চৌধুরী মশাই-এর শ্যালক ছিল সঙ্গে। সে-ই বর-বৌকে সঙ্গে করে আনছিল। তার সঙ্গে আসছিল নরনারায়ণ চৌধুরীর গোমস্তা, একেবারে সামনের পালকীতে। আর একেবারে সকলের সামনে-সামনে দীনু গোমস্তা আগে আগে চলেছে। কৈলাশ গোমস্তাকে লোকে দূর থেকে নমস্কার করছে। এক-একটা গ্রামে ঢোকে তারা আর গাঁয়ের বৌ-ঝি-ছেলে বুড়ো সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বলে–গোমস্তা মশাই, বউরাণীকে একবার দেখবো
কৈলাস গোমস্তা বলে–আরে না না, এখন না, কাল চৌধুরী বাড়িতে বউরাণীকে সাজিয়ে-গুজিয়ে দেখাবো তোদের
–ওমা, তা এখন কি সাজগোজ নেই?
–তা থাকবে না কেন? এখন সেই কেষ্টনগর থেকে রেলে চড়ে বৌ ঘেমে-নেয়ে আসছে, এখন কি কেউ দ্যাখে রে? কালকে সাজিয়ে-গুজিয়ে রাখবো বউমাকে তখন দেখিস–
এমনি সারা রাস্তা। সকলকে ঠাণ্ডা করতে করতেই কৈলাস গোমস্তা অস্থির।
পেছনের পালকীতে প্রকাশমামা মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো–একটু পা চালিয়ে পা চালিয়ে দীনু—
যেন প্রকাশ মামারই বিয়ে। তার সাজগোজের বাহার বরকে পর্যন্ত হার মানিয়েছে। বিয়ের উৎসবের ক’দিন ধরে তার খাটুনিরও যেমন শেষ নেই, আবার উৎসাহেরও তেমনি কামাই নেই।
হইচই করতে করতে বর-বৌ নবাবগঞ্জের চৌধুরীবাড়ির উঠোনে এসে ঢুকলো। গ্রাম ঝেটিয়ে লোকজন এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে।
কৈলাস গোমস্তা মার মার করে উঠলো-সরো গো, সরো সবাই, সরো। বৌ-এর দম আটকে আসবে সরো, ভেতরে হাওয়া ঢুকতে দাও–
প্রকাশ মামাও কম যায় না। কোঁচানো ধুতি আর ঢিলে পাঞ্জাবি নিয়ে হিমশিম্ খেয়ে যাচ্ছে। সে–ও বলে উঠলো–যাও, যাও, যাও, ওদিকে যাও ভাই সব, এদিকে ভিড় নয়, এদিকে ভিড় নয়–
গৌরী পিসীর আর তর সইলো না। সে কারো মানা শুনবে না। একেবারে দৌড়ে এসে পালকীর দরজার সামনে নিচু হয়ে বৌ-এর ঘোমটা তুলে মুখখানা দেখলে।
নয়নতারাও চমকে গেছে। এ আবার কে? শাশুড়ী নাকি?
বউ দেখে গৌরী পিসীর খুশীর আর শেষ নেই। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো– ওলো, জোরে জোরে উলু দে, জোরে জোরে উলু দে তোরা
সত্যিই নয়নতারার রূপের বাহার দেখে গাঁ-সুদ্ধ লোক অবাক। এমন রূপও হয় নাকি! দোতলার ঘরে নরনারায়ণ চৌধুরী তখন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর প্রথম নাত বৌ বাড়িতে এসেছে। তাঁকেই প্রথমে প্রণাম করতে হবে।
–চলো বৌমা, তোমার কর্তাবাবুকে আগে পেন্নাম করবে চলো—
নরনারায়ণ চৌধুরীর বহুদিনের সাধ পূর্ণ হতে চলেছে তখন। অনেক অভিশাপ তিনি কুড়িয়েছেন! এবার যাবার সময় নাত-বৌ-এর মুখ দেখতে পেলেন। এবার তাঁর বংশের ধারা আবহমান কাল ধরে চলুক। বংশপরম্পরায় নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশের গৌরব আরো বৃদ্ধি হোক। অনাগত কালের মানুষ বলুক–এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা নরনারায়ণ চৌধুরী মানুষের সমাজে সত্যিই ছিলেন এক নরনারায়ণ। তিনি ছিলেন দানবীর, কর্মবীর, দেবদ্বিজে ভক্তিপরায়ণ, মহাপুরুষ! এই তাঁর পৌত্র, এই সদানন্দ চৌধুরীরই একদিন সন্তান হবে, সেই সন্তানেরও আবার একদিন সন্তান হবে। এমনি করে সন্তানের পর সন্তানের জন্ম হয়ে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে পুরুষানুক্রমে তাদের বংশাবলীর মধ্যে দিয়েই তিনি চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন। এ বয়সে এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় এই-ই তাঁর একমাত্র কামনা, এই-ই তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা–এই-ই তাঁর একমাত্র সুখ!
