তো ও কে?
নয়নতারা তখন আর সহ্য করতে পারলে না। বলে উঠলো–ওকে আপনারা শাস্তি দেবেন না মিস্টার সেন–শাস্তি দেবেন না। আপনি নিজে একটু বুঝিয়ে বলুন–
–কিন্তু সত্যি বলুন তো, উনি কে আপনার?
–উনি আমার স্বামী–
‘স্বামী’ বলবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পরিবেশের আবহাওয়ায় যেন একটা বিদ্যুৎ-চমক খেলে গেল।
মিস্টার ব্যানার্জি এতক্ষণ কিছু বলেননি। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার নয়নতারার হাতটা ধরে টান দিতে গেলেন।
বললেন–করছো কী তুমি? কী পাগলামি করছো?
কিন্তু তার আগেই নয়নতারা সেই মেঝের ওপরই সোজা অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেল। চোখের জলে তার মুখের গালের ম্যাক্স-ফ্যাকটার ধুয়ে মুছে ভেসে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তখনও যেন তার কানে বাজতে লাগলো সদানন্দর বলা শেষ কথাগুলো–আমি আসামী, আমি মানুষকে বিশ্বাস করেছিলুম, আমি মানুষকে ভালবেসেছিলুম, আমি মানুষের শুভ কামনা করেছিলুম, আমি চেয়েছিলুম মানুষ সুখী হোক, আমি চেয়েছিলুম মানুষের মঙ্গল হোক। কিন্তু আজ এই পনের বছর পরে জানলুম মানুষকে বিশ্বাস করা, মানুষকে ভালবাসা, মানুষের শুভ কামনা করা পাপ, আমি তাই আজ পাপী, আমি তাই আজ আপরাধী, আমি তাই আজ আসামী, আমাকে আপনারা আমার পাপের শাস্তি দিন, আমাকে আপনারা ফাঁসি দিন–
সেদিন যারা সেখানে ছিল সবাই তখন স্তম্ভিত হয়ে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু মালা বোসের গাওয়া সেই গানটা তখনও যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল–
ও নিষ্ঠুর আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে—
.
তারপর? তা তারপরের পরেও তো একটা তারপর থাকতে পারে। সেই তারপরের কথাটাই বলি। আজ থেকে এক হাজার ন’শো তিয়াত্তর বছর আগে সেদিনের সেই মানুষের পৃথিবী যেমন আর এক সদানন্দকে সমসাময়িক সমাজ থেকে নিমূর্ল নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করেছিল, এত কাল পরে আজকের মানুষের পৃথিবীও তার আর উত্তরসূরী আসামীকে শাস্তি দিয়ে নিজেদের নিরাপদ মনে করে নিশ্চিন্ত হলো। কর্তাবাবু, চৌধুরী মশাই আর প্রকাশ মামার পৃথিবী আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠলো আর এক নতুন আশ্বাসে, আবার নবাবগঞ্জের স্কুলে-কলেজে-হাসপাতালে নতুন উদ্যমে আর এক অরাজকতার বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ লক্ষ কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিকের দল কর্তাবাবুদের করুণার ওপর আত্মসমর্পণ করে অস্তিত্ব বজায় রাখবার আপ্রাণ চেষ্টায় ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগলো। ‘গ্রীন পার্কে’ আরো চড়া দরে নারীদেহের বেচা-কেনা হতে লাগলো। থিয়েটার রোডের বাড়িগুলোতে আবার ককটেল পার্টির আসরে জমায়েত হতে লাগলো কলকাতার গণ্যমান্য মানুষের দল। এক হাজার ন’শো তিয়াত্তর বছর আগে সব কিছু যেমন চলছিল, এতদিন পরেও আবার ঠিক তেমনি চলতে লাগলো সব কিছু। কোনও কিছুরই পরিবর্তন হলো না। কিন্তু সব কিছুর অন্তরালে আকাশ-বাতাস-অন্তরীক্ষ থেকে তখনও একজনের ক্ষীণ কণ্ঠ তার ভালোবাসার একমাত্র সাবধান বাণী শুনিয়ে যেতে লাগলো। সে বাণী কেউ বা হয়ত শুনলো, আবার কেউ বা হয়ত শুনতে পেলে না, কিন্তু সেই নিপীড়িত লাঞ্ছিত আসামীর বলার আর তবু বিরাম হলো না কোনও দিন। সে কণ্ঠ যুগ যুগ ধরে কেবল বলেই চললো–তোমারা সৎ হও, তোমরা সুখী হও, তোমরা মানুষকে বিশ্বাস করো, তোমরা মানুষকে ভালোবাসো, তোমাদের কল্যাণ হোক, তোমাদের শুভ হোক, তোমাদের জয় হোক–
সর্বেহত্র সুখীনঃ সন্তু
সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ
সর্বে ভদ্ৰানি পশ্যন্তি
মা কশ্চিৎ দুঃখং আপ্লুয়াৎ।