রাত হইয়াছে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একখানা গাড়ীর আওয়াজ পাইয়া হাজারি বলিল–ও বংশী, কেষ্টনগর এলো যে। ডালে কাঁটা দিয়ে নাও–
সঙ্গে সঙ্গে গোবরা চাকর খাবার ঘর হইতে হাঁকিল–থাড কেলাস দু-থালা–উত্তেজনায় হাজারির সারাদেহ কেমন করিয়া উঠিল। কি কাজের ভিড়, কি লোকজনের হৈ চৈ, কি ব্যস্ততা–ইহার মধ্যেই তো মজা। তা নয়, গোপালনগরের মত পাড়াগাঁ জায়গায় কুণ্ডুদের বৃহৎ নিস্তব্ধ অট্টালিকার মধ্যে নিস্তব্ধ রান্নাঘরের কোণে বসিয়া কড়িকাঠ গুনিতে গুনিতে আর বাড়ীর পিছনের বাগানের তেঁতুল গাছে বাদুড় ঝোলা ডালপালার দিকে চাহিয়া চাহিয়া রান্না করা–সে কি তাহার পোষায়! সে হইল শহরের মানুষ।
.
সংক্রান্তির পরের দিন কুসুমের বাড়ী বেলা প্রায় বারোটার সময় সে নিমন্ত্রণ রাখিতে গেল। বংশী ঠাকুরকে বলিয়া একটু সকাল সকাল হোটেল হইতে বাহির হইল।
কুসুম গোয়ালঘরের নতুন উনুনে আলাদা করিয়া কপির ডালনা রাঁধিতেছে–একখানা কলার পাতায় খানকতক বেগুন ভাজা ও একটা পাথরের খোরায় ছোলার ডাল। শুদ্ধাচারে সব করিতে হইতেছে বলিয়াই পাথরের খোরা ও কলাপাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা–হাজারি দেখিয়া মনে মনে হাসিয়া ভাবিল–কুসুমের কাণ্ড দ্যাখো! থাকি হোটেলে–কত ছোঁয়ালেপা হয়ে যায় তার নেই ঠিক–ও আবার নেয়ে ধুয়ে ধোয়া কাপড় পরে গুরুঠাকুরের মত যত্ন করে রাঁধতে বসেচে।
কুসুম সলজ্জ হাসিয়া বলিল–জ্যাঠামশায়, এখনও হয়নি। একটু দেরি আছে–আমি কিন্তু তরকারি সব রেঁধেছি–আপনি শুধু বসে যাবেন–
হাজারি বলিল–তুমি তরকারি রাঁধলে যে বড়! সে কথা তো ছিল না। আমি তোমার তরকারি খাবো কেন?
–ঠকাতে পারবেন না জ্যাঠামশাই। কোনো তরকারিতে নুন দিইনি। নুন না দিলে খেতে আপনার আপত্তি কি? ভাবলাম আপনি অত বেলায় এসে তরকারি রাঁধবেন সে বড় কষ্ট হবে–লুচি ভাজা আর কি হাঙ্গামা, দেরিই তো হবে তরকারি রাঁধতে। তাই নিয়ে এসে–
–নুন দাওনি। না মা তুমি হাসালে দেখচি। আলুনি তরকারি খাওয়াবে তোমার বাড়ী?
–আর গোয়ালার মেয়ে হয়ে আমি নিজের হাতের রান্না তরকারি খাইয়ে আপনার জাত মেরে দেবো–নরকে পচতে হবে না আমাকে তার জন্যে?
হাজারি হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল! বলিল, দাও ময়দাটা। মেখে নিই ততক্ষণ–
–সব ঠিক আছে জ্যাঠামশাই। কিছু করতে হবে না আপনাকে। আপনি বরং শুধু নেচি কেটে লুচিগুলো বেলে দিন–কপিটা হয়ে গেলেই চাটন রাঁধব–তারপর লুচি ভেজে গরম গরম–ওতে কি জ্যাঠামশায়? ও কি?
