কিন্তু মানুষের উচ্চাভিলাষ থাকলে যে একদিন মানুষ কোথায় উঠতে পারে এই পার্ক স্ট্রীটের বাড়িটাই তার প্রমাণ। এইজন্যে মানদা মাসি কত লোককে কত খোশামোদ করেছে। একটা একটা করে মানদা মাসি পয়সা জমিয়েছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ভবিষ্যতের অভাবের কথা ভেবে নয়, আসলে ভবিষ্যতের প্রাচুর্যের কথা ভেবেই। সেই খোলার বস্তির ঘরের ভেতরে শুয়ে শুয়ে মানদা-মাসি স্বপ্ন দেখতো কবে সেই খোলার বাড়িটা এতদিন পাকা বাড়িতে রুপান্তরিত হবে। মেয়েরা সেজেগুজে সোফার ওপর বসে থাকবে। আর বড় গাড়ি এসে দাঁড়াবে সামনে। সেই গাড়ি থেকে বড় বড় লোকের ছেলেরা নামবে আর তাদের গা থেকে ভুর ভুর করে বিলিতি আতরের গন্ধ বেরোবে।
আর সেই জন্যেই মানদা মাসি কত খোশামোদ করেছে বাতাসীকে। বাতাসীর পা পর্যন্ত টিপে দিতে কসুর করেনি মানদা মাসি। ভেবেছিল বাতাসী অন্তত বড়বাবুকে বলে একটা টাকা পাওয়ার সুরাহা করে দেবে। হাজার হোক পুলিসের বড়বাবু তো!
কিন্তু কপাল! আমি যাই বঙ্গে তো কপাল যায় সঙ্গে। সেইবাতাসীর শেষকালে কী না হলো? ওরই নাম হলো কপাল। সেই বড়বাবু শেষকালে চাকরিতে আরো বড় হলো। বড়বাবুর বাপ মরে গেল। কত চাকর বাকর। সেই বাতাসীরই আবার কত খোয়াব শেষকালে। এক গেলাস জল পর্যন্ত গড়িয়ে খেতে হতো না তাকে। বড়বাবুর যখন আরো পয়সা হলো তখন মটরগাড়ি করে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেত। এমন কী একটা সতীন ছিল সেও একদিন গলায় দড়ি দিয়ে মরলো।
ওরই নাম হলো কপাল। কোথায় ছিল কোন্ বস্তিতে, আর কার হাতে পড়ে একে বারে রাতারাতি রাজরাণী হয়ে গেল।
আর মানদা মাসি!
মানদা মাসি তখনও যে-কে সেই। তার তখনও সেই আগেকার দুর্দশা। তখনও সেই খোলার ঘরে বস্তিতে দিশী মেয়ে আর দিশী মাল নিয়ে কারবার করে তাকে পেট চালাতে হয়।
ঠিক সেই সময়ে একদিন একটা অফিসের কেরানী এক বন্ধুকে নিয়ে এসে হাজির হলো। তার নামটাও আজ আর তেমন মনে নেই। শীতেশ না কী যেন নাম ছিল তার।
শীতেশ বললে–আমার এক বন্ধুকে এনেছি মাসি–
–বন্ধু? বন্ধুকে এনেছ তো ভালোই করেছ, তা কার ঘরে বসবে তোমরা?
শীতেশ বললে–বসতে আসিনি মাসি আজকে। আমার এই বন্ধু ব্যবসা করতে চায়, তা আমি বলেছি তোমার ব্যবসা বুদ্ধি খুব আছে, তোমার এ ব্যবসায় লাভ-লোকসান কী সেই সব শুনতে চায়। একে একটু বুঝিয়ে বল তো তুমি–
মাসি জিজ্ঞেস করলে–তোমার নাম কী বাবা?
ছেলেটা লাজুক খুব। বললে–অমার নাম নিখিলেশ, নিখিলেশ ব্যানার্জী।
বেশ নামটা। নামটা মনে ছিল মাসির। কিন্তু খানিকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারলে টাকা তার তেমন নেই। ধার-ধোর করে বড়জোর হাজার পাঁচেক টাকা তুলতে পারে। অর্থাৎ বাজিয়ে দেখতে চাইছিল কোন কারবারে কত লাভ। মেয়েদের বোর্ডিং-হাউস করলেই বা কত লাভ, আর এই ব্যবসাতেই বা কত। হিসেবপত্র করে মাসি সেদিন প্রমাণ করিয়ে দিয়েছিল যে তেমন করে সাহেব পাড়ায় এই ব্যবসা করলে টাকায় দশগুণ লাভ। মানে এক টাকায় দশ টাকা।
কথাটা শুনে ছেলেরা চলে গিয়েছিল। মাসি ভেবেছিল আর আসবে না তারা, আর এ পথ মাড়ারে না।
কিন্তু আশচর্য! সত্যিই, আশ্চর্য না আশ্চর্য!
