সদানন্দ আর একজনকে ধরলো। বললে–-শোন, তোমাদের মেমসাহেবকে একবার ডেকে দিতে পারো?
–মেমসাহেব? ডেকে দিচ্ছি–
–তোমার নাম কি মধু?
বেয়ারাটা বললে–না, আমি মধুকে বলে দিচ্ছি–
বলে কোথায় উধাও হয়ে গেল এক নিমেষে। সদানন্দ বুঝতে পারলে সত্যিই এবাড়ির সবাই ব্যস্ত। নয়নতারার ছেলের আজ জন্মদিন। সদানন্দও নয়নতারার ছেলেকে আশীর্বাদ করবে। এত লোক এসেছে নয়নতারার ছেলেকে আশীর্বাদ করতে আর সদানন্দই বা কেন বাদ পড়ে যাবে?
কিন্তু কোথায় কী? কেউ আর মেমসাহেবকে খবর দিলে না। সত্যিই তো, খবর দিলেই বা কী! নয়নতারা নিজেও তো ব্যস্ত এত লোককে সে আজ নেমন্তন্ন করেছে। তাদের দিকেই তো আগে নজর দিতে হবে তাকে! সদানন্দ তো আজ এখানে অনাহূত। সদানন্দ তো আজ এখানে অনাবশ্যক!
বারান্দাটা পেরিয়ে একটু উত্তর দিকে যেতেই অনেক লোকের গলার শব্দ কানে আসতে লাগালো। কেউ যেন ভেতরে মেয়েলি-গলায় গান গাইছে গানের কথাগুলো অস্পষ্ট কানে আসতে লাগলো।
আমি পালিয়ে থাকি মুদি আঁখি
আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি
কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে।
সামনেই একটা বিরাট হলঘর। লোকজনের জটলা সেখানেই। সদানন্দ আস্তে আস্তে একটা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কাচবন্ধ জানলা। কিন্তু কাচের ভেতর দিয়ে সদানন্দ উঁকি দিয়ে দেখলে। এত লোক! সকলের হাতেই গ্লাস। কী যেন খাচ্ছে সবাই। মাঝে-মাঝে সবাই-ই গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। হয়ত মদই হবে, কিম্বা হয়ত মদ নয়। হঠাৎ নজর পড়ে গেল নয়নতারার ওপর। অনেক দিন পরে দেখলে তাকে। পনেরো বছর পরে! কিন্তু কই, নয়নতারা তো এই পনেরা বছর পরেও একটুকু বদলায়নি। যেন বয়েস আরো অনেক কমে গেছে তার! আর কত সেজেছে! নড়ছে-চড়ছে, সকলের সঙ্গে ঘুরে কথা বলছে আর কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচলটা খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। শুধু তার শাড়ি নয়, নিজেকেও যেন আর সামলাতে পারছে না সে। তবে কি নয়নতারাও ওদের মত মদ খেয়েছে নাকি!
হঠাৎ দেখলে সেই মানদা মাসি! গাড়িতে করে ঢুকতে দেখেছিল যাকে। সেই মানদা মাসি কী যেন বললে নয়নতারাকে। কথাটা শুনেই নয়নতারা ঘুরে দাঁড়ালো। বললে– আমাকে? ডাকছে? কে ডাকছে? কোথায়?
–ওই যে আবদুল বলছে।
–কোথায় আবদুল? ডাকো তো আমার কাছে—
কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলবার কি সময় আছে নয়নতারার! কথাটা বলতে বলতে আবার অন্য দিকে চলে গেল। সদানন্দ হঠাৎ সেই সমরজিৎবাবুর ছেলে সুশীল সামন্তকে দেখতে পেলে, সেই মহেশ যাকে বড়দাদাবাবু বলতো। আর তার দিকে একটা ছোট বেদীর ওপরে বসে গান গাইছে এক মহিলা–
মারকে তোমার ভয় করেছি বলে
তাইতো এমন হৃদয় ওঠে জ্বলে—
ভেতরে তখন নিখিলেশ দৌড়তে দৌড়তে মিস্টার সেনের কাছে এসেছে।
–আপনার টেলিফোন মিস্টার সেন!
