তখনও সদানন্দ ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পারেনি।
হরি মুহুরি সদানন্দর হাতটা খপ করে ধরে ফেললে। ধরে টানতে লাগলো। বললে– আর বোঝবার কিছু নেই, চলুন কর্তামশাই আপনাকে ডাকছেন–
বলে টানতে টানতে একেবারে গদিবাড়িতে কর্তামশাই-এর সামনে হাজির করলো।
রসিক পাল বললেন–তুমি চলে যাচ্ছিলে যে?
সদানন্দ বললে–আজ্ঞে আপনি যে চলে যেতে বললেন–
–তুমি বলছো কী? আমি তোমাকে চলে যেতে বলেছি? এই যে এতগুলো লোক এখানে রয়েছে, এরাও তো শুনেছে, এরা কেউ বলুক তো আমি তোমাকে কখন চলে যেতে বললাম? বলুক এরা
তা তার দরকার হলো না। সদানন্দ আবার রয়ে গেল চৌবেড়িয়াতে। তার জন্যে অন্য একটা ঘরের বন্দোবস্ত হলো। ইস্কুল প্রতিষ্ঠা হলো। গভর্নমেন্ট থেকে প্রাইমারি স্কুলের টাকাও ধার্য হলো শেষ পর্যন্ত। সবই করে দিয়েছিলেন সেই রসিক পাল মশাই।
হায়, কিন্তু কোথায় গেলেন সেই রসিক পাল, আর কোথায় রইল তাঁর সেই স্কুল। সে-সব চলে গেছে এখন। সেই নরনারায়ণ চৌধুরী, সেই হরনারয়ণ চৌধুরী, সেই নয়নতারা, সেই নিখিলেশ, সেই কালিগঞ্জের বৌ, সবাই কে কোথায় চলে গেল তা জানবার প্রয়োজন তাঁর ফুরিয়ে গেছে আজ। সেই রসিক পালের দেওয়া ঘরখানাতেই তাঁর দিন কাটে এখন, এই চৌবেড়িয়ার রসিক পালের এস্টেট থেকেই তাঁর ভরণ-পোষণটা এসে যায়। আর সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কোথা দিয়ে কেটে যায় কী করে কাটে তারও খেয়াল থাকে না সদানন্দবাবুর! রসিক পালের এস্টেটের টাকায় জীবন চলছে তাঁর। শুধু তাঁর নয়, অনেকেরই জীবন চলে। এ যেন ধর্মশালার মত অনেকটা। এককালের মাস্টার মশাই এখানকার অনেকেরই মাস্টার মশাই, তাঁকে মানে সবাই। ভাত আসে অতিথিশালা থেকে, আর তিনি রুটিন বেঁধে জীবন-যাপন করেন। বেশ শান্তিতেই আছেন তিনি। এই জীবনটার কথাই তিনি লিখে যাবেন। অনেক পাতা লেখা হয়ে গেছে। সেদিন আবার তিনি খাতাটা নিয়ে লিখতে বসেছেন।
তিনি লিখতে লাগলেন—“আমি এখন ঘরেও নাই, ঘরের বাইরেও নাই। ঘরই আমার নিকট পর, আবার পরই আমার নিকট ঘর। আমার চাওয়ারও কিছু নাই, তাই পাওয়ার পর্বও আমার চুকিয়া গিয়াছে চিরকালের মত। আজ এত দূর হইতে বাল্যকালের দিনগুলির দিকে চাহিয়া কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আর কিছু করিবারও নাই। যাহা কিছু ইহ-জীবনে করিয়াছি তাহা ভাল করিবার উদ্দেশ্যেই করিয়াছি। পরের ভালো ব্যতীত আর কিছু ভাবি নাই, তবে…..”
হঠাৎ ঘরের দরজায় একটা টোকা পড়লো।
লিখতে লিখতে থেমে গেলেন সদানন্দবাবু। জিজ্ঞেস করলেন–কে?
বাইরে থেকে কেউ উত্তর দিলে না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন–কে?
