নরনারায়ণ তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে হিসেবের খাতা দেখছেন। আর মাথার কাছে সেই সিন্দুকটা। ওটা তিনি কাছছাড়া করতে পারতেন না।
–কে?
তারপর ঠাহর করে দেখেই যেন বিচলিত হয়ে উঠতেন।
–আমি নায়েব মশাই, আমি। কালীগঞ্জের বৌ।
–ও!
বলে যেন হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়তেন। একটু নড়ে-চড়ে সরে শুতে চেষ্টা করতেন।
বলতেন–তা আপনি আবার কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন বৌ-মণি! আমি তো বলেই ছিলুম আপনাকে আর আসতে হবে না–
কালীগঞ্জের বৌ বলতো–কিন্তু আর তো আমি অপেক্ষা করতে পারছি না নায়েবমশাই। আর কত দিন অপেক্ষা করবো? এই দশ বছর ধরে আপনি বলে আসছেন আমাকে আসতে হবে না, আমাকে আসতে হবে না। শেষকালে আমি মারা গেলে কি আমার টাকাগুলো দেবেন? তখন সে-টাকা আমার কে খাবে? সে টাকায় কি আমার পিণ্ডি দেওয়া হবে?
–আঃ, বৌ মণি আপনি বড় রেগে যাচ্ছেন! আমি যখন বলেছি আপনার টাকা দেব তখন দেবই।
–কিন্তু কবে দেবেন তাই বলুন! আজই টাকা দিতে হবে আমাকে। এই আমি এখানে বসলুম। এখান থেকে আমি নড়ছি না আর যতক্ষণ না আমার দশ হাজার টাকা পচ্ছি–
বলে কালীগঞ্জের বৌ সেইখানে সেই মেঝের ওপরেই বসে পড়লো।
হঠাৎ দাদুর নজরে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছে–ওরে, খোকা এখানে কেন? ওরে কে আছিস, খোকাকে এখান থেকে নিয়ে যা, ও দীনু–
দীননাথ কোথা থেকে দৌড়তে দৌড়তে এসে সদানন্দর হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যেত। সদানন্দ আর দেখতে পেত না কালীগঞ্জের বৌকে। কিন্তু মন থেকে দূর করতে পারতো না দৃশ্যটা। থেকে থেকে কেবল কালীগঞ্জের বৌ-এর চেহারাটা চোখের ওপর ভেসে উঠতো। ঘুমের ঘোরেও মনে হতো ওই বুঝি কালীগঞ্জের বৌ এল!
একদিন দীনুকে জিজ্ঞেস করেছিল–ও বউটা কে দীনুমামা?
দীনুমামা বলেছিল–চুপ, ওকথা জিজ্ঞেস করতে নেই–
তবু ছাড়েনি সদানন্দ। জিজ্ঞেস করেছিল–ও দাদুর কাছে টাকা চায় কেন? কীসের টাকা? দাদু ওকে টাকা দেয় না কেন? ও কে?
দীনু বলেছিল–ও-সব কথা তোমার জানতে-নেই। ও কালীগঞ্জের বৌ–
এর বেশী আর কিছু বলতো না দীনু। শুধু দীনু নয়, ওই কালীগঞ্জের বউ বাড়ীতে এলেই বাড়িসুদ্ধ সবাই যেন কেমন গম্ভীর হয়ে যেত। দাদু থেকে শুরু করে বাবা মা সবাই কেমন চুপ করে থাকতো। কারোর মুখে আর কোনও কথা বেরোত না তখন। ও যেন কালীগঞ্জের বৌ নয়, যম। যেন নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়িতে সাক্ষাৎ যম এসেছে চৌধুরীবাড়ীর সর্বনাশ করতে। যেন সে চলে গেলেই সবাই বাঁচে।
কিন্তু রসিক পাল মশাই-এর এখানে অন্য রকম। রসিক পাল মশাই চৌবেড়িয়ার সুখী মানুষ। ধর্মভীরু। সবাইকে দয়া-দাক্ষিণ্য করেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। আড়তে যেমন বহু লোক থাকে খায় শোয়, তেমনি আবার সুদের একটা পয়সা পর্যন্ত ছাড়েন না। বলেন– না হে, ওটি পারবো না। দাতব্য করতে বলো করছি কিন্তু সুদের হিসেবে গরমিল করতে পরবো না–ওটা পাপ–
রসিক পাল মশাই সত্যিই রসিক পুরুষ।
হঠাৎ হঠাৎ তাঁর অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। সেদিনও তেমনি। কাজ করতে করতে আবার হঠাৎ ডেকে উঠলেন–হরি–
পাশের আড়তঘর থেকে হরি মুহুরি দৌড়ে এল। বললে–আজ্ঞে ডাকছেন, আমাকে?