–টেলিফোন! চিফ-মিনিস্টারের ভাব দেখেই বোঝা গেল তিনি যেন এই টেলি-ফোনটার জন্যেই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। নদীয়ার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কথা দিয়েছিল রিপোর্ট দেবে। সি আর পি এতক্ষণে পাঠানো হয়েছে নিশ্চয়ই। মিস্টার সেন হাতের ঘড়িটা দেখলেন। যেতে আর কতক্ষণ লাগবে! বড় জোর দু’ঘণ্টা।
–হ্যালো।
ওদিকে তখন আগুনের শিখায় আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। লোক্যাল পুলিস গিয়েছিল কিন্তু তারা কিছু করতে না পেরে ফিরে চলে এসেছে। নিতাই হালদার দোকানের জিনিসপত্র কিছুই বার করতে পারেনি। একদিন কত আড্ডা দিয়েছে সবাই ওই দোকানের মাচার ওপর বসে আজ সেই আগুনের হলকা লেগে সেটাও মড় মড় করে ভেঙে পড়লো! হঠাৎ সেই মড় মড় শব্দ শুনে যেন কারা গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলো হো-হো করে। যেন তাদের বড় আনন্দ হয়েছে। গ্রামের লোকের যদি সর্বনাশ হয় তো কাদের এত আনন্দ! তারা কারা? কারা এত হাসছে! সমস্ত সর্বনাশ ছাপিয়ে কাদের উল্লাসের ধ্বনি এমন করে সমস্ত অঞ্চল। এত উচ্চকিত করছে। কে! কে ওরা?
অন্ধকারের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে যারা এতক্ষণ ছোটাছুটি করছিল, রাত বাড়তেই তারা আবার বুক ফুলিয়ে সকলের সামনে দাপাদাপি করতে শুরু করেছে। এতদিন আমরা অনেক অনেক সহ্য করেছি। একদিন কর্তাবাবুদের ভয়ে মাথা তুলতে পারিনি আমরা। এক কথায় আমরা বাড়ি-ঘর-জমি-খামার সব ছেড়ে রাস্তায় গিয়ে বসেছি, আমরা গলায় দড়ি দিয়েছি, পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। বংশী ঢালীর কুড়ুল আমাদের মাথায় পড়েছে। আমরা তবু সব মুখ বুঁজে সহ্য করেছি। এবার পাশার দান উলটে গেছে। এবার আমরা বেঁচে উঠেছি। যে গ্রামে একদিন কেউ আমাদের দিকে এতটুকু সহানুভূতি দেখায়নি, আমাদের চোখের জলে কারোর বুক ভেজেনি, কর্তাবাবুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটা কড়ে আঙুল উঁচিয়েও কেউ প্রতিবাদ জানায়নি, আজ সেই গ্রামের সকলকেই তার সমস্ত প্রতিশোধ সুদে আসলে মাথায় তুলে নিতে হবে। শুধু এ-গ্রামের নয়। এ-গ্রামের পাশের গ্রাম, তার পাশের পাশের গ্রাম, তারপরে সারা বাঙলা দেশ অতিক্রম করে সারা পৃথিবী জুড়ে আমরা আমাদের কর্তাবাবুদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেব।
বেহারি পালের সামনে দিয়েই কারা যেন তখন দৌড়ে যাচ্ছিল। বেহারি পাল ভয় পেয়ে গেল। কে রে তোরা? কারা? কারা ছুটে যাচ্ছিস?
লোকগুলো দাঁড়িয়ে গেল। তাদের মুখের দিকে চেয়েই বেহারি পালের মাথাটা বন্ বন্ করে ঘুরে উঠলো। বেহারি পালের মনে হলো যেন কপিল পায়রাপোড়া তার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে হাসছে।