হাজারি বেলিফ বললে–কী ভাবছে মশাই? চলুন চলুন, দেখা তো হলো, এবার চলুন, চলে যাই–
সদানন্দ বললে–কিন্তু নয়নতারার সঙ্গে দেখা না করে যাই কী করে?
–কিন্তু দারোয়ান তো আমাদের ঢুকতে দেবে না। দেখছেন না কলকাতার সব বড় বড় লোক আসছে, এখানে আমাদের মত গরীব লোকদের ঢুকতে দেবে কেন? আপনি তো আবার দাড়িটাও কামাননি–
সদানন্দ বললে–তা হোক, তবু আমি ঢুকবো, নয়নতারার সঙ্গে দেখা না করে আমি যাবোই না।
–কিন্তু যদি ঢুকতে না দেয়?
সদানন্দ বললে–আপনি আমার পেছন পেছন থাকুন, আমি যেমন করে হোক ভেতরে ঢুকবোই। আমার নাম শুনলে নয়নতারা কিছুতেই আপত্তি করবে না, একবারের জন্যে সে দেখা করবেই।
হাজারি বললে–তা হলে ওই দিকের গেটে চলুন–ওই দিকটা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করি একটু–
বলে হাজারি বেলিফ সামনে এগিয়ে গেল।
.
নবাবগঞ্জে তখনও বারোয়ারিতলার নিতাই হালদারের দোকানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বহুদিন আগে ওইখানে মাচার ওপর বসে একদিন সবাই দল বেঁধে তাস খেলেছে। কিন্তু এখন তাদের বয়েস হয়েছে। সে-যুগের মানুষ তারা, আজকের নতুন যুগের মানুষের কাছে তারা একেবারে অচেনা। এই পনেরো বছরে যারা নবাবগঞ্জে জন্মেছে তাদের অতীতও নেই, বর্তমানও নেই, হয়ত ভবিষ্যৎ নেই তাদের। কিন্তু তারা দেখছে যাদের হাতে তাদের মানুষ হবার ভার পড়েছে তারা নির্বিকার। নিয়ম করে মাইনে না পেলেই তারা মিছিল করে। তারা আকাশে ডান হাতের ঘুষি তুলে স্লোগান দেয়। আর যখন সকালবেলা স্কুলে কলেজে যায় তখন সেখানে তাদের পড়াবার বোঝাবার লোক কেউ নেই। আর তারপর যেদিন পরীক্ষায় বসে সেদিন অসহায় হয়ে পাশে বসা বন্ধুর খাতার দিকে চেয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার অক্ষম চেষ্টা করে।
কিন্তু কে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবে?
মানুষের ইতিহাসে এক-একটা যুগ যখন সমাজ-সংসারের প্রত্যেকটি মানুষ নিজেকে প্রবঞ্চনা করেই বুঝি একটা অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ লাভ করে। আর সেই প্রবঞ্চনার প্রতিযোগিতায় হেরে গেলেই তখন সবাই অত্মহননের পথ ধরে। এ-যুগটাও বোধ হয় তেমনি। প্রবঞ্চনা করতে করতে যখন ধরা পড়ে যাবার উপক্রম হয় তখন হাতের কাছে নিজের থালা বাসনটাও ভেঙে চুরমার করে দিয়ে মানুষ তার অভাবের ক্ষোভ মেটায়। জিনিস কম পড়লেই তো ফাঁকিতে সেটা পূরণ করতে ইচ্ছে হয়। এখানেও তাই হয়েছে। এই ফাঁকির কারবারে কেউ আর এখন কারো চেয়ে কম যায় না। নবাবগঞ্জের মানুষ এখন ফাঁকির প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। কলেজে পড়লেই যদি পাস করে বিদ্বান হওয়া যায় তো পাসই করবো। আর পাস করলেই যদি চাকরি পাওয়া যায় তো তাই-ই করবো। সোজা পথে পাস না করতে পারি তো ফাঁকি দিয়ে টুকে পাস করবো।
সূত্রপাতটা এখানেই হয়েছিল। তার পরে এরই ছোঁয়াচ লাগলো হাসপাতালে। রোগীদের ওষুধ দিলে তো ডাক্তারদের কিছু লাভ নেই, অথচ সেই ওষুধ বাইরে বেচলে বরং নগদ লাভ। পনেরো বছর আগে যখন নবাবগঞ্জে প্রথম হাসপাতাল শুরু হলো তখন যা ছিল আশীর্বাদ তাই-ই এখন হয়ে উঠেছে অভিশাপ!
