হঠাৎ দারোয়ানটা হইহই করে উঠলো।
–হটো, হটো সব, হটো ইহাঁসে—
একটা রুল নিয়ে ভিড়ের দিকে এগিয়ে এল। ভিড় সরতেই একটা গাড়ি সোঁ-সোঁ করে একেবারে ভেতরের বাগানের দিকে ঢুকে গেল। বাইরের আলোর রেশ গাড়ির ভেতরে পড়তেই সদানন্দ দেখলে সেখানে একজন মহিলা বসে আছে। মানদা মাসি না? পনেরো বছর পরে দেখা, কিন্তু তবু চিনেত কষ্ট হলো না। এখন মাথার চুলগুলো একটু সাদা হয়ে গেছে, আর শাড়িটাও দামী ফরসা। গাড়ির পেছনে হেলান দিয়ে রাণীর মত বসে আছে। এত টাকা হলো কী করে তার? আর নয়নতারার বাড়িতেই বা কী করতে এল? নয়নতারার সঙ্গে মানদা মাসির সম্পর্ক কীসের? তাকে দেখেই দারোয়ান স্যালিউট করে সশ্রদ্ধ ভঙ্গি করলে। এ কী হলো! কালীঘাটের বস্তির খোলার বাড়ির সেই দ্রারিদ্র্য থেকে কীসের সিঁড়ি বেয়ে এখানে এই থিয়েটার রোডের ইজ্জতের শিখরে উঠে এসেছে সে? কীসের দৌলতে?
সঙ্গে সঙ্গে তখন আর একটা গাড়ি।
সদানন্দ অন্যমনস্ক ছিল। দারোয়নের তাড়া খেয়ে আবার পাশে সরে এল। এ কে? পাশ থেকে কে একজন বলে উঠলো-পুলিস কমিশনার সাহেব—
কিন্তু সদানন্দ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলে এ সেই সমরজিৎবাবুর ছেলে! সেই মহেশের বড়দাদাবাবু! এরা সব এ বাড়িতে এল কেন? এর কি সবাই নয়নতারাকে চেনে? নয়নতারার সঙ্গে এদের কীসের সম্পর্ক?
সদানন্দর চোখের সামনে দিয়েই গাড়িগুলো একে-একে ভেতরে ঢুকতে লাগলো। আর তার মনে হতে লাগলো সে যেন সেই পনেরো বছর আগেকার সেই নবাবগঞ্জের নিজেদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তেমনি সমারোহে, তেমনি জৌলুস। সেদিন তার বিয়ে। বিরাট একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছে সদর দরজার মাথায়। আশে-পাশের সমস্ত গ্রামের লোকজন দল বেঁধে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসছে।
হাজারি বেলিফ দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে–এখানে কী হচ্ছে দারোয়ানজী?
দারোয়ানের তখন বলবার সময় নেই। সে তখন গন্যমান্য অতিথি-অভ্যাগতদের সেলাম করতেই ব্যস্ত।
পাশে দাঁড়ানো একটা লোক বললে–পার্টি হচ্ছে–
–কীসের পার্টি?
