অপু জিজ্ঞাসা করিল—কেন, সুরেশদা কিছু বললেন না?
—আহা, সে আগেই বলি নি? সে শ্বশুরবাড়ির বিষয় পেয়ে সেখানেই বাস করছে, সেই রাজশাহী না দিনাজপুর। সে একখানা পত্র দিয়েও খোঁজ করে না, মা আছে কি মলো। তবে আব তোমাকে বলছি কি? সুরেশ কলকাতায় থাকলে কি আর কথা ছিল বাবা?
অপুকে খাইতে দিয়া গল্প করিতে করিতে তিনি বলিলেন, ও ভুলে গিয়েছি তোমাকে বলতে, আমাদের নিশ্চিন্দিপুরের ভুবন মুখুজ্যের মেয়ে লীলা যে কাশীতে আছে, জানো না?
অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল লীলাদি! নিশ্চিন্দিপুরের? কাশীতে কেন?
জ্যাঠাইমা বলিলেন—ওর ভাসুর কি চাকরি করে এখানে। বড়ো কষ্ট মেয়েটার, স্বামী তো আজ দুসাত বছর পক্ষাঘাতে পঙ্গু, বড়ো ছেলেটা কাজ না পেয়ে বসে আছে, আরও চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে সবসুদ্ধ, ভাসুরের সংসারে ঘাড় গুঁজে থাকে। যাও না, দেখা করে এসো আজ বিকেলে, কালীতলার গলিতে ঢুকেই বাঁদিকে বাড়িটা।
বাল্যজীবনের সেই রানুদির বোন লীলাদি! নিশ্চিন্দিপুরের মেয়ে। বৈকাল হইতে অপুর দেরি সহিল না, জ্যাঠাইমার বাড়ি হইতে বাহির হইয়াই সে কালীতলার গলি খুঁজিয়া বাহির করিল—সরু ধরনের তেতলা বাড়িটা। সিঁড়ি যেমন সংকীর্ণ তেমনি অন্ধকার, এত অন্ধকার যে পকেট হইতে দেশলাই-এর কাঠি বাহির করিয়া না জ্বালাইয়া সে এই বেলা দুইটার সময়ও পথ খুঁজিয়া পাইতেছিল না!
একটা ছোট দুয়ার পার হইয়া সরু একটা দালান। একটি দশ-বারো বছরের ছেলের প্রশ্নের উত্তরে সে বলিল, এখানে কি নিশ্চিন্দিপুরের লীলাদি আছেন? আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি বলে গিয়ে। অপুর কথা শেষ না হইতে পাশের ঘর হইতে নারীকণ্ঠের প্রশ্ন শোনা গেল, কে রে খোকা? সঙ্গে সঙ্গে একটি পাতলা গড়নের গৌরবর্ণ মহিলা.দরজার চৌকাঠে আসিয়া দাঁড়াইলেন, পরনে আধময়লা শাড়ি, হাতে শাখা, বয়েস বছর সাইত্রিশ, মাথায় একরাশ কালো চুল। অপু চিনিল, কাছে গিয়া পায়ের ধুলা সইয়া প্রণাম করিয়া হাসিমুখে বলিল, চিনতে পারো শীলাদি?
