কিন্তু অসহায়ের প্রতি এই করুণাকে বড় ভয়ের চোখে দেখেছেন দস্তয়েফস্কি। বলেছেন, নায়কের প্রতি পাঠকের করুণার উদ্রেক হলে তার অন্তর্নিহিত সত্য স্বরূপ করুণার নিচে চাপা পড়ে যায়। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পাঠক তথা সমস্ত আয়োজনটাই তাঁর পণ্ড হয়ে যায় তখন।তাই হুগোর ‘horrible beauty’ হয়েট-এর ‘terrible beauty’র চেয়ে ‘grotesque beauty’-র মধ্যেই দস্তয়েফস্কি দেখলেন “avenue to spiritual reality in art.”
Positive good man-এর প্রসঙ্গে আর্টে রিয়ালিজমের প্রশ্ন যখন এল তখনই এর good man চরিত্রে জটিলতা দেখা দিল। চরিত্র থেকে বাদ চলে গেল নির্বুদ্ধিতা ও ভঁড়ামির। অংশটা, যুক্ত হল মনুষ্যোচিতদুর্বলতা আর উৎকেন্দ্রিকতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই জটিল Positive good man চরিত্রটির সফল চিত্র যিনি আমাদের প্রথম উপহার দিলেন তার নাম দস্তয়েফস্কি। চরিত্রটি ইডিয়ট’-এর প্রিন্স মিসকিন। সেই থেকে এই পজিটিভ চরিত্রে হাত দিয়েছেন অনেকেই, সফলও হয়েছেন কোন কোন লেখক, অবশ্য ততদিনে সাহিত্যও তার কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন করেছে। যুদ্ধ আর এটম বোমার আঘাতে মানুষের বিশ্বাস গেছে চূর্ণবিচূর্ণ ইয়ে, নিরবলম্ব মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে একটা চাপিয়ে দেওয়া অনিচ্ছার বোঝা, বেঁচে। থাকা হয়ে উঠেছে এক হাস্যকর অবাস্তব ব্যায়াম। এই চিন্তার প্রতিফলক-সাহিত্যে জীবন নেতিবাদের অন্ধকারে তার নিজস্ব চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। তবু তারই মধ্যে মাঝে মাঝে ক্ষণপ্রভার মতন দু’একটি পজিটিভ চরিত্র আমাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। তেমনই একটি চরিত্র ১৯৫৯ সালের রচিত ইয়োনেসকোর নাটক ‘রাইনোসেরাস’ (গণ্ডার) এর নায়ক বেরেজের। বন্ধু, সমাজ, শেষ পর্যন্ত স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে তবু আত্মসমর্পণ করে নি বেরেজের। অবমানুষ হবার বিরুদ্ধে শেষ অবধি সে একলা লড়াই করে গেছে। একা লড়াইতে ফাঁকি থাকে না। তাই পজিটিভ চরিত্রে কঁকির অবকাশ নেই। আর realism-এ ফকির সুযোগই বা কোথায়!
পজিটিভ চরিত্র নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনার আগে এই realism কী ব্যাপার তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, “রাজাবদল”-এর গৌর পণ্ডিত মশায়, “শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন”-এর লোকনাথ এবং “আসামী হাজির”-এর সদানন্দ বিভিন্ন কোণ থেকে আমাদের মনে যে ছাপ ফেলেছে, সে আসলে একটি মানুষেরই ছাপ, সে মানুষ ‘a positive good man’! এই যে সাধারণ মানুষ থেকে বেছে অন্য একটি সাধারণ মানুষ খুঁজে বের করা যে সর্বপ্রকারে সাধারণ হয়েও উৎকেন্দ্রিকতাবশত অ-সাধারণ, দস্তয়েফস্কি বলেছেন এটাই আর্টে realism in a higher sense অর্থাৎ “to find the man in a man.”
বিখ্যাত সমালোচক কনসট্যানটিন মাচুল্ স্কি realism-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন,…the new reality created by the artist of genius, real, because, it reveals the very essence of existence.
