- বইয়ের নামঃ অপরাজিত
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. দুপুর প্রায় গড়াইয়া গিয়াছে
দুপুর প্রায় গড়াইয়া গিয়াছে। রায়চৌধুরীদের বাড়ির বড়ো ফটকে রবিবাসরীয় ভিখারিদের ভিড় এখনও ভাঙে নাই। বীর মুহুরির উপর ভিখারির চাউল দিবার ভার আছে, কিন্তু ভিখারিদের মধ্যে পর্যন্ত অনেকে সন্দেহ করে যে, জমাদার শম্ভুনাথ সিংহের সঙ্গে যোগ-সাজসের ফলে তাহারা ন্যায্য প্রাপ্য হইতে প্রতিবারই বঞ্চিত হইতেছে। ইহা লইয়া তাহদের ঝগড়া দ্বন্দ্ব কোনকালেই মেটে নাই। শেষ পর্যন্ত দারোয়ানেরা রাগিয়া ওঠে, রামনিইরা সিং দু-চারজনকে গলাধাক্কা দিতে যায়। তখন হয় বুড়ো খাজাঞ্চি মহাশয়, নয়তো গিরীশ গোমস্ত আসিয়া ব্যাপারটা মিটাইয়া দেয়। প্রায় কোন রবিবারই ভিখারি-বিদায় ব্যাপারটা বিনা গোলমালে নিষ্পন্ন হয় না।
রান্না-বাড়িতে কি একটা লইয়া এতক্ষণ রাঁধুনীদের মধ্যে বাচসা চলিতেছিল। রাঁধুনী বামনী মোক্ষদা থালায় নিজের ভাত সাজাইয়া লইয়া রণে ভঙ্গ দিয়া সরিয়া পড়াতে সেখানকার গোলমালও একটু কমিল। রাঁধুনীদের মধ্যে সর্বজয়ার বয়স অপেক্ষাকৃত কম-বড়োলোকের বাড়ি—শহর-বাজার জায়গা, পাড়াগোঁয়ে মেয়ে বলিয়া ইহাদের এসব কথাবার্তায় সে বড়ো একটা থাকে না। তবুও মোক্ষদা বামনী তাঁহাকে মধ্যস্থ মানিয়া সদু-ঝিয়ের কি অবিচারের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিতেছিল। যখন যে দলে থাকে, তখন সে দলের মন জোগাইয়া কথা বলাটা সর্বজয়ার একটা অভ্যাস, এজন্য তাহার উপর কাহারও রাগ নাই। মোক্ষদা সরিয়া পড়ার পর সর্বজয়াও নিজের ভাত বাড়িয়া লইয়া তাহার থাকিবার ছোট ঘরটাতে ফিরিল। এ বাড়িতে প্রথম আসিয়া বছর-দুই ঠাকুরদালানের পাশের যে ঘরটাতে সে থাকিত, এ ঘরটা সেটা নয়; তাহারই সামনাসামনি পশ্চিমের বারান্দার কোণের ঘরটাতে সে এখন থাকে-সেই রকমই অন্ধকার, সেই ধরনেরই স্যাঁতসেঁতে মেজে, তবে সে ঘরটার মতো ইহার পাশে আস্তাবল নাই, এই একটু সুবিধার কথা।
সর্বজয়া তখনও ভালো করিয়া ভাতের থালা ঘরের মেজেতে নামায় নাই, এমন সময় সদু-ঝি অগ্নিমূর্তি হইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিল।
—বলি, মুখি বামনী কী পরিচয় দিচ্ছিল তোমার কাছে শুনি? বদমায়েশ মাগী কোথাকার, আমার নামে যখন-তখন যার-তার কাছে লাগিয়ে করবে কি জিগ্যেস করি? বলে দেয় যেন বড়ো বৌরানীর কাছে—যায় যেন বলতে-তুমিও দেখে নিয়ো বলে দিচ্ছি বাছা, আমি যদি গিন্নিমার কাছে বলে ওকে এ বাড়ি থেকে না তাড়াই তবে আমি রামনিধি ভড়ের মেয়ে নই-নই-নই-এই তোমায় বলে দিলুম।
সর্বজয়া হাসিমুখে বলিল, না সদু-মাসি, সে বললেই অমনি আমি শুনবো কেন? তা ছাড়া ওর স্বভাব তো জানো-ওই রকম, ওর মনে কোন রাগ নেই, মুখে হাউ-হাউ করে বকে-এমন তো কিছু বলেও নি।–আর তা ছাড়া আমি আজ দু-মাস দশ মাস তো নয়, তোমায় দেখচি আজ তিন বছর-বললেই কি আর আমি শুনি? তিন বচ্ছর এ বাড়িতে ঢুকিচি, কই তোমার নামে–
সদু-ঝি একটু নরম হইয়া বলিল, অপু কোথায়, দেখচি নে-আজ তো রবিবার-ইস্কুল তো আজি বন্দ—
সর্বজয়া প্রতিদিন রান্নাঘরের কাজ সারিয়া আসিয়া তবে স্নান করে, তেলের বাটিতে বোতল হইতে নারিকেল তৈল ঢালিতে ঢালিতে বলিল, কোথায় বেরিয়েচে। ওই শেঠেদের বাড়ির পাশে কোন এক বন্ধুর বাড়ি, সেখানে ছুটির দিন যায় বেড়াতে। তাই বুঝি বেরিয়েচে। ছেলে তো নয়, একটা পাগল-দুপুর রোদুর রোজ মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া চাই তার। দাঁড়িয়ে কেন, বোসো না মাসি! সদু বলিল, না, তুমি খাও, আর বসবো না-ভাবলুম, যাই কথাটা গিয়ে শুনে আসি, তাই এলুম। বোলো ওবেলা মুখি বামনীকে, একটু বুঝিয়ে দিয়ো-খোকাবাবুর ভাতে সেই দইয়ের হ্যাঁড়ি বৈ-করা মনে নেই বুঝি? সদুর পেটে অনেক কথা আছে, বুঝলে? দেখতেই ভালোমানুষটি, বোলো বুঝিয়ে–
সদু-ঝি চলিয়া গেলে সর্বজয়া তেল মাখিতে বসিল। একটু পরে দোরের কাছে পায়ের শব্দে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিয়া বলিল, ওঃ, রোদ্দুরে ঘুরে তোর মুখ যে একেবারে রাঙা হয়ে গিয়েচে! বোস বোস-আয়-ওমা আমার কি হবে।
অপু ঘরের ভিতর ঢুকিয়া একেবারে সোজা বিছানায় গিয়া একটা বালিশ টানিয়া শুইয়া পড়িল। হাত-পাখ্যাখানা সজোরে নাড়িয়া মিনিটখানেক বাতাস খাইয়া লইয়া মায়ের দিকে চাহিয়া বলিল, এখনও নাও নি? বেলা তো দুটো–
সর্বজয়া বলিল, ভাত খাবি দুটো—
অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না—
–খা না দুটোখানি? ভালো ছানার ডালনা আছে, সকালে শুধু তো ডাল আর বেগুনভাজা দিয়ে খেয়ে গিাইচিস। ক্ষিদে পেয়েচে আবার এতক্ষণ–
অপু বলিল, দেখি কেমন?
পরে সে বিছানা হইতে উঠিয়া আসিয়া মেজেতে ভাতের থালার ঢাকনি উঠাইতে গেল। সর্বজয়া বলিল, ছুঁস নে, ষ্টুস নো-থাক এখন, নেয়ে এসে দেখাচ্চি।
অপু হাসিয়া বলিল, ছুঁস নে ছুঁস নে কেন? কেন? আমি বুঝি মুচি? ব্রাহ্মণকে বুঝি অমনি বলতে আছে? পাপ হয় না?
—যা হয় হবে। ভারি। আমার বামুন, সন্ধে নেই, আহ্নিক নেই, বাচবিচের জ্ঞান নেই, এঁটো জ্ঞান নেই।–ভারি আমার–
খানিকটা পরে সর্বজয়া স্নান সারিয়া আসিয়া ছেলেকে বলিল, আমার পাতে বসিস এখন।
অপু মুখে হাসি টিপিয়া বলিল, আমি কাবুর পাতে বসচি নে, ব্রাহ্মাণের খেতে নেই কারুর এঁটো।
সর্বজয়া খাইতে বসিলে অপু মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া সুর নিচু করিয়া বলিল, আজ এক জায়গায় একটা চাকরির কথা বলেচে মা একজন। ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, গাড়ি যখন এসে লাগবে-লোকেদের কাছে নতুন পাঁজি বিক্রি করতে হবে। পাঁচটাকা মাইনে আর জলখাবার। ইস্কুলে পড়তে পড়তেও হবে। একজন বলছিল।
ছেলে যে চাকুরির কথা একে ওকে জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়ায় সর্বজয়া একথা জানে। চাকুরি হইলে সে মন্দ কথা নয়, কিন্তু অপুর মুখে চাকুরির কথা তাহার মোটেই ভালো লাগে না। সে তো এমন কিছু বড়ো হয় নাই। তাহা ছাড়া রৌদ্র আছে, বৃষ্টি আছে। শহর-বাজার জায়গা, পথে ঘাটে গাড়ি-ঘোড়া-কত বিপদ! অত বিপদের মুখে ছেলেকে ছাড়িয়া দিতে সে রাজি নয়।
সর্বজয়া কথাটা তেমন গায়ে মাখিল না। ছেলেকে বলিল, আয় বোস পাতে-হয়েচে, আমার। আয়—
অপু খাইতে বসিয়া বলিল, বেশ ভালো হয়, না মা? পাঁচ টাকা করে মইনে। তুমি জমিয়ো। তারপর মাইনে বাড়াবে বলেচে। আমার বন্ধু সতীনদের বাড়ির পাশে খোলার ঘর ভাড়া আছে দুটাকা মাসে। সেখানে আমরা যাবো-এদের বাড়ি তোমার যা খাটুনি! ইস্কুল থেকে আমনি চলে যাবো ইস্টিশানে-খাবার সেখানেই খাবো। কেমন তো?
সর্বজয়া বলিল-বুট করে দেবো, বেঁধে নিয়ে যাস।
দিন দশেক কাটিয়া গেল। আর কোন কথাবার্তা কোনো পক্ষেই উঠিল না। তাহার পর বড়োবাবু হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়িলেন এবং অত্যন্ত সঙ্গীন ও সংকটাপন্ন অবস্থার ভিতর দিয়া তাঁহার দিন-পনেরো কাটিল। বাড়িতে সকলের মুখে ঝি-চাকর দারোয়ানের মুখে বড়োবাবুর অসুখের বিভিন্ন অবস্থার কথা ছাড়া আর অন্য কথা নাই।
বড়োবাবু সামলাইয়া উঠিবার দিনকয়েক পর একদিন অপু আসিয়া হাসি-হাসি মুখে মাকে বলিল, আজ মা, বুঝলে, একটা ঘুড়ির দোকানে বলেচে যদি আমি বসে বসে ঘুড়ি জুড়ে দি আঠা দিয়ে, তারা সাত টাকা করে মাইনে আর রোজ দু-খানা করে ঘুড়ি দেবে। মস্ত ঘুড়ির দোকান, ঘুড়ি তৈরি করে কলকাতায় চালান দেয়-সোমবারে যেতে বলেচে–
এ আশার দৃষ্টি এ হাসি এ সব জিনিস সর্বজয়ার অপরিচিত নয়। দেশে নিশ্চিন্দিপুরের ভিটাতে থাকিতে কতদিন, দীর্ঘ পনেরো-ষোল বৎসব ধরিয়া মাঝে মাঝে কতবার স্বামীর মুখে এই ধরনের কথা সে শুনিয়াছে। এই সুর, এই কথার ভঙ্গি সে চেনে। এইবার একটা কিছু লাগিয়া যাইবেএইবার ঘটিল, অল্পই দেরি। নিশ্চিন্দিপুরের যথাসর্বস্ব বিক্ৰয় করিয়া পথে বাহির হওয়ার মূলেও সেই সুরেরই মোহ।
চারি বৎসর এখনও পূর্ণ হয় নাই, এই দশা ইহাব মধ্যে। কিন্তু সর্বজয়া চিনিয়াও চিনিল না। আজ বহুদিন ধরিয়া তাহার নিজের গৃহ বলিয়া কিছু নাই, অথচ নারীর অস্তনিহিত নীড় বাঁধিবার পিপাসটুকু ভিতবে ভিতরে তাহাকে পীড়া দেয়। অবলম্বন যতই তুচ্ছ ও ক্ষণভঙ্গুর হউক, মন তাঁহাই আঁকড়াইয়া ধরিতে ছুটিয়া যায়, নিজেকে ভুলাইতে চেষ্টা করে।
তাহা ছাড়া পুত্রের অনভিজ্ঞ মনের তরুণ উল্লাসকে পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতাব চাপে শ্বাসরোধ করিয়া মারিতে মায়াও হয়।
সে বলিল, তা যাস না সোমবারে! বেশ তো,-দেখে আসিস। হ্যাঁ শুনিস নি, মেজ বৌরানী যে শিগগির আসচেন, আজ শূনছিলাম রান্না-বাড়িতে
অপুর চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, আগ্রহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল, কবে মা, কবে?
–এই মাসের মধ্যেই আসবেন। বড়োবাবুর শরীর খারাপ, কাজ-টাজ দেখতে পারেন না, তাই মেজবাবু এসে থাকবেন দিন-কতক।
লীলা আসিবে কি-না একথা দুই-দুইবার মাকে বলি বলি করিয়াও কি জানি কেন সে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না। বাহিরে যাইতে যাইতে মনে মনে ভাবিল, তাদের বাড়িতে সবাই আসচে, মা বাবা আসচে, আর সে কি সেখানে পড়ে থাকবে? সে-ও আসবে।-ঠিক আসবে।
পরদিন সে স্কুল হইতে ফিরিয়া তাহদের ঘরটাতে ঢুকিতেই তাহার মা বলিল, অপু, আগে খাবার খেয়ে নে। আজ একখানা চিঠি এসেচে, দেখাচ্চি।
অপু বিস্মিতমুখে বলিল, চিঠি? কোথায়? কে দিয়েচে মা?
কাশীতে তাহার বাবার মৃত্যুর পর হইতে এ পর্যন্ত আজি আড়াই বৎসরের উপর এ বাড়িতে তাহারা আসিয়াছে, কই, কেহ তো একখানা পোস্টকর্ডে একছত্ৰ লিখিয়া তাহাদের খোঁজ করে নাই? লোকের যে পত্র আসে, একথা তাহারা তো ভুলিয়াই গিয়াছে!
সে বলিল, কই দেখি?
পত্ৰ-তা আবার খামে। খামিটার উপরে মায়ের নাম লেখা। সে তাড়াতাড়ি পত্ৰখানা খাম হইতে বাহির করিয়া অধীর আগ্রহের সহিত সেখানাকে পড়িতে লাগিল। পড়া শেষ করিয়া বুঝিতেনা-পারার দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, ভবতারণ চক্রবর্তী কে মা?—পরে পত্রের উপরকার ঠিকানাটা আর একবার দেখিয়া বলিল, কাশী থেকে লিখেচে।
সর্বজয়া বলিল, তুই তো ওঁকে নিচিন্দিপুরে দেখেচিস!—সেই সেবার গেলেন, দুয়াকে পুতুলের বাক্স কিনে দিয়ে গেলেন, তুই তখন সাত বছরের। মনে নেই তোর? তিনদিন ছিলেন আমাদের বাড়ি।
–জানি মা, দিদি বলতো তোমার জ্যাঠামশায় হন-না? তা এতদিন তো আর কোনও—
–আপন নয়, দূর সম্পর্কের। জ্যাঠামশায় তো দেশে বড়ো-একটা থাকতেন না, কাশী-গয়া, ঠাকুর-দেবতার জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, এখনও বেড়ান। ওঁদের দেশ হচ্চে মনসাপোতা, আড়ংঘাটার কাছে। সেখেন থেকে ক্রোশ দুই-সেবার আড়ংঘাটায় যুগল দেখতে গিয়ে ওঁদের বাড়ি গিয়ে ছিলাম দু-দিন। বাড়িতে মেয়ে-জামাই থাকত। সে মেয়ে-জামাই তো লিখেচেন মারা গিয়েচেছেলেপিলে কাবুর নেই–
অপু বলিল, হ্যাঁ, তাই তো লিখেচেন। নিশ্চিন্দিপুরে গিয়ে আমাদের খোজ করেচেন। সেখানে শূনেচেন কাশী গিাইচি। তারপর কাশীতে গিয়ে আমাদের সব খবর জেনেচেনি। এখানকার ঠিকানা নিয়েচেন বোধ হয়। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে।
সর্বজয়া হাসিয়া বলিল-আমি দুপুরবেলা খেয়ে একটু বলি গড়াই—ক্ষেমিঝি বললে তোমার একখানা চিঠি আছে। হাতে নিয়ে দেখি আমার নাম-আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। তারপব খুলে পড়ে দেখি এই—নিতে আসবেন লিখচেন শিগগির। দ্যাখা দিকি, কবে আসবেন লেখা আছে কিছু?
অপু বলিল, বেশ হয়, না মা? এদের এখেনে একদণ্ড ভালো লাগে না। তোমার খাটুনিটা কমে-সেই সকালে উঠে রান্না-বাড়ি ঢোকো, আর দুটো তিনটে–
ব্যাপারটা এখনও সর্বজয়া বিশ্বাস করে নাই। আবার গৃহ মিলিবে, আশ্রয় মিলিবে, নিজের মনোমতো ঘর গড়া চলিবে! বড়োলোকের বাড়ির এ রাঁধুনীবৃত্তি, এ ছন্নছাড়া জীবনযাত্রায় কি এতদিনে-বিশ্বাস হয় না। অদৃষ্ট তেমন নয় বলিয়া ভয় কবে।
তাহার পর দু-জনে মিলিয়া নানা কথাবার্তা চলিল। জ্যাঠামশায় কি রকম লোক, সেখানে যাওয়া ঘটিলে কেমন হয়,–নানা কথা, উঠিবার সময় অপু বলিল-শেঠেদের বাড়িব পাশে কাঠগোলায় পুতুলনাচ হবে একটু পরে। দেখে আসবো মা?
–সকাল সকাল ফিরবি, যেন ফটক বন্ধ করে দেয় না, দেখিস—
পথে যাইতে যাইতে খুশিতে তাহার গা কেমন করিতে লাগিল। মন যেন শোলার মতো হালকা। মুক্তি, এতদিন পরে মুক্তি! কিন্তু লীলা যে আসিতেছে? পুতুলনাচের আসরে বসিয়া কেবলই লীলার কথা মনে হইতে লাগিল। লীলা আসিয়া তাহার সহিত মিশিবে তো? হয়তো এখন বড়ো হইয়াছে, হয়তো আর তাহার সঙ্গে কথা বলিবে না।
পুতুলনাচ আরম্ভ হইতে অনেক দেরি হইয়া গেল। না দেখিয়াও সে যাইতে পারিল না। অনেক রাত্রে যখন আসর ভাঙিয়া গেল, তখন তাহার মনে পড়িল, এত রাত্রে বাড়ি ঢোকা যাইবে না, ফটক বন্ধ করিয়া দিয়াছে, বড়োলোকের বাড়ির দারোয়ানেরা কেহ তাহার জন্য গরজ করিয়া ফটক খুলিয়া দিবে না। সঙ্গে সঙ্গে বড়ো ভয়ও হইল। রাত্ৰিতে এ রকম একা সে বাড়ির বাহিরে কাটায় নাই। কোথায় এখন সে থাকে? মা-ই বা কি বলিবে!
আসরের সব লোক চলিয়া গেল। আসরের কোণে একটা পান-লেমনেডের দোকানো তখনও বেচা-কেনা চলিতেছে। সেখানে একটা কাঠের বাক্সের উপর সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তারপর কখন সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে জানে না, ঘুম ভাঙিয়া দেখিল ভোর হইয়া গিয়াছে, পথে লোক চলাচল আরম্ভ হইয়াছে।
সে একটু বেলা করিয়া বাড়ি ফিরিল। ফটকের কাছে বাড়ির গাড়ি দুইখানি তৈয়ার হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। দেউড়িতে ঢুকিয়া খানিকটা আসিয়া দেখিল বাড়ির তিন-চার জন ছেলে সাজিয়া গুজিয়া কোথায় চলিয়াছে। নিজেদের ঘরের সামনে নিস্তারিণী বিকে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাসিম, এত সকালে গাড়ি যাচ্ছে কোথায়? মেজবাবুরা কি আজকে আসবে?
নিস্তারিণী বলিল, তাই তো পুনছি। কাল চিঠি এসেচে-শুধু মেজবাবু আর বৌরানী আসবে, লীলা দিদিমণি এখন আসবেন না-ইস্কুলের এগজামিন। সেই বড়োদিনের সময় তবে আসবে। গিন্নিমা বলছিলেন বিকেলে–
অপুর মনটা একমুহূর্তে দমিয়া গেল। লীলা আসিবে না! বড়োদিনের ছুটিতে আসিলেই বা কি-সে তো তাহার আগে এখান হইতে চলিয়া যাইবে। যাইবার আগে একবার দেখা হইয়া যাইত এই সময় আসিলে। কতদিন সে আসে নাই।
তাহার মা বলিল, বেশ ছেলে তো, কোথায় ছিলি রাত্তিরে? আমার ভেবে সারারাত চোখের পাতা বোজেনি কাল।
অপু বলিল, রাত বেশি হয়ে গেল, ফটক বন্ধ করে দেবে জানি, তাই আমার এক বন্ধু ছিল, আমার সঙ্গে পড়ে, তাদেরই বাড়িতে-। পরে হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, না মা, সেখানে পানের দোকানে একটা কেরোসিন কাঠের বাক্স পড়ে ছিল, তার উপর শুয়ে–
সর্বজয়া বলিল, ওমা, আমার কি হবে। এই সারারাত ঠাণ্ডায় সেখেনে-লক্ষ্মীছাড়া ছেলে, যেয়ো তুমি ফের কোনদিন সন্দেব পর কোথাও-তোমার বড়ো ইয়ে হয়েচে, না?
অপু হাসিয়া বলিল-তা আমি কি করে ঢুকবো বলো না? ফটিক ভেঙে ঢুকবো?
রাগটা একটু কমিয়া আসিলে সর্বজয়া বলিল-তারপর জ্যাঠামশায় তো কাল এসেচেন। তুই বেরিয়ে গেলে একটু পরেই এলেন, তোর খোঁজ করলেন, আজ ওবেলা আবার আসবেন। বললেন, এখেনে কোথায় তার জানাশশুনো লোক আছে, তাদের বাড়ি থাকবেন। এদের বাড়ি থাকবার অসুবিধে-পবণ্ড নিয়ে যেতে চাচ্চেন।
অপু বলিল, সত্যি? কি কি বলো না মা, কি সব কথা হল?
আগ্রহে অপু মায়ের পাশে চৌকির ধারে বসিয়া পড়িয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিল। দু-জনের অনেক কথাবার্তা হইল। জ্যাঠামশায় বলিয়াছেন, তাহার। আর কেহ নাই, ইহাদেবীই উপর সব ভার দিয়া তিনি কাশী যাইবেন। অনেকদিন পরে সংসার পাতিবার আশায় সর্বজয়া আনন্দে উৎফুল্প। ইহাদের বাড়ি হইতে নানা টুকটাক গৃহস্থালিব প্রযোজনীয় জিনিস নানা সময় সংগ্ৰহ করিযা সযত্নে বাখিযা দিয়াছে। একটা বড়ো টিনের টেমি দেখাইয়া বলিল, সেখেনে রান্নাঘবে জ্বালবো-কত বড়ো লম্পটা দেখেচিস? দু-পয়সোব তেল ধবে।
দুপুরের পব সে মায়ের পাতে ভাত খাইতে বসিয়াচে, এমন সময় দুয়ারের সামনে কাহার ছায়া পড়িল। চাহিয়া দেখিয়া সে ভাতের গ্রাস আর মুখে তুলিতে পারিল না।
লীলা!
পরীক্ষণেই লীলা হাসিমুখে ঘরে ঢুকিল; কিন্তু অপুর দিকে চাহিয়া সে যেন একটু অবাক হইযা গেল। অপুকে যেন আর চেনা যায় না।-সে তো দেখিতে বরাববই সুন্দব, কিন্তু এই দেড় বৎসরে কি হইয়া উঠিয়াছে সে? কি গায়ের রং, কি মুখের শ্ৰী, কি সুন্দর স্বপ্ন-মাখা চোখদুটি! লীলার যেন একটু লজ্জা হইল। বলিল, উঃ, আগের চেয়ে মাথাতে কত বড়ো হয়ে গিয়েচ!
লীলার সম্বন্ধেও অপুর ঠিক সেই কথাই মনে হইল। এ যেন সে লীলা নয়, যাহার সঙ্গে সে দেড় বৎসর পূর্বে অবাধে মিলিয়া মিশিয়া কত গল্প ও খেলা করিয়াছে। তাহার তো মনে হয় না। লীলার মতো সুন্দরী মেয়ে সে কোথাও দেখিয়াছে।–রানুদিও নয়। খানিকক্ষণ সে যেন চোখ ফিরাইতে পারিল না।
দুজনেই যেন একটু সংকোচ বোধ করিতে লাগিল।
অপু বলিল, তুমি কি করে এলে? আমি আজ সকালেও জিজ্ঞেস করিচি। নিস্তারিণী মাসি বললে, তুমি আসবে না, এখন স্কুলের ছুটি নেই-সেই বড়োদিনের সময় নাকি আসবে?
লীলা বলিল, আমার কথা তোমার মনে ছিল?
–না, তা কেন? তারপর এতদিন পরে বুঝি-বেশ-একেবারে ড়ুমুরের ফুল-
–ড়ুমুরের ফুল আমি, না তুমি? খোকামণির ভাতের সময় তোমাকে যাওয়ার জন্যে চিঠি লেখোলাম ঠাকুরমায়ের কাছে, এ বাড়ির সবাই গেল, যাও নি কেন?
অপু এসব কথা কিছুই জানে না। তাহাকে কেহ বলে নাই। জিজ্ঞাসা করিল, খোকামণি কে?
লীলা বলিল, বাঃ, আমার ভাই! জানো না?…এই এক বছরের হলো।
লীলার জন্য অপুর মনে একটু দুঃখ হইল। লীলা জানে না। যাহাকে সে এত আগ্ৰহ করিয়া ভাইয়ের অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রণ করিয়াছিল, এ বাড়িতে তাহার স্থান কোথায় বা অবস্থা কি। সে বলিলদেড় বছর আসো নি-না? পড়চ কোন ক্লাসে?
লীলা তক্তপোশের কোণে বসিয়া পড়িল। বলিল, আমি আমার কথা কিছু বলবো না আগে– আগে তোমার কথা বলো। তোমার মা ভালো আছেন? তুমিও তো পড়ো-না?
-আমি এবারে মাইনর ক্লাসে উঠবো-পরে একটু গর্বিতমুখে বলিল, আর বছর ফাস্ট হয়ে ক্লাসে উঠেচি, প্রাইজ দিয়েচে।
লীলা অপুর দিকে চাহিল। বেলা তিনটার কম নয়। এত বেলায় সে খাইতে বসিয়াছে! বিস্ময়ের সুরে বলিল, এখন খেতে বসেচ, এত বেলায়?
অপুর লজ্জা হইল। সে সকালে সরকারদের ঘরে বসিয়া খাইয়া স্কুলে যায়—শুধু ডালভাত-তাও শ্ৰীকণ্ঠ ঠাকুর বেগার-শোধ ভাবে দিয়া যায়, খাইয়া পেট ভরে না, স্কুলেই ক্ষুধা পায়, সেখান হইতে ফিরিয়া মায়ের পাতে ভাত ঢাকা থাকে, বৈকালে তাঁহাই খায়। আজ ছুটির দিন বলিয়া সকালেই মায়ের পাতে খাইতে বসিয়াছে।
অপু ভালো করিয়া উত্তর দিতে পারিল না বটে, কিন্তু লীলা ব্যাপারটা কতক না বুঝিল এমন নহে। ঘরের হীন আসবাব-পত্র, অপুর হীন বেশ-অবেলায় নিরুপকরণ দুটি ভাত সাগ্রহে খাওয়া– লীলার কেন যেন মনে বড়ো বিঁধিল। সে কোন কথা বলিল না।
অপু বলিল, তোমার সব বই এনেচ। এখেনে? দেখাতে হবে আমাকে। ভালো গল্প কি ছবির বই নেই?
লীলা বলিল, তোমার জন্যে কিনে এনেচি আসিবার সময়। তুমি গল্পের বই ভালোবাসো বলে একখানা সাগরের কথা’ এনেচি, আরও দু-তিনখানা এনেচি, আনচি, তুমি খেয়ে ওঠে।
অপুর খাওয়া প্রায় শেষ হইয়াছিল, খুশিতে বাকিটা কোনোরকমে শেষ করিয়া উঠিয়া পড়িল। লীলা লক্ষ করিয়া দেখিল, সে পাতের সবটা এমন করিয়া খাইয়াছে, পাতে একটা দানাও পড়িয়া নাই। সঙ্গে সঙ্গে তাহার উপর লীলার কেমন একটা অপুর্ব মনের ভাব হইল-সে ধরনের অনুভূতি লীলার জীবনে এই প্রথম, আর কাহারও সম্পর্কে সে ধরনের কিছু তো কখনও হয়। নাই।
একটু পরে লীলা অনেক বই আনিল। অপুর মনে হইল, লীলা কেমন করিয়া তাহার মনের কথাটি জানিয়া, সে যাহা পড়িতে জানিতে ভালোবাসে সেই ধরনের বইগুলি আনিয়াছে। সাগরের কথা’ বইখানাতে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প। সাগরের তলায় বড়ো বড়ো পাহাড় আছে, আগ্নেয়গিরি আছে, প্রবাল নামক এক প্রকার প্রাণী আছে, দেখিতে গাছপালার মতো-কোথায় এক মহাদেশ নাকি সমুদ্রের গর্ভে ড়ুবিয়া আছে-এই সব।
লীলা একখানা পুরাতন খাতা দেখাইল। তাহার ঝোঁক ছবি আঁকিবার দিকে; বলিল-সেই তোমায় একবার ফুলগাছ একে দেখতে দিলাম মনে আছে? তারপর কত একেচি দেখবে?
অপুর মনে হইল লীলার হাতের আঁকা আগের চেয়ে এখন ভালো হইয়াছে। সে নিজে একটা রেখা কখনও সোজা করিয়া টানিতে পারে না-ড্রইংগুলি দেখিতে দেখিতে লীলার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বেশ এঁকেচো তো। তোমাদের ইস্কুলে করায়, না এমনি আঁকো?
এতক্ষণ পরে অপুর মনে পড়িল লীলা কোন স্কুলে পড়ে, কোন ক্লাসে পড়ে সে কথা কিছুই জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। বলিল-তোমাদের কি ইস্কুল? এবার কোন ক্লাসে পড়চো?
-এবার মাইনর সেকেন্ড ক্লাসে উঠেছি-গিরীন্দ্রমোহিনী গার্লস স্কুল—আমাদের বাড়ির পাশেই–
অপু বলিল, জিজ্ঞেস করবো?
লীলা হাসি মুখে ঘাড় নাড়িয়া চুপ করিয়া রহিল।
অপু বলিল, আচ্ছা বলো-চট্টগ্রাম কর্ণফুলির মোহনায়-কি ইংরেজি হবে?
লীলা ভাবিয়া বলিল, চিটাগং ইজ অন দি মাউথ অফ দি কর্ণফুলি।
অপু বলিল, ক’জন মাস্টার তোমাদের সেখেনে?
-আটজন, হেড মিস্ট্রেস এন্ট্রান্স পাশ, আমাদের গ্রামার পড়ান। পরে সে বলিল-মা’র সঙ্গে দেখা করবে না?
-এখন যাবো, না একটু পরে যাবো? বিকেলে যাবো এখন, সেই ভালো।
তাহার পরে সে একটু থামিয়া বলিল, তুমি শোনো নি লীলা, আমরা যে এখান থেকে চলে যাচি!
লীলা আশ্চর্য হইয়া অপুর দিকে চাহিল। বলিল-কোথায়?
–আমার এক দাদামশায় আছেন, তিনি এতদিন পরে আমাদের খোঁজ পেয়ে তাদের দেশের বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন।
অপু সংক্ষেপে সব বলিল।
লীলা বলিয়া উঠিল-চলে যাবে? বাঃ রে!
হয়তো সে কি আপত্তি করিতে যাইতেছিল, কিন্তু পরীক্ষণেই বুঝিল, যাওয়া না-যাওয়ার উপর অপুর তো কোনও হাত নাই, কোনও কথাই এক্ষেত্রে বলা চলিতে পারে না।
খানিকক্ষণ কেহই কথা বলিল না।
লীলা বলিল, তুমি বেশ এখানে থেকে ইস্কুলে পড়ো না কেন? সেখানে কি ইস্কুল আছে? পড়বে কোথায়? সে তো পাড়াগা।
—আমি থাকতে পারি। কিন্তু মা তো আমায়। এখেনে রেখে থাকতে পারবে না, নইলে আর কি–
–না হয় এক কাজ করো না কেন? কলকাতায় আমাদের বাড়ি থেকে পড়বে। আমি মাকে বলবো, অপূর্ব আমাদের বাড়িতে থাকবে; বেশ সুবিধে—আমাদের বাড়ির সামনে আজকাল ইলেকট্রিক ট্রাম হয়েছে—এঞ্জিনও নেই, ঘোড়াও নেই, এমনি চলে-তারের মধ্যে বিদ্যুৎ পোরা আছে, তাতে চলে।
–কি রকম গাড়ি? তারের ওপর দিয়ে চলে?
–একটা ডাণ্ডা আছে। তারে ঠেকে থাকে, তাতেই চলে। কলকাতা গেলে দেখবে এখনছ-সাত বছর হল ইলেকট্রিক ট্রাম হয়েছে, আগে ঘোড়ায় টানতো–
আরও অনেকক্ষণ দু-জনের কথাবার্তা চলিল।
বৈকালে সর্বজয়ার জ্যাঠামশায় ভবতারণ চক্ৰবর্তী আসিলেন। অপুকে কাছে ডাকিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। ঠিক করিলেন, দুইদিন পরে বুধবারের দিন লইয়া যাইবেন। অপু দু-একবার ভাবিল লীলার প্রস্তাবটা একবার মায়ের কাছে তোলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথাটা আর কার্যে পরিণত হইল না।
সকালের রৌদ্র ফুটিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গেই উলা স্টেশনে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল। এখান হইতেই মনসাপোত যাইবার সুবিধা। ভবতারণ চক্ৰবর্তী পূর্ব হইতেই পত্ৰ দিয়া গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছিলেন। কাল রাত্রে একটু কষ্ট হইয়াছিল। এক্সপ্রেস ট্রেনখানা দেরিতে পৌঁছানোর জন্য ব্যান্ডেল হইতে নৈহাটির গাড়িখানা পাওয়া যায় নাই। ফলে বেশি রাত্রে নৈহাটিতে আসিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিতে হইয়াছিল।
সারারাত্রি জাগরণের ফলে অপু কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল সে জানে না। চক্ৰবর্তী মহাশয়ের ডাকে উঠিয়া জানোলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিল একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গাড়ি লাগিয়াছে। সেখানেই তাদের নামিতে হইবে। কুলিরা ইতিমধ্যে তাহাদের কিছু জিনিসপত্র নামাইয়াছে।
গোবুর গাড়িতে উঠিয়া চক্ৰবর্তী মহাশয় অনবরত তামাক টানিতে লাগিলেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হইবে, একহারা পাতলা চেহারা, মুখে দাড়ি গোফ নাই, মাথার চুল সব পাকা। বলিলেনজয়া, ঘুম পাচ্ছে না তো?
সর্বজয়া হাসিয়া বলিল, আমি তো নৈহাটিতে ঘুমিয়ে নিইচি আধঘণ্টা, অপুও ঘুমিয়েচে। আপনারই ঘুম হয় নি
চক্ৰবর্তী মহাশয় খুব খানিকটা কাশিয়া লইয়া বলিলেন,-ওঃ, সোজা খোজটা করেছি। তোদের! আর-বছর বোশেখে মেয়েটা গেল মারা, হরিধান তো তার আগেই। এই বয়সে হাত পুড়িয়ে রোধেও খেতে হয়েছে,-কেউ নেই সংসারে। তাই ভাবলাম হরিহর বাবাজীর তো নিশ্চিন্দিপুর থেকে উঠে যাবার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন থেকেই, যাই এখানেই নিয়ে আসি। একটু ধানের জমি আছে, গৃহদেবতার সেবাটাও হবে। গ্রামে ব্রাহ্মণ তেমন নেই,–আর আমি তো এখানে থাকব না। আমি একটু কিছু ঠিক করে দিয়েই কাশী চলে যাবো। একরকম করে হরিহর নেবেন চালিয়ে। তাই গেলাম নিশ্চিন্দিপুর–
সর্বজয়া বলিল, আপনি বুঝি আমাদের কাশী যাওয়ার কথা শোনেননি?
—তা কি করে শুনবো? তোমাদের দেশে গিয়ে শুনলাম তোমরা নেই। সেখানে। কেউ তোমাদের কথা বলতে পারে না-সবাই বলে তারা এখান থেকে বেচে-কিনে তিন-চার বছর হল কাশী চলে গিয়েছে। তখন কাশী যাই। কাশী আমি আছি আজ দশ বছর। খুঁজতেই সব বেরিয়ে পড়লো। হিসেব করে দেখলাম হরিহর যখন মারা যান, তখন আমিও কাশীতেই আছি, অথচ কখনও দেখাশুনো হয় নি, তা হলে কি আর–
অপু আগ্রহের সুরে বলিল, নিশ্চিন্দিপুরে আমাদের বাড়িটা কেমন আচে, দাদামশায়?
–সেদিকে আমি গোলাম কাই! পথেই সব খবর পেলাম কি-না। আমি আর সেখানে দাঁড়াই নি। কেউ ঠিকানা দিতে পারলে না। ভুবন মুখুজ্যে মশায় অবিশ্যি খাওয়া-দাওয়া করতে বললেন, আর তোমার বাপের একশো নিন্দে-বুদ্ধি নেই, সাংসারিক জ্ঞান নেই।–হেন তেন। যাক সেসব কথা, তোমরা এলে ভালো হল। যে ক’ঘর যজমান আছে তোমাদের বছর তাতে কেটে যাবে। পাশেই তেলিরা বেশ অবস্থাপন্ন, তাদের ঠাকুর প্রতিষ্ঠা আছে। আমি পুজোটুজো করতাম অবিশ্যি, সেটাও হাতে নিতে হবে ক্ৰমে। তোমাদের নিজেদের জিনিস দেখে শূনে নিতে হবে–
উলা গ্রামের মধ্যেও খুব বন, গ্রাম ছাড়াইয়া মাঠের পথেও বনঝোপ। সূৰ্য আকাশে অনেকখানি উঠিয়া গিয়াছে, চারিধারে প্রভাতী রৌদ্রের মেলা। পথের ধারে বনতুলসীর জঙ্গল, মাঠের ঘাসে এখনও স্থানে স্থানে শিশির জমিয়া আছে, কোন বুপকথার দেশের মাকড়সা যেন বুপলি জাল বুনিয়া রাখিয়াছে। মাঝে মাঝে কিসের একটা গন্ধ, বিশেষ কোনও ফুল ফলের গন্ধ নয়। কিন্তু। শিশিরসিক্ত ঘাস, সকালের বাতাস, অড়হরের ক্ষেত, এখানে ওখানে বনজ গাছপালা, সবসুদ্ধ মিলাইয়া একটা সুন্দর সুগন্ধ।
অনেকদিন পরে এই সব গাছপালার প্রথম দৰ্শন অপুর প্রাণে একটা উল্লাসের ঢেউ উঠিল। অপূর্ব অদ্ভুত, সুতীব্র; মিনমিনে ধরনের নয়, পানসে গানসে জোলো ধরনের নয়। অপুর মন সে শ্রেণীরই নয় আদৌ, তাহা সেই শ্রেণীর যাহা জীবনের সকল অবদানকে, ঐশ্বর্যকে প্ৰাণপণে নিংড়াইয়া চুযিয়া আঁটিসার করিয়া খাইবার ক্ষমতা রাখে। অল্পেই নাচিয়া ওঠে, অল্পে দমিয়াও যায়—যদিও পুনরায় নাচিয়া উঠিতে বেশি বিলম্ব করে না।
মনসাপোতা গ্রামে যখন গাড়ি ঢুকিল তখন বেলা দুপুর। সর্বজয়া ছাইয়ের পিছন দিকের ফাঁক দিয়া চাহিয়া দেখিতেছে তাহার নূতনতম জীবনযাত্রা আরম্ভ করিবার স্থানটা কি রকম। তাহার মনে হইল গ্রামটাতে লোকের বাস একটু বেশি, একটু যেন বেশি ঠেসাঠেসি, ফাকা জায়গা বেশি নাই, গ্রামের মধ্যে বেশি বনজঙ্গলের বালাইও নাই। একটা কাহাদের বাড়ি, বাহির-বাটীর দাওয়ায় জনকয়েক লোক গল্প করিতেছিল, গোরুর গাড়িতে কাহারা আসিতেছে দেখিয়া চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল। উঠানে বাঁশের আলনায় মাছ ধরিবার জাল শুকাইতে দিয়াছে। বোধ হয়। গ্রামের জেলেপাড়া।
আরও খানিক গিয়া গাড়ি দাঁড়াইল। ছোট্ট উঠানের সামনে একখানি মাঝারি গোছের চালাঘর, দু-খানা ছোট্ট দোচালা ঘর, উঠানে একটা পেয়ারা গাছ ও একপাশে একটা পাতকুয়া। বাড়ির পিছনে একটা তেঁতুল গাছ–তাহার ডালপালা বড়ো চালাঘরখানার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। সামনের উঠানটা বাঁশের জাফরি দিয়া ঘেরা। চক্ৰবর্তী মহাশয় গাড়ি হইতে নামিলেন। অপু মা’কে হাত ধরিয়া নামাইল।
চক্ৰবর্তী মহাশয় আসিবার সময় যে তেলিবাড়ির উল্লেখ করিয়াছিলেন, বৈকালের দিকে তাহাদের বাড়ির সকলে দেখিতে আসিল। তেলি-গিন্নি খুব মোটা, রং বেজায় কালো। সঙ্গে চারপাঁচটি ছেলেমেয়ে, দুটি পুত্রবধু। প্রায় সকলেরই হাতে মোটা মোটা সোনার অনন্ত দেখিয়া সর্বজয়ার মন সম্রামে পূর্ণ হইয়া উঠিল। ঘরের ভিতর হইতে দু-খানা কুশাসন বাহির করিয়া আনিয়া সলজ্জা ভাবে বলিল, আসুন আসুন, বসুন।
তেলি-গিন্নি পায়েরু ধূলা লইয়া প্ৰণাম করিলে ছেলেমেয়ে ও পুত্রবধুরাও দেখাদেখি তাহাই করিল। তেলি-গিন্নি হাসিমুখে বলিল, দুপুরবেলা এলেন মা-ঠাকরুন। একবার বলি যাই। এই যে পাশেই বাড়ি, তা আসতে পেলাম না। মেজছেলে এলো গোয়াড়ী থেকে-গোয়াড়ীতে দোকান আছে কি-না! মেজ বৌমার মেয়েটাও ন্যাওটো, মা দেখতে ফুরসত পায় না, দুপুরবেলা আমাকে একেবারে পেয়ে বসে-ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বেলা দুটো! ঘুঙড়ি কাশি, গুপী কবরেজ বলেছে ময়ূরপুচ্ছ পুড়িয়ে মধু দিয়ে খাওয়াতে। তাই কি সোজাসুজি পুড়ুলে হবে মা, চৌষট্টি ফৈজৎ—কাসার ঘটির মধ্যে পোরো, তা ঘুটের জ্বাল করো, তা টিমে আঁচে চড়াও। হ্যারে হাজরী, ভোঁদা গোয়াড়ী থেকে কাল মধু এনেছে কি-না জানিস?
আঠারো-উনিশ বছরের একটি মেয়ে ঘাড় নাড়িয়া কথাব উত্তর দিবার পূর্বেই তেলি-গিন্নি তাহাকে দেখাইয়া বলিল, ওইটি আমার মেজ মেয়ে-বহরমপুরে বিয়ে দিয়েচি। জামাই বড়োবাজারে এদের দোকানে কাজকর্ম করেন। নিজেদেরও গোলা, দোকান রয়োচে কালনা-বেয়াই সেখানে দেখেন শোনেন। কিন্তু হলে হবে কি মা—এমন কথা ভূভারতে কেউ কখনও শোনে নি। দুই ছেলে, নাতি নাতনী, বেয়ান মারা গেলেন ভাদর মাসে, মাঘ মাসে বুড়ো আবার বিয়ে করে আনলে। এখন ছেলেদের সব দিয়েছে ভেন্ন করে। জামাইয়ের মুশকিল, ছেলেমানুষ-তা। উনি বলেছেন, তা এখন তুমি বাবা আমাদের দোকানেই থাকো, কাজ দেখো শোনো শেখো, ব্যবসাদারের ছেলে, তারপর একটা হিল্পে লাগিয়ে দেওয়া যাবে।
বড়ো পুত্রবধূ এতক্ষণ কথা বলে নাই। সেইহাদের মতো জুড়ু বানিস নয়, বেশ টকটকে রং। বোধ হয় শহর-অঞ্চলের মেয়ে। এ-দলের মধ্যে সেই সুন্দরী, বয়স বাইশ-তেইশ হইবে। সে নিচের ঠোঁটের কেমন চমৎকার এক প্রকার ভঙ্গি করিয়া বলিল, এরা এসেছেন, সারাদিন খাওয়া-দাওয়া হয় নি, এঁদের আজকের সব ব্যবস্থা তো করে দিতে হবে? বেলাও তো গিয়েছে, এঁরা আবার রান্না করবেন!
এই সময় অপু বাড়ির উঠানে ঢুকিল। সে আসিয়াই গ্রামখানা বেড়াইয়া দেখিতে বাহিরে গিয়াছিল। তেলি-গিন্নি বলিল-কে মা-ঠাকরুন? ছেলে বুঝি? এই এক ছেলে? বাঃ, চেহারা যেন রাজপুত্ত্বর।
সকলেরই চোখ তাহার উপর পড়িল। অপু উঠানে ঢুকিয়াই এতগুলি অপরিচিতের সম্মুখে পড়িয়া কিছু লজ্জিত ও সংকুচিত হইয়া উঠিল। পাশ কাটাইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিতেছিল, তাহার মা বলিল, দাঁড়া না। এখেনে। ভারি লাজুক ছেলে মা-এখন ওইটুকুতে দাঁড়িয়েচে-আর এক মেয়ে ছিল, তা-সর্বজয়ার গলার স্বর ভারী হইয়া আসিল। গিন্নি ও বড়ো পুত্রবধূ একসঙ্গে বলিল, নেই, হ্যাঁ মা? সর্বজয়া বলিল, সে কি মেয়ে মা! আমায় ছলতে এসেছিল, কি চুল, কি চোখ, কি মিষ্টি কথা? বকো-ঝাঁকো, গাল দাও, মা’র মুখে উঁচু কথাটি কেউ শোনে নি কোনদিন।
ছোট বউ বলিল, কত বয়সে গেল মা?
–এই তেরোয় পড়েই-ভাদ্র মাসে তেরোয় পড়ল, আশ্বিন মাসের ৭ই-দেখতে দেখতে চার বছর হয়ে গেল।
তেলি-গিন্নি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া কহিল-আহা মা, তা কি করবে বলো, সংসারে থাকতে গেলে সবই…তাই উনি বললেন-আমি বললাম। আসুন তারা-চাকতি মশায় পূজা-আচ্চা করেনতা উনি মেয়েজামাই মারা যাওয়ার পর থেকে বড়ো থাকেন না। গায়ে একঘর বামুন নেই।– কাজকর্মে সেই গোয়াড়ী দৌড়তে হয়-থাকলে ভালো! বীরভূম না বাঁকড়ো জেলা থেকে সেবার এলো কি চাটুজ্যে। কি নামটা রে পাঁচী? বললে বাস করবো। বাড়ি থেকে চালডাল সিধে পাঠিয়ে দিই। তিন মাস রইল, বলে আজ ছেলেপিলে আনব্য-কাল ছেলেপিলে আনব-ও মা, এক মাগী গোয়ালার মেয়ে উঠোন ঝাঁট দিত। আমাদের, তা বলি বামুন মানুষ এসেছে, ওঁরাও কাজটা করে দিস।। ঘেন্নার কথা শোনো মা, আবা বছর শিবরাত্রির দিন-তাকে নিয়ে—
বউ-দুটি ও মেয়েরা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
সর্বজয়া অবাক হইয়া বলিল, পালালো নাকি?
–পালালো কি এমন তেমন পালালো মা? সেই সঙ্গে আমাদের এক প্রস্থ বাসন। কিছুই জানি নে মা, সব নিজের ঘর থেকে.বলি আহা বামুন এসেচে-সবুক, আছে বাড়তি। তা সেই বাসন সবসুদ্ধ নিয়ে দুজনে নিউদ্দিশ! যাক সে সব কথা মা, উঠি তাহলে আজ। রান্নার কি আছে না-আছে বলে মা, সব দিই বন্দোবস্ত করে।
আট-দশ দিন কাটিয়া গেল; সর্বজয়া ঘরবাড়ি মনের মতো করিয়া সাজাইয়াছে। দেওয়াল উঠান নিকাইয়া পুঁছিয়া লইয়াছে। নিজস্ব ঘরদের অনেকদিন ছিল না, নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া অবধিই নাই-এতদিন পরে একটা সংসারের সমস্ত ভার হাতে পাইয়া সে গত চার বৎসরের সঞ্চিত সাধ মিটাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
জ্যাঠামশায় লোক মন্দ নহেন বটে, কিন্তু শীঘ্রই সর্বজয়া দেখিল তিনি একটু বেশি কৃপণ। ক্ৰমে ইহাও বোঝা গেল—তিনি যে নিছক পরার্থপরতার ঝোঁকেই ইহাদের এখানে আনিয়াছেন অহা নহে, অনেকটা আনিয়াছেন নিজের গরজে। তেলিদের প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরটি পূজা না করিলে সংসায় ভালো রূপ চলে না, তাহাদের বার্ষিক বৃত্তিও বন্ধ হইয়া যায়। এই বার্ষিক বৃত্তি সম্বল করিয়াই তিনি কাশী থাকেন। পাকা লোক, অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া তবে তিনি ইহাদের আনিয়া তুলিয়াছেন। সর্বজয়াকে প্রায়ই বলেন–জয়া, তোর ছেলেকে বল কাজকর্ম সব দেখে নিতে। আমার মেয়াদ আর কতদিন? ওদের বাড়ির কাজটা দিক না আরম্ভ করে-সিধের চালেই তো মাস চলে যাবে।
সর্বজয় তাহাতে খুব খুশি।
সকলের তাগিদে শীঘ্রই অপু পূজার কাজ আরম্ভ কুরিল-দুটি একটি করিয়া কাজকর্ম আরম্ভ হইতে হইতে ক্ৰমে এপাড়ায় ওপাড়ায় অনেক বাড়ি হইতেই লক্ষ্মীপূজায় মাকালীপূজায় তাহার ডাক আসে। অপু মহা উৎসাহে প্ৰাতঃস্নান করিয়া উপনয়নের চেলির কাপড় পরিয়া নিজের টিনের বাক্সের বাংলা নিত্যকর্মপদ্ধতিখানা হাতে লইয়া পূজা করিতে যায়। পূজা করিতে বসিয়া আনাড়ির মতো কোন অনুষ্ঠান করিতে কোন অনুষ্ঠান করে। পূজার কোন পদ্ধতি জানে না-বার বার বইয়ের উপর বুকিয়া পড়িয়া দেখে কি লেখা আছে-“বজায় তুং বলিবার পর শিবের মাথায় বঞ্জের কি গতি করিতে হইবে—‘ওঁ ব্ৰহ্মপৃষ্ঠ ঋষি সূতলছন্দঃ কূর্মো দেবতা’ বলিয়া কোন মুদ্রায় আসনের কোণ কি ভাবে ধরিতে হইবে।-কোনরকমে গোজামিল দিয়া কোজ সারিবার মতো পটুত্বও তাহার আয়ত্ত হয়। নাই, সুতরাং পদে পদে আনাড়িপনা টুকু ধরা পড়ে।
একদিন সেটুকু বেশি করিয়া ধরা পড়িল ওপাড়ার সরকারদের বাড়ি। যে ব্ৰাহ্মণ তাহাদের বাড়িতে পূজা করিত, সে কি জন্য রাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, গৃহদেবতা নারায়ণের পূজার জন্য তাহাদের লোক অপুকে ডাকিয়া লইয়া গেল। বাড়ির বড়ো মেয়ে নিরুপমা পূজার জোগাড় করিয়া দিতেছিল, চৌদ্দ বৎসরের ছেলেকে চেলি পরিয়া পুঁথি বগলে গভীর মুখে আসিতে দেখিয়া সে একটু অবাক হইল। জিজ্ঞাসা করিল, তুমি পুজো করতে পারবে? কি নাম তোমার? চাকতি মশায় তোমার কে হন?
মুখচোরা অপুর মুখে বেশি কথা জোগাইল না, লাজুক মুখে সে গিয়া আনাড়ির মতো আসনের উপর বসিল।
পূজা কিছুদূর অগ্রসর হইতে না হইতে নিরুপমার কাছে পূজারির বিদ্যা ধরা পড়িয়া গেল। নিরুপমা হাসিয়া বলিল, ওকি? ঠাকুর নামিয়ে আগে নাইয়ে নাও, তবে তো তুলসী দেবে?–
অপু থতমত খাইয়া ঠাকুর নামাইতে গেল।
নিরুপমা বসিয়া পড়িয়া বলিল-উঁহু, তাড়াতাড়ি কোরো না। এই টাটে আগে ঠাকুর নামাও-আচ্ছা, এখন বড়ো তাম্রকুণ্ডুতে জল ঢালো–
অপু ঝুঁকিয়া পড়িয়া বইয়ের পাতা উলটাইয়া স্নানের মন্ত্র খুঁজতে লাগিল। তুলসীপত্র পরাইয়া শালগ্রামকে সিংহাসনে উঠাইতে যাইতেছে, নিরুপমা বলিল, ওকি? তুলসীপাত উপুড় করে পরাতে হয় বুঝি? চিৎ করে পরাও–
ঘামে রাঙামুখ হইয়া কোনরকমে পূজা সাঙ্গ করিয়া অপু চলিয়া আসিতেছিল, নিরুপমা ও বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা তাহাকে আসন পাতিয়া বসাইয়া ভোগের ফলমূল ও সন্দেশ জলযোগ করাইয়া। তবে ছাড়িয়া দিল।
মাসখানেক কাটিয়া গেল।
অপুর কেমন মনে হয় নিশ্চিন্দিপুরের সে অপূর্ব মায়ারূপ এখানকার কিছুতেই নাই। এই গ্রামে নদী নাই, মাঠ থাকিলেও সে মাঠ নাই, লোকজন বেশি, গ্রামের মধ্যেও লোকজন বেশি। নিশ্চিন্দিপুরের সেই উদার স্বপ্নমাখানো মাঠ, সে নদীতীর এখানে নাই, তাদের দেশের মতো গাছপালা, কত ফুলফল, পাখি, নিশ্চিন্দিপুরের সে অপূর্ব বন-বৈচিত্র্য, কোথায় সে সব? কোথায় সে নিবিড় পুম্পিত ছাতিম বন, ডালে ডালে সোনার সিঁদুর ছড়ানো সন্ধ্যা?
সরকার-বাড়ি হইতে আজকাল প্রায়ই পূজা করিবার ডাক আসে। শান্তস্বভাব, সুন্দর ও চেহারার গুণে অপুকেই আগে চায়। বিশেষ বারব্রতের দিনে পূজাপত্র সারিয়া অনেক বেলায় সে ধামা করিয়া নানাবাড়ির পূজার নৈবেদ্য ও চাল-কলা বহিয়া বাড়ি আনে। সর্বজয়া হাসিমুখে বলে, ওঃ, আজ চাল তো অনেক হয়েচে!–দেখি! সন্দেশ কদের বাড়ির নৈবিদ্যিতে দিল রে!
অপু খুশির সহিত দেখাইয়া বলে, কুণ্ডুবাড়ি থেকে কেমন একছড়া কলা দিয়েচে, দেখেচো মা?
সর্বজয়া বলে, এবার বোধহয় ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন, এদের ধরে থাকা যাক, গিন্নি লোক বড়ো ভালো। মেজছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে তত্ত্ব পাঠিয়েচে-অসময়ের আম-অমনি আমার এখানে পাঠিয়ে দিয়েচে-খাস এখন দুধ দিয়ে।
এত নানারকমের ভালো জিনিস সর্বজয়া কখনও নিজের আয়ত্তের মধ্যে পায় নাই। তাহার কতকালের স্বপ্ন! নিশ্চিন্দিপুরের বাড়িতে কত নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে, উঠানের উপর ঝুঁকিয়া-পড়া বাঁশবনের পত্ৰস্পন্দনে, ঘুঘুর ডাকে, তাহার অবসন্ন অন্যমনস্ক মন যে অবাস্তব সচ্ছলতার ছবি আপন মনে ভাঙ্গিত গড়িত-হাতে খরচ নাই, ফুটা বাড়িতে জল পড়ে বৃষ্টির রাত্রে, পাড়ায় মুখ পায় না, সকলে তুচ্ছ করে, তাচ্ছিল্য করে, মানুষ বলিয়াই গণ্য করে না-সে সব দিনের স্মৃতির সঙ্গে, আমবুল শাকের বনে পুরানো পাচিলের দীর্ঘছায়ার সঙ্গে যে সব দূরকালের দুরাশার রঙে রঙিন ভবিষ্যৎ জড়ানো ছিল–এই তো এতদিনে তাহারা পৃথিবীর মাটিতে নামিয়া আসিয়াছে।
পূজার কাজে অপুর অত্যন্ত উৎসাহী। রোজ সকালে উঠিয়া সে কলুপাড়ার একটা গাছ হইতে রাশীকৃত কচি কচি বেলপাতা পাড়িয়া আনে। একটা খাতা বাঁধিয়াছে, তাহাতে সর্বদা ব্যবহারের সুবিধার জন্য নানা দেব-দেবীর স্তবের মন্ত্র, মানের মন্ত্র, তুলসীদান প্ৰণালী লিখিয়া লইয়াছে। পাড়ায় পূজা করিতে নিজের তোলা ফুল-বেলপাতা লইয়া যায়, পূজার সকল পদ্ধতি নিখুঁতভাবে জানা না থাকিলেও উৎসাহ ও একাগ্রতায় সে সকল অভাব পূরণ করিয়া লয়।
বর্ষাকালের মাঝামাঝি অপু একদিন মাকে বলিল যে, সে স্কুলে পড়িতে যাইবে। সর্বজয়া আশ্চর্য হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কোন ইস্কুল রে?
–কেন, এই তো আড়াবোয়ালেতে বেশ ইস্কুল রয়েচে।
–সে তো এখেন থেকে যেতে-আসতে চার ক্রোশ পথ। সেখেনে যাবি হেঁটে পড়তে?
সর্বজয়া কথাটা তখনকার মতো উড়াইয়া দিল বটে, কিন্তু ছেলের মুখে কয়েকদিন ধরিয়া বার বার কথাটা শুনিয়া সে শেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, যা খুশি করো অপু, আমি জানি নে। তোমরা কোনো কালে কাবুর কথা তো শুনলে না? শুনবেও না-সেই একজন নিজের খেয়ালে সারাজন্ম কাটিয়ে গেল, তোমারও তো সে ধারা বজায় রাখা চাই! ইস্কুলে পড়বো! ইস্কুলে পড়বি তো এদিকে কি হবে? দিব্যি একটা যাহোক দাঁড়াবার পথ তুবু হয়ে আসছে—এখন তুমি দাও ছেড়ে–তারপর ইদিকেও যাক, ওদিকেও যাক
মায়ের কথায় সে চুপ করিয়া গেল। চক্ৰবর্তী মহাশয় গত পৌষ মাসে কাশী চলিয়া গিয়াছেন, আজকাল তাহাকেই সমস্ত দেখিতে শুনিতে হয়। সামান্য একটু জমি-জমা আছে, তাহার খাজনা আদায়, ধান কাটাইবার বন্দোবস্তু, দশকর্ম, গৃহদেবতার পূজা। গ্রামে ব্রাহ্মণ নাই, তাহারাই একঘর মোটে। চাষি কৈবর্ত ও অন্যান্য জাতির বাস, তাহা ছাড়া এ-পাড়ার কুণ্ডুরা ও ও-পাড়ার সরকারেরা। কাজে কর্মে ইহাদের সকলেরই বাড়ি অপুকে ষষ্ঠীপূজা, মাকালীপূজা করিয়া বেড়াইতে হয়। সবাই মানে, জিনিসপত্র দেয়।
সেদিন কি একটা তিথি উপলক্ষে সরকার-বাড়ি লক্ষ্মীপূজা ছিল। পূজা সারিয়া খানিক রাত্রে জিনিসপত্র একটা পুঁটুলি বাঁধিয়া লইয়া সে পথ বাহিয়া বাড়ির দিকে আসিতেছিল; খুব জ্যোৎস্না, সরকার বাড়ির সামনে নারিকেল গাছে কাঠঠোকরা শব্দ করিতেছে। শীত বেশ পড়িয়াছে; বাতাস খুব ঠাণ্ডা, পথে ক্ষেত্র কাপালির বেড়ায় আমড়া গাছে বাউল ধরিয়াছে। কাপালিদের বাড়ির বেগুনক্ষেতের উঁচুনিচু জমিতে এক জায়গায় জ্যোৎস্না পড়িয়া চক চক করিতেছে-পাশের অন্ধকার। অপু মনে মনে কল্পনা করিতে করিতে যাইতেছিল যে, উঁচু জায়গাটা একটা ভালুক, নিচুটা জলের চৌবাচ্চা, তার পরের উঁচুটা নুনের টিবি। মনে মনে ভাবিল-কমললেবু দিয়েচে, বাড়ি গিয়ে কমলালেবুখাবো। মনের সুখে শহরে-শেখা একটা গানের একটা চরণ সে গুনগুন করিয়া ধরিল—
সাগর-কূলে বসিয়া বিরলে হেরিব লহরীমালা–
অনেকদিনের স্বপ্ন যেন আবার ফিরিয়া আসে। নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে ইছামতীর তীরের বনে, মাঠে কত ধূসর অপরাহ্নের কত জ্যোৎস্না-রাতের সে-সব স্বপ্ন! এই ছোট্ট চাষাগাঁয়ে চিরকালই এ রকম ষষ্ঠীপূজা মাকালীপূজা করিয়া কাঁটাইতে হইবে?
সারাদিনের রোদো-পোড়া মাটি নৈশ শিশিরে স্নিগ্ধ হইয়া আসিয়াছে, এখন শীতের রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় তাহারই সুগন্ধ।
অপুর মনে হইল রেলগাড়ির চাকায় চাকায় যেন শব্দ হয়—ছোটঠাকুর-পো-বটঠাকুরপো-ছোটুঠাকুর-পো-বটঠাকুর-পো-
দুই-এক দিনের মধ্যে সে মায়ের কাছে কথাটা আবার তুলিল। এবার শুধু তোলা নয়, নিতান্ত নাছোড়বান্দা হইয়া পড়িল। আড়বোয়ালের স্কুল দুই ক্রোশ দূরে, তাই কি? সে খুব হ্যাঁটিতে পরিবে: এটুকু। সে বুঝি চিরকাল এই রকম চাষাগায়ে বসিয়া বসিয়া ঠাকুরপূজা করিবে? বাহিরে যাইতে পাবিবে না বুঝি?
তবু আরও মাস দুই কাটিল। স্কুলের পড়াশোনা সর্বজয়া বোঝে না, সে যাহা বোঝে তাহা পাইয়াছে। তবে আবার ইস্কুলে পড়িয়া কি লাভ? বেশ তো সংসার গুছাইয়া উঠিতেছে। আর বছর কয়েক পরে ছেলের বিবাহ–তারপরই একঘর মানুষের মতো মানুষ।
সর্বজয়ার স্বপ্ন সার্থক হইয়াছে।
কিন্তু অপুর তাহা হয় নাই। তাহাকে ধরিয়া রাখা গেল না-শ্রাবণের প্রথমে সে আড়বোয়ালের মাইনর স্কুলে ভর্তি হইয়া যাতায়াত শুবু করিল।
এই পথের কথা সে জীবনের কোনোদিন ভোলে নাই-এই একটি বৎসর ধরিয়া কি অপরূপ আনন্দই পাইয়াছিল-প্রতিদিন সকালে-বিকালে এই পথ হ্যাঁটিবার সময়টাতে। …নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া অবধি এত আনন্দ আর হয় নাই।
ক্রোশ দুই পথ। দুধারে বট, তুঁতের ছায়া, ঝোপঝাপ, মাঠ, মাঝে মাঝে অনেকখানি ফাকা আকাশ। স্কুলে বসিয়া অপুর মনে হইত। সে যেন একা কতদূর বিদেশে আসিয়াছে, মন চঞ্চল হইয়া উঠিত-ছুটির পরে নির্জন পথে বাহির হইয়া পড়িত।-বৈকালের ছায়ায় ঢাঙা তাল-খেজুরগাছগুলা যেন দিগন্তের আকাশ ছুইতে চাহিতেছে-পিড়িং পিড়িং পাখির ডাক-ঘু হু মাঠের হাওয়ায় পাকা ফসলের গন্ধ আনিতেছে-সর্বত্র একটা মুক্তি, একটা আনন্দের বার্তা।…
কিন্তু সর্বাপেক্ষা সে আনন্দ পাইত পথচলতি লোকজনের সঙ্গে কথা কহিয়া। কত ধরনের লোকের সঙ্গে পথে দেখা হইত-কত দূর-গ্রামের লোক পথ দিয়া হ্যাঁটিত, কত দেশের লোক কত দেশে যাইত। অপু সবেমাত্র একা পথে বাহির হইয়াছে, বাহিরের পৃথিবীটার সহিত নতুন ভাবে পরিচয় হইতেছে, পথে ঘাটে সকলেব সঙ্গে আলাপ করিয়া তাহদের কথা জানিতে তাহার প্রবল আগ্রহ। পথ চলিবার সময়টা এইজন্য বড়ো ভালো লাগে, সাগ্রহে সে ইহার প্রতীক্ষা করে, স্কুলের ছুটির পর পথে নামিয়াই ভাবে-এইবার গল্প শুনবো। পরে ক্ষিপ্ৰপদে আগইয়া আসিয়া কোনো অপরিচিত লোকের নাগাল ধরিয়া ফেলে। প্রায়ই চাষালোক, হাতে খুঁকোকন্ধে। অপু জিজ্ঞাসা কবেকোথায় যোচ্ছ, হ্যাঁ কাক? চলো আমি মনসাপোতা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে যাবো। মামজোয়ান গিাইছিলে? তোমাদের বাড়ি বুঝি? না? শিকড়ে? নাম শুনেচি, কোনদিকে জানি নে। কি খেয়ে সকালে বেরিয়েছ, হ্যাঁ কাকা?…
তারপর সে নানা খুঁটিনাটি কথা জিজ্ঞাসা করে-কেমন সে গ্রাম, ক’ঘর লোকের বাস, কোন নদীর ধারে? ক’জন লোক তাদের বাড়ি, কত ছেলেমেয়ে, তারা কি করে?.
কত গল্প, কত গ্রামের কিংবদন্তি, সেকাল-একালের কত কথা, পল্পী-গৃহস্থের কত সুখদুঃখের কাহিনী-সে। শুনিয়াছিল এই এক বৎসরে। সে চিরদিন গল্প-পাগলা, গল্প শুনিতে শুনিতে আহার-নিদ্ৰা ভুলিয়া যায়-যন্ত সামান্য ঘটনাই হোক, তাহার ভালো লাগে। একটা ঘটনা মনে কি গভীর রেখাপাতই করিয়াছিল!
কোন গ্রামের এক ব্ৰাহ্মণবাড়ির বৌ এক বাগদীর সঙ্গে কুলের বাহির হইয়া গিয়াছিল-আজ অপুর সঙ্গীটি এইমাত্র তাকে শামুকপোতার বিলে গুগলি তুলিতে দেখিয়া আসিয়াছে। পরনে ছেঁড়া কাপড়, গায়ে গহনা নাই, ডাঙায় একটি ছোটছেলে বসিয়া আছে, বোধ হয় তাহারই। অপু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোমার দেশের মেয়ে? তোমায় চিনতে পারলে?
হ্যাঁ, চিনিতে পারিয়াছিল। কত কাঁদিল, চোখের জল ফেলিল, বাপ-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করিল। অনুরোধ করিল যেন এসব কথা দেশে গিয়া সে না বলে। বাপ-মা শুনিয়া কষ্ট পাইবে। সে বেশ সুখে আছে। কপালে যাহা ছিল, তাহা হইয়াছে।
সঙ্গীটি উপসংহারে বলিল, বামুন-বাড়ির বৌ, হর্তেলের মতো গায়ের রঙ-যেন ঠাকরুনের পিরতিমে!
দুর্গ-প্রতিমার মতো রূপসী একটি গৃহস্থবধূ ছেঁড়া কাপড় পরনে, শামুকপোতার বিলে হাঁটুজল ভাঙিয়া চুপড়ি হাতে গুগলি তুলিতেছে-কত কাল ছবিটা তাহার মনে ছিল!
সেদিন সে স্কুলে গিয়া দেখিল স্কুলসুদ্ধ লোক বেজায় সন্ত্রস্ত! মাস্টারেরা এদিক ওদিক ছুটািছুটি করিতেছেন। স্কুল-ঘর গাঁদা ফুলের মালা দিয়া সাজানো হইতেছে, তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় খামোখা একটি সুবৃহৎ সিঁড়ি-ভাঙা ভগ্নাংশ কষিয়া নিজের ক্লাসের বোর্ড পুরাইয়া রাখিয়াছেন। হঠাৎ আজ স্কুল-ঘরের বারান্দা ও কম্পাউন্ড এত সাফ করিয়া রাখা হইয়াছে যে, যাহারা বারোমাস এস্থানের সহিত পরিচিত, তাহদের বিস্মিত হইবার কথা। হেডমাস্টার ফণীবাবু খাতপত্র, অ্যাডমিশন বুক, শিক্ষকগণের হাজিরা বই লইয়া মহা ব্যস্ত। সেকেন্ড পণ্ডিতকে ডাকিয়া বলিলেন, ও অমূল্যবাবু, চৌঠে তারিখে খাতায় যে নাম সই করেন নি? আপনাকে বলে বলে আর পারা গেল না। দেরিতে এসেছিলেন তো খাতায় সই করে ক্লাসে গেলেই হত? সব মনে থাকে, এইটের বেলাতেই
অপু শুনিল একটার সময় ইন্সপেক্টর আসিবেন স্কুল দেখিতে। ইন্সপেক্টর আসিলে কি করিযা উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিতে হইবে, তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় ক্লাসের ছেলেদের সে বিষয়ে তালিম দিতে লাগিলেন।
বারোটার কিছু পূর্বে একখানা ঘোড়ার গাড়ি আসিয়া স্কুলের সামনে থামিল। হেডমাস্টার তখনও ফাইল দূরস্ত শেষ করিয়া উঠিতে পারেন নাই বোধ হয়-তিনি এত সকালে ইন্সপেক্টর আসিয়া পড়াটা প্রত্যাশা করেন নাই, জানাল দিয়া উঁকি মারিয়া গাড়ি দেখিতে পাইয়াই উঠি-পড়ি অবস্থায় ছুটিলেন। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় হঠাৎ তড়িৎ স্পষ্ট ভেকের মতো সজীব হইয়া উঠিয়া তারস্বরে ও মহা উৎসাহে। (অন্যদিন এই সময়টাই তিনি ক্লাসে বসিয়া মাধ্যাহিক নিদ্রাটুকু উপভোগ করিয়া থাকেন) দ্রব পদার্থকহাকে বলে তাহার কর্ণনা আরম্ভ করিলেন। পাশের ঘরে সেকেন্ড পণ্ডিত মহাশয়ের ইকোর শব্দ অদ্ভুত ক্ষিপ্ৰতার সহিত বন্ধ হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার উচ্চকণ্ঠ শোনা যাইতে লাগিল। শিক্ষক বলিলেন, মতি, তোমরা অবশ্যই কমললেবু দেখিয়াছ, পৃথিবীর আকারএই হরেন-কমললেবুর ন্যায় গোলাকার–
হেডমাস্টারের পিছনে পিছনে ইন্সপেক্টর স্কুল ঘরে ঢুকিলেন। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বৎসর হইবে, বেঁটে, গৌরবর্ণ, সাটিন জিনের লম্বা কোট গায়ে, সিল্কের চাদর গলায়, পায়ে সাদা ক্যাম্বিশের জুতা, চোখে চশমা। গলার স্বর ভারী। প্রথমে তিনি অফিস-ঘরে ঢুকিয়া খাতপত্র অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখার পরে বাহির হইয়া হেডমাস্টারের সঙ্গে ফাস্ট ক্লাসে গেলেন। অপুর বুক টিপ, টিপ করিতেছিল। এইবার তাঁহাদের ক্লাসে আসিবার পালা। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় গলার সুর আর এক গ্রাম চড়াইলেন।
ইন্সপেক্টর ঘরে ঢুকিয়া বোর্ডের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এরা কি ভগ্নাংশ ধরেছে? তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয়ের মুখ আত্মপ্রসাদে উজ্জ্বল দেখাইল; বলিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, দু-ব্লাসে আমি অঙ্ক কাবাই কি না। ও ক্লাসেই অনেকটা এগিয়ে দিই-সরল ভগ্নাংশটা শেষ করে ফেলি
ইন্সপেক্টর এক এক করিয়া বাঙলা রিডিং পড়িতে বলিলেন। পড়িতে উঠিয়াই অপুর গলা কাঁপিতে লাগিল। শেষের দিকে তাহার পড়া বেশ ভালো হইতেছে বলিয়া তাহার নিজেরই কানে ঠেকিল। পরিষ্কার সতেজ বাঁশির মতো গলা। রিনারিনে মিষ্টি।
–বেশ, বেশ রিডিং। কি নাম তোমার?
তিনি আরও কয়েকটি প্রশ্ন করিলেন। তারপর সবগুলি ক্লাস একে একে ঘুরিয়া আসিয়া জলের ঘরে ডাব সন্দেশ খাইলেন। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় অপুকে বলিলেন, তুই হাতে করে এই ছুটির দরখাস্তখানা নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাক, তোকে খুব পছন্দ করেছেন, যেমন বাইরে আসবেন, অমনি দরখাস্তখানা হাতে দিবি—দু-দিন ছুটি চাইবি-তোর কথায় হয়ে যাবে-এগিয়ে যা।
ইন্সপেক্টর চলিয়া গেলেন। তঁহার গাড়ি কিছুদূর যাইতে না যাইতে ছেলেরা সমস্বরে কলরব করিতে করিতে স্কুল হইতে বাহির হইয়া পড়িল। হেডমাস্টার ফণীবাবু অপুকে বলিলেন, ইন্সপেক্টর বাবু খুব সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছেন তোমার ওপর। বোর্ডের একজামিন দেওয়াব তোমাকে দিয়ে-তৈরি হও, বুঝলে?
বোর্ডের পরীক্ষা দিতে মনোনীত হওয়ার জন্য যত না হউক, ইন্সপেক্টরের পরিদর্শনের জন্য দুদিন স্কুল বন্ধ থাকিবার আনন্দে উৎফুল্প হইয়া সে বাড়ির দিকে রওনা হইল। অন্যদিনের চেয়ে দেরি হইয়া গিয়াছে। অর্ধেক পথ চলিয়া আসিয়া পথের ধারে একটা সাঁকোর উপর বসিয়া মায়ের দেওয়া খাবারের পুঁটুলি খুলিয়া বুটি, নারিকেলকোরা ও গুড় বাহির করিল। এইখানটাতে বসিয়া রোজ সে স্কুল হইতে ফিরিবার পথে খাবার খায়। রাস্তার বাঁকের মুখে সাঁকোটা, হঠাৎ কোনো দিক হইতে দেখা যায় না, একটা বড়ো তুতি-গাছের ডালপালা নত হইয়া ছায়া ও আশ্রয় দুই-ই জোগাইতেছে। সাঁকোর নিচে আমরুল শাকের বনের ধারে একটু একটু জল বাধিয়াছে, মুখ বাড়াইলেই জলে ছায়া পড়ে। অপুর কেমন একটা অস্পষ্ট ভিত্তিহীন ধারণা আছে যে, জলটা মাছে ভর্তি, তাই সে একটু একটু বুটির টুকরা উপর হইতে ফেলিয়া দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখে মাছে ঠোকরাইতেছে কি না।
সাঁকোর নিচের জলে হাত মুখ ধুইতে নামিতে গিয়া হঠাৎ তাহার চোখ পড়িল একজন ঝাঁকড়া-চুল কালোমতো লোক রাস্তার ধারের মাঠে নামিয়া লতা-কাঠি কুড়াইতেছে। অপু কৌতূহলী হইয়া চাহিয়া রহিল। লোকটা খুব লম্বা নয়, বেঁটে ধরনের, শক্ত হাত পা, পিঠে একগাছা বড়ো ধনুক, একটা বড়ো বেঁচেকা, মাথার চুল লম্বা লম্বা, গলায় রাঙা সবুজ হিংলাজের মালা। সে অত্যন্ত কৌতূহলী হইয়া ডাকিয়া বলিল, ওখানে কি খুঁজচো? পরে লোকটির সঙ্গে তাহার আলাপ হইল। সে জাতিতে সাঁওতাল, অনেক দূরে কোথায় দুমকা জেলা আছে, সেখানে বাড়ি। অনেক দিন বর্ধমানে ছিল, বাঁকা বাঁকা বাংলা বলে, পায়ে হ্যাঁটিয়া সেখান হইতে আসিতেছে। গন্তব্য স্থান অনিৰ্দেশ্যএরূপে যতদূর যাওয়া যায় যাইবে, সঙ্গে তীর ধনুক আছে, পথের ধারে বনে মাঠে যাহা শিকার মেলে-তাহাই খায়। সম্প্রতি একটা কি পাখি মারিয়াছে, মাঠের কোন ক্ষেত হইতে গোটকয়েক বড়ো বড়ো বেগুনও তুলিয়াছে-তোহ্যাঁই পুড়াইয়া খাইবার জোগাড়ে শুকনো লতা-কাঠি কুড়াইতেছে। অপু বলিল, কি পাখি দেখি? লোকটা ঝোলা হইতে বাহির করিয়া দেখাইল একটা বড়ো হড়িয়াল ঘুঘু। সত্যিকারের তীর ধনুক-যাহাতে সত্যিকারের শিকার সম্ভব হয়-অপু কখনও দেখে নাই। বলিল, দেখি একগাছা তীর তোমার? পরে হাতে লইয়া দেখিল, মুখে শক্ত লোহার ফলা, পিছনে বুনোেপাখির পালক বাঁধা-অদ্ভুত কৌতূহলপ্রদ ও মুগ্ধকর জিনিস!
–আচ্ছা এতে পাখি মারে, আর কি মরে?
লোকটা উত্তর দিল, সবই মারা যায়-খরগোশ, শিয়াল, বেজি, এমন কি বাঘ পর্যন্ত। তবে বাঘ মারিবার সময় তীরের ফলায় অন্য একটা লতার রস মাখাইয়া লইতে হয় …তাহার পর সে তুঁতগাছতলায় শুকনা পাতা লতার আগুন জ্বলিল। অপুর পা আর সেখান হইতে নড়িতে চাহিল না-মুগ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল, লোকটা পাখিটার পালক ছাড়াইয়া আগুনে ঝলসাইতে ছিল, বেগুনগুলাও পুড়াইতে দিল।
বেলা অত্যন্ত পড়িলে অপু বাড়ি রওনা হইল। আহার শেষ করিয়া লোকটা তখন তাহার বেঁচেক ও তীর ধনুক লইয়া রওনা হইয়াছে। এ রকম মানুষ সে তো কখনও দেখে নাই। বাঃযেদিকে দুই চোখ যায় সেদিকে যাওয়া-পথে পথে তীর ধনুক দিয়া শিকার করা, বনের লতাপাতা কুড়াইয়া গাছতলায় দিনের শেষে বেগুন পুড়াইয়া খাওয়া! গোটা আষ্টেক বড়ো বড়ো বেগুন সামান্য একটু নুনের ছিটা দিয়া গ্রাসের পর গ্রাস তুলিয়া কি করিয়াই নিমেষের মধ্যে সাবাড়া করিয়া ফেলিল।…
মাস কয়েক কাটিয়া গেল। সকালবেলা স্কুলের ভাত চাহিতে গিয়া অপু দেখিল রান্না চড়ানো হয় নাই। সর্বজয়া বলিল, আজ যে কুলুইচণ্ডী পুজো-আজি স্কুলে যাবি কি করে?…ওরা বলে গিয়েচে ওদের পুজোটা সেরে দেওয়ার জন্যে-পুজোবারে কি আর স্কুলে যেতে পারবি? বড় দেরি হয়ে যাবে।
-হ্যাঁ, তাই বইকি? আমি পুজো করতে গিয়ে স্কুল কামাই করি আর কি? আমি ওসব পারবো না, পুজোঁটুজো আমি আর করবো কি করে, রোজই তো পুজো লেগে থাকবে। আর আমি বুঝি রোজ রোজ-তুমি ভাত নিয়ে এসো আমি ওসব শুনছিনে-।
-লক্ষ্মী বাবা আমার। আচ্ছা, আজকের দিনটা পুজোটা সেরে নে। ওরা বলে গিয়েছে ওপাড়াসুদ্ধ পুজো হবে। চাল পাওয়া যাবে এক ধামার কম নয়, মানিক আমার, কথা শোনো, শুনতে হয়।
অপু কোন মতেই শুনিল না। অবশেষে না খাইয়াই স্কুলে চলিয়া গেল। সর্বজয়া ভাবে নাই যে, ছেলে সত্যসত্যই তাহার কথা ঠেলিয়া না খাইয়া স্কুলে চলিয়া যাইবে। যখন সত্যই বুঝিতে পারিল, তখন তাহার চোখের জল আর বাধা মানিল না। ইহা সে আশা করে নাই।
অপু স্কুলে পৌঁছিতেই হেডমাস্টার ফণীবাবু তাহাকে নিজের ঘরে ডাক দিলেন। ফণীবাবুর ঘরেই স্থানীয় ব্রাঞ্চ পোস্ট-অফিস, ফণীবাবুই পোস্ট-মাস্টার। তিনি তখন ডাকঘরের কাজ করিতেছিলেন। বলিলেন, এসো অপূর্ব, তোমার নম্বর দেখবো? ইন্সপেক্টর অফিস থেকে পাঠিয়ে দিয়েচে-বোর্ডের এগজামিনে তুমি জেলার মধ্যে প্রথম হয়েচ–পাঁচ টাকার একটা স্কলারশিপ পাবে। যদি আরও পড়ো’তবে। পড়বে তো?
এই সময়ে তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় ঘরে ঢুকিলেন। ফণীবাবু বলিলেন, ওকে সে কথা এখন বললাম পণ্ডিতমশাই! জিজ্ঞাসা করচি, আরও পড়বে তো? তৃতীয় পণ্ডিত বলিলেন, পড়বে না, বাঃ! হীরের টুকরো ছেলে, স্কুলের নাম রেখেছে। ওরা যদি না পড়ে তো পড়বে কে, কেষ্ট তেলির বেটা গোবর্ধন? কিছু না, আপনি ইন্সপেক্টর অফিসে লিখে দিন যে, ও হাই স্কুলে পড়বে। ওর আবার জিজ্ঞেসটা কি?-ওঃ, সোজা পরিশ্রম করিচি মশাই ওকে ভগ্নাংশটা শেখাতে?
প্রথমটা অপু যেন ভালো করিয়া কথাটা বুঝিতে পারিল না। পরে যখন বুঝিল তখন তাঁহার মুখে কথা জোগাইল না। হেডমাস্টার একখানা কাগজ বাহির করিয়া তাহার সামনে ধরিয়া বলিলেন—এইখানে একটা নাম সই করে দাও তো। আমি কিন্তু লিখে দিলাম যে, তুমি হাই স্কুলে পড়বে। আজই ইন্সপেক্টর অফিসে পাঠিয়ে দেবো।
সকাল সকাল ছুটি লইয়া বাড়ি ফিরিবার পথে মায়ের করুণ মুখচ্ছবি বার বার তাহার মনে আসিতে লাগিল। পথের পাশে দুপুরের রৌদ্রভরা শ্যামল মাঠ, প্রাচীন তুঁত বটগাছের ছায়া, ঘন শালপত্রের অন্তরালে ঘুঘুর উদাস কণ্ঠ, সব যেন করুণ হইয়া উঠিল। তাহার মনে এই অপূর্ব করুণ ভাবটি বড়ো গভীর ছাপ রাখিয়া গিয়াছিল। আজিকার দুপুরটির কথা উত্তর জীবনে বড়ো মনে আসিত তাহার। কত-কতদিন পরে আবার এই শ্যামচ্ছায়াভিরা বীথি, বাল্যের অপরূপ জীবনানন্দ, ঘুঘুর ডাক, মায়ের মনের একদিনের দুঃখটি-অনস্তের মণিহারে গাঁথা দানাগুলির একটি, পশ্চিম দিগন্তে প্রতি সন্ধ্যায় ছিঁড়িয়া-পড়া, বহুবিস্মৃত মুক্তাবলীর মধ্যে কেমন করিয়া অক্ষয় হইয়া ছিল।
বাড়িতে তাহার মাও আজ সারাদিন খায় নাই। ভাত চাহিয়া না পাইয়া ছেলে না খাইয়াই চলিয়া গিয়াছে স্কুলে-সৰ্বজয়া কি করিয়া খাবারের কাছে বসে? কুলুইচণ্ডীর ফলার খাইয়া অপু বৈকালে বেড়াইতে গেল।
গ্রামের বাহিরে ধঞ্চেক্ষেতের ফসল কাটিয়া লওয়া হইয়াছে। চারি ধারে খোলা মাঠ পড়িয়া আছে। আবার সেই সব রঙিন কল্পনা; সে পরীক্ষায় বৃত্তি পাইয়াছে। তার স্বপ্নের অতীত! মোটে এক বছর পড়িয়াই বৃত্তি পাইল!…সুমুখের জীবনের কত ছবিই আবার মনে আসে। ওই মাঠের পারে রক্তআকাশটার মতো। রহস্যস্বপ্নভরা যে অজানা অকুল জীবন-মহাসমুদ্র.পুলকে সারাদেহ শিহরিয়া উঠে। মাকে এখনও সব কথা বলা হয় নাই। মায়ের মনের বেদনার রঙে যেন মাঠ, ঘাট, অস্তদিগন্তের মেঘমালা রাঙানো। গভীর ছায়াভরা সন্ধ্যায় মায়ের দুঃখভরা মনটার মতো ঘুলি-ঘুলি অন্ধকার।
দালানের পাশের ঘরে মিটি মিটি প্ৰদীপ জ্বলিতেছে। সর্বজয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় ছেলেকে ওবেলার কুলুইচণ্ডী-ব্রতের চিড়ে-মুড়কির ফলার খাইতে দিল। নিকটে বসিয়া চাপাকলার খোসা ছাড়াইয়া দিতে দিতে বলিল, ওরা কত দুঃখু করলে আজ। সরকারবাড়ি থেকে বলে গেল তুই পুজো করবি-তারা খুঁজতে এলে আমি বললাম, সে স্কুলে চলে গিয়েছে। তখন তারা আবার ভৈরব চক্কত্তিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওই অত বেলায়–তুই যদি যেতিস–
—আজি না গিয়ে ভালো করিচি মা। আজ হেডমাস্টার বলেচে। আমি এগজামিনে স্কলারশিপ পেইচি। বড়ো স্কুলে পড়লে মাসে পাঁচ টাকা করে পাবো। স্কুলে যেতেই হেডমাস্টার ডেকে বললে–
সর্বজয়ার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কোথায় পড়তে হবে?
