.
কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না যে তার বংশধর তার ফুলসজ্জায় শোবার ঘরের দরজা সবার দৃষ্টির অগোচরে বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উন্মুক্ত আকাশের তলায় একদিন আবার তার কন্টকশয্যাও পাতবে। তখনও তিনি জানতেন না যে বহুকাল পরে একদিন তার পৌত্র থিয়েটার রোডের একটা নতুন বাড়িতে এসে নতুন করে আবার তার ফুলশয্যা পাবে। হ্যাঁ, ফুলশয্যাই তো। নয়নতারার থিয়েটার রোডের বাড়িতে ফুলশয্যার আয়োজনই তো হয়েছিল। যত ছিল মদের আর খাবারের আয়োজন, ফুলের আয়োজনও তার চেয়ে কিছু কম ছিল না।
সেই সেদিন কলকাতার আর এক প্রান্ত থেকে তখন নরনারায়ণ চৌধুরীর বংশধর ঠিক তেমনি করেই হেঁটে আসছে। সঙ্গে হাজারি বেলিফ। হাজারি বেলিফ শেয়ালদ’ স্টেশনে নেমেই তাড়াতাড়ি পোঁটলা থেকে ক্ষুর বার করে দাড়িটা কামিয়ে নিয়েছে!
কিন্তু যত দক্ষিণে এগোতে লাগলো ততই সুন্দর সুন্দর রাস্তা, ততই বড় বড় বাড়ি। এদিকে আর কোথাও ভিখিরির উৎপাত নেই। এদিকে আর বড়বাজারের শেয়ালদার মত চিৎকার কোলাহল নেই।
সদানন্দ বললে–এদিকটা তো বেশ নিরিবিলি হাজারিবাবু, এদিকে তো আর ভিখিরির উৎপাত নেই–
হাজারি বললে–কী বলছেন মশাই, এদিকে ভিখিরি নেই? এ-পাড়ায় যত ভিখিরি আছে তত ভিখিরি দুনিয়াতে নেই, তা জানেন?
–তাই নাকি?
আরে মশাই এরা যে হচ্ছে অন্য রকমের ভিখিরি!
সদানন্দ বললে–তার মানে?
–আমি কোর্টের বেলিফ, আমি যে এদের সবাইকে চিনি। এদের নামেও যে হুলিয়া আছে।
–তাই নাকি। তা এদের তুমি সমন ধরাও না কেন?
হাজারি বললে–কেন সমন ধরাবো মশাই? তাহলে আমার পেট চলবে কী করে? এরা যে আমাকে দু-চার পাঁচ টাকা করে ঘুষ দেয়, আর আমিও কোর্টে গিয়ে রিপোর্ট দিই আসামী বেপাত্তা। তাতে এরাও বাঁচে আমিও বাঁচি। আর সঙ্গে সঙ্গে হাকিম পেসকার উকিল মোক্তার অ্যাটর্নী পেয়াদা সবাই-ই বাঁচে–
সদানন্দ বললে–তা তুমি কী করে জানলে এরাও ভিক্ষে করে?
হাজারি বললে–তা জানবো না? এদের বাড়িতে যে আমাকে রোজ আসতে হয়। আমি যে নিজের চোখে দেখেছি মশাই এরা জাত-ভিখিরি।
–তাই নাকি?
–হ্যাঁ, এরা ও-পাড়ার লোকেদের মত পয়সা ভিক্ষে করে না। এদের অল্প পয়সাতে পেট ভরে না তাই এরা লাখ-লাখ টাকা ভিক্ষে চায়। এরা বাড়ি ভিক্ষে করে, গাড়ি ভিক্ষে করে, মেয়েমানুষ ভিক্ষে করে, পারমিট লাইসেন্স আর পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ ভিক্ষে করে, এরা কি ভাবছেন ওদের মতন ছোটলোক ভিখিরি?
তারপর পাশের একটা বাড়ির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে-এই দেখুন, এই যে দেখছে বাড়িটা, এটাও একটা ভিখিরির বাড়ি, এর নাম ‘গ্রীন পার্ক’–
–‘গ্রীন পার্ক’ মানে?