এই অভিশাপই সেদিন হঠাৎ বুঝি বারুদ হয়ে ফেটে উঠলো।
কোথা থেকে যে দল বেঁধে কারা সব লুকিয়ে লুকিয়ে এসে জড়ো হয়েছিল তা আগে কেউ জানতে পারেনি। যখন জানলো তখন সেই অভিশাপের আগুন স্কুল আর কলেজ বাড়ি থেকে ছড়িয়ে একেবারে হাসপাতাল বাড়িতে গিয়ে ঠেকেছে। নবাবগঞ্জ যখন পুড়ে ছারখার হচ্ছে তখন দশ ক্রোশ দূরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তার বউকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেছে। কিন্তু হাতের কাছে ছিল চৌকিদার। তার ওপরে ছিল পাঁচ ক্রোশ দূরের থানা। থানা থেকে ডি এস পি, তারপর ডি এস পি থেকে এস পি।
বারোয়ারিতলায় তখন হাট বসেছিল। কলকাতা থেকে ভেণ্ডার এসেছিল দলে-দলে। তারা রেলবাজারের ইস্টিশানে নেমে যথানিয়মে সোজা চলে এসেছে নবাবগঞ্জে। নবাবগঞ্জ থেকে পাঁচ-সিকে দরের ঢ্যাঁড়স কিনে নিয়ে গিয়ে কোলে মার্কেটে আড়াই টাকা দরে বেচবে। শুধু ঢ্যাঁড়সই নয়, কুমড়ো, বেগুন, ডাঁটা, লাউ সব কিছু এখান থেকে চলে গিয়ে উঠবে শহরের বাজারে। তখন হাটও চলছিল বেশ। কিন্তু হঠাৎ হই-চই-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। আগুনের ধোঁয়া এসে নাকে লাগলো সকলের। যে-যার বাড়ি থেকে বাইরে ছুটে এল। কী হয়েছে গো? কী হয়েছে এখানে?
বেহারি পাল তখন আরো বুড়ো হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষ চোখে ভালো দেখতে পায় না। তাড়াতাড়ি আবার দোকানে ফিরে গেল। বললে–দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দাও কৈলাস, ইস্কুলবাড়িতে আগুন লেগেছে–
যেন দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করলেই আগুনকে ঠেকানো যাবে।
কিন্তু খানিক পরেই আবার খবর এল হাসপাতালে আগুন লেগেছে। তা হলে কী হবে? ও কৈলাস, ও পরমেশ, ও দীনু–
যার আছে তারই ভাবনা। যার নেই তার ভাবনাও নেই। বেহারি পালের অবস্থা তখন আরো ভালো। ছেলে নেই, মেয়ে নেই, শুধু বুড়ো আর বুড়ি। তার বাড়িটার সামনেই হাসপাতালটা। অত বড় চৌধুরীদের বাড়িটা তখন হাসপাতালে পরিণত হয়েছিল। এককালে কত জমজমাট ছিল ওই বাড়ি। শেষকালে হাসপাতাল হবার পর থেকে আরো জমজমাট হয়েছিল জায়গাটা।
কৈলাস দোকান বন্ধ করে দিয়ে বললে–আমিও একবার বাড়ির দিকে যাই পাল মশাই, আমার বাড়ির খড়ের চাল–
তা খড়ের চাল তো সকলেরই। পাকা বাড়িই যদি আগুনে পুড়তে পারে তো খড়ের চাল তো এক মিনিটের তোয়াক্কা।