- বইয়ের নামঃ উত্তাল সময়ের ইতিকথা
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- প্রকাশনাঃ করুণা প্রকাশনী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.১ বিনয় তাকিয়েই আছে
উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়
[এই উপন্যাস ‘কেয়াপাতার নৌকো’ ও ‘শতধারায় বয়ে যায়’- এর পরবর্তী পর্ব। কাহিনির মূল চরিত্র বিনয় পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আন্দামানে চলে এসেছে। দক্ষিণ আন্দামানের দু- প্রান্তে এমন অঞ্চলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে যার চারদিকে গভীর অরণ্য আর সমুদ্র। জঙ্গলে রয়েছে এখানকার আদিম জনগোষ্ঠী জারোয়ারা, সমুদ্রে হিংস্র হাঙরের দল। রয়েছে কালাপনির সাজা নিয়ে যারা ব্রিটিশ আমলে আন্দামানে এসেছিল তাদের ছোট ছোট কলোনি। অরণ্য নির্মূল করে ছিন্নমূল মানুষ অনন্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলছে তাদের নতুন বাসভূমি। বিনয় এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সে জেনেছে ঝিনুক অনেক দূরের মধ্য আন্দামানে। তাকেও খুঁজছে সে। অপরাজেয় মানুষের অনন্য সংগ্রামের কাহিনি ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’। এখানে তার একটি অংশ প্রকাশিত হল।]
*
বিনয় তাকিয়েই আছে, তাকিয়েই আছে। পলকহীন। বুঝিবা শত বর্ষ ধরে।
সামনের দিকে যতদূর চোখ যায়, ছোট বড় মাঝারি-চৌকো, তেকোণা, লম্বাটে, নানা আকারের কত যে দ্বীপ! সবই জনহীন, নিঝুম। একসময় ঝিনুকদের নিয়ে ‘স্টিমশিপ ‘চলুঙ্গা’ একটা দ্বীপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
অগুনতি দ্বীপ, প্রতিটি দ্বীপে উঁচুনিচু পাহাড়। পাহাড়গুলোর গায়ে ডালপালাওয়ালা প্রাচীন মহাবৃক্ষের সারি। আকাশে উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে সি-গাল। এত গাছ, এত পাখি, সমুদ্র থেকে মাথা তুলে থাকা এত দ্বীপ! তবু বিনয়ের মনে হয়, বিশাল সমুদ্র জুড়ে হঠাৎ অপার শূন্যতা নেমে এসেছে। আর সেই শূন্যতা তার বুকের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কতক্ষণ পর খেয়াল নেই, বিনয়ের চোখ চলে যায় পশ্চিমের দিকটায়। উপসাগর, যার নাম সেসোস্ট্রেস বে–তার ওপারে যে পাহাড়টা অন্য সব পাহাড়ের মতোই গাছ-গাছালি ঝোঁপঝাড়ে লতাপাতায় তীব্র সবুজ হয়ে আছে সেটাকে খুব চেনা চেনা হল। আন্দামানের মানচিত্রে এর ছবি দেখেছে বিনয়। নিশ্চয়ই মাউন্ট হ্যারিয়েট। একটা ধবধবে সাদা ক্রস ওটার চুড়োয় সটান দাঁড়িয়ে আছে। আবছাভাবে বিনয়ের মনে পড়ে, আঠারোশো বাহাত্তরে পরাধীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড মেয়ো এই দ্বীপমালায় নির্বাসিত বন্দিরা কী ধরনের দুদর্শা আর নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, স্বচক্ষে দেখার জন্য এখানে এসেছিলেন। এক পাঠান কয়েদি, শের খান, মাউন্ট হ্যারিয়েটের তলদেশে, সমুদ্রের ধারে তাকে হত্যা করে। ক্রসটা বছরের পর বছর নীরবে সেই শোকের বার্তা ঘোষণা করে চলেছে।
এদিকে ‘রস’ দ্বীপের ধার ঘেঁষে উপসাগরের জল ফুঁড়ে ফুঁড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে শ’য়ে শ’য়ে উড়ুক্কু মাছ। রুপোলি ঝিলিকের ম্যাজিক তৈরি করে পনেরো কুড়ি ফিট দূরে ফের সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছে। উড়ন্ত মাছেদের এই খেলাটা চলছে অবিরাম। ক্লান্তিবিহীন।
বিনয় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে বাঁ ধারে কোনাকুনি উপসাগরের ওপারে চড়াই-উতরাইতে ঢেউ খেলানো শহর পোর্ট ব্লেয়ার। তারই একটা উঁচু টিলার মাথায় সেলুলার জেল। আকাশ-ছোঁওয়া একটা টাওয়ার মাঝখানে রেখে সেটার গা থেকে পাঁচ দিকে পাঁচটা লাল রঙের বিশাল তেতলা উইং বা ইমারত চলে গেছে। এগুলোর প্রতিটি তলায় সেলের পর সেল। মোটামুটি সাত ফিট বা ছফিট মাপের একেকটা খুপরি। উনিশশো পঁয়তাল্লিশের আগে মোট উইং ছিল সাতটা। জাপানি বোমায় দু’টো পুরোপুরি ধংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পরই ইংরেজরা সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারের ভারতীয় কলোনি থেকে চাটিবাটি গুটিয়ে চলে গেছে। দেশ এখন স্বাধীন। তবু আদিগন্ত কালাপানির মাঝখানে দক্ষিণ আন্দামানের রুক্ষ, ভীতিকর, দমবন্ধ করা এই বন্দিশালার দিকে তাকালে বুকের ভেতরটা আমৃল কেঁপে যায়। কুখ্যাত এই জেলখানা ঘিরে হাড় হিম করা নানা ঘটনা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারও জানতে বাকি নেই। ব্রিটিশ রাজত্বের অসীম দম্ভ এবং নির্যাতনের স্মৃতিস্তম্ভ এই সেলুলার জেল। আন্দামান নিয়ে যত বই বেরিয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই এর ছবি চোখে পড়বে। একেকটা শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চোখ ধাঁধানো প্রাচীন কোনও সৌধ বা অন্য কোনও ল্যান্ডমার্ক যা দেখলে লহমায় শহরটাকে চিনে নেওয়া যায়। প্যারিসের যেমন আইফেল টাওয়ার, লন্ডনের বিগ বেন, বম্বের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া বা কলকাতার হাওড়া ব্রিজ। আন্দামানের তেমনি সেলুলার জেল।
জেলখানাটার অনেকটা নিচে, উপসাগরের ধার ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তা ডাইনে এবং বাঁয়ে বহুদূর চলে গেছে। সেখানে কিছু লোকজন চোখে পড়ছে। দূর থেকে ছোট ছোট পুতুলের মতো মনে হয়। যেন মানুষের বনসাই।
উপসাগর থেকে হুহু করে উঠে আসছে তুমুল ঝোড়ো বাতাস; ‘রস’ আইল্যান্ডের সারি সারি নারকেল গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে সমানে ঝাঁকিয়ে চলেছে।
সমুদ্র, পাহাড় এবং হাজার হাজার বছরের মহা অরণ্য দিয়ে সাজানো এই দ্বীপপুঞ্জের চারিদিকে কত অবাক করা দৃশ্য, হাওয়ার। সাঁই সাঁই অবিরল শব্দ–কিছুই শুনতে বা দেখতে পাচ্ছেনা বিনয়। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, পাক খেয়ে খেয়ে নিরুদ্দেশে চলে যাওয়া অসংখ্য গলিখুঁজির গোলকধাঁধায়, কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে উদ্বাস্তুদের কলোনি আর রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে ভোর হতে না হতেই উভ্রান্তের মতো ছুটে গেছে। পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে ঝিনুককে। না, তাকে পাওয়া যায়নি। হতাশ, ব্যর্থ, হা-ক্লান্ত বিনয় ফিরে এসেছে সন্ধের পর। দিনের পর দিন। তারপর ধীরে ধীরে কবে যেন ঝিনুকের মুখ স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে গেছে। তার জন্য সারাক্ষণ যে আবেগে বুকের ভেতরটা উতরোল হয়ে থাকত তার তীব্রতা ক্রমশ জুড়িয়ে এসেছে। যে মেয়ে নিজের। ইচ্ছায় হারিয়ে গেছে তার জন্য কতকাল আর একইরকম ব্যাকুলতা টিকে থাকে? ‘নতুন ভারত’-এ চাকরি নেবার পর সে বিনয়ের জীবনের নতুন পরিধি থেকে দুরে, আরও দূরে সরে যাচ্ছিল।
কিন্তু চকিতের জন্য সে দিন খিদিরপুরের বাইশ নম্বর ডেকে ঝিনুককে দেখার পর পুরনো ব্যাকুলতা বুকের গভীর স্তর খুঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। জাহাজের খোলে হাজারটা ছিন্নমূল মানুষের ভেতর আতিপাতি করে তার সন্ধান করেছে। বিনয়। না, তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বিনয় ভেবেছে, হয়তো চোখের ভুল, নেহাতই ক্ষণিকের বিভ্রম। হয়তো মুখের আদলে খানিকটা মিল আছে, তাই মনে হয়েছে ঝিনুক। বিনয় নিজেকে বোঝাতে চেয়েছে, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামানেই যাবে কেন ঝিনুক? কার সঙ্গেই বা যাবে? কলকাতার মতো মহানগরে তার চেনাজানা এমন কেউ নেই যার সঙ্গে সে আন্দামানের জাহাজে উঠতে পারে।
কিন্তু এই কিছুক্ষণ আগে বিনয়ের সব ভ্রান্তি কেটে গেছে। অন্য কেউ নয়, ঝিনুকই ইন্টার আইল্যান্ড সারভিসের ‘‘চলুঙ্গা’ জাহাজে পাঁচশো উদ্বাস্তুর সঙ্গে মিডল আইল্যান্ডে চলে গেল।
কে বলে পুরনো আবেগ মরে যায়? তা-ই যদি হত, হৃৎপিণ্ড এ উথাল পাথাল হচ্ছে কেন? কেনই বা শিরাস্নায়ু ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে? একটা দম-আটকানো কষ্ট ডেলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে গেছে। তারই মধ্যে বিনয় ভাবছিল, যেমন করে তোক মিডল আন্দামানে ঝিনুকের কাছে তাকে যেতেই হবে। কাল হোক, পরশু হোক বা দশ বিশ দিন পরে। ঝিনুকের সঙ্গে দেখা তো করবেই, তাকে না নিয়ে কলকাতায় ফিরবে না। হঠাৎ দূর থেকে ভট ভট শব্দ কানে এল। চমকে বিনয় দেখতে পায়, সেলোস্ট্রেস বে আধখানা বৃত্তের আকারে বেঁকে যেখানে সেলুলার জেলের তলা দিয়ে ডাইনে বহু দূরে চলে গেছে সেখান থেকে দুটো বড় লঞ্চ এদিকে এগিয়ে আসছে।
পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে, ‘বিনয়বাবু, বিনয়বাবু–’’
ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ে–নিরঞ্জন। সে বলল, ‘আপনের মালপত্র গোছগাছ কইরা রেডি হন। লঞ্চ আইতে আছে। এইবার পোর্ট ব্লেয়ার টাউনে যামু—’
মালপত্র আর কী। একটা চামড়ার স্যুটকেস, মাঝারি একটা হোল্ড-অলে তোশক, হাওয়া বালিশ, কম্বল, চাদর আর মশারি গুছিয়ে বেঁধে দিয়েছে ‘শান্তিনিবাস’ মেসের সুবল। সেগুলো গার্ডেন আমব্রেলা ধরনের মস্ত একটা ছাতার তলায় একধারে রেখে দিয়েছে বিনয়। সে অন্যমনস্কর মতো পা ফেলে ফেলে তেজি বোদ ঠেকাতে যেখানে গার্ডেন আমব্রেলাগুলো ডানা মেলে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে এগিয়ে গেল।
এদিকে বিভাস এবং উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের চার পাঁচজন কর্মী মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শরণার্থীদের সমানে তাড়া দিচ্ছিল। পোর্ট ব্লেয়ার যেতে হবে। পনেরো কুড়ি মিনিটের ভেতর সবাই যেন প্রস্তুত হয়ে নেয়। নিরঞ্জন বিনয়কে যা বলেছে, বিভাসরা ঠিক তা-ই বলছে উদ্বাস্তুদের।
কলকাতা থেকে আসার পথে: সমুদ্রে সাইক্লোনের মুখে পড়েছিল কিনয়দের জাহাজ ‘এস এস মহারাজা’। তুমুল রোলিং জাহাজের খোলে হাজারখানেক উদ্বাস্তুকে অবিরল একবার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে, পরক্ষণে নিচে আছড়ে ফেলে, দুমড়ে মুচড়ে তাদের শরীরগুলোকে ময়দা ঠাসার মতো তালগোল পাকিয়ে ছেড়েছিল। যা খেয়েছিল পাকস্থলী থেকে হড়হড় করে বমি হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। পরে সমুদ্র শান্ত হলেও তারা এতটাই কাহিল হয়ে পড়ে যে খাওয়ার কোনওরকম ইচ্ছাই ছিল না; বাঙ্কে চোখ বুজে নির্জীব শুয়ে থেকেছে তারা।
কিন্তু ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছবার পর পায়ের তলায় মাটি পেয়ে খিদেটা ফের ফিরে আসে। পেট জ্বলে যাচ্ছিল তাদের। যেন দাউদাউ আগুন জ্বলছে। জাহাজেই চানটান সেরে নিয়েছিল। ‘রস’-এ নেমে ভাত ডাল মাছ তরকারি দিয়ে গলা অবধি ঠেসে তবে শান্তি। খাওয়াদাওয়া চুকলে ভালো করে যে জিরিয়ে নেবে তেমন ফুরসত পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ছ’ ছ’টা বিয়ে হল। তারপর শ’ পাঁচেক উদ্বাস্তু তুলে নিয়ে ‘চলুঙ্গা’ জাহাজ মিডল আন্দামানে চলে গেল। বাকি যারা রইল, এতসব ঘটনার পর অপার ক্লান্তিতে তাদের চোখ জুড়ে এসেছে। ঝাড়ালো প্যাডক কি চুগলুম গাছের ছায়ায়, কিংবা বিরাট বিরাট পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে-যে যেখানে পেরেছে, শুয়ে পড়েছে।
বিভাসদের হাঁকাহাঁকিতে তারা ধড়মড় করে উঠে বসে। তারপর কলকাতার রিলিফ ক্যাম্পগুলো থেকে পার্থিব সম্পত্তি বলতে–টিনের বেড়ানো বাক্স, কথাকানি, ছেঁড়া শতরঞ্চিতে জড়ানো বিছানা, হাতা খুন্তি কড়াই যে যেটুকু পেরেছে নিয়ে এসেছে, সব জড়ো করে নিল।
এদিকে উপসাগরের জল তোলপাড় করে, গম্ভীর ভো বাজিয়ে সেই লঞ্চ দুটো রস আইল্যান্ডের জেটিতে এসে ভিড়ল। দুই লঞ্চেরই খালাসিরা লোহার শেকল দিয়ে জলযান দুটোকে জেটির মোটা মোটা লোহার থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর রেলিং লাগানো চওড়া কাঠের পাটাতন ফেলে লঞ্চের সঙ্গে জেটি জুড়ে দিল। এই ছোট পুল দিয়ে লঞ্চে উঠতে হবে।
বিভাস, নিরঞ্জন এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের ছেলেরা দারুণ করিৎকর্মা। হাতে পায়ে তাদের যেন বিদ্যুৎ খেলতে থাকে। ছোটাছুটি এবং হাঁকডাক করে উদ্বাস্তুদের জেটির কাছে জড়ো করে একে একে তাদের লঞ্চে তুলতে লাগল। সমস্ত কাজটার মধ্যে রয়েছে নিখুঁত শৃঙ্খলা।
একটা লঞ্চ বোঝাই হয়ে গেলে বিভাস সেটায় উঠে পড়ে। লঞ্চটার নাম ‘সিগাল’। ‘সিগাল’ আর দাঁড়াল না, জল কেটে কেটে পোর্ট ব্লেয়ারের দিকে চলে গেল।
প্রথম লঞ্চটা চলে যাবার পর পরের লঞ্চ ‘‘নটিলাস’-এ একই প্রক্রিয়ায় উদ্বাস্তুদের তুলে ফেলল নিরঞ্জনরা। সবাই উঠলে আন্দামানের চিফ কনজারভেটর অফ ফরেষ্ট ব্রজদুলাল মণ্ডল, চিফ মেডিকেল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ, হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন, ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট ও রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের ইন-চার্জ বিশ্বজিৎ রাহা এবং আরও কয়েকজন বড় মাপের অফিসার।
অফিসার এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা ছাড়াও পোর্ট ব্লেয়ারের আরও অনেক পুরনো বাঙালি বাসিন্দা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাতে এসেছিল। বোঝাতে চেয়েছিল বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে সুদুর এই দ্বীপপুঞ্জে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষগুলোকে নির্বাসনে পাঠানো হয়নি। এখানেও তাদের অগুনতি শুভাকাক্ষী রয়েছে। সবসময় আত্মীয় পরিজনের মতো এরা পাশে থাকবে। দুটো মোটরলঞ্চে এই আন্দামানবাসী বাঙালিদের জায়গা হয়নি। ‘রস’ আইল্যান্ডের জেটিতে একজোড়া মোর্টর বোট বাঁধা রয়েছে। ছোট জলযান দুটো তাদের নিয়ে আসবে।
যে দুই স্টিম লঞ্চ উদ্বাস্তুদের নিয়ে সেসোস্ট্রেস বের জল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে তার একটার নাম ‘সি-গাল’, অন্যটা ‘‘নটিলাস’। এই তো সবে ইংরেজ রাজত্বের অবসান হল। তাদের দেওয়া লঞ্চের নামগুলো এখনও টিকে আছে।
‘‘নটিলাস’-এর দোতলার ডেকে রেলিং ধরে দূরমনস্কর মতো তাকিয়ে ছিল বিনয়। চারপাশের দৃশ্যাবলি ছাপিয়ে একটি মুখ স্থিরচিত্রের মতো চোখের সামনে কোনও অদৃশ্য ফ্রেমে আটকে আছে। পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল, ‘ছুটোবাবু–’
ঘুরে দাঁড়াতেই বিনয়ের চোখে পড়ল হলধর সূত্রধর। বুড়োটে, কুঁজো ধরনের লোকটার আদি বাড়ি ছিল রাজদিয়ার কাছাকাছি একটা গ্রাম-গিরিগঞ্জে। দেশে থাকতে মাঝে মাঝে হেমনাথের কাছে আসত সে। দেশভাগের পর কোথায় ছিটকে পড়েছিল, বিনয় জানে না। অনেক কাল বাদে এই সেদিন দমদমের এক ত্রাণশিবিরে তার সঙ্গে দেখা। তারপর স্টিমশিপ ‘মহারাজায়। তারপর ‘নটিলাস’ লঞ্চে।
বিনয় জিগ্যেস করে, ‘কিছু বলবেন?’
‘হ—’ আস্তে মাথা নাড়ে হলধর।
সামান্য কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
হলধর বলে, ‘শুনাশুন একহান কথা কানে আইছে।’
‘কী?’
‘আমাগে নিকি (নাকি) পুট বিলাসে (পোর্ট ব্লেয়ার) রাখব না। মেলা (অনেক) দূরে জঙ্গলে লইয়া যাইব। হেগুলা (সেসব) কেমুন জাগা (জায়গা), কেঠা জানে।’
খবরটা নতুন নয়। নিরঞ্জন আগেই বিনয়কে জানিয়েছে, পোর্ট ব্লেয়ার শহর থেকে তিরিশ-চল্লিশ মাইল পশ্চিমে উদ্বাস্তুদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। বসানো হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। পূর্ব বাংলার ছিন্নমূল মানুষদের বাসস্থান। সেই এলাকাগুলো ঠিক কী ধরনের সে সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা নেই বিনয়ের।
হলধর বলতে লাগল, ‘হোনলাম (শুনলাম) যেইহানে আমাগো লইয়া যাইব হের (তার) চাইর পাশে আলিসান আলিসান জঙ্গল। জংলি জারোরা (জারোয়ারা) কাছাকাছিই থাকে। বিষমাখা তির ফ্যাকে (ছোড়ে)।
বিনয় রীতিমতো অবাক। গিরিগঞ্জের হলধর সূত্রধর, যে কোনওদিন স্কুলের ধারাকাছে ঘেঁষেনি, অক্ষরপরিচয়হীন বেজায় সাদাসিধে, দেশভাগের আগে বিক্রমপুরের চৌহদ্দির বাইরে কখনও কোথাও যায়নি, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছেছিল। এখন স্টিমঞ্চ ‘নটিলাস’-এ পোর্টব্লেয়ার চলেছে। এই সময়টুকুর মধ্যে কত তথ্যই না সংগ্রহ করে ফেলেছে।
হলধর থামেনি। ‘জারোরা নিকি কয়জন ‘রিফুজ’রে মাইরা ফালাইছে। ছুটোবাবু, ডরে বুক কাপে।’
হলধরকে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে আরও পনেরো-কুড়িজন উদ্বাস্তু ডেকের নানা দিক থেকে চলে এসেছে। সবারই মুখ চেনা। দু-চার জনের নামও জানে বিনয়। দেশ থেকে উৎখাত হয়ে হলধরের সঙ্গে এরা দমদমের ত্রাণশিবিরে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে। সবার চোখেমুখে গভীর উৎকণ্ঠার ছাপ। সৃষ্টিছাড়া আদিম অরণ্যে হিংস্র জারোয়াদের পাশাপাশি থাকতে হবে, হলধরের মতো এই খবরটা নিশ্চয়ই তারাও পেয়ে গেছে। এদেরই একজন মাখন রুদ্রপাল বলল, ‘জারোগো হাতে মারণের লেইগা কি গরমেন (গভর্নমেন্ট) আমাগো এই আন্ধারমান দ্বীপি লইয়া আইল ছুটোবাবু?’ হলধরের দেখাদেখি দমদম ক্যাম্পের আরও অনেকেই বিনয়কে ‘ছুটোবাবু’ বলে।
ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হাজার মাইল দূরের এই দ্বীপপুঞ্জে জঙ্গলের ভেতর এখানকার আদি বাসিন্দাদের তীরের মুখে শরণার্থীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানেই হবে তাদের নতুন স্থায়ী বাসস্থান, ভাবতেই ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে বিনয়ের। দেশ ছেড়ে চলে আসার পর শিয়ালদা স্টেশনে আর ত্রাণশিবিরে কী নিদারুণ দুর্গতির মধ্যে যে এদের দিন কেটেছে। সেটাকে বেঁচে থাকা বলে না। ক্ষয়ে ক্ষয়ে তারা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ভয়, দ্বিধা কাটিয়ে আন্দামানের জাহাজে উঠেছে। তাদের জানানো হয়েছে সমুদ্রের মাঝখানে তাদের যে নিজস্ব বাসভূমি হবে তা সম্পূর্ণ নিরাপদ, ঝাটমুক্ত। পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে যে জীবন তারা চিরতরে ফেলে এসেছে, ফের তা গড়ে তুলবে অসীম পরিশ্রমে অফুরান মমতায়। যা হারিয়েছে তার বহুগুণ ফিরে পাবে। সমস্ত অনিশ্চয়তা এবং ক্লেশের অবসান ঘটবে। কিন্তু আন্দামানে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে যে সব খবর হলধররা পেয়েছে। তাতে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছে।
এই যে এতগুলো সর্বহারানো মানুষ ঘোর অনিচ্ছায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে সেজন্য বিনয়ও কম দায়ী নয়। সে হলধরদের বুঝিয়েছে, ত্রাণশিবিরে যৎসামান্য সরকারি খয়রাতের ওপর নির্ভর করে আমেরিকান টমিদের ফেলে যাওয়া ব্যারাকের ঘুপচি কামরায় কামরায় কষ্টে, গ্লানিতে বাকি জীবন কাটানো অসম্ভব। তা ছাড়া তাদের ছেলেমেয়েরা আছে। তাদের ভবিষ্যৎ আছে। এই সন্তান সন্ততিদের কথাও তো ভাবতে হবে। তারা কি চিরকাল ত্রাণশিবিরে নিজেদের গায়ে ‘রিফিউজি’ তকমা লাগিয়ে কাটিয়ে দেবে? আন্দামানে গেলে উর্বর জমি মিলবে। ধান বোনো, আনাজের চাষ করো, শস্যের লাবণ্যে ভরে যাবে মাঠ। সমুদ্রে আছে অফুরন্ত মাছ, জঙ্গলে হরিণ। একটু খাটলে আমৃত্যু খাদ্যের অভাব হবে না। তাছাড়া তাদের সাহায্য করার জন্য রয়েছে নানারকম সরকারি সাহায্য, অনুদান।
বিনয়ের ধারণা ছিল, পোর্টব্লেয়ার শহরের আশেপাশে উদ্বাস্তুদের গ্রাম বসানো হচ্ছে। কিন্তু এখানে পৌঁছনোর পর অন্যরকম শোনা যাচ্ছে। যদি শরণার্থীরা বিপন্ন হয়ে পড়ে তাদের শেষ অবলম্বনটুকু ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। হঠাৎ মনে পড়ল, এর আগে চার-পাঁচ খেপে কয়েক হাজার শরণার্থীকে এখানে আনা হয়েছে। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে, জানা নেই। যদি ভালো না থাকে, নিশ্চয়ই অভিযোগ শোনা যেত। পরক্ষণে খেয়াল হল, ওটা তো কলকাতা শহর নয় যে ভালো বা মন্দ সমস্ত খবর লহমায় লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। পৃথিবীর জনারণ্য থেকে বহুদুরে দুর্গম জঙ্গলের খাঁজের ভেতর উদ্বাস্তুদের আদৌ কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা, হলে কী ধরনের সমস্যা–তা সহজে জানার উপায় নেই। বিনয়ের মনে কিছুটা ধন্দ দেখা দিয়েই চকিতে মিলিয়ে গেল। ছিন্নমূল মানুষগুলো তেমন কোনও সংকটে যদি পড়েই থাকে, সরকারি দপ্তর তার মতো একজন সাংবাদিককে নিশ্চয়ই আন্দামনে পুনর্বাসনের কাজকর্ম দেখাতে নিয়ে যেত না। কেননা, এখান থেকে সে যে প্রতিবেদন লিখে পাঠাবে, তাতে মেনল্যান্ডে সব জানাজানি হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে এর মধ্যেই উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে দিয়েছে। রোজই কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় আর পার্কগুলোতে মিছিল, মিটিং, স্লোগান। আন্দামানে এসে শরণার্থীদের দুর্গতির শেষ নেই, সত্যিই যদি তেমনটা হয়ে থাকে আর তা জানাজানি হয়ে যায়, কলকাতায় আগুন জ্বলে যাবে। ত্রাণ শিবিরগুলোতে বা শিয়ালদায় বছরের পর বছর যারা পড়ে আছে তাদের একজনকেও আর আন্দামানের জাহাজে তোলা সম্ভব হবে না। এখানকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া পুরোপুরি বানচাল হয়ে যাবে।
হলধররা একদৃষ্টে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিনয় বলল, আপনাদের মতো আমিও শুনেছি জারোয়ারা তাদের কাছাকাছি এলাকায় নতুন কারওকে দেখলে তির ছোড়ে। কিন্তু কলকাতা থেকে নিয়ে এসে আপনাদের বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে, তা তো আর হয় না। সরকার জারোয়াদের ঠেকাবার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা কি আর করেনি?
ঘুরিয়ে একরকম মিথ্যেই বলতে হল। উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তার জন্য কোনওরকম বন্দোবস্ত করা হয়েছে কিনা, বিনয়ের জানা নেই। কিন্তু সত্যিটা বললে হলধররা আরও ভয় পেয়ে যাবে। পোর্ট ব্লেয়ারে নেমে হয়তো এমন বেঁকে বসবে যে জঙ্গলে যেখানে তাদের জন্য জমি ঠিক করে রাখা আছে তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তুমুল হইচই বাধিয়ে একটা বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলবে।
মাখন রুদ্রপাল চতুর লোক। হলধরের পাশ থেকে সে বলে ওঠে, মনে লয় (হয়), জারোগো ব্যাপারে সরকার কী ব্যাবোস্তা করছে, আপনে পুরাটা জানেন না। ডেকের অন্য দিকে, বেশ খানিকটা দূরে, সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেব, ডাক্তার চট্টরাজ, বিশ্বজিৎ রাহা এবং আরও কয়েকজন অফিসার কিছু আলোচনা করছিলেন। তাদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল মাখন। উই ছারেগো (স্যারদের) আমাগো কথা ইট্ট বুজাইয়া কইয়েন ছুটোবাবু। দ্যাশ ছাইড়া আহনের পর কত কষ্ট যে পাইছি হের (তার) লিখাজুখা (লেখাজোখা) নাই। আন্ধারমান দ্বীপি বড় আশা লইয়া আইছি। ওনারা য্যান দ্যাহেন আমাগো এইহানে মরতে না হয়।
মাখন সার সত্যটা এর মধ্যেই বুঝে গেছে। বিশ্বজিৎ রাহা, মণ্ডলসাহেব, সেনসাহেবরাই তাদের আসল রক্ষাকর্তা। বিনয়ের বেশ মজাই লাগে। বলল, আপনারাই গিয়ে ওঁদের বলুন না
হলধরের হয়তো মনে হল, বিনয় বিরক্ত হয়েছে। মাখন ফের কী বলতে যাচ্ছিল, গলার স্বর চড়িয়ে তাকে থামিয়ে দিল।–‘তুমি চুপ যাও। কারে কী কইতে হয় জানো না। ছুটোবাবু যা ভালা বুঝবেন হেয়া (তা) করবেন।’ বিনয়কে বলল, ‘আপনেই আমাগো বলভরসা। মাখনার কথায় কিছু মনে কইরেন না।’
বিনয় একটু হাসল। সরকারি অফিসারদের কাছে তাদের হয়ে দরবার করার জন্য মাখন যে তাকে ধরেছে তাতে হলধর খুবই অসন্তুষ্ট এবং বিব্রতও। বিনয়ের ওপর তার অগাধ আস্থা। যা যা করলে এই অজানা দ্বীপপুঞ্জে তাদের নতুন জীবন হবে অবাধ, ভয়শূন্য আর নিশ্চিন্ত, রাজদিয়ার হেমকর্তার নাতি তাই করবে। সাউকারি করে মাখনের পরামর্শ দেবার দরকার নেই।
হলধর বলল, ‘একহান কথা জিগামু ছুটোবাবু?’ আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।-–‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’
দূরে বিশ্বজিৎ রাহাকে দেখিয়ে হলধর বলল, ‘তেনি তহন (তিনি তখন) পুট বিলাসে (পোর্ট ব্লেয়ার) তেনার বাড়ি আপনেরে থাকনের কথা কইলেন।’
বিনয় অবাক। ‘রস’ আইল্যান্ডে মহারাজা’ জাহাজ থেকে নামার পর জগদীশ গুহঠাকুরতার চিঠি বিশ্বজিৎকে দেবার পর তিনি যে তাকে তার বাংলোতে থাকার কথা বলেছিলেন সেটা তাহলে লক্ষ করেছে হলধর!
বিনয় বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছেন তো—’
হাতজোড় করে হলধর বলল, ‘আপনেরে কিলাম আমরা ছাড়ুম না ছুটোবাবু। আপনের ভরসাতেই আন্ধারমানে আইছি। আমাগো লগে আপনেরে জঙ্গল যাইতেই লাগব।নাইলে পুট বিলাস থিকা আমরা এক পাও লডুম (নড়ব) না।’
তার সঙ্গীরা একই কথা বলে। এমনকী মাখনও।
আন্দামানের বিজন অরণ্যে বিনয়ই তাদের একমাত্র অবলম্বন। খড়কুটোর মতো তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে হলধররা। লহমার জন্য চোখের আড়াল করতে চায় না।
যেখানে যেখানে উদ্বাস্তুদের বসতি গড়ে উঠছে সেইসব এলাকায় যাবার জন্যই বিনয়ের আন্দামনে আসা। বিশ্বজিতের সঙ্গে আলাপ হবার পর ভেবেছিল, দু-একদিন পোর্ট ব্লেয়ারে তার বাংলোয় থাকবে। এখানকার পুনর্বাসন সম্পর্কে তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই প্রচুর তথ্য পাওয়া যাবে। কেননা রিহ্যাবিলিটেশনের বেশির ভাগ দায়িত্বই তার। কিন্তু হলধররা তাকে কিছুতেই ছাড়বে না। সে বিশ্বজিতের বাংলোয় গেলে ওদের মনোবল ভেঙে পড়বে। তার ওপর এত মানুষের এত বিশ্বাস তুচ্ছ করার বস্তু নয়।
বিনয় বলল, ‘ঠিক আছে, আপনাদের সঙ্গেই যাব।’
চারপাশের মুখগুলো থেকে উৎকণ্ঠার ছাপ ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। হলধররা আর দাঁড়ায় না। ডেকের অন্য প্রান্তে চলে যায়।
এতক্ষণ হলধরদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল বিনয়। ওরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুকের চিন্তাটা চারপাশ থেকে তার মাথায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১.২ সেসোস্ট্রেস বে পেরিয়ে
সেসোস্ট্রেস বে পেরিয়ে কোনাকুনি এপারে এলে পোর্ট ব্লেয়ারের গা ঘেঁষে পাশাপাশি দুটো জেটি। দুই স্টিম লঞ্চ সেখানে এসে ভিড়ল। লঞ্চের খালাসি এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়।
রেলিং-লাগানো কাঠের পাটাতন ফেলে চোখের পলকে ‘রস’ আইল্যান্ডের মতোই এপারের জেটিতে দুই লঞ্চকে জুড়ে দেওয়া হল। এক লঞ্চে এসেছিল বিভাস, অন লঞ্চটায় নিরঞ্জন। তারা হই হই করে উদ্বাস্তুদের নামাতে শুরু করল। মিনিট পনেরোর ভেতর দুই লঞ্চ কঁকা হয়ে গেল। সবার সঙ্গে অফিসাররাও নেমে এসেছেন। বিনয়ও।
জেটি দুটোর পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। একটা সমুদ্রের ধার দিয়ে দিয়ে। অন্যটা উঁচু উঁচু টিলা পেরিয়ে সোজা ওপর দিকে। রাস্তায় জিপ ছাড়াও অনেকগুলো নানা ধরনের মোটর দাঁড়িয়ে আছে। ফিয়েট, হিন্দুস্থান, অষ্টিন ইত্যাদি ইত্যাদি। বিনয় আন্দাজ করে নিল ওগুলো সরকারি অফিসারদের গাড়ি।
সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেবরা সেই সকাল থেকে ‘রস’ আইল্যান্ডে কাটিয়ে এসেছেন। সারাদিনের ধকলে ক্লান্তিবোধ করছিলেন। সবার কাছ থেকে আপাতত বিদায় নিয়ে যে যার গাড়িতে উঠে পড়লেন। বিনয়কে বললেন, আপনি তো এখন কিছুদিন আন্দামানে আছেন। পরে আবার দেখা হবে।
অফিসারদের মধ্যে একমাত্র বিশ্বজিৎ রাহাই থেকে গেলেন। আর রইল পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। আজ মেনল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তুরা এসেছে ফেলে তো চলে যাওয়া যায় না।
সূর্যটা খানিক আগে আকাশের ঢালে সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো আটকে ছিল। এখন আর সেটাকে দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিম দিকের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে নেমে গেছে। বাসি হলুদের মতো দিনের শেষ ম্যাড়ম্যাড়ে আলো এখনও জঙ্গলে পাহাড়ে এবং উপসাগরে আলতো ভাবে আটকে আছে। বড়জোর আর মিনিট পনেরো; তারপর সেটুকুও থাকবে না। ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে।
উদ্বাস্তুদের জন্য নতুন নতুন বসতির যে পত্তন হচ্ছে সেগুলো পোর্ট ব্লেয়ার থেকে তিরিশ-চল্লিশ কি পঞ্চাশ মাইল দূরে। আজ সকালে চারদিন বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে তারা ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছেছে। একটানা সমুদ্রযাত্রার কারণে তাদের সবার শরীর জুড়ে অপার ক্লান্তি। মুখচোখ দেখে টের পাওয়া যায় হাত-পা যেন ভেঙে আসছে। এই অবস্থায় কি ওদের সুদুর জঙ্গলে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে? উদ্বাস্তুদের এই দঙ্গলে শক্তপোক্ত যুবক যুবতী ছাড়াও রয়েছে বাচ্চাকাচ্চা এবং হাড়ের ওপর চামড়াজড়ানো শীর্ণ থুথুড়ে বুড়োবুড়িরা। পাহাড়ি রাস্তায় টাল খেতে খেতে নতুন বসতিতে পৌঁছতে কত রাত হয়ে যাবে, কে জানে। সেই ধাক্কা কি বয়স্ক মানুষগুলো আর বাচ্চারা সামলাতে পারবে?
ঝিনুকের চিন্তাটা বিনয়কে উতলা করে রেখেছিল। তার ফাঁকে ঝাঁকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে এই সব ভাবনা তার মাথায় ঢুকে পড়ছে।
বিভাস আর নিরঞ্জনের কর্মকাণ্ডে লেশমাত্র ত্রুটি নেই। হাঁকডাক করে তারা উদ্বাস্তুদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শরণার্থীদের মাথায় বা হাতে তাদের লটবহর। নানা বয়সের বিবাহিত মেয়েদের কোলে কাখে ছোট ছোট দুধের শিশু, সেই সঙ্গে কাধ থেকে ঝুলছে ময়লা চট কি মোট কাপড়ের ঝুলি। সেগুলোর ভেতর টুকিটাকি নানা জিনিসপত্র।
বিভাস টিনের চোঙা মুখে লাগিয়ে উদ্বাস্তুদের উদ্দেশে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিল, ভাইয়েরা বইনেরা মায়েরা, কয়টা দিন। আপনাগো উপুর দিয়া মেলা (অনেক) তাফাল গ্যাচে। আইজ আর আপনাগো নয়া বসতে নিয়া যামু না। রাইতখন পোর্ট ব্লেয়ারে কাটাইয়া কাইল সকালে রওনা দিবেন। সে একনাগাড়ে বলতে লাগল, ‘অহন আমরা যামু এবারডিন বাজারের সুমখে। হেইহানে আপনেগো থাকনের ব্যবস্থা করা আছে। জাগাখান (জায়গা) বেশি। দূরে না। হাইটাই যাওন যাইব। আহেন, আমাগো লগে আহেন-’
এদিকে বিশ্বজিৎ রাহা বিনয়ের কাছে চলে এসেছিলেন। বললেন, ‘চলুন, আমার সঙ্গে গাড়িতে যাবেন।‘
অন্য সব গাড়ি চলে গেলেও একটিমাত্র জিপ রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশ্বজিৎ সেদিকে পা বাড়াতে যাবেন, হঠাৎ বিনয়ের মনে পড়ল, হলধরদের কথা দেওয়া হয়েছে আন্দামানে সে যতদিন। আছে তাদের সঙ্গে থাকবে। অঙ্গীকার তো ভাঙা যায় না। অবশ্য এটাও ঠিক, আন্দামানের নানা জায়গা তাকে যেতে হবে। সারাটা। সফর ওদের সঙ্গে কাটানো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রথম দিকের বেশ কয়েকটা দিন ওদের কাছে থাকতেই হবে।
বিনয় বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি ওদের সঙ্গেই যেতে চাই’ কেন যাওয়া দরকার সেটা বুঝিয়ে বলল।
বুঝেছি, অজানা নতুন জায়গায় ওরা আপনার ওপর খুব ডিপেন্ড করছে। বিশ্বজিৎ একটু হেসে বললেন, ‘চলুন, আমিও হাঁটতে হাঁটতে যাই। এবারডিন বাজারের সামনের মাঠে আমাকেও যেতে হবে। রাত্তিরে রিফিউজিদের খাওয়া-থাকার কী ব্যবস্থা হয়েছে, কোথাও কোনও ত্রুটি আছে কিনা সেসব দেখে রাত্তিরে আমার বাংলোয় ফিরব।’ তার জিপের ড্রাইভার কালীপদকে–রোগা, কালো, লম্বাটে মুখ, ঝাকড়া চুল, বছর পঁচিশ বয়স- ডেকে জিপ নিয়ে এবারডিন বাজারে চলে যেতে বললেন।
এদিকে উদ্বাস্তুদের দলটা সারি দিয়ে চলতে শুরু করেছে। দক্ষ গাইডের মতো বিভাস আর নিরঞ্জন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সমুদ্রের ধার ঘেঁষে যে রাস্তাটা ডাইনে এবং বয়ে গেছে সেটা ধরে নয়; যে রাস্তাটা সোজা টিলার পর টিলা পেরিয়ে ওপরে উঠেছে সেটা দিয়েই এগিয়ে চলেছে সবাই। মাঝখানে একটু দুরত্ব রেখে বিশ্বজিৎ আর বিনয় উদ্বাস্তুদের পাশাপাশি হাঁটছিল।
‘রস’ আইল্যান্ডে নিরঞ্জন পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বিনয় আন্দাজ করেছিল বিশ্বজিতের বয়স-বত্রিশ তেত্রিশ হবে। অর্থাৎ তার চেয়ে মোটামুটি বছর দশেকের বড়। সতেজ, মেদহীন চেহারা। পরিপূর্ণ যুবকই বলা যায় তাঁকে।
কম বয়সে বিরাট সরকারি দায়িত্ব পেলে প্রায় সবারই একটা ভারিক্কি ভাব এসে যায়। সারাক্ষণ গম্ভীর। চারপাশে উঁচু উঁচু দেওয়াল তুলে তার ভেতর ঢুকে যায় তারা। বুঝিয়ে দেয় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্বজিৎ কিন্তু তেমনটা নন। হাসিখুশি, কোনও রকম চাতুরি নেই, মৰ্জা করতে পারেন, প্রাণ খুলে হাসতে পারেন। আলাপ হবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল বিনয়ের। আন্দামানে একজন চমৎকার বন্ধু পাওয়া গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে কথাও হচ্ছিল। বিশ্বজিৎ বলছিলেন, তখন রিডিউজিদের নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিলাম যে ভালো করে আলাপটাই হয়নি। জগদীশকাকা লিখেছেন, আপনাকে যেন সাহায্য করি। ব্যস, এটুকুই। একটু থেমে ফের বলেন, ‘আপনিই প্রথম একজন জার্নালিস্ট যিনি আন্দামানে রিফিউজি সেটেলমেন্ট কভার করতে এসেছেন। আপনার সম্বন্ধে খুব জানতে ইচ্ছে করছে।‘
নিজের থেকে বিনয়কে কিছু বলতে হল না। কয়েক মিনিটের ভেতর নানা প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার সম্পর্কে প্রায় সমস্ত কিছু জেনে নিলেন বিশ্বজিৎ। ঝিনুকের ব্যাপারটা বাদেবাকি সবই বলে। গেল বিনয়। এই একটা গোপন দুর্বল জায়গা আছে তার বুকের ভেতর। নিদারুণ কষ্টকরও। ঝিনুকের কথা যারা জানে তারা জানে। নিজের মুখে বিনয় অন্য কারওকে বলতে পারবে না।
বিশ্বজিৎ গভীর আগ্রহে শুনছিলেন। সহানুভূতিতে তার মন ভরে যায়। ভারী গলায় বললেন, আপনি নিজেও তাহলে দেশভাগের একজন ভিকটিম। তাই উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে এত সিমপ্যাথি। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামান অব্দি তাদের সঙ্গে চলে এসেছেন।
কথাটা মোটামুটি ঠিকই। আন্দামানে আসার জন্য ব্যগ্র হয়ে ছিল সে। ‘নতুন ভারত’ অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ায় এখানে আসা সম্ভব হয়েছে। নইলে এত তাড়াতাড়ি আসা সম্ভব হত না। তবে একদিন।
একদিন, দু বছর পরেই হোক বা চার বছর পরে, এই দ্বীপপুঞ্জে আসতই। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ চোদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে সীমান্তের এপারে চলে এসেছে, তারা কোথায় কীভাবে নতুন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, নাকি ভেঙেচুরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেসব নিজের চোখে দেখতে চায় সে। শিয়ালদা স্টেশনে, কলকাতার চারপাশের কলোনি আর ত্রাণশিবিরগুলোতে দিনের পর দিন গেছে সে। এখন এসেছে আন্দামানে। শোনা যাচ্ছে, ভারতবর্ষের নানা প্রভিন্সে পুনর্বাসনের জন্য শরণার্থীদের পাঠানো হবে। যেখানেই তারা যাক, বিনয় সেখানেই যাবে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমাদের বাড়িও ছিল ওপারে। আনডিভাইডেড বেঙ্গলের মাইমেনসিং ডিস্ট্রিক্টে। তবে আমরা রিফিউজি না, পার্টিশনের অনেক আগেই চলে এসেছিলাম।’
এই মানুষটি সম্পর্কে বিনয়েরও জানার আগ্রহ কম নয়। কিন্তু বিশ্বজিৎ নিজের ব্যাপারে আর একটি কথাও বললেন না। বিনয় যে জিগ্যেস করবে তেমন সাহস হল না। বেশি কৌতূহল দেখালে বিশ্বজিৎ বিরক্ত হতে পারেন। আন্দামানে যখন আসাই হয়েছে, সবই জানা যাবে।
একটু চুপচাপ। দিনের আলো আরও কমে গেছে। রাস্তার দুধারে কত যে। নারকেল গাছ আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে! আর আছে। বিশাল বিশাল শিশু, রেন-ট্রি এবং নাম না জানা মহাবৃক্ষের সারি। সেসবের ফাঁকে ফাঁকে অল্প কিছু কাঠের বাড়ি, ক্কচিৎ দু চারটে পাকা দালান।
অগুনতি গাছের ছায়ায় চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে। সব কেমন যেন। ঝাপসা ঝাপসা।
উদ্বাস্তুরা প্রায় নিঃশব্দে হাঁটছে তো হাঁটছেই। তাদের দেখতে দেখতে মনে হল, মধ্যযুগের যাযাবরেরা এইভাবেই বুঝিবা খাদ্যের সন্ধানে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাহাড় পর্বত মরুভূমি পার হয়ে। ঘুরে বেড়াত।
একটা টিলার মাথায় চলে এসেছিল বিনয়রা। পথ এবার নিচের দিকে নেমে দূরে অন্য একটা টিলায় গিয়ে উঠেছে।
বিশ্বজিৎ দূরের টিলাটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমরা প্রায় এসে গেছি। ওই টিলাটার পর এবারডিন বাজার। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘জগদীশকাকার কাগজ কেমন চলছে?’