–মহকুমার বড়ো স্কুলে।
–তা তুই কি বললি?
–আমি কিছু বলি নি। পাঁচটা করে টাকা মাসে মাসে দেবে, যদি না পড়ি তবে তো আর দেবে না। ওতে মাইনে ফ্রি করে নেবে। আর ওই পাঁচ টাকাতে বোর্ডিং-এ থাকবার খরচও কুলিয়ে যাবে।
সর্বজয়া আর কোন কথা বলিল না। কি কথা সে বলিবে? যুক্তি এতই অকাট্য যে, তাহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার কিছুই নাই। ছেলে স্কলারশিপ পাইয়াছে, শহরে পড়িতে যাইবে, ইহাতে মাবাপের ছেলেকে বাধা দিয়া বাড়ি বসাইয়া রাখিবার পদ্ধতি কোথায় চলিত আছে? এ যেন তাহার বিরুদ্ধে কোন দণ্ডী তার নির্মম অকাট্য দণ্ড উঠাইয়াছে তাহার দুর্বল হাতের সাধ্য নাই যে ঠেকাইয়া রাখে। ছেলেও ওইদিকে ঝুঁকিয়াছে! আজিকার দিনটিই যেন কার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিল সে। ভবিষ্যতের সহস্ৰ সুখস্বপ্ন কুয়াশার মতো অনন্তে বিলীন হইয়া যাইতেছে কেন আজকের দিনটিতে বিশেষ করিয়া?
মাসখানেক পরে বৃত্তি পাওয়ার খবর কাগজে পাওয়া গেল।
যাইবার পূর্বদিন বৈকালে সর্বজয়া ব্যস্তভাবে ছেলের জিনিসপত্র গুছাইয়া দিতে লাগিল। ছেলে কখনও একা বিদেশে বাহির হয় নাই, নিতান্ত আনাড়ী, ছেলে-মানুষ ছেলে। কত জিনিসের দরকার হইবে, কে থাকিবে তখন সেখানে যে মুখে মুখে সব অভাব জোগাইয়া ফিরিবে, সব জিনিস হাতে লাইয়া বসিয়া থাকিবো? খুঁটিনাটি-একখানা কাঁথা পাতিবার, একখানি গায়ের-একটি জল খাইবার গ্লাস, ঘরের তৈরি এক শিশি সরের ঘি, এক পুঁটুলি নারিকেল নাড়ু, অপু ফুলকটা একটা মাঝারি জামবাটিতে দুধ খাইতে ভালোবাসে-সেই বাটিটা, ছোট একটা বোতলে মাখিবার চৈ-মিশানো নারিকেল তৈল, আরও কত কি। অপুর মাথার বালিশের পুরানো ওয়াড় বদলাইয়া নূতন ওয়াড় পরাইয়া দিল। দধি-যাত্রার আবশ্যকীয় দই একটা ছোট পাথরবাটিতে পাতিয়া রাখিল। ছেলেকে কি করিয়া বিদেশে চলিতে হইবে সে বিষয়ে সহস্র উপদেশ দিয়াও তাহার মনে তৃপ্তি হইতেছিল না। ভাবিয়া দেখিয়া যেটি বাদ দিয়াছে মনে হয় সেটি তখনই আবার ডাকিয়া বলিয়া দিতেছিল।
—যদি কেউ মারে-টারে, কত দুন্টু ছেলে তো আচে, আমনি মাস্টারকে বলে দিবি-বুঝলি? রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়িসা নে যেন ভাত খাবার আগে! এ তো বাড়ি নয় যে কেউ তোকে ওঠাবেখেয়ে তবে ঘুমুদ্বি-নিয়তো তাদের বলবি, যা হয়েচে তাই দিয়ে ভাত দাও-বুঝলি তো?
সন্ধ্যার পর সে কুণ্ডুদের বাড়ি মনসার ভাসান শুনিতে গেল। অধিকারী নিজে বেহুলা সাজিয়া পায়ে ঘুঙুর বাঁধিয়া নাচে-কেশ গানের গলা। খানিকটা শুনিয়া তাহার ভালো লাগিল না। শুধু ছড়া কাটা ও নাচ সে পছন্দ করে না,-যুদ্ধ নাই, তলোয়ার খেলা নাই, যেন পানসে-পানসে।
তবুও আজিকার রাতটি বড়ো ভালো লাগিল তাহার। এই মনসা ভাসানোর আসর, এই নূতন জায়গা, এই অচেনা গ্ৰাম্য বালকের দল, ফিরিবার পথে তাঁহাদের পাড়ার বাঁকে প্রস্ফুটিত হেনা ফুলেব গন্ধ-ভরা নৈশ বাতাস জোনাকি-জুলা অন্ধকারে কেমন মায়াময় মনে হয়।.
রাত্রে সে আরও দু-একটা জিনিস সঙ্গে লইল। বাবার হাতের লেখা একখানা গানের খাতা, বাবার উদ্ভট শ্লোকের খাতাখানা বড়ো পেটরাটা হইতে বাহির করিয়া রাখিল-বড়ো বড়ো গোটা গোটা ছাঁদের হাতের লেখাটা বাবার কথা মনে আনিয়া দেয়। গানগুলির সঙ্গে বাবার গলার সুর এমনভাবে জড়াইয়া আছে যে, সেগুলি পড়িয়া গেলেই বাবাব সুর কানে বাজে। নিশ্চিন্দিপুরের কত ক্রীড়াক্কাস্ত শান্ত সন্ধ্যা, মেঘমেদুর বর্ষামধ্যাহ্ন, কত জ্যোৎস্না-ভরা রহস্যময়ী রাত্রি বিদেশ-বিভুই-এব সেই দুঃখ-মাখানো দিনগুলির সঙ্গে এই গানের সুরা যেন জড়াইয়া আছে–সেই দশাশ্বমেধ ঘাটের রানা, কাশীর পরিচিত সেই বাঙালি কথকঠাকুর।
সর্বজয়ার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে, হয়তো ছেলে শেষ পর্যন্ত বিদেশে যাইবার মত করিবে না। কিন্তু তাহার অপু যে পিছনেব দিকে ফিরিয়াও চাহিতেছে না। সে যে এত খাটিয়া, একেওকে বলিয়া কহিয়া তাহার সাধ্যমতো যতটা কুলায়, ছেলেব ভবিষ্যৎ জীবনের অবলম্বন একটা খাড়া করিয়া দিয়াছিল–ছেলে তাহার পায়ে দলিয়া যাইতেছে–কি জানি কিসের টানে! কোথায়? তাহার মেহদুর্বল দৃষ্টি তাহাকে দেখিতে দিতেছিল না যে, ছেলের ডাক আসিয়াছে বাহিরের জগৎ হইতে। সে জগৎটা তাহার দাবি আদায় করিতে তো ছাড়িবে না-সাধ্য কি সর্বজয়ার যে চিরকাল ছেলেকে আঁচলে লুকাইয়া রাখে?
যাত্রার পূর্বে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের দধির ফোটা অপুর কপালে পরাইয়া দিতে দিতে বলিলবাড়ি আবার শিগগির শিগগির আসবি কিন্তু, তোদের ইতুপুজোর ছুটি দেবে তো?
-হ্যাঁ, ইস্কুলে বুঝি ইতুপুজোয় ছুটি হয়? তাতে আবার বড়ো ইস্কুল। সেই আবার আসবো গরমের ছুটিতে।
ছেলের অকল্যাণের আশঙ্কায় উচ্ছ্বসিত চোখের জল বহু কষ্ট সর্বজয়া চাপিয়া রাখিব।
অপু মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া ভারী বোঁচকাটা পিঠে ঝুলাইয়া লইয়া বাড়ির বাহির হইয়া গেল।
মাঘ মাসের সকাল। কাল একটু একটু মেঘ ছিল, আজ মেঘ-ভাঙা রাঙা রোদ কুতুবাড়ির দোফলা আম গাছের মাথায় ঝলমল করিতেছে-বাড়ির সামনে বাঁশবনের তলায় চকচকে সবুজ পাতার আড়ালে বুনো আদার রঙিন ফুল যেন দূর ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নের মতো সকালের বুকে।
০২. সবে ভোর হইয়াছে
সবে ভোর হইয়াছে। দেওয়ানপুর গবর্নমেন্ট মডেল ইনস্টিটিউশনের ছেলেদের বোর্ডিং-ঘরের সব দরজা এখনও খুলে নাই। কেবল স্কুলের মাঠে দুইজন শিক্ষক পায়চারি করিতেছেন। সম্মুখের রাস্তা দিয়া এত ভোরেই গ্রাম হইতে গোয়ালারা বাজারে দুধ বেচিতে আনিতেছিল, একজন শিক্ষক আগইয়া আসিয়া বলিলেন–দাঁড়াও, ও ঘোষের পো, কাল দুধ দিয়ে গেলে তো নিছক জল, আজ দেখি কেমন দুধটা!
অপর শিক্ষকটি পিছু পিছু আসিয়া বলিলেন, নেবেন না সত্যেনবাবু, একটু বেলা না গেলে ভালো দুধ পাওয়া যায় না। আপনি নতুন লোক, এসব জায়গার গতিক জানেন না, যার-তার কাছে দুধ নেবেন না-আমার জানা গোয়ালা আছে, কিনে দেবো বেলা হলে।
বোর্ডিং-বাড়ির কোণের ঘরে দরজা খুলিয়া একটি ছেলে বাহির হইয়া আসিল ও দূরের করোনেশন ক্লক-টাওয়ারের ঘড়িতে কয়টা বাজিয়াছে চাহিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল। সত্যেনবাবুর সঙ্গী শিক্ষকটির নাম রামপদবাবু, তিনি ডাকিয়া বলিলেন-ওহে সমীর, ওই যে ছেলেটি এবার ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেয়েছে, সে কাল রাত্রে এসেছে না?
ছেলেটি বলিল, এসেছে স্যার, ঘুমুচ্ছে এখনও। ডেকে দেবো?-পরে সে জানালার কাছে গিয়া ডাকিল, অপূর্ব, ও অপূর্ব।
ছিপছিপে পাতলা চেহারা, চোদ-পনেরো বৎসরের একটি খুব সুন্দর ছেলে চোখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া আসিল। রামপদবাবু বলিলেন, তোমার নাম অপূর্ব ও–এবার আড়বোয়ালের স্কুল থেকে স্কলারশিপ পেয়েছ?-বাড়ি কোথায়? ও! বেশ বেশ, আচ্ছা, স্কুলে দেখা হবে।
সমীর জিজ্ঞাসা করিল, স্যার, অপূর্ব কোন ঘরে থাকবে এখনও সেকেন মাস্টার মশায় ঠিক করে দেন নি। আপনি একটু বলবেন?
রামপদবাবু বলিলেন, কেন, তোর ঘরে তো সীট খালি রয়েছে-ওখানেই থাকবে।
সমীর বোধ হয় ইহাই চাহিতেছিল, বলিল-আপনি একটু বলবেন তাহলে সেকেন—
রামপদবাবু চলিয়া গেলে অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, ইনি কে? পরে পরিচয় শুনিয়া সে একটু আঁপ্ৰতিভ হইল। হয়তো বোর্ডিং-এর নিয়ম নাই এত বেলা পর্যন্ত ঘুমানো, সে না জানিয়া শুনিয়া প্রথম দিনটাতেই হয়তো একটা অপরাধের কাজ করিয়া বসিয়াছে।.
একটু বেলা হইলে সে স্কুল-বাড়ি দেখিতে গেল। কাল অনেক রাত্রে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, ভালো করিয়া দেখিবার সুযোগ পায় নাই। রাত্রের অন্ধকারে আবছায়া-দেখিতে-পাওয়া সাদা রং-এর প্ৰকাণ্ড স্কুল বাড়িটা তাহার মনে একটা আনন্দ ও রহস্যের সঞ্চার করিয়াছিল।
এই স্কুলে সে পড়িতে পাইবে!..কতদিন শহরে থাকিতে তাহাদের ছোট স্কুলটা হইতে বাহির হইয়া বাড়ি ফিরিবার পথে দেখিতে পাইত-হাই স্কুলের প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডে ছেলেরা সকলেই এক ধরনের পোশাক পরিয়া ফুটবল খেলিতেছে। তখন কতদিন মনে হইয়াছে এত বড়ো স্কুলে পড়িতে যাওয়া কি তাহার ঘটিবে কোন কালে-“এসব বড়োলোকের ছেলেদের জন্য। এতদিনে তাহার। আশা পূর্ণ হইতে চলিল।
বেলা দশটার কিছু আগে বোর্ডিং-সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিধুবাবু তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সে কোন ঘরে আছে, নাম কি, বাড়ি কোথায়, নানা জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া বলিলেন, সমীর ছোকরা ভালো, একসঙ্গে থাকলে বেশ পড়াশুনো হবে। এখানকার পুকুরের জলে নাইবে না। কখনও-জািল ভালো নয়, স্কুলের ইন্দারার জলে ছাড়া-আচ্ছা যাও, এদিকে আবার ঘণ্টা বাজবার সময় হল।
সাড়ে দশটায় ক্লাস বসিল। প্রথম বই খাতা হাতে ক্লাস-বুমে ঢুকিবার সময় তাহার বুক আগ্রহের ঔৎসুক্যে টিপ টিপ করিতেছিল। বেশ বড়ো ঘর, নিচু চৌকির উপর মাস্টারের চেয়ার পাতা-খুব বড়ো ব্ল্যাকবোর্ড। সব ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নিখুঁতভাবে সাজানো। চেয়ার, বেঞ্চি, টেবিল, ডেস্ক সব ঝকঝকি করিতেছে, কোথাও একটু ময়লা বা দাগ নাই।
মাস্টারক্লাসে ঢুকিলে সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। এ নিয়ম পূর্বে সে যেসব স্কুলে পড়িত সেখানে দেখে নাই। কেহ স্কুল পরিদর্শন করিতে আসিলে উঠিয়া দাঁড়াইবার কথা মাস্টার শিখাইয়া দিতেন। সত্য সত্যই এতদিন পরে সে বড়ো স্কুলে পড়িতেছে বটে।.
জানোলা দিয়া চাহিয়া দেখিল পাশের ক্লাসরুমে একজন কোট-প্যান্টপরা মাস্টার বোর্ডে কি লিখিতে দিয়া ক্লাসের এদিক-ওদিক পায়চারি করিতেছেন-চোখে চশমা, আধাপাকা দাড়ি বুকেব উপর পড়িয়াছে, গভীর চেহারা। সে পাশের ছেলেকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল,-উনি কোন মাস্টার ভাই?
ছেলেটি বলিল-উনি মিঃ দত্ত, হেডমাস্টার-কিশচান, খুব ভালো ইংরিজি জানেন।
অপূর্ব শুনিয়া নিরাশ হইল যে, তাহাদের ক্লাসে মিঃ দত্তের কোন ঘণ্টা নাই। থার্ড ক্লাসের নিচে কোন ক্লাসে তিনি নাকি নামেন না।
পাশেই স্কুলের লাইব্রেরি, ন্যাপাথ্যালিনের গন্ধ-ভরা পুবোনো বই-এর গন্ধ আসিতেছিল। ভাবিল এ ধরনের ভরপুর লাইব্রেরির গন্ধ কি কখনও ছোটখাটো স্কুলে পাওয়া যায়?
ঢং ঢেং করিয়া ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ে-আড়বোয়ালের স্কুলের মতো একখণ্ড রেলেব পাটির লোহা বাজায় না, সত্যিকারের পেটা ঘড়ি।-কি গভীর আওয়াজটা!.
টিফিনের পরের ঘণ্টায় সত্যেনবাবুর ক্লাস। চব্বিশ-পাঁচিশ বৎসরের যুবক, বেশ বলিষ্ঠ গড়ন, ইহার মুখ দেখিয়া অপুর মনে হইল ইনি ভাবি বিদ্বান, বুদ্ধিমানও বটে। প্রথম দিনেই ইহাব উপর কেমন এক ধরনের শ্রদ্ধা তাহার গড়িয়া উঠিল! সে শ্ৰদ্ধা আরও গভীর হইল ইহার মুখের ইংবিজি উচ্চারণে।
ছুটির পর স্কুলের মাঠে বোর্ডিং-এব ছেলেদের নানা ধরনের খেলা শুরু হইল। তাঁহাদেব ক্লাসের ননী ও সমীর তাহাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়া অন্য সকল ছেলেদের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল। সে ক্রিকেট খেলা জানে না, ননী তাহার হাতে নিজের ব্যাটখানা দিযা তাহাকে বল মারিতে বলিল ও নিজে উইকেট হইতে একটু দূরে দাঁড়াইয়া খেলার আইনকানুন বুঝাইযা দিতে লাগিল।
খেলার অবসানে যে-যাহাব স্থানে চলিয়া গেল। খেলার মাঠে পশ্চিম কোণে একটা বড়ো বাদাম গাছ, অপু গিয়া তাহার তলায় বসিল। একটু দূরে গবর্নমেন্টের দাতব্য ঔষধালয়। বৈকালেও সেখানে একদল বোগীর ভিড় হইয়াছে, তাহাদের নানা কলরবের মধ্যে একটি ছোট মেয়ের কান্নার সুর শোনা যাইতেছে। অপূর্ব কেমন অন্যমনস্ক হইয়া গেল। চৌদ-পনেরো বৎসর বয়সের মধ্যে এই আজ প্রথম দিন, যেদিনটি সে মায়ের নিকট হইতে বহু দূরে আত্মীয়-বন্ধুহীন প্রবাসে একা কাটাইতেছে। সেদিক দিয়া দেখিতে গেলে আজ তাহার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।
কত কথা মনে ওঠে, এই সুদীর্ঘ পনেরো বৎসরের জীবনে কি অপূর্ব বৈচিত্ৰ্য, কি ঐশ্বর্য।
সমীর টেবিলে আলো জ্বালিয়াছে। অপুর কিছু ভালো লাগিতেছিল না-বিছানায় গিয়া শুইয়া রহিল। খানিকটা পরে সমীর পিছনে চাহিয়া তাহকে সে অবস্থায় দেখিয়া বলিল, পড়বে না?
–আলোটা জ্বলিয়ে রাখো, সুপারিন্টেন্ডেন্ট এখুনি দেখতে আসবে, শুয়ে আছ দেখলে বাকবে।
অপু উঠিয়া আলো জ্বলিল। বলিল, রোজ আসেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট? সেকেন্ড মাস্টার তো-না?
সমীরের কথা ঠিক। অপু আলো জালিবার একটু পরেই বিধুবাবু ঘরে ঢুকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি রকম লাগলো। আজ ক্লাসে? পড়াশুনো সব দেখে নিয়েচ তো? সমীর, ওকে একটু দেখিয়ে দিস তো কোথায় কিসের পড়া। ক্লাসের বুটনটো ওকে লিখে দে বরং-সব বই কোেনা হয়েচে তো তোমার?.জিওমেট্রি নেই? আচ্ছা, আমার কাছে পাওয়া যাবে, এক টাকা সাড়ে পাঁচ আনা, কাল সকালে আমার ঘর থেকে গিয়ে নিয়ে এসো একখানা।
বিধুবাবু চলিয়া গেলে সমীর পড়িতে বসিল; কিন্তু পিছনে চাহিয়া পুনরায় অপূর্বকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া সে কাছে আসিয়া বলিল, বাড়ির জন্যে মন কেমন করছে।–না?
তাহার পর সে খাটের ধারে বসিয়া তাহাকে বাড়ির সম্বন্ধে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। বলিল, তোমার মা একা থাকেন বাড়িতে? আর কেউ না? তার তো থাকতে কষ্ট হয়।
অপূর্ব বলিল, ও কিসের ঘণ্টা ভাই?
–বোর্ডিং-এর খাওয়ার ঘণ্টা-চলে যাই।
খাওয়া-দাওয়ার পর দুই-তিনজন ছেলে তাহাদের ঘরে আসিল। এই সময়টা আর সুপারিন্টেন্ডেন্টের ভয় নাই, তিনি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। শীতের রাত্রে আর বড়ো একটা বাহির হন না। ছেলেরা এই সময়ে এঘর-ওঘর বেড়াইয়া গল্পগুজবের অবকাশ পায়। সমীর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিল, এসো নৃপেন, এই আমার খাটে বসো-শিশির যাও ওখানে-অপূর্ব জানো তাস খেলা?
নৃপেন বলিল, হেডমাস্টার আসবে না তো?
শিশির বলিল, হঁবা, এত রাত্তিরে আবার হেডমাস্টার—
অপূর্বও তাঁস খেলিতে বসিল বটে। কিন্তু শীঘ্রই বুঝিতে পারিল, মায়ের ও দিদির সঙ্গে কত কাল আগে খেলার সে বিদ্যা লইয়া এখানে তাসখেলা খাটিবে না। তাসখেলায় ইহারা সব ঘুণ, কোন হাতে কি তাস আছে সব ইহাদের নখদর্পণে। তাহা ছাড়া এতগুলি অপরিচিত ছেলের সম্মুখে তাহাকে তাহার পুরাতন মুখচোরা রোগে পাইয়া বসিল; অনেক লোকের সামনে সে মোটেই স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা বলিতে পারে না। মনে হয়, কথা বলিলেই হয়তো ইহার হাসিয়া উঠিবে। সে সমীরকে বলিল, তোমরা খেলো, আমি দেখি। শিশির ছাড়ে না। বলিল, তিনদিনে শিখিয়ে দেব, ধরে দিকি তাস!
বাহিরো যেন কিসের শব্দ হইল। শিশির সঙ্গে সঙ্গে চুপ করিয়া গেল এবং হাতের তাস লুকাইয়া পরের পাঁচ মিনিট এমন অবস্থায় রহিল যে সেখানে একটা কাঠের পুতুল থাকিলে সেটাও তাহার অপেক্ষা বেশি নড়িত। সকলেরই সেই অবস্থা। সমীর টেবিলের আলোটা একটু কম৷ইয়া দিল। আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না। নৃপেন একবার দরজার ফাঁক দিয়া বাহিরের বারান্দাতে উঁকি মারিয়া দেখিয়া আসিয়া নিজের তাস সমীরের তেশকের তলা হইতে বাহির করিয়া বলিল, ও কিছু না, এসো এসো-তোমার হাতের খেলা শিশির।
রাত এগারোটার সময় পা টিপিয়া টিপিয়া যে যাহার ঘরে চলিয়া গেলে অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, তোমাদের রোজ এমনি হয় নাকি? কেউ টের পায় না? আচ্ছা, চুপ করে বসেছিল, ও ছেলেটা কে?
ছেলেটাকে তাহার ভালো লাগিয়াছে। ঘরে ঢুকিবার পর হইতে সে বেশি কথা বলে নাই, তাহার কাঠের কোণটিতে নীরবে বসিয়া ছিল। বয়স তেরো-চোঁদ হইবে, বেশ চেহারা। ইহাদের দলে থাকিয়াও সে এতদিনে তাসখেলা শেখে নাই, ইহাদের কথাবার্তা হইতে অপূর্ব বুঝিয়াছিল।
পরদিন শনিবার। বোর্ডিং-এর বেশির ভাগ ছেলেই সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে ছুটি লইয়া বাড়ি চলিয়া গেল। অপূর্ব মোট দুই দিন হইল আসিয়াছে; তাহা ছাড়া, যাতায়াতে খরচপত্রও আছে, কাজেই তাহার যাওয়ার কথাই উঠিতে পারে না। কিন্তু তবু তাহার মনে হইল, এই শনিবারে একবার মাকে দেখিয়া আসিলে মন্দ হইত না-সারা শনিবারের বৈকালটা কেমন খালি-খালি ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকিতেছিল।
সন্ধ্যার সময় সে ঘরে আসিয়া আলো জ্বলিল। ঘরে সে একা, সমীর বাড়ি চলিয়া গিয়াছে, এ রকম চুনকাম-করা ঘরে একা থাকিবার সৌভাগ্য কখনও তাহার হয় নাই, সে খুশি হইয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া নিজের খাটে বসিয়া রহিল। মনে মনে ভাবিল, এইবার সমীরের মতো একটা টেবিল আমার হয়? একটা টেবিলের দাম কত, সমীরকে জিজ্ঞাসা করব।
পরে সে আলোটা লইয়া গিয়া সমীরের টেবিলে পড়িতে বসিল। বুটনে লেখা আছেসোমবারে পাটিগণিতের দিন। অঙ্ককে সে বাঘ বিবেচনা করে। বইখানা খুলিয়া সভয়ে প্রশ্নাবলীর অঙ্ক কয়েকটি দেখিতেছে, এমন সময় দরজা দিয়া ঘরে কে ঢুকিল। কাল রাত্রের সেই শান্ত ছেলেটি। অপুর্ব বলিল-এসো, এসো, বোসো।
ছেলেটি বলিল, আপনি বাড়ি যান নি?
অপু বলিল, না, আমি তো মোটে পরশু এলাম, বাড়িও দূরে। গিয়ে আবার সোমবারে আসা যাবে না।
ছেলেটি অপুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। অপু বলিল-বোর্ডিং-এ যে আজ একেবারেই ছেলে নেই, সব শনিবারেই কি এমনই হয়? তুমি বাড়ি যাও নি কেন? তোমার নামটা কি জানি নে ভাই।
–দেবব্রত বসু-আপনার মনে থাকে না। বাড়ি গেলাম না ইচ্ছে করে? সেকেন মাস্টার ছুটি দিলে না। ছুটি চাইতে গেলাম, বললে, আর শনিবারে গেলে আবার এ শনিবারে কি? হবে না, যাও।
তাহার পর সে বসিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ গল্প করিল। তাহার বাড়ি শহর হইতে মাইল বারো দূরে, ট্রেনে যাইতে হয়। সে শনিবারে বাড়ি না গিয়া থাকিতে পারে না, মন হাঁপাইয়া উঠে, অথচ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছুটি দিতে চায় না। তাহার কথাবার্তার ধরনে অপু বুঝিতে পারিল যে, বাড়ি না। যাইতে পারিয়া মন আজ খুবই খারাপ, অনবরত বাড়ির কথা ছাড়া অন্য কথা সে বড়ো একটা বলিল না। দেবব্রত খানিকটা বসিয়া থাকিয়া অপুর বালিশটা টানিয়া লইয়া শুইয়া পড়িল। অনেকটা আপন মনে বলিল, সামনের শনিবারে ছুটি দিতেই হবে, সেকেন মাস্টার না দেয় হেডমাস্টারেব কাছে গিয়ে বলবো।
অপু এ ধরনের দূর প্রবাসে এক রাত্রিবাস করিতে আদৌ অভ্যস্ত নয়, চিরকাল মা-বাপের কাছে কাটাইয়াছে, আজকার রাত্রিটা তাহার সম্পূর্ণ উদাস ও নিঃসঙ্গ ঠেকিতেছিল।
দেবব্রত হঠাৎ বিছানা হইতে উঠিয়া বসিল, আপনি দেখেন নি বুঝি? জানেন না? আসুন না আপনাকে দেখাই, আসুন উঠে!
পরে সে অপুর হাত ধরিয়া পিছনের দেওয়ালের বড়ো জানালাটার কাছে লইয়া গিয়া দেখাইল, সেটার পাশাপাশি দুটি গরাদে তুলিয়া ফেলিয়া আবার বসানো চলে। একটা লোক অনায়াসে সেই ফাঁকটুকু দিয়া ঘরে যাতায়াত করিতে পারে। বলিল, শুধু সমীরদা আর গণেশ জানে, কাউকে যেন বলবেন না।
একটু পরে বোর্ডিং-এর খাওয়ার ঘণ্টা পড়িল।
খাওয়ার আগে অপু বলিল, আচ্ছা ভাই, এ কথাটার মানে জানো?
একখণ্ড ছাপা কাগজ সে দেবব্রতকে দেখিতে দিল। বড়ো বড়ো অক্ষরে কাগজখানাতে লেখা আছে-Literature, এত বড়ো কথা সে এ পর্যন্ত কমই পাইয়াছে, অর্থটা জানিবার খুব ক্টৌতুহল। দেবব্রত জানে না, বলিল, চলুন, খাওয়ার সময় মণিদাকে জিজ্ঞেস করবো।
মণিমোহন সেকেন্ড ক্লাসের ছাত্র, দেবব্রত কাগজখানা দেখাইলে সে বলিল, এর মানে সাহিত্য। এ ম্যাকমিলান কোম্পানির বইয়ের বিজ্ঞাপন, কোথায় পেলে?
অপু হাত তুলিয়া দেখাইয়া বলিল, ওই লাইব্রেরির কোণটায় কুড়িয়ে পেয়েছি, লাইব্রেরির ভেতর থেকে কেমন করে উড়ে এসেছে বোধ হয়। কাগজখানার আত্মাণ লইয়া হাসিমুখে বলিল, কেমন ন্যাপথালিনের গন্ধটা।
কাগজখানা সে যত্ন করিয়া রাখিয়া দিল।
হেডমাস্টারকে অপু অত্যন্ত ভয় করে। প্রৌঢ় বয়স, বেশ লম্বা, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ-অনেকটা যাত্রার দলের মুনির মতো। ভারি নাকি কড়া মেজাজের লোক, শিক্ষকেরা পর্যন্ত তঁহাকে ভয় করিয়া চলেন। অপু এতদিন তাহাকে দূর হইতে দেখিয়া আসিতেছিল। একদিন একটা বড়ো মজা হইল। সত্যেনবাবু ক্লাসে আসিয়া বাংলা হইতে ইংরেজি করিতে দিয়াছেন, এমন সময় হেডমাস্টার ক্লাসে ঢুকিতেই সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। হেডমাস্টার বইখানা সত্যেনবাবুর হাত হইতে লইয়া একবার চোখ বুলাইয়া দেখিয়া লইয়া গম্ভীরস্বরে বলিলেন-আচ্ছা, এই যে এতে ভিক্টর হিউগো কথাটা লেখা আছে, ভিক্টর হিউগো কে ছিলেন জানো?–ক্লাস নীরব। এ নাম কেহ জানে না। পাড়াগায়ের স্কুলের ফোর্থ ক্লাসের ছেলে, কেহ নামও শোনে নাই।–
কে বলিতে পারো।–তুমি-তুমি?
ক্লাসে সূচি পড়িলে তাহার শব্দ শোনা যায়।
অপুর অস্পষ্ট মনে হইল নামটা-যেন তাহার নিতান্ত অপরিচিত নয়, কোথাও যেন সে পাইয়াছে ইহার আগে। কিন্তু তাহার পালা আসিল ও চলিয়া গেল, তাহার মনে পড়িল না। ওদিকের বেঞ্চিটা ঘুরিয়া যখন প্রশ্নটা তাহাদের সম্মুখের বেঞ্চের ছেলেদের কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তখন তাহার হঠাৎ মনে পড়িল, নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে সেই পুরাতন “বঙ্গবাসী”গুলার মধ্যে কোথায় সে একথাটা পড়িয়ছে-বোধ হয়, সেই “বিলাত যাত্রীর চিঠি’র মধ্যে হইবে। তাহার মনে পড়িয়াছে! পরীক্ষণেই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল-ফরাসী দেশের লেখক, খুব বড়ো লেখক। প্যারিসে তার পাথরের মূর্তি আছে, পথের ধারে।
হেডমাস্টার বোধ হয় এ ক্লাসের ছেলের নিকট এ ভাবের উত্তর আশা করেন নাই, তাহার দিকে চশমা-আঁটা জ্বলজ্বলে চোখে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিতেই অপু অভিভূত ও সংকুচিত অবস্থায় চোখ নামাইয়া লইল। হেডমাস্টার বলিলেন, আচ্ছা, বেশ। পথের ধারে নয়, বাগানের মধ্যে মূর্তিটা আছে—বসো, বসো সব।
সত্যেনবাবু তাহার উপর খুব সন্তুষ্ট হইলেন। ছুটির পর তাহাকে সঙ্গে করিয়া নিজের বাসায় লইয়া গেলেন। ছোটখাটো বাড়ি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, একাই থাকেন। স্টেভ জ্বলিয়া চা ও খাবার করিয়া তাহাকে দিলেন, নিজেও খাইলেন। বলিলেন, আর একটু ভালো করে গ্রামারটা পড়বে।–আমি তোমাকে দাগ দিয়ে দেখিয়ে দেবো!
অপুর লজ্জাটা অনেকক্ষণ কাটিয়া গিয়াছিল, সে আলমারিটার দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-ওতে আপনার অনেক বই আছে?
সত্যেনবাবু আলমারি খুলিয়া দেখাইলেন। বেশির ভাগই আইনের বই, শীঘ্রই আইন পরীক্ষা দিবেন। একখানা বই তাহার হাতে দিয়া বলিলেন-এখানা তুমি পড়ো-বাংলা বই, ইতিহাসের গল্প।
অপুর আরও দু-একখানা বই নামাইয়া দেখিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিল না।
মাস দুই-তিনের মধ্যে বোর্ডিং-এর সকলের সঙ্গে তাহার খুব জানাশোনা হইয়া গেল।
হয়তো তাহা ঘটিত না, কারণ তাহার মতো লাজুক ও মুখচোরা প্রকৃতির ছেলের পক্ষে সকলের সহিত মিশিয়া আলাপ করিয়া লওয়াটা একরূপ সম্ভবের বাহিরের ব্যাপার, কিন্তু প্রায় সকলেই তাহার সহিত যাচিয়া আসিয়া আলাপ করিল। তাহাকে কে খুশি করিতে পারে-ইহা লইয়া দিনকতক যেন বোর্ডিং-এর ছেলেদের মধ্যে একটা পাল্লা দেওয়া চলিল। খাবার-ঘরে খাইতে বসিবার সময় সকলেরই ইচ্ছা-অপু তাহার কাছে বসে, এ তাড়াতাড়ি বড়ো পিঁড়িখানা পাতিয়া দিতেছে, ও ঘি খাইবার নিমন্ত্রণ করিতেছে। প্ৰথম প্ৰথম সে ইহাতে অস্বস্তিবোধ করিত, খাইতে বসিয়া তাহার ভালো করিয়া খাওয়া ঘটিত না, কোনরকমে খাওয়া সাবিয়া উঠিয়া আসিত। কিন্তু যেদিন ফাস্ট ক্লাসের রমাপতি পর্যন্ত তাহাকে নিজের পাতের লেবু তুলিয়া দিয়া গেল, সেদিন সে মনে মনে খুশি তো হইলই, একটু গর্বও অনুভব করিল। রমাপতি বয়সে তাহার অপেক্ষা চার-পাঁচ বৎসরের বড়ো, ইংরেজি ভালো জানে বলিয়া হেডমাস্টারের প্রিয়পাত্র, মাস্টারের পর্যন্ত খাতির করিয়া চলেন, একটু গভীর প্রকৃতির ছেলেও বটে। খাওয়া শেষ করিয়া আসিতে আসিতে সে ভাবিল, আমি কি ওই শ্যামলালের মতো? রমাপতিদা পর্যন্ত সোধে লেবু দিল! দেয় ওদের? কথাই বলে না।
দেবব্রত অন্ধকারের মধ্যে কাঁঠালতলাটায় তাহারই অপেক্ষা করিতেছিল। বলিল-আপনার ঘরে যাব অপূর্বদা, একটা টাস্ক একটু বলে দেবেন?
পরে সে হাসিমুখে বলিল, আজ বুধবার, আর চারদিন পরেই বাড়ি যাব। শনিবারটা ছেড়ে দিন, মধ্যে আর তিনটে দিন। আপনি বাড়ি যাবেন না, অপূর্বদা?
প্রথম কয়েকমাস কাটিয়া গেল। স্কুল-কম্পাউন্ডের সেই পাতাবাহার ও চীনা-জবার ঝোপটা অপুর বড়ো প্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল। সে রবিবারের শান্ত দুপুরে রৌদ্রে পিঠ দিয়া শুকনা পাতার রাশির মধ্যে বসিয়া বসিয়া বই পড়ে। ক্লাসের বই পড়িতে তাহার ভালো লাগে না, সে সব বই-এর গল্পগুলি সে মাসখানেকের মধ্যেই পড়িয়া শেষ করিয়াছে। কিন্তু মুশকিল। এই যে, স্কুল লাইব্রেরিতে ইংরে বই বেশি; যে বইগুলার বাধাই চিত্তাকর্ষক, ছবি বেশি, সেগুলা সবই ইংরেজি। ইংরেজি সে ভালো বুঝিতে পারে না, কেবল ছবির তলাকার বর্ণনাটা বোঝে মাত্র।
একদিন হেডমাস্টারের অফিসে তাহার ডাক পড়িল। হেডমাস্টার ডাকিতেছেন শুনিয়া তাহার প্ৰাণ উড়িয়া গেল। ভয়ে ভয়ে অফিস ঘরের দুয়ারের কাছে গিয়া দেখিল, আর একজন সাহেবি পোশাক-পরা ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে বসিয়া আছেন। হেডমাস্টারের ইঙ্গিতে সে ঘরে ঢুকিয়া দুজনের সামনে গিয়া দাঁড়াইল।
ভদ্রলোকটি ইংরেজিতে তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন ও সামনের একখানা পাতার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া কি দেখিয়া লইয়া একখানা ইংরেজি বই তাহার হাতে দিয়া ইংরেজিতে বলিলেন, এই বইখানা তুমি পড়তে নিয়েছিলে?
অপু দেখিল, বইখানা The world of lice, মাসখানেক আগে লাইব্রেরি হইতে পড়িবার জন্য সে লইয়াছিল। সবটা ভালো বুঝিতে পারে নাই।
সে কম্পিত কণ্ঠে বলিল, ইয়েস—
হেডমাস্টার গর্জন করিয়া বলিলেন, ইয়েস স্যার!
অপুর পা কাঁপিতেছিল, জিভ শুকাইয়া আসিতেছিল, থিতামত খাইয়া বলিল, ইয়েস স্যার—
ভদ্রলোকটি পুনরায় ইংরেজিতে বলিলেন, স্লেজ কাহাকে বলে?
অপু ইহার আগে কখনও ইংরেজি বলিতে অভ্যাস করে নাই, ভাবিয়া ভাবিয়া ইংরেজিতে বানাইয়া বলিল, এক ধরনের গাড়ি কুকুরে টানে। বরফের উপর দিয়া যাওয়ার কথাটা মনে আসিলেও হঠাৎ সে ইংরেজি করিতে পরিল না।
–অন্য গাড়ির সঙ্গে স্নেজের পার্থক্য কি?
অপু প্ৰথমে বলিল, ব্লেজ হ্যাজ-তারপরই তাহার মনে পড়িল-আর্টিকল-সংক্রাঙ্ক কোন গোলযোগ এখানে উঠিতে পারে। ‘এ’ বা দি’ কোনটা বলিতে হইবে তাড়াতাড়ির মাথায় ভাবিবার সময় না পাইয়া সোজাসুজি বহুবচনে বলিল, মেজেস, হ্যাভ নো হুইলস–
–অরোরা বোরিয়ালিস কাহাকে বলে?
অপুর চোখমুখ উজ্জ্বল দেখাইল। মাত্র দিন কতক আগে সত্যেনবাবুর কি একখানা ইংরেজি বইতে সেইহার ছবি দেখিয়াছিল। সে জায়গাটা পড়িয়া মানে না বুঝিলেও এ-কথাটা খুব গোল-ভরা বলিয়া সত্যেনবাবুর নিকট উচ্চারণ জানিয়া মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছিল। তাড়াতাড়ি বলিল, অরোরা বোরিয়ালিস ইজ এ কাইন্ড অব অ্যাটমোসফেরিক ইলেকট্রিসিটি
ফিরিয়া আসিবার সময় শুনিল, আগন্তুক ভদ্রলোকটি বলিতেছেন, আনইউজুয়াল ফর এ বয় অব ফোর্থ ক্লাস। কি নাম বললেন? এ স্ট্রাইকিংলি হ্যান্ডসাম বয়-বেশ বেশ!
অপু পরে জানিয়াছিল তিনি স্কুল-বিভাগের বড়ো ইন্সপেক্টর, না বলিয়া হঠাৎ স্কুল দেখিতে আসিয়াছিলেন।
পরে সে রমাপতির ঘরে আঁক বুঝিতে যায়। রমাপতি অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, নিজের সীট বেশ সাজাইয়া রাখিয়াছে। টেবিলের উপর পাথরের দোয়াতদানি, নতুন নিব পরানো কলমগুলি সাফ করিয়া গুছাইয়া রাখিয়াছে, বিছানাটি ধবধবে, বালিশের ওপর তোয়ালে। অপুর সঙ্গে পড়াশুনার কথাবার্তা মিটিবার পর সে বলিল, এবার তোমায় সরস্বতী পুজোতে ছোট ছেলেদের লীডার হতে হবে, আর তো বেশি দেরিও নেই, এখন থেকেই চাঁদা আদায়ের কাজে বেবুনো চাই।
উঠিবার সময় ভাবিল, রমাপতিদার মতো এইরকম একটা দোয়াতদানি হয় আমার? চমৎকার ফুলকটা? লিখে আরাম আছে। হ্যাঁ, চাদ চাইতে যাব বইকি! ওসব হবে না। আমায় দিয়ে।–আসল কথা সে বেজায় মুখচোরা, কাহারও সহিত কথা বলিতে পরিবে না।
সে নিজের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, দেবব্রত সমীরের টেবিলে মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া শুইয়া আছে। অপু বলিল, কি দেবু, বাড়ি যাও নি আজ?
দেবব্রত মাথা না তুলিয়াই বলিল, দেখুন না কাণ্ড সেকেন মাস্টারের, ছুটি দিলে না-ও শনিবারে বাড়ি যাই নি, আপনি তো জানেন অপুর্বদা! বললে, তুমি ফি শনিবারে বাড়ি যাও, তোমার ছুটি হবে না।–
দেবব্রতর জন্য অপুর মনে বড়ো কষ্ট হইল। বাড়ির জন্য তাহার মনটা সারা সপ্তাহ ধরিয়া কি রকম তৃষিত থাকে অপু সে সন্ধান রাখে। মনে ভাবিল, ওরই ওপর সুপারিন্টেন্ডেন্টের যত কড়াকড়ি। থাকতে পারে না, ছেলেমানুষ-আচ্ছা লোক!
অপু বলিল, রমাপতিদাকে দিয়ে আমি একবার বিধুবাবুকে বলবো?
দেবব্রত মান হাসিয়া বলিল, কাকে বলবেন? তিনি আছেন বুঝি? মেয়ের জন্যে নিধে বোহারাকে দিয়ে বাজার থেকে কমললেবু আনলেন, কপি আনালেন। তিনি বাড়ি চলে গিয়েছেন কোন কালে, সে দুটোর ট্রেনে-আর এখন বলেই বা কি হবে, আমাদের লাইনের গাড়িও তো চলে গিয়েছে-আজ আর গাড়ি নেই।
অপু তাহাকে ভুলাইবার জন্য বলিল, এসো একটা খেলা করা যাক। তুমি হও চোর, একখানা বই চুরি করে লুকিয়ে থাকে, আমি ডিটেকটিভ হবো, তোমাকে ঠিক খুঁজে বার করবো-কিংবা ওইটে যেন একটা নকশা, তুমি ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে পালাবে, আমি তোমাকে খুঁজে বার করব—-পড়ো নি ‘নিহিলিস্ট রহস্য’? চমৎকার বই-উঃ, কি সে কাণ্ড? প্রতুলের কাছে আছে, চেয়ে দেবো।
দেবব্রতের খেলাধুলা ভালো লাগিতেছিল না, তবুও অপুর কথার কোন প্রতিবাদ না করিয়া মাথা তুলিয়া বসিল। বলিল, আমি লাইব্রেরির ওই কোণটায় গিয়ে লুকিয়ে থাকিব?
-লুকিয়ে থাকতে হবে না, এই কাগজখানা একটা দরকারি নকশা, তুমি পকেটের মধ্যে নিয়ে যেন রেলগাড়িতে যাচ্চো, আমি বার করে দেখে নেবো, তুমি পিস্তল বার করে গুলি করতে আসবে—
দেবব্রতকে লইয়া খেলা জমিল না, একে সে ‘নিহিলিস্ট রহস্য’ পড়ে নাই, তাহার উপর তাহার মন খারাপ। নূতন ধরনের যুদ্ধ-জাহাজের নকশাখানা সে বিনা বাধায় ও এত সহজে বিপক্ষের গুপ্তচরকে চুরি করিতে দিল যে, তাহাকে এসব কার্যে নিযুক্ত করিলে রুশীয় সম্রাটকে পতনের অপেক্ষায় ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিদ্রোহের মুখ চাহিয়া বসিয়া থাকিতে হইত না।
বেলা প্ৰায় পড়িয়া আসিয়াছে। বোর্ডিং-এর পিছনে দেওয়ানি আদালতের কম্পাউন্ডে অর্থীপ্রত্যার্থীর ভিড় কমিয়া গিয়াছে। দেবব্রত জানালার দিকে চাহিয়া বলিল, ক্লক টাওয়ারের ঘড়িতে কটা বেজেছে দেখুন না একবার? কাউকে বলবেন না অপূর্বদা, আমি এখুনি বাড়ি যাব।
অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল, এখন যাবে কিসে? এই যে বললে ট্রেন নেই?
দেবব্রত সুর নিচু করিয়া বলিল-এগার মাইল তো রাস্তা মোটে, হেঁটে যাব, একটু রাত যদি হয়ে পড়ে জ্যোৎস্না আছে, বেশ যাওয়া যাবে।
-এগারো মাইল রাস্তা এখন এই পড়ন্ত বেলায় হেঁটে যেতে কত রাত হবে জানো? রাস্তা কখনও হেঁটেচো তুমি? তা ছাড়া না বলে যাওয়া-যদি কেউ টের পায়?
কিন্তু দেবব্রতকে নিবৃত্ত করা গেল না। সে কখনও রাস্তা হ্যাঁটে নাই তাহা ঠিক, রাত্রি হইবে তাহা ঠিক, বিধুবাবুর কানে কথাটা উঠিলে বিপদ আছে, সবই ঠিক কিন্তু বাড়ি সে যাইবেই-সে কিছুতেই থাকিতে পরিবে না-যাহ ঘটে ঘটবে। অবশেষে অপু বলিল, তা হলে আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
দেবব্রত বলিল, তা হলে সবাই টের পেয়ে যাবে, আপনি তিন-চার মাস বোর্ডিং ছেড়ে কোথাও যান নি, খাবার-ঘরে না দেখতে পেলে সবাই জানতে পারবে।
দেবব্রত চলিয়া গেলে অপু কাহারও নিকট সে কথা বলিল না বটে, কিন্তু পরদিন সকালে খাওয়ার ঘরে দেখা গেল দেবব্রতের অনুপস্থিতি অনেকে লক্ষ করিয়াছে। রবিবার বৈকালে সমীর আসিলে তাহাকে সে কথাটা বলিল। পরদিন সোমবার দেবব্রত সকলের সম্মুখে কি করিয়া বোর্ডিংএর কম্পাউন্ডে ঢুকিবে বা ধরা পড়িলে কৃতকর্যের কি কৈফিয়ত দিবে। এই লইয়াই দুজনে অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা করিল।
কিন্তু সকালে উঠিয়া দেবব্রতাকে সমীরের বিছানায় শুইয়া ঘুমাইতে দেখিয়া সে দস্তুর মতো অবাক হইয়া গেল। সমীর বাইরে মুখ ধুইতে গিয়াছিল, আসিলে জানা গেল যে, কাল অনেক রাত্রে দেবব্ৰত আসিয়া জানালায় শব্দ করিতে থাকে। পাছে কেউ টের পায় এজন্য পিছনের জানালাব খোলা-গরাদটা তুলিয়া সমীর তাহাকে ঘরে ঢুকাইয়া লইয়াছে।
অপু আগ্রহের সঙ্গে শুনিতে বসিলা। কখন সে বাড়ি পৌঁছিলা? রাত কত হইয়াছিল, তাহার মা তখন কি করিতেছিলেন?-ইত্যাদি।
রাত অনেক হইয়াছিল। বাড়িতে রাতের খাওয়া প্ৰায় শেষ হয় হয়। তাহার মা ছোট ভাইকে প্রদীপ ধরিয়া রান্নাঘর হইতে বড়োঘরের রোয়াকে পৌঁছাইয়া দিতেছেন এমন সময়
অপু কত দিন নিজে বাড়ি যায় নাই। মাকে কত দিন সে দেখে নাই। ইহার মতো হ্যাঁটিয়া যাতায়াতের পথ হইলে এতদিনে কতবার যাইত। রেলগাড়ি, গহনার নৌকা, আবার খানিকটা হাঁটাপথও। যাতায়াতে দেড় টাকা খরচ, তাহার এক মাসের জলখাবার। কোথায় পাইবে দেড় টাকা যে, প্রতি শনিবার তো দূরের কথা, মাসে অন্তত একবারও বাড়ি যাইবে! জলখাবারের পয়সা বাঁচাইয়া আনা আষ্টেক পয়সা হইয়াছে, আর এক টাকা হইলেই-বাড়ি। হয়তো এক টাকা জমিতে জমিতে গরমের দুটিই বা আসিয়া যাইবে, কে জানে?
পরদিন স্কুলে হৈ হৈ ব্যাপার। দেবব্রত যে লুকাইয়া কাহাকেও না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গিয়াছিল এবং রবিবার রাত্রে লুকাইয়া বোর্ডিং-এ ঢুকিয়াছে, সে কথা কি করিয়া প্রকাশ হইয়া গিয়াছে। বিধুবাবু সুপারিন্টেন্ডেন্ট-সে কথা হেডমাস্টারের কানে তুলিয়াছেন। ব্যাপারের গুরুত্ব বুঝিয়া সমীরের প্রাণ ভয়ে উড়িয়া গেল, সেই যে জানালার ভাঙা গরাদ খুলিয়া দেবব্রতকে তাহাদের ঘরে ঢুকাইয়া লইয়াছে, সে কথা হেডমাস্টার জানিতে পারিলে কি আর রক্ষা থাকিবে? সমীর রমাপতির ঘরে গিয়া অবস্থাটা বুঝিয়া আসিল। দেবব্রত নিজেই সব স্বীকার করিয়াছে, সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় নাই, কিন্তু সমীরের জানোলা খুলিয়া দেওয়ার কথা কিছুই বলে নাই। বলিয়াছে, সে সোমবার খুব ভোরে চুপি চুপি লুকাইয়া বোর্ডিং-এ ঢুকিয়াছে, কেহ টের পায় নাই। স্কুল বসিলে ক্লাসে ক্লাসে হেডমাস্টারের সাকুলার গেল যে, টিফিনের সময় স্কুলের হলে দেবব্রতকে বেত মারা হইবে, সকল ছাত্র ও টিচারদের সে সময় সেখানে উপস্থিত থাকা চাই।
সমীর গিয়া রমাপতিকে বলিল, আপনি একবার বলুন না। রমাপতিদা হেডমাস্টারকে, ও ছেলেমানুষ, থাকতে পারে না বাড়ি না গিয়ে, আপনি তো জানেন ও কি রকম home-sick? মিথ্যে মিথ্যে ওকে তিন শনিবার ছুটি দিলে না। সেকেন মাস্টার, ওর কি দোষ?
উপর-ক্লাসের ছাত্রদের ডেপুটেশনকে হেডমাস্টার হ্যাঁকাইয়া দিলেন। টিফিনের সময় সকলে হলে একত্র হইলে দেবব্রতকে আনা হইল। ভয়ে তাহার মুখ শুকাইয়া ছোট হইয়া গিয়াছে। হেডমাস্টার বঞ্জ গভীর স্বরে ঘোষণা করিলেন যে, এই প্রথম অপরাধ বলিয়া তিনি শুধু বেত মারিয়াই ছাড়িয়া দিতেছেন নতুবা স্কুল হইতে তাড়াইয়া দিতেন।–রীতিমতো বেত চলিল। কয়েক ঘা বেত খাইবার পরই দেবব্রত চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। হেডমাস্টার গর্জন করিয়া বলিলেন, চুপ।। Bend this way, bend! মারা দেখিয়া বিশেষ করিয়া দেবব্রতের কান্নায় অপুর চোখে জল আসিয়া গেল। মনে পড়িল, লীলাদের বাড়ি এই রকম মার একদিন সেও খাইয়াছিল বড়োবাবুর কাছে, সেও বিনা দোষে।
অপু উঠিয়া বারান্দায় গেল। ফিরিয়া আসিতে সমীর ধমক দিয়া চুপি চুপি বলিল, তুই ও-রকম কঁদেছিস কেন অপূর্ব? থাম না-হেডমাস্টার বকবে—
সরস্বতী পূজার সময় তাহার আট আনা চাদা ধরাতে অপু বড়ো বিপদে পড়িল। মাসের শেষ, হাতেও পয়সা তেমন নাই, অথচ সে মুখে কাহাকেও না’ বলিতে পারে না, সরস্বতী পূজার চাঁদা দিয়া হাত একেবারে খালি হইয়া গেল। বৈকালে সমীর জিজ্ঞাসা করিল, খাবার খেতে গেলি নে অপূর্ব?
সে হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।
সমীর তাহার সব খবর রাখে, বলিল, আমি বরাবর দেখে আসচি অপূর্ব হাতের পয়সা ভারি বে-আন্দাজি খরচ করিস তুই—বুঝেসুঝে চললে এরকম হয় না-আট আনা চাঁদা কে দিতে বলেছে?
অপু হাসিমুখে বলিল, আচ্ছা, আচ্ছা, যা তোকে আর শেখাতে হবে না-ভারি। আমার গুরুঠাকুর–
সমীর বলিল, না হাসি নয়, সত্যি কথা বলছি। আর এই ননী, ভুলো, রাসবেহারী-ওদের ও রকম বাজারে নিয়ে গিয়ে খাবার খাওয়াস কেন?
অপু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলি, যাঃ বকিস নে-ওরা ধরে খাওয়াবার জন্যে, তা করব কি?
সমীর রাগ করিয়া বলিল, খাওয়াতে বললেই অমনি খাওয়াতে হবে? ওরাও দুষ্ট্রর ধাড়ি, তোকে পেয়েছে ওই রকম তাই। অন্য কারুর কাছে তো কই ঘেঁষে না। আড়ালে তোকে বোকা বলে তা জানিস!
-হ্যাঁ বলে বইকি!
–আমার মিথ্যে কথা বলে লাভ? সেদিন মণিদার ঘরে তোর কথা হচ্ছিল। ওই বদমায়েশ রাসবেহারটা বলছিল-ফাঁকি দিয়ে খেয়ে নেয়,–আর ও-সব কলার লজেঞ্জুস কিনে এনে বিলিয়ে বাহাদুরি করতে কে বলেছে তোকে?
সমীর নিতান্ত মিথ্যা বলে নাই। জীবনে এই প্রথম নিজের খরচপত্র অপুকে নিজে বুঝিয়া করিতে হইতেছে, ইহার পূর্বে কখনও পয়সাকড়ি নিজের হাতের মধ্যে পাইয়া নাড়াচাড়া করে নাইকাজেই সে টাকা-পয়সার ওজন বুঝিতে পারে না, স্কলারশিপের টাকা হইতে বোর্ডিং-এর খরচ মিটাইয়া টাকা-দুই হাতখরচের জন্য বাঁচে–এই দেড় টাকা দুটাকাকে সে টাকার হিসাবে না দেখিয়া পয়সার হিসাবে দেখিয়া থাকে। ইতিপূর্বে কখনও আটটা পয়সা একত্র হাতের মধ্যে পায় নাই–একশো কুড়িটা পয়সা তাহার কাছে কুবেরের ধনভাণ্ডারের সমান অসীম মনে হয়। মাসের প্রথমে ঠিক রাখিতে না পারিয়া সে দরাজ হাতে খরচ করে-বাঁধানো খাতা কেনে, কালি কেনে, খাবার খায়। প্রায়ই দু-চারজন ছেলে আসিয়া ধরে তাহাদিগকে খাওয়াইতে হইবে। তাহার খুব প্রশংসা করে, পড়াশুনার তারিফ করে! অপু মনে মনে অত্যন্ত গর্ব অনুভব করে, ভাবে।–সোজা ভালো ছেলে আমি! সবাই কি খাতির করে! তবুও তো মোটে পাঁচ মাস এসিচি!
মহা খুশির সহিত তাহাদিগকে বাজারে লইয়া গিয়া খাবার খাওয়ায়। ইহার উপর আবার কেহ। কেহ ধার করিতে আসে, অপু কাহাকেও না’ বলিতে পারে না।
এরূপ করিলে কুবেরের ভাণ্ডার আর কিছু বেশি দিন টিকিতে পারে বটে, কিন্তু একশত কুড়িটা পয়সা দশদিনের মধ্যেই নিঃশেষে উড়িয়া যায়, মাসের বাকি দিনগুলিতে কষ্ট ও টানাটানির সীমা থাকে না। দু-দশটা পয়সা যে যাহা ধার লয়, মুখচোরা অপু কাহারও কাছে তাগাদা করিতে পারে না,-প্রায়ই তাহা আর আদায় হয় না।
সমীর ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট হাতে বাহির হইয়া গেল। অপু ভাবিল-বলুক বোকা, আমি তো আর বোকা নাই! পয়সা ধার নিয়েচে কেন দেবে না-সবাই দেবে।
পরে সে একখানা বই হাতে লইয়া তাহার প্রিয় গাছপালা-ঘেরা সেই কোণটিতে বসিতে যায়। মনে পড়ে এতক্ষণ সেখানে ছায়া পড়িয়া গিয়াছে, চীনে-জবা গাছে কচি কচি পাতা ধরিয়াছে। যাইবার সময় ভাবে, দেখি আর কাঁটা লজেঞ্ছস আছে?-পরে বোতল হইতে গোটাকতক বাহির করিয়া মুখে পুরিয়া দেয়।–ভাবে, আসছে মাসের টাকা পেলে ওই যে আনারসের একরকম আছে, তাই কিনে আনিব এক শিশি-কি চমৎকার এগুলো খেতে! এ ধরনের ফলের আস্বাদযুক্ত লজেঞ্জুস সে আর কখনও খায় নাই!
কম্পাউন্ডে নামিয়া লাইব্রেরির কোণটা দিয়া যাইতে যাইতে সে হঠাৎ অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া গেল। একজন বেঁটেমতো লোক ইদারার কাছে দাঁড়াইয়া স্কুলের কেরানী ও বোর্ডিং-এর বাজার সরকার গোপীনাথ দত্তের সঙ্গে আলাপ করিতেছে।
তাহার বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাৎ করিয়া উঠিল.সে কিসের টানে যেন লোকটার দিকে পায়ে পায়ে আগাইয়া গেল.লোকটা এবার তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়াছে-হাতটা কেমন বাঁকাইয়া আছে, তখনই কথা শেষ করিয়া সে ইদারার পাড়ের গায়ে ঠেস-দেওয়ানো ছাতাটা হাতে লইয়া কম্পাউন্ডের ফটক দিয়া বাহির হইয়া গেল।
অপু খানিকক্ষণ একদৃষ্টি সেদিকে চাহিয়া রহিল। লোকটাকে দেখিতে অবিকল তাহার বাবার
কতদিন সে বাবার মুখ দেখে নাই। আজ চার বৎসর!
উদগত চোখের জল চাপিয়া জবাতলায় গিয়া সে গাছের ছায়ায় চুপ করিয়া বসিল।
অন্যমনস্কভাবে বইখানা সে উলটাইয়া যায়। তাহার প্রিয় সেই তিনরঙা ছবিটা বাহির করিল, পাশের পৃষ্ঠার সেই পদ্যটা।
স্বদেশ হইতে বহুদূরে, আত্মীয়স্বজন হইতে বহুদূরে, আলজিরিয়ার কর্কশ, বন্ধুর, জাহীন মরুপ্রান্তে একজন মুমূর্ষ তরুণ সৈনিক বালুশয্যায় শায়িত। দেখিবার কেহ নাই। কেবল জনৈক সৈনিকবন্ধু পাশে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া মুখে চামড়ার বোতল হইতে একটু একটু জল দিঠেছে। পৃথিবীর নিকট হইতে শেষ বিদায় লইবার সময় সম্মুখের এই অপরিচিত, ধূসর উঁচুনিচু বালিয়াড়ি, পিছনের আকাশে সান্ধ্যসূৰ্যরক্তচ্ছটিা, দুরে খৰ্জ্জুরকুঞ্জ ও উর্ধ্বমুখ উক্ট্রশ্রেণীর দিকে চোখ রাখিয়া মুমূর্ষ। সৈনিকটির কেবলই মনে পড়িতেছে বহুদূরে রাইন নদীতীরবতী তাহার জন্মপল্লীর কথা…তাহার মা আছেন সেখানে। বন্ধু, তুমি আমার মায়ের কাছে খবরটা পৌঁছাইয়া দিয়ো, ভুলিয়ো না।…
For my home is in distant Bingen, Fair Birgen on the Rhine!
মাকে অপু দেখে নাই আজ পাঁচ মাসঃ-সে। আর থাকিতে পারে না…বোর্ডিং তাহার ভালো লাগে না, স্কুল আর ভালো লাগে না, মাকে না দেখিয়া আর থাকা যায় না।
এই সব সময়ে এই নির্জন অপরাহুগুলিতে নিশ্চিন্দিপুরের কথা কেমন করিয়া তাহার মনে পড়িয়া যায়। সেই একদিনের কথা মনে পড়ে।…
বাড়িতে পাশের পোড়ো ভিটার বনে অনেকগুলো ছাতারে পাখি কিচকিচ করিতেছিল, কি ভাবিয়া একটা চিল ছুঁড়িয়া মারিতেই দলের মধ্যে ছোট একটা পাখি ঘাড় মোচড়াইয়া টুপ করিয়া ঝোপের নিচে পড়িয়া গেল, বাকিগুলা উড়িয়া পলাইল। তাহার টিলে পাখি সত্য সত্য মরিবে ইহা সে ভাবে নাই, দৌড়িয়া গিয়া মহা আগ্রহে দিদিকে ডাকিল, ওরে দিদি, শিগগির আয় রে, দেখবি একটা জিনিস, ছুটে আয়–
দুৰ্গা আসিয়া দেখিয়া বলিল, দেখি, দে-দিকি আমার হাতে! পরে সে নিজের হাতে পাখিটিকে লইয়া কৌতূহলের সহিত নাড়িয়া চড়িয়া দেখিল। ঘাড় ভাঙিয়া গিয়াছে, মুখ দিয়া রক্ত উঠিয়াছে, দুর্গার আঙুলে রক্ত লাগিয়া গেল। দুৰ্গা তিরস্কারের সুরে বলিল, আহা, কেন মারতে গেলি তুই?
অপুর বিজয়গর্বে উৎফুল্প মন একটু দমিয়া গেল।
দুর্গা বলিল, আজ কি বার রে? সোমবার না? তুই তো বামুনের ছেলে-চল, তুই আর আমি একে নিয়ে গিয়ে গাঙের ধারে পুড়িয়ে আসি, এর গতি হয়ে যাবে।
তারপর দুর্গা কোথা হইতে একটা দেশলাই সংগ্ৰহ করিয়া আনিল, তেঁতুলতলার ঘাটের এক ঝোপেব ধারে শূকনো পাতার আগুনে পাখিটাকে খানিক পুড়াইল, পরে আধঝলসানো পাখিটা নদীর জলে ফেলিয়া দিয়া সে ভক্তিভাবে বলিল-হরিবোল হরি, হবি ঠাকুর ওর গতি করবেন, দেখিস! আহা, কি করেই ঘাড়টা থেতলে দিয়েছিলি? কখখনো ওরকম করিস নে আর। বনে জঙ্গলে উড়ে বেড়ায়, কাবুর কিছু করে না, মারতে আছে, ছিঃ!–
নদী হইতে অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিয়া দুৰ্গা চিতার জায়গাটা ধুইয়া দিল।
সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরিবার সময় কে জানে তাহারা কোন মুক্ত বিহঙ্গ আত্মার আশীৰ্বাদ লইয়া ফিবিয়াছিল!…
দেবব্রত আসিয়া ডাক দিতে অপুর নিশ্চিন্দিপুরের স্বপ্ন মিলাইয়া গেল।
দেবব্রত বলিল, অপুর্বদা এখানে বসে আছেন? আমি ঠিক ভেবেচি আপনি এখানেই আছেন-কি কথা ভাবচোন-মুখ ভার-ভার–
অপু হাসিয়া বলিল-ও কিছু না, এসো বোসো। কি? চলো দেখি রাসবেহারী কি করছে।
দেবব্রত বলিল, না, যাবেন না অপূর্বদা, কেন ওদের সঙ্গে মেশেন? আপনার নামে লাগিয়েচে, ধোপার পয়সা দেয় না, পয়সা বাকি রাখে এই সব! যাবেন না। ওদের ওখানে–
–কে বলেচে এসব কথা?
–ওই ওরাই বলে। বিনোদ ধোপাকে শিখিয়ে দিচ্ছিল। আপনার কাছে পয়সা বাকি না রাখতে। বলছিল, ও আর দেবে না-তিনবারের পয়সা নাকি বাকি আছে?
অপু বলিল-বা রে, বেশ লোক তো সব! হাতে পয়সা ছিল না। তাই দিইনি-এই সামনের মাসে প্রথমেই দিয়ে দেবো।–তা আবার ধোপাকে শিখিয়ে দেওয়া-আচ্ছা তো সব।
দেবব্রত বলিল-আবার আপনি ওদের যান খাওয়াতে! আপনার সেই খাতাখানা নিয়ে ওই বদমাইশ হিমাংশুটা আজ কত ঠাট্টা তামাশা করছিল-ওদের দেখান কেন ওসব?
অপূর্ব বলিল—এসব কথা আমি জানি নে, আমি লিখছিলাম ননীমাধব এসে বলে-ওটা কি? তাই একটুখানি পড়ে শোনালাম। কি কি-কি বলছিল?
–আপনাকে পাগল বলে-যন্ত রাজ্যির গাছপালার কথা নাকি শুধু শুধু খাতায় লেখা! আবোল-তাবোল শুধু তাতেই ভর্তি? ওরা তাই নিয়ে হাসে। আপনি চুপ করে এইখানে মাঝে মাঝে এসে বসেন বলে কত কথা তুলেছে
অপুর রাগ হইল, একটু লজ্জাও হইল। ভাবিল, খাতাখানা না দেখালেই হত সেদিন! দেখতে চাইলে তাই তো দেখলাম, নইলে আমি সোধে তো আর
মাঝে মাঝে তাহার মনে কেমন একটা অস্থিরতা আসে, এসব দিনে বোর্ডিং-এর ঘরে আবদ্ধ থাকিতে মন চাহে না। কোথায় কোন মাঠ বৈকালের রোদে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, ছায়াভিরা নদীজলে কোথায় নববধূর নাকছবির মতো পানকলস শ্যাওলার কুচ কুচা সাদা ফুল ফুটিয়া নদীজল আলো করিয়া রাখিয়াছে, মাঠের মাঝে উঁচু ডাঙায় কোথায় ঘেটুফুলের বন.এই সবের স্বপ্নে সে বিভোর থাকে, মুক্ত আকাশ, মুক্ত মাঠ, গাছপালার জন্য মন কেমন করে। গাছপালা না দেখিয়া বেশীদিন থাকা তাহার পক্ষে একেবারে অসম্ভব! মনে বেশি কষ্ট হইলে একখানা খাতায় সে বসিয়া বসিয়া যত রাজ্যের গাছের ও লতাপাতার নাম লেখে এবং যে ধরনের ভুমিশ্ৰীীর জন্য মনটা তৃষিত থাকে, তাহারই একটা কল্পিত বৰ্ণনায় খাতা ভরাইয়া তোলে। সেখানে নদীর পাশেই থাকে মাঠ, বাবলা বন, নানা বনজ গাছ, পাখিডাকা সকাল-বিকালের রোদ… ফুল। ফুলের সংখ্যা থাকে না। বোর্ডিং-এর ঘরটায় আবদ্ধ থাকিয়াও মনে মনে সে নানা অজানা মাঠে বনে নদীতীরে বেড়াইতে আসে। একখানা বাঁধা খাতাই সে এভাবে লিখিয়া পুরাইয়া ফেলিয়াছে!
অপু ভাবিল, বলুক গে, আর কখখনো কিছু দেখাচ্ছি নে। ওদের সঙ্গে এই আমার হয়ে গেল। দেবো। আবার কখনও ক্লাসের ট্রানস্লেশন বলে!
০৩. ফাল্গুন মাসের প্রথম হইতেই
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ফাল্গুন মাসের প্রথম হইতেই স্কুল কম্পাউন্ডের চারিপাশে গাছপালার নতুন পাতা গজাইল। ক্রিকেট খেলার মাঠে বড়ো বাদাম গাছটার রক্তাভ কচি সবুজ পাতা সকালের রৌদ্রে দেখিতে হইল চমৎকার, শীত একেবারে নাই বলিলেই হয়।
বোর্ডিং-এর রাসবিহারীর দল পরামর্শ করিল মাম্জোয়ানে দোলের মেলা দেখিতে যাইতে হইবে। মামূজোয়ানের মেলা এ অঞ্চলের বিখ্যাত মেলা।
অপু খুশির সহিত রাসবিহারীদের দলে ভিড়িল। মাম্জোয়ানের মেলার কথা অনেক দিন হইতে সে শুনিয়া আসিতেছে। তাহা ছাড়া নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া পর্যন্ত কোথাও মেলা বা বারোয়ারি আর কখনও দেখা ঘটে নাই।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিধুবাবু দু-দিনের ছুটি দিলেন। অপু অনেকদিন পরে যেন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। ক্রোশ তিনেক পথ-মাঠ ও কাঁচা মাটির রাস্তা। ছোট ছোট গ্রাম, কুমারেরা চাক ঘুরাইয়া কলসি গড়িতেছে। পথের ধারের ছোট দোকানে দোকানদার রেড়ির ফলের বীজ ওজন করিয়া লইতেছে—সজিনা গাছ সব ফুলে ভর্তি—এমন চমৎকার লাগে।…ছুটি-ছাটা ও শনি-রবিবারে সীমাবদ্ধ না হইয়া এই যে জীবনধারা পথের দুইপাশে, দিনে রাত্রে, শত দুঃখে সুখে আকাশ বাতাসের তলে, নিরাবরণ মুক্ত প্রকৃতির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাতাইয়া চঞ্চল আনন্দে ছুটিয়া চলিয়াছে—এই জীবনধারার সহিত সে নিজেকে পরিচিত করিতে চায়।
মাঠে কাহারা শুকনা খেজুর ডালের আগুনে রস জ্বাল দিতেছে দেখিয়া তাহার ইচ্ছা হইল— সে তাহাদের কাছে গিয়া খানিকক্ষণ রস জ্বাল দেওয়া দেখিবে, বসিয়া বসিয়া শুনিবে উহারা কি কথাবার্তা বলিতেছে।
ননী বলিল, তোকে পাগল বলি কি আর সাধে? দূর, দূর-আর কি দেখবি ওখানে?
অপু অপ্রতিভ মুখে বলিল, আয় না, ওরা কি বলছে শুনি? ওরা কত গল্প জানে, জানিস? আয় না
রাজু রায়ের পাঠশালার সেই দিনগুলি হইতে বয়স্ক লোকের গল্পের ও কথাবার্তার প্রতি তাহার প্রবল মোহ আছে-একটা বিস্তৃততর, অপরিচিত জীবনের কথা ইহাদের মুখে শোনা যায়। অপু ছাড়িয়া যাইতে রাজি নয়—রাসবিহারীর দল অগত্যা তাহাকে ফেলিয়া চলিয়া গেল।
সুশ্রী চেহারার ভদ্রলোকের ছেলে দেখিয়া মুচিরা খুব খাতির করিল। খেজুর রস খাইতে আসিয়াছে ভাবিয়া মাটির নতুন ভাড় ধুইয়া জিরান কাঠের টাটকা রস লইয়া আসিল। ইহাদের কাছে অপু আদৌ মুখচোরা নয়। ঘন্টাখানেকের উপর সে তাহাদের সেখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গুড় জ্বাল দেওয়া দেখিল।
মাম্জোয়ানের মেলায় পৌঁছিতে তাহার হইয়া গেল বেলা বারোটা। প্রকাণ্ড মেলা, ভয়ানক ভিড়; রৌদ্রে তিন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া মুখ রাঙা হইয়া গিয়াছে, সঙ্গীদের মধ্যে কাহাকেও সে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিল না। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দুই-ই পাইয়াছে, ভালো খাবার খাইবার পয়সা নাই, একটা দোকান হইতে সামান্য কিছু খাইয়া এক ঘটি জল খাইল। তাহার পর একটা পাখির খেলার তাঁবুর ফাঁক দিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল—ভিতরে কি খেলা হইতেছে। একজন পশ্চিমা লোক হটাইয়া দিতে আসিল।
অপু বলিল, কত করে নেবে খেলা দেখতে?…দুপয়সা দেব-দেখাবে?
লোকটি বলিল, এখন খেলা শুরু হইয়া গিয়াছে, আধঘণ্টা পরে আসিতে।
একটা পানের দোকানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, যাত্রা কবে বসবে জানো?
বৈকালে লোকের ভিড় খুব বাড়িল। দোকানে দোকানে, বিশেষ করিয়া পানের দোকানগুলিতে খুব ভিড়। খেলা ও ম্যাজিকের তাঁবুগুলির সামনে খুব ঘণ্টা ও জয়ঢাক বাজিতেছে। অপু দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল—একটা বড়ো তাঁবুর বাহিরে আলকাতরা-মাখা জন দুই লোক বাঁশের মাচার উপর দাঁড়াইয়া কৌতূহলী জনতার সম্মুখে খেলার অত্যাশ্চর্যতা ও অভিনবত্বের নমুনাস্বরূপ একটা লম্বা লাল-নীল কাগজের মালা নানা অঙ্গভঙ্গিসহকারে মুখ হইতে টানিয়া বাহির করিতেছে।
সে পাশের একটা লোককে জিজ্ঞাসা করিল, এ খেলা কয়সা জানো?
নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে বাবার বইয়ের দপ্তরে একখানা পুরাতন বই ছিল, তাহার মনে আছে, বইখানার নাম রহস্য লহরী। রুমাল উড়াইয়া দেওয়া, কাটামুণ্ডুকে কথা বলানো, এক ঘণ্টার মধ্যে আম-চারায় ফল ধরানো প্রভৃতি নানা ম্যাজিকের প্রক্রিয়া বইখানাতে ছিল। অপু বই দেখিয়া দু-একবার চেষ্টা করিতে গিয়াছিল, কিন্তু নানা বিলাতি ঔষধের ফর্দ ও উপকরণের তালিকা দেখিয়া, বিশেষ করিয়া –নিশাদল” দ্রব্যটি কি বা তাহা কোথায় পাওয়া যায় ঠিক করিতে না পারিয়া, অবশেষে ছাড়িয়া দেয়।
সে মনে মনে ভাবিল—ওই সব দেখেই তো ওরা শেখে! বাবার সেই বইখানাতে কত ম্যাজিকের কথা লেখা ছিল! নিশ্চিন্দিপুর থেকে আসবার সময় কোথায় যে গেল বইখানা!
চারিধারে বাজনার শব্দ, লোকজনের হাসি-খুশি, খেলো সিগারেটের ধোঁয়া, ভিড়, আলো, সাজানো দোকানের সারি, তাহার মন উৎসবের নেশায় মাতিয়া উঠিল।
একদল ছেলেমেয়ে একখানা গোরুর গাড়ির ছইয়ের ভিতর হইতে কৌতূহল ও আগ্রহে মুখ বাড়াইয়া ম্যাজিকের তাঁবুর জীবন্ত বিজ্ঞাপন দেখিতে দেখিতে যাইতেছে। সকল লোককেই সিগারেট খাইতে দেখিয়া তাহার ইচ্ছা হইল সেও খায়—একটা পানের দোকানে ক্রেতার ভিড়ের পিছনে খানিকটা দাঁড়াইয়া অবশেষে একটা কাঠের বাক্সের উপর উঠিয়া একজনের কাঁধের উপর দিয়া হাতটা বাড়াইয়া দিয়া বলিল, এক পয়সার দাও তো? এই যে এইদিকে—এক পয়সার সিগারেটভালো দেখে দিয়ো-যা ভালো।
একটা গাছের তলায় বইয়ের দোকান দেখিয়া সেখানে দাঁড়াইল। চটের থলের উপর বই বিছানো, দোকানী খুব বুড়া, চোখে সুতাবাঁধা চশমা। একখানা ছবিওয়ালা চটি আরব্য উপন্যাস অপুর পছন্দ হইল—সে পড়ে নাই-কিন্তু দোকানী দাম বলিল আট আনা। হাতে পয়সা থাকিলে সে কিনিত।
বইখানা আর একবার দেখিতে গিয়া হঠাৎ সম্মুখের দিকে চোখ পড়াতে সে অবাক হইয়া গেল। সম্মুখের একটা দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া আছে—পটু! তার নিশ্চিন্দিপুরের বাল্যসঙ্গী পটু।
অপু তাড়াতাড়ি আগাইয়া গিয়া গায়ে হাত দিতেই পটু মুখ ফিরাইয়া তাহার দিকে চাহিল–প্রথমটা যেন চিনিতে পারিল না-পরে প্রায় চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, অপুদা?…এখানে কি করে, কোথা থেকে অপুদা?
অপু বলিল, তুই কোথা থেকে?
-আমার তো দিদির বিয়ে হয়েছে এই লাউখালি। এইখেন থেকে দু-কোশ। তাই মেলা দেখতে এলাম—তুই কি করে এলি কাশী থেকে
অপু সব বলিল। বাবার মৃত্যু, বড়োলোকের বাড়ি, মনসাপোতা স্কুল। জিজ্ঞাসা করিল, বিনিদির বিয়ে হয়েছে মামূজোয়ানের কাছে? বেশ তো–
অপুর মনে পড়িল, অনেকদিন আগে দিদির চড়ইভাতিতে বিনিদিব ভয়ে ভয়ে আসিয়া যোগ দেওয়া। গরিব অগ্রদানী বামুনের মেয়ে, সমাজে নিচু স্থান, নম্র ও ভীরু চোখ দুটি সর্বদাই নামান, অসেই সন্তুষ্ট।
দুজনেই খুব খুশি হইয়াছিল। অপু বলিল—মেলার মধ্যে বড্ড ভিড় ভাই, চল কোথাও একটু ফাঁকা জায়গাতে গিয়ে বসি—অনেক কথা আছে তোর সঙ্গে।
বাহিরের একটা গাছতলায় দুজনে গিয়া বসিল—তাহাদের বাড়িটা কিভাবে আছে? …বানুদি কেমন?…নেড়া, পটল, নীলু, সতুদা ইহারা?…ইছামতী নদীটা? পটু সব কথার উত্তর দিতে পারিল না, পটুও আজ অনেকদিন গ্রামছাড়া। পটুর আপন মা নাই, সত্য। অপুরা দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাওয়ার পর হইতে সে সঙ্গীহীন হইয়া পড়িয়াছিল, দিদির বিবাহের পরে বাড়িতে একেবারেই মন টিকিল না। কিছুদিন এখানে ওখানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল পড়াশুনার চেষ্টায়। কোথাও সুবিধা হয় নাই। দিদিব বাড়ি মাঝে মাঝে আসে, এখানে থাকিয়া যদি পড়াশুনার সুযোগ হয়, সেই চেষ্টায় আছে। অনেকদিন গ্রামছাড়া, সেখানকার বিশেষ কিছু খবর জানে না। তবে শুনিয়া আসিয়াছিল শীঘ্রই বানীদিব বিবাহ হইবে, সে তিন বছর আগেকার কথা, এতদিন নিশ্চয় হইয়া গিয়াছে।
পটু কথা বলিতে বলিতে অপুর দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল।
রূপকথার রাজপুত্রের মতো চেহারা হইয়া উঠিয়াছে অপুদার।…কি সুন্দর মুখ!…অপুদার কাপড়চোপড়ের ধরনও একেবারে পরিবর্তিত হইয়াছে।
অপু তাহাকে একটা খাবারের দোকানে লইয়া গিয়া খাবার খাওয়াইল, বাহিরে আসিয়া বলিল, সিগারেট খাবি? তাহাকে ম্যাজিকের তাঁবুর সামনে আনিয়া বলিল, ম্যাজিক দেখিস নি তুই? আয় তোকে দেখাই—পরে সে আট পয়সার দুইখানা টিকিট কাটিয়া উৎসুক মুখে পটুকে লইয়া ম্যাজিকের তাঁবুতে ঢুকিল।
ম্যাজিক দেখিতে দেখিতে অপু জিজ্ঞাসা করিল, ইয়ে, আমরা চলে এলে রানুদি বলত নাকি কিন্তু আমাদের আমার কথা? নাঃ
খুব বলিত। পটুর কাছে কতদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছে অপু তাহাকে কোনো পত্র লিখিয়াছে কি, তাহাদের কাশীর ঠিকানা কি? পটু বলিতে পারে নাই। শেষে পটু বলিল, বুড়ো নরোত্তম বাবাজী তোর কথা ভারি বলতো!
অপুর চোখ জলে ভরিয়া আসিল। তাহার বোষ্টমদাদু এখনও বাঁচিয়া আছে?—এখনও তাহার কথা ভুলিয়া যায় নাই? মধুর প্রভাতের পদ্মফুলের মতো ছিল দিনগুলা—আকাশ ছিল নির্মল, বাতাস কি শান্ত, নবীন উৎসাহ ভরা মধুচ্ছন্দ! মধুর নিশ্চিন্দিপুর! মধুর ইছামতীর কলমর্মর!…মধুর তাহার দুঃখী দিদি দুর্গার স্নেহভরা ডাগর চোখের স্মৃতি!…কতদূর, কত দুরে চলিয়া গিয়াছে সে দিনের জীবন। খেলাঘরের দোকানে নোনা-পাতার পান বিক্রি, সেই সতুদার মাকাল ফল চুরি করিয়া দৌড় দেওয়া!…
একবার একখানা বইতে সে পড়িয়াছিল দেবতার মায়ায় একটা লোক স্নানের সময় জলে ডুব দিয়া পুনরায় উঠিবার যে সামান্য ফঁকটুকু তাহারই মধ্যে ষাট বৎসরের সুদীর্ঘ জীবনের সকল সুখ দুঃখ ভোগ করিয়াছিল—যেন তাহার বিবাহ হইল, ছেলেমেয়ে হইল, তাহারা সব মানুষ হইল, কতক বা মরিয়া গেল, বাকিগুলির বিবাহ হইল, নিজেও সে বৃদ্ধ হইয়া গেল–হঠাৎ জল হইতে মাথা তুলিয়া দেখে—কোথাও কিছু নয়, সে যেখানে সেখানেই আছে, কোথায় বা ঘরবাড়ি, বা ছেলেমেয়ে!…
গল্পটা পড়িয়া পর্যন্ত মাঝে মাঝে সে ভাবে তাহারও ওরকম হয় না? এক-এক সময় তাহার মনে হয় হয়তো বা তাহার হইয়াছে। এ সব কিছু না-স্বপ্ন। বাবার মৃত্যু, এই বিদেশে, এই স্কুলে পড়া–সব স্বপ্ন। কবে একদিন ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া দেখিবে সে নিশ্চিন্দিপুরের বাড়িতে তাহাদের সেই বনের ধারের ঘরটাতে আষাঢ়ের পড়ন্ত বেলায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল-সন্ধ্যার দিকে পাখির কলরবে জাগিয়া উঠিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে ভাবিতেছে, কি সব হিজিবিজি অর্থহীন স্বপ্নই না সে দেখিয়াছে ঘুমের ঘোরে!…বেশ মজা হয় আবার তাহার দিদি ফিরিয়া আসে, তাহার বাবা, তাহাদের বাড়িটা।
একদিন ক্লাসে সত্যেনবাবু একটা ইংরেজ কবিতা পড়াইতেছিলেন, নামটা গ্রেভস্ অফ এ হাউসহোল্ড। নির্জনে বসিয়া সেটা আবৃত্তি করিতে করিতে তাহার চোখ দিয়া জল পড়ে। ভাইবোনেরা একসঙ্গে মানুষ, এক মায়ের কোলেপিঠে, এক ছেঁড়া কাঁথার তলে। বড়ো হইয়া জীবনের ডাকে কে কোথায় গেল চলিয়া-কাহারও সমাধি সমুদ্রে, কাহারও কোন্ অজানা দেশের অপরিচিত আকাশের তলে, কাহারও বা ফুল-ফোটা কোন্ গ্রাম্য বনের ধারে।
আপনা-আপনি পথ চলিতে চলিতে এই সব স্বপ্নে সে বিভোর হইয়া যায়। কত কথা যেন মনে ওঠে! যত লোকের দুঃখের দুর্দশার কাহিনী। নিশ্চিন্দিপুরের জানালার ধারে বসিয়া বাল্যের সে ছবি দেখা–সেই বিপন্ন কর্ণ, নির্বাসিতা সীতা, দরিদ্র বালক অশ্বত্থামা, পরাজিত রাজা দুর্যোধন, পল্লীবালিকা জোয়ান। বুঝাইয়া বলিবার বয়স তাহার এখনও হয় নাই; ভাবকে সে ভাষা দিতে জানে না—অল্পদিনের জীবনে অধীত সমুদয় পদ্য ও কাহিনী অবলম্বন করিয়া সে যেভাবে জগৎকে গড়িয়া তুলিয়াছে–অনাবিল তরুণ মনের তাহা প্রথম কাব্য—তার কাঁচা জীবনে সুখে দুঃখে, আশায় নিরাশায় গাঁথা বনফুলের হার।—প্রথম উচ্চারিত ঋক্মন্ত্রের কারণ ছিল যে বিস্ময় যে আনন্দতাহাদেরই সগোত্র, তাহাদেরই মতো ঋদ্ধিশীল ও অবাচ্য সৌন্দর্যময়।
রাগরক্ত সন্ধ্যার আকাশে সত্যের প্রথম শুকতারা।
কে জানে ওর মনের সে সব গহন গভীর গোপন রহস্য? কে বোঝে?
