বললে–নমস্কার, নমস্কার! এত দেরি হলো যে আপনার?
সস্ত্রীক অ্যামব্যাসাডাররাও এগিয়ে এলেন। সবার লক্ষ্য তখন তাদের দুজনের দিকে। এতক্ষণ যে-গান শোনবার জন্যে তাদের মনোযোগের শেষ ছিল না, এখন মিস্টার সেনের আবির্ভাবে যে তাদের সব ধ্যান ছারখার হয়ে গেল।
সবারই ওই এক প্রশ্ন–এত দেরি হলো যে?
মিস্টার সেন সকলকেই ওই এক উত্তর দিলেন-হঠাৎ একটা ট্রাঙ্ক কল এসেছিল–
ট্রাঙ্ককল! মিসেস ব্যানার্জি একটা বেয়ারাকে একেবারে সঙ্গে করে ধরে এনেছে। সামনে তার ট্রে ধরা। তাতে সার সার গেলাস সাজানো। আর একজনের ট্রে-তে স্ন্যাক্স।
–নিন মিসেস সেন–নিন—
মিস্টার সামন্ত এগিয়ে এলেন। তাকে দেখেই মিস্টার সেন একটু পাশে সরে দাঁড়ালেন। গলাটা নামিয়ে মিস্টার সেন বললেন–নদীয়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এখুনি টেলিফোন করেছিলেন–
তারপরে দুজনে কী কথা হলো কে জানে! সে-সব কেউ শুনতে পেলে না। কিন্তু সে বেশিক্ষণ নয়। অন্যদিকে মিসেস ব্যানার্জির ব্যস্ততা তখন আরো বেড়ে গিয়েছে। একবার একজনের কাছে যায়, আবার সেখান থেকে আর একজনের কাছে গিয়ে হাজির হয়। সব দিকে তার নজর রাখতে হবে। এই যে আজ তার বাড়িতে এত অতিথি, এত মান্যগণ্য অভ্যাগত, এ সবই মিসেস ব্যানার্জির বহুদিনের কলা-কৌশলের ফল। আর পনেরো বছরের অক্লান্ত সাধনায় ইজ্জতের এই শিখরে এসে উঠেছে সে। এককালে অনেক লাঞ্ছনা অনেক গঞ্জনা তাকে মাথা পেতে সহ্য করতে হয়েছে। নবাবগঞ্জের শ্বশুরবাড়িতে তার অপমানের শেষ ছিল না। আজ এতদিন পরে তার প্রতিশোধ নিতে পেরেছে সে, এ কী তার কম গৌরব! সেদিনকার সব লাঞ্ছনার যন্ত্রণা যে সে আজকের ককটেলের প্রলেপ দিয়ে মুছে দিতে পেরেছে, এইটুকুই কী কম! আজকে তাকে দেখে কে বলবে এই নয়নতারাই সেদিনকার সেই অসহায় নয়নতারা! যেদিন নবাবগঞ্জে তার শ্বশুরবাড়ির সমস্ত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে তাদের মুখের ওপর দিয়ে সে মাথা উঁচু করে সদম্ভে চলে আসতে পেরেছিল, সেদিন কী কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল যে আবার একদিন মিসেস ব্যানার্জি হয়ে তার এই থিয়েটার রোডের বাড়িতে সে ককটেল পার্টি দিতে পারবে! আজকের এরা এই গণ্যমান্য অতিথিরা সেদিনকার নয়নতারাকে দেখেনি। দেখলেও হয়ত চিনতে পারতো না। কিম্বা যে নয়নতারা নৈহাটি স্টেশন থেকে পায়ে চটি গলিয়ে ডেলি-পাসেঞ্জারি করতো তাকেও তো এখন এখানে দেখলে কেউ চিনতে পারবে না। কিন্তু এও তো তার একদিনে হয়নি। এখানে উঠতেই কী তাকে কম অধ্যবসায় করতে হয়েছে। এর পেছনে কত অপব্যয়, কত তোষামোদের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে তা এরা কেউ জানে না। আর জানে না বলেই আজ তার সব কৃচ্ছ্রসাধন সার্থক, সব প্রতারণা সুন্দর। আজ কলকাতার অভিজাত সমাজে তাই মিসেস ব্যানার্জীর এত মর্যাদা!
