তরকারির কথায় হাজারির নিজের গোপনীয় উচ্চাশার কথা মনে পড়িল। তরকারি তাহার গ্রাম হইতে কিনিলে রাণাঘাট বাজারের চেয়ে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। এখন হইতেই সে আনাজপত্র লইয়া যাইবে।
হৰি ঘোষকে বলিল–আচ্ছা, তোমাদের আলু ক’মণ হতে পারে?
–বাবাঠাকুর তার কি কোন ঠিক আছে? তবে ত্রিশ-চল্লিশ মণ খুব হবে।
–তুমি সমস্ত আলু আমায় দিতে পারবে? নগদ দাম দেবো।
হরি ধোষ কৌতূহলের সহিত জিজ্ঞাসা করিল–বাবাঠাকুর, আজকাল কাঁচামালের ব্যবসা করচেন নাকি?
–ব্যবসা এখনও করিনি, তবে করবো ভাবচি। সে তোমায় বলব একদিন।
গোয়ালপাড়া হইতে আসিবার পথে একটা খুব বড় বাঁশবনের মাঝখান দিয়া পথ। এখানে লোকজন নাই, এঁড়োশোলা গ্রামেই লোকজনের বসত নাই। আগে ছিল–ম্যালেরিয়ায় মরিয়া হাজিয়া লোকশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। শুধুই বড় বড় আম-কাঁঠালের বাগান ও বাঁশবনের জঙ্গল।
এই বাঁশবনের মধ্যে পুরোনো দিনে পালিত পাড়া ছিল, হাজারি বাল্যকালেও দেখিয়াছে। পালিতেরা বেশ বর্ধিষ্ণু ছিল গ্রামের মধ্যে, পূজাপার্বণ, দোল-দুর্গোৎসব পৰ্যন্ত হইয়াছে বাজেন পালিতের বাড়ী। এখন জঙ্গলের মধ্যে পালিতদের ভিটাটা পড়িয়া আছে এই পর্যন্ত। দিন মানেই বোধ হয় বাঘ লুকাইয়া থাকে।
বাঁশঝাড়ে কটকট করিয়া শুকনো বাঁশের শব্দ হইতেছে–ঘন ছায়া, শুকনো বাঁশপাতার ও সোলার শব্দ। ফিঙ্গে, শালিখ পাখীর কলরব। হাজারির মনে হইল, আজ যেন তার হোটেলের দাসত্ব-জীবন গতে মুক্তির দিন। সেই ভীষণ গরম উনুনের সামনে বসিয়া আজ আর তাকে ডেকচিতে ভাত-ডাল রান্না করিতে হইবে না। পদ্ম ঝিয়ের কড়া তাগাদা ও মুরুব্বিয়ানা সহ্য করিতে হইবে না। বাঁশবনের ছায়ায় পূর্ণ শান্তিতে সে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরিয়া ঘুমায়–তাহা হইলেও কেহ কিছু বলিতে পারিবে না।
এই মুক্তি সে ভাল ভাবেই আবাদ করিতে চায় বলিয়াই তো হোটেল খুলিবার কথা এত ভাবে।
সে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছে, এইবার কিছু টাকা হইলেই সে রাণাঘাটের বাজারে হোটেল খুলিয়া দিতে পারে।
হাজারি সত্যই চিন্তা করিতে আরম্ভ করিল, টাকা কোথায় ধার পাওয়া যাইতে পারে। এক গ্রামের গোসাঁইরা বড় লোক, কিন্তু তাহারা প্রায় সবাই থাকে কলিকাতায়। এখানে বৃদ্ধ কেশব গোসাঁই থাকেন বটে কিন্তু লোকটা ভয়ানক কৃপণ–তিনি কি হাজারির মত সামান্য লোককে বিনা বন্ধকে, বিনা জামিনে টাকা ধার দিবেন?
হাজারির জামিন হইবেই বা কে!
