আমি হর্ষোৎফুল্ল লোচনে তরলিকার হস্ত হইতে পত্রিকা গ্রহণ করিলাম। তাহাতে লিখিত ছিল, হংস যেমন মুক্তামালায় মৃণালভ্রমে প্রতারিত হয়, তেমনি আমার মন মুক্তাময় একাবলীমালায় প্রতারিত হইয়া তোমার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত হইয়াছে। পথভ্রান্ত পথিকের দিগ্ভ্রম, মূকের জিহ্বাচ্ছেদ, অসম্বদ্ধভাষীর জ্বরপ্রলাপ, নাস্তিকের চার্ব্বাকশাস্ত্র, উন্মত্তের সুরাপান যেরূপ ভয়ঙ্কর, পত্রিকাও আমার পক্ষে সেইরূপ ভয়ঙ্কর বোধ হইল। পত্রিকা পাঠ করিয়া উন্মত্ত ও অবশেন্দ্রিয় হইলাম। পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, তরলিকে! তুমি তাঁহাকে কোথায় কি রূপে দেখিলে? তিনি কি কহিলেন? তুমি তথায় কতক্ষণ ছিলে? তিনি আমাদের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়া কত দূর পর্য্যন্ত আসিয়াছিলেন? প্রিয়জনসম্বদ্ধ এক কথাও বারংবার বলিতে ও শুনিতে ভাল লাগে। আমি পরিজনদিগকে তথা হইতে বিদায় করিয়া কেবল তরলিকার সহিত মুনিকুমারসম্বদ্ধ কথায় দিবসক্ষেপ করিলাম।
২.০৬ দিবাবসানে দিবাকরের বিরহে
দিবাবসানে দিবাকরের বিরহে পূর্ব্ব দিক্ আমার ন্যায় মলিন হইল। মদীয় হৃদয়ের ন্যায় পশ্চিম দিকের রাগ বৃদ্ধি হইতে লাগিল। দুই এক দণ্ড বেলা আছে এমন সময়ে ছত্রধারিণী আসিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আমরা স্নান করিতে গিয়া যে দুই জন মুনিকুমার দেখিয়াছিলাম, তাঁহাদের এক জন দ্বারে দণ্ডায়মান আছেন। বলিলেন, অক্ষমালা লইতে আসিয়াছি। মুনিকুমার, এই শব্দ শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া কহিলাম, শীঘ্র সঙ্গে করিয়া লইয়া আইস। যেরূপ রূপের সহায় যৌবন, যৌবনের সহায় মকরকেতন, মকরকেতনের সহায় বসন্তকাল, বসন্তকালের সহায় মলয়পবন, সেইরূপ তিনি পুণ্ডরীকের সখা, নাম কপিঞ্জল, দেখিবামাত্র চিনিলাম। তাঁহার বিষণ্ণ আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন অভিপ্রায়ে আমাকে কিছু বলিতে আসিয়াছেন। আমি উঠিয়া প্রণাম করিয়া সমাদরে আসন প্রদান করিলাম। আসনে উপবেশন করিলে চরণ ধৌত করিয়া দিলাম। অনন্তর কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়া আমার নিকটে উপবিষ্ট তরলিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে আমি তাঁহার দৃষ্টিতেই অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া বিনয়বাক্যে কহিলাম, ভগবন্! আমা হইতে ইহাকে ভিন্ন ভাবিবেন না। যাহা আদেশ করিতে অভিলাষ হয় অশঙ্কিত ও অসঙ্কুচিত চিত্তে আজ্ঞা করুন।
কপিঞ্জল কহিলেন, রাজপুত্ত্রি! কি কহিব, লজ্জায় বাক্যস্ফূর্ত্তি হইতেছে না। কন্দমূলফলাশী বনবাসীর মনে অনঙ্গবিলাস সঞ্চারিত হইবে ইহা স্বপ্নের অগোচর। শান্তস্বভাব তাপসকে প্রণয়পরবশ করিয়া বিধি কি বিড়ম্বনা করিলেন! দগ্ধ মন্মথ অনায়াসেই লোকদিগকে উপহাসাস্পদ ও অবজ্ঞাস্পদ করিতে পারে। অন্তঃকরণে একবার অনঙ্গবিলাস সঞ্চারিত হইলে আর ভদ্রতা নাই। তখন প্রগাঢ় ধীশক্তিসম্পন্ন লোকেরাও নিতান্ত অসার ও অপদার্থ হইয়া যান। তখন আর লজ্জা, ধৈর্য্য, বিনয়, গাম্ভীর্য্য কিছুই থাকে না। বন্ধু যে পথে পদার্পণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, জানি না, উহা কি বল্কলধারণের উপযুক্ত, কি জটাধারণের সমুচিত, কি তপস্যার অনুরূপ, কি ধর্ম্মের অঙ্গ, কি অপবর্গ লাভের উপায়! কি দৈবদুর্ব্বিপাক উপস্থিত! না বলিলে চলে না, উপায়ান্তর ও শরণান্তরও দেখি না, কি করি বলিতে হইল। শাস্ত্রকারেরা লিখিয়াছেন, স্বীয় প্রাণবিনাশেও যদি সুহৃদের প্রাণরক্ষা হয় তথাপি তাহা কর্ত্তব্য; সুতরাং আমাকে লজ্জায় জলাঞ্জলি দিতে হইল।