মালা বোস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লাইনগুলো তখন আবার গাইছে–
আমি পালিয়ে থাকি মুদি আঁখি
আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি
কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে
ও নিঠুর, আরো কী বাণ তোমার তুণে আছে—
মানদা মাসি এবার মিসেস ব্যানার্জির পাশে এসে দাঁড়ালো। বললে–দিদি তোমাকে একবার বাইরে কে ডাকছে–
–আমাকে? ডাকছে? কে ডাকছে? কোথায়?
–ওই যে আবদুল বলছে—
–কোথায় আবদুল? আবদুলকে আমার কাছে ডাকো তো!
মানদা মাসি গিয়ে বলতেই আবদুল এল। বললে–মধু বলছিল মেমসায়েবকে একজন কে ডাকছে–
–আমাকে ডাকছে? কে? নাম কী? আমাকে কী করতে ডাকছে? তুই মধুকে ডাক। মধুকে ডেকে দে আমার কাছে–
মিসেস ব্যানার্জি আবার তখন অন্যদিকে ছুটে গেছে। মিসেস সামন্ত একলা-একলা দাঁড়িয়ে আছে। একলা থাকা ভালো নয়। মিসেস সামন্তর কাছে গিয়ে বললে–একলা দাঁড়িয়ে আছেন কেন, আসুন, আসুন–
বলে তাকে একদল মেয়ের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলে সকলের সঙ্গে। এই হচ্ছে মিসেস সামন্ত আর এই হচ্ছে মিসেস সিনহা, ইনি মিসেস দীক্শিত ইনি হচ্ছেন…
তারপর পাশের দিকে চেয়ে বললে–এই যে মিস্টার সামন্ত, আপনি সব পাচ্ছেন তো ঠিক? টিকিয়া কাবাব নিয়েছেন?
–নিয়েছি নিয়েছি, খুব ভালো হয়েছে—
–প্লিজ চেয়ে চেয়ে নেবেন, আমি একলা সব দিকে দেখতে পাচ্ছি না—
.
আর ওদিকে তখন পেছনের সিঁড়ি দিয়ে সদানন্দ ওপরে উঠছে। সঙ্গে হাজারি বেলিফ। সিঁড়ি দিয়ে ওপর থেকেও কেউ-কেউ নিচেয় নামছে। সকলেরই ব্যস্ততা। কারো দিকে কারো চেয়ে দেখবার সময় নেই। অসংখ্য লোক এসেছে বাড়িতে আর অসংখ্য তাদের অনুচর। অনুচরদের অবশ্য বাইরের রাস্তায় গাড়িতে বসে থাকবার কথা। কিন্তু তাদের মধ্যে কারো কারো ভেতরে আসবারও দরকার হয়। তাদেরই একজনকে ডাকলে সদানন্দ। বললে–হ্যাঁ ভাই, ওপরে ব্যানার্জি সাহেবের বউকে একবার ডেকে দিতে পারো?
–মেমসায়েব?
সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, মেমসাহেব।
লোকটা বললে–ওই ওপরে মধুকে গিয়ে বলুন–
মধু! মধু আবার কে? কিন্তু সে-সব কথা শোনবার সময় নেই তখন বেয়ারাটার। তার কাজ আছে অনেক। থিয়েটার রোডের বাড়ির বেয়ারাদের কারো বাজে কথা বলবার সময়ই নেই। সে যেমন সিঁড়ি দিয়ে নামছিল তেমনি নেমে চলে গেল।
ওপরে তখন আরো অচেনা লোকের আনাগোনা। সদানন্দ চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। এ কী সাজ-সরঞ্জাম নয়নতারার বাড়ির! জীবনে সদানন্দ এমন সাজানো বাড়ি দেখেনি। নয়নতারার সেই নৈহাটির ভাড়াটে বাড়ির চেহারাটাও মনে পড়লো। সে বাড়ি আর এবাড়ি! এ কী মেঝে, এ কী দেয়াল, এ কী আলো!