বিনয় বলল, ‘বেশ ভালো। এখানে ‘নতুন ভারত’ আসে?’
‘আসে। তবে রোজ নয়। উইকে তিনদিন প্লেন সারভিস আছে। প্লেনের সঙ্গে কাগজও আসে।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘আপনাদের কাগজ রিফিউজি প্রবলেমের ওপর অন্য পেপারগুলোর চাইতে অনেক বেশি ইমপর্টান্স দিচ্ছে। তার ওপর অন্যেরা যা করেনি, আপনারা তাই করতে চলেছেন। আন্দামান সেটেলমেন্ট কভার করবেন। আশা করি, সার্কুলেশন হুহু করে বেড়ে যাবে।’
বিশ্বজিৎ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ‘নতুন ভারত’-এর পরিকল্পনা আপাতত তা-ই। উদ্বাস্তু সমস্যার ওপর বিশেষ করে জোর দেওয়া। সেটা সঠিক ধরে ফেলেছেন বিশ্বজিৎ।
বিনয় একটু হাসল। তবে ‘নতুন ভারত’ নিয়ে কোনও মন্তব্য করল না। বলল, ‘এখানকার রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ কেমন চলছে?’
বিশ্বজিৎ আস্তে মাথা নাড়লেন। ‘আমি কিছু বলব না। নিজের চোখে দেখে আপনাকে সেটা বুঝে নিতে হবে।’
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।
ঝিনুকের চিন্তাটা ভেতরে ভেতরে চলছিলই। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হল, পুনর্বাসন দপ্তরের এই মহা ক্ষমতাবান অফিসারটি ইচ্ছা করলে ঝিনুকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সরাসরি তো বলা যায় না, আমাকে মিডল আন্দামানে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিন। পোর্ট ব্লেয়ারকে ঘিরে দক্ষিণ আন্দামানের শরণার্থীদের নতুন নতুন বসতিগুলো না দেখেই কেন সে মধ্য আন্দামানে যেতে চাইছে এই নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠবে। সেগুলো তার পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর।
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বিনয় জিগ্যেস করল, ‘মিডল আন্দামান এখান থেকে কতদূর?
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘ষাট বাষট্টি মাইল।‘
‘নিরঞ্জনবাবু বলেছেন, ইন্টার-আইল্যান্ড শিপ সারভিসের জাহাজ মাসে একবার মাত্র ওখানে যায়।‘
‘ঠিকই বলেছে।‘
‘এছাড়া আর কোনওভাবে সেখানে যাওয়া যায় না? চলতে চলতে ঘাড় ফিরিয়ে কয়েক পলক বিনয়কে লক্ষ করলেন বিশ্বজিৎ। তারপর বললেন, যায়। শেল কালেক্টরদের মোর্টর বোট আইল্যান্ডের কোস্ট ধরে ধরে মাঝে মাঝে মিডল আইল্যান্ড, এমনকী আরও দূরে নর্থ আইল্যান্ড অব্দি চলে যায়।তবে কতদিনে যাবে তার ঠিক নেই।’
‘শেল কালেক্টর কাদের বলে?’
বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে দিলেন, সমুদ্রে ডুবুরি নামিয়ে যারা শঙ্খ, কড়ি, যেমন টার্বো ট্রোকাসনটিলাস এমনি নানা জিনিস তুলে আনে তারা হল শেল-কালেক্টর। সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তবেই এসব শেল তোলা যায়। তোলার পর অ্যাসিড দিয়ে সাফ করে পালিশ লাগিয়ে এগুলো বাইরে চালান করা হয়। বিদেশের বাজারে আন্দামানের টার্বো ট্রোকাস নটিলাসের বিপুল চাহিদা।
বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘তা ছাড়া নর্থ আন্দামানের মায়াবন্দরে একটা কোম্পানির অনেকগুলো বিরাট বিরাট কাঠের কারখানা রয়েছে। তাদের ছোট জাহাজ আছে একটা। সেটা মিডল আন্দামান হয়ে কখনও পনেরো দিন, কখনও বা দু তিন মাস পর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মায়াবন্দর যায়।’
নিরাশই হয়ে পড়ে বিনয়। শেল কালেক্টরদের বোট বা কাঠের কারখানার জাহাজের ব্যাপারটা অনেকখানিই অনিশ্চিত। কবে ওদের মিডল আর নর্থ আন্দামানে যাবার দরকার হবে, কে জানে। এমনও তো হতে পারে, পাঁচ-সাত দিনের ভেতর যাবে।
বিনয় জিগ্যেস করে, ‘ওরা কি নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কারওকে নিয়ে যায়?
‘না। তবে–’
‘সরকারি অফিসাররা বললে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে।’
আশার একটু সংকেত যেন দেখতে পায় বিনয়। গভীর আগ্রহে বলে, কয়েকদিনের মধ্যে ওদের বোট বা জাহাজ মিডল আন্দামানে যাবে কিনা সেটা কি জানা যায়।
‘তা হয়তো যায়।’ বলেই বিশ্বজিতের খেয়াল হল, মধ্য আন্দামান সম্পর্কে বিনয়ের কেন এত ঔৎসুক্য? জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি মিডল আন্দামানে যেতে চাইছেন?’
হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।’-ওখানে তো সেটেলমেন্ট হচ্ছে। সেটা দেখাও খুব জরুরি।’
‘অবশ্যই। আগে সাউথ আন্দামানের সেটেলমেন্ট দেখে নিন। তারপর মিডল আন্দামানে যাবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।’
বিনয় বুঝতে পারছে, বিশ্বজিৎ ইচ্ছা করলে শেল কালেক্টরদের বোটে বা কাঠের কারবারিদের জাহাজে তাকে পাঠিয়ে দিতে পারেন। তার মতো বিপুল ক্ষমতাবান অফিসারের হুকুম অমান্য করার মতো বুকের পাটা ওদের কারও হবে না। কিন্তু বোট বা জাহাজ কবে ছাড়বে সেটা বড় মাপের প্রশ্ন। তা ছাড়া এখানে পা। দিতে না দিতেই পোর্ট ব্লেয়ারের চারপাশের পুনর্বাসনের হাল না দেখে সত্তর মাইল দূরের মধ্য আন্দামানে যাবার জন্য এত ব্যগ্র হয়ে ওঠাটা একটু দৃষ্টিকটুই। যতই ব্যাকুল হোক ঝিনুকের সঙ্গে এখনই দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। আপাতত বেশ কিছুদিন বিনয়কে দক্ষিণ আন্দামানেই কাটাতে হবে।
খানিক আগে বিশ্বজিৎ যে উঁচু টিলাটা দেখিয়েছিলেন, চড়াই বেয়ে বেয়ে সবাই এখন সেটার মাথায় উঠছে। নিঃশব্দে খানিকটা চলার পর বিনয় জিগ্যেস করে,
‘একটা খবর জানা যেতে পারে?’
বিশ্বজিৎ জানতে চাইলেন।–’কী খবর?’
‘একটি মেয়ে, উনিশ কুড়ি বছর বয়স, আজ আমাদের সঙ্গে ‘রস’ আইল্যান্ডে এসেছে। সে ‘চলুঙ্গা’ জাহাজে মিডল আন্দামানে গেছে। ও কোন ফ্যামিলির সঙ্গে ওখানকার কোন সেটেলমেন্টে গেল, দয়া করে যদি একটু খোঁজ নেন—’
‘কী নাম মেয়েটির?
‘তাপসী লাহিড়ি। ডাকনাম ঝিনুক।’ বলেই হকচকিয়ে যায় বিনয়। ঝিনুকের নামটা গোপনই রাখতে চেয়েছিল সে। ভেবেছিল, মিডল আন্দামানে গিয়ে সেখানকার সেটেলমেন্টগুলোতে ঘুরে তাকে খুঁজে বার করবে। কিন্তু বিশ্বজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের এই সংকল্পের কথাটা লহমার জন্য ভুলে গিয়েছিল বিনয়। নিজের অজান্তে ঝিনুকের নাম তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।
চলতে চলতে পলকহীন বিনয়ের দিকে তাকাতে থাকেন বিশ্বজিৎ। রীতিমতো অবাকই হন। বিস্ময়টা থিতিয়ে এলে হেসে হেসে বলেন, ‘আশ্চর্য!’
আশ্চর্যটা কী কারণে আন্দাজ করতে পারল না বিনয়। বিশ্বজিৎ এরপর কী বলবেন সেজন্য চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে।
বিশ্বজিৎ লঘু সুরে এবার বললেন, ‘মহারাজা’ জাহাজে চারদিন একসঙ্গে কাটালেন। ‘রস’ আইল্যান্ডেও বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছেন। মেয়েটি কোন ফ্যামিলির সঙ্গে এসেছে, তাকেই তো জিগ্যেস করতে পারতেন।‘ পারতপক্ষে মিথ্যে বলে না বিনয়। তেমন অভ্যাসই নেই। এখন অবলীলায় তাই বলতে হল।-’জাহাজে কি ‘রস’-এ ওকে লক্ষ করিনি। রিফিউজিরা থাকত শিপের খোলে। আমি আপার ডেকে। ও যখন ‘চলুঙ্গা’ জাহাজে মিডল আন্দামান যাচ্ছে তখন দেখতে পেলাম। কিন্তু ‘চলুঙ্গা’ অনেকটা দূরে চলে গেছে।‘
‘নামটাম যখন বলতে পারছেন, মেয়েটিকে ভালোই চেনেন মনে হচ্ছে।’
প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে থাকে বিনয়ের। মুখ ফসকে যখন ঝিনুকের নামটা বেরিয়েই এসেছে কতরকম প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হবে, কে জানে। বিশ্বজিৎ প্রথমেই অবধারিত যা জানতে চাইবেন, এত পরিচিত মেয়েটি কোন পরিবারের সঙ্গে আন্দামানে এসেছে, বিনয় তার খবর রাখে না, সেটাই বিস্ময়কর। এই সুতো ধরে কথা যে উঠবে! গোপন ব্যাপারটা হয়তো আর রাখা যাবে না। বিনয় টের পেল, কপালে দানা দানা ঘাম জমেছে। ঝাপসা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, চিনি।‘
বিশ্বজিৎ এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। বললেন, ‘আপনি যা জানতে চাইছেন, খুব সহজেই তা জানা যাবে। যে রিফিউজিরা আজ এসেছে, তাদের নাম, বয়স, তারা কোন কোন ফ্যামিলির মেম্বার, সেই ফ্যামিলিগুলোর হৈড় কারা, দেশ ইস্ট পাকিস্তানের কোন ডিস্ট্রিক্টে ছিল–ডিটেলে তার লিস্ট আমার অ্যাটাচি কেসে আছে। আমার ড্রাইভার অ্যাটাচিটা নিয়ে জিপে চলে গেছে। সেটা দেখে আপনাকে বলে দেব।’
এটা শুক্লপক্ষ। সূর্যাস্ত হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। চাঁদ উঠে আসছে। কারা যেন জাদুল্লস উপুড় করে রুপোলি জ্যোৎস্না ঢেলে দিতে শুরু করেছে সারা চরাচর জুড়ে।
খাড়াই ভেঙে টিলার মাথায় চলে এসেছিল বিনয়রা। এবার তাদের এ ধারের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে হবে। চড়াই বেয়ে ওঠাটা ভীষণ কষ্টের, কিন্তু উতরাই দিয়ে নামাটা অনেক আরামের।
বেশ খানিকটা দূরে টিম টিম করে প্রচুর আলো জ্বলছিল। বিশ্বজিৎ বললেন, ওই হল এবারডিন মার্কেট। আমাদের ডেস্টিনেশন।
১.৩ ব্যারাকের মতো দালান
তিন দিকে লম্বা লম্বা ব্যারাকের মতো দোতালা-তেতলা দালান ছাড়াও রয়েছে টিনের বা টালির চালের বেশ কিছু বাড়ি। বেশির ভাগ বাড়ির একতলায় নানা ধরনের দোকানপাট। মুদিখানা, ধোবিখানা, ওষুধের দোকান, জামাকাপড়ের দোকান, দাওয়াখানা, ছোটখাট হোটেল ইত্যাদি ইত্যাদি। বিজলিবাতি ছাড়াও কোনও কোনওটায় গ্যাসের আলোও জ্বলছে।
মস্ত মাঠটা বাজারের সামনের দিকে। সেখানে চল্লিশ-পঞ্চাশটা বাঁশের খুঁটি পুঁতে সেগুলোর গায়ে লম্বা ইলেকট্রিকের তার বেঁধে বাল্ব জ্বালানো হয়েছে। মাঠের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বসার জন্য চট পাতা। একধারে কটা চেয়ার এবং সাদা ধবধবে চাদর দিয়ে ঢাকা একটা টেবিল।
প্রচুর লোকজন জমা হয়েছে এখানে। চেহারা দেখে বোঝা যায়। এদের কেউ শিখ, কেউ মাদ্রাজি, কেউ বর্মী, কেউ পাঠান এবং ভারতের নানা অঞ্চলের মানুষ। জনতা কিন্তু চটের ওপর বসেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। চারপাশ থেকে অজস্র মাছির ভনভনানির মতো আওয়াজ আসছে।
এই মাঠে আজ কি মিটিং টিটিং কিছু আছে? যদি থাকেও তার সঙ্গে মেনল্যান্ড থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কী সম্পর্ক? তাদের এখানে নিয়ে আসা হল কেন? বুঝতে না পেরে ধন্দে পড়ে যায় বিনয়। সে কিছু জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিশ্বজিৎ বললেন, ‘যে মাঠটায় আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি তার সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একটা গ্লোরিয়াস চ্যাপটার জড়িয়ে আছে।‘
আন্দামান সম্পর্কে নানা বইপত্র পড়েছে বিনয়। সে জানে আঠারোশো সাতান্নর মিউটিনির পর ইংরেজরা বহু সিপাহিকে গুলি করে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। অনেককে পোর্ট ব্লেয়ারে নির্বাসনে পাঠায়। তারপর বিশ শতকের গোড়ার দিকে। দেশের মুক্তির জন্য যখন সশস্ত্র অভ্যুত্থান শুরু হল তখন বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র এবং ভারতের অন্য সব প্রভিন্স থেকে বিপ্লবীদের ধরে ধরে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে নিয়ে আসা হয়। এবারডিন মার্কেটের সামনের মাঠটায় এমন কিছু কি ঘটেছিল যাতে বিদ্রোহী সিপাহি বা পরবর্তী কালের বিপ্লবীরা জড়িত ছিলেন? বিনয়ের তা জানা নেই।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্দামানে এসেছিলেন। এই মাঠে তিনি আমাদের জাতীয় পতাকা তুলেছেন।‘
সারা শরীরে শিহরন অনুভব করে বিনয়। পরক্ষণে গভীর বিষাদে মন ভরে যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক আর ফিরে আসেননি। কাগজে মাঝে মাঝেই খবর বেরয়, তিনি আসছেন, তিনি আসছেন। কিন্তু আসেন আর না। দেশের মানুষ বিপুল প্রত্যাশা আর অসীম উৎকণ্ঠা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। বিনয় তাদেরই একজন। হঠাৎ তার মনে হল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে এই তো সেদিন। মাত্র কয়েক বছর আগে। তখন কি বিশ্বজিৎ এই দ্বীপে ছিলেন? থাকা অসম্ভব নয়। উৎসুক সুরে জিগ্যেস করে, ‘আপনি কি নেতাজিকে দেখেছেন?’
‘না। আমি স্বাধীনতার পর পোর্ট ব্লেয়ারে এসেছি।‘ বিশ্বজিৎ বললেন, ‘তবে আমার কাকা তাকে দেখেছেন।‘
সব কেমন যেন গুলিয়ে গেল। রীতিমতো অবাকই হল বিনয়। বলল, ‘আপনার কাকা! তিনি কীভাবে—’
তাকে শেষ করতে দিলেন না বিশ্বজিৎ। ‘কাকা নাইনটিন টোয়েন্টিতে আন্দামানে এসেছিলেন। সেই থেকে এখানেই আছেন।‘
নাইনটিন টোয়েন্টি। অর্থাৎ সেটা ইংরেজ আমল। বিশ্বজিতের কাকা সম্পর্কে কৌতূহল প্রবল হয়ে ওঠে বিনয়ের। সে জানতে চায়, উনি কি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কোনও সারভিস নিয়ে এই আইল্যান্ডে এসেছিলেন?
‘একেবারে উলটো।‘ বিশ্বজিৎ হাসলেন।–’ইংরেজদের গোলামি করার কথা তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না। বরং এ দেশ থেকে তাদের উৎখাত করাই ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। কাকা ছিলেন একজন সশস্ত্র বিপ্লবী–ইংরেজরা বলত টেররিস্ট।‘
বিশ্বজিৎ বিশদভাবে জানালেন তাঁর কাকা শেখরনাথ কর এবং আরও কয়েকজন বিপ্লবী উনিশশো আঠারোয় বিহারে একটি মেল ট্রেনে হানা দিয়েছিলেন। কানপুর থেকে একটা বগিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ট্রেনটা কলকাতায় যাচ্ছিল। শেখরনাথদের উদ্দেশ্য, অস্ত্রগুলো লুট করা।
বগিটা পাহারা দিয়ে আনছিল পুলিশের বড়সড় একটা বাহিনী আর দু’জন জঁদরেল ব্রিটিশ অফিসার। দু’পক্ষের গোলাগুলিতে তিনজন বিপ্লবী মারা যান, কয়েকজন মারাত্মক জখম হন। ওদিকে একজন ব্রিটিশ অফিসার আর তিনজন কনস্টেবলেরও মৃত্যু হয়, চার-পাঁচজন কনস্টেবলেরও গুরুতর চোট লাগে। তখন মধ্যরাত। অন্য কামরাগুলোতে যাত্রীরা ঘুমাচ্ছিল। গুলির আওয়াজে তারা জেগে ওঠে। আতঙ্কে হইচই করতে করতে ট্রেনের অ্যালার্ম চেন টেনে দেয়। শেখরনাথ এবং তার পাঁচ সঙ্গীর হাতে পায়ে গুলি লেগেছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল সারা গা। সেই অবস্থাতেই ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যান।
অন্ধকারে তিন বিপ্লবী দৌড়তে দৌড়তে বিহারের এক অজ দেহাতে লুকিয়ে ছিলেন কিন্তু পুলিশ গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেখানে পৌঁছে যায়। ধরা পড়ার পর কিছুদিন অকথ্য নির্যাতন চলে। তারপর বিচার। আইনকানুন ইংরেজদের, আদালত ইংরেজের, বিচারক ইংরেজ। ফলে যা হবার তা-ই হল। দুই বিপ্লবীর ফাঁসি হয়ে গেল আর শেখরনাথকে পাঠানো হল সেলুলার জেলে। বাকি। জীবন এখানেই তাকে কাটাতে হবে। সেলুলার জেলের সলিটারি সেলে কয়েক বছর আটকে রাখার পর তাকে জেলখানার বাইরে আনা হয়। তখন পোর্টব্লেয়ারে পাহাড় কেটে নতুন নতুন রাস্তা বানাচ্ছে পি.ডব্লু.ডি, শেখরনাথকে সেখানে হিসাব রাখার কাজ দেওয়া হয়। কারাগারের নির্জন কুঠুরি থেকে একটুখানি মুক্তি পেলেন ঠিকই, কিন্তু মেনল্যান্ডে যে পালিয়ে আসবেন তার উপায় নেই। চারদিকে গভীর জঙ্গল আর সমুদ্র। জঙ্গলে রয়েছে হিংস্র আদিবাসীরা, সমুদ্রে তাদের চেয়েও ভয়ংকর ঝাঁকে ঝাকে হাঙর। যেদিকেই যান, পালানো অসম্ভব। ধীরে ধীরে আন্দামানকে ভালোবেসে ফেললেন শেখরনাথ, আশ্চর্য এক মায়ায় জড়িয়ে গেলেন বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার সঙ্গে। স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ডে ফিরে যেতে পারতেন। যাওয়া হয়নি।
অবাক বিস্ময়ে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। যেন এক অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর কাহিনি। জগদীশ গুহঠাকুরতা বারবার বলে দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র উদ্বাস্তু পুনর্বাসন নয়, আন্দামনের সমস্ত দিক নিয়ে তাকে লেখা পাঠাতে হবে। বিশেষ করে জোর দিতে হবে। সেলুলার জেলের ওপর। কুখ্যাত এই জেলখানায় জীবনের বহু মূল্যবান সময় কাটিয়ে দিয়েছেন শেখরনাথ। তার কাছ থেকে ব্রিটিশ আমলে এই বন্দিশালায় কী ধরনের নির্মম উৎপীড়ন চালানো হত, সেসব তথ্য জানা যাবে।
বিনয় ব্যগ্র হয়ে ওঠে।-কাকার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। ওঁকে কোথায় পাওয়া যাবে?
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘নিশ্চয়ই আলাপ হবে। তবে আপাতত উনি পোর্টব্লেয়ারে নেই, লিটল আন্দামানে গেছেন। দু’চার দিনের ভেতর ফিরে আসবেন।‘
‘আজ যে উদ্বাস্তুরা এসেছে আমি তো তাদের সঙ্গে পুনর্বাসনের জায়গায় চলে যাব। কাকার সঙ্গে দেখা হবে কী করে? বিনয়ের গলায় হতাশা ফুটে বেরয়।
তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়ে বিশ্বজিৎ বললেন, কাকা এখন উদ্বাস্তুদের মধ্যে কাজ করছেন। আপনি যেখানে যাচ্ছেন, লিটল আন্দামান থেকে ফিরেই তিনি সেখানে চলে যাবেন।
আরও অনেক প্রশ্ন ছিল বিনয়ের, কিন্তু সেসব করা হল না।
‘বইয়া (বসে) পড়েন, বইয়া পড়েন।’ ওদিকে তুমুল হাঁকাহাঁকি করে চটের আসনের ওপর বসিয়ে দিতে লাগল নিরঞ্জন আর বিভাস। সভাটভা যা-ই হোক তা যে উদ্বাস্তুদের জন্যই, সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে। তবে উদ্দেশ্য ধরা যাচ্ছেনা।
এলাকাটা ঘিরে আগে থেকেই জমায়েত হয়েছিল, তাদের মধ্যে হঠাৎ চাঞ্চল্য দেখা গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা ধবধবে ফিয়েট গাড়ি আর একটা জিপ এসে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়ে। জিপ থেকে নেমে আসে তিন চারজন কনস্টেবল। ফিয়েট থেকে মাঝবয়সি একজন–বেশ সুপুরষ। চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, মাথায় ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল। চেহারায় প্রবল একটা ব্যক্তিত্ব রয়েছে। পরনে ঢোলা ট্রাউজার্স এবং শার্ট।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘চিফ কমিশনার এসে গেছেন। চলুন আমার সঙ্গে।’ বলে ব্যস্তভাবে এগিয়ে গেলেন। তার পাশাপাশি লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল বিনয়। প্রৌঢ়টি যে চিফ কমিশনার, আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হয় না।
চিফ কমিশনারের কাছে এসে সসম্ভ্রমে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আসুন স্যার–’ টেবিল চেয়ারগুলো যেখানে সাজানো রয়েছে। তাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল বিনয়।
ইংরেজিতেই কথা বলছিলেন বিশ্বজিৎরা। বোঝা গেল, চিফ কমিশনার অবাঙালি। তিনি চেয়ারে বসলেন না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তুদের উদ্দেশে যা বললেন, মোটামুটি এইরকম। ‘আন্দামানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। দেশভাগের পর সব কিছু হারিয়ে আপনারা ভারতে চলে এসেছিলেন। নিদারুণ কষ্ট আর দুর্ভোগের মধ্যে আপনাদের দিন কেটেছে। পশ্চিমবাংলা ছোট রাজ্য। সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেবার মতো যথেষ্ট জমি নেই। তাই বাংলার বাইরে উদ্বাস্তুদের পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানের এই দ্বীপে। কিন্তু আন্দামান সম্পর্কে ইন্ডিয়ান মেনল্যান্ডের মানুষের ভীষণ ভয়, অস্বস্তি। সংশয় কাটিয়ে আপনারা যে শেষ পর্যন্ত এখানে এসেছেন, এতে আপনাদের ভালোই হবে। আপনাদের জন্য প্রচুর জমি ঠিক করা আছে। এখানে সুখে শান্তিতে বাস করুন। আন্দামানের সব অফিসার আর কর্মী আপনাদের সমস্তরকম সাহায্য করবেন।’
পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর কথাগুলো বাংলায় তরজমা করে দিতে লাগলেন বিশ্বজিৎ।
ভাষণ শেষ করে চিফ কমিশনার উদ্বাস্তুদের মধ্যে চলে গেলেন। নিরঞ্জন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনেরা হলে উইঠা খাড়। চিফ কমিশনার সাহেব আপনেগো লগে আলাপ করবেন।
উদ্বাস্তুরা লহমায় উঠে দাঁড়াল। সবাই ত্রস্ত, সচকিত।
চিফ কমিশনারের সঙ্গে বিশ্বজিৎও এসেছিলেন। উদ্বাস্তুদের চোখমুখের চেহারা লক্ষ করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। আমি তো আছি। উনি যা জিগ্যেস করছেন তার জবাব দেবেন।
বয়স্কদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন চিফ কমিশনার। পূর্ব পাকিস্তানে কার বাড়ি কোথায় ছিল, কতদিন আগে দেশ থেকে চলে এসেছে, কলকাতায় কোথায় কাটিয়েছে, জাহাজে পোর্টব্লেয়ারে আসতে কোনওরকম কষ্ট হয়েছে কি না, ‘রস’ আইল্যান্ডে নেমে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করেছে কি না ইত্যাদি।
বিশ্বজিতের ভূমিকাটা দোভাষীর। সমানে ইংরেজি থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে ইংরেজি করে যাচ্ছিলেন।
আলাপ-টালাপ হয়ে গেলে আবার সেই টেবিল চেয়ারগুলোর কাছে চলে এলেন চিফ কমিশনার। বিশ্বজিৎকে জিগ্যেস করলেন, ‘এদের কি কাল রিহ্যাবিলিটেশনের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে, না দু’একদিন ওরা পোর্টব্লেয়ারে থেকে যাবে?’
বিশ্বজিৎ জানালেন, ‘না স্যার। রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালে ডি.পি ফ্যামিলিগুলোকে নিয়ে যাওয়া হবে।’
‘দেখো, ওদের যেন কোনও অসুবিধে না হয়।’
‘হবে না। সব ব্যবস্থা করা আছে।’
‘গুড। আমি এখন যাচ্ছি–’
চিফ কমিশনার তার ফিয়েটের দিকে পা বাড়াতে যাবেন, হঠাৎ বিনয়ের কথা মনে পড়ে গেল বিশ্বজিতের। বলল, ‘স্যার, একজনের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব।
‘কে?’
বিশ্বজিৎ বিনয়কে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন। চিফ কমিশনার রীতিমতো খুশি। বললেন, ‘আপনিই বোধহয় প্রথম সাংবাদিক যিনি আন্দামানের রিফিউজি সেটলমেন্ট দেখতে এলেন। মোস্ট ওয়েলকাম।‘ একটু থেমে ফের বলেন, ‘খবর পাচ্ছি রিফিউজিরা যাতে এখানে না আসে সে জন্যে কোনও কোনও পলিটিক্যাল পার্টি কলকাতায় অ্যাজিটেশন শুরু করেছে? কী চাইছে পার্টিগুলো? ওদের মুভমেন্ট কি বিরাট আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে?’
এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব জানা নেই বিনয়ের। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় এখন রিফিউজিদের নিয়ে কত যে মিছিল চোখে পড়ে! পার্কে পার্কে মিটিং। স্লোগানে স্লোগানে আকাশ চৌচির হয়ে যায়। নিজের চোখে বিনয় ক’মাস আগে মিশন রো’তে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে পুলিশের তুমুল লড়াই দেখেছে। বেপরোয়া লাঠি, টিয়ার গ্যাস, এমনকী গুলিও চালিয়েছে পুলিশ। উদ্বাস্তুরা মুখ বুজে বরদাস্ত করেনি; খোয়া ইট হাতের কাছে যা পেয়েছে তারাও পুলিশের দিকে তাক করে সমানে ছুঁড়ে গেছে।
অনেকে বলে কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্য বামপন্থী দলগুলো উদ্বাস্তুদের মধ্যে ‘বেস’ তৈরি করার জন্য তাদের খেপিয়ে তুলছে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যাদের কোনও আশা নেই, ভবিষ্যৎ নেই, চোখের সামনে শুধুই অনন্ত তমসা, এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ওরা নিজেদের শক্তি বাড়াতে চায়।
বিনয় অস্বস্তি বোধ করছিল। বলল, ‘পার্টিগুলোর মোটিভ কী, আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে নানা লোকে নানা কথা বলে।‘ কী বলে সেটা আর জানায় না।
চিফ কমিশনার এ ব্যাপারে আর কিছু জিগ্যেস করলেন না। একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।–’আপনি রিফিউজি সেটলমেন্টগুলোতে যান। ঘুরে ঘুরে দেখুন রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ কীভাবে চলছে। ত্রুটি চোখে পড়লে নিশ্চয়ই লিখবেন। কনস্ট্রাকটিভ সমালোচনা সব সময় কাম্য। কিন্তু দয়া করে এমন কিছু লিখবেন না যাতে কলকাতায় আগুন লেগে যায়। তাহলে যা-ও রিফিওজি আসছে, সেটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। পুনর্বাসনের এত বড় একটা পরিকল্পনা যাতে বানচাল না হয়ে যায়। সেটা মাথায় রাখবেন। আচ্ছা, নমস্কার—’ ক’পা এগিয়ে তিনি তার গাড়িতে উঠে পড়েন।
এধারে নিরঞ্জন আর বিভাস চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল, মালপত্তর কান্ধে (কাঁধে) তুইলা আমাগো লগে চলেন। নিশ্চয় হগলটির (সকলের) ক্ষুদা পাইছে। কয়দিন সমুন্দুরে ঝড়-তুফানে। আপনেগো দলামোচড়া কইরা ছাড়বে। আইজ সকালে ‘রস’-এ। নামনের পর সারাটা দিন শরীলের উপর দিয়া মেলা (অনেক) তাফাল গেছে। আমাগো লোকেরা ভাত ডাইল মাছ তরকারি রাইন্ধা বাড়ছে। গিয়া খাইয়া শুইয়া পড়বেন। ঘুমটা জবর দরকার।
উদ্বাস্তুরা যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল।
শহরের যেসব দোকানদার, হোটেলওয়ালা, মুদি, সেলুনওয়ালা জড়ো হয়েছিল, চিফ কমিশনার গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারাও সরে পড়েছে।
এধারে বিনয় বলছিল, সকালে পোর্টব্লেয়ারের ভি আই পি বাঙালিরা রিফিউজিদের রিসিভ করতে ‘রস’ আইল্যান্ডে গিয়েছিলেন। সন্ধেবেলা চিফ কমিশনার এবারডিন মার্কেটের সামনে তাদের রিসিভ করলেন। এটাই নিয়ম নাকি?’
‘আপনি লক্ষ করেছেন দেখছি।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘নিয়ম ঠিক নয়, তবে আন্দামানের রিফিউজি আসা শুরু হতেই এটা চলছে। আসুন, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন—’
একটু অবাক হল বিনয়! –’কোথায়?’
‘কোথায় আবার? আমার বাংলোয়।’
‘সে হয় না। রিফিউজিরা আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না।’
‘আমি ওদের সঙ্গে কথা বলছি।’
‘কিন্তু—’
‘আবার কী?’
‘কাল সকালে ওরা নতুন সেটলমেন্টের জায়গায় চলে যাবে। ওদের সঙ্গে আমারও তো যাওয়া দরকার।‘
বিশ্বজিৎ হাসলেন।–’যাবেন, নিশ্চয়ই যাবেন। আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব। চিন্তা করবেন না।’
উদ্বাস্তুরা কিন্তু নাছোড়। রাত্তিরটা বিশ্বজিতের বাংলোয় গিয়ে বিনয় থাকবে, এটা জানাতেই হুলস্থুল বেধে গেল। বিনয় কড়ার করেছিল, যতদিন না আন্দামানের পুনর্বাসন কেন্দ্রে শরণার্থীরা থিতু হয়ে বসছে সে তাদের সঙ্গে থাকবে। বিনয় আন্দামানে পা দিয়েই যদি অন্য কোথাও রাত কাটাতে যায় কার ভরসায় তারা থাকবে? বিনয় কাছে না থাকলে তারা সেটলমেন্টে তো যাবেই না, এমনকী আজ রাতের জন্য নিরঞ্জনরা সেখানে তাদের নিয়ে যেতে চাইছে, যেখানেও যাবে না।
উদ্বাস্তুদের আশঙ্কাটা কোথায়, মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছিল বিনয়। ওরা হয়তো ভেবেছে, ভুজুং ভাজুং দিয়ে আন্দামানে তাদের পৌঁছে দিয়ে বিনয় কলকাতায় চলে যাবে। বিশ্বজিৎ রাহার বাংলোয় রাত কাটাতে যাওয়াটা কৌশলমাত্র। কাল আর সে তাদের কাছে ফিরে আসবে না। আন্দামানের চিফ কমিশনার থেকে বড় বড় অফিসার এবং পুরো পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা তাদের যথেষ্ট খাতিরযত্ন করেছে। কিন্তু তাদের ওপর মাত্র একদিনে উদ্বাস্তুদের আস্থা তৈরি হয়নি। বিনয়কে তাদের পাশে চাইই চাই।
বিনয় বলল, ‘আপনাদের হয়তো মনে হয়েছে, এই যে রাহাসাহেব আমাকে তার বাংলোয় নিয়ে যেতে চাইছেন, এর পেছনে আমার কু-মতলব রয়েছে। কিন্তু আপনারা তো শুনেছেন, মুখের কথা খসালেই কলকাতায় ফেরা যায় না। তিন সপ্তাহ পর পর এখান থেকে কলকাতার জাহাজ ছাড়ে। কম করে তিন সপ্তাহ আমাকে এখানে থাকতেই হবে। নিশ্চিন্ত থাকুন, কাল সকালেই আপনাদের কাছে চলে আসব।‘
উদ্বাস্তুরা তাকে ঘিরে ধরেছিল৷ ভিড়ের সামনের দিকে রয়েছে হলধর দাস। তার কাঁধে একটা হাত রেখে বিনয় বলল, ‘আপনি তো জানেন, আপনাদের হেমকর্তার নাতি মিছে কথা বলে না।
অনেক বোঝানোর পর উদ্বাস্তুরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রাজি হল। আজ রাতটা বিনয় বিশ্বজিৎ রাহার বাংলোয় থাকতে পারে।
বিশ্বজিতের ড্রাইভার কালীপদ তার জিপ নিয়ে ঘুরপথে মাঠের পাশের রাস্তায় এসে অপেক্ষা করছিল। বিনয়কে সঙ্গে করে তিনি সেদিকে চলে গেলেন।
এদিকে বিভাস আর নিরঞ্জন লাইন দিয়ে উদ্বাস্তুদের নিয়ে চলেছে এবারডিন মার্কেটের ডানধারের রাস্তার দিকে। বিনয়ের ধারণা ওখানেই কোথাও শরণার্থীদের রাতে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
১.৪ এবারডিন বাজার
এবারডিন বাজার থেকে যে রাস্তাটা পশ্চিম দিকে,গেছে, সেটা ধরে জিপ ছুটছিল। পাহাড়ি শহর। উঁচু-নিচু পথ। গাড়ি একবার টিলার মাথায় উঠছে, তার পরেই নেমে যাচ্ছে নিচে। চড়াই-উতরাইতে ওঠানামা করতে করতে নাচের তালে দৌড়াচ্ছে জিপটা।
বাজারের জমজমাট এলাকা ছাড়ানোর পর সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। শহর এধারে তেমন দানা বাঁধেনি। দূরে দূরে ছাড়া ছাড়া দু’চারটে বাড়ি চোখে পড়ে। গাড়ি টিলার ওপর চড়লে দু’পাশে গাছ। সেখানে ঝোঁপঝাড়, বুনো গাছের জটলা। উতরাইতে নামলে কিন্তু দৃশ্যটা বদলে যাচ্ছে। এবার ডাইনে বাঁয়ে দুদিকেই সমতল জমিতে ধানের খেত।
রাস্তায় অনেকটা দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে মিটমিট করে দু-একটা বা জ্বলছে। • সেগুলো থাকা না-থাকা সমান। জোনাকির আলোও তার চেয়ে জোরালো। তবে পূর্ণিমার চাঁদ আকাশের অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছে। অঢেল জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মাইল নিচের পৃথিবী।
জিপের পেছন দিকের সিটে পাশাপাশি বসেছিল বিনয় আর বিশ্বজিৎ। বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ কেটেছে। অন্যমনস্কর মতো বাইরের দৃশ্যাবলি দেখছে বিনয়। নতুন একটা জায়গায় এলে সেখানকার সম্বন্ধে আগ্রহ থাকাটা স্বাভাবিক।
‘বিনয়বাবু-’
বিশ্বজিতের ডাক কানে আসতে মুখ ফিরিয়ে তাকায় বিনয়।–’কিছু বলবেন?’
‘হ্যাঁ। ‘রস’ আইল্যান্ডে উদ্বাস্তুরা নামার পর থেকে ওদের যেভাবে রিসিভ করা হয়েছে সেটা আপনার কেমন লাগল?’
‘চমৎকার।’ বিনয় বলতে লাগল, ‘সব চেয়ে আমার ভালো লেগেছে চিফ কমিশনারকে। আন্দামানের বিশিষ্ট বাঙালিরা। রিফিউজিদের ভরসা দেবার জন্য ছুটে যাবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নন-বেঙ্গলি চিফ কমিশনার বাঙালি উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে এতটা সিমপ্যাথেটিক, ভাবতে পারিনি।’
চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বিশ্বজিৎকে। তার মুখে বিচিত্র একটু হাসি ফুটে ওঠে। কী আছে সেই হাসিতে? ব্যঙ্গ? মজা? না তান্য কিছু?
