তারপর একটু থেমে বললে–এক গ্লাস জল দিতে পারেন, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে–
সদানন্দবাবু বললেন–আপনি বসুন, আমি জল আনি—
.
রসিক পালের এস্টেটে বন্দোবস্ত সব পাকা। আগে আরো পাকা ছিল। তখন রসিক পাল বেঁচে ছিলেন। কাছারি বাড়িতে পাকা খাতায় সকলের নাম লেখা থাকতো। কে আজ খাবে, কী তার নাম, ক’জন খাবে, কী কাজে তারা চৌবেড়িয়ায় এসেছে, হরি মুহুরির লোক সব কিছু খাতায় লিখে রাখতো। রসিক পালের টাকাও যেমন ছিল, তেমনি আবার সে-টাকার সদ্ব্যবহারও ছিল। যেদিন স্কুল উঠে গেল, সেদিন রসিক পাল বড় কষ্ট পেয়েছিলেন মনে মনে। কিন্তু উঠে যাবার কারণও ছিল। রসিক পাল সুদখোর মানুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষটাকে যে ভালো ভাবে না চিনেছে সে রসিক পালকে বুঝতে ভুল করবে। রসিক পাল কথায় কথায় বলতেন–আমি কি টাকা নিয়ে দান-ছত্তোর করতে বসেছি হে যে সুদের টাকা ছেড়ে দেব?
কিন্তু হরি মুহুরি যখন এসে খরচের কথা বলতো তখন রেগে যেতেন। বলতেন–খরচ হবে তো খরচ হবে, আমি কি টাকা নিয়ে স্বগ্যে যাবো? আমি সঙ্গে করে টাকা নিয়েও আসিনি, সঙ্গে করে নিয়ে যাবোও না। যা খরচ হবে তা হবে। চালের দাম বাড়ছে বলে কি আমি অতিথিশালা তুলে দেব ভেবেছ?
লোক বলতো–পাগল, পাল মশাই একজন আস্ত পাগল।
সদানন্দবাবু সব ভালো করে দেখতেন। এমন লোক আগে কখনও দেখেননি তিনি। দেখলে তাঁর জীবনটা অন্য রকম করে গড়ে উঠত। হয়ত এমন করে এভাবে জীবনটা শেষ করতে হতো না।
আত্মজীবনীটা লেখবার সময় ওই রসিক পাল সম্বন্ধে অনেকগুলো পাতা লিখতে হবে। যে-পৃথিবী ঘেন্নায় ছেড়ে এসে এখানে এমন করে আশ্রয় পেয়েছেন এখানকার সেই আশ্রয়দাতার কথা না লিখলে তাঁর লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
স্কুল যেদিন উঠে গেল সেদিন রসিক পাল বড় দুঃখ করে বলেছিলেন–মাস্টার, আমি পারলুম না
সদানন্দবাবু বলেছিলেন–আপনি যে পারবেন না পাল মশাই তা আমি জানতুম।
–কী করে জেনেছিলে?
সদানন্দবাবু বলেছিলেন–কারণ কেউ-ই পারেনি। কেউ পারেনি বলেই আপনি পারলেন না।
–তার মানে? রসিক পাল অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছিলেন মাস্টারের দিকে।
সদানন্দবাবু বলেছিলেন–মানে হুঁকোর খোল-নলচে খারাপ হয়ে গেলে কি তামাক ধরে, না ধোঁয়া বেরোয়!
রসিক পাল কথাগুলো তবু বুঝতে পারেননি সেদিন। রসিক পাল দেদার টাকাই উপায় করেছিলেন, কিন্তু টাকার ওপর আসক্তি তাঁর কমেনি। টাকার আসক্তি যার আছে তার দ্বারা টাকার সদ্ব্যয় কেমন করে হবে? তাই ছেলেরা স্কুলে আসতো না, সদানন্দবাবু বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ডেকে আনবার চেষ্টা করতেন।
শেষকালে সদানন্দবাবু একদিন হাল ছেড়ে দিলেন।
বললেন–এবার স্কুল তুলে দিন পাল মশাই, আর আমাকেও মুক্তি দিন–
–কেন? কী বলছো তুমি?
