নিলু বললে–এবার শুইয়ে দিন। আহা মরে যাই, সোনামণি আমার শুইয়ে দিন, ওর লাগচে। দিদি কিছু বলবে না আপনার সামনে।
খোকাকে শুইয়ে দিয়ে হঠাৎ ভবানীর মনে হল, ঠিক হয়েচে, শিশুর সৌন্দর্য বুঝবার পক্ষে তার বাপ-মাকে বাদ দিলে চলবে কেন? শিশু এবং তার বাপ-মা একই স্বর্ণসূত্রে গাঁথা মালা। এরা পরস্পরকে বুঝবে। পরস্পর পরস্পরকে ভালো বলবে–সৃষ্টির বিধান এই। নিজেকে বাদ দিলে চলবে না। এও বেদান্তের সেই অমর বাণী, দশমস্তমসি। তুমিই দশম। নিজেকে বাদ দিয়ে গুনলে চলবে কেন?
তার পরদিন সকালে এল হলা পেকে, তার সঙ্গে এল হলা পেকের অনুচর দুর্ধর্ষ ডাকাত অঘোর মুচি। অঘোর মুচিকে তিলুরা তিন বোনে দেখে খুব খুশি। অঘোর ওদের কোলে করে মানুষ করেচে ছেলেবেলায়।
তিলু বললে–এসো অঘোর দাদা, জেল থেকে কবে এলে?
অঘোর বললে–কাল এ্যালাম দিদিমণিরা। তোমাদের দেখতি এ্যালাম, আর বলি সন্নিসি ঠাকুরকে দেখে একটা পেরনাম করে আসি। গঙ্গাচ্যানের ফল হবে। কোথায় তিনি?
–তিনি বাড়ি থাকেন কারো? ওই বাঁশতলায় ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন দ্যাখো গিয়ে। অঘোর দাদা বোসো, কাঁটাল খাবা। তোমরা দুজনেই বোসো।
–খোকনকে দেখবো দিদিমণি। আগে সন্নিসিঠাকুরকে দণ্ডবৎ করে আসি। বাঁশতলার আসনে চৈতন্যভারতী চুপ করে বসেছিলেন। ধুনি জ্বালানো ছিল না। হলা পেকে আর অঘোর মুচি গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল।
সন্ন্যাসী বললেন–কে?
–মোরা, বাবা।
হলা পেকে বললে–এ আমার শাকরেদ, অঘোর। গারদ থেকি কাল খালাস পেয়েছে। এই গাঁয়েই বাড়ি।
–জেল হয়েছিল কেন?
–আপনার কাছে নুকুবো কেন বাবা। ডাকাতি করেলাম দুজনে। দুজনেরই হাজত হয়েল।
–খুব শক্তি আছে তোমাদের দুজনেরই। ভালো কাজে সেটা লাগালে দোষ কি?
–দোষ কিছু নেই বাবা। হাত নিশপিশ করে। থাকতি পারি নে।
চৈতন্যভারতী বললেন–হাত নিশপিশ করুক। যে মনটা তোমাকে ব্যস্ত করে, সেটা সর্বদা সৎকাজে লাগিয়ে রাখো। মন আপনিই ভালো হবে।
হলা পেকে বসে বসে শুনলে। অঘোর মুচির ওসব ভালো লাগছিল। না। সে ভাবছিল তিলু দিদিমণির কাছ থেকে একখানা পাকা কাঁঠাল চেয়ে নিয়ে খেতে হবে। এমন সময় নিলু সেখানে এসে ডাকলেও সন্নিসি দাদা
চৈতন্যভারতী বললেন–কি দিদি?
–পাকা কলা আর পেঁপে নিয়ে আসবো? ছ্যান হয়েচে?
–না হয় নি। তুমি নিয়ে এসো, এতে কোনো আপত্তি নেই। আচ্ছা। এ দেশে ছ্যা করা বলে কেন?
–কি বলবে?
–কিছু বলবে না। তুমি যাও, যশুরে বাঙাল সব কোথাকার! নিয়ে এসো কি খাবার আছে।
–অমনি বললি আমি কিন্তু আনবো না সেটুকু বলে দিচ্চি দাদা।
হলা পেকে দাঁড়িয়ে উঠে বললে–তা হলে মুই রণ-পা পরি?
সন্ন্যাসী হেসে বললেন–রণ-পা পরে কি হবে?
