দু’জনেই পেছন ফিরে তাকালেন। কিন্তু ফিরে তাকিয়ে যা দেখলেন তাতে চমকে উঠেছে দু’জনেই। দেখলেন লোকটা পাশের একটা লোককে এক হাত দিয়ে ধরে উন্মাদের মত একটা ক্ষুর দিয়ে মারাত্মক আঘাত করে চলেছে। আর লোকটার আর্তনাদে সমস্ত বাড়িটাও যেন সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠছে।
চিৎকার শুনে তখন হলঘরের ভেতর থেকে সবাই ছুটে এসেছে। কী হলো? কে আর্তনাদ করে উঠলো? আজকে তো মিসেস ব্যানার্জির ছেলের জন্মদিন। এই শুভ দিনে কান্না কেন? চীৎকার কেন? আর্তনাদ কেন? মিস্টার আর মিসেস হেন্ডারসন, মিস্টার আর মিসেস নবিকভ, মিস্টার আর মিসেস সামন্ত, মানদা মাসি, মালা বোস সবাই ছুটে এসেছে।
কী হলো ওখানে? কী হলো?
বারান্দাটা তখন ভিড়ে ভিড়। সবাই দেখলে জায়গাটা রক্তে রক্তে একেবারে ভেসে গেছে। একটা ময়লা জামা পরা লোক হাতে ক্ষুর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। ক্ষুরটায় রক্ত মাখা। আর তারই পাশে একটা লোক মুমূর্ষ হয়ে মেঝের ওপর পড়ে আছে।
মিস্টার সেন লোকটার হাত ধরে ফেলেছেন। সবাই উত্তেজিত! মিস্টার ব্যানার্জিও কাণ্ড দেখে অবাক। লোকটাকে যেন চিনতে পারলে সে।
মিস্টার সামন্ত কাছে আসতেই মিস্টার সেন তার হাত ছেড়ে দিলেন।
–তুমি ওই লোকটাকে খুন করেছ?
সদানন্দ স্থির দৃষ্টিতে মিস্টার সামন্তর মুখের দিকে চাইলে। বললে–হ্যাঁ!
–তোমার নাম কী?
সদানন্দ বললে–আমার নাম বললে চিনবেন না–
–তবু নামটা বলো।
–আমার নাম সদানন্দ চৌধুরী।
–কোথায় থাক তুমি? তোমার বাড়ি কোথায়?
–নবাবগঞ্জে।
–নবাবগঞ্জ? নদীয়া ডিসট্রিক্টের নবাবগঞ্জ?
–তোমার বাবার নাম?
–আমার বাবার নাম হরনারায়ণ চৌধুরী।
–আর ও কে?
সদানন্দ বললে–ওর নামও সদানন্দ চৌধুরী।
–সে কী? একই নাম তোমাদের দু’জনের?
সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, ও আর আমি একই। ও আমারই ছায়া। সারা জীবন ও আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে, সারা জীবন ও আমাকে জ্বালিয়েছে। আমার বিবেকের মত ও কেবল আমাকে সারা জীবন যন্ত্রণা দিয়েই এসেছে। ওর সঙ্গেই আজ আমি এখানে এসেছি। ও-ই আমাকে এখানে আনলে। এখানে না এলে আমাকে আজকের এই সমস্ত কিছু দেখতে হতো না। আমি এতদিন বেশ ছিলুম, আমার তো কোনও কষ্টই ছিল না। কিন্তু কেন ও আমাকে এসব দেখালে! না দেখালে আমি তো জানতেও পারতুম না কিছু। আমি তো বরং জানতুম নবাবগঞ্জের লোক সুখে আছে। তারা হাসপাতাল থেকে ওষুধ পাচ্ছে, ডাক্তারের সেবা পাচ্ছে, তারা স্কুলে কলেজে লেখাপড়া শিখে মানুষ হচ্ছে। আমি জানতেও পারতুম না যে থিয়েটার রোডে নয়নতারার ছেলের জন্মদিনে এত মদের ফোয়ারা ছুটেছে, আমি তো জানতে পারতুম না আমারই টাকায় মোটা দরে ‘গ্রীন পার্কে’ মেয়েমানুষের মাংস বিক্রি হচ্ছে…।
বলতে বলতে সদানন্দর যেন দম ফুরিয়ে এল। সে হাঁপাতে লাগলো।
তারপর একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো–আমাকে আপনারা অ্যারেস্ট করুন। দয়া করে আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করুন। আমি স্বীকার করছি আমি ওকে খুন করেছি আমি স্বীকার করছি আমি আসামী।
মিস্টার সামন্ত তখন সদানন্দর হাতটা চেপে ধরে আছে। জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু এখানে তুমি আসতে গেলে কেন? এখানে মিসেস ব্যানার্জির বাড়িতে তুমি কিসের জন্যে এলে? এখানে কিসের কাজ তোমার? এখানে কে তোমাকে আসতে বলেছিল?
