- বইয়ের নামঃ আদর্শ হিন্দু-হোটেল
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মাটিগন্ধা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. রাণাঘাটের রেল-বাজারে বেচু চক্কত্তির হোটেল
আদর্শ হিন্দু-হোটেল – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
রাণাঘাটের রেল-বাজারে বেচু চক্কত্তির হোটেল যে রাণাঘাটের আদি ও অকৃত্রিম হিন্দু-হোটেল এ-কথা হোটেলের সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা না থাকিলেও অনেকেই জানে। কয়েক বছরের মধ্যে রাণাঘাট রেলবাজারের অসম্ভব রকমের উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলটির অবস্থা ফিরিয়া যায়। আজ দশ বৎসরের মধ্যে হোটেলের পাকা বাড়ী হইয়াছে, চারজন রসুয়ে-বামুনে রান্না করিতে করিতে হিমশিম খাইয়া যায়, এমন খদ্দেরের ভিড়।
বেচু চক্কত্তি (বয়স পঞ্চাশের ওপর, না-ফর্সা না-কালো দোহারা চেহারা, মাথায় কাঁচা পাকা চুল) হোটেলের সামনের ঘরে একটা তক্তপোশে কাঠের হাত-বাক্সের ওপর কনুয়ের ভয় দিয়া বসিয়া আছে। বেলা দশটা। বনগাঁ লাইনের ট্রেন এইমাত্র আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কিছু কিছু প্যাসেঞ্জার বাহিরের গেট দিয়া রাস্তায় পড়িতে শুরু হইয়াছে।
বেচু চক্কত্তির হোটেলের চাকর মতি রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া হাঁকিতেছে–এই দিকে আসুন বাবু, গরম ভাত তৈরি, মাছের ঝোল, ডাল, তরকারী ভাত–হিন্দু-হোটেল বাবু–
দুইজন লোক বক্তৃতায় ভুলিয়া পাশের যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলের লোকের সাদর আমন্ত্রণ উপেক্ষা করিয়া বেচু চক্কত্তির হোটেলেই ঢুকিল।
–এই যে, বোঁচকা এখানে রাখুন। দাঁড়ান বাবু, টিকিট নিতে হবে এখানে–কোন ক্লাসে খাবেন? ফাস্ট ক্লাস না সেকেন্ ক্লাস–ফাস্ট ক্লাসে পাঁচ আনা, সেকেন ক্লাসে তিন আনা–
এ হোটেলের নিয়ম, পয়সা দিয়া বেচু চক্কত্তির নিকট হইতে টিকিট (এক টুকরা সাদা কাগজে-নম্বর ও শ্রেণী লেখা) কিনিয়া ভিতরে যাইতে হইবে। সেখানে একজন রসুয়ে বামুন বসিয়া আছে, খদ্দেরের টিকিট লইয়া তাহাকে নিদিষ্ট স্থানে বসাইয়া দিবার জন্য। খাইবার জায়গা দরমার বেড়া দিয়া দুই ভাগ করা। এক দিকে ফাস্ট ক্লাস, অন্য দিকে সেকেন, ক্লাস। খদ্দের খাইয়া চলিয়া গেলে এই সব টিকিট বেচু চক্কত্তির কাছে জমা দেওয়া হইবে– সেগুলি দেখিয়া তহবিল মিলানো ও উদ্বৃত্ত ভাত তরকারীর পরিমাণ তদারক হইবে, রসুয়ে বামুনেরা চুরি করতে না পারে।
চাকর ভিতরে আসিয়া বলিল–মোটে চার জন লোক খদ্দের। দু’জন ওদের ওখানে গেল।
বেচু চক্কত্তি বলিল–যাক্ গে। তুই আর একটু এগিয়ে যা–শান্তিপুর আসবার সময় হ’ল। এই গাড়ীতে দু-পাঁচটা খদ্দের থাকেই। আর ভেতরে বামুনকে বলে আয়, শান্তিপুর আসবার আগে যেন আর ভাত না চড়ায়। এক ডেকচিতে এখন চলুক।
এমন সময় হোটেলের ঝি পদ্ম ঘরে ঢুকিয়া বলিল–পয়সা দেও বাবু, দই নে আসি।
বেচু বলিল–দই কি হবে?