–আপনার জন্যি কলা-মুলো সংগেরো করে নিয়ে আসি। নিলু দিদি তো চটে গিয়েচে।
অঘোর মুচি বললে–মোর জন্য একখানা পাকা কাঁটাল। ও দিদিমণি, বড্ড খিদে নেগেছে।
নিলু বললে–যাও বাড়ি গিয়ে বড়দিদি বলে ডাক দিয়ো। বড়দি দেবে এখন।
–না দিদি, তুমি চলো। বড়দি এখুনি বকবে এমন। গারদ খেটে এসিচিকেন গিইছিলি, কি করিছিলি, সাত কৈফিয়ৎ দিতে হবে। আর সবাই তো জানে, মুই চোর ডাকাত। খাতি পাই নে তাই চুরি ডাকাতি করি, খাতি পেলি কি আর করতাম। গেরামে এসে যা দেখচি। চালের কাঠা দু আনা দশ পয়সা। তাতে আর কিছুদিন গারদে থাকলি হত ভালো। খাবো কেমন করে অত আক্ৰা চালের ভাত? ছেলেপিলেরে বা কি খাওয়াবো। কি বলেন বাবাঠাকুর?
সন্নিসি বললেন–যা ভালো বোঝো তাই করবে বাবা। তবে মানুষ খুন করো না। ওটা করা ঠিক নয়।
হলা পেকে এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। মানুষ খুনের কথায় সে এবার চাঙ্গা হয় উঠলো। হলা আসলে হল খুনী। অনেক মুণ্ডু কেটেছে। মানুষের খুনের কথা পাড়লে সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
চৈতন্যভারতীর সামনে এসে বললে–জোড়হাত করি বাবাঠাকুর। কিছু মনে করবেন না। একটা কথা বলি শুনুন। পানচিতে গাঁয়ের মোড়লবাড়ি সেবার ডাকাতি করতে গেলাম। যখন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠচি, তখন ছোট মোড়ল মোরে আটকালে। ওর হাতে মাছমারা কোঁচ। এক লাঠির ঘায়ে কোঁচ ছুঁড়ে ফেলে দেলাম–আমার সামনে লাঠি ধরতি পারবে কেন ছেলেছোকরা? তখন সে ইট তুলি মারতি এল। আমি ওরে বললাম আমার সঙ্গে লাগতি এসো না, সরে যাও। তা তার নিয়তি ঘুনিয়ে এসেছে, সে কি শোনে? আমায় একটা খারাপ গালাগালি দেলে। সঙ্গে সঙ্গে এক লাঠিতে ওর মাথাটা দোফাঁক করে দেলাম। উল্টে পড়লো গড়িয়ে সিঁড়ির নিচে, কুমড়ো গড়ান দিয়ে।
নিলু বললে–ইস্ মাগো!
চৈতন্যভারতী মশায় বললেন–তারপর?
–তারপর শুনুন আশ্চয্যি কাণ্ড। বড় মোড়লের পুতের বৌ, দিব্যি দশাসই সুন্দরী, মনে হোলো আঠারো-কুড়ি বয়স–চুল এলো করে দিয়ে এই লম্বা সড়কি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দোতলার মুখি সিঁড়ির নিচে, যেখান থেকে চাপা সিঁড়ি ফেলবার দরজা।
ভারতী মশায় অনেকদিন ঘরছাড়া, জিজ্ঞেস করলেন–চাপা সিঁড়ি কি?
নিলু বললে–চাপা সিঁড়ি দেখেন নি? আমার বাপের বাড়ি আছে, দেখাব। সিঁড়িতে ওঠবার পর দোতলায় যেখানে গিয়ে পা দেবেন, সেখান থেকে চাপা সিঁড়ি মাথার ওপর দিয়ে ফেলে দেয়। সে দরজার কবাট থাকে মাথার ওপর। তা হলে ডাকাতেরা আর দোতলায় উঠতি পারে না।
–কেন পারবে না?
হলা পেকে উত্তর দিলে এ কথার। বললে–আপনাকে বুঝিয়ে বলতি পারলে না দিদিমণি। চাপা সিঁড়ি চেপে ফেলে দিলি আর দোতলায় ওঠা যায় না। বড় কঠিন হয়ে পড়ে। এমনি সিঁড়ি যা, তার মুখের কবাট জোড়া কুড়ল দিয়ে চালা করা যায়, চাপা সিঁড়ির কবাট মাথার ওপর থাকে, কুড়ুল দিয়ে কাটা যায় না। বোঝলেন এবার?