সদানন্দ বললে–সেকথা আপনারা মিসেস ব্যানার্জিকেই জিজ্ঞেস করুন–
–কী মিসেস ব্যানার্জি, আপনি একে চেনেন?
মিস্টার ব্যানার্জি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–না না মিস্টার সামন্ত, আমরা তো কেউ চিনি না। ও কে? এখানে এলো কেন? আমার তো ওকে আসতেও বলিনি।
সদানন্দ বলে উঠলো–হ্যাঁ, ওরা সত্যি কথাই বলেছেন, ওঁরা কেউই আমাকে এখানে আসতে বলেননি। আমি ওঁদের কেউই না। আমার সঙ্গে ওদের কোনও সম্পর্ক নেই। এই লোকটাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। এই-ই আমাকে এখানে এনে এই সব দেখালে! সেই জন্যেই আমি একে খুন করেছি–! আমি আপনাকে অনুনয় করে বলছি আমাকে অ্যারেস্ট করুণ আপনারা। আমি আসামী।
–কিন্তু এই সামান্য কারণেই ওকে খুন করলে?
সদানন্দ বললে–আপনারা একে সামান্য কারণ বলছেন? জানেন এ লোকটা আমার কত বড় ক্ষতি করেছে? এই লোকটাই আমাকে দেখালে সত্যবাদিতা পাপ, এই লোকটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে যে মানুষকে বিশ্বাস করা অন্যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে বিদ্রোহ করা পাগলামি। আসলে বিশ্বাস করুন ওর কথাই ঠিক, আমিই পাপ করেছি। মানুষকে বিশ্বাস করে আমি পাপ করেছি, মানুষকে ভালোবেসে আমি পাপ করেছি মানুষকে দয়া করে আমি পাপ করেছি। আমার সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি এখন প্রস্তুত, আপনারা আমাকে গ্রেফতার করুন, আমাকে ফাঁসি দিন, আমি আসামী–
মিস্টার সামন্ত পাশের দিকে কাদের ইঙ্গিত করতেই তারা এসে সদানন্দকে গ্রেফতার করতে গেল। কিন্তু তার আগেই নয়নতারা হঠাৎ সদানন্দর সামনে গিয়ে তাকে আড়াল করে দাঁড়াল। তারপর দুটো হাত দু’দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিস্টার সামন্তর দিকে চেয়ে বললে–একে অ্যারেস্ট করবেন না মিস্টার সামন্ত।
সবাই অবাক হয়ে গেল। মিসেস ব্যানার্জি এ কী বলছেন!
–সে কী মিসেস ব্যানার্জি, আপনি কেন বাধা দিচ্ছেন? এ তো একটা অ্যান্টি-সোশ্যাল, এ তো একটা ভ্যাগাবণ্ড
নয়নতারা বললে–প্লিজ মিস্টার সামন্ত, ওকে অ্যারেস্ট করবে না, ওর কোনও দোষ নেই–কোনও দোষ নেই ওর।