হাজারি গায়ের চাদরের ভিতর হইতে একটা শালপাতার ঠোঙা বাহির করিতে করিতে আমতা আমতা করিয়া বলিল–এই কিছু নতুন গুড়ের সন্দেশ–আজ পয়লা তারিখে ও মাসের ক’দিনের মাইনেটা দিলে কি না–তাই ভাবলাম একটুখানি মিষ্টি–
কুসুম রাগ করিয়া বলিল–এ আপনার বড্ড অন্যাই কিন্তু জ্যাঠামশায়। আপনার এই সবে চাকুরির মাইনে–আমার জন্যে খরচ করে সন্দেশ না কিনলে আর চলতো না? আপনার দণ্ড করতে আমার এখানে সেবা করতে বলেছি?…না, এসব কি ছেলেমানুষী আপনার–
হাজারি শালপাতার ঠোঙাটি দাওয়ার প্রান্তে অপরাধীর মত সঙ্কোচের সহিত নামাইয়া রাখিয়া বলিল–আমার কি ইচ্ছে করে না মা, তোমার জন্যে কিছু আনতে? বাবা মেয়েকে খাওয়ায় না বুঝি?
হাজারির রকম-সকম দেখিয়া কুসুমের হাসি পাইলেও সে হাসি চাপিয়া রাগের সুরেই বলিল–না ভারি চটে গিয়েছি–-পয়সা হাতে এলেই অমনি খরচ করার জন্যে হাত সুড়সুড় করে বুঝি? ভারী বড়লোক হয়েছেন বুঝি? ও মাসের সাতটা দিন কাজ করে কত মাইনে পেয়েছেন যে এক ঢাকার সন্দেশ আনলেন অমনি? হাজারি চুপ করিয়া অপ্রতিভ মুখে বসিয়া রহিল।
–আসুন ইদিকে, এই আসনখানায় বসুন, ময়দাটা নেচি করুন এবার—
মা কাহাকে অত বকিতেছে দেখিতে কুসুমের ছেলে মেয়ে কোথা হইতে আসিয়া সামনে উঠানে দাঁড়াইতেই হাজারি ঠোঙা হইতে সন্দেশ লইয়া তাহাদের হাতে কিছু কিছু দিয়া বলিল যাক, নাতিনাতনী তো আগে খাক–মেয়ে খায় না খায় বুঝবে পরে–
পরে কুসুমের দিকে ফিরিয়া বলিল–নাও হাত পাতো, আর রাগ করে না—
কুসুম এবার আর হাসি চাপিয়া রাখিতে পারিল না। বলিল–আমি রাঁধতে রাঁধতে খাব?
–কেন আলগোছে?
–না।
–কেন?
–আমি বুড়ো মাগী, ভোগের আগে পেসাদ পেয়ে বসে থাকি আর কি!
হাজারি বুঝিল তাহার খাওয়া না হইয়া গেলে কুসুম কিছুই খাইবে না। সে বিনা বাক্য ব্যয়ে লুচির ময়দা লইয়া বসিয়া গেল।……
কুসম বলিল–হোটেল খুলবার কি করলেন?
–গোপাল ঘোষের তামাকের দোকানের পাশে ওই ঘরখানা ন’টাকা ভাড়া বলে। দেখেচ ঘরখানা?
কুসুম উৎফুল্ল হইয়া বলিল–কবে খুলবেন?
–সামনের মাসে। টাকা দেবে তো?
কুসুম গলার সুর নীচু করিয়া বলিল–আস্তে আস্তে। কেউ শুনবে–
–তোমার শাশুড়ী কই?
–আমি যেতে পারলাম না বাইরে, তাই দুধ নিয়ে বেরিয়েছে–এল বলে।
–বাত সেরেছে?
–মরচের মাদুলী নিয়ে এখন ভাল আছে। আগে মধ্যে দিনকতক পঙ্গু হয়ে পড়েছিল– তার চেয়ে ঢের ভাল। আপনার জায়গা করে দিই–ওগুলো ভেজে ফেলুন–গরম গরম দেবো–
হাজারি খাইতে বসিল। কুসুম কাছে বসিয়া কখনও লুচি, কখনও তরকারি দিতে দিতে বলিল–আপনি তরকারিতে বেশী করে নুন মেখে খান–
–রান্না চমৎকার হয়েছে মা–
–থাক আপনার আর–
–হোটেল যেদিন খুলবো, সেদিন তোমায় নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াবো–