ম্যাজিকের তাঁবু হইতে বাহির হইয়া দুজনে মেলার মধ্যে ঢুকিল। বোর্ডিং-এর একটি ছেলের সঙ্গেও তাহার দেখা হইল না, কিন্তু তাহার আমোদর তৃষ্ণা এখনও মেটে নাই, এখনও ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিবার ইচ্ছা। বলিল–চ পটু, দেখে আসি যাত্ৰা বসবে কখন-যাত্রা না দেখে যাস্ নে যেন।
পটু বলিল, অপুদা কোন ক্লাসে পড়িস তুই?…
অপু অন্যমনস্কভাবে বলিল, ওই যে ম্যাজিক দেখলি, ও আমার বাবার একখানা বই ছিল, তাতে সব লেখা ছিল, কি করে করা যায়—জিনিস পেলে আমিও করতে পারি–
–কোন্ ক্লাসে তুই—
–ফোর্থ ক্লাসে। একদিন আমাদের স্কুলে চল, দেখে আসবি দেখবি কত বড়ো স্কুল–রাত্রে আমার কাছে থাকবি এখন একটু থামিয়া বলিল—সত্যি এত জায়গায় তো গেলাম, নিশ্চিন্দিপুরের মতো আর কিছু লাগে না—কোথাও ভালো লাগে না–
–তোরা যাবি নে আর সেখানে? সেখানে তোদর জন্যে সবাই দুঃখ করে, তোর কথা তো সবাই বলে-পরে সে হাসিয়া বলিল, অপুদা, তোর কাপড় পরবার ধরন পর্যন্ত বদলে গেছে, তুমি আর সেই নিশ্চিন্দিপুরের পাড়াগেয়ে ছেলে নেই–
অপু খুব খুশি হইল। গর্বের সহিত গায়ের শাটটা দেখাইয়া বলিল, কেমন রংটা, না? ফার্স্ট ক্লাসের রমাপতিদার গায়ে আছে, তাই দেখে এটা কিনেছি—দেড় টাকা দাম।
সে একথা বলিল না যে শাটটা সে অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া অপরের দেখাদেখি দরজির দোকান হইতে পারে কিনিয়াছে, দরজির অনবরত তাগাদা সত্ত্বেও এখনও দাম দিয়া উঠিতে পারিতেছে না।
বেলা বেশ পড়িয়া আসিয়াছে। আলকাতরা মাখা জীবন্ত বিজ্ঞাপনটি বিকট চিৎকার করিয়া লোক জড়ো করিতেছে।
পটু সন্ধ্যার কিছু পূর্বে দিদির বাড়ির দিকে রওনা হইল। অপুর সহিত এতকাল পরে দেখা হওয়াতে সে খুব খুশি হইয়াছে। কোথা হইতে অপুদা কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে! তবুও স্রোতের তৃণের মতো ভাসিতে ভাসিতে অপুদা আশ্রয় খুঁজিয়া পাইয়াছে, কিন্তু এই তিন বৎসরকাল সে-ও তো ভাসিয়াই বেড়াইতেছে একরকম, তাহার কি কোন উপায় হইবে না?
সন্ধ্যার পর বাড়ি পৌঁছিল। তাহার দিদি বিনির বিবাহ বিশেষ অবস্থাপন্ন ঘরে হয় নাই, মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, খানদুই-তিন ঘর। পশ্চিমের ভিটায় পুরানো আমলের কোঠা ভাঙিয়া পড়িয়া আছে, তাহারই একটা ঘরে বর্তমানে রান্নাঘর, ছাদ নাই, আপাতত খড়ের ছাউনি, একখানা চাল ইটের দেওয়ালের গায়ে কাতভাবে বানো।
বিনি ভাইকে খাবার খাইতে দিল। বলিল–কি রকম দেখলি মেলা?…সে এখন আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে, বিশেষ মোেটাসোটা হয় নাই, সেই রকমই আছে। গলার স্বর শুধু বদলাইয়া গিয়াছে।
পটু হাসিমুখে বলিল, আজ কি হয়েছে জানিস দিদি, অপুর সঙ্গে দেখা হয়েচে-মেলায়।
বিনি বিস্ময়ের সুরে বলিল, অপু! সে কি করে—কোথা থেকে—
পরে পটুর মুখে সব শুনিয়া সে অবাক হইয়া গেল। বলি—বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে–আহা সঙ্গে করে আনলি নে কেন?…দেখতে বড়ো হয়েছে?…
—সে অপুই আর নেই। দেখলে চেনা যায় না। আরও সুন্দর হয়েছে দেখতে—তবে সেই রকম পাগলা আছে এখনওভারি সুন্দর লাগে—এমন হয়েচে।…এতকাল পরে দেখা হয়ে আমার মেলায় যাওয়াই আজ সার্থক হয়েছে। খুড়িমা মনসাপোত থাকে বললে।
—সে এখেন থেকে কত দূর?…
—সে অনেক, রেলে যেতে হয়। মাম্জোয়ান থেকে নদশ কোশ হবে।
বিনি বলিল, আহা একদিন নিয়ে আসিস না অপুকে, একবার দেখতে ইচ্ছে করে–
ছাদ-ভাঙা রান্নাবাড়ির বোয়াকে পটু খাইতে বসিল। বিনি বলিল, তোর চত্তি মশায়কে একবার বলে দেখিস দিকি কাল? বলিস বছর তিনেক থাকতে দাও, তার পর নিজের চেষ্টা নিজে করব–
পটু বলিল, বছর তিনেকের মধ্যে পড়া শেষ হয়ে যাবে না-হুসাত বছরের কমে কি পাশ দিতে পারব?…অপুদা বাড়িতে পড়ে কত লেখাপড়া জানত আমি তো তাও পড়ি নি, তুমি একবার চকত্তি মশায়কে বলল না দিদি?
বিনি বলিল—আমিও বলব এখন। বড্ড ভয় করে-শাহে আবার বড়ঠাকুরঝি হাত-পা নেড়ে ওঠে–বঠাকুরঝিকে একবার ধরতে পারিস?—আমি কথা কইলে তো কেউ শুনবে না, ও যদি বলে তবে হয়
পটু যে তাহা বোঝে না এমন নয়। অর্থাভাবে দিদিকে ভালো পাত্রের হাতে দিতে পারা যায় নাই, দোজবর, বয়স বেশি। ওপক্ষের গুটিকতক ছেলেমেয়েও আছে, দুই বিধবা ননদ বর্তমান, ইহারা সকলেই তাহার দিদির প্রভু। ভালোমানুষ বলিয়া সকলেই তাহার উপর দিয়া যোল আনা প্রভুত্ব চালাইয়া থাকে। উদয়াস্ত খাটিতে হয়, বাড়ির প্রত্যেকেই বিবেচনা করে তাহাকে দিয়া ব্যক্তিগত ফরমাইশ খাটাইবার অধিকার উহাদের প্রত্যেকেরই আছে, কাজেই তাহাকে কেহ দয়া করে না।
অনেক রাত্রে বিনির স্বামী অর্জুন চক্রবর্তী বাড়ি ফিরিল। মাম্জোয়ানের বাজারে তাহার খাবারের দোকান আছে, আজকাল মেলার সময় বলিয়া রাত্রে একবার আহার করিতে আসে মাত্র। খাইয়াই আবার চলিয়া যায়, রাত্রেও কেনাবেচা হয়। লোকটি ভারি কৃপণ! বিনি রোজই আশা করে—ছোট ভাইটা এখানে কয়দিন হইল আসিয়াছে, এ পর্যন্ত কোন দিন একটা রসগোল্লাও তাহার জন্য হাতে করিয়া বাড়ি আসে নাই, অথচ নিজেরই তো খাবারের দোকান। এ রকম লোকের কাছে ভাইয়ের সম্বন্ধে কি কথাই বা সে বলিবে!
তবুও বিনি বলিল। স্বামীকে ভাত বাড়িয়া দিয়া সে সামনে বসিল, ননদেরা কেহ রান্নাঘরে নাই, এ ছাড়া আর সুযোগ ঘটিবে না। অর্জুন চক্রবর্তী বিস্ময়ের সুবে বলিল—পটল? এখানে থাকবে?…
বিনি মরীয়া হইয়া বলিল—ওই ওর সমান অপূর্ব বলে ছেলে—আমাদের গাঁয়ের, সেও পড়ছে। এখেনে যদি থাকে তবে এই মামূজোয়ান ইস্কুলে গিয়ে পড়তে পারে—একটা হিল্লে হয়—
অর্জুন চক্রবর্তী বলিল—ওসব এখন হবে-টবে না, দোকানের অবস্থা ভালো নয়, দোলের বাজারে খাজনা বেড়ে গিয়েছে দুনো, অথচ দোকানে আয় নেই। মাম্জোয়ানে খটি খুলে চার আনা সের ছানা-তাই বিকুচ্ছে দশ আনায়, তা লাভ করব, না খাজনা দেব, না মহাজন মেটাব? মেলা দেখে বাড়ি চলে যাক—ও সব ঝক্কি এখন নেওয়া বললেই নেওয়া।
বিনি খানিকটা চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—বোশেক মাসের দিকে আসতে বলবো?
অর্জুন চক্রবর্তী বলিল—ববাশেখ মাসের বাকিটা আর কি—আর মাস দেড়েক বই তো নয়! …ওসব এখন হবে না, ওসব নিয়ে এখন দিক কোরো না-ভালো লাগে না, সারাদিন খাটুনির পর–বলে নিজের জ্বালায় তাই বাঁচিনে তা আবার—হুঁ—
বিনি আর কিছু বলিতে সাহস করিল না। মনে খুব কষ্ট হইল—ভাইটা আশা করিয়া আসিয়াছিল–দিদির বাড়ি থাকিয়া পড়িতে পাইবে! বলিল—আচ্ছা, অপু কেমন করে পড়ছে রে?
পটু বলিল–সে যে এস্কলারশিপ পেয়েচেতাতেই খরচ চলে যায়।
বিনি বলিল—তুই তা পাস নে? তাহলে তোরও তো–
পটু হাসিয়া বলিলনা পড়েই এস্কলারশিপ পাবোবা তো—পাশ দিলে তবে পাওয়া যাবে, সে সব আমার হবে না, অপুদা ভালো ছেলে-ও কি আর আমার হবে?…
বিনি বলিল—তুই অপুকে একবার বলে দেখবি? ও ঠিক একটা কিছু তোকে জোগাড় করে দিতে পারে।
দুজনে পরামর্শ করিয়া তাহাই অবশেষে যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করিল।
সর্বজয়া পিছু পিছু উঠিয়া বড়োঘরের দরজাটা বন্ধ করিয়া দিতে আসিল, সম্মুখের উঠানে নামিয়া বলিল—মাঝে মাঝে এসো বৌমা, বাড়ি আগলে পড়ে থাকতে হয়, নইলে দুপুর বেলা এক একবার ভাবি তোমাদের ওখানে একটু বেড়িয়ে আসি। সেদিন বা গয়লাপাড়ায় চুরি হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফেলে যেতে ভরসা পাই নে।
তেলি-বাড়ির বড়ো বধু বেড়াইতে আসিয়াছিল, তিন বৎসরের ছোট মেয়েটির হাত ধরিয়া হাসিমুখে চলিয়া গেল।
এতক্ষণ সর্বজয়া কেশ ছিল। ইহারা সব দুপুরের পর আসিয়াছিল, গল্পগুজবে সময়টা তবুও একরকম কাটিল। কিন্তু একা একা সে তো আর থাকিতে পারে না। শুধুই সব সময়ই, দিন নাই রাত্রি নাই—অপুর কথা মনে পড়ে। অপুর কথা ছাড়া অন্য কোন কথাই তাহার মনে স্থান পায় না।
আজ সে গিয়াছে এই পাঁচ মাস হইল। কত শনিবার কত ছুটির দিন চলিয়া গিয়াছে এই পাঁচ মাসের মধ্যে। সর্বজয়া সকালে উঠিয়া বসিয়াছে—আজ দুপুরে আসিবে। দুপুর চলিয়া গেলে ভাবিয়াছে বৈকালে আসিবে। অপু আসে নাই।
অপুর কত জিনিস ঘরে পড়িয়া আছে, কত স্থান হইতে কত কি সংগ্রহ করিয়া আনিয়া রাখিয়া গিয়াছে—অবোধ পাগল ছেলে! শুন্য ঘরের দিকে চাহিয়া সর্বজয়া হাঁপায়, অপুর মুখ মনে আনিবার চেষ্টা করে। এক একবার তাহার মনে হয় অপুর মুখ সে একেবারে ভুলিয়া গিয়াছে। যতই জোর করিয়া মনে আনিবার চেষ্টা করে ততই সে মুখ অস্পষ্ট হইয়া যায়…অপুর মুখের আদলটা মনে আনিলেও ঠোঁটের ভঙ্গিটা ঠিক মনে পড়ে না, চোখের চাহনিটা মনে পড়ে না…সর্বজয়া একেবারে পাগলের মতো হইয়া ওঠে—-অপুর, তাহার অপুর মুখ সে ভুলিয়া যাইতেছে!
কেবলই অপুর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। অপু কথা বলিতে জানিত না, কোন্ কথার কি মানে হয় বুঝিত না। মনে আছে.নিশ্চিন্দিপুরের বাড়িতে থাকিতে একবার রান্নাবাড়ির দাওয়ায় কাঁঠাল ভাঙিয়া ছেলেমেয়েকে দিতেছিল। দুর্গা বাটি পাতিয়া আগ্রহের সহিত কাঁঠাল-ভাঙা দেখিতেছে, অপু দুর্গার বাটিটা দেখাইয়া হাসিমুখে বলিয়া উঠিল—দিদি কাটালের বড়ো প্রভু, না মা? সর্বজয়া প্রথমটা বুঝিতে পারে নাই, শেষে বুঝিয়াছিল, দিদি কাঁঠালের বড়ো ভক্ত এ কথাটা বুঝাইতে ভক্ত কথাটার স্থানে প্রভু ব্যবহার করিয়াছে। তখন অপুর বয়স নয় বৎসরের কম নয় অথচ তখনও সে কাজে-কথায় নিতান্ত ছেলেমানুষ।
একবার নতুন পরনের কাপড় কোথা হইতে ছিড়িয়া আসিবার জন্য অপু মার খাইয়াছিল। কতদিনের কথা, তবুও ঠিক মনে আছে। হাঁড়িতে আমসত্ত্ব, কুলচুর রাখিবার জো ছিল না, অপু কোন্ ফাঁকে ঢাকনি খুলিয়া চুরি করিয়া খাইবেই। এই অবস্থায় একদিন ধরা পড়িয়া যায়, তখনকার সেই ভয়ে হোট হইয়া যাওয়া রাঙা মুখখানি মনে পড়ে। বিদেশে একা কত কষ্টই হইতেছে, কে তাহাকে সেখানে বুঝিতেছে!
আর একদিনের কথা সে কখনও ভুলিবে না। অপুর বয়স যখন তিন বৎসর, তখন সে একবার হারাইয়া যায়। খানিকটা আগে সম্মুখের উঠানের কাঁঠালতলায় বসিয়া খেলা করিতে তাহাকে দেখা গিয়াছে, ইহারই মধ্যে কোথায় গেল!…পাড়ায় কাহারও বাড়িতে নাই, পিছনের বাঁশবনেও নাই—চারিধারে খুঁজিয়া কোথাও অপুকে পাইল না। সর্বজয়া কাঁদিয়া আকুল হইল—কিন্তু যখন হরিহর বাড়ির পাশের বাঁশতলার ডোবাটা খুঁজিবার জন্য ও-পাড়া হইতে জেলেদের ডাকিয়া আনাইল, তখন তাহার আর কান্নাকাটি রহিল না। সে কেন কাঠের মতো হইয়া ডোবার পাড়ে দাঁড়াইয়া জেলেদের জাল ফেলা দেখিতে লাগিল। পাড়াসুদ্ধ লোক ভাঙিয়া পড়িয়াছিল—ডোবার পাড়ে অর জেলে টানাজালের বাঁধন খুলিতেছিল, সর্বজয়া ভাবিল অক্রুর মাঝিকে চিরকাল সে নিরীহ বলিয়া জানে, ভালো মানুষের মতো কতবার মাছ বেঁচিয়া গিয়াছে তাহাদের বাড়ি—সে সাক্ষাৎ যমের বাহন হইয়া আসিল কি করিয়া? শুধু অর মাঝি নয়, সবাই যেন যমদূত অন্য অন্য লোকেরা যাহারা মজা দেখিতে দুটিয়াছে, তাহারা—এমন কি তাহার স্বামী পর্যন্ত। সেই তো গিয়া ইহাদের ডাকিয়া আনিয়াছে। সর্বজয়ার মনে হইতেছিল যে, ইহারা সকলে মিলিয়া তাহার বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে কি একটা ষড়যন্ত্র আঁটিয়াছে—কোন হৃদয়হীন নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র।
ঠিক সেই সময়ে দুর্গা অপুকে খুঁজিয়া আনিয়া হাজির করিল। অপু নাকি নদীর ধারের পথ দিয়া হন্ হন্ করিয়া হাঁটিয়া একা একা সোনাডাঙার মাঠের দিকে যাইতেছিল, অনেকখানি চলিয়া গিয়াছিল। তাহার পর ফিরিতে গিয়া বোধ হয় পথ চিনিতে পারে নাই। বাড়ির কাঁটাল-তলায় বসিয়া
খেলা করিতে করিতে কখন কোন ফাঁকে বাহির হইয়া গিয়াছে, কেহ জানে না।
যখন সকলে যে-যাহার বাড়ি চলিয়া গেল, তখন সর্বজয়া স্বামীকে বলিল—এ ছেলে কোনদিন সংসারী হবে না, দেখে নিয়ো–
হরিহর বলিল—কেন?…তা ও-রকম হয়, ছেলেমানুষ গিয়েই থাকে–
সর্বজয়া বলিল—তুমি পাগল হয়েছ!…তিন বছর বয়েসে অন্য ছেলে বাড়ির বাইরে পা দেয় না, আর ও কিনা গা ছেড়ে, বাঁশবন, মাঠ ভেঙে গিয়েছে সেই সোনাডাঙার মাঠের রাস্তায়। তাও ফেরবার নাম নেই–হন্ হন্ করে হেঁটেই চলেছে। কখখনো সংসারে মন দেবে না, তোমাকে বলে দিলাম-এ আমার কপালেই লেখা আছে!
কত কথা সব মনে পড়ে নিশ্চিন্দিপুরের বাড়ির কথা, দুর্গার কথা। এ জায়গা ভালো লাগে, এখন মনে হয়, আবার যদি নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিয়া যাওয়া সম্ভব হইত! একদিন যে-নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া আসিতে উৎসাহের অবধি ছিল না, এখন তাহাই যেন রূপকথার রাজ্যের মতো সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারকার ধরা-ছোঁয়ার বাহিরের জিনিস হইয়া পড়িয়াছে! ভাবিতে ভাবিতে প্রথম বসন্তের পুষ্পসুবাসমধুর বৈকাল বহিয়া যায়, অলস অস্ত-আকাশে কত রং ফুটিয়া আবার মিলাইয়া যায়, গাছপালায় পাখি ডাকে। এ রকম একদিন নয়, কতদিন হইয়াছে।
কোন কিছু ভালোমন্দ জিনিস পাইলেই সেটুকু সর্বজয়া ছেলের জন্য তুলিয়া রাখে। কুণ্ডুদের বাড়ির বিবাহের তত্তে সন্দেশ আসিলে সর্বজয়া প্রাণ ধরিয়া তাহার একটা খাইতে পারে নাই। ছেলের জন্য তুলিয়া রাখিয়া রাখিয়া অবশেষে যখন হাঁড়ির ভিতর পচিয়া উঠিল তখন ফেলিয়া দিতে হইল। পৌষপার্বণের সময় হয়তো অপু বাড়ি আসিবে, পিঠা খাইতে ভালোবাসে, নিশ্চয় আসিবে। সর্বজয়া চাল কুটিয়া সমস্ত আয়োজন ঠিক করিয়া রাখিয়া বসিয়া রহিল—কোথায় অপু?
এক সময় তাহার মনে হয়, অপু আর সে অপু নাই। সে যেন কেমন হইয়া গিয়াছে, কই অনেকদিন তো সে মাকে ই-উ-উ করিয়া ভয় দেখায় নাই, অকারণে আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে নাই, একোণে কোণে লুকাইয়া দুষ্টুমি-ভরা হাসিমুখে উকি মারে নাই, যাহা তাহা বলিয়া কথা ঢাকিতে যায় নাই! ভাবিয়া কথা বলিতে শিখিয়াছে—এসব সর্বজয়া পছন্দ করে না। অপুর ছেলেমানুষির জন্য সর্বজয়ার মন তৃষিত হইয়া থাকে, অপু না বাড়ুক, সে সব সময়ে তাহার উপরে একান্ত নির্ভরশীল ছোট্ট খোকাটি হইয়া থাকুক—সবর্জয়া যেন মনে মনে ইহাই চায়। কিন্তু তাহার অপু যে একেবারে বদলাইয়া যাইতেছে!…
অপুর উপর মাঝে মাঝে তাহার অত্যন্ত রাগ হয়। সে কি জানে না—তাহার মা কি রকম ছটফট করিতেছে বাড়িতে! একবারটি কি এতদিনের মধ্যে আসিতে নাই? ছেলেবেলায় সন্ধ্যার পর এ-ঘর হইতে ও-ঘরে যাইতে হইলে মায়ের দরকার হইত, মা খাওয়াইয়া না দিলে খাওয়া হইত নাএই সেদিনও তো। এখন আর মাকে দরকার হয় না—না? বেশ—তাহারও ভাবিবার দায় পড়িয়া গিয়াছে, সে আর ভাবিবে না। বয়স হইয়া আসিল, এখন ইষ্টচিন্তা করিয়া কাল কাটাইবার সময়, ছেলে হইয়া স্বর্গে ধ্বজা তুলিবে কি না!
কিন্তু শীঘ্রই সর্বজয়া আবিষ্কার করিল—ছেলের কথা না ভাবিয়া সে একদণ্ড থাকিতে পারে। এতদিন সে ছেলের কথা প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তে ভাবিয়া আসিয়াছে। অপুর সহিত অসহযোগ করিলে জীবনটাই যেন ফাঁকা, অর্থহীন, অবলম্বনশূন্য হইয়া পড়ে—তাহার জীবনে আর কিছুই নাই—এক অপু ছাড়া!…
এক একদিন নির্জন দুপুর বেলা ঘরে বসিয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদে।
সে দিন বৈকালে সে ঘরে বসিয়া কার্পাস তুলার বীজ ছাড়াইতেছিল, হঠাৎ সম্মুখের ঘোট ঘুলঘুলি জানালার ফাঁক দিয়া বাড়ির সামনের পথের দিকে তাহার চোখ পড়িল। পথ দিয়া কে যেন যাইতেছেমাথার চুল ঠিক যেন অপুর মতো, ঘন কালো, বড়ো বড়ো ঢেউখেলানো, সর্বজয়ার মনটা হঁাৎ করিয়া উঠিল। মনে মনে ভাবিল—এ অঞ্চলের মধ্যে এ রকম চুল তো কখনও কারও দেখি নি কোনদিন—সেই শত্তুরের মতো চুল অবিকল!…
তাহার মনটা কেমন উদাস অনামনস্ক হইয়া যায়, তুলার বীজ ছাড়াইতে আর আগ্রহ থাকে না।
হঠাৎ ঘরের দরজায় কে যেন টোকা দিল। তখনই আবার মৃদু টোকা। সর্বজয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া দোর খুলিয়া ফেলে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতে পারে না।
অপু দুষ্টুমি-ভরা হাসিমুখে দাঁড়াইয়া আছে। নিচু হইয়া প্রণাম করিবার আগেই সর্বজয়া পাগলের মতো ছুটিয়া গিয়া ছেলেকে জড়াইয়া ধরিল।
অপু হাসিয়া বলিল—টের পাও নি তুমি, না মা? আমি ভাবলাম আস্তে আস্তে উঠে দরজায় টোকা দেবো।
সে মাম্জোয়ানেব মেলা দেখিতে আসিয়া একবার বাড়িতে না আসিয়া থাকিতে পারে নাই। এত নিকটে আসিয়া মার সঙ্গে দেখা হইবে না! পুলিনের নিকট রেলভাড়া ধার লইয়া তবে আসিয়াছে। একটা পুটলি খুলিয়া বলিল, তোমার জন্য উঁচ আর গুলিসুতো এনেচি-আর এই দ্যাখো কেমন কাঁচা পাপর এনেছি মুগের ডালের—সেই কাশীতে তুমি ভেজে দিতে!
অপুর চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। অন্য ধরনের জামা গায়ে কি সুন্দর মানাইয়াছে! সর্বজয়া বলে, বেশ জামাটা—এবার বুঝি কিনেছিস?
মার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে দেখিয়া অপু খুব খুশি। জামাটা ভালো করিয়া দেখাইয়া বলিল— সবাই বলে জামাটার রং চমৎকার হয়েছে চাঁপাফুলের মতো হবে ধুয়ে এলে—এই তো মোটে কোরা।
বোর্ডিং এ গিয়া অপু এই কয় মাস মাস্টার ও ছাত্রদের মধ্যে যাহাকেই মনে মনে প্রশংসা করে, কতকটা নিজের জ্ঞাতসারে কতকটা অজ্ঞাতসারে তাহারই হাবভাব, কথা বলিবাব ভঙ্গি নকল করিয়াছে। সত্যেনবাবুর, রমাপতির, দেবব্রতের, নতুন আঁকের মাস্টারের! সর্বজয়ার যেন অপুকে নতুন নতুন ঠেকে। পুরাতন অপু যেন আর নাই। অপু তো এ রকম মাথা পিছনের দিকে হেলাইয়া কথা বলিত না? সে তো পকেটে হাত পুরিয়া এ ভাবে সোজা হইয়া দাঁড়াইত না?
সন্ধ্যার সময় মায়ের রাঁধিবার স্থানটিতে অপু পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া গল্প করে। সর্বজয়া আজ অনেকদিন পরে রাত্রে রাঁধিতে বসিয়াছে।–সেখানে কত ছেলে একসঙ্গে থাকে? এক ঘবে কজন? দু-বেলাই মাছ দেয়? পেট ভরিযা ভাত দেয় তো? কি খাবার খায় সে বৈকালে? কাপড় নিজে কাচিতে হয়? সে তাহা পাবে তো!-পড়াশুনার কথা সর্বজয়া জিজ্ঞাসা করিতে জানে না, শুধু খাওয়ার কথাই জিজ্ঞাসা করে। অপুর হাসিতে, ঘাড় দুলুনিতে, হাত-পা নাড়াতে, ঠোঁটের নিচের ভঙ্গিতে সর্বজয়া আবার পুরানো অপু, চিরপরিচিত অপুকে ফিরিয়া পায়। বুকে চাপিতে ইচ্ছা করে। সে অপুর গল্প শোনে না, শুধু মুখের দিকেই চাহিয়া থাকে।
–হাতে পায়ে বল পেলাম মা, এক এক সময় মনে হত-অপু বলে কেউ ছিল না, ও যেন স্বপ্ন দেখিচি, আবার ভাবতাম-না, সেই চোখ, টুকটুকে ঠোঁট, মুখের তিল—স্বপ্ন নয়, সত্যিই তো–রাঁধতে বসেও কেবল মনে হয় মা, অপুর আসা স্বপ্ন হয় তো, সব মিথ্যে—তাই কেবল ওর মুখেই চেয়ে ঠাউরে দেখি
অপু চলিয়া যাইবার কয়েকদিন পরে সর্বজয়া তেলিগিন্নির কাছে গল্প করিয়াছিল।
পরদিনটাও অপু বাড়ি রহিল।
যাইবার সময় মাকে বলিল—মা, আমাকে একটা টাকা দাও না? কতকগুলো ধার আছে এ মাসে, শোধ করব, দেবে?
সর্বজয়ার কাছে টাকা ছিল না, বিশেষ কখনও থাকে না। তেলিরা ও কুণ্ডুরা জিনিসপত্রটা, কাপড়খানা, সিধাটা—এই রকমই দিয়া সাহায্য করে। নগদ টাকাকড়ি কেহ দেয় না। তবু ছেলের পাছে কষ্ট হয় এজন্য সে তেলিগিন্নির নিকট হইতে একটা টাকা ধার করিয়া আনিয়া ছেলের হাতে দিল।
সন্ধ্যার আগে অপু চলিয়া গেল, ক্রোশ দুই দুরে স্টেশন, সন্ধ্যার পরেই ট্রেন।
০৪. বৎসর দুই কোথা দিয়া কাটিয়া গেল
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বৎসর দুই কোথা দিয়া কাটিয়া গেল।
অপু ক্রমেই বড়ো জড়াইয়া পড়িয়াছে, খরচে আয়ে কিছুতেই আর কুলাইতে পারে না। নানাদিকে দেনা কতভাবে হুঁশিয়ার হইয়াও কিছু হয় না। এক পয়সার মুড়ি কিনিয়া দুই বেলা খাইল, নিজে সাবান দিয়া কাপড় কাচিল, লজেঞ্জুস ভুলিয়া গেল।
পরদিনই আবার বোর্ডিং-এর ছেলেদের দল চাঁদা করিয়া হালুয়া খাইবে। অপু হাসিমুখে সমীরকে বলিল-দু-আনা ধাব দিবি সমীর, হালুয়া খাবো?—দু-আনা করে চাঁদা—ওই ওবা ওখানে করছে—কিশমিশ দিয়ে বেশ ভালো করে করচে–
সমীরেব কাছে অপুর দেনা অনেক। সমীর পয়সা দিল না।
প্রতিবার বাড়ি হইতে আসিবার সময় সে মায়ের যৎসামান্য আয হইতে টাকাটা আধুলিটা প্রায়ই চাহিয়া আনে—মা না দিতে চাহিলে রাগ করে, অভিমান করে, সর্বজয়াকে দিতেই হয়।
ইহার মধ্যে আবার পটু মাঝে মাঝে আসিয়া ভাগ বসাইয়া থাকে। সে কিছুই সুবিধা করিতে পারে নাই পড়াশুনার। নানাস্থানে ঘুবিছে, ভগ্নিপতি অর্জুন চক্রবর্তী তত তাহাকে বাড়ি ঢুকিতে দেয় না। বিনিকে এ সব লইয়া কম গঞ্জনা সহ্য করিতে হয় নাই বা কম চোখের জল ফেলিতে হয় নাই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পটু নিরাশ্রয় ও নিরবলম্ব অবস্থায় পথে পথেই ঘোরে, যদিও পড়াশুনাব আশা সে এখনও অবধি ছাড়ে নাই। অপু তাহার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু সুবিধা করিতে পারে নাই। দু-তিন মাস হয়তো দেখা নাই, হঠাৎ একদিন কোথা হইতে পুঁটলি বগলে করিয়া পটু আসিয়া হাজির হয়, অপু তাহাকে যত্ন করিয়া বাখে, তিন-চারদিন ছাড়ে না, সে না চাহিলেও যখন যাহা পাবে হাতে খুঁজিয়া দেয়টাকা পারে না, সিকিটা দুয়ানিটা। পটু নিশ্চিন্দিপুরে আর যায় না–তাহার বাবা সম্প্রতি মারা গিয়াছেন—সত্যা দেশের বাড়িতে তাহার দুই মেয়ে লইয়া থাকেন, সেখানে ভাই বোন কেহই আর যায় না। পটুকে দেখিলে অপুর ভাবি একটা সহানুভূতি হয়, কিন্তু ভালো কবিবার তাহার হাতে আর কি ক্ষমতা আছে?
একদিন রাসবিহারী আসিয়া দু-আনা পয়সা ধার চাহিল। রাসবিহারী গরিবের ছেলে, তাহা ছাড়া পড়াশুনায় ভালো নয় বলিয়া বোর্ডিং-এ খাতিরও পায় না। অপুকে সবাই দলে নেয়, পয়সা দিতে না পারিলেও নেয়। কিন্তু তাহাকে পোঁছেও না। অপু এ সব জানিত বলিয়াই তাহার উপর কেমন একটা করুণা। কিন্তু আজ সে নানা কারণে রাসবিহারীর প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। বলিল, আমি কোথায় পাবো পয়সা?—আমি কি টাকার গাছ?—দিতে পারবো না যাও।রাসবিহারী পীড়াপীড়ি শুরু করিল। কিন্তু অপু একেবারে বাঁকিয়া বসিল। বলিল, কক্ষনো দেবো না তোমায়—যা পারো করো।
রমাপতির কাছে ছেলেদের একখানা মাসিক পত্র আসে, তাহাতে সে একদিন ছায়াপথ সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ পড়িল। ছায়াপথ কাহাকে বলে ইহার আগে জানিত না—এতবড় বিশাল কোন জিনিসের ধারণাও কখনও করে নাই-নক্ষত্রের সম্বন্ধেও কিছু জানা ছিল না। শরতের আকাশ রাত্রে মেঘমুক্ত-বোর্ডিং-এর পিছনে খেলার কম্পাউন্ডে রাত্রে দাঁড়াইয়া ছায়াপথটা প্রথম দেখিয়া সে কী আনন্দ। জুলজুলে সাদা হায়াপথটা কালো আকাশের বুক চিরিয়া কোথা হইতে কোথায় গিয়াছে— শুধু নক্ষত্রে ভরা!…
কাঁঠালতলাটায় দাঁড়াইয়া সে কতক্ষণ মুগ্ধনেত্রে আকাশের পানে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল–নবজাগ্রত মনের প্রথম বিস্ময়!…
পৌষ মাসের প্রথমে অপুর নিজের একটু সুবিধা ঘটিল। নতুন ডেপুটিবাবুর বাসাতে ছেলেদের জন্য একজন পড়াইবার লোক চাই। হেডপণ্ডিত তাহাকে ঠিক করিয়া দিলেন। দুটি ছেলে পড়ানো, থাকা ও খাওয়া।
দুই-তিনদিনের মধ্যেই বোর্ডিং হইতে বাসা উঠাইয়া অপু সেখানে গেল। বোর্ডিং-এ অনেক বাকি পড়িয়াছে, সুপারিন্টেন্ডেন্ট তলে তলে হেডমাস্টারের কাছে এসব কথা রিপোর্ট করিয়াছেন, যদিও অপু তাহা জানে না।
বাহিরের ঘরে থাকিবার জায়গা স্থির হইল। বিছানাপত্র গুছাইয়া পাতিয়া লইতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। সন্ধ্যার পরে খানিকটা বেড়াইয়া আসিয়া রাঁধুনী ঠাকুরের ডাকে বাড়ির মধ্যে খাইতে গেল। দালানে ঘাড় খুঁজিয়া খাইতে খাইতে তাহার মনে হইল—একজন কে পাশের দুয়ারের কাছে দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ হইতে তাহার খাওয়া দেখিতেছেন। একবার মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিতে তিনি সবিয়া আসিলেন। খুব সুন্দরী মহিলা, তাহার মায়ের অপেক্ষাও ব্যস অনেক-অনেক কম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—তোমার বাড়ি কোথায়?
অপু ঘাড় না তুলিয়া বলিল, মনসাপোতা—অনেক দূর এখেন থেকে–
-বাড়িতে কে কে আছেন?
–শুধু মা আছেন, আর কেউ না।
—তোমার বাবা বুঝি ভাই বোন কটি তোমরা?
—এখন আমি একা। আমার দিদি ছিল—সে সাত-আট বছর হল মারা গিয়েছে।–
কোনোরকমে তাড়াতাড়ি খাওয়া সাবিয়া সে উঠিয়া আসিল। শীতকালেও সে যেন ঘামিয়া উঠিয়াছে।
পরদিন সকালে অপু বাড়ির ভিতর হইতে খাইয়া আসিয়া দেখিল, বছর তেরো বয়সের একটি সুন্দরী মেয়ে ছোট্ট একটি খোকাব হাত ধরিয়া বাহিরের ঘরে দাঁড়াইয়া আছে। অপু বুঝিল—সে কাল রাত্রের পরিচিত মহিলাটির মেয়ে। অপু আপন মনে বই গুছাইয়া স্কুলে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল, মেয়েটি একদৃষ্টে চাহিয়া দেখিতেছিল। হঠাৎ অপুর ইচ্ছা হইল, এ মেয়েটির সামনে কিছু পৌরুষ দেখাইবে—কেহ তাহাকে বলিয়া দেয় নাই, শিখায় নাই, আপনাআপনি তাহার মনে হইল। হাতের কাছে অন্য কিছু না পাইয়া সে নিজের অঙ্কের ইনস্ট্রমেন্ট বাক্সটা বিনা কারণে খুলিয়া প্রোটেক্টর, সেটুস্কোয়ার, কম্পাসগুলোকে বিছানার উপর ছড়াইয়া ফেলিয়া পুনরায় সেগুলো বাক্সে সাজাইতে লাগিল। কি জানি কেন অপুর মনে হইল, এই ব্যাপারেই তাহার চরম পৌরুষ দেখানো হইবে। মেয়েটি দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল, কোনো কথা বলিল না, অপুও কোনো কথা বলিল না।
আলাপ হইল সেদিন সন্ধ্যায়। সে স্কুল হইতে আসিয়া সবে দাঁড়াইয়াছে, মেয়েটি আসিয়া লাজুক চোখে বলিল—আপনাকে মা খাবার খেতে ডাকছেন।
আসন পাতা—পরোটা, বেগুন ভাজা, আলুচচ্চড়ি, চিনি। অপু চিনি পছন্দ করে না গুড়ের মতো জিনিস নাই, কেন ইহারা এমন সুন্দর গরম গরম পরোটা চিনি দিয়া খায়?…
মেয়েটি কাছে দাঁড়াইয়া ছিল। বলিল—মাকে বলব আর দিতে?
–না; তোমরা চিনি খাও কেন?…গুড় তো ভালো—
মেয়েটি বিস্মিতমুখে বলিল—কেন, আপনি চিনি খান না?
–ভালোবাসি নেরুগীর খাবার—খেজুর গুড়ের মতো কি আর খেতে ভালো?—মেয়েটির সামনে তাহার আদৌ লজ্জা ছিল না, কিন্তু এই সময়ে মহিলাটি ঘরে ঢোকাতে অপুর লম্বা লম্বা কথা বন্ধ হইয়া গেল। মহিলাটি বলিলেন—ওকে দাদা বলে ডাকবি নির্মলা, কাছে বসে খাওয়াতে হবে রোজ। ও দেখছি যে-রকম লাজুক, এ পর্যন্ত তো আমার সঙ্গে একটা কথাও বললে না-না দেখলে আধপেটা খেয়ে উঠে যাবে।
অপু লজ্জিত হইল। মনে মনে ভাবিল ইহাকে সে মা বলিয়া ডাকিবে। কিন্তু লজ্জায় পারিল, সুযোগ কোথায়? এমনি খামকা মা বলিয়া ডাকা—সে বড়ো—সে তাহা পারিবে না।
মাসখানেক ইহাদের বাড়ি থাকিতে থাকিতে অপুর কতকগুলি নতুন বিষয়ে জ্ঞান হইল। সবাই ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, আটপৌরে পোশাক-পরিচ্ছদও সুদৃশ্য ও সুরুচিসম্মত। মেয়েদের শাড়ি পরিবার ধরনটি বেশ লাগে, একে সবাই দেখিতে সুশ্রী, তাহার উপর সুদৃশ্য শাড়ি-সেমিজে আরও সুন্দর দেখায়। এই জিনিসটা অপু কখনও জানিত না, বড়োলোকের বাড়ি থাকিবার সময়ও নহে, কারণ সেখানে ঐশ্বর্যের আড়ম্বরে তাহার অনভ্যস্ত চক্ষু ধাঁধিয়া গিয়াছিল—সহজ গৃহস্থ জীবনের দৈনন্দিন ব্যাপারের পর্যায়ে তাহাকে সে ফেলিতে পারে নাই।
অপু যে-সমাজ, যে-আবহাওয়ায় মানুষ—সেখানকার কেহ এ ধরনের সহজ সৌন্দর্যময় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নয়। নানা জায়গায় বেড়াইয়া নানা ধরনের লোকের সঙ্গে মিশিয়া তাহার আজকাল চোখ ফুটিয়াছে; সে আজকাল বুঝিতে পারে নিশ্চিন্দিপুরে তাহাদের গৃহস্থালি ছিল দরিদ্রের, অতি দরিদ্রের গৃহস্থালি। শিল্প নয়, শ্রী ছাঁদ নয়, সৌন্দর্য নয়, শুধু খাওয়া আর থাকা।
নির্মলা আসিয়া কাছে বসিল। অপু অ্যালজেব্রার শক্ত আঁক কষিতেছিল, নির্মলা নিজের বইখানা খুলিয়া বলিল—আমায় ইংরেজিটা একটু বলে দেবেন দাদা?
অপু বলিল—এসে জুটলে? এখন ওসব হবে না, ভারি মুশকিল, একটা আঁকও সকাল থেকে মিলল না!
নির্মলা নিজে বসিয়া পড়িতে লাগিল। সে বেশ ইংরেজি জানে, তাহার বাবা যত্ন করিয়া শিখাইয়াছেন, বাংলাও খুব ভালো জানে।
একটু পড়িয়াই সে বইখানা বন্ধ করিয়া অপুর আঁক কষা দেখিতে লাগিল। খানিকটা আপন মনে চুপ করিয়ে বসিয়া রহিল। তাহার পর আর একবার ঝুঁকিয়া দেখিয়া অপুর কাঁধে হাত দিয়া ডাকিয়া বলিল—এদিকে ফিরুন দাদা, আচ্ছা এই পদ্যটা মিলিয়ে–
অপু বলিল—যাও! আমি জানি নে, ওই তো তোমার দোষ নির্মলা, আঁক মিলছে না, এখন তোমার পদ্য মেলাবার সময়—আচ্ছা লোক
নির্মলা মৃদু মৃদু হাসিয়া বলিল—এ পদ্যটা আর মেলাতে হয় না আপনার বলুন দিকি—সেই গাছ গাছ নয়, যাতে নেই ফল
অপু আঁক-কষা ছাড়িয়া বলিল—মিলবে না? আচ্ছা দ্যাখোপরে খানিকটা আপন মনে ভাবিয়া বলিল—সেই লোক তোক নয়, যার নেই বল-হল না?
নির্মলা লাইন দুটি আপন মনে আবৃত্তি করিয়া বুঝিয়া দেখিল কোথায়ও কানে বাধিতেছে কি। ঘাড় নাড়িয়া বলিল—আচ্ছা এবার বলুন তো আর একটা
–আমি আর বলব না—তুমি ওরকম দুষ্টুমি করো কেন? আমি আঁকগুলো কষে নিই, তারপর যত ইচ্ছা পদ্য মিলিয়ে দেবো
–আচ্ছা এই একটা-সেই ফুল ফুল নয়, যার—
–মাকে এখুনি উঠে গিয়ে বলে আসবো, নির্মলা—ঠিক বলছি, ওরকম যদি–
নির্মলা রাগ করিয়া উঠিয়া গেল। যাইবার সময় পিছন ফিরিয়া তাহার দিকে চাহিয়া বলিলওবেলা কে খাবার বয়ে আনে বাইরের ঘরে দেখবো–
এরকম প্রায়ই হয়, অপু ইহাতে ভয় পায় না। বেশ লাগে নির্মলাকে।
পূজার পর নির্মলার এক মামা বেড়াইতে আসিলেন। অপু শুনিল, তিনি নাকি বিলাতফেরত নির্মলার ছোট ভাই নস্তুর নিকট কথাটা শুনিল। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়, বোগা শ্যামবর্ণ। এ লোক বিলাতফেরত!
বাল্যে নদীর ধারে ছায়াময় বৈকালে পুরাতন বঙ্গবাসী তে পড়া সেই বিলাতযাত্রীর চিঠির মধ্যে পঠিত আনন্দভরা পুরাতন পথ বাহিয়া মরুভূমির পার্শ্বের সুয়েজ খালের ভিতর দিয়া, নীল ভূমধ্যসাগরমধ্যস্থ দ্রাক্ষাকুঞ্জবেষ্টিত কর্সিকা দুরে ফেলিয়া সেই মধুর স্বপ্নমাখা পথ-যাত্রা।
এই লোকটা সেখানে গিয়াছিল? এই নিতান্ত সাধারণ ধরনের মানুষটা-যে দিব্য নিরীহমুখে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া মোচার ঘণ্ট দিয়া ভাত খাইতেছে!
দু-এক দিনেই নির্মলার মামা অমরবাবুর সহিত তাহার খুব আলাপ হইয়া গেল।
বিলাতের কত কথা সে জানিতে চায়। পথের ধারে সেখানে কি সব গাছপালা? আমাদের দেশের পরিচিত কোন গাছ সেখানে আছে? প্যারিস খুব বড়ো শহর? অমরবাবু নেপোলিয়নের সমাধি দেখিয়াছেন? ডোভারের খড়ির পাহাড়? ব্রিটিশ মিউজিয়ামে নাকি নানা অদ্ভুত জিনিস আছে কি কি? আর ভেনিস?—ইতালির আকাশ নাকি দেখিতে অপূর্ব?
পাড়াগাঁয়ের স্কুলের ছেলে, এত সব কথা জানিবার কৌতূহল হইল কি করিয়া অমরবাবু বুঝিতে পারেন না। এত আগ্রহ করিয়া শুনিবার মতো জিনিস সেখানে কি আর আছে! একঘেয়েধোঁয়া–বৃষ্টি-শীত। তিনি পয়সা খরচ করিয়া সেখানে গিয়াছিলেন সাবান প্রস্তুত প্রণালী শিখিবার জন্য, পথের ধারের গাছপালা দেখিতে যান নাই বা ইতালির আকাশের রং লক্ষ করিয়া দেখিবাব উপযুক্ত সময়ের প্রাচুর্যও তার ছিল না।
নির্মলাকে অপুর ভালো লাগে, কিন্তু সে তাহা দেখাইতে জানে না। পবের বাড়ি বলিয়াই হউক বা একটু লাজুক প্রকৃতির বলিয়াই হউক, সে বাহিরের ঘরে শান্তভাবে বাস করে-কি তাহার অভাব, কোষ্টা তাহার দরকার, সে কথা কাহাকেও জানায় না। অপুর এই উদাসীনতা নির্মলার বড়ো বাজে, তবুও সে না চাহিতেই নির্মলা তাহার মযলা বালিশের ওযাড় সাবান দিয়া নিজে কাচিয়া দিয়া যায়, গামছা পরিষ্কার করিয়া দেয়, ছেঁড়া কাপড় বাড়ির মধ্যে লইয়া গিয়া মাকে দিয়া সেলাইয়েব কলে সেলাই করিয়া আনিয়া দেয়। নির্মলা চায় অপূর্ব-দাদা তাহাকে ফাইফরমাশ করে, তাহার প্রতি হুকুমজারি করে; কিন্তু অপু কাহারও উপর কোনো হুকুম কোনোদিন করিতে জানে না—এক মা ছাড়া। দিদি ও মায়ের সেবায় সে অভ্যস্ত বটে, তাও সে-সেবা অযাচিতভাবে পাওয়া যাইত তাই। নইলে অপু কখনও হুকুম করিয়া সেবা আদায় করিতে শিখে নাই। তা ছাড়া সে সমাজের যে স্তরের মধ্যে মানুষ, ডেপুটিবাবুরা সেখানকার চোখে ব্রহ্মলোকবাসী দেবতার সমকক্ষ জীব। নির্মলা ডেপুটিবাবুর বড় মেয়ে—রূপে, বেশভূষায়, পড়াশুনায়, কথাবার্তায় একমাত্র লীলা ছাড়া সে এ পর্যন্ত যত মেয়ের সংস্পর্শে আসিয়াছে—সকলের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে কি করিয়া নির্মলার উপর হুকুমজারি করিবে? নির্মলা তাহা বোঝে না—সে দাদা বলিয়া ডাকে, অপুর প্রতি একটা আন্তরিক টানের পরিচয় তাহার প্রতি কাজে-কেন অপূর্ব-দাদা তাহাকে প্রাণপণে খাটাইয়া লয় না, নিষ্ঠুরভাবে অযথা ফাইফরমাশ করে না? তাহা হইলে সে খুশি হইত।
চৈত্র মাসের শেষে একদিন ফুটবল খেলিতে খেলিতে অপুর হাঁটুটা কি ভাবে মচকাইয়া গিয়া সে মাঠে পড়িয়া গেল। সঙ্গীরা তাহাকে ধরাধরি করিয়া আনিয়া ডেপুটিবাবুর বাসায় দিয়া গেল। নির্মলার মা ব্যস্ত হইয়া বাহিরের ঘরে আসিলেন, কাছে গিয়া বলিলেন–দেখি দেখি, কি হয়েছে? অপুর উজ্জ্বল গৌরবর্ণ সুন্দর মুখ ঘামে ও যন্ত্রণায় রাঙা হইয়া গিয়াছে, ডান পা-খানা সোজা করিতে পারিতেছে না। মনিয়া চাকর নির্মলার মার স্লিপ লইয়া ডাক্তারখানায় ছুটিল। নিলা বাড়ি ছিল না, ভাইবোনদের লইয়া গাড়ি করিয়া মুন্সেফবাবুর বাসায় বেড়াইতে গিয়াছিল। একটু পরে সরকারি ডাক্তার আসিয়া দেখিয়া শুনিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিয়া গেলেন। সন্ধ্যার আগে নির্মলা আসিল। সব শুনিয়া বাহিরের ঘরে আসিয়া বলিলকই দেখি, বেশ হয়েছে দস্যিবৃত্তি করার ফল হবে না? ভারি খুশি হয়েছি আমি–
নির্মলা কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। অপু মনে মনে ক্ষুন্ন হইয়া ভাবিল—যাক না, আর কখনও যদি কথা কই
আধ ঘণ্টা পরেই নির্মলা আসিয়া হাজির। কৌতুকের সুরে বলিল—পায়ের ব্যথা-ট্যথা জানি নে, গরম জল আনতে বলে দিয়ে এলাম, এমন করে সেঁক দেবোলাগে তো লাগবে—দুষ্টুমি করাব বাহাদুরি বেরিয়ে যাবে-কমলালেবু খাবেন একটা?—না, তাও না?
মনিয়া চাকর গরম জল আনিলে নির্মলা অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া ব্যথার উপর সেঁক দিল, নির্মলার ভাইবোনেরা সব দেখিতে আসিয়া ধরিল-ও দাদা, এইবার একটা গল্প বলুন না।
অপুর মুখে গল্প শুনিতে সবাই ভালোবাসে।
নির্মলা বলিল-হা, দাদা এখন পাশ ফিরে শুতে পারছেন না—এখন গল্প না বললে চলবে কেন?…চুপ করে বসে থাকো সব-নয়তো বাড়ির মধ্যে পাঠিয়ে দেব।
পরদিন সকালটা নির্মলা আসিল না। দুপুরের পর আসিয়া বৈকাল পর্যন্ত বসিয়া নানা গল্প করিল, বই পড়িয়া শুনাইল। বাড়ির ভিতর হইতে থালায় করিয়া আখ ও শাঁখ-আলু কাটিয়া লইয়া আসিল। তাহার পর তাহাদের পদ্যমেলানোর আর অন্ত নাই! নির্মলার পদটি মিলাইয়া দিয়াই অপু তাহাকে আর একটা পদ মিলাইতে বলে–নির্মলাও অল্প কয়েক মিনিটে তাহার জবাব দিয়া অন্য একটা প্রশ্ন করে। …কেহ কাহাকেও ঠকাইতে পারে না।
ডেপুটিবাবুর স্ত্রী একবার বাহিরের ঘরে আসিতে আসিতে শুনিয়া বলিলেন—বেশ হয়েছে, আব ভাবনা নেই—এখন তোমরা দু-ভাইবোনে একটা কবির দল খুলে দেশে দেশে বেড়িয়ে বেড়াও গিয়ে–
অপু লজ্জিত হইয়া চুপ করিয়া রহিল। ডেপুটিবাবুর স্ত্রীর বড়ো সাধ অপু তাহাকে মা বলিয়া ডাকে। সে যে আড়ালে তাহাকে মা বলে, তাহা তিনি জানেন কিন্তু সামনাসামনি অপু কখনও তাহাকে মা বলিয়া ডাকে নাই, এজন্য ডেপুটিবাবুর স্ত্রী খুব দুঃখিত।
অপু যে ইচ্ছা করিয়া করে না তাহা নহে। ডেপুটিবাবুর বাসায় থাকিবার কথা একবার সে বাড়িতে গিয়া মায়ের কাছে গল্প করাতে সর্বজয়া ভারি খুশি হইয়াছিল। ডেপুটিবাবুর বাড়ি! কম কথা নয়!…সেখানে কি করিয়া থাকিতে হইবে, চলিতে হইবে সে বিষয়ে ছেলেকে নানা উপদেশ দিয়া অবশেষে বলিয়াছিল-ডেপুটিবাবুর বউকে মা বলে ডাকবি—আর ডেপুটিবাবুকে বাবা বলে ডাকবি–
অপু লজ্জিত মুখে বলিয়াছিল—হ্যাঁ, আমি ওসব পিরবো না
সর্বজয়া বলিয়াছিল—তাতে দোষ কি?—বলিস, তারা খুশি হবেন—কম একটা বোলোকের আশ্রয় তো নয়!—তাহার কাছে সবাই বড়ো মানুষ।
অপু তখন মায়ের নিকট রাজি হইয়া আসিলেও এখানে তাহা কার্যে পরিণত করিতে পারে নাই। মুখে কেমন বাধে, লজ্জা করে।
একদিন—অপু তখন একমাস হইল সারিয়া উঠিয়াছে—নির্মলা বাহিরের ঘরে চেয়ারে বসিয়া কি বই পড়িতেছিল, ঘোর বর্ষা সারা দিনটা, বেলা বেশি নাই-বৃষ্টি একটু কমিয়াছে। অপু বিনা ছাতায় কোথা হইতে ভিজিতে ভিজিতে আসিয়া দৌড়াইয়া ঘরে ঢুকিতেই নির্মলা বই মুড়িয়া বলিয়া উঠিল—এঃ, আপনি যে দাদা ভিজে একেবারে–
অপুর মনে যে জন্যই হউক খুব স্ফূর্তি ছিল–তাহার দিকে চাহিয়া বলিল—চট করে চা আর খাবার—তিন মিনিটে–
নির্মলা বিস্মিত হইল, সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দিত হইল। এ রকম তো কখনও হুকুমের সুরে অপূর্বদা বলে না। সে হাসিমুখে মুখ টিপিয়া বলিল-পারব না তিন মিনিটে-ঘোড়ায় জিন দিয়ে এলেন কিনা একেবারে!
অপু হাসিয়া বলিল—আর তো বেশিদিন না—আর তিনটি মাস তোমাদের জ্বালাবো, তারপর চলে যাচ্ছি–
নির্মলার মুখ হইতে হাসি মিলাইয়া গেল। বিস্ময়ের সুরে বলিল—কোথায় যাবেন।
-তিন মাস পরেই এগজামিন দিয়েই চলে যাবো, কলকাতায় পড়বো পাস হলে—
নির্মলা এতদিন সম্ভবত এটা ভাবিয়া দেখে নাই, বলিল–আর এখানে থাকবেন না?
অপু ঘাড় নাড়িল। খানিকটা থামিয়া কৌতুকের সুরে বলিল—তুমি তো বাঁচো, যে খাটুনি তোমার তো ভালো—ওকি? বা রে-কি হলো–শোন নির্মলা–
হঠাৎ নির্মলা উঠিয়া গেল কেন—চোখে কি কথায় তাহার এত জল আসিয়া পড়িল, বুঝিতে পারিয়া সে মনে মনে অনুতপ্ত হইল। আপন মনে বলিল—আর ওকে ক্ষ্যাপাবো না—ভারী পাগল—আহা, ওকে সব সময় খোঁচা দিই—সোজা খেটেছে ও, যখন পা ভেঙে পড়েছিলাম পনেরো দিন ধরে, জানতে দেয় নি যে আমি নিজের বাড়িতে নেই–
ইহার মধ্যে আবার একদিন পটু আসিল। ডেপুটিবাবুর বাসাতে অপু উঠিয়া আসিবার পর সে কখনও আসে নাই। খানিকটা ইতস্তত করিয়া বাসায় ঢুকিল। এক-পা ধুলা, রুক্ষ চুল, হাতে পুটুলি। সে কোন সুবিধা খুঁজিতে আসে নাই, এদিকে আসিলে অপুর সঙ্গে দেখা না করিয়া সে যাইতে পারে না। পটুর মুখে অনেক দিন পর সে রানুদির খবর পাইল। পাড়াগাঁয়ের নিঃসহায় নিরুপায় ছেলেদের অভ্যাসমতো সে গ্রামের যত মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি ঘুরিয়া বেড়ানো শুরু করিয়াছে। বাপের বাড়ির লোক, অনেকের হয়তো বা খেলার সঙ্গী, মেয়েরা আগ্রহ করিয়া রাখে, ছাড়িয়া দিতে চাহে না, যে কয়টা দিন থাকে খাওয়া সম্বন্ধে নির্ভাবনা। কোন স্থানে দু-দিন, কোথাও পাঁচদিন–মেয়েরা আবার আসিতে বলে, যাবার সময় খাবার তৈয়ারি করিয়া সঙ্গে দেয়। এ এক ব্যবসা পটু ধরিযাছে মন্দ নয়—ইহার মধ্যে সে তাহাদের পাড়ার সব মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দু-চার বার ঘুরিয়া আসিয়াছে।
এইভাবেই একদিন রানুদির শববাড়ি সে গিয়াছে–সে গল্প কবিল। রানুদিব শ্বশুরবাড়ি রানাঘাটের কাছে—তাহারা পশ্চিমে কোথায় চাকুরি উপলক্ষে থাকেন-পূজার সময় বাড়ি আসিয়াছিলেন, সপ্তমী পূজার দিন অনাহতভাবে পটু গিযা হাজির। সেখানে আট দিন ছিল। রানুদিব যত্ন কি! তাহার দুরবস্থা শুনিয়া গোপনে তিনটা টাকা দিয়াছিল, আসিবার সময় নতুন ধুতি চাদর, এক পুটুলি বাসি লুচি সন্দেশ।
অপু বলিল—আমার কথা কিছু বললে না?
–শুধুই তোর কথা। যে কয়দিন ছিলাম, সকালে সন্ধ্যাতে তোর কথা। তারা আবার একাদশীর দিনই পশ্চিমে চলে যাবে, আমাকে রানুদি বললে, ভাড়ার টাকা দিচ্ছি, তাকে একবার নিয়ে আয় এখানে—ছবচ্ছব দেখা হয় নিতা আমার আবার জ্বর হল—দিদির বাড়ি এসে দশ-বারোদিন পড়ে রইলাম-তোর ওখানে আর যাওয়া হল না—ওরাও চলে গেল পশ্চিমে
—ভাড়ার টাকা দেয় নি?
পটু লজ্জিত মুখে বলিল—হ্যাঁ, তোর আর আমার যাতায়াতের ভাড়া হিসেব করেসেও খরচ হয়ে গেল, দিদি কোথায় আর পাবে, আমার সেই ভাড়ার টাকা থেকে নেবু ডালিম ওষুধ-সব হল। রানুদির মতন অমন মেয়ে আর দেখি নি অপুদা, তোর কথা বলতে তার চোখে জল পড়ে।
হঠাৎ অপুর গলা যেন কেমন আড়ষ্ট হইয়া উঠিল–সে তাড়াতাড়ি কি দেখিবার ভান করিয়া জানালার বাহিরের দিকে চাহিল।
–শুধু রানুদি না, যত মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গেলাম, রানীদি, আশালতা, ওপাড়ার সুনয়নীদিসবাই তোর কথা আগে জিজ্ঞেস করে—
ঘণ্টা দুই থাকিয়া পটু চলিয়া গেল।
দেওয়ানপুর স্কুলেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা গৃহীত হয়। খরচ-পত্র করিয়া কোথাও যাইতে হইল। পরীক্ষার পর হেডমাস্টার মিঃ দত্ত অপুকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। বলিলেন-বাড়ি যাবে কবে?
এই কয় বৎসরে হেডমাস্টারের সঙ্গে তাহার কেমন একটা নিবিড় সৌহার্দ্যের সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিয়াছে, দু-জনের কেহই এতদিনে জানিতে পারে নাই সে বন্ধন কতটা দৃঢ়।
অপু বলিল—সামনের বুধবার যাব ভাবছি।
–পাশ হলে কি করবে ভাবছো? কলেজে পড়বে তো?
–কলেজে পড়বার খুব ইচ্ছে, স্যর।
–যদি স্কলারশিপ না পাও?
অপু মৃদু হাসিয়া চুপ করিয়া থাকে।
–ভগবানের ওপর নির্ভর করে চলো, সব ঠিক হয়ে যাবে। দাঁড়াও, বাইবেলের একটা জায়গা পড়ে শোনাই তোমাকে
মিঃ দত্ত খ্রিস্টান। ক্লাসে কতদিন বাইবেল খুলিয়া চমৎকার চমৎকার উক্তি তাহাদের পড়িয়া শুনাইয়াছেন, অপুর তরুণ মনে বুদ্ধদেবের পীতবাসধারী সৌম্যমূর্তির পাশে, তাহাদের গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিশালাক্ষীর পাশে, বোষ্টমদাদু নবরাত্তম দাসের ঠাকুর শ্রীচৈতন্যের পাশে, দীর্ঘদেহ শান্তনয়ন যীশুর মূর্তি কোন্ কালে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল—তাহার মন যীশুকে বর্জন করে নাই, কাটার মুকুটপরা, লাঞ্ছিত, অপমানিত এক দেবোন্মাদ যুবককে মনেপ্রাণে বরণ করিতে শিখিয়াছিল।
মিঃ দত্ত বলিলেন—কলকাতাতেই পড়ো—অনেক জিনিস দেখবার শেখবার আছে—কোন কোন পাড়াগাঁয়ের কলেজে খবচ কম পড়ে বটে কিন্তু সেখানে মন বড়ো হয় না, চোখ ফোটে না, আমি কলকাতাকেই ভালো বলি।
অপু অনেকদিন হইতেই ঠিক করিয়া রাখিয়াছে, কলেজে পড়িবে এবং কলিকাতার কলেজেই পড়িবে।
মিঃ দত্ত বলিলেন—স্কুল লাইব্রেরির লে মিজারেবল-খানা তুমি খুব ভালোবাসতে-ওখানা তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি, আমি আর একখানা কিনে নেবো।
অপু বেশি কথা বলিতে জানে না—এখনও পারিল না— মুখচোরার মতো খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া হেডমাস্টারের পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিয়া বাহির হইয়া আসিল।
হেডমাস্টারের মনে হইল—তাহার দীর্ঘ ত্রিশ বৎসরের শিক্ষকজীবনে এ রকম আর কোন ছেলের সংস্পর্শে তিনি কখনও আসেন নাই।—ভাবময়, স্বপ্নদর্শী বালক, জগতে সহায়হীন, সম্পদহীন! হয়তো একটু নির্বোধ, একটু অপরিণামদশী-কিন্তু উদার, সরল, নিষ্পাপ, জ্ঞান-পিপাসু ও জিজ্ঞাসু। মনে মনে তিনি বালকটিকে বড়ো ভালোবাসিয়াছিলেন।
তাঁহার জীবনে এই একটি আসিয়াছিল, চলিয়া গেল। ক্লাসে পড়াইবার সময় ইহার কৌতূহলী ডাগর চোখ ও আগ্রহোজ্জল মুখের দিকে চাহিয়া ইংরেজির ঘণ্টায় কত নতুন কথা, কত গল্প, ইতিহাসের কাহিনী বলিয়া যাইতেন–ইহার নীরব, জিজ্ঞাসু চোখ দুটি তাহার নিকট হইতে যেরুপ জোর করিয়া পাঠ আদায় করিয়া লইয়াছে, সেরুপ আর কেহ পারে নাই, সে প্রেরণা সহজলভ্য নয়, তিনি তাহা জানেন।
গত চার বৎসরের স্মৃতি-জড়ানো দেওয়ানপুর হইতে বিদায় লইবার সময়ে অপুর মন ভালো ছিল না। দেবব্রত বলিল-তুমি চলে গেলে অপূর্বদা, এবার পড়া ছেড়ে দেবো।
নির্মলার সঙ্গে বাহিরের ঘরে দেখা। ফাখুন মাসের অপূর্ব অদ্ভুত দিনগুলি। বাতাসে কিসের যেন মৃদু মিগ্ধ, অনির্দেশ্য সুগন্ধ। আমের বউলের সুবাস সকালের রৌদ্রকে যেন মাতাল করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু অপুর আনন্দ সে-সব হইতে আসে নাই—গত কয়েকদিন ধরিয়া সে রাইডার হ্যাগার্ডের ক্লিওপেট্রা পড়িতেছিল। তাহার তরুণ কল্পনাকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়াছে বইখানা। কোথায় এই হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন সমাধি-জ্যোৎস্নাভরা নীলনদ, বিস্মৃত রা দেবের মন্দির!-ঔপন্যাসিক হ্যাগার্ডের স্থান সমালোচকের মতে যেখানেই নির্দিষ্ট হউক তাহাতে আসে যায় না—তাহার নবীন, অবিকৃত মন একদিন যে গভীর আনন্দ পাইয়াছিল বইখানা হইতে—এইটাই বড়ো কথা তাহার কাছে।
নির্মলার সহিত দেখা অপুর মনের সেই অবস্থায়,—অপ্রকৃতিস্থ, মত্ত, রঙিন—সে তখন শুধু একটা সুপ্রাচীন রহস্যময়, অধুনালুপ্ত জাতির দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে! ক্লিওপেট্রা? হউন তিনি সুন্দরী—তাহাকে সে গ্রাহ্য কবে না! পিরামিডের অন্ধকার গর্ভগৃহে বহু হাজার বৎসরের সুপ্তি ভাঙিয়া সম্রাট মেঙ্কাউরা গ্রানাইট পাথরের সমাধি-সিন্দুকে যখন রোষে পার্শ্বপরিবর্তন করেন-মনুষ্য সৃষ্টির পূর্বেকার জনহীন আদিম পৃথিবীর নীরবতার মধ্যে শুধু সিহোর নদী লিবিয়া মরুভূমির বুকের উপর দিয়া বহিয়া যায়—অপূর্ব রহস্যে ভরা মিশর! অদ্ভুত নিয়তির অকাট্য লিপি! তাহার মন সারা দুপুর আর কিছু ভাবিতে চায় না।
গরম বাতাসে দমকা ধুলাবালি উড়াইয়া আনিতেছিল বলিয়া অপু দরজা ভেজাইয়া বসিয়া ছিল, নির্মলা দরজা ঠেলিয়া ঘরে আসিল। অপু বলিল—এসো এসো, আজ সকালে তো তোমাদেব স্কুলে প্রাইজ হল-কে প্রাইজ দিলেন—মুন্সেফবাবুর স্ত্রী, না? ওই মোটামতো যিনি গাড়ি থেকে নামলেন, উনিই তো?
—আপনি বুঝি ওদিকে ছিলেন তখন? মাগো, কি মোটা?—আমি তো কখনও—পাবে হঠাৎ যেন মনে পড়িল এইভাবে বলিল, তারপর আপনি তো যাবেন আজ, না দাদা?
-হ্যাঁ, দুটোর গাড়িতে যাব—রামধারিয়াকে একটু ডেকে নিয়ে এসো তো—জিনিসপত্তরগুলো একটু বেঁধে দেবে।
–রামধারিয়া কি আপনার চিরকাল করে দিয়ে এসেছে নাকি? কই, কি জিনিস আগে বলুন।
দুইজনে মিলিয়া বইয়ের ধুলা ঝাড়িয়া গোছানো, বিছানা বাঁধা চলিল। নির্মলা অপুর ঘোট টিনের তোরঙ্গটা খুলিয়া বলিল—মাগো! কি করে রেখেছেন বাক্সটা! কাপড়ে, কাগজে, বইয়ে হাভুল পাল—আচ্ছা এত বাজে কাগজ কি হবে দাদা? ফেলে দেবো?…
অপু বলিয়া উঠিল—হাঁ হাঁ-না না-ওসব ফেলে না।
সে আজ দুই-তিন বছরের চিঠি, নানা সময়ে নানা কথা লেখা কাগজের টুকরা সব জমাইয়া রাখিয়াছে। অনেক স্মৃতি জড়ানো সেগুলির সঙ্গে, পুরাতন সময়কে আবার ফিরাইয়া আনে-সেগুলি প্রাণ ধরিয়া অপু ফেলিয়া দিতে পারে না। কবে কোন্ কালে তাহার দিদি দুর্গা নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে আদর করিয়া তাহাকে কোন্ বন হইতে একটা পাখির বাসা আনিয়া দিয়াছিল, কতকালের কথা, বাসাটা সে আজও বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে—বাবার হাতের লেখা একখানা কাগজ—আর কত কি।
নির্মলা বলিল—এ কি! আপনার মোটে দুখানা কাপড়, আর জামা নেই?
অপু হাসিয়া বলিল-পয়সাই নেই হাতে ৩ জামা! নইলে ইচ্ছা তো আছে সুকুমায়ের মতো একটা জামা করাববা—ওতে আমাকে যা মানায়—ওই রংটাতে
নির্মলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল—থাক থাক, আর বাহাদুরি করতে হবে না। এই রইল চাবি, এখুনি হারিয়ে ফেলবেন না যেন আবার। আমি মিশির ঠাকুরকে বলে দিয়েছি, এখুনি লুচি ভেজে আনবে-দাঁড়ান, দেখি গিয়ে আপনার গাড়ির কত দেরি?
এখনও ঘণ্টা দুই। মার সঙ্গে দেখা করে যাবো, আবার হয়তো কতদিন পরে আসব তার ঠিক কি?
—আসবেনই না। আপনাকে আমি বুঝি নি ভাবছেন? এখান থেকে চলে গেলে আপনি আবার এ-মুখো হবেন?—কখনো না।
অপু কি প্রতিবাদ করিতে গেল, নির্মলা বাধা দিয়া বলিল—সে আমি জানি! এই দু-বছর আপনাকে দেখে আসছি দাদা, আমার বুঝতে বাকি নেই, আপনার শরীরে মায়া দয়া কম।
–কম?-বা রে—এ তো তুমি-আমি বুঝি—
–দাঁড়ান, দেখি গিয়ে মিশির ঠাকুর কি করছে—তাড়া না দিলে সে কি আর—
নির্মলার মা যাইবার সময় চোখের জল ফেলিলেন। কিন্তু নির্মলা বাড়ির মধ্যে কি কাজে ব্যস্ত ছিল, মায়ের বহু ডাকাডাকিতেও সে কাজ ফেলিয়া বাহিরে আসিতে পারিল না। অপু স্টেশনের পথে যাইতে যাইতে ভাবিল—নির্মলা আচ্ছা তো! একবার বার হল না—যাবার সময়টা দেখা হত আচ্ছা খামখেয়ালি!
যখন তখন রেলগাড়িতে চড়াটা ঘটে না বলিয়াই রেলে চড়িলেই তাহার একটা অপূর্ব আনন্দ হয়। ছোট্ট তোরঙ্গ ও বিছানাটার মোট লইয়া জানালার ধারে বসিয়া চাহিয়া দেখিতে দেখিতে কত কথা মনে আসিতেছিল। এখন সে কত বড়ো হইয়াছে—একা একা ট্রেনে চড়িয়া বেড়াইতেছে। তারপর এমনি একদিন হয়তো নীল নদের তীরে ক্লিওপেট্রার দেশে—এক জ্যোৎস্না রাতে শত শত প্রাচীন সমাধির বুকের উপর দিয়া অজানা সে যাত্রা।
স্টেশনে নামিয়া বাড়ি যাইবার পথে একটা গাছতলা দিয়া যাইতে যাইতে মাঝে মাঝে কেমন একটা সুগন্ধ-মাটির, ঝরা পাতার, কোন্ ফুলের। ফানের তপ্ত রৌদ্র গাছে গাছে পাতা ঝরাইয়া দিতেছে, মাঠের ধারে অনেক গাছে নতুন পাতা গজাইয়াছে—পলাশের ডালে রাঙা রাঙা নতুন ফোটা ফুল যেন আবতির পঞ্চপ্রদীপের ঊর্ধ্বমুখী শিখার মতো জ্বলিতেছে। অপুর মন যেন আনন্দে শিহরিয়া ওঠে—যদিও সে ট্রেনে আজ সারা পথ শুধু নির্মলা আর দেবব্রতের কথা ভাবিয়াছে…কখনও শুধুই নির্মলা, কখনও শুধুই দেবব্রত—তাহার স্কুলজীবনে এই দুইটি বন্ধু যতটা তাহার প্রাণের কাছাকাছি আসিয়াছিল, অতটা নিকটে অমনভাবে আর কেহ আসিতে পারে নাই, তবুও তাহার মনে হয় আজকার আনন্দের সঙ্গে নির্মলার সম্পর্ক নাই, দেবব্রতের নাই—আছে তার নিশ্চিন্দিপুরের বাল্যজীবনের সিন্ধস্পর্শ, আর বহুদুর-বিসর্পিত, রহস্যময় কোন্ অন্তরের ইঙ্গিত–সে মানে বালক হইলেও এ-কথা বোঝে।
প্রথম যৌবনের শুরু, বয়ঃসন্ধিকালে রূপ ফাটিয়া পড়িতেছে,—এই ছায়া, বকুলের গন্ধ, বনান্তরে অবসন্ন ফায়ূনদিনে পাখির ডাক, ময়ূরকণ্ঠী রং-এর আকাশটা-রক্তে যেন এদের নেশা লাগে—গর্ব, উৎসাহ, নবীন জীবনের আনন্দভরা প্রথম পদক্ষেপে। নির্মলা তুচ্ছ! আর এক দিক হইতে ডাক আসে—অপু আশায় আশায় থাকে।
নিরাবরণ মুক্ত প্রকৃতির এ আহ্বান, রোমান্সের আহ্বান—তার রক্তে মেশানো, এ আসিয়াছে তাহার বাবার নিকট হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে-বন্ধন-মুক্ত হইয়া ছুটিয়া বাহির হওয়া, মন কি চায় নাবুঝিয়াই তাহার পিছু পিছু দৌড়ানো, এ তাহার নিরীহ শান্ত প্রকৃতি ব্রাহ্মণপণ্ডিত পিতামহ রামহরি তর্কালঙ্কারের দান নয়–যদিও সে তার নিস্পৃহ জ্ঞানপিপাসা ও অধ্যয়ন-প্রিয়তাকে লাভ করিয়াছে বটে। কে জানে পূর্বপুরুষ ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের উচ্ছৃঙ্খল রক্ত কিছু আছে কি-না–
তাই তাহার মনে হয় কি যেন একটা ঘটিবে, তাহারই প্রতীক্ষায় থাকে।
অপূর্ব গন্ধে-ভরা বাতাসে, নবীন বসন্তের শ্যামলীতে, অস্তসূর্যের রক্তআভায় সে রোমান্সের বার্তা যেন লেখা থাকে।
০৫. বাড়িতে অপু মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করিল
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বাড়িতে অপু মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করিল। কলিকাতায় যদি পড়িতে যায় স্কলারশিপ না পাইলে কি কোন সুবিধা হইবে? সর্বজয়া কখনও জীবনে কলিকাতা দেখে নাই—সে কিছু জানে না। পড়া তো অনেক হইয়াছে, আর পড়ার দরকার কি?-অপুর মনে কলেজে পড়িবার ইচ্ছা খুব প্রবল। কলেজে পড়িলে মানুষ বিদ্যার জাহাজ হয়। সবাই বলিবে কলেজের ছেলে।
মাকে বলিল—না যদি স্কলারশিপ পাই, তাই বা কি? একরকম করে হয়ে যাবে—রমাপতিদা বলে, কত গরিবের ছেলে কলকাতায় পড়চে, গিয়ে একটু চেষ্টা করলেই নাকি সুবিধা হয়ে যাবে, ও আমি করে নেবো মা–
কলিকাতায় যাইবার পূর্বদিন রাত্রে আগ্রহে উত্তেজনায় তাহার ঘুম হইল না। মাথার মধ্যে যেন কেমন করে, বুকের মধ্যেও। গলায় যেন কি আটকাইয়া গিয়াছে। সত্য সত্য সে কাল এমন সময় কলিকাতায় বসিয়া আছে?…কলিকাতায়!.কলিকাতা সম্বন্ধে কত গল্প, কত কি সে শুনিয়াছে। অতবড় শহর আর নাই। কত কি অদ্ভুত জিনিস দেখিবার আছে, বড়ো বড়ো লাইব্রেরি আছে, সে শুনিয়াছে বই চাহিলেই সেখানে বসিয়া পড়িতে দেয়।
বিছানায় শুইয়া সারারাত্রি ছটফট করিতে লাগিল। বাড়ির পিছনের তেঁতুল গাছের ডালপালা অন্ধকারকে আরও ঘন করিয়াছে, ভোর আর কিছুতেই হয় না। হয়তো তাহার কলিকাতা যাওযা ঘটিবে না, কলেজে পড়া ঘটিবে না, কত লোক হঠাৎ মারা গিয়াছে, এমন হয়তো সেও মরিয়া যাইতে পারে। কলিকাতা না দেখিয়া, কলেজে অন্তত কিছুদিন পড়ার আগে যেন সে না মরে!–দোহাই ভগবান!
কলিকাতায় সে কাহাকেও চেনে না, কোথায় গিয়া উঠিবে ঠিক জানা নাই, পথঘাটও জানা নাই। মাসকতক আগে দেবব্রত তাহাকে নিজের এক মেলোমশাইয়ের কলিকাতার ঠিকানা দিয়া বলিয়াছিল, দরকার হইলে এই ঠিকানায় গিয়া তাহার নাম করিলেই তিনি আদর করিয়া থাকিবার স্থান দিবেন। ট্রেনে উঠিবার সময় অপু সেকাগজখানা বাহির করিয়া পকেটে রাখিল। রেলের পুরানো টাইমটেবলের পিছন হইতে ছিড়িয়া লওয়া একখানা কলিকাতা শহরের নকশা তাহার টিনের তোরটার মধ্যে অনেকদিন আগে ছিল, সেখানাও বাহির করিয়া বসিল।
ইহার পূর্বেও অপু শহর দেখিয়াছে, তবুও ট্রেন হইতে নামিয়া শিয়ালদহ স্টেশনের সম্মুখের বড়ো রাস্তায় একবার আসিয়া দাঁড়াইতেই সে অবাক হইয়া গেল। এরকম কাণ্ড সে কোথায় দেখিয়াছে? ট্রামগাড়ি ইহার নাম? আর এক রকমের গাড়ি নিঃশব্দে দৌড়াইয়া চলিয়াছে, অপু কখনও
দেখিলেও মনে মনে আন্দাজ করিল, ইহারই নাম মোেটর গাড়ি। সে বিস্ময়ের সহিত দু-একখানার দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল; স্টেশনের অফিস ঘরে সে মাথার উপর একটা কি চাকার মতো জিনিস বন্ বন্ বেগে ঘুরিতে দেখিয়াছে, সে আন্দাজ করিল উহাই ইলেকট্রিক পাখা।
যে-ঠিকানা বন্ধু দিয়াছিল, তাহা খুঁজিয়া বাহির করা তাহার পক্ষে এক মহা মুশকিলের ব্যাপার, পকেটে রেলের টাইমটেবলের মোড়ক হইতে সংগ্রহ করা কলিকাতার যে নকশা ছিল তাহা মিলাইয়া হ্যারিসন রোড খুঁজিয়া বাহির করিল। জিনিসপত্র তাহার এমন বেশি কিছু নহে, বগলেছোট বিহানাটি ও ডান হাতে ভারী পুটুলিটা ঝুলাইয়া পথ চলিতে চলিতে সামনে পাওয়া গেল আমহার্স্ট স্ট্রীট। তাহার পর আরও খানিক ঘুরিয়া সে পঞ্চানন দাসের গলি বাহির করিল।
অখিলবাবু সন্ধ্যার আগে আসিলেন, কালো নাদুস নুদুস চেহারা; অপুর পরিচয় ও উদ্দেশ্য শুনিয়া খুশি হইলেন ও খুব উৎসাহ দিলেন। ঝিকে ডাকাইয়া তখনই খাবার আনাইয়া অপুকে খাইতে দিলেন, সারাদিন খাওয়া হয় নাই জানিতে পারিয়া তিনি এত ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন যে, নিজে সন্ধ্যাহিক করিবার জন্য আসনখানি মেসের ছাদে পাতিয়াও আহ্নিক করিতে ভুলিয়া গেলেন।
সন্ধ্যার সময় সে মেসের ছাদে শুইয়া পড়িল। সারাদিন বেড়াইয়া সে বড়ো ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে।
সে তো কলিকাতায় আসিয়াছে মিউজিয়াম, গড়ের মাঠ দেখিতে পাইবে তো?…বায়োস্কোপ দেখিবে…এখানে খুব বড়ড়া বায়োস্কোপ আছে সে জানে। তাহাদের দেওয়ানপুরের স্কুলে একবার একটা ভ্রমণকারী বায়োস্কোপের দল গিয়াছিল, তাহাতেই সে জানে বায়োস্কোপ কি অদ্ভুত দেখিতে। তবে এখানে নাকি বায়োস্কোপে গল্পের বই দেখায়। সেখানে তাহা ছিল না—রেলগাড়ি দৌড়াইতেছে, একটা লোক হাত পা নাড়িয়া মুখভঙ্গি করিয়া লোক হাসাইতেছে-এই সব। এখানে বায়োস্কোপে গল্পের বই দেখিতে চায়। অখিলবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল, বায়োস্কোপ যেখানে হয়, এখান থেকে কত দূর?
অখিলবাবুর মেসে খাইয়া অপু ইহার-উহার পরামর্শমতো নানাস্থানে হাঁটাহাঁটি করিতে লাগিল, কোথাও বা থাকিবার স্থানের জন্য, কোথাও বা ছেলে পড়াইবার সুবিধার জন্য, কাহারও কাছে বা কলেজে বিনা বেতনে ভর্তি হইবার যোগাযোগের জন্য। এদিকে কলেজে ভর্তি হইবার সময়ও চলিয়া যায়, সঙ্গে যে কয়টা টাকা ছিল তাহা পকেটে লইয়া একদিন সে ভর্তি হইতে বাহির হইল। প্রেসিডেন্সি কলেজের দিকে সে ইচ্ছা করিয়াই ঘেঁষিল না, সেখানে সবদিকেই খরচ অত্যন্ত বেশি। মেট্রোপলিটান কলেজ গলির ভিতর, বিশেষত পুরানো ধরনের বলিয়া সেখানেও ভর্তি হইতে ইচ্ছা হইল না। মিশনারিদের কলেজ হইতে একদল ছেলে বাহির হইয়া সিটি কলেজে ভর্তি হইতে চলিয়াছিল, তাহাদের দলে মিশিয়া গিয়া কেরানীর নিকট হইতে কাগজ চাহিয়া লইয়া নাম লিখিয়া ফেলিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়িটার গড়ন ও আকৃতি তাহার কাছে এত খারাপ ঠেকিল যে, কাগজখানি ছিড়িয়া ফেলিয়া সে বাহিরে আসিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। অবশেষে রিপন কলেজের বাড়ি তাহার কাছে বেশ ভালো ও উঁচু মনে হইল। ভর্তি হইয়া সে আর একটি ছাত্রের সঙ্গে ক্লাসবুমগুলি দেখিতে গেল। ক্লাসে ইলেকট্রিক পাখা। কি করিয়া খুলিতে হয়? তাহার সঙ্গী দেখাইয়া দিল। সে খুশির সহিত তাহার নিচে খানিকক্ষণ বসিয়া রহিল, এত হাতের কাছে ইলেকট্রিক পাখা পাইয়া বার বার পাখা খুলিয়া বন্ধ করিয়া দেখিতে লাগিল।
অখিলবাবুদের মেসে থাকা ও পড়াশুনা দুইয়ের ঘোর অসুবিধা। এক এক ঘরের মেজেতে তিনটি ট্রাঙ্ক, কতকগুলি জুতার বাক্স, কালি বুরুশ, তিনটি হুঁকা। ঘরে আর কোন আসবাবপত্র নাই, রাত্রে আলো সবদিন জ্বলে না। ঘর দেখিয়া মনে হয় ইহার অধিবাসিগণের জীবনে মাত্র দুইটি উদ্দেশ্য আছে—অফিসে চাকরি করা ও মেসে আসিয়া খাওয়া ও ঘুমানো। এক এক ঘরে যে তিনটি বাবু থাকেন তাহারা ছটার সময় অফিস হইতে আসিয়া হাত-মুখ ধুইয়া যে যাঁর বিছানায় শুইয়া পড়িয়া চুপ করিয়া তামাক টানিতে থাকেন, একটু আধটু গল্পগুজব যা হয়, প্রায়ই অফিস-সংক্রান্ত; তারপরেই আহারাদি সারিয়া নিদ্রা। অখিলবাবু কোথায় ছেলে পড়ান, অফিসের পর সেখান হইতে ফিরিতে দেরি হইয়া যায়। তিনিও সারাদিন খাটুনির পর মেসে আসিয়া শুইয়া পড়েন।
অপু এ রকম ঘরে এতগুলি লোকের সহিত এক বিছানায় কখনও শুইতে অভ্যস্ত নয়, রাত্রে তাহার যেন হাঁপ ধরে, ভালো ঘুম হয় না। কিন্তু অন্য কোথাও কোনরকম সুবিধা না হইলে সে যাইবে কোথায়? তাহা ছাড়া অপুর আর এক ভাবনা মায়ের জন্য। স্কলারশিপ পাইলে সেই টাকা হইতে মাকে কিছু কিছু পাঠাইবার আশ্বাস সে আসিবার সময় দিয়া আসিয়াছে কিন্তু কোথায় বা স্কলারশিপ, কোথায় বা কি। মার কিরুপে চলিতেছে, দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাবনাই তাহার আরও প্রবল হইল।
মাসের শেষে অখিলবাবু অপুর জন্য একটা ছেলে পড়ানো ঠিক করিয়া দিলেন, দুইবেলা একটা ছোট ছেলে ও একটি মেয়েকে পড়াইতে হইবে, মাসে পনেরো টাকা।
অখিলবাবুর মেসে পরের বিছানায় শুইয়া থাকা তাহার পছন্দ হয় না। কিন্তু কলেজ হইতে ফিরিয়া পথে কয়েকটি মেসে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, পনেরো টাকা মাত্র আয়ে কোনো মেসে থাকা চলে না। তাহার ক্লাসের কয়েকটি ছেলে মিলিয়া একখানা ঘর ভাড়া করিয়া থাকিত, নিজেরাই রাঁধিয়া খাইত, অপুকে তাহারা লইতে রাজি হইল।
যে তিনটি ছেলে একসঙ্গে ঘর ভাড়া করিয়া থাকে, তাহাদের সকলেরই বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়। ইহাদের মধ্যে সুরেশ্বরের আয় কিছু বেশি, এম.এ. ক্লাসের ছাত্র, চল্লিশ টাকার টিউশনি আছে। জানকী যেন কোথায় ছেলে পড়াইয়া কুড়ি টাকা পায়। নির্মলের আয় আরও কম। সকলের আয় একত্র করিয়া যে মাসে যাহা অকুলান হয়, সুরেশ্বর নিজেই তাহা দিয়া দেয়, কাহাকেও বলে না। অপু প্রথমে তাহা জানিত না, মাস দুই থাকিবার পর তাহার সন্দেহ হইল প্রতি মাসে সুরেশ্বর পঁচিশত্রিশ টাকা দোকানের দেনা শোধ করে, অথচ কাহারও নিকট চায় না কেন? সুরেশ্বরের কাছে একদিন কথাটা তুলিলে সে হাসিয়া উড়াইয়া দিল। সে বেশি এমন কিছু দেয় না, যদিই বা দেয়—তাতেই বা কি? তাহাদের যখন আয় বাড়িবে তখন তাহারাও অনায়াসে দিতে পারিবে, কেহ বাধা দিবে না তখন।
নির্মল রবিঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করিতে করিতে ঘরে ঢুকিল। তাহার গায়ে খুব শক্তি, সুগঠিত মাংসপেশী, চওড়া বুক। অপুর মতই বয়স। হাতের ভিতর একটা কাগজের ঠোঙা দেখাইয়া বলিল-নুতন মটরশুঁটি, লঙ্কা দিয়ে ভেজে–
অপু হাত হইতে ঠোঙাটা কাড়িয়া লইয়া বলিল-দেখি? পরে হাসিমুখে বলিল–সুরেশ্বরদা, স্টোভ ধরিয়ে নিন–আমি মুড়ি আনিকপয়সার আনব? এক-দুই-তিন-চার–
—আমার দিকে আঙুল দিয়ে গুনো না ওরকম—
অপু হাসিয়া নির্মলের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল—তোমার দিকেই আঙুল বেশি করে দেখাব তিন-তিন-তিন–
নির্মল তাহাকে ধরিতে যাইবার পূর্বে সে হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। সুরেশ্বর বলিল—একরাশ বই এনেছে কলেজের লাইব্রেরি থেকে—এতও পড়তে পারে—মায় মসেনের রোমের হিস্ট্রি এক ভল্যুম–
অপুর গলা মিষ্টি বলিয়া সন্ধ্যার পর সবাই গান গাওয়ার জন্য ধরে। কিন্তু পুরাতন লাজুকপনা তাহার এখনও যায় নাই, অনেক সাধ্যসাধনার পর একটি বা দুটি গান গাহিয়া থাকে, আর কিছুতেই গাওয়ানো যায় না। কিন্তু রবিঠাকুরের কবিতার সে বড়ো ভক্ত, নির্মলের চেয়েও। যখন কেহ ঘরে থাকে না, নির্জনে হাত-পা নাড়িয়া আবৃত্তি করে–
সন্ন্যাসী উপগুপ্ত
মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে
একদা ছিলেন সুপ্ত।
ইতিহাসের অধ্যাপক মিঃ বসুকে অপুর সবচেয়ে ভালো লাগে। সবদিন তাহার ক্লাস থাকে না–কলেজের পড়ায় কোন উৎসাহ থাকে না সেদিন। কালো রিবন-ঝোলানো পাশ-নে চশমা পরিয়া উজ্জ্বলচক্ষু মিঃ বসু ক্লাসরুমে ঢুকিলেই সে নড়িয়া চড়িয়া সংযত হইয়া বসে, বক্তৃতার প্রত্যেৰু কথা মন দিয়া শোনে। এম.এ.-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। অপুর ধারণায় মহাপণ্ডিত। গিবন বা মসেন বা লর্ড ব্রাইস জাতীয়। মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস—ঈজিপ্ট, ব্যাবিলন, আসিরিয়া, ভারতবর্ষীয় সভ্যতার উত্থানপতনের কাহিনী তাহার মনশ্চক্ষুর সম্মুখে ছবির মতো পড়িয়া আছে।
ইতিহাসের পরে লজিকের ঘণ্টা। হাজিরা ডাকিত্সা অধ্যাপক পড়ানো শুরু করিবার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলে কমিতে শুরু করিল। অপু এ ঘণ্টায় পিছনের বেঞ্চিতে বসিয়া লাইব্রেরি হইতে লওয়া ইতিহাস, উপন্যাস বা কবিতার বই পড়ে, অধ্যাপকের কথার দিকে এতটুকু মন দেয় না, শুনিতে ভালো লাগে না। সেদিন একমনে অন্য বই পড়িতেছে, হঠাৎ অধ্যাপক তাহাকে লক্ষ করিয়া কি প্রশ্ন করিলেন। প্রশ্নটা সে শুনিতে পায় নাই, কিন্তু ক্লাস হঠাৎ নীরব হইয়া যাওয়াতে তাহার চমক ভাঙ্গিল, চাহিয়া দেখিল সকলেরই চোখ তাহার দিকে। সে উঠিয়া দাঁড়াইল। অধ্যাপক বলিলেনতোমার হাতে ওখানা লজিকের বই?