হঠাৎ কৈলাস গোমস্তা এসে খবর দিলে কর্তাবাবু,–কালীগঞ্জের বৌ এসেছে–
–কে?
–আজ্ঞে কালীগঞ্জের বৌ!
–তা কালীগঞ্জের বৌ হঠাৎ আজকে এল কেন? তাকে কি তোমরা নেমন্তন্ন করেছিলে?
–আজ্ঞে, সে কী কথা! তাকে নেমন্তন্ন করতে যাবো কেন? আপনি তো তাকে নেমন্তন্ন করতে বারণ করেছিলেন?
–তাহলে খবর পেলে কী করে যে আজকে আমার নাতির বিয়ে?
–তা জানি নে, তবে নতুন বউয়ের মুখ দেখবার জন্যে একখানা শাড়ি আর এক হাঁড়ি মিষ্টিও এনেছে। নতুন বউ-এর মুখ দেখতে চাইছে–
সমস্ত বাড়িময় খন উৎসবের আবহাওয়া। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের লুচি ভাজার গন্ধে বাড়ি তখন একেবারে ম-ম করছে। আত্মীয়-কুটুম এসে গেছে দূর দূর থেকে। এমন সময় কি না কালীগঞ্জের বউকে এ বাড়িতে আসতে হয়!
নরনারায়ণ চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন–বংশী ঢালী কোথায়?
–ডেকে দেব?
–ডেকে দাও, আর দেখো যেন আমার ঘরের কাছে এখন কেউ না আসে, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবে। যাও–
তা বংশী ঢালী এল। কর্তাবাবুর বাড়ির বিয়েতে সে পরনের কাপড়খানা রঙীন করে ছাপিয়েছে। মাথার চুলগুলো তেল-চকচকে করে আঁচড়ে নিয়ে বাহার করেছে।
সামনে এসে দাঁড়াতেই কর্তাবাবু কৈলাস গোমস্তার দিকে চেয়ে বললেন কালীগঞ্জের বৌ যা-কিছু এনেছে, সন্দেশ শাড়ি সব নেবে, খুব খাতির করে নেবে। বুঝলে?
–বৌ দেখাবো?
–হ্যাঁ। আর দেখ, খাতিরের যেন কমতি না হয়, যেমন করে বাড়ির আত্মীয়-কুটুমদের খাতির করা নিয়ম, কালীগঞ্জের বৌকেও ঠিক তেমনি করে খাতির-যত্ন করবে। যেন কোথাও কোনও ত্রুটি না থাকে। বুঝলে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–তাহলে তুমি এখন যাও, গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো, দেখবে যেন এদিকে কেউ না আসে–
কৈলাস গোমস্তা চলে যেতেই কর্তাবাবু চাইলেন বংশী ঢালীর দিকে। বললেন– বংশী, আগে তুই তো আমার ইজ্জত অনেকবার বাঁচিয়েছি। আর একবার বাঁচাতে পারবি?
–হ্যাঁ হুজুর, আপনি যখন যা বলবেন তাই করবো। বলুন, কার ঘাড় থেকে কটা মাথা নিতে হবে–