মালা বোস তখন থেকেই আছে। বলতে গেলে নয়নতারার উত্থানের ইতিহাসের শুরু থেকেই। সেও আজ এসেছে। একদিন একসঙ্গে এক অফিসে পাশাপাশি বসে চাকরি করেছে। নয়নতারার যখন এ-পাড়ায় বসতি শুরু তখন থেকেই যাতায়াত। এই এখানে বাড়ি করার সময়েও অনেক দিন এসেছে। বাড়ির প্ল্যান থেকে শুরু করে গৃহ-প্রবেশ আর তারপর নয়নদির এই সন্তান হওয়া–সবই সে দেখেছে। তারপর এখানে যতবার পার্টি হয়েছে ততবার মালাকেও নেমন্তন্ন করেছে নয়নতারা। আর মালাও প্রত্যেকবার এসে কয়েকখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছে। মালার বড় শখ শহরের গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করা। এক-একজন গণ্যমান্য লোকের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। আর সে কৃতার্থ হয়ে গেছে। তার সব চেয়ে বেশী লোভ মিনিস্টারদের সঙ্গে পরিচয় করতে।
–তুই একটা গান গা ভাই!
–গান?
গান মালা গায় বটে, কিন্তু আজকের মত এত বড় পার্টিতে গান গাওয়া সোজা নাকি? মালার কেমন ভয় করছিল। কদিন থেকেই জিজ্ঞেস করছিল–কে কে আসবে?
নয়নতারা বলেছিল–সবাই আসবে–
–সবাই মানে? যারা বরাবর আসে?
নয়নতারা বলেছিলনা, এবার ফরেন এমব্যাসির লোকদের নেমন্তন্ন করেছি। মিস্টার হেন্ডারসন আসছে, মিস্টার নবিকভ্ আসছে–
–আর!
–আর মিস্টার সেন—
–মিস্টার সেন কে?
–আমাদের চিফ-মিনিস্টার!
–সত্যি বলছো তুমি?
–সত্যি বলছি না কি মিথ্যে বলছি? সবাই জোড়ায়-জোড়ায় আসবে, দেখিস। এবারও ককটেল। এবার ভালো ড্রিঙ্কস-এর ব্যবস্থা আছে–
মালা বলেছিল–আমি ওসব খাবো না নয়নদি, আমার বড় মাথা গুলোয়।
নয়নতারা বলেছিল–প্রথম প্রথম একটু ওরকম সকলেরই হয়, প্রথম-প্রথম আমারও হতো, দু-চার দিন খেলেই দেখবি তখন কেমন ভালো লাগবে।
–কিন্তু সবাই দেখতে পাবে যে!
–কেউ দেখতে পাবে না। আমি তো কোল্ড ড্রিঙ্ক-এর সঙ্গে একটু করে জিন মিশিয়ে দেব। সবাই ভাববে তুই কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছিস–
নয়নতারার পার্টিতে বরাবরই সেই নিয়ম। মেয়েরা সফট ড্রিঙ্ক খায়, কিন্তু তার সঙ্গে একটু জিন মেশানো থাকে। যখন পার্টি শেষ হয় তখন বাড়িতে ফিরে গিয়ে বড় শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। তখন মনে হয় কালকের সন্ধ্যেটা বড় আনন্দে কেটেছে।
মালা সেদিনও এসেছিল। স্বামী মিস্টার বোসও এসেছিল। এতগুলো ভি আই পি এখানে আসবে, এ সুযোগ ছাড়বার নয়। এতে তাদের বোর্ডিং হাউসেরও ইজ্জৎ বাড়বে। কলকাতা শহরে ব্যবসা করতে গেলে কত রকম বিপদ-আপদ আসে। তা কি বলা যায়? তখন পরিচয়ের জের টেনে অনেক সুবিধে আদায় করা চলে।
