কিন্তু সকলের আড়ালে থাকে মানদা মাসি। মানদা মাসিই বলতে গেলে এই গ্রীন পার্কের চাবিকাটি। আসলে বস্তির ব্যবস্থা আর এই পার্ক স্ট্রীটের ব্যবসায় কোনও তফাৎ নেই। সেই কালীঘাটের মেয়েদেরই সাজ-পোশাক পরিয়ে পরিয়ে কড়া ইলেকট্রিক আলোর তলায় দাঁড় করিয়ে দিলেই তাদের আবার তখন অন্য রকম চেহারা হয়ে যায়। আগে যাদের রেট ছিল এক টাকা, তারাই এখানে এসে ঘণ্টায় একশো টাকা দর হাঁকে। তারাই কেউ চীনে মেয়ে সাজে, কেউ কাশ্মিরী, কেউ বা মেমসাহেব।
এ ছাড়া যদি অন্য কিছু চাও তাও পাবে। বেঁটে লম্বা রোগা পাতলা, এক-একজন ভদ্রলোকের ছেলের এক-এক রকম পছন্দ। কাঠের পার্টিশান দেওয়া সব ঘর। আব্রুর ব্যবস্থা ভালো। কারো সঙ্গে কারো দেখা হবার ভয় নেই। ফেল কড়ি মাখো তেল। বাঁধা মেয়াদ সকলের। তারপর তোমার মেয়াদ ফুরোলেই তোমার ঘর খালি করে দিতে হবে।
ঘণ্টায় ঘণ্টায় ক্যাশ টাকা নিয়ে এসে ম্যানেজার জমা করে মানদা মাসির কাছে। এক একদিন জমে তিন হাজার, এক-একদিন চার হাজার। পাঁচ হাজারে গিয়েও এক-একদিন ঠেকে। পালে-পার্বণে বাড়ে। যেমন দুর্গা-পুজো। দুর্গাপুজো আর বড়দিনেই ‘গ্রীন-পার্কে’র মরসুম। তখন আবার কলকাতার বাইরে থেকেও লোক আসে। সোজা দিল্লী বোম্বাই থেকে লোক আকাশ দিয়ে উড়ে এসে নামে কলকাতায়। তখন মানদা মাসির আর নাইবার খাবার সময় থাকে না। অত টাকার হিসেব কি সোজা কথা!
কিন্তু টাকা বড় নচ্ছার জিনিস। বিশেষ করে ক্যাশ টাকা। ক্যাশ টাকার হিসেব যদি যখনকার তখন নগদনগদ না করা যায় তো সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। তাই সাহেবকে বলা আছে। প্রতিদিন সন্ধ্যেয় মানদা মাসি নিজের গাড়ি করে নিজের হাতে একেবারে ব্যানার্জি সাহেবের কাছে গিয়ে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসে।
ব্যানার্জি সাহেব অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে ওই টাকার জন্যে। হিসেবের খাতাটাও সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। কারবারের আধাআধি বখরার পাই-পয়সাটাও পর্যন্ত সব বুঝিয়ে দিতে হয় সাহেবকে। এমন কি মদের বিল পর্যন্ত।
সেদিন হঠাৎ টেলিফোন এল–কোথায়? মাসি কোথায়?
গলা শুনেই ম্যানেজার বুঝতে পারে। সোজা লাইনটা একেবারে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়।
মাসি লাইনটা পেয়ে বলে-হ্যালো–
ওদিক থেকে সাহেবের গলার শব্দ আসে–কিছু টাকা দরকার ছিল, এই হাজার পাঁচেকের মত।
–এক্ষুনি?
সাহেব বলে–হ্যাঁ, এখানে পার্টি বসে আছে–এখন কত কালেকশান হয়েছে?