অপু বলিল—না স্যর, প্যালগ্রেডের গোডেন ট্রেজারি–
-তোমাকে যদি আমার ঘণ্টায় পার্সেন্টেজ না দিই? পড়া শোনো না কেন?
অপু চুপ করিয়া রহিল। অধ্যাপক তাহাকে বসিতে বলিয়া পুনরায় অধ্যাপনা আরম্ভ করিলেন। জানকী চিমটি কাটিয়া বলিল—হল তো? রোজ রোজ বলি লজিকের ঘণ্টায় আমাদের সঙ্গে পালাতে–তা শোনা হয় না–আয় চলে
দেড়শত ছেলের ক্লাস। পিছনের বেঞ্চের সামনের দরজাটি ছেলেরা ইচ্ছা করিয়া খুলিয়া রাখে পালাইবার সুবিধার জন্য। জানকী এদিক ওদিক চাহিয়া সুড়ুৎ করিয়া সরিয়া পড়িল। তাহার পরে বিরাজ। অপুও মহাজনদের পথ ধরিল। নিচে আসিলে লাইব্রেরিয়ান বলিল—কি রায় মশায়, আমাদের পার্বণীটা কি পাব না?
অপু খুব খুশি হয়। কে তাহাকে চিনিত পাঁচ মাস আগে! এতবড় কলিকাতা শহর, এতবড় কলেজ, এত ছেলে। এখানেও তাহাকে রায় মশায় বলিয়া খাতির করিতেছে, তাহার কাছে পার্বণী চাহিতেছে। হাসিয়া বলে-কাল এনে দোব সত্যবাবু, আজ ভুলে গেছি—আপনি এক ভল্যম গিবন দেবেন কিন্তু আজ
উৎসাহে পড়িয়া গিবন বাড়ি লইয়া যায় বটে কিন্তু ভালো লাগে না। এত খুঁটিনাটি বিরক্তিকর মনে হয়। পরদিন সেখানা ফেরত দিয়া অন্য ইতিহাস লইয়া গেল।
পূজার কিছু পূর্বে অপুদের বাসা উঠিয়া গেল। খরচে আয়ে অনেকদিন হইতেই কুলাইতেছিল না, সুরেশ্বরের ভালো টিউশনটি হঠাৎ হাতছাড়া হইল—কে বাড়তি খরচ চালায়? নির্মল ও জানকী অন্য কোথায় চলিয়া গেল, সুরেশ্বর গিয়া মেসে উঠিল। অপুর যে মাসিক আয়, কলেজের মাহিনা দিয়া তাহা হইতে বারো টাকা বাঁচে-কলিকাতা শহরে বারো টাকায় যে কিছুতেই চলিতে পারে না, অপুর সে জ্ঞান এতদিনেও হয় নাই। সুতরাং সে ভাবিল বারো টাকাতেই চলিবে, খুব চলিবে। বারো টাকা কি কম টাকা!
কিন্তু বারো টাকা আরও বেশি দিন রহিল না, একদিন পড়াইতে গিয়া শুনিল, ছেলের শরীর খারাপ বলিয়া ডাক্তার হাওয়া বদলাইতে বলিয়াছে, পড়াশুনা এখন বন্ধ থাকিবে। এক মাসের মাহিনা তাহারা বাড়তি দিয়া জবাব দিল।
টাকা কয়টি পকেটে করিয়া সেখান হইতে বাহির হইয়া অপু আকাশ-পাতাল ভাবিতে ভাবিতে ফুটপাথ বাহিয়া চলিল। সুরেশ্বরের মেসে সে জিনিসপত্র রাখিয়া দিয়াছে, সেইখানেই গেস্ট-চার্জ দিয়া খায়, রাত্রে মেসের বারান্দাতে শুইয়া থাকে। টাকা যাহা আছে, মেসের দেনা মিটাইতে যাইবে। সামান্য কিছু হাতে থাকিতে পারে বটে, কিন্তু তাহার পর?
সুরেশ্বরের মেসে আসিয়া নিজের নামের একখানি পত্র ডাকবাক্সে দেখিল। হাতের লেখাটা সে চেনে না-খুলিয়া দেখিল চিঠিখানা মায়ের, কিন্তু অপরের হাতে লেখা। হাতে ব্যথা হইয়া মা বড়ো কষ্ট পাইতেছেন, অপু কি তিনটি টাকা পাঠাইয়া দিতে পারে? মা কখনও কিছু চান না, মুখ বুজিয়া সকল দুঃখ সহ্য করেন, সে-ই বরং দেওয়ানুপুরে থাকিতে নানা ছলছুতায় মাঝে মাঝে কত টাকা মায়ের কাছ হইতে লইয়াছে। হাতে না থাকিলেও তেলিবাড়ি হইতে চাহিয়া-চিন্তিয়া মা জোগাড় করিয়া দিতেন। খুব কষ্ট না হইলে কখনও মা তাহাকে টাকার জন্য লেখেন নাই।
পকেট হইতে টাকা বাহির করিয়া গুনিয়া দেখিল সাতাশটি টাকা আছে। মেসের দেনা সাড়ে পনেরো টাকা বাদে সাড়ে এগারো টাকা থাকে। মাকে কত টাকা পাঠানো যায়? মনে মনে ভাবিলতিনটে টাকা তো চেয়েছেন, আমি দশ টাকা পাঠিয়ে দিই, মনিঅর্ডার পিওন যখন টাকা নিয়ে যাবে, মা ভাববেন বুঝি তিন টাকা কিংবা হয়তো দুটাকার মনিঅর্ডার জিজ্ঞেস করবেন, কত টাকা? পিওন যেই বলবে দশ টাকা, মা অবাক হয়ে যাবেন। মাকে তাক লাগিয়ে দেবো-ভারি মজা হবে, বাড়িতে গেলে মা শুধু সেই গল্পই করবেন দিনরাত
অপ্রত্যাশিত টাকা প্রাপ্তিতে মায়ের আনন্দোজ্জ্বল মুখখানা কল্পনা করিয়া অপু ভারি খুশি হইল। বৌবাজার পোস্টাফিস হইতে টাকাটা পাঠাইয়া দিয়া সে ভাবিল–বেশ হল। আহা, মাকে কেউ কখনও দশ টাকার মনিঅর্ডার একসঙ্গে পাঠায় নি টাকা পেয়ে খুশি হবেন। আমার তো এখন রইল দেড় টাকা, তারপর একটা কিছু ঠিক হয়ে যাবেই।
কলেজের একটি ছেলের সঙ্গে তাহার খুব বন্ধুত্ব হইয়াছে। সেও গরিব ছাত্র, ঢাকা জেলায় বাড়ি, নাম প্রণব মুখার্জি। খুব লম্বা, গৌরবর্ণ, দোহারা চেহারা, বুদ্ধিপ্রোজ্জ্বল দৃষ্টি। কলেজলাইব্রেরিতে একসঙ্গে বসিয়া বই পড়িতে পড়িতে দুজনের আলাপ। এমন সব বই দু-জনে লইয়া যায়, যাহা সাধারণ ছাত্রেরা পড়ে না, নামও জানে না। ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেকে মসেন লইতে দেখিয়া প্রণব তাহার দিকে আকৃষ্ট হয়। আলাপ ক্ৰমে বন্ধুত্বে পরিণত হইয়াছে।
অপু শীঘ্রই বুঝিতে পারিল, প্রণবের পড়াশুনা তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি। অনেক গ্রন্থকারের নামও সে কখনও শোনে নাই—নীটশে, এমার্সন, টুর্গেনিভ, ব্রেস্টেড়—প্রণবের কথায় সে ইহাদের বই পড়িতে আরম্ভ করিল। তাহারই উৎসাহে সে পুনরায় ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের সহিত গিবন শুরু করিল, ইলিয়াডের অনুবাদ পড়িল।
অপুর পড়াশুনার কোনও বাঁধাবাঁধি রীতি নাই। যখন যাহা ভালো লাগে, কখনও ইতিহাস, কখনও নাটক, কখনও কবিতা, কখনও প্রবন্ধ, কখনও বিজ্ঞান। প্রণব নিজে অত্যন্ত সংযমী ও শৃঙ্খলাপ্রিয়। সে বলিল—ওতে কিছু হবে না, ওরকম পড়ো কেন?
অপু চেষ্টা করিয়াও পড়াশুনায় শৃঙ্খলা আনিতে পারিল না। লাইব্রেরি ঘরের ছাদ পর্যন্ত উঁচু বড়ো বড়ো বইয়ে ভরা আলমারির দৃশ্য তাহাকে দিশাহারা করিয়া দেয়। সকল বই-ই খুলিয়া দেখিতে সাধ যায়,Gases of the Atmosphere-স্যার উইলিয়াম র্যামজের। সে পড়িয়া দেখিবে কি কি গ্যাস! Extinct Animals—ই রে, ল্যানকাস্টার, জানিবার তার ভয়ানক আগ্রহ! Worlds Around Us. প্রক্টর! উঃ, বইখানা না পড়িলে রাত্রে ঘুম হইবে না। প্রণব হাসিয়া বলে—দূর! ও কি পড়া? তোমার তো পড়া নয়, পড়া পড়া খেলা
এত বড়ো লাইব্রেরি, এত বই! নক্ষত্রজগৎ হইতে শুরু করিয়া পৃথিবীর জীবজগৎ, উদ্ভিদজগৎ, আণুবীক্ষণিক প্রাণিকুল, ইতিহাস—সব সংক্রান্ত বই। তাহার অধীর উৎসুক মন চায় এই বিশ্বের সব কথা জানিতে। বুঝিতে পারুক আর নাই পারুক—একবার বইগুলি খুলিয়া দেখিতেও সাধ যায়। লুপ্ত প্রাণিকুল সম্বন্ধে খানকতক ভালো বই পড়িল—অলিভার লজের Pioneers of science-বড়ো বড়ো নীহারিকাদের ফটো দেখিয়া মুগ্ধ হইল। নীটশে ভালো বুঝিতে না পারিলেও দু-তিখানা বই পড়িল। টুর্গেনিভ একেবারে শেষ করিয়া ফেলিল, বারোনা না যোলখানা বই। চোয়ের সামনে টুর্গেনিভ এক নতুন জগৎ খুলিয়া দিয়া গেল—কি অপূর্ব হাসি-অশ্রু মাখানো কল্পনোক।
প্রণবের কাছেই সে সন্ধান পাইল, শ্যামবাজারে এক বড়োলোকের বাড়ি দরিদ্র ছাত্রদের খাইতে দেওয়া হয়। প্রণবের পরামর্শে সে ঠিকানা খুঁজিয়া সেখানে গেল। এ পর্যন্ত কখনও কিছু যে চায় নাই, কাহারও কাছে চাহিতে পারে না; আত্মমর্যাদাবোধের জন্য নহে, লাজুকতা ও আনাড়িপনার জন্য এতদিন সে-সবের দরকারও হয় নাই, কিন্তু আর যে চলে না!
খুব বড়োলোকের বাড়ি; দারোয়ান বলিল-কি চাই?
অপু বলিল, এখানে গরিব ছেলেদের খেতে দেয়, তাই জানতে-কাকে বলবো জানো?
দারোয়ান তাহাকে পাশের দিকে একটা ছোট ঘরে লইয়া গেল।
ইলেকট্রিক পাখার তলায় একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক বসিয়া কি লিখিতেছিলেন। মুখ তুলিয়া বলিলেন—এখানে কি দরকার আপনার?
অপু সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল—এখানে কি পুওর স্টুডেন্টদের খেতে দেওয়া হয়? তাই আমি–
—আপনি দরখাস্ত করেছিলেন?
কিসের দরখাস্ত অপু জানে না।
—জুন মাসে দরখাস্ত করতে হয় আমাদের, নাম্বার লিমিটেড কিনা, এখন আর খালি নেই। আবার আসছে বছর—তাছাড়া, আমরা ভাবছি ওটা উঠিয়ে দেবো, এস্টেট রিসিভারের হাতে যাচ্ছে, ও-সব আর সুবিধে হবে না।
ফিরিবার সময় গেটের বাহিরে আসিয়া অপুর মনে বড়ো কষ্ট হইল। কখনও সে কাহারও নিকট কিছু চায় নাই, চাহিয়া বিমুখ হইবার দুঃখ কখনও ভোগ করে নাই, চোখে তাহার প্রায় জল
আসিল।
পকেটে মাত্র আনা দুই পয়সা অবশিষ্ট আছে—এই বিশাল কলিকাতা শহরে তাহাই শেষ অবলম্বন। কাহাকেই বা সে এখানে চেনে, কাহার কাছে যাইবে? অখিলবাবুর মেসে দুই মাস সে প্রথম খাইয়াছে, সেখানে যাইতে লজ্জা করে। সুরেশ্বরের নিজেরই চলে না; তাহার উপর সে কখনও জুলুম করিতে পারিবে না।
আরও কয়েকদিন কাটিয়া গেল। কোনদিন সুরেশ্বরের মেসে এক বেলা খাইয়া, কোনদিন বা জানকীর কাছে কাটাইয়া চলিতেছিল। একদিন সারাদিন না খাওয়ার পর সে নিরুপায় হইয়া অখিলবাবুর মেসে সন্ধ্যার পর গেল। অখিলবাবু অনেকদিন পর তাহাকে পাইয়া খুশি হইলেন। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর অনেকক্ষণ গল্পগুজব করিলেন। বলি বলি করিয়াও অপু নিজের দুর্দশার কথা অখিলবাবুকে বলিতে পারিল না। তাহা হইলে হয়তো তিনি তাহাকে ছাড়িবেন না, সেখানে থাকিতে বাধ্য করিবেন। সে জুলুম করা হয় অনর্থক।
কিন্তু এদিকে আর চলে না! এক জায়গায় বই, এক জায়গায় বিছানা। কোথায় কখন রাত কাটাইবে কিছু ঠিক নাই—ইহাতে পড়াশুনা হয় না। পরীক্ষাও নিকটবর্তী। না খাইয়াই বা কয় দিন চলে!
অখিলবাবুর মেস হইতে ফিরিবার পথে একটা খুব বড়ো বাড়ি। ফটকের কাছে মোটর গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। এই বাড়ির লোকে যদি ইচ্ছা করে তবে এখনই তাহার কলিকাতায় থাকার সকল ব্যবস্থা করিয়া দিতে পারে। সাহস করিয়া যদি সে বলিতে পারে, তবে হয়তো এখনই হয়। একবার সে বলিয়া দেখিবে?
কোথাও কিছু সুবিধা না হইলে তাহাকে বাধ্য হইয়া পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়া দেশে ফিরিতে হইবে। এই লাইব্রেরি, এত বই, বন্ধুবান্ধব, কলেজ—সব ফেলিয়া হয়তো মনসাপোতায় গিয়া আবার পুরাতন জীবনের পুনরাবৃত্তি করিতে হইবে। পড়াশুনা তাহার কাছে একটা রোমান্স, একটা অজানা বিচিত্র জগৎ দিনে দিনে চোখের সামনে খুলিয়া যাওয়া, ইহাকে সে চায়, ইহাই এতদিন চাহিয়া আসিয়াছে। কলেজ হইতে বাহির হইয়া চাকরি, অর্থোপার্জন—এসব কথা সে কোনদিন ভাবে নাই, তাহার মাথার মধ্যে কোনদিন এসব সাংসারিক কথা ঢোকে নাই—সে চায় এই অজানার রোমান্স এই বিচিত্র ভাবধারার সহিত আরও ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ। প্রাচীন দিনের জগৎ, অধুনালুপ্ত অতিকায় প্রাণীদল, বিশাল শুন্যের দৃশ্য, অদৃশ্য নক্ষত্ররাজি, ফরাসি বিদ্রোহ নানা কথা। এই সব ছাড়িয়া শালগ্রাম হাতে মনসাপোতায় বাড়ি-বাড়ি ঠাকুর-পূজা…!
অপুর মনে হইল—এই রকমই বড় বাড়ি আছে লীলাদের, কলিকাতারই কোন জায়গায়। অনেকদিন আগে লীলা তাহাকে বলিয়াছিল, কলিকাতায় তাহাদের বাড়িতে থাকিয়া পড়িতে। সে ঠিকানা জানে না কোথায় লীলাদের বাড়ি, কেই বা এখানে তাহাকে বলিয়া দিবে, তাহা ছাড়া সেসব আজ ছয় সাত বছরের কথা হইয়া গেল, এতদিন কি-আর লীলা তাহার কথা মনে রাখিয়াছে? কোন্ কালে ভুলিয়া গিয়াছে।
অপু ভাবিল—ঠিকানা জানলেই কি আর আমি সেখানে যেতে পারতাম, না, গিয়ে কিছু বলতে—সে আমার কাজ নয়—তার ওপর এই অবস্থায়। দূর, তা কখনও হয়? তাছাড়া লীলার বিয়ে-থাওয়া হয়ে এতদিন সে শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছে। সে-সব কি আর আজকের কথা?
ক্লাসে জানকী একদিন একটা সুবিধার কথা বলিল। সে ঝামাপুকুরের কোন ঠাকুরবাড়িতে রাত্রে খায়। সকালে কোথায় ছেলে পড়াইয়া একবেলা তাহাদের সেখানে খায়। সম্প্রতি সে বোনের বিবাহে বাড়ি যাইতেছে, ফিরিয়া না আসা পর্যন্ত অপু রাত্রে রাজবাড়িতে তাহার বদলে খাইতে পারে। বাড়ি যাইবার পূর্বে ঠাকুরবাড়ির সেবাইতকে বলিয়া কহিয়া সে সব ব্যবস্থা করিয়া যাইবে এখন। অপু রাজি আছে?
রাজি? হাতে স্বর্গ পাওয়া নিতান্ত গল্পকথা নয় তাহা হইলে!
ঠাকুরবাড়ির খাওয়া নিতান্ত মন্দ নয়, অপুর কাছে তাহা খুব ভালো লাগে। আলোচালের ভাত, টক, কোনও কোনও দিন ভোগের পয়সাও পাওয়া যায়, তবে মাছ-মাংসের সম্পর্ক নাই, নিরামিষ।
কিন্তু এ তো আর দু-বেলা নয়; শুধু রাত্রে। দিনমানটাতে বড়ো কষ্ট হয়। দুই পয়সার মুড়ি ও কলের জল। তবুও তো পেটটা ভরে! কলেজ হইতে বাহির হইয়া বৈকালে তাহার এত ক্ষুধা পায় যে গা ঝিম ঝিম করে, পেটে যেন এক ঝাক বোলতা হল ফুটাইতেছে—পয়সা জুটাইতে পারিলে অপু এ সময়টা পথের ধারের দোকান হইতে এক পয়সার ছোলাভাজা কিনিয়া খায়।
সব দিন পয়সা থাকে না, সেদিন সন্ধ্যার পরেই ঠাকুরবাড়ি চলিয়া যায়, কিন্তু ঠাকুরের আরতি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে খাইতে দিবার নিয়ম নাই—তাও একবার নয়, দুইবার দুটি ঠাকুরের আরতি। আরতির কোন নির্দিষ্ট সময় নাই, সেবাইত ঠাকুরের মর্জি ও সুবিধামতো রাত আটটাতেও হয়, নটাতেও হয়, দশটাতেও হয়, আবার এক-একদিন সন্ধ্যার পরেই হয়।
কলেজে যাইতে সেদিন মুরারি বলিল—সি.বি.বি.-র ক্লাসে কেউ যেয়ো না—আমরা সব স্ট্রাইক করেছি।
অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল,-কেন, কি করেছে সি.সি.বি.?
মুরারি হাসিয়া বলিল,—করে নি কিছু, পড়া জিজ্ঞেস করবে বলেছে রোমের হিস্ট্রির। একপাতাও পড়ি নি, না পারলে বকুনি দেবে কি রকম জানো তো?
গজেন বলিল—আমার তো আরও মুশকিল। রোমের হিস্ট্রির বই-ই যে আমি কিনি নি!
মন্মথ আগে সেন্ট জেভিয়ারে পড়িত, সে বিলাতি নাচের ভঙ্গিতে হাত লম্বা করিয়া বার কয়েক পাক খাইয়া একটা ইংরাজি গানের চরণ বার দুই গাহিল। অপু বলিল—কিন্তু পার্সেন্টেজ যাবে যে?
প্রতুল বলিলভারি একদিনের পার্সেন্টেজ। তা আমি ক্লাসে নাম প্রেজেন্ট করেও পালিয়ে আসতে পারি—সে তো আর তুমি পারবে না?
অপু বলিল-খুব পারি। পারব না কেন?
প্রতুল বলিল—সে তোমার কাজ নয়, সি.সি.বি.-র চোখ ভারি ইয়ে—আমরা বলে তাই এক একদিন সরষেফুল দেখি, তা তুমি পারো পালিয়ে আসতে?
এখুনি। দ্যাখো সবাই দাঁড়িয়ে—পারি কি না পারি, কিন্তু যদি পারি খাওয়াতে হবে বলে দিলাম
অপু উৎসাহে সিড়ি ভাঙিয়া উপরে উঠিয়া গেল। গজেন বলিল—কেন ওকে আর ওসব শেখাচ্ছিস?
—শেখাচ্ছি মানে? ভাজা মাছখানা উলটে খেতে জানে নাভারি সাধু!
মুরারি বলিল-না, না, তোমরা জানো না, অপূর্ব ভারি pure spirit। সেদিন
–হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি, ওরকম সুন্দর চেহারা থাকলে আমাদের কত সার্টিফিকেট আসতো-বাবা, বঙ্কিমবাবু কি আর সাধে সুন্দর মুখের গুণ গেয়ে গেছেন।
–কি বাজে বকছিস প্রতুল? দিন দিন ভারি ইতর হয়ে উঠছিস কিন্তু—
প্রিন্সিপালের গাড়ি কলেজের সামনে আসিয়া লাগাতে যে যেদিকে সুবিধা পাইল সরিয়া পড়িল।
মিঃ বসুর ক্লাসে নামটা প্রেজেন্ট করিয়াই আজ অপু পলাইবার পথ খুঁজিতে লাগিল। বাঁদিকের দরজাটা একদম খোলা, প্রোফেসারের চোখ অন্যদিকে। সুযোগ খুঁজিতে খুঁজিতে প্রোফেসারের চোখ আবার তাহার দিকে পড়িল, কাজেই খানিকক্ষণ ভালোমানুষের মতো নিরীহমুখে বসিয়া থাকিতে বাধ্য হইল। এইবার একবার অন্যদিকে চোখ পড়িলেই হয়। হঠাৎ প্রোফেসার তাহাকেই প্রশ্ন করিলেন,–Was Merius justified in his action?
সর্বনাশ! মেরিয়াস কে! একদিনও সে যে রোমের ইতিহাসের লেকচার শোনে নাই!
উত্তর না পাইয়া প্রোফেসার অন্য একটা প্রশ্ন করিলেন—What do you think of Sullas—
অপু বিপন্নমুখে কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
রাস্কেল মণিলালটা মুখে কাপড় খুঁজিয়া খিল খিল করিয়া হাসিতেছে!
প্রোফেসার বিরক্ত হইয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন।
—You, you there you behind the pillar–
এবার মণিলালের পালা। সে থামের আড়ালে সরিয়া বসিবার বৃথা চেষ্টা হইতে বিরত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। দেখা গেল সুন্না বা মেরিয়াসের সম্বন্ধে অপুর সহিত তাহার মতের কোন পার্থক্য নাই, সমানই নির্বিকার। মণিলালের দুর্গতিতে অপু খুব খুশি হইয়া পাশের ছেলেকে আঙুলের খোঁচা দিয়া ফিস ফিস করিয়া বলিল-Rightly served! ভারি হাসি হচ্ছিল—
—চুপ চুপ—এখুনি আবার এদিকে চাইবে সি.সি.বি. কথা শুনলে–
–এবার আমি সোজা—
পিছন হইতে নৃপেন ব্যস্তস্বরে বলিল—এইবার আমায় জিজ্ঞেস করবে—ডেটটা ভাই দে না শিগগির বলে শিগগির
অপুর পাশের ছেলেটি বলিল—কে কাকে ডেট বলে দাদা-মেরিভেল পুলারের বইয়ের রং কেমন এখনও চাক্ষুষ দেখি নি-কেটে পড়ো না সোজা–
অপু খানিকক্ষণ হইতেই পোফেসারের দৃষ্টির গতি একমনে লক্ষ করিতেছিল, সে বুঝিতে পারিল ও-কোণ হইতে একবার এদিকে ফিরিলে পালানো অসম্ভব হইবে, কারণ এদিকে এখনও অনেক ছেলেকে প্রশ্ন করিতে বাকি। এই সুবর্ণ সুযোগ। বিলম্ব করিলে…।
দু-একবার উসখুস করিয়া, একবার এদিক ওদিক চাহিয়া অপু সাঁ করিয়া খোলা দরজা দিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
পিছু পিছু হরিদাস-অন্স পরেই নৃপেন।…
তিনজনেই উপরের বারান্দাতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করিয়া তর তর করিয়া সিড়ি বাহিয়া একেবারে একতলায় নামিয়া আসিল।
অপু পিছন ফিরিয়া সঙ্গীদের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল—হি-হি-হি-উ-আর একটু হলেই—
নৃপেন বলিল-আমাকে তো-মিনিট-দুই দেরিকাল হয়েছে কি বুঝলে?
অপু বলিল-যাক, এখানে আর দাঁড়িয়ে খোশগল্প করার কোনও দরকার দেখছি নে। এখুনি প্রিন্সিপ্যাল নেমে আসবেন, গাড়ি লাগিয়েছে দরজায়—কমনরুমে বরং এসো
একটু পরে সকলে বাহির হইয়া পড়িল। আজ আর ক্লাস ছিল না। কে গ্রাহ্য করে বুড়ো সি. বি, বি. ও তাঁহার রোমের ইতিহাসের যত বাজে প্রশ্ন?
অপু কিন্তু কিছু নিরাশ হইল। ক্লাস হইতে পালাইতে পারিলে প্রতুলের দল খাওয়াইবে বলিয়াছিল। কিন্তু লাইব্রেরিয়ানের কাছে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, তাহারা অনেকক্ষণ চলিয়া গিয়াছে।—কোন্ সকালে দুই পয়সার মুড়ি ও একটা ফুলুরি খাইয়া বাহির হইয়াছে—পেট যেন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছিল, কিছু খাইতে পারিলে হইত! ক্লাসে এতক্ষণ বেশ ছিল, বুঝিতে পারে নাই, বাহিরে আসিয়া ক্ষুধার যন্ত্রণাই প্রবল হইয়া উঠিল। এদিকে পকেটে একটাও পয়সা নাই। সে ভাবিল—ওরা আচ্ছা তো? বললে খাওয়াব, তাই তো আমি পালাতে গেলাম। নিজেরা এদিকে সরে পড়েছে কোন্ কালে! এখন কিছু খেলে তবুও রাত অবধি থাকা যেত–আজ সোমবার, আটটার মধ্যেই আরতি হয়ে যাবে—উঃ, ক্ষিদে যা পেয়েছে!–
০৬. কষ্ট করিতে অপু কখনও অভ্যস্ত নয়
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এ ধরনের কষ্ট করিতে অপু কখনও অভ্যস্ত নয়। বাড়ির এক ছেলে, চিরকাল বাপ-মায়ের আদরে কাটাইয়াছে। শহরে বড়োলোকের বাড়িতে অন্য কষ্ট থাকিলেও খাওয়ার কষ্টটা অন্তত ছিল না। তাছাড়া সেখানে মাথার উপর ছিল মা, সকল আপদবিপদে সর্বজয়া ডানা মেলিয়া ছেলেকে আড়াল করিয়া রাখিতে প্রাণপণ করিত, কোনও কিছু আঁচ লাগিতে দিত না। দেওয়ানপুরে স্কলারশিপের টাকায় বালক-বুদ্ধিতে যথেষ্ট শৌখিনতা করিয়াছে—খাইয়াছে, খাওয়াইয়াছে, ভালো ভালো জামা কাপড় পরিয়াছে,—তখন সেসব জিনিস সস্তাও ছিল।
কিন্তু শীঘ্রই অপু বুঝিল—কলিকাতা দেওয়ানপুর নয়। এখানে কেহ কাহাকেও পোঁছে না। ইউরোপে যুদ্ধ বাধিয়া গত কয়েক মাসের মধ্যে কাপড়ের দাম এত চড়িয়াছে যে কাপড় আর কেনা যায় না। ভালো কাপড় তাহার মোটে আছে একখানা, একটি টুইল শার্ট সম্বল। ছেলেবেলা হইতেই ময়লা কাপড় পরিতে সে ভালোবাসে না, দু-তিনদিন অন্তর সাবান দিয়া কাপড় কাচিয়া শুকাইলে, তাহাই পরিয়া বাহির হইতে পারে। সবদিন কাপড় ঠিক সময়ে শুকায় না, কাপড় কাচিবার পরিশ্রমে এক-একদিন আবার ক্ষুধা এত বেশি পায় যে, মাত্র দু-পয়সার খাবারে কিছুই হয় না—ক্লাসে লেকচার শুনিতে বসিয়া মাথা যেন হঠাৎ শোলার মতো হালকা বোধ হয়।
এদিকে থাকার কষ্টও খুব। সুরেশ্বর এম.এ. পরীক্ষা দিয়া বাড়ি চলিয়া গিয়াছে, তাহার মেসে আর থাকিবার সুবিধা নাই। যাইবার আগে সুরেশ্বর একটা ঔষধের কারখানার উপরে একটা ছোট ঘরে তাহার থাকিবার স্থান ঠিক করিয়া দিয়া গিয়াছে। ওই কারখানায় সুরেশ্বরের জানালোনা একজন লোক কাজ করে ও রাত্রে ওপরের ঘরটাতে থাকে। ঠিক হইয়াছে, যতদিন কিছু একটা সুবিধা না হইতেছে, ততদিন অপু ওই ঘরটাতে লোকটার সঙ্গে থাকিবে। ঘরটা একে ছোট, তাহার উপর অর্ধেকটা ভর্তি ঔষধবোঝাই প্যাকবাক্সে। রাশীকৃত জঞ্জাল বাঙ্গগুলির পিছনে জমানো, কেমন একটা গন্ধ! নেংটি ইদুরের উৎপাতে কাপড়-চোপড় রাখিবার জো নাই, অপুর একমাত্র টুইল শার্টটার দু–জায়গায় কাটিয়া ফুটা করিয়া দিয়াছে। রাত্রে ঘরময় আরশোলার উৎপাত। ঘরের সেলোকটা যেমন নোংরা তেমনই তামাক-প্রিয়, রাত্রে উঠিয়া অন্তত তিনবার তামাক সাজিয়া খায়। তাহার কাশির শব্দে ঘুম হওয়া দায়। ঘরের কোণে তামাকের গুল রাশীকৃত করিয়া রাখিয়া দেয়। অপু নিজে বার দুই পরিষ্কার করিয়াছিল। এক টুকরা রবারের ফিতার মতোই ঘরের নোংরামিটা স্থিতিস্থাপক পূর্বাবস্থায় ফিরিতে এতটুকু দেরি হয় না। খাওয়া-পরা থাকিবার কষ্ট অপু কখনও করে নাই, বিশেষ করিয়া একলা যুঝিতে হইতেছে বলিয়া কষ্ট আরও বেশি।
অন্যমনস্কভাবে যাইতে যাইতে সে কৃষ্ণদাস পালের মূর্তির মোড়ে আসিল। যুদ্ধের নূতন খবর বাহির হইয়াছে বলিয়া কাগজওয়ালা হাঁকিতেছে। শেয়ালদার একটা ট্রাম হইতে লোজন নামা-উঠা করিতেছে। একটি চোখে-চশমা তরুণ যুবকের দিকে একবার চাহিয়াই মনে হইল—চেনা-চেনা মুখ! একটু পরে সেও অপুর দিকে চাহিতে দুইজনে চোখাচোখি হইল। এবার অপু চিনিয়াছে—সুরেশদা! নিশ্চিন্দিপুরের বাড়ির পাশের সেই পোড়ো ভিটার মালিক নীলমণি জ্যাঠামশায়ের ছেলে সুরেশ।
সুরেশও চিনিয়াছিল। অপু তাড়াতাড়ি কাছে গিয়া হাসিমুখে বলিল, সুরেশদা যে!
যেবার দুর্গা মারা যায়, সে বৎসর শীতকালে ইহারা যা কয়েক মাসের জন্য দেশে গিয়াছিল, তাহার পর আর কখনও দেখাসাক্ষাৎ হয় নাই। সুরেশ আকৃতিতে যুবক হইয়া উঠিয়াছে। দীর্ঘ দেহ, সুগঠিত হাত পা। বাল্যের সে চেহারার অনেক পরিবর্তন হইয়াছে।
সুরেশ সহজ-সুরেই বলিল—আরে অপূর্ব? এখানে কোথা থেকে?
সুরেশের খাঁটি শহুরে গলার সুরে ও উচ্চারণ-ভঙ্গিতে অপু একটু ভয় খাইয়া গেল।
সুরেশ বলিল—তারপর এখানে কি চাকরি-টাকরি করা হচ্ছে?
-না—আমি যে পড়ি ফার্স্ট ইয়ারে রিপনে-
–তাই নাকি? তা এখন যাওয়া হচ্ছে কোথায়?
অপু সে-কথার কোনও উত্তর না দিয়া আগ্রহের সুরে বলিল, জেঠিমা কোথায়?
—এখানেই, শ্যামবাজারে। আমাদের বাড়ি কেনা হয়েছে সেখানে–
সুরেশের সহিত সাক্ষাতে অপু ভারি খুশি হইয়াছিল। তাহাদের বাড়ির পাশের যে পোডড়া ভিটার বনঝোপের সহিত তাহার ও দিদি দুর্গার আবাল্য অতিমধুর পরিচয়, সেই ভিটারই লোক ইহারা। যদিও কখনও সেখানে ইহারা বাস করে নাই, শহরে শহরেই ঘোরে, তবুও তো সে ভিটারই লোক, তাহা ছাড়া দশরাত্রির জ্ঞাতি, অতি আপনার জন।
অপু বলিল—অতসীদি এখানে আছে? সুনীল? সুনীল কি পড়ে?
–এবার সেকেন ক্লাসে উঠেছে—আচ্ছা, যাই তাহলে, আমার ট্রাম আসছে–
সুরেশের সুরে কোনও আগ্রহ বা আন্তরিকতা ছিল না, সে এমন সহজ সুরে কথা বলিতেছিল, যেন অপুর সঙ্গে তাহার দুইবেলা দেখা হয়। অপু কিন্তু নিজের আগ্রহ লইয়া এত ব্যস্ত ছিল যে, সুরেশের কথাবার্তার সেদিকটা তাহার কাছে ধরা পড়িল না।
—আপনি কি করেন সুরেশদা?
—মেডিকেল কলেজে পড়ি, এবার থার্ড ইয়ার—
–আপনাদের ওখানে একদিন যাব সুরেশদা-জেঠিমার সঙ্গে দেখা করে আসব–
সুরেশ ট্রামের পা-দানিতে পা দিয়া উঠিতে উঠিতে অনাসক্ত সুরে বলিল, বেশ বেশ, আমি আসি এখন
এতদিন পর সুরেশদার সহিত দেখা হওয়াতে অপুর মনে এমন বিস্ময় ও আনন্দ হইয়াছিল যে, ট্রামটা ছাড়িয়া দিলে তাহার মনে পড়িল—সুরেশদার বাড়ির ঠিকানাটা তত জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। সে চলন্ত ট্রামের পাশে ছুটিতে ছুটিতে জিজ্ঞাসা করিল—আপনাদের বাড়ির ঠিকানাটাও সুরেশদা, ঠিকানাটা যে
সুরেশ মুখ বাড়াইয়া বলিল—চবিবশ-এর দুই সি, বিশ্বকোষ লেন, শ্যামবাজার—
পরের রবিবার সকালে স্নান করিয়া অপু শ্যামবাজারে সুরেশদার ওখানে যাইবার জন্য বাহির হইল। আগের দিন টুইল শার্টটা ও কাপড়খানা সাবান দিয়া কাচিয়া শুকাইয়া লইয়াছিল, জুতার শাচনীয় দুরবস্থা ঢাকিবার জন্য একটি পরিচিত মেসে এক সহপাঠীর নিকট হইতে জুতার কালি চাহিয়া নিজে বুরুশ করিয়া লইল। সেখানে অতসীদি ইত্যাদি রহিয়াছেন, দীনহীন বেশে কি যাওয়া চলে?
ঠিকানা খুঁজিয়া বাহির করিতে দেরি হইল না। ছোটখাটো দোতলা বাড়ি, আধুনিক ধরনের তৈয়ারি। ইলেকট্রট লাইট আছে, বাহিরে বৈঠকখানা, দোলায় উঠিবার সিড়ি। সুরেশ বাড়ি ছিল না, ঝিয়ের কাছে সে পরিচয় দিতে পারিল না, বৈঠকখানায় তাহাকে বসাইয়া ঝি চলিয়া গেল। ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, একটা পুরোনো রোল-টপ ডেস্ক, খানকতক চেয়ার। ভারি সুন্দর বাড়ি তো! এত আপনার জনের কলিকাতায় এরকম বাড়ি আছে, ইহাতে অপু মনে মনে একটু গর্ব ও আনন্দ অনুভব করিল। টেবিলে একখানা সেদিনের অমৃতবাজার পড়িয়া ছিল, উলটাইয়া পালটাইয়া যুদ্ধের খবর পড়িতে লাগিল।
অনেক বেলায় সুরেশ আসিল।
তাহাকে দেখিয়া বলিল, এই যে অপূর্ব, কখন এলে?
অপু হাসিমুখে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল—আসুন সুরেশদা—আমি, আমি অনেকক্ষণ ধরে বেশ বাড়িটা তো আপনাদের
—এটা আমার বড়োমামা—যিনি পাটনার উকিল, তিনি কিনেছেন; তারা তো কেউ থাকেন, আমরাই থাকি। বসো, আমি আসি বাড়ির মধ্যে থেকে–
অপু মনে মনে ভাবিল—এবার সুরেশদা বাড়ির ভেতর গিয়ে বললেই জেঠিমা ডেকে পাঠাবে, এখানে খেতে বলবে
কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সুরেশ বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইল না। সে যখন পুনরায় আসিল, তখন বারোটা বাজিয়া গিয়াছে। চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া পড়িয়া নিশ্চিন্তি সুরে বলিল, তারপর?…বলিয়াই খবরের কাগজখানা হাতে তুলিয়া চোখ বুলাইতে লাগিল। অপু দেখিল সুরেশ পান চিবাইতেছে। খাওয়ার আগে এত বেলায় পান খাওয়া অভ্যাস, না-কি খাওয়া হইয়া গেল!
দুই চারিটা প্রশ্নের জবাব দিতে ও খবরের কাগজ পড়িতে পড়িতে একটা বাজিল। সুরেশের চোখ ঘুমে বুজিয়া আসিতেছিল। সে হঠাৎ কাগজখানা টেবিলে রাখিয়া দিয়া চেয়ার হইতে উঠিয়া পড়িয়া বলিল, তুমি না হয় বসে কাগজ পড়ো, আমি একটুখানি শুয়ে নি। একটা ডাব খাবে?
ডাব খাইবে কি রকম, এত বেলায়, এ অবস্থায়? অপু ভালো বুঝিতে না পারিয়া বলিল, ডাব? থাক, এত বেলায়–ইয়ে–না।
সেই যে সুরেশ বাড়ি ঢুকিল—একটা-দুইটা—আড়াইটা, আর দেখা নাই। ইহারা কত বেলায় খায়! রবিবার বলিয়া বুঝি এত দেরি? কিন্তু যখন তিনটা বাজিয়া গেল, তখন অপুর মনে হইল, কোথাও কিছু ভুল হইয়াছে নিশ্চয়। হয় সে-ই ভুল বুঝিয়াছে, না হয় উহারা ভুল করিয়াছে। তাহার এত ক্ষুধা পাইয়াছিল যে, সে আর বসিতে পারিতেছে না। উঠিবে কিনা ভাবিতেছে, কেমন সময় সুরেশের ছোট ভাই সুনীল বাড়ির ভিতর হইতে বাহিরে আসিল। অপু ডাকিবার পূর্বেই সে সাইকেল লইয়া বাড়ির বাহিরে কোথায় চলিয়া গেল।
সেই সুনীল-যাহাকে সঙ্গে লইয়া নিমন্ত্রণে ঘঁদা বাঁধিবার দরুন জেঠিমা তাহাকে ফলারেবামুনের ছেলে বলিয়াছিলেন! ইহাদের যে এতদিন পর আবার দেখিতে পাওয়া যাইবে, তাহা যেন অপু ভাবে নাই। সুনীলকে দেখিয়া তাহার বিস্ময় ও আনন্দ দুই-ই হইল। এ যেন কেমন একটা ঠিক বুঝানো যায় না।
ইহাদের সঙ্গে দেখা করিতে আসিবার মূলে অপুর কোন স্বার্থসিদ্ধি বা সুযোগসন্ধানের উদ্দেশ্য ছিল না, বা ইহা যে নিতান্ত গায়ে পড়িয়া আলাপ জমাইবার মতো দেখাইতেছে—একবারও সেকথা তাহার মনে উদয় হয় নাই। এখানে তাহার আসিবার মূলে সেই বিস্ময়ের ভাব—যাহা তাহার জন্মগত। কে আবার জানিত, খাস কলিকাতা শহরে এতদিন পরে নিশ্চিন্দিপুরের বাড়ির পাশের পোড়ো ভিটাটার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা হইয়া যাইবে। এই ঘটনাটুকু তাহাকে মুগ্ধ করিবার পক্ষে যথেষ্ট। এ যেন জীবনের কোন্ অপরিচিত বাঁকে পত্রপুষ্পে সজ্জিত অজানা কোন কুঞ্জবন-বাঁকের মোড়ে ইহাদের অস্তিত্ব যেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
বিস্ময় মনের অতি উচ্চ ভাব এবং উচ্চ বলিয়াই সহজলভ্য নয়। সত্যকার বিস্ময়ের স্থান অনেক উপরে-বুদ্ধি যার খুব প্রশস্ত ও উদার, মন সব সময় সতর্কনূতন ছবি নূতন ভাব গ্রহণ করিবার ক্ষমতা রাখে—সে-ই প্রকৃত বিস্ময়-রসকে ভোগ করিতে পারে। যাদের মনের যন্ত্র অলস, মিনমিনে পরিপূর্ণ, উদার বিস্ময়ের মতো উচ্চ মনোভাব তাদের অপরিচিত থাকিয়া যায়।
বিস্ময়কে যাঁহারা বলিয়াছেন Mother of philosophy, তাহারা একটু কম বলেন। বিস্ময়ই আসল Philosophy, বাকিটা তাহার অর্থসংগতি মাত্র।
তিনটার পর সুরেশ বাহির হইয়া আসিল। সে হাই তুলিয়া বলিল–কাল রাত্রে ছিল নাইটডিউটি, চোখ মোটে বোজে নিতাই একটু গড়িয়ে নিলাম—চলো, মাঠে ক্যালকাটা টিমের হকি খেলা আছে—একটু দেখে আসা যাক–
অপু মনে মনে সুরেশদাকে ঘুমের জন্য অপরাধী ঠাওর করিবার জন্য লজ্জিত হইল। সারারাত কাল বেচারি ঘুমায় নাই—তাহার ঘুম আসা সম্পূর্ণ স্বাভাবিকই তো!…
সে বলিল—আমি মাঠে যাবো না সুরেশদা, কাল এগজামিন আছে, পড়া তৈরি হয় নি মোটে—আমি যাই ইয়ে-জেঠিমার সঙ্গে একবার দেখা করে গেলে হতো
সুরেশ বলিল—হ্যাঁ হ্যাঁ—বেশ তো—এসো না—
অপু সুরেশের সঙ্গে সংকুচিত ভাবে বাড়ির মধ্যে ঢুকিল। সুরেশের মা ঘরের মধ্যে বসিয়াছিলেন–সুরেশ গিয়া বলিল-এ সেই অপূর্ব মা–নিশ্চিন্দপুরের হরিকাকার ছেলে–তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে
অপূর্ব পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল—সুরেশের কথায় ভাবে তাহার মনে হইল, সে যে এতক্ষণ আসিয়া বাহিরের ঘরে বসিয়া আছে সে কথা সুরেশ বাড়ির মধ্যে আদৌ বলে নাই।
জেঠিমার মাথার চুল অনেক পাকিয়া গিয়াছে বলিয়া অপুর মনে হইল। অপুর প্রণামের উত্তরে তিনি বলিলেন, এসো-এসো–থাক, থাক্-কলকাতায় কি করো?
অপু ইতিপূর্বে কখনও জেঠিমার সম্মুখে কথা বলিতে পারিত না। গম্ভীর ও গর্বিত (যেটুকু সে ধরিতে পারিত না) চালচলনের জন্য জেঠিমাকে সে ভয় করিত। আনাড়ি ও অগোছালো সুরে বলিল, এই এখানে পড়ি, কলেজে পড়ি।
জেঠিমা যেন একটু বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, কলেজে পড়? ম্যাট্রিক পাশ দিয়েছ?
—আর বছর ম্যাট্রিক পাশ করেছি-
-তোমার বাবা কোথায়?—তোমরা তো সেই কাশী চলে গিয়েছিলে, না?
–বাবা তো নেই—তিনি তো কাশীতেই…
তারপর অপু সংক্ষেপে বলিল সব কথা। এই সময়ে পাশের ঘর হইতে একটি বাইশ-তেইশ বছরের তরুণী এ ঘরে ঢুকিতেই অপু বলিয়া উঠিল, অতসীদি না?…
অতসী অনেক বড়ো হইয়াছে, তাহাকে চেনা যায় না। সে অপুকে চিনিতে পারিল, বলি, অপূর্ব কখন এলে?
আর একটি মেয়ে ও-ঘর হইতে আসিয়া দোরের কাছে দাঁড়াইল। পনেরো যোল বৎসর বয়স হইবে, বেশ সুশ্রী, বড়ো বড়ো চোখ। কথা বলিতে বলিতে সেদিকে চোখ পড়াতে অপু দেখিল, মেয়েটি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে। খানিকটা পরে অতসী বলিল—মণি, দেখে এসে তো দিদি, কুশিকাটাগুলো ও-ঘরের বিছানায় ফেলে এসেছি কি না?
মেয়েটি চলিয়া গেল এবং একটু পরেই আবার দুয়ারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল-না বড়দি, দেখলাম না তো?
জেঠিমা অল্প দুই চারিটা কথার পরই কোথায় উঠিয়া গেলেন। অতসী অনেকক্ষণ কথাবার্তা কহিল। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিল। তারপর সেও চলিয়া গেল। অপু ভাবিতেছিল, এবার সে উঠিবে কিনা। কেহই ঘরে নাই, এ সময় ওঠাটা কি উচিত হইবে?…ক্ষুধা একবার উঠিয়া পড়িয়া গিয়াছে, এখন ক্ষুধা আর নাই, তবে গা ঝিম্ ঝিম্ করিতেছে। যাওয়ার কথা কাহাকেও ডাকিয়া বলিয়া যাইবে?…
দোরের কাছে গিয়া সে দেখিল সেই মেয়েটি বারান্দা দিয়া ও-ঘর হইতে বাহির হইয়া সিঁড়ির দিকে যাইতেছে—আর কেহ কোথাও নাই, তাহাকেই না বলিলে চলে না। উদ্দেশে ডাকিয়া বলিল—এই গিয়ে—আমি যাচ্ছি, আমার আবার কাজ–
মেয়েটি তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল—চলে যাবেন? দাঁড়ান, পিসিমাকে ডাকি—চা খেয়েছেন?
অপু বলিল-চা তা-থাক্, বরং অন্য একদিন—
মেয়েটি বলিল—বসুন, বসুন-দাঁড়ান চা আনি—পিসিমাকে ডাকি দাঁড়ান।
কিন্তু খানিকটা পরে মেয়েটিই এক পেয়ালা চা ও একটা প্লেটে কিছু হালুয়া আনিয়া তাহার সামনে বসিল। অপু ক্ষুধার মুখে হালুযাটুকু গোগ্রাসে গিলিল। গরম চা খাইতে গিয়া প্রথম চুমুকে মুখ পুড়াইয়া ফেলিয়া ঢালিয়া ঢালিয়া খাইতে লাগিল।
মেয়েটি বলিল—আপনি বুঝি ওদের খুড়তুতো ভাই? থাক প্লেটটা এখানেই–আর একটু হালুয়া আনব?
—হালুয়া? …না–ইয়ে তেমন ক্ষিদে নেই, সুরেশদার বাবা আমার জ্যাঠামশাই হতেন, জ্ঞাতি-সম্পর্ক
এই সময় অতসী ঘরে ঢোকাতে মেয়েটি চায়ের বাটি ও প্লেট লইযা চলিয়া গেল।
সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়িতে খাইয়া অনেক রাত্রে সে নিজের থাকিবার স্থানে ফিরিয়া দেখিল আরও একজন তোক সেখানে রাত্রের জন্য আশ্রয় লইয়াছে। মাঝে মাঝে এরকম আসে, কারখানার লোকের দু-একজন আত্মীয়স্বজন মাঝে মাঝে আসে ও দু-চার দিন থাকিয়া যায়। একে ছোট ঘর, থাকিবার কষ্ট, তাহাতে লোক বাড়িলে এইটুকু ঘরের মধ্যে তিষ্ঠানো দায় হইয়া উঠে। পরনের কাপড় এমন ময়লা যে, ঘরের বাতাসে একটা অপ্রীতিকর গন্ধ। অপু সব সহ্য করিতে পারে, এক ঘরে এ-ধরনের নোংরা স্বভাবের লোকের ভিড়ের মধ্যে শুইতে পারে না, জীবনে সে তা কখনও করে নাই ইহা তাহার অসহ্য। কোথায় রাত্রে আসিয়া নির্জনে একটু পড়াশুনা করিবে-না, ইহাদের বকবকের চোটে সে ঘর ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। নতুন লোকটি বড়োবাজারের আলুপোস্তায় আলুর চালান সইয়া আসে—হুগলী জেলার কোন জায়গা হইতে, অপু জানে, আরও একবার আসিয়াছিল। লোকটি বলিল, কোথায় যান, ও মশায়? আবার বেরোন না-কি?
অপু বলিল, এইখানটাতে দাঁড়িয়ে-বেজায় গরম আজ…
একটু পরে লোকটা বলিয়া উঠিলা, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিছানাটা কি মহাশয়ের? আসুন, আসুন, সরিয়ে ন্যান্ একটু—এঘঁকোর জলটা গেল গড়িয়ে পড়ে—দুত্তোর-নাঃ–
অপু বিছানা সরাইয়া পুনরায় বাহিরে আসিল। সে কি বলিবে? এখানে তাহার কি জোর খাটে? উহারাই উপরোধে পড়িয়া দয়া করিয়া থাকিতে দিয়াছে এখানে। মুখে কিছু না বলিলেও অপু অন্যদিন হয়তো মনে মনে বিরক্ত হইত, কিন্তু আজ সে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক ছিল। বাহিরের বারান্দায় জীর্ণ কাঠের রেলিং ধরিয়া অন্ধকারের দিকে চাহিয়া ভাবিতেছিল-সুরেশাদের কেমন চমৎকার বাড়ি কলকাতায়। ইলেকট্রিক পাখা, আলো, ঘরগুলি কেমন সাজানো, মেয়েটির কেমন সুন্দর কাপড় পরনে। চারটা না বাজিতে চা, জলখাবার, চারিদিকে যেন লক্ষ্মীশ্রী, কিছুরই অভাব নাই।
তাহাদেরই যে কি হইয়াছে, কোথায় মা আছে একটেরে পড়িয়া, কলিকাতা শহরে, এই রকম ছন্নছাড়া অবস্থায় সে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, পেট পুরিয়া আহার জোটে না, পরনে নাই কাপড়!…
দিন তিনেক পরে জগদ্ধাত্রী পূজা। কলিকাতায় এত উৎসব জগদ্ধাত্রী পূজায়, তা সে জানিত। দেশে কখনও এ পূজা কোথাও হইত না—কোথাও দেখে নাই। গলিতে গলিতে, সর্বত্র উৎসবের নহবত বাজিতেছে, কত দুয়ারের পাশে কলাগাছ বসানো, দেবদারুর পাতার মালা টাঙানো।
কাঠের কারখানার পাশের গলিটার মধ্যে একজন বড়োলোকের বাড়িতে পূজা। সন্ধ্যার সময় নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকেরা সারি বাঁধিয়া বাড়িটার মধ্যে ঢুকিতেছে—অপু ভাবিল, সেও যদি যায়!…কতকাল নিমন্ত্রণ খায় নাই! কে তাহাকে চিনিবে?…খুব লোভও হইল, ভয়ও হইল।
০৭. শীতকালের দিকে একদিন কলেজ
সপ্তম পরিচ্ছেদ
শীতকালের দিকে একদিন কলেজ ইউনিয়নে প্রণব একটা প্রবন্ধ পাঠ করিল। ইংরেজিতে লেখা, বিষয়–আমাদের সামাজিক সমস্যা; বাছিয়া বাছিয়া শক্ত ইংরেজিতে সে নানান সমস্যার উল্লেখ করিয়াছে; বিধবা-বিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা, পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি। সে প্রত্যেক সমস্যাটি নিজের দিক হইতে দেখিতে চাহিয়াছে এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সনাতন প্রথার স্বপক্ষে মত দিয়াছে। প্রণবের উচ্চারণ ও বলিবার ভঙ্গি খুব ভালো, যুক্তির ওজন অনুসারে সে কখনও ডান হাতে ঘুষি পাকাইয়া, কখনও মুঠাদ্বারা বাতাস আঁকড়াইয়া, কখনও বা সম্মুখের টেবিলে সশব্দে চাপড় মারিয়া বাল্যবিবাহের প্রয়োজনীয়তা ও স্ত্রীশিক্ষার অসারত্ব প্রমাণ করিয়া দিল। প্রণবের বন্ধুদলের ঘন ঘন করতালিতে প্রতিপক্ষের কানে তালা লাগিবার উপক্রম হইল।
অপর পক্ষে উঠিল মন্মথ-সেই যে-ছেলেটি পূর্বে সেন্ট জেভিয়ারে পড়িত। লাটিন জানে বলিয়া ক্লাসে সকলে তাহাকে ভয় করিয়া চলে, তাহার সামনে কেহ ভয়ে ইংরেজি বলে না, পাছে ইংরেজির ভুল হইলে তাহার বিদ্রুপ শুনিতে হয়। সাহেবদের চালচলন, ডিনারের এটিকেট, আচারব্যবহার সম্বন্ধে ক্লাসের মধ্যে সে অথরিটি—তাহার উপর কারুর কথা খাটে না। ক্লাসের এক হতভাগ্য ছাত্র সাহেবপাড়ার কোন রেস্তোরাতে তাহার সহিত খাইতে গিয়া ডান হাতে কাটা ধরিবার অপরাধে এক সপ্তাহকাল ক্লাসে, সকলের সামনে মন্মথর টিটকারি সহ্য করে। মন্মথর ইংরেজি আরও চোখা, কম আড়ষ্ট, উচ্চারণও সাহেবি ধরনের। কিন্তু একেই তাহার উপর ক্লাসের অনেকের রাগ আছে, এদিকে আবার সে বিদেশী বুলি আওড়াইয়া সনাতন হিন্দুধর্মের চিরাচরিত প্রথার নিন্দাবাদ করিতেছে; ইহাতে একদল ছেলে খুব চটিয়া উঠিল—চারিদিক হইতে shame shame.withdraw, withdraw, রব উঠিল—তাহার নিজের বন্ধুদল প্রশংসাসূচক হাততালি দিতে লাগিল-ফলে এত গোলমালের সৃষ্টি হইয়া পড়িল যে, মন্মথ বক্তৃতার শেষের দিকে কি বলিল সভার কেহই তাহার একবর্ণও বুঝিতে পারিল না।
প্রণবের দলই ভারী। তাহারা প্রণবকে আকাশে তুলিল, মন্মথকে স্বধর্মবিরোধী নাস্তিক বলিয়া গালি দিল, সে যে হিন্দুশাস্ত্র একছত্রও না পড়িয়া কোন্ স্পর্ধায় বর্ণাশ্রম ধর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সভায় কথা বলিতে সাহস করিল, তাহাতে কেহ কেহ আশ্চর্য হইয়া গেল। লাটিন-ভাষার সহিত তাহার পরিচয়ের সত্যতায়ও দু-একজন তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করিল (লাটিন জানে বলিয়া অনেকের রাগ ছিল তাহার উপর)। একজন দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল,-প্রতিপক্ষের বক্তার সংস্কৃতে যেমন অধিকার, যদি তাঁহার লাটিন ভাষার অধিকারও সেই ধরনের
আক্ৰমণ ক্রমেই ব্যক্তিগত হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া সভাপতি-অর্থনীতির অধ্যাপক মিঃ দে বলিয়া উঠিলেন-Come, Come, Manmatha has never said that he is a Seneca or a Lucretius-have the goodness to come to the point.
অপু এই প্রথম এরকম ধরনের সভায় যোগ দিল–স্কুলে এসব ছিল না, যদিও হেডমাস্টার প্রতিবারই হইবার আশ্বাস দিতেন। এখানে এদিনকার ব্যাপারটা তাহার কাছে নিতান্ত হাস্যাস্পদ ঠেকিল। ওসব মামুলি কথা মামুলিভাবে বলিয়া লাভ কি? সামনের অধিবেশনে সে নিজে একটা প্রবন্ধ পড়িবে। সে দেখাইয়া দিবে-ওসব একঘেয়ে মামুলি বুলি না আওড়াইয়া কি ভাবে প্রবন্ধ লেখা যায়। একেবারে নূতন এমন বিষয় লইয়া সে লিখিবে, যাহা লইয়া কখনও কেহ আলোচনা করে নাই।
এক সপ্তাহ খাটিয়া প্রবন্ধ লিখিয়া ফেলিল। নাম-নূতনের আহ্বান; সকল বিষয়ে পুরাতনকে ছাটিয়া একেবারে বাদ। কি আচার-ব্যবহার, কি সাহিত্য, কি দেখিবার ভঙ্গি—সব বিষয়েই নুতনকে বরণ করিয়া লইতে হইবে। অপু মনে মনে অনুভব করে, তাহার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যাহা খুব বড়ো, খুব সুন্দর। তাহার উনিশ বৎসরের জীবনের প্রতিদিনের সুখদুঃখ, পথের যে-ছেলেটি অসহায়ভাবে কাঁদিয়া উঠিয়াছে, কবে এক অপরাহের ম্লান আলোয় যে পাখিটা তাহাদের দেশের বনের ধারে বসিয়া দোল খাইত, দিদির চোখের মমতা-ভরা দৃষ্টি, লীলার বন্ধুত্ব, রানুদি, নির্মলা, দেবব্রত, রৌদ্রদীপ্ত নীলাকাশ, জ্যোৎস্না রাত্রি নানা কল্পনার টুকরা, কত কি আশা-নিরাশাব লুকোচুরি—সবসুদ্ধ লইয়া এই যে উনিশটি বৎসর—ইহা তাহার বৃথা যায় নাই—কোটি কোটি যোজন দূর শূন্যপার হইতে সূর্যের আলো যেমন নিঃশব্দ জ্যোতির অবদানে শীর্ণ শিশু-চারাকে পত্রপুস্পফলে সমৃদ্ধ করিয়া তলে, এই উনিশ বৎসরের জীবনের মধ্য দিয়া শাশ্বত অনন্ত তেমনি ওর প্রবধমান তরুণ প্রাণে তাহার বাণী পৌঁছাইয়া দিয়াছে—ছায়ান্ধকার তৃণভূমির গন্ধে, ডালে ডালে সোনার সিঁদুর-মাখানো অপরুপ সন্ধ্যায়; উদার কল্পনায় ভরপুর নিঃশব্দ জীবনমায়ায়।—সে একটা অপূর্ব শক্তি অনুভব করে নিজের মধ্যে—এটা যেন বাহিরে প্রকাশ করিবার জিনিস-মনে-মনে ধরিয়া রাখার নয়। কোথায় থাকিবে প্রণব আর মন্মথ?…সবাই মামুলি কথা বলে। সক বিষয়ে এই মামুলি ধরন যেন তাহাদের দেশের একচেটে হইয়া উঠিতেছে—যেমন গরুড়ের মতো ডিম ফুটিয়া বাহির হইয়া সারা পৃথিবীটার রসভাণ্ডার গ্রাস করিতে ছুটিতেছে, সে তীব্র আগ্রহ ভরা পিপাসার্ত নবীন মনের সকল কানা তাহাতে তৃপ্ত হয় না। ইহারই বিরুদ্ধে, ইহাদের সকলের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হইবে, সব ওলট-পালট করিয়া দিবার নিমিত্ত সঙ্ঘবদ্ধ হইতে হইবে তাহাদিগকে এবং সে-ই হইবে তাহার অগ্রণী।
দিন কতক ধরিয়া অপু ক্লাসে ছেলেদের মধ্যে তাহার স্বভাবসিদ্ধ ধরনে গর্ব করিয়া বেড়াইল যে, এমন প্রবন্ধ পড়িবে যাহা কেহ কোনদিন লিখিবার কল্পনা করে নাই, কেহ কখনও শোনে নাই ইত্যাদি। লজিকের ঘোকরা-প্রোফেসার ইউনিয়নের সেক্রেটারি, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি বলে নোটিশ দেবো তোমার প্রবন্ধের হে, বিষয়টা কি?
পরে নাম শুনিয়া হাসিয়া বলিলেন,-বেশ, বেশ! নামটা বেশ দিয়েছ—but why totপুরাতনের বাণী? অপু হাসিমুখে চুপ করিয়া রহিল। নির্দিষ্ট দিনে যদিও ভাইস-প্রিন্সিপ্যালের সভাপতি হইবার কথা নোটিশে ছিল, তিনি কাৰ্যবশত আসিতে পারিলেন না। ইতিহাসের অধ্যাপক মিঃ বসুকে সভাপতির আসনে বসিতে সকলে অনুরোধ করিল। ভিড় খুব হইয়াছে, প্রকাশ্য সভায় অনেক লোকের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কিছু করা অপুর এই প্রথম। প্রথমটা তাহার পা কাঁপিল, গলাও খুব কাঁপিল, কিন্তু ক্ৰমে বেশ সহজ হইয়া আসিল। প্রবন্ধ খুব সতেজ-এ বয়সে যাহা কিছু দোষ থাকে—উচ্ছাস, অনভিজ্ঞ আইডিয়ালিজম-ভালো মন্দ নির্বিশেষে পুরাতনকে ছাঁটিয়া ফেলিবার দম্ভ-বেপরোয়া সমালোচনা, তাহার প্রবন্ধে কোনটাই বাদ যায় নাই। প্রবন্ধ পড়িবার পরে খুব হৈ-চৈ হইল। খুব তীব্র সমালোচনা হইল। প্রতিপক্ষ কড়া কড়া কথা শুনাইয়া দিতে ছাড়িল না। কিন্তু অপু দেখিল অধিকাংশ সমালোচকই ফাঁকা আওয়াজ করিতেছে। সে যাহা লইয়া প্রবন্ধ লিখিয়াছে, সে বিষয়ে কাহারও কিছু অভিজ্ঞতাও নাই, বলিবার বিষয়ও নাই, তাহারা তাহাকে মন্মথর শ্রেণীতে ফেলিয়া দেশদ্রোহী, সমাজদ্রোহী বলিয়া গালাগালি দিতে শুরু করিয়াছে।
অপু মনে মনে একটু বিস্মিত হইল। হয়তো সে আরও পরিস্ফুট করিয়া লিখিলে ভালো করিত। জিনিসটা কি পরিষ্কার হয় নাই? এত বড়ো সভার মধ্যে তাহার নিতান্ত অন্তরঙ্গ দু-একজন বন্ধু ছাড়া সকলেই তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছে,টিটকারি গালাগালি অংশের জন্য মন্মথকে হিংসা করার তাহার কিছুই নাই। শেষে সভাপতি তাহাকে প্রতিবাদের উত্তর দিবার অধিকার দেওয়াতে সে উঠিয়া ব্যাপারটা আরও খুলিয়া বলিবার চেষ্টা করিল। দু-চারজন সমালোচক—যাহাদের প্রতিবাদ সে বসিয়া নোট করিয়া লইয়াছিল, তাহাদিগকে উত্তর দিতে গিয়া যুক্তির খেই হারাইয়া ফেলিল। অপর পক্ষ এই অবসরে আর এক পালা হাসিয়া লইতে ছাড়িল না। অপু রাগিয়া গিয়াছিল, এইবার যুক্তির পথ না ধরিয়া উচ্ছাসের পথ ধরিল। সকলকে সংকীর্ণমনা বলিয়া গালি দিল, একটা বিদ্রুপাত্মক গল্প বলিয়া অবশেষে টেবিলের উপর একটা কিল মারিয়া এমার্সনের একটা কবিতা আবৃত্তি করিতে করিতে বক্তৃতার উপসংহার করিল।
ছেলেদের দল খুব গোলমাল করিতে করিতে হলের বাহির হইয়া গেল। বেশির ভাগ ছেলে তাহাকে যা তা বলিতেছিল নিছক বিদ্যা জাহির করিবার চেষ্টা ছাড়া তাহার প্রবন্ধ যে অন্য কিছুই নহে, ইহাও অনেকের মুখে শোনা যাইতেছে। সে শেষের দিকে এমার্সনের এই কবিতাটি আবৃত্তি করিয়াছিল—
I am the owner of the sphere
Of the seven stars and the solar year.
তাহাতেই অনেকে তাহাকে দাম্ভিক ঠাওরাইয়া নানারূপ বিদ্রুপ ও টিটকারি দিতেও ছাড়িল। কিন্তু অপু ও-কবিতাটায় নিজেকে আদৌ উদ্দেশ করে নাই, যদিও তাহার নিজেকে জাহির করার স্পৃহাও কিছু কম ছিল না বা মিথ্যা গর্ব প্রকাশে সে ক্লাসের কাহারও অপেক্ষা কম নহে, বরং বেশি।
তাহার নিজের দলের কেহ কেহ তাহাকে ঘিরিয়া কথা বলিতে বলিতে চলিল। ভিড় একটু কমিয়া গেলে সে সকলের নিকট হইতে বিদায় লইয়া কলেজ হইতে বাহির হইতে যাইতেছিল, গেটের কাছে একটি সতেরো-আঠারো বছরের লাজুক প্রকৃতির ছেলে তাহাকে বলিল—একটুখানি দাঁড়াবেন?
অপু ছেলেটিকে চেনে না, কখনও দেখে নাই। একহারা, বেশ সুশ্রী, পাতলা সিল্কের জামা গায়ে, পায়ে জরির নাগরা জুতা।
ছেলেটি কুষ্ঠিতভাবে বলিল,-আপনার প্রবন্ধটা আমায় একটু পড়তে দেবেন? কাল আবার আপনাকে ফেরত দেব।
অপুর আহত আত্মাভিমান পুনরায় হঠাৎ ফিরিয়া আসিল। খাতাখানা ছেলেটির হাতে দিয়া বলিল,-দেখবেন কাইন্ডলি, যেন হারিয়ে না যায়—আপনি বুঝি-সায়েন্স-ও।
পরদিন কলেজ বসিবার সময় ছেলেটি গেটেই দাঁড়াইয়াছিল—-অপুর হাতে খাতাখানা ফিরাইয়া দিয়া ছোট একটি নমস্কার করিয়াই ভিড়ের মধ্যে কোথায় চলিয়া গেল। অন্যমনস্ক ভাবে ক্লাসে বসিয়া অপু খাতাখানা উলটাইতেছিল, একখানা কি কাগজ খাতাখানার ভিতর হইতে বাহির হইয়া ইলেকট্রিক পাখার হাওয়ায় খানিকটা উড়িয়া গেল। পাশের ছেলেটি সেখানা কুড়াইয়া তাহার হাতে দিলে সে পড়িয়া দেখিল, পেন্সিলে লেখা একটি কবিতা–তাহাকে উদ্দেশ করিয়া–
শ্ৰীযুক্ত অপূর্বকুমার রায়
করকমলেষু–
বাঙ্গালী সমাজ যেন পঙ্কময় বদ্ধ জলাশয়
নাহি আলো স্বাস্থ্যভরা, বহে হেথা বায়ু বিষময়
জীবন-কোরকগুলি, অকালে শুকায়ে পড়ে ঝরি,
বাঁচাবার নাহি কেহ, সকলেই আছে যেন মরি।
নাহি চিন্তা, নাহি বুদ্ধি, নাহি ইচ্ছা, নাহি উচ্চ আশা,
সুখদুঃখহীন এক জড়পিণ্ড, নাহি মুখে ভাষা।
এর মাঝে দেখি যবে কোনো মুখ উজ্জ্বল সরল,
নয়নে আশার দৃষ্টি, ওষ্ঠপ্রান্তে জীবন হরষ–
অধরে ললাটে ভূতে প্রতিভার সুন্দর বিকাশ,
স্থির দৃঢ় কণ্ঠস্বরে ইচ্ছাশক্তি প্রত্যক্ষ প্রকাশ,
সম্ভমে হৃদয় পুরে আনন্দ ও আশা জাগে প্রাণে,
সম্ভাষিতে চাহে হিয়া বিমল প্রীতির অর্ঘ্যদানে।
তাই এই ক্ষীণ-ভাষা ছন্দে গাঁথি দীন উপহার
লজ্জাহীন অসংকোচে আনিয়াছি সম্মুখে তোমার,
উচ্চলক্ষ্য, উচ্চআশা বাঙ্গালায় এনে দাও বীর
সুযোগ্য সন্তান যে রে তোরা সবে বঙ্গ-জননীর।
গুণমুগ্ধ
শ্রী–
ফার্স্ট ইয়ার, সায়েন্স, সেকশন বি।
অপু বিস্মিত হইল। আগ্রহের ও ঔৎসুক্যের সহিত আর একবার পড়িল—তাহাকে উদ্দেশ করিয়া লেখা এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। একে চায় তো আরে পায়,—একেই নিজের কথা পরকে জাক করিয়া বেড়াইতে সে অদ্বিতীয়, তাহার উপর তাহারই উদ্দেশে লিখিত এক অপরিচিত ছাত্রের এই পত্র পাইয়া আনন্দে ও বিস্ময়ে সে ভুলিয়া গেল যে, ক্লাসে স্বয়ং মিঃ বসু ইতিহাসের বক্তৃতায় কোন এক রোমান সম্রাটের অমানুষিক ঔদরিকতার কাহিনী সবিস্তারে বলিতেছেন। সে পাশের ছেলেকে ডাকিয়া পত্ৰখানা দেখাইতে যাইতেই জানকী খোঁচা দিয়া বলিল,—এই! সি.সি.বি. এক্ষুনি শকে উঠবে—তোর দিকে তাকাচ্ছে, সামনে চা—এই!
আঃ—কতক্ষণে সি.সি.বি.-র এই বাজে বকুনি শেষ হইবে! বাহিরে গিয়া সকলকে চিঠিখানা দেখাইতে পারিলে যে সে বাঁচে।—ছেলেটিকেও খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে।
ছুটির পর গেটের কাছেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা হইল। বোধ হয় সে তাহারই অশ্বক্ষায় দাঁড়াইয়াছিল। কলেজের মধ্যে এইরূপ একজন মুগ্ধ ভক্ত পাইয়া অপু মনে মনে গর্ব অনুভব করিয়াছিল বটে, কিন্তু সেই তাহার পুরাতন মুখচোরা লোগ! তবে তাহার পক্ষে একটু সাহসের বিষয় এই দাঁড়াইল যে, ছেলেটি তাহার অপেক্ষাও লাজুক। অপু গিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কিছুক্ষণ ইতস্তত করিয়া তাহার হাত ধরিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হইল। কেহই কাগজে লেখা পদ্যটার কোনও উল্লেখ করিল না, যদিও দুজনেই বুঝিল যে, তাহাদের আলাপের মূলে কালকের সেই চিঠিখানা। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি বলিল-চলুন কোথাও বেড়াতে যাই, কলকাতার বাইরে কোথাও মাঠে–শহরের মধ্যে হাঁপ ধরে—কোথাও একটা ঘাস দেখবার জো নেই—
কথাটা শুনিয়াই অপুর মনে হইল, এ ছেলেটি তো সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃতির। ঘাস না দেখিয়া কষ্ট হয় এমন কথা তো আজ প্রায় এক বৎসর কলিকাতার অভিজ্ঞতায় কলেজের কোন বন্ধুর মুখে শোনে নাই।
সাউথ সেকশনের ট্রেনে গোটাচারেক স্টেশন পরে তাহারা নামিল। অপু কখনও এদিকে আসে নাই। ফাঁকা মাঠ, কেয়া বোপ, মাঝে মাঝে হোগলা বন। সরু মেঠো পথ ধরিয়া দুজনে হাঁটিয়া চলিতেছিল-ট্রেনের অল্প আধঘণ্টার আলাপেই দুজনের মধ্যে একটা নিবিড় পরিচয় জমিয়া উঠিল। মাঠের মধ্যে একটা গাছের তলায় ঘাসের উপরে দুজনে গিয়া বসিল।
ছেলেটি নিজের ইতিহাস বলিতেছিল–
হাজারিবাগ জেলায় তাহাদের এক অদ্রের খনি ছিল, ছেলেবেলায় সে সেখানেই মানুষ। জায়গাটার নাম বড়বনী, চারিধারে পাহাড় আর শাল-পলাশের বন, কিছু দূরে দারুকের নদী। নিকট পাহাড়ের গায়ে একটা ঝরনা…পড়ন্ত বেলায় শালবনের পিছনের আকাশটা কত কি রঙে রঞ্জিত হইত-প্রথম বৈশাখে শাল-কুসুমের ঘন সুগন্ধ দুপুরে রৌদ্রকে মাতাইত, পলাশবনে বসন্তের দিনে যেন ডালে ডালে আরতির পঞ্চপ্রদীপ জ্বলিত-সন্ধ্যার পরই অন্ধকারে গা ঢাকিয়া বাঘেরা আসিত ঝরনার জল পান করিতে—বাংলো হইতে একটু দূরে বালির উপর কতদিন সকালে বড়ো বড়ো বাঘের পায়ের থাবার দাগ দেখা গিয়াছে।
সেখানকার জ্যোৎস্না রাত্রি! সে রাত্রির বর্ণনা নাই, ভাষা জোগায় না। স্বর্গ যেন দূরের নৈশকুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট পাহাড়শ্রেণীর ওপারে–ছায়াহীন, সীমাহীন, অনন্তরসক্ষরা জ্যোৎস্না যেন দিকচক্রবালে তাহারই ইঙ্গিত দিত।
এক-আধদিন নয়, শৈশবের দশ-দশটি বৎসর সেখানে কাটিয়াছে। সে অন্য জগৎ, পৃথিবীর মুক্ত প্রসারতার রুপ সেখানে চোখে কি মায়া-অঞ্জন মাখাইয়া দিয়াছে—কোথাও আর ভালো লাগে না! অভ্রের খনিতে লোকসান হইতে লাগিল, খনি অপরে কিনিয়া লইল, তাহার পর হইতেই কলিকাতায়। মন হাঁপাইয়া উঠে-খাঁচার পাখির মতো ছটফট করে। বাল্যের সে অপূর্ব আনন্দ মন হইতে নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া গিয়াছে।
অপু এ ধরনের কথা কাহারও মুখে এ পর্যন্ত শোনে নাই—এ যে তাহারই অন্তরের কথার প্রতিধ্বনি। গাছপালা, নদী, মাঠ ভালোবাসে বলিয়া দেওয়ানপুরে তাহাকে সবাই বলিত পাগল। একবার মাঘ মাসের শেষে পথে কোন গাছের গায়ে আলোকলতা দেখিয়া রমাপতিকে বলিয়াছিল, কেমন সুন্দর! দেখুন দেখুন রমাপতিদা–
রমাপতি মুরুব্বিয়ানার সুরে বলিয়াছিল মনে আছে—ওসব যার মাথায় ঢুকেছে তার পরকালটি একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেছে।
পরকালটা কি জন্য যে ঝরঝরে হইয়া গিয়াছে, একথা সে বুঝিতে পারে নাই—কিন্তু ভাবিয়াছিল রমাপতিদা স্কুলের মধ্যে ভালো ছেলে, ফার্স্ট ক্লাসের ছাত্র, অবশ্যই তাহার অপেক্ষা ভালো জানে। এ পর্যন্ত কাহারও নিকট হইতেই সে ইহার সায় পায় নাই, এই এতদিন পরে ইহাকে ছাড়া। তাহা হইলে তাহার মতো লোকও আছে!…সে একেবারে সৃষ্টিছাড়া নয়!…
অনিল বলিল-দেখুন, এই এত ছেলে কলেজে পড়ে, অনেকের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি ভালো লাগে না—dull, unimaginative mind, পড়তে হয় পড়ে যাচ্ছে, বিশেষ কোন বিষয়ে কৌতূহলও নেই, জানবার একটা সত্যিকার আগ্রহও নেই। তাছাড়া এত হোট কথা নিয়ে থাকে যে, মন মোটে-মানে, কেমন যেন,—যেন মাটির উপর hop করে বেড়ায়। প্রথম সেদিন আপনার কথা শুনে মনে হল, এই একজন অন্য ধরনের, এ দলের নয়।
অপু মৃদু হাসিয়া চুপ করিয়া রহিল। এসব সে-ও নিজের মনের মধ্যে অস্পষ্ট ভাবে অনুভব করিয়াছে, অপরের সঙ্গে নিজের এ পার্থক্য মাঝে মাঝে তাহার কাছে ধরা পড়িলেও সে নিজের সম্বন্ধে আদৌ সচেতন নয় বলিয়া এ জিনিসটা বুঝিতে পারিত না। তাহা ছাড়া অপুর প্রকৃতি আরও শান্ত, উগ্রতাশূন্য ও উদার,—পরের তীব্র সমালোচনা ও আক্রমণের ধাতই নাই তাহার একেবারে। কিন্তু তাহার একটা মহৎ দোষ এই যে নিজের বিষয়ে কথা একবার পাড়িলে সে আর ছাড়িতে চায় না—অপরেও যে নিজেদের সম্বন্ধে বলিতে ইচ্ছা করিতে পারে, তরুণ বয়সের অনাবিল আত্মম্ভরিতা ও আত্মপ্রত্যয় সে বিষয়ে তাহাকে অন্ধ করিয়া রাখে। সুতরাং সে নিজের বিষয়ে একটানা কথা বসিয়া যায় নিজের ইচ্ছা, আশা-আকাঙক্ষা, নিজের ভালোমন্দ লাগা, নিজের পড়াশুনা। নিজের কোন দুঃখদুর্দশার কথা বলে না, কোন ব্যথা-বেদনার কথা তোলে না-জলের উপরকার দাগের মতো সেসব কথা তাহার মনে মোটে স্থান পায় না। আনকোরা তাজা নবীন চোখের দৃষ্টি শুধুই সম্মুখের দিকে, সম্মুখের বহুদূর দিকচক্রবাল রেখারও ওপারে—আনন্দ ও আশায় ভরা এক অপূর্ব রাজ্যের দিকে।
সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরিয়া চিমনি-ভাঙা পুরোনো হিক্কসের লণ্ঠনটা জ্বালিয়া সে পকেট হইতে অনিলের চিঠিখানা বাহির করিয়া আবার পড়িতে বসিল। আমায় যে ভালো বলে, সে আমার পরম বন্ধু, আমার মহৎ উপকার করে, আমার আত্মপ্রত্যয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত হইতে সাহায্য করে, আমার মনের গভীর গোপন কোনও সুকানো রতুকে দিনের আলোয় মুখ দেখাইতে সাহস দেয়।
পড়িতে পড়িতে পাশের বিছানার দিকে চাহিয়া মনে পড়ে—আজ আবার তাহার ঘরের অপর লোকটির এক আত্মীয় কাঁচরাপাড়া হইতে আসিয়াছে এবং এই ঘরেই শুইবে। সে আত্মীয়টির বয়স বছর ত্রিশেক হইবে; কাঁচরাপাড়া লোকো অফিসে চাকরি করে, বেশি লেখাপড়া না জানিলেও অনবরত যা-তা ইংরেজি বলে, হরদম সিগারেট খায়, অত্যন্ত বকে, অকারণে গায়ে পড়িয়া ভাই ভাই বলিয়া কথা বলে, তাহার মধ্যে বারো আনা থিয়েটারের গল্প, অমুক অ্যাকট্রেস তারাবাঈ-এর ভূমিকায় যে রকম অভিনয় করে, অমুক থিয়েটারের বিধুমুখীর মতো গান—বিশেষ করিয়া হীরার দুল প্রহসনে বেদেনীর ভূমিকায়, নয়ন জলের ফাঁদ পেতেছি নামক সেই বিখ্যাত গানখানি সে যেমন গায়, তেমন আর কোথায়, কে গাহিতে পারে?—তিনি এজন্য বাজি ফেলিতে প্রস্তুত আছেন।
এসব কথা অপুর ভালো লাগে না, থিয়েটারের কথা শুনিতে তাহার কোনও কৌতূহল হয় না। এ লোকটির চেয়ে আলুর ব্যবসাদারটি অনেক ভালো। সে পাড়াগাঁইয়ের লোক, অপেক্ষাকৃত সরল প্রকৃতির, আর এত বাজে কথা বলে না; অন্তত তাহার সঙ্গে তো নয়ই। এ ব্যক্তিটির যত গল্প তাহার সঙ্গে।
মনে মনে ভাবে—একটু ইচ্ছে করে—বেশ একা একটি ঘর হয়, একা বসে পড়াশুনো করি, টেবিল থাকে একটা, বেশ ফুল কিনে এনে গ্লাসের জলে দিয়ে সাজিয়ে রাখি। এ ঘরটায় না আছে জানালা, পড়তে পড়তে একটু খোলা আকাশ দেখবার জো নাই, তামাকের গুল রোজ পরিষ্কার করি, আর রোজ ওরা এইরকম নোংরা করবে—মা ওয়াড় করে দিয়েছিল, ছিড়ে গিয়েছে, কি বিশ্রী তেলচিটচিটে বালিশটা হয়েছে। এবার হাতে পয়সা হলে একটা ওয়াড় করব।
অনিলের সঙ্গে পরদিন বৈকালে গঙ্গার ধারে বেড়াইতে গেল। চাদপাল ঘাটে, প্রিন্সেপ ঘাটে বড়ো বড়ো জাহাজ নোঙর করিয়া আছে, অপু পড়িয়া দেখিল : কোনটার নাম বম্বে, কোনটা নাম ইদজ্জু মারু। সেদিন বৈকালে নতুন ধরনের রং-করা একখানা বড় জাহাজ দেখিয়াছিল, নাম লেখা আছে শেনানডোয়া, অনিল বলিল, আমেরিকান মাল জাহাজ-জাপানের পথে আমেরিকায় যায়। অপু অনেক শ দাঁড়াইয়া জাহাজখানি দেখিল। নীল পোশাক পরা একটা লস্কর রেলিং ধরিয়া কিয়া পরা কালের মধ্যে কি দেখিতেছে। লোকাট কি সুখী। কত দেশবিদেশে বেড়ায়, কত সমুদ্রে পাড়ি দেয়, চীন সমুদ্রে টাইফুনে পড়িয়াছে, পিনাং-এর নারিকেলকুগের গুয়ায় কত দুপুর কাটাইয়ারে কত ঝড়বৃষ্টির মাত্র এই রকম রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া বাত্যা, উত্তাল, উন্মত্ত মহাসমুদ্রের রুপ দেখিয়াহে। কি ও লোকটা বোৰে কি? কিছুই না। ও কি দূর হইতে ফুজিয়ামা দেখিয়া আত্মহারা হইয়াছে? দক্ষিণ আমেরিকার কোনও বন্দরে নামিয়া পথের ধারে কি গাছপালা আছে তাহা নিবিষ্ট মনে সাগ্রহে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে? হয়তো জাপানের পথের ধারে বাংলা দেশের পরিচিত কোনও ফুল আছে, ও লোকটি জানে না, হয়তো ক্যালিফোর্নিয়ার শহরবন্দর হইতে দূরে নির্জন Sierra-র ঢালুতে বনঝোপের নানা অচেনা ফুলের সঙ্গে তাহাদের দেশের সন্ধ্যামণি ফুলও ফুটিয়া থাকে, ও লোকটা কি কখনও সেখানে সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় বড়ো একখণ্ড পাথরের উপর আপন মনে বসিয়া নীল আকাশের দিকে চাহিয়া থাকিয়াছে?
