সদানন্দবাবুর সেই দিন থেকে আর কোথাও যেতে পারলেন না। এই চৌবেড়িয়াতেই রয়ে গেলেন।
হরি মুহুরি প্রথম দিনেই বুঝতে পেরেছিল।
বলেছিল–আচ্ছা মাস্টার মশাই, নয়নতারা কে?
সদানন্দবাবু একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন প্রথমে। বললেন–কেন মুহুরি মশাই? নয়নতারার কথা তুমি জানলে কেমন করে?
–আপনি নিজেই বলেছেন।
বলে হরি মুহুরি হাসতে লাগলো।
সদানন্দবাবু বললেন–ও বুঝতে পেরেছি, আমার ওই এক বদ অভ্যেস, ঘুমোতে ঘুমোতে কথা বলি। আজকে পাল মশাইও তাই বলছিলেন আমাকে। আমি নাকি গান গেয়েছিলুম–
–আমিই তো বলেছি কর্তামশাইকে। আমি তো আপনার পাশের ঘরে শুয়েছিলুম, তাই মাঝরাত্তিরে আপনার হরুঠাকুরের কবিগান শুনে চমকে উঠেছিলুম। ভাবলুম সেকালের গান একালে এত রাত্তিরে কে গায়! তা আপনি কবিগানের দলে ছিলেন নাকি?
সদানন্দবাবুর হাসি পেল। মুখে বললেন–না না, কবির দলে ছিলুম না। কবির দলে থাকতে যাবো কোন্ দুঃখে! গানটা শুনেছি তাই মনে আছে–
–আপনার দেশ কোথায় মাস্টার মশাই? আপনার বাড়ি?
এই চৌবেড়িয়াতে আসর পর থেকে এই প্রশ্ন তাঁকে অনেকবারই শুনতে হয়েছে। আরো যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনই হয়তো শুনতে হবে। রসিক পালও জিজ্ঞেস করতেন প্রথম প্রথম। অজ্ঞাতকুলশীল মানুষকে নিজের আস্তানায় আশ্রয় দিতে গেলে তার কুলুজি জানতে হয়। কোথায় নিবাস, পিতার নাম, সব কিছু।
রসিক পাল বলতেন–ঠিক আছে বাবা, তোমার কিছু বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি কোথাও তোমার একটা ঘা আছে
–ঘা?
–হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ, এতদিন মহাজনী কারবার করছি আর লোক চিনতে পারবো না? তোমায় কিছু বলতে হবে না। কবিগানের কথাও বলতে হবে না, নয়নতারা কে তা–ও বলতে হবে না। আমি সব বুঝতে পেরেছি–
বলেই একটা লম্বা হাঁচি হাঁচলেন। আর সদানন্দবাবু ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলেন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বেলা নটা।
হাঁচির পরেই মনটা বেশ প্রসন্ন হয়ে উঠলো রসিক পালের। হাঁচির সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা মিলে গেছে এমন ঘটনায় রসিক পাল বরাবরই প্রসন্ন হয়ে উঠতেন।
সদানন্দবাবু চৌবেড়িয়াতে যাবার পর থেকেই রসিক পাল মশাই-এর মেজাজ যেন কেমন মিষ্টি হয়ে গেল। তিনি দু’হাতে দানছত্র করতে লাগলেন। ফকির পাল বাবার কাণ্ড দেখে একদিন বাপকে বললে–এখন দিনকাল বদলে গেছে, এখন কি আর এত খরচ বাড়ানো উচিত বাবা?
রসিক পাল আশেপাশের লোকজনদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন–দেখ দেখ, ফকিরের কথা শুনলে তোমরা! আজকালকার ছেলে তো, কেবল কোট-প্যান্ট পরতেই শিখেছে। আরে, আমি আমার নিজের টাকা খরচ করবো তাতে তোর কী? তুই কথা বলবার কে? আমার রোজগার করা টাকা আমি খরচ করবো তাতে তোর অত মাথাব্যথা কেন শুনি?
.