–এখানে টাকা আর মেয়েমানুষের ভিক্ষে চলে। এর ভেতরে গেলে দেখবেন সার-সার সব ঘর। এটা হচ্ছে ব্যানার্জি সাহেবের নিজের ভিক্ষের জায়গা। এখানে মেয়েমানুষ লেলিয়ে দিয়ে নিজে টাকা ভিক্ষে করতে আসে ব্যানার্জি সাহেব। আসলে ব্যানার্জি সাহেবই এর মালিক কিন্তু দেখাশোনা করে সব মানদা মাসি–
–মানদা মাসি! নরনারায়ণ চৌধুরীর বংশধর চমকে উঠলো। নামটা যেন বড় চেনা চেনা ঠেকলো। মানদা মাসি যে তার চরণপূজো করেছিল, সে এখানে এল? কেন এখানে এল কী করে?
–আসুন, আসুন মশাই এখান থেকে।
সদানন্দ তবু ছাড়লে না। বললে–কেন চলে আসবো, আপনি আগে বলুন এখানে কী হয়?
হাজারি বেলিফ বললে–মশাই আপনার সঙ্গে আমি আর তক্কো করতে পারবো না, তার চেয়ে আমাকে না-হয় তিনটে টাকা দিন, আমি চলে যাচ্ছি–আমার কাজ নেই সমন ধরিয়ে–
বলে আগে আগে চলতে লাগলো। সদানন্দও চলতে লাগলো পেছন পেছন। আরো এগিয়ে গিয়ে আর একটা রাস্তা। তারপরে আরো একটা। তারপরে আবার আর একটা বড় রাস্তা। চলতে চলতে যেন সারা বিশ্বটাই তারা প্রদক্ষিণ করে চলেছে।
হাজারি বেলিফ বললে–আর তো হাঁটতে পারছিনে মশাই, আর কত দূর–?
সদানন্দ বললে–এইবার এসে গেছি, এই তো সামনেই–
সামনেই একটা জায়গায় গাড়ির ভিড় আছে এ-ধার থেকে ও-ধার পর্যন্ত। একটা বাড়ির সামনে অনেকগুলো আলো জ্বলছে। রাস্তার অনেকখানি জায়গা জুড়ে আলোয় আলো হয়ে গেছে। ওই-ই তো থিয়েটার রোড। এই-ই বোধ হয় নয়নতারার বাড়ি।
গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সদানন্দ। অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে একজন দারোয়ান। আশেপাশে আরো অনেক লোক। সব রাস্তার লোক মজা দেখতে দাঁড়িয়েছে।
সদানন্দ সামনে যেতেই দারোয়ানটা হাটিয়ে দিলে–এধার থেকে সরে যাও, হাটো, সব হাটো, দূর হাটো–
হাজারি বেলিফও পেছনে ছিল। সেও সরে দাঁড়ালো। পাশের একজন লোককে জিজ্ঞেস করলে–এ কার বাড়ি ভাই? কোন সাহেবের বাড়ি এটা?
রাস্তায় একটু ভিড় দেখলেই যারা দাঁড়িয়ে পড়ে লোকটা তাদেরই দলের। সেও বোধ হয় মজা দেখতেই এসে দাঁড়িয়েছিল।
বললে–এটা তো ব্যানার্জি সাহেবের বাড়ি–
ব্যানার্জি সাহেবের বাড়ি কথাটা কানে যেতেই সদানন্দ একটু সচেতন হয়ে উঠলো। তা হলে এইই নয়নতারার বাড়ি! সদানন্দ চারিদিকে ভালো করে চেয়ে দেখলে। এত বড় বাড়ি! এত বিলাস, এত ঐশ্বর্য! সদানন্দ মনে মনে খুশি হলো। ভালোই হয়েছে। নয়নতারার তা হলে আর কোনও অভাব অনটন নেই। এখন সচ্ছল সংসার। কিন্তু এ কীসের উৎসব এ বাড়িতে? এত অতিথি অভ্যাগত কীসের আকর্ষণে?
সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। কেউ ভেতরে যেতে দেবে না তাকে। আজকে এ বাড়ির ভেতরে তার জন্যে প্রবেশ নিষেধ। তবু একবার নয়নতারার সঙ্গে দেখা হলে ভালো হতো। একটু শুধু দেখা করে যেত। একটু শুধু জিজ্ঞেস করে যেত কেমন আছে সে? কী তার সর্বনাশ করেছে সে! জীবনের সর্বস্ব দিয়ে কী অপরাধ সে করেছে তার কাছে! নইলে তার বিরুদ্ধে এই অযৌক্তিক অভিযোগ!