অথচ ও লোকটারই অদৃষ্টে ঘটিতেছে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, সমুদ্রে-সমুদ্রে বেড়ানোযাহার চোখ নাই, দেখিতে জানে না; আর সে যে শৈশব হইতে কত সাধ পুষিয়া রাখিয়া আসিতেছে মনের কোণে, তাহার কি কিছুই হইবে না? …কবে যে সে যাইবে! …কলিকাতার শীতের রাত্রের এ ধোঁয়া তাহার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। চোখ জ্বালা করে, নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে, কিছু দেখা যায় না, মন তাহার একেবারে পাগল হইয়া ওঠে—এ এক অপ্রত্যাশিত উপদ্রব! কে জানিত শীতকালে কলিকাতার এ চেহারা হয়।
ওই লোকটার মতো জাহাজের খালাসী হইতে পারিলেও সুখ ছিল!
Ship ahoy! …কোথাকার জাহাজ?…
কলিকাতা হইতে পোর্ট মর্সবি, অস্ট্রেলেশিয়া,
ওটা কি উঁচুমতো দুরে?
প্রবালের বড়ো বাঁধThe Great Barrier Reef–
এই সমুদ্রের ঠিক এই স্থানে, প্রাচীন নাবিক টাসম্যান ঘোর তুফানে পড়িয়া মাস্তুল ভাঙা পালহেঁড়া ডুবু ডুবু অবস্থায় অকূলে ভাসিতে ভাসিতে বারো দিনের দিন কুল দেখিতে পান সেইটাই—সেকালে ভ্যান ডিমেনল্যান্ড, বর্তমানে টাসমেনিয়া।…কেমন দূরে নীল চক্রবালরেখা!…উড়ন্ত সিন্ধু-শকুনদলের মাতামাতি, প্রবালের বাঁধের উপর বড়ো বড় ঢেউয়ের সবেগে আছড়াইয়া পড়ার গম্ভীর আওয়াজ।
উপকূলরেখার অনেক পিছনে যে পাহাড়টা মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে, ওটা হয়তো জলহীন দিক-দিশাহীন ধু ধু নির্জন মরুর মধ্যে…শুধুই বালি আর শুকনা বাবুল গাছের বন,…শত শত ক্রোশ দূরে ওর অজানা অধিত্যকায় লুকানো আছে সোনার খনি, কালো ওপ্যালের খনি…এই খর, জ্বলন্ত, মরুরৌদ্রে খনির সন্ধানে বাহির হইয়া কত লোক ওদিকে গিয়াছিল আর ফেরে নাই, মরুদেশের নানা স্থানে তাহাদের হাড়গুলা রৌদ্রে বৃষ্টিতে ক্ৰমে সাদা হইয়া আসিল।
অনিল বলিল, চলুন, আজ সন্ধে হয়ে গেল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাহাজ দেখে আর কি হবে?…
অপু সমুদ্র-সংক্রান্ত বহু বই কলেজ লাইব্রেরি হইতে পড়িয়া ফেলিয়াছে! কেমন একটা নেশা, কখনও কোন ছাত্র যাহা পড়ে না, এমন সব বই। বহু প্রাচীন নাবিক ও তাহাদের জলযাত্রার বৃত্তান্ত, নানা দেশ আবিষ্কারের কথা, সিবাস্টিয়ান ক্যাবট, এরিকসন, কটেজ ও পিজারো কর্তৃক মেক্সিকো ও পেরু বিজয়ের কথা। দুর্ধর্ষ স্পেনীয় বীর পিজারো ব্রেজিলের জঙ্গলে রুপার পাহাড়ের অনুসন্ধানে গিয়া কি করিয়া জঙ্গলের মধ্যে পথ হারাইয়া বেঘোরে অনাহারে সসৈন্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইল—আরও কত কি।
পরদিন কলেজ পালাইয়া দু-জনে দুপুরবেলা স্টান্ড রোডের সমস্ত স্টিমার কোম্পানির অফিসগুলি ঘুরিয়া বেড়াইল। প্রথমে পি. এভ, ও.। টিফিনের সময় কেরানীবাবুরা নিচের জলখাবার ঘরে বসিয়া চা খাইতেছেন, কেহ বিড়ি টানিতেছেন। অপু পিছনে রহিল, অনিল আগাইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—আচ্ছে, আমরা জাহাজে চাকরি খুত্ষজছি, এখানে খালি আছে জানেন?
একজন ঢাক-পড়া নোগা চেহারার বাবু বলিলেন,চাকরি? জাহাজে…কোন জাহাজে?
-যে কোন জাহাজে–
অপুর বুক উত্তেজনায় ও কৌতূহলে টিপ টিপ করিতেছিল, কি বুঝি হয়।
বাবুটি বলিলেন, জাহাজের চাকরিতে তোমাদের চলবে না হে হোকরা-দ্যাখো, একবার ওপরে মেরিন মাস্টারের ঘরে খোঁজ করো।
কিছুই হইল না। বি.আই.এস.এন তথৈবচ। নিপইউশেনকাইশাও তাই! টার্নার মরিসনের অফিসে তাহাদের সহিত কেহ কথাও কহিল না। বড়ো বড়ো বাড়ি, সিঁড়ি ভাঙিয়া ওঠানামা করিতে করিতে শীতকালেও ঘাম দেখা দিল। অবশেষে, মরীয়া হইয়া অপু গ্লাডস্টোন ওয়াইলির অফিসে চারতলায় উঠিয়া মেরিন মাস্টারের কামরায় ঢুকিয়া পড়িল। খুব দীর্ঘদেহ, অত বড়ো গোঁফ সে কখনও কাহারও দেখে নাই। সাহেব বিরক্ত হইয়া ঘণ্টা বাজাইয়া কাহাকে ডাক দিল। অপুর কথা কানেও তুলিল না। একজন প্রৌঢ় বয়সের বাঙালিবাবু ঘরে ঢুকিয়া ইহাদের দেখিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিলেন—এ ঘরে কি? এসো, এসো, বাইরে এসো।
বাহিরে গিয়া অনিলের মুখে আসিবার উদ্দেশ্য শুনিয়া বলিলেন, কেন হে ছোকরা? বাড়ি থেকে রাগ করে পালাচ্ছ?
অনিল বলিল-না রাগ করে কেন পালাব?
-রাগ করে পালাচ্ছ না তো, এ মতি হল কেন? জাহাজে চাকরি খুঁজছে–কোন্ চাকরি হবে জানো? খালাসির চাকরি…এক বছরের এগ্রিমেন্টে জাহাজে উঠতে হবে। বাঙালির খাওয়া জাহাজে পাবে না…কষ্টের শেষ হবে, লস্করগুলো অত্যন্ত বদমায়েস, তোমাদের সঙ্গে বনবে না। আরও নানা কষ্ট-স্টোকারের কাজ পাবে, কয়লা দিতে দিতে জান হয়রান হবে—সে সব কি তোমাদের কাজ?
-এখন কোন জাহাজ ছাড়ছে নাকি?
-জাহাজ তো ছাড়ছে গোলকুণ্ডা—আর সাতদিন পরে মঙ্গলবারে ছাড়বে মাল জাহাজ কলম্বো হয়ে ডারবান যাবে।
দুজনেই মহা পীড়াপীড়ি শুরু করিল। তাহাদেব কোনও কষ্ট হইবে না, কষ্ট কবা তাহাদের অভ্যাস আছে। দয়া করিয়া তিনি যদি কোন ব্যবস্থা করেন। অপু প্রায় কাদ-কাদ হইয়া বলিল—তা হোক, দিন আপনি জোগাড় করে—ওসব কিছু কষ্ট না—দিন আপনি—গোরা লস্করে কি করবে আমাদের? কয়লা খুব দিতে পারব
কেরানীবাবুটি হাসিয়া বলিলেন,—একি ছেলেখেলা হে ছোকরা! কয়লা দেবে তোমবা বুঝতে তো পারছে না সেখানকার কাণ্ডকারখান! বয়লারের গরম, হাওয়া নেই, দম বন্ধ হয়ে আসবে, চার শভেল কয়লা দিতে না দিতে হাতের শিরা দড়ির মতো ফুলে উঠবে—আর তাতে ওই ডেলিকেট হাত-হপ জিবুতে দেবে না, দাঁড়াতে দেখলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মারবে চাবুক দশ হাজার ঘোড়ার জোরের এঞ্জিনের স্টিম বজায় রাখতে হবে সব সময়, নিঃশ্বাস ফেলবার সময় পাবে না—আর গরম কি সোজা! কুম্ভীপাক নরকের গরম ফার্নেসের মুখে। সে তোমাদের কাজ?…
তবুও দুজনে ছাড়ে না।
ইহারা যে বাড়ি হইতে পালাইয়া যাইতেছে, সে ধারণা বাবুটির আরও দৃঢ় হইল। বলিলেন,নাম ঠিকানা দিয়ে যাও তো তোমাদের বাড়ির। দেখি তোমাদের বাড়িতে না হয় নিজে একবার যাব।
কোনো রকমেই তাহাকে রাজি করাইতে না পারিয়া অবশেষে তাহারা চলিয়া আসিল।
০৮. একদিন অপু দুপুরবেলা
অষ্টম পরিচ্ছেদ
একদিন অপু দুপুরবেলা কলেজ হইতে বাসায় ফিরিয়াস আসিয়া গায়ের জামা খুলিতেছে, এমন সময় পাশের বাড়ির জানালাটার দিকে হঠাৎ চোখ পড়িতে সে আর চোখ ফিরাইয়া সইতে পারিল না। জানালাটার গায়ে খড়ি দিয়া মাঝারি অক্ষরে মেয়েলি ছাঁদে লেখা আছে—হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে। অপু অবাক হইয়া খানিকটা সেদিকে চাহিয়া রহিল এবং পরক্ষণেই কৌতুকের আবেগে হাতের নোটখাতাখানা মেজেতে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া আপন মনে হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
পাশের বাড়ি—তাহার ঘরটা হইতে জানালাটা হাত পাঁচ ছয় দূরে—মধ্যে একটা সরু গলি। অনেকদিন সে দেখিয়াছে, পাশের বাড়ির একটি মেয়ে জানালার গরাদে ধরিয়া এদিকে চাহিয়া আছে, বয়স চৌদ্দ-পনেরো। রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কোকড়া কোঁকড়া চুল, বেশ মুখখানা, যদিও তাহাকে সুন্দরী বলিয়া কোনদিনও অপুর মনে হয় নাই। তাহার কলেজ হইতে আসিবার সময় হইলে প্রায়ই সে মেয়েটিকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিত, ক্রমে শুধু দাঁড়ানো নয়, মেয়েটি তাহাকে দেখিলেই হঠাৎ হাসিয়া জানালার আড়ালে মুখ লুকায়, কখনও বা জানলাটার খড়খড়ি বারকতক খুলিয়া বন্ধ করিয়া মনোযোগ আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করে, দিনের মধ্যে দুবার, তিনবার, চারবার কাপড় বদলাইয়া ঘরটার মধ্যে অকারণে ঘোরাফেরা করে এবং ছুতানাতায় জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়ায়। কতদিন এরকম হয়, অপু মনে মনে ভাবে—মেয়েটা আচ্ছা বেহায়া তো! কিন্তু আজকের এ ব্যাপার একেবারে অপ্রত্যাশিত।
আজ ও-বেলা উড়ে ঠাকুরের হোটেলে খাইতে গিয়া সে দেখিয়াছিল, সুন্দর ঠাকুর মুখ ভার করিয়া বসিয়া আছে। দুই-তিন মাসের টাকা বাকি, সামান্য পুঁজির হোটেল, অপূর্ববাবু ইহার কি ব্যবস্থা করিতেছেন?…আর কতদিন এভাবে সে বাকি টানিয়া যাইবে?…সুন্দর ঠাকুরের কথায় তাহার মনে যে দুর্ভাবনার মেঘ জমিয়াছিল, সেটা কৌতুকের হাওয়ায় এক মুহূর্তে কাটিয়া গেল!—আচ্ছা তো মেয়েটা? দ্যাখো কি লিখে রেখেছে—ওদের-হো-হো—আচ্ছা—হি-হি–
সেদিন আর মেয়েটিকে দেখা গেল না, যদিও সন্ধ্যার সময় একবার ঘরে ফিরিয়া সে দেখিল, জানালার সে খড়ির লেখা মুছিয়া ফেলা হইয়াছে। পরদিন সকালে ঘরের মধ্যে মাদুর বিছাইয়া পড়িতে পড়িতে মুখ তুলিতেই অপু দেখিতে পাইল, মেয়েটি জানালার ধারে দাঁড়াইয়া আছে। কলেজে যাইবার কিছু আগে মেয়েটি আর একবার আসিয়া দাঁড়াইল। সবে স্নান সারিয়া আসিয়াছে, লালপাড় শাড়ি পরনে, ভিজে চুল পিঠের উপর ফেলা, সোনার বালা পরা নিটোল ডান হাতটি দিয়া জানালার গরাদে ধরিয়া আছে। অল্পক্ষণের জন্য–
কথাটা ভাবিতে ভাবিতে সে কলেজে গেল। সেখানে অনেকের কাছে ব্যাপারটা গল্প করিল। প্রণব তো শুনিয়া হাসিয়া খুন, জানকীও তাই। সবাই আসিয়া দেখিতে চায়—এ যে একেবারে সত্যিকার জানালা-কাব্য! সত্যেন বলিল, নভেল ও মাসিকের পাতায় পড়া যায় বটে, কিন্তু বাস্তব জগতে এরকম যে ঘটে তাহা তো জানা ছিল না!…নানা হাসি তামাশা চলিল, সকলেই যে ভদ্রতাসঙ্গত কথা বলিয়াই ক্ষান্ত রহিল তাহা বলিলে সত্যের অপলাপ করা হইবে।
তারপর দিনচারেক বেশ কাটিল, হঠাৎ একদিন আবার জানালায় লেখা—হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে। জানালার খড়খড়ির গায়ে এমনভাবে লেখা যে, জানালা খুলিয়া লম্বা কবজাটা মুড়িয়া ফেলিলে লেখাটা শুধু তাহার ঘর হইতেই দেখা যায়, অন্য কারুর চোখে পড়িবার কথা নহে। প্রণবটা যদি এ সময় এখানে থাকিত! তারপর আবার দিন-দুই সব ঠাণ্ডা।
সেদিন একটু মেঘলা ছিল—সকালে কয়েক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। দুপুরের পরই আবার খুব মেঘ করিয়া আসিল। কারখানার উঠানে মালবোঝাই মোটর লরিগুলার শব্দ একটু থামিলেও দুপুরের শিফট-এ মিস্ত্রিদের প্যাকবাক্সের গায়ে লোহার বেড় পরাইবার দুমদাম আওয়াজ বেজায়। এই বিকট আওয়াজের জন্য দুপুরবেলা এখানে তিষ্ঠানো দায়।
অপু ঘুমাইবার বৃথা চেষ্টা করিয়া উঠিয়া বসিতেই দেখিল, মেয়েটি জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। অল্পক্ষণের জন্য দুজনের চোখাচোখি হইল। মেয়েটি অন্য অন্য দিনের মতো আজও হাসিয়া ফেলিল। অপুর মাথায় দুষ্টুমি চাপিয়া গেল। সেও আগাইয়া গিয়া জানালার গরাদে ধরিয়া দাঁড়াইল-তারপর সে নিজেও হাসিল। মেয়েটি একবার পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল কেহ আসিতেছে কিনা—পরে সেও আসিয়া জানালার ধারে দাঁড়াইল। অপু কৌতুকের সুরে বলিল,-কি গো হেমলতা, আমায় বিয়ে করবে?
মেয়েটি বলিলকরব। কথা শেষ করিয়া সে হাসিয়া ফেলিল।
অপু বলিল,-কি জাত তোমরা—বামুন? আমি কিন্তু বামুন।
মেয়েটি খোঁপায় হাত দিয়া একটা কাঁটা ভাল করিয়া খুঁজিয়া দিতে দিতে বলিল—আমরাও বামুন।পরে হাসিয়া বলিল—আমার নাম তো জেনেছেন, আপনার নাম কি?
অপু বলিল, ভালো নাম অপূর্ব, আমরা বাঙ্গাল দেশের লোক-শহরের মেয়ে তোমরা–আমাদের তো দুচোখে দেখতেই পারো না—তাই না? তোমায় একটা কথা বলি শোন।…ওরকম লিখো না জানালার গায়ে যদি কেউ টের পায়?
মেয়েটি আর একবার পিছন ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, কে টের পাবে? কেউ দেখতে পায় না ওদিক থেকে আমি যাই, কাকিমা আসবে ঠাকুরঘর থেকে। আপনি বিকেলে রোজ থাকেন?
মেয়েটি চলিয়া গেলে অপুর হাসি পাইল। পাগল না তো? ঠিক—এতদিন সে বুঝিতে পারে নাই…মেয়েটি পাগল! মেয়েটির চোখে তাই কেমন একটা অদ্ভুত ধরনের দৃষ্টি। কথাটা মনে হইবার সঙ্গে সঙ্গে একটা গভীর করুণা ও অনুকম্পায় তাহার সারা মন ভরিয়া গেল। মেয়ের বাপকে সে মাঝে মাঝে প্রায়ই দেখে—প্রৌঢ়, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কোন অফিসের কেরানী বোধ হয়। সে কলেজে যাইবার সময় রোজ ভদ্রলোক ট্রামের অপেক্ষায় ফুটপাথের ধারে দাঁড়াইয়া থাকেন। হয়তো মেয়েটির বাবাই, নয়তো কাকা বা জ্যাঠামশায়, কি মামা-মোটর উপর তিনিই একমাত্র অভিভাবক। খুব বেশি অবস্থাপন্ন বলিয়া মনে হয় না। হয়তো তাহাকে দেখিয়া মেয়েটা ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছে— এরকম তো হয়!
তাহার ইচ্ছা হইল, এবার মেয়েটিকে দেখিতে পাইলে তাহাকে দুটা মিষ্ট কথা, দুটা সান্ত্বনাব কথা বলিবে। কেহ কিছু মনে করিবে? যদি নিতাইবাবু টের পায়?—পাইবে।
খবরের কাগজে সে মাঝে মাঝে ছেলে-পড়ানোর বিজ্ঞাপন খুঁজিত, একদিন দেখিল কোন একজন ডাক্তারের বাড়ির জন্য একজন প্রাইভেট টিউটর দরকার। গেল সে সেখানে। দোতলা বড়ো বাড়ি, নিচে বৈঠকখানা কিন্তু সেখানে বড়ো কেহ বসে না, ডাক্তারবাবুর কনসালটিং রুম দোতলার কোণের কামরায়, সেখানেই রোগীর ভিড়। অপু গিয়া দেখিল, নিচের ঘরটাতে অন্ন জন পনেরো নানা বয়সের লোক তীর্থের কাকের মতো হাঁ করিয়া বসিয়া—সেও গিয়া একপাশে বসিয়া গেল। তাহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, ওই বিজ্ঞাপনটা শুধু তাহারই চোখে পড়িয়াছে—এত সকালে, অত ঘোট ঘোট অক্ষরে এককোণে লেখা বিজ্ঞাপনটা—সেও ভাবিয়াছিল—উঃ…এ যে ভিড় দেখা যায় ক্রমেই বাড়িয়া চলিল।
কাহাকে পড়াইতে হইবে; কোন ক্লাসের ছেলে, কত বড়ো, কেহই জানে না। পাশের একটি লোক জিজ্ঞাসা করিল-মশাই জানেন কিছু, কোন ক্লাসের–
অপু বলিল, সেও কিছুই জানে না। একটি আঠারো উনিশ বছরের ছোরার সঙ্গে অপুর আলাপ হইল। ম্যাট্রিকুলেশন ফেল করিয়া হোমিওপ্যাথি পড়ে, টিউশনির নিতান্ত দরকার, ন হইলেই চলিবে না, সে নাকি কালও একবার আসিয়াছিল, নিজের দুরবস্থার কথা সব কর্তাকে জানাইয়া গিয়াছে, তাহার হইলেও হইতে পারে। ঘণ্টাখানেক ধরিয়া অপু দেখিতেছিল, কাঠের সিড়িটা বাহিয়া এক-একজন লোক উপরের ঘরে উঠিতেছে এবং নামিবার সময় মুখ অন্ধকার করিয়া পাশের দরজা দিয়া বাহিরে চলিয়া যাইতেছে। যদি তাহারও না হয়। পড়া বন্ধ করিয়া মনসাপোতা—কিন্তু সেখানেই বা চলিবে কিসে?
চাকর আসিয়া জানাইল, আজ বেলা হইয়া গিয়াছে, ডাক্তারবাবু কাহারও সঙ্গে এখন আর দেখা করিবেন না। এক-একখানা কাগজে সকলে নিজের নিজের নামধাম ও যোগ্যতা লিখিয়া রাখিয়া যাইতে পারেন, প্রয়োজন বুঝিলে জানানো যাইবে।
হেঁদো কথা। সকলেই একবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়িলপ্রত্যেকেরই মনে মনে বিশ্বাস-একবার গৃহস্বামী তাহাকে চাক্ষুষ দেখিয়া তাহার গুণ শুনিলে আর চাকুরি না দিয়া থাকিতে পারিবেন না! অপুও ভাবিল সে উপরে যাইতে পারিলে একবার চেষ্টা করিয়া দেখিত। তবে সে নিজের দুরবস্থার কথা কাহারও কাছে বলিতে পারিবে না। তাহার লজ্জা করে, দৈন্যের কঁদুনি গাহিয়া পরের সহানুভূতি আকর্ষণ করিবার চেষ্টা—অসম্ভব! লোকে কি করিয়া যে করে! প্রথম প্রথম সে কলিকাতায় আসিয়া ভাবিয়াছিল, কত বড়লোকের বাড়ি আছে কলিকাতায়, চাহিলে একজন দরিদ্র ছাত্রের উপায় করিয়া দিতে কেহ কুণ্ঠিত হইবে না। কত পয়সা তো তাহাদের কত দিকে যায়। কিন্তু তখন সে নিজেকে ভুল বুঝিয়াছিল, চাহিবার প্রবৃত্তি, পরের চোখে নিজেকে হীন প্রতিপন্ন করিবার প্রবৃত্তি, এ-সব তাহার মধ্যে নাইতাহার আছে—সে যাহা নয় তাহা হইতেও নিজেকে বড় বলিয়া জাহির করিবার, বাহাদুরি করিবার, মিথ্যা গর্ব করিয়া বেড়াইবার একটা কুঅভ্যাস। তাহার মায়ের নির্বুদ্ধিতা এই দিক দিয়া ছেলেতে বর্তাইয়াছে, একেবারে হুবহু অবিকল। এই কলিকাতা শহরে মহা কষ্ট পাইলেও সে নিতান্ত অন্তরঙ্গ এক-আধজন ছাড়া কখনও কাহাকে তাও নিজের মুখে কখনও কিছু বলে না। পাছে ভাবে গরিব।
ইতস্ততঃ করিয়া সেও অপরের দেখাদেখি কাঠের সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতে গেল। নিচের উঠান হইতে চাকর হাঁ হাঁ করিয়া উঠিল—আরে কাহে আপনোক উপরমে যাতে হেঁ…বাত্ নেহি মাতে হেঁ, এ বড়া মুশকিল। অপু সে কথা গ্রাহ্য না করিয়া উপরে উঠিয়া গেল। প্রৌঢ় বয়সের একটি ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে বসিয়া, হোমিওপ্যাথি-পড়া ছোকরাটির সঙ্গে কি তর্ক চলিতেছে বাহির হইতে বুঝা গেল—ছোকরাটি কি বলিতেছে, ভদ্রলোকটি কি বুঝাইতেছেন! সে ছোকরা একেবারে নাছোড়বান্দা, টিউশনি তাহার চাই-ই। ভদ্রলোকটি বলিতেছেন, ম্যাট্রিকুলেশন ফেল টিউটর দিয়া তিনি কি করিবেন? ক্রমে সকলে একে একে বাহিরে আসিয়া চলিয়া গেল। অপু ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া সসংকোচে বলিল–আপনাদের কি একজন পড়াবার লোক দরকার—আজ সকালের কাগজে বেরিয়েছে—
যেন সে এত লোকের ভিড়, উপরে উঠার নিষেধাজ্ঞা, কাগজে নামধাম লিখিয়া রাখিবার উপদেশ কিছুই জানে না! আসলে সে ইচ্ছা করিয়া এরুপ ভালোমানুষ সাজে নাই—অপরিচিত স্থানে আসিয়া অপরিচিত লোকের সহিত কথা কহিতে গিয়া আনাড়িপনার দরুন কথার মধ্যে নিজের অজ্ঞাতসারে একটা ন্যাকা সুর আসিয়া গেল।
ভদ্রলোক একবার আপাদমস্তক তাহাকে দেখিয়া লইলেন, তারপর একটা চেয়ার দেখাইয়া বলিলেন, বসুন। আপনি কি পাশ?-ও, আই.এ. পড়ছেন,—দেশ কোথায়?…ও!…এখানে থাকেন কোথায়?!
তিনি আরও যেন খানিকক্ষণ তাহাকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিলেন। মিনিট পনেরো পরে-অপু বসিয়াই আছে—ডাক্তারবাবু হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন,—দেখুন, পড়ানো মানে—আমার একটি মেয়ে—তাকেই পড়াতে হবে। যাকে তাকে তো নিতে পারি নে কিন্তু আপনাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে—ওরে শোন-তোের দিদিমণিকে ডেকে নিয়ে আয় তোবগে আমি ডাকছি
একটু পরে মেয়েটি আসিল। বছর পনেরো বয়স, তন্বী সুন্দরী, বড়ো বড়ো চোখ, আঙুলের গড়ন ভারি সুন্দর, রেশমী জামা গায়ে, চওড়া পাড় শাড়ি, গলায় সোনার সরু চেন, হাতে প্লেন বালা। মাথায় চুল এত ঘন যে দু-ধারের কান যেন ঢাকিয়া গিয়াছে—জাপানী মেয়েদের মতো ফাঁপানো খোপা!
-এইটি আমার মেয়ে, নাম প্রতিবালা। বেথুন স্কুলে পড়ে, এইবার সেকেন্ড ক্লাসে উঠেছে। ইনি তোমার মাস্টার খুকি—আজ বাদ দিয়ে কাল থেকে উনি আসবেনা, এর মুখ দেখেই আমার মনে হয়েছে ইনিই ঠিক হবেন। বয়স আপনার আর কত হবে—এই উনিশ-কুড়ি, মুখ দেখেই তো মনে হয় ছেলেমানুষ, তাছাড়া একটা distinction-এর ছাপ রয়েছে। খুকি, বোসো মা–
টিউশান জোটার আনন্দে যত হোকনা-হোক, ভদ্রলোক যে বলিয়াছেন তাহার মুখে একটা distinction-এর ছাপ আছে—এই আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া সে সারাটা দিন কাটাইল ও ক্লাসে, পথে, বাসায়, হোটেলে–সর্বত্র বন্ধুবান্ধবদের কাছে কথাটা লইয়া নির্বোধের মতো খুব আঁক করিয়া বেড়াইল। মাহিনা যত নির্দিষ্ট হইয়াছিল, তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি বলিল, মেয়েটির সৌন্দর্যব্যাখ্যা অনেক বাড়াইয়া করিল।
কিন্তু পরদিন পড়াইতে গিয়া দেখিল—মেয়েটি দেওয়ানপুরের নির্মলা নয়। সেরকম সরলা, স্নেহময়ী, হাস্যমুখী নয়—অল্প কথা কয়, খাটাইয়া লইতে জানে, একটু যেন গর্বিত! কথাবার্তা বলে হুকুমের ভাবে। অমুক অঙ্কটা কাল বুঝিয়ে দেবেন, অমুকটা কাল করে আনবেন, আজ আরও একঘণ্টা বেশি পড়াবেন, পরীক্ষা আছে—ইত্যাদি! একদিন কোন কারণে আসিতে না পারিলে পরদিন কৈফিয়ত তলব করিবার সুরে অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞাসা করে। অপু মনে মনে বড়ো ভয় খাইয়া গেল, যে রকম মেয়ে, কোনদিন পড়ানোর কোন ত্রুটির কথা বাবাকে লাগাইবে, চাকরির দফা গয়া—পথে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকিবে না। ছাত্রীর উপর অসন্তুষ্টি ও বিরক্তিতে তাহার মন ভরিয়া উঠিল।
মাসখানেক কাটিয়া গেল। প্রথম মাসের মাহিনা পাইয়াই মাকে কিছু টাকা পাঠাইয়া দিল। বৌবাজার ডাকঘর হইতে টাকাটা পাঠাইয়া সে চলিয়া যাইতেছিল, সঙ্গের বন্ধুটি বলিল, এসো তো ভাই একটু চোরাবাজারে, একটা ভালো অপেরাগ্লাস কাল দর করে রেখে এসেছি–নিয়ে আসি।
চোরাবাজারের নামও কখনও অপু শোনে নাই। ঢুকিয়া দেখিয়াই সে অবাক হইয়া গেল। নানা ধরনের জিনিসপত্র, খেলনা, আসবাবপত্র, ছবি, ঘড়ি, জুতা, কলের গান, বই, বিছানা, সাবান, কৌচ, কেদারা—সবই পুরানো মাল। অপুর মনে হইল-বেশ সস্তা দরে বিকাইতেছে। একটা ফুলের টব, দর বলিল ছআনা। একটা ভালো দোয়াতদান দশ আনা। এগারো টাকায় কলের গান মায় রেকর্ড! এত দিন কলিকাতায় আছে, এত সস্তায় এখানে জিনিসপত্র বেচা-কেনা হয়, তা তো সে জানে না। এত শৌখিন জিনিসের এত কম দাম!
তাহার মাথায় এক খেয়াল আসিয়া গেল। পরদিন সে বাকি টাকা হাতে বৈকালে আসিয়া চোরাবাজারে ঢুকি। মনে ভাবিল—এইবার একটু ভালো ভাবে থাকব, ওরকম গোয়ালঘরে থাকতে পারি নে—যেমন নোংরা তেমনি অন্ধকার। প্রথমেই সে ফুলদানি-জোড়া কিনিল। দোয়াতদানের উপর অনেকদিন হইতে ঝোঁক, সেটিও কিনিল। একটা জাপানী পর্দা, খানচারেক ছবি, খানকতক প্লেট, একটা আয়না, ঝুটা পাথর-বসানো ছোট একটা আংটি! ছেলেমানুষের মতো আনন্দে শুধু জিনিসগুলিকে দখলে আনিবার বেঁকে যাহাই চোখে ভালো লাগিল, তাহাই কিনিল। দাও বুঝিয়া দুএকজন দোকানদার বেশ ঠকাইয়াও লইল। ডবল-উইকের একটা পিতলের টেবিলল্যাম্প পছন্দ হওয়াতে দোকানীকে জিজ্ঞাসা করিল,—এটার দাম কত? দোকানী বলিল, সাড়ে তিন টাকা। অপুর বিশ্বাস…এরকম আলোর দাম পনেরো-যোল টাকা। এরুপ মনে হওয়ার একমাত্র কারণএই যে, অনেকদিন আগে লীলাদের বাড়ি থাকিবার সময় সে এই ধরনের আলো লীলার পড়িবার ঘরে টেবিলে জ্বলিতে দেখিয়াছিল। সে বেশি দর কষিতে ভরসা করিল না, চার আনা মাত্র কমাইয়া তিন টাকা চার আনা মূল্যে সেই মান্ধাতার আমলের টেবিল ল্যাম্পটা মহা খুশির সহিত কিনিয়া ফেলিল। মুটের মাথায় জিনিসপত্র চাপাইয়া সে সোৎসাহে ও সাগ্রহে সব বাসায় আনিয়া হাজির করিল ও সারাদিন খাটিয়া ঘরদোর ঝাড়িয়া ঝাট দিয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া হবিগুলি দেওয়ালে টাঙ্গাইল, সস্তা জাপানী পর্দাটা দরজায় ঝুলাইল, আয়নাটাকে গজাল আঁটিয়া বসাইল, ফুলদানির জন্য ফুল কিনিয়া আনিতে ভুলিয়া গিয়াছিল, সেগুলিকে ধুইয়া মুছিয়া আপাতত জানালার ধারে রাখিয়া দিল, দোয়াতদানটা তেঁতুল দিয়া মাজিয়া ঝকঝকে করিয়া রাখিল। বাহিরে অনেকদিনের একটা খালি প্যাকবাক্স পড়িয়াছিল, সেটা ঝাড়িয়া মুছিয়া টেবিলে পরিণত করিয়া সন্ধ্যার পর টেবিল ল্যাম্পটা সেটার উপর রাখিয়া পড়িতে বসিল। বই হইতে মুখ তুলিয়া সে ঘন ঘন ঘরের চারিদিকে খুশির সহিত চাহিয়া দেখিতেছিল—ঠিক একেবারে যেন বোলোকদের সাজানো ঘর। ছবি, পর্দা ফুলদানি টেবিল-ল্যাম্প সব!—এতদিন পয়সা ছিল না, হয় নাই। কিন্তু এইবার কেন সে মহিষের মতো বিলের কাদায় লুটাইয়া পড়িয়া থাকিতে যাইবে?
বাহাদুরি করিবার ঝোঁকে পরদিন সে ক্লাসের বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া নিজের ঘরে খাওয়াইল-প্রণব, জানকী, সতীশ, অনিল এমন কি সেন্ট জেভিয়ার কলেজের সেই ভূতপূর্ব ছাত্র চালবাজ মন্মথকে পর্যন্ত।
মন্মথ ঘরে ঢুকিয়া বলিল-হুররে!—আরে আমাদের অপূর্ব এসব করেছে কি! কোখেকে বাজে রাবিশ এক পুরোনো পর্দা জুটিয়েছে দ্যাখো। এত খাবার কে খাবে?
অপু নিচের কারখানার হেড মিস্ত্রিকে বলিয়া তাহাদের বড়ো লোহার চায়ের কেটলিটা ও একটা পলিতা-বসানো সেকেলে লোহার স্টোভ ধার করিয়া আনিয়া চা চড়াইয়াছে; একরাশ কমলালেবু, সিঙ্গাড়া, কচুরি, পানতুয়া, কলা ও কাঁচা পাঁপর কিনিয়া আনিয়াছে—সবাই দেখিতে দেখিতে খাবার অর্ধেকের উপর কমাইয়া আনিল। কথায় কথায় অপু তাহাদের দেশের বাড়ির কথা তুলিল–মস্ত দোতলা বাড়ি নদীর ধারে, এখনও পূজার দালানটা দেখিলে তাক লাগে, এখনও খুব নাম-দেনার দায়ে মস্ত জমিদারি হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে, তাই আজ এ অবস্থানহিলে ইত্যাদি।
প্রণব চা পরিবেশন করিতে গিয়া খানিকটা জানকীর পায়ের উপর ফেলিয়া দিল। ঘরসুদ্ধ সবাই হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। সতীশ আসিয়াই সটান শুইয়া পড়িয়াছিল অপুর বিছানায়, বলিল,–ওহে তোমরা কেউ আমার গালে একটা পানতুয়া ফেলে দাও তো! হাঁ করে আছি
সতীশ বলিল,-হা হে, ভালো কথা মনে পড়েছে। তোমার সেই জানালা-কাব্যের নায়িকা কোন্ দিকে থাকেন? এই জানালাটি নাকি?–
অনিল বাদে আর সকলেই হাসি ও কলববের সঙ্গে সেদিকে ঝুঁকিয়া পড়িতে গেল–অপু লজ্জামিশ্রিত সুরে বলিলনা না ভাই, ওদিকে যেয়ো না–সে কিছু না, সব বানানো কথা আমার—ওসব কিছু না।
মেয়েটি পাগল এই ধারণা হওয়া পর্যন্ত তাহার কথা মনে উঠিলেই অপুর মন করুণার্ম হইয়া উঠে। তাহাকে লইয়া এই হাসি-ঠাট্টা তাহার মনে বড়ো বিধিল। কথার সুর ফিরাইবাব জন্য সে নতুন কেনা পর্দাটার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। পরে হঠাৎ মনে পড়াতে সেই ঝুটা পাথরের আংটিটা বাহির করিয়া খুশির সহিত বলিল,-এটা দ্যাখো তো কেমন হয়েছে? কত দাম হবে।
মন্মথ দেখিয়া বলিল—এ কোথাকার একটা বাজে পাথর বসানো আংটি, কেমিকেল সোনার, এর আবার দামটা কি…দূর!
অনিলের এ কথাটা ভালো লাগিল না। মন্মথ ইতিপূর্বে অপুর পর্দাটা দেখিয়া নাক সিটকাইয়াছে, ইহাও তাহার ভালো লাগে নাই। সে বলিল—তুমি তো জহুরি নও, সব তাতেই চাল দিতে আস কেন? চেনো এ পাথর?
-জহুরি হবার দরকারটা কি শুনি—এটা কি এমারেল্ড, না হীরে, না—
–শুধু এমারেল্ড আর হীরের নাম শুনে রেখছ বই তো নয়? এটা কর্নেলিয়ান—চেনো কর্নেলিয়ান? অভ্রের খনিতে পাওয়া যায়, আমাদের ছিল, আমি খুব ভালো জানি।
অনিল খুব ভালোই জানে অপুর আংটির পাথরটা কর্নেলিয়ান নয় কিছুই নয়—শুধু মন্মথর কথার প্রতিবাদ করিয়া মন্মথর চালিয়াতি কথাবার্তায় অপুর মনে কোনও ঘা না লাগে সেই চেষ্টায় কনেলিয়ান ও টোপাজ পাথরের আকৃতি প্রকৃতি সম্বন্ধে যা মুখে আসিল তাহাই বলিতে লাগিল। তার অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে মন্মথ সাহস করিয়া আর কিছু বলিতে পারিল না।
তাহার পর প্রণব একটা গান ধরাতে উভয়ের তর্ক থামিয়া গেল। আরও অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিখুশি, কথাবার্তা ও আরও বার-দুই চা খাইবার পর অন্য সকলে বিদায় লইল, কেবল অনিল থাকিয়া গেল, অপুও তাহাকে থাকিতে অনুরোধ করিল।
সকলে চলিয়া যাইবার পর অনিল ভৎর্সনার সুরে বলিল—আচ্ছা, এসব আপনার কি কাণ্ড? (সে এতদিনের আলাপে এখনও অপুকে তুমি বলে না) কেন এসব কিনলেন মিছে পয়সা খরচ করে?
অপু হাসিয়া বলিল,-কেন তাতে কি? এসব তো—ভালো থাকতে কি ইচ্ছে যায় না?
—খেতে পান না এদিকে, আর মিথ্যে এই সব—সে যাক, এই দামে পুরানো বইয়ের দোকানের সেই গিবনের সেটটা যে হয়ে যেত। আপনার মতো লোকও যদি এই ভুয়ো মালের পেছনে পয়সা খরচ করেন তবে অন্য ছেলের কথা কি? একটা পুরানো দূরবীন যে এই দামে হয়ে যেত, আমার সন্ধানে একটা আছে ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের এক জায়গায় একটা সাহেবের ছিল—স্যাটার্নের রিং চমৎকার দেখা যায়—কম টাকায় হত, মেম বিক্রি করে ফেলছে অভাবে আপনি কিছু দিতেন, আমি কিছু দিতাম, দুজনে কিনে রাখলে ঢের বেশি বুদ্ধির কাজ হত—
অপু অপ্রতিভের হাসি হাসিল। দূরবীনের উপর তাহার লোভ আছে অনেক দিন হইতে। অতএব তাহার মনে হইল—এ টাকার ইহা অপেক্ষাও সদ্ব্যয় হইতে পারিত বটে। কিন্তু সে যে ভালো থাকিতে চায়, ভালো ঘরে সুদৃশ্য সুরুচিসম্মত আসবাবপত্র রাখিতে চায়—সেটাও তো তার কাছে বড়ো সত্য—তাহাকেও বা সে মনে মনে অস্বীকার করে কি করিয়া?
অনিল আর কিছু বলিল না। পুরানো বাজারের এসব সস্তা খেলো মালকে তাহার বন্ধু যে এত খুশির সহিত ঘরে আনিয়া ঘর সাজাইয়াছে, ইহাতেই সে মনে মনে চটিয়াছিল—শুধু অপুর মনে আব বেশি আঘাত দিতে ইচ্ছা না থাকায় সে বিবক্তি চাপিয়া গেল।
অপু বলিল-হুল্লোড়ে পড়ে তোমার খাওয়া হল না অনিল, আর খানকতক কাঁচা পাঁপর ভাজব?
অনিল আর খাইতে চাহিল না। অপু বলিল—তবে চলো, কোথাও বেরুইগড়ের মাঠে কি গঙ্গার ধারে।
অনিলও তাই চায়, বলিল-দেখুন অপূর্বাবু, উনিশ-কুড়ি-একুশ বছর থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর বয়সের লোক পর্যন্ত কি রকম গলির মধ্যে বাড়ির সামনেকার ছোট্ট বোয়াটুকুতে বসে আড্ডা দিচ্ছে—এমন চমৎকার বিকেল, কোত্থাও বেরুনো নেই, শরীরের বা মনের কোনও অ্যাডভেঞ্চার নেই, আসন-পিঁড়ি হয়ে সব ষষ্ঠী বুড়ি সেজে ঘরের কোণের কথা, পাড়ার গুজব, কি দরে কে ওবেলা বাজারে ইলিশ মাছ কিনেছে সেই সব—ওঃ হাউ আই হেট দে! আপনি জানেন না, এই সব র্যাঙ্ক স্টুপিডিটি দেখলে আমার রক্ত গরম হয়ে ওঠে-বরদাস্ত করতে পারি নে মোটে— গা যেন কেমন–
-কিন্তু ভাই, তোমার ও গড়ের মাঠে আমার মন ভোলে না—মোটরের শব্দ মোটর বাইকের ফটফট আওয়াজ, পেট্রোল গ্যাসের গন্ধ, ট্রামের ঘড়ঘড়ানি-নামেই ভাই মাঠ, গলার কথা আর না-ই বা তুললাম।
–কাল আপনাকে নিয়ে যাব এক জায়গায়। বুঝতে পারবেন একটা জিনিস—একটা ছেলে—আমার এক বন্ধুর বন্ধু—ছেলেটা সাউথ আফ্রিকায় মানুষ হয়েছে, সেইখানেই জন্ম-সেখান থেকে তার বাবা তাদের নিয়ে চলে এসেছে কলকাতায়, কিয়ার্স লেনে থাকে। তার মুখের কথা শুনে এমন আনন্দ হয়! এমন মন! এখানে থেকে মরে যাচ্ছে—শুনবেন তার মুখে সেখানকার জীবনের বর্ণনা-হিংসে হয়, সত্যি!
অপু এখনই যাইতে চায়। অনিল বলিল, আজ থাক, কাল ঠিক যাব দুজনে! দেখুন অপূর্ববাবু, কিছু যেন মনে করবেন না, আপনাকে তখন কি সব বললাম বলে। আপনারা কি জন্যে তৈরি হয়েছেন জানেন? ওসব চিপ ফাইনারির খদ্দের আপনারা কেন হবেন? দেখুন, এ পুরুষ তো কেটে গেল, এ সময়ের কবি, বৈজ্ঞানিক, দাতা, লেখক, ডাক্তার, দেশসেবক—এঁরা তো কিছুদিন পরে সব ফৌত হবেন, তাদের হাত থেকে কাজ তুলে নিতে হবে কাদের, না, যারা এখন উঠছে। একদল তো চাই এই জেনারেশনের হাত থেকে সেই সব কাজ নেবার? সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, আর্টে, দেশসেবায়, গানে–সব কিছুতে, নতুন দল যারা উঠছে, বিশেষ করে যাদের মধ্যে গিফট আছে, তাদের কি হুল্লোড় করে কাটাবার সময়?
অপু মুখে হাসিয়া কথাটা উড়াইয়া দিল বটে, কিন্তু মনে মনে ভারি খুশি হইল—কথার মধ্যে তাহারও যে দিবার কিছু আছে বা থাকিতে পারে সেদিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে বুঝিয়া।
পরে দু-জনে বেড়াইতে বাহির হইল।
০৯. ছাত্রীকে পড়াইতে যাইবার সময়
নবম পরিচ্ছেদ
ছাত্রীকে পড়াইতে যাইবার সময় অপুর গায়ে যেন জ্বর আসে, ছুটি-ছাটার দিনটা না যাইতে হইলে সে যেন বাঁচিয়া যায়। অদ্ভুত মেয়ে! এমন কারণে-অকারণে প্রভুত্ব জাহির করার চেষ্টা, এমন তাচ্ছিল্যের ভাব—এই রকম সে একমাত্র অতসীদিতে দেখিয়াছে!
একদিন সে ছাত্রীর একটা রুপা-বধানো পেন্সিল হারাইয়া ফেলিল। পকেটে ভুলিয়া লইয়া গিয়াছিল, কোথায় ফেলিয়াছে, তারপর আর কিছু খেয়াল ছিল না, পরদিন প্রীতি সেটা চাহিতেই তাহার তো চক্ষুস্থির! সংকুচিতভাবে বলিল—কোথায় যে হারিয়ে ফেললাম—কাল বরং একটা কিনে–
প্রীতি অপ্রসন্ন মুখে বলিল, ওটা আমার দাদুমণির দেওয়া বার্থ-ডে গিফট ছিল—
ইহার পর আর কিনিয়া আনিবার প্রস্তাবটা উত্থাপিত করা যায় না, মনে মনে ভাবিল, কাল থেকে ছেড়ে দেবো।এখানে আর চলবে না।
কি একটা ছুটির পরদিন সে পড়াইতে গিয়াছে, প্রীতি জিজ্ঞাসা করিল, কাল যে আসেন নি?
অপু বলিল, কাল ছিল ছুটির দিনটা—তাই আর আসি নি।
প্রীতি ফট করিয়া বলিয়া বসিল—কেন, কাল তো আমাদের সরকার, বাইরের দু-জন চাকর, ড্রাইভার সব এসেছিল? আমার পড়াশুনো কিছু হল না, আজ ডিটেন্ করে রাখলে পাঁচটা
অবধি।
অপুর হঠাৎ বড়ো রাগ হইল, দুঃখও হইল। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমি তোমাদের সরকার কি রাঁধুনীঠাকুর তো নই, প্রীতি! কাল স্কুল কলেজ সব বন্ধ ছিল, এজন্য ভাবলাম আজ যাব না। আমার যদি ভুলই হয়ে থাকে-তোমার সেই রকম মাস্টার রেখো যিনি এখানে বাজার-সরকারের মতো থাকবেন। আমি কাল থেকে আর আসব না বলে যাচ্ছি।
বাড়ির বাহিরে আসিয়া মনে হইল—দেওয়ানপুরের নির্মলাদের কথা। তাহারাও তো অবস্থাপন্ন, তাহাদের বাড়িতেও সে প্রাইভেট মাস্টার ছিল, কিন্তু সেখানে সে ছিল বাড়ির ছেলের মতো-নির্মলার মা দেখিতেন ছেলের চোখে, নির্মলা দেখিত ভাইয়ের চোখে—সে স্নেহ কি পথেঘাটে সুলভ? নির্মলার মতো মমতাময়ীকে তখন সে চিনিয়াও চেনে নাই, আজ নতুন করিয়া তাহাকে আর চিনিয়া লাভ কি? আর লীলা? সে কথা ভাবিতেই বুকের ভিতরটা যেন কেমন করিয়া উঠিল–যাক সে সব কথা।
হাতের টাকায় কিছুদিন চলিল। ইতিমধ্যে কলেজে একটা বড়ো ঘটনা হইয়া গেল, প্রণব লেখাপড়া ছাড়িয়া কি নাকি দেশের কাজ করিতে চলিয়া গেল। সকলে বলিল, সে এনার্কিস্ট দলে যোগ দিয়াছে।
প্রণব চলিয়া যাওয়ার মাসখানেক পর একদিন অপু হোটেলে খাইতে গিয়া দেখিল, সুন্দরঠাকুর হোটেলওয়ালার মুখ ভার-ভার। দু-তিন মাসের টাকা বাকি, পাওনাদার আর কতদিন শোনে? আজ সে স্পষ্ট জানাইল, দেনা শোধ না করিলে আর সে খাইতে পাইবে না। বলিল-বাবু, অন্য খদ্দের হলে মাসের পয়লাটি যেতে দিই নেওই কৃক্টোবাবু খায়, ওদের পাটের কলের হপ্তাটি পেলে দিয়ে দেয়—তুমি বলে আমি কিছু বলছি না—দু-মাসের ওপর আজ নিয়ে সাত দিন। যাক আর পারব না, আপুনি আর আসবেন না-আমার ভাত একজন ভদ্রনোকের ছেলে খেয়েছে ভাবব, আর কি করব?
কথাগুলি খুব ন্যায্য এবং আদৌ অসংগত নয়, কিন্তু খাইতে গিয়া এরুপ বুঢ় প্রত্যাখ্যানে অপুর চোখে জল আসিল। তাহার তো একদিনও ইচ্ছা ছিল না যে, ঠাকুরকে সে ফাঁকি দিবে, কিন্তু সেই প্রীতির টিউশনিটা ছাড়িয়া দেওয়ার পর আজ দুই-তিন মাস একেবারে নিরুপায় অবস্থায় ঘুরিতেছে যে!
বিপদের উপর বিপদ। দিন-দুই পরে কলেজে দিয়া দেখিল নোটিশ বোর্ডে লিখিয়া দিয়াছে, যাহাদের মাহিনা বাকি আছে, এক সপ্তাহের মধ্যে শোধ না করিলে কাহাকেও বার্ষিক পরীক্ষা দিতে দেওয়া হইবে না। অপু চক্ষে অন্ধকার দেখিল। প্রায় গোটা এক বৎসরের মাহিনাই যে তাহার বাকি!—মাত্র মাস-দুইয়ের মাহিনা দেওয়া আছে—সেই প্রথম দিকে একবার, আর প্রীতির টিউশনির টাকা হইতে একবার—তাহার পর হইতে খাওয়াই জোটে না তো কলেজের মাহিনা! দশ মাসেব বেতন ছটাকা হিসাবে ষাট টাকা বাকি। কোন দিক হইতে একটা কলঙ্কধরা নিকেলের সিকিও আসিবার সুবিধা নাই যাহার, ষাট টাকা সে এক সপ্তাহের মধ্যে কোথা হইতে জোগাড় করিবে? হয়তো তাহাকে পরীক্ষা দিতে দিবে না, গ্রীষ্মের ছুটির পর সেকেন্ড ইয়ারে উঠিতে দিবে না, সারা বছরের কষ্ট ও পরিশ্রম সব ব্যর্থ নিরর্থক হইয়া যাইবে।
কলেজ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া সন্ধ্যার সময় সে হাত-খরচের পয়সা হইতে চাউল ও আলু কিনিয়া আনিয়া থাকিবার ঘরের সামনের বারান্দাতে রান্নার জোগাড় করিল। হোটেলে খাওয়া বন্ধ হইবার পর হইতে আজ কয়দিন নিজে রাঁধিয়া খাইতেছে। হিসাব করিয়া দেখিয়াছে ইহাতে খুব সস্তায় হয়, কাঠ কিনিতে হয় না। নিচের কারখানার মিস্ত্রিদের ঘর হইতে কাঠের চেঁচ ও টুকরা কুড়াইয়া আনে, পাচ-ছয় পয়সায় খাওয়া-দাওয়া হয়। আলুভাতে ডিমভাতে আর ভাত। ভাত চড়াইয়া ডাক দিল-ও বহুবহু নিয়ে এসো, আমার হয়ে গেল বলে-ছোট কঁসিটাও এনো
কারখানার দারোয়ান শ্যুদত্ত তেওয়ারীর বৌ একখানা বড়ো পিতলের থালা ও কাসি লইয়া উপরে আসিল—এক লোটা জল ও গোটাকতক কাঁচা লঙ্কাও আনিল।
থালা বাসন নাই বলিয়া সে-ই দুই বেলা থালা আনিয়া দেয়। হাসিমুখে বলিল, মছলিকা তরকারি হম নেহি ছুঁয়ে গা বাবুজি
-কোথায় তোমার মছলি?—ও শুধু আলু–একটু হলুদবাটা এনে দ্যাও না বহু? বোজ বোজ আলুভাতে ভালো লাগে না–
বহুকে ভালো বলিতে হইবে, রোজ উচ্ছিষ্ট থালা নামাইয়া লইয়া যায়, নিজে মাজিয়া লয় হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ যাহা কখনও করে না—অপু বাধা দিয়াছিল, বহু বলে, তুম তো হামারে লেড়কাকে বরাবর হোগে বাবুজী ইসমে ক্যা হ্যায়?–
দিন কতক পর মায়ের একটা চিঠি আসিল, হঠাৎ পিছলাইয়া পড়িয়া সর্বজয়ার পায়ে বড়ো লাগিয়াছে, পয়সার কষ্ট যাইতেছে। মায়ের অভাবের খবর পাইলে অপু বড়ো ব্যস্ত হইয়া উঠে, মায়ের নানা কাল্পনিক দুঃখের চিন্তায় তাহার মনকে অস্থির করিয়া তোলে, হয়তো আজ পয়সার অভাবে মায়ের খাওয়া হইল না, হয়তো কেহ দেখিতেছে না, মা আজ দু-দিন উপবাস করিয়া আছে, এইসব নানা ভাবনা আসিয়া জোটে, নিজের আলুভাতে ভাতও যেন গলা দিয়া নামিতে চায় না।
এদিকে আর এক গোলমাল-কারখানার ম্যানেজার ইতিপূর্বে তাহাকে বার-দুই ডাকাইয়া বলিয়াছেন উপরে যে ঘরে সে আছে তার সমস্তটাই ঔষধের গুদাম করা হইবে—সে যেন অন্যত্র বাসা দেখিয়া সয়–বলিয়াছেন আজ মাস তিনেক আগে, তাহার পর আর কোনও উচ্চবাচ্য করেন নাই—অপুও থাকিবার স্থানের জন্য কোথায় কি ভাবে কাহার কাছে গিয়া চেষ্টা করিবে বুঝিতে না পারিয়া একরূপ নিশ্চেষ্টই ছিল এবং নিশ্চিন্ত ভাবে দিন যাইতে দেখিয়া ভাবিয়াছিল, ও-কথা হয়তো আর উঠিবে না কিন্তু এইবার যেন সময় পাইয়াই ম্যানেজার বেশি পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিলেন।
হাতের পয়সা ফুরাইয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গে অপু এত সাধ করিয়া কেনা শখের আসবাবগুলি বেচিতে আরম্ভ করিল। প্রথমে গেল প্লেটগুলি—তাও কেহই কিনিতে চায় না—অবশেষে চৌদ্দ আনায় এক পুরানো দোকানদারের কাছে বেঁচিয়া দিল। সেই দোকানদারই ফুলদানিটা আট আনায় কিনিল, দু-খানা ছবি দশ আনায়। তবু শেষ পর্যন্ত সে স্যান্ডাের ডাম্বেলটা ও জাপানী পর্দাটা প্রাণপণে আঁকড়াইয়া রহিল।
সে শীঘ্রই আবিষ্কার করিল–ছাতু জিনিসটার অসীম গুণ—সস্তার দিক হইতেও বটে, অল্প খরচে পেট ভরাইবার দিক হইতেও বটে। আগে আগে চৈত্র বৈশাখ মাসে তাহার মা নতুন যবের ছাতু কুটিয়া তাহাদের খাইতে দিতেন—তখন ছাতু ছিল বৎসরের মধ্যে একবার পালা-পাবণে শখ করিয়া খাইবার জিনিস, তাহাই এখন হইয়া পড়িল প্রাণধারণের প্রধান অবলম্বন। আগে একটু-আধটু গুড়ে তাহার ছাতু খাওয়া হইত না, গুড় আরও বেশি করিয়া দিবার জন্য মাকে কত বিরক্ত করিয়াছে, এখন খরচ বাঁচাইবার জন্য শুধু নুন ও তেওয়ারী-বহুর নিকট হইতে কাঁচা লঙ্কা আনাইয়া তাই দিয়া খায়। অভ্যাস নাই, খাইতে ভালো লাগে না।
কিন্তু ছাতু খুব সুস্বাদু না হউক, তাহাও বিনা পয়সায় পাওয়া যায় না। অপু বুঝিতেছিল টানাটানি করিয়া আর বড়জোর দিন দশেক—তারপর কূলকিনারাহীন অজানা মহাসমুদ্র!…তখন কি উপায়?…
সে রোজ সকালে উঠিয়া নিকটবর্তী এক লাইব্রেরিতে গিয়া দৈনিক ইংরেজি বাংলা কাগজে ছেলে-পড়ানোর বিজ্ঞাপন খুঁজিয়া দেখে, গ্যাসপোস্টের গায়েও অনেক সময় এই ধরনের বিজ্ঞাপন মারা থাকে—চলিতে চলিতে গ্যাসপোস্টের বিজ্ঞাপন দেখিয়া বেড়ানো তাহার একটা বাতিক হইয়া দাঁড়াইল। প্রায়ই বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন।আলো ও হাওয়াযুক্ত ভদ্র-পরিবারের থাকিবার উপযোগী দুইখানি কামরা ও রান্নাঘর, ভাড়া নামমাত্র। যদি বা কালেভদ্রে এক-আধটা ছেলে-পড়ানোর বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, তার ঠিকানাটি আগে কেহ ছিড়িয়া দিয়াছে। কাপড় ময়লা হইয়া আসিল বেজায়, সাবানের অভাবে কাচিতে পারিল না। তেওয়ারীর স্ত্রী একদিন সোড়া সাবান দিয়া নিজেদের কাপড় সিদ্ধ করিতে বসিয়াছে, অপু নিজের ময়লা শার্ট ও ধুতিখানা লইয়া গিয়া বলিল, বহু তোমার সাবানের বোল একটু দেবে, আমি এ দুটোয় মাখিয়ে রেখে দিতারপর ওবেলা কলেজ থেকে এসে কলে জল এলে কেচে নেবো—দেবে?…।
তেওয়ারী-বধু বলিল, দে দিজিয়ে না বাবুজী, হাম্ হাঁড়ি মে ডাল দেগা।
অপু ভাবে—আহা, বহু কি ভালো লোক!যদি কখনও পয়সা হয় ওর উপকার করবো–
এক একবার তাহার মনে হয়, যদি কিছু না জোটে, তবে এবার হয়তো কলেজ ছাড়িয়া দিয়া মনসাপোতা ফিরিতে হইবে কিন্তু সেখানেও আর চলিবার কোনও উপায় নাই, তেলি ও কুণ্ডুরা পূজার জন্য অন্যস্থান হইতে পূজারি-বামুন আনাইয়া জায়গা-জমি দিয়া বাস করাইয়াছে। আজ কয়েকদিন হইল মায়ের পত্রে সে-খবর জানিয়াছে, এখন তাহার মাকেও আর তেলিরা সাহায্য করে না, দেখেশোনে না! মায়ের একাই চলে না—তার মধ্যে সে আবার কোথায় গিয়া জুটিবে?—তাহা ছাড়া পড়াশুনা ছাড়া? অসম্ভব!
সে নিজে বেশ বুঝিতে পারে, এই এক বৎসরে তাহার মনের প্রসারতা এত বাড়িয়া গিয়াছে, এমন একটা নতুন ভাবে সে জগৎটাকে, জীবনটাকে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছে-যা কিনা দশ বৎসর মনসাপোতা কি দেওয়ানপুরে পড়িয়া হাবুডুবু খাইলেও সম্ভব হইয়া উঠিত না। সে এটুকু বেশ বোঝে, কলেজে পড়িয়া ইহা হয় নাই, কোনও প্রফেসারের বক্তৃতাতেও নাযাহা কিছু হইয়াছে, এই বড়ো আলমারি-ভরা লাইব্রেরিটার জন্য, সে তাহার কাছে কৃতজ্ঞ।
যতক্ষণ সে লাইব্রেরিতে থাকে, ততক্ষণ তাহার খাওয়া-দাওয়ার কথা তত মনে থাকে না। এই সময়টা এক একটা খেয়ালের ঘোরে কাটে। খেয়ালমতো এক একটা বিষয়ে প্রশ্ন জাগে মনে, তাহার উত্তর খুঁজিতে গিয়া বিকারের রোগীর মতো অদম্য পিপাসায় সে সম্বন্ধে যত বই পাওয়া যায় হাতের কাছে—পড়িতে চেষ্টা করে। কখনও খেয়াল-নক্ষত্র জগৎ…কখনও প্রাচীন গ্রীস ও রোমের জীবনযাত্রা প্রণালীর সহিত একটা নিবিড় পরিচয়ের ইচ্ছা—কখনও কীট, কখনও হল্যান্ড রোজের নেপোলিয়ন। কোনো খেয়াল থাকে দুদিন, কোনোটা আবার একমাস! তার কল্পনা সব সময়ই বড়ো একটা কিছুকে আশ্রয় করিয়া পুষ্টিলাভ করিতে চায়—বড়ো ছবি, জাতির উত্থান-পতনের কাহিনী, চাঁদের দেশের পাহাড়শ্রেণী, বর্তমান মহাযুদ্ধ, কোন বড়োলোকের জীবনী।
কারখানার ম্যানেজার আর একদিন তাগিদ দিলেন। খুব সুখের বাসা ছিল না বটে, কিন্তু এখন সে যায় কোথায়? হাতে কিছু না থাকায় সে এবার পর্দাটা একদিন বেচিতে লইয়া গেল। এটা তাহার বড়ো শখের জিনিস ছিল। পর্দাটাতে একটা জাপানী ছবি আঁকা—ফুলে ভরা চেরি গাছ, একটু জলরেখা, মাঝ-জলে বড়ো বড়ো ভিক্টোরিয়া রিজিয়া ফুটিয়া আছে, ওপারে ঢেউখেলানো কাঠের ছাদওয়ালা একটা দেবমন্দির, দূরে ফুজিসানের তুষারাবৃত শিখর একটু একটু নজরে পড়ে। এই ছবিখানার জন্যই সে পর্দাটা কিনিয়াছিল, এইজন্যই এত দিন হাতছাড়া করিতে পারে নাই কিন্তু উপায় কি? সাড়ে তিন টাকা দিয়া কেনা ছিল, বহু দোকান ঘুরিয়া তাহার দাম হইল এক টাকা তিন আনা।
পর্দা বেঁচিয়া অনেকদিন পর সে ভাত রাঁধিবার ব্যবস্থা করিল। ছাতু খাইয়া খাইয়া অরুচি ধরিয়া গিয়াছে, বাজার হইতে এক পয়সার কলমি শাকও কিনিয়া আনিল। মনে পড়িল—সে কলমি শাক ভাজা খাইতে ভালোবাসিত বলিয়া ছেলেবেলায় দিদি যখন-তখন গড়ের পুকুর হইতে কত কলমি তুলিয়া আনিত! দিন সাতেক পর্দা-বেচা পয়সায় চলিল মন্দ নয়, তারপরই যে-কে সেই! আর পর্দা নাই, কিছুই নাই, একেবারে কানাকড়িটা হাতে নাই।
কলেজ যাইতে হইল না-খাইয়া। বৈকালে কলেজ হইতে বাহির হইয়া সত্যই মাথা ঘুরিতে লাগিল, আর সেই মাথা ঝিম্ ঝিম্ করা, পা নড়িতে না চাওয়া। মুশকিল এই যে, ক্লাসে মিথ্যা গর্ব ও বাহাদুরির ফলে সকলেই জানে সে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, কাহারও কাছে বলিবার মুখও তো নাই। দু-একজন যাহারা জানে যেমন জানকী—তাহাদের নিজেদের অবস্থাও তথৈবচ।
সারাদিন না খাইয়া সন্ধ্যার সময় বাসায় আসিয়াই শুইয়া পড়িল। রাত আটটার পরে আর না থাকিতে পারিয়া তেওয়ারী-বধুকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল–ছোলা কি অড়হরের ডাল আছে, বহু? আজ আর ক্ষিদে নেই তেমন, রাঁধব না আর, ভিজিয়ে খেতাম।
সকালে উঠিয়াই প্রথমে তাহার মনে আসিল যে, আজ সে একেবারে কপর্দকশূন্য। আজও কালকার মতো না খাইয়া কলেজে যাইতে হইবে। কতদিন এভাবে চালাইবে সে? না খাইয়া থাকার কষ্ট ভয়ানককাল লজিকের ঘণ্টার শেষে সেটা সে ভালো করিয়া বুঝিয়াছিল-বিকালের দিকে ক্ষুধাটা পড়িয়া যাওয়াতে তত কষ্ট বোঝা যায় নাই-কিন্তু সেই বেলা দুটোর সময়টা! পেটে ঠিক যেন বোলতার আঁক হুল ফুটাইতেছে—বার দুই জল খাইবার ঘরে গিয়া গ্লাসকতক জল খাইয়া কাল যন্ত্রণাটা অনেকখানি নিবারণ হইয়াছিল। আজ আবার সেই কষ্ট সম্মুখে!
হাতমুখ ধুইয়া বাহির হইয়া বেলা দশটা পর্যন্ত সে আবার নানা গ্যাসপোস্টের বিজ্ঞাপন দেখিয়া বেড়াইল, তাহার পর বাসায় না ফিরিয়া সোজা কলেজে গেল। অন্য কেহ কিছু লক্ষ না করিলেও অনিল দু-তিনবার জিজ্ঞাসা করিল—আপনার কোনও অসুখবিসুখ হয়েছে? মুখ শুকনো কেন? অপু অন্য কথা পাড়িয়া প্রশ্নটা এড়াইয়া গেল। বই লইয়া আজ সে কলেজে আসে নাই, খালি হাতে কলেজ হইতে বাহির হইয়া রাস্তায় রাস্তায় খানিকটা ঘুরিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল, মা আজ দিন-বারো আগে টাকা চাহিয়া পত্র পাঠাইয়াছিলেন—টাকাও দেওয়া হয় নাই, পত্রের জবাঝও না।
কথাটা ভাবিতেই সে অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া পড়িলনা-খাওয়ার কষ্ট সে ভালো বুঝিয়াছে মায়েরও হয়তো বা এতদিন না-খাওয়া শুরু হইয়াছে, কে জানে? তাহা ছাড়া মায়ের স্বভাবও সে ভালো বোঝে, নিজের কষ্টের বেলা মা কাহাকেও বলিবে না বা জানাইবে না, মুখ বুজিয়া সমুদ্র গিলিবে।
অপু অস্থির হইয়া পড়িল। এখন কি করে সে। জ্যাঠাইমাদের বাড়ি গিয়া সব খুলিয়া বলিবে?—গোটাকতক টাকা যদি এখন ধার পাওয়া যায় সেখানে, মাকে তো আপাতত পাঠাইয়া দেওয়া যাইবে এখন। কিন্তু খানিকটা ভাবিয়া দেখিল, সেখানে গিয়া সে টাকার কথা তুলিতেই পারিবে না-জ্যাঠাইমাকে সে মনে মনে ভয় করে। অখিলবাবু? সামান্য মাহিনা পায়, সেখানে গিয়া টাকা চাহিতে বাধে। তাহার এক সহপাঠীর কথা হঠাৎ তাহার মনে পড়িল, খুব বেশি আলাপ নাই, কিন্তু শুনিয়াছে বড়োলোকের ছেলে—একবার যাইয়া দেখিবে কি? ছেলেটির বাড়ি বৌবাজারের একটা গলিতে, কলকাতার বনেদি ঘর, বড়ো তেতলা বাড়ি, পূজার দালান, সামনে বড়ো বড়ো সেকেলে ধরনের থাম, কার্নিসে একঝাক পায়রার বাসা; বাহিরের ফ্লোরের খোপটা একজন হিন্দুস্থানী ভুজাওয়ালা ভাড়া লইয়া ছাতুর দোকান খুলিয়াছে। একটু পরেই অপুর সহপাঠী ছেলেটি বাহিরে আসিয়া বলিল—কই, কে ডাকছে—ও-তুমি?—রোল টুএল; এক্সকিউজ মি—তোমার নামটা জানি নে ভাই–sorry—এসো, এসো ভেতরে এসো।
খানিকক্ষণ বসিয়া গল্পগুজব হইল। খানিকক্ষণ গল্প করিতে করিতে অপু বুঝিল, এখানে টাকার কথা তোলাটা তাহার পক্ষে কতদূর দুঃসাধ্য ব্যাপার।–অসম্ভব—তাহা কি কখনও হয়? কি বলিয়া টাকা ধার চাহিবে সে এখানে? এই আমাকে এই—গোটাকতক টাকা ধার দিতে পারো কদিনের জন্যে? কথাটা কি বিশ্রী শোনাইবে! ভাবিতেও যেন লজ্জা ও সংকোচে তাহার মুখ ঘামিয়া রাঙা হইয়া উঠিল। ছেলেটি বলিল-বা রে, এখুনি উঠবে কি?-না না, বোসো, চা খাও-দাঁড়াও, আমি আসছি–
ঘিয়ে-ভাজা চিড়ে নিমকি, পেপে-কাটা, সন্দেশ ও চা। অপু ক্ষুধার মুখে লোভীর মতো সেগুলি ব্যগ্রভাবে গোগ্রাসে গিলিল। গরম চা কয়েক চুমুক খাইতে শরীরের ঝিম ঝিম ভাবটা কাটিয়া মনের স্বাভাবিক অবস্থা যেন ফিরিয়া আসিল এবং আসিবার সঙ্গে সঙ্গে এখানে টাকা ধার চাওয়াটা যে কতদূর অসম্ভব সেটাও বুঝিল। বন্ধুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া বাহিরে আসিয়া ভাবিল— ভাগ্যিস—হাউ অ্যাস্পার্ড। তা কি কখনও আমি—দুর!
রাত্রিতে শুইয়া ভাবিতে ভাবিতে তাহার মনে পড়িল, আগামীকাল নববর্ষের প্রথম দিন। কাল কলেজের ছুটি আছে। কাল একবার শ্যামবাজারে জ্যাঠাইমাদের বাড়িতে যাইবে, নববর্ষের দিনটা জ্যাঠাইমাকে প্রণাম করিয়া আসাও হইবে—সেটাও একটা কর্তব্য, তাহা ছাড়া–
মনে মনে ভাবিল-কাল গেলে জেঠিমা কি আর না খাইয়ে ছেড়ে দেবে? বছরকারের দিনটা—সেদিন সুরেশদা তো আর বাড়ির মধ্যে বলে নি–বললে কি আর খেতে বলত না? সুরেশদা ওই রকম ভুলো মানুষ–
ভুল কাহার, পরদিন অপুর বুঝিতে দেরি হইল না। সকালে নটার সময় সুরেশদের বাড়ি গিয়া প্রথমে বাহিরে কাহাকেও পাইল না। বলা না, কওয়া না, হুপ করিয়া কি বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া যাইবে? কি সমাচার, না নববর্ষের দিন প্রণাম করিতে আসিয়াছি—দুতাটা যে বড়ো দুর্বল! সাত পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে সে খানিকক্ষণ পরে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়া একেবারে জ্যাঠাইমাকে পাইল দরজার সামনের বোয়াকে। প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা লইল, জ্যাঠাইমার মুখে যে বিশেষ প্রীতি বিকশিত হইল না, তাহা অপু ছাড়া যে-কেহ বুঝিতে পারিত। তাহার সংবাদ লইবার জন্য তিনি বিশেষ কোন আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না, সে-ই নিজের সংকোচ ঢাকিবার জন্য অতসীদি কবে শ্বশুরবাড়ি গিয়াছে, সুনীল বুঝি কোথায় বাহির হইয়াছে প্রভৃতি ধরনের মামুলী প্রশ্ন করিয়া যাইতে লাগিল।
তারপর জ্যাঠাইমা কোথায় চলিয়া গেলেন, কেহ বাড়ি নাই, সে দালানের একটি বেঞ্চিতে বসিয়া একখানা এল. রায়ের ক্যাটালগ নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিবার ভান করিল। বইখানার মধ্যে একখানা বিবাহের প্রীতি-উপহার, হাতে লইয়া বিস্ময়ের সহিত দেখিল—সেখানা সুরেশের বিবাহের! সে দুঃখিতও হইল, আশ্চর্যও হইল, মাত্র মাসখানেক আগে বিবাহ হইয়াছে, সুরেশদা তাহার ঠিকানা জানে, সবই জানে, অথচ কি জ্যাঠাইমা, কি সুরেশদা, কেহই তাহাকে জানায় নাই।
‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় বেলা সাড়ে দশটা পর্যন্ত বসিয়া থাকিয়া সে জ্যাঠাইমার কাছে বিদায় লইয়া চলিয়া আসিল; জ্যাঠাইমা নির্লিপ্ত, অন্যমনস্ক সুরে বলিল—আচ্ছা তা এসো—থাক
থা—আচ্ছা।
ফুটপাতে নামিয়া সে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। মনে মনে ভাবিল—সুরেশদার বিয়ে হয়ে গিয়েছে ফালুন মাসে, একবার বললেও না!অথচ আমাদের আপনার লোক-আজ দ্যাখো না নববর্ষের দিনটা খেতেও বললে না–
খানিকদুরে আসিতে আসিতে তাহার কেমন হাসিও পাইল। আচ্ছা যদি বলতাম, জেঠিমা আমি এখানে এবেলা খাবো তাহলে—হি-হি-তাহলে কি হতো!
বাসার কাছে পথে সুন্দর-ঠাকুর হোটেলওয়ালার সঙ্গে দেখা। দু-দুবার নাকি সে অপুর বাসায় গিয়াছে, পায় নাই, আজ পয়লা বৈশাখ, হোটেলের নতুন খাতা টাকা দেওয়া চাই-ই। সুন্দর-ঠাকুর চিৎকারের সুরে বলিল—ভাতের তো এক পয়সা দিলে না—আবার লুচি খেলে বাবু নদিন—সাত আনা হিসাবে সাত নং তেষট্টি আনা—তিন টাকা পনেরো আনা—আজ তিন মাস ঘোরাচ্ছো, আজ খাতা মহরতনা দিলে হবেই না বলে দিচ্ছি।
অপুর দোষ-লোভে পড়িয়া সে কোথা হইতে শোধ দিবে না ভাবিয়াই ধারে আট-নয় দিন লুচি খাইয়াছিল। সুন্দর-ঠাকুরের চড়া চড়া কথায় পথে লোক জুটিয়া গেল—পথে দাঁড়াইয়া অপদস্থ হওয়ার ভয়ে সে কোথা হইতে দিবে বিন্দুবিসর্গ না ভাবিয়াই বলিল, বৈকালে নিশ্চয়ই সব শোধ করিয়া দিবে।
বৈকালে একটা বিজ্ঞাপনে দেখিল কোন্ স্কুলে একজন ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করা শিক্ষক দরকার, টাটকা মারিয়া দিয়া গিয়াছে, এখনও কেহ ঘেঁড়ে নাই। খুঁজিয়া তখনই বাহির করিল, মেছুয়াবাজারের একটা গলির মধ্যে কাহাদের ভাড়া বাড়ির বাহিরের ঘরে স্কুল—আপার প্রাইমারি পাঠশালা। জনকতক বৃদ্ধ বসিয়া দাবা খেলিতেছেন, একজন তাহার মধ্যে নাকি স্কুলের হেডমাস্টার। অঙ্কের শিক্ষক-দশ টাকা মাহিনা—ইত্যাদি। বাজার যা তাতে ইহাই যথেষ্ট।
অপর মন বেজায় দমিয়া গেল। এই অন্ধকার স্কুলঘরটা, দারিদ্র্য, এই ত্ৰিকালোত্তীর্ণ বদ্ধগণের মুখের একটা বুদ্ধিহীন সন্তোষের ভাব ও মনের স্থবিরত্ব, ইহাদের সাহচর্য হইতে তাহাকে দূরে হটাইয়া সইতে চাহিল। যাহা জীবনের বিরোধী, আনন্দের বিরোধী, সর্বোপরি–তাহার অস্থিমজ্জাগত যে রোমাঞ্চের তৃষ্ণা—তাহার বিরোধী, অপু সেখানে একদণ্ড তিষ্ঠিতে পারে না। ইহারা বৃদ্ধ বলিয়া যে এমন ভাব হইল অপুর, তাহা নয়, ইহাদের অপেক্ষাও বৃদ্ধ ছিলেন, শৈশবের সঙ্গী নরোত্তম দাস বাবাজী। কিন্তু সেখানে সদাসর্বদা একটা মুক্তির হাওয়া বহিত, কাশীর কথকঠাকুরকেও এইজন্যই ভালো লাগিয়াছিল। অসহায়, দরিদ্র বৃদ্ধ একটা আশাভরা আনন্দের বাণী বহন করিয়া আনিয়াছিলেন তাহার মনে-যেদিন জিনিসপত্র বাঁধিয়া হাসিমুখে নতুন সংসার বাঁধিবার উৎসাহে রাজঘাটের স্টেশনে ট্রেনে চড়িয়া দেশে রওনা হইয়াছিলেন।
স্কুল হইতে যখন সে বাহির হইল, বেলা প্রায় গিয়াছে। তাহার কেমন একটা ভয় হইল-এ ভয়টা এতদিন হয় নাই। না খাইয়া থাকিবার বাস্তবতা ইতিপূর্বে এভাবে কখনও নিজের জীবনে সে অনুভব করে নাই—বিশেষ করিয়া যখন এখানে খাইতে পাওয়া নির্ভর করিতেছে নিজের কিছু একটা খুঁজিয়া বাহির করিবার সাফল্যের উপর। কিন্তু তাহার সকলের চেয়ে দুর্ভাবনা মায়ের জন্য। একটা পয়সা সে মাকে পাঠাইতে পারিল না, আজ এতদিন মা পত্ৰ দিয়াছেন—কি করিয়া চলিতেছে মায়ের!
কিন্তু এখানে তো কোনও কিছুই আশা দেখা যায় না-এত বড়ো কলিকাতা শহরে পাড়াগাঁয়ের ছেলে, সহায় নাই, চেনাশোনা নাই, সে কোথায় যাইবে—কি করিবে?
পথে একটা মারোয়াড়ির বাড়িতে বোধহয় বিবাহ। সন্ধ্যার তখনও সামান্য বিলম্ব আছে, কিন্তু এরই মধ্যে সামনের লাল-নীল ইলেকট্রিক আলোর মালা জ্বালাইয়া দিয়াছে, দু-চারখানা মোটর ও জুড়ি গাড়ি আসিতে শুরু করিয়াছে। লুচি-ভাজার মন মাতানো সুগন্ধে বাড়ির সামনেটা ভরপুর। হঠাৎ অপু দাঁড়াইয়া গেল। ভাবিল—যদি গিয়ে বলি আমি একজন পুওর স্টুডেন্ট—সারাদিন খাই নি তবে খেতে দেবে না?–ঠিক দেবে—এত বড়োলোকের বাড়ি, কত লোক তো খাবে বলতে দোষ কি? কে-ই বা চিনবে আমায় এখানে?…।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিল না। সে বেশ বুঝিল, মনে মোল আনা ইচ্ছা থাকিলেও মুখ দিয়া এ কথা সে বলিতে পারিবে না কাহারও কাছে লজ্জা করিবে। লজ্জা না করিলে সে যাইত। মুখচোরা হওয়ার অসুবিধা সে জীবনে পদে পদে দেখিয়া আসিতেছে।
কলিকাতা ছাড়িয়া মনসাপোতা ফিরিবে? কথাটা সে ভাবিতে পারে না—প্রত্যেক রক্তবিন্দু বিদ্রোহী হইয়া উঠে। তাহার জীবনসন্ধানী মন তাহাকে বলিয়া দেয় এখানে জীবন, আলো, পুষ্টি, প্রসারতা—সেখানে অন্ধকার, দৈন্য, নিভিয়া যাওয়া। কিন্তু উপায় কই তাহার হাতে? সে তো চেষ্টার ত্রুটি করে নাই। সব দিকেই গোলমাল। কলেজের মাহিনা না দিলে, আপাতত পরীক্ষা দিতে দিলেও, বেতন শোধ না করিলে প্রমোশন বন্ধ। থাকিবার স্থানের এই দশা, দু-বেলা ওষুধের কারখানার ম্যানেজার উঠিয়া যাইবার তাগিদ দেয়, আহার তথৈবচ, সুন্দর-ঠাকুরের দেনা, মায়ের কষ্ট—একেই তত সে সংসারানভিজ্ঞ, স্বপ্নদর্শী প্রকৃতির—কিসে কি সুবিধা হয় এমনিই বোঝে না—তাহাতে এই কয় দিনের ব্যাপার তাহাকে একেবারে দিশাহারা করিয়া তুলিয়াছে।
বাসায় আসিয়া ছাদের উপর বসিল। একখানা খারা কুড়াইয়া আনিয়া ভাবিল—আচ্ছা, দেখি দিকি কোন্ পিঠটা পড়ে? পরে নিশ্চিন্দিপুরে বাল্যে দিদির কাছে যেমন শিখিয়াছিল, সেইভাবে চোখ বুজিয়া খারাটা ঘুড়িয়া ফেলিয়া দেখিল—একবার-দুবারকলিকাতা ছাড়িয়া যাওয়ার দিকটাই পড়ে। তৃতীয়বার ফেলিয়া দেখিতে তাহার সাহস হইল না।
বাল্যকাল হইতে নিশ্চিন্দিপুরের বিশালাক্ষী দেবীর উপর তাহার অসীম শ্রদ্ধা। করুণাময়ী দেবীর কথা কত সে শুনিয়াছে, সে তো তার গ্রামের ছেলে-কলিকাতায় কি তার শক্তি খাটে না?
পরীক্ষা হইবার দিনকয়েক পরে একদিন অনিল তাহাকে জানাইল সায়েন্স সেকশনের মধ্যে সে গণিত ও বস্তুবিজ্ঞানে প্রথম হইয়াছে, প্রফেসরের বাড়ি গিয়া নম্বর জানিয়া আসিয়াছে। অপু শুনিয়া আন্তরিক সুখী হইল, অনিলকে সে ভারি ভালোবাসে, সত্যিকার চবিত্রবান বুদ্ধিমান ও উদারমতি ছাত্র। অনিলের যে জিনিসটা তাহার ভালো লাগে না, সেটা তাহার অপরকে তীব্রভাবে আক্রমণ ও সমালোচনা করিবার একটা দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন তুচ্ছ কাজে বা জিনিসে অপু তাহার আসক্তি দেখে নাই-কোনও ছোট কথা, কি সুবিধার কথা, কি বাজে খোশগল্প তাহার মুখে শোনে নাই।
অপু দেখিয়াছে সব সময় অনিলের মনে একটা চাঞ্চল্য, একটা অতৃপ্তি—তাহার অধীরে মন মহাভারতের বকপী ধর্মরাজের মতো সব সময়ই ফাদিয়া বসিয়া আছেকা চ বার্তা?
অপুর সহিত এইজন্যেই অনিলের মিলিয়াছিল ভালো। দুজনের আশা আকাঙক্ষা, প্রবৃত্তি এক ধরনের। অপুর বাংলা ও ইংরেজি লেখা খুব ভালো, কবিতা-প্রবন্ধ, মায় একখানা উপন্যাস পর্যন্ত লিখিয়াছে। দু-তিনখানা বাঁধানো খাতা ভর্তি—লেখা এমন কিছু নয়, গল্পগুলি ছেলেমানুষি ধরনের উচ্ছ্বাসে ভরা, কবিতা-রবি ঠাকুরের নকল, উপন্যাসখানাতে-জলদস্যুর দল, প্রেম, আত্মদান, কিছুই বাদ যায় নাই কিন্তু এইগুলি পড়িয়াই অনিল সম্প্রতি অপুর আরও ভক্ত হইয়া উঠিয়াছে।
সপ্তাহের শেষে দুজনে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াইতে গেল। একটা ঝিলের ধারের ঘন সবুজ লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে বসিয়া অনিল বন্ধুকে একটা সুসংবাদ দিল। বাগানে আসিয়া গাছের ছায়ায় এইভাবে বসিয়া বলিবে বলিয়াই এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিল। তাহার বাবার এক বন্ধু তাহাকে খুব ভালোবাসেন, বড়বনীর অভ্রের খনির তিনি ছিলেন একজন অংশীদার, তিনি গত পরীক্ষার ফলে অনিলের উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া নিজের খরচে বিদেশে পাঠাইতে চাহিতেছেন, আই.এসসি.-টা পাস দিলেই সোজা বিলাত বা ফ্রান্স।
কেমব্রিজে কি ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়ব, রাদারফোর্ড আছেন, টমসন আছেন—এঁদের সব দুবেলা দেখতে পাওয়া একটা পুণ্য-যুদ্ধ থামলে জার্মানিতে যাব, মস্ত জাত-বিরাট ভাইটালিটি—গয়টে, অস্টওয়ালডের দেশ-ওখানে কি আর না যাব?
