- বইয়ের নামঃ আসামী হাজির
- লেখকের নামঃ বিমল মিত্র
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০. আসামী হাজির’ প্রসঙ্গে – যজ্ঞেশ্বর রায়
আসামী হাজির – উপন্যাস – বিমল মিত্র
‘আসামী হাজির’ প্রসঙ্গে – যজ্ঞেশ্বর রায়
১৯৭১-এর নভেম্বর থেকে “আসামী হাজির” সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। সেই থেকে শুরু করে ১৯৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত আগাগোড়া আমি ছিলাম উপন্যাসখানির নিয়মিত পাঠক। পড়তে পড়তে এই দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি যে কত অনায়াসে বিমল মিত্রের কলমে একটি Positive good man জীবন্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য এ-ধরনের চরিত্র-চিত্ৰণ তার হাতে এই প্রথম নয়। তাঁর প্রথম উপন্যাস –সাহেব বিবি গোলাম-এ, যে বই থেকে তার খ্যাতির জয়যাত্রা শুরু, তার ভূতনাথ চরিত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি উপন্যাসে নানা নামে নানা বেশে এই সক্রিয় ভাল মানুষটির আনাগোনা আমরা দেখেছি। আসলে প্রতিবাদের এই বলিষ্ঠ কণ্ঠ লেখকের মধ্যে সর্বদাই মুখর। হতাশা, গ্লানি অন্যায়কে তিনি নির্দয় ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন আমাদের সমাজ-জীবনে রাষ্ট্রে কত দুর্নীতি দুরাচার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে; কিন্তু শুধু ওই দিকটা দেখিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হন না তিনি। আলোর দিকেও তার চোখ আছে। সবাই যখন অন্ধকারের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করছে তিনি তখন দু’হাত প্রসারিত করে ধরেছেন আলোর উদ্দেশে। পরম নৈরাশ্যের মধ্যে এমন করে তিনি বিশ্বাসের প্রদীপটি তুলে ধরেন যে, তাকে সেই মুহূর্তেই মনে হয়, তিনি মানুষের একজন চিরকালের অকৃত্রিম বন্ধু। জনতার কাছ থেকে জনপ্রিয়তার শিরোপা তাই তো তিনি এমন অনায়াসে অর্জন করেছেন।
আজ যখন অন্যান্য সাহিত্যরথিগণ অন্ধকারকেই আমাদের অনিবার্য নিয়তি বলে বলছেন তখন বিমল মিত্রের এই আলোর দিকে, বিশ্বাসের দিকে প্রসারিত অতন্দ্র দৃষ্টিকে আমরা ক্রমশই আরো প্রখর হয়ে উঠতে দেখছি; দেখছি যে –’ভাল মানুষ’ চরিত্রগুলো এতদিন অসহায় বিভ্রান্ত মানুষগুলোর পাশে পাশে প্রদীপ হাতে নিয়ে তাদের আলো দেখিয়ে চলত সেই সীমিত ও খণ্ডিত চরিত্রগুলো ক্রমশঃ অখণ্ড ও সম্পূর্ণ হতে চেয়ে তার উপন্যাসে নায়কের ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। যেমন –রাজাবদল-এর গৌর পণ্ডিত মশাই, –শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন-এর লোকনাথ এবং আলোচ্য উপন্যাসের সদানন্দ।
Positive good man-কে নায়ক করে উপন্যাস লেখা, দস্তয়েফস্কি বলেছেন, সব চেয়ে কঠিন কাজ। এ কাজে যিনি সফল হন তিনি শ্রেষ্ঠ শিল্পী। শিল্পীর এই শ্রেষ্ঠত্ব বোঝা সহজ নয়। –On the Modern Element in Literature’ গ্রন্থে Mathew Arnold বলেছেনঃ
And everywhere there is connexion, everywhere there is illustration : no single event, no single literature, is adequately comprehended except in relation to other events, to other literature.