কয়েক লহমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়। তারপর দ্বিধাগ্রস্তের মতো জিগ্যেস করে, হাসছেন যে?’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘লোকটার দুটো চেহারা আছে। একটা আপনি দেখেছেন।’
‘সেটা এত তাড়াতাড়ি কি বোঝা যাবে? সবে তো এলেন–’ বলতে বলতে থেমে গেলেন বিশ্বজিৎ। ধীরে ধীরে মুখটা ওধারের জানলার দিকে ফিরিয়ে আনমনা তাকিয়ে রইলেন।
বিনয় বুঝে নিল, এ নিয়ে আপাতত মুখ খুলবেন না বিশ্বজিৎ। তার মনে একটা ধন্দ ঢুকে গেল। চিফ কমিশনারকে যেটুকু দেখা গেছে তাতে বেশ ভালোই লেগেছে। অমায়িক, সহানুভূতিশীল। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা কিন্তু লেশমাত্র অহমিকা নেই। এই সদয়, স্নিগ্ধ মুখের আড়ালে অন্য যে মুখটি লুকনো রয়েছে সেটা কেমন, অনুমান করতে চাইল বিনয়। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, চিফ কমিশনারের চিন্তাটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঝিনুকের মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে। উদ্বাস্তুরা তাকে ছাড়তে চাইছিল না। তবু বিশ্বজিৎ তাকে যে একরকম টেনে নিয়েই তার বাংলোয় চলেছেন সেটা একদিক থেকে ভালোই হল। বিশ্বজিতের অ্যাটাচিতে উদ্বাস্তুদের নামের যে দীর্ঘ তালিকাটা রয়েছে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আজ রাতেই ঝিনুক কাদের সঙ্গে এসেছে, বার করা যাবে।
অনেকটা দৌড়ের পর একটা চৌমাথায় চলে এল বিনয়দের জিপ। কালীপদ গাড়িটা ঘুরিয়ে ডানপাশের রাস্তায় নিয়ে গেল। মোড়ের মুখেই বাঁ দিকে প্যাগোডা ধরনের বড় বিল্ডিং।
বিশ্বজিং ওধারের জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘এটা ফুঙ্গি চাউং–বুদ্ধমন্দির। আর খানিকটা গেলেই আমার বাংলো।’
বিনয়ের মনে পড়ে গেল, ব্রহ্মদেশ ব্রিটিশ আমলে ছিল ভারতের একটি প্রদেশ। উনিশশো পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত সেখান থেকে কয়েদিদের পাঠানো হত আন্দামানে। এদের বেশিরভাগই বৌদ্ধধর্মের উপাসক। খুব সম্ভব সেই কারণে এখানে ‘ফুঙ্গি চাউং’ গড়ে তোলা হয়েছে।
বুদ্ধমন্দির পেছনে ফেলে আরও দুতিনটে ছোট ছোট টিলা পেরিয়ে একটা অনেক উঁচু টিলার ঢালে চলে এল জিপ। নিচেই উপসাগর। বিনয় আন্দাজ করে নিল এটা সিসোস্ট্রেস বে। ‘রস’ আইল্যান্ডের দিক থেকে বেঁকে এধারে চলে এসেছে।
টিলার গায়ে বেশ কটা কাঠের বাংলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
একটা দোতলা বাংলোর কমপাউন্ডের ভেতর জিপটা নিয়ে এসে থামিয়ে দিল কালীপদ।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এই আমার আস্তানা। আসুন—’
দু’জনে নেমে পড়ল।
বাইরের দিকে ক’টা বাল জুলছিল। সেই আলোয় দেখা গেল, বাংলোর গ্রাউন্ড ফ্লোরে দু-তিনটে ঘর ছাড়া বাকি অংশটা ফাঁকা; সেখানে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা।
একপাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বিশ্বজিৎ কালীপদকে বললেন, ‘আমার অ্যাটাচি আর বিনয়বাবুর সুটকেস-টুটকেস ওপরে নিয়ে আয়।‘
দোতলায় উঠলেই বড় একটা হল-ঘর। কাঠের ফ্লোরে জুটের কাপেট পাতা। তার একধারে দু’সেট বেতের সোফা, সেন্টার টেবিল। আরেক পাশে ডাইনিং টেবিল এবং অনেকগুলো চেয়ার। সিলিং থেকে চারটে ফ্যান ঝুলছে। দু’পাশের দেওয়ালে ল্যাম্পশেডের ভেতর জোরালো আলো জ্বলছিল। একপাশের দেওয়াল জুড়ে কাঁচের পাল্লা দেওয়া আলমারি। সেগুলো রকমারি বইয়ে ঠাসা। হলঘরটি ঘিরে চারটে বেডরুম, কিচেন ইত্যাদি।
বিনয়দের পায়ের আওয়াজে কিচেন আর বেডরুমগুলোর দিক থেকে তিনজন বেরিয়ে এল। বয়স কুড়ি থেকে চল্লিশ বিয়াল্লিশের মধ্যে। দেখেই বোঝা যায় কাজের লোক।
একটা সোফায় বিনয়কে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসলেন বিশ্বজিৎ। বিনয়ের সঙ্গে তিনজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন।—এঁর কথা তোমাদের বলেছি। যতদিন আন্দামানে আছেন, মাঝে মাঝে আমাদের এখানে এসে থাকবেন। পুবদিকের বড় ঘরটায় ওঁর জন্যে বিছানা-টিছানা করে রাখা হয়েছে তো?’
তিনজনই ঘাড় কাত করে-হয়েছে।
‘রান্নাটান্না?’
ওরা জানায়, তাও হয়ে গেছে।
বিনয় বুঝতে পারে, তাকে যে এখানে নিয়ে আসবেন তা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন বিশ্বজিৎ।
এবার কাজের লোকেদের নামগুলোও বিনয়কে জানিয়ে দেন বিশ্বজিৎ। সবচেয়ে কমবয়সি ছেলেটির নাম গোপাল, যার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ সে কার্তিক আর বয়স্ক লোকটি হল ভুবন।
বিশ্বজিৎ ভুবনকে বললেন, ‘আমাদের জন্যে গরম চা নিয়ে এসো। আগুন আগুন। ঠান্ডা শরবত যেন না হয়ে যায়।’কার্তিককে বললেন, ‘জল গরম করে আমার আর বিনয়বাবুর ঘরের বাথরুমে দিয়ে আসবে। দেরি করো না।
কার্তিক আর ভুবন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঝটিতে দু’জনে ভেতর দিকে চলে যায়। নিশ্চয়ই কিচেনে। তবে গোপাল একধারে উদগ্রীব দাঁড়িয়ে থাকে, যদি তাকে কোনও ফরমাশ দেওয়া হয় তারই অপেক্ষায়।
বিনয়ের কৌতূহল হচ্ছিল। কাজের লোকেরা আছে ঠিকই, তবু বাংলোটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। একটু ইতস্তত করে জিগ্যেস করল, ‘আর কারওকে তো দেখছি না।’
ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলেন বিশ্বজিৎ। কয়েক পলক স্থির দৃষ্টিতে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার চোখে কৌতুক ঝিলিক দিয়ে যায়। হঠাৎ শব্দ করে হেসে ওঠেন। স্বচ্ছ, নির্মল, প্রাণখোলা হাসি। হাসতে হাসতেই বলতে থাকেন, কী ভেবেছিলেন, গন্ডাখানেক আন্ডা বাচ্চা নিয়ে বেশ রসেবশে আছি? আমি একদম একা। চিরকুমার থাকব কি না, জানি না। তবে কোনও মহিলা নিয়ার ফিউচারে মিসেস রাহা হয়ে আমার লাইফে আবির্ভূত হবেন, এমন সম্ভাবনা আপাতত নেই। কাকা আছেন তার কথা আপনাকে বলেছি। তিনি কনফার্মড চিরকুমার। আন্দামানের দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে বেড়ান। রিসেন্টলি রিফিউজিরা আসতে শুরু করেছে। তাদের সঙ্গেই ইদানীং বেশির ভাগ সময়টা কাটান। পোর্টব্লেয়ারে যখন আসেন, আমার কাছেই থাকেন।
ভুবন চা দিয়ে গেল। কাপ তুলে নিয়ে বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘অবশ্য আমার মা, দুই বোন আর এক ভাই কলকাতার বরানগরে থাকে। বছরে একবার এসে কয়েকদিন এখানে কাটিয়ে যায়। আমার বাবা নেই। এই যে বাংলোটা দেখছেন এটা পুরোপুরি ভৃত্যতান্ত্রিক। ভুবন, গোপাল, কার্তিক, আর কালীপদ দিনের পর দিন আমার সব ঝক্কি সামলায়।’
কালীপদ বিনয়ের মালপত্র আর বিশ্বজিতের অ্যাটাচিটা মাথায় কাঁধে চাপিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল। বিশ্বজিৎ তাকে বললেন, ‘বিনয়বাবুর জিনিসগুলো পূর্ব দিকের ঘরে রেখে অ্যাটাচিকেসটা আমার ঘরের আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখবে।’
বিনয়ের বুকের ভেতর জোরালো কঁকুনি লাগে। বলতে যাচ্ছিল, ‘অ্যাটাচিটা এখানে থাক। রিফিউজিদের লিস্টটা দেখব’ কিন্তু বলা গেল না। ঝিনুকের জন্য সে কতটা ব্যগ্র হয়ে আছে, তার সঙ্গে ঝিনুকের সম্পর্কটা কী ধরনের সেসব বিশ্বজিৎকে জানানো যায়নি। মাত্র একদিনের পরিচয়ে জীবনের গোপন দহন কি খুলে মেলে দেখানো যায়? বিশ্বজিৎকে সে শুধু বলেছিল, ঝিনুক নামে একটি মেয়ের খোঁজ করছে। চেনাজানা কারও সম্বন্ধে জানতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেটাকে খুব সম্ভব লঘুভাবেই নিয়েছেন বিশ্বজিৎ, তেমন গুরুত্ব দেননি। হয়তো ভেবেছেন, যখন হোক নামের তালিকা ঘেঁটে বিনয়কে বললেই হল। কিন্তু বিনয়ের এই সন্ধানের পেছনে কতখানি উৎকণ্ঠা, কতখানি ব্যাকুলতা আর আবেগ জড়িয়ে রয়েছে, তিনি বুঝবেন কী করে?
বিশ্বজিৎ এবার বললেন, ‘আমার কথা শোনালাম। জগদীশ কাকা লিখেছেন, লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর সঙ্গে ইস্ট পাকিস্তান থেকে আপনি ইন্ডিয়ায় চলে এসেছেন। ব্যস, এটুকুই। আপনার সম্বন্ধে, পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্বন্ধে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু রাত হয়েছে। তাছাড়া সারাদিনের স্ট্রেনে আপনি আমি দুজনেই ভীষণ টায়ার্ড। আজ থাক। পরে আপনার কথা শোনা যাবে।’
কার্তিক এসে খবর দিল বাথরুমে গরম জল দেওয়া হয়েছে।
.
খাওয়াদাওয়া চুকতে ঢুকতে বেশ রাত হয়ে গেল। বিনয়কে পুব দিকের ঘরে পৌঁছে দিয়ে দক্ষিণ দিকে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন বিশ্বজিৎ।
বিনয়ের ঘরের মাঝখানে মস্ত খাট ছাড়াও রয়েছে আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, আর্ম চেয়ার, মেঝেতে জুট কার্পেট ইত্যাদি। শিয়রের দিকে এবং ডানপাশে কাঠের দেওয়ালের গায়ে মস্ত জোড়া জানালা। পাল্লাগুলো খোলা।
ধবধবে নরম বিছানায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল বিনয়। দুই দেওয়ালে দুটো আলো জ্বলছিল; এক সময় নিভিয়ে দিয়ে শুয়েও পড়ে সে।
সাড়ে চার দিনের সমুদ্রযাত্রা, তার ভেতর পুরো একটা রাত সাইক্লোনের তুমুল তাণ্ডবের মধ্যে কেটেছে। আজ ‘রস’ আইল্যান্ডে নামার পর লহমার জন্যও বিশ্রাম হয়নি। কত মানুষ, কত রকমের ঘটনা, সারাক্ষণ হইচই। এসবের মধ্যে গা এলিয়ে জিরিয়ে নেবার মতো ফুরসত কোথায়?
সারা শরীরে অসীম ক্লান্তি। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু ঘুম আসছে না। খানিকটা সময় এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ল বিনয়। বিছানা থেকে নেমে শিয়রের দিকের জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁয়ে ঘন জঙ্গলে ঢাকা মাউন্ট হ্যারিয়েটের গায়ে সেই সাদা ক্রসটা চোখে পড়ছে। ডাইনে কোনাকুনি পাহাড়ের মাথায় সেলুলার জেল। সামনের দিকে সোজাসুজি যতদূর চোখ যায় উপসাগর–সিসোস্ট্রেস বে।
পোর্টব্লেয়ার এখন একেবারে নিঝুম। কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ বা মানুষ, কেউ জেগে নেই। কিন্তু সমুদ্র বুঝিবা কখনও ঘুমায় না। বহুদুর থেকে জ্যোৎস্নার রুপোলি তবক-মোড়া ঢেউয়ের পর ঢেউ সশব্দে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। অবিরল। ক্লান্তিহীন। আর আছে জোরালো হাওয়া; সমুদ্র ফুঁড়ে উঠে এসে শহরের বাড়িঘর, উঁচু উঁচু ঝাকড়া-মাথা মহা মহা বৃক্ষ নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে।
কোনও দিকে লক্ষ নেই বিনয়ের। সমস্ত কিছু ছাপিয়ে ঝিনুকের মুখ চরাচর জুড়ে চোখের সামনে ফুটে উঠছে। এক সপ্তাহ, দু’সপ্তাহ কি আরও বেশি, যতদিন, লাক, মধ্য আন্দামানে সে যাবেই। একবার যখন দেখা গেছে, খুঁজে তাকে বার করবেই। বুঝিয়ে দেবে অপমানে, অভিমানে ঝিনুক যে নিরুদ্দেশ হয়েছিল সেজন্য সে দায়ী নয়। ঝিনুকের মানসিক যাতনা, যাবতীয় ক্লেশ আর ক্ষোভ সে ঘুচিয়ে দেবে।
ভাবতে ভাবতে আচমকা মস্তিষ্কের গোপন কুঠুরি থেকে আরও ক’টি মুখ বেরিয়ে এল। আনন্দ সুনীতি হিরণ সুধা এবং– এবং ঝুমা।
কী আশ্চর্য, খিদিরপুর ডকে একটি তরুণীর মুখে ঝিনুকের আদলটি দেখে সে উদ্ভ্রান্তের মতো জাহাজের খোলে সাড়ে চার দিন তাকে খুঁজে বেড়িয়েছে। ‘রস’ আইল্যান্ডে নামার পরও সেই সন্ধানে ছেদ পড়েনি। পাঁচ দিনেরও বেশি সময় ঝিনুকের জন্য বুকের ভেতরটা এমনই উতরোল হয়ে আছে যে আর কারও কথা মনে পড়েনি; বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে গিয়েছিল বিনয়।
এক কুহেলিবিলীন সন্ধ্যায় ভবানীপুরের বাড়ি থেকে কারওকে কিছু না জানিয়ে সেই যে ঝিনুক চলে গিয়েছিল তারপর ক’টা মাস কীভাবে যে কেটেছে, বিনয়ই শুধু জানে। কেউ যেন তাকে অপার শূন্যতায় ছুঁড়ে দিয়েছিল। প্রতি মুহূর্তে মনে হত কারা বুঝি বুকে অবিরাম শেল বিধিয়ে চলেছে। বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।
কিন্তু সময় এক অলৌকিক জাদুকর। ধীরে ধীরে তার সব দুঃখ, সব আকুলতা কখন যে হরণ করে নিতে শুরু করেছিল, টের পায়নি বিনয়। বাকি যেটুকু ছিল তা প্রায় মুছে দিয়েছে ঝুমা। এই এক পরমাশ্চর্য মেয়ে। বেপরোয়া, দুঃসাহসী। যে কোনও যুবককে আচ্ছন্ন করার মতো ম্যাজিক তার হাতে আছে। তাই বলে ঝিনুকের কাছ থেকে বিনয়কে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা সে করেনি। বরং চিরদুঃখী, ধর্ষিত মেয়েটার জন্য তার বুকের ভেতর ছিল অফুরান সহানুভূতি।
কিন্তু ঝিনুক নিঃশব্দে নিখোঁজ হবার পর জীবনের যে অংশটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল অপার মায়ায় আর মাধুর্যে তা ক্রমশ ভরে দিয়েছে ঝুমা। নিয়তিতাড়িতের মতো তার কাছে না গিয়ে যেন উপায় ছিল না বিনয়ের।
আন্দামানে আসার আগে যখন বিনয় কুমার সঙ্গে দেখা করতে যায় সে বলেছিল, রোজ না হলেও দু’তিন দিন পর পর বিনয় যেন চিঠি লেখে। ঝুমা তার জন্য অনন্ত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে।
জীবনের লকূল পাওয়া ভার। সময়ের পাকে পাকে কত অজানা রহস্য যে লুকিয়ে থাকে; আচমকা বেরিয়ে এসে ভবিষ্যতের সমস্ত পরিকল্পনা আর স্বপ্ন তছনছ করে দেয়। কে জানত আন্দামানের জাহাজে আবার ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে?
আচমকা ঝুমা এবং ঝিনুক চোখের সামনে থেকে সরে যায়। অপার্থিব কোনও দর্পণে নিজের চেহারাটা দেখতে পায় বিনয়। প্রতিবিম্ব আঙুল তুলে তীব্র শ্লেষের সুরে বলে, বাহ্ বাহ্, চমৎকার। যেই ঝিনুক নিরুদ্দেশ হল, অমনি ঝুমার দিকে ঢলে পড়লে। যে নারী কৈশোরের শুরু থেকে তোমার খাসবায়ুতে জড়িয়ে আছে তার স্মৃতি নিয়ে দিন কাটিয়ে দেওয়া যেত না? একটাই তো জীবন। হাতে কত কাজ তোমার। দেখতে দেখতে সময় কেটে যেত।
আয়নার ছায়া আরও বলে, তুমি একটা নোংরা, হীন মানুষ। সংযম নেই, একাগ্রতা নেই, নিষ্ঠা নেই। যেই ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হল অমনি তার জন্য উতলা হয়ে উঠেছ। দুই যুবতাঁকে দুই আঙুলের ডগায় দাঁড় করিয়ে এখন কী খেলা খেলতে চাও? বিশ্বাসঘাতক। একসঙ্গে দুটি মেয়ের সঙ্গে প্রবঞ্চনাকরতে তোমার আটকাবে না? মধ্য আন্দামানে যদি ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হয়, কী করবে তাকে নিয়ে? ওদিকে ঝুমার সঙ্গে তোমার যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে তার কী হবে? কী তার ভবিষ্যৎ?
বিনয় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছে। স্নায়ুমণ্ডলী ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে। এলোমেলো পা ফেলে, প্রায় টলতে টলতে এসে বিছানায় নিজের শরীরটাকে ছুঁড়ে দিল।
.
খুব ভোরে ওঠা বহুদিনের অভ্যাস বিনয়ের। আজ কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল। ঘুম ভাঙতে চোখে পড়ল, সিসোস্ট্রেস বে অনেক দূরে যেখানে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে তারও ওধারে জলতল থেকে যেন সূর্যটা আকাশের ঢাল বেয়ে বেশ খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে।
সকালের লাল টকটকে সূর্য এখন রং পালটে সোনালি হতে শুরু করেছে। খোলা জানলা দিয়ে অঢেল রোদ এসে পড়েছে ঘরে।
কয়েক পলক বাইরে তাকিয়ে রইল বিনয়। কাল রাতে যেমনটা শুনেছিল আজও উপসাগর থেকে পাড়ে ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ উঠে আসছে বিরামহীন। আকাশ জুড়ে ঝাঁকে ঝাকে উড়ছে সিগাল। এই সাগর পাখিদের নজর কিন্তু জলের দিকে। মাছের নড়াচড়া দেখলেই হেঁ দিয়ে পড়ছে। ধারালো ঠোঁট সামুদ্রিক কোনও মাছ গেঁথে ফের উঠে যাচ্ছে।
বেশিক্ষণ বসে থাকা গেল না। চকিতে মনে পড়ে গেল, সকালের দিকেই উদ্বাস্তুদের সঙ্গে নতুন সেটলমেন্টে যেতে হবে। ব্যস্তভাবে উঠে পড়ে বিনয়। আর কার্তিক তখনই এক বালতি গরম জল নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। বলল, ‘তাড়াতাড়ি চান করে নিন। সারের (স্যারের) চান হয়ে গেছে। আপনার জন্যি হল-এ বসে আচেন।‘ সার হলেন বিশ্বজিৎ রাহা।
বালতিটা লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে চলে যাচ্ছিল কার্তিক, তাকে। থামিয়ে বিনয় জিগ্যেস করে, এখনও তো ঠান্ডা পড়েনি। কালও গরম জল দিয়েছিলে, আজও দিলে-’ বলতে বলতে থেমে যায়।
ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিল কার্তিক। সে বুঝিয়ে দিল। বর্ষার জল পোর্টব্লেয়ারে ধরে রাখার ব্যবস্থা আছে। সারাবছর তা সাপ্লাই করা হয়। একে জমা জুল, তার ওপর এখানকার সামুদ্রিক নোনা বাতাস। শুধু জমানো জলে চান করলে শরীর খারাপ হবে। তার সঙ্গে গরম জল মিশিয়ে নিলে ভয় নেই।
মিনিট কুড়ির ভেতর শেভ করে, চান সেরে, পোশাক পালটে হল-ঘরে চলে এল বিনয়। আন্দামানের জাহাজে ওঠার আগে প্যান্ট শার্ট কিনেছিল। এখন তা-ই পরেছে সে।
একটা সোফায় বসে সেন্টার টেবিলের ওপর ঝুঁকে খুব মন দিয়ে একতাড়া কাগজ দেখছিলেন বিশ্বজিৎ। কাছাকাছি আসতেই বিনয় চিনতে পারল। কাল যে উদ্বাস্তুরা এসেছে কাগজগুলোতে তাদের নামটাম টাইপ করা রয়েছে। বিশ্বজিৎ তাহলে ঝিনুকের কথা ভুলে যাননি। সে কাদের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে এসেছে, নিশ্চয়ই জেনে গেছেন তিনি। অফুরান আশায় আর উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা দুলতে থাকে বিনয়ের।
পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন বিশ্বজিৎ। বললেন, ‘বসুন—’
বিশ্বজিতের দিকে চোখ রেখে মুখোমুখি একটা সোফায় বসে পড়ল বিনয়।
বিশ্বজিৎ ধীরে ধীরে মাথাটা ডাইনে থেকে বাঁয়ে, বাঁয়ে থেকে ডাইনে হেলাতে হেলাতে বললেন, ‘নো স্যার, তাপসী লাহিড়ি বা ঝিনুক নামে কারওকে পাওয়া গেল না। আমি পুরো লিস্টটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। ওই নাম দু’টো কোত্থাও নেই।’
এক ফুঁয়ে সব আলো কেউ যেন নিভিয়ে দিয়েছে। চতুর্দিক থেকে অনন্ত হতাশা বিনয়কে ঘিরে ধরতে থাকে।
বিহুলের মতো সে বলে, ‘নেই? বিশ্বজিৎ কী ভেবে বললেন, আমার চোখে হয়তো এড়িয়ে গেছে। আপনি বরং একবার দেখুন।
কাঁপা হাতে বিশাল লিস্টটা তুলে নেয় বিনয়। দৃষ্টিশক্তিকে প্রখর করে রুদ্ধশ্বাসে প্রতিটি পাতা আঁতিপাঁতি খুঁজতে থাকে। নেই, নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও ঝিনুক থাকতে পারে কিন্তু এই তালিকায় নেই।
খিদিরপুর ডকে আর রস আইল্যান্ডে আবছাভাবে একটি মেয়ের মুখে ঝিনুকের আর্দল চোখে পড়েছিল। পরে মনে হয়েছিল, সেটা হয়লে ভুল। কিন্তু ‘চলুঙ্গা’ জাহাজে তাকে স্পষ্ট দেখা গেছে। তখন বিকেল। পড়ন্ত বেলার অজস্র আলোয় ভরে ছিল সমস্ত চরাচর। তার ভেতর চোখের ভ্রম হয় কী করে? চকিতে বিদ্যুতাড়িত গতিতে একটা সংকেত বিনয়ের মাথার ভেতর খেলে যায়। যার সঙ্গে এসে থাক, ঝিনুক তাকে নিজের আসল নামটা নিশ্চয়ই জানায়নি। এ নিয়ে তার মনে এখন আর লেশমাত্র ধন্দ নেই৷ মিডল আন্দামানে গেলে সব সংশয়ের অবসান হবে। তার সংকল্প আরও দৃঢ় হয়। মধ্য আন্দামানে তাকে যেতে হবে। যেতেই হবে।
সেন্টার টেবিলে লিস্টটা নামিয়ে রাখে বিনয়। বিশ্বজিৎ তা লক্ষ করছিলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘নিজের চোখে দেখবে তো?’
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।–‘দেখলাম। নেই।‘ মনের ভেতর কোন গূঢ় ভাবনা চলছে সেটা আর জানায় না।
রান্নার লোকটি এসে বলে, ‘সার (স্যার), খাবার হয়ে গেল দেব?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দাও–’ বিশ্বজিৎ উঠে পড়লেন।–‘চলুন বিনয়বাবু—’
হল-ঘরের একধারে সমুদ্রের দিকের জানলার পাশে ডাই টেবিল। সেখানে গিয়ে বসতে না-বসতেই ভুবন দুজনকে বড় প্লেটে লুচি তরকারি বেগুনভাজা আর মিষ্টি দিয়ে গেল।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘পেট ভরে খেয়ে নিন। খাওয়া হতে বেরিয়ে পড়ব। জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হ যাবে। তার আগে খাবারদাবার কিন্তু মিলবে না।‘
বিনয় জিগ্যেস করল, ‘জেফ্রি পয়েন্টটা কোথায়?’
এখান থেকে অনেকটা দুরে। পঞ্চাশ বাহান্ন মাইল তো হবে সমুদ্রের একটা ‘বে’ আছে ওই দিকটায়। ওখানে রিফিউজিতে নতুন সেটলমেন্ট বসানো হচ্ছে।
‘ওখানে জঙ্গল নেই?’
বিশ্বজিৎ হাসলেন।–’আন্দামানে এমন কোনও জায়গা পাবেন না যেখানে জঙ্গল নেই। জেফ্রি পয়েন্টেও ডিপ ফরেস্ট। গেলে দেখতে পাবেন।’
গভীর জঙ্গলে কীভাবে বসতি গড়ে উঠছে, ভেবে পেল না বিনয়। তবে এ নিয়ে সে আর কোনও প্রশ্ন করল না।
খাওয়া হয়ে গেলে কার্তিককে ডেকে বললেন, ‘এই স্যারে সঙ্গে ওঁর ঘরে যাও। ওঁর মালপত্র গোছগাছ করে কালীপ গাড়িতে রেখে আসবে।‘
কিছুক্ষণের মধ্যে বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে নিচে নেমে এলেন বিশ্বজিৎ। জিপে স্টিয়ারিং ধরে বসে ছিল কালীপদ। গাড়িটা বেশ প্রশস্ত। সামনের দিকে ড্রাইভার ছাড়াও দু’জন বেশ আরাম করে বসতে পারে।
বিশ্বজিৎ তার ফ্রন্ট সিটেই উঠে বসল। বিনয়ের সুটকেস হোন্ড-অল পেছন দিকের সিটে রেখে গিয়েছিল কার্তিক।
কালীপদকে কিছু বলতে হল না। খুব সম্ভব তার জানা আছে, কোন দিকে যেতে হবে। স্টার্ট দিয়ে ঢাল বেয়ে খানিকটা নেমে ডানধারের রাস্তা ধরে জিপটাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল।
চড়াই উতরাই পেরিয়ে গাড়ি চলেছে তো চলেছেই। রাস্তার দু’ধারে কোথাও খাদ, কোথাও সমতল জমি। খাদে জঙ্গল মাথা তুলে আছে। কোথাও বা ধানের খেত। মাঝে মাঝে কাঠের বাড়ি, দু’চারটে দালান-কোঠা।
কাল রাত্তিরে ওই পথ দিয়েই বিশ্বজিতের বাংলোয় গিয়েছিল বিনয়। তখন পরিপূর্ণ চাঁদ আলো ঢেলে দিচ্ছিল নিচের পৃথিবীতে। সমস্ত কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এখন এই দিনের বেলাতেও রাস্তাঘাট এবং দুধারের দৃশ্যাবলি চিনতে অসুবিধা হল না। ছবির মতো সব মাথায় গাঁথা হয়ে গেছে।
ফুঙ্গি চাউং পার হয়ে জিপের মুখ ডান পাশের রাস্তার দিকে যখন কালীপদ ঘোরাচ্ছে রীতিমতো অবাকই হল বিনয়। কেননা, তাদের বাঁ দিকে যাবার কথা। সেখানে এবারডিন বাজারের লাগোয়া দু তিনটে বাড়িতে উদ্বাস্তুরা রয়েছে। বিনয় ভেবেছিল সকালে সেখানে যাবে তারা। তারপর উদ্বাস্তুদের সঙ্গে সেটলমেন্টের দিকে রওনা হবে।
গলার স্বর সামান্য উঁচুতে তুলে বিনয় বলল, ‘এ কী, আমরা এবারডিন মার্কেটে যাব না?’ বিশ্বজিৎ বললেন, ‘না।‘
‘তা হলে?’
‘আমরা সোজা পোর্টে যাচ্ছি।’
পোর্ট হল বন্দর। সেখানে কেন যেতে হবে বোঝা যাচ্ছে না। বিনয় বিমূঢ়ের মতো জিগ্যেস করল, ‘কিন্তু রিফিউজিরা?’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘বিভাসরা এতক্ষণে ওদের নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেছে। পোর্ট থেকে আমরা একসঙ্গে সেটলমেন্টে যাব।’
জিপ মোড় ঘুরে ফের দৌড় শুরু করল। এতক্ষণ দু’পাশে ছাড়া ছাড়া কিছু বাংলো জাতীয় বাড়ি চোখে পড়ছিল। কোনওটাই কাছাকাছি নয়, একটার সঙ্গে অন্যটার দূরত্ব অনেকখানি।
ক্রমশ বাড়ির সংখ্যা বাড়ছে কাঠের বাড়ির চাইতে পাকা বিল্ডিং বেশি। একতল্ম, দোতলা, মাঝে মাঝে দু-একটা তেতলাও। বেশ কগ কাঠ চেরাইয়ের কারখানাও চোখে পড়ল। শহর এদিকটায় দস্তুর মতো জমজমাট। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। জিপ, ভ্যান, কিছু প্রাইভেট কারও ব্যস্তভাবে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।
একেকটা এলাকা পেরিয়ে যেতে যেতে বিশ্বজিৎ বলে যাচ্ছেন, ‘এই জায়গাটা ভিলানিপুর, –এটা হল হ্যাডো–’ ইত্যাদি।
একসময় বিশ্বজিতের জিপ পোর্টে পৌঁছে গেল।
১.৫ মূল পোর্টের গা ঘেঁষে
মূল পোর্টের গা ঘেঁষে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। সেগুলোর পাশে কালীপদ জিপটা পার্ক করতেই বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে নেমে পড়লেন। কালীপদকে বললেন, ‘বিনয়বাবুর লাগেজ জেটিতে নিয়ে এসো।’
পার্কিং এরিয়া থেকে খানিকটা এগলে মস্ত গেট। গেটের পর ডাইনে বাঁয়ে দু তিনটে বিল্ডিং। মাঝখান দিয়ে সোজা রাস্তা চলে গেছে। বিল্ডিংগুলোতে জাহাজ কোম্পানির অফিস। কোম্পানির ক’জন কর্মচারী এধারে ওধারে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। অলস আড্ডার মেজাজে। নগন্য পোর্ট, বিনয়ের মনে হল, খুব সম্ভব এই বন্দরে সবসময় তেমন ব্যস্ততা থাকে না। বিশ্বজিৎকে দেখে ওরা শশব্যস্তে এগিয়ে আসে।–’নমস্কার স্যার, রিফিউজিদের নিয়ে বিভাসবাবুরা এসে গেছেন। চলুন স্যার—’
বিশ্বজিৎ যে পোর্টব্লেয়ারের একজন জবরদস্ত অফিসার সেটা টের পাচ্ছিল বিনয়। বিশ্বজিৎ ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এবং রিফিউজি ডিপার্টমেন্টের একজন হর্তাকর্তা, জাহাজি ব্যাপারটা তার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না, তবু কখন কী ঝঞ্ঝাটে ফেঁসে যাবে তা তো বলা যায় না, তাই এখানকার ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরদের তুষ্ট রাখতে হয়। সেই কারণেই খাতিরের এমন বহর।
কর্মচারীরা যে বিভাসদেরও চেনে তাও জানা গেল। এ ধরনের ছোট শহরে সবাই সবার পরিচিত।
বিশ্বজিৎ প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘আপনাদের খবর সব ভালো তো?’
‘হ্যাঁ স্যার–’
বিশ্বজিৎরা হাঁটছিলেন। পাশাপাশি কর্মচারীরা চলেছে। বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আপনাদের আর কষ্ট করে আসতে হবে না।’
কিন্তু কে কার কথা শোনে! কর্মচারীরা চলতেই থাকে। নাছোড়বান্দাদের কীভাবেই বা ঠেকানো যায়। বিশ্বজিৎ আর কিছু বললেন না।
লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে বিনয়রা মস্ত এক জেটিতে চলে এল। বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এর নাম চ্যাথাম—’
চ্যাথামের কথা অনেক আগেই বিভাসদের মুখে শুনেছে বিনয়। এই প্রথম দেখল।
জেটির পশ্চিম কোনায় স্টিমশিপ ‘মহারাজা’ নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। কাল ‘রস’ আইল্যান্ডে উদ্বাস্তুদের নামিয়ে বিশাল জলযান এদিকেই এসেছিল। পাহাড়ের আড়াল থাকায় চ্যাথাম জেটিটা তখন চোখে পড়েনি।
জেটির মাঝখানে উদ্বাস্তুরা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। সঙ্গে তাদের লটবহর। সবাই চুপচাপ। কেমন যেন উদাসীন। সরকারি বাবুরা যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই তো যেতে হবে। এমন একটা নিরুপায় ভাব তাদের চোখেমুখে। চার দিন সমুদ্র আর এক রাত এবারডিন মার্কেটে কাটিয়ে দুশ্চিন্তা করার মতো শক্তিটুকুও বুঝিবা আর নেই। ভাঙাচোরা, ছিন্নমূল মানুষগুলো নিয়তির হাতে
.
নিজেদের সঁপে দিয়ে উপসাগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
বিভাস, নিরঞ্জন এবং পুনর্বাসন দপ্তরের ক’জন কর্মচারী উদ্বাস্তুদের কাছাকাছি পঁড়িয়ে কথা বলছিল। খানিক দূরে তিরিশ-চল্লিশজনের এক পাঁচমেশালি জটলা। মুখ-চোখ এবং দাড়ি পাগড়ি দেখে বর্মি এবং শিখদের চেনা যাচ্ছে। বাকিরা খুব। সম্ভব তামিল, মালাবারি মোপলা এবং ভারতের নানা এলাকার লোক। দু’চারজন বাঙালিও থাকতে পারে। সবাই বেশ বয়স্ক। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন থেকে ষাট-পঁয়ষট্টির ভেতর বয়স।
জেটির গায়ে এক পাশে নোঙর ফেলে আছে ‘স্টিমশিপ ‘মহারাজা’। অন্যদিকে কালকের সেই দুটো স্টিমলঞ্চ ‘সি-গাল’ আর ‘নটিলাস’ লোহার শিকল দিয়ে জেটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে।
বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে উদ্বাস্তুদের দিকে এগিয়ে গেলেন। শিপিং কোম্পানির কর্মচারীরা অবশ্য থেমে গেল। আন্দামান-নিকোবর আইল্যান্ডসের ম্যাজিস্ট্রেটকে খানিকক্ষণ সঙ্গ দিয়ে যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়েছে। তারা ধীরে ধীরে ফিরে যেতে লাগল।
হলধর সূত্রধর, মাখন রুদ্রপাল এবং আরও কয়েকজন বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। উদ্বাস্তুদের দঙ্গল থেকে তারা প্রায় দৌড়েই চলে আসে।
হলধর এক নিঃশ্বাসে তত্বড় করে বলে যায়, ‘ছুটোবাবু আইজ বিহানে উইঠা আপনের লেইগা পথের দিকে তাকাইয়াআছিলাম। কিন্তুক আপনে আইলেন না। হেরপর সরকারি বাবুরা যহন এই জাহাজঘাটায় লইয়া আইল, জবর ডরাইয়া গ্যাছিলাম। হগলে (সকলে) কওয়াকওয়ি করতে আছিল আপনে ভাটকি (ফাঁকি) দিয়া কইলকাতায় ফিরা যাইবেন। অহন কী ভালা যে লাগতে আছে!’ তার ষাটবাষট্টি বছরের শুষ্ক চোখ বাষ্পে ভরে যেতে লাগল। আনন্দে। ক্ষণিক উচ্ছ্বাসে।
মাখন অপরাধী অপরাধী মুখ করে বলল, ‘সকাল তরি (পর্যন্ত) আপনেরে না দেইখা ভাবছিলাম সমুন্দুরের মধ্যিখানে আমাগো বিসজ্জন দিয়া বুঝিন চইলাই যাইবেন। আমারে মাপকইরা দ্যান।‘ সে হাতজোড় করল।
বাকি সবাই একই সুরে বলে যেতে লাগল। বিনয় হেসে হেসে বলে, ‘দেখলেন তো আমি আপনাদের ফাঁকি দিই নি। ঠিক এসে গেছি। আপনারা যে যার জায়গায় ফিরে যান। আমি ওঁদের কাছে যাচ্ছি।’ একটু দূরে বিশ্বজিৎ নিরঞ্জন আর বিভাসের সঙ্গে কথা বলছেন। সে সেদিকে চলে গেল।
বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করছিলেন, ‘নতুন সেটলমেন্টে রিফিউজিদের থাকার মতো সব ব্যবস্থা করা হয়েছে?’
নিরঞ্জন বলল, ‘হয়েছে।‘
‘চেনম্যান আর জরিপদাররা ওখানে আছে তো?’
‘নিশ্চয়ই।‘
চেনম্যান এবং জরিপদারদের ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না বিনয়ের। এ নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন করল না। সেটলমেন্টে গেলেই সব জানা যাবে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আর দেরি করে কী হবে? যাওয়ার ব্যবস্থা করো।’
হাঁকাহাঁকি করে উদ্বাস্তুদের দুই মিলঞ্চ ‘সি-গাল আর ‘নটিলাস’-এ তুলে ফেলল নিরঞ্জনরা। তারপর সেই বর্মি শিখ টিমেরা উঠল। সবার শেষে বিশ্বজিৎ আর বিনয়।
বিনয় উঠেছিল ‘নটিলাস’-এ। নিচের ডেকটা উদ্বাস্তুতে বোঝাই। সেখানে জায়গা না পেয়ে অনেকে আপার ডেকেও চলে গেছে। তাদের দেখাশোনা করছিল নিরঞ্জন। বিভাস বাকি উদ্বাস্তুদের নিয়ে ‘সি-গাল’-এ উঠেছে।
বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ‘নটিলাস’-এর দোতলায় চলে এল। এখানে ডেকের একদিকে কিছু উদ্বাস্তু বসে আছে। অন্য ধারে বর্মি, শিখ এবং নানা জাতের লোকের জটলা। বিশ্বজিতের কাছে এসে বর্মিরা সসম্ভ্রমে কপালে হাত ঠেকিয়ে কেউ বলছে নমস্তে’, কেউ বা আদাব’।
বিশ্বজিৎ প্রতি-নমস্কার জানিয়ে তাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন–কে কেমন আছে, কাজকর্ম কেমন চলছে, ছেলেমেয়েরা কে কী করছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
চ্যাথাম জেটিতে বিনয় লোকগুলোকে দেখেছিল ঠিকই, তবে খানিকটা অন্যমনস্কর মতো এবার ভালো করে লক্ষ করল। সবার গায়ের চামড়া কর্কশ, তামাটে। গালে গলায় কপালে সরু সরু অগুনতি রেখা; সেখানে পুঞ্জীভূত রুক্ষতা জমাট বেঁধে আছে। আন্দাজ করল, এরা হয়তো দীর্ঘকাল এই দ্বীপে রয়েছে। আন্দামানের অজস্র তীব্র রোদ, বছরে দু’বার প্রবল বৃষ্টিপাত আর নোনা হাওয়া তাদের চেহারায় শুষ্ক কাঠিন্য এনে দিয়েছে। বোঝ যাচ্ছিল বিশ্বজিৎকে ওরা যেমন চেনে, তিনিও তাদের সবাইকে চেনেন।
একটা লম্বা-চওড়া লোক, মুখে কাঁচা-পাকা অজস্র দাড়ি–খুব সম্ভব সে পাঠান–জিগ্যেস করল, সাহাব, পাকিস্তানসে আর কত আদমি আন্দামানে আসবে?’
বিশ্বজিৎ হাসলেন, ‘অনেক। এই তো সবে শুরু।‘
লোকগুলো আর দাঁড়াল না; যেখানে ছিল সেখানে ফিরে গেল।
বিশ্বজিৎ বিনয়ের দিকে তাকান। –‘এঁরা কারা জানেন?’
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়। -–‘না।‘
‘এক সময়ের দুর্ধর্ষ সব কয়েদি। যাবজ্জীবন জেল খাটতে আন্দামান পাঠানো হয়েছিল। এদের লাইফ হিস্ট্রি শুনলে বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবে। মুক্তি পাবার পর বিয়ে-শাদি করে শান্তশিষ্ট গৃহপালিত প্রাণী হয়ে গেছে।‘
বিনয় যা ভেবেছিল- লোকগুলো অনেককাল আন্দামানে আছে–সেটা মিলে গেছে। কিন্তু নানা দুষ্কর্মের জন্য তাদের যে কালাপানি পাঠানো হয়েছিল তা বোঝা যায়নি। সে রীতিমতো অবাক হল অন্য একটা কারণে। জিগ্যেস করল, ‘এই ক্রিমিনালদের বিয়ে হল কী করে? মেয়ে পেল কোথায়?’
‘আন্দামানে তাদের জন্যে সুটেবল ব্রাইড মানে যোগ্য পাত্রী ছিল। বিয়ে আটকায় কে?’
‘এই তো সবে দেশ স্বাধীন হল। তার আগে আসামীদের জন্যে এখানে কনে মজুত ছিল?’