তাহার অবস্থা অত্যন্তই খারাপ। দু’খানা মাত্র চালাঘর। রান্নাঘরখানা গত বর্ষায় পড়িয়া গিয়াছে–পয়সা অভাবে সারানো হয় নাই, উঠানের আমতলায় রান্না হয়–বৃষ্টির দিন এখন ক্রমশঃ চলিয়া গেল, এখন তত অসুবিধা হয় না।
বেলা প্রায় পড়িয়া আসিয়াছে।
হাজারি বাড়ী ফিরিয়া দেখিল, তাহার ছোট মেয়ে টেঁপি ঘরের দাওয়ায় বসিয়া উল বুনিতেছে। টেঁপি বাবাকে দেখিয়া বলিল–তোমার জন্য আসন বুনচি বাবা-কাল তুমি যদি থাকো, কালকের মধ্যে হয়ে যাবে। তোমার সঙ্গে দিয়ে দেবো।
হাজারি মনে মনে হাসিল। বেচু চক্কত্তির হোটেলে সে রঙীন পশমের আসন পাতিয়া খাইতে বসিয়াছে–ছবিটি বেশ বটে। পদ্ম ঝি কি মন্তব্য করিবে তাহা হইলে?
মেয়েকে বলিল–দেখি কেমন আসন? বা বেশ হচ্ছে তো, কোথায় শিখলি তুই বুনতে?
টেঁপি বলিল–মুখুয্যে-বাড়ীর নীলা-দি আর অতসী-দি’র কাছে। আমি রোজ যাই দুপুরে, ওরা আমায় গান শেখায়, বোনা শেখায়।
–ওরা এখনও আছে? হরিচরণবাবু চলে যান নি এখনও?
–ওরা নাকি এ মাসটা থাকবে। থাকলে তো আমারই ভাল–আমি কাজটা শিখে নিতে পারি। কি চমৎকার গান গাইতে পারে অতসী-দি! আজ শুনবে বাবা?
–তুই গান শিখলি কিছু?
টেঁপি লাজুক স্বরে বলিল–দু-একটা। সে কিছু নয়। তুমি অতসী-দির গান যদি শোনো, তবে বলবে যে কলের গানের রেকর্ড শুনচি। ওদের বাড়ী খুব বড় কলের গানও আছে। রোজ সন্ধ্যের পর বাজায়। কত রকমের গান আছে–যাবে শুনতে সন্ধ্যের পর? অতসী-দি নিজে কল বাজায়। আমিও যাবো তোমার সঙ্গে–অতসী-দিকে বলবো বাবা এসেছে, ভালো ভালো বেছে গান দেবে।
হাজারি বলিল–হ্যাঁরে, হরিচরণবাবুর শরীর সেরেচে জানিস?
–তা তো জানিনে, তবে তিনি বৈঠকখানায় বসে রোজই তো সবার সঙ্গে গল্প করেন। একদিন বৈঠকখানায় কলের গান বাজিয়েছিলেন। কি চমৎকার কীৰ্ত্তন!
সঙ্গীত-শিল্পের প্রতি বর্তমানে হাজারির তত আগ্রহ নাই, হাজারির উদ্দেশ্য হরিচরণবাবুকে বলিয়া কহিয়া অন্ততঃ শ’দুই টাকা ধার করা যায় কিনা, সেদিকে।
হরিচরণ মুখুয্যে মহাশয় এ গাঁয়ের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন ও সম্ভ্রান্ত লোক। তাঁহারা এ গ্রামের জমিদার–কিন্তু অনেক দিন হইতেই গ্রাম ছাড়িয়াছেন। প্রকাণ্ড তিন-মহলা বাড়ী পড়িয়া আছে, দু-একজন বৃদ্ধা পিসী-মাসী ছাড়া বাড়ীতে আর কেহ এতদিন ছিল না।
আজ মাস চার-পাঁচ হইল হরিচরণ মুখুয্যের একমাত্র পুত্র কলিকাতায় মারা যায় বসন্ত রোগে। পুত্রের মৃত্যুর পর হইতেই আজ প্রায় তিন মাস হইল হরিচরণবাবু সপরিবারে দেশের বাটীতে আসিয়া যে কেন বাস করিতেছেন–সে খবর হাজারি রাখে না। তবে ইহা জানে যে, হরিচরণবাবু গ্রামের উত্তর মাঠে একটি দীঘি খনন করিবার জন্য জেলা বোর্ডের হাতে অনেকগুলি টাকা দান করিয়াছেন এবং পুত্রের নামে একটি ডিসপেনসারী করিয়া দিবেন গ্রামে। হরিচরণবাবু কারো বাড়ী যান না। নিজের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন সব সময়। তার দুই মেয়ে ও স্ত্রী এখানেই, তাছাড়া চাকর-বাকর ও দু’জন দরোয়ান আছে বাড়ীতে।