সদানন্দবাবু বললেন–আমি গোড়াতেই আপনাকে বলেছিলুম এসব কাণ্ড আরম্ভ না করতে, কিন্তু আপনি কিছুতেই শুনলেন না। এখন কেউ লেখাপড়া করবে না। এখন লেখাপড়া না করেই ছেলেরা হাজার টাকা মাইনের চাকরি চাইবে–
–ওটা তোমার রাগের কথা মাস্টার, তুমি আর একটু চেষ্টা করে দেখ না। মাসে মাসে আমি এতগুলো টাকা দিচ্ছি, গভর্মেন্টের ঘর থেকেও টাকা আনবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, দেখবে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে–
কিন্তু ঠিক শেষ পর্যন্ত হলো না। যত দিন যেতে লাগলো ততই যেন কারা সব গ্রামে আসতে লাগলো লুকিয়ে লুকিয়ে। অচেনা সব মুখ তাদের। রাতের অন্ধকারে তারা গঙ্গার ধারে গঞ্জের হোটেলে এসে ব্যাপারী সেজে রইল। তারপর একদিন কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ রসিক পাল মশাই-এর বসত বাড়ির ভেতর থেকে একসঙ্গে একটা আর্তনাদ উঠলো।
সে অনেক রাত তখন!
তারপর পুলিস এল, এনকোয়ারি হলো। কয়েকদিন ধরে চৌবেড়িয়াতে খুব হইচই হলো। লোকজনকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চললো। কয়েকজন গ্রেফতারও হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুরই ফয়সালা হল না। যে মানুষ একদিন সামান্য অবস্থা থেকে নিজের আর্থিক অবস্থা ফিরিয়ে দশজনের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁকে থতম করে দেশকে পাপমুক্ত করা হলো।
তারপরও কিছুদিন স্কুল চলেছিল। কিন্তু পাশের গ্রামে আর একটা স্কুল হলো। একদিন তারা এখানকার সব ছেলে ভাঙিয়ে নিয়ে চলে গেল।
রসিক পাল মশাই-এর ছেলে ফকির পাল বললে–মাস্টার মশাই, এবার কী করবো তা হলে?
সদানন্দবাবু বললেন–আর কী করবে? এবার স্কুল বন্ধ করে দাও, আর আমাকেও এবার মুক্তি দাও–
ফকির বললে–কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন?
সদানন্দবাবু বললেন–আমি আর কোথায় যাবো বাবা, যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই চলে যাবো। তোমাদের ঘাড়ে কতদিন বসে বসে খাবো, বলো?
ফকির বললে–তা হবে না মাস্টার মশাই, আমি জানি আপনার কোথাও যাবার জায়গা নেই–
সদানন্দবাবু বললেন–ওকথা বোল না ফকির; মানুষের সমাজে জায়গা না হোক, বনে জঙ্গলে জানোয়ারের সমাজে তো জায়গা হবেই—
তবু ফকির পাল ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। রসিক পালের সব ক্রিয়াকর্মই ফকির চালিয়ে যাচ্ছে। বার বাড়ির উল্টোদিকে অতিথিশালা ছিলই আগে থেকে। কখনও সেখানে কেউ থাকতো, আবার কখনও কেউ থাকতো না। তীর্থের গুরুমহারাজ কিম্বা পাণ্ডাঠাকুর কেউ এলে তাঁদের অতিথিশালার একটা মহলেই আশ্রয় দেওয়া হতো। তাঁদের জন্যে যেমন ব্যবস্থা ছিল, মাস্টার মশাই-এর জন্যেও ঠিক সেই তেমন ব্যবস্থাই হলো।