তবু উত্তর নেই।
সদানন্দবাবু এবার উঠলেন। উঠে দরজাটা খুলতেই দেখলেন একজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় তাঁরই বয়েসী। হাতে একটা পুঁটুলি।
সদানন্দবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কাকে চাই?
–আপনার নাম কি সদানন্দ চৌধুরী?
সদানন্দবাবু বললেন—হ্যাঁ–
–আপনার পিতার নাম কি হরনারায়ণ চৌধুরী?
সদানন্দবাবু আবার বললেন–হ্যাঁ—
–আপনার নিবাস কি নবাবগঞ্জে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
বলতেই ভদ্রলোক আর কোনও কথা না বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। বললে– আরে মশাই, আপনাকে আজ পনেরো বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর আপনি এখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছেন–
বলে তক্তপোশের ওপর বসে রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে লাগলো।
সদানন্দবাবু তখনও বুঝতে পারছেন না কিছু। বললেন–আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না আপনার কথা–
–আরে মশাই, আমার নাম হাজারি বেলিফ, আমি ফৌজদারি-আদালত থেকে আসছি। আপনার নামে হুলিয়া আছে। আপনি খুন করে এখানে লুকিয়ে আছেন, ভেবেছেন কেউ টের পাবে না—
সদানন্দবাবু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–আমি খুন করেছি? বলছেন কী আপনি? কাকে?
ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলো। যেন বেশ একটা মজার বিষয়বস্তু পেয়েছে সদানন্দবাবুর কথার মধ্যে।
বললে–দাঁড়ান মশাই, আজ এত বছর ধরে আপনার পেছনে লেগে পড়ে আছি, আপনার জন্যে আমার চাকরি যায়-যায় অবস্থা–
সদানন্দবাবু ভদ্রলোকের হাল-চাল দেখে কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। বললেন–দেখুন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন
ভদ্রলোক বললে–কেন, আমি তো সোজা বাংলা ভাষাতেই কথা বলছি, আপনি নিজেও তো বাঙালী মশাই। আপনার নিবাস নদীয়া জেলার নবাবগঞ্জ গ্রামে, আপনার পিতামহের নাম নরনারায়ণ চৌধুরী, আপনার পিতার নাম হরনারায়ণ চৌধুরী, আপনারা নবাবগঞ্জের জমিদার, আমি কি কিছু জানি না বলতে চান?
সদানন্দবাবু তখনও অবাক হয়ে দেখছিলেন ভদ্রলোকের মুখখানা। মনে হলো কোথায় যেন আগে দেখেছিলেন লোকটাকে। ভদ্রলোক তখন একটা মোটা ঝাড়নের মত রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছে ঘষে ঘষে। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছে লোকটা মনে হলো।
ভদ্রলোকের যেন হঠাৎ নজরে পড়লো। বললে–আরে, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন না, আপনার তো এখন কোনও কাজকর্ম নেই, কেবল খাচ্ছেন-দাচ্ছেন আর নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন–রসিক পালের পুষ্যিপুত্তুর হয়ে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে আছেন
কথাগুলো সদানন্দবাবুর ভালো লাগলো না। কিন্তু সে কথা চেপে গিয়ে বললেন আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি বলুন তো
–আমাকে কোথায় আর দেখবেন। কোর্টেই দেখেছেন।
–কোর্টে? কোর্টে তো আমি কখনও যাইনি।
–তাহলে কালেক্টরি অফিসে দেখেছেন। আমি কোর্টে যাই, কালেক্টরিতে যাই, দুনিয়ার সব জায়গাতেই যে আমায় যেতে হয় মশাই। দুনিয়াতে যে-যে কিছু সম্পত্তি করেছে তার কাছেই আমাকে যেতে হয়। আমার কাজই তো আসামীকে কোর্টে নিয়ে গিয়ে হাজির করা। যেমন আপনি! আপনি একজন আসামী বলেই আপনার কাছে এসেছি