অনিল অপুর বিদেশে যাইবার টান জানে-বলিল, আপনাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করব। নাহয় দু-জনে আমেরিকায় চলে যাব–আমি সব ঠিক করব দেখবেন।
অনিলের প্রভাব যেমন অপুর জীবনে বিস্তার লাভ করিতেছিল, সঙ্গে সঙ্গে অপুর চরিত্রের পবিত্রতা, মনের ছেলেমানুষি ও ভাবগ্রাহিতা অনিলের কঠোর সমালোচনা ও অযথা আক্রমণপ্রবৃত্তিকে অনেকটা সংযত করিয়া তুলিতেছিল। দূরের পিপাসা অপুর আরও অনেক বেশি, অনেক উদ্দাম-কলিকাতার ধোঁয়াভরা, সংকীর্ণ, ভ্যাপসা-গন্ধ সিওয়ার্ড ডিচের ভিতর হইতে বাহির হইয়া হঠাৎ যেন একটা উদার প্রান্তর, জ্যোৎস্নামাখা মুক্ত আকাশ, পাখিদের আনন্দভরা পক্ষ-সংগীতের, একটা বন-প্রান্তের রহস্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অপুর কথার সুরে, জীবন-পিপাসু নবীন চোখের দৃষ্টিতে, অন্তত অনিলের তো মনে হয়।
কোন্ পথে যাওয়া হইবে সে কথা উঠিল। অপু উৎসাহে অনিলের কাছে ঘেঁষিয়া বলিল–এসো একটা প্যাক্ট করি—দেখি হাত? এসো আমরা কখনো কেরানীগিরি করব না, পয়সা পয়সা করব না কখখনো সামান্য জিনিসে ভুলব না কখনও-ব্যাস?…পরে মাটিতে একটা ঘুষি মারিয়া বলিল-খুব বড় কিছু একটা করব জীবনে।
অনিল সাধারণত অপুর মতো নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়া উঠে না, তবুও আজ উৎসাহের মুখে অনেক কথা বলিয়া ফেলিল, বিলাতে পড়া শেষ করিয়া সে আমেরিকায় যাইবে, জাপান হইয়া দেশে ফিরিবে। বিদেশ হইতে ফিরিয়া সারাজীবন বৈজ্ঞানিক গবেষণা লইয়াই থাকিবে।
অপু বলিল—যখন দেশে ছিলাম, তখন আমার একখানা ‘প্রাকৃতিক ভূগোল’ বলে ছেঁড়া, পুরোনো বই ছিল—তাতে লেখা ছিল, এমন সব নক্ষত্র আছে, যাদের আলো আজও এসে পৃথিবীতে পেীছয় নি, সে-সব এত দূরে-মনে আছে, সন্ধ্যের সময় একটা নদীতে নৌকা ছেড়ে দিয়ে নৌকার ওপর বসে সে কথা ভাবতাম, ওপারে একটা কদম গাছ ছিল, তার মাথাতে একটা তারা উঠত সকলের আগে, তারাটার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম—কি যে একটা ভাব হত মনে! একটা mystery. একটা uplift-এর ভাব—ছেলেমানুষ তখন, সে-সব বুঝতাম না, কিন্তু সেই থেকে যখনই মনে দুঃখ হয়েছে, কি কোনও ছোট কাজে গিয়েছে, তখনই আকাশের নক্ষত্রদের দিকে চাইলেই আবার ছেলেবেলার সেই uplift-এর ভাবটা, একটা joy, বুঝলে? একটা অদ্ভুত transcendental joy–সে ভাই মুখে তোমাকে–
বেলা পড়িলে দু-জনে স্টিমারে কলিকাতায় ফিরিল।
পরদিন কলেজের কমনরুমে অনেকক্ষণ আবার সেই কথা।
কলেজ হইতে উৎফুল্ল মনে বাহির হইয়া অনিল প্রথমে দোকানে এক কাপ চা খাইল, পরে ফুটপাতের ধারে দাঁড়াইয়া একটুখানি ভাবিল, কালীঘাটে মাসির বাড়ি যাওয়ার কথা আছে, এখন যাইবে কিনা। একখানা বই কিনিবার জন্য একবার কলেজ স্ট্রীটেও যাওয়া দরকার। কোথায় আগে যায়? অপূর্ব একমাত্র ছেলে, যার কথা তার সব সময় মনে হয়। যে কোনরূপে হউক অপূর্বকে সে নিশ্চয়ই বিদেশ দেখাইবে।
তলপেটে অনেকক্ষণ হইতে একটা কী বেদনা বোধ হইতেছিল, এইবার যেন একটু বাড়িয়াছে, হাঁটিয়া চৌরঙ্গির মোড় পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, সেটা আর না যাওয়াই ভালো। সম্মুখেই ডালহাউসি স্কোয়ারের ট্রাম, সে ভাবিল—পরেরটাতে যাব, বেজায় ভিড়, ততক্ষণ বরং চিঠিখানা ডাকে ফেলে আসি।
নিকটেই লাল রংয়ের গোল ডাকবাক্স ফুটপাথের ধারে, ডাকবাক্সটার গা ঘেঁষিয়া একজন মুসলমান ফেরিওয়ালা পাকা কাঁচকলা বিক্রি করিতেছে, তাহার বাজরায় পা না লাগে এইজন্য এক পায়ে ভর করিয়া অন্য পা-খানা একটু অস্বাভাবিক রকমে পিছনে বাঁকাভাবে পাতিয়া সে সবে চিঠিখানা ডাকবাক্সের মুখে ছাড়িয়া দিয়াছে—এমন সময় হঠাৎ পিছন হইতে যেন এক তীক্ষ্ণ বর্শা দিয়া তাহার দেহটা এফোঁড়-ওফোঁড় করিয়া দিল, এক নিমেষে, অনিল সেটাতে হাত দিয়া সামলাইতেও যেন অবকাশ পাইল না। হঠাৎ যেন পায়ের তলা হইতে মাটিটা সরিয়া গেল…চোখে অন্ধকাব—কাঁচকলার বাজরার কানাটা মাথায় লাগিতেই মাথাটায় একটা বেদনা—মুসলমানটি কি বলিয়া উঠিল—হৈ হৈ, বহু লোক—কি হয়েছে মশায়?…কি হল মশায়?…সবো সরো-বাতাস করো…বরফ নিয়ে এসো…এই যে আমার রুমাল নিন না…।
অনিলের দুটি মাত্র কথা শুধু মনে ছিল—একবার সে অতিকষ্টে গোঙাইয়া গোঙাইয়া বলিল—রি-রিপন কলেজ-অপুর্ব রায়-রিপন
আর মনে ছিল সামনের একটা সাইন বোর্ড-গণেশচন্দ্র দা এন্ড কোং-কারবাইডের মশলা, তারপরেই সেই তীক্ষ্ণ বর্শাটা পুনরায় কে যেন সজোরে তলপেটে ঢুকাইয়া দিল—সঙ্গে সঙ্গে সব অন্ধকার–
কতক্ষণ পরে সে জানে না, তাহার জ্ঞান হইল। একটা বাক্স বা ঘরের মধ্যে সে শুইয়া আছে, ঘরটা বেজায় দুলিতেছে—পেটে ভয়ানক যন্ত্রণাকাহারা কি বলিতেছে, অনেক মোটরগাড়ির ভেঁপুর শব্দ—আবার ধোঁয়া ধোঁয়া…
পুনরায় যখন অনিলের জ্ঞান হইল, সে চোখ মেলিয়া চাহিয়া দেখিল একটা বড়ো সাদা দেওয়ালের পাশে একখানা খাটে সে শুইয়া আছে। পাশে তাহার বাবা ও ছোটকাকা বসিয়া, আরও তিনজন অপরিচিত লোক। নার্সের পোশাক পরা দু-জন মেম। এটা হাসপাতাল? কোন্ হাসপাতাল? কি হইয়াছে তাহার? তলপেটে যন্ত্রণা তখনও সমান, শরীর ঝিম্ ঝিম্ করিতেছে, সারা দেহ যেন অবশ।
পরদিন বেলা দশটার সময় অপু গেল। সেই কাল খবর পাইয়া তখনই ছুটিয়া শিয়ালদহের মোড়ে গিয়াছিল। সঙ্গে ছিল সত্যেন ও চার-পাঁচজন ছেলে। টেলিফোনে অ্যাম্বুলেন্সে গাড়ি আনাইয়া তখনই সকলে মিলিয়া তাহাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় ও বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। ডাক্তার বলেন, হার্নিয়া…স্ক্রাঙ্গুলেটেড হার্নিয়া, তখনই অস্ত্র করা হইয়াছে…
বৈকালেও সে গেল। কেবিন ভাড়া করা হইয়াছে, অনিলের মা বসিয়াছিলেন, অপু গিয়া পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল। অনিল এখন অনেকটা ভালো আছে, অস্ত্র করার পরে বেজায় যন্ত্রণা পাইয়াছিল, সারারাত ও সারাদিন দুপুরের পর সেটা একটু কম। মুখ রক্তশূন্য পাণ্ডুর। সে হাসিয়া অপুর হাত ধরিয়া কাছে বসাইল, বলিল—স্বাস্থ্যের মতন জিনিস আর নেই, যতই বলুন—এই তিনটে দিন যেন একেবারে মুছে গিয়েছে জীবন থেকে।
অপু বলিল—বেশি কথা বোলো না, যন্ত্রণা কেমন এখন?
অনিলের মা বলিলেন, তোমার কথা সব শুনেছি, ভাগ্যিস তুমি ছিলে বাবা সেদিন!
অনিল বলিল,-দেখবেন মজা, ঘণ্টা নাড়লেই নার্স এখুনি ছুটে আসবে—বাজাবো দেখবেন?—সে হাসিয়া একটা হাত-ঘণ্টা বাজাইতেই লম্বা একজন নার্স আসিয়া হাজিব। সে চলিয়া গেলে অনিলের মা বলিলেন—কি যে করিস মিছিমিছি? ছিঃ–
দুজনেই খুব হাসিতে লাগিল।
খানিকক্ষণ গড়ের মাঠের দিকে বেড়াইয়া সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরিয়া অপু সবে আলোটি জ্বালিয়াছে, এমন সময় সত্যেন ও অনিলের পিসতুতো ভাই ফণী—অপু তাহাকে হাসপাতালে প্রথম দেখিয়াছে, সেখানেই প্রথম আলাপ—ব্যস্তসমস্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকিল। সত্যেন বলিল—ও, তোমাকে দু-বার এর আগে খুঁজে গেছি—এখুনি হাসপাতালে এসো—জানো না?…
অপু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উহাদের মুখের দিকে চাহিতেই ফণী বলিল—অনিল মাবা গিয়েছে এই সাড়ে ছয়টার সময় হঠাৎ।
সকলে ছুটিতে ছুটিতে হাসপাতালে গেল। অনিলের মৃতদেহ খাট হইতে নামাইয়া সাদা চাদর দিয়া ঢাকিয়া মেজেতে রাখিয়াছে। বহু আত্মীয়স্বজনে কেবিন ভবিয়া গিয়াছে, ক্লাসের অনেক ছেলে উপস্থিত, একদল ছেলে এইমাত্র এসেন্স ও ফুলের তোড়া লইয়া কেবিনে ঢুকিল। অল্প পরেই মৃতদেহ নিমতলায় লইয়া যাওয়া হইল।
সব কাজ শেষ হইতে বাত্রি তিনটা বাজিয়া গেল।
অন্য সকলে গঙ্গাস্নান করিতে লাগিল। অপু বলিল, তোমরা নাও, আমি গঙ্গায় নাইবো না, কলের জলে সকালবেলা নাইবো। কলকাতাব গঙ্গায় নাইতে আমার মন যায় না।
অনিলের বাবার মতো লোক সে কখনও দেখে নাই। এত বিপদেও তিনি সারারাত বাঁধানো চাতালে বসিয়া ধীবভাবে কাঠের নল বসানো সটকাতে তামাক টানিতেছেন! অপুকে বার-দুই জিজ্ঞাসা করিয়াছেন—বাবা তোমার ঘুম লাগে নি তো?…কোন কষ্ট হয় তো বলল বাবা।
অপু শুনিয়া চোখের জল রাখিতে পারে নাই।
সুনীল সিগারেট কেসটা তাহার জিম্মায় রাখিয়া জলে নামিলে সে ঘাটের ধাপের উপর বসিয়া রহিল। অন্ধকার আকাশে অসংখ্য জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, রাত্রিশেষের আকাশে উজ্জ্বল সপ্তর্ষিমণ্ডল ওপারে জেসপ কোম্পানির কারখানার মাথায় ঝুঁকিয়া পড়িতেছে, পূর্ব-আকাশে চিত্রা প্রত্যাসন্ন দিবালোকের মুখে মিলাইয়া যাইতেছে। অপু মনের মধ্যে কোনও শোক কি দুঃখের ভাব খুঁজিয়া পাইল না—কিন্তু মাত্র তিনদিন আগে কোম্পানির বাগানে বসিয়া যেমন অনিলের সঙ্গে গল্প করিয়াছিল, সারা আকাশের অসংখ্য নক্ষত্ররাজির দিকে চাহিয়া বাল্যে নদীর ধারে বসিয়া সন্ধ্যার প্রথম নক্ষত্রটি দেখিবার দিনগুলির মতো এক অপূর্ব, অবর্ণনীয় রহস্যের ভাবে তাহার মন পরিপূর্ণ হইয়া গেল কেমন মনে হইতে লাগিল, কি একটা অসীম রহস্য ও বিপুলতার আবেগে নির্বাক নক্ষত্রজগৎটা যেন মুহূর্তে মুহূর্তে স্পন্দিত হইতেছে।
অনিলের মৃত্যুর পর অপু বড়ো মুষড়াইয়া পড়িল। কেমন এক ধরনের অবসাদ শরীরে ও মনে আশ্রয় করিয়াছে, কোন কাজে উৎসাহ আসে না, হাত-পা উঠে না।
বৈকালে ঘুরিতে ঘুরিতে সে কলেজ স্কোয়ারের একখানা বেঞ্চির উপর বসিল। এতদিন তো এখানে রহিল, কিছুই স্থির হইল না, এভাবে আর কতদিন চলে? ভাবিল, না হয় অ্যাম্বুলেন্সে যেতাম, কলেজের অনেকে তো যাচ্ছে, কিন্তু মা কি তা যেতে দেবে?
পরে ভাবিল—বাড়ি চলে যাই, মাসখানেক অর্ডারলি রিট্রিট করা যাক।
পাশে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক অনেকক্ষণ হইতে বসিয়া ছিলেন। মধ্যবয়সি লোক, চোখে চশমা, হাতের শিরগুলি দড়ির মতো মোটা। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সাঁতারের ম্যাচ কবে হবে জানেন?
অপু জানে না, বলিতে পারিল না। ক্রমে দু-চার কথায় আলাপ জমিল। সাঁতারেরই গল্প। কথায় কথায় প্রকাশ পাইল—তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার বহুস্থান ঘুরিয়াছেন। অপু কৌতূহল দমন করিতে না পারিয়া তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিল।
ভদ্রলোক বলিলেন,-আমার নাম সুরেন্দ্রনাথ বসু মল্লিক–
অনেকদিনের একটা কথা অপুর মনে পড়িয়া গেল, সে সোজা হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—আমি আপনাকে চিনি, আপনি অনেকদিন আগে বঙ্গবাসীতে বিলাত-যাত্রীর চিঠি লিখতেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ—ঠিক, সে দশ এগাবো বছর আগেকার কথা—তুমি কি করে জানলে? পড়তে নাকি?
-ওঃ, শুধু পড়তাম না, হাঁ করে বসে থাকতাম কাগজখানার জন্যে—তখন আমার বয়েস বছর দশ। পাড়াগাঁয়ে থাকতাম—কি inspiration যে পেতাম আপনার লেখা থেকে!…
ভদ্রলোকটি ভারি খুশি হইলেন। সে কি করে, কোথায় থাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। বলিলেন,–দ্যাখো কোথায় বসে কে লেখে আর কোথায় গিয়ে তার বীজ উড়ে পড়ে—বিলেতে হ্যাম্পস্টেডের একটা বোর্ডিং-এ বসে লিখতাম, আর বাংলায় এক obscure পাড়াগাঁয়ের এক ছোট ছেলে আমার লেখা পড়ে—বাঃ বাঃ–
ভদ্রলোকটির ব্যবসাবাণিজ্যে খুব উৎসাহ দেখা গেল। মাদ্রাজে সমুদ্রের ধারে জমি লইয়াছেন, নারিকেল ও ভ্যানিলার চাষ করিবেন। নিঃসম্বল তেরো বৎসরের নিগ্রো বালককে ইউরোপে আসিয়া নিজের উপার্জন নিজে করিতে দেখিয়াছেন, দেশের যুবকদের চাষবাস করিতে উপদেশ দেন।
ভদ্রলোকটিকে আর অপুর অপরিচিত মনে হইল না। তাহার বাল্যজীবনের কতকগুলি অবর্ণনীয়, আনন্দ-মুহূর্তের জন্য এই প্রৌঢ় ব্যক্তিটি দায়ী, ইহারই লেখার ভিতর দিয়া বাহিরের জগতের সঙ্গে সেই আনন্দভরা প্রথম পরিচয়
সম্পূর্ণ নতুন ধরনের উৎসাহ লইয়া সে ফিরিল। কে জানিত বঙ্গবাসীর সে লেখকের সঙ্গে এভাবে দেখা হইয়া যাইবে।…শুধু বাঁচিয়া থাকাই এক সম্পদ, তোমার বিনা চেষ্টাতেই এই অমৃতময়ী জীবনধারা প্রতি পলের রসপাত্র, পূর্ণ করিয়া তোমার অন্যমনস্ক, অসতর্ক মনে অমৃত পরিবেশন করিবে…সে যে করিয়া হউক বাঁচিবে।
সন্ধ্যা ঠিক হয় নাই, উঠানে তেলি-বাড়ির বড়ো-বৌ দাঁড়াইয়া কি গল্প করিতেছিল, দুর হইতে অপুকে আসিতে দেখিয়া হাসিমুখে বলিল—কে আসছে বলুন তো মা-ঠাকুন?—সর্বজয়ার বুকের ভিতরটা কেমন করিয়া উঠিল, অপু নয় তো—অসম্ভব—সে এখন কেন
পরক্ষণেই সে ছুটিয়া আসিয়া অপুকে বুকের ভিতর জড়াইয়া ধরিল। সর্বজয়ার চোখের জলে তাহার জামার হাতটা ভিজিয়া উঠিল। মাকে যেন এবার নিজের অপেক্ষা মাথায় ছোট, দুর্বল ও অসহায় বলিয়া অপুর মনে হইতে লাগিল। তপঃকৃশ শবরীর মতো ক্ষীণাঙ্গী, আলুথালু, অধরুক্ষ চুলের গোছা একদিকে পড়িয়াছে, মুখের চেহারা এখনও সুন্দর, গ্রীবা ও কপালের রেখাবলী এখনও অনেকাংশে ঋজু ও সুকুমার। তবে এবার মায়ের চুল পাকিয়াছে, কানের পাশের চুলে পাক ধরিয়াছে। নিজের সবল দৃঢ় বাহুবেষ্টনে, সরলা, চিরদুঃখিনী মাকে সংসারের সহস্র দুঃখ-বিপদ হইতে বাঁচাইয়া রাখিতে অপুর ইচ্ছা যায়। এ ভাবটা এইবার প্রথম সে মনের মধ্যে অনুভব করিল, ইতিপূর্বে কখনও হয় নাই।
বড়ো-বৌ একপাশে হাসিমুখে দাঁড়াইয়াছিল, সে অপুকে ছোট দেখিয়াছে, এখন আর তাহাকে দেখিয়া ঘোমটা দেয় না। সর্বজয়া বলিল,-এবার ও এসেছে বৌমা, এবার কালই কিন্তু
অপু নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি খুড়িমা, কাল কি?
বড়ো-বৌ হাসিয়া বলিল,-দেখো কাল,—আজ বলব না তো!
খিচুড়ি খাইতে ভালোবাসে বলিয়া সর্বজয়া অপুকে রাত্রে খিচুড়ি রাঁধিয়া দিল; পেট ভবিয়া খাওয়া ঘটিল, এই সাত-আটদিন পর আজ মায়ের কাছে। সর্বজয়া জিজ্ঞাসা করিল,হ্যাঁ রে, সেখানে খিচুড়ি খেতে পাস?
অপুর শৈশবে তাহার মা শত প্রতারণার আবরণে নগ্ন দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর রূপকে তাহাদের শিশুচক্ষুর আড়াল করিয়া রাখিতেন, এখন আবার অপুর পালা। সে বলিল,-, বাদলা হলেই খিচুড়ি হয়।
–কি ডালের করে?
–মুগের বেশি, মসুরীরও করে, খাঁড়ি মসুরী।
—সকালে জলখাবার খেতে দেয় কি কি?
অপু প্রাতঃকালীন জলযোগের এক কাল্পনিক বিবরণ খুব উৎসাহের সহিত বিবৃত করিয়া গেল। মোহনভোগ, চা, এক-একদিন লুচিও দেয়। খাওয়ার বেশ সুবিধা!
প্রীতির টুইশানি কোনকালে চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু অপু সে কথা মাকে জানায় নাই; সর্বজয়া বলিল—হাঁ রে, তুই যে সে মেয়েটিকে পড়াস—তাকে কি বলে ডাকিস? খুব বড়োলোকের মেয়ে, না?
—তার নাম ধরেই ডাকি—
–দেখতে-শুনতে বেশ ভালো?
–বেশ দেখতে—
–হ্যাঁ রে, তোর সঙ্গে বিয়ে দেয় না? বেশ হয় তা হলে–
অপু লজ্জার মুখে বলিল,-হা–তারা হল বড়োলোক আমার সঙ্গে—তা কি কখনও তোমার যেমন কথা!
সর্বজয়ার কিন্তু মনে মনে বিশ্বাস অপুর মতো ছেলে পাইলে লোকে এখনি লুফিয়া লইবে। অপু ভাবে, তবুও তো মা আসল কথা কিছুই জানে না। প্রীতির টুইশানি থাকিলে কি আর না খাইয়া দিন যায় কলিকাতায়?
অপু দেখিল-সে যে টাকা পাঠায় নাই, মা একটিবারও সে-কথা উত্থাপন করিল মা, শুধুই তাহার কলিকাতার অবস্থানের সুবিধা-অসুবিধা সংক্রান্ত নানা আগ্রহ-ভরা প্রশ্ন। নিজেকে এমনভাবে সর্বপ্রকারে মুছিয়া বিলোপ করিতে তাহার মায়ের মতো সে আর কাহাকেও এ পর্যন্ত দেখে নাই। সে জানিত বাড়ি গেলে এ লইয়া মা কোন কথা তুলিবে না।
সর্বজয়া একটা এনামেলের বাটি ও গ্লাস ঘরের ভিতর হইতে আনিয়া হাসিমুখে বলিল,—এই দ্যাখ, এই দু-খানা ছেঁড়া কাপড় বদলে তোর জন্যে নিইচিবেশ ভালো, না?…কত বড়ো বাটিটা দ্যাখ।
অপু ভাবিল, মা যা দ্যাখে তাই বলে ভালো, এ আর কি ভালো, যদি আমার সেই পুরানোদোকানে কেনা প্লেটগুলো মা দেখত।
কলিকাতায় সে দুরুহ জীবনসংগ্রামের পর এখানে বেশ আনন্দে ও নির্ভাবনায় দিন কাটে। রাত্রে মায়ের কাছে শুইয়া সে আবার নিজেকে ছেলেমানুষের মতো মনে করে বলে, সেই গানটা কি মা, ছেলেবেলায় তুমি আর আমি শুয়ে শুয়ে রাত্রে গাইতাম—এক-একদিন দিদিও—সেই চিরদিন কখনও সমান না যায়-কভু বনে বনে রাখালেরি সনে, কভু বা রাজত্ব পায়
পরে আবদারের সুরে বলে–গাও না মা, গানটা?
সর্বজয়া হাসিয়া বলে–হ্যাঁ, এখন কি আর গলা আছে—দূর–
–এসো দু-জনে গাই—এসো না মা-খুব হবে, এসো–
সর্বজয়ার মনে আছে—অপু যখন ছোট ছিল তখন কোনও কোনও মেয়ে-মজলিশে, ঘোট ছোট ছেলেমেয়েদের গান হয়তো হইত, অপুর গলা ছিল খুব মিষ্ট, কিন্তু তাহাকে প্রথমে কিছুতেই গান গাওয়ানো যাইত না—অথচ যেদিন তাহার গাহিবার ইচ্ছা হইত, সেদিন মায়ের কাছে চুপি চুপি বার বার বলিত, আমি কিন্তু আজ গান গাইবো না, গাইতে বোলো না। অর্থাৎ সেদিন তাকে এক-আধবার বলিলেই সে গাহিবে। সর্বজয়া ছেলের মন বুঝিয়া অমনি বলিত—তা অপু এবার কেন একটা গান কর না?…দু-একবার লাজুক মুখে অস্বীকার করার পর অমনি অপু গান শুরু করিয়া দিত।
সে অপু এখন একজন মানুষের মতন মানুষ। এত রূপ এ অঞ্চলের মধ্যে কে কবে দেখিয়াছে? একহারা চেহারা বটে, কিন্তু সবল, দীর্ঘ, শক্ত হাত-পা। কি মাথার চুল, কি ডাগর চোখের নিষ্পাপ পবিত্র দৃষ্টি; রাঙা ঠোঁটের দু-পাশে বাল্যের সে সুকুমার ভঙ্গি এখনও বিলুপ্ত হয় নাই, শুধু সর্বজয়াই তাহা ধরিতে পারে।
অপু কিন্তু সে ছেলেবেলার অপু আর নাই। প্রায় সবই বদলাইয়া গিয়াছে, সে অপূর্ব হাসি, সে ছেলেমানুষি, সে কথায় কথায় মান অভিমান, আবদার, গলার সে রিনরিনে মিষ্টি সুর—এখনও অপুর স্বর খুবই মিষ্টি—তবুও সে অপরূপ বাল্যস্বর, সে চাঞ্চল্য—পাগলামি—সে সবের কিছুই নাই। সব ছেলেই বাল্যে সমান ছেলেমানুষ থাকে না কিন্তু অপু ছিল মূর্তিমান শৈশব। সরলতায়, দুষ্টামিতে, রূপে, ভাবুকতায়—দেবশিশুর মতো! এক ছেলে ছিল তাই কি, শত ছেলেতে কি হয়? সর্বজয়া মনে মনে বলে-বেশি চাই নে, দশটা পাঁচটা চাই নে ঠাকুর, ওকেই আর জন্মে আবার কোলজোড়া করে দিয়ো।
সর্বজয়ার জীবনের পাত্র পরিপূর্ণ করিয়া অপু যে অমৃত শৈশবে পরিবেশন করিয়াছে, তারই স্মৃতি তার দুঃখভরা জীবন-পথের পাথেয়। আর কিছুই সে চায় না।
কোনও কোনও দিন রাত্রে অপু মায়ের কাছে গল্প শুনিতে চায়। সর্বজয়া বলে—তুই তো কত ইংরেজি বই পড়িস, কত কি—তুই একটা গল্প বল না বরং শুনি। অপু গল্প করে। দু-জনে নানা পরামর্শ করে; সর্বজয়া পুত্রের বিবাহ দিবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কাটাদহের সান্ডাল বাড়ি নাকি ভালো মেয়ে আছে সে শুনিয়াছে, অপু পাশটা দিলেই এইবার…।
তারপর অপু বলিল,ভালো কথা মা—আজকাল জেঠিমারা কলকাতায় বাড়ি পেয়েছে যে! সেদিন তাদের বাড়ি গেছলাম–
সর্বজয়া বলে,-তাই নাকি?…তোকে খুব যত্নটত্ন করলে?—কি খেতে দিলে—
অপু নানা কথা সাজাইয়া বানাইয়া বলে। সর্বজয়া বলে,—আমায় একবার নিয়ে যাবি–কলকাতা কখনও দেখি নি, বটঠাকুরদের বাড়ি দুদিন থেকে মা-কালীর চরণ দর্শন করে আসি তা হলে?…
অপু বলে,—বেশ তো মা, নিয়ে যাব, যেয়ো সেই পুজোর সময়।
সর্বজয়া বলে,—একটা সাধ আছে অপু, বঠাকুরদের দরুন নিশ্চিন্দিপুরের বাগানখানা তুই মানুষ হয়ে যদি নিতে পারতিস ভুবন মুখুজ্যেদের কাছ থেকে, তবে
সামান্য সাধ, সামান্য আশা। কিন্তু যার সাধ, যার আশা, তার কাছে তা হোটও নয়, সামান্যও নয়। মায়ের ব্যথা কোন্খানে অপুর তাহা বুঝিতে দেরি হয় না। মায়ের অত্যন্ত ইচ্ছা নিশ্চিন্দিপুরে গিয়া বাস করা, সে অপু জানে। সর্বজয়া বলে,—তুই মানুষ হলে, তোর একটা ভালো চাকরি হলে, তোর বৌ নিয়ে তখন আবার নিশ্চিন্দিপুরে গিয়ে ভিটেতে কোঠা উঠিয়ে বাস করব। বাগানখানা কিন্তু যদি নিতে পারিস—বড়ো ইচ্ছে হয়।
অপুর কিন্তু একটা কথা মনে হইল, মা আর বেশিদিন বাঁচিবে না। মায়ের চেহারা অত্যন্ত রোগা হইয়া গিয়াছে এবার, কেবলই অসুখে ভুগিতেছে। মুখে যত সান্ত্বনা দেওয়া, যত আশার কথা বলাসব বলে। জানালার ধারে তক্তপোশে দুপুরের পর মা একটু ঘুমাইয়া পড়ে, অনেক বেলা পড়িয়া যায়। অপু কাছে আসিয়া বসে, গায়ে হাত দিয়া বলে,—গা যে তোমার বেশ গরম, দেখি?
সর্বজয়া সেসব কথা উড়াইয়া দেয়। এ-গল্প ও-গল্প করে। বলে,-হা, অতসীর মা আমার কথাটথা কিছু বলে?
অপু মনে মনে ভাবে—মা আর বাঁচবে না—বেশি দিন। কেমন যেন-কেমন-কি করে থাকব মা মারা গেলে?
অনেক বেলা পড়িয়া যায়–
জানালার পাশেই একটা আতা গাছ। আতা ফুলের মিষ্টি ভুরভুবে গন্ধ বৈকালের বাতাসে। একটু পোড়ড়া জমি। এক ঢিবি সুরকি। একটা চারা জামরুল গাছ। পুরোনো বাড়ির দেওয়ালের ধারে ধারে বনমূলার গাছ। কন্টিকারির ঝাড়। একটা জায়গায় কঞ্চি দিয়া ঘিরিয়া সর্বজয়া শাকের ক্ষেত করিয়াছে।
একটা অদ্ভুত ধরনের মনের ভাব হয় অপুর। কেমন এক ধরনের গভীর বিষাদ…মায়ের এই সব ছোটখাটো আশা, তুচ্ছ সাধ—কত নিষ্ফল।…মা কি ওই শাকের ক্ষেতের শাক খাইতে পারিবে?কালীঘাটের কালীদর্শন করিবে জ্যাঠাইমার বাসায় থাকিয়া!…নিশ্চিন্দিপুরের আমবাগান…
এক ধরনের নির্জনতা-সঙ্গীহীনতার ভাব…মায়ের উপর গভীর করুণা …রাঙা রোদ মিলাইতেছে চারা জামরুল গাছটাতে…সন্ধ্যা ঘনাইতেছে। ছাতারে ও শালিক পাখির দল কিচমিচ ও ঝটাপটি করিতেছে।…।
অপুর চোখে জল আসিল…কি অদ্ভুত নির্জনতা-মাখানো সন্ধ্যাটা! মুখে হাসিয়া সস্নেহে মায়ের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল,—আচ্ছা, মা, বড়ো বৌয়ের সঙ্গে বাজি রেখেছিলে কি নিয়ে বলল না-বললে না তো সেদিন?…
ছুটি ফুরাইলে অপু বাড়ি হইতে রওনা হইল।
স্টেশনে আসিয়া কিন্তু ট্রেন পাইল না, গহনার নৌকা আসিতে অত্যন্ত দেরি হইয়াছে, ট্রেন আধ ঘণ্টা পূর্বে ছাড়িয়া গিয়াছে।
সর্বজয়া ছেলের বাড়ি হইতে যাইবার দিনটাতে অন্যমনস্ক থাকিবার জন্য কাপড়, বালিশের ওয়াড় সাজিমাটি দিয়া সিদ্ধ করিয়া বাঁশবনের ডোবার জলে কাচিতে নামিয়াছে—সন্ধ্যার কিছু পূর্বে অপু বাড়ির দাওয়ায় জিনিসপত্র নামাইয়া ছুটিয়া ডোবার ধারে গিয়া পিছন হইতে ডাকিল,-মা!…
সর্বজয়া ভুলিয়া থাকিবার জন্য দুপুর হইতে কাপড় সিদ্ধ লইয়া ব্যস্ত আছে, চমকিয়া পিছন দিকে চাহিয়া আনন্দ-মিশ্রিত সুরে বলে,—তুই!-যাওয়া হল না?
অপু হাসিমুখে বলিল,-গাড়ি পাওয়া গেল না—এসো বাড়ি–
বাঁশবনের ছায়ায় মায়ের মুখে সেদিন যে অপূর্ব আনন্দের ও তৃপ্তির ছাপ পড়িয়াছিল, অপু পূর্বে কোনও দিন তাহা দেখে নাই-বহুকাল পর্যন্ত মায়ের এ মুখখানা তাহার মনে ছিল। সেদিন রাত্রে দু-জনে নানা কথা! অপু আবার ছেলেবেলাকার গল্প শুনিতে চায় মার মুখে—সর্বজয়া লজ্জিত সুরে বলে-হ্যাঁ, আমার আবার গল্প!…সেসব ছেলেবয়সের গল্প-বুঝি এখন শুনে তোর ভালো লাগবে? অপুকে আর সর্বজয়া বুঝিতে পারে না—এ সে ছোট্ট অপু নয়, সে ঠোঁট ফুলাইলেই সর্বজয়া বুঝিত ছেলে কি চাহিতেছে…এ কলেজের ছেলে, তরুণ অপু, এর মন, মতিগতি, আশা আকাঙক্ষা—সর্বজয়ার অভিজ্ঞতার বাহিরে অপু বলেনা মা, তুমি সেই ছেলেবেলার শ্যামলঙ্কার গল্পটা করো। সর্বজয়া বলে,—তা আবার কি শুনবি—তুই বরং তোর বইয়ের একটা গল্প বল্ক ত ভালো গল্প তো পড়িস?…
পরদিন সে কলিকাতায় ফিরিল।
কলেজ সেই দিনই প্রথম খুলিয়াছে, প্রমোশন পাওয়া ছেলেদের তালিকা বাহির হইয়াছে, নোটিশ বোর্ডের কাছে রথযাত্রার ভিড়—সে অধীর আগ্রহে ভিড় ঠেলিয়া নিজের নামটা আছে কিনা দেখিতে গেল।
আছে। দু-তিনবার বেশ ভালো করিয়া দেখিল। আরও আশ্চর্য এই যে, পাশেই যে সব ছেলে পাশ করিয়াছে অথচ বেতন বাকি তাহার দরুন প্রমোশন পায় নাই, তাহাদের একটা তালিকা দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু তাহার মধ্যে অপুর নাম নাই, অথচ অপু জানে তাহারই সর্বাপেক্ষা বেশি বেতন বাকি।
সে ব্যাপারটা বুঝিতে না পারিয়া ভিড়ের বাহিরে আসিল। কেমন করিয়া এরূপ অসম্ভব সম্ভব হইল, নানাদিক হইতে বুঝিবার চেষ্টা করিয়াও তকন কিছু ঠাহর করিতে পারিল না।
দু-তিনদিন পরে তাহার এক সহপাঠী নিজের প্রমোশন বন্ধ হওয়ার কারণ জানিতে অফিসঘরে কেরানীর কাছে গেল, সে-ও গেল সঙ্গে। হেড ক্লার্ক বলিল—এ কি ছেলের হাতের মোয়া হে ছোকরা! কত রোল?…পরে একখানা বাঁধানো খাতা খুলিয়া আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল—এই দ্যাখো রোল টেনলাল কালির মার্কা মারা রয়েছে—দু-মাসের মাইনে বাকি-মাইনে শোধ না দিলে প্রমোশন দেওয়া হবে না, প্রিন্সিপালের কাছে যাও, আমি আর কি করবো?
অপু তাড়াতাড়ি ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিতে গেল—তাহার রোল নম্বর কুড়ি—একই পাতায়। দেখিল অনেক ছেলের নামের সঙ্গে সঙ্গে কালিতে ডি লেখা আছে অর্থাৎ ডিফল্টার—মাহিনা দেয় নাই। সঙ্গে সঙ্গে নামের উলটাদিকে মন্তব্যের ঘরে কোন্ কোন্ মাসের মাহিনা বাকি তাহা লেখা আছে। কিন্তু তাহার নামটাতে কোন কিছু দাগ বা আঁচড় নাই—একেবারে পরিষ্কার মুক্তার মতো হাতের লেখা জুলজুল করিতেছে—রায় অপূর্বকুমার-লাল কালির একটা বিন্দু পর্যন্ত নাই…
ঘটনা হয়তো খুব সামান্য, কিছুই না-হয়তো একটা সম্পূর্ণ কমের ভুল, না হয় কেরানীর হিসাবের ভুল, কিন্তু অপুর মনে ঘটনাটা গভীর রেখাপাত করিল।
মনে আছে—অনেকদিন আগে ছেলেবেলায় তাহার দিদি যেবার মারা গিয়াছিল, সেবার শীতের দিনে বৈকালে নদীর ধারে বসিয়া ভাবিত, দিদি কি নরকে গিয়াছে? সেখানকার বর্ণনা সে মহাভারতে পড়িয়াছিল, ঘোর অন্ধকার নরকে শত শত বিকটাকার পাখি ও তাহাদের চেয়েও বিকটাকার যমদুতের হাতে পড়িয়া তাহার দিদির কি অবস্থা হইতেছে! কথাটা মনে আসিতেই বুকের কাছটায় কি একটা আটকাইয়া যেন গলা বন্ধ হইয়া আসিত—চোখের জলে কাশবন শিমুলগাছ ঝাপসা হইয়া আসিত, কি জানি কেন, সে তাহার হাস্যমুখী দিদির সঙ্গে মহাভারতেক্ত নরকের পারিপার্শ্বিক অবস্থার যেন কোন মতেই খাপ খাইয়াইতে পারিত না। তাহার মন বলিত, নানাদিদি সেখানে নাই—সে জায়গা দিদির জন্য নয়।
তারপর ওপারে কাশবনে ম্লান সন্ধ্যার রাঙা আলো যেন অপূর্ব রহস্য মাখানো মনে হইত–আপনা-আপনি তাহার শিশুমন কোন্ অদৃশ্য শক্তির নিকট হাতজোড় করিয়া প্রার্থনা করিত-আমার দিদিকে তোমরা কোন কষ্ট দিয়ো না-সে অনেক কষ্ট পেয়ে গেছে তোমাদের পায়ে পড়ি, তাকে কিছু বোলো না
ছেলেবেলার সে সহজ নির্ভরতার ভাব সে এখনও হারায় নাই। এই সেদিনও কলিকাতায় পড়িতে আসিবার সময়ও তাহার মনে হইয়াছিল—যাই না, আমি তো একটা ভালো কাজে যাচ্ছি কত লোক তো কত চায়, আমি বিদ্যে চাইছি-আমায় এর উপায় ভগবান ঠিক করে দেবেন। তাহার এ নির্ভরতা আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাইয়াছিলেন দেওয়ানপুরের হেডমাস্টার মিঃ দত্ত। তিনি ছিলেন—ভক্ত ও বিশ্বাসী খ্রিস্টান। তিনি তাহাকে যে-সব কথা বলিতেন অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে সে ভাবের কথা বলিতেন না। শুধু গ্রামার অ্যালজেব্রা নয়—কত উপদেশের কথা, গভীর বিশ্বাসেব কথা, ঈশ্বর, পরলোক, অন্তরতম অন্তরের নানা গোপনবাণী। হয়তো বা তাহার মনে হইয়াছিল, এ বালকের মনের ক্ষেত্রে এ-সকল উপদেশ সময়ে অঙ্কুরিত হইবে।
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি, বাস্তার ফেরিওয়ালা হাঁকিতেছে, পেয়ারাফুলি আম, ল্যাংড়া আমদিনবাত টিপ টিপ বৃষ্টি, পথঘাটে জল কাদা। এই সময়টার সঙ্গে অপুর কেমন একটা নিরাশ্রয়তা ও নিঃসম্বলতার ভাব জড়িত হইয়া আছে, আর-বছর ঠিক এই সময়টিতে কলিকাতায় নূতন আসিয়া অবলম্বন-শূন্য অবস্থায় পথে পথে ঘুরিতে হইয়াছিল, কি না জানি হয়, কোথায় না জানি কি সুবিধা জুটিবে—এবারও তাই।
ঔষধের কারখানায় এবার আর স্থান হয় নাই। এক বন্ধুর মেসে দিনকতক উঠিয়াছিল, এখন আবার অন্য একটি বন্ধুর মেসে আছে। নানাস্থানে ছেলে পড়ানোব চেষ্টা করিযা কিছুই জুটিল না, পরের মেসেই বা চলে কি কবিয়া? তাহা ছাড়া এই বন্ধুর ব্যবহার তত ভালো নয়, কেমন যেন বিরক্তির ভাব সর্বদাই—তাহার অবস্থা সবই জানে অথচ একদিন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, সে মেস খুঁজিয়া লইতে এত দেরি কেন করিতেছে—এ মাসটার পরে আর কোথাও সিট খালি পাওয়া যাইবে? অপু মনে বড়ো আহত হইল। একদিন তাহার হঠাৎ মনে হইল খবরের কাগজ বিক্রয় করিলে কেমন হয়? কলিকাতার খবচ চলে না? মাকেও তত…
অপু সব সন্ধান লইল। তিন পয়সা দিয়া নগদ কিনিয়া আনিতে হয় খবরের কাগজের অফিস হইতে, চার পয়সায় বিক্রি, এক পয়সা লাভ কাগজ পিছু; কিন্তু মূলধন তো চাই; কাহারও কাছে হাত পাতিতে লজ্জা করে, দিবেই বা কে? এই কলিকাতা শহরে এমন একজনও নাই যে তাহাকে টাকা দেয়? সে সুদ দিতে রাজি আছে। সমীবের কাছে যাইতে ইচ্ছা হয় না, সে ভালো করিয়া কথা কয় না। ভাবিয়া-চিন্তিয়া অবশেষে কারখানাব তেওয়ারী-বৌয়ের কাছে গিয়া সব বলিল। তেওয়ারী-বৌ সুদ লইবে না। লুকাইয়া দুটা মাত্র টাকা বাহির করিয়া দিল, তবে আশ্বিন মাসে তাহারা দেশে যাইবে, তাহার পূর্বে টাকাটা দেওয়া চাই।
ফিরিবার পথে অপু ভাবিল…বহুর পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করে, মায়ের মতো দ্যাখে, আহা কি ভালো লোক।
পরদিন সকালে সে দুটিল অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসে। সেখানে কাগজ-বিক্রেতাদের মারামারি, সবাই আগে কাগজ চায়। অপু ভিড়ের মধ্যে ঢুকিতে পারিল না—কাগজ পাইতে বেলা হইয়া গেল। তাহার পর আর এক নূতন বিপদ—অন্য কাগজওয়ালাদের মতো কাগজ হাঁকিতে পারা তো দূরের কথা, লোকে তাহার দিকে চাহিলে সে সংকুচিত হইয়া পড়ে, গলা দিয়া কথা বাহির হয় না। সকলেই তাহার দিকে চায়, সুশ্রী সুন্দর ভদ্রলোকের ছেলে কাগজ বিক্রয় করিতেছে, এ দৃশ্য তখনকার সময়ে কেহ দেখে নাই—অপু ভাবে—বা রে, আমি কি চড়কের নতুন সঙ নাকি? খানিক দুরে আর একটা জায়গায় চলিয়া যায়। কাহাকেও বিনীত ভাবে মুখের দিকে না চাহিয়া বলেএকখানা খবরের কাগজ নেবেন? অমৃতবাজার?
কলেজে যাইবার পূর্বে মাত্র আঠারোখানি বিক্রয় হইল। বাকিগুলি এক খবরের কাগজের ফেরিওয়ালা তিন পয়সা দরে কিনিয়া লইল। পরদিন লজ্জাটা অনেকটা কমিল, ট্রামে অনেকগুলি কাগজ কাটিল, বোধ হয় বাঙালি ভদ্রলোকের ছেলে বলিয়াই তাহার নিকট হইতে অনেকে কাগজ লইল।
মাসের শেষে একদিন কলেজে হৈ-চৈ উঠিল। গিয়া দেখে কোথাকার এক ছেলে লাইব্রেরির একখানা বই চুরি করিয়া পালাইতেছিল, ধরা পড়িয়াছে–তাহারই গোলমাল। অপু তাহাকে চিনিল একদিন আর বছর সে ঠাকুরবাড়িতে খাইতে যাইতেছিল, ওই ছেলেটিও বারাণসী ঘোষ স্ট্রীটের দত্তবাড়ি দরিদ্র ছাত্র হিসাবে খাইতে যাইতেছিল। শীতের রাত্রি, খুব বৃষ্টি আসাতে দুজনে এক গাড়িবারান্দার নিচে ঝাড়া দু-ঘন্টা দাঁড়াইয়া থাকে। ছেলেটি তখন অনেক দূর হইতে হাঁটিয়া অতদূর খাইতে যায় শুনিয়া অপুর মনে বড়ো দয়া হয়। সে নামও জানিত, মেট্রেপলিটন কলেজে থার্ড ইয়ারের ছেলে তাহাও জানিত, কিন্তু কোনও কথা প্রকাশ করিল না। কলেজ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট পুলিশের হাতে দিবার ব্যবস্থা করিতেছিলেন, দর্শনের অধ্যাপক বৃদ্ধ প্রসাদদাস মিত্র মধ্যস্থতা করিয়া ছাড়িয়া দিলেন।
অপুর যেন বড়ো আঘাত লাগিল-সে পিছু পিছু গিয়া অখিল মিস্ত্রি লেনের মোড়ে ছেলেটিকে ধরিল। ছেলেটির নাম হরেন, সে দিশাহারার মতো হাঁটিতেছিল। অপুকে চিনিতে পারিয়া ঝ ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। অত্যন্ত অচল হইয়াছে, ভেঁড়া কাপড়, চারিদিকে দেনা, দত্তবাড়ি আজকাল আর খাইতে দেয় না–বর্ধমান জেলায় দেশ, এখানে কোনও আত্মীয়স্বজন নাই। অপু মির্জাপুর পার্কে একখানা বেঞ্চিতে তাহাকে টানিয়া লইয়া গিয়া বসাইল, ছেলেটার মুখে বসন্তের দাগ, রং কালো, চুল রুক্ষ, গায়ের শার্ট কজির অনেকটা উপর পর্যন্ত হেঁড়া। অপুর চোখে জল আসিতেছিল, বলিল-তোমাকে একটা পরামর্শ দিই শোনোখবরের কাগজ বিক্রি করবে? বাদামভাজা খাওয়া যাক এসো—এই বাদামভাজা
পূজা পর্যন্ত দুজনের বেশ চলিল। পূজার পরই পুনমূষিক–তেওয়ারীবৌয়ের দেনা শোধ করিয়া যাহা থাকিল, তাহাতে মাসিক খরচের কিছু অংশ কুলান হয় বটে, বেশিটাই হয় না। সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষাও হইয়া গেল, এইবারই গোলমাল—সারা বছরের মাহিনা ও পরীক্ষার ফী দিতে হইবে অল্পদিন পরেই।
উপায় কিছুই নাই। সে কাহারও কাছে কিছু চাহিতে পারিবে না। হয়তো পরীক্ষা দেওয়াই হইবে না। সত্যই তো, এত টাকা—এ তো আর ছেলেখেলা নয়? মন্মথকে একদিন হাসিয়া সব কথা খুলিয়া বলে। মন্মথ শুনিয়া অবাক হইয়া গেল, বলিল—এসব কথা আগে জানাতে হয় আমাকে। মন্মথ সত্যই খুব খাটিল। নিজের দেশের বার লাইব্রেরিতে চাঁদা তুলিয়া প্রায় পঞ্চাশ টাকা আনিয়া দিল, কলেজে প্রফেসারদের মধ্যে চাঁদা তুলিয়া ফেলিল, অল্পদিনের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে অনেকগুলি টাকা আসিতে দেখিয়া অপু নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। কিন্তু বাকি বেতন একরূপ শোধ হইলেও তখনও পরীক্ষার ফী-এর এক পয়সাও জোগাড় হয় নাই, মন্মথ ও বৌবাজারের সেই ছেলেটি বিশ্বনাথ—দু-জনে মিলিয়া ভাইস-প্রিন্সিপ্যালকে গিয়া ধরিল, অপূর্বকে কলেজের বাকি বেতন কিছু ছাড়িয়া দিতে হইবে।
এদিকে ঔষধের কারখানায় থাকিবার সুবিধার জন্য অপু পুনরায় কারখানার মানেজারের নিকটে গেল। এই মাস তিনেক যদি সেখানে থাকিবার সুবিধা পায়, তবে পরীক্ষার পড়াটা করিতে পারে। এর-ওর-তার মেসে সারা বছর অস্থিতপঞ্চকভাবে থাকিয়া তেমন পড়াশুনা হয় নাই। কারখানার আর সকলে অপুকে চিনিত, পছন্দও করিত, তাহারা বলিল—ওহে, তুমি একবার মিঃ লাহিড়ীর কাছে যেতে পারো? ওর কাছে বলাই ভুল-মিঃ লাহিড়ী কারখানার একজন ডিরেক্টর, তাঁর চিঠি যদি আনতে পার, ও সুড়সুড় করে রাজি হবে এখন। ঠিকানা লইয়া অপু উপরি উপরি তিন-চার দিন ভবানীপুরে মিঃ লাহিড়ীর বাড়ি গেল, দেখা পাইল না,-বড়োলোকের গাড়িবারান্দার ধারে বেঞ্চের উপর বসিয়া চলিয়া আসে। দিনকতক কাটিল।
সেদিন রবিবার। ভাবিল, আজ আর দেখা না করিয়া আসিবে না। মিঃ লাহিড়ী বাড়ি নাই বটে, তবে বেলা এগারোটার মধ্যে আসিবেন। খানিকক্ষণ বসিয়া আছে, এমন সময় একজন ঝি আসিয়া বলিল—আপনাকে দিদিমণি ডাকছেন—
অপু আশ্চর্য হইয়া গেল। কোন্ দিদিমণি তাহাকে ডাকিবেন এখানে? সে বিস্ময়ের সুরে বলিল—আমাকে? না—আমি তো
ঝি ভুল করে নাই, তাহাকেই ডানধারে একটা বড়ো কামরা, অনেকগুলো বড়ো বড়ো আলমারি, প্রকাণ্ড বনাত-মোড়া টেবিল, চামড়ার গদি-আঁটা আরাম চেয়ার ও বসিবার চেয়ার। সরু বারান্দা পার হইয়া একটা চকমিলানো হোট পাথর-বধানো উঠান; পাশের ছোট ঘরটায় হাতলহীন চেয়ারে একটি আঠারো-উনিশ বছর বয়সের তরুণী বসিয়া টেবিলে বই কাগজ ছড়াইয়া কি লিখিতেছে, পরনে সাদাসিদে আটপৌরে লালপাড় শাড়ি, ব্লাউজ, ঢিলে-খোঁপা, গলায সরু চেন, হাতে প্লেন বালা–অপরূপ সুন্দরী! সে ঘরে ঢুকিতেই মেয়েটি হাসিমুখে চেয়ার হইতে উঠিযা দাঁড়াইল।
অপু স্বপ্ন দেখিতেছে না তো? সকালে সে আজ কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছে! …নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করিয়াও করা যায় না—আপনা-আপনি তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল লীলা।
লীলা মৃদু মৃদু হাসিমুখে তাহার দিকে চাহিয়া ছিল। বলিল—চিনতে পেরেছেন তো দেখছি? আপনাকে কিন্তু চেনা যায় না—ওঃ কতকাল পর—আট বছর খুব হবেনা?
অপু এতক্ষণ পর কথা ফিবিয়া পাইল। সম্মুখের এই অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণী লীলাও বটে, না-ও বটে। কেবল হাসির ভঙ্গি ও এক ধরনের হাত রাখিবার ভঙ্গিটা পরিচিত পুরোন।
সে বলিল, আট বছর—হ্যাঁ তা—তোতোমাকেও দেখলে চেনা যায় না। অপু আপনি বলিতে পারিল না, মুখে বাধিল, লীলাব সম্বোধনে সে মনে আঘাত পাইয়াছিল।
লীলা বলিল—আপনাকে দু-দিন দেখেছি, পশু কলেজে যাবার সময় গাড়িতে উঠছি, দেখি কে একজন গাড়িবারান্দার ধারে বেঞ্চিতে বসে—দেখে মনে হল কোথায় দেখেছি যেন—আবার কালও দেখি বসে—আজ সকালে বাহিরের ঘরে খবরের কাগজখানা এসেছে কিনা দেখতে জানালা দিয়ে দেখি আজও বসে-তখন হঠাৎ মনে হল আপনি…তখন মাকে বলেছি, মা আসছেন—কি করছেন কলকাতায়? রিপনে?-বাঃ, তা এতদিন আছেন, একদিন এখানে আসতে নেই?
বাল্যের সেই লীলা!—একজন অত্যন্ত পরিচিত, অত্যন্ত আপনার লোক যেন দূরে চলিয়া গিয়া পর হইয়া পড়িয়াছে। আপনি বলিবে না তুমি বলিবে, দিশাহারা অপু তাহা ঠাহর করিতে পারিল না। বলিল, কি করে আসব? আমি কি ঠিকানা জানি?
লীলা বলিল—ভালো কথা, আজ এখানে হঠাৎ কি করে এসে পড়লেন?
অপু লজ্জায় বলিতে পারিল না যে, সে এখানে থাকিবার স্থানের সুপারিশ ধরিতে আশিয়াছে। লীলা জিজ্ঞাসা করিল—মা ভালো আছেন? বেশ—আপনার বুঝি সেকেন্ড ইয়ার? আমার ফার্স্ট ইয়ার আটস্।
একটি মহিলা ঘরে ঢুকিলেন। অপু চিনিল, বিস্মিতও হইল। লীলার মা মেজ-বৌরানী কিন্তু বিধবার বেশ। আট দশ বৎসর পূর্বের সে অতুলনীয় ৰূপরাশি এখন একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া না গেলেও দেখিলে হঠাৎ চেনা যায় না। অপু পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল। মেজ-বৌরানী বলিলেন—এসো বাবা এসো, লীলা কালও বলেছে, কে একজন বসে আছে মা, ঠিক বর্ধমানের সেই অপূর্বর মতো—আজ আমাকে গিয়ে বললে, ও আর কেউ নয় ঠিক অপূর্ব—তখনই আমি ঝিকে দিয়ে ডাকতে পাঠালাম—বসো। দাঁড়িয়ে কেন বাবা? ভালো আছ বেশ? তোমার মা কোথায়?
অপু সংকুচিতভাবে কথার উত্তর দিয়া গেল। মেজ-বৌরানীর কথায় কি আন্তরিকতার সুর। যেন কত কালের পুরাতন পরিচিত আত্মীয়তার আবহাওয়া। অপু কি করিতেছে, কোথায় থাকে, মা কোথায় থাকেন, কি করিয়া চলে, এবার পরীক্ষা দিয়া পুনরায় পড়িবে কি না, নানা খুঁটিনাটি প্রশ্ন। তারপর তিনি চা ও খাবারের বন্দোবস্ত করিতে বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেলে অপু বলিল—ইয়ে, তোমার বাবা কি
লীলা ধরা গলায় বলিল—বাবা তো, এই তিন বছর হল—এটা মামার বাড়ি–
অপু বলিল—ও! তাই ঝি বললে দিদিমণি ডাকছেন—মানে উনি?…মিঃ লাহিড়ী কে হন তোমার?
–দাদামশায়—উনি ব্যারিস্টার, তবে আজকাল আর প্র্যাকটিস করেন না—বড়ো মামা হাইকোর্টে বেরুচ্ছেন। ও-বছর বিলেত থেকে এসেছেন।
চা ও খাবার খাইয়া অপু বিদায় লইল। লীলা বলিল—বড়ো মামার মেয়ের নে-ডে পার্টি, সামনের বুধবারে। এখানে বিকালে আসবেন অবিশ্যি অপূর্বাবু—ভুলবেন না যেন—ঠিক কিন্তু ভুলবেন না।
পথে আসিয়া অপুর চোখে প্রায় জল আসিল। অপূর্ববাবু!—
লীলাই বটে, কিন্তু ঠিক কি সেই এগারো বছরের কৌতুকময়ী সরলা স্নেহময়ী লীলা?…সে লীলা কি তাহাকে অপূর্ববাবু বলিয়া ডাকিত? তবুও কি আন্তরিকতা ও আত্মীয়তা। আর নিজের আপনার লোক জ্যাঠাইমাও তো কলিকাতায় আছেন-মেজ-বৌরানী সম্পূর্ণ পর হইয়া আজ তাহার বিষয়েতে যত খুঁটিনাটি আন্তরিক আগ্রহে প্রশ্ন করিলেন, জ্যাঠাইমা কোনও দিন তাহা করিয়াছেন?…
বাসায় ফিরিয়া কেবলই লীলার কথা ভাবিল। তাহার মনের যে স্থান লীলা দখল করিয়া আছে ঠিক সে স্থানটিতে আর কেহই তো নাই? কিন্তু সে এ লীলা নয়। সে লীলা স্বপ্ন হইয়া কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে—আর কি তাহার দেখা মিলিবে কোনও কালে? সে ঠিক বুঝিতে পারিল না— আজকার সাক্ষাতে সে আনন্দিত হইয়াছে কি ব্যথিত হইয়াছে।
বুধবারে পার্টির জন্য সে টুইল শার্টটা সাবান দিয়া কাচিয়া লইল। ভাবিল, নিজের যাহা আছে তাহাই পরিয়া যাইবে, চাহিবার চিন্তিবার আবশ্যক নাই। তবুও যেন বড়ো হীনবেশ হইল। মনে মনে ভাবিল, হাতে যখন পয়সা ছিল, তখন লীলার সঙ্গে দেখা হল না—আর এখন একেবারে এই দশা, এখন কিনা–!
লীলার দাদামশায় মিঃ লাহিড়ী খুব মিশুক লোক। অপুকে বৈঠকখানায় বসাইয়া খানিকক্ষণ গল্পগুজব করিলেন। লীলা আসিল, সে ভারি ব্যস্ত, একবার দু-চার কথা বলিয়াই চলিয়া গেল। কোনও পার্টিতে কেহ কখনও তাহাকে নিমন্ত্রণ করে নাই। যখন এক এক করিয়া নিমন্ত্রিত ভদ্রলোক ও মহিলাগণ আসিতে আরম্ভ করিলেন, তখন অপু খুব খুশি হইল। কলিকাতা শহরে এ রকম ধনী উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে মিশিবার সুযোগ—এ বুঝি সকলের হয়? মাকে গিয়া গল্প করিবার মতো একটা জিনিস পাইয়াছে এতদিন পরে! মা শুনিয়া কি খুশিই যে হইবেন।
বৈঠকখানায় অনেক সুবেশ যুবকের ভিড়, প্রায় সকলেই বড়োললকের ছেলে, কেহ বা নতুন ব্যারিস্টারি পাশ করিয়া আসিয়াছে, কেহ বা ডাক্তার, বেশির ভাগ বিলাতফেরত। কি লইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া তর্ক হইতেছিল। কর্পোরেশন ইলেকশন লইয়া কথা কাটাকাটি। অপু এ বিষয়ে কিছু জানে না, সে একপাশে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
পাড়াগাঁয়ের কোন একটা মিউনিসিপ্যালিটির কথায় সেখানকার নানা অসুবিধার কথাও উঠিল।
একজন মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে সোনা-বাঁধানো চশমা, একটু টানিয়া টানিয়া কথা বলিবার অভ্যাস, মাঝে মাঝে মোটা চুরুটে টান দিয়া কথা বলিতেছিলেন–দেখুন মিঃ সেন, এগ্রিকালচারের কথা যে বলছেন, ও শখের ব্যাপার নয়—ও কাজ আপনার আমার নয়, ইট মাস্ট বি ব্রেড ইন্ দি বোন্জ ন্মগত একটা ধাত গড়ে না উঠলে শুধু কলের লাঙল কিনলে ও হয় না
প্রতিপক্ষ একজন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসরের যুবক, সাহেবি পোশাক-পরা, কেশ সবল ও সুস্থকায়। তিনি অধীরভাবে সামনে ঝুঁকিয়া বলিলেন—মাপ করবেন রমেশবাবু, কিন্তু একথার কোনও ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। আপনি কি বলতে চান তা হলে এডুকেশন, অর্গানিজেশন, ক্যাপিটাল—এসবের মূল্য নেই এগ্রিকালচারে? এই যে–
—আছে, সেকেন্ডারি—
—তবে চাষার ছেলে ভিন্ন কোনও শিক্ষিত লোক কখনও ওসবে যাবে না?…কারণ ইট ইজ নট ব্রেড ইন হিজ বোন্? অদ্ভুত কথা আপনার আমার সঙ্গে কেম্বুিজে একজন আইরিশ ছাত্র পড়ত-লম্বা লম্বা চুল মাথায়, সুন্দর চেহারা, ধরনধারনে টু পোয়েট। হয়তো সারারাত জেগে হল্লা করছে, একটা বেহালা নিয়ে বাজাচ্ছে—আবার হয়তো দেখুন সারাদিন পড়ছে, বসে কি লিখছেনয় তো ভাবছে—ডিগ্রি নিয়ে চলে গেল বেরিয়ে কানাডায়—গবর্নমেন্ট হোমস্টেড ল্যান্ডে জংলী জমি নিলে-ছোট্ট একটা কাঠের কুঁড়েঘরে সেই দুর্ধর্ষ শীতের মধ্যে তিন-চার বৎসর কাটালে হোমস্টেড ল্যান্ডের নিয়ম হচ্ছে টাইট হবার আগে পাঁচ বৎসর জমির ওপব বাস করা চাই–থেকে জমি পরিষ্কার করলে, নিজের হাতে রোজ জমি সাফ করে—লোকজন নেই, দুশো একর জমি, ভাবুন কতদিনে–
ওদিকে একদলের মধ্যে আলোচনা বেশ ঘনাইয়া আসিল। একজন কে বলিয়া উঠিল—এসব মর্যালিটি, আপনি যা বলছেন, সেকেলে হয়ে পড়েছে—এটা তো মানেন যে, ওসব তৈবি হয়েছে বিশেষ কোনও সামাজিক অবস্থায়, সমাজকে বা ইনডিভিজুয়ালকে প্রোটেকশান দেবার জন্যে, সুতরাং–
-বটে, তাহলে সবাই সুবিধাবাদী আপনারা। নর্ম্যাটিভ ভ্যালু বলে কোনও কিছুর স্থান নেই দুনিয়ায়?…ধরুন যদি–
অপু খুব খুশি হইল। কলিকাতার বড়োলোকর বাড়ির পার্টিতে সে নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছে, তাহা ছাড়া শিক্ষিত বিলাতফেরত দলের মধ্যে এভাবে। নাটক-নভেলে পড়িয়াছিল বটে, কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা কখনও হয় নাই। সে অতীব খুশির সহিত চারিধারে চাহিয়া একবার দেখিল মার্বেলের বড়ো ইলেকট্রিক ল্যাম্প কড়ি হইতে ঝুলিতেছে, সুন্দর ফুলকাটা ছিটের কাপড়ে ঢাকা কৌচ, সোফা, দামি আয়না-বড়ো বড়ো গোলাপ, মোরাদাবাদের পিতলের গোলাপদানি। নিজের বসিবার কোঁচখানা সে দু-একবার অপরের অলক্ষিতে টিপিয়া দেখিল। তাহা ছাড়া এ ধরনের কথাবার্তা—এই তো সে চায়! কোথায় সে ছিল পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের ছেলে—তিন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া মাম্জোয়ানের স্কুলে পড়িতে যাইত, সে এখন কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে! এ-ধরনের একটা উৎসবের মধ্যে তাহার উপস্থিতি ও পাঁচজনের একজন হইয়া বসিবার আত্মপ্রসাদে ঘরের তাবৎ উপকরণ ও অনুষ্ঠানকে যেন সে সারা দেহ-মন দ্বারা উপভোগ করিতেছিল।
কৃষিকার্যে উৎসাহী ভদ্রলোকটি অন্য কথা তুলিয়াছেন, কিন্তু অপুর দক্ষিণ ধারের দলটি পূর্ব আলোচনাই চালাইতেছেন এখনও। অপুর মনে হইল সে-ও এ-আলোচনায় যোগদান করিবে,আর হয়তো এধরনের সম্রান্ত সমাজে মিশিবার সুযোগ জীবনে কখনও ঘটিবে না। এই সময় দু-এক কথা এখানে বলিলে সে-ও একটা আত্মপ্রসাদ। ভবিষ্যতে ভাবিয়া আনন্দ পাওয়া যাইবে। পাস-নে চশমাপরা যুবকটির নাম হীরক সেন। নতুন পাশ করা ব্যারিস্টার! মুখে বেশ বুদ্ধির ছাপ—কি কথায় সে বলিল—ওসব মানি নে বিমলবাব, দেহ একটা এঞ্জিন—এঞ্জিনের যতক্ষণ স্টিম থাকে, চলে যেই কলকজা বিগড়ে যায়, সব বন্ধ–
অপু অবসর খুঁজিতেছিল, এই সময় তাহার মনে হইল এ-বিষয়ে সে কিছু কথা বলিতে পারে। সে দু-একবার চেষ্টা করিয়া সাহস সঞ্চয় করিয়া কতকটা আনাড়ি, কতকটা মরীয়ার মতো আরক্ত মুখে বলিল-দেখুন মাপ করবেন, আমি আপনার মতে ঠিক মত দিতে পারি নে-দেহটাকে এঞ্জিনের সঙ্গে তুলনা করুন ক্ষতি নেই, কিন্তু যদি বলেন দেহ ছাড়া আর কিছু নেই।
ঘরের সকলেই তাহার দিকে যে কতকটা বিস্ময়ে, কতকটা কৌতুকের সহিত চাহিতেছে, সেটুকু সে বুঝিতে পারিল—তাহাতে সে আরও অভিভূত হইয়া পড়িলসঙ্গে সঙ্গে সেটুকু চাপিবার চেষ্টায় আরও মরীয়া হইয়া উঠিল।
একজন বাধা দিয়া বলিল—মশায় কি করেন, জানতে পারি কি?
—আমি এবার আই.এ. দেবো।
পাঁস-নে চশমা-পরা যে যুবকটি এঞ্জিনের কথা তুলিয়াছিল, সে বলিল,-ইউনিভার্সিটির আরও দু-এক ক্লাস পড়ে এ তর্কগুলো করলে ভালো হয় না?
সে এমন অতিরিক্ত শান্তভাবে কথাগুলি বলিল যে, ঘরসুদ্ধ লোক হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। অপুর মুখ দাড়িমের মতো লাল হইয়া উঠিল।
যদি সে পূর্ব হইতেই ধারণা করিয়া না লইত যে, সে এ-সভায় ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র এবং উহারা দয়া করিয়া তাহার এখানে উপস্থিতি সহ্য করিতেছে—তাহা হইলে এমন উগ্র ও অভদ্র ভাবের প্রত্যুত্তরে হয়তো তাহার রাগ হইত—কিন্তু সে তো কোনও কিছুতেই এদের সমকক্ষ নয়!—রাগ করিবার মতো ভরসা সে নিজের মধ্যে খুঁজিয়া পাইল না। তার অত্যন্ত লজ্জা হইল—এবং সঙ্গে সঙ্গে সেটা ঢাকিবার জন্য সে আরও মরীয়ার সুরে বলিল—ইউনিভার্সিটির ক্লাসে না পড়লে যে কিছু জানা যায় না একথা আমি বিশ্বাস করি নে—আমি একথা বলতে পারি কোনও ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র যে-কোনও কলেজের হিস্ট্রিতে কি ইংলিশ পোইট্রিতে কিংবা জেনারেল নলেজে পারবে না আমার সঙ্গে।
নিতান্ত অপটু ধরনের কথা সকলে আরও একদফা হাসিয়া উঠিল।
তারপর তাহারা নিজেদের মধ্যে অন্য কথাবার্তায় প্রবৃত্ত হইল। অপু আধঘণ্টা থাকিলেও তাহার অস্তিত্বই যেন সকলে ভুলিয়া গেল। উঠিবার সময় তাহারা নিজেদের মধ্যে করমর্দন ও পরস্পরের নিকট বিদায় গ্রহণ করিল, তাহার দিকে কেহ ফিরিয়াও চাহিল না।
যেভাবে সকলে তাহাকে উড়াইয়া দিল বা মানুষের মধ্যে গণ্য করিল না, তাহাতে সত্যই অপু অপমান ও লজ্জায় অভিভূত হইয়া পড়িল। তাহার পাশ কাটাইয়া সকলে চলিয়া গেল—কে একটা প্রশ্নও জিজ্ঞাসা করিল না, তাহার সম্বন্ধে কেহ কোন কৌতূহলও দেখাইল না। অপু মনে মনে ভাবিল—বেশ, না বলুক কথা—আমি কি জানি না-জানি, তার খবর ওরা কি জানে? সে জানত অনিল…
সে চলিয়া যাইতেছে, এমন সময় লীলা আসিয়া তাহাকে নিজে বাড়ির মধ্যে লইয়া গেল। বলিল,-মা, অপূর্ববাবু না খেয়েই চুপি চুপি পালাচ্ছিলেন।
লীলা বৈঠকখানার ব্যাপারটা না জানিতে পারে…
একটি ছোট আট-নয় বৎসরের ছেলেকে দেখাইয়া বলিল—একে চেনেন অপূর্ববাবু? এ সেই খোকামণি, আমার ছোট ভাই, এর অন্নপ্রাশনেই আপনাকে একবার আসতে বলেছিলুম, মনে নেই?
লীলার কয়েকটি সহপাঠিনী সেখানে উপস্থিত, সে সকলকে বলিল—তোমরা জানো না, অপূর্ববাবুর গলা খুব ভালো, তবে গান গাইবেন কিনা জানি নে, মানে বেজায় লাজুক, আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, একটা অনুরোধ রাখবেন অপুর্বাবু?
অপু অনেকের অনুরোধ-উপরোধে অবশেষে বলিল—আমি বাজাতে জানি নে—কেউ যদি বরং বাজান।–
খাওয়াটা ভালোই হইল। তবুও রাত্রে বাসায় ফিরিতে ফিরিতে তাহার মনে হইতেছিল—আর কখনও এখানে সে আসিবে না। বড়োলোকর সঙ্গে তাহার কিসের খাতির-দরকার কি আসিবার? দারুণ অতৃপ্তি।
যেদিন অপুর পরীক্ষা আরম্ভ হইবে তাহার দিন-পাঁচেক আগে অপু পত্রে জানিল মায়ের অসুখ, হস্তাক্ষর তেলিবাড়ির বড়ো বৌয়ের।
সন্ধ্যার সময় অপু বাড়ি পৌঁছিল।
সর্বজয়া কাঁথা গায়ে দিয়া শুইয়া আছে, দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে দেখিয়া মনে হয়। অপুকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি বিছানার উপর উঠিয়া বসিল। অনেক দিন হইতেই অসুখে ভুগিতেছে, পরীক্ষার পড়ার ব্যাঘাত হওয়ার ভয়ে খবর দেয় নাই, সেদিন তেলি-বৌ জোর করিয়া নিজে পত্র দিয়াছে। এমন যে কিছু শয্যাগত অবস্থা তাহা নয়, খায়-দায়, কাজকর্ম করে। আবার অসুখও হয়। সন্ধ্যা হইলেই শয্যা আশ্রয় করে, আবার সকালে উঠিয়া গৃহকর্ম শুরু করে। চিরদিনের গৃহিণীপনা এ অসুস্থ শরীরেও তাহাকে ত্যাগ করে নাই।
অপু বলিল-উঠো না বিছানা থেকে মা—শুয়ে থাকো—দেখি গা!
—তুই আয় বোস-ও কিছু না—একটু জ্বর হয়, খাই-দাই—ও এমন সময়ে হযেই থাকে। বোশেখ মাসের দিকে সেরে যাবে—তুই যে মেয়েকে পড়াস, সে ভালো আছে তো?
সর্বজয়ার বোগশীর্ণ মুখের হাসিতে অপুর চোখে জল আসিল। সে পুটুলি খুলিয়া গোটাকতক কমলালেবু, বেদানা, আপেল বাহির করিয়া দেখাইল। জিনিসপত্র সস্তায় কিনিতে পাবিলে সর্বজয়া ভারি খুশি হয়। অপু জানে মাকে আমোদ দিবার এটা একটা প্রকৃষ্ট পন্থা। কমলালেবু দেখাইয়া বলে-কত সস্তায় কলকাতায় জিনিসপত্র পাওয়া যায় দ্যাখো-লেবুগুলো দশপয়সা
প্রকৃতপক্ষে লেবু কটির দাম ছআনা।
সর্বজয়া আগ্রহের সহিত বলিল—দেখি? ওমা, এখানে যে ওগুলোর দাম বারো আনাব কম নয়—এখানে সব ডাকাত।
চার পয়সার এক তাড়া পান দেখাইয়া বলিল-বৈঠকখানা বাজার থেকে দু-পয়সায়—দ্যাখো মা
সর্বজয়া ভাবে—এবার ছেলের সংসারী হইবাব দিকে মন গিয়াছে, হিসাব করিয়া সে চলিতে শিখিয়াছে।
অপু ইচ্ছা করিয়াই লীলার সঙ্গে সাক্ষাতের কথাটা উঠায় না। ভাবে, মা মনে মনে দুরাশা পোষণ করে, হয়তো এখনই বলিয়া বসিবেলীলার সঙ্গে তোর বিয়ে হয় না?. দরকার কি, অসুস্থ মায়ের মনে সে-সব দুরাশার ঢেউ তুলিয়া?
এমন সব কথা কখনও অপু মায়ের সামনে বলে না, যাহা কিনা মা বুঝিবে না। জগৎ সংসারটাকে মায়ের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের উপযোগী করিয়াই সে মায়ের সম্মুখে উপস্থিত করে। দিনতিনেক সে বাড়ি রহিল। রোজ দুপুরে জানলার ধারের বিছানাটিতে সর্বজয়া শুইয়া থাকে, পার্ক সে বসিয়া নানা গল্প করে। ক্রমে বেলা যায়, রোদ প্রথমে ওঠে রান্নাঘরের চালায়, পরে বেড়ার বারের পাতেমাদার গাছটার মাথায়, ক্রমে বাঁশঝাড়ের ডগায়। ছায়া পড়িয়া যায়-বৈকালের ঘন ছায়ায় অপুর মনে আবার একটা বিপুল নির্জনতা ও সঙ্গহীনতার ভাব আনে—গত গ্রীষ্মের ছুটির দিনের মতো।
সর্বজয়া হাসিয়া বলে—পাশটা হলে এবার তোর বিয়ের ঠিক করেছি এক জায়গায়। মেয়ের দিদিমা এসেছিল এখানে, বেশ লোক—
ঘরের কোণে একটা তাকে সংসারের জিনিসপত্র সর্বজয়া রাখিয়া দেয়—একটা হাঁড়িতে আমসত্ত্ব, একটা পাত্রে আচার। অপু চিরকালের অভ্যাস অনুসারে মাঝে মাঝে ভাড় হাঁড়ি খুঁজিয়াপাতিয়া মাকে লুকাইয়া এটা-ওটা চুরি করিয়া খায়! এ কয়দিনও খাইয়াছে। সর্বজয়া বিছানায় চোখ বুজিয়া শুইয়া থাকে, টের পায় না—সেদিন দুপুরে অপু জানালাটার কাছে দাঁড়াইয়া আছে-গায়ে মায়ের গামছাখানা। হঠাৎ সর্বজয়া চোখ চাহিয়া বলিল-আমার গামছাখানা আবার পিষচো কেন?—ওখানা তিলে বড়ি দেবো বলে রেখে দিইচি-কুণ্ডুদের বাড়ির গামছা ওখানা, ভারি ঠুকোআর সরে সরে তাকটার ঘাড়ে যাচ্ছ কেন?–হুঁসনে তাক-তুমি এমন দুষ্টু হয়েচো, বাসি কাপড়ে ছুঁয়েছিলে তাকটা?
কথাটা অপুর বুকে কেমন বিধিল মা সেরে উঠে তিলে বড়ি দেবে? তা দিয়েছে! মা আর উঠছে না হঠাৎ তাহার মনে হইল, এই সেদিনও তো সে তাক হইতে আমসত্ত্ব চুরি করিয়াছে…মা, অসহায় মা বিছানায় জ্বরের ঘোরে পড়িয়া ছিল…একুশ বৎসর ধরিয়া মায়ের যে শাসন চলিয়াছিল আজ তাহা শিথিল হইয়া পড়িতেছে, দুর্বল হইয়া পড়িতেছে, নিজের অধিকার আর বোধ হয় প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে না কখনও…।
অপু চতুর্থদিন সকালে চলিয়া গেল, কালই পরীক্ষা। চুকিয়া গেলেই আবার আসিবে। শেষবাত্রে ঘুম ভাঙিয়া শোনে, সর্বজয়া রান্নাঘরে ইতিমধ্যে কখন ঘুম হইতে উঠিয়া চলিয়া গিয়াছে, ছেলের সঙ্গে গরম পরোটা দেওয়া যাইবে।
সর্বজয়ার এরকম কোনও দিন হয় নাই। অপু চলিয়া যাওয়ার দিনটা হইতে বৈকালে তাহার এত মন হু হু করিতে লাগিল, যেন কেহ কোথাও নাই, একটা অসহায় ভাব, মনের উদাস অবস্থা। কত কথা, সারা জীবনের কত ঘটনা, কত আনন্দ ও অশ্রুর ইতিহাস একে একে মনে আসিয়া উদয় হয়। গত একমাস ধরিয়া এসব কথা মনে হইতেছে। নির্জনে বসিলেই বিশেষ করিয়া …। ছেলেবেলায় বুধী বলিয়া গাই ছিল বাড়িতে…বাল্যসঙ্গিনী হিমিদি দুজনে একসঙ্গে দো-পেটে গাঁদাগাছ পুঁতিয়া জল দিত। একদিন হিমিদি ও সে বন্যাব জলে মাঠে ঘড়া বুকে সাঁতার কাটিতে গিয়া ডুবিয়া গিয়াছিল আব একটু হইলেই…
বিবাহ…মনে আছে সেদিন দুপুরে খুব বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহার ছোট ভাই তখন বাঁচিয়া, লুকাইয়া তাহাকে নাড় দিয়া গিয়াছিল হাতের মুঠায়। ছোট্ট ছেলেবেলার অপু…কাচের পুতুলের মতো রুপ…প্রথম স্পষ্ট কথা শিখিল, কি জানি কি করিয়া শিখিল ভিজে। একদিন অপুকে কদমা হাতে বসাইয়া রাখিয়াছিল।-কেমন খেলি ও খোকা?
অপু দন্তহীন মুখে কদমা চিবাইতে চিবাইতে ফুলের মতো মুখটি তুলিয়া মায়ের দিকে চাহিয়া বলিল—‘ভিজে’। হি হি—ভাবিলে এখনও সর্বজয়ার হাসি পায়।
সেদিন দুপুর হইতেই বুকে মাঝে মাঝে ফিক-ধরা বেদনা হইতে লাগিল। তেলি-বৌ আসিয়া তেল গরম করিয়া দিয়া গেল। দু-তিনবার দেখিয়াও গেল। সন্ধ্যার পর কেহ কোথাও নাই। একা নির্জন বাড়ি। জ্বরও আসিল।
রাত্রে খুব পরিষ্কার আকাশে ত্রয়োদশীর প্রকাণ্ড বড়ো চাদ উঠিয়াছে। জীবনে এই প্রথম সর্বজয়ার একা থাকিতে ভয়-ভয় করিতে লাগিল। খানিক রাত্রে একবার যেন মনে হইল, সে জলের তলায় পড়িয়া আছে, নাকে মুখে জল ঢুকিয়া নিঃশ্বাস একেবারে বন্ধ হইয়া আসিতেছে…একেবারে বন্ধ। সে ভয়ে এক-গা ঘামিয়া ধড়মড় করিয়া বিছানার উপর উঠিয়া বসিল। সে কি মরিয়া যাইতেছে? এই কি মৃত্যু?—সে এখন কাহাকে ডাকে? জীবনে সর্বপ্রথম এই তাহার জীবনের ভয় হইল—ইহার আগে কখনও তো এমন হয় নাই! পরে নিজের ভয় দেখিয়া তাহার আর একদফা ভয় হইল। ভয় কিসের? না—না–মৃত্যু, সে এরকম নয়। ও কিছু না।
কত চুরি, কত পাপ…চুরিই যে কত করিয়াছে তাহার কি ঠিক আছে? ছেলেমেয়েকে খাওয়াইতে অমুকের গাছের কলার কাঁদিটা, অমুকের গাছের শসাটা লুকাইয়া রাখিত তক্তপোশের তুলায়-ভুবন মুখুজ্যেদের বাড়ি হইতে একবার দশ পলা তেল ধার করিয়া আনিয়া ভালোমানুষ রানুর মার কাছে পাঁচ পলা শোধ দিয়া আসিয়াছিল, মিথ্যা করিয়া বলিয়াছিল—পাঁচ পলাই তো নিয়ে গিছলাম নদিবোলো সেজ ঠাকুরঝিকে। সারাজীবন ধরিয়া শুধু দুঃখ ও অপমান। কেন আজ এসব কথা মনে উঠিতেছে?
ঘর অন্ধকার। …খাটের তলায় নেংটি ইদুর ঘুট ঘুটু করিতেছে। সর্বজয়া ভাবিল, ওদের বাড়ির কলটা না আনলে আর চলে না—নতুন মুগগুলো সব খেয়ে ফেললে। কিন্তু নেংটি ইদুরের শব্দ তো?—সর্বজয়ার আবার সেই ভয়টা আসিল, দুর্দমনীয় ভয়…সারা শরীর যেন ধীরে ধীরে অসাড় হইয়া আসিতেছে ভয়ে…পায়ের দিক হইতে ভয়টা সুড়সুড়ি কাটিয়া উপরের দিকে উঠিতেছে, যতটা উঠিতেছে, ততটা অসাড় করিয়া দিতেছে…না—পায়ের দিক হইতে না-হাতের আঙুলের দিক হইতে…কিন্তু তাহার সন্দেহ হইতেছে কেন? ইদুরের শব্দ নয় কেন? কিসের শব্দ? কখনও তো এমন সন্দেহ হয় না?…হঠাৎ সর্বজয়ার মনে হইল, না—পায়ের ও হাতের দিক হইতে সুড়সড়ি কাটিয়া যাহা উপরের দিকে উঠিতেছে তাহা ভয় নয়—তাহা মৃত্যু। মৃত্যু? ভীষণ ভয়ে সর্বজয়া ধড়মড় করিয়া আবার বিছানা হইতে উঠিতে গেল… চিৎকার করিতে গেল…খুব…খুব চিৎকার, আকাশফাটা চিৎকার–অনেকক্ষণ চিৎকার করিয়াছে, আর সে চেঁচাইতে পারে না…গলা ভাঙিয়া আসিয়াছে…কেউ আসিল না তো?…কিন্তু সে তো বিছানা হইতে…বিছানা হইতে উঠিল কখন?…সে তো উঠে নাই–ভয়টা সুড়সুড়ি কাটিয়া সারা দেহ ছাইয়া ফেলিয়াছে, যেন খুব বড়ো একটা কালো মাকড়সা…খুঁড়েব বিষে দেহ অবশ…অসাড় হাতও নাড়ানো যায় না…পা-ও না…সে চিৎকার করে নাই… ভুল।…
সুন্দর জ্যোৎস্না উঠিয়াছে…একজনের কথাই মনে হয়…অপু…অপু…অপুকে ফেলিয়া সে থাকিতে পারিতেছে না…অসম্ভব।…বিস্ময়ের সহিত দেখিল-সে নিজে অনেকক্ষণ কাঁদিতেছে!… এতক্ষণ তো টের পায় নাই!…আশ্চর্য!…চোখের জলে বালিশ ভিজিয়া গিয়াছে যে!…
জ্যোৎস্না অপূর্ব, ভয় হয় না…কেমন একটা আনন্দ…আকাশটা, পুরাতন আকাশটা যেন স্নেহে প্রেমে জ্যোৎস্না হইয়া গলিয়া ঝরিয়া বিন্দুতে বিন্দুতে নিজেকে নিঃশেষ করিয়া দিতেছে…টুপ…চুপ…টুপ…টাপ। আবার কান্না পায়…জ্যোৎস্নার আলোয় জানালার গরাদে ধরিযা হাসিমুখে ও কে দাঁড়াইয়া আছে?…সর্বজয়ার দৃষ্টি পাশের জানলাব দিকে নিবদ্ধ হইল… বিস্ময়ে আনন্দে রোগশীর্ণ মুখখানা মুহূর্তে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল…অপু…দাঁড়াইয়া আছে।…এ অপু নয়…সেই ছেলেবেলাকার ছোট্ট অপু…এতটুকু অপু…নিশ্চিন্দিপুরের বাঁশবনের ভিটেতে এমন কত চৈত্রজ্যোৎস্নারাতে ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়া জ্যোৎস্নার আলো আসিয়া পড়িত যাহার দন্তহীন ফুলের কুঁড়ির মতো কচি মুখে…সেই অপু…ওর ছেলেমানুষ খঞ্জন পাখির মতো ডাগর ডাগর চোখের নীল চাহনি…চুল কোকড়া কোকড়া…মুখচোরা, ভালোমানুষ লাজুক বোকা, জগতের ঘোরপ্যাঁচ কিছুই একেবারে বোঝে না…কোথায় যেন সে যায়…নীল আকাশ বাহিয়া বহু দূরে…বহু দূরের দিকে, সুনীল মেঘপদবীর অনেক উপরে…যায়…যায়…যায়…যায়…মেঘের ফাঁকে যাইতে যাইতে মিলাইয়া যায়…
বুঝি মৃত্যু আসিয়াছে। …কিন্তু তার ছেলের বেশে, তাকে আদর করিয়া আগু বাড়াইয়া লইতে…এতই সুন্দর…।
কি হাসি!…কি মিষ্টি হাসি ওর মুখের!…
পরদিন সকালে তেলি-বাড়ির বড়ো বৌ আসিল। দরজায় রাত্রে খিল খেওয়া হয় নাই, খোলাই আছে। বড়ো-বৌ আপন মনে বলিল–রাত্রে দেখছি মা-ঠাকরুনের অসুখ খুব বেড়েছে, খিলটাও দিতে পারেন নি।
বিছানার উপর সর্বজয়া যেন ঘুমাইতেছেন। তেলি-বৌ একবার ভাবিল-ডাকিবে না কিন্তু পথ্যের কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য ডাকিয়া উঠাইতে গেল। সর্বজয়া কোনও সাড়া দিলেন না, নড়িলেনও না। বড়ো-বৌ আরও দু-একবার ডাকাডাকি করিল, পরে হঠাৎ কি ভাবিয়া নিকটে আসিয়া ভালো করিয়া দেখিল।
পরক্ষণেই সে সব বুঝিল।
সর্বজয়ার মৃত্যুর পর কিছুকাল অপু এক অদ্ভুত মনোভাবের সহিত পরিচিত হইল। প্রথম অংশটা আনন্দ-মিশ্রিত—এমন কি মায়ের মৃত্যু-সংবাদ প্রথম যখন সে তেলি-বাড়ির তারের খবরে জানিল, তখন প্রথমটা তাহার মনে একটা আনন্দ, একটা যেন মুক্তির নিঃশ্বাস…একটা বাঁধন-ছেঁড়ার উল্লাস…অতি অল্পক্ষণের জন্য নিজের অজ্ঞাতসারে। তাহার পরই নিজের মনোভাবে তাহার দুঃখ ও আতঙ্ক উপস্থিত হইল। এ কি! সে চায় কি! মা যে নিজেকে একেবারে বিলোপ করিয়া ফেলিয়াছিলেন তাহার সুবিধার জন্য। মা কি তাহার জীবনপথের বাধা?—কেমন করিয়া সে এমন নিষ্ঠুর, এমন হৃদয়হীন— তবুও সত্যকে সে অস্বীকার করিতে পারিল না। মাকে এত ভালোবাসিত তো, কিন্তু মায়ের মৃত্যু-সংবাদটা প্রথমে যে একটা উল্লাসের স্পর্শ মনে আনিয়াছিল—ইহা সত্য— সত্য–তাহাকে উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। তাহার পর সে বাড়ি রওনা হইল। উলা স্টেশনে নামিয়া হাঁটিতে শুরু করিল। এই প্রথম এ পথে সে যাইতেছে—যেদিন মা নাই! গ্রামে ঢুকিবার কিছু আগে আধমজা কোদলা নদী, এ সময়ে হাঁটিয়া পার হওয়া যায়—এরই তীরে কাল মাকে সবাই দাহ করিয়া গিয়াছে! বাড়ি পৌঁছিল বৈকালে। এই সেদিন বাড়ি হইতে গিয়াছে, মা তখনও ছিলেন…ঘরে তালা দেওয়া, চাবি কাহাদের কাছে? বোধ হয় তেলি-বাড়ির ওরা লইয়া গিয়াছে। ঘরের পৈঠায় অপু চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। উঠানের বাহিরে আগড়ের কাছে এক জায়গায় পোড়া খড় জড়ো করা। সেদিকে চোখ পড়িতেই অপু শিহরিয়া উঠিল—সে বুঝিয়াছে—মাকে যাহারা সৎকার করিতে গিয়াছিল, দাহ অন্তে তাহাবা কাল এখানে আগুন ছুঁইয়া নিমপাতা খাইয়া শুদ্ধ হইয়াছে—প্রথাটা অপু জানে…মা মারা গিয়াছেন এখনও অপুর বিশ্বাস হয় নাই…একুশ বৎসরের বন্ধন, মন এক মুহূর্তে টানিয়া ছিড়িয়া ফেলিতে পাবে নাই… কিন্তু পোড়া খড়গুলাতে নগ্ন, রূঢ় নিষ্ঠুর সত্যটা…মা নাই! মা নাই।.বৈকালের কি রূপটা! নির্জন, নিরালা, কোনও দিকে কেহ নাই। উদাস পৃথিবী, নিস্তব্ধ বিবাগী রাঙা রোদভরা আকাশটা।…অপু অর্থহীন দৃষ্টিতে পোড়া খড়গুলার দিকে চাহিয়া রহিল।
কিন্তু মায়ের গায়ের কথাখানা উঠানের আলনায় মেলিয়া দেওয়া কেন? কথাখানা মায়ের গায়ে ছিল…সঙ্গেই তো যাওয়ার কথা। অনেক দিনের নিশ্চিন্দিপুরের আমলের, মায়ের হাতে সেলাই করা কল্কা-কাটা রাঙা সুতার কাজ। …কতক্ষণ সে বসিয়া ছিল জানে না, রোদ প্রায় পড়িয়া আসিল। তেলি-বাড়ির বড়ো ছেলে নাদুর ডাকে চমক ভাঙিতেই সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। ম্লান হাসিয়া বলিল-এই যে, আমার ঘরের চাবিটা তোমাদের বাড়ি?…
নাদু বলিল—কখন এলে, এখানে বসে একলাটি-~-বেশ তো দাদাঠাকুর-এসো আমাদের বাড়ি।
অপু বলিল, না ভাই, তুমি চাবিটা নিয়ে এসো—ঘরের মধ্যে দেখি জিনিসগুলোর কি ব্যবস্থা। চাবি দিয়া নাদু চলিয়া গেল।
—ঘর খুলে দ্যাখো, আমি আসছি এখুনি।
অপু ঘরে ঢুকিল। তক্তপোশের উপর বিছানা নাই, বালিশ, মাদুর কিছু নাই—তক্তপোশটা পড়িয়া আছে—তক্তপোশের তলায় একটা পাথরের খোরায় কি ভিজানো—খোরাটা হাতে তুলিয়া দেখিল। চিরতা না নিমছাল কি ভিজানো-মায়ের ওষুধ।
বাহিরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কে বলিল—ঘরের মধ্যে কে?—অপু খোরাটা তক্তপোশের কোণে নামাইয়া রাখিয়া বাহিরের দাওয়ায় আসিল। নিরুপমা দিদি নিরুপমাও অবাক-গালে আঙুল দিয়া বলিল—তুমি! কখন এলে ভাই?-কই কেউ তো বলে নি!…
অপু বলিলনা, এই তো এলাম,—এই এখনও আধঘণ্টা হয় নি।
নিরুপমা বলিল—আমি বলি রোদ পড়ে গিয়েছে, কাঁথাটা কেচে মেলে দিয়ে এসেছি বাইরে, যাই কাঁথাখানা তুলে রেখে আসি কুতুদের বাড়ি। তাই আসছি—
অপু বলিল—কাঁথাখানা মায়ের গায়ে ছিল, না নিরুদি?