তোমার সমক্ষে রোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ পূর্ব্বক বন্ধুরে সেই প্রকার তিরস্কার করিয়া আমি তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। স্নানানন্তর সরোবর হইতে উঠিয়া তুমি বাটী আসিলে ভাবিলাম, বন্ধু এক্ষণে একাকী কি করিতেছেন গুপ্ত ভাবে এক বার দেখিয়া আসি। অনন্তর আস্তে আস্তে আসিয়া বৃক্ষের অন্তরাল হইতে দৃষ্টিপাত করিলাম; কিন্তু তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। তৎকালে আমার অন্তঃকরণে কত বিতর্ক, কত সন্দেহ ও কতই বা ভয় উপস্থিত হইল। একবার ভাবিলাম, অনঙ্গের মোহন শরে মুগ্ধ হইয়া বন্ধু বুঝি, সেই কামিনীর অনুগামী হইয়া থাকিবেন। আবার মনে করিলাম সেই সুন্দরীর গমনের পর চৈতন্যোদয় হওয়াতে লজ্জায় আমাকে মুখ দেখাইতে না পারিয়া বুঝি কোন স্থানে লুকাইয়া আছেন; কি আমি ভর্ৎসনা করিয়াছি বলিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া কোন স্থানে প্রস্থান করিয়াছেন; কিংবা আমাকেই অন্বেষণ করিতেছেন। আমরা দুই জনে চিরকাল একত্র ছিলাম; কখন পরস্পর বিরহদুঃখ সহ্য করিতে হয় নাই। সুতরাং বন্ধুকে না দেখিয়া যে কত ভাবনা উপস্থিত হইল তাহা বাক্য দ্বারা ব্যক্ত করা যায় না। পুনর্ব্বার চিন্তা করিলাম, বন্ধু আমার সমক্ষে সেই রূপ অধীরতা প্রকাশ করিয়া অতিশয় লজ্জিত হইয়া থাকিবেন। লজ্জায় কে কি না করে। কত লোক লজ্জার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত কত অসদুপায় অবলম্বন করে। জলে, অনলে ও উদ্বন্ধনেও প্রাণত্যাগ করিয়া থাকে; যাহা হউক, নিশ্চিন্ত থাকা হইবে না অন্বেষণ করি। ক্রমে তরুলতাগহন, চন্দনবীথিকা, লতামণ্ডপ, সরোবরের কূল সর্ব্বত্র অন্বেষণ করিলাম, কুত্রাপি দেখিতে পাইলাম না; তখন স্নেহকাতর মনে অনিষ্ট শঙ্কাই প্রবল হইয়া উঠিল।
পুনর্ব্বার সতর্কতা পূর্ব্বক ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে করিতে দেখিলাম সরোবরের তীরে নানাবিধলতাবেষ্টিত নিভৃত এক লতাগহনের অভ্যন্তরবর্ত্তী শিলাতলে বসিয়া বাম করে বাম গণ্ড সংস্থাপন পূর্ব্বক চিন্তা করিতেছেন। দুই চক্ষু মুদ্রিত, নেত্রজলে কপোলযুগল ভাসিতেছে। ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতেছে। শরীর স্পন্দরহিত, কান্তিশূন্য ও পাণ্ডুবর্ণ। হঠাৎ দেখিলে চিত্রিতের ন্যায় বোধ হয়; এরূপ জ্ঞানশূন্য যে, কল্পপাদপের কুসুমমঞ্জরীর অবশিষ্টরেণুগন্ধলোভে ভ্রমর ঝঙ্কার পূর্ব্বক বারংবার কর্ণে বসিতেছে এবং লতা হইতে কুসুম ও কুসুমরেণু গাত্রে পড়িতেছে তথাপি সংজ্ঞা নাই, কলেবর এরূপ শীর্ণ যে সহসা চিনিতে পারা যায় না। তদবস্থাপন্ন তাঁহাকে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া অতিশয় বিষণ্ণ হইলাম। উদ্বিগ্ন চিত্তে চিন্তা করিলাম মকরকেতুর কি প্রভাব! যে ব্যক্তি উহার শরসন্ধানের পথবর্ত্তী হয় নাই সেই ধন্য ও নিরুদ্বেগে সংসারযাত্রা সংবরণ করিয়া থাকে। এক বার উহার বাণপাতের সম্মুখবর্ত্তী হইলে আর কোন জ্ঞান থাকে না। কি আশ্চর্য্য! ক্ষণকালের মধ্যে এরূপ জ্ঞানরাশি ঈদৃশ অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইয়াছেন। ইনি শৈশবাবধি ধীর ও শান্তপ্রকৃতি ছিলেন। সকলে আদর্শস্বরূপ জ্ঞান করিয়া ইঁহার স্বভাবের অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিত ও গুণের কথা উল্লেখ করিয়া যথেষ্ট প্রশংসা করিত। আজি কি রূপে বিবেকশক্তি ও তপঃপ্রভাবের পরাভব করিয়া এবং গাম্ভীর্য্যের উন্মূলন ও ধৈর্য্যের সমূলচ্ছেদ করিয়া দগ্ধ মন্মথ এই অসামান্য সৎস্বভাবসম্পন্ন মহাত্মাকে ইতর জনের ন্যায় অভিভূত ও উন্মত্ত করিল! শাস্ত্রকারেরা কহেন, নির্দ্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক রূপে যৌবনকাল অতিবাহিত করা অতি কঠিন কর্ম্ম। ইঁহার অবস্থা শাস্ত্রকারদিগের কথাই সপ্রমাণ করিতেছে। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে নিকটবর্ত্তী হইলাম এবং শিলাতলের এক পার্শ্বে উপবেশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, সখে! তোমাকে এরূপ দেখিতেছি কেন? বল আজি তোমার কি ঘটিয়াছে?