‘ছিল, ছিল’- হাসতে হাসতে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এইসব প্রাতঃস্মরণীয়া মেয়েমানুষও পুরুষদের মতো এখানে জেল খাটতে এসেছিল।’
পুরুষদের ‘কালাপানি’তে পাঠাবার কথা বিনয়ের জানা আছে। কিন্তু মেয়েদের কথা এই প্রথম শুনল। খানিকক্ষণ চুপকরে থাকে। তারপর জিগ্যেস করে, ‘এদের বিয়ে হল কী করে?’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এত তাড়া কীসের? এখানে যখন এসেই পড়েছেন সব জানতে পারবেন।’
ওদিকে দু’টো লঞ্চই ছেড়ে দিয়েছিল। উপসাগরের নীল জল উথালপাথাল করে তারা কোনাকুনি ছুটে যাচ্ছে।
সূর্য এতক্ষণে আরও খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে। এখন আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। নোনা জলে তীব্র রোদ যেন ঝলকে যাচ্ছে।
আধ ঘণ্টাও লাগল না, উপসাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে পৌঁছে গেল ‘সি-গাল’ আর ‘নটিলাস’।
বিশ্বজিৎ বললেন, এই জায়গাটার নাম ‘বাম্বুফ্ল্যাট’।
এখানেও দু’টো কাজ চলার মতো ছোট জেটি রয়েছে। জলও গভীর নয়। তাই বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। কিন্তু লঞ্চের পক্ষে অসুবিধে নেই।
লঞ্চ বাঁধাহ্যাঁদা হলে উদ্বাস্তুদের নামানো হল। প্রাক্তন কয়েদিদের সঙ্গে বিনয়রাও নেমে পড়ল। তারা বিশ্বজিৎকে ‘আদাব’ এবং ‘নমস্তে’ জানিয়ে চলে গেল।
জেটির মাথায় অ্যাসবেস্টসের অল্প একটু ছাউনি। সেটার তলা দিয়ে সবাই ওধারে চলে গেল। বাইরে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে। সেখানে বারো চোদ্দোটা মাঝারি আকারের লরি লাইন দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে। সেগুলোর মাথা খোলা। সামনে ড্রাইভারের কেবিন। পেছন দিকে কাঠের মজবুত পাটাতন। ড্রাইভার এবং খালাসিরা যে যার লরির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লরির সারির ওধারে একটা জিপ চোখে পড়ে। কালীপদ বিনয়ের মালপত্র নিয়ে সেদিকে চলে গেল।
বিনয় বুঝতে পারছিল, গাড়িগুলো পুনর্বাসন দপ্তরের। উদ্বাস্তুদের নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে।
বিশ্বজিৎ নিরঞ্জন আর বিভাসকে বললেন, ‘তোমরা ডি.পি ফ্যামিলিগুলোকে লরিতে ভোলো৷ বিনয়বাবু আর আমি জিপে গিয়ে বসছি। সবাই উঠলে একসঙ্গে রওনা হব।’
লরির ড্রাইভার খালাসিদের মতো জিপের চালক তার গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশ্বজিৎকে দেখে তার শরীর টানটান হয়ে গেল। ছফিটের মতো হাইট। লম্বাটে মুখ, চওড়া বুক, ছড়ানো মজবুত কঁধ, মাথায় প্রচুর চুল, মুখটা পরিষ্কার করে কামানো, তবে থুতনিতে তেকোনা দাড়ি। পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট আর শার্ট। বয়স সাতাশ-আটাশের মতো। কপালে হাত ঠেকিয়ে সে বলল, ‘আদাব–’
আদাবের জবাবে মাথা সামান্য হেলিয়ে বিশ্বজিৎ বলেন, ‘ক্যায়সা হ্যায় নাসিম?’
‘আপহিকা মেহেরবানিসে সব কুছ ঠিক হ্যায়।’
এবার বিশ্বজিৎ কালীপদকে বললেন, ‘সুটকেস টুটকেস জিপে তুলে দিয়ে তুমি ফিরে যাও। স্টিমার ব্যাম্বুফ্ল্যাটে বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না। আমি কাল, না হলে পরশু ফিরব।‘
জিপের পেছন দিকে লটবহর রেখে ব্যস্তভাবে জেটির দিকে চলে গেল।
ওদিকে নিরঞ্জনরা যে প্রক্রিয়ায় উদ্বাস্তুদের খিদিরপুর ডকে ‘মহারাজা’ জাহাজে কিংবা ‘রস’ আইল্যান্ডে, আর চ্যাথাম জেটিতে স্টিমারে তুলেছিল, ঠিক সেইভাবেই লরিতেও তুলে ফেলল। তারপর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘রাহাদা, আমরা রেডি—’
নাসিম জানে, এখন কী করতে হবে। সে ব্যস্তভাবে ঘুরে গিয়ে জিপে উঠে পড়ল। ফ্রন্ট সিটে বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে উঠে তার পাশে বসে পড়লেন।
বারোটি লরি এবং একটি জিপ, মোট তেরোটি গাড়ি দৌড় শুরু করল।
সুর্য এখন প্রায় মাথার ওপর উঠে এসেছে। রোদের তেজ অনেক বেড়ে গেছে। মাত্র কয়েক মিনিট উপসাগর আর মাউন্ট হ্যারিয়েটের চুড়োটা দেখা যাচ্ছিল। তারপর চোখের সামনে থেকে একেবারে উধাও।
উঁচু উঁচু পাহাড় আর ছোট বড় অগুনতি টিলার কোমরে পাক খেতে খেতে পথ কখনও ওপরে উঠে যাচ্ছে, কখনও নেমে আসছে নিচে। একবার খাড়াই, তারপরেই উৎরাই। এক পাশে পাথরের নিরেট দেওয়াল, অন্যদিকে খাদ। খাদ কোথাও গভীর, কোথাও ততটা নয়। দু’ধারেই নিবিড় জঙ্গল। ছোটখাট গাছ যে কত তার লেখাজোখা নেই। রয়েছে বিশাল বিশাল সব মহাবৃক্ষ, মোটা মোটা বেত আর বুনো লতা সেগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। রেখেছে। আর মাঝে মাঝেই অনেকটা করে জায়গা জুড়ে পঁচিশ-তিরিশ ফিট উঁচু বুনো ঘাসের বন। জঙ্গল কোথাও কোথাও এমন দুর্ভেদ্য যে এই দুপুরবেলাতেও সূর্যালোক ঢোকে না।
গাড়িগুলো চলছে খুব জোরেও নয়, আবার ধীর গতিতেও নয়। মাঝামাঝি স্পিডে। কেননা পাহাড়ি রাস্তা তেমন চওড়া নয়। বেশি স্পিড় তুললে বাঁকের মুখে স্কিড় করে খাদে গিয়ে পড়ার ভয়।
মাথার ওপর অনেকটা উঁচু দিয়ে অজস্র পাখি উড়ে যাচ্ছে। বক আর সি-গাল ছাড়া অন্যদের চিনতে পারল না বিনয়।
পনেরো কুড়ি মিনিট পর পর বসতি চোখে পড়ছে। খুব বড় নয়। তিরিশ-চল্লিশটা কাঠের বাড়ি, মাথায় আসবেস্টস টিনের ছাউনি। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বাড়িগুলো অনেককালের পুরনো। কিছু কিছু লোকজনও চোখে পড়ছিল। তাদের কারওকে দেখে উদ্বাস্তু মনে হয় না। সর্ব খোয়ানো শরণার্থীদের চেহারায় একটা মার্কামারা ছাপ থাকে।
হাজার বছরের প্রাচীন অরণ্যের খাঁজে খাঁজে লোকালয় দেখা যাবে, ভাবতে পারেনি বিনয়। অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। জিগ্যেস করল, এগুলো তো রিফিউজি সেটলমেন্ট নয়। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের সব বাড়িঘরা এখানে কারা থাকে?
বিশ্বজিৎ বললেন, যেসব কয়েদি ব্রিটিশ আমলে আন্দামানে লাইফ-টাইম জেল খাটতে এসেছিল, এগুলো তাদের ভিলেজ।
বিনয় আর কোনও প্রশ্ন করল না।
.
দেখতে দেখতে সূর্যটা পশ্চিম আকাশের ঢালু গা বেয়ে নামতে নামতে উঁচু উঁচু পাহাড়ের আড়ালে উধাও হল। বেলা হেলে পড়েছে। তবু এখনও চারদিকে অঢেল রোদ।
একটা উতরাই বেয়ে গাড়িগুলো যেখানে নেমে এল সেখানে পাথুরে রাস্তা নেই। এবড়ো-খেবড়ো হলেও, মাইল দেড় দুই জুড়ে মোটামুটি সমতল জমি। সেটার তিন দিকে জঙ্গল, পাহাড়, অন্যদিকটায় সমুদ্র।
যতদূর চোখ যায় বিশাল বিশাল গাছের গুঁড়ি আর সেসবের মোটা মোটা ডালপালা তূপাকার হয়ে পড়ে আছে। এক লহমায় বোঝা যায়, বন কেটে অনেকটা জমি বার করা হয়েছে। তবে বড় বড় প্রাচীন সব গাছ কাটা হলেও অজস্র ছোট এবং মাঝারি গাছ, আর মাঝে মাঝে বুনো ঘাসের ঝোঁপঝাড়। এসব নির্মূল করতে না পারলে পুরো জমি পাওয়া যাবে না।
বেশ খানিকটা দূরে সমুদ্রের কাছাকাছি তক্তার বেড়া আর টিনের চালের অনেকগুলো লম্বা লম্বা ব্যারাকজাতীয় বাড়ি। বোঝাই যায় এগুলো নতুন তৈরি হয়েছে। সেখানে পনেরো বিশজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
তেরোটা গাড়ি সোজা ব্যারাকগুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘এই হল আমাদের নিউ সেটলমেন্টের জায়গা। এখানে উদ্বাস্তুদের জমি দেওয়া হবে। আসুন–’ বলে জিপ থেকে নেমে পড়লেন বিশ্বজিৎ।
ছিন্নমূল মানুষগুলোকে সমুদ্র আর জঙ্গলে ঘেরা বহু দূরের এই এলাকাটিতেই যে বসতি গড়ে তুলতে হবে, সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল বিনয়। সেও নেমে এল।
যে লোকগুলো সারি সারি ব্যারাকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তারা বিশ্বজিতের দিকে প্রায় দৌড়ে চলে এল। এদের মধ্যে নানা জাতের মানুষ রয়েছে। রয়েছে দু’তিনজন কর্মীও। তবে সবচেয়ে বেশি করে যে নজরে পড়ে তার বয়স পঞ্চাশের আশপাশে। নিরেট চেহারা, পাথরের পাটার মতো চওড়া বুক, কাঁধ অবধি এলো মেলো কাঁচা-পাকা রুক্ষ চুল, মুখে আট-দশ দিনের জমানো দাড়ি। ছড়ানো চোয়াল, পুরু ঠোঁট। পরনে দোমড়ানো মোচড়ানো খাকি প্যান্ট আর কালচে রঙের জামা, যেটার একটাও বোতাম নেই। দেখামাত্র টের পাওয়া যায়, লোকটার গায়ে দানবের শক্তি। তার ঠিক পাশেই রয়েছে তেইশ-চবিশ বছরের একটি বাঙালি যুবক। পাতলা, একহারা চেহারা, তরতরে মুখ। পরনে ঢোলা প্যান্ট আর শার্ট। বাকি সবাই তাদের পেছনে।
বাঙালি যুবকটি হাতজোড় করে বিশ্বজিৎকে বলল, নমস্কার স্যার। আমরা দুফার থিকা আপনেগো সেইগা পথের দিকে তাকাইয়া রইছি।’ কথা শুনেই টের পাওয়া যায় তার আদি বাড়ি পূর্ববাংলায়।
বিশ্বজিৎ বললেন, হ্যাঁ। আমাদের আসতে দেরি হয়ে গেল।
লম্বাচওড়া শক্তিমান লোকটি এবং বাকি সকলে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, নমস্তে সাহাব–’বোঝা গেল তারা অবাঙালি।
ঘাড় সামান্য কাত করে প্রতি-নমস্কার জানালেন বিশ্বজিৎ। তারপর বাঙালি যুবকটিকে বললেন, ‘সেই সকালবেলা রিফিউজিরা খেয়ে বেরিয়েছিল। এখন সূর্য ডুবতে চলেছে। খিদেয় তাদের পেটে আগুন জ্বলছে। খাবার-টাবার সব রেডি তো?’
যুবকটি বলল, হ স্যার। দুফারের আগেই পাক (রান্না) হইয়া গ্যাছে।’
‘ভেরি গুড।’
বিশ্বজিৎ এবার বিনয়ের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। যুবকটির নাম পরিতোষ বণিক। দেশভাগের পরে পরেই ফরিদপুরের পালং থেকে চলে এসেছিল। আইএ পাশ। আন্দামানের এই নতুন সেটলমেন্টের কলোনাইজেশন অ্যাসিস্টান্ট, সংক্ষেপে সি.এ। শরণার্থীদের এই উপনিবেশ গড়ে তোলার অনেকখানি দায়িত্ব। তার এখানে থেকেই পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার তদারক করবে সে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘বিনয়বাবুর কথা তোমাকে বলেছি। উনি আপাতত এখানে থাকবেন। আন্দামানের রিহ্যাবিলিটেশন সম্পর্কে ওঁদের কাগজে লিখবেন। ওঁকে সবরকম সাহায্য করবে।‘
‘নিশ্চয়ই স্যার। আপনে কি এইবার কয়েকদিন থাইকা যাইবেন?’
‘বড়জোর কালকের দিনটা আছি। পরশু আমাকে ফিরতেই হবে। কোর্টে অনেকগুলো কেস রয়েছে। কোনওটার হিয়ারিং আছে, কোনওটার জাজমেন্ট দিতে হবে।‘
বিশ্বজিৎ শুধু রিহ্যাবিলিটেশন অফিসারই নন, আন্দামানের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিষ্ট্রেটও। তাকে নানারকম ঝক্কি সামলাতে হয়। তিনি বলতে লাগলেন, ‘তিন দিন আগে কাহালিবাবু মাল নিয়ে এসেছিলেন। তাতে কতদিন চলবে?’
ঘাড় চুলকতে চুলকতে চোখ নামিয়ে পরিতোষ বলল, ‘স্যার, রিফিউজিগো যা লিস্ট পাইছি হেয়াতে (তাতে) মনে লয় (হয়) তিনশো জন আইছে। হেরা তারা ছাড়া রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের বিশ বাইশজন এমপ্লয়ি আছে। যা মাল আইছে, কতদিন চলব হিসাবটা বুঝতে পারছি না। এই ধরনের কাম তো আগে করি নাই। তাই—’
ধমকের সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এটা একটা এক্সকিউজ হল? কলোনি চালাবে তুমি। হিসেবটা বুঝবে অন্য লোক? এভাবে চাকরি রাখতে পারবে না।‘
সচকিত বিনয় বিশ্বজিতের দিকে তাকায়। কাল সকাল থেকে আজ বিকেল অবধি, মোটামুটি দেড় দিনের মতো তাকে দেখছে সে। অমায়িক, সহানুভূতিশীল নরম স্বভাবের মানুষ বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু কাজকর্মের ব্যাপারে তিনি যে অত্যন্ত কঠোর, কারও কোনওরকম গাফিলতি বা অজুহাত যে বরদাস্ত করেন না সেটা টের পাওয়া গেল।
মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল পরিতোষের। কী জবাব দেবে, ভেবে পাচ্ছে না।
নীরস গলায় বিশ্বজিৎ বললেন, ‘যেসব মাল এসেছে, সেগুলোর কত ওজন, তার ফর্দ আছে তো? না হারিয়ে ফেলেছ?’
পরিতোষের মনে হল, ফঁড়াটা খুব সম্ভব এ যাত্রায় কেটেই গেল। জোরে শ্বাস টেনে সে বলল, ‘আছে স্যার, আছে। অহনই লইয়া আসুম?’
‘এখন আনতে হবে না। পরে দেখব।’ বলেই সেই বলবান লোকটার দিকে তাকালেন বিশ্বজিৎ।–‘তোমার খবর কী ধনপত সিং?’
ধনপত বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘আপকো কিরপাসে (কৃপায়) ঠিক হি হ্যায় সাহাব।’
‘কাল থেকে জমি জরিপের কাজ শুরু হবে। তোমরা রেডি তো?’
‘রিডি (রেডি) সাহাব।’ ধনপত তার সঙ্গী দু’জন বর্মি এবং অন্যদের দেখিয়ে বলল, হিন্দুস্থানিতে যা বলল তার বাংলা মোটামুটি এরকম। কাল রাতকো এই চেইনম্যানরা এসে গেছে।
জরিপের ব্যাপারটা ভাসা ভাসা ভাবে আন্দাজ করে নিল বিনয়, তবে চেনম্যানদের কী কাজ সেটা ধোঁয়াটে হয়ে রইল। এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না সে। পোর্টক্লেয়ার থেকে বহু দূরে নিবিড় বনভূমির এই খাঁজের ভেতর যখন এসেই পড়েছে কাল হোক, পরশু হোক, চেনম্যানদের সম্পর্কে অবশ্যই জানা যাবে।
ওধারে লরি থেকে রিফিউজিদের নামিয়ে ফেলেছে বিভাস আর নিরঞ্জন। সেদিক থেকে শোরগোল ভেসে আসছে। অতগুলো মানুষ একসঙ্গে কথা বলছে, তারই আওয়াজ।
বিশ্বজিৎ বিনয়কে বললেন, ‘চলুন, ওখানে যাওয়া যাক। দুজনে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। পরিতোষও ভিজে বেড়ালের মতো তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। ধনপতরা এল না, তারা দাঁড়িয়েই রইল।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘ধনপত আর বর্মিটর্মিদের দেখলেন তো। এরা কারা জানেন?’
বিনয় বলল, কী করে জানব? এই তো সবে এলাম। তবে আপনাদের কথা শুনে মনে হল জরিপ-টরিপ কিছু করবে।‘
‘হ্যাঁ। এরা সব ব্রিটিশ আমলে সাজা খাটতে ‘কালাপানি’ এসেছিল। তারপর এখানেই থেকে গেছে।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘তখনকার জেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ওদের ‘পি.ডব্লু.ডি’তে কাজ দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর আন্দামানে যখন রিফিউজিদের পাঠানো হল তখন ওদের রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করা হয়।’
বেলা চড়লে চ্যাথাম জেটি থেকে যখন ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে আসছিল সেই সময় স্টিম লঞ্চে ইংরেজ রাজত্বের কয়েদিদের দেখেছিল বিনয়। তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। নতুন সেটলমেন্টে ধনপতদের সারাক্ষণই পাওয়া যাবে। ভাবতেই শিহরন অনুভব করে সে।
নতুন জায়গায় এসে উদ্বাস্তুরা খুবই উত্তেজিত। তারা এত হইচই বাধিয়েছে যে কারও কথাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা।
ভিড়ের ভেতর থেকে হলধররা কয়েকজন বিনয়ের কাছে চলে এল। সবারই চোখেমুখে দুশ্চিন্তা এবং শঙ্কার ছাপ। হলধর ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তিন দিকে জঙ্গল, পাহাড়, আরেক দিকে সমুদ্র। এই আমাগো কুনহানে লইয়া আইল! আর তো ফিরনের উপায় নাই।
বিনয় অবাক। বলল, ‘দেশ তো গেছে। কোথায় আর ফিরবেন? ফিরলে তো কলকাতার সেই ক্যাম্পেই যেতে হবে। কিন্তু ক্যাম্প কি কঁকা পড়ে আছে? এত দিনে অন্য রিফিউজি এনে নিশ্চয়ই সেখানে তোলা হয়েছে। একটু থেমে বলল, ক্যাম্পে কী সুখে ছিলেন, একবার ভেবে দেখুন।‘
মুখের কথা শুনে আন্দামানে এসেছে হলধর। কিন্তু স্বচক্ষে যখন দেখল বিজন, গহন অরণ্যে বাকি জীবন কাটাতে হবে, এটা ভেবে ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছে। সে চুপ করে থাকে। হয়তো খেয়াল হয়, এই দ্বীপ ছাড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও তাদের জন্য ছ’আঙুল জমি পড়ে নেই। অনেকক্ষণ পর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বিমর্ষ মুখে বলে, ‘হ, কই আর যামু! যাওনের জাগা নাই।’
বিনয় বুঝিয়ে বলে, ‘দুঃখ করবেন না। এখন থেকে এটাই আপনাদের দেশ। এখানেই জমি পাবেন, টাকা-পয়সা পাবেন, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্যে স্কুল বসবে। আস্তে আস্তে দেখবেন, সব কষ্ট ঘুচে গেছে।‘
বিভাস ওধার থেকে রিফিউজিদের তাড়া লাগাচ্ছিল, ‘যার যার মাল লইয়া ব্যারাকে রাখেন। হের পর সমুদ্র থিকা হাত-পা ও ধুইয়া আসেন। অহনই খাওনেরটা (খাবার) দেওয়া অইব।
বিনয় হলধরদের বলল, ‘যান যান, চলে যান।‘
১.৬ বিশাল চারটে ব্যারাক
বিশাল চারটে ব্যারাক ছাড়াও পাঁচ-ছ’টা বড় কাঠের বাড়িও তোলা হয়েছে। যতদিন না শরণার্থীরা নিজেদের ঘরবাড়ি তৈরি করে নিতে পারছে, ব্যারাকেই তাদের থাকতে হবে। ব্যারাকের ভেতর দেওয়াল তুলে আলাদা আলাদা কুঠুরিতে ভাগ করা হয়নি। টানা পাটাতন পেতে দেওয়া হয়েছে।
দুটো ব্যারাকে থাকবে পুরুষেরা, বাকি দু’টোয় মেয়েমানুষ আর বাচ্চাকাচ্চারা। বাকি যে পাঁচ ছটা ঘর তোলা হয়েছে তার দুটো হল গুদাম, সেখানে সেটলমেন্টের নানা মালপত্র রাখার ব্যবস্থা। দুটো ঘর পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের জন্য, একটা ঘর কলোনাইজেশন আসিষ্টান্টের, বাকি ঘর দুটোয় পোর্টব্লেয়ার থেকে যে অফিসাররা দু’চার দিনের জন্য সেটলমেন্টের কাজকর্ম দেখতে আসেন তারা থাকেন। বিশেষ করে বিশ্বজিৎ রাহা।
চান করা, কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা ইত্যাদির মোটা কাজের জন্য সমুদ্র হাতের কাছেই রয়েছে। কিন্তু নোনা জল তো আর খাওয়া যায় না। সে জন্য কাছাকাছি একটা ঝরনা রয়েছে, অবিরল সেটা জল ঢেলে চলেছে। ঝরনাটা যেখানে, তার পাশের পাহাড়ের মাথায় নৌকোর আকারে মস্ত একটা খোল বা গহুর। সারা বর্ষার জল সেখানে জমে থাকে। দরকারমতো সেখান থেকেও লম্বা লম্বা পাইপ দিয়ে জল আনা যেতে পারে।
.
বিশ্বজিৎ এই সেটলমেন্টে এলে যে ঘরটায় থাকেন বিনয়কে নিয়ে সেখানে চলে এলেন। জিপের ড্রাইভার নাসিম এর মধ্যে। বিনয়ের সুটকেস বিছানা-টিছানা রেখে গেছে।
ঘরটার দুই দেওয়াল ঘেঁষে দু’খানা তক্তপোশ পাতা রয়েছে। আর আছে কাঠের আলমারি। দেওয়ালে টাঙানো আয়না। একটা তাকে সাবান, নারকেল তেলের কৌটো ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এই ঘরেই আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন। পরশু অবশ্য আমি পোর্টব্লেয়ার চলে যাচ্ছি। তারপরও যতদিন ইচ্ছে এখানে থেকে সেটলমেন্টের কাজ দেখবেন। সারাদিন জানি করে জামা-প্যান্টের হাল খারাপ হয়ে গেছে। ঘামে সারা গা চটচট করছে। সুটকেস খুলে তোয়ালে-টোয়ালে বার করে সমুদ্রে গিয়ে চানটা সেরে আসি। পরিতোষরা রিফিউজিদের নিয়ে ব্যস্ত। আজ কিন্তু চানের জন্যে গরম জলের ব্যবস্থা করা যাবে না। কাল থেকে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
বিনয় পোর্টব্লেয়ারে বিশ্বজিতের বাংলোয় আপত্তি করেনি। সেখানে অনেক কাজের লোক রয়েছে। কিন্তু এখানে উদ্বাস্তুরাই আসল। তার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের ব্যস্ত করে তোলাটা অস্বস্তিকর। বলল, ‘কী দরকার? সবাই যখন সমুদ্রে গিয়ে চান করবে, আমার জন্যে স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্টের দরকার নেই। সেটা খারাপ দেখাবে।‘
বিনয় যে বাড়তি কোনও সুবিধা নিতে চায় না সেটা বুঝে আর কিছু বললেন না বিশ্বজিৎ। একটু হেসে আলমারি খুলে ফেললেন। ভেতরে বেশ ক’টা তাকে কয়েক প্রস্থ পোশাক, তোয়ালে রয়েছে।
বিনয়ের মনে পড়ল সকালে তারা যখন পোটচেয়ার থেকে বেরিয়েছিল, সঙ্গে কিছুই নেননি বিশ্বজিৎ। একেবারে খালি হাত-পা। দু’দিন তিনি জঙ্গলে কাটাবেন। পরনের জামা-প্যান্ট তো ঘামে, পথের ধুলোয় নোংরা, চটকানো-মটকানো হয়ে যাবে। সেই পোশাকে কি দুটো দিন কাটানো যায়? উদ্বাস্তুদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, জঙ্গলের কোন অভ্যন্তরে, সে ব্যাপারে বিনয়ের কৌতূহল তখন এত প্রবল, উত্তেজনা এমন তীব্র যে অন্য কোনও দিকে তার লক্ষ ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে, জঙ্গলে কাটানোর মতো সমস্ত কিছুই এখানে মজুত করে রেখেছেন বিশ্বজিৎ
দু’জনেই ঘরে পরার মতো পাজামা-শার্ট আর পাতলা চটি-টটি বার করে বেরিয়ে পড়ল।
হঠাৎ কিছু খেয়াল হতে বিনয় বলে, ‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।’
চলতে চলতে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলুন–’
‘আন্দামানে রিফিউজিদের তো আরও সেটলমেন্ট হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, তিনটে।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, আজ যারা এল। তাদের আগে আড়াই হাজারের মতো মানুষ এসেছে। ওদের জমি-টমি দিয়ে বসানো হচ্ছে।’
বিনয় জিগ্যেস করে, ‘সেই সেটলমেন্টগুলো কোথায়?’
উত্তর দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘ওধারে তিনটে পাহাড় পেরলে পাশাপাশি দুটো সেটলমেন্ট, থার্ডটা আরও দূরে।‘
‘সেইসব জায়গায় তো আপনাকে যেতে হয়—’
‘তা তো হয়ই। এতগুলো মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আমাদের ভরসায় এত দুরের আইল্যান্ডে এসেছে। তারা কী অবস্থায় রয়েছে, তাদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না, কোনও গ্রিভান্স আছে কি না, সেসব দেখতে হবে না?’
বিশ্বজিৎকে যত দেখছে, তার কথা যত গুনছে, ততই শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। বিনয় জিগ্যেস করল, ‘ওই সেটলমেন্টগুলোতে নিশ্চয়ই এখানকার মতো জামাকাপড় রাখা আছে?’
বিশ্বজিৎ হেসে ফেলেন। ‘–তা তো আছেই।‘
বিভাস আর নিরঞ্জন এর মধ্যে উদ্বাস্তুদের সমুদ্রের দিকে নিয়ে গেছে। ওদর দেখতে পাচ্ছিল বিনয়রা।
পরিতোষ কাছাকাছি কোথাও ছিল। সে দৌড়ে আসে। ব্যগ্রভাবে বলল, ‘স্যার, আপনেরা কষ্ট কইরা সমুদ্রে যাইয়েন না। ঘরে যান। আমি জল পাঠাইয়া দিতে আছি।’
খুব ঠান্ডা গলায় বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমাদের আরামের জন্যে ভাবতে হবে না। এই সেটলমেন্ট যাদের জন্যে তাদের কথা ভাবো।’
ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে থাকে পরিতোষ। আর কিছু বলতে সাহস হয় না তার।
বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে এগিয়ে চললেন।
সেটলমেন্টের এদিকটা অন্য তিনদিকের মতো ঘন জঙ্গলে ঢাকা। লম্বালম্বি তার খানিকটা সাফ করে সমুদ্রে যাবার পথ করে নেওয়া হয়েছে। তবে পথের দু’পাশে এখনও চাপ-বাঁধা ঘন ঝোঁপ, নানা ধরনের অজস্র বুনো গাছ এবং জলডেঙ্গুয়া অর্থাৎ বনতুলসীর উদ্দাম ঝাড়।
সমুদ্রের ধারে এসে দেখা গেল দু-আড়াইশো ফিটের মতো চওড়া সোনালি বালির বিচ; ডাইনে এবং বাঁয়ে বহুদূর অবধি শরীর এলিয়ে পড়ে আছে। বেলাভূমির মাথায় মাইলের পর মাইল জুড়ে ঝাড়ালো ম্যানগ্রোভের জটলা। আর কত যে নারকেল গাছ তার লেখাজোখা নেই। আকাশের দিকে মাথা তুলে তারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আন্দামানের তটরেখা পাহারা দিয়ে চলেছে।
বিচের পর থেকে সমুদ্র। পাড়ের দিকে সিকি মাইল অবধি কাঁচের মতো টলটলে জল। খুব বেশি হলে কোমর সমান। জল এতটাই স্বচ্ছ যে নিচের বালুকণা, পাথর, নুড়ি, নানা রঙের ঝিনুক, সামুদ্রিক শ্যাওলা আর আগাছা স্পষ্ট দেখা যায়।
সিকি মাইল পর থেকে জলের রং ক্রমশ পালটে গেছে। প্রথমে হালকা সবুজ, তারপর গাঢ় সবুজ, নীল এবং আরও দূরে ঘন কালো হয়ে অন্তহীন সমুদ্র দিগন্ত অবধি চলে গেছে।
উদ্বাস্তুরা জলে নেমে পড়েছিল। কলকাতা থেকে আসার সময় চার পাঁচ দিন ‘মহারাজা’ জাহাজে তোলা জলে তারা চান করেছিল। এই প্রথম অফুরান সমুদ্র পেয়েছে। পদ্মা-মেঘনা-কালাবদর ধলেশ্বরীর দেশের মানুষ, এত জল পেয়ে সবাই ডগমগ। বুড়োবুড়ি যুবক যুবতী– কেউ সাঁতরাচ্ছে, কেউ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ডুবের পর ডুব দিয়ে চলেছে। ছোট বাচ্চাগুলো খলবল করে জল ছিটচ্ছে।
সমুদ্র রং বদলে যেখানে সবুজ হতে শুরু করেছে সেদিক থেকে লক্ষ কোটি মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে তীরের দিকে। কত রকমের যে মাছ–সুরমাই, লান্স ভেটকি, সার্ডিন, শাকুস, পমফ্রেট ছাড়াও নাম-না-জানা আরও অসংখ্য। এছাড়া উড়ুক্কু মাছেরা তো রয়েছেই। তারা সমুদ্র ফুঁড়ে উঠে আসছে; আধখানা বৃত্তের আকারে শূন্যে চক্কর দিয়ে ফের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই ওড়াউড়ি চলছে অবিরাম।
জল পেয়ে উদ্বাস্তুরা খুশি তো হয়েছেই। মাছ দেখে একেবারে আত্মহারা। খিদিরপুর ডকে জাহাজে ওঠার সময় তারা ত্রাসে সংশয়ে একেবারে কুঁকড়ে ছিল। এই প্রথম তাদের উচ্ছ্বসিত হতে দেখা গেল। চোখেমুখে তাদের প্রবল উত্তেজনা। নিজেদের মধ্যে ওরা বলাবলি করছিল।
‘বাইসুত রে, সমুন্দুরে কত মাছ দেখছনি? মনে লয় দশহান পদ্ম, দশহান ম্যাঘনা ছেইচা (ছঁচে) ফালাইলেও এত মাছ মিলব না।’
‘সারা জনম খাইয়াও শ্যাষ করন যাইব না।’
‘সারা জনম কী কও, চৈদ্দে পুরুষ খাইলেও ফুরাইব না।’
‘হ, সাচাই কইছ।’
‘কেম্প (ক্যাম্প) থিকা যহন আমাগো খিদিরপুরে লইয়া আইল, ডরে হাত-পাও প্যান্টের ভিতরে হাইন্দা (ঢুকে) গ্যাছিল। অহন মনে লয় (হয়) আন্দায়মানে না খাইয়া মরুম না। আর কিছু না জুটুক, সমুদুরে মাছ তো আছে, হেই খাইয়া বাইচা থাকুম।’
পাড়ে দাঁড়িয়ে বিভাস, নিরঞ্জন আর পুনর্বাসন বিভাগের ক’জন কর্মী উদ্বাস্তুদের ওপর সতর্ক নজর রাখছিল। নিরঞ্জন গলার স্বর উঁচুতে তুলে সমানে বলে যাচ্ছে, ‘কেও বেশিদুর যাইবা না। সমুন্দুরের কিনারে ছান (চান) কর। হাঙ্গরের চোখে পড়লে রক্ষা নাই। সাবধান, সাবধান—’
রাঁচির লোকটিও একটানা চেঁচিয়ে যাচ্ছে, বদমাশ মচ্ছি (হাঙর) হোত খতরনাক। হোশিয়ার—’ তারা অনবরত বলে যাচ্ছে, খানিক দূরে সমুদ্রের জল যেখানে সবুজ হতে শুরু করেছে তার ওধারে হাঙরেরা ঝাঁকে ঝুঁকে ঘুরে বেড়ায়। যে কোনও মুহূর্তে তারা বিদ্যুৎগতিতে পাড়ের দিকে হানা দিতে পারে। সামুদ্রিক এই দানবেরা মানুষ পেলে ধারালো দাঁতে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।
এত হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও উদ্বাস্তুরা কি সহজে সমুদ্র ছেড়ে উঠতে চায়? দুরে গেল না বটে, কিনারার কাছে জল নিয়ে মাতামাতি করতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত ধমকধামক দিয়ে নিরঞ্জনরা তাদের তুলে ফেলল।–’আমাগো কথা কানে তোলো না। হাঙ্গরের প্যাটে কেও গালে তহন দোষ অইব সরকারের। দুনিয়াসুদ্ধা মানুষ জানবো, হাঙ্গর দিয়া খাওয়ানের লেইগা আমরা রিফিউজিগো আন্দামানে লইয়া আইছি।’
উদ্বাস্তুরা সাড়াশব্দ করে না। অপরাধী অপরাধী মুখ করে নিরঞ্জনদের সঙ্গে সেটলমেন্টে ফিরে গেল।
ওরা চলে যাবার পর বিশ্বজিৎ আর বিনয় ভালো করে হাত-পা মুখ ধুয়ে নিল। সারাদিন পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে এসেছে তারা। ধুলোয় ঘামে জামাকাপড় চটচট করছিল। সেসব বদলে পাজামা-শার্ট পরে নিল।
সেটলমেন্টে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ কাজের কথাটা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। বলল, ‘আমি তো আপাতত এই জঙ্গলে থেকে যাব। আমাদের কাগজে আন্দামানের রিপোর্ট পাঠাব কী করে?’ এই প্রশ্নটা কি আগেও একবার বিশ্বজিৎকে করেছিল সে? ঠিক মনে পড়ল না।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমি তো কালকের দিনটা এখানে আছি। এর মধ্যে দুটো রিপোর্ট লিখে ফেলুন। আমি পরশু পোর্টব্লেয়ার গিয়ে এয়ার মেলে আপনাদের কাগজে পাঠিয়ে দেব।’
‘এবারটা না হয় পাঠানো গেল। তারপর?’
বিশ্বজিৎ জানালেন, পোর্টব্লেয়ার থেকে দু-তিন দিন পর পর। রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের গাড়ি নানা জিনিসপত্র নিয়ে এই অঞ্চলের সেটলমেন্টগুলোতে আসে। ড্রাইভারকে তিনি বলে দেবেন বিনয়ের কাছ থেকে লেখা নিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে। বিশ্বজিৎ রিপোর্টগুলো পাওয়ামাত্র কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন।
রোদের তেজ আর নেই। দিনের শেষ আলোটুকু ফিকে হতে হতে দ্রুত নিভে যাচ্ছে। পাহাড় আর বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষের হায়া দীর্ঘ হয়ে চরাচর ঢেকে দিচ্ছে। একটু পরেই বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে।
সেটলমেন্টে এসে দেখা গেল, এর মধ্যে অগুনতি হ্যাঁজাক আর গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বলছে বেশ কিছু হ্যারিকেনও। জোরালো আলোয় ভরে গেছে চারিদিক।
লম্বা লম্বা ব্যারাক ধরনের বাড়িগুলোর সামনের দিকের অনেকখানি জায়গায় জঙ্গল তো নির্মূল করা হয়েছিলই, নিচের ঘাস চেঁছে পরিষ্কার করে মাটিও বার করা হয়েছে। সেখানে লম্বা করে দুই সারিতে এমনভাবে চট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে পাশাপাশি অনেকে বসতে পারে।
ব্যারাকগুলোর একধারে বিরাট বিরাট টিনের ড্রাম আর উঁই করা অ্যালুমিনিয়ামের থালা আর গেলাস। সেখানে নিরঞ্জন আর বিভাস তো রয়েছেই, তাছাড়া পুনর্বাসন বিভাগের অন্য কর্মীদেরও দেখা যাচ্ছে।
নিরঞ্জনরা দারুণ করিৎকর্মা। সমুদ্র থেকে চান করে আসার পর উদ্বাস্তুদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তারা।
নিরঞ্জনের হাতে লম্বা তালিকা। সেটা দেখে হেঁকে হেঁকে উদ্বাস্তুদের নাম পড়ছিল। –’চন্দ্র সূত্রধর, হরিমতি সূত্রধর–সরকার থিকা আপনেগো হগলেরে থাল গেলাস দেওন হইতে আছে। একে একে লইতে থাকেন–’ নিরঞ্জন কখনও উদ্বাস্তুদের ‘তুমি’ করে বলে, কখনও ‘আপনি’। নিরঞ্জনের পাশেই বিভাস এবং আরও দু’জন কর্মী দাঁড়িয়ে আছে। তারপর টিনের ড্রামগুলোর কাছে আরও কয়েকজন কর্মী। তাদের হাতে মস্ত মস্ত পেতলের হাতা।
বিভাসরা থালা-গেলাস দিয়ে ভ্রামগুলোর দিকে উদ্বাস্তুদের পাঠিয়ে দিচ্ছে। ড্রাম বোঝই রয়েছে খিচুড়ি চালডালের সঙ্গে আলু কুমড়ো পটল এবং অন্যান্য সবজি সেদ্ধ করা হয়েছে। আলাদা করে তরকারি বা ভাজাটাজা করার সময় হয়তো পাওয়া যায়নি।
পুনর্বাসন বিভাগের একজন কর্মী হাতায় করে উদ্বাস্তুদের থালায় খিচুড়ি এবং অন্যজন আর একটা ড্রাম থেকে মগে করে গেলাসে গেলাসে খাওয়ার জল দিচ্ছে।
পরিতোষ একধারে দাঁড়িয়ে তদারক করছিল। সে খানিক দূরে বিছানো চটের আসনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে উদ্বাস্তুদের বলছিল, ‘আপনেরা ওইখানে গিয়া বইসা বইসা খান। আইজ খিচোড়ি দেওয়া হইল। কাইল থিকা ভাত মাছ ডাইল দুধ পাইবেন। যান—’
বিনয়কে সঙ্গে করে বিশ্বজিৎ পরিতোষদের কাছে চলে এসেছিলেন। তাদের দিকে নজর পড়তেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে পরিতোষ। ক’পা এগিয়ে এসে জিগ্যেস করে, ‘স্যার, আপনেরা কি অখন খাইবেন?’
বিশ্বজিৎ একটু হাসলেন। –‘কখন সেই সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। সন্ধে হতে চলল। এর ভেতর পেটে কিছু পড়েনি। পেটে হুতাশন জ্বলছে হে–’
রিফিউজিদের জন্য অ্যালুমিনিয়ামের নতুন নতুন থালা গেলাস ছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু শালপাতার থালা আর মাটির গেলাস। পরিতোষ নিজের হাতে শালপাতার থালায় খিচুড়ি নিয়ে এল বিশ্বজিৎদের জন্য। বলল, ‘আপনেরা খাইতে থাকেন স্যার। খাওন হইলে জল নিয়ে আসুম–’
বিশ্বজিৎ আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের প্রায় সর্বেসর্বা; বিপুল ক্ষমতাবান। কিন্তু তার জন্য আলাদা করে পোলাও কালিয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। নিশ্চয়ই আগে থেকে হুকুমনামা জারি করা আছে, যত বড় অফিসারই হোন, রিফিউজি সেটলমেন্টে এলে উদ্বাস্তুরা যা খাবে তাদেরও তা-ই খেতে হবে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমাদের জন্যে উতলা হতে হবে না। খিচুড়ি নিয়ে আসা তোমার উচিত হয়নি। যখন দরকার হবে, আমরাই জল চেয়ে নেব। তুমি ওধারে যাও। দেখ, কার কী লাগবে, পেট ভরে ওরা খাচ্ছে কি না।’
পরিতোষ চলে গেল।
ওধারে খিচুড়ি বিতরণ হয়ে গিয়েছিল। উদ্বাস্তুরা কাতার দিয়ে চটের আসনে বসে খাচ্ছে।
সন্ধে নেমে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও যে অন্ধকার ফিকে ফিকে জোলো কালির মতো মনে হচ্ছিল, এখন তা অনেক গাঢ় হয়েছে। দক্ষিণ দিকের সমুদ্র আর দেখা যাচ্ছে না। বাকি তিন পাশের উঁচু উঁচু পাহাড় আর জঙ্গল প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় জন্তুর মতো এত পেতে আহে। সেদিকে তাকালে বুকের ভেতর কেমন যেন শিহরন খেলে যায়। বিনয়ের মনে হয় পৃথিবীর বাইরে সৌরলোকের কোনও সৃষ্টিছাড়া গ্রহে এসে পড়েছে।
উদ্বাস্তুরা যেখানে বসে খাচ্ছি সেখান থেকে নিরঞ্জনের গলা ভেসে আসে। কখন যে সে ওদের কাছে চলে গিয়েছিল, টের পাওয়া যায়নি।
নিরঞ্জন গলার স্বর উঁচুতে তুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছিল, ‘ভাই সগল, পোর্ট ব্লেয়ার থিকা এতখানি পথ আইতে আপনেগো শরীলের উপুর দিয়া অনেকখানি তাফাল গ্যাছে। আইজ তরাতরি খাওনদাওন সাইরা গিয়া শুইয়া পড়েন। কাইল সকাল সকাল উইঠা পড়বেন। কাইল থিকাই আপনেগো জমিন দেওয়া হইব।’
খানিক দূরে দাঁড়িয়ে খিচুড়ি দিয়ে নৈশভোজ সারতে সারতে রীতিমতো অবাকই হয়ে গেল বিনয়। বিশ্বজিতের দিকে ফিরে বলল, ‘এখানে সব দিকেই তো ঘোর জঙ্গল। বড় বড় কটা গাছ কাটা হয়েছে শুধু। এই জঙ্গলে জমি কোথায়? কী করে তা দেওয়া হবে? কে কতটা এলাকা পাচ্ছে তা-ই বা ঠিক হবে কীভাবে?’