পদ্ম হাসিয়া বলিল–একজন ফাস্টো কেলাসে খাবে। আমায় বলে পাঠিয়েছে। দই চাই, পাকা কলা চাই–
বেচু বলিল–কে বল তো? খদ্দের?
–খদ্দের তো বটেই। পয়সা দিয়ে খাবে। এমনি না। আমার ভাইপো আসবে দেশ থেকে এই শান্তিপুরের গাড়ীতে।
–না–না–তাকে পয়সা দিতে হবে না। সে ছেলেমানুষ, দু-এক দিনের জন্যে আসবে–তার কাছ থেকে পয়সা কিসের? দইয়ের পয়সা নিয়ে যা–
বেচু একথা কখনো কাহাকেও বলে না, কিন্তু পদ্ম ঝিয়ের সম্বন্ধে অন্য কথা। পদ্ম ঝি এ হোটেলে যা বলে তাই হয়। তাহার উপর কথা বলিবার কেহ নাই। সেজন্য দুষ্ট লোকে নানারকম মন্দ কথা বলে। কিন্তু সে-সব কথায় কান দিতে গেলে চলে না।
শান্তিপুরের গাড়ী আসিবার শব্দ পাওয়া গেল।
হোটেলের চাকর খদ্দের আনিতে স্টেশনে যাইতেছিল, বেচু চক্কত্তি বলিল–খদ্দের বেশী করে আনতে না পারলে আর তোমায় রাখা হবেনা মনে রেখো–আমার খরচা না পোষালে মিথ্যে চাকর রাখতে যাই কেন? গেল হপ্তাতে তুমি মোটে তেইশটা খদ্দের এনেছ–তাতে হোটেল চলে?
পদ্ম ঝি বলিল–তোমায় পই-পই করে বলে হার মেনে গেলাম; তিন আনা বাড়িয়ে চোদ্দ পয়সা করো, আর ফাস্টো কেলাস-টেলাস তুলে দ্যাও। ক’টা খদ্দের হয় ফাস্টো কেলাসে? যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলে রেট কমিয়েছে–শুনে–
বেচু বলিল–চুপ চুপ, একটু আস্তে আস্তে বল না। কারও কানে কথা গেলে এখুনি—
এমন সময় দু’জন খদ্দের সঙ্গে করিয়া মতি চাকর ফিরিয়া আসিল।
বেচু বলিল–আসুন বাবু, পুঁটুলি এখানে রাখুন। কোন কেলাসে খাবেন বাবুরা? পাঁচ আনা আর তিন আনা–
একজন বলিল–তোমার সেই বামুন ঠাকুরটি আছে তো? তার হাতের রান্না খেতেই এলাম। আমরা সে-বার খেয়ে গিয়ে আর ভুলতে পারি নে। মাংস হবে?
–না বাবু, মাংস তো রান্না নেই–তবে যদি অর্ডার দেন তো ওবেলা—
লোকটি বলিল–আমরা মোকদ্দমা করতে এসেছি কিনা, যদি জিতি পোড়ামা আর সিদ্বেশ্বরীর ইচ্ছেয়–তবে হোটেলে আমাদের আজ থাকতেই হবে। কাল উকীলের বাড়ী কাজ আছে–তা হলে আজ ওবেলা তিন সের মাংস চাই–কিন্তু সেই বামুন ঠাকুরকে দিয়ে রান্না করানো চাই। নইলে আমরা অন্য জায়গায় যাব।
ইহারা টিকিট কিনিয়া খাইবার ঘরে ঢুকিলে পদ্ম ঝি বলিল–পোড়ারমুখো মিনসে আবার শুনতে না পায়। কি যে ওর রান্নার সুখ্যাত করে লোকে, তা বলতে পারি নে–কি এমন মরণ রান্নার!
বেচু বলিল–টিকিটগুলো নিয়ে আয় তো ভেতর থেকে। এ-বেলার হিসেবটা মিটিয়ে রাখি। আর এখন তো গাড়ী নেই–আবার সেই একটায় মুড়োগাছা লোকাল–