কুঠির অনেক চাকর-বাকর জবাব হয়ে গিয়েচে, সামান্য কিছু পাইক পেয়াদা আছে এই মাত্র। লাঠিয়ালের দল বহুদিন আগে অন্তর্হিত। ওদিকের বাগানগুলো লতাজঙ্গলে নিবিড় ও দুষ্প্রবেশ্য। দিনমানেও সাপের ভয়ে কেউ ঢোকে না। সেদিন একটা গোখুরা সাপ মারা পড়েছিল কুঠির পশ্চিম দিকের হাতার ঘন ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে।
পুরোনো চাকর-বাকরদের মধ্যে আছে কেবল কুঠির বহু পুরোনো রাঁধুনী ঠাকুর বংশীবদন মুখুয্যে–দেওয়ানজি ও অন্যান্য কর্মচারীর ভাত রাঁধে।
ময়নার মেয়ে শিবি বললেও দাদু, ও দেওয়ানদাদু, সায়েবদের নাকি নাইবার ঘর ছিল? আমি দেখবো
তখন দেওয়ান হরকালী সুর নিজে সঙ্গে করে ওদের সকলকে নিয়ে গেলেন বড় গোসলখানায়। সেখানে একটা বড় টব দেখে তো সকলে অবাক। ময়নার মেয়ের ইচ্ছে ছিল এই টবে সে একবার নেমে দেখবে কি করে সায়েবরা নাইতো–মুখ ফুটে কথাটা সে বলতে পারলে না। অনেকক্ষণ ধরে ওরা আসবাবপত্তর দেখলে, হাতে করে নাড়লে, টিপে টিপে দেখলে।
সায়েবরা এত জিনিস নিয়ে কি করত?
বেলা পড়লে ওরা যখন চলে এসে গাড়িতে উঠলো, কুঠির কর্মচারীরা সসম্ভমে গাড়ি পর্যন্ত এসে ওদের এগিয়ে দিয়ে গেল।
.
রাত্রে খেটেপুটে এসে লালমোহন পাল পশ্চিম দিকের চারচালা বড় ঘরের কাঁঠালকাঠের তক্তপোশে শুয়েচে, তুলসী ডিবেভর্তি পান এনে শিয়রের বালিশের কাছে রেখে দিয়ে বললে–কুঠি দেখে এ্যালাম আজ।
লালমোহন পাল একটু অন্যমনস্ক, আড়াইশো ছালা গাছতামাকের। বায়না করা হয়েছিল ভাজনঘাট মোকামে, মালটা এখনো এসে পৌঁছোয় নি, একটু ভাবনায় পড়েছে সে। তুলসী উত্তর না পেয়ে বলে–কি ভাবচো?
–কিছু না।
–ব্যবসার কথা ঠিক!
–ধরো তাই।
–আজ কুঠি দেখতি গিয়েছিলাম, দেখে এ্যালাম।
–কি দেখলে?
–বাবাঃ, সে কত কি! তুমি দেখেচ গা?
–আমি? আমার বলে মরবার ফুরসুত নেই, আমি যাবো কুঠির জিনিস দেখতি! পাগল আছো বড়বৌ, আমরা হচ্ছি ব্যবসাদার লোক, শখ-শৌখিনতা আমাদের জন্যি না। এই দ্যাখো, ভজনঘাটের তামাক আসি নি, ভাবচি।
-হ্যাঁগা, আমার একটা সাধ রাখবা?
তুলসী নবছরের মেয়ের মতো আবদারের সুরে কথা শেষ করে হাসি-হাসি মুখে স্বামীর কাছে এগিয়ে এল।
লালমোহন পাল বিরক্তির সুরে বললে–কি?
অভিমানের সুরে তুলসী বলে–রাগ করলে গা? তবে বলবো নি।
-বলোই না ছাই!
–না।
–লক্ষি দিদি আমার, বলো বলো—
–ওমা আমার কি হবে! তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেচে, ও আবার কি কথা! অমন বলতি আছে? ব্যবসা করে টাকা আনতিই শিখেচো, ভদ্দরলোকের কথাও শেখো নি, ভদ্দরলোকের রীতনীত কিছুই জানো না। ইস্ত্রিকে আবার দিদি বলে কেড়া।
লালমোহন বড় অপ্রতিভ হয়ে গেল। সে সত্যিই অন্যমনস্ক ছিল, বললে–কি করতি হবে বলো বড়বৌ
জরিমানা দিতি হবে
–কত?
–আমার একটা সাধ আছে, মেটাতি হবে। মেটাবে বলো?
–কি?