বিশ্বজিৎ হাসলেন।–’কালই সব দেখতে পাবেন।’
খাওয়া হয়ে গেলে আঁচিয়ে, জল খেয়ে বিনয়কে নিয়ে বিশ্বজিৎ তাঁর ঘরে চলে গেলেন।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
২.০১ জেফ্রির পয়েন্টে অন্ধকার
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরের এই জেফ্রির পয়েন্টে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। সেই সঙ্গে নেমেছে গাঢ় কুয়াশা। এখন শুক্লপক্ষ। আকাশে পূর্ণ চাঁদের মায়াবী আলো। অন্ধকার আর কুয়াশার স্তরগুলো ভেদ করে চুঁইয়ে চুঁইয়ে সেই আলো এসে পড়েছে দক্ষিণ আন্দামানের এই সৃষ্টিছাড়া ভূখণ্ডে।
তিনদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাথায় হাজার বছরের আদিম অরণ্য, অন্যদিকে যতদূর চোখ যায় ধু-ধু দিগন্ত অবধি সমুদ্র–অফুরান বঙ্গোপসাগর। অন্ধকার আর কুয়াশা মাখানো জ্যোৎস্না চারপাশের চরাচরকে অপার কোনও রহস্যে যেন মুড়ে রেখেছে। সমুদ্রকে ঝাঁকি দিতে দিতে উঠে আসছে জোরালো হাওয়া। তুমুল ঢেউ এসে ভেঙে পড়ছে সোনালি বালির বিচে। একটানা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে শাঁই শাঁই। সমুদ্রের দিকটা ছাড়া বাকি সব কিছু একেবারে নিঝুম। অনন্ত নৈঃশব্দ্য বনভূমি, পাহাড় আর উপত্যকা পাষাণভারের মতো চেপে বসেছে।
এখানে নতুন উপনিবেশের পত্তন হবে। গড়ে উঠবে বাংলার ছিন্নমূল মানুষদের নতুন বাসভূমি। কয়েক ঘণ্টা আগে সেই বিকেল বেলায় দেড়শো উদ্বাস্তু পরিবারের শ’ পাঁচেক প্রথম দলটা এসে গেছে। সাড়ে চারদিন জাহাজে আর এ পোর্ট ব্লেয়ারে কাটিয়ে লরিতে চেপে চড়াই-উতরাই ভেঙে ঝাঁকানি খেতে খেতে যখন তারা পৌঁছল হাড়মজ্জা প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সন্ধে নামতে না নামতেই তাদের খাইয়ে ব্যারাকের মতো লম্বা ঘরগুলোতে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছিল বিভাসরা। এখন তারা গভীর ঘুমের আরকে ডুবে আছে।
কিছুক্ষণ আগেও পূনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের কথাবার্তা ভেসে আসছিল। তাদেরও আর সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সারাদিন হইহই করে খাটাখাটুনির পর ওরাও অপার ক্লান্তিতে বিছানায় শরীর ঢেলে দিয়েছে।
বিশ্বজিৎ রাহার মাঝারি ধরনের ঘরটিতে টেবলের ওপর ঝুঁকে লিখে চলেছে বিনয়। টেবলের এক কোণে একটা ঝকঝকে কাচের বড় লণ্ঠন জ্বলছে আরও একটা লণ্ঠনও রয়েছে। সেটা ঝুলছে সিলিং থেকে। দুই লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোয় ঘর ভরে গেছে।
এই ঘরের দুটো তক্তপোশে পুনর্বাসন দপ্তরের একজন কর্মী বিছানা পেতে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। একটা বিছানায় মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে ক্রাইম স্টোরি পড়ছেন বিশ্বজিৎ। তিনি ডিটেকটিভ গল্পের পোকা। অন্য বিছানাটা ফাঁকা। লেখা শেষ হলে বিনয়ও সেখানে শুয়ে পড়বে।
ঘরের চার কোনায় চারটে পেতলের সরায় মশা-মারার তেজি ধূপ পুড়ছে। এই বিজন অরণ্যে লক্ষ কোটি মশা আর বাড়িয়া পোকা দিবারাত্রি ঝাঁক বেঁধে টহল দিয়ে বেড়ায়। রাত্তিরে তাদের উদ্যমটা শতগুণ বেড়ে যায়। তারা টের পেয়েছে জেফ্রি পয়েন্টে নতুন মানুষ এসেছে। মানুষ মানেই তো টাটকা সুস্বাদু রক্ত।
বিনয়ের টেবলের সামনের বড় জানালাটা খোলা। ওরা ঘরে এসে ঢুকতেই বাড়িয়া পোকা আর মশাদের দঙ্গলগুলো ঢুকে আসছিল কিন্তু ধূপের উগ্র ঝাঁঝে ফিরে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু যাদের এনার্জি বেশি, ভেতরে এসে হাত-পা-শুঁড়-ডানা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দমবন্ধ হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঘরের এধারে ওধারে মরা পোকা আর মশাদের ডাঁই।
পরশু দুপুরে বিশ্বজিৎ পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে যাবেন। তার হাতে ‘নতুন ভারত’-এর জন্য অন্তত দুটো প্রতিবেদন তৈরি করে দিতেই হবে। আজ রাত্তিরে একটা লেখা শেষ না করলেই নয়। সেই সঙ্গে লিখতে হবে তিনটে চিঠি! বাকি প্রতিবেদনটা কাল এক ফাঁকে লিখে ফেলবে। বিশ্বজিৎ সেগুলো পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্লেনে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন।
এক সময় প্রথম রিপোর্টটা শেষ হল। খিদিরপুর ডক থেকে হাজারখানেক উদ্বাস্তুকে নিয়ে এস এস ‘মহারাজা’ জাহাজে রওনা হওয়ার পর থেকে পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছনো পর্যন্ত অনুপুঙ্খ বিবরণ গুছিয়ে লিখেছে বিনয়। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় আতঙ্কে উদ্বাস্তুদের দিশেহারা হয়ে যাওয়া, তাদের মৃত্যুভয়, তাদের বুঝিয়েসুঝিয়ে ভরসা দিয়ে শান্ত করা, উত্তাল সমুদ্রে ভয়াবহ সাইক্লোনের মুখে পড়া–কোনও তে দিতে কিছুই বাদ যায়নি।
লেখাটা বেশ বড়ই হল। পুরো এগারো পাতা। আগাগোড়া সেটা পড়ে দু-চারটে শব্দ পালটে, তিন-চারটে প্যারা কেটে নতুন করে লিখল বিনয়। মনে হল রিপোর্টটা ভালোই দাঁড়িয়েছে। আন্দামানের প্রথম প্রতিবেদনটা যে ‘নতুন ভারত’-এর পাঠকদের উৎসুক করে তুলবে তা নিয়ে বিনয়ের সংশয় নেই। ভেতরে ভেতরে তৃপ্তিই বোধ করল সে। একটা লাগসই হেডিং দিতে হবে। খানিকক্ষণ ভেবে প্রথম পাতার মাথায় বড় বড় অক্ষরে লিখে ফেলল ‘উত্তাল কালাপানি পেরিয়ে উদ্বাস্তুদের আন্দামান যাত্রা’। তারপর কাগজগুলো গুছিয়ে পিন দিয়ে গেঁথে টেবলের এক পাশে রাখল।
ঘাড় গুঁজে একটানা কলম চালিয়েছে। একটু ক্লান্তই লাগছিল বিনয়ের। পিঠটা পেছন দিকে হেলিয়ে জানালার বাইরে তাকাল সে। সন্ধের পর থেকে যেমনটা দেখেছিল তার কোনও হেরফের নেই। ঘোলাটে চাঁদের আলো, কুয়াশা আর অন্ধকারে দক্ষিণ র্তিা কানে আন্দামানের পাহাড় অরণ্য জুড়ে সেই অন্তহীন নিশুতি। কিছুক্ষণ যাচ্ছে না। আগেও সমুদ্রের দিক থেকে জোর হাওয়া দিচ্ছিল। হঠাৎ হাওয়ার তেজ পড়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের লক্ষ কোটি ঢেউ বাতাসের ধাক্কায় পাড়ে এসে বিপুল গর্জনে অবিরল ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। এখন সেই আওয়াজ থেমে গেছে। কোনও এক অদৃশ্য ম্যাজিসিয়ান জাদুকাঠি ছুঁইয়ে আচমকা যেন জেফ্রি পয়েন্টের সব শব্দ থামিয়ে দিয়েছে।
এই রাত্রিবেলা আদিম প্রকৃতির নিস্তব্ধ খাঁজের ভেতর বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন গা ছম ছম করে।
কয়েক মিনিট বাইরে তাকিয়ে থাকার পর সুটকেস থেকে চিঠির কাগজ খামটাম বার করে নিল বিনয়। আপাতত তিনটে চিঠি লিখতে হবে। একটা ‘নতুন ভারত’-এর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়িকে, একটা আনন্দকে, একটা সুধাকে। চকিতে মনে পড়ে গেল, কলকাতা থেকে জাহাজে ওঠার আগে ঝুমা কতবার যে বলেছে আন্দামানে পৌঁছেই বিনয় যেন তাকে চিঠি লেখে। বিনয় নিজেও জানিয়েছিল, লিখবে, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই লিখবে।
ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর তার জীবন জুড়ে যে ধু-ধু শূন্যতা নেমে এসেছিল সেই কটা ধীরে ধীরে ভরিয়ে তুলেছিল ঝুমা। রাজদিয়ায় তাকে নিয়ে দুই কিশোরীর মধ্যে যে মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা কতকাল চলত, কে জানে। কলকাতায় আসার পর যখন তারা পূর্ণ যুবতী তখনও সেই যুদ্ধের অবসান হয়নি।
ঝুমা এক পরমাশ্চর্য মেয়ে। যেন কোনও মায়া কাননের পরি। কী যে তীব্র সম্মোহন তার। এস্রাজে ছড় টানার মতো তার হাসি, তার কণ্ঠস্বরে হালকা ঝংকার, নিটোল ফুলদানির মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে আধবোজা চঞ্চল চোখে তাকানো, তার সারা শরীর থেকে উঠে আসা উগ্র সুগন্ধ বিনয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলত। শত আলোকবর্ষ দূরের পূর্ব বাংলার ছোট্ট শহর রাজদিয়ায় এক বিজন দুপুরে কিশোরী ঝুমা তাদের বাড়ির চিলেকোঠায় একটি চুম্বনে সেদিনের বিনয়ের স্নায়ুতে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। বিনয়ের হাত ধরে জীবনের অজানা রহস্যের অনেকগুলো দরজা পার করে যৌবনের সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে সে। তার কাছে গেলে সারা। শরীর ঝিম ঝিম করত। প্রবল আকর্ষণে সমস্ত শিকড় ছিঁড়ে ঝুমা বিনয়কে ছিনিয়ে নিতে চাইত।
অন্যদিকে ছিল ঝিনুক। চিরদুঃখী মেয়েটার শান্ত করুণ মুখ, বিষাদ মাখানো চোখের তাকানো, তার নিঝুম বসে থাকা, তার সংগোপন যাতনা–সব মিলিয়ে এমন এক শক্তি ছিল যা দিয়ে বিনয়কে নিজের কাছে ধরে রেখেছে। ঝুমা তার সমস্ত মাদকতা দিয়েও তাকে পুরোপুরি কেড়ে নিতে পারেনি।
কিন্তু ঝিনুক নিখোঁজ হওয়ার পর উদ্ভ্রান্তের মতো কলকাতা এবং মহানগরের চারপাশে পঁচিশ-তিরিশ মাইল দূর অবধি ঘুরে ঘুরেও যখন তার সন্ধান পাওয়া গেল না, ভেঙেচুরে একেবারে তছনছ হয়ে গিয়েছিল বিনয়। সেই সময় অফুরান মমতায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ঝুমা। যে মেয়ে পুরুষের রক্তে তুফান তোলে, জাদুকরির মতো আঙুলের ডগায় তুলে তাকে নাচায়, তুড়ি মেরে মেরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে মাতিয়ে দিতে পারে, এ যেন সেই ঝুমা নয়। কী প্রগাঢ় মায়া এই ঝুমার, কী অনন্ত সহানুভূতি।
ঝিনুক জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়ার পর এক সময় বিনয়ের মনে হয়েছিল আকাশ খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে। ঝিনুককে ছাড়া কীভাবে দিন কাটবে ভাবতেও পারছিল না। সে যে কী নিদারুণ ক্লেশ, কী যে অসহ্য দাহ! কিন্তু জীবন তো এক জায়গায় থেমে থাকে না; তার ভাঁজে ভাঁজে কত যে ইন্দ্রজাল লুকনো আছে, আগে তা কি সে জানত? ঝিনুক তার হাড়েমজ্জায় যে দগদগে রক্তাক্ত ক্ষত রেখে গিয়েছিল, ঝুমা তার ওপর স্নিগ্ধ প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে। তখন পাগল পাগল, অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। তাকে সেখান থেকে তুলে এনে কত যত্নে ঝুমা যে সুস্থ স্বাভাবিক করে তুলেছে। ক্রমশ বিনয়ের মনে হয়েছে স্বেচ্ছায় যে মেয়েটি হারিয়ে গেছে তার জন্য বাকি দীর্ঘ জীবনটা শুধু স্মৃতি, হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কাটানো যায় না। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ঝুমার হাতে সঁপে দিয়েছে সে।
কিন্তু কে জানত, আন্দামানে ‘রস’ আইল্যান্ডে ঝিনুকের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাবে? না, তাকে ভোলা যায়নি। বুকের ভেতর যে গোপন ক্ষতটা মনে হয়েছিল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ফের সেটা সময়ের স্তর ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। বিনয় টের পেয়েছে, নতুন করে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। ঝিনুকের জন্য সেই পুরনো আবেগ আর তীব্র ব্যাকুলতা তাকে উথালপাতাল করে দিয়েছে। আরও একবার সে টের পেয়েছে তার শ্বাসপ্রশ্বাসে মেয়েটা জড়িয়ে আছে। আমৃত্যু জড়িয়েই থাকবে।
ঝিনুককে দেখার পর ঝুমা বহু-বহু দূরে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এ এক আশ্চর্য খেলা। যতদিন ঝিনুককে পাওয়া যায়নি, সেই শূন্য স্থানে চলে এসেছিল ঝুমা। কিন্তু এখন? বিনয়ের অজান্তে কেউ যেন তাকে নিঃশব্দে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে।
এরপর ঝুমাকে চিঠি লেখা কি ঠিক হবে? বিনয় মনস্থির করে ফেলল লিখবে না। লেখাটা মহা অন্যায়। এক ধরনের পাপই হবে। সে যেন নিয়তিতাড়িত এক মানুষ। ঝিনুকই তার নিয়তি। তাকে বাদ দিয়ে অন্য কোনও নারীর কথা এই মুহূর্তে সে ভাবতে পারছে না। ঝুমা খুবই কষ্ট পাবে, ভেঙেও পড়বে কিন্তু সম্পর্কটা খুব সম্ভব রাখা যাবে না। ঝুমাকে সে কি ভালোবাসেনি? বেসেছে। দুঃখের দিনে সংকটের সময় সে যখন চুরমার হয়ে যাচ্ছিল, ঝুমা পাশে থেকে তাকে ধসে পড়তে দেয়নি। অবিরল শুশ্রূষায় সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে। এটা তো ঠিক মনপ্রাণ ঢেলে মেয়েটা তাকে ভালোবেসেছে। কিন্তু যে ’রস’ আইল্যান্ডে ঝিনুককে দেখার পর বিনয়ের মনে হয়েছে জীবনের প্রথম নারীটি তার বত্রিশ নাড়ি ধরে টান দিয়েছে। ঝিনুকের সঙ্গে কাল একটি কথাও হয়নি। চলুঙ্গা জাহাজের আপার ডেকে দাঁড়িয়ে ছিল সে। জাহাজটা সুরে, আরও দূরে, ধীরে ধীরে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। তারপর অন্য একটা দ্বীপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই যে দেখা হয়েছিল তারপর থেকে ঝিনুক ঝুমার কাছ থেকে প্রবল টানে উপড়ে নিয়ে গেছে তাকে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে বিনয়। তারপর প্রথম চিঠিটা লেখে প্রসাদ লাহিড়িকে। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি। সে নিরাপদে আন্দামানে পৌঁছেছে, উদ্বাস্তু পরিবারগুলির সঙ্গে কাল চলে এসেছে জেফ্রি পয়েন্টে; গভীর অরণ্যের মধ্যে এখানেই রিফিউজি সেটলমেন্ট গড়ে উঠবে। দুটো প্রতিবেদন আপাতত সে পাঠাচ্ছে। এরপর দুদিন পর পর পাঠাতে থাকবে। ‘নতুন ভারত’-এর কপি এয়ারমেলে যদি বিশ্বজিৎ রাহার ঠিকানায় পাঠানো হয় সে পেয়ে যাবে। ঠিকানা লিখে দিল: C/o বিশ্বজিৎ রাহা, মেরিন জেটির কাছে। পোর্ট ব্লেয়ার। আন্দামান। প্রণাম জানিয়ে চিঠি শেষ করল বিনয়।
পরের চিঠিটা সে লিখল আনন্দকে। এটাও ছোট চিঠি। নির্বিঘ্নে পৌঁছবার খবর দিয়ে বিনয় জানাল, সে ভালোই আছে। তার জন্য কেউ যেন দুশ্চিন্তা না করে। বাড়ির কে কেমন আছে, ইত্যাদি জানিয়ে আনন্দ যেন মাঝে মাঝে চিঠি লেখে। বিনয়ও লিখবে। বিশ্বজিৎ রাহার ঠিকানা জানিয়ে সেখানেই যোগাযোগ করতে লিখল। তার চিঠিতে ঝুমার নামটা পর্যন্ত নেই।
বিনয় জানে, কলকাতায় আনন্দর কাছে চিঠি পৌঁছানোমাত্র খবর পেয়ে যাবে ঝুমা। তাকে না লিখে তার মামাকে লিখেছে, এতে ভীষণ ভেঙে পড়বে মেয়েটা। কিন্তু কিছু করার নেই বিনয়ের। চকিতের জন্য তার খেয়াল হল, অনন্তকাল সে আন্দামানে পড়ে থাকবে না। একমাস কি দু’মাস পর তাকে কলকাতায় ফিরে যেতেই হবে। তখন কি ঝুমা তার কাছে ছুটে আসবে না? তার ব্যাকুলতার সামনে দাঁড়িয়ে কী জবাব দেবে সে? না–এখন আর সেসব ভাবতে পারছে না বিনয়।
ঝুমার চিন্তাটা মাথা থেকে এক রকম জোর করেই বার করে দিয়ে শেষ চিঠিটা লিখতে শুরু করল বিনয়।
‘প্রিয় ছোটদি,
এখন অনেক রাত। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে অনেক দূরে আজ বিকেলে আমরা এমন একটা সৃষ্টিছাড়া জায়গায় এসে পৌঁছেছি, কলকাতায় বসে তুই তা কল্পনাই করতে পারবি না। তিনদিকে গভীর অরণ্য, একদিকে সমুদ্র। এই এলাকাতেই কাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের উপনিবেশ তৈরির কাজ শুরু হবে। মনে হচ্ছে পশ্চিম। আফ্রিকার সুগভীর অরণ্যে ঘেরা আদিকালের এক অজানা, রহস্যময় পৃথিবীতে এসে পড়েছি। যতদূর চোখ যায়, এলাকাটা এত নির্জন, এমনই নিঝুম যে গা ছম ছম করে। এখানে বেশ কিছুদিন আমাকে থাকতে হবে। আমার ধারণা, এমন সব ঘটনা আর অভিজ্ঞতা হবে, আগে আর কখনও তা হয়নি।
সে যাক, তোরা কেমন আছিস? তুই তো সেই ছেলেমানুষ বয়স থেকেই ছিচকাঁদুনে; একটুতেই কেঁদে কেটে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভাসিয়ে। দিস। আমার জন্য ভেবে ভেবে মোটেও শরীর খারাপ করবি না। তোর ঠাকুরঘরে যে শ’খানেক দেবদেবী রয়েছে তাদের নামে দিব্যি করে বলছি, আমি ভালো আছি। আমার বিপদের কোনও ভয় নেই। যেসব অফিসার এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা সেটলমেন্ট গড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তারা সব সময় আমার দিকে লক্ষ রাখছেন। আদরযত্নের লেশমাত্র ত্রুটি নেই।
একজনের জন্য আমি ভীষণ দুর্ভাবনায় আছি। তিনি হেমদাদু। কলকাতায় থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের অনেক খবর পাওয়া যায়। কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরে পৃথিবী নামে গ্রহটির সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক যেন ছিঁড়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানে কী হচ্ছে, সেখানকার হাল আরও খারাপ হয়ে গেছে কি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।
বর্ডার থেকে নিত্য দাস এর মধ্যে কি হেমদাদুর চিঠিপত্র দিয়ে গেছে? যদি দাদুর চিঠি আসে, খামে ভরে নিচের ঠিকানায় অবশ্যই পাঠিয়ে দিবি…..
এই পর্যন্ত লেখার পর হঠাৎ ঝিনুকের মুখ চোখের সামনে, ভেসে ওঠে। এই মেয়েটার প্রতি যার অনন্ত সহানুভূতি, সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও একমাত্র সে-ই তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছিল। লাঞ্ছনায়, গ্লানিতে, অসম্মানে চিরদুঃখী ঝিনুক যখন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, খুবই কষ্ট পেয়েছিল সুধা।
তার এই ছোটদির কাছে সেই জ্ঞানবুদ্ধি হবার বয়স থেকে কখনও কিছু লুকোয়নি বিনয়। তার জীবনের ভালোমন্দ, সংকট বা আনন্দের মুহূর্তগুলো অকপটে মেলে ধরেছে।
কিন্তু না, ঝিনুকের কথা এখন কিছুতেই লিখতে পারবে না। আপাতত তা গোপনই রাখবে। তার কারণও রয়েছে। ঝিনুকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে মাত্র। কিন্তু কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়নি। সে রয়েছে মধ্য আন্দামানে, আর বিনু দক্ষিণ আন্দামানের জেফ্রি পয়েন্টে। দূরত্ব আর কতটুকু? বড়জোর ষাট কি সত্তর মাইল। সে তো মাইলের হিসেবে। কিন্তু এই দুর্গম দ্বীপপুঞ্জে যাতায়াত এমনই দুরূহ যে এক মাসের মধ্যে সেখানে যাওয়া অসম্ভব। এর থেকে লক্ষ কোটি মাইল দূরের নক্ষত্রলোকে পৌঁছনো অনেক সহজ।
সবার আগে মধ্য আন্দামানে গিয়ে ঝিনুককে খুঁজে বার করতে হবে। নিরুদ্দেশ হবার পর থেকে কতটা দুঃখ, কতখানি ক্লেশ, কতখানি অভিমান মনের গোপন কুঠুরিতে সে জমিয়ে রেখেছে। প্রথমে তা জানতে হবে। সামনাসামনি তাকে দেখে ঝিনুকের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, ঘৃণায় ক্রোধে তাকে ফিরিয়ে দেবে কি না কিছুই জানা নেই।
বিনয়ের ধারণা, বিনয়ের বিশ্বাস ঝিনুক তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু মাঝখানের কয়েক মাসে সে যদি পুরোপুরি বদলে গিয়ে থাকে? যদি সে তাকে ফিরিয়ে দেয়? বুকের ভেতরটা হঠাৎই ভীষণ উতলা হয়ে ওঠে বিনয়ের।
খানিকক্ষণ পর মন কিছুটা শান্ত হলে সে ফের লেখা শুরু করে।
জানিস ছোটদি, আন্দামানে আসার পর এমন একটা ঘটনা ঘটেছে তার পরিণাম সুখকর হবে, নাকি অনন্ত বেদনাদায়ক, বুঝতে পারছি না। ঘটনাটি আমাকে প্রবল সংশয়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে এই চিঠিতে আর কিছু লিখছি না। তেমন বুঝলে পরে সমস্ত জানাব। দ্বারিকদাদু, জেঠিমা, হিরণদা আর তুই আমার ভালোবাসা এবং প্রণাম নিস। ইতি তোদের বিনু।
নিচে বিশ্বজিৎ রাহার ঠিকানা দিয়ে লিখল, এখানে উত্তর দিলে আমি পেয়ে যাব।
আগাগোড়া চিঠিটা একবার পড়ল বিনয়। আচমকা খেয়াল হল, ঝিনুকের ব্যাপারটা গোপন রাখবে ঠিক করেও নিজের অজান্তেই তার সম্বন্ধে একটু ইঙ্গিত দিয়ে ফেলেছে। লাইনগুলো কেটে দেবে কি? পরক্ষণে ভাবল, লেখা যখন হয়েই গেছে–থাক।
তিনটে চিঠি তিনটে খামে পুরে মুখ আঠা দিয়ে আটকে আনন্দ, প্রসাদ এবং সুধার পুরো নাম ঠিকানা লেখা যখন শেষ হয়েছে সেই সময় দূর থেকে অনেকগুলো ড্রাম বাজানোর একটানা তীব্র আওয়াজ ভেসে এল। কারা যেন উন্মাদের মতো বাজিয়ে চলেছে।
আদিম বনভূমির অন্তরাত্মা ভেদ করে শব্দপুঞ্জ উঠে আসছে। মধ্যরাতের নিরেট স্তব্ধতা ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যাচ্ছে।
অজানা ভয়াবহ কোনও আশঙ্কায় পা থেকে মাথা অবধি কেঁপে যায় বিনয়ের।
এদিকে বাইরে তুমুল হইচই শুরু হয়ে গেছে। পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা সারাদিন অসুরের মতো খেটে কোনওরকমে খাওয়াদাওয়া সেরে অসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ড্রামের শব্দে তাদের চোখ থেকে লহমায় ঘুম ছুটে গেছে। বিছানা থেকে উঠে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে যে যার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে।
জানালার বাইরে বিহুলের মতো তাকিয়ে ছিল বিনয়। দেখতে পেল কতকগুলো ছায়ামূর্তি ক্ষিপ্র হাতে একের পর এক মশাল জ্বালাচ্ছে। বেশ কয়েকজনের হাতে লম্বা লম্বা টর্চ। ওদের মধ্যে থেকে কয়েকজন সমানে চেঁচিয়ে চলেছে, জারোয়া–জারোয়া–হোঁশিয়ার।
নতুন সেটেলমেন্টের এধারের অংশটুকু আলোয় ভরে গেছে। এখন বাইরের লোকগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ বণিক, চেইনম্যান ধনপত সিং, তার চারজন বর্মি সহকারী, বিভাস, নিরঞ্জন এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের অন্য সব বাঙালি এবং অবাঙালি কর্মীরা, যাদের মধ্যে বেশ ক’জন পুরানো দাগি আসামি। এরা ব্রিটিশ আমলে যাবজ্জীবন কালাপানি’র সাজা নিয়ে আন্দামানে জেল খাটতে এসেছিল।
ওদিকে পাশের খাটে সচকিত হয়ে উঠে বসেছেন বিশ্বজিৎ। হাতের বইটা একধারে রেখে মশারি তুলে নেমে এলেন। বললেন, চলুন, দেখা যাক কী হল–
২.০২ উদ্দাম জঙ্গলের ভেতর
উত্তর দিকে অনেকটা দূরে চাপ বাঁধা, ঝাপসা, উদ্দাম জঙ্গলের ভেতর ড্রামের আওয়াজ ক্রমশ আরও তীব্র হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে ভেসে আসছে বেশ কিছু মানুষের হইচই। তারা একসঙ্গে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলছে, এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
অত দূরের ওই জঙ্গলে এত রাতে কারা ড্রাম পেটাচ্ছে, কিছুই আন্দাজ করতে পারল না বিনয়। অজানা শঙ্কায় তার বুকের ভেতরটা কেঁপে গেল।
উত্তর দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিশ্বজিৎ। পলকহীন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বিনয়। নিচু গলায় জিগ্যেস করল, কারা ড্রাম বাজাচ্ছে?
বিশ্বজিৎ তার দিকে তাকালেন না। দুরে চোখ রেখে বললেন, বুশ পুলিশেরা।
ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। বিনয় জানতে চাইল, বুশ পুলিশ বলতে?
এবার চোখ ফেরালেন বিশ্বজিৎ। দুরের দুর্ভেদ্য বনভূমির দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ওখানে পেরিমিটার রোড় রয়েছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পশ্চিম থেকে ওটা পুব দিকে চলে গেছে।
বিনয়ের কাছে ব্যাপারটা গুলিয়ে গেল। সে জিগ্যেস করে, এ জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা আছে নাকি?
না না—
বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে দিলেন, পেরিমিটার রোড নামে রাস্তাটা পুরোপুরি কাল্পনিক। ওটা মোটামুটি ভেবে নেওয়া হয়েছে। জঙ্গলে সোজা একটা লাইন ধরে দেড়-দুশো গজ দূরে দূরে তিরিশ-চল্লিশ ফিট উঁচু উঁচু টঙ বানিয়ে দিনরাত পালা করে তিন শিফটে পুলিশের একটা দল পাহারা দেয়। কেননা পেরিমিটার রোডের ওধারে আরও গভীর অরণ্যে হিংস্র জারোয়ারা থাকে। মাঝে মাঝেই তারা এ ধারের পুরনো পেনাল কলোনি আর যেসব নতুন রিফিউজি সেটলমেন্ট বসছে, সেখানে হানা দেয়। ওরা হয়তো মনে করে আন্দামানের সব জঙ্গলের অধিকার একমাত্র তাদেরই। সেখানে অন্য কেউ এসে থাকুক, একেবারেই তা চায় না। এই সব। অনুপ্রবেশকারীকে তাড়াতেই তাদের অবিরত সশস্ত্র হানাদারি। ওদের গতিবিধির ওপর সর্বক্ষণ নজর রেখে চলেছে বুশ পুলিশ। তির-ধনুক বা অন্য ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যখনই তারা সেটলমেন্টগুলোর দিকে আসতে থাকে, ড্রাম পিটিয়ে, হল্লা করে বুশ পুলিশ সবাইকে সতর্ক করে দেয়। খুব সম্ভব আজ জারোয়াদের গতিবিধি লক্ষ করে তারা ড্রাম বাজিয়ে চলেছে।
ধনপত কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এসে বলল, আগে যা কর দেখুঙ্গা।
বিশ্বজিৎ বললেন, দেখ–
মশাল হাতে দু’জন সঙ্গীকে নিয়ে ধনপত তক্ষুনি উত্তর দিকে জোর জোরে পা চালিয়ে দিল।
নয়া সেটলমেন্টের খানিকটা অংশ বিশাল বিশাল গাছ কেটে, ঝোঁপঝাড় নির্মূল করে বন বিভাগের কর্মীরা সাফ করে রেখেছিল। সে আর কতটুকু এলাকা! তারপর আন্দামানের হাজার বছরের প্রাচীন অরণ্য অপার রহস্য আর ভয়াবহতা নিয়ে আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে।
ধনপতদের তিন জনের হাতে তিনটে মশাল। ফাঁকা জায়গাটা তারা সবে পেরিয়েছে, তখনই দেখা গেল আট-দশজন হট্টাকট্টা চেহারার বুশ পুলিশ, হাতে বন্দুক, জঙ্গল ভেদ করে ঊৰ্ধশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে বেরিয়ে এসে ধনপতদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের চোখেমুখে উত্তেজনা, ত্রাস। ধনপতদের সঙ্গে ওরা কিছুক্ষণ কথা বলল, তার একটা বর্ণও শুনতে পেল না বিনয়রা।
একটু পরেই দেখা গেল বুশ পুলিশের দলটাকে নিয়ে ধনপতরা ফিরে এল।
বুশ পুলিশরা প্রায় সবাই বিহারি আর পাঞ্জাবের লোক। চাকরি নিয়ে দুর্গম দ্বীপে চলে এসেছে।
বিশ্বজিৎ ওদের চেনেন। পুলিশের দলটাও তাকে খুব ভালো করেই চেনে। জিগ্যেস করলেন, ডিউটি ছেড়ে তোমরা পালিয়ে এলে কেন?
বিনয় লক্ষ করল, বিশ্বজিতের কপাল কুঁচকে গেছে। পুলিশরা। ঘাঁটি ছেড়ে চলে আসায় তিনি খুবই বিরক্ত।
পুলিশরা হাইমাই করে তড়বড়িয়ে একসঙ্গে বলতে শুরু করল, ফলে বিরাট এক হট্টগোলের সৃষ্টি হল।
গলা চড়িয়ে ধমকের সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, হল্লাগুল্লা মাত কর। এক সাথ নেহি– একজন সিপাহি শিখের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, তুম বোলো। আইস্তা আইস্তা। হড়বড়াকে নেহি।
শিখ জানাল, তারা পেরিমিটার রোডে টঙের মাথায় বসে। অন্যদিনের মতো জারোয়া এলাকার দিকে নজর রাখছিল। আচানক দেখতে পেল দূর থেকে জংলিরা তির-ধনুক ইত্যাদি মারাত্মক হাতিয়ার নিয়ে সেটলমেন্টের দিকে আসছে। নয়া আদমিরা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের উৎখাত মানুষেরা বনজঙ্গল কেটে এখানে কলোনি বসাতে এসেছে তা তারা টের পেয়ে গেছে। এই এলাকায় বাইরের লোকজন এসে পাকাপাকিভাবে থাকুক সেটা তাদের আদৌ পছন্দ নয়। তাই জারোয়াদের মতলব ছিল মধ্যরাতে হামলা চালিয়ে উদ্বাস্তুদের ভাগিয়ে দেবে।
বুশ পুলিশ জারোয়াদের দেখামাত্র ড্রাম পিটিয়ে হল্লা বাধিয়ে সেলটমেন্টের সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ড্রামের আওয়াজ-টাওয়াজ কেউ যদি শুনতে না পেয়ে থাকে তাই শিখেরা কয়েকজন এখানে দৌড়ে এসেছে।
এদিকে লম্বা লম্বা ব্যারাকগুলোতে উদ্বাস্তুরা মড়ার মতো অসাড়ে ঘুমচ্ছিল। হইচই শুনে তাদের চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়। বাচ্চাকাচ্চা ছেলেবুড়ো সুদ্ধ শ’পাঁচেক মানুষ হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে আসে।
বিনয় লক্ষ করল, মশালের আলোয় তাদের তিনদিক ঘিরে উদ্বিগ্ন মানুষের সারি সারি মুখ। ভিড়ের ভেতর থেকে হলধর সূত্রধর, মাখন রুদ্রপাল, এমনি কয়েকজন ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে আসে।
দূরে বুশ পুলিশের টঙগুলো থেকে অবিরাম ড্রামের গম্ভীর, হাড়-কাঁপানো শব্দ ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে অরণ্য ভেদ করে আসছে হইচই।
হলধর জিগ্যেস করে, মইদ্য রাইতে ঢাকের বাদ্যি ক্যান ছুটোবাবু? মেলা (অনেক) মাইনষে চিল্লাইতেও আছে।
মাখন রুদ্রপাল বলল, এই অচিন দ্যাশে ডরে বুক কাপে ছুটোবাবু। কুনো বিপদ কি ঘটল?
আচমকা বর্মি চেইনম্যানদের একজন বলে ওঠে, জারোয়া আতা হ্যায়। উসি লিয়ে হেঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। বহুকাল আন্দামানে থাকার কারণে সে এবং তার মতো সব বর্মি এবং ফারেন হিন্দুস্থানিটা রপ্ত করে ফেলেছে। আঠারোশো সাতান্নয় মহাবিদ্রোহের পর যুক্তপ্রদেশ থেকে যে বিপ্লবী সিপাহিদের আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল তখন থেকেই এখানকার মুখের বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে হিন্দুস্থানি হিন্দি আর উর্দুর মিশেলেও এই ভাষাটা সবাই বলে থাকে–সে বর্মিই হোক বা কারেন, কিংবা বাঙালি তামিল অর্থাৎ মারাঠি–তফাৎ ভারতের সমস্ত প্রদেশের মানুষও।
এতক্ষণ পাঁচশো মানুষের বিশাল জনতার মুখে চোখে ছিল উৎকণ্ঠা। লহমায় সেখানে আতঙ্ক ফুটে বেরুল। শোরগোল জুড়ে দিল তারা।
গরমেন (গভর্নমেন্ট) আমাগো মারতে লইয়া আইছে এই আন্ধারমান দ্বীপে।
সমুন্দুরে ঝড় তুফানে আছাড়িপিছাড়ি খাইছি। টেউগুলান আকাশে তুইলা পাতালে নামাইয়া আমাগো দুরমুশ করতে করতে হাড্ডিগুড্ডি চুর চুর কইরা ছাড়ছে। হের পরেও বাইচা আছিলাম। কিন্তু জারোর (জারোয়ার) হাত থিকা নিস্তার নাই। অরা আমাগো নিকাশ কইরা ছাড়ব।
হলধর কঁপা কাপ গলায় বিনয়কে বলল, ‘রস’ দ্বীপ থিকা ইস্টিমারে পুট বিলানে (পোর্ট ব্লেয়ারে) আসনের সোময় জারোগো কথা আপনেরে কইছিলাম। পাকিস্থানে রাজাকার, আর পশ্চিমা মুসলমানগো হাত থিকা কুনোরকমে বাপ-মায়ের দেওয়া পরান লইয়া ইন্ডিয়ায় আইছিলাম। আন্ধারমানে আমাগো নিঘঘাত মরণ। আপনের উপর ভরসা কইরা এই আমরা কই (কোথায়) আইলাম!
বিনয় বিব্রতভাবে কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, আচমকা ডান ধারে ভিড়ের শেষ মাথায় যে উদ্বাস্তুরা দাঁড়িয়ে ছিল, তুমুল হুলস্থূল বাধিয়ে দিল। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে উন্মাদের মতো বলতে লাগল, এইহানে আমরা থাকুম না। আমাগো এই যমের পুরী থিকা অন্য হানে লইয়া যান।
বয়স্ক পুরুষগুলোর হইচই শুনতে শুনতে নানা বয়সের মেয়েমানুষ এবং বাচ্চারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। তারা ডাক ছেড়ে প্রচণ্ড কান্না জুড়ে দিল।
চিৎকার এবং কান্নার একটানা শব্দ জেফ্রি পয়েন্টের পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে মাঝরাতের আবহাওয়াটাকে উতরোল ফুরে তোলে।
ড্রামের আওয়াজে এবং জারোয়াদের হাতিয়ার হাতে দূরের ৮ জঙ্গল থেকে ধেয়ে আসার খবর শুনে বিশ্বজিৎরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। উদ্বাস্তুদের কান্না এবং চেঁচামেচিতে তারা একেবারে হকচকিয়ে যান।
হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে বিশ্বজিৎদের খানিকটা সময় লাগল। তারপর বিশ্বজিতের সঙ্গে পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা উদ্বাস্তুদের বোঝাতে লাগল, তাদের কোনও ভয় নেই। বুশ পুলিশ আছে, পুনর্বাসন এবং কাছাকাছি বন বিভাগের অগুনতি কর্মী আর ফরেস্ট গার্ড রয়েছে, তেমন বুঝলে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আরও পুলিশ আনা হবে। জায়োরারা উদ্বাস্তুদের চামড়ায় একটি আঁচড় কাটতে পারবে না। কিন্তু কে কার কথা শোনে! তাদের কান্না এবং চিৎকার ক্রমশ আরও উদ্দাম হয়ে উঠতে থাকে।
ধনপত বিশ্বজিতের খুব কাছে এসে চাপা গলায় বলে, এ আদমিলোক কোনও কথা শুনবে না। হুকুম দেন তো থামাতে কোসিস করি।
বিশ্বজিৎ বললেন, দেখ চেষ্টা করে।
ধনপত উদ্বাস্তুদের দিকে সরে গিয়ে গলার স্বর শেষ পর্দায় তুলে হুঙ্কার ছাড়ে, রিফুজলোগ বিলকুল চোপ। রোনা (কাঁদা), চিল্লানা বন্ধ কর। বিনয় আগেই শুনেছে উনিশ বছর আগে তিন তিনটি খুন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি হিসেবে কালাপানিতে সাজা খাটতে এসেছিল ধনপত। এই মধ্যরাতে তার ভেতর থেকে সেই দুর্ধর্ষ কয়েদিটি হঠাৎই বেরিয়ে এসেছে। তার হাঁকানিতে উদ্বাস্তুদের উতরোল কান্নাকাটি লহমায় মিইয়ে যায়। কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করে, জারো বাইর হইয়া আইছে। অহন আমাগো কী অইব?
