ভেণ্ডাররা তখন খালি ঝাঁকা নিকে পালাতে অরম্ভ করেছে। পরমেশ মৌলিকও আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভরসা পেলে না। আগুনটা যে কোন্ দিকে মোড় ঘুরবে তা বলা যাচ্ছে না। যতক্ষণ বেলা ছিল ততক্ষণ তবু এদিকে-ওদিকে চোখে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু তারপর অন্ধকার নেমে আসতেই সব ঝাপসা। আগুনের হলকার দাপটে কাছের মানুষকেও তখন যেন বীভৎস মনে হয়, ভয় করে।
ডাক্তারবাবু তখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে সাইকেল নিয়ে।
বেহারি পাল দূর থেকে দেখেই চিনতে পেরেছে। চিৎকার করে ডাকলে–ও ডাক্তারবাবু, কোথায় চললেন?
ডাক্তারবাবু শহরের মানুষ। এখানে পয়সা উপায় করবার জন্যে চাকরি নিয়েছিল। কিন্তু ফ্যামিলি ছিল শহরে। সেখান থেকে সাইকেলে রোজ যাতায়াত করতো। তখন বিপদ দেখে আবার সাইকেলে চেপে শহরের দিকে রওনা দিলে। বললে–আপনারাও পালান পাল মশাই, বাঁচতে চান তো পালান–
বেহারি পাল বললে–কিন্তু আমার যে বাড়ি এখানে ডাক্তারবাবু, আমি কোথায় পালাবো–
কিন্তু সে কথা আর কে শোনে! আর কেই বা তার উত্তর দেয়! কিম্বা হয়ত ডাক্তার বাবু একটা কিছু উত্তর দিলে, কিন্তু তা আর কারো কানে গেল না।
আর শুধু কি ডাক্তারবাবু, যারা ইস্কুল কলেজের মাস্টার তারাও তখন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।
তাদেরও একজনকে চিনতে পারলে বেহারি পাল। বললে–ও তারক, তারক, আগুন কে লাগালে?
তারক মাস্টার যত না ইস্কুলে পড়ায় তার চেয়ে প্রাইভেটে ছেলে পড়ায় বেশি। এক একটা ছেলেকে পাস করাতে একশো টাকা করে রেট করে দিয়েছে। তার কোচিং ইস্কুলে পড়লে সবাই পাস।
সেও ছুটছে। বললে–নকশাল–
–নকশাল মানে?
মানে আর বলা হলো না। তারক মাস্টার তখন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই তারক মাস্টার কোচিং স্কুল করে আশি বিঘে জমি, বউ-এর পঞ্চাশ ভরি সোনার গয়না, আর দোতলা পাকা বাড়ি করে ফেলেছিল নবাবগঞ্জে।
কিন্তু ওদিক থেকে কারা যেন দৌড়তে দৌড়তে ছুটে আসছে। রাত্রের অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত তাদের গতিবিধি। ওদিক থেকে এদিকে যায় আবার এদিক থেকে ওদিকে। বেহারি পাল একবার বাড়ির ভেতরে যায় আর আর-একবার বাইরে আসে। তার পাটের আড়তে যদি একবার আগুন লাগে তা হলে কী হবে!
গিন্নী ভালো করে চোখে দেখতে পায় না। কাছে এসে বললে–ওগো, দাঁড়িয়ে কী দেখছে, পুড়ে মরবে নাকি?
বেহারি পাল মশাই বললে–দশ হাজার টাকার পাট রয়েছে যে আড়তে, সেটার কী হবে?
গিন্নী বললে–তা তোমার পাট আগে না জীবন আগে?
বেহারি পাল মশাই বললে–তা হলে চলো–
–হ্যাঁ চলো, সদা যে আমাদের এমন সব্বোনাশ করবে তা কে জানতো! কে যে ওকে ইস্কুল-হাসপাতাল করতে বলেছিল এখেনে কে জানে, আমি তখনই জানতুম কাজটা ও ভালো করলে না–এ দেশের লোকের ভালো করবার জন্যে কে ওকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল!