তা এদিকে তখন ঘরের মধ্যে বসে হাজারি বেলিফ অপেক্ষা করছিল। আসামী কি পালালো নাকি? জল আনতে গেল তো গেলই। এতক্ষণ লাগে এক গেলাস জল আনতে! ভদ্রলোক হাতের পোঁটলাটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ঘরের বাইরে একবার উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলে। কে যেন যাচ্ছিল উঠোন পেরিয়ে।
ডাকলেও গো, কে তুমি? একবার ইদিকে এসো তো ভাই–
অতিথিশালার লোক। ডাক শুনে কাছে এল। ভদ্রলোক বললে–তুমি এ বাড়ির লোক তো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–কী নাম তোমার?
–গণেশ।
–গণেশ! বেশ নাম। ভাই গণেশ, তুমি বলতে পারো এই ঘরের সদানন্দবাবু কোথায় গেলেন?
–আমাদের মাস্টার মশাই-এর কথা বলছেন?
ভদ্রলোক বললে–সদানন্দবাবু বুঝি তোমাদের মাস্টার মশাই?
–আজ্ঞে, এখন আর মাস্টারি করেন না, আগে করতেন। তাঁকে দরকার?
–হ্যাঁ ভাই, এক গ্লাস জল চেয়েছিলুম তাঁর কাছে। অনেক দূর থেকে আসছি কিনা আমি। বড্ড জল-তেষ্টা পেয়েছিল
গণেশ বললে–আপনি মাস্টার মশাই-এর কাছে জল চেয়েছিলেন? তবেই হয়েছে! আজকে তাহলে আর জল পেয়েছেন!
–সে কী? কেন? তিনি যে আমাকে বসতে বলে চলে গেলেন?
গণেশ বললে–তাঁকে নিজেকেই কে জল দেয় তার ঠিক নেই, তিনি আনবেন জল! তিনি নিজের হাতে কখনও জল গড়িয়ে খেয়েছেন? তাঁর নিজের জল-তেষ্টা পেয়েছে কি না তাই-ই বলে তিনি বুঝতে পারেন না কখনও।
কথাগুলো শুনে হাজারির বেশ মজা লাগলো। বললে–তাহলে মাস্টারি করতেন কী করে এখানে?
গণেশ বললে–ওই জন্যেই তো কর্তামশাই-এর ইস্কুলটা উঠে গেল।
–পড়াতে পারতেন না বুঝি?
–পড়াতে পারবেন না কেন? বড্ড ভালো মানুষ যে, তাই কেউ তাঁকে মানুষ বলেই মানতো না। একটু ভয়-ভক্তি না করলে কি ইস্কুল চালানো চলে? অত ভালো মানুষ বলেই তো বুড়ো কর্তামশাই ওঁকে অত ভালবাসতেন।
ভদ্রলোক বললে–তাহলে তো দেখছি মুশকিলে পড়া গেল–
গণেশ বললে–-মুশকিলে আর কেন পড়বেন, আমি জল এনে দিচ্ছি—
বলে গণেশ ভেতর দিকে কোথায় চলে গেল। দুপুর বেলা। সাধারণত এমন সময় সকলেরই একটু বিশ্রাম। সকাল থেকে কাজ চলতে চলতে দুপুর বেলাতে এসেই কাজের চাকা যা একটু থামে। তারপর বিকেল বেলা সেই যে শুরু হবে, তার শেষ হবে অনেক রাত্রে পৌঁছিয়ে। নবাবগঞ্জের বাড়িতেও ঠিক এমনি হতো। অথচ সংসার বলতে তো ওই তিনটে প্রাণী। নরনারায়ণ চৌধুরী, বাবা, মা আর ওই সদানন্দ। অনেকে নামটা ছোট করে দিয়ে ডাকতো–সদা।
চৌধুরী বাড়িতে নতুন বউ এসেছে। পালকী আসছে রেলবাজার থেকে। ট্রেন থেকে বর আর বউকে নামিয়ে তোলা হয়েছে পালকীতে। ছ’ ক্রোশ রাস্তা উঁচু-নিচু এবড়ো খেবড়ো মেঠো পথ।