পরে লীলা তাহার মুখের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে এবং চিনিতে পারে নাই দেখিয়া বলিল, আমার নাম অপু, বাড়ি নিশ্চিন্দিপুরে ছিল আগে।
লীলা তাড়াতাড়ি আনন্দের সুরে বলিয়া উঠিল-ও! অপু, হরিকাকার ছেলে! এসো, এসো ভাই, এসো। পরে সে অপুর চিবুক স্পর্শ করিয়া আদর করিল এবং কি বলিতে গিয়া ঝর ঝর্ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
অদ্ভুত মুহূর্ত! এমন সব অপূর্ব, সুপবিত্র মুহূর্তও জীবনে আসে। লীলাদির ঘনিষ্ঠ আদরটুকু অপুর সারা শরীরে একটা স্নিগ্ধ আনন্দের শিহরণ আনিল। গ্রামের মেয়ে, তাহাকে ছোট দেখিয়াছে, সে ছাড়া এত আপনার জনের মতো অন্তরঙ্গতা কে দেখাইতে পারে? লীলাদি ছিল তাহাদের ধনী প্রতিবেশী ভুবন মুখুজ্যের মেয়ে, বয়সে তাহার অপেক্ষা অনেক বড়ো, অল্প বয়সে বিবাহ হইয়াছিল, তারপরেই শশুরবাড়ি চলিয়া আসিয়াছিল ও সেইখানেই থাকিত। শৈশবে অল্পদিন মাত্র উভয়ের সাক্ষাৎ কিন্তু আজ অপুর মনে হইল লীলাদির মতো আপনার জন সারা কাশীতে আর কেহ নাই। শৈশব স্বপ্নের সেই নিশ্চিন্দিপুর, তারই জলে বাতাসে দুজনের দেহ পুষ্ট ও বর্ধিত হইয়াছে একদিন।
তারপর লীলা অপুর জন্য আসন আনিয়া পাতিয়া দিল, দালানেই পাতিল, ঘরদোর বেশি নাই, বিশেষ করিয়া পরের সংসার, নিজের নহে। সে নিজে কাছে বসিল, কত খোঁজখবর লইল। অপুর বারণ সত্ত্বেও ছেলেকে দিয়া জলখাবার আনাইল, চা করিয়া দিল।
তারপর লীলা নিজের অনেক কথা বলি। বড়ো ছেলেটি চৌদ্দ বছরের হইয়া মারা গিয়াছে, তাহার উপর সংসারে এই দুর্দশা। উনি পক্ষাঘাতে পঙ্গু, ভাসুবেব সংসারে চোর হইয়া থাকা, ভাসুর লোক মন্দ নন, কিন্তু বড়ো জা-পায়ে কোটি কোটি দণ্ডবৎ। দুর্দশার একশেষ। সংসারের যত উঞ্ছ কাজ সব তাহার ঘাড়ে, আপন জন কেহ কোথাও নাই, বাপের বাড়িতে এমন কেহ নাই যাহার কাছে দুই দিন আশ্রয় লইতে পারে। সতু মানুষ নয়, লেখাপড়া শেখে নাই, গ্রামে মুদির দোকান করে, পৈতৃক সম্পত্তি একে একে বেঁচিয়া খাইতেছে—তাহার উপর দুইটি বিবাহ করিয়াছে, একরাশ ছেলেপিলে। তাহার নিজেরই চলে না, লীলা সেখানে আর কি কবিয়া থাকে।
অপু বলিল—দুটো বিয়ে কেন?
—পেটে বিদ্যে না থাকলে যা হয়। প্রথম পক্ষের বৌয়ের বাপের সঙ্গে কি ঝগড়া হল, তাকে জব্দ করার জন্যে আবার বিয়ে করলে। এখন নিজেই জব্দ হচ্ছেন, দুই বৌ ঘাড়ে তার ওপর দুই বৌয়ের ছেলেপিলে। তার ওপর রানুও ওখানেই কিনা!
–রানুদি? ওখানে কেন?
–তারও কপাল ভালো নয়। আজ বছর সাত-আট বিধবা হয়েছে, তার আর কোনও উপায় নেই, সতুর সংসারেই আছে। শ্বশুরবাড়িতে এক দেওর আছে, মাঝে মাঝে নিয়ে যায়, বেশির ভাগ নিশ্চিন্দিপুরেই থাকে।
অপু অনেকক্ষণ ধরিয়া রানুদির কথা জিজ্ঞাসা করিবে ভাবিতেছিল, কিন্তু কেন প্রশ্নটা করিতে পারে নাই সে-ই জানে। লীলার কথার পরে অপু অন্যমনস্ক হইয়া গেল। হঠাৎ লীলা বলিল—দ্যাখ ভাই অপু, নিশ্চিন্দিপুরের সেই বাঁশবাগানের ভিটে এত মিষ্টি লাগে, কি মধু যে মাখানো ছিল তাতে! ভেবে দ্যাখ, মা নেই, বাবা নেই, কিছু তো নেই, তবুও তার কথা ভাবি। সেই বাপের ভিটে আজ দেখি নি এগারো বছর। সেবার সতুকে চিঠি লিখলাম, উত্তর দিলে এখানে কোথায় থাকবে, থাকবার ঘরদোর নেই, পুবের দালান ভেঙে পড়ে গিয়েছে, পশ্চিমের ইরি দুটোও নেই, ছেলেপিলে কোথায় থাকবে,–এই সব একরাশ ওজর। বলি থাক তবে, ভগবান যদি মুখ তুলে চান কোনদিন, দেখব নয় তো বাবা বিশ্বনাথ তো চরণে রেখেছেন–