পদ্ম ঝি রাগের মাথায় ভুলিয়া গিয়াছিল, এই মাত্ৰ বেচু চক্কত্তি বলিয়াছেন যে, কাল হাজারির বদলে ঠিকা ঠাকুর রাখা হইয়াছিল যাহার মজুরি হাজারির মাহিনা হইতে কাটা যাইবে।
হাজারি অবাক হইয়া বলিল, একা কি রকম? এই তো ঠিকে ঠাকুর রাখা হয়েছে বল্লেন কর্তাবাবু?
পদ্ম ঝি সামলাইয়া লইবার চেষ্টায় বলিল–হইছিল তো। হয়নি তো কি? কর্তামশায় কি মিথ্যে কথা বলেন তোমার কাছে? যদি না-ই বা পাওয়া যেত ঠাকুর তবে ঠাকুরকে একা খাটতে হোত না? তোমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবার সময় নেই আমার–মুর্শিদাবাদ আসবার সময় হোল। এখুনি ইষ্টিশানের খদ্দের সব আসবে। ডাল সাঁৎলে ফেলো তাড়াতাড়ি, চচ্চড়িটা চড়িয়ে দ্যাও।
মুর্শিদাবাদ ট্রেন সশব্দে আসিয়া প্লাটফর্মে দাঁড়াইল। এইবার কিছু খরিদ্দারের ভিড় হইবে।
হাজারি ছোট ডেকচিটার মধ্যে হাত ডুবাইয়া ভাল সাঁৎলাইতেছে, এমন সময় বাহিরে গদির ঘরে বেচু চক্কত্তির চড়া গলার আওয়াজ এবং তর্কবিতর্কের শব্দ শুনিয়া সে রান্নাঘরের দোরের কাছে আসিয়া বাহিরের ঘরের দিকে চাহিল।
যতীশ ভটচাজের সঙ্গে কর্তামশায়ের কথা কাটাকাটি হইতেছে। যতীশ ভটচাজ অনেক দিন হইতে তাহাদের খরিদ্দার–আগে আগে নগদ পয়সা দিয়া খাইয়া যাইত, আল মাস-ছয় হইতে মাসিক হারে খায়। বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন, ম্যালেরিয়া রোগীর মত চেহারা, মাথার চুল প্রায় পাকিয়া গিয়াছে, রং পূর্বে ফর্সা ছিল, এখন পুড়িয়া আধকালো হইয়া আসিয়াছে প্রায়। পরনে ময়লা ধুতি, গায়ে লংক্লথের ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে বিবর্ণ কেম্বিসের জুতা।
বেচু চক্কত্তি বলিতেছেন–না, আপনি অন্যস্তর চেষ্টা করুন ভটচাজ মশাই। আমি পারবো না সোজা কথা। হোটেল খুলিচি দু’পয়সা রোজগারের চেষ্টা, অন্নছত্তর তো খুলিনি?
যতীশ ভটচাজ, বলিতেছে –টাকার জন্যে আপনি ভাববেন না চক্কত্তি মশাই। এ ক’ মাসের বাকী আমি এক সঙ্গে দেবো।
–না মশাই–আপনি অন্যন্তর চেষ্টা করুন। যা গিয়েচে, গিয়েচে–আর আপনাকে খাইয়ে আমি জড়াতে রাজী নই।
যতীশ ভটচাজ, বেশ নরম সুরে বলিল–না না, যাবে কেন? বিলক্ষণ! পাই-পয়সা শোধ করে দেবো। তবে পড়ে গিইচি একটু ফেরে কর্তামশাই, (খুব খোশামোদ জুড়ে দিয়েচে!) তা এই কটা দিন যেমন খাচ্চি তেমনি খেয়ে যাই–সামনের মাসের পয়লা দোসরা–
–না মশাই, সামনের মাসের পয়লা দোসরার এখনো ঢের দেরি। ওসব আর চলবে না। মাপ করবেন, আপনি অন্যন্তরে দেখুন–
যতীশ ভটচাজের চেহারা দেখিয়া হাজারির মনে হইল, লোকটা খুব ক্ষুধার্ত, সকাল হইতে কিছু খায় নাই। এত বেলায় না খাওয়াইয়া কর্তামশাই তাড়াইয়া দিতেছেন, কাজটা কি ভালো? হয়ত কিছু কষ্টে পড়িয়া থাকিবে, নতুবা দুমুঠা খাইবার জন্য লোকে এত খোশামোদ করে না।
হাজারির ইচ্ছা হইল, একবার সে বলে–কর্তামশাই আমি আজ খাবো না–কাল দেশে একটা নেমন্তন্ন ছিল খেয়ে শরীর খারাপ আছে। আমার ভাতটা না হয় ভটচাজ মশাই খেয়ে যান–কিন্তু কথাটা বলিলে কর্তামশায়ের অপমান করা হইবে, বিশেষ করিয়া পদ্ম তাহা হইলে তাহাকে আস্ত রাখিবে না।
যতীশ ভটচাজ শেষ পর্যন্ত না খাইয়া চলিয়া গেল।
হাজারি ভাবিল–আহা, পুরোনো খদ্দের–ওকে এক থাল ভাত দিলে কি ক্ষতি হোত হোটেলের–আমি যদি কখনো হোটেল করি, খেতে এসে কাউকে ফেরাবো না–এতে আমার হোটেল উঠে যায় আর থাকে। একে তো ভাত বেচে পয়সা–তার ওপর খিদের সময় লোককে ফেরাবো?
