পুরুষদের পর মেয়েরা। তাদের খাওয়া যখন শেষ হল, সূর্য পশ্চিম আকাশে অনেকখানি ঢলে পড়েছে। হেমন্তের মরা রোদ দ্রুত জুড়িয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ ঝিনুককে মনে পড়ল বিনুর। কাল এখানে আসার পর রাজদিয়া অঞ্চলের পরিচিত মানুষজনকে কাছে পেয়ে আবেগে, আনন্দে ভেসে গিয়েছিল। ঝিনুকের কথা ভাবতেই সীমাহীন ব্যাকুলতা বোধ করে সে। মনে মনে ঠিক করে ফেলে, আজই কলকাতায় ফিরে যাবে। যুগলকে তা জানাতেই সে হুলস্থুল বাধিয়ে দেয়, এই কথা তো আছিল না ছুটোবাবু। আইজের (আজকের) দিন থাইকা কাইল যাইবেন। কিছুতেই আইজ আপনেরে ছাড়ুম না।
মুকুন্দপুরের অন্য বাসিন্দারা যুগলের সঙ্গে সুর মেলায়। আজ কোনওভাবেই বিনুকে যেতে দেবে না।
কাল সুধাদের বাড়িতে একরকম জেদই ধরেছিল যুগল। বিনুকে মুকুন্দপুরে নিয়ে সাত আটদিন নিজেদের কাছে রাখবে। বিনু অতদিন থাকবে না। শেষ পর্যন্ত হিরণ রফা করে দিয়েছিল, আজকের দিনটা থেকে কাল চলে যাবে বিনু। কিন্তু আজই সে ফিরে যেতে চাইছে।
যুগল অবুঝ, একগুয়ে বালকের মতো হাত-পা ছুঁড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে, কত বচ্ছর পর আপনেরে কাছে পাইছি। আইসাই চইলা যাইবেন, হেয়া হইব না, হইব না, হইব না।
কেন বিনু আজই ফিরে যাবে, যুগলকে তা বলা যায় না। সেই ছেলেবেলা থেকে সে দেখে আসছে, ঝিনুক চিরদুঃখী। মা-বাবার তিক্ত সম্পর্ক তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। যেন এক নিপ্রাণ প্রতিমা। সারাক্ষণই প্রায় চুপচাপ।
অন্য সবার সামনে যেমনই হোক, যত নিঝুম বা জড়সড়, হেমনাথ স্নেহলতা আর বিনুর কাছে সে একেবারেই অন্য মানুষ। তার মধ্যে যে একটা গোপন জলপ্রপাত আছে, এই তিনজনই শুধু সেটা বার করে আনতে পারত। তাদের সঙ্গে ওর যত হাসি, কল কল করে যত কথা, তাদের কাছে তার যত আবদার। বড় হবার পর থেকে মেয়েটাকে অপার মায়ায়, অফুরান সহানুভূতিতে ঘিরে রেখেছে বিনু। আর বিনুকে, একমাত্র বিনুকেই শত হাতে আঁকড়ে ধরেছে ঝিনুক।
সবই ঠিক ছিল। মসৃণ নিয়মে প্রিয় নারীটিকে আরও নিবিড় করে পেয়ে যেত বিনু। ঝিনুকের যাবতীয় ক্লেশেরও হয়তো অবসান ঘটত। কিন্তু এই সেদিন ঢাকা থেকে যখন তাকে উদ্ধার করে আনা হল, ঝিনুক যেন এক ভগ্নস্তূপ। শারীরিক সর্বনাশ যতটুকু হয়েছে তার সহস্র গুণ ক্ষতি হয়েছে মনের দিক থেকে। ঝিনুক তখন প্রায়-উন্মাদ। বিধ্বস্ত। তাকে কত যত্নে কত শুশ্রূষায় যে খানিকটা স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে, বিনুর চাইতে কে আর তা বেশি জানে!