রসিক পাল বললেন–দেখ হরি, ওই যে লোকটা, ওর নামটা কী যেন…
–আজ্ঞে কার কথা বলছেন?
–ওই যে, কাল বিকেলবেলা আমার গদিবাড়িতে এসেছিল। রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গাইছিল? আমি তাকে ডেকে সব জিজ্ঞেস করেছি। তা আমি ভাবছি কি জানো, আসলে ছেলেটা খারাপ নয়, বুঝলে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গাইলে ওর কী দোষ বলো? ঘুমোলে তো আর কারো জ্ঞান থাকে না! ঘুম না মড়া।
হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে, তা তো বটেই–
–তবে যে তুমি বললে–ছেলেটা ভালো নয়, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পীরিতের গান গায়, মেয়েমানুষদের নাম ধরে ডাকে!
হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে যা ঘটেছে আমি তাই-ই আপনাকে বলেছি–
না হে, আমি ভেবে দেখলাম ওর কিছু দোষ নেই। ওর জন্যে তোমাদের যদি ঘুমের ব্যাঘাত হয় তো ওর বিছানাটা না-হয় তোমরা অন্য ঘরে করে দাও–
হরি মুহুরি বললে–কিন্তু কর্তামশাই, তিনি তো চলে গেছেন–
–চলে গেছেন মানে?
–আজ্ঞে তিনি যে বললেন আপনি তাকে চলে যেতে বলেছেন।
–আমি? তাঁকে চলে যেতে বলেছি?
–আজ্ঞে তিনি তো তাই বললেন। বলে আড়তঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
রসিক পাল রেগে গেলেন। বললেন–তোমাদের কি কোনও আক্কেল বলে কিছু নেই? তিনি বললেন আর তোমরাও তাঁকে যেতে দিলে? কোথায় যাবেন তিনি? তোমরা জানো তাঁর কোনও যাবার জায়গা নেই? তাঁকে জিজ্ঞেস করেছ তিনি যাবেন কোথায়? তার কোনও চুলোয় কি কেউ আছে যে সেখানে তিনি যাবেন?
হরি মুহুরি আর সেখানে দাঁড়াল না। সোজা একেবারে দৌড়তে লাগলো রাস্তার দিকে। সামনের বড় রাস্তাটা একেবারে গিয়ে পড়েছে গঙ্গার কাছে। তখনও সদানন্দ কোথায় যাবে ঠিক করতে পারেনি। গঞ্জের মুখে খানকয়েক দোকান। সেখানে গিয়েই ভাবছিল কোথায় যাওয়া যায়। সেই কোথায় নবাবগঞ্জ আর কোথায় সেই নৈহাটি আর কোথায় সেই সুলতানপুর। সব জায়গা থেকে ভাসতে ভাসতে একেবারে এই অজ গ্রামে চৌবেড়িয়াতে এসে হাজির হয়েছিল। এবার এখান থেকেও চলে যেতে হলো।
হঠাৎ পেছনে হরি মুহুরির গলা শোনা গেল।
–ও মশাই, ও মশাই—
ডাকতে ডাকতে সামনে এসে হাঁফাতে লাগলো বুড়ো মানুষটা।
বলল–আপনি তো খুব ভদ্রলোক মশাই, কর্তামশাইকে কিছু না বলে কয়ে চলে এলেন, এদিকে আমার হয়রানি, চলুন–