এখানে বলা দরকার realistic আর realism-এ পার্থক্য আছে। Realistic লেখা হচ্ছে। বাস্তবের ফটোগ্রাফিক অনুকৃতি (কার্বন কপি)। Reality in art অন্য ব্যাপার। এখানে লেখক সংসারে সমাজে নিত্য ঘটা ঘটনার বিবৃতি মাত্র দেন না, তিনি অনুরূপ ঘটনা নির্মাণও করেন। সে ঘটনার ভাষ্যের ভিতর দিয়ে একটি চরিত্র ক্রমাগত বিশিষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক বাস্তবতায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু উত্তীর্ণ হওয়ার কথা যত সহজে বলা হল ব্যাপারটা তত সহজ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কথাশিল্পের সমস্ত সম্ভাব্য দিকগুলো। বিশেষ করে ভাবতে হবে কী ভাবে বলব। যে ভাবে বললে–idea ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত হয়ে ওঠে, কাহিনীর শেষে নায়কের গা থেকে ঘটনার নামাবলী খসে গিয়ে নিঃসঙ্গ সেই নিরাবরণ মানুষটি পাঠকের মনের দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে থাকে তাকেই বলি সার্থক রচনা। কিন্তু সে বড় সহজ কাজ নয়। ত য় তার War and peace শেষ করে ডায়েরীতে লিখেছিলেন–I cannot call my composition a tale, because, I do not know how to make my characters act only for the sake of proving or clarifying any one idea or series of ideas.
তল্স্তয় যা পারেন নি বলে বলেছেন এক্ষেত্রে ‘আসামী হাজির’-এর লেখক কিন্তু তা পেরেছেন। তিনি তাঁর প্রতিটি ঘটনাকে একটি মুল ঘটনার মধ্যে কেন্দ্রীভূত করেছেন এবং একটি প্রত্যয়কে প্রমাণ অথবা প্রাঞ্জল করার জন্যে সব চরিত্র ও ঘটনা সেদিকে সক্রিয় করে তুলেছেন। ঘটনাগুলো বহু শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হতে হতে চতুর্দিক থেকে এগিয়ে এসে শেষে উদ্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে লয় পেয়েছে। এইভাবেই নিজস্ব প্যাটার্ন ও টেকচারের টানাপড়েনে ‘আসামী হাজির’-এর লেখক তার ফিশনাল য়ুনিভার্স অর্থাৎ কাহিনীর বিশাল জগৎ গড়ে তুলেছে। এই বাবদে তিনি বালজাক, ডিকেনস, গোগোল, দস্তয়েফস্কির সঙ্গে তুলনীয়। বিশেষ করে grotesque beauty প্রসঙ্গে দস্তয়েফস্কি তো অবশ্যই। পজিটিভ গুড ম্যান-এর চরিত্র থেকে যখন ব্যঙ্গাত্মক অংশটা বাদ দেওয়া হল, যোগ করা হল উৎকেন্দ্রিকতা, তখনই ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনার শূন্যস্থান পূর্ণ করল অনৈসর্গিক উপস্থাপনা। যেমন ‘শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন’-এ নায়ক লোকনাথ ঈশ্বরের সঙ্গে তর্ক করছে। যেমন ‘আসামী হাজির’-এ সদানন্দ তার দ্বিতীয় সত্তাকে অর্থাৎ হাজারি বেলিফকে খুন করেছে। এইসব অনৈসর্গিক ঘটনার সন্নিবেশ দেখেই সেকালের দস্তয়েফস্কিকে এবং একালের বিমল মিত্রকে অনেক সমালোচক অতিরঞ্জনের দোষে অভিযুক্ত করেছেন; কিন্তু এ দোষ যে দোষ নয় বরং বিশেষ এক ধরনের গুণ দস্তয়েফস্কিই তার জবাব বেঁচে থাকতে দিয়ে গেছেন। যাদের তা মনে নেই কিংবা যাঁরা তা জানেন না তাদের অবগতির জন্যে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি বলেছেন, “All art consist in a certain portion of exaggeration provided…one does not exceed certain bounds.”