তারপর তো কলকাতায় পাড়ি। কিন্তু সুনীতিদের বাড়ি এসে মেয়েটাকে কী লাঞ্ছনাই না ভোগ করতে হয়েছে! সুধারা অবশ্য গভীর মমতায় তাকে কাছে টেনে নিয়েছে। হাসিখুশি, স্বাভাবিক, শঙ্কাহীন। ঝিনুককে ওদের কাছে রেখে মুকুন্দপুরে এসেছে বিনু। সুধাদের দিক থেকে দুর্ভাবনা নেই। কিন্তু এই যে প্রায় দেড়টা দিন সে ঝিনুকের কাছে নেই, এর ভেতর রাজদিয়া এলাকার কেউ যদি সুধাদের বাড়ি গিয়ে থাকে? সুধারা তো জানে না, কার কোন কথায়, সামান্য কোন ইঙ্গিতে ফের কুঁকড়ে যাবে ঝিনুক, শক্ত খোলার ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নেবে, ফিরে যাবে ঢাকার সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে। তাকে পুরোপুরি সুস্থ এবং স্বাভাবিক করে তোলার এত যত্ন, এত প্রয়াস, সব ব্যর্থ হয়ে যাবে। না, ঝিনুকের কাছ থেকে বেশিক্ষণ দূরে থাকা ঠিক নয়।
যুগল তো বটেই, মুকুন্দপুরের বাসিন্দারা প্রচুর কাকুতি মিনতি করল, হাতে পায়ে ধরল, কিন্তু বিনুকে কিছুতেই আটকানো গেল না।
হরনাথ বলল, দিন তো ফুরাইয়াই আসছে। আর একখান রাইত থাইকা গ্যালে আমরা বড় আনন্দ পাইতাম।
বিনু বলল, কলকাতায় আমার খুব দরকারী কাজ আছে। না গেলেই নয়। মিথ্যেই বলেছে সে। না বলে উপায়ই বা কী। চলে যাবার একটা ওজর তো চাই।
যুগল আর একটা কথাও বলল না। একেবারে গুম মেরে গেছে। ছোটবাবুর ওপর তার বড় অভিমান। আরেকটা রাত থেকে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হত না, আকাশ মাথার ওপর খান খান হয়ে ভেঙে পড়ত না। কলকাতায় কী এমন দরকার যে আজকের রাতটা থেকে যেতে পারবে না?
বিনু আর দেরি করল না। পাখি তার বাসি জামাকাপড় ধুয়ে, শুকিয়ে পাট করে রেখেছিল। সেগুলো কাপড়ের ব্যাগে পুরে বেরিয়ে পড়ল।
শেষ পর্যন্ত অভিমান করে থাকা গেল না। থমথমে মুখে যুগল বলল, যাইবেনই যহন, চলেন আপনেরে কইলকাতায় পৌঁছাইয়া দিয়া আসি।
বিনু যুগলের কাঁধে একখানা হাত রেখে হেসে হেসে খুব নরম গলায় বলল, রাগ করো না। সত্যিই আমার জরুরি কাজ আছে। নইলে থেকে যেতাম।
আর কি মুকুন্দপুরে আপনেরে আনা যাইব?
কী বলছ তুমি! দেশের এত মানুষ এখানে রয়েছে। আরও অনেকে আসবে। না এসে কি পারি?
যুগল একটুতেই খুশি হয়ে যায়। তার মুখ আলো হয়ে ওঠে। না আসলে আমরা বেবাকে গিয়া কইলকাতা থিকা আপনেরে ধইরা আনুম।
কথা বলতে বলতে বিরাট চত্বর পেরিয়ে, নতুন বসতির অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায় সবাই। এখান থেকে আগরপাড়া পর্যন্ত ধানখেত, খাল ইত্যাদি।
মুকুন্দপুরের লোকজন বিনুদের পেছন পেছন চলে এসেছিল। বিনু বলল, আপনারা আর কষ্ট করে আসবেন না। ফিরে যান।
সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। সারি সারি ম্লান মুখ। তারা বলে, আপনের আশায় আমরা পথ চাইয়া থাকুম কিলাম–
ওদের দেখতে দেখতে বিনুর বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে ওঠে, বলেছি তো আসব। নিশ্চয়ই আসব।