–পালান, পালান, সি আর পি আসছে, সি আর পি আসছে, সি আর পি আসছে–
বলতে বলতে কার যেন তীরের মত অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিশ ক্রোশ দূরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যখন খবর গেল তখন নবাবগঞ্জের যা সর্বনাশ হবার তা হয়ে গেছে। সিনেমা দেখে বাড়িতে আসবার আগেই অনেকবার খোঁজাখুঁজি পড়েছে। কেউ জানে না কোথায় গেছেন তিনি। এস পি অনেকবার টেলিফোন করেছে।
–নবাবগঞ্জ? সে কোথায়?
এস পি বললে–সে এখান থেকে বিশ ক্রোশ দূরে। কলকাতা থেকে আরো পুলিস ফোর্স আনতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় টেলিফোন করা হলো। চিফ-মিনিস্টার মিস্টার সেন তখন রাইটার্স বিল্ডিং-এ কাজ সেরে উঠে পড়েছেন। এমন সময় টেলিফোন এল। টেলিফোন ধরেছে পি-এ।
পি-এ বললে–এখন তো তিনি বাইরে যাচ্ছেন কাল দিনের বেলা রিং করবেন–
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন কিন্তু খুব আর্জেন্ট দরকার, এখনি সি আর পি পাঠাতে হবে নবাবগঞ্জে–সমস্ত নবাবগঞ্জ জ্বলছে। সবাই বাড়ি ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে–
শেষ পর্যন্ত মিস্টার সেন টেলিফোন ধরলেন। বললেন হঠাৎ আগুন লাগাবার কারণটাই বা কী?
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন কারণ আমি নিজে স্পটে গিয়ে ইনভেস্টিগেট করছি। তার আগে আমার এখুনি সি আর পি ফোর্স চাই। লোকাল পুলিস পাঠানো হয়েছে, কিন্তু মনে হচ্ছে না তার কিছু করতে পারবে–
মিস্টার সেন বললেন–ঠিক আছে, আমি অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি, আপনি আজ রাত্রের মধ্যেই রিপোর্ট দেবেন, যত রাতই হোক–
বলে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন। তারপর পি-একে বললেন–আমি একবার থিয়েটার রোডে যাচ্ছি। মিসেস ব্যানার্জির বাড়িতে। টেলিফোন এলে আমাকে সেখানে রিং করবেন–
বলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
.
থিয়েটার রোডের মিসেস ব্যানার্জির বাড়িতে যখন মিস্টার সেন পৌঁছলেন তখন সেখানে অনেকেই পৌঁছে গেছে। উপলক্ষটা যা-ই হোক, সামাজিক মেলা-মেশাটাই হলো আসল। আর এই সব মেলামেশাতেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। এমনি করেই এই শহরের আরো অনেক লোক ক্ষমতার স্বর্গে উঠে চিরস্মরণীয় হয়ে উঠেছে। এমনি করেই সে-যুগে কেউ রায়সাহেব হয়েছে, কেউ বা রায়বাহাদুর হয়েছে। আর একবার ওসব হলে সে-গৌরব বংশানুক্রমিক ভাবে তোমার উত্তরাধিকারীদের ওপরেও বর্তাবে। অবশ্য সেই ব্রিটিশ আমল এখন আর নেই। না থাক, তাতে কোনও ক্ষতিও হয়নি। আমরা আমাদের নিজেদের জন্যে মানুষের সেই স্তর-বিভাগ এখনও বজায় রেখেছি। আমরা গণতন্ত্রের উপাসক হয়েও মানুষে-মানুষে বৈষম্যকে অস্বীকার করিনি। রায়সাহেব রায়বাহাদুরের বদলে আমরা পদ্মশ্রী-পদ্মভূষণ প্রবর্তন করেছি। কিন্তু সেই বৈষম্যের বেড়াজাল ভেদ করে সকলের মাথায় ওঠা কি সোজা? সেই জন্যেই তো আমি এখানে বাড়ি করেছি, এই থিয়েটার রোডে। যাতে তোমরা আমাকে নিজের স্তরে প্রমোশন দাও। আর সেই জন্যেই তো নৈহাটির মধ্যবিত্ত পরিবেশ ছেড়ে এখানে এলুম। এখানে না এলে কি তোমরাই আমার পার্টিতে আসতে? নইলে তো টালিগঞ্জ-যাদবপুর-শ্যামবাজার বাগবাজারের মত সাধারণ মানুষরাও তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের জন্মদিনের পার্টিতে সেখানে তোমাদের নেমন্তন্ন করতো। তখন?