-কোথায়?…পরশু রাতে তো তারপরও বিকেলে বড়ো-বৌকে বলেছেন কাঁথাখানা সরিয়ে রাখো মা-ও আমার অপুর জন্যে, বর্ষাকালে কলকাতা পাঠাতে হবে—সেই পুরানো তুলো জমানো কালো কম্বলটা ছিল…সেইখানা গায়ে দিয়েছিলেন—তিনি আবার প্রাণ ধরে তোমার কথা নষ্ট করবেন?…তাই কাল যখন ওরা তাকে নিয়ে-থুয়ে গেল তখন ভাবলাম রুগীর বিছানায় তো ছিল কাঁথাখানা, জলকাঁচা করে রোদে দিইকাল আর পারি নি আজ সকালে ধুয়ে আলনায় দিয়ে গেলাম—তা এসো-আমাদের বাড়ি-ওসব শুনবো না—মুখ শুকনোহবিষ্যি হয় নি? এসো
নিরুপমার আগে আগে সে কলের পুতুলের মতো তাদের বাড়ি গেল। সরকার মহাশয় কাছে ডাকিয়া বাইয়া অনেক সান্ত্বনার কথা বলিলেন।
নিরুদি কি করিয়া মুখ দেখিয়া বুঝিল খাওয়া হয় নাই! নাদুও তত ছিলকই কোনও কথা তো বলে নাই?
সন্ধ্যার পর নিরুপমা একখানা রেকাবিতে আখ ও ফলমূল কাটিয়া আনিল। একটা কাসাব বাটিতে কাঁচামুগের ডাল-ভিজা, কলা ও আখের গুড় নিয়া নিজে একসঙ্গে মাখিয়া আনিয়াছে। অপু কারুর হাতে চটকানো জিনিস খায় না, ঘেন্না-ঘেন্না করে…প্রথমটা মুখে তুলিতে একটুখানি গা কেমন করিতেছিল। তারপর দুই-এক গ্রাস খাইয়া মনে হইল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আস্বাদই তো!…নিজের হাতে বা মায়ের হাতে মাখিলে যা হইত—তাই। পরদিন হবিষ্যের সময় নিরুপমা গোয়ালে সব জোগাড়পত্র করিয়া অপুকে ডাক দিল। উনুনে ফু পাড়িয়া কাঠ ধরাইয়া দিল। ফুটিয়া উঠিলে বলিল-এইবার নামিয়ে ফ্যালো, ভাই।
অপু বলিল—আর একটু হবে না—নিরুদি?
নিরুপমা বলিল—নামাও দেখি, ও হয়ে গিয়েছে। ডালবাটাটা জুড়োতে দাও—
সব মিটিয়া গেলে সে কলিকাতায় ফিরিবার উদ্যোগ করিল। সর্বজয়ার জাতিখানা, সর্বজয়ার হাতে সইকরা খানদুই মনিঅর্ডারের রসিদ চালের বাতায় গোঁজা ছিল—সেগুলি, সর্বজয়ার নখ কাটিবার নরুণটা পুটলির মধ্যে বাঁধিয়া লইল। দোরের পাশে ঘরের কোণে সেই তাকটা—আসিবার সময় সেদিকে নজর পড়িল। আচারভরা ভাড়, আমসত্ত্বের হাঁড়িটা, কুলচুর, মায়ের গঙ্গাজলের পিতলের ঘটি, সবই পড়িয়া আছে…যে যত ইচ্ছা খুশি খাইতে পারে, যাহা খুশি দুইতে পারে, কেহ বকিবার নাই, বাধা দিবার নাই। তাহার প্রাণ ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। সে মুক্তি চায় না…অবাধ অধিকার চায় নাতুমি এসে শাসন করো, এসব ছুঁতে দিয়ো না, হাত দিতে দিয়ো না ফিরে এসো মা…ফিরে এসো…
কলিকাতায় ফিরিয়া আসিল, একটা তীব্র ঔদাসীন্য সব বিষয়ে, সকল কাজে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই ভয়ানক নির্জনতার ভাবটা। পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছিল, কলিকাতায় থাকিতে একদণ্ড ইচ্ছা হয় না…মন পাগল হইয়া উঠে, কেমন যেন পালাই-পালাই ভাব হয় সর্বদা, অথচ পালাইবার স্থান নাই, জগতে সে একেবারে একাল-সত্যসত্যই একাকী।
এই ভয়ানক নির্জনতার ভাব এক এক সময় অপুর বুকে পাথরের মতো চাপিয়া বসে, কিছুতেই সেটা সে কাটাইয়া উঠিতে পারে না, ঘরে থাকা তাহার পক্ষে তখন আর সম্ভব হয় না। গলিটার বাহিরে বড়ো রাস্তা, সামনে গোলদিঘি, বৈকালে গাড়ি, মোটর, লোকজন ছেলেমেয়ে। বড়ো মোটরগাড়িতে কোন সম্রান্ত গৃহস্থের মেয়েরা বাড়ির ছেলেমেয়েদের লইয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছে, অপুর মনে হয় কেন সুখী পরিবার!—ভাই, বোন, মা, ঠাকুরমা, পিসিমা, রাঙাদি, বড়দা, ছোটকা। যাহাদের থাকে তাহাদের কি সব দিক দিয়াই এমন করিয়া ভগবান দিয়া দেন। অন্যমনস্ক হইবার জন্য এক-একদিন সে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরিতে গিয়া বিলাতি ম্যাগাজিনের পাতা উলটাইয়া থাকে। কিন্তু কোথাও বেশিক্ষণ বসিবার ইচ্ছা হয় না, শুধুই কেবল এখানে-ওখানে ফুটপাথ হইতে বাসায়, বাসা হইতে ফুটপাতে। এক জায়গায় বসিলেই শুধু মায়ের কথা মনে আসে, উঠিয়া ভাবে গোলদিঘিতে আজ সাঁতারের ম্যাচের কি হল দেখে আসি বরংকলিকাতায় থাকিতে ইচ্ছা করে না, মনে হয় বাহিরে কোথাও চলিয়া গেলে শান্তি পাওয়া যাইত—যে কোনও জায়গায়, যে কোন জায়গায়-পাহাড়ে, জঙ্গলে, হরিদ্বাবে কেদার-বদরীর পথে—মাঝে মাঝে ঝরনা, নির্জন অধিত্যকায় কত ধরনের বিচিত্র বন্যপুষ্প, দেওদার ও পাইন বনের ঘন ছায়া। সাধু সন্ন্যাসী দেবমন্দির, রামচটি, শ্যামচটি কত বর্ণনা তো সে বইয়ে পড়ে, একা বাহির হইয়া পড়া মন্দ কি? কি হইবে এখানে শহরের ঘিঞ্জি ও ধোঁয়ার বেড়াজালের মধ্যে?
কিন্তু পয়সা কই? তাও তো পয়সার দরকার। তেলিরা কুড়ি টাকা দিয়াছিল মাতৃশ্রাদ্ধের দরুন, নিরুপমা নিজে হইতে পনেরো, বড়ো-বৌ আলাদা দশ। অপু সে টাকার এক পয়সাও রাখে নাই, অনেক লোকজন খাওয়াইয়াছে। তবু তো সামান্যভাবে তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ!
দশপিণ্ড দানেব দিন সে কি তীব্র বেদনা! পুরোহিত বলিতেছেন-প্রেতা শ্রীসর্বজয়া দেবী— অপু ভাবে কাহাকে প্রেত বলিতেছে? সর্বজয়া দেবী প্রেত? তাহার মা, প্রীতি আনন্দ ও দুঃখ-মুহূর্তের সঙ্গিনী, এত আশাময়ী, হাস্যময়ী, এত জীবন্ত যে ছিল কিছুদিন আগেও, সে প্রেত? সে আকাশছো নিরালম্বো বায়ুভূত-নিরাশ্রয়ঃ?
তারপরই মধুর আশার বাণী—আকাশ মধুময় হউক, বাতাস মধুময় হউক, পথের ধূলি মধুময় হউক, ওষধি সকল মধুময় হউক, বনস্পতি মধুময় হউক, সূর্য চন্দ্র, অন্তরীক্ষস্থিত আমাদের পিতা মধুময় হউন।
সারাদিনব্যাপী উপবাস অবসাদ, শোকের পর এ মন্ত্র অপুর মনে সত্য সত্যই মধুবৰ্ষণ করিয়াছিল, চোখের জল সে রাখিতে পারে নাই। হে আকাশের দেবতা, বাতাসের দেবতা, তাই করো, মা আমার অনেক কষ্ট কবে গিয়েছেন, তার প্রাণে তোমাদের উদার আশীর্বাদের অমৃতধারা বর্ষণ করো।
এই অবস্থায় শুধুই ইচ্ছা কবে যারা আপনার লোক, যারা তাহাকে জানে ও মাকে জানিত তাহাদের কাছে যাইতে। এক জ্যাঠাইমারা আছেন—কিন্তু তাঁহাদেব সহানুভূতি নাই, তবু সেখানেই যাইতে ইচ্ছা করে। তবুও মনে হয়, হয়তো জ্যাঠাইমা মায়ের দু-পাঁচটা কথা বলিবেন এখন, দুটা সহানুভূতির কথা হয়তো বলিবেন—
মাস-তিনেক এভাবে কাটিল। এ তিন মাসের কাহিনী তাহার জীবনের ইতিহাসে একটা একটানা নিরবচ্ছিন্ন দুঃখের কাহিনী। ভবিষ্যৎ জীবনে অপু এ গলিটাব নিকট দিয়া যাইতে যাইতে নিজের অজ্ঞাতসারে একবার বড়ো রাস্তা হইতে গলির মোড়ে চাহিয়া দেখিত, আর কখনও সে ইহার মধ্যে ঢোকে নাই।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে সে একদিন খবরের কাগজে দেখিল-যুদ্ধের জন্য তোক লওয়া হইতেছে, পার্ক স্ট্রীটে তাহার অফিস। দুপুরে ঘুরিতে ঘুরিতে সে গেল পার্ক স্ট্রীটে।
টেবিলে একরাশ আপানো ফর্ম পড়িয়া ছিল, অপু একখানা তুলিয়া পড়িয়া রিক্রুটিং অফিসারকে বলিল-কোথাকার জন্য লোক নেওয়া হবে?
–মেসোপটেমিয়া, রেলওয়ে ও ট্রান্সপোর্ট বিভাগের জন্য। তুমি কি টেলিগ্রাফ জানোনা মোটর মিন্ত্রি?
অপু বলিল—সে কিছুই নহে। ও-সব কাজ জানে না, তবে অন্য যে কোন কাজ—কি কেরানীগিরি।
সাহেব বলিল-না, দুঃখিত আমরা শুধু কাজ জানা লোক নিচ্ছি—বেশির ভাগ মোটর ড্রাইভার, সিগন্যালার, স্টেশন মাস্টার সব।
এই অবস্থায় একদিন লীলার সঙ্গে দেখা। ইতস্তত লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে একদিন ডালহাউসি স্কোয়ারের মোড়ে সে রাস্তা পার হইবার জন্য অপেক্ষা করিতেছে, সামনে একখানা হলদে রঙের বড়ো মিনার্ভা গাড়ি ট্রাফিক পুলিশে দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছিল হঠাৎ গাড়িখানার দিক হইতে তাহার নাম ধরিয়া কে ডাকিল।
সে গাড়ির কাছে গিয়া দেখিল, লীলা ও আর দুই-তিনটি অপরিচিত মেয়ে। লীলার ছোটভাই ড্রাইভারের পাশে বসিয়া। লীলা আগ্রহের সুরে বলিল—আপনি আচ্ছা তো অপূর্ববাবু? তিন-চার মাসের মধ্যে দেখা করলেন না, কেন বলুন তো? মা সেদিনও আপনার কথা—
অপুর আকৃতিতে একটা কিছু লক্ষ করিয়া সে বিস্ময়ের সুরে বলিল–আপনার কি হয়েছে? অসুখ থেকে উঠেছেন নাকি, শরীর-মাথার চুল অমন ছোেট-ঘোট, কি হয়েছে বলুন তো?
অপু হাসিয়া বলিল-কই না, কি হবে কিছু তো হয় নি?
–মা কেমন আছেন?
—মা? তা মামা তো নেই। ফাগুন মাসে মারা গিয়েছেন।
কথা শেষ করিয়া অপু আর এক দফা পাগলের মতো হাসিল।
হয়তো বাল্যের সে প্রীতি নানা ঘটনায়, বহু বৎসরের চাপে লীলার মনে নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছিল, হয়তো ঐশ্বর্যের আঁচ লাগিয়া সে মধুর বাল্যমন অন্যভাবে পরিবর্তিত হইয়াছিল ধীরে ধীরে, অপুর মুখের এই অর্থহীন হাসিটা যেন একখানা তীক্ষ্ণ ছুরির মতো গিয়া তাহার মনের কোন গোপন মণিমঞ্জুষার রুদ্ধ ঢাকনির ফাঁকটাকে হঠাৎ একটা সজোরে চাড়া দিল, এক মুহূর্তে অপুর সমস্ত ছবিটা তাহার মনের চোখে ভাসিয়া উঠিল—সহায়হীন, মাতৃহীন, আশ্রয়হীন, পথে-পথে বেড়াইতেছে-কে মুখের দিকে চাহিবার আছে?
লীলার গলা আড়ষ্ট হইয়া গেল, একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,আপনি আমাদের ওখানে কবে আসবেন বলুন-না, ও রকম বললে হবে না। এ-কথা আমাদের জানানো আপনার উচিত ছিল না? অন্তত মাকেও বলা তো কাল সকালে আসুন—ঠিক বলুন আসবেন? কেমন ঠিক তাসেবারকার মতো করবেন না কিন্তু ভালো কথা, আপনার ঠিকানাটা বলুন তো, কি—ভুলবেন না কিন্তু–।
গাড়ি চলিয়া গেল।
বাসায় ফিরিয়া অপু মনের মধ্যে অনেক তোলাপাড়া করিল। লীলার মুখে সে একটা কিসের ছাপ দেখিয়াছে, বর্তমান অবস্থায় মন তাহার এই আন্তরিকতার স্নেহস্পর্শটুকুরই কাঙ্গাল বটে—কিন্তু এই বেশে কোথাও যাইতে ইচ্ছা হয় না, এই জামায়, এই কাপড়ে, এই ভাবে। থাক বরং।
তিনদিন পর নিজের নামে একখানা পত্ৰ আসিতে দেখিয়া সে বিস্মিত হইল—মা ছাড়া আর তো কাহারও পত্র সে পায় নাই। কে পত্ৰ দিল? পত্ৰ খুলিয়া পড়িল :
অপূর্ববাবু,
আপনার এখানে আসবার কথা ছিল সোমবারে, কিন্তু আজ শুক্রবার হয়ে গেল আপনি এলেন। আপনাকে মা একবার অবিশ্যি অবিশ্যি আসতে বলেছেন, না এলে তিনি খুব দুঃখিত হবেন। আজ বিকেলে পাচটার সময় আপনার আসা চাই-ই। নমস্কার নেবেন।
কথাটা লইয়া মনের মধ্যে সে অনেক বোঝাপড়া করিল। কি লাভ গিয়া? ওরা বড়োমানুষ, কোন্ বিষয়ে সে ওদের সঙ্গে সমান যে, ওদের বাড়ি যখন-তখন যাইবে? মেজ-বৌরানী যে তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, সেই কথাটা তাহার মনে অনেকবার যাওয়া-আসা করিল—সেইটা, আর লীলার আন্তরিকতা। কিন্তু মেজ-বৌরানী কি আর তার মায়ের অভাব দূর করিতে পারিবেন? তিনি বড়োলোকের মেয়ে, বড়োলোকের বধূ! তাহার মায়ের আসন হৃদয়ের যে স্থানটিতে, সে শুধু তাহার দুঃখিনী মা অর্জন করিয়াছে তাহার বেদনা, ব্যর্থতা, দৈন্য-দুঃখ, শত অপমান দ্বারা—ছয় সিলিন্ডারের মিনার্ভা গাড়িতে চড়িয়া কোনও ধনীবধূ-হউন তিনি স্নেহময়ী, হউন তিনি মহিমময়ী—তাঁহার সেখানে প্রবেশাধিকার কোথায়?
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে পরীক্ষার ফল বাহির হইল। প্রথম বিভাগের প্রথম সতের জনের মধ্যে তাহার নাম, বাংলাতে সকলের মধ্যে প্রথম হইয়াছে, এজন্য একটা সোনার মেডেল পাইবে। এমন কেহ নাই যাহার কাছে খবরটা বলিয়া বাহাদুরি করা যাইতে পারে। কোনও পরিচিত বন্ধুবান্ধব পর্যন্ত এখানে নাই—ছুটিতে সব দেশে গিয়াছে। জ্যাঠাইমার কাছে যাইবে?…গিয়া জানাইবে জ্যাঠাইমাকে?…কি লাভ, হয়তো তিনি বিরক্ত হইবেন, দরকার নাই যাওয়ার।
১০. আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি
দশম পরিচ্ছেদ
আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সব কলেজ খুলিয়া গেল, অপু কোনও কলেজে ভর্তি হইল না। অধ্যাপক মিঃ বসু তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইয়া ইতিহাসে অনার্স কোর্স লওয়াইতে যথেষ্ট চেষ্টা করিলেন! অপু ভাবিল—কি হবে আর কলেজে পড়ে? সে সময়টা ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে কাটাব, বি.এ.-র ইতিহাসে এমন কোন নতুন কথা নেই যা আমি জানি নে। ও দু-বছর মিছিমিছি নষ্ট, লাইব্রেরিতে তার চেয়ে অনেক পড়ে ফেলতে পারব এখন। তা ছাড়া ভর্তির টাকা, মাইনে, এ সব পাই বা কোথায়?
একটা কিছু চাকুরি না খুঁজিলে চলে না। খবরের কাগজ ক্রিয়ের পুঁজি অনেকদিন ফুরাইয়া গিয়াছে, মায়ের মৃত্যুর পর সে কাজে আর উৎসাহ নাই। একটা ছোট ছেলে পড়ানো আছে, তাতে শুধু দুটো ভাত খাওয়া চলে দু-বেলা–কোনমতে ইকমিক কুকারে আলুসিদ্ধ, ডালসিদ্ধ ও ভাত। মাছ, মাংস, দুধ, ডাল, তরকারি তো অনেকদিন-আগে-দেখা স্বপ্নের মতো মনে হয়—যাক সে-সব, কিন্তু ঘর-ভাড়া, কাপড়জামা, জলখাবার, এসব চলে কিসে? তাহা ছাড়া অপুর অভিজ্ঞতা জন্মিয়াছে যে, কলিকাতায় ছেলে-পড়ানো বাবার মুখে শৈশবে শেখা উদ্ভট শ্লোকের পদ্মপস্থিত জলবিন্দুর মতো চপল, আজ যদি যায় কাল দাঁড়াইবার স্থান নাই!
কয়েকদিন ধরিয়া খবরের কাগজ দেখিয়া দেখিয়া পাইওনিয়ার ড্রাগ স্টোর্সে একটা কাজ খালি দেখা গেল দিনকতক পরে। আমহার্স্ট স্ট্রেটের মোড়া বড়ো দোকান, পিছনে কারখানা, তখনও ভিড় জমিতে শুরু হয় নাই, অপু ঢুকিয়াই এক স্থূলকায় আধাবয়সি ভদ্রলোকের একেবারে সামনে পড়িল। ভদ্রলোক বলিলেন, কাকে চান?
অপু লাজুক মুখে বলিল—আজ্ঞে, চাকরি খালির বিজ্ঞাপন দেখে—তাই
–ও! আপনি ম্যাট্রিক পাশ?
—আমি এবার আই.এ.–
ভদ্রলোক পুনরায় কিয়ায় ভর দিয়া হাল ছাড়িয়া দিবার সুরে বলিলেন–ও আই.এ. পাশ নিয়ে আমরা কি করব, আমাদের লেবেলিং ও মাল বটলিং করার জন্য লোক চাই। খাটুনিও খুব, সকাল সাতটা থেকে সাড়ে দশটা, মধ্যে দেড় ঘন্টা খাবার ছুটি, আবার বারোটা থেকে পাচটা, কাজের চাপ পড়লে রাত আটটাও বাজবে–
-মাইনে কত?
—আপাতত পনেরো, ওভারটাইম খাটলে দু-আনা জলখাবার–সে-সব আপনাদের কলেজের ছোকরার কাজ নয় মশায়—আমরা এমনি মোটামুটি লোক চাই!
ইহার দিনকতক পর আর একটা চাকুরি খালির বিজ্ঞাপন দেখিয়া গেল ক্লাইভ স্ট্রীটে। দেখিল, সেটা একটা লোহা-লক্কড়ের দোকান, বাঙালি ফার্ম। একজন ত্রিশ-বত্রিশ বছরের অত্যন্ত চুল ফাঁপানো, টেরিকাটা লোক ইস্ত্রিকরা কামিজ পরিয়া বসিয়া আছে, মুখের নিচের দিকের গড়নে একটা কর্কশ ও স্থূল ভাব, এমন ধরনের চোখের ভাবকে সে মাতাল ও কুচরিত্র লোকের সঙ্গে মনে মনে জড়িত করিয়া থাকে। লোকটি অত্যন্ত অবজ্ঞার সুরে বলিল—কি, কি এখানে?
অপুর নিজেকেই অত্যন্ত ছোট বোধ হইল নিজের কাছে। সে সংকুচিত সুরে বলিল—এখানে একটা চাকরি খালি দেখে আসছি।
লোকটার চেহারা বড়োলোকের বাড়ির উজ্জ্বল, অসচ্চরিত্র, বড়ো ছেলের মতো। পূর্বে এধরনের চরিত্রের সহিত তাহার পরিচয় হইয়াছে, লীলাদের বাড়ি বর্ধমানে থাকিতে। এই টাইপটা সে চেনে।
লোকটা কর্কশ সুরে বলিল—কি করো তুমি?
—আমি আই.এ. পাশ করি নে কিছু—আপনাদের এখানে–
—টাইপরাইটিং জানো? না?—যাও যাও, এখানে না-ও কলেজ-টলেজ এখানে চলবে—যাও–
সেদিনকার ব্যাপারটা বাসায় আসিয়া গল্প করাতে ক্যাম্বেল স্কুলের ছাত্রটির এক কাকা বলিলেন—ওদের আজকাল ভারি দেমাক, যুদ্ধের বাজারে লোহার দোকানদার সব লাল হয়ে যাচ্ছে, দালালেরা পর্যন্ত দু-পয়সা করে নিলে।
অপু বলিল-দালাল আমি হতে পারি নে?
-কেন পারবেন না, শক্তটা কি? আমার শ্বশুর একজন বড়ো দালাল, আপনাকে নিয়ে যাব একদিন—সব শিখিয়ে দেবেন, আপনাদের মতো শিক্ষিত ছেলে তো আরও ভালো কাজ করবে
মহা-উৎসাহে ক্লাইভ স্ট্রীট অঞ্চলে লোহার বাজারে দালালি করিতে বাহির হইয়া প্রথম দিনচার-পাঁচ ঘোরাঘুরিই সার হইল; কেহ ভালো করিয়া কথাও বলে না, একদিন একজন বড়া দোকানী জিজ্ঞাসা করিল,—বোলটু আছে? পাঁচ ইঞ্চি পাঁচ জ? অপু বোলটু কাহাকে বলে জানে না, কোন্ দিকের মাপ পাঁচ ইঞ্চি পাঁচ জ তাহাও বুঝিতে পারিল না। নোটবুকে টুকিয়া লইল, মনে মনে ভাবিল,
একটা অর্ডার তো পাইয়াছে, খুঁজিবার মতোও একটা কিছু জুটিয়াছে এতদিন পরে।
পাঁচ ইঞ্চি পাঁচ জ বোলটু এ-দোকান ও-দোকান দিনচারেক বৃথা খোঁজাখুঁজির পর তাহার ধারণা পৌঁছল যে, জিনিসটা বাজারে সুলভপ্রাপ্য নয় বলিয়াই দোকানী এত সহজে তাহাকে অর্ডার দিয়াছিল। একদিন একজন দালাল বলিল—মশাই সওয়া ইঞ্চি ঘেরের সীসের পাইপ দিতে পারেন জোগাড় করে আড়াই শো ফুট? যান না, অর্ডারটা নিয়ে আসুন এই পাশেই ইউনাইটেড মেশিনারি কোম্পানির অফিস থেকে।
পাশেই খুব বড়ো বাড়ি। অফিসের লোকে প্রথমে তাহাকে অর্ডার দিতে চায় না, অকুশেষে জিজ্ঞাসা করিল-মাল আমাদের এখানে ডেলিভারি দিতে পারবেন তো?…
এ কথার মানে ঠিক না বুঝিয়াই সে বলিল—হাঁ দিতে পারব।
বহু খুঁজিয়া কলেজ স্ট্রীটের যে দোকান হইতে মাল বাহির হইল, তাহারা মাল নিজের খরচে কোথাও ডেলিভারি দিতে রাজি নয়, অপু নিজের ঘাড়ে ঝুঁকি লইয়া গরুর গাড়িতে সীসার পাইপ বোঝাই দেওয়াই-রাজা উডমান্ড স্ট্রীটে দুপুর রোদ্রে মাল আনিয়া হাজিরও করিল। ইউনাইটেড মেশিনারি কিন্তু গাড়ির ভাড়া দিতে একদম অস্বীকার করিল, মাল তো এখানে ডেলিভারি দিবার কথা ছিল, তবে গাড়ি-ভাড়া কিসের? অপু ভাবিল, না হয় নিজের দালালির টাকা হইতে গাড়ি ভাড়াটা মিটাইয়া দিবে এখন। এখন কাজে নামিয়া অভিজ্ঞতাটাই আসল, না-ই বা হইল বেশি লাভ।
সে বলিল—আমার ব্রোকারেজটা?
-সে কি মশাই, আপনি সাড়ে পাঁচ আনা ফুটে দর দিয়েছেন, আপনার দালালি নেন নি? তা কখনও হয়–
অপু জানে না যে, প্রথম দর দিবার সময় তাহার মধ্যে দালালি ধরিয়া দিবার নিয়ম, সবাই তাহা দিয়া থাকে, সেও যে তাহা দেয় নাই, এ কথা কেহই বিশ্বাস করিল না। বার-বার সেই কথা তাহাদের বুঝাইতে গিয়া নিজের আনাড়িপনাই বিশেষ করিয়া ধরা পড়িল। সীসার পাইপওয়ালা গোমস্তা তাহাদের বিল বুঝিয়া পাইয়া চলিয়া গেল—তিনদিন ধরিয়া রৌদ্রে ছুটাছুটি ও পরিশ্রম সার হইল, একটি পয়সাও তাহাকে দিল না কোন পক্ষই। খোট্টা গাড়োয়ান পথ বন্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–হামারা ভাড়া কৌন দেগা?
একজন বৃদ্ধ মুসলমান দালানের এক পাশে দাঁড়াইয়া ব্যাপার দেখিতেছিল, অপু অফিস হইতে বাহিরে আসিলেই সে বলিল, বাবু, আপনি কতদিন এ কাজে নেমেছেন কাজ তো কিছুই জানেন না দেখছি–
অপুকে সেকথা স্বীকার করিতে হইল। লোকটি বলিল–আপনি লেখাপড়া জানেন, ও-সব খুচরা কাজ করে আপনার পোষাবে না। আপনি আমার সঙ্গে কাজে নামবেন?-বড়ো মেশিনারির দালালি, ইঞ্জিন, বয়লার এই সব। এক-একবারে পাঁচশো সাতশো টাকা রোজগার হবেবাবু ইংরেজি জানি নে তাই, তা যদি জানতাম, বাজারে এতদিন গুছিয়ে…নামবেন আমার সঙ্গে?
অপু হাতে স্বর্গ পাইয়া গেল। গাড়োয়ানকে ভাড়াটা যে দণ্ড দিতে হইল, আনন্দের আতিশয্যে সেটাও গ্রাহের মধ্যে আনিল না। মুসলমানটির সঙ্গে তাহার অনেকক্ষণ কথাবার্তা হইল—অপু নিজের বাসার ঠিকানা দিয়া দিল। স্থির হইল, কাল সকাল দশটার সময় এইখানে লোকটি তাহার অপেক্ষা করিবে।
অপু রাত্রে শুইয়া মনে মনে ভাবিল—এতদিন পরে একটা সুবিধে জুটেছে,—এইবার হয়তো পয়সার মুখ দেখবো।
কিন্তু মাসখানেক কিছুই হইল না—একদিন দালালটি তাহাকে বলিল—দুটোর পর আর বাজারে থাকেন না, এতে কি হয় কখনও বাবু? যান কোথায়?
অপু বলিল, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে পড়তে যাই—দুটো থেকে সাতটা পর্যন্ত থাকি। একদিন যেয়ো, দেখাবো কত বড়ো লাইব্রেরি।
লাইব্রেরিতে ইতিহাস খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়ে, কোন এক দরিদ্র ঘরের ছোট ছেলের কাহিনী পড়িতে বো ইচ্ছা যায়, সংসারে দুঃখকষ্টের সঙ্গে যুদ্ধ—তাহাদের জীবনের অতি ঘনিষ্ঠ ধরনের সংবাদ জানিতে মন যায়।
মানুষের সত্যকার ইতিহাস কোথায় লেখা আছে? জগতের বড়ো ঐতিহাসিকদের অনেকেই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজনৈতিক বিপ্লবের ঝাঝে, সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, মন্ত্রীদের সোনালি পোশাকের জাঁকজমকে, দরিদ্র গৃহস্থের কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। পথের ধারের আমগাছে তাহাদের পুঁটুলিবাঁধা ছাতু কবে ফুরাইয়া গেল, সন্ধ্যায় ঘোড়ার হাট হইতে ঘোড়া কিনিয়া আনিয়া পল্লীর মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের ছেলে তাহার মায়ের মনে কোথায় আনন্দের ঢেউ তুলিয়াছিল—ছহাজার বছরের ইতিহাসে সে-সব কথা লেখা নাই—থাকিলেও বড়ো কম-রাজা যযাতি কি সম্রাট অশোকের শুধু রাজনৈতিক জীবনের গল্প সবাই শৈশব হইতে মুখস্ত করে কিন্তু ভারতবর্ষের, গ্রীসের, রোমের যব, গম ক্ষেতের ধারে, ওলিভ, বন্যদ্রাক্ষা, মার্টল ঝোপের ছায়ায় ছায়ায় যে প্রতিদিনের জীবন হাজার হাজার বছর ধরিয়া প্রতি সকালে সন্ধ্যায় যাপিত হইয়াছে তাহাদের সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশার গল্প, তাহাদের বুকের স্পন্দনের ইতিহাস সে জানিতে চায়।
কেবল মাঝে মাঝে এখানে ওখানে ঐতিহাসিকদের লেখা পাতায় সম্মিলিত সৈন্যবহের এই আড়ালটা সরিয়া যায়, সারি বাধা বর্শার অরণ্যের ফাঁকে দূর অতীতের এক ক্ষুদ্র গৃহস্থের ছোট বাড়ি নজরে আসে। অজ্ঞাতনামা কোন লেখকের জীবন-কথা, কি কালের স্রোতে কুলে-লাগা এক টুকরা পত্র, প্রাচীন মিশরের কোন্ কৃষক পুত্রকে শস্য কাটিবার কি আয়োজন করিতে লিখিয়াছিল, বহু হাজার বছর পর তাহাদের টুকরা ভূগর্ভে প্রোথিত মৃন্ময়পাত্রের মতো দিনের আলোয় বাহির হইয়া আছে।
কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ ধরনের, আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চায় সে। মানুষ মানুষের বুকের কথা জানিতে চায়। আজ যা তুচ্ছ, হাজার বছর পরে তা মহা-সম্পদ। ভবিষ্যতের সত্যকার ইতিহাস হইবে এই কাহিনী, মানুষের মনের ইতিহাস, তার প্রাণের ইতিহাস।
আর একটা দিক তাহার চোখে পড়ে। একটা জিনিস বেশ স্পষ্ট হইয়া উঠে তাহার কাছে মহাকালের এই মিছিল। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ইতিহাস গিবন ক্রমশূন্য লিখিয়াছেন, কি অন্য কেহ ভ্রমশূন্য লিখিয়াছেন, এ বিষয়ে তাহার তত কৌতূহল নাই, সে শুধু কৌতূহলাক্রান্ত মহাকালের এই বিরাট মিছিলে। হাজার যুগ আগেকার কত রাজা, রানী, সম্রাট, মন্ত্রী, খোজা, সেনাপতি, বালক, যুবা, কত অশ্রুনয়না তরুণী, কত অর্থলিন্দু রাজপুরুষ—যাহারা অর্থের জন্য অন্তরঙ্গ বন্ধুর গুপ্ত কথা প্রকাশ করিয়া তাহাকে ঘাতকের কুঠারের মুখে নিক্ষেপ করিতে দ্বিধা বোধ করে নাই—অনন্ত কালসমুদ্রে ইহাদের ভাসিয়া যাওয়ার, বুদ্বুদের মতো মিলাইয়া যাওয়ার দিকটা। কোথায় তাহাদের বৃথা শ্রমের পুরস্কার, তাহাদের অর্থলিপ্সার সার্থকতা?
এদিকে ছুটাছুটিই সার হইতেছে কাজ কিছুই হয় না। সে তো চায় না বড়োমানুষ হইতে খাওয়া-পরা চলিয়া গেলেই সে খুশি—পড়াশুনা করার সে সময় পায় ও নিশ্চিন্ত হইতে পারে। কিন্তু তাও তো হয় না, টুইশানি না থাকিলে একবেলা আহারও জুটিত না যে। তা ছাড়া এ সব জায়গার আবহাওয়াই তাহার ভালো লাগে না আদৌ। চারিধারে অত্যন্ত হুঁশিয়ারি, দর-কষাকষি…শুধু টাকা…টাকা…টাকা-সংক্রান্ত কথাবার্তা—-লোকজনের মুখে ও চোখের ভাবে ইতর ও অশোভন লোভ যেন উগ্রভাবে ফুটিয়া বাহির হইতেছে—এদের পাকা বৈষয়িক কথাবার্তায় ও চালচলনে অপু ভয় খাইয়া গেল। লাইব্রেরির পরিচিত জগতে আসিয়া সে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচে প্রতিদিন।
একদিন মুসলমান দালালটি বাজারে তাহার কাছে দুইটি টাকা ধার চাহিল। বড়ো কষ্ট যাইতেছে, পরের সপ্তাহেই দিয়া দিবে এখন। অপু ভাবিল—হয়তো বাড়িতে ছেলেমেয়ে আছে, রোজগার নাই এক পয়সা। অর্থাভাবের কষ্ট যে কি সে তাহা ভালো করিয়াই বুঝিয়াছে এই দুই বৎসর—নিজের বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্য না থাকিলেও একটি টাকা বাসা হইতে আনিয়া পরদিন বাজারে লোকটাকে দিল।
ইহার দিন সাতেক পর অপু সকালে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া ঘরের দোরে কাহার ধাক্কার শব্দ পাইল, দোর খুলিয়া দেখিল-মুসলমান দালালটি হাসিমুখে দাঁড়াইয়া।
—এসো, এসো আবদুল, তারপর খবর কি?
—আদাব বাবু, চলুন, ঘরের মধ্যে বলি। এ-ঘরে আপনি একলা থাকেন, না আর কেউ–ওঃ—কেশ ঘর তো বাবু।
–এসো-বসো। চা খাবে?
চা-পানের পর আবদুল আসিবার উদ্দেশ্য বলিল। বারাকপুরে একটা বড়ো বয়লারের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে, ঠিক সেই ধরনের বয়লারেরই আবার এদিকে একটা খরিদ্দার জুটিয়া গিয়াছে, কাজটা লাগাইতে পারিলে তিনশো টাকার কম নয়—একটা বড় দাও। কিন্তু মুশকিল দাঁড়াইয়াছে এই যে, এখনই বারাকপুরে গিয়া বয়লারটি দেখিয়া আসা দরকার এবং কিছু বায়না দিবারও প্রয়োজন আছে—অথচ তাহার হাতে একটা পয়সাও নাই। এখন কি করা?
অপু বলিল—খদ্দের মাল ইনস্পেকশনে যাবে না?
–আগে আমরা দেখি, তবে তো খদ্দেরকে নিয়ে যাব?—দেড় পার্সেন্ট করে ধরলেও সাড়ে চারশো টাকা থাকবে আমাদের—খদ্দের হাতের মুঠোয় রয়েছে—আপনি নির্ভাবনায় থাকুন—এখন টাকার কি করি?
অপু পূর্বদিন টুইশানির টাকা পাইয়াছিল, বলিল–কত টাকার দরকার? আমি তো ছেলেপড়ানোর মাইনে পেয়েছি কত তোমার লাগবে বলে।
হিসাবপত্র করিয়া আট টাকা পড়িবে দেখা গেল। ঠিক হইল-আবদুল এবেলা বয়লার দেখিয়া আসিয়া ওবেলা বাজারে অপুকে খবর দিবে। অপু বাক্স খুলিয়া টাকা আনিয়া আবদুলের হাতে দিল।
বৈকালে সে পাটের এক্সচেঞ্জের বারান্দাতে বেলা পাঁচটা পর্যন্ত আগ্রহের সহিত আবদুলের আগমন প্রতীক্ষা করিল। আবদুল সেদিন আসিল না, পরদিনও তাহার দেখা নাই। ক্রমে একে একে সাত-আটদিন কাটিয়া গেল—কোথায় আবদুল? সারা বাজার ও রাজা উডমান্ড স্ট্রীটের লোহার দোকান আগাগোড়া খুঁজিয়াও তাহার সন্ধান মিলিল না। ক্লাইভ স্ট্রীটের একজন দোকানদার শুনিয়া বলিল—কত টাকা নিয়েছে আপনার মশাই! আবদুল তো! মশাই জোচ্চোরের ধাড়ি—আর টাকা পেয়েছেন,—টাকা নিয়ে সে দেশে পালিয়েছে—আপনিও যেমন!…
প্রথমে সে বিশ্বাস করিল না। আবদুল সে রকম মানুষ নয়, তাহা ছাড়া এত লোক থাকিতে তাহাকে কেন ঠকাইতে যাইবে?
কিন্তু এ ধারণা বেশিদিন টিকিল না! ক্ৰমে জানা গেল আবদুল দেশে যাইবে বলিয়া যাহার কাছে সামান্য যাহা কিছু পাওনা ছিল, সব আদায় করিয়া লইয়া গিয়াছে দিন সাতেক আগে! কাটাপেরেকের দোকানের বৃদ্ধ বিশ্বাস মহাশয় বলিলেন—আশ্চয্যি কথা মশাই, সবাই জানে আবদুলের কাণ্ডকারখানা আর আপনি তাকে চেনেন নি দু-তিন মাসেও? রাধে-কৃষ্ট! বেটা জুয়াচোরের ধাড়ি, হার্ডওয়ারের বাজারে সবাই চিনে ফেলেছে, এখানে আর সুবিধে হয় না, তাই গিয়ে আজকাল জুটেছে মেশিনারির বাজারে। কোনও দোকানে তো আপনার একবার জিজ্ঞেস করাও উচিত ছিল। হার্ডওয়ারের দালালি করা কি আপনার মতো ভালোমানুষের কাজ মশাই? আপনার অল্প বয়স, অন্য কাজ কিছু দেখে নিন গে। এখানে কথা বেচে খেতে হবে, সে আপনার কর্ম নয়, তবুও ভালো যে আটটা টাকার ওপর দিয়ে গিয়েছে—
আট টাকা বিশ্বাস মহাশয়ের কাছে যতই তুচ্ছ হউক অপুর কাছে তাহা নয়। ব্যাপার বুঝিয়া চোখে অন্ধকার দেখিল—গোটা মাসের ছেলে পড়ানোর দরুন সব টাকাটাই যে সে তুলিয়া দিয়াছে আবদুলের হাতে! এখন সারা মাস চলিবে কিসে! বাড়ি ভাড়ার দেনা, গত মাসের শেষে বন্ধুর কাছে ধার-এ সবের উপায়?
দিশাহারা ভাবে পথ চলিতে চলিতে সে ক্লাইভ স্ট্রীটে শেয়ার মার্কেটের সামনে আসিয়া পড়িল। দালাল ও ক্রেতাদের চিৎকার, মাড়োয়ারিদের ভিড় ও ঠেলাঠেলি, থর্নিক্রফট ছআনা, নাগরমল সাড়ে পাঁচ আনা-বেজায় ভিড়, বেজায় হৈ-চৈ, লালদিঘির পাশ কাটাইয়া লাটসাহেবের বাড়ির সম্মুখ দিয়া সে একেবারে গড়ের মাঠের মধ্যে কেল্লার দক্ষিণে একটা নির্জন স্থানে একটা বড়ো বাদাম গাছের ছায়ায় আসিয়া বসিল।
আজই সকালে বাড়িওয়ালা একবার তাগাদা দিয়াছে, কাপড় একেবারে নাই, না কুলাইলেও ছেলে পড়ানোর টাকা হইতে কাপড় কিনিবে ঠিক করিয়াছিল, রুম-মেট তো নিত্য ধারের জন্য তাগাদা করিতেছে। আবদুল শেষকালে এভাবে ঠকাইল তাহাকে? চোখে তাহার জল আসিয়া পড়িল-দুঃখদিনের সাথী বলিয়া কত বিশ্বাস যে করিত সে আবদুলকে।
অনেকক্ষণ সে বসিয়া রহিল। ঝা ঝা করিতেছে দুপুর, বেলা দেড়টা আন্দাজ। কেহ কোন দিকে নাই, আকাশ মেঘমুক্ত, দূরপ্রসারী নীল আকাশের গায়ে কালো বিন্দুর মতো চিল উড়িয়া চলিয়াছেদূর হইতে দুরে, সেই ছেলেবেলার মতো—ছোট হইতে ক্রমে মিলাইয়া চলিয়াছে। একজন ঘেসেড়া বর্ষার লম্বা লম্বা ঘাস কাটিতেছে। হোট একটি খোট্টাদের মেয়ে ঝুড়িতে ঘুটে কুড়াইতেছে।…দুরে খিদিরপুরের ট্রাম যাইতেছে…গঙ্গার দিকে বড়ো একটা জাহাজের চোফোর্টের বেতারের মাস্তুল এক… দুই… তিন… চার… আকাশ কি ঘন নীল—এই তো চারিধারের মুক্ত সৌন্দর্য…এই কম্পমান শ্রাবণ দুপুরের খররৌদ্র… বিদ্যুৎ… সূর্য… রাত্রির তারা… প্রেম… মা… দিদি… অনিল… মাথার উপরে নিঃসীম নীল আকাশ…মৃত্যুপারের দেশ…চিররাত্রির অন্ধকারে যেখানে সাঁই সাঁই রবে ধূমকেতুর দল আগুনের পুচ্ছ দুলাইয়া উড়িয়া চলে—গ্রহ ছোটে, চন্দ্রসূর্য লাটিমের মতো আপনার বেগে আপনি ঘুরিয়া বেড়ায়…তুহিন শীতল ব্যোমপথে দূরে দূরে দেবলোকের মেরুপর্বতের ফাঁকে ফাঁকে তাহারা মিটমিট করে—এই পরিপূর্ণ মহিমার মধ্যে জন্ম লইয়া আটটা টাকা… তুচ্ছ আট টাকা… এ কোন বিচিত্র জগৎ!…কিসের থর্নিক্রফট আর নাগরমল?
কখন বেলা পাচটা বাজিয়া গিয়াছিল, কখন একটু দূরে একটা ফুটবল টিমের খেলা আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল—একটা বল দুম করিয়া তাহার একেবারে সামনে আসিয়া পড়াতে তাহার চমক ভাঙিল। উঠিয়া সে বলটা দু-হাতে ধরিয়া সজোরে একটা লাথি মারিয়া সেটাকে ধাবমান লাইনসম্যানের দিকে ছুঁড়িয়া দিল।
একদিন পথে হঠাৎ প্রণবের সঙ্গে দেখা। দুজনেই ভারি খুশি হইল। সে কলিকাতায় আসিয়া পর্যন্ত অপুকে কত জায়গায় খুঁজিয়াছে, প্রথমটা সন্ধান পায় নাই, পরে জানিতে পারে অপূর্ব পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়া কোথায় চাকুরিতে ঢুকিয়াছে। প্রণব রাজনৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত হইয়া বৎসরখানেক হাজতভোগের পর সম্প্রতি খালাস হইয়াছে, হাসিয়া বলিল—কিছুদিন গবর্নমেন্টের অতিথি হয়ে এলুম রে, এসেই তোর কত খোঁজ করেছি—তারপর, কোথায় চাকরি করিস, মাইনে কত?
অপু হাসিমুখে বলিল—খবরের কাগজের আফিসে, মাইনে সত্তর টাকা!
সর্বৈব মিথ্যা। টাকা চল্লিশেক মাইনে পায়, কি একটা ফন্ড বাবদ কিছু কাটিয়া লওয়ার পর হাতে পৌঁছায় তেত্রিশ টাকা ক আনা। একটু গর্বের সুরে বলিল, চাকরি সোজা নয়, রয়টারের বাংলা করার ভার আমার ওপর বুধবারের কাগজে আট ও ধর্ম বলে লেখাটা আমার, দেখিস পড়ে।
প্রণব হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিল—তুই ধর্মের সম্বন্ধে লিখতে গেলি কি নিয়ে রে! কি জানিস তুই
–ওখানেই তোমার গোলমাল। ধর্ম মানে তুই বলতে চাইছিস, সেটা হচ্ছে collective ধর্ম, আমি বলি ওটার প্রয়োজনীয়তা ছিল আদিম মানুষের সমাজে, আর একটা ধর্ম আছে, যা কিনা নিজের নিজের, আমার ধর্ম আমার, তোমার ধর্ম তোমার, এইটের কথাই আমি—যে ধর্ম আমার নিজের তা যে আর কারও নয়, তা আমার চেয়ে কে ভালো বোঝে?
—বৌবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে ওসব কথা হবে না, আয় গোলদিঘিতে লেকচার দিবি।
–শুনবি তুই? চল তবে–
গোলদিঘিতে আসিয়া দুজনে একটা নির্জন কোণ বাছিয়া লইল। প্রণব বলিল—বেঞ্চের উপর দাঁড়া উঠে।
অপু বলিল–দাঁড়াচ্ছি, কিন্তু লোক জমবে না তো? তা হলে কিন্তু আর একটি কথাও বলব না।
তারপর আধঘন্টাটাক অপু বেঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া ধর্ম সম্বন্ধে এক বক্তৃতা দিয়া গেল। সে নিষ্কপট ও উদার—যা মুখে বলে মনে মনে তাহা বিশ্বাস করে। প্রণব শেষ পর্যন্ত শুনিবার পর ভাবিল—এসব কথা নিয়ে খুব তো নাড়াচাড়া করেছে মনের মধ্যে! একটু পাগলামির ছিট আছে, কিন্তু ওকে ওইজন্যেই এত ভালোবাসি।
অপু বেঞ্চ হইতে নামিয়া বলিল—কেমন লাগল?–
—তুই খুব sincere, যদিও একটু ছিটগ্রস্ত—
অপু লজ্জামিশ্রিত হাস্যের সহিত বলিল—যাঃ–
প্রণব বলিল—কিন্তু কলেজটা ছেড়ে ভালো কাজ করিস নি, যদিও আমি জানি, তাই সেদিন বিনয়কে বলছিলাম যে অপূর্ব কলেজে না গিয়েও যা পড়াশুনা করবে, তোমরা দু-বেলা কলেজের সিমেন্ট ঘষে ঘষে উঠিয়ে ফেললেও তা হবে না! ওর মধ্যে একটা সত্যিকার পিপাসা রয়েছে যে–
নিজের প্রশংসা শুনিয়া অপু খুব খুশিবালকের মতো খুশি। উজ্জ্বল মুখে বলিল-অনেকদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা, চল তোকে কিছু খাওয়াইগেকলেজ-মেটদের আর কারুর দেখা পাই নে আমোদ করা হয় নি কতদিন যে—মা মারা যাওয়ার পর থেকে তো…
প্রণব বিস্ময়ের সুরে বলিল-মাও মারা গিয়েছেন।
–ওঃ, সে কথা বুঝি বলি নি? সে তো প্রায় এক বছর হতে চলল—
সামনেই একটা চায়ের দোকান। অপু প্রণবের হাত ধরিয়া সেখানে ঢুকিল। প্রণবের ভারি ভালো লাগিল অপুর এই অত্যন্ত খাঁটি ও অকৃত্রিম, আগ্রহ-ভরা হাত ধরিয়া টানা। সে মনে মনে ভাবিল—এরকম warmth আর sincerity কজনের মধ্যে পাওয়া যায়? বন্ধু তো মুখে অনেকেই আছে-অপু একটা জুয়েল।
অপু বলিল—কি খাবি বল্?—এই বেয়ারা, কি আছে ভালো?
খাইতে খাইতে প্রণব বলিল—তারপর চাকরির কথা বল—যে বাজার কি করে জোটালি?
অপু প্রথমে লোহার বাজারের দালালির গল্প করিল। হাসিয়া বলিল—তারপর আবদুলের মহাভিনিষ্ক্রমণের পরে হার্ডওয়ার আর জমলো না—ঘুরে ঘুরে বেড়াই চাকরি খুঁজে, বুঝলি—একদিন একজন বললে, বি.এন.আর. অফিসে অনেক নতুন লোক নেওয়া হচ্ছে—গেলুম সেখানে। খুব লোকের ভিড়, চাকরি অনেক খালি আছে, ইংরিজি লিখতে পড়তে পারলেই চাকরি হচ্ছে। ব্যাপার কি, শুনলাম মাস-দুই হল স্ট্রাইক চলছে—তাদের জায়গায় নতুন লোক নেওয়া হচ্ছে–
প্ৰণব চায়ে চুমুক দিয়া বলিল—চাকরি পেলি?
–শোন না, চাকরি তখুনি হয়ে গেল, প্রিন্সিপ্যালের সার্টিফিকেটটাই কাজের হল, তখুনি ছাপানো ফর্মে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দিলে, বাইরে এসে ভারি আনন্দ হল মনটাতে। চল্লিশ টাকা মাইনে, যেতে হবে গঞ্জাম জেলায়, অনেক দুর, যা ঠিক চাই তাই—বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটের মোড়ে একটা চায়ের দোকানে বসে মনের খুশিতে উপরি উপরি চার কাপ চা খেয়ে ফেললাম—ভাবলাম এতদিন পর পয়সার কষ্টটা তো ঘুচল?—আর কি খাবি? এই বেয়ারা, আর দুটো ডিম ভাজা–না–না—খা–
—দু-দিন চাকরি হয়েছে বলে বুঝি—তোর সেই পুরানো রোগ আজও-হ্যাঁ, তারপর?
–তারপর বাড়ি এসে রাতে শুয়ে শুয়ে মনটাতে ভালো বললে না—ভাবলাম, ওরা একটা সুবিধে আদায় করবার জন্য স্ট্রাইক করেছে, দুমাস তাদেরও ছেলেমেয়ে কষ্ট পাচ্ছে, তাদের মুখের ভাতের থালা কেড়ে খাব শেষকালে?—আবার ভাবি, যাই চলে, অতদূর কখনও দেখি নি, তা ছাড়া মা মারা যাওয়ার পর কলকাতা আর ভালো লাগে না, যাইগে—কিন্তু শেষ পর্যন্ত—ফের ওদের অফিসে গেলাম—ছাপানো ফর্মখানা ফেরত দিয়ে এলাম, বলে এলাম আমার যাওয়ার সুবিধে হবে না—
প্রণব বলিল—তোর মুখ আর চোখ look full of music and poetry-প্রথম থেকে আমি জানি যে একজন আইডিয়াসিস্ট হোকরা—তোদের দিয়েই তো এসব হবে—তোর এ খবরের কাগজের কাজ কখন?
–রাত নটার পর যেতে হয়, রাত তিনটের পর ছুটি। ভারি ঘুম পায়, এখনও রাতজাগা অভ্যেস হয় নি, তবে সুবিধে আছে, সকাল দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে নি, সারাদিন লাইব্রেরিতে কাটাতে পারি–
খাওয়া-দাওয়া ভালোই হইল। অপু বলিল—জল খাস নে—চল কলেজ স্কোয়ারে শরবৎ খাব-বেশ মিষ্টি লাগে খেতে।—লেমন স্কোয়াশ খেয়েছিস-আয়–
কলেজের অত ছেলের মধ্যে এক অনিল ও প্রণব ছাড়া সে আর কাহাকেও বন্ধু ভাবে গ্রহণ করিতে পারে নাই, অনেকদিন পরে মন খুলিয়া আলাপের শোক পাইয়া তাহার গল্প আর ফুরাইতেছিল না। বলিল, গাছপালা যে কতদিন দেখি নি, ইট আর সিমেন্ট অসহ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের অফিসে একজন কাজ করে, তার বাড়ি হাওড়া জেলা, সেদিন বলছে, বাড়ির বাগানে আগাছা বেড়ে উঠছে, তাই সাফ করছে রবিবারেরবিবারে। আমি তাকে বলি, কি গাছ মিত্তির মশাই? সে বলে—কিছু না, ঝুপি গাছ। আমি বলি—বলুন না, কি কি গাছ? রোজ সোমবারে সে বাড়ি থেকে এলে তাকে এই কথা জিজ্ঞেস করি—সে হয়তো ভাবে, আচ্ছা পাগল!—রাত্রে, ভাই, সারারাত প্রেসের ঘড়ঘড়ানি, গরম, প্রিন্টারের তাগাদার মধ্যে আমার কেবল মিত্তির মশায়ের বাড়ির সেই ঝুপি বনের কথা মনে হয়—ভাবি কি না কি জানি গাছ। এদিকে চোখ ঘুমে ঢুলে আসে, বাত একটার পর শরীর এলিয়ে পড়তে চায়, শরীরের বাঁধন যেন ক্রমে আলগা হয়ে আসে, কুঁজোব জল চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে ফুলে-ফুলো রাঙা-রাঙা, জ্বালা-করা চোখে আবার কাজ করতে বসি–ইলেকট্রিক বাতিতে যেন চোখে ছুঁচ বেঁধে-আর এত গরমও ঘরটাতে!
পরে সে আগ্রহের সুরে বলিল—একদিন রবিবারে চল তুই আব আমি কোনও পাড়াগাঁযে গিয়ে মাঠে, বনের ধারে ধারে সারাদিন বেড়িয়ে কাটাব—বেশ সেখানেই লতাকাঠি কুড়িয়ে আমরা রাঁধব—বিকেল হবে—পাখির ডাক যে কতকাল শুনি নি! দোয়েল কি বৌ-কথা-কও, ওদের ডাক তো ভুলেই গিয়েছি, রবিবার দিনটা ছুটি, চল্ যাবি?—এখন কত ফুল ফোটাবও সময়—আমি অনেক বনের ফুলের নাম জানি, দেখিস চিনিয়ে দেব। যাবি প্রণব, চল আজ থিয়েটার দেখি? স্টারে ‘সধবার একাদশী’ আছে-যাবি?
নিজেই দু-খানা গ্যালারির টিকিট কিনিল থিয়েটার ভাঙিলে অনেক রাত্রিতে ফিরিবার পথে অপু বলিল—কি হবে বাকি রাতটুকু ঘুমিয়ে; আজ বসে গল্প করে রাত কাটাই। কর্নওয়ালিস স্কোয়ারের কাছে আসিয়া অপু বন্ধুর হাত ধরিয়া রেলিং টপকাইয়া স্কোয়ারের ভিতর ঢুকিয়া পড়িল— আয় আয়, এই বেঞ্চিটাতে বসি, আমি নিমাদের পার্ট প্লে করব, দেখবি–
প্রণব হাসিয়া বলিল—তোর মাথা খারাপ আছে—এত রাত্রে বেশি চেঁচাস নি-পুলিশ এসে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু খানিকটা পর প্রবও মাতিয়া উঠিল। দুজনে হাসিয়া আবোল-তাবোল বকিয়া আরও ঘণ্টাখানেক কাটাইল। অপু একটা বেঞ্চির উপরে গড়াগড়ি দিতেছিল ও মুখে নিমাদের অনুকরণে ইংরাজি কি কবিতা আবৃত্তি করিতেছিল-প্রণবের ভয়সূচক স্বরে উঠিয়া বসিয়া চাহিয়া দেখিল ফুটপাতের উপর একজন পাহারাওয়ালা। অমনি সে বেঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল-Hai, Holy Light! Heavens First born!-পরে দু-জনেই ডাফ স্ট্রীটের দিকের রেলিং টপকাইয়া সোজা দৌড় দিল।
রাত্রি আর বেশি নাই। আমহার্স্ট স্ট্রীটের একটা বড়ো লাল বাড়ির পৈঠায় অপু গিয়ে বসিয়া পড়িয়া বলিল-কোথায় আর যাবো-আয় বোস এখানে–
প্ৰণব বলিল—একটা গান ধর তবে—
অপু বলিল-বাড়ির লোকে দোর খুলে বেরিয়ে আসবে-কোনরকমে পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি–
-কেমন পাহারাওয়ালাটাকে চেঁচিয়ে বললুম—Hail, Holy Light!–হি-হি–টেরও পায় নি? কোথা দিয়ে পালালুম-নিমাদের মতো হয় নি?—হি-হি–
প্রণব বলিল—তোর মাথায় ছিট আছে—যাঃ, সারা রাতটা ঘুম হল না তোর পাল্লায় পড়ে গা একটা গানই গা—আস্তে আস্তে ধর—আবার হাসে, যাঃ—
ইহার দিন-পনেরো পরে একদিন প্রণব আসিয়া বলিল—তোকে নিয়ে যাব বলে এলাম— আমার মামাতো বোেনর বিয়ে হবে সোমবারে, শুক্রবার রাত্রে আমরা যাব, খুলনা থেকে স্টিমারে যেতে হয়, অনেকদিন কোথাও যাস নি, চল আমার সঙ্গে, দিন চার-পাঁচের ছুটি পাবি নে?
ছুটি মিলিল। ট্রেনে উঠিবার সময় তাহার ভারি আনন্দ। অনেকদিন কলিকাতা ছাড়িয়া যায় নাই, অনেকদিন রেলেও চড়ে নাই। সকালবেলা স্টিমারে উঠিবার সময় ভৈরবের ওপার হইতে তরুণ সূর্য ওঠার দৃশ্যটা তাহাকে মুগ্ধ করিল। নদী খুব বড়ো ও চওড়া, স্টিমার প্রণবের মামার বাড়ির ঘাটে ধরে না, পাশের গ্রামে নামিয়া নৌকায় যাইতে হয়। অপু এ অঞ্চলে কখনও আসে নাই, সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশ, নদীর ধারে সুপারির সারি, বাঁশ, বেতবন, অসংখ্য নারকেল গাছ। টিনের চালাওয়ালা গোলা গঞ্জ। অদ্ভুত ধরনের নাম, স্বরূপকাটি, যশাইকাটি।
দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ও খাড়া পশ্চিম, দু-দিক হইতে প্রকাণ্ড দুটা নদী আসিয়া পরস্পরকে চুঁইয়া অর্ধচন্দ্রাকারে বাঁকিয়া গিয়াছে, সেখানটাতে জলের রং ঈষৎ সবুজ এবং এই সঙ্গমস্থানেই ও-পারে আধ মাইলের মধ্যে প্রণবের মামার বাড়ির গ্রাম গঙ্গানন্দকাটি।
নদীর ঘাট হইতে বাড়িটা অতি অল্প দূরে। এ গ্রামের মধ্যে ইহারাই অবস্থাপন্ন সম্রান্ত গৃহস্থ।
অনেকবার অপু এ ধরনের বাড়ির ছবি কল্পনা করিয়াছে, এই ধরনের বড়ো নদীর ধারে, শহরবাজারের ছোঁয়াচ ও আবহাওয়া হইতে বহু দূরে কোন এক অখ্যাত ক্ষুদ্র পাড়াগাঁয়ের সম্রান্ত গৃহ, আগে অবস্থা ভালো ছিল, অথচ এখন নাই, নাটমন্দির, পূজার দালান, দোলমঞ্চ, রাসমঞ্চ সবই থাকিবে, অথচ সে-সব হইবে ভাঙা, শ্রীহীন—আর থাকিবে প্রাচীন ধনীবংশের ভ্রান্ত মর্যাদাবোধ, মানসম্মান, উদারতা। প্রণবের মামার বাড়ির সঙ্গে সব যেন হুবহু মিলিয়া গেল।
ঘাট হইতে দুই সারি নারিকেল গাছ সোজা একেবারে বাড়ির দেউড়িতে গিয়া শেষ হইয়াছে, বাঁয়ে প্রকাণ্ড পূজার দালান, ডাইনে হলুদ রঙের কলসি বসানো ফটক ও ফুলবাগান, দোলমঞ্চ, রাসমঞ্চ, নাটমন্দির। খুব জলুস নাই কোনটারই, কার্নিস খসিয়া পড়িতেছে, একরাশ গোলাপায়রা নাটমন্দিরের মেজেতে চরিয়া বেড়াইতেছে, এক-আধটা ঝটাপট করিয়া ছাদে উড়িয়া পালাইতেছে, একখানা যোল-বেহারার সেকেলে হাঙরমুখো পালকি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়িয়া আছে। দেখিয়া মনে হয়—এক সময় ইহাদের অবস্থা খুব ভালো ছিল, বর্তমানে পসারহীন ডাক্তারের দ্বারে সংযুক্ত অনাদৃত পিতলের পাতের মতো শ্রীহীন ও মলিন।
পুলু এসেছে, পুলু এসেছে—এই যে পুলু—এটি কে সঙ্গে? ও! বেশ বেশ, স্টিমার কি আজ লেট? ওরে নিবারণকে ডাক, ব্যাগটা বাড়ির মধ্যে নিয়ে যা, আহা থাক, এসো এসো দীর্ঘজীবী হও।
চপ্রণব তাহাকে একেবারে বাড়ির মধ্যে লইয়া গেল। অপু অপরিচিত বাড়ির মধ্যে অন্দরমহলে যথারীতি অত্যন্ত লাজুক মুখে ও সংকোচের সহিত ঢুকিল। প্রণবের বড়ো মামিমা আসিয়া কুশল-প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। অপুকে দেখিয়া বলিলেন-এ ছেলেটিকে কোখেকে আনলি পুলু? এ মুখ যেন–
প্রণব হাসিয়া বলিল–কি করে চিনবেন মামিমা? ও কি আর বাঙ্গাল দেশের মানুষ?
প্রণবের মামিমা বলিলেন–তা নয় রে, কতবার পটে আঁকা ছবি দেখেছি, ঠাকুর-দেবতার মুখের মতো মুখ এসো এসো দীর্ঘজীবী হও–
প্রণবের দেখাদেখি অপুও পায়ের ধুলা সইয়া প্রণাম করিল।
–এসো এসো, বাবা আমার এসো—কি সুন্দর মুখ–দেশ কোথায় বাবা?
সন্ধ্যার পর সারাদিনের গরমটা একটু কমিল। দেউড়ির বাহিরে আরতির কাঁসর ঘন্টা বাজিয়া উঠিল, চারদিকে শাঁখ বাজিল। উপরের খোলাছাদে শীতল পাটি পাতিয়া অপু একা বসিয়া ছিল, প্রণব ঘুম হইতে সন্ধ্যার কিছু আগে উঠিয়া কোথায় গিয়াছে। কেমন একটা নতুন ধরনের অনুভূতি-সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কি সেটা? কে জানে, হয়তো শাঁখের রব বা আরতির বাজনার দরুন কিংবা হয়তো…
মোটর উপর এ এক অপরিচিত জগৎ। কলিকাতার কর্মব্যস্ত, কোলাহলমুখর ধূলিপূর্ণ আবহাওয়া হইতে সম্পূর্ণ পৃথক এক ভিন্ন জীবনধারার জগৎ।
নারিকেলশ্রেণীর পশীর্ষে নবমীর জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে, এইমাত্র ফুটিল, অপু লক্ষ করে নাই। কি কথা যেন সব মনে আসে। অনেকদিনের কথা।
পিছন হইতে প্রণব বলিল-কেমন, গাছপালা গাছপালা করে পাগল, দেখলি তো গাছপালা নদীতে আসতে? কি রকম লাগল বল শুনি।
অপু বলিল—সে যা লাগল তা লাগল—এখন কি মনে হচ্ছে জানিস এই আরতি শুনে? ছেলেবেলায়, আমার দাদু ছিল ভক্ত বৈষ্ণব, তার মুখে শুনতাম, বংশী বটতট কদম্ব নিকট, কালিন্দী ধীর সমীর-যেন
সিঁড়িতে কাহাদের পায়ের শব্দ শোনা গেল। প্রণব ডাকিয়া বলিল—কে রে? মেনী? শোন–
একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের বালিকা হাসিয়া দরজার কাছে দাঁড়াইল। প্রণব বলিল–কে, কে রে? মেয়েটি পিছন ফিরিয়া কাহাদের দিকে একবার চাহিয়া দেখিয়া বলিল—সবাই আছে, ননীদি, দাসীদি, মেজদি, সরলা-তাস খেলব চিলেকোঠার ঘরে–
অপু মনে মনে ভাবিল-এ-বাড়ির মেয়ে-ছেলে সবাই দেখতে ভারি সুন্দর তো?
প্রণব বলিল—এটি মামার ছোট মেয়ে, এরই মেজ বোনের বিয়ে। কবোনের মধ্যে সে-ই সকলের চেয়ে সুশ্রী—মেনী ডাক তো একবারঅপর্ণাকে?
মেনী সিঁড়িতে গিয়া কি বলিতেই একটা সম্মিলিত মেয়েলি কণ্ঠের চাপা হাস্যধ্বনি শুনিতে পাওয়া গেল, অল্পক্ষণ পরেই একটি যোল-সতেরো বছরের নতমুখী সুন্দরী মেয়ে দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রণব বলিল—ও আমার বন্ধু, তোরও সুবাদে দাদা-লজ্জা কাকে এখানে রে? এটি মামার মেজ মেয়ে অপর্ণা—এরই–
মেয়েটি চপলা নয়, মৃদু হাসিয়া তখনই সরিয়া গেল, কি সুন্দর একটাল চুল! কিছু দিন আগে পড়া একটা ইংরাজি উপন্যাসের একটা লাইন বার বার তাহার মনে আসিতে লাগিল–Do they breed goddesses at Slocum Magna? Do…they…breed…goddesses…at…Slocum Magna?
এ রাতটার কথা অপুর চিরকাল মনে ছিল।
পরদিন প্রণবের সঙ্গে অপু তাহার মামার বাড়ির সবটা ঘুরিয়া দেখিল। প্রাচীন ধনীবংশবটে। বাড়ির উত্তর দিকে পুরাতন আমলের আবাসবাটি ও প্রকাণ্ড সাতদুয়ারী পূজার দালান ভগ্ন অবস্থায় পড়িয়া আছে, ওপারে অন্যতম শরিক রামদুর্লভ বাঁড়ুজ্যের বাড়ি। পুরাতন আমলের বসতবাটি বর্তমানে পরিত্যক্ত, রামদুর্লভের ছোট ভাই সেখানে বাস করিতেন। কি কারণে তাহার একমাত্র পুত্র নিরুদ্দেশ হইয়া যাওয়াতে তাহারা বেঁচিয়া-কিনিয়া কাশীবাগী হইয়াছেন।
এ সব কথা প্রণবের মুখেই ক্রমে ক্রমে শোনা গেল।
স্নানের সময়ে সে নদীতে স্নান করিতে চাহিলে সকলেই বারণ করিল—এখানকার নদীতে এ সময়ে কুমিরের উৎপাত খুব বেশি, পুকুরে স্নান করাই নিরাপদ।
বৈকালে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক কাছারি বাড়ির বারান্দাতে বসিয়া গল্প করিতেছিলেন, দিনপনেরো পূর্বে নিকটস্থ কোন গ্রামের জনৈক তাঁতির ছেলে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইয়া যায়, সম্প্রতি তাহাকে রায়মঙ্গলের এক নির্জন চরে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে। ছেলেটি বলে, তাহাকে নাকি পরীতে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিল, প্রমাণস্বরূপ সে আঁচলের খুট খুলিয়া কাঁচা লবঙ্গ, এলাচ ও জায়ফল বাহির করিয়া দেখাইয়াছে, এ-অঞ্চলের ত্রিসীমানায় এ সকলের গাছ নাই-পরী কোথাও হইতে আনিয়া উপহার দিয়াছে।
প্রণবের মামিমা দুপুরে কাছে বসিয়া দুজনকে খাওয়াইলেন, অনেকদিন অপুর অদৃষ্টে এত যত্ন আদর বা এত ভালো খাওয়া-দাওয়া জোটে নাই। চিনি, ক্ষীর, মশলা, কর্পূর, ঘৃত, জীবনে কখনও তাহাদের দরিদ্র গৃহস্থালিতে এ সকলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে নাই। মায়ের সংসারে চালের গুঁড়া, গুড় ও সরিষার তৈলের কারবার ছিল বেশি।
১১. পরদিন বিবাহ
একাদশ পরিচ্ছেদ
পরদিন বিবাহ। সকাল হইতে নানা কাজে সে বাড়ির ছেলের মতো খাটিতে লাগিল। নাটমন্দিরে বরাসন সাজানোর ভার পড়িল তাহার উপর। প্রাচীন আমলের বড়ো জাজিম ও শতরঞ্চির উপর সাদা চাদর পাতিয়া ফরাস বিছানো, কাচের সেজ ও বাতির ডুম টাঙানো, দেবদারু পাতার ফটক বাধা, কাগজ কাটিয়া দম্পতির উদ্দেশে আশিসবাণী রচনা, সকাল আটটা হইতে বেলা তিনটা পর্যন্ত এসব কাজে কাটিল।
সন্ধ্যার সময় বর আসিবে। বরের গ্রাম এই নদীরই ধারে, তবে দশ বারো ক্রোশ দূরে, নদীপথেই আসিতে হইবে। বরের পিতা ও-অঞ্চলের নাকি বড়ো গাঁতিদার, তাহা ছাড়া বিস্তৃত মহাজনী কারবারও আছে।
বরের নৌকা আসিতে একটু বিলম্ব হইতে পারে, প্রথম লগ্নে বিবাহ যদি না হয় রাত্রি দশটার লগ্ন বাদ যাইবে না।
ব্যাপার বুঝিয়া অপু বলিল-রাত তো আজ জাগতেই হবে দেখছি, আমি এখন একটু ঘুমিয়ে নিই ভাই, বর এলে আমাকে ডেকে তুলো এখন।
প্রণব তাহাকে তেতলার চিলেকোঠার ঘরে লইয়া গিয়া বলিল—এখানে হৈ-চৈ কম, এখানে ঘুম হবে এখন, আমি ঘণ্টা দুই পরে ডাকবো।
ঘরটা ছোট, কিন্তু খুব হাওয়া, দিনের শ্রান্তিতে সে শুইতে না শুইতে ঘুমাইয়া পড়িল।
কতক্ষণ পরে সে ঠিক জানে না, কাহাদের ডাকাডাকিতে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল।
সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, বর এসেছে বুঝি? উঃ, রাত অনেক হয়েছে তো! কিন্তু প্রণবের মুখের দিকে চাহিয়া তাহার মনে হইল—একটা কিছু যেন ঘটিয়াছে। সে বিস্ময়ের সুরে বলিল—কি-কি প্রণব-কিছু হয়েছে নাকি?
উত্তরের পরিবর্তে প্ৰণব তাহার বিছানার পাশে বসিয়া পড়িয়া কাতর মুখে তাহার দিকে চাহিল, পরে হল-ছল চোখে তাহার হাত দুটি ধরিয়া বলিল—ভাই আমাদের মান রক্ষার ভার তোমার হাতে আজ রাত্রে, অপর্ণাকে এখুনি তোমার বিয়ে করতে হবে, আর সময় বেশি নেই, রাত খুব অল্প আছে, আমাদের মান রাখো ভাই।
আকাশ হইতে পড়িলেও অপু এত অবাক হইত না।
প্রণব বলে কি?…প্রণবের মাথা খারাপ হইয়া গেল নাকি? না-কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখিতেছে!
এই সময়ে দুজন গ্রামের লোকও ঘরে ঢুকিলেন, একজন বলিলেন—আপনার সঙ্গে যদিও আমার পরিচয় হয় নি, তবুও আপনার কথা সব পুলুর মুখে শুনেছি—এদের আজ বড় বিপদ, সব বলছি আপনাকে, আপনি না বাঁচালে আর উপায় নেই
ততক্ষণে অপু ঘুমের ঘোরটা অনেকখানি কাটাইয়া উঠিয়াছে, সে না-বুঝিতে পারার দৃষ্টিতে একবার প্রণবের, একবার লোক দুইটির মুখের দিকে চাহিতে লাগিল। ব্যাপারখানা কি!
ব্যাপার অনেক।
সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেক পর বরপক্ষের নৌকা আসিয়া ঘাটে লাগে। লোকজনের ভিড় খুব, তিনখানা গ্রামের প্রজাপত্র উৎসব দেখিতে আসিয়াছে। বরকে হাঙরমুখো সেকেলে বড়ো পালকিতে উঠাইয়া বাজনা-বাদ্য ও ধুমধামের সহিত মহা সমাদরে ঘাট হইতে নাটমন্দিরে বরাসনে আনা হইতেছিল— এমন সময় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিল। বাড়ির উঠানে পালকিখানা আসিয়া পৌঁছিয়াছে, হঠাৎ বর নাকি পালকি হইতে লাফাইয়া পড়িয়া চেঁচাইয়া বলিতে থাকে—হুক্কা বোলাও, হুক্কা বোলাও।
সে কি বেজায় চিৎকার!
এক মুহূর্তে সব গোলমাল হইয়া গেল। চিৎকার হঠাৎ থামে না, বরকর্তা স্বয়ং দৌড়িয়া গেলেন, বরপক্ষের প্রবীণ লোকেরা ছুটিয়া গেলেন,—চারিদিকে সকলে অবাক, প্রজারা অবাক, গ্রামসুদ্ধ লোক অবাক! সে এক কাণ্ড! চোখে না দেখিলে বুঝানো কঠিন আর কি যে লজ্জা, সারা উঠান জুড়িয়া প্রজা, প্রতিবেশী, আত্মীয়কুটুম্ব, পাড়ার ও গ্রামের ছোট বড়ো সকলে উপস্থিত, সকলের সামনে-বড়য্যে বাড়ির মেয়ের বিবাহে এ ভাবের ঘটনা ঘটিবে, তাহা স্বপ্নাতীত, এ উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, মেয়েদের মধ্যে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। বর যে প্রকৃতিস্থ নয়, একথা বুঝিতে কাহারও বাকি রহিল না।
বরপক্ষ যদিও নানাভাবে কথাটা ঢাকিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন, কেহ বলিলেন গরমে ও সারাদিনের উপবাসের কষ্টেও কিছু নয়, ওরকম হইয়া থাকে…কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজে চাপা দেওয়া গেল না, ক্রমে ক্রমে নাকি প্রকাশ হইতে লাগিল যে, বরের একটু সামান্য ছিট আছে বটে, কিংবা ছিল বটে, তবে সেটা সবসময় যে থাকে তা নয়, আজকার গরমে, বিশেষ উৎসবের উত্তেজনায় ইত্যাদি। ব্যাপারটা অনেকখানি সহজ হইয়া আসিতেছিল, নানা পক্ষের বোঝানোতে আবার সোজা হাওয়া বহিতে শুরু করিয়াছিল, মেয়ের বাপ শশীনারায়ণ বাঁড়জ্যেও মন হইতে সমস্তটা ঝাড়িয়া ফেলিতে প্রস্তুত ছিলেন—তাহা ছাড়া উপায়ও অবশ্য ছিল না—কিন্তু এদিকে মেয়ের মা অর্থাৎ প্রণবের বড়ো মামিমা মেয়ের হাত ধরিয়া নিজের ঘরে ঢুকিয়া খিল দিয়াছেন,—তিনি বলেন, জানিয়া-শুনিয়া তাহার সোনার প্রতিমা মেয়েকে তিনি ও পাগলের হাতে কখনই তুলিয়া দিতে পারিবেন না, যাহা অদৃষ্টে আছে ঘটিবে। সকলের বহু অনুনয়-বিনয়েও এই তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে তিনি আর ঘরের দরজা খোলেন নাই, নাকি তেমন তেমন বুঝিলে মেয়েকে রামদা দিয়া কাটিয়া নিজের গলায় দা বসাইয়া দিবেন এমনও শাসাইয়াছেন, সুতরাং কেহ দরজা ভাঙিতে সাহস করে নাই। অপর্ণাও এমনি মেয়ে, সবাই জানে, মা তাহার গলায় যদি সত্যিই রাম-দা বসাইয়া দেয়, সে প্রতিবাদে মুখে কখনও টু শব্দটি উচ্চারণ করিবে না, মায়ের ব্যবস্থা শান্তভাবেই মানিয়া লইবে।
পিছনের ভদ্রলোকটি বলিলেন, আপনি না রক্ষা করলে আর কেউ নেই, হয় এদিকে একটা খুনোখুনি হবে, না হয় সকাল হলেই ও-মেয়ে দো-পড়া হয়ে যাবে—এসব দিকের গতিক তো জানেন না, দো-পড়া হলে কি আর ও মেয়ের বিয়ে হবে মশাই?…আহা, অমন সোনার পুতুল মেয়ে, এত কড়ো ঘর, ওরই অদৃষ্টে শেষে কিনা এই কেলেঙ্কারি। এ রাত্রের মধ্যে আপনি ছাড়া এ অঞ্চলে ওমেয়ের উপযুক্ত পাত্র কেউ নেই-বাঁচান আপনি–
অপুর মাথায় যেন কিসের দাপাদাপি, মাতামাতি…মাথার মধ্যে যেন চৈতন্যদেবের নগরসংকীর্তন শুরু হইয়াছে!…এ কি সংকটে তাহাকে ভগবান ফেলিলেন! সকল প্রকার বন্ধনকে সে ভয় করে, তাহার উপর বিবাহের মতো বন্ধন! এই তো সেদিন মা তাহাকে মুক্তি দিয়া গেলেন…আবার এক বৎসর ঘুরিতেই—এ কি!
মেয়েটির মুখ মনে হইল…আজই সকালে নিচের ঘরে তাহাকে দেখিয়াছে…কি শান্ত, সুন্দর গতিভঙ্গি। সোনার প্রতিমাই বটে, তাহার অদৃষ্টে উৎসবের দিনে এই ব্যাপার!…তাহারা ছাড়া রাম-দা-এর কাণ্ডটা…কি করে সে এখন?
কিন্তু ভাবিবার অবসর কোথায়? পিছনে প্রণব দাঁড়াইয়া কি বলিতেছে, সেই ভদ্রলোক দুটি তার হাত ধরিয়াছেন—তাহাও সে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতে পারিত কিন্তু মেয়েটিও যেন শান্ত সাগর চোখ দুটি তুলিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে, সেই যে কাল সন্ধ্যায় প্রণবের আহ্বানে ছাদের উপরে যেমন তাহার পানে চাহিয়াছিল—তেমনি অপরূপ স্নিগ্ধ চাহনিতে…নির্বাক মিনতির দৃষ্টিতে সেও যেন তাহার উত্তরের অপেক্ষা করিতেছে।…
সে বলিল, চলো ভাই, যা করতে বলবে, আমি তাই করব, এসো।
নিচে কোথাও কোন শব্দ নাই, উৎসব-কোলাহল থামিয়া গিয়াছে, বরপক্ষ এ বাড়ি হইতে সদলবলে উঠিয়া গিয়া ইহাদের শরিক রামদুর্লভ বড়জ্যের চণ্ডীমণ্ডপে আশ্রয় লইয়াছেন, এ-বাড়ির ঘরে-ঘরে খিল বন্ধ। কেবল নাটমন্দিরে উত্তর বারান্দার স্থানে স্থানে দু-চারজন জটলা করিয়া কি বলাবলি করিতেছে, আশ্চর্য এই যে, সম্প্রদানসভায় পুরোহিত মহাশয় এত গোলমালের মধ্যেও ঠিক নিজের কুশাসনখানির উপর বসিয়া আছেন, তিনি নাকি সেই সন্ধ্যার সময় আসনে বসিয়াছেন আর উঠেন নাই।
সকলে মিলিয়া সইয়া গিয়া অপুকে বরাসনে বসাইয়া দিল।
এসব ঘটনা পরবর্তী জীবনে অপুর তত মনে ছিল না, বাংলা খবরের কাগজের ছবির মতো অস্পষ্ট ধোঁয়া-ধোঁয়া ঠেকিত। তাহার মন তখন এত দিশাহারা ও অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় ছিল, চারিধারে কি হইতেছে, তাহার আদৌ লক্ষ্য ছিল না।
আবার দু-একটা যাহা লক্ষ করিতেছিল, যতই তুচ্ছ হোক গভীরভাবে মনে আঁকিয়া গিয়াছিল, যেমন—সামিয়ানার কোণের দিকে কে একজন ডাব কাটিতেছিল, ডাবটা গোল ও রাঙা, কাটারির বাঁটটা বাঁশের–অনেকদিন পর্যন্ত মনে ছিল।
রেশমি-চেলি-পরা সালংকাৱা কন্যাকে সভায় আনা হইল, বাড়ির মধ্যে হঠাৎ শাঁখ বাজিয়া উঠিল, উলুধ্বনি শোনা গেল, লোকে ভিড় করিয়া সম্প্রদানসভার চারিদিকে গোল হইয়া দাঁড়াইল। পুরোহিতের কথায় অপু চেলি পরিল, নূতন উপবীত ধারণ করিল, কলের পুতুলের মতো মন্ত্রপাঠ করিয়া গেল। স্ত্রী-আচারের সময় আসিল, তখনও সে অন্যমনস্ক, নববধূর মতো সেও ঘাড় খুঁজিয়া আছে, যে ব্যাপারটা ঘটিতেছে চারিধারে তখনও যেন সে সম্যক ধারণা করিতে পারে নাই কানের পাশ দিয়া কি একটা যেন শিরশির করিয়া উপরের দিকে উঠিতেছেনা, ঠিক উপরের দিকে নয়, যেন নিচের দিকে নামিতেছে।
প্রণবের বড়ো মামিমা কাঁদিতেছিলেন তাহা মনে আছে, তিনিই আবার গরদের শাড়ির আঁচল দিয়া তাহার মুখের ঘাম মুছাইয়া দিলেন, তাহাও মনে ছিল। কে একজন মহিলা বলিলেন—মেয়ের শিবপুজোর জোর ছিল বড়োবৌ তাই এমন বর মিললো। ভাঙা দালান যে রূপে আলো করছে।
শুভদৃষ্টির সময় সে এক অপূর্ব ব্যাপার। মেয়েটি লজ্জায় ডাগর চোখ দুটি নত করিয়া আছে, অপু কৌতূহলের সহিত চাহিয়া দেখিল, ভালো করিয়াই দেখিল, যতক্ষণ কাপড়ের ঢাকাটা ছিল, ততক্ষণ সে মেয়েটির মুখ ছাড়া অন্যদিকে চাহে নাই-চিবুকের গঠন-ভঙ্গিটি এক চমক দেখিয়াই সুঠাম ও সুন্দর মনে হইল। প্রতিমার মতো রুপই বটে, চুর্ণ অলকের দু-এক গাছা কানের আশেপাশে পড়িয়াছে, হিজুল রঙের ললাটে ও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কানে সোনার দুলে আলো পড়িয়া জ্বলিতেছে।
বাসর হইল খুব অল্পক্ষণ, রাত্রি অল্পই ছিল। মেয়েদের ভিড়ে বাসর ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম হইল। ইহাদের অনেকেই বিবাহ ভাঙিয়া যাইতে নিজের নিজের বাড়ি চলিয়া গিয়াছিলেন, কোথা হইতে একজনকে ধরিয়া আনিয়া অপর্ণার বিবাহ দেওয়া হইতেছে শুনিয়া তাহারা পুনরায় ব্যাপারটা দেখিতে আসিলেন। একরাত্রে এত মজা এ অঞ্চলের অধিবাসীর ভাগ্যে কখনও জোটে নাই কিন্তু পথ-ইতেধরিয়া-আনা বরকে দেখিয়া সকলে একবাক্যে স্বীকার করিলেন-এইবার অপর্ণার উপযুক্ত বর হইয়াছে বটে।
প্রণবের বড়ো মামিমা তেজস্বিনী মহিলা, তিনি বাকিয়া না বসিলে ওই বায়ুরোগগ্রস্ত পাত্রটির সহিতই আজ তাঁহার মেয়ের বিবাহ হইয়া যাইত নিশ্চয়ই। এমন কি তাহার অমন রাশভারী স্বামী শশীনারায়ণ বাঁড়ুজ্যে যখন নিজে বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন—বড়োবৌ, কি করো পাগলের মতো, দোর খোলো, আমার মুখ রাখো-ছিঃ—তখনও তিনি অচল ছিলেন। তিনি বলিলেন—মা, যখনই একে পুলুর সঙ্গে দেখেছি, তখনই আমার মন যেন বলেছে এ আমার আপনার লোক—ছেলে তো আরও অনেক পুলুর সঙ্গে এসেছে গিয়েছে কিন্তু এত মায়া কারোর উপর হয়নি কখনও-ভেবে দ্যাখো মা, এ মুখ আর লোকালয়ে দেখাব না ভেবেছিলাম—ও ছেলে যদি আজ পুলুর সঙ্গে এ বাড়ি না আসত।
পূর্বের সেই প্রৌঢ় বাধা দিয়া বলিলেন—তা কি করে হবে মা, ওই যে তোমার অপর্ণার স্বামী, তুমি আমি কেনারাম মুখুজ্যের ছেলের সঙ্গে ওর সম্বন্ধ ঠিক করতে গেলে কি হবে, ভগবান যে ওদের দুজনের জন্যে দুজনকে গড়েছেন, ও ছেলেকে যে আজ এখানে আসতেই হবে মা
প্রণবের মামিমা বলিলেন—আবার যে এমন করে কথা বলব তা আজ দুঘন্টা আগেও ভাবিনি—এখন আপনারা পাচজনে আশীর্বাদ করুন, যাতে—যাতে
চোখের জলে তাহার গলা আড়ষ্ট হইয়া গেল। উপস্থিত কাহারও চোখ শুষ্ক ছিল না, অপুও অতি কষ্টে উদগত অঞ চাপিয়া বসিয়া রহিল। প্রণবের মামিমার উপর শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে তাহার মন-মায়ের পরই বোধ হয় এমন আর কাহাবও উপর—কেবল আর একজন আছেন-মেজ বৌরানী—তিনি লীলার মা।
তা ছাড়া মায়ের উপর তাহার মনোভাব, শ্রদ্ধা বা ভক্তির ভাব নয়, তাহা আরও অনেক ঘনিষ্ঠ, অনেক গভীর, অনেক আপন—বত্রিশ নাড়ীর বাঁধনের সঙ্গে সেখানে যেন যোগ-সে-সব কথা বুঝাইয়া বলা যায় না—যাক সে কথা।
বিশ্বাসঘাতক প্রণব কোথা হইতে আসিয়া সকলকে জানাইয়া দিল যে, নূতন জামাই খুব ভালো গাহিতে পারে। অপর্ণার মা তখনই বাসর হইতে চলিয়া গেলেন; বালিকা ও তরুণীর দল একে চায় তো আরে পায়, এদিকে অপু ঘামিয়া রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। না সে পারে ভালো করিয়া কাহারও দিকে চাহিতে, না মুখ দিয়া বাহির হয় কোন কথা। নিতান্ত পীড়াপীড়িতে একটা রবিবাবুর গান গাহিল, তারপর আর কেহ ছাড়িতে চায় না–সুতরাং আর একটা মেয়েরাও গাহিলেন, একটি বধুর কণ্ঠস্বর ভারি সুমিষ্ট। প্রৌঢ়া ঠানদি নববধুর গা ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন–ওরে ও নাতনি, তোর বর ভেবেছে ও বাঙাল দেশে এসে নিজেই গান গেয়ে আসর মাতিয়ে দেবে—শুনিয়ে দে না তোর গলাজারিজুরি একবার দে না ভেঙে
অপু মনে মনে ভাবেকার বর?…সে আবার কার বর?…এই সুসজ্জিতা সুন্দরী মতমুখী মেয়েটি তাহার পাশে বসিয়া, এ তার কে হয়?…স্ত্রী…তাহারই স্ত্রী?