তার তিন মাস পরেই একদিন সেই খোলার বস্তির সামনে সদর রাস্তায় একটা মস্ত গাড়ি এসে হাজির। বলতে গেলে গাড়ি করে সে-পাড়ায় কোনও লোক আসতো না। কালীঘাটের খদ্দেররা সবাই-ই ছোটলোক।
কিন্তু তখন মাসি কল্পনা করতেও পরেনি। গাড়ির ড্রাইভার এসে খবর নিলে, মানদা মাসি নামে ইহা কোই হ্যায়?
মানদা মাসি বললে–হ্যাঁ বাছা, আমারই নাম মানদা।
ড্রাইভার বললে–সাহেব আপনাকে একবার ডাকছে—
–সায়েব? কে সায়েব? কোথায় তোমার সায়েব?
–গাড়িমে। বলে বড় রাস্তায় গাড়িটা দেখিয়ে দিলে ড্রাইভার।
মানদা মাসি তখনও বুঝতে পারেনি। তার কাছে আবার গাড়িতে কে আসতে যাবে! তখন বেশ অন্ধকার চারিদিকে। গলিটা পেরিয়ে বড় রাস্তার ওপর গাড়িটার কাছে গিয়েও চিনতে পারেনি।
–আমায় চিনতে পারছো মাসি?
মানদা মাসি বারবার করে চেহারাটা দেখেও চিনতে পারলে না।
–চিনতে পারলে না? শীতেশকে মনে আছে? সেই রোগা লম্বা মতন?
–হ্যাঁ হ্যাঁ। তা সে কোথায় বাবা?
–সে মরে গেছে। একদিন হার্ট-ফেল করে মরে গেছে। তা আমি অনেক দিন আগে তার সঙ্গে তোমার এখানে এসেছিলুম। আমার নাম নিখিলেশ। নিখিলেশ ব্যানার্জি। এখন মনে পড়েছে তো?
অনেক কষ্টে মনে পড়লো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সেই যারা একদিন অফিসে কেরানী-গিরি করতো, তাদের এরকম গাড়ি হলো কী করে সেটা বুঝতে পারলে না।
–তুমি আমার সঙ্গে একবার যেতে পারবে মাসি?
মানদা মাসি বললে–কোথায়?
–যেখানে হোক, এখানে বসে কথা হবে না, একটা নিরিবিলি কোনও জায়গায় বসে তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই। যে ব্যবসার কথা বলেছিলুম সেই ব্যবসা সম্বন্ধেই পরামর্শ করতে চাই–আমার সঙ্গে একবার চলো না এখন।
তা, সেই হলো সূত্রপাত। যে-মানুষটার কাছে একদিন পাঁচ হাজার টাকাও ছিল না, সেই মানুষটাই একদিন এক কথায় পঞ্চাশ হাজার টাকা বার করে দিলে। আর তারপরেই পার্ক স্ট্রীটের পাড়ায় একদিন গড়ে উঠলো এই ‘গ্রীন-পার্ক’। গ্রীন-পার্কে দিনের বেলা কিছু ব্যতিক্রম বোঝবার উপায় নেই। আশে-পাশের আরো দশটা অফিস বাড়ির মত এর চেহারা। কিন্তু সন্ধ্যের পর থেকেই এ বাড়ি যেন নেশা করে। নেশায় একেবারে টলতে থাকে। তখন নানা রং-বেরংএর গাড়ি এসে সামনের রাস্তায় দাঁড়ায়। তখন বড় বড় গণ্যমান্য ভদ্রলোকেরা লিফট দিয়ে ওপরে উঠে আসে। দরজার মুখে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের প্রথমে হাজির হতে হয় ম্যানেজারের কাছে। ম্যানেজার যেমন যেমন হুকুম দেয় তেমনি হুকুম তামিল হয়। কেউ চায় কালো, কেউ চায় ফর্সা, কেউ চায় নেপালী, কেউ চায় কাশ্মীরী, আবার কেউ চায় মেমসাহেব। ইংলিশ জার্মান ফ্রেঞ্চ মেমসাহেব। সব জাতের মেয়েমানুষের ব্যবস্থা আছে। ‘গ্রীন-পার্কে’।