ট্রেনের প্যাসেঞ্জার খরিদ্দারগণ আসিয়া পড়িয়াছে। খাইবার ঘরে বেশ ভিড়। মতি চাকর আজ দশ-বারোটি লোক জুটাইয়া আনিয়াছে। পদ্ম আসিয়া বলিল–দশ থালা ভাত বাড়ো–দু’থালা নিরিমিষ্যি। আলুর ডালনা দিও।
আধঘণ্টা পরে মুর্শিদাবাদ ট্রেনের খরিদ্দার বিদায় হইলে, অপ্রত্যাশিত ভাবে বনগাঁয়ের ট্রেনের সময় কতকগুলি লোক খাইতে আসিল। বেলা দেড়টা, এ সময় নূতন লোক প্রায়ই আসে না, পদ্ম ঝি যখন হাঁকিল, পাঁচ থালা ভাত ঠাকুর–হাজারি তাহাকে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিল–ডাল একেবারেই নেই–দু’জনের মত হবে কি না–
পদ্ম ঝি ডেকচির কাছে আসিয়া নীচু হইয়া দেখিয়া চাপা কণ্ঠে বলিল–ওমা, এ তো একেবারেই নেই বল্লে হয়! এখন খদ্দের খাওয়াবো কি দিয়ে? তোমার দোষ, যখন ডাল কমে আসছে, এখনও দু’খানা টেরেন্ বাকি, তখন একটু ফেন মিশিয়ে সাঁৎলে নিলে না কেন? কতবার তোমায় বলে দেওয়া হয়েছে। ফেন আছে?
হাজারি বলিল–আছে।
–আছে তো দু’বাটি দ্যাও ডালে ফেলে– দিয়ে একটু নুন দিয়ে গরম করে নাও। হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখচো কি?
হাজারি এ ধরনের কাজ কখনো করে নাই। করিতে তাহার বাধে। সে সত্যই ভাল রাঁধুনী। ইচ্ছা করিয়া হাতের ভাল রান্নাটা নষ্ট করিতে বা এভাবে খরিদ্দার ঠকাইতে তাহার মন সরে না। কিন্তু পদ্ম ঝির হুকুম না মানিয়া উপায় কি? বাধ্য হইয়া ডালে ফেন মিশাইয়া খরিদ্দার বিদায় করিতে হইল।
ছুটি পাইল সেদিন প্রায় বেলা আড়াইটায়।
একটুখানি গড়াইয়া লইয়া রোদ একটু পড়িয়া আসিলে সে চূর্ণীনদীর তীরে তাহার অভ্যাসমত বেড়াইতে চলিল। আজ ক’দিন নদীর ধারে যায় নাই–আর সেই পরিচিত নির্জন নিমগাছটার তলায় বসিয়া গাছের গুঁড়ি ঠেস্ দিয়া ওপারের খেয়াঘাটের দিকে এবং শান্তিপুর যাইবার রাস্তার দিকে চাহিয়া থাকে নাই। বেশ লাগে জায়গাটা।