হঠাৎ মিস্টার সেন এসে গেলেন। ওয়েস্ট বেঙ্গলের চিফ-মিনিস্টার। গাড়ি থেকে নামার সময় থেকেই হাতজোড় করে নমস্কারের পালা শুরু হয়েছিল। একেবারে সেই দারোয়ান থেকে শুরু করে বেয়ারা, বাবুর্চি ডিঙিয়ে শেষ-মেশ গৃহস্বামী পর্যন্ত।
–নমস্কার-নমস্কার-নমস্কার—
মিসেস ব্যানার্জি ছিল একেবারে দোতলার হলঘরে। তখন মালা বোস গান ধরে দিয়েছে। গলা কেঁপে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার যোগাড়। কী যে গাইবে তা-ই ঠিক করতে পারছিল না। নয়নতারা বললে–গা না তুই, যে কোনও একটা গান–
–রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবো? কাল একটা নতুন রবীন্দ্রসংগীত শিখেছি নয়নদি–
–বেশ তো, তা গা না। রবীন্দ্র সংগীত তো সাহেবরা খুব পছন্দ করে। টেগোর-সঙ্ বললে–সাত খুন মাপ–গা তুই, আরম্ভ করে দে–
হারমোনিয়ামটা সে তার নিজের বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিল। গান গাওয়া তো তেমন অভ্যেস নেই। তবু সময় পেলেই মাঝে মাঝে প্যাঁ-পোঁ করেছে।
মালা গাইতে লাগল–
ও নিঠুর, আরো কী বাণ তোমার তুণে আছে—
মালার স্বামী যেন কেমন বিব্রত বোধ করলে। এ কী গান আরম্ভ করলে মালা! মিসেস ব্যানার্জি পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকেই বললে–এ কী গান আরম্ভ করলে মালা, আজকে আপনার ছেলের জন্মদিন, আনন্দের দিন…অন্য গান গাইতে বলুন ওকে মিসেস ব্যানার্জি–
মিসেস ব্যানার্জি বললে–তাতে কী হয়েছে মিস্টার বোস! এও তো টেগোর-সঙ– মালা তখন চোখ বুঁজিয়ে গাইছে–
ও নিঠুর, আরো কী বাণ তোমার তুণে আছে
তুমি মর্মে আমায় হিয়ার কাছে।
মিস্টার হেন্ডারসন আর মিসেস লেন্ডারসন গায়িকার দিকে চেয়ে গান শুনছিলেন। দুজনের হাতেই গেলাস। মিসেস ব্যানার্জির নজর পড়লো সেদিকে। দেখলে গ্লাস খালি। সঙ্গে সঙ্গে কাছে গিয়ে বেয়ারার কাছ থেকে দুটো গ্লাস নিয়ে তাদের দিলে।
মিসেস হেন্ডারসন হেসে গেলাসটা নিলে।
বললে–টেগোর-সঙ
–হ্যাঁ, কেমন লাগছে আপনার?
–ভেরি গুড।
বলে আবার গায়িকার দিকে ফিরে গান শুনতে লাগলো।
মালা বোস উৎসাহ পেয়ে তখন গেয়ে চলেছে–
আমি পালিয়ে থাকি মুদি আঁখি
আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি–
–এ কী মিসেস নবিকভ, আপনার গ্লাস খালি যেন? নিন আর একটা নিন—
মিস্টার আর মিসেস নভিকভ্ দুজনেই আবার গ্লাস নিলেন। দুজনেই গান শুনছিলেন একমনে। আর শুধু কি তারা? সকলের দিকেই নজর দিতে হচ্ছে নয়নতারাকে। মিস্টার ব্যানার্জি আজকে এই উৎসবের হোস্ট। তারও নজর সব দিকে। মিস্টার আর মিসেস সামন্তও এসেছেন। এই আগের রাত্রেই এ বাড়িতে এসে তিনি যে তিন হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে গেছেন তার ক্ষীণতম চিহ্নটুকু পর্যন্তও আজ আর তার মুখে নেই। বড় আনন্দ পাচ্ছেন গান শুনে।
হঠাৎ মিস্টার আর মিসেস সেন ঘরে ঢুকতেই মিসেস ব্যানার্জি এগিয়ে গেল।