পরদিন সকালে পূর্বতন বরপক্ষের সহিত তুল কা৩ বাধিল। উভয়পক্ষে বিস্তর তক, ঝগড়া, শাপাশি, মামলার ভয় প্রদর্শনের পর কেনারাম মুখুজ্যে দলবলসহ নৌকা করিয়া স্বগ্রামের দিকে যাত্রা করিলেন। প্রণব বড়োমামাকে বলিল—ওসব বড়োলোকের মুখ জড়ভরত ছেলের চেয়ে আমি যে অপূর্বকে কত বড়ো মনে করি।…একা কলকাতা শহরে সহায়হীন অবস্থায় ওকে যা দুঃখের সঙ্গে লড়াই করতে দেখেছি আজ তিন বছর ধরে, ওকে একটা সত্যিকার মানুষ বলে ভাবি।
অপুর ঘর-বাড়ি নাই, ফুলশয্যা এখানেই হইল। রাত্রে অপু ঘরে ঢুকিয়া দেখিল ঘরের চারিধার ফুল ও ফুলের মালায় সাজানো, পালকের উপর বিছানায় মেয়েরা একরাশ বৈশাখী চাপাফুল ছড়াইয়া রাখিয়াছে, ঘরের বাতাসে পুস্পসারের মৃদু সৌরভ। অপু সাগ্রহে নববধুর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছিল। বাসরের রাত্রের পর আর মেয়েটির সহিত দেখা হয় নাই বা এ পর্যন্ত তাহার সঙ্গে কথাবার্তা হয় নাই আদৌ আচ্ছা ব্যাপারটা কি রকম ঘটিবে? অপুর বুক কৌতূহলে ও আগ্রহে টিপ টিপ করিতেছিল।
খানিক রাত্রে নববধূ ঘরে ঢুকিল। সঙ্গে সঙ্গে অপুর মনে আর একদফা একটা অবাস্তবতার ভাব জাগিয়া উঠিল। এ মেয়েটি তাহারই স্ত্রী!…স্ত্রী বলিতে যাহা বোঝায় অপুর ধারণা ছিল, তা যেন এ নয়…কিংবা হয়তো স্ত্রী বলিতে ইহাই বোঝায়, তাহার ধারণা ভুল ছিল। মেয়েটি দোরের কাছে ন যযৌ ন তস্থে অবস্থায় দাঁড়াইয়া ঘামিতেছিল—অপু অতিকষ্টে সংকোচ কাটাইয়া মৃদুস্বরে বলিল— আপনি—তু—তুমি দাঁড়িয়ে কেন? এখানে এসে বোসো
বাহিরে বহু বালিকাকণ্ঠের একটা সম্মিলিত কলহাস্যধ্বনি উঠিল। মেয়েটিও মৃদু হাসিয়া পালঙ্কের একধারে বসিল-লজ্জায় অপুর নিকট হইতে দূরে বসিল। এই সময় প্রণবের ছোটমামিমা আসিয়া বালিকার দলকে বকিয়া-ঝকিয়া নিচে নামাইয়া লইয়া যাইতে অপু খানিকটা স্বস্তি বোধ করিল। মেয়েটির দিকে চাহিয়া বলিল—তোমার নাম কি?
মেয়েটি মৃদুস্বরে নতমুখে বলিল—শ্ৰীমতী অপর্ণা দেবী—সঙ্গে সঙ্গে সে অল্প একটু হাসিল। যেমন সুন্দর মুখ তেমনি সুন্দর মুখের হাসিটা কি রং!…কি গ্রীবার ভঙ্গি। চিবুকের গঠনটি কি অপরূপ—মুখের দিকে চাহিয়া উজ্জ্বল বাতির আলোয় অপুর যেন কিসের নেশা লাগিয়া গেল।
দু-জনেই খানিকক্ষণ চুপ। অপুর গলা শুকাইয়া আসিয়াছিল। কুঁজা হইতে জল ঢালিয়া এক গ্লাস জলই সে খাইয়া ফেলিল। কি কথা বলিবে সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না, ভাবিয়া ভাবিয়া অবশেষে বলিল—আচ্ছা, আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়াতে তোমার মনে খুব কষ্ট হয়েছে—না?
বধু মৃদু হাসিল।–বুঝতে পেরেছি ভারি কষ্ট হয়েছে-তা আমার–
—যান–
এই প্রথম কথা, তাহাকে এই প্রথম সম্বোধন। অপুর সারাদেহে যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, অনেক মেয়ে তো ইতিপূর্বে তাহার সঙ্গে কথা বলিয়াছে, এ রকম তো কখনও হয় নাই?…
দক্ষিণের জানালা দিয়া মিঠা হাওয়া বহিতেছিল, চাপাফুলের সুগন্ধে ঘরের বাতাস ভরপুর।
অপু বলিল—রাত দুটো বাজে, শোবে না? ইয়ে—এখানেই তো শোবে?
মা ও দিদির সঙ্গে ভিন্ন কখনও অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে এক বিছানায় সে শোয় নাই, একা একঘরে এতবড় অনাত্মীয়, নিঃসম্পর্কীয় মেয়ের পাশে এক বিছানায় শোওয়া—সেটা ভালো দেখাইবে? কেমন যেন বাধ-বাধ ঠেকিতেছিল। একবার তাহার হাতখানা মেয়েটির গায়ে অসাবধানতাবশত ঠেকিয়া গেল—সঙ্গে সঙ্গে সারা গা শিহরিয়া উঠিল। কৌতূহলে ও ব্যাপারের অভিনবতায় তাহার শরীরের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিতেছিল—ঘরের উজ্জ্বল আলোয় অপুর সুন্দর মুখ রাঙা ও একটা অস্বাভাবিক দীপ্তিসম্পন্ন দেখাইতেছিল।
হঠাৎ সে কিসের টানে পাশ ফিরিয়া মেয়েটির গায়ে ভয়ে ভয়ে হাত তুলিয়া দিল। বলিল সেদিন যখন আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হল, তুমি কি ভেবেছিলে?
মেয়েটি মৃদু হাসিয়া তাহার হাতখানা আস্তে আস্তে সরাইয়া দিয়া বলিল—আপনি কি ভেবেছিলেন আগে বলুন?…সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের সুঠাম, পুষ্পপেলব হাতখানি বাতির আলোয় তুলিয়া ধরিয়া হাসিমুখে বলিল—গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে—এই দেখুন কাঁটা দিয়েছে—কেন বলুন না?…কথা শেষ করিয়া সে আবার মৃদু হাসিল।
এতগুলি কথা একসঙ্গে এই প্রথম! কি অপূর্ব রোমান্স এ! ইহার অপেক্ষা কোন রোমান্স আছে আর এ জগতে, না চিনিয়া, না বুঝিয়া সে এতদিন কি হিজিবিজি ভাবিয়া বেড়াইয়াছে?…জীবনের জগতের সঙ্গে এ কি অপূর্ব ঘনিষ্ঠ পরিচয়…তাহার মাথার মধ্যে কেমন যেন করিতেছে, মদ খাইলে বোধ হয় এরকম নেশা হয়…ঘরের হাওয়া যেন …ঘরের মধ্যে যেন আর থাকা যায় না…বেজায় গরম। সে বলিল—একটু বাইরের ছাদে বেড়িয়ে আসি, খুব গরম না? আসছি এখুনি।
বৈশাখের জ্যোৎস্না রাত্রি-রাত্রি বেশি হইলেও বাড়ির লোক এখনও ঘুমায় নাই, কাল এখানে বৌভাত হইবে, নিচে তাহারই উদ্যোগ আয়োজন চলিতেছে। দালানের পাশে বড়ো রোয়াকে ঝিয়েরা কচুর শাক কুটিতেছে, রান্না-কোঠার পিছনে নতুন খড়ের চালা বাঁধা হইয়াছে, সেখানে এত রাত্রে পানতুয়া ভিয়ান হইতেছে—সে ছাদের আলিসার ধারে দাঁড়াইয়া দেখিল।
ছাদে কেহ নাই, দূরের নদীর দিক হইতে একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বহিতেছে। দু-দিন যে কি ঘটিয়াছে তাহা যেন সে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারে নাই—আজ বুঝিয়াছে। কয়েকদিন পূর্বেও সে ছিল সহায়শূন্য, বন্ধুশুন্য, গৃহশূন্য, আত্মীয়শূন্য, জগতে সম্পূর্ণ একাকী, মুখের দিকে চাহিবার ছিল না কেহই। কিন্তু আজ তো তাহা নয়, আজ ওই মেয়েটি যে কোথা হইতে আসিয়া পাশে দাঁড়াইয়াছে, মনে হইতেছে যেন ও জীবনের পরম বন্ধু।
মা এ-সময় কোথায়?…মায়ের যে বড়ো সাধ ছিল…মনসাপোতার বাড়িতে শুইয়া শুইয়া কত রাত্রে সে-সব কত সাধ, কত আশার গল্প…মায়ের সোনার দেহ কোদলাতীরের শ্মশানে চিতাগ্নিতে পুড়িবার রাত্রি হইতে সে আশা-আকাঙ্ক্ষার তো সমাধি হইয়াছিল…মাকে বাদ দিয়া জীবনের কোন্ উৎসব…
তপ্ত আকুল চোখের জলে চারিদিক ঝাপসা হইয়া আসিল।
বৈশাখী শুক্লা দ্বাদশী রাত্রির জ্যোৎস্না যেন তাহার পরলোকগত দুঃখিনী মায়ের আশীর্বাদের মতো তাহার বিভ্রান্ত হৃদয়কে স্পর্শ করিয়া সরল শুভ্র মহিমায় স্বর্গ হইতে ঝরিয়া পড়িতেছে।
১২. কলিকাতার কর্মকঠোর, কোলাহলমুখর, বাস্তব জগতে
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
কলিকাতার কর্মকঠোর, কোলাহলমুখর, বাস্তব জগতে প্রত্যাবর্তন করিয়া গত কয়েকদিনের জীবনকে নিতান্ত স্বপ্ন বলিয়া মনে হইল অপুর। একথা কি সত্য—গত শুক্ৰবাব বৈশাখী পূর্ণিমার শেষরাত্রে সে অনেক দূরের নদী-তীরবর্তী এক অজানা গ্রামের অজানা গৃহস্থবাটীর মেয়েকে বলিয়াছিল—আমি এ বছর যদি আর না আসি অপর্ণা?…
প্রথমবার মেয়েটি একটু হাসিয়া মুখ নিচু করিয়াছিল, কথা বলে নাই।
অপু আবার বলিয়াছিল—চুপ করে থাকলে হবে না, তুমি যদি বলল আসব, নইলে আসব না, সত্যি অপর্ণা। বলল কি বলবে?
মেয়েটি লজ্জারমুখে বলিয়াছিল—বা রে, আমি কে? মা রয়েছেন, বাবা রয়েছেন, ওদের আপনি ভারি
—বেশ আসব না তবে। তোমার নিজের ইচ্ছে না থাকে—
–আমি কি সে কথা বলেছি?
–তা হলে?
–আপনার ইচ্ছে যদি হয় আসতে, আসবেন-না হয় আসবেন না, আমার কথায় কি হবে?
ও কথা ইহার বেশি আর অগ্রসর হয় নাই, অন্য সময় এ ক্ষেত্রে হয়তো অপুর অত্যন্ত অভিমান হইত, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কৌতূহলটাই তাহার মনের অন্য সব প্রবৃত্তিকে ছাপাইয়া উঠিয়াছে–ভালোবাসার চোখে মেয়েটিকে সে এখনও দেখিতে পারে নাই, যেখানে ভালোবাসা নাই, সেখানে অভিমানও নাই।
সেদিন বৈকালে গোলদিঘির মোড়ে একজন ফেরিওয়ালা চাঁপাফুল বেচিতেছিল, সে আগ্রহের সহিত গিয়া ফুল কিনিল। ফুলটা আঘ্রাণের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মনের মধ্যে একটা বেদনা সে সুস্পষ্ট অনুভব করিল, একটা কিছু পাইয়া হারাইবার বেদনা, একটা শূন্যতা, একটা খালি-খালি ভাব…মেয়েটির মাথার চুলের সে গন্ধটাও যেন আবার পাওয়া যায়…
অন্যমনস্কভাবে গোলদিঘির এক কোণে ঘাসের উপর অনেকক্ষণ একা বসিয়া বসিয়া সেদিনের সেই রাতটি আবার সে মনে আনিবার চেষ্টা করিল। মেয়েটির মুখখানি কি রকম যেন?…ভারি সুন্দর মুখ…কিন্তু এই কয়দিনের মধ্যেই সব যেন মুছিয়া অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে—মেয়েটির মুখ মনে আনিবার ও ধরিয়া রাখিবার যত বেশি চেষ্টা করিতেছে সে, ততই সে মুখ দ্রুত অস্পষ্ট হইয়া যাইতেছে। শুধু নতপল্লব কৃষ্ণতারা চোখদুটির ভঙ্গি অল্প অল্প মনে আসে, আর মনে আসে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সে স্নিগ্ধ হাসিটুকু। প্রথমে ললাটে লজ্জা ঘনাইয়া আসে, ললাট হইতে নামে ডাগর দুটি চোখে, পরে কপোলে…তারপরই যেন সারা মুখখানি অল্পক্ষণের জন্য অন্ধকার হইয়া আসে…ভারি সুন্দর দেখায় সে সময়! তারপরই আসে সেই অপূর্ব হাসিটি, ওরকম হাসি আর কারও মুখে অপু কখনও দেখে নাই। কিন্তু মুখের সব আদলটা তো মনে আসে না—সেটা মনে আনিবার জন্য সে ঘাসের উপর শুইয়া অনেকক্ষণ ভাবিল, অনেকক্ষণ প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া দেখিলনা কিছুতেই মনে আসে না—কিংবা হয়তো আসে অতি অল্পক্ষণের জন্য, আবার তখনই অস্পষ্ট হইয়া যায়। অপর্ণা কেমন নামটি?…।
জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি প্রণব কলিকাতায় আসিল। বিবাহের পর এই তাহার সঙ্গে প্রথম দেখা। সে আসিয়া গল্প করিল, অপর্ণার মা বলিয়াছেন—তাহার কোন্ পুণ্যে এ রকম তরুণ দেবতার মতো রূপবান জামাই পাইয়াছেন জানেন না—তাহার কেহ কোথাও নাই শুনিয়া চোখের জল রাখিতে পারেন নাই।
অপু খুশি হইল, হাসিয়া বলিল—তবু তো একটা ভালো জামা গায়ে দিতে পারলাম না, সাদা পাঞ্জাবি গায়ে বিয়ে হল—দূর!…না খেয়ে-দেয়ে একটা সিল্কের জামা করালুম, সেটা গেল ছিড়ে-ছুটে, তখন তুমি এলে তোমার মামার বাড়িতে নিয়ে যেতে, তার আগে আসতে পারলে না—আচ্ছা সিল্কের জামাটাতে আমায় কেমন দেখাতো?
–ওঃ-সাক্ষাৎ অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার…ঢের ঢের হামবাগ দেখেছি, কিন্তু তোর জুড়ি খুঁজে পাওয়া ভার-বুঝলি?
–না—কিন্তু একটা কথা। অপর্ণার মা কি বলেন তাহা জানিতে অপুর তত কৌতূহল নাইঅপর্ণা কি বলিয়াছে—অপর্ণা?…অপর্ণা কিছু বলে নাই?…হয়তো কেনারাম মুখুজ্যের ছেলের সঙ্গে বিবাহ না হওয়াতে মনে মনে দুঃখিত হইয়াছে—না?
প্রণবের মামা এ বিবাহে তত সন্তুষ্ট হন নাই, স্ত্রীর উপরে মনে মনে চটিয়াছেন এবং তাঁহার মনে ধারণা-প্রণবই তাহার মামিমার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়া নিজের বন্ধুর সঙ্গে বোনের বিবাহ দেওয়াইয়াছে। নাম নাই, বংশ নাই, চালচুলা নাই—চেহারা লইয়া কি মানুষ ধুইয়া খাইবে…কিন্তু এসব কথা প্রণব অপুকে কিছু বলিল না।
একটা কথা শুনিয়া সে দুঃখিত হইল।—কেনারাম মুখুজ্যের ছেলেটি নিজে দেখিয়া মেয়ে পছন্দ করিয়াছিল। অপর্ণাকে বিবাহ করিবার অত্যন্ত আগ্রহ ছিল তাহার—কিন্তু হঠাৎ বিবাহ-সভায় আসিয়া কি যেন গোলমাল হইয়া গেল, সারারাত্রি কোথা দিয়া কাটিল, সকালবেলা যখন একটু হুঁশ হইল, তখন সে দাদাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল—দাদা, আমার বিয়ে হল না?
এখনও তাহার অবশ্য ঘোর কাটে নাই…বাড়ি ফিরিবার পথেও তাহার মুখে ওই কথা—এখন নাকি সে বন্ধ উন্মাদ! ঘরে তালা দিয়া রাখা হইয়াছে।
অপু বলিল—হাসিস কেন, হাসবার কি আছে?…পাগল তো নিজের ইচ্ছেয় হয় নি, সে বেচারির আর দোষ কি? ও নিয়ে হাসি ভালো লাগে না।
রাত্রে বিছানায় শুইয়া ঘুম হয় না—কেবলই অপর্ণার কথা মনে আসে। প্রণব এ কি করিয়া দিল তাহাকে? সে যে বেশ ছিল, এ কোন্ সোনার শিকল তাহার মুক্ত, বন্ধনহীন হাতে-পায়ে অদৃশ্য নাগপাশের মতো দিন দিন জড়াইয়া পড়িতেছে? লাইব্রেরিতে বসিয়া কেবল আজকাল বাংলা উপন্যাস পড়ে—দেখিল, তাহার মতো বিবাহ নভেলে অনেক ঘটিয়াছে, অভাব নাই।
পূজার সময় শ্বশুরবাড়ি যাওয়া ঘটিল না। একে তো অর্থাভাবে সে নিজের ভালো জামা-কাপড় কিনিতে পারিল না, শ্বশুরবাড়ি হইতে পূজার তত্ত্বে যাহা পাওয়া গেল, তাহা পরিয়া সেখানে যাইতে তাহার ভারি বাধ-বাধ ঠেকিল। তাহা ছাড়া অপর্ণার মা চিঠির উপর চিঠি দিলে কি হইবে, তাহার বাবার দিক হইতে জামাইকে পূজার সময় লইয়া যাইবার বিশেষ কোন আগ্রহ দেখা গেল না বরং তাহার নিকট হইতে উপদেশপূর্ণ পত্র পাওয়া গেল যে, একটা ভালো চাকুরি যেন সে শীঘ্র দেখিয়া লয়, এখন অল্প বয়স, এই তো অর্থ উপার্জনের সময়, এখন আলস্য ও ব্যসনে কাটাইলে…এমনি ধরনের নানা কথা। এখানে বলা আবশ্যক, এ বিবাহে তিনি অপুকে একেবারে ফাঁকি দিয়াছিলেন, কেনারাম মুখুজ্যের ছেলেকে যাহা দিবার কথা ছিল তাহার সিকিও এ জামাইকে দেন নাই।
ছুটি পাওয়া গেল পুনরায় বৈশাখ মাসে। পূর্বদিন রাত্রে তাহার কিছুতেই ঘুম আসে না, কি রকম চুল ছাঁটা হইয়াছে, আয়নায় দশবার দেখিল। এই সাদা পাঞ্জাবিতে তাহাকে ভালো মানায় না, এই তসরের কোটটাতে?
অপর্ণার মা তাহাকে পাইয়া হাতে যেন আকাশের চাঁদ পাইলেন। সেদিনটা খুব বৃষ্টি, অপু নৌকা হইতে নামিয়া বাড়ির বাহিরের উঠানে পা দিতেই কে পূজার দালানে বসিয়াছিল, ছুটিয়া গিয়া বাড়ির মধ্যে খবর দিল। এক মুহূর্তে বাড়ির উপরের নিচের সব জানালা খুলিয়া গেল, বাড়িতে ঝিবৌয়ের সংখ্যা নাই, সকলে জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন—মুষলধারায় বৃষ্টিপাত অগ্রাহ্য করিয়া অপর্ণার মা উঠানে তাহাকে লইতে ছুটিয়া আসিলেন, সারা বাড়িতে একটা আনন্দের সাড়া পড়িয়া গেল।
ফুলশয্যার সেই ঘরে, সেই পালঙ্কেই রাত্রে শুইয়া সে অপর্ণার প্রতীক্ষায় রহিল।
এক বৎসরে অপর্ণার এ কি পরিবর্তন! তখন ছিল বালিকা—এখন ইহাকে দেখিলে যেন আর চেনা যায় না! লীলার মতো চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য ইহার নাই বটে, কিন্তু অপর্ণার যাহা আছে, তাহা উহাদের কাহারও নাই। অপুর মনে হইল দু-একখানা প্রাচীন পটে-আঁকা তরুণী দেবীমূর্তির, কি দশমহাবিদ্যা বোড়শী মূর্তির মুখে এ-ধরনের অনুপম, মহিমময় স্নিগ্ধ সৌন্দর্য সে দেখিয়াছে। একটু সেকেলে, একটু প্রাচীন ধরনের সৌন্দর্য…সুতরাং দুষ্প্রাপ্য। যেন মনে হয় এ খাটি বাংলার জিনি, এই দুর পল্লীপ্রান্তরের নদীতীরের সকল শ্যামলতা, সকল সরসতা, পথপ্রান্তে বনফুলের সকল সরলতা হানিয়া ও মুখ গড়া, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া বাংলার পত্নীর চুত-বকুলবীথির ছায়ায় ছায়ায় কত অপরাহু নদীঘাটের যাওয়া-আসার পথে এই উজ্জ্বলশ্যামবর্ণা, রূপসী তরুণী বধূদের লক্ষ্মীর মতো আলতা রাঙা পদচিহ্ন কতবার পড়িয়াছে মুছিয়াছে, আবার পড়িয়াছে ইহাদেরই মেহ-প্রেমের, দুঃখসুখের কাহিনী, বেহুলা-লখিন্দরের গানে, ফুল্লরার বারোমাস্যায়, সুবচনীর ব্রতকথায়, বাংলার বৈষ্ণবকবিদের রাধিকার রূপবর্ণনায়, পাড়াগাঁয়ের ছড়ায়, উপকথায়, সুয়োরানী দুয়োরানীর গল্পে!…
অপু বলিল—তোমার সঙ্গে কিন্তু আড়ি, সারা বছরে একখানা চিঠি দিলে না কেন?
অপর্ণা সলজ্জ মৃদু একটু হাসিয়া চুপ করিয়া রহিল। তারপর একবার ডাগর চোখ দুটি তুলিয়া স্বামীর দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিল। খুব মৃদুস্বরে মুখে হাসি টিপিয়া বলিল—আর আমার বুঝি রাগ হতে নেই?…
অপু দেখিল—এতদিন কলিকাতায় সে জারুল কাঠের তক্তপোশে শুইয়া অপর্ণার যে মুখ ভাবিত—আসল মুখ একেবারেই তাহা নহে—ঠিক এই অনুপম মুখই সে দেখিয়াছিল বটে ফুলশয্যার রাত্রে, এমন ভুলও হয়!
–পুজোর সময় আসি নি তাই?-তুমি ভাবতে কি না?—ও-সব মুখের কথা, ছাই ভাবতে!
—না গো না, মা বললেন, তুমি আসবে ষষ্ঠীর দিন, ষষ্ঠী গেল, পুজো গেল, তখনও মা বললেন তুমি একাদশীর পর আসবে—আমি–
অপর্ণা হঠাৎ থামিয়া গেল, অল্প একটু চাহিয়া চোখ নিচু করিল।
অপু আগ্রহের সুরে বলিল—তুমি কি, বললে না?
অপর্ণা বলিল—আমি জানি নে, বলব না—
অপু বলিল—আমি জানি আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়াতে তুমি মনে মনে–
অপর্ণা স্নেহপূর্ণ তিরস্কারের সুরে ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল—আবার ওই কথা?…ওসব কথা বলতে আছে? ছিঃ-বলো না–
—তা কই, তুমি খুশি হয়েছ, একথা তো তোমার মুখে শুনি নি অপর্ণা–
অপর্ণা হাসিমুখে বলিল—তারপর কতদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে গো শুনি?–সেই আর-বছর বোশেখ আর এ বোশেখ–
—আচ্ছা বেশ, এখন তো দেখা হল, এখন আমার কথার উত্তর দাও?
অপর্ণা কি-একটা হঠাৎ মনে পড়িবার ভঙ্গিতে তাহার দিকে চাহিয়া আগ্রহের সুরে বলিলতুমি নাকি যুদ্ধে যাচ্ছিলে, পুলুদা বলছিল, সত্যি?–
–যাই নি, এবার ভাবছি যাবো—এখান থেকে গিয়েই যাবো–
অপর্ণা ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল—আচ্ছা থাক গো, আর রাগ করতে হবে না, আচ্ছা তোমার কথার কি উত্তর দেব বলো তো?—ওসব আমি মুখে বলতে পারব না–
—আচ্ছা, যুদ্ধ কাদের মধ্যে বেধেছে, জানো?…
–ইংরেজের সঙ্গে আর জার্মানির সঙ্গে আমাদের বাড়িতে বাংলা কাগজ আসে! আমি পড়ি যে!
অপর্ণা রুপার ডিবাতে পান আনিয়াছিল, খুলিয়া বলিল—পান খাবে না?…
বাহিরে এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গেল। এতটুকু গরম নাই, ঠাণ্ডা রাতটির ভিজা মাটির সুগন্ধে ঝিরঝিরে দক্ষিণ হাওয়া ভরপুর, একটু পরে সুন্দর জ্যোৎস্না উঠিল।
অপু বলিল—আচ্ছা অপর্ণা, চাঁপাফুল পাওয়া যায় তো কাউকে কাল বলো না, বিছানায় রেখে দেবে? আছে চাপাগাছ কোথাও?…
—আমাদের বাগানেই আছে। আমি কাউকে বলতে পারব না কিন্তু তুমি বলো কাল সকালে ওই নৃপেনকে, কি অনাদিকে…কি আমার ছোট বোনকে বলল
–আচ্ছা কেন বল তো চাঁপাফুলের কথা তুললাম?…
অপর্ণা সলজ্জ হাসিল। অপুর বুঝিতে দেরি হইল না যে, অপর্ণা তাহার মনের কথা ঠিক ধরিয়াছে। তাহার হাসিবার ভঙ্গিতে অপু একথা বুঝিল। বেশ বুদ্ধিমতী তো অপর্ণা!…
সে বলিল—হ্যাঁ একটা কথা অপর্ণা, তোমাকে একবার কিন্তু নিয়ে যাব দেশে, যাবে তো?
অপর্ণা বলিল-মাকে বলল, আমার কথায় তো হবে না…
-তুমি রাজি কি না বলল আগে—সেখানে কিন্তু কষ্ট হবে। অপু একবার ভাবিল—সত্যি কথাটা খুলিয়াই বলে। কিন্তু সেই পুরাতন গর্ব ও বাহাদুরির ঝোঁক!—বলিল—অবিশ্যি একদিন আমাদেরও সবই ছিল। যেখানে থাকতুম—আমাদের পৈতৃক দেশ—এখন তো-দোতলা মস্ত বাড়ি—মানে সবই—তবে শরিকানী মামলা আর মানে ম্যালেরিয়ায়-বুঝলে না? এখন যেখানে থাকি, সেখানে দু-খানা মেটে চালাঘর, তাও মা মারা যাওয়ার পর আর সেখানে যাই নি, তোমাদের মতো ঝি-চাকর নেই, নিজের হাতে সব করতে হবে তা আগে থেকেই বলে রাখি। তুমি হলে জমিদারের মেয়ে–
অপর্ণা কৌতুকের সুরে বলিল—আছিই তো জমিদারের মেয়ে। হিংসে হচ্ছে বুঝি? একটু থামিয়া শান্ত সুরে বলিল—কেন একশবার ওকথা বলো?…তুমি কাল মাকে বাবাকে বলে রাজি করাও, আমি তোমার সঙ্গে যেখানে নিয়ে যাবে যাবো, গাছতলাতেও যাবো, আমি তোমার সব কথা জানি, পুলুদা মায়ের কাছে বলছিল, আমি সব শুনেছি। যেখানে নিয়ে যাবে, নিয়ে চলল, তোমার ইচ্ছে, আমার তাতে মতামত কি?
রাত্রে দুজনে কেহ ঘুমাইল না।
বধূকে লইয়া সে রওনা হইল। শ্বশুর প্রথমটা আপত্তি তুলিয়াছিলেন—নিয়ে তো যেতে চাইছ বাবাজী, কিন্তু এখন নিয়ে গিয়ে তুলবে কোথায়? চাকরি-বাকরি ভালো কর, ঘর-দোর ওঠাও, নিয়ে যাবার এত তাড়াতাড়িটা কি?
সিঁড়ির ঘরে অপর্ণার মা স্বামীকে বলিলেন-হাগা, তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে যাচ্ছে দিন দিন-না কি? জামাইকে ও-সব কথা বলেছ? আজকালকার ছেলেমেয়েদের ধরন আলাদা, তুমি জানো না। ছেলেমানুষ জামাই, টাকাকড়ি, চাকরি-বাকরি ভগবান যখন দেবেন তখন হবে। আজকালের মেয়েরা ও-সব বোঝে না, বিশেষ করে তোমার মেয়ে সে ধরনেরই নয়, ওর মন আমি খুব ভালো বুঝি। দাও গিয়ে পাঠিয়ে ওকে জামাইয়ের সঙ্গেওদের সুখ নিয়েই সুখ।
উৎসাহে অপুর রাত্রে ঘুম হয় না এমন অবস্থা, কাল সারাদিন অপর্ণাকে লইয়া রেল স্টিমারে কাটানো–উঃ!…শুধু সে আর অপর্ণা, আর কেউ না। রাত্রে অস্পষ্ট আলোকে অপর্ণাকে ভালো করিয়া দেখিবারই সুযোগ হয় না, দিনে দেখা হওয়া এ বাড়িতে অসম্ভব—কিন্তু কাল সকালটি হইতে তাহারা দুজনে-মাঝে আর কোন বাধা ব্যবধান থাকিবে না!
কিন্তু স্টিমারে অপর্ণা রহিল মেয়েদের জায়গায়। তিন ঘণ্টা কাল সেভাবে কাটিল! তার পরেই রেল।
এইখানেই অপু সর্বপ্রথম গৃহস্থালি পাতিল স্ত্রীর সঙ্গে। ট্রেনের তখনও অনেক দেরি। যাত্রীদের রান্না খাওয়ার জন্য স্টেশন হইতে একটু দূরে ভৈরবের ধারে ছোট ছোট খড়ের ঘর অনেকগুলি তারই একটা চার আনায় ভাড়া পাওয়া গেল। অপু দোকানে খাবার কিনিতে যাইতেছে দেখিয়া বধু বলিল—তা কেন? এই তো এখানে উনুন আছে, যাত্রীরা সব বেঁধে খায়, এখনও তত তিন-চার ঘণ্টা দেরি গাড়ির, আমি রাঁধব।
অপু ভারি খুশি। সে ভারি মজা হইবে! এ কথাটা এতক্ষণ তাহার মনে আসে নাই। মহা উৎসাহে বাজার হইতে জিনিসপত্র কিনিয়া আনিল। ঘরে ঢুকিয়া দেখে ইতিমধ্যেই কখন বধু স্নান সারিয়া ভিজা চুলটি পিঠের উপর ফেলিয়া, কপালে সিন্দুরের টিপ দিয়া লাল-জরিপাড় মটকার শাড়ি পরিয়া ব্যস্তসমস্ত অবস্থায় এটা-ওটা ঠিক করিতেছে। হাসিমুখে বলিল—বাড়িওয়ালি জিজ্ঞেস করছে উনি তোমার ভাই বুঝি? আমি হেসে ফেলতেই বুঝতে পেরেছে, বলেছে—জামাই! তাই তো বলি!—আরও কি বলিতে গিয়া অপর্ণা লজ্জায় কথা শেষ করিতে না পারিয়া হাসিয়া ফেলিল।
অপু মুগ্ধনেত্রে বধুর দিকে চাহিয়া ছিল। কিশোরীর তনুদেহটি বেড়িয়া স্ফুটনোম্মুখ যৌবন কি অপূর্ব সুষমায় আত্মপ্রকাশ করিতেছে। সুন্দর নিটোল গৌর বাহু দুটি, চুলের খোঁপার ভঙ্গিটি কি অপরুপ! গভীর রাত্রে শোবার ঘরে এ পর্যন্ত দেখাশোনা, দিনের আলোয় স্নানের পরে এ অবস্থায় তাহার স্বাভাবিক গতিবিধি লক্ষ করিবার সুযোগ কখনও ঘটে নাই-আজ দেখিয়া মনে হইল অপর্ণা সত্যই সুন্দরী বটে।
কাঁচা কাঠ কিছুতেই ধরে না, প্রথমে বধু, পরে সে নিজে, ফুঁ দিয়া চোখ লাল করিয়া ফেলিল। প্রৌঢ়া বাড়িওয়ালি ইহাদের জন্য নিজের ঘরে বাটনা বাটিতে গিয়াছিল। ফিরিয়া আসিয়া দুজনের দুর্দশা দেখিয়া বলিল—ওগো মেয়ে, সরো বাছা, জামাইকে যেতে বললো। তোমাদের কি ও কাজ মা? সরো আমি দি ধরিয়ে।
বধূ তাগিদ দিয়া অপুকে স্নানে পাঠাইল। নদী হইতে ফিরিয়া সে দেখিল—ইহার মধ্যে কখন বধূ বাড়িওয়ালিকে দিয়া বাজার হইতে রসগোল্লা ও ছানা আনাইয়াছে, রেকাবিতে পেঁপে কাটা, খাবার ও গ্লাসে নেবুর রস মেশানো চিনির শরবত। অপু হাসিয়া বলিল—উঃ, ভারি গিন্নিপনা যে!…আচ্ছা, তরকারিতে নুন দেওয়ার সময় গিন্নিপনার দৌড়টা একবার দেখা যাবে।
অপর্ণা বলিল—আচ্ছা গো দেখোপরে ছেলেমানুষের মতো ঘাড় দুলাইয়া বলিল—ঠিক হলে কিন্তু আমায় কি দেবে?
অপু কৌতুকের সুরে বলিল—ঠিক হলে যা দেব, তা এখুনি পেতে চাও?
–যাও, আচ্ছা তো দুষ্ট!
একবার সে রন্ধনরত বধূর পিছনে আসিয়া চুপি চুপি দাঁড়াইল। দৃশ্যটা এত নতুন, এত অভিনব ঠেকিতেছিল তাহার কাছে! এই সুঠাম, সুন্দরী পরের মেয়েটি তাহার নিতান্ত আপনার জনএকমাত্র পৃথিবীতে আপনার জন! পরে সে সন্তর্পণে নিচু হইয়া পিঠের উপরে এলানো চুলের গিঁঠটা ধরিয়া অতর্কিতে এক টান দিতেই বধূ পিছনে চাহিয়া কৃত্রিম কোপের সুরে বলিলউঃ! আমার লাগে না বুঝি?…ভারি দুষ্টু তো …রান্না থাকবে পড়ে বলে দিচ্ছি যদি আবার চুল ধরে টানবে—
অপু ভাবে, মা ঠিক এই ধরনের কথা বলিত—এই ধরনের স্নেহ-প্রীতি-ঝরা চোখ। সে দেখিয়াছে, কি দিদি, কি রানুদি, কি লীলা, কি অপর্ণা—সকলেরই মধ্যে মা যেন অল্পবিস্তর মিশাইয়া আছেন—ঠিক সময়ে ঠিক অবস্থায় ইহারা একই ধরনের কথা বলে, চোখে মুখে একই ধরনের স্নেহ ফুটিয়া ওঠে।
একটি ভদ্রলোক অনেকক্ষণ হইতে প্লাটফর্মে পায়চারি করিতেছিলেন। ট্রেনে উঠিবার কিছু পূর্বে অপু তাঁহাকে চিনিতে পারিল, দেওয়ানপুরের মাস্টার সেই সত্যেনবাবু। অপু থার্ড ক্লাসে পড়িবার সময়ই ইনি আইন পাশ করিয়া স্কুলের চাকুরি ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিলেন, আর কখনও দেখা হয় নাই। পুরাতন ছাত্রকে দেখিয়া খুশি হইলেন, অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন, অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে কে কি করিতেছে শুনিবার আগ্রহ দেখাইলেন।
তিনি আজকাল পাটনা হাইকোর্টে ওকালতি করিতেছেন, চালচলন দেখিয়া অপুর মনে হইল—বেশ দু-পয়সা উপার্জন করেন। তবুও বলিলেন, পুরানো দিনই ছিল ভালো, দেওয়ানপুরের কথা মনে হইলে কষ্ট হয়। ট্রেন আসিলে তিনি সেকেন্ড ক্লাসে উঠিলেন।
অপর্ণাকে সব ভালো করিয়া দেখাইবার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে নামিয়া অপু একখানা ফিটন গাড়ি ভাড়া করিয়া খানিকটা ঘুরিল।
অপু একটা জিনিস লক্ষ করিল; অপর্ণা কখনও কিছু দেখে নাই বটে, কিন্তু কোনও বিষয়ে কোনও অশোভন ব্যগ্রতা দেখায় না। ধীর, স্থির, সংযত, বুদ্ধিমতী—এই বয়সেই চরিত্রগত একটা কেমন সহজ গাম্ভীর্য-যাহার পরিণতি সে দেখিয়াছে ইহারই মায়ের মধ্যে; উছলিয়া-পড়া মাতৃত্বের সঙ্গে চরিত্রের সে কি দৃঢ় অটলতা।
মনসাপোতা পৌঁছিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। অপু বাড়িঘরের বিশেষ কিছু ঠিক করে নাই, কাহাকেও সংবাদ দেয় নাই, কিছু না—অথচ হঠাৎ স্ত্রীকে আনিয়া হাজির করিয়াছে। বিবাহের পর মাত্র একবার এখানে দুদিনের জন্য আসিয়াছিল, বাড়িঘর অপরিষ্কার, রাত্রিবাসের অনুপযুক্ত, উঠানে ঢুকিয়া পেয়ারা গাছটার তলায় সন্ধ্যার অন্ধকারে বধু দাঁড়াইয়া রহিল, অপু গরুর গাড়ি হইতে তোরঙ্গ ও কাঠের হাতবাক্সটা নামাইতে গেল। উঠানে পাশের জঙ্গলে নানা পতঙ্গ কুস্বর করিয়া ডাকিতেছে, ঝোপে ঝোপে জোনাকির ঝাক জ্বলিতেছে।
কেহ কোথাও নাই, কেহ তরুণ দম্পতিকে সাদরে বরণ ও অভ্যর্থনা করিয়া ঘরে তুলিয়া লইতে ছুটিয়া আসিল না, তাহারাই দুজনে টানাটানি করিয়া নিজেদের পেঁটরা তোরঙ্গ মাত্র দেশলাইয়ের কাঠির আলোর সাহায্যে ঘরের দাওয়ায় তুলিতে লাগিল। সে আজ কাহাকেও ইচ্ছা করিয়াই খবর দেয় নাই, ভাবিয়াছিল—মা যখন বরণ করে নিতে পারলেন না আমার বৌকে, অত সাধ ছিল মার-তখন আর কাউকে বরণ করতে হবে না, ও অধিকার আর কাউকে বুঝি দেব?
অপর্ণা জানিত তাহার স্বামী দরিদ্র কিন্তু এ রকম দরিদ্র তাহা সে ভাবে নাই। তাহাদেব পাড়ার নাপিত-বাড়ির মতো নিচু, ছোট চালাঘব। দাওয়ার একধারে গরু বাছুর উঠিয়া ভাঙিযা দিয়াছে…ছাঁচতলায় কাঁই-বীচি ফুটিয়া বর্ষার জলে চারা বাহির হইয়াছে…একস্থানে খড় উড়িয়া চালের বাখারি ঝুলিয়া পড়িয়াছে…বাড়ির চারিধারে কি পোকা একঘেয়ে ডাকিতেছে…এরকম ঘবে তাহাকে দিন কাটাইতে হইবে?…অপর্ণার মন দমিয়া গেল। কি করিয়া থাকিবে সে এখানে? মায়ের কথা মনে হইল…খুড়িমাদের কথা মনে হইল…ছোট ভাই বিনুর কথা মনে হইল, কান্না ঠেলিয়া বাহিরে আসিতে চাহিতেছিল…সে মরিয়া যাইবে এখানে থাকিলে…।
অপু খুঁজিয়া-পাতিয়া একটা লণ্ঠন জ্বালিল। ঘবের মাটির মেঝেতে পোকাষ খুঁড়িযা মাটি জড়ো করিয়াছে। তক্তপোশের একটা পাশ ঝাড়িয়া তাহার উপর অপর্ণাকে বসাইল…সবে অপর্ণাকে অন্ধকার ঘবে বসাইয়া লণ্ঠনটা হাতে বাহিরে হাতবাক্সটা আনিতে গেল …অপর্ণার গা ছম ছম করিয়া উঠিল অন্ধকারে…পরক্ষণেই অপু নিজের ভুল বুঝিযা আলো হাতে ঘরে ঢুকিয়া বলিল–দ্যাখো কাণ্ড, তোমাকে একা অন্ধকারে বসিয়ে রেখে-থাক লণ্ঠনটা এখানে
অপর্ণার কান্না আসিতেছিল।…
আধঘণ্টা পরে ঝাড়িয়া-ঝুড়িয়া ঘরটা একরকম রাত্রি কাটানোর মতো দাঁড়াইল। কি খাওয়া যায় রাত্রে? রান্নাঘর ব্যবহারের উপযোগী নাই তো বটেই, তা ছাড়া চাল, ডাল, কাঠ কিছুই নাই। অপর্ণা তোরঙ্গ খুলিয়া একটা পুটুলি বার করিয়া বলিল—ভুলে গিয়েছিলাম তখন, মা নাড় দিয়েছিলেন এতে বেঁধে—অনেক আছে—এই খাও।
অপু অপ্রতিভ হইয়া পড়িয়াছিল। সংসার কখনও করে নাই—এই নতুন নিতান্ত আনাড়ি অপর্ণাকে এ অবস্থায় এখানে আনা ভালো হয় নাই, সে এতক্ষণে বুঝিয়াছে। অপ্রতিভের সুরে বলিল-রানাঘাট থেকে কিছু খাবার নিলেই হত—তোমাকে একা বসিয়ে রেখে যাই কি করে নইলে ক্ষেত্র কাপালির বাড়ি থেকে চিড়ে আর দুধ—যাব?…
অপর্ণা ঘাড় নাড়িয়া বারণ করিল।
তেলিদের বাড়িতে কেউ ছিল না, তিন-চারি মাস হইতে তাহারা কলিকাতায় আছে, বাড়ি তালাবন্ধ, নতুবা কাল রাত্রে ইহাদের কথাবার্তা শুনিয়া সে-বাড়ির লোক আসিল। সকালে সংবাদ পাইয়া ও-পাড়া হইতে নিরুপমা ছুটিয়া আসিল। অপু কৌতুকের সুরে বলিল—এসো, এসো নিরুদিদি, এখন মা নেই, তোমরা কোথায় বরণ করে ঘরে তুলবে, দুধে-আলতার পাথরে দাঁড় করাবে, তা না তুমি সকালে পান চিবুতে চিবুতে এলে। বেশ যা হোক।
নিরুপমা অনুযোগ করিয়া বলিল–তুমি ভাই সেই চৌদ্দ বছরে যেমন পাগলটি ছিলে, এখনও ঠিক সেই আছে। বৌ নিয়ে আসছে তা একটা খবর না, কিছু না। কি করে জানব তুমি এ অবস্থায় একজন ভদ্রলোকের মেয়েকে এই ভাঙা ঘরে হুপ করে এনে তুলবে? ছি ছি, দ্যাখ তো কাণ্ডখানা? রাত্রে যে রইলে কি করে এখানে, সে কেবল তুমিই পারো।
নিরুপমা গিনি দিয়া বৌ-এর মুখ দেখিল।
অপু বলিল-তোমাদের ভরসাতেই কিন্তু ওকে এখানে রেখে যাব নিরুদি। আমাকে সোমবার চাকুরিতে যেতেই হবে। নিরুপমা বৌ দেখিয়া খুব খুশি, বলিল—আমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখে দেব বৌকে, এখানে থাকতে দেব না! অপু বলিল—তা হবে না, আমার মায়ের ভিটেতে সন্ধে দেবে কে তাহলে? রাত্রে তোমাদের ওখানে শোবার জন্যে নিয়ে যেয়ো। নিরুপমা তাতেই রাজি। চৌদ্দ বছরের ছেলে যখন প্রথম চেলি পরিয়া তাহাদের বাড়ি পূজা করিতে গিয়াছিল, তখন হইতে সে অপুকে সত্য সত্য স্নেহ করে, তাহার দিকে টানে। অপু ঘরবাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যাওয়ায় সে মনে মনে খুব দুঃখিত হইয়াছিল। মেয়েরা গতিকে বোঝে না, বাহিরকে বিশ্বাস করে না, মানুষের উদ্দাম ছুটিবার বহির্মুখী আকাঙ্ক্ষাকে শান্ত সংযত করিয়া তাহাকে গৃহস্থালি পাতাইয়া, বাসা বাঁধাইবার প্রবৃত্তি নারীমনের সহজাত ধর্ম, তাহাদের সকল মাধুর্য, স্নেহ, প্রেমের প্রয়োগনৈপুণ্য এখানে। সে শক্তিও এত বিশাল যে খুব কম পুরুষই তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া জয়ী হইবার আশা করিতে পারে। অপু বাড়ি ফিরিয়া নীড় বাঁধাতে নিরুপমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল।
কলিকাতায় ফিরিয়া অপুর আর কিছু ভালো লাগে না, কেবল শনিবারের অপেক্ষায় দিন গুনিতে থাকে। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যাহারা নব-বিবাহিত তাহাদের সঙ্গে কেবল বিবাহিত জীবনের গল্প করিতে ও শুনিতে ভালো লাগে। কোনওরকমে এক সপ্তাহ কাটাইয়া শনিবার দিন সে বাড়ি গেল। অপর্ণার গৃহিণীপনায় সে মনে মনে আশ্চর্য না হইয়া পারিল না। এই সাত-আট দিনের মধ্যেই অপর্ণা বাড়ির চেহারা একেবারে বদলাইয়া ফেলিয়াছে। তেলি-বাড়ির বুড়ি ঝিকে দিয়া নিজের তত্ত্বাবধানে ঘরের দেওয়াল লেপিয়া ঠিক করাইয়াছে। দাওয়ায় মাটি ধরাইয়া দিয়াছে, রাঙা এলামাটি আনিয়া চারিধারে রঙ করাইয়াছে, নিজের হাতে এখানে তাক, ওখানে কুলুঙ্গি গাঁথিয়াছে, তক্তপোশের তলাকার রাশীকৃত ইদুরের মাটি নিজেই উঠাইয়া বাহিরে ফেলিয়া গগাবর-মাটি লেপিয়া দিয়াছে। সারা বাড়ি যেন ঝকঝক তক তক করিতেছে। অথচ অপর্ণা জীবনে এই প্রথম মাটির ঘরে পা দিল। পূর্ব গৌরব যতই ক্ষুন্ন হউক, তবুও সে ধনীবংশের মেয়ে, বাপ-মায়ের আদরে লালিত, বাড়ি থাকিতে নিজের হাতে তাহাকে কখনও বিশেষ কিছু করিতে হইত না।
মাসখানেক ধরিয়া প্রতি শনিবারে বাড়ি যাতায়াত করিবার পর অপু দেখিল তাহার যাহা আয় ফি শনিবার বাড়ি যাওয়ার খরচ তাহাতে কুলায় না। সংসারে দশ-বারো টাকার বেশি মাসে এ পর্যন্ত সে দিতে পারে নাই। সে বোঝে—ইহাতে সংসার চালাইতে অপর্ণাকে দস্তুরমতে বেগ পাইতে হয়। অতএব ঘন ঘন বাড়ি যাওয়া বন্ধ করিল।
ডাকপিয়নের খাকির পোশাক যে বুকের মধ্যে হঠাৎ এরুপ ঢেউ তুলিতে পারে, ব্যগ্র আশার আশ্বাস দিয়াই পরমুহূর্তে নিরাশা ও দুঃখের অতলতলে নিমজ্জিত করিয়া দিতে পারে, পনেরো টাকা বেতনের আমহার্স্ট স্ট্রীট পোস্টাফিসের পিওন যে একদিন তাহার দুঃখ-সুখের বিধাতা হইবে, এ কথা কবে ভাবিয়াছিল? পূর্বে কালেভদ্রে মায়ের চিঠি আসিত, তাহার এজন্য এরূপ ব্যগ্র প্রতীক্ষার প্রয়োজন ছিল না। পরে মায়ের মৃত্যুর পর বৎসরখানেক তাহাকে একখানি পত্রও কেহ দেয় নাই। উঃ, কি দিনই গিয়াছে সেই এক বৎসর! মনে আছে, তখন বোজ সকালে চিঠির বাক্স বৃথা আশয় একবার করিয়া খোঁজ করিয়া হাসিমুখে পাশের ঘরের বন্ধুকে উদ্দেশ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিত—আরে, বীরেন বোসের জন্যে তো এ বাসায় আর থাকা চলে না দেখছি!—রোজ রোজ যত চিঠি আসে তার অর্ধেক বীরেন বোসের নামে!
বন্ধু হাসিয়া বলিত–ওহে পাঁচজন থাকলেই চিঠিপত্র আসে পাঁচদিক থেকে। তোমার নেই কোনও চুলোয় কেউ, দেবে কে চিঠি?
বোধ হয় কথাটা রূঢ় সত্য বলিয়াই অপুর মনে আঘাত লাগিত কথাটায়। বীরেন বোসের নানা ছাদের চিঠিগুলি লোলুপ দৃষ্টিতে চাহিয়া চাহিয়া দেখিত—সাদা খাম, সবুজ খাম, হলদে খাম, মেয়েলি হাতের লেখা পোস্টকার্ড, এক-একবার হাতে তুলিয়া লোভ দমন করিতে না পারিয়া দেখিয়াছেও ইতি তোমার দিদি, ইতি তোমার মা, আপনার স্নেহের ছোট বোন সুশী, ইত্যাদি। বীরেন বোস মিথ্যা বলে নাই, চারিদিকে আত্মীয় বন্ধু থাকিলেই রোজ পত্র আসে—তাহার চিঠি তো আর আকাশ হইতে
পড়িবে না? আজকাল আর সে দিন নাই। পত্র লিখিবার লোক হইয়াছে এতদিনে।
জন্মাষ্টমীর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার কথা, কিন্তু দিনগুলো মাসের মতো দীর্ঘ।
অবশেষে জন্মাষ্টমীর ছুটি আসিয়া গেল। এডিটারকে বলিয়া বেলা তিনটার সময় আফিস হইতে বাহির হইয়া সে স্টেশনে আসিল। পথে নব-বিবাহিত বন্ধু অনাথবাবু বৈঠকখানা বাজার হইতে আম কিনিয়া উর্বশ্বাসে ট্রাম ধরিতে ছুটিতেছেন। অপুর কথার উত্তরে বলিলেন—সময় নেই, তিনটে পনেরো ফেল করলে আবার সেই চারটে পঁচিশ, দুঘণ্টা দেরি হয়ে যাবে বাড়ি পৌঁছতে আচ্ছা আসি, নমস্কার।
দাড়িটা ঠিক কামানো হইয়াছে তো?
মুখ রৌদ্রে, ধুলায় ও ঘামে যে বিবর্ণ হইয়া যাইবে তাহার কি? কি গাধা-বোট গাড়িখানা, এতক্ষণে মোটে নৈহাটি? বাড়ি পৌঁছিতে প্রায় সন্ধ্যা হইতে পারে। খুশির সহিত ভাবিল, চিঠি লিখে
তো যাচ্ছি নে, হঠাৎ দেখে অপর্ণা একেবারে অবাক হয়ে যাবে এখন
বাড়ি যখন পৌঁছিল, তখনও সন্ধ্যার কিছু দেরি। বধূ বাড়ি নাই, বোধ হয় নিবুপমাদেব বাড়ি কি পুকুরের ঘাটে গিয়াছে। কেহ কোথাও নাই। অপু ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পুঁটলি নামাইয়া রাখিয়া সাবানখানা খুঁজিয়া বাহির করিয়া আগে হাত মুখ ও মাথা ধুইয়া ফেলিযা তাকের আয়না ও চিরুনির সাহায্যে টেরি কাটিল। পরে নিজের আগমনের সকল চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল।
আধঘণ্টা পরেই সে ফিরিল। বধূ ঘরের মধ্যে প্রদীপের সামনে মাদুব পাতিয়া বসিয়া কি বই পড়িতেছে। অপু পা টিপিয়া টিপিয়া তাহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল। এটা অপুর পুরানো রোগ, মায়ের সঙ্গে কতবার এরকম করিয়াছে। হঠাৎ কি একটা শব্দে বধূ পিছন ফিরিয়া চাহিয়া ভয়ে ধড়মড় করিয়া উঠিবার চেষ্টা করিতে অপু হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
বধূ অপ্রতিভেব সুরে বলিল—ওমা তুমি! কখন-ই–তোমার তো—
অপু হাসিতে হাসিতে বলিল—কেমন জব্দ! আচ্ছা তো ভীতু!
বধূ ততক্ষণে সামলাইয়া লইয়া হাসি মুখে বলিল—বা রে, ওই রকম করে বুঝি আচমকা ভয় দেখাতে আছে? কটার গাড়িতে এলে এখন–তাই বুঝি আজ ছ-সাত দিন চিঠি দেওয়া হয় নি।
আমি ভাবছি–
অপু বলিল—তারপর, তুমি কি রকম আছ, বলো? মায়ের চিঠিপত্র পেয়েছ?
-তুমি কিন্তু রোগা হয়ে গিয়েছ, অসুখ-বিসুখ হয়েছিল বুঝি?
-আমার এবারকার চিঠির কাগজটা কেমন? ভালো না? তোমার জন্যে এনেছি পঁচিশখানা। তারপর রাত্রে কি খাওয়াবে বলো?
-কি খাবে বলল? ঘি এনে রেখেছি, আলুপটলের ডালনা করি—আর দুধ আছে—
পরদিন সকালে উঠিয়া অপু দেখিয়া অবাক হইল, বাড়ির পিছনের উঠানে অপর্ণা ছোট ছোট বেড়া দিয়া শাকের ক্ষেত, বেগুনের ক্ষেত করিয়াছে। দাওয়ার ধারে ধারে গাঁদার চারা বসাইয়াছে। রান্নাঘরের চালায় পুঁইলতা লাউলতা উঠাইয়া দিয়াছে। দেখাইয়া বলিল,–আজ পুইশাক খাওয়াব আমার গাছের! ওই দোপাটিগুলো দ্যাখো? কত বড়, না? নিরুপমা দিদি বীজ দিয়েছেন। আর একটা জিনিস দ্যাখো নি? এসো দেখাব
অপুর সারা শরীরে একটা আনন্দের শিহরণ বহিল। অপর্ণা যেন তাহার মনের গোপন কথাটি জানিয়া বুঝিয়াই কোথা হইতে একটা ছোট চাপা গাছের ডাল আনিয়া মাটিতে পুঁতিয়াছে, দেখাইয়া বলিল—দ্যাখো কেমন হবে না এখানে?
–হবে না আর কেন? আচ্ছা, এত ফুল থাকতে চাপা ফুলের ডাল যে পুঁততে গেলে?
অপর্ণা সলজ্জমুখে বলিল—জানি নে-যাও।
অপু তো লেখে নাই, পত্রে তো এ কথা অপর্ণাকে জানায় নাই যে, মিত্তির বাড়ির কম্পাউন্ডের চাঁপা ফুল গাছটা তাহাকে কি কষ্টই না দিয়াছে এই দু-মাস! চাপা ফুল যে হঠাৎ তাহার এত প্রিয় হইয়া উঠিয়াছে, এ কথাটি মনে মনে অনুমান করিবার জন্য এই কর্মব্যস্ত, সদা হাসিমুখ মেয়েটির উপর তাহার মন কৃতজ্ঞতায় ভরিয়া উঠিল।
অপর্ণা বলিল—এখানে একটু বেড়া দিয়ে ঘিরে দেবে? মাগো, কি ছাগলের উৎপাতই তোমাদের দেশে! চারাগাছ থাকতে দেয় না, রোজ খেয়েদেয়ে সারা দুপুর কঞ্চি হাতে দাওয়ায় বসে ছাগল তাড়াই আর বই পড়ি—দুপুরে রোজ নিরুদি আসেন, ও বাড়ির মেয়েরা আসে, ভারি ভালো মেয়ে কিন্তু নিরুদিদি।
আজ সারাদিন ছিল বর্ষা। সন্ধ্যার পর একটানা বৃষ্টি নামিয়াছে, হয়তো বা সারা রাত্রি ধরিয়া বর্ষা চলিবে। বাহিরে কৃষ্ণাষ্টমীর অন্ধকার মেঘে ঘনীভূত করিয়া তুলিয়াছে। বধূ বলিল—রান্নাঘরে এসে বসবে? গরম গরম সেঁকে দি। অপু বলিল—তা হবে না, আজ এসো আমরা দুজনে একপাতে খাবো! অপর্ণা প্রথমটা রাজি হইল না, অবশেষে স্বামীর পীড়াপীড়িতে বাধ্য হইয়া একটা থালায় রুটি সাজাইয়া খাবার ঠাঁই করিল।
অপু দেখিয়া বলিল,—ও হবে না, তুমি আমার পাশে বসো, ওরকম বসলে চলবে না। আরও একটু—আরও-পরে সে বাঁ-হাতে অপর্ণার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল—এবার এসো দু-জনে খাই–
বধূ হাসিয়া বলিল—আচ্ছা তোমার বদখেয়ালও মাথায় আসে, মাগো মা! দেখতে তো খুব ভালোমানুষটি!
লাভের মধ্যে বধুর একরূপ খাওয়াই হইল না সেরাত্রে। অন্যমনস্ক অপু গল্প করিতে করিতে থালার রুটি উঠাইতে উঠাইতে প্রায় শেষ করিয়া ফেলিল—পাছে স্বামীর কম পড়িয়া যায় এই ভয়ে সে বেচারি খান-তিনের বেশি নিজের জন্য লইতে পারিল না। খাওয়া-দাওয়ার পর অপর্ণা বলিল— কই, কি বই এনেছ বললে, দেখি?
দু-জনেই কৌতুকপ্রিয় সমবয়সি সুস্থমন, বালকবালিকার মতো আমোদ করিতে, গল্প করিতে, সারারাত জাগিতে, অকারণে অর্থহীন বকিতে দুজনেরই সমান আগ্রহ সমান উৎসাহ। অপু একখানা নতুন-আনা বই খুলিয়া বলিল—পড়ো তো এই পদ্যটা?
অপর্ণা প্রদীপের সলতেটা চাপার কলির মতো আঙুল দিয়া উসকাইয়া দিয়া পিলসুজটা আরও নিকটে টানিয়া আনিল। পরে সে লজ্জা করিতেছে দেখিয়া অপু উৎসাহ দিবার জন্য বলিল—পড়ো না, কই দেখি?
অপর্ণা যে কবিতা এত সুন্দর পড়িতে পারে অপুর তাহা জানা ছিল না। সে ঈষৎ লজ্জাজড়িত স্বরে পড়িতেছিল—
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কুলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা–
অপু পড়ার প্রশংসা করিতেই অপর্ণা বই মুড়িয়া বন্ধ করিল। স্বামীর দিকে উজ্জ্বলমুখে চাহিয়া কৌতুকের ভঙ্গিতে বলিল-থাকগে পড়া, একটা গান করো না।
অপু বলিল, একটা টিপ পরো না খুকি! ভারি সুন্দর মানাবে তোমার কপালে—
অপর্ণা সলজ্জ হাসিয়া বলিল—যাও—
সত্যি বলছি অপর্ণা, আছে টিপ?–
—আমার বয়সে বুঝি টিপ পরে? আমার ছোট বোন শান্তির এখন টিপ পরবার বয়স তো
কিন্তু শেষে তাহাকে টিপ পরিতেই হইল। সত্যই ভারি সুন্দর দেখাইতেছিল, প্রতিমার চোখের মতো টানা, আয়ত সুন্দর চোখ দুটির উপর দীর্ঘ, ঘনকালো, জোড়াভুরুর মাঝখানটিতে টিপ মানাইয়াছে কি সুন্দর! অপুর মনে হইল—এই মুখের জন্যই জগতের টিপ সৃষ্টি হইয়াছে-প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয় এই টিপ-পরা মুখখানি বারবার সতৃষ্ণ চোখে চাহিয়া দেখবার জন্যই।
অপর্ণা বলে—ছাই দেখাচ্ছে, এ বয়সে কি টিপ মানায়? কি করি পরের ছেলে, বললে তো আর কথা শুনবে না তুমি!
-না গো পরের মেয়ে, শোনো একটু সরে এসো তো—
ভারি দুই-এত জ্বালাতনও তুমি করতে পার!…
অপু বলিল—আচ্ছা, আমায় দেখতে কেমন দেখায় বলো না সত্যি-কেমন মুখ আমার? ভালল, না পেঁচার মতো?
অপর্ণার মুখ কৌতুকে উজ্জ্বল দেখাইল-নাক সিটকাইল, বলিল—বিশ্রী, পেঁচার মতো।
অপু কৃত্রিম অভিমানের সুরে বলিল—আর তোমার মুখ তো ভালো, তা হলেই হয়ে গেল। যাই, শুইগে যাই-রাত কম হয় নি কাল ভোরে আবার–
বধূ খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
এই রাত্রিটা গভীর দাগ দিয়া গিয়াছিল অপুর মনে। মাটির ঘরের আনাচে-কানাচে, গাছপালায় বাঁশবনে, ঝিম্ ঝিম্ নিশীথের একটানা বর্ষার ধারা। চারিধারই নিস্তব্ধ। পূর্বদিকের জানালা দিয়া বর্ষাসজল বাদল রাতের দমকা হাওয়া মাঝে মাঝে আসে—মাটির প্রদীপের আলোতে, খড়ের ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছাইয়া সে ও অপর্ণা!
অপু বলিল—দ্যাখো আজ রাত্রে মায়ের কথা মনে হয়—মা যদি আজ থাকতেন?
অপর্ণা শান্ত সুরে বলিল—মা সবই জানেন, যেখানে গিয়েছেন, সেখান থেকে সবই দেখছেন। পরে সে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া চোখ তুলিয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—দ্যাখো, আমি মাকে দেখেছি।
অপু বিস্ময়ের দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে চাহিল। অপর্ণার মুখে শান্ত, স্থির বিশ্বাস ও সরল পবিত্রতা ছাড়া আর কিছু নাই।
অপর্ণা বলিল—শোনো, একদিন কি মাসটায়, তোমার সেদিন চিঠি এলো দুপুর বেলা। বিকেলে আঁচল পেতে পানচালার পিড়েতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি-সেদিন সকালে উঠোনের ওই লাউগাছটাকে পুঁতেছি, কঞ্চি কেটে তাকে উঠিয়েছি, খেতে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে, বুঝলে? স্বপ্নে দেখছি-একজন কে দেখতে বেশ সুন্দর, লালপেড়ে শাড়িপরা, কপালে সিঁদুর, তোমার মুখের তো আদল, আমায় আদর করে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলছেন—ও আবাগীর মেয়ে, অবেলায় শুয়ো না, ওঠো, অসুখ-বিসুখ হবে আবার? তারপর তিনি তার হাতের সিদুরের কৌটো থেকে আমার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিতেই আমি চমকে জেগে উঠলাম—এমন স্পষ্ট আর সত্যি বলে মনে হল যে, তাড়াতাড়ি কপালে হাত দিয়ে দেখতে গেলাম সিদুর লেগে আছে কিনা-দেখি কিছুই না— বুক ধড়াস করে উঠল—চারদিকে অবাক হয়ে চেয়ে দেখ সন্ধে হয়ে গিয়েছে-বাড়িতে কেউ নেই—খানিকক্ষণ না পারি কিছু করতে হাত পা যেন অবশ—তারপরে মনে হল, এ মা-আর কেউ না, ঠিক মা। মা এসেছিলেন এয়োতির সিঁদুর পরিয়ে দিতে। কাউকে বলি নি, আজ বললাম তোমায়।
বাহিরের বর্ষাধারার অবিশ্রান্ত রিম্ ঝিম্ শব্দ, একটা কি পতঙ্গ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে তান রাখিয়া একটানা ডাকিয়া চলিয়াছে, মাঝে মাঝে পুবে-হাওয়ার দমকা, অপর্ণার মাথার চুলের গন্ধ। জীবনের এই সব মুহূর্ত বড় অদ্ভুত। অনভিজ্ঞ হইলেও অপু তাহা বুঝিল। হঠাৎ ক্ষণিক বিদ্যুৎচমকে যেন অন্ধকার পথের অনেকখানি নজরে পড়ে। এমন সব চিন্তা মনে আসে, সাধারণ অবস্থায়, সুস্থ মনে সারা জীবনেও সে-সব চিন্তা মনে আসিত না।…কেমন একটা রহস্য…আত্মার অদৃষ্টলিপি…একটা বিরাট অসীমতা…।
কিন্তু পরক্ষণেই চোখ জলে ভরিয়া আসিল। সে কোনও কথা বলিল না। কোন মন্তব্য প্রকাশ করিল না, কেহই কোন কথা বলিল না।
খানিকটা পরে সে বলিল, আর একটা কবিতা পড়ো—শুনি বরং।
অপর্ণা বলিল–তুমি একটা গান করো–
অপু রবিঠাকুরের গান গাহিল একটা, দুইটা, তিনটা। তারপর আবার কথা, আবার গল্প। অপর্ণা হাসিয়া বলিল—আর রাত নেই কিন্তু ফরসা হয়ে এল–
—ঘুম পাচ্ছে?—
–না। তুমি একটা কাজ করো না? কাল আর যেয়ো না—
অফিস কামাই করব? তা কি কখনও চলে?
ভোর হইয়া গেল। অপর্ণা উঠিতে যাইতেছিল, অপু কোন্ সময় ইতিমধ্যে তাহার আঁচলের সঙ্গে নিজের কাপড়ের সঙ্গে গিঁট বাঁধিয়া রাখিয়াছে, উঠিতে গিয়া টান পড়িল। অপর্ণা হাসিয়া বলিল—ওমা তুমি কি! আচ্ছা দুষ্ট তো…এখুনি হারানের মা কাজ করতে আসবে বুড়ি কি ভাববে বলল দিকি? ভাববে, এত বেলা অবধি ঘরের মধ্যে—মাগো মা, ছাড়ো, লজ্জা করেছিঃ!
অপু ততক্ষণে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া শুইয়া পড়িয়াছে।
—ছাড়ো, ছাড়ো, লক্ষ্মী ছিঃ—এখুনি এলো বলে বুড়ি, পায়ে পড়ি তোমার ছাড়ো অপু নির্বিকার।
এমন সময় বাহিরে হারানের মায়ের গলা শোনা গেল। অপর্ণা ব্যস্তভাবে মিনতির সুরে বলিল—ওই এসেছে বুড়ি—ছাড়া ছিঃ–লক্ষ্মীটি—ওরকম দুষ্টুমি করে না—লক্ষ্মী–
হারানের মা কপাটের গায়ে ধাক্কা দিয়া বলিল—ও বৌমা, ভোর হয়ে গিয়েছে। ওঠো, ওঠো, ঘড়া ঘটিগুলো বার করে দেবে না?
অপু হাসিয়া উঠিয়া আঁচলের গিঁট খুলিয়া দিল।
অফিস কামাই করিয়া সে-দিনটা অপু বাড়িতেই রহিয়া গেল।
১৩. ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে স্বাস্থ্য প্রদর্শনী
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে স্বাস্থ্য প্রদর্শনী উপলক্ষে খুব ভিড়। অপু অনেকদিন হইতে ইনস্টিটিউটের সভ্য, তাহাদের জনকয়েকের উপর শিশুমঙ্গল ও খাদ্য-বিভাগের তত্ত্বাবধানের ভার আছে। দুপুর হইতে সে এই কাজে লাগিয়া আছে। মন্মথ বি.এ. পাস করিয়া অ্যাটর্নির আর্টিকল ক্লার্ক হইয়াছে। তাহার সহিত একদিন ইনস্টিটিউটের বসিবার ঘরে ঘোর তর্ক। অপুর দৃঢ় বিশ্বাস-যুদ্ধের পর ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাইবে। বিলাতে লয়েড জর্জ বলিয়াছেন, যুদ্ধশেষে ভারতবর্ষকে আমরা আর পদানত করিয়া রাখিব না। ভারতকে দিয়া আর ক্রীতদাসের কার্য করাইয়া লইলে চলিবে না। Indians must not remain as hewers of wood and drawers of water.
এই সময়েই একদিন ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরিতে কাগজ খুলিয়া একটা সংবাদ দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল। জোয়ান অব আর্ককে রোমান ক্যাথলিক যাজকশক্তি তাহাদের ধর্মসম্প্রদায়ের সাধুর তালিকাভুক্ত করিয়াছেন।
তার শৈশবের আনন্দ-মুহূর্তের সঙ্গিনী সেই পল্লীবালিকা জোয়ান-ইছামতীর ধারে শান্ত বাবলা-বনের ছায়ায় বসিয়া শৈশবের সে স্বপ্নভরা দিনগুলিতে যাহার সঙ্গে প্রথম পরিচয়! ইহার পর সে একদিন সিনেমাতে জোয়ান অব আর্কের বাৎসরিক স্মৃতি উৎসব দেখিল। ডমরেমির নিভৃত পল্লীপ্রান্তে ফ্রান্সের সকল প্রদেশ হইতে লোকজন জড়ো হইয়াছে—পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হইতে কত নরনারী আসিয়াছে…সামরিক পোশাকে সজ্জিত ফরাসি সৈনিক কর্মচারীর দল…সবসুদ্ধ মিলিয়া এক মাইল দীর্ঘ বিরাট শোভাযাত্রা…জোয়ানের সঙ্গে তার নাড়ীর কি যেন যোগ…জোয়ানের সম্মানে তার নিজের বুক যেন গর্বে ফুলিয়া উঠিতেছিল…শৈশবের স্বপ্নের সে মোহ অপু এখনও কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই।
বড়ো হইয়া অবধি সে এই মেয়েটিকে কি শ্রদ্ধার চোখে ভক্তির চোখে দেখিয়া আসিয়াছে এতদিন, সে কথা জানিত এক অনিল-নতুবা কল্পনা যাহাদের পঙ্গু, মন মিনমিনে, পানসে—তাহাদের কাছে সেকথা তুলিয়া লাভ কি? কলেজে পড়িবার সময় সে বড়ো ইতিহাসে জোয়ানের বিস্তৃত বিবরণ পড়িয়াছে—অতীত শতাব্দীর সেই অবুঝ নিষ্ঠুরতা, ধর্মমতের গোঁড়ামি, খুঁটিতে বাঁধিয়া হৃদয়হীন দাহন-সূর্যদেবের রথচক্রের দ্রুত আবর্তনে অসীম আকাশে যেমন দুপুর হয় বৈকাল, বৈকাল হয় রাত্রি, রাত্রি হয় প্রভাত—মহাকালের রথচক্রের আবর্তনে এক শতাব্দীর অন্ধকারপুঞ্জ তেমনি পরের শতাব্দীতে দূরীভূত হইয়া যাইতেছে। সত্যের শুকতারা একদিন যে প্রকাশ হইবেই, জীবনের দুঃখদৈন্যের অন্ধকার শুধু যে প্রভাতেরই অগ্রদূত-কলকাকলিময়, ফুলফোটা অমৃতঝরা প্রভাত।
অন্যমনস্ক মনে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া সে খাদ্য-বিভাগের ঘরে ঢুকিতে যাইতেছে, কে তাহাকে ডাকিল। ফিরিয়া চাহিয়া দেখিয়া প্রথমটা চিনিতে পারিল না—পরে বিস্ময়ের সুরে বলিল-প্রীতি, না? এগজিবিশন দেখতে এসেছিলে বুঝি? ভালো আছ?
প্রীতি অনেক বড় হইয়াছে। দেখিয়া বুঝিল, বিবাহ হইয়া গিয়াছে। সে সঙ্গিনী প্রৌঢ়া মহিলাকে ডাকিয়া বলিল—মা, আমার মাস্টার মশায় অপূর্ববাবু—সেই অপূর্ববাবু।
অপু প্রণাম করিল। প্রীতি বলিল—আচ্ছা আপনার রাগ তো? এক কথায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন, দেখুন! কত ছোট ছিলুম, বুঝতুম কি কিছু? তারপর আপনার কত খোঁজ করেছিলুম, আর কোনও সন্ধানই কেউ বলতে পারলে না। আপনি আজকাল কি করছেন মাস্টার মশায়?
—ছেলেও পড়াই, রাত্রে খবরের কাগজের আপিসে চাকরিও করি—
–আচ্ছা মাস্টার মশাই, আপনাকে যদি বলি, আমাদের বাড়ি কি আপনি আর যাবেন না?
অপুর মনে পূর্বতন ছাত্রীর উপর কেমন একটা স্নেহ আসিল। কথা গুছাইয়া বলিতে জানিত, কি বলিতে কি বলিয়া ফেলিয়াছিল সে সময়—তাহারও অত সহজে রাগ করা ঠিক হয় নাই। সে বলিল—তুমি অত অপ্রতিভ ভাবে কথা বলছ কেন প্রীতি! দোষ আমারই, তুমি না হয় ছেলেমানুষ ছিলে, আমার রাগ করা উচিত হয় নি
ঠিকানা বিনিময়ের পর প্রীতি পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিয়া বিদায় লইল।
আবার অপুর একথা মনে না হইয়া পারিল না–কাল, মহাকাল, সবারই মধ্যে পরিবর্তন আনিয়া দিবে…তোমার বিচারের অধিকার কি?
আরও মাস দুই কোন রকমে কাটাইয়া অপু পূজার সময় দেশে গেল। সেদিন ষষ্ঠী, বাড়ির উঠানে পা দিয়া দেখিল পাড়ার একদল মেয়ে ঘরের দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া হাসিকলরব করিতেছে-অপু উপস্থিত হইতে অপর্ণা ঘোমটা টানিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিল। পাড়ার মেয়েদের সে আজ ষষ্ঠী উপলক্ষে বৈকালিক জলযোগের নিমন্ত্রণ করিয়া নিজের হাতে সকলকে আলতা সিঁদুর পরাইয়াছে। হাসিয়া বলিল—ভাগ্যিস এলে! ভাবছিলাম এমন কলার বড়াটা আজ ভাজলাম—
-সত্যি, কই দেখি?
-বা রে, হাত মুখ ধোওঠাণ্ডা হও—অমন পেটুক কেন তুমি?…পেটুক গোপাল কোথাকার!
পরে সে রেকাবিতে খাবার আনিয়া বলিল, এগুলো খেয়ে ফেলো, তারপর আরও দেবদ্যাখো তো খেয়ে, মিষ্টি কম হয় নি তো?-তোমার তো আবার একটুখানি গুড়ে হবে না!
খাইতে খাইতে অপু ভাবিল—বেশ তত শিখেছে করতে! বেশ–
পরে দেওয়ালের দিকে চোখ পড়াতে বলিল—বাঃ, ও-রকম আলপনা দিয়েছে কে? ভারি সুন্দর তো!
অপর্ণা মৃদু হাসিয়া বলিল—ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীপুজোতে তো এলে না! আমি বাড়িতে পুজো করলাম,-মা করতেন, সিঁদুরমাখা কাঠা দেখি তোলা রয়েছে, তাতে নতুন ধান পেতে-বামুন খাওয়ালাম। তুমি এলেও দুটি খেতে পেতে গো—তারই ওই আলপনা
তাই তো! তুমি ভারি গিন্নি হয়ে উঠেছ দেখছি! লক্ষ্মীপুজো, লোক খাওয়ানো—আমার কিন্তু এসব ভারি ভালো লাগে অপর্ণা—সত্যি, মাও খুব ভালোবাসতেন—একবার তখন আমরা এখানে নতুন এসেছি—একজন বুড়োমতোলোক আমাদের উঠোনের ধারে এসে দাঁড়িয়ে বলে— খোকা ক্ষিদে পেয়েছে, দুটো মুড়ি খাওয়াতে পারো?—আমি মাকে গিয়ে বললাম, মা, একজন মুড়ি খেতে চাচ্ছে, ওকে খানকতক রুটি করে খাওয়ালে ভারি খুশি হবে—খাওয়াবে মা? মা কি করলেন বলো তো?
-রুটি তৈরি করে বুঝি—
—তা নয়। মা একটু করে সরের ঘি করে রাখতেন, আমি বোর্ডিং থেকে বাড়ি-টাড়ি এলে পাতে দিতেন। আমায় খুশি করবার জন্য মা সেই ঘি দিয়ে আট-দশখানা পরোটা ভেজে লোকটাকে ডেকে, দাওয়ার কোলে সিঁড়ি পেতে খেতে দিলেন। লোকটা তো অবাক, তার মুখের এমন ভাব হল!
রাত্রে অপর্ণা বলিল—দ্যাখো, মা চিঠি লিখেছেন,-পুজোর পর মুরারিদা আসবেন নিতে, পাঁচ-ছমাস যাই নি, তুমি যাবে আমাদের ওখানে?
অপুর বড়ো অভিমান হইল। সে তো আশা করিয়া পূজার সময় বাড়ি আসিল, আর এদিকে কিনা অপর্ণা বাপের বাড়ি যাইবার জন্য পা বাড়াইয়া আছে! সে-ই তাহা হইলে ভাবিয়া মরে, অপর্ণার কাছে বাপের বাড়ি যাওয়াটাই অধিকতর লোভনীয়!
অপু উদাস সুরে বলিল—বেশ, যাও। আমার যাওয়া ঘটবে না, ছুটি নেই এখন। কথাটা শেষ করিয়া সে পাশ ফিরিয়া শুইয়া বই পড়িতে লাগিল।
অপর্ণা খানিকক্ষণ পরে বলিল—এবারে যে বইগুলো এনেছ আমার জন্যে, ওর মধ্যে একখানা চয়নিকা তো আনলে না? সেই যে সে-বার বলে গেলে জন্মাষ্টমীর সময়? এক-আধ কথার জবাব পাইয়া ভাবিল সারা দিনের কষ্টে স্বামীর হয়তো ঘুম আসিতেছে। তখন সেও ঘুমাইয়া পড়িল।
দশমীর পরদিনই মুরারি আসিয়া হাজির। জামাইকেও যাইতে হইবে, অপর্ণার মা বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছেন, ইত্যাদি নানা পীড়াপীড়ি শুরু করিল। অপু বলিল-পাগল! ছুটি কোথায় যে যাব আমি? বোনকে নিতে এসেছ, বোনকেই নিয়ে যাও ভাই—আমরা গরিব চাকরে লোক, তোমাদের মতো জমিদার নই-আমাদের কি গেলে চলে?
অপর্ণা বুঝিয়াছিল স্বামী চটিয়াছে, এ অবস্থায় তাহার যাইবার ইচ্ছা ছিল না আদৌ, কিন্তু বড়ো ভাই লইতে আসিয়াছে সে কি করিয়াই না বলে? দোটানার মধ্যে সে বড় মুশকিলে পড়িল। স্বামীকে বলিল-দ্যাখো আমি যেতাম না। কিন্তু মুরারিদা এসেছেন, আমি কি কিছু বলতে পারি?…রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি, তুমি এখন না যাও, কালীপুজোর ছুটিতে অবিশ্যি করে যেয়োভুলো না যেন।
অপর্ণা চলিয়া যাইবার পর মনসাপোতা আর একদিনও ভালো লাগিল না। কিন্তু বাধ্য হইয়া সে রাত্রিটা সেখানে কাটাইতে হইল, কারণ অপর্ণারা গেল বৈকালের ট্রেনে। কোনদিন লুচি হয় না কিন্তু দাদার কাছে স্বামীকে ছোট হইতে না হয়, এই ভাবিয়া অপর্ণা দুইদিনই রাত্রে লুচির ব্যবস্থা করিয়াছিল—আজও স্বামীর খাবার আলাদা করিয়া ঘরের কোণে ঢাকিয়া রাখিয়া গিয়াছে। লুচি কখানা খাইয়াই অপু উদাস মনে জানালার কাছে আসিয়া বসিল। খুব জ্যোৎস্না উঠিয়াছে, বাড়ির উঠানের গাছে গাছে এখনও কি পাখি ডাকিতেছে, শূন্য ঘর, শূন্য শয্যাস্ত-অপুর চোখে প্রায় জল আসিল। অপর্ণা সব বুঝিয়া তাহাকে এই কষ্টের মধ্যে ফেলিয়া গেল। বড়োলোকের মেয়ে কিনা?…আচ্ছা বেশ।…অভিমানের মুখে সে এ কথা ভুলিয়া গেল যে, অপর্ণা আজ ছমাস এই শূন্য বাড়িতে শূন্য শয্যায় তাহারই মুখ চাহিয়া কাটাইয়াছে।
পরদিন প্রত্যুষে অপু কলিকাতা রওনা হইল। সেখানে দিনচারেক পরেই অপর্ণার এক পত্র আসিল—অপু সে পত্রের কোনও জবাব দিল না। দিন পাঁচ-ছয় পরে অপর্ণার আর একখানা চিঠি। উত্তর না পাইয়া ব্যস্ত আছে, শরীর ভালো আছে তো? অসুখ-বিসুখের সময়, কেমন আছে পত্রপাঠ যেন জানায়, নতুবা বড়ো দুর্ভাবনার মধ্যে থাকিতে হইতেছে। তাহারও কোন জবাব গেল না।
মাসখানেক কাটিল।
কার্তিক মাসের শেষের দিকে একদিন একখানা দীর্ঘ পত্ৰ আসিল। অপর্ণা লিখিয়াছে—ওগো আমার বুকে এমন পাষাণ চাপিয়ে আর কতদিন রাখবে, আমি এত কি অপরাধ করেছি তোমার কাছে?…আজ একমাসের ওপর হল তোমার একচ্ছত্র লেখা পাই নি, কি করে দিন কাটাচ্ছি, তা কাকে জানাব? দ্যাখো, যদি কোন দোষই করে থাকি, তুমি যদি আমার উপর রাগ করবে তবে ত্রিভুবনে আর কার কাছে দাঁড়াই বলল তো?
অপু ভাবিল-বেশ জব্দ, কেন, যাও বাপের বাড়ি!—আমাকে চাইবার দরকার কি, কে আমি? সঙ্গে সঙ্গে একটা অপূর্ব পুলকের ভাব মনের কোণে দেখা দিল—পথে, ট্রামে, আপিসে, বাসায়, সব সময় সকল অবস্থাতেই মনে না হইয়া পারিল না যে পৃথিবীতে একজন কেহ আছে, যে, সর্বদা তাহার জন্য ভাবিতেছে, তাহারই চিঠি না পাইলে সে-জনের দিন কাটিতে চাহে না, জীবন বিস্বাদ লাগে। সে যে হঠাৎ এক সুন্দরী তরুণীর নিকট এতটা প্রয়োজনীয় হইয়া উঠিয়াছে—এ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অভিনব ও অদ্ভুত তাহার কাছে। অতএব তাহাকে আরও ভাবাও, আরও কষ্ট দাও, তাহার রজনী আরও বিনিদ্র করিয়া তোল।
সুতরাং অপর্ণার মিনতি বৃথা হইল। অপু চিঠির জবাব দিল না।
এদিকে অপুদের আপিসের অবস্থা বড়ো খারাপ হইয়া আসিল। কাগজ উঠিয়া যাইবার জোগাড়, একদিন স্বত্বাধিকারী তাহাদের কয়েকজনকে ডাকিয়া পাঠাইলেন, কি করা উচিত সেসম্বন্ধে পরামর্শ। কথাবার্তার গতিকে বুঝিল কাগজের পরমায়ু আর বেশি দিন নয়। তাহার একজন সহকর্মী বাহিরে আসিয়া বলিল—এ বাজারে চাকরিটুকু গেলে মশাই দাঁড়াবার জো নেই একেবারেবোনের বিয়েতে টাকা ধার, সুদে-আসলে অনেক দাঁড়িয়েছে, সুদটা দিয়ে থামি