–তিন হাজারের মত হয়েছে।
–ঠিক আছে, এখন তিন হাজারের মত হলেই চলবে। আমি বসে আছি—
সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার নিজে ব্যানার্জি সাহেবের বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসে। ব্যানার্জি সাহেবের সামনে তখন কে একজন বসে ছিল। ভারি সম্ভ্রান্ত চেহারা। ম্যানেজার চলে যেতেই টাকাটা নিয়ে সোজা ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিলেন মিস্টার ব্যানার্জি।
ভদ্রলোক টাকাটা পকেটে পুরতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিস্টার ব্যানার্জি ছাড়লেন না। বললেন মিস্টার সামন্ত, টাকাটা গুনে নিন, প্লিজ–
মিস্টার সামন্ত বললেন–সে কী, আপনি যখন দিচ্ছেন তখন..
মিস্টার ব্যানার্জি বললেন–তা হোক, আপনি আমার বন্ধু হতে পারেন, কিন্তু বিজনেস ইজ বিজনেস–
অগত্যা মিস্টার সামন্ত টাকাগুলো এক-একটা করে গুনে নিয়ে উঠলেন। বললেন–হ্যাঁ, ঠিক আছে–ও কে–একটা সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা পের্টিকো। তাঁর গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ কানে এল। দারোয়ান গেট খুলে দিতেই গাড়িটা ধোঁয়া ছেড়ে বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে গেল।
নয়নতারা তখনও জেগে ছিল। নিখিলেশ ঘরে ঢুকতেই বললে–কী হলো, চলে গেছে!
নিখিলেশ বললে–হ্যাঁ আপদ গেছে, তিন হাজারের কম ছাড়লে না। বললে খুব টানাটানি চলছে। আর আমিও ভাবলুম পুলিসকে চটিয়ে লাভ নেই-
নয়নতারা বললে–যাক গে শুয়ে পড়ো, কালকে আবার পার্টি আছে–
ঘরের আলো নিভে গেল। সমস্ত নবাবগঞ্জ ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু অন্ধকার ঘরেও কর্তাবাবুর চোখে ঘুম নেই। হর্ষনাথ চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। বংশী ঢালী তার কাজ নিঃশব্দে সমাধা করেছে। আর কোনও ভাবনা নেই। কাল প্রথমেই পার্টিতে চিফ মিনিস্টার মিস্টার সেনকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে, ইউ-এস-এর মিস্টার হেন্ডারসনকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে, মসকোর মিস্টার নাভিককেও নেমন্তন্ন করা হয়েছে, সকলেই মিসেসদের নিয়ে আসবে। নবাবগঞ্জের কাউকেই আর নেমন্তন্ন করতে বাকি নেই। যত ভি-আই-পি আছে সবাইকেই। এমন কি একটু আগেই যে লোকটা তিন হাজার টাকা নিয়ে চলে গেল সেই মিস্টার সামন্তও মিসেস সামন্তকে নিয়ে আসবে!
হঠাৎ চৌধুরী মশাই এল।
কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কে?
চৌধুরী মশাই বললেই–আমি—
কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কী খবর? খোকা পালায়নি তো?
–না, খাওয়া-দাওয়ার পর বউমার ঘরে শুতে ঢুকিয়ে দিয়ে আমরা চলে এসেছি–কর্তাবাবু তাতেও নিশ্চিন্ত হলেন না। জিজ্ঞেস করলেন–কিন্তু ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে কিনা তাই বলল না, খিল দিয়েছে?
–হ্যাঁ।
যাক, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলেন কর্তাবাবু। আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। একদিন নিখিলেশ মদের দোকানে পিকেটিং করে জেলে গিয়েছিল। পুলিসের লাঠি খেয়েছিল। অনেক দিন ধরে অনেক দুঃখ ছিল তার। দেশ স্বাধীন হবার পর সকলের সব কিছু হলো, শুধু তারই কিছু হলো না। এবার সে-দুঃখ গেল। এবার আর কোনও দুঃখ নেই। এবার কর্তাবাবুর নাতি তার ফুলশয্যার রাত্রে শোবার ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে। এবার নতুন বউমার রূপ দেখে সে ভুলে যাবে। এবার নরনারায়ণ চৌধুরী তার পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে বংশপরম্পরায় অমর হয়ে থাকবেন, অনন্তকাল ধরে নিজের রক্তের ধারার মধ্যে অখণ্ড পরমায়ু লাভ করবেন। তিনি অক্ষয়, অব্যয় অজর-অমর হয়ে বিরাজ করবেন।