শীত আসচে সামনে, গাঁয়ের সব গরিব দুঃখী লোকদের একখানা করে রেজাই দেবো আর বামুনঠাকুরদের সবাইকে জোনাজাৎ একখানা করে বনাত দেবো। কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন।
গরিবদের রেজাই দেওয়া হবে, কিন্তু বামুনরা তোমার দান নেবে না। আমাদের গাঁয়ের ঠাকুরদের চেনো না? বেশ, আমি আগে দেখি একটা ইস্টিমিট করে। কত খরচ লাগবে। কলকাতা থেকে মাল আনাতি লোক পাঠাতি হবে, তার পরে।
–আর একটা কথা
–কি?
–এক বুড়ো বামুনের চাকরি ছাড়িয়ে দিয়েচে দেওয়ানমশাই কুঠি থেকে। তার নাম প্রসন্ন চক্কত্তি। বলেছেন, তোমার আর কোনো দরকার
–এসে ধরেচে বুঝি তোমায়? এ তোমার অন্যায় বড়বৌ। কুঠির কাজ আমি কি বুঝি? কাজ নেই তাই জবাব হয়ে গিয়েচে। কাজ না থাকলি বসে মাইনে গুনতি হবে?
–হ্যাঁ হবে। এ বয়সে তিনি এখন যাবেন কোথায় জিজ্ঞেস করি? কেডা চাকরি দেবে?
নালু পাল বিরক্তির সুরে বললে–ছেলেমানুষ তুমি, এসবের মধ্যি থাকো কেন? তুমি কি বোঝো কাজের বিষয়? টাকাটা ছেলের হাতের মোয়া পেয়েচ, না? বললিই হোলো? কেন তোমার কাছে সে আসে জিজ্ঞেস করি? বিটলে বামুন!
তুলসী ধীর সুরে বললে–দ্যাখো, একটা কথা বলি। অমন যা-তা কথা মুখে এনো না। আজ দুটো টাকা হয়েচে বলে অতটা বাড়িও না।
লালমোহন পাল বললে–কি আর বাড়ালাম আমি? আমি তোমাকে বললাম, নীলকুঠির কাজ আমি কি বুঝি! দেওয়ান যা করেন, তার ওপর তোমার আমার কথা বলা তো উচিত নয়। তুমি মেয়েমানুষ, কি বোঝো এ সবের? কাজের দস্তুর এই।
–বেশ, কাজ তুমি দ্যাও আর না দ্যাও গিয়ে–যা-তা বলতি নেই লোককে। ওতে লোকে ভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েচে, আজ তাই বড্ড অংখার। ছিঃ
তুলসী রাগ করে অপ্রসন্ন মুখে উঠে চলে গেল।
এ হল বছর দুই আগের কথা। তারপর প্রসন্ন চক্কত্তি আমিন কোথায় চলে গেল এতকালের কাছারি ছেড়ে। উপায়ও ছিল না। হরকালী সুর কর্মচারী ছাঁটাই করেছিলেন জমিদারের ব্যয়সঙ্কোচ করবার জন্যে। কে কোথায় ছড়িয়ে পড়লো তার ঠিক ছিল না। ভজা মুচি সহিস ও বেয়ারা শ্রীরাম মুচির চাকরি গেলে চাষবাস করতো। ও বছর শ্রাবণ মাসে মোল্লাহাটির হাট থেকে ফেরবার পথে অন্ধকারে ওকে সাপে কামড়ায়, তাতেই সে মারা যায়।
নীলকুঠির বড়সাহেবের বাংলোর সামনে আজকাল লালমোহন পালের ধানের খামার। খাসজমি দেড়শো বিঘের ধান সেখানে পৌষ মাসে ঝাড়া হয়, বিচালির আঁটি গাদাবন্দি হয়, যে বড় বারান্দাতে সাহেবরা ছোট হাজরি খেতো সেখানে ধান-ঝাড়াই কৃষাণ এবং জন মজুরেরা বসে দাকাটা তামাক খায় আর বলাবলি করে–সমুন্দির। সায়েবগুলো এই ঠানটায় বসে কত মুরগির গোস্ত ধুনেছে আর ইঞ্জিরি বলেচে। ইদিকি কোনো লোকের ঢোকবার হুকুম ছেলো না আর। আজ সেখানডাতে বসে ওই দ্যাখো রজবালি দাদ চুলকোচ্ছে!..
৭. নতুন লতাপাতার বংশ
বিকেলবেলা খোকাকে নিয়ে ভবানী বাঁড়ুয্যে গেলেন রামকানাই কবিরাজের ঘরে।