–কপিল, তুই?
কে একজন পাশ থেকে আরো জোরে হেসে উঠলো। বেহারী পাল তার দিকে চাইতেই সে বলে উঠলো-আমাকে চিনতে পারছেন পাল মশাই?
–কে তুই?
–আমি মানিক ঘোষ। আর আমার পাশে এই যে একে দেখছেন, এ হলো ফটিক প্রামাণিক
বেহারি পাল সেখানেই মাথা ঘুরে অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেল।
.
সমস্ত বাড়িটার চোখে তখন কক্টেল আরো কুটিল নেশার ঘোর ঘনিয়ে এনেছে। নয়নতারার বুঝি একটু তখন সময় হলো। একটু সামান্য ফুরসৎ। এই ফুরসৎটুকুর মধ্যে যা বলবার বলে নাও। আমার সময় নেই বাজে লোকের সঙ্গে কথা বলবার।
–কোথায়? কে ডাকছে আমাকে? কে?
মধু বললে–এই যে, ইনি–
হলঘরের চড়া আলোর আওতা থেকে এসে প্রথম বাইরে একটু অস্বস্তি লেগেছিল। তারপর সামনে খোঁচা-খোঁচা গোফ-দাড়ি-ভর্তি মুখখানার দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল নয়নতারা। এ লোকটা আবার তার সঙ্গে দেখা করতে চায় কেন? ডেকরেটারের লোক নাকি? টাকা চাইতে এসেছে?
নয়নতারা তার কাছে গিয়ে বললে–এখন কোনও পেমেণ্ট হবে না–এখন পেমেণ্ট নিতে এলে কেন?
কথাটা বলেই যেন সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বললে–ও, তুমি!
সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, আবার এলুম—
–কিন্তু–
সদানন্দ বললে–তুমি খুব ব্যস্ত—
নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, আমার প্রথমের জন্মদিন তো, তাই–
–প্রথম মানে?
–আমার ছেলে!
সদানন্দ বললেও, খুব ভালো। আমাকে তুমি অবশ্য আসতে বলোনি, তবু আমিও আশীর্বাদ করছি তোমার ছেলেকে। সে সুখী হোক্–
আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিল, সদানন্দ, কিন্তু নয়নতারার তখন ওদিকে অনেক তাড়া। বললে–আজকে সবাই এসেছে ও-ঘরে, আমি ছাড়া আর তো কেউ দেখবার নেই? তা তুমি আর একদিন আসতে পারো না? ঠিক আজকেই তুমি এলে?
সদানন্দ বললে–-তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল—
নয়নতারা বললে–আজকেই?
–হ্যাঁ, এখনই। আর হয়ত কখনও সময় পাবো না আমি। হয়ত আর কখনও আমাদের দেখাও হবে না।
নয়নতারাও বললে–তা কাল যে-কোনও সময়ে তুমি একবার এসো না, যে-কোনও সময়। আমি সব সময়েই থাকবো। তখন হাতে অনেক সময় থাকবে। বেশ নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে
–না, কাল তো সময় হবে না আমার, আজই আমার শেষ আসা।
নয়নতারা বললে–তা কাল না-আসতে পারো, পরশুই এসো—
সদানন্দ বললে–কিন্তু আজ আমার জন্যে তুমি একটুকু সময়ও দিতে পারো না?
নয়নতারা বললে–তুমি দেখছো তো আমার অবস্থা, চিফ-মিনিস্টার এসেছেন, ফরেন আমবাসাডাররা এসেছেন, পুলিস কমিশনার এসেছে, আরো কত লোক সব এসেছে, সবাই গণ্যমান্য লোক। তাঁদের দেখাশোনা করতে তো সেই একলা আমিই–
সদানন্দ বললে–তারা অবশ্য আমার চেয়ে অনেক বড় লোক, তাদের দিকটাই তো তোমার আগে দেখা উচিত–
নয়নতারা বললে–তুমি অমন করে কথা বলছো কেন? মনে হচ্ছে তুমি যেন রাগ করলে!
সদানন্দ বললে–রাগ? আমি রাগ করলে কার কী এসে যায়! রাগের কথা হচ্ছে না, শুধু বলো তুমি কী সুখী হয়েছ? কারণ, বলতে গেলে তোমার সুখের জন্যেই আমি আমার সর্বস্ব একদিন তোমাকে দিয়ে গিয়েছিলুম–
নয়নতারা কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। বললে–বলছি তো ও-সব কথা বলবার সময় নেই এখন, তবু তুমি সেই কথাই আরম্ভ করলে। পরে একদিন এসো না, তখন ওই কথা বলবো–
নয়নতারার মুখে-চোখে যেন বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো। সদানন্দ এখান থেকে চলে গেলেই যেন যে বাঁচে। আজকে এখানে সদানন্দর উপস্থিতি যেন সে চাইছে না।
–কিন্তু তুমি সুখী হয়েছ কী না শুধু সেই কথাটুকু বলবারও তোমার সময় নেই আজ?
হঠাৎ ওদিক থেকে মিস্টার সেন এসে পড়তেই কথার মধ্যে বাধা পড়লো। মিস্টার সেন কাছে আসতেই নয়নতারার চোখে মুখে আবার আনন্দের ছাপ ফুটে উঠলো।
–মিসেস ব্যানার্জী আপনি এখানে? আমি চলি—
নয়নতারা চমকে উঠলো। বললে–সে কী, আপনি এখনই যাবেন?
মিস্টার সেন বললেন–এখনই টেলিফোনে কথা হলো, নদীয়া জেলায় খুব ট্রাবল শুরু হয়েছে–ফায়ারিং হয়ে গেছে অনেকগুলো ক্যাজুয়্যালটি, আমাকে এখুনি আর একবার রাইটার্সে যেতে হবে–
–নদীয়া ডিসট্রিক্টে? কোথায়?
–ওই যে বললুম নবাবগঞ্জ! নবাবগঞ্জ থেকে এখন আশেপাশের গ্রামেও নাকি গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়ছে শুনলুম–
সদানন্দ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার আর থাকতে পারলে না। বললে–নবাবগঞ্জ?
এতক্ষণে চিফ-মিনিস্টার সদানন্দর দিকে চেয়ে দেখলেন। আগে যেন তিনি তাকে দেখতেই পাননি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ মুখে, এ লোকটা আবার কে?
সদানন্দ বললে–নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীকে আপনারা অ্যারেস্ট করেছেন কী? তিনিই ওখানকার সব চেয়ে বড় কালপ্রিট।
অবাক হয়ে গেলেন মিস্টার সেন। লোকটা বলে কী?
–হ্যাঁ, সেই নরনারায়ণ চৌধুরীর জন্যেই ওখানে আজ যত অশান্তি। ওখানকার কপিল পায়রাপোড়া ওর জন্যেই গলায় দড়ি দিয়েছিল। মানিক ঘোষ পাগল হয়ে গিয়েছিল, ফটিক প্রামাণিক ওর জন্যেই রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়িয়েছিল, ওকে কী আপনারা ধরেছেন?
চিফ-মিনিস্টার আরো অবাক। সদানন্দকে কিছু না বলে মিসেস ব্যানার্জির দিকে চেয়ে বললেন–এ লোকটা কে?
মিসেস ব্যানার্জি বললে–ও কেউ না, আপনি ওদিকে চলুন ওদিকে চলুন–বলে মিস্টার সেনকে নিয়ে হলঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু চলতে চলতে খানিক দূর যেতেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ কানে এল। যেন অমানুষিক যন্ত্রণায় কেউ ছাদ-ফাটা চীৎকার করে উঠলো।