ম্যাথু আরনল্ড-এর এই উক্তির তাৎপর্য আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি “আসামী হাজির” পড়তে পড়তে। আমার কেবল মনে হয়েছে Positive good man সম্পর্কে আগে থেকে পাঠকের যদি যৎকিঞ্চিৎ ধারণা তৈরি না থাকে তো “আসামী হাজির”-এর নায়ককে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। একটা নেলা-ক্ষেপা বোকা-পাগলা মানুষের অধিক বড় জোর একজন ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ বলে মনে হবে তাকে। এই এলোমেলো চরিত্রটির যে। একটা “grotesque beauty”–একটা রহস্যময় খেয়ালী সৌন্দর্য আছে, তা না বোঝাই থেকে যাবে। সদানন্দের চেয়ে উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্ররাই তখন মনে ছাপ ফেলবে বেশী করে; এমন দুরূহ শিল্পকৃতিত্বের কিছুই পাঠক বুঝতে পারবেন না।
Positive good man-কে সম্যক আয়ত্ব করতে অনেক লেখকই পারেন নি। Positive good man বলতে সব আগে আমাদের মনে পড়বে চৈতন্যদেব অথবা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে। ইওরোপের খৃশ্চিয়ান জগৎ একবাক্যে স্মরণ করবেন যীশুকে। কিন্তু এই মহামানবদের আদলে চরিত্র আঁকতে চাইলে তা হয়ে যাবে মহামানব নিয়ে উপন্যাস, তা আর তখন রস-সাহিত্য হবে না। দস্তয়েফস্কি বলেন, রসসাহিত্যের কাজ সাধারণ মানুষের। মধ্যে থেকে সাধারণ নয় এমন একটি মানুষকে উপস্থিত করা। সে হবে শিশুর মতন সরল, পবিত্র এবং স্বভাবতই সৎ অথচ সে থাকবে (যেহেতু মহামানব নয়) –Screened with human weakness. পাঠক তার সম্পর্কে যত জানবেন ততই তার আত্মীয় হয়ে উঠবেন এবং ততই অনুভব করবেন যে এ মানুষটি তার নিজের জাতের নয়, এ মানুষটির ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না, এ যেন কেমন বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, একলা। একে বন্ধু, সমাজ, বাপ-মা এমন কি শেষপর্যন্ত তার স্ত্রী ও ত্যাগ করে চলে যায়, কারো সঙ্গেই সে সহ-অবস্থান করতে পারে, সমঝোতায় আসতে পারে না। আপোস বলে যে একটা কথা আছে, তা যেন তার অভিধানে থাকতে নেই।
কিন্তু এহেন জটিল চরিত্র প্রথমেই কোন লেখক কল্পনা করেন নি। প্রথমে তাদের কল্পনায় Positive good man হিসেবে একটি সরল বিশ্বাসের অটল মানুষই ধরা পড়েছিল। পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে তার সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ ষোড়শ শতকে। লেখক একজন স্পেনিস। একাধারে কবি নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক সারভাঁতে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি “ডন কুইক্সট”-এর জন্যে অমর হয়ে আছেন। দস্তয়েফস্কি লিখেছেন—”of all the good characters in christ an literature, Don Quixote stands as the most finished of all. But he is good solely because he is ludicrous at the same time comical.” Comical হওয়াতে চরিত্রটির ওজন কমে গেছে অতিমাত্রায়। তার সততা সারল্য ও নিষ্ঠা পাঠকের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। তথাকথিত হিরোইজমের প্রতি শ্লেষ হিসেবেই চরিত্রটিকে পাঠক ভালবেসেছে কিন্তু তার Positive goodness চোখে পড়ে নি কারো। Tom Jones-এর ভাগ্যেও জুটেছে সেই ক্লাউনেরই জনপ্রিয়তা। নাম চরিত্রের ওই উপন্যাসটি লেখেন হেনরি ফিলডিং। ১৭৪০-এর কাছাকাছি প্রকাশিত এই বইটিতে একটি সরল মানুষের সহজ বিশ্বাসের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ে এমন ব্যঙ্গ কৌতুক করা হয়েছে যে এই ভঁড়ামির তলায় একটি বিশুদ্ধ সৎ চরিত্র সমূলে চাপা পড়ে গিয়েছে। অন্যপক্ষে ডিকেনসের ‘পিকউইক’ অনবদ্য চরিত্র হলেও ডন কুইক্সটের তুলনায় অনেক দুর্বল। তবু মোটামুটি ভাবে এ সব চরিত্র পাঠকের মন কেড়েছে কেবল তাদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতার জন্যে। সৎ ও সরল মানুষকে সবাই ভালবাসে। সবাই যাকে উপহাস করে কিংবা হুগোর “লে মিজেরাবল”-এর নায়ক জাঁ ভালজার মতন যে কেবল ভাগ্যদোষে অত্যাচারই কুড়োয়, কারো কাছে এটুকু স্নেহ-মমতা পায় না, স্বভাবতই সেই অনন্যোপায় মানুষটির জন্যে পাঠকের মন করুণায় ভরে ওঠে। সেকালের হিউমারের গোপন লক্ষ্যটিও ছিল তাই “…to aroise compassion.” অর্থাৎ পাঠকের মনে করুণা উদ্রেক করা।