–ছেলের জন্মদিন।
ছেলের জন্মদিন! কথাটা শুনেই সদানন্দর খুব ভালো লাগলো। ভাবতে ভালো লাগলো নয়নতারা সুখী হয়েছে, নয়নতারার সংসার করার সাধ মিটেছে। যে-সংসার সদানন্দ তাকে দিতে পারেনি সেই সংসার তাকে নিখিলেশ দিয়েছে। সদানন্দর বদলে নিখিলেশ নয়নতারার সব সাধ পূর্ণ করেছে। তা করুক, যে-কেউ একজন যে নয়নতারাকে খুশী করেছে তাতেই সদানন্দ খুশী।
হাজারি বেলিফ বললে–আপনি যে কেন দাড়ি কামান না মশাই তা বলতে পারি না। ওই দাড়ি কামান না বলেই তো আপনাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি তো সেইজন্যেই সব সময়ে পোঁটলার মধ্যে দাড়ি কামাবার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে বেরুই–
এবার হঠাৎ আর একটা বিরাট লম্বা গাড়ি এল। এমব্যাসির গাড়ি। ভেতরে যিনি বসে আছেন তিনি সাহেব। আর তার পাশে তার মেমসাহেব। শুধু সেই গাড়িখানাই নয়, আরো অনেক সাহেব-মেমসাহেব এলো। সদানন্দর মনে হলো নয়নতারা তার ছেলের জন্মদিনে সত্যিই অনেক জাঁকজমকের আয়োজন করেছে। কিন্তু সেই ‘গ্রীনপার্ক’! কার টাকায় আজকের এই উৎসব? এ কি তার দেওয়া উপার্জনের টাকা! গ্রীন পার্কের টাকা যদি না হবে তবে এ বাড়িতে সেই মানদা মাসি আসবে কেন? মানদা মাসির সঙ্গে এ বাড়ির কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠবে কেন?
সমস্ত জিনিসটাই কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হলো সদানন্দর কাছে। যে-কলকাতায় এত ভিখিরি, যে কলকাতায় এত অভাব, এত অভিযোগ সে কলকাতায় ছেলের জন্মদিনের উৎসবে এত ঘটা কেন? এত অপব্যয়, এত অপচয় কেন?
এক-একটা করে গাড়ি আসছে। দারোয়ানজী সেলাম করছে গাড়ির আরোহীদের। আর দর্শকরা গেটের দু-পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির ভেতরের ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যটা আঁচ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু এই ঐশ্বর্যের বিলাসবাহুল্য বাইরের লোকের কাছে প্রদর্শনী করবার জন্যেই কী সেদিন নয়নতারাকে অত টাকা দিয়েছিল সদানন্দ? সদানন্দ কী তার দেওয়া অর্থের এই ব্যবহারই আশা করেছিল নয়নতারার কাছে?
সঙ্গে সঙ্গে নবাবগঞ্জের সেই দূর থেকে দেখা দৃশ্যটার কথাও মনে পড়ল সদানন্দর। এ কী হলো! মানুষ মানুষ হোক এই চিন্তাই তো সে করেছিল সেদিন। কখনও তো সে বলেনি যে আমার ইচ্ছে অনুযায়ীই তোমাদের এই সমাজ চলুক। অর্থটাকে উপকরণ মাত্র হিসাবেই তো মনে করেছিল সে। চেয়েছিল সেই উপকরণ ভাঙিয়ে মানুষের জীবনধারণের সমস্যাই শুধু মিটুক। উপকরণটাই প্রধান হোক এটা তো সে চায়নি। অর্থের অভাবের জন্যে মানুষের সমস্ত সৎ প্রচেষ্টা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলেই সকলের অভিযোগ ছিল। কারো চাই বিদ্যা, কারো চাই মুক্তি কারো চাই সেবা। আবার কারো চাই জ্ঞান। এই সমস্ত কিছু অধিগত করবার জন্যেই তো চাই অর্থ! যেমন অন্ন! অন্ন তো ভক্ষণ করবার জন্যেই। অন্ন গলাধঃকরণেই তো অন্নের আসল উপযোগিতা। কিন্তু তা না করে যদি কেউ তার শরীরে অন্ন মাখে তা হলেই তো তাকে উচ্ছিষ্ট হওয়া বলে! নবাবগঞ্জে তার দেওয়া অর্থ যেমন সমস্ত গ্রামকে উচ্ছিষ্ট করেছে, নয়নতারার বাড়িতেও যে তাই! এখানেও যেন মনে হচ্ছে নয়নতারার ঐশ্বর্য নয়নতারাকে উচ্ছিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু এই-ই কী সদানন্দ চেয়েছিল?
সদানন্দ যত ভাবলো ততই তার কষ্ট হতে লাগলো।