ধনপত এবার নরম গলায় বলল, ডরো মাত। আমরা তো আছি। বারিকে (ব্যারাকে) চলে যাও। আমরা জংলি আদমিদের সামলাব।
উদ্বাস্তুরা আর দাঁড়ায় না; যে যার ব্যারাকে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ত্রাস তাদের যতটা, কৌতূহল তার চেয়ে লেশমাত্র কম নয়। ব্যারাকে ঢুকলেও দরজা সামান্য ফাঁক করে অনেকে রুদ্ধশ্বসে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সশস্ত্র জারোয়ারা সেটলমেন্ট পর্যন্ত এসে পড়বে কি না তাই নিয়ে তাদের প্রচণ্ড শঙ্কা।
ওদিকে অদৃশ্য পেরিমিটার রোড থেকে বনভূমি, আকাশ, পাহাড় খান খান করে যেন ড্রামের আওয়াজ আরও আরও প্রবল হয়ে উঠছে। আন্দাজ করা যাচ্ছে জারোয়ারা নিশ্চয়ই গভীর অরণ্যে তাদের বাসস্থানে ফিরে যায়নি।
বিশ্বজিৎ থেকে চেইনম্যান ধনপত, ক’জন বুশ পুলিশ থেকে পরিতোষ, নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের সব কর্মী সেটলমেন্টের ফাঁকা এলাকাটার ওধারে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছে। পলকহীন। প্রায় দমবন্ধ করে নিঃশব্দে।
আচমকা চোখে পড়ল সাফ করা জায়গার ওধারের জঙ্গল থেকে আবছা ছায়ামূর্তির মতো একদল আধা উলঙ্গ কালো মানুষ বেরিয়ে এল। আফ্রিকার নিগ্রোয়েডদের মতো কালো কালো চেহারা, পাঁচ ফিটের মতো হাইট, হাতে তির-ধনুক এবং অন্য সব আদিম অস্ত্র।
অনেকগুলো মশাল জ্বলছিল ঠিকই কিন্তু তার আলো অতদূর অবধি পৌঁছায়নি। তবু কুয়াশা থেকে চুঁইয়ে আসা ঝাপসা আলোয় তাদের মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই জারোয়া।
এর আগে কখনও জারোয়া দেখেনি বিনয়। তাদের কথা শুনেছে মাত্র। সামনাসামনি তাদের আসতে দেখে বুকের ভেতর। ঠান্ডা শিহরন খেলে যায় তার।
জারোয়াদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দক্ষিণ আন্দামানের এই অঞ্চলে উড়ে আসা আগন্তুকদের তাড়াবার জন্য, তারা মাঝরাতে হানা দিয়েছে।
বিশ্বজিৎ সকলকে সতর্ক করে দিলেন, খুব সাবধান। জারোয়ারা যেন এখানে আসতে না পারে।
একজন বুশ পুলিশ বলল, জরুর জংলি লোগোকো রুখ দুঙ্গা
সেই শিখ পুলিশটি বলল, সাহাব, আপকো হুকুম হো যায় তো, ফায়ার করে দিই। দো-চার জংলি মর যায়গা, ব্যস কাম ফতে। ও হারামিরা আর কভি ইহা আনেকো ভরসা নেহি পায়েগা। ফায়ার করু?
বুশ পুলিশটি গুলি বন্দুক ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। এদিকে সরকার থেকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ভারতবর্ষের পাহাড়বাসী জনজাতি, আদিবাসী, কারও গায়ে একটি আঁচড় কাটা চলবে না। নিজস্ব পরিবেশে তাদের নিজের মতো করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কত ধরনের মানুষ রয়েছে এই সুবিপুল ভূখণ্ডে। তাদের যেভাবেই হোক সংরক্ষণ করতে হবে। এই সব ছোট বড় অসংখ্য জনগোষ্ঠী নিয়েই তো দেশ। অন্য সবার মতো তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এরা শেষ হয়ে গেলে বহুবর্ণময়। বহুভাষাভাষী ভারতবর্ষের জনজীবন তার সুবিশাল মহিমা হারিয়ে ফেলবে। যে যেভাবে আছে সে সেইভাবেই থাকুক, এই হল সরকারের ঘোষিত নীতি। পূর্ব পাকিস্তানের আগন্তুকদের জন্য বনবাসী জারোয়ারা উৎখাত হয়ে যাক–এটা কোনওভাবেই কাম্য নয়। সম্পূর্ণ বেআইনিও।
বিশ্বজিৎ আঁতকে উঠলেন, না না, ওদের গায়ে গুলি চালানো চলবে না।
শিখ জিগ্যেস করল, তাহলে জংলিদের রুখব কী করে?
একটু চিন্তা করে বিশ্বজিৎ বললেন, আকাশের দিকে বন্দুক তুলে তোমরা কয়েকবার ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার কর। মনে হয় ফাঁকা আওয়াজে কাজ হবে।
শুধু শিখটিই নয়, যে ক’জন বুশ পুলিশ নয়া সেটলমেন্ট অবধি চলে এসেছিল তারা সবাই মাথার ওপর বন্দুক উঁচিয়ে পর পর ফায়ার করতে লাগল।
লহমায় ম্যাজিকের মতো কাজ হল। জেফ্রি পয়েন্টের আকাশ এবং বনভূমির নিরেট স্তব্ধতাকে চৌচির করে মুহুর্মুহু যে শব্দ হতে জঙ্গলের আদিম বাসিন্দারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, খুব সম্ভব অরণ্যের গোপন অন্তঃপুরে থাকলেও বন্দুকের মহিমা তারা জানে।
কালো কালো ঝাপসা যে মূর্তিগুলো দেখা গিয়েছিল, লহমায় জঙ্গলের ভেতর তারা উধাও হয়ে যায়। এক ফোঁটা রক্তপাত হল না, কিন্তু কৌশলে কাজ হাসিল হয়ে গেল।
বুশ পুলিশের দলটা জানতে চাইল পেরিমিটার রোডের টঙে তারা ফিরে যাবে কি না।
বিশ্বজিৎ বললেন, আরও কিছুক্ষণ থাকো। জাবোয়ারা ভীষণ একরোখা। তেমনি হিংস্র। খুব সহজে এখানে সেলটমেন্ট বসাতে দেবে না। বার বার এসে তারা হামলা চালাতে চাইবে।
আরও ঘন্টাখানেক স্নায়ু টান টান করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বিশ্বজিৎরা। তারপর সবাইকে হুঁশিয়ার থাকতে বলে বুশ পুলিশের দলটাকে পেরিমিটার রোডে পাঠিয়ে বিভাস, নিরঞ্জন, পরিতোষ, ধনপত এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের জিগ্যেস করেন, তোমাদের এখানে ক্যানেস্তারা আছে?
পরিতোষ জেফ্রি পয়েন্টের কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট বা সি এ বিভাস নিরঞ্জনরা আট-দশ দিনের বেশি এখানে থাকবে না। তাদের পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে যেতে হবে। কিছুদিন পর ফের তারা উদ্বাস্তু আনতে কলকাতায় যাবে। মুখের কথা খসালেই তো মেনল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তু আনা যায় না। তার জন্য অনেক তোড়জোড় করতে হয়। জেফ্রি পয়েন্টের সব ঝক্কি সামলাতে হবে পরিতোষকে। অবশ্য তার সঙ্গে ধনপতের মতো জবরদস্ত একজন কর্মী ছাড়াও রিহ্যাবিলিটেশনের আরও অনেকেই রয়েছে। তবু জারোয়াদের জন্য দুশ্চিন্তাটা থেকেই যাচ্ছে বিশ্বজিতের।
পরিতোষ বলল, না স্যার
যত তাড়াতাড়ি পার, ইনডেন্ট করে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে কুড়ি-পঁচিশটা ক্যানেস্তারা আনিয়ে নিও। জারোয়ারা এদিকে আসুক বা না-আসুক, সন্ধের পর থেকে কয়েক বার ৮ ক্যানেস্তারাগুলো পিটিয়ে আওয়াজ করবে। ওদিকে বুশ পুলিশ আর তাদের ভ্রাম তো রয়েছেই। বেশি আওয়াজ হলে জারোয়ারা সহজে এদিকে ঘেঁষবে না।
পরিতোষ ঘাড় কাত করে জানায়, বিশ্বজিৎ যা বলেছেন অবিলম্বে তা করা হবে।
যাও, এবার গিয়ে শুয়ে পড়। আশা করি, আজ রাত্তিরে আর কোনও উৎপাত হবে না।
সবাই যে যার আস্তানায় চলে গেল। বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে লক্ষ করলেন, উদ্বাস্তুরা কেউ তাদের লম্বা লম্বা ব্যারাকে শুয়ে পড়েনি। বন্ধ দরজার তলা দিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। তার মানে ভেতরে লণ্ঠন জ্বলছে।
অনেকের চাপা গলার স্বর ব্যারাকগুলোতে শোনা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে জারোয়াদের এই অতর্কিত হামলাটা তাদের হতচকিত এবং সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। নির্ঘাত তাই নিয়ে তাদের কথাবার্তা চলছে। বাকি রাতটা নিশ্চয়ই ওরা ঘুমবে না। ভয়ে, উত্তেজনায় কাটিয়ে দেবে।
উদ্বাস্তুদের কথাবার্তা শোনার ভীষণ আগ্রহ ছিল বিনয়ের। কিন্তু সে সুযোগ পাওয়া গেল না। বিশ্বজিৎ তাকে দাঁড়াতে দিলেন না। সোজা নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, শুয়ে পড়ুন। ভোর। হতে দু-আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় নেই। ঘুমন। নইলে শরীর খারাপ হবে।
বিনয় শুয়ে পড়ল ঠিকই। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। একটা প্রবল দুর্ভাবনা তার মাথায় চেপে বসেছে যেন।
এই যে ছিন্নমূল মানুষের দলটা কাল এস এস মহারাজা’ জাহাজে আন্দামানে এখানে এসে পৌঁছেছে, সেটা পুরোপুরি স্বেচ্ছায় নয়। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল তাদের মনে। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো মিছিলে স্লোগানে অবিরল চিৎকার করে গেছে, উদ্বাস্তুরা যেন আন্দামানে না আসে, পশ্চিমবঙ্গেই পুনর্বাসনের দাবিতে অনড় থাকে।
সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের রিহ্যাবিলিটেশন দপ্তর এবং পশ্চিমবাংলার ত্রাণ বিভাগের অফিসাররা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের অনেকটা নরম করেছিলেন। জানিয়েছিলেন উদ্বাস্তুদের জন্য বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে সোনায় মোড়া ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। পূর্ব পাকিস্তানে তারা যা ফেলে এসেছে তার বিশগুণ পাওয়া যাবে এখানে এলে।
এই বোঝনোর কাজটা বিনয়ও কম করেনি। সেও উদ্বাস্তুদের প্রচুর ভরসা দিয়েছিল। তাই এদের, বিশেষ করে কাল যারা এসেছে তাদের সম্বন্ধে কিছু দায় তারও রয়েছে। অন্তত সেটাই সে মনে করে।
রস আইল্যান্ড থেকে লঞ্চে পোর্ট ব্লেয়ারে আসার সময় হলধর সূত্রধর, মাখন রুদ্রপালরা এভাবে তাকে জারোয়াদের কথা বলেছিল। বিনয় তাদের অনবরত সাহস জুগিয়ে গেছে। জারোয়ারা তাদের মতো জঙ্গলে থাকে। হয়তো নতুন লোক দেখলে ছুটকো-ছাটকা ঝঞ্ঝাটও বাধাতে চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লোকেরা আছে। যত হিংস্রই হোক, জঙ্গলের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এসে জারোয়ারা তাদের লেশমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না।
কিন্তু আসলে কী দাঁড়াল? আজ বিকেলে উদ্বাস্তুরা জেফ্রি পয়েন্টে সেটলমেন্ট বানাতে এসেছে, আর আজই মধ্যরাতে কিনা জারোয়ারা হানা দিয়ে বসল।
ত্রাণ শিবিরে বা শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে দিনের পর দিন কাটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উচ্ছেদ হয়ে আসা মানুষগুলোর জীবনশক্তি ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে এসেছে; মনোবল গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। আর প্রথম দিনই সশস্ত্র, তিরন্দাজ জারোয়াদের হামলায় তারা নিশ্চয়ই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। জেফ্রি পয়েন্টে এমন একটা অভ্যর্থনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ভয়ে, আতঙ্কে তারা একেবারে বিস্ত।
ধনপত এই মানুষগুলোকে ধমকে ধামকে ব্যারাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আজকের রাতটা কাটলে তারা কী করে বসবে, সেই চিন্তাটা কাটার মতো বিঁধে বিনয়ের মাথায় বিঁধে রইল।
অনেকক্ষণ বাদে হঠাৎ খেয়াল হল পাহাড়, জঙ্গল, উপত্যকা, সব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বুশ পুলিশের ভ্রামগুলো এখন আর বাজছে না। কোথাও কোনও শব্দ নেই। তার মানে জারোয়ারা দুর্গম বনভূমিতে তাদের বাসস্থানে ফিরে গেছে।
আর ঠিক এই সময় দু’চোখ জুড়ে আসতে লাগল বিনয়ের।
২.০৩ বহু মানুষের হইচই
বহু মানুষের হইচই আর উতরোল কান্নার আওয়াজে আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল বিনয়ের। প্রথমটা সে বুঝে উঠতে পারল না, কোথায় আছে। মাথাটা সামান্য তুলতেই চোখে পড়ল, সারা ঘর ঝকঝকে রোদে ভরে গেছে। শিয়রের দিকে জানালার বাইরে লাইন দিয়ে পাহাড়ের সারি, আর নিবিড় জঙ্গল। এখন জোরালো হাওয়া বইছে, কাছাকাছি কোথাও সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
চকিতে সমস্ত মনে পড়ে গেল বিনয়ের। ধড়মড় করে উঠে বসে সে। নিজের অজান্তেই তার নজর চলে যায় পাশের খাটটার দিকে। বিছানা খালি। বিশ্বজিৎ কখন উঠে বাইরে বেরিয়ে গেছেন, টের পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভব বিনয় ঘুমচ্ছে দেখে তাকে আর ডাকেননি।
ক্ষিপ্র হাতে মশারি সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল বিনয়। ঘরের বাইরে যেতেই দেখতে পেল কাল যে উদ্বাস্তুরা এখানে এসেছিল–বুড়ো-ধুড়ো, বাচ্চা কাচ্চা, যুবক-যুবতী, আধবয়সি নারী-পুরুষ–তাঁরা সবাই ব্যারাকগুলোর সামনের ফাঁকা জায়গাটায় উন্মাদের মতো কেঁদে চলেছে আর একসঙ্গে জড়ানো জড়ানো গলায় কী সব বলে চলেছে। এদেরই কান্না আর হইচইতে তার চোখ থেকে ঘুম ছুটে গিয়েছিল। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বজিৎ, নিরঞ্জন, বিভাস, ধনপত এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। তারা হাত নেড়ে নেড়ে অবিরল উদ্বাস্তুদের কী বুঝিয়ে চলেছেন।
ছিন্নমূল মানুষগুলোর তুমুল কান্নাকাটি আর প্রচণ্ড অস্থিরতার কারণটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিল বিনয়। পায়ে পায়ে সে জটলাটার কাছে চলে এল। চমকে উঠে লক্ষ্য করল উদ্বাস্তুরা যে যার মালপত্রটিনের বাক্স, বিছানা এবং টুকিটাকি নানা মালপত্র বাঁধাছাদা করে ব্যারাক থেকে বার করে এনে বাইরে জড়ো করেছে।
সবাই মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সমানে বলে চলেছে, আমরা এই জঙ্গলে থাকুম না।
কিছুতেই থাকুম না।
এহানে থাকলে জারোর হাতে হগলটির (সকলের) মরণ।
আমরা ঠিক কইরা ফালাইছি, কইলকাতায় ফিরা, যামু। আন্ধারমানে থাকুম না।
নানা বয়সের পুরুষেরা সমানে শোরগোল করছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁদছে বাচ্চাকাচ্চার দল আর মেয়েরা।
বিনয়ের ধারণা, কাল রাত্তিরে ধনপতের হাঁকডাকে উদ্বাস্তুরা ব্যারাকে ঢুকে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু চুপচাপ শুয়ে পড়েনি। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্দামানের এই মৃত্যুপুরীতে তারা আর এক লহমাও থাকবে না।
কাল রাতের মতো ধমক-ধামক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতে চাইছিল ধনপত কিন্তু বিশ্বজিৎ ধীর, স্থির, অভিজ্ঞ তো বটেই, অত্যন্ত বুদ্ধিমান অফিসার। তিনি জানেন যারা মরিয়া হয়ে উঠেছে, লটবহর গুছিয়ে নিয়ে যারা চলে যাবার জন্য প্রস্তুত, হুঙ্কার ছেড়ে তাদের দমিয়ে রাখা যাবে না। সব সময় একই স্ট্র্যাটেজিতে কাজ হয় না। নানা সমস্যা সামলাতে নানা কৌশল দরকার।
বিশ্বজিতের ধৈর্যের সীমা পরিসীমা নেই। তিনি ধনপতকে টু শব্দটি করতে না দিয়ে সমানে বুঝিয়ে চলেছেন। জারোয়ারা হঠাৎই কাল সেটলমেন্টে চলে এসেছিল। আর যাতে এদিকে না আসতে পারে তার জন্য আরও জোরদার বন্দোবস্ত করা হবে। বুশ পুলিশের সংখ্যা চার-পাঁচগুণ বাড়িয়ে দেবেন। তা ছাড়া পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা দিনের বেলায় তো বটেই, পালা করে রাত জেগে। জেগে দূরের জঙ্গলের দিকে নজর রাখবে। উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তায় লেশমাত্র ত্রুটি রাখা হবে না।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। বিশ্বজিতের এত ঢালাও প্রতিশ্রুতি উদ্বাস্তুদের এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি এবং কান্নার মাত্রাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে।
বিশ্বজিতের সহিষ্ণুতার শেষ নেই। তিনি জিগ্যেস করেন, আপনারা তো এখানে থাকতে চাইছেন না। কী করতে চান তাহলে?
ছিন্নমূল মানুষগুলোর ভেতর থেকে মাখন রুদ্রপাল সামনে এগিয়ে আসে। হাতজোড় করে বলে, আমরা কইলকাতায় ফিরা। যামু।
বিশ্বজিৎ বলেন, ফিরে তো যাবেন কিন্তু বলামাত্রই এখান থেকে ফেরা যায় না।
ক্যান যাইব না? কাল বিকেলে যে সব ট্রাক চেপে উদ্বাস্তুরা এখানে এসেছিল সেটলমেন্ট এলাকা থেকে একটু দূরে একটা টিলার মাথায় চেটালো মতো জায়গায় লাইন দিয়ে সেগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে মাখন রুদ্রপাল বলল, উই তো গাড়িগুলান খাড়ইয়া রইছে। উইগুলানে চাপাইয়া আমাগো পুট বিলাসে (পোর্ট ব্লেয়ারে) লইয়া যান। হেইহান থিকা কইলকাতার জাহাজে উঠাইয়া দিবেন।
বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে বললেন, সরকারি পুনর্বাসন দপ্তরের নথিতে উদ্বাস্তুদের নাম পাকাপাকিভাবে তুলে আন্দামানে পাঠানো হয়েছে। তাদের জন্য এখানে জমির ব্যবস্থাও করা হয়ে গেছে। নথি থেকে নাম খারিজ করিয়ে এদের কলকাতায় ফেরত পাঠানো সহজ নয়। প্রক্রিয়াটি কার্যকর হতে অনেক সময় লাগবে। কমপক্ষে পাঁচ-ছ’মাস। একবার নাম কাটানোর আর্জি জানালে সরকার মাখন রুদ্রপালদের কোনওরকম দায়িত্ব নেবে না। তারা খাবে কী? থাকবে কোথায়? সরকারি দপ্তরের ব্যবস্থায় উদ্বাস্তুরা এখানে আসতে পেরেছিল। তারাই তাদের আদরযত্ন করে আন্দামানে নিয়ে এসেছিল। ফিরে যেতে হলে নিজেদের পয়সায় জাহাজের টিকেট কাটতে হবে। তত পয়সা কি মাখনদের আছে?
আরও একটা সমস্যা, কলকাতা থেকে জাহাজ এলে সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে যায় না। একটানা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর এস এস মহারাজা’ তিন সপ্তাহ এখানে নোঙর ফেলে থাকে। তারপর। ফেরার প্রশ্ন। এই তিনটে সপ্তাহ উদ্বাস্তুদের চলবে কী করে?
মাখন ভীষণ দমে যায়। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।
তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল ঢ্যাঙা, ক্ষয়টে চেহারার আধ বুড়ো একটা লোক। তার নাম লক্ষ্মণ দাস। আদি বাড়ি ছিল পালং থানার তাহেরপুর গ্রামে। সে বলল, সার (স্যার) অন্য কারোরে বুজি (বুঝি) না, আপনেই আমাগো কাছে সরকার। গরমেনের (গভর্নমেন্টের) কাগজে আমাগো নামনুম যা আছে আপনেই কাইটা দ্যান।
বিশ্বজিৎ হয়তো একটু আমোদ বোধ করেন। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলেন, অত ক্ষমতা আমার নেই।
আচে, আচে, হেয়া আমরা জানি।
বিশ্বজিৎ যে ওদের কাছে ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। হাজারবার অস্বীকার করলেও এই ধারণাটা পালটাবে না। বৃথা চেষ্টা না করে তিনি বললেন, নাম না হয় কাটা গেল। তারপর?
লক্ষ্মণ দাস বলল, জাহাজের টিকিট কাটতে তো শুনছি মেলা (অনেক) ট্যাহা লাগে। অত ট্যাহা আমাগো নাই। তয়।
তবে কী?
অল্প-স্বল্প কিছু পহা (পয়সা) আছে। তিন হপ্তা হইল একইশ দিন। অতদিন পর পর কইলকাতার জাহাজ ছাড়ে। অত সোমায় (সময়) এহানে থাকন যাইব না। আপনে দয়া কইরা ফেরনের ব্যবোস্তা কইরা দ্যান।
বিশ্বজিৎ হতভম্বের মতো কয়েক লহমা তাকিয়ে থাকেন। তারপর জিগ্যেস করেন, আমি কী ব্যবস্থা করব?
আমাগো খান চাল্লিশেক নাও ঠিক কইরা দ্যান। যাগো নাও হেরা (তারা) দুইজন কইরা পিতিটি (প্রতিটি) নাওয়ে যাইব। কইলকাতায় পৌঁছাইলে হেরা তাগো নাও লইয়া আন্ধারমানে। ফিরা আইব।
লক্ষ্মণ দাস এক নিশ্বাসে বলে যেতে লাগল, নাও আমরাই বাইয়া লইয়া যামু। নাওয়ের মালিকগো কিছুই করণ লাগব না। হেরা খালি বইয়া থাকব।
বলে কী লোকটা? স্তম্ভিত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে খানিকটা সময় লাগল বিশ্বজিতের। তারপর তিনি বললেন, আপনারা নৌকোয় করে সমুদ্র পাড়ি দিতে চান!
লক্ষ্মণ দাস বলে, হ। আমরা পদ্মা-মাঘনার দ্যাশের মানুষ। দশ-বারো বচ্ছর বস (বয়স) থিকা আলিসান আলিসান গাঙ পাড়ি দিয়া এত বড় হইচি। পারুম না ক্যান?
এতক্ষণ বিশ্বজিতের পাশে দাঁড়িয়ে হতবাক শুনে যাচ্ছিল বিনয়। এবার মুখ খুলল সে, আপনাদের মাথাগুলোই খারাপ হয়ে গেছে। পদ্মা-মেঘনা আর সমুদ্র এক হল?
লক্ষ্মণের গা ঘেঁষে আরও অনেকেই রয়েছে। তাদের একজন হল রসময় শীল। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ষাটের ওপরে। সে বলে, সমুন্দুর আর কত বড় হইব? পদ্মা-মঘনা-ধলেশ্বরী থিকা দুই গুণ কি তিন গুণ হইব। হের বেশি না। আমরা ঠিকই পাড়ি দিয়া চইলা যাইতে পারুম। আপনেরা খালি নাও জুটাইয়া দ্যান।
নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। নিরঞ্জন বলে উঠল, পোলাপানের লাখান (মতো) কথা কইয়েন না দাস মশয়। যে উদ্বাস্তুরা জেফ্রি পয়েন্টে এসেছে তাদের সবাইকে সে তো চেনেই, তাদের নামও জানে। বলতে লাগল, পদ্মা-ম্যাঘনাকালাবদর-ধলেশ্বরী-আইডল খাঁ, এমুন হাজার হাজার নদী এক লগে করলেও সমুদ্রের এক কোনার সমানও হইব না। হেয়া (তা) ছাড়া আন্দামানে আহনের সোমায় ঝড়তুফানের মুখে পড়ছিলেন, মনে নাই? তিন মাইল চাইর মাইল জুইড়া একেকখান ঢেউ আকাশ তরি (পর্যন্ত) উইঠা যায়। অত বড় মহারাজা জাহাজখানরে মোচার খোলার লাখান (মতো) নাচাইয়া ছাড়ছিল। তাইলে (তাহলে) ছোট ছোট নাওয়ের (নৌকোর) কী হাল হইব ভাইবা দ্যাখছেন? ঝড়তুফান লাগব না, এমনেই সমুদ্রে যে ঢেউ থাকে, আন্দামান থিকা পাঁচশো হাত দূরেও যাইতে হইব, হেই ঢেউ নাওগুলারে আছাড় মাইরা ডুবাইয়া দিব। এই সমুদ্রে লাখে লাখে হাঙ্গর ঘুরতে আছে। সিধা এতগুলান মানুষ তাগো ফলার হইয়া যাইবেন।একটু থেমে কী খেয়াল হওয়ায় ফের বলে, আরে আসল কথাখানই তো মাথায় আছিল না। আন্দামানে নাও পাইবেন কই?
লক্ষ্মণ অবাক বিস্ময়ে জিগ্যেস করে, ক্যান, এই হানে নাও নাই?
না। সমুদ্রে নাও ভাসাইয়া ঘুরাফিরার কথা উন্মাদেও ভাবে না। এহানে হুদা (শুধু) লঞ্চ, স্টিমার, মোটর বোট কি জাহাজ। দাস মশয়, আপনেরা নাওয়ে কইরা কইলকাতায় ফিরনের চিন্তা ছাড়েন। পাগলেও এমুনডা ভাবে না।
লক্ষ্মণ দাস যখন নৌকোয় সমুদ্র পাড়ি দেবার কথা বলছিল সেই সময় বাচ্চাগুলো এবং মেয়েমানুষদের কান্নাকাটি থেমে গিয়েছিল। ক্ষয়া ক্ষয়া উদ্বাস্তু পুরুষগুলোও শোরগোল করছিল না। আশায় আশায় সবাই বিশ্বজিৎদের কাছে এসে জড়ো হয়েছিল। যখন জানা গেল নৌকো পাওয়া যাবে না, কলকাতায় ফিরে যাবার ভাবনাটা নেহাতই দুরাশা, তারা একেবারে মুষড়ে পড়ে।
মাখন রুদ্রপালের কণ্ঠমণিটা ঘন ঘন ওঠানামা করছিল। সে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করে, তাইলে কি এই জঙ্গলে জারোগা (জারোয়াদের) হাতেই আমাগো মরণ লিখা আছে? বলে বিনয়ের দিকে তাকায় সে। –’আপনে কী ক’ন ছুটোবাবু?
এতক্ষণ সামান্য দু-একটা কথা বলা ছাড়া প্রায় নীরবেই থেকেছে বিনয়। সরকারি আমলা এবং কর্মীরা যখন উদ্বাস্তুদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করছে সেখানে তার মতো একজনের মুখ খোলা ঠিক নয়। কিন্তু হলধর, মাখনের মতো উদ্বাস্তুরা, যাদের সঙ্গে সে কাল আন্দামানে এসেছে তার ওপর। ওদের অনেক আশা-ভরসা। মাখন রুদ্রপাল যখন তাকেই সরাসরি প্রশ্নটা করেছে তখন তার জবাব দেওয়াটা খুবই জরুরি।
বিনয় যা বলল,তা এইরকম। রাজাকার, মুসলিম লিগ আর। পশ্চিমা মুসলমানদের অবিরল উৎপাতে আতঙ্কগ্রস্ত মাখনরা চোদ্দো পুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হবার পর কলকাতায় চলে আসে। প্রথমে শিয়ালদা স্টেশনে, পরে ত্রাণ শিবিরের দমবন্ধ করা নরককুণ্ডে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। আশাহীন, ভবিষ্যৎহীন, অদ্ভুত এক জীবন। বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে লেশমাত্র তফাত ছিল না।
হঠাৎ আন্দামানে একটা সুযোগ এসে গেছে। এখানে পরিবার পিছু সাত একর করে জমি মিলবে। যতদিন না জমি থেকে ফসল উঠছে সরকার থেকে ক্যাশ ডোল পাওয়া যাবে। এখানে স্কুল বসবে, স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠবে। পূর্ব পাকিস্তানে যা যা হারিয়ে এসেছে মাখন হলধররা, এখানে তার পুরোটা না হলেও অনেকটাই পাওয়া যাবে। কলকাতায় পচে গলে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে মরে যাওয়ার চেয়ে সেটা কি কাম্য নয়? যে চরম ক্ষতি তাদের হয়ে গেছে তার অনেকটাই বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে পূরণ হয়ে যাবে।
তা ছাড়া, আরও একটা বিরাট সমস্যাও রয়েছে। ধরা যাক আন্দামানে পুনর্বাসনের তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে পরের জাহাজে কি তার পরের জাহাজে জেদ ধরে হলধররা চলে গেল। যদিও সেই আশা নেই বললেই হয়। কেননা জাহাজের টিকিট কাটার পয়সা তাদের নেই। তবু কোনও রকমে চলে গেল। কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকবে কোথায়? যে রিলিফ ক্যাম্পগুলো থেকে তারা চলে এসেছে সেসব কি এখনও ফাঁকা পড়ে আছে? পূর্ব পাকিস্তান থেকে তো বটেই, আসাম থেকেও তাড়া খেয়ে হাজারে হাজারে ছিন্নমূল মানুষ চলে আসছে কলকাতায়। হলধরদের রিলিফ ক্যাম্পগুলো এতদিনে বোঝাই হয়ে গেছে। জারোয়াদের হামলার ভয়ে তারা যদি চলে যায় তাদের এদিকও যাবে, ওদিকও যাবে। সরকারি কর্তারা মিথ্যে স্তোক দেননি; জারোয়ারা যাতে তাদের গায়ে আঁচড় কাটতে না পারে, তার ব্যবস্থা তো হয়েই যাচ্ছে। আতঙ্কের কোনও কারণ নেই।
উত্তেজনায় ত্রাসে কিছুক্ষণ আগেও উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদছিল উদ্বাস্তুরা, চিৎকার করছিল। এখন একেবারে চুপ হয়ে গেছে। প্রথমে বিশ্বজিৎ, তারপর নিরঞ্জন, তারও পর বিনয় একে একে সবাই যেভাবে সমস্ত পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিয়েছে তাতে নতুন করে তারা ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছে। সত্যিই তো, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যখন তারা এসেই পড়েছে এখন আর এখান থেকে বেরুবার উপায় নেই। নৌকোয় কালাপানি পাড়ি দেবার চিন্তা নেহাতই পাগলামি। তা ছাড়া নৌকোই মিলবে না। সরকার টিকিট না কাটলে জাহাজেই উঠতে দেবে না। পয়সাই নেই যে টিকিট কাটতে পারবে। ডাঙা নয় যে লটবহর মাথায় চাপিয়ে বউ-ছেলেমেয়ের হাত ধরে হেঁটে হেঁটে কলকাতায় ফিরে যাবে।
মাখন রুদ্রপাল বলল, আপনেগো হগল কথা হোনলাম (শুনলাম)। যা যা কইলেন হেগুলান (সেগুলো) উড়াইয়া দেওন যায় না। জবর সোমস্যাই। তভু
দ্বিধা এবং ত্রাস যে এখনও পুরোপুরি মাখনরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। তবে আগের সেই জেদ আর নেই, অনেকটাই নরম হয়েছে তারা। এখান থেকে ফিরে যাবার যে প্রচুর সমস্যা, ফিরে গেলে যে সমস্যা শতগুণ বেড়ে যাবে সেসব তাদের মাথায় ঢুকতে শুরু করেছে।
বিনয় উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন, তবু কী?
মাখন বলল, আমরা নিজেগো মইদ্যে ইট্ট পরামশ্য কইরা লই সায়েব। হগলে কী কয় শুইনা আপনেগো কাছে আমাগো মত জানাইয়া দিতে আছি।
তাই জানান–’
মাখন হলধর এবং আরও কয়েকজন বয়স্ক উদ্বাস্তুকে সঙ্গে করে খানিক দূরে ডালপালাওলা বিশাল একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে গিয়ে বসল। প্রায় ঘণ্টাখানেক নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলল। তারপর ফিরে এল।
বিশ্বজিৎরা সবাই ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন। তারা যেন ঠিকই করে ফেলেছেন যে সংকট দেখা দিয়েছে সেটার সুরাহা না হওয়া অবধি এক পাও নড়বেন না।
মাখন বলল, আমরা ভাইবা দ্যাখলাম, কালাপানি ছাইড়া যখন যাইতেই পারুম না তহন আর কী করণ? এহানেই থাইকা যামু। আমাগো বলভরসা আপনেরাই। যেয়াতে (যাতে) বাইচা থাকতে পারি হেইটা দেইখেন সারেরা।
গভীর সহানুভূতির সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, আমরা সব সময় আপনাদের পাশে আছি। থাকবও।
সেই সকাল থেকে যে তুমুল বিপত্তি শুরু হয়েছিল, আপাতত তার অবসান। একটানা কয়েক ঘণ্টা টান টান উত্তেজনার পর অনেকটাই স্বস্তি। বিশ্বজিৎরা বেশ আরামই বোধ করলেন।
সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছিল। এই দ্বীপপুঞ্জে রোদ, বাতাস সবই অপর্যাপ্ত। এবং প্রবলও। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। নোনা জলের উত্তাল ঢেউয়ের মাথা থেকে তেজি রোদ ছুরির ফলার মতো ঠিকরে ঠিকরে উঠে আসছে। তাকালে চোখ ঝলসে যায়।
কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ পায়ে পায়ে বিশ্বজিতের কাছে এসে দাঁড়ায়। নিচু গলায় বলে, স্যার, একহান কথা জিগাই
জারোয়াদের নিয়ে যে ঝাটটা তৈরি হয়েছিল সেটা থেকে মুক্ত হয়ে বেশ হালকা লাগছিল বিশ্বজিতের। লঘু সুরে বললেন, জিগাও
সকালের খাওনেরটা (খাবারটা) ভোরেই বানান (তৈরি) অইয়া গেছিল। জারোয়াগো তাফালে কারোরই খাওয়া হয় নাই। অহন কী করা?
উদ্বাস্তুরা, পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মী এবং অফিসাররা, কারও পেটে যে এত বেলা অবধি এক ফোঁটা জলও পড়েনি, সেটা খেয়াল ছিল না বিশ্বজিতের। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই তো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, পৌনে একটা বাজে। এখন আর সকালের খাবার দিয়ে কী হবে? দুপুরের জন্য রান্নাবান্নার কিছু ব্যবস্থা হয়েছে? না কি তোমরা এখানেই সেই সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছ?
না স্যার, আমি রান্ধনের লোকজনরে পাঠাইয়া দিচ্ছি। মাঝে মইদ্যে গিয়া দেইখাও আইছি। আর আধা ঘণ্টার ভিতরে পাক (রান্না) শ্যাষ হইয়া যাইব।
পরিতোষকে খুব একটা কাজের মানুষ বলে মনে করতেন না বিশ্বজিৎ। তার কর্মকুশলতা সম্পর্কে তার ধারণা তেমন উঁচু ছিল না। সেটা এখন অনেকটাই বদলে গেল। নাঃ, এত ঝামেলা-ঝক্ষাটের মধ্যেও সে আসল কাজটা ভোলেনি। বিশ্বজিৎ খুশি হলেন। বললেন, ঠিক আছে। তারপর বিভাস নিরঞ্জনদের দিকে তাকালেন।–তোমরা রিফিউজিদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সমুদ্র থেকে স্নান করিয়ে আনন। দেখো, কেউ যেন বেশি দূরে। চলে না যায়, বিচের কাছাকাছিই স্নানটা সারে। আসলে পাড়ের কাছে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে জল খুব বেশি হলে কোমরসমান। তারপর থেকে সমুদ্র গম্ভীর হতে শুরু করেছে। সেখানে হাঙরের দঙ্গল হন্যে হয়ে ঘুরছে। রিফিউজিদের নাগালে পেলে ছিঁড়ে খাবে। তাই বিশ্বজিতের এই হুঁশিয়ারি।
নিরঞ্জন বলল, আমার খেয়াল আছে। কাইলও রিফিউজিগো দূরে যাইতে দেই নাই। কিনারের কাছে লামাইয়া (নামিয়ে) ছান (স্নান) করাইয়া আনছি। বলে বিভাস এবং অন্য কয়েকজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে উদ্বাস্তুরা যেখানে জটলা করছিল সেখানে গিয়ে তাড়া লাগায়। –গামছা গুমছা লইয়া হগলটি (সকলে) সমুন্দুরে চলেন। পাক (রান্না) হইয়া গ্যাছে।
এদিকে বিশ্বজিৎ বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে। নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, হইচই শুনে সেই ভোরবেলা রিফিউজিদের কাছে চলে এসেছিলাম। মুখটুখ ধোওয়া হয়নি। এতক্ষণ প্রচণ্ড এক্সাইটমেন্টের মধ্যে ছিলাম। খিদেতেষ্টা কিছুই টের পাইনি। এখন মনে হচ্ছে পেটে হুতাশন জ্বলছে। চলুন, ব্রাশ-ট্রাশ করে স্নান সেরে খেয়ে নিই।
বিনয়ও টের পাচ্ছিল, খিদেটা তার পেটের ভেতর অনবরত ছুঁচ ফুটিয়ে চলেছে। সে হাসল। পরক্ষণে কী মনে পড়তে ব্যগ্রভাবে বলে ওঠে, আসল কাজটাই কিন্তু আজ করা হল না।
আগ্রহের সুরে বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন, কী বলুন তো?
আজ থেকে রিফিউজিদের জমি মেপে বিলি করার কথা ছিল না?
ছিল তো। কিন্তু কাল রাত্তির থেকে যে হুজ্জত গেছে তাতে আজ জমি বিলির প্রক্রিয়াটা শুরু করা একেবারেই সম্ভব ছিল না। { ইন ফ্যাক্ট ব্যাপারটা আমাদের মাথাতেই আসেনি। আজকের বাকি দিনটা আর রাত্তিরটা যদি ভালোয় ভালোয় কাটে, কাল থেকে জমি দেওয়া হবে।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিশ্বজিৎ বললেন, ভেবেছিলাম, আজ পিসফুলি যদি জমি ডিস্ট্রিবিউশনটা আরম্ভ করা যেত, কাল সকালে পোর্ট ব্লেয়ারে? ফিরতে পারতাম। কিন্তু সেটা আর হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও দু-একদিন এখানে থেকে যেতে হবে। ওদিকে পোর্ট ব্লেয়ারে অনেক কেস পেন্ডিং রয়েছে। আমি না গেলে সেগুলোর হিয়ারিং বা জাজমেন্ট সব বন্ধ থাকবে। কিন্তু কী আর করা। এখানকার ব্যাপারটা ভীষণ আর্জেন্ট। এটাকে টপ প্রায়োরিটি দিতে হবে।
বিশ্বজিৎ রাহা যে শুধু আন্দামানের রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের সর্বেসর্বাই নন, এখানকার একজন ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটও সেটা বিনয় ভালো করেই জানে। বিশ্বজিৎ এই জেফ্রি পয়েন্টের সেটলমেন্টে আরও কটা দিন থাকবেন, তার সঙ্গ; পাওয়া যাবে, এতে খুশিই হল বিনয়। সে উত্তর দিল না।
বিশ্বজিৎ একটু ভেবে এবার বললেন, আমার একটা অনুরোধ আছে।
মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল বিনয়।–বলুন
জারোয়ারা যে কাল রিফিউজিদের ওপর হামলা করতে এসেছিল, কাইন্ডলি আপনার রিপোর্টে এটা লিখবেন না। বুঝতেই পারছেন যে রিফিউজিরা মেন ল্যান্ডে রয়েছে, এই আইল্যান্ডে তারা আসতে চায় না। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো তাদের সমানে উসকে চলেছে। জারোয়াদের খবরটা বেরলে একটা রিফিউজিকেও আন্দামানের জাহাজে তোলা যাবে না। পার্টিগুলো এই নিয়ে সারা ওয়েস্ট বেঙ্গল, বিশেষ করে কলকাতা তোলপাড় করে ফেলবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বিনয়। তারপর দ্বিধার সুরে বলে,
তার দ্বিধা বা অস্বস্তির কারণটা আন্দাজ করতে পারছিলেন বিশ্বজিৎ। বললেন, একজন অনেস্ট সাংবাদিক হিসেবে যা ঘটেছে। সেটা পাঠককে আপনার জানানো দরকার। কিন্তু
বিনয় উদগ্রীব তাকিয়ে থাকে। কোনও প্রশ্ন করে না।
বিশ্বজিৎ বললেন, আন্দামানের সঙ্গে বাঙালি উদ্বাস্তুদের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। কাইন্ডলি এমন কিছু লিখবেন না যাতে এই আইল্যান্ডগুলো তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এখানকার জমি খুবই ফার্টাইল। প্রত্যেকটা ফ্যামিলি সাত একর করে জমি পাবে। সেটা কি সহজ ব্যাপার?
বিনয় এবারও কিছু বলে না। নীরবে শুনতে থাকে।
বিশ্বজিৎ থামেননি। –ওয়েস্ট বেঙ্গলে সরকারি রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে যারা রয়েছে তাদের প্রতি মাসে কিছু কিছু ক্যাশলে দেওয়া হয়। ক্যাশড়োল তো এক রকম ভিক্ষেই। ভিক্ষের ওপর এত মানুষ সারা জীবন বেঁচে থাকতে পারে? সেটা কি অ্যাট অল সম্মানজনক? তা ছাড়া সারা জীবন তো ডোল পাওয়া যাবে না। একদিন না একদিন গভর্নমেন্ট তা বন্ধ করে দেবে! রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে চিরকাল থাকতেও দেবেনা। তখন কী হবে এদের? কী ভবিষ্যৎ অদের ছেলেমেয়েদের? তাই বলছিলাম আন্দামানে রিফিউজিদের আসা যাতে বন্ধ না হয় সেটা দেখা দরকার। মানে-
বিনয় জিগ্যেস করল, মানে?
একটা সম্পূর্ণ নতুন, অচেনা জায়গায় সেটেলমেন্ট গড়ে তোলার কাজ চলছে। ছোটখাট কিছু প্রবলেম তো দেখা দেবেই। বড় স্বার্থের জন্যে সেসব নিয়ে বেশি হইচই না করাই ভালো। ইগনোর করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।
বিনয় জানে, বিশ্বজিৎ মনেপ্রাণে চান আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ বাঙালিদের দ্বিতীয় স্বদেশ হয়ে উঠুক। সীমান্তের ওপারে অবারিত নীলাকাশ, শত জলধারায় বহমান অজস্র নদী, সোনালি শস্যে ভরা আদিগন্ত ধানের খেত, ফুল পাখি বৃক্ষলতা ইত্যাদি মিলিয়ে স্বপ্নের মতো যে মায়াবী ভূখণ্ডটি ফেলে তাদের চলে আসতে হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে ঠিক তেমনটিই তারা নিজেদের হাতে সৃষ্টি করুক। এখানকার সেটলমেন্টগুলোর সঙ্গে গভীর আবেগে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন।
বিশ্বজিৎকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে বিনয়, ততই তার শ্রদ্ধা বেড়ে চলেছে। ইচ্ছা করলে তিনি হিল্লি-দিল্লি কলকাতা বা মুম্বইতে পোস্টিং নিতে পারতেন। বিশাল বিশাল মেট্রোপলিসের অঢেল আরাম বা স্বাচ্ছন্দ্যের কথা তিনি ভাবেননি। সর্বস্ব খুইয়ে আসা ছিন্নমূল মানুষগুলোর জন্য এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপপুঞ্জে পড়ে আছেন।
বিনয় গাভীর গলায় বলল, জারোয়ারা মাঝরাতে হানা দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কারও তো কোনও ক্ষতি হয়নি। সবাই বেঁচে আছে। আমার রিপোর্টে এই ঘটনাটা সম্বন্ধে একটা লাইনও লিখব না।
বিশ্বজিতের মুখটা আলো হয়ে উঠল। তিনি সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তামুক্ত। আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় কোনও রকম বাধা হলে সেটা যেন তার নিজস্ব পরাজয়।
এক সময় দুজনে তাদের ঘরে চলে এল।
২.০৪ উদ্বাস্তুদের মধ্যে তুমুল আতঙ্ক
পরশু মাঝ রাতে উত্তর দিকের গভীর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নয়া সেটলমেন্টে হানা দিতে এসেছিল। ফলে উদ্বাস্তুদের মধ্যে তুমুল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ধাক্কা সামলাতে কাল দুপুর পেরিয়ে গেছে। উদ্বাস্তুদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করতে বিশ্বজিৎ বিভাস নিরঞ্জন ধনপত সিং থেকে শুরু করে পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের দম বেরিয়ে গিয়েছিল।
কাল রাতটা অবশ্য নির্বিঘ্নেই কেটে গেছে। বুশ পুলিশ আর সেটলমেন্টের কর্মীরা খুবই সতর্ক ছিল। পালা করে তারা রাত জেগেছে। জারোয়ারা আর এদিকে আসেনি।
আজ সকাল হতে না হতেই বিভাস নিরঞ্জনরা হাঁকডাক করে উদ্বাস্তুদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল। পশ্চিম দিকের পাহাড়ের ঢাল যেখানে ঝোঁপঝাড় আর অজস্র বুনো গাছ আর লতায় ঠাসা, তাড়া দিয়ে দিয়ে তাদের সেখানে পাঠিয়েছে। আবরু বাঁচানোর জন্য চারদিক ঘিরে এখানে পায়খানা-টায়খানা তৈরি করে রাখা হয়নি। বুড়ো-ধুড়ো, বাচ্চা-কাচ্চা, জোয়ান ছেলেমেয়ে প্রতিদিনের প্রাকৃত কর্মটি সারার জন্য ঝোঁপজঙ্গলের আড়ালে না গিয়ে উপায় নেই কারও। খোলা আকাশের নিচে এই মুক্ত, আদিম শৌচাগারই একমাত্র ভরসা।
জঙ্গল থেকে সমুদ্রে গিয়ে মুখটুখ ধুয়ে উদ্বাস্তুরা ফিরে আসতেই বিভাসরা হেঁকে হেঁকে বলতে লাগল, হগলে (সবাই) একহান কইরা থাল গিলাস (থালা গেলাস) লইয়া আহেন।
আগের দিনই উদ্বাস্তুদের কিছু কিছু বাসনকোসন দেওয়া হয়েছিল। একটু পর দেখা গেল, কথামতো থালা এবং গেলাস নিয়ে বিভাসদের সামনে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
চারদিকের হাঁকাহাঁকিতে বিশ্বজিৎ এবং বিনয়েরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারাও তাড়াহুড়ো করে সমুদ্র থেকে মুখটুখ ধুয়ে বিভাসদের কাছে চলে এলেন।
সকালে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা। চিঁড়ে, আখের গুড় এবং এক গেলাস করে দুধ। আমেরিকার কটা চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশন এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এভাঙ্গেলিস্টরা পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য ঢাউস ঢাউস সুদৃশ্য টিনের পাত্র বোঝাই করে পাউডার মিল্ক, চকলেট, চিজ, মাখন ইত্যাদি নিয়মিত কলকাতায় পাঠাচ্ছে। সর্বস্ব হারিয়ে আসা রুক্ষ, আধমরা, ছিন্নমূল মানুষগুলো যাতে অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে শেষ না হয়ে যায় সে জন্য সাগরপারের দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অনন্ত দুর্ভাবনা।
যেসব পুষ্টিকর খাদ্যবস্তু জাহাজ বা প্লেনে কলকাতায় পৌঁছয়। তার সামান্য কণিকা আন্দামানের দুর্গম অরণ্যে যেসব সেটলমেন্ট বসছে সেখানেও পাঠানো হয়। তবে শুধুই পাউডার মিল্ক। অন্য সমস্ত বাদ।
গুঁড়ো দুধ গুলে প্রকাণ্ড একটা ড্রাম বোঝাই করে রেখেছিল সেটলমেন্টের কর্মীরা।
প্রতিটি উদ্বাস্তুর থালায় চিড়ে, গুঁড় ও গেলাসে দুধ বিলি করা শুরু হয়।
বিশ্বজিৎ আগেই কড়া হুকুমনামা জারি করে রেখেছিলেন, তাঁদের জন্য আলাদা দামি দামি খাবারের ব্যবস্থা যেন না করা হয়। উদ্বাস্তুরা যা খাবে যে দরের মহামান্য অফিসারই হোন, তাকেও তাই খেতে হবে।
বিশ্বজিৎ আর বিনয় খালি হাতে চলে এসেছিল। তাদের ঘরে আগে থেকেই থালা গেলাস রাখা ছিল। পরিতোষ দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এল। চিঁড়ে-গুড়টুড় নিয়ে উদ্বাস্তুদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করলেন বিশ্বজিৎরা।
খাওয়াদাওয়া চুকতে ঢুকতে মিনিট চল্লিশেক লেগে গেল। এর। মধ্যে বেশ খানিকটা বেলা হয়েছে। সূর্য পুব দিকের পাহাড়ের চুড়োর ওপর উঠে এসেছে। তেজি রোদে ভেসে যাচ্ছে বনজঙ্গল উপত্যকা। এই সকাল বেলাতেই সমুদ্রের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। রোদে নোনা জল থেকে এখনই আঁঝ উঠে আসছে। বেলা যত বাড়বে এই ঝঝ ততো বাড়বে। চোক আরও ধাঁধিয়ে যাবে।সসস।
বিশ্বজিৎ পরিতোষ বিভাসদের ডেকে বললেন, আর দেরি কোরো না; জমি মেপে ভাগ বাটোয়ারার বন্দোবস্ত কর।
বিভাস বলল, হ। অহনই কামটা শুরু করুম।
একদিনে কটা ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া সম্ভব?
লা-ডিনরে জিগাইয়া কইতে আছি।
লা-ডিন এই সেটলমেন্টের আমিন। উনিশশো তিরিশে বর্মার মৌলমিন থেকে খুনের দায়ে কালাপানির সাজা নিয়ে আন্দামানে এসেছিল। ভারত স্বাধীন হল,ব্রহ্মদেশ ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হয়ে নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা পেল। কিন্তু লা-ডিন আর মৌলমিনে ফিরে যায়নি। আন্দামানেই থেকে গেছে।
এখানে আসার পর প্রথম বছরটা সেলুলার জেলেই কাটাতে হয়েছে লা-ডিনকে। তারপর তাকে জেলের বাইরে পি ডব্লু ডিতে কাজ দেওয়া হয়। জমি জরিপের খুঁটিনাটি শিখে সে তুঘোড় আমিন হয়ে ওঠে। সেই কাজটাই করে যাচ্ছিল। যখন আন্দামানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হল সেই সময় তাকে পি ডরু ডি থেকে রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে বদলি করা হয়।
বিভাস লা-ডিনের কাছে চলে গেল। তার সঙ্গে আলোলাচনা সেরে ফিরে এসে বিশ্বজিৎকে বলল, পনরোটা ফ্যামিলিরে জমিন মাইপা দ্যাওন (দেওয়া) যাইতে পারে। এইটাই ম্যাক্সিমাম।
বিশ্বজিৎ মনে মনে অঙ্ক কষে বললেন, তার মানে আড়াইশো ফ্যামিলিকে ল্যান্ড ডিষ্ট্রিবিউট করতে সতেরো-আঠারো দিন লেগে যাবে।
হেয়া (তা) তো লাগবই। জঙ্গলের মধ্যে জমি মাইপা (মেপে) সীমানা ঠিক করন তো সোজা কথা না। সোময় তো লাগেই।
কিন্তু
উৎসুক চোখে বিশ্বজিতের দিকে তাকাল বিভাস। কোনও প্রশ্ন করল না।
বিশ্বজিৎ বললেন, আমার পক্ষে এতদিন এই সেটলমেন্টে পড়ে থাকা সম্ভব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে যেতে হবে।
বিনয় পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সে আগেই শুনেছে, পোর্ট ব্লেয়ারে বিশ্বজিতের কোর্টে অনেক কেস জমে আছে। সেই সব মামলার শুনানি হবে, কম করে ছ-সাতটা রায় দিতে হবে।
বিভাস বলল, অতদিন থাকতে হইব না। আপনের সামনে কামটা খালি আরম্ভ হউক। পরে আমরা অন্য ফেমিলিগুলানরে জমিন বিলি কইরা দিতে পারুম।
জমি ডিস্ট্রিবিউশন শেষ হলেই তুমি আর নিরঞ্জন পোর্ট ব্লেয়ার চলে আসবে। সেখানে রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের অনেক কাজ পড়ে আছে। নতুন নতুন আরও সেটলমেন্ট বসবে। কোথায় কোথায় বসবে, ঘুরে ঘুরে সেইসব জায়গা সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করতে হবে।
হে (সেই) খেয়াল আমার আছে। আপনে চিন্তা কইরেন না।
যাও, এবার কাজে লেগে পড়।
এর মধ্যে পরিতোষ সেটলমেন্টের এক ধারে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া যে অফিসঘর রয়েছে সেখান থেকে মোটা বাঁধানো লম্বা একটা খাতা নিয়ে এসেছে। সেটায় উদ্বাস্তু ফ্যামিলিগুলো কাল এখানে এসেছে তাদের নাম, প্রতিটি পরিবারের আলাদা আলাদা বিবরণ লেখা আছে।
ওদিকে ধনপত এবং পুনর্বাসনের কয়েকজন কর্মী মালপত্র রাখার গুদাম থেকে কোদাল, শাবল, করাত এবং লম্বা লম্বা বর্মি দা এবং গোলাকার মস্ত দুটো জার এনে একধারে জড়ো করে রেখেছে। জার বা বয়ম দুটো গাঢ় ধরনের তরল জিনিসে বোঝাই।
উদ্বাস্তুরা সামনের ফাঁকা জায়গাটায় কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বা বসে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। বিভাস পরিতোষের হাত থেকে খাতাটা নিয়ে গলার স্বর উঁচুতে তুলে উদ্বাস্তুদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, হগলে মন দিয়া আমার কথা শুনেন।
চিড়েটিড়ে খাওয়ার পর ছিন্নমূল মানুষগুলোর কেমন একটা এলানো ভাব এসে গিয়েছিল। এবার তারা চনমনে হয়ে ওঠে। যারা বসে ছিল তারা শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
বিভাস থামেনি। বলেই চলেছে, কাইল জারোয়াগো লেইগা মেলা (অনেক) তাফাল গ্যাছে। তাই আপনেগো জমিন দেওন যায়। নাই। আইজ থিকা বিলি করন শুরু হইব। একদিনে এতগুলান ফেমিলিরে দেওন সোম্ভব না। রোজ পনরোটা ফেমিলিরে জমিন বিলি করন হইব। যারা আইজ জমিন পাইবেন হেয়াগো (তাদের) নাম পড়তে আছি। হাতের খাতাটা খুলে সে পড়তে লাগল, জলধর বারুই, মনা ব্যাপারী, সহদেব রুদ্রপাল…
পনেরো জনের নাম পড়া হলে বিভাস বলল, প্রতিটি ফেমিলিরে শাবল, কুড়াল, দাও (দা) দেওন হইব। আপনেরা আউগাইয়া (এগিয়ে) আইয়া লইতে থাকেন।
পনেরোটি পরিবারকে শাবল-টাবল দেওয়া হলে বিভাস ধনপতকে বলল, এইবার এয়াগো (এদের) হাতে লোশান দাও উদ্বাস্তুদের বলল, যারা আমাগো লগে জঙ্গলে জমিন লইতে যাইবেন হেরা (তারা) গায়ে লোশান মাইখা লন (নিন)। মাথাতেও মাখবেন।
লোশান অর্থাৎ লোশন। সেটা যে কী বস্তু আন্দাজ করতে পারছিল না উদ্বাস্তুরা। জঙ্গলে জমি বুঝে নিতে হলে সেটা গায়ে মাথায় কেনই বা মাখতে হবে কেউ ভেবে পাচ্ছিল না। তারা রীতিমতো অবাকই হয়ে যাচ্ছিল।
উদ্বাস্তুদের মনোভাব কিছুটা আঁচ করে বিভাস বলল, ক্যান লোশান মাখতে লাগব, জঙ্গলে গ্যালেই ট্যার পাইবেন। ধনপত তুমি এয়াগো (এদের) হাতে লোশান দাও—
ধনপত হতবুদ্ধি মানুষগুলোকে তাড়া দিয়ে দিয়ে তার কাছে ডেকে নিল। তারপর সেই মোটা জার থেকে পরপর তাদের দাঁড় করিয়ে হাতে গাঢ় তরল চটচটে জিনিস ঢেলে দিতে লাগল। নির্দেশমতো গায়ে মাথায় সেসব মেখে নিল উদ্বাস্তুরা।
বিনয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। সেও কম অবাক হয়নি। নিচুগলায় বিশ্বজিৎকে জিগ্যেস করল, রিফিউজিদের ওই লিকুয়িডটা মাখতে বলা হল কেন?
বিশ্বজিৎ মৃদু হাসলেন। প্রশ্নের উত্তরটা না দিয়ে বললেন, আন্দামানে কীভাবে উদ্বাস্তুদের ল্যান্ড ডিস্ট্রিবিউট করা হয়, নিশ্চয়ই আপনাদের কাগজে তা লিখবেন।
হ্যাঁ, তা তো লিখতেই হবে।
তা হলে আমাদের সঙ্গে আপনাকেও জঙ্গলে যেতে হবে। আর তখন বুঝতে পারবেন লিকুয়িডটা কেন মাখা জরুরি।
আপনিও জঙ্গলে যাবেন নাকি?
অবশ্যই। বিশ্বজিৎ জানালেন, আন্দামানের যেখানে যেখানে রিফিউজি সেটলমেন্ট বসেছে সেসব জায়গায় তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জমি বিলিবণ্টনের শুরুটা করে দিয়েছেন। এখানেও করবেন।
বিশ্বজিৎ, বিভাস, নিরঞ্জন, লা-ডিন এবং পুনর্বাসনের কর্মীরা লোশন মেখে নিল। দেখাদেখি বিনয়ও মাখল।
যে ফ্যামিলিগুলোকে আজ জমি দেওয়া হবে তাদের হেড অফ দি ফ্যামিলি অর্থাৎ কর্তারা বিভাসের কথায় শাবল এবং বর্মি দা হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছে। পুনর্বাসনের কর্মীরা দা-শাবল তো নিয়েছেই, সেইসঙ্গে নিয়েছে লম্বা লম্বা লোহার চেন।
ব্যারাকগুলোর সামনের ফাঁকা জায়গাটায় তিন দিকে–পুবে, পশ্চিমে এবং উত্তরে ঘোর জঙ্গল। এবার সবাই উত্তর দিকে চলল। যাদের জমি দেওয়া হবে তারা তো যাচ্ছেই, বাকি উদ্বাস্তুদের অনেকেই তাদের পিছুপিছু চলেছে। জমি কীভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হবে ওরা স্বচক্ষে তা দেখতে চায়। কৌতূহল, অপার কৌতূহল।
কালই বিনয়ের চোখে পড়েছিল ব্যারাকের পেছন দিকে বিশাল বিশাল গাছ কেটে সেগুলোর গুঁড়ি এবং মোটা মোটা ডাল মস্ত এলাকা জুড়ে ভঁই করে করে ফেলে রান্না হয়েছে। কাল নজরে পড়েনি, পাহাড়-প্রমাণ গুঁড়িগুলোর পেছন দিকে আট-দশ ফুটের মতো মাপ করে বাঁশ কেটে সেই টুকরোগুলোও টাল দিয়ে সাজানো রয়েছে।
বনবিভাগের কিছু কর্মী বিনয়দের সঙ্গে চলেছে। কিন্তু আরও কুড়ি-পঁচিশজন দশ-পনেরোটা করে বাঁশের খুঁটি দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাথায় চাপিয়ে একটু ঘুরপথে উত্তরের জঙ্গলে যাচ্ছে। এদের কারও কারও হাতে রয়েছে নানা মাপের এবং ওজনের করাত। যে করাতগুলো প্রকাণ্ড এবং বেজায় ভারী সেগুলো দুজনে দুমাথায় ধরে নিয়ে চলেছে। মাঝারিগুলো তুলনায় অনেক হালকা। এগুলোর জন্য দুজন দরকার নেই। একজনই হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে পারছে।
বাঁশের খুঁটি বা করাত কোন কাজে লাগবে, আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করল না বিনয়। জঙ্গলে ঢুকলেই তা জানা যাবে।
ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢোকার মুখে এসে ঘুরে দাঁড়াল বিভাস। যে উদ্বাস্তুদের আজ জমি দেওয়া হবে না তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনেরা গায়ে লোশান মাইখা আহেন নাই। এহানেই খাড়হয়া খাড়ইয়া আমাগো কাম কাইজ (কাজকর্ম) দ্যাখেন।
লোকগুলো দাঁড়িয়ে পড়ল। বিনয়রা জঙ্গলে ঢুকে বড় বড় সব গাছ যেগুলোর বেড় তিনশো চারশো ফিটের মতো সেগুলো কাটা হলেও, শিকড়বাকড় এখনও তুলে ফেলা হয়নি। কিন্তু বিরাট মহাবৃক্ষ আর কটা? চারিদিকে অগুনতি মাঝারি এবং ছোট ছোট গাছ, ঝোঁপঝাড়, বনতুলসীর উদ্দাম জঙ্গল। যে গাছগুলো অক্ষত দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে মোটা মোটা বেতের লতা।
বড় গাছগুলো কেটে ফেলায় কোথাও কোথাও জঙ্গল ততটা ঘন নয়, তাই আকাশ চোখে পড়ছে। কিন্তু যেখানে হাজার বছরের অরণ্য ডালপালা মেলে চাপ বেঁধে রয়েছে সেইসব এলাকায় আন্দামানের তেজি সূর্যালোকও ঢুকতে পারছে না। সমস্ত কিছু ছায়াচ্ছন্ন, অন্ধকার অন্ধকার। সেখানকার মাটি স্যাঁতসেঁতে, ঠান্ডা, শ্যাওলার পুরু স্তর জমে আছে। অসাবধানে পা ফেললে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা।
জঙ্গলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাকে বাড়িয়া পোকা, মাছি আর মশাদের দঙ্গল কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এসে বিনয়দের হেঁকে ধরল। সরসর আশেপাশে অদৃশ্য সরীসৃপেরা বুকে ভর দিয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। মাথার ওপর নাম না-জানা হাজারে হাজারে বুনো পাখি চক্কর দিয়ে কর্কশ গলায় সমানে চেঁচিয়ে চলেছে। উর্ধশ্বাসে কটা বুনো শুয়োর দৌড়তে দৌড়তে ঝোঁপঝাড় ভেদ করে আরও দূরে উধাও হয়ে গেল যেখানে জঙ্গল আরও জমাট, আরও দুর্ভেদ্য।
হঠাৎ উটকো কিছু মানুষ এসে পড়ায় এখানকার আদি বাসিন্দা জারোয়ারা খেপে গিয়ে কাল রাতে হানা দিয়েছিল। আজ দেখা যাচ্ছে পোকামাকড় সরীসৃপ পাখি থেকে জন্তুজানোয়ার, সবাই মহাবিরক্ত। উড়ে এসে যারা জুড়ে বসতে চাইছে, ভাগ বসাতে চাইছে তাদের আবহমানকালের অধিকারে তাদের ওপর ওরা আদৌ খুশি নয়। যতই চেঁচিয়ে-মেচিয়ে, চক্কর মেরে তারা হুলুস্থুল বাঁধাক, যে লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের ওপার থেকে এপারে চলে এসেছে তাদের জন্য উপনিবেশ তো গড়ে তুলতেই হবে।
কয়েক পা এগুতেই গাছের ডাল থেকে থপ করে কী যেন বিনয়দের মাথার ওপর পড়ল। খুব একটা ভারী নয়নরম, হড়হড়ে, ঠান্ডা।
বিনয় চমকে ওঠে। পরক্ষণে চোখে পড়ে অগুনতি সেঁক তারগা বেয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। শুধু তারই নয়, অন্য সবারই এক হাল।
লোশনটার মহিমা এতক্ষণে বোঝা গেল। ওটা না মাখলে জেঁকগুলো তাদের গা থেকে রক্ত শুষে নিত। হাত দিয়ে কটাকে আর ছাড়ানো যেত!
বিশ্বজিৎ তাকে লক্ষ করছিলেন। চোখাচোখি হতে একটু হাসলেন। তার হাসিটা যেন বুঝিয়ে দিল কেন লোশন মাখতে হয়েছে, এবার টের পেলেন তো।
একটা সামান্য ফাঁকা মতো জায়গায় এসে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। বিভাস গলার স্বর উঁচুতে তুলে হল, মোহনবাঁশি কর্মকার
একটা আধবুড়ো রোগাটে চেহারার লোক মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, খাড়া খাড়া কাঁচা-পাকা চুল–পরনে ময়লা ফতুয়া আর খাটো ধুতি-সামনে এসে বলল, আইজ্ঞা—
পরথম আপনেরে জমিন দেওন অইব। বড় গাছগুলান সরকার থিকা কাইটা দেওন অইছে। মাঝারিগুলানও কাইটা দিমু কিন্তুক ছুটো গাছ, ঝোঁপঝাঁপ আপনেগো হগল রিফুজিগো সাফ কইরা লইতে অইব।
মোহনবাঁশি হুঁশিয়ার লোক। সে ঢোক গিলে জিগ্যেস করল, বড় গাছগুলান কাটা অইছে ঠিকই কিন্তুক মাটির উপুরে হাতখানেক কইরা রইয়া গ্যাছে; মাটির তলে রইছে শিকড়বাকড়। হেগুলান (সেগুলো) উঠান (ওঠানো) তো আমাগো শক্তিতে কুলাইব না।
বিভাস বলল, বড় গাছের গোড়া আর শিকড় আপনেগো তুলতে অইব না, আমরাই তুইলা দিমু।
সহদেব রুদ্রপাল এবং জলধর বারুইয়ের বয়স অনেক কম। তিরিশের বেশি হবে না। দেশভাগের পর এপারে এসে শিয়ালদা স্টেশনে কিছুদিন কাটিয়ে তারপর ত্রাণশিবিরে গিয়ে উঠেছিল। তাদের ওপর দিয়ে ঝড়ঝাঁপটা কম যায়নি কিন্তু শরীরস্বাস্থ্য সেভাবে ভেঙে পড়েনি। মোটামুটি অটুটই আছে। দুজনেরই শক্তপোক্ত চেহারা।
সহদেব বলল, শিকড়কড় আপনেরা উঠাইবেন বাকি ঝোঁপঝাঁপ আমরা সাফ করুম। জঙ্গলের মুখ থিকা জমিন বাইর করতে যে মেলা (অনেক) সোময় লাইগা যাইব ছার (স্যার)।
বিভাস বলল, হেয়া তো লাগবই।
সংশয়ের সুরে জলধর বলল, জঙ্গলে ভরা জমিন দিয়াই কী কইবেন, এইবার নিজেগো প্যাটের চিন্তা নিজেরা কর।
তার মনোভাবটা বুঝতে পারছিল বিভাস। হেসে হেসে বলল, ভাইবেন না। আন্দামানে আপনেগো শুকাইয়া মারণের লেইগা আনি নাই। যতদিন না চাষবাস কইরা ফসল ফলাইতে পারেন, আপনেগো প্যাটের চিন্তা সরকারের। আমাগো উপুর ভরসা রাখেন।
দূরের জঙ্গলে লম্বা লম্বা করাত নিয়ে যারা ঢুকেছিল সেখান থেকে একটানা ঘষঘষ আওয়াজ আসছে। বিনয় আন্দাজ করে নিল। বড় গাছ কাটা শুরু হয়ে গেছে। মাঝারি মাপের করাত নিয়ে যারা এসেছিল তারা গভীর জঙ্গলে যায়নি। কাছাকাছি যে পাতলা জঙ্গল রয়েছে সেখানকার মাঝারি গাছগুলো কাটছে।
গাছ কাটার কায়দাটা বিচিত্র ধরনের। দুজন করে লোক গাছে চড়ে ক্ষিপ্র হাতে করাত চালিয়ে প্রথমে ডালগুলো ছেঁটে ফেলছে, তারপর নিচে নেমে এসে কবন্ধ গাছের গুঁড়িগুলো খণ্ড খণ্ড করে টাল দিয়ে রাখছে।
বনভূমির চতুর্দিকে শুধু করাত রাত চালানোর কর্কশ আওয়াজ। জঙ্গলের মাথায় পাখিদের চেঁচামেচি আরও বেড়েছে। বেড়েছে বনচর প্রাণীদের দুদ্দাড় দৌড়ে পালানোর শব্দ। বেড়েছে মশা-মাছি নানা ধরনের পোকা আর পতঙ্গের ওড়াউড়ি।
বিনয়রা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার খানিকটা দূর দিয়ে এক পাল হরিণ বিদ্যুৎ গতিতে বাঁ পাশের পাহাড়ের দিকে চলে গেল।
বিশ্বজিৎ একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ব্যস্ততার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বারোটি ফ্যামিলি আজ পনেরো। বিঘে করে মোট একশো আশি বিঘে জমি পাবে। এতটা জমি মাপজোখ করা কি মুখের কথা। তিনি বললেন, বেলা বেড়ে গেছে। আর দেরি করো না। এবার আসল কাজ আরম্ভ করে দাও।
আমিন লা-ডিন, চেনম্যান ধনপত এবং পুনর্বাসন দপ্তরের আরও কজন কর্মী মুহূর্তে তৎপর হয়ে ওঠে। প্রথমেই মোহনবাঁশিকে জমি দেওয়া হবে। তাকে সঙ্গে নিয়ে লা-ডিনরা জঙ্গলের ডানদিকে গেল। তাদের সঙ্গে বিভাস বিনয় এবং বিশ্বজিৎও গেলেন। বিভাস জমি মাপার কাজটা যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় তার তদারক করবে। একবার কাজটা শুরু করে দিতে পারলে বাকিটা মসৃণভাবে চলবে। ঠিক হল, জঙ্গলের ডান পাশে জমি পাবে মোহনবাঁশি। কিন্তু নিবিড় কাঁটাঝোঁপ, ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা ঘণ বনতুলসীর ঝাড়, গাছ, বুক সমান উঁচু ঘাস বনের ভেতর জমি মাপা সহজ নয়। একটা দল সমানে ধারালো চালিয়ে ঝোঁপঝাড় কেটে সাত আট ফিটের মতো জায়গা সাফ করছে; সেখান দিয়ে। লোহার লম্বা চেন পেতে জমি মাপার কাজ চলল।
লা-ডিন আর ধনপত হাঁকডাক করে বলল, খুঁটি বসাতে বসাতে চল- তুরন্ত
বনবিভাগের যে কর্মীরা বাঁশের সমান মাপের টুকরোগুলো নিয়ে এসেছিল, শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে দশ হাত পর পর খুঁটি পুঁততে লাগল। এই খুঁটি অবধিই মোহন বাঁশির জমির সীমানা। চৌকোনা পনেরো বিঘে জমি খুঁটি দিয়ে ঘিরতে সময় লাগল ঘন্টা দেড়েক।
মোহনবাঁশির পর সহদেবের পালা। মোহনবাঁশির জমির চারপাশে যেসব খুঁটি বসানো হয়েছে সেগুলোর পর চার ফিটের মতো বাদ দিয়ে একই প্রক্রিয়ায় জমি মেপে সহদেবকে দেওয়া হল।
কিন্তু পোকামাকড়, হরিণ, শুয়োর, তক্ষকই নয়, মাঝে মাঝে থোকায় থোকায় ঝোঁপঝাপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। বাদামি রঙের চেলা বিছেরা। লম্বায় এক বিগধ এক ফুটের মতো, চওড়ায় ইঞ্চিখানেক।
হোঁশিয়ার-হোঁশিয়ার। কানখাজুরা (চেলা বিছে) বহোত জহরিলা। সাপের চেয়েও খতারনাক। কামড়ালে জান চলে যাবে।
মোহনবাঁশি সহদেবরা দৌড়ে বিশ হাত দূরে চলে যায়। তাদের মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে তারা চিৎকার করতে আমাগো আন্ধারমানে আইনা যমের মুখে ফেইকা (ছুঁড়ে) দিছে। একদিকে জারো (জারোয়া), একদিকে কানখাজুরা, সমুন্দুরে হাঙ্গর। আমাগো নিঘঘাত মরণ।
বিভাস হুংকার ছাড়ে। চুপ। এক্কেরে চুপ। পদ্ম ম্যাঘনার দ্যাশ থিকা আইছেন। সেই হল জাগায় (জায়গায়) সাপ বাঘ কুমের (কুমির) আছিল না? বেবটাকে (সবাই) বাঘ আর কুমিরের প্যাটে গ্যাছেন? নিকি সাপের ছোবল মইরা ঝইরা গ্যাছেন?
বিভাসের তর্জন-গর্জনে মোহনবাঁশিদের চেঁচামেচি থেমে যায়। তারা চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।
বিনয় আগে লক্ষ করেনি। এবার দেখতে পেল, যারা বাঁশের খুঁটি, শাবল, কুড়ল এবং করাটরাত নিয়ে এসেছিল তারা কয়েকটা বড় বড় পেটমোটা বোতলও সঙ্গে করে এনেছে। বোতলগুলো পেট্রোল বোঝাই।
কানখাজুরা বা চেলা বিছেগুলো দলা পাকিয়ে কিলবিল করছে। ধনপত চকিতে একটা বোতল থেকে বিষাক্ত সরীসৃপগুলোর গায়ে পেট্রোল ছিটিয়ে দিয়ে দেশলাইয়ের কাঠি ধরিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। চোখের পলকে দাউদাউ আগুনে পুড়ে বিছেগুলো দলা পাকিয়ে যায়।
বিভাস মোহনবাঁশিদের দিকে ফিরে বলল, এইবার ডর কাটছে তো? আমরা আপনেগো পাশে আছি। কানখাজুরা জারোয়া কেও আপনেগো কিছু করতে পারব না। আহেন আহেন, আবার জমিন মাপামাপি শুরু হইব। নিজেগো চৌখে দেইখা হল (সব) বুইঝা লন (নিন)।
মোহনবাঁশিদের সাহস অনেকখানি ফিরে আসে। হয়তো ভাবে কাল রাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বুশ পুলিশ এবং ধনপতরা জারোয়াদের ঠেকিয়েছে, আজ কানখাজুরা মারল। এসবই তো তাদের নিরাপত্তার জন্য। পায়ে পায়ে উদ্বাস্তুরা ফিরে আসে।
যে এলাকা দিয়ে জমি মাপামাপির জন্য লম্বা লোহার চেন বসানো হবে সেখানকার ঝোঁপঝাড় কেটে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়ে যায়। তবে পুরোপুরি নির্বিঘ্নে নয়। কতকাল ধরে যে কানখাজুরা আর জেঁকেরা জঙ্গলের ভেতর চিরস্থায়ী আস্তানা গেড়ে আছে। দশ পা এগতে না এগতেই গাছের ডালপালা থেকে থোকায় থোকায় জোঁক মাথায় এসে পড়ছে। সারা গায়ে এবং মাথায় লোশন লাগানো রয়েছে তাই বাঁচোয়া। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো গা-মাথা থেকে খসে পড়ছে। ঝোঁপজঙ্গলে দা কিংবা কোদালের কোপ পড়লেই বুড় বুড় করে বেরিয়ে আসছে কানখাজুরা এবং অন্য সব বুনো সরীসৃপের দঙ্গল। পেট্রোল দিয়ে তাদের পোড়াতে পোড়াতে জমি মাপা এবং খুঁটি পোঁতা চলতে লাগল। মোহনবাঁশির পরিবারের জন্য পনেরো বিঘে জমি মেপে তার চরপাশে খুঁটি পুঁতে পুঁতে সীমানা ঠিক করে দিয়ে, তারপর সহদেবের পরিবারের জন্য জমি দেওয়া হল। এইভাবে সূর্য যখন পশ্চিম দিকে ঢলতে শুরু করেছে তার মধ্যে পাঁচটি ফ্যামিলিকে জমি বিলি করা সম্ভব হল।
সেই সকালবেলায় চিড়ে গুড় খেয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিল সবাই। খিদেয় এখন পেট জ্বলে যাচ্ছে। মুখে কেউ খিদের কথা না বললেও সেটা বোঝা যাচ্ছিল। বিশ্বজিৎ বললেন, এ বেলার মতো কাজ বন্ধ থাক। খেয়েদেয়ে এসে আবার করা যাবে।
বিভাস হেঁকে হেঁকে সবাইকে বলল, অহন কেম্পে ফিরা চলেন।
.
স্নান এবং খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে যখন সবাই আবার জঙ্গলে ঢুকল, সূর্য আরও খানিকটা হেলে গেছে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ও বেলা মাত্র পাঁচটা ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া হয়েছে। এভাবে কাজ হলে এতগুলো ফ্যামিলিকে জমি দিতে অনেক সময় লেগে যাবে। যে উদ্বাস্তুরা এখানে এসে পৌঁছেছে এক উইকের ভেতর তাদের ল্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কমপ্লিট করতেই হবে। মাসখানেক বাদে আবার একশো ফ্যামিলি মেনল্যান্ড থেকে এসে পড়বে। এখন প্রচুর কাজ।
ঠিক করা ছিল, আজ বারোটি ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া হবে কিন্তু উত্তর দিকে ঝোঁপ-ঝাড় অনেক বেশি ঘন। সেসব সাফ করে আর মাত্র চারটি ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া সম্ভব হল।
আজ সব মিলিয়ে নটা উদ্বাস্তু ফ্যামিলি জমি পেল।
সূর্য পশ্চিমদিকের পাহাড়ের পেছনে অনেকখানি নেমে গেছে। সেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। পাহাড় আর বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষগুলির ছায়া নেমে এসেছে উপত্যকায়। সেই ছায়া এমনই ঘন যে সন্ধে হবার আগেই চারিদিক দ্রুত অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার ভেদ করে সহজে নজর চলে না।
বিভাস হেঁকে বলল, আইজকার মতো কাম বন্ধ। কাইল ভুরের। (ভোরের আলো ফুটলেই আবার জমিন দেওন শুরু হইব। চলেন কেম্পে যাই
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সবাই ব্যারাকগুলোর দিকে এগিয়ে যায়।
বিনয় আর বিশ্বজিৎ বিরাট দলটার একেবারে পেছনে ছিলেন। সারাটা দিন জঙ্গলের পুরু শ্যাওলায় ঢাকা, সঁতসেঁতে, পিছল, উৎকট সোঁদা গন্ধে-ভরা জমি, নানা ধরনের পোকামাকড়, সেঁক। আর কানখাজুরার মধ্যে কাটিয়ে ভীষণ ক্লান্তি বোধ করছিলেন। দুজনে।
পশ্চিমদিকের পাহাড় এবং বনজঙ্গল গাঢ় ছায়ায় ঢেকে গেলেও পুবদিকের পাহাড়ে বেলাশেষের একটু আলো এখনও আলগাভাবে লেগে রয়েছে। দক্ষিণ প্রান্তে পাহাড়-টাহাড় নেই; একেবারে খোলা। সেখানে অফুরান বঙ্গোপসাগর। যদিও নিভুনিভু, তবু সমুদ্রের ঢেউগুলোর মাথায় মাথায় প্রচুর আলো দোল খাচ্ছে।
চলতে চলতে হঠাৎ পুবের পাহাড়ের দিকে নজর চলে যায় বিনয়ের। এক দঙ্গল হাতিকে প্যাচানো পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে হটিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসছে কটা লোক। খুব সম্ভব তারা মাহুত। হাতিদের পেছনে দুটো বিরাট ট্রাক। ট্রাক বা হাতি, কারও কোনও তাড়া নেই। তারা ধীর চালে এধারের ঢাল দিয়ে নেমে আসছে।
অবাক বিনয় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জেফ্রি পয়েন্টে হাতির পাল। আর পেল্লায় পেল্লায় ট্রাক নিয়ে কেন লোকগুলো আসছে, বোঝা যাচ্ছে না।
বিশ্বজিৎও কম অবাক হননি। হাতিটাতি এসে হাজির হবে, খুব সম্ভব জানতেন না। তাই তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
উদ্বাস্তুদের নিয়ে বিভাসরা বেশ খানিক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। হাতি দেখে তারাও থমকে গেছে।
কয়েক মিনিটের ভেতর কটা বিপুল আকারের প্রাণী, দুটো ট্রাক আর বেশ কিছু মানুষ নিচের উপত্যকায় নেমে এল।
বিশ্বজিতের সঙ্গে বিনয়ও সেদিকে এগিয়ে গেল। ওদিকে হাতি দেখে বিভাসরা শুধু নয়, যে উদ্বাস্তুরা ক্যাম্পে ছিল তারাও ছুটে এসেছে। বাচ্চাকাচ্চা, যুবকযুবতী, বুড়োধুড়ো–কেউ বাকি নেই। সবার চোখে অপার কৌতূহল।
বিনয় গুনে গুনে দেখল সবসুদ্ধ পাঁচটি হাতি। মাহুতরা পায়ে মোটা শিকল লাগিয়ে গাছের গুঁড়িতে সেগুলোকে বেঁধে ফেলল। কাল যে ছোট লরিগুলোতে চেপে উদ্বাস্তুরা এসেছিল সেগুলো কাতার দিয়ে ক্যাম্প থেকে খানিক দূরে র্ঘড়িয়ে আছে। দুই ট্রাকের ড্রাইভার লরিগুলোর পেছনে তাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল। ট্রাকে আরও কয়েকজন রয়েছে। মাহুতসুদ্ধ তারা সবাই বিশ্বজিতের কাছে দৌড়ে এল। এদের মধ্যে নানা জাতের মানুষ রয়েছে বর্মি, শিখ, সাঁওতাল, তামিল ইত্যাদি। সবার বয়স পঞ্চাশের ওপারে। বিনয় আন্দাজ করে নিল এরা একদিন বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে কালাপানির সাজা খাটতে এসেছিল। এখন মুক্তি পেয়ে তারা স্বাধীন ভারতের সরকারি কর্মচারী।
সবাই এসে সসম্ভ্রমে কপালে হাত ঠেকিয়ে বিশ্বজিৎকে বলে, সেলাম হুজৌর
বিশ্বজিৎ ওদের না চিনলেও, ওরা বিশ্বজিৎকে খুব ভালো। চেনে। মোটামুটি একটা আন্দাজ করে নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ কর?
সবার হয়ে একটা হট্টাকাট্টা চেহারার, চাড়া-দেওয়া গোঁফওয়ালা লোক, নিশ্চয়ই পুরো দলটার চালক বা সর্দার, বলল, হ, হুজৌর। লোকটা খুবই বিনয়ী, ন; গলার স্বর নরম। কে বলবে সে একদিন দুর্ধর্ষ দাগি আসামি হয়ে এখানে এসেছিল।
তোমাদের এখানে কে পাঠিয়েছে?
তিরুরের ফরিস্টার (ফরেস্টার) সাহাব।
তিরুর অঞ্চলের ফরেস্ট অফিসারকে ভালোই চেনেন বিশ্বজিৎ। বললেন, মণ্ডল সাহেব পাঠিয়েছেন?
হা সাহেব। এখান থেকে গাছের মোটা মোটা বল্লা নিয়ে যেতে হবে। উসি লিয়ে
তোমার নাম কী?
আজীব সিং।
ঠিক আছে। কবে থেকে কাজ শুরু করবে?
কাল সুবেসে।
একটু ভেবে বিশ্বজিৎ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের খানাদানার কী বন্দোবস্ত? এখানকার রিফিউজিদের সঙ্গে খাবে?
আজীব সিং বলল, জি, নেহি। সে জানায়, নিজেদের রসদ চাল ডাল আটা তেল ঘি রশুন পেঁয়াজ মরিচ মশলা আর এক বস্তা আলু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। হাতিগুলোর জন্যও খাবার আনা হয়েছে। বস্তা বস্তা ছোলা, কলাগাছ, কলার কাদি এবং অন্যান্য বুনো ফল। রসদ ফুরিয়ে গেলে আবার তারা ট্রাক পাঠিয়ে আনিয়ে নেবে। শুধু তা-ই নয়, তাদের থাকার ব্যবস্থাও নিজেরাই করবে। রসদের সঙ্গে অনেকগুলো তবুও এসেছে। সেটেলমেন্টের একধারে সেগুলো খাটিয়ে নিলেই হবে।
ঠিক আছে। তোমরা অনেকদূর থেকে আসছ। এবার কিছুক্ষণ আরাম করে তাবুটাবু বসিয়ে নাও। বিশ্বজিৎ আর দাঁড়ালেন না। বিনয়কে সঙ্গে করে তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বিনয়ের মাথায় বল্লা শব্দটা ঘুরছিল। কথাটার মানে সে জানে না। জিজ্ঞেস করল, বল্লা কী?
বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে দিলেন যে, বড় বড় গাছ কাটার পর বিশাল আকারের গুঁড়ি এবং মোটা মোটা ডাল চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে সেগুলো হল বল্লা।
হাতি ওগুলো কীভাবে সরাবে?
কাল থেকেই দেখতে পাবেন। বিশ্বজিৎ বললেন, আমাদের। এখানে ক্রেন নেই। হাতিরাই ক্রেনের কাজ করবে।
বিনয় আর কোনও প্রশ্ন করল না।
ওদিকে উদ্বাস্তুরা কিন্তু হাতিগুলোর সঙ্গ ছাড়েনি। খুব সম্ভব একসঙ্গে এত হাতি আগে আর কখনও দেখেনি। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তারা পাহাড়প্রমাণ প্রাণীগুলোকে লক্ষ করছিল।
হাতিরা উঁচুনিচু পাহাড় ডিঙিয়ে এতটা পথ হেঁটে আসার ধকলে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। তারা বসে পড়েছে। কিন্তু জঙ্গলে নিশ্চিন্তে জিরোবার কি উপায় আছে? মশা আর বাড়িয়া পোকার ঝক তাদের হেঁকে ধরেছে। অবিরাম গুঁড়ের ঝাঁপটা মারতে মারতে তারা মশাটশা তাড়িয়ে চলেছে।
বিশ্বজিৎ আজীব সিংদের কিছুক্ষণ আরাম করে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু এখন তাদের বসে বসে জিরোবার সময় নয়।
ওদের একজন হাতিগুলোর চারপাশে মশা এবং পোকা মারার ধূপ জ্বালিয়ে দিল। দুজন পাঁচটা কাঠের বিরাট গামলা বোঝাই করে ছোলা, কলা, কলাগাছ ইত্যাদি হাতিদের সামনে এনে রাখল। হাতিপিছু একটা করে গামলা।
পোকা আর মশামারা ধূপ জ্বালাতে অনেক পোকামাকড় লহমায় মরে গেল। বাকি সবাই মহা বিপদের গন্ধ পেয়ে জঙ্গলের। দিকে উধাও। হাতিদের খিদে পেয়েছিল জবর। তারা এখন অপার স্বস্তিতে খাওয়া শুরু করল।
আজীব সিংয়ের বাহিনীর অন্য লোকগুলো বসে নেই। তারা ট্রাক থেকে তাঁবুটাবু নামিয়ে মাটিতে খুঁটি পুঁতে পর পর সেগুলো খাটিয়ে ফেলতে থাকে। কয়েকজন অন্য লটবহর নামিয়ে আনে। তাঁবুগুলোর একধারে একজন মাটি খুঁড়ে উনুন বানিয়ে ফেলে। দুজন জঙ্গলে গিয়ে শুকনো কাঠকুটো জোগাড় করে নিয়ে আসে। শুকনো কাঠই এখানে জ্বালানি।
উদ্বাস্তুদের মধ্যে যারা যুবকযুবতী বা আরও বয়স্ক হাতি দেখার সঙ্গে সঙ্গে আজীব সিংদের কার্যকলাপ খুব মন দিয়ে লক্ষ করছিল। কিন্তু বাচ্চাগুলো এতক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হাতিগুলোকে ঘিরে চক্কর দিতে দিতে তুমুল হইচই বাধিয়ে দেয়।
আজীব সিং দুহাত তুলে নাড়তে নাড়তে বলে, বিচ্চেলোগ, চিল্লামিল্লি মত করো। হাঁথি গুসা করেগা তো বহুৎ খতরা হো যায়েগা।
সবাই মোটামুটি আন্দাজে বুঝল, এত চেঁচামেচিতে হাতিদের মেজাজ বিগড়ে যাবে। এই বিশাল প্রাণীগুলো একবার খেপে গেলে রক্ষা নেই; মহা সর্বনাশ ঘটবে।
উদ্বাস্তুদের মধ্যে যারা বয়স্ক, বিপদের গুরুত্বটা তারা বুঝতে পারছিল। তারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাচ্চাকাচ্চাদের ঠান্ডা করে, এই পোলাপানেরা চিল্লাইস না, চিল্লাইস না। হাতি চেতলে (খেপে গেলে) অঁড়ে প্যাচাইয়া (পেঁচিয়ে) আছাড় মাইরা শ্যাষ করব।
বাচ্চাদের হল্লা থেমে যায়।
.
বিনয়কে নিয়ে বিশ্বজিৎ তার ঘরে ফিরে এলেন। বাইরে দিনশেষের ফ্যাকাশে আলো থাকলেও ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। তবে পুনর্বাসন বিভাগের কোনও কর্মী লণ্ঠন জ্বালিয়ে তার তেজ কমিয়ে রেখে গিয়েছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটার শিখা বাড়িয়ে দিলেন বিশ্বজিৎ। উজ্জ্বল আলোয় ঘর ভরে গেল।
বিশ্বজিৎ এবার জুতো খুলে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন। বললেন, হোল ডে জঙ্গলে ভীষণ ধকল গেছে। একটু রেস্ট নিয়ে নিন।
বিনয়ের হাত-পা যেন আলগা আলগা হয়ে আসছিল। সেও হুড়মুড় করে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর বিশ্বজিৎ বললেন, কাল তো আমাকে পোর্টব্লেয়ার চলে যেতে হচ্ছে। মাসখানেক বাদে আবার একশো উদ্বাস্তু ফ্যামিলি আসবে। তার বন্দোবস্ত করতে হবে। নিরঞ্জন আর বিভাসকে দু খেপ কলকাতায় রিফিউজি আনতে পাঠিয়েছিলাম। এবার অন্য লোক যাবে। বিভাসদের পোর্টব্লেয়ারে রিহ্যাবিলিটেশন অফিসে প্রচুর কাজ জমে আছে। সেসব ওদের শেষ করতে হবে। সেগুলো আমাকে চেক করে দিল্লিতে পাঠাতে হবে। তাছাড়া আমার কোর্টে অনেকগুলো কেস জমে রয়েছে। আমি না গেলে হিয়ারিং শুরু করা যাবে না।
এসব কথা গতকালও বলেছিলেন বিশ্বজিৎ। বিনয় জিজ্ঞেস করল, কাল কখন যাবেন?
যেতে যেতে বিকেল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
ওঁদের কথাবার্তার মধ্যে বনবিভাগের একজন কলাই-করা দুটো বড় কাপ বোঝাই করে চা নিয়ে এল। তার সঙ্গে প্রচুর বিস্কুট।
কর্মীটি বর্মি। চায়ের কাপটাপ টেবলে রেখে ঘরের চার কোনায় মশা এবং পোকা মারা ধূল্প জ্বালিয়ে দিল। কেননা সন্ধে নামতে না-নামতেই মশাদের দঙ্গল ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে।
চায়ের পেয়ালা থেকে ধোঁয়া উড়ছিল। সটান উঠে বসলেন বিশ্বজিৎ। বললেন, এই বস্তুটির জন্যে মন-প্রাণ অস্থির হয়ে উঠেছিল।বর্মিটিকে দেখিয়ে বলেন, লোকটা বোধ হয় অন্তর্যামী। ঠিক সময় ঠিক জিনিসটি এনে হাজির করেছে। নিন–চা খান।
বিনয়ও এর মধ্যে উঠে পড়েছে। একটু হেসে সে চায়ের পেয়ালা তুলে নিল।
বর্মিট কাজ শেষ করে আর দাঁড়ায়নি। নিঃশব্দে চলে গেছে।
চা খেতে খেতে দুজনের কথা হচ্ছিল। বিশ্বজিৎ বললেন, যদি মনে হয়, আপনাদের কাগজের জন্যে আরও দু-একটা রিপোর্ট লিখবেন, আজই লিখে ফেলুন। কাল আমার সঙ্গে দিয়ে দেবেন।
বিনয় বলল, হ্যাঁ, লিখতে তো হবেই। তবে এক্ষুনি নয়; রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর লিখব।
ঠিক আছে।
একটু ভেবে বিনয় এবার জিগ্যেস করে, বলেছিলেন কাকা দু-চারদিনের মধ্যে এখানে এসে পড়বেন। তাকে ভীষণ দরকার। তাঁর কাছ থেকে ব্রিটিশ আমলের আন্দামানের অনেক কথা জানা যেত।
এই কাকা হলেন শেখরনাথ রাহা। বিশ্বজিতের বাবার সবচেয়ে ছোট ভাই। তার কথা আগেই বিশ্বজিতের কাছে শুনেছে বিনয়। শেখরনাথ ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী। অহিংস নির্বিষ আন্দোলনে ইংরেজ সরকারকে এদেশ থেকে উৎখাত করা যাবে, তিনি বা তার মতো বিপ্লবীরা আদৌ তা বিশ্বাস করতেন না। ভারতের মতো একটা কলোনি থেকে চরকা কেটে, সত্যাগ্রহ বা অসহযোগ আন্দোলন করলে তারা চাটিবাটি গুটিয়ে দেশ থেকে সুবোধ বালকের মতো বিদায় হবে, এসব আকাশ কুসুম কল্পনা। পাগলের প্রলাপও বলা যায়। এই উপমহাদেশের মতো কামধেনু। ফেলে কেউ কি সহজে চলে যেতে চায়! এদের তাড়াতে হলে সশস্ত্র অভ্যুত্থান চাই। তার জন্য চাই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল। মুখের কথা খসালেই তো সেসব মুড়ি মুড়কির মতো পাওয়া যায় না। তার জন্য টাকা দরকার। ট্রেন ডাকাতি করে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ধরা পড়ে উনিশশো কুড়ি সালে শেখরনাথ কালাপানির সাজা নিয়ে আন্দামানে এসেছিলেন। পোর্টব্লেয়ারে সেলুলার জেল এবং বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা।
তাদের নতুন ভারত-এর চিফ রিপোর্টার, নিউজ এডিটর থেকে শুরু করে কাগজের মালিক জগদীশ গুহঠাকুরতা পর্যন্ত সবাই চান শুধু রিফিউজি সেটেলমেন্টই নয়, সেলুলার জেল, ব্রিটিশ আমলের পেনাল কলোনি ইত্যাদি সম্পর্কেও যেন নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠায় বিনয়। ইন্ডিয়ার মেন ল্যান্ডের মানুষজনের কাছে আন্দামান এক অচেনা দ্বীপপুঞ্জ। যেমন ভীতিকর তেমনি রহস্যময়। এই দ্বীপগুলি সম্বন্ধে সবার অপার কৌতূহল। শেখরনাথের সঙ্গে দেখা হলে তার কাছ থেকে সেকালের এবং একালের অজস্র তথ্য জোগাড় করা যাবে।
বিশ্বজিতের সঙ্গে এই নিয়েও অনেক কথা হয়েছে বিনয়ের। তিনি বললেন, জেফ্রি পয়েন্টে নতুন সেটেলমেন্ট বসছে আর। কাকা আসবেন না তাই কখনও হয়। নিশ্চিন্ত থাকুন, দু-একদিনের মধ্যে তিনি ঠিক এসে পড়বেন। এখানকার উদ্বাস্তুরা এখন তার। ধ্যানজ্ঞান।
.
রাত্তিরেও সেটেলমেন্ট অফিসের সামনের খোলা চত্বরে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। দুদিন খিচুড়ি খাওয়ানো হয়েছে। আজ দুপুরে দেওয়া হয়েছিল ভাত ডাল আর সুবয়াই মাছের ঝোল। এবেলা অর্থাৎ রাত্তিরে চাপাটি তরকারি এবং ডাল।
খোলা চত্বরটায় অনেকগুলো গ্যাস বাতি আর হ্যাঁজাক জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। আলোয় আলোয় ভরে গেছে সমস্ত এলাকাটা।
বড় বড় কাঠের পরাতে পাহাড় প্রমাণ চাপাটি। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড। ডেকচি বোঝাই ডাল, তরকারি। তরকারি বলতে আলু কুমড়োর ছক্কা। ছক্কার স্বাদ বাড়াবার জন্য প্রচুর আস্ত আস্ত ছোলা দেওয়া হয়েছে।
উদ্বাস্তুরা নিজের নিজের থালা গেলাস হাতে নিয়ে যথারীতি কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিরঞ্জন আর বিভাসের তদারকিতে। ধনপত এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীরা তাদের থালায় চাপাটি টাপাটি তুলে দিচ্ছে। খাবার নিয়ে তারা কঁকা জায়গায় চলে যাচ্ছে।
বিশ্বজিৎ বিনয়কে সঙ্গে করে চলে এসেছেন। খাবার নিয়ে। খেতে খেতে তারা কথা বলছিলেন।
মজার গলায় বিনয় জিগ্যেস করল, রিফিউজিদের জন্যে এই সরকারি লঙ্গরখানা কতদিন চালু থাকবে?
বিশ্বজিৎ একটু ভেবে বললেন, দ্যাট ডিপেন্ডস
কথাটা বুঝতে পারল না বিনয়; সে তাকিয়ে থাকে।
বিশ্বজিৎ বললেন, বড় বড় গাছগুলো তো আমরা কেটে দিচ্ছিই। জমি ডিস্ট্রিবিউশনের পর বাকি ঝোঁপঝাড় মাঝারি আর ছোট গাছটাছ কেটে সাফ করবে রিফিউজিরা আপনাকে আগেই তা বলেছি। তারপর যে যার জমির একধারে নিজেদের ঘর তুলে নেবে। চাষের জমির পাশেই বাড়ি। এই বাড়ির সব মেটিরিয়াল বাঁশ টিন দড়ি কাঠগভর্নমেন্ট থেকে দেওয়া হবে।
বিশ্বজিৎ আরও জানালেন, ঘর তোলা হলে অ্যাডাল্টদের মাথা পিছু পঁচিশ টাকা আর মাইনরদের মাথা পিছু কুড়ি টাকা করে। ক্যাশডোল দেওয়া হবে। সেই টাকায় উদ্বাস্তুরা নিজেদের ফ্যামিলি চালাবে। অবশ্য আইরিশ আর আমেরিকান এভাঙ্গেলিস্টরা যে। পাউডার মিল্ক পাঠাচ্ছে সেটা ওদের ফ্রি দেওয়া হবে। তখন রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্ট এই কমন কিচেন বন্ধ করে দেবে। আগে যেসব সেটেলমেন্ট বসানো হয়েছে সেসব জায়গাতেও এটা করা হয়েছে।
বিনয় বেশ ধন্দে পড়ে যায়। কিন্তু
কী?
টাকা না হয় দেওয়া হল, কিন্তু এই জঙ্গলের ভেতর মানুষগুলো চাল ডাল তেল নুন কোথায় পাবে? এখানে তো হাটবাজার কিছু নেই।
বিশ্বজিৎ জানালেন, রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে একটা কো-অপারেটিভ সেকশন রয়েছে। সেই সেকশনের লোকজন এখানে এসে দোকান বসাবে। পোর্টক্লেয়ার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিক্রি করবে। না-লাভ, না-লোকসান, এই পদ্ধতিতে।
ওঁদের কথাবার্তার মধ্যেই মোহনবাঁশি, সহদেব, হলধর দাসরা হাতে খাবারের থালা এনে কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। মোহনবাঁশিদের কী একটা যেন বলার আছে কিন্তু বলতে পারছে না। ভয়ে ভয়ে শুধু বিশ্বজিতের দিকে বার বার তাকাচ্ছে।
বিশ্বজিৎ মোহনবাঁশিদের লক্ষ করেছিলেন। জিগ্যেস করলেন, কিছু বলবেন?
মোহনবাঁশি মাথা নেড়ে খুব বিনীত ভঙ্গিতে বলল, হ, স্যার
বেশ তো বলুন না।
জমিন দেওয়া শুরু হইচ্ছে। তমস্ত (সমস্ত দিন আমাগো যার যার জমিনে কাইটা যাইব। সন্ধ্যার পর আর কুনো কাম নাই। ওই সোময়টা কিছুক্ষণ যদিন আমরা ইট্ট গানবাজনা করি, আপত্ত নাই
সহদেব বলল, দ্যাশ ছাইড়া আসনের সোময় আমি একহান দোতারা লইয়া আইছি। কেও কেও সারিন্দাও আনছে। গান বাজনা করলে মন ভাল থাকব।
চকিতে বিশ্বজিৎ একবার বিনয়ের দিকে তাকালেন। তাঁর চাউনির মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যাতে আন্দাজ করা যায় তিনি খুশি হয়েছেন। খুশির কারণটাও মোটামুটি আঁচ করা যাচ্ছে। পরশু রাত্তিরে জারোয়ারা যখন আঁচমকা সেটেলমেন্টে হানা দিয়েছিল, উদ্বাস্তুরা ভয়ে আতঙ্কে পাগলের মতো চেঁচাচ্ছিল; তারা কিছুতেই এই দ্বীপে থাকবে না, কলকাতায় ফিরে যাবে। আজ তারাই কিনা পাহাড়ে-ঘেরা বিজন বনভূমিতে গান বাজনার আসর বসাতে চাইছে। এই সেটেলমেন্টে বাকি জীবন কাটানো যে ওদের ভবিতব্য সেটা ওরা বুঝতে পারছে। এখানে তাদের মন বসতে শুরু করেছে। ভালো লক্ষণ।
বিশ্বজিতের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। উৎসাহ দেবার সুরে বেশ জোর দিয়েই বললেন, নিশ্চয়ই গাইবেন, বাজাবেন। গ বাজনায় মন ভালো থাকে। যদি আরও কিছু বাজনার জিনি দরকার হয়, যেমন ধরুন হারমোনিয়াম, তবলা, সব সরকার থে কিনে দেওয়া হবে।
মোহনবাঁশির চোখ দুটো উদ্দীপনায় চকচক করছে, তাদে আর্জি যে এত সহজে পূরণ হবে, ভাবতে পারেনি। বল আমাগো মইদ্যে (মধ্যে) কেঠা কেঠা (কে কে) হারমুনি অ তবলা বাজাইতে পারে, একবার খবর লই, হের পর আপনে কমু
আমি তো কালই চলে যাচ্ছি। তবে এখানকার অফিস পরিতোষ বণিক থাকবেন। তাঁকে বলবেন সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে
সার (স্যার), ভরসা যহন দিলেন, আর দুইখান কথা কই।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন।
ফাঁকা চত্বরটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে মোহনবাঁশি বলল, আম ওইহানে খুটি কুইপা (পুঁতে), বাঁশের পাটাতন বহাইয়া (বসিয়ে একহান বড় কইরা মাচান বানাইতে চাই।
বিশ্বজিৎ একটু অবাক হলেন। –মাচান দিয়ে কী হবে?
হের উপুর বইসা গীত গামু। কুলোনির মাইনষে ঘিরা বই শুনব।
গীত বাদ্যের একটা পাকাঁপোক্ত বন্দোবস্ত করতে চাই। মোহনবাঁশিরা। মঞ্চ সাজিয়ে তারা আসর বসাবে, কিন্তু শ্রা ছাড়া আসরের তো মানেই হয় না, তাই তাদের ঘিরে বস সেটেলমেন্টের নতুন বাসিন্দারা।
বিশ্বজিৎ বললেন, নিশ্চয়ই মাচান বানিয়ে নেবেন। আর যেন বলবেন?
আইজ রাইতেই খাওয়া দাওয়া সাইরা কিছু সোময় গী গাইতে চাই। বাত্তিগুলান নিভাইয়া না দিলে ভালা হয়। আন্ধা তো গাওন (গাওয়া) যায় না।
না না, আলো অবশ্যই জ্বলবে। আমি বলে দেব। যা আপনারা খেয়ে নিন।
মোহনবাঁশিরা চলে গেল।
.
খাওয়া চুকলে নিজেদের ঘরে চলে এল বিনয়রা। বিশ্বজি বললেন, এবার লেখা শুরু করে দিন।
মশা এবং পোকামাকড় মারা ধূপগুলো জ্বলছিল। কাজে জঙ্গলের দিক থেকে তারা এদিকে ঘেঁষছিল না।
খোলা জানালার ধার ঘেঁষে যে লেখার টেবলটা রয়েছে সেট ওপর একটা লণ্ঠন তুলে কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ল বিনয়।
ওধারের খাটে কাত হয়ে শুয়ে একটা বই খুলে পড়তে লাগলেন বিশ্বজিৎ। বিনয় যতক্ষণ লিখবে, তিনি পড়বেন।
কয়েক লাইন লেখার পর হঠাৎ হইচই কানে এল। জানালার বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল, ওধারের চত্বরে তুমুল ব্যস্ততা চলছে। উদ্বাস্তুরা তো বটেই, পুনর্বাসন দপ্তরের কয়েকজন কর্মী বিপুল উদ্যমে অনেকটা জায়গা জুড়ে লম্বা লম্বা চট বিছিয়ে লোকজনের বসার ব্যবস্থা করছে। বিভাস, নিরঞ্জন বা পরিতোষরাও গা গুটিয়ে নেই। তাদেরও বিপুল উৎসাহ। কটা হ্যাঁজাক আর গ্যাসবাতি এনে চারপাশে এবং মাঝখানে বসিয়ে দিচ্ছে।
আসর সাজানো শেষ। সেটেলমেন্টের কেউ বাকি নেই; সবাই কে। মাঝখানে খানিকটা অংশ বাদ দিয়ে গোল হয়ে বসে পড়তে শুরু করেছে। বোঝাই যায়, মাঝখানের জায়গাটা বাজনদার আর গাইয়েদের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে।
একটু পরেই সহদেব, হলধর, মোহনবাঁশি এবং হরিপদ দোতারা সারিন্দা টারিন্দা নিয়ে আসরের মধ্যিখানে বসে পড়ল। খুলনার আছেরপুর গাঁয়ের হরিপদ এবং তার দাদা সোমেন বিশ্বাসকে স্পষ্ট মনে আছে বিনয়ের। রস আইল্যান্ডে রিফিউজি নার কোটা পূর্ণ করার জন্য পঁয়তাল্লিশ মিনিটে যে ছ ছটা বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে হরিপদও ছিল।
যেসব ফ্যামিলি কলকাতা থেকে মহারাজা জাহাজ বোঝাই হয়ে এই খেপে আন্দামানে এসেছে তাদের দু ভাগে ভাগ হয়ে একদল গেছে মিডল আন্দামানে। আরেক দল সাউথ আন্দামানের এই জেফ্রি পয়েন্টে। এদের ভেতর যে হরিপদরা ছিল, আগে খেয়াল করেনি বিনয়। আসলে আন্দামানে পৌঁছুবার পর এত ধকল গেছে, এতসব ঘটনা ঘটেছে যে আলাদা করে হরিপদর কথা তার মাথায় আসেনি।
হরিপদ কী করবে ওখানে? গাইবে? বাজাবে?
মোহনর্বাশি দোতারা আর সহদেব সারিন্দা নিয়ে এসেছিল। একটু পর মোহনবাঁশির আঙুলের টোকায় দোতারা টুং টুং সুরে বেজে ওঠে। ধীর লয়ে সারিন্দায় ছড় টানে সহদেব। ক্রমশ লহর তুলে দুই বাদ্যযন্ত্রের সুর পর্দায় পর্দায় চড়তে থাকে।
ঠিক এই সময় একটা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে গাইতে শুরু করে হরিপদ।
বন্ধু আমার নিধনিয়ার ধন
তারে দেখলে জুড়ায় জীবন যৈবন,
না দেখলে হয় আমার মরণ
যেদিন হইতে বন্ধুহারা
আমি হইয়াছি পাগলের পারা গো
আমার দুই নয়নে বহে ধারা
কে করে আমায় বারণ…
রোগাটে গড়নের ভীরু, লাজুক, মুখচোরা, গেঁয়ো যুবকটির এমন এক আকুল করা, সতেজ কণ্ঠস্বর রয়েছে, কে তা ভাবতে পেরেছিল! পদ্মা-মেঘনা-মধুমতী পারের স্মৃতিটাকে বহুদূরের বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে লহমায় তুলে এনেছে হরিপদ। তিন টার দিকের পাহাড়ে গানের সুরটা প্রতিধ্বনি তুলে চলেছে অবিরল; হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকেও। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
ওধারে হাতের বইটা নামিয়ে রেখে উঠে বসেছেন বিশ্বজিৎ। গানটা তাঁকেও প্রবল নাড়া দিয়েছে। নিচু গলায় বললেন, এক্সেলেন্ট! এ একেবারে খাঁটি ইস্ট বেঙ্গলের জিনিস। শহুরে ভেজাল ভাটিয়ালি নয়। চলুন, বাইরে গিয়ে শোনা যাক।
দুজনে বেরিয়ে আসর থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওঁদের দেখলে হরিপদ হয়তো ঘাবড়ে যাবে; গানের সুর তাল কেটে যাবে, তাই খুব কাছে না যাওয়াই ভালো।
হরিপদ আধবোজা চোখে বিভোর হয়ে গেয়ে চলেছে।
বনের আগুন সবাই দেখে
আমার মনের আগুন কেউ না দেখে গো।
আমি বনপোড়া হরিণের মতো
পুড়িয়া হই ছাই যখন।
শিখাইয়া দারুণ পীরিতি
আসলো না মোর প্রাণনিধি গো
সারা জীবন সার হইল।
সার হইল, গো আমার কান্দন
একের পর এক গান গেয়ে হরিপদ যখন থামল, বেশ রাত হয়ে। গেছে। সে যতক্ষণ গাইছিল তারিফের সুরে শ্রোতারা মাঝে মাঝেই বলে উঠছিল, আহা হা, কী গীতইনা হুনলাম (শুনলাম)! বা ‘পরান খান উথালি পাথালি করে গো’
আসর ভাঙার পর বিশ্বজিৎ আর বিনয় হরিপদর কাছে এগিয়ে যায়। মুগ্ধ গলায় বিশ্বজিৎ বললেন, তুমি তো গুণী লোক হে। একজন সত্যিকারের আর্টিক্ট।
গুণী শব্দটা হরিপদর জানা। কিন্তু আর্টিস্ট কথাটার মানে জানে না। তবে বিশ্বজিৎ যে তার সুখ্যাতি করছেন সেটা বুঝতে পারছিল। সঙ্কোচে সে একেবারে এতটুকু হয়ে যায়। মুখ নামিয়ে বলে, আপনারা আমার হাবিজাবি গান শুনিছেন!
বিশ্বজিৎ বললেন, হাবিজাবি কী বলছ! চমৎকার গেয়েছ।
আরও নুয়ে পড়ল হরিপদ। কী যেন বলতে চাইল; পারল না। গলার ভেতর উত্তরটা আটকে গেল।
বিশ্বজিৎ তার কাঁধে একটা হাত রাখলেন। এতগুলো। মানুষকে আনন্দ দেওয়া, সেটা কি সোজা কথা! সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে, সেখানে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। এখন এই দ্বীপ তোমাদের দেশ। নিজে আনন্দে থাকো, সবাইকে আনন্দ দাও। মোহনর্বাশি সহদেবদের বললেন, তোমরাও গুণী মানুষ। যেমন বলেছিলে তেমনি রোজ সন্ধের পর আসর বসাবে। অনেক রাত হয়ে গেছে, এবার ব্যারাকে গিয়ে শুয়ে পড়। কাল সকাল থেকে আবার জমি দেওয়া শুরু হবে। বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে তাড়াতাড়ি উঠতে পারবে না।
বিশ্বজিৎও আর দাঁড়ালেন না, বিনয়কে জেনে থাকলে। তাড়াতাড়ি উঠতে পারবে না।
বিশ্বজিৎ আর দাঁড়ালেন না, বিনয়কে সঙ্গে করে নিজের ঘরে চলে এলেন।
বিনয় প্রতিবেদন লিখতে লিখতে উঠে গিয়েছিল। ভেবেছিল ফিরে এসে বাকিটা শেষ করে ফেলবে। কিন্তু এখন আর টেবলে। গিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে না। হরিপদর গান আর মোহনবাঁশিদের বাজনার রেশ জেফ্রি পয়েন্টের পাহাড়ে, বনভূমিতে এবং সমুদ্রে এখনও থেকে গেছে যেন। খুব ভালো লাগছে বিনয়ের। হরিপদরা যেন পূর্ববাংলা নামে বহুদূরের এক স্বপ্নের ভূখণ্ডে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। আজ আর অন্য কাজে মন বসবে না।
পুনর্বাসন দপ্তরের কোনও কর্মী কখন যেন এসে তাদের দুজনের মশারি খাটিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বিনয় টেবলের ওপর যে লণ্ঠনটা জ্বলছিল সেটা নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল।
বিশ্বজিত শুয়ে পড়লেন। তাঁর খাটের পাশে নিচু টেবলে আরেকটা লণ্ঠন জ্বলছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটা নিভিয়ে দিতে দিতে বললেন, আজ আর লেখাটা কমপ্লিট করা গেল না–তাই তো?
বিনয় বলল, হ্যাঁ, কাল সকালে উঠে ওটা শেষ করব। আসলে হরিপদর গানটা
বিশ্বজিৎ বললেন, খুব সাধারণ চেহারা–মোস্ট আন-ইমপ্রেসিভ। পাশ দিয়ে গেলে কেউ ফিরেও তাকাবে না। কিন্তু ছেলেটার গলায় ম্যাজিক আছে; একেবারে হিপনোটিক। কার ভেতরে কী যে থাকে, মুখ দেখে বোঝা যায় না।
২.০৫ জমি বিলি হওয়ার কথা
পরদিন ঘুম ভাঙতে বেশ দেরিই হয়ে গেল বিনয়ের। ধড়মড় করে উঠে মশারির বাইরে এসে দেখল বিশ্বজিৎ নেই। জমি বিলি হওয়ার কথা খুব সকাল থেকে। বিনয় গভীর ঘুমে ডুবে আছে, তাই আর তাকে ডাকেননি। নিশ্চয়ই উদ্বাস্তু এবং পুনর্বাসনের কর্মীদের নিয়ে জঙ্গলে চলে গেছেন।
একটা তোয়ালে নিয়ে সমুদ্রের ধারে চলে এল বিনয়। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে চা এবং সকালের খাবার খেয়ে কালকের লেখাটা নিয়ে বসতে হবে।
সূর্য পুবদিকের পাহাড়ের মাথায় উঠে এসেছে। তিনদিকের ঘন জঙ্গলে এবং সমুদ্রে রোদ ঝলকে যাচ্ছে। রোদটা এত তেজি যে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না।
বিচটা একেবারে ফাঁকা। কেননা জেফ্রি পয়েন্টের বাসিন্দারা এখন সবাই উত্তর দিকের জঙ্গলে।
মুখটুখ ধুয়ে তোয়ালেতে মুছতে মুছতে বিচের ওপর দিয়ে সে যখন ফিরতে শুরু করেছে, হঠাৎ ভট ভট শব্দ কানে এল। ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল একটা মোটর বোট সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে খুব আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। বোটটার গায়ে নাম লেখা: সি-গাল। সি-গালের মানে তো সিন্ধুশকুন, নাকি সাগর পাখি।
বোটটায় জনা চারেক লোক রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বর্মি, সেটা তার মঙ্গোলিয়ান চেহারা দেখে লহমায় ধরে ফেলা যায়। বাকি তিনজন বেশ কালো। সবার চুল চামড়া ঘেঁষে ছোট ছোট করে ঘঁটা। কেউ মাঝারি হাইটের, কেউ বেড ঢ্যাঙা। বমিটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট আর হাতকাটা জামা। অন্য সবাই পরেছে খাটো হাফ প্যান্ট, প্যান্টগুলো আঁট হয়ে গায়ে লেপটে আছে। শার্টটার্ট নেই। দুজনের গলায় কালো কারে ক্রস ঝুলছে। বোঝাই যাচ্ছে খ্রিস্টান। বাকি লোকটির গলায় কিছু নেই।
ওরা বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। বোটটা থামিয়ে বর্মিটি হিন্দি এবং উর্দু মেশানো হিন্দুস্থানিতে জিগ্যেস করল, সাহাব, এই জেফ্রি পয়েন্টে রিফিউজি সেটলমেন্ট বসার কথা শুনেছিলাম। পাকিস্তানের রিফিউজিরা কি এসে গেছে? বাঙালি, বিহারি, মারাঠি শিখ বর্মি কারেন–সবাই এখানে হিন্দুস্থানিতে কথা বলে। সেই মিউটিনির সময় যে সিপাহিদের কালাপানি সার করে এই দ্বীপে পাঠানো হয়েছিল তখন থেকেই হিন্দুস্থানি বুলি অর্থাৎ ভাষাটা চালু হয়েছে। প্রায় একশো বছর ধরে সেটা চলছে।
বিনয়ের চেহারাটা উদ্বাস্তুদের মতো ক্ষয়াটে, ভাঙা-চোরা, নুয়ে-পড়া ধরনের নয়। তাকে দেখলে মনেই হয় না, দারিদ্র, কষ্ট বা চরম দুর্দশার মধ্যে আছে সে। বরং চোখেমুখে সম্ভ্রান্ত, মার্জিত একটা ছাপ রয়েছে। তাই বর্মিটা তাকে সাহাব বলেছে। তার কথাবার্তায় রীতিমতো সম্ভ্রম মেশানো।
বিনয় বলল, হ্যাঁ, অনেক উদ্বাস্তু ফ্যামিলি এসে গেছে। আরও আসবে।
নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করল লোকগুলো। তারপর বর্মিটা বলল, হামলোগ আতে হেঁ। এদিকে যখন এসেই পড়েছি নয়া সেটলমেন্টের কামকাজ কেমন হচ্ছে, একবার দেখেই যাই।
মোটর বোর্টটা যদিও ছোট কিন্তু কিনারে ঘেঁষতে পারছে না, কেননা সেখানে জলের গভীরতা দেড় দুফিটের বেশি হবে না। বোটের তলার দিকটা জলতলের বালিতে আটকে যাবে। খানিক দূরে জল যেখানে কোমর সমান গভীর সেখানে নোঙর ফেলে বর্মিরা চারজন সমুদ্রে নেমে পড়ল। তারপর জল ঠেলে ঠেলে পাড়ে এসে উঠল। তাদের প্যান্টট্যান্ট ভিজে গেছে, কিন্তু তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ভাবখানা এইরকম ভিজে যখন গেছে তখন শুকিয়েও যাবে।
বর্মি আর সঙ্গীরা বিনয়ের কাছে চলে এসেছিল। বর্মিটা জিগ্যেস করল, আপলোগ সেটলমেন্টকা অফসর হ্যায়?
অফসর অর্থাৎ অফিসার। কলকাতা আসার পর কাজ চালাবার মতো হিন্দি এবং একটুআধটু উর্দু শিখে নিয়েছে বিনয়। বুঝতে পারে, মোটামুটি বলতেও পারে। সে বলল, না না, আমি কলকাতার একটা নিউজ পেপারে কাজ করি। আন্দামানের সেটলমেন্ট দেখতে এসেছি।
আপনি আখবরে কাম করেন? পত্রকার? বর্মির ভক্তি যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল।
আখবর কথাটার মানে জানত না বিনয়। আন্দাজে বুঝে নিল–খবরের কাগজ। পত্রকারটা আগেই শুনেছে–সেটা হল সাংবাদিক।
বিনয় বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আপনাদের পরিচয়টা কিন্তু জানতে পারিনি।
বমিটি বিপুল উৎসাহে জানায়, সে শেল কালেক্টর। নাম লা পোয়ে। আন্দামানের দরিয়া ইজারা নিয়ে জলের তলা থেকে নানারকম শঙ্খ কড়ি টার্বো ট্রোকাস ইত্যাদি তুলে ঘষেমেজে সাফ করে কলকাতা বোম্বাই এমনি বিরাট বিরাট শহরে পাঠায়। আন্দামানের শেলের সারা দুনিয়া জুড়ে কদর। কলকাতা বোম্বাইয়ের বড় বড় শেঠেরা সেসব পৃথিবীর নানা জায়গায় চালান দেয়। শেল নিয়ে লাখো লাখো টাকার কারবার চলছে।
শেলের ব্যাবসা নিয়ে কিছুই ভাবছিল না বিনয়। সে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝিনুকের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লা পোয়ে জানায়, সি-গাল বোটটার মালিক সে নিজে। সরকারের কাছ থেকে সে নিজেই শেল তোলার লাইসেন্স নেয়, ফি বছর লাইসেন্স রিনিউ করতে হয়। বছরের পর বছর এইভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে।
লা পেয়ে তার সঙ্গীদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা হল যোশেফ, জন এবং রামন। তিনজনই কেরালার লোক। দুজন। খ্রিস্টান, একজন হিন্দু। ওরা ডাইভার। অর্থাৎ জলের তলায় ডুব দিয়ে দিয়ে হাঙর এবং অন্য সব হিংস্র সামুদ্রিক জন্তুর সঙ্গে লড়াই করে ট্রোকাস টার্বো ইত্যাদি দামি দামি শেল তুলে আনে।
ঝিনুকের চিন্তায় বিনয়ের মাথার ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছিল। সে আগেই শুনেছে, শেল কালেক্টররা আন্দামানের নানা দ্বীপের চারদিকে ঘুরে ঘুরে শেল তোলে। ঝিনুক রয়েছে মিডল আন্দামানে। এখান থেকে কম করে ষাট-সত্তর মাইল দূরে। লা পোয়েরা কি সেখানে যায়?
রস আইল্যান্ডে চকিতের জন্য ঝিনুককে দেখার পর থেকে তীব্র ব্যাকুলতায় বুকের ভেতরটা ভরে আছে বিনয়ের। ঝিনুকের সঙ্গে তার সম্পর্কটা ঠিক কী, বিশ্বজিৎকে জানাতে পারেনি। সংকোচ হয়েছে। একটু ঘুরিয়ে শুধু বলেছে, সে মিডল আন্দামানের নতুন নতুন সেটলমেন্টগুলো দেখতে চায়। সেইসব অঞ্চলের রিপোর্টও সে নতুন ভারত-এ পাঠাবে। এগুলো তার অ্যাসাইনমেন্টের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্যটা হল, একবার মিডল আন্দামানে পৌঁছাত পারলে সেটেলমেন্টের পর সেলটমেন্ট ঘুরে সে ঝিনুককে যেভাবেই হোক খুঁজে বার করবে।
কিন্তু বিশ্বজিৎ বিশেষ গরজ দেখাননি। বলেছেন, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সাউথ আন্দামানে সেটেলমেন্টের পত্তন কীভাবে হচ্ছে, প্রথম সেটা দেখুক বিনয়, পরে তাকে মিডল আন্দামানে পাঠবার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি কেমন করে জানবেন একটি চিরদুঃখী তরুণীর জন্য কতটা অস্থির হয়ে আছে বিনয়!
লা পোয়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আশায় উত্তেজনায় উথালপাতাল হয়ে যাচ্ছিল বিনয়। কৌশলে জেনে নিতে হবে ওরা মিডল আন্দামানে শেল তুলতে যায় কিনা। যদি যায় যেভাবেই হোক ওদের সঙ্গে সেখানে চলে যাবে।
লা পোয়ে জিগ্যেস করল, বড়ে সাহাবকে আপনি চেনেন?
বিনয় একটু অবাক হল।কোন বড়ে সাহেব?
রাহা সাহাব। যাঁর হাত দিয়ে এই সব সেটলমেন্ট বসছে।
রাহা সাহাবকে চিনব না? তিনিই তো আমাকে এই জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে এসেছেন।
সাহেব কি এখন এখানে আছেন?
আছেন। জঙ্গলে রিফিউজিদের জমি দেওয়া হচ্ছে। তিনি তার দেখাশোনা করছেন।
খুশিতে চোখমুখ চক চক করতে থাকে লা পোয়ের। আজ আমার নসিবটা বহুত আচ্ছা। বড়ে সাহাবের সঙ্গে দেখা হবে। ওঁকে সালাম দিয়ে যাই। উনি কোন দিকের জঙ্গলে আছেন?
উত্তর দিকের।
লা পায়ে আর সঙ্গীদের নিয়ে দুরের জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
এই শেল কালেক্টরটাকে কোনও ভাবেই ছাড়া যায় না। বিনয়ের খেয়াল রইল না, এখনও তার চাটা খাওয়া হয় নি। খেয়াল রইল না, কাল রাত্রিরে যে লেখাটা শুরু করেছিল, সেটা শেষ করা জরুরি। সেও লা পেয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
.
উত্তরের জঙ্গলে এখন তুমুল ব্যস্ততা। একদিকে বন দপ্তরের কর্মীরা লম্বা লম্বা করাত চালিয়ে বিশাল বিশাল ঝাড়লো মহাবৃক্ষকে কাটছে। লা ডিন তার দল বল নিয়ে চেন দিয়ে জমি মাপছে, আর একটা দল বাঁশের খুঁটি পুঁতে জমির সীমানা ঠিক করে দিচ্ছে। তাদের কাজকর্ম তদারক ধনপত, নিরঞ্জন এবং বিভাস। উদ্বাস্তুরাও রয়েছে প্রচুর। তারা তাদের জমি বুঝে নিচ্ছে।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করছেন বিশ্বজিৎ। ঝোঁপ ঝাড় লতাপাতা ঠেলে আসার শব্দে পেছন ফিরে তাকিয়ে লা পোয়েদের সঙ্গে বিনয়কে দেখে তিনি রীতিমতো অবাক।
লা পেয়ে এবং তার তিন কেরেলি ডাইভার কপালে হাত ঠেকিয়ে কোমর ঝুঁকিয়ে বলল, সেলাম বড়ে সাহাব। আপনার তবিয়ত আচ্ছা হ্যায় তে?
লঘু সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, আমার তবিয়ৎ কখনও খারাপ হয় না। সব সময় আচ্ছা থাকে। তা তেমারা এখানে আমার খবর পেলে কী করে? বলে একটু কী ভেবে বিনয়কে দেখিয়ে বলল, নিশ্চয়ই এই সাহেবের কাজ?
হা- লা পোয়ে জানায় মোটর বোট নিয়ে তারা জেফ্রি পয়েন্টে এসেছিল। বিনয়কে সমুদ্রের বিচে দেখে নেমে আসে। তারা আগেই খবর পেয়েছিল এখানে রিফিউজি সেটলমেন্ট বসছে। বিনয়ের কাছেই শুনেছে বিশ্বজিৎ এখানে আছেন। তাই
বিশ্বজিৎ বললেন, তোমাদের কাজকর্ম ঠিকমতো চলছে?
জি বড়ে সাহেব। সবই আপনার মেহেরবানিতে। এহী সাল আগের সালের চেয়ে তিন গুনা (গুণ) সিপি (শেল অর্থাৎ শঙ্খ কড়ি টড়ি) উঠছে।
বিশ্বজিৎ হাসলেন। তাহলে লাভ ভালোই হবে বলছ?
হাঁ বড়ে সাহাব। আপনি যদি আমাদের না দেখতেন, বালবাচ্চা নিয়ে ভুখা মরতে হত। আপনার জন্য আমরা বেঁচে গেছি। এই জিন্দগিতে আপনার মেহেরবানি কভি ।
বাস, বাস– একটা হাত তুলে লা পোয়েকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, এত গুণকীর্তন করে তাকে অকাশে চড়াতে হবে না।
লা পেয়ে থেমে গেল। বিনয় চুপচাপ একধারে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। সে জানে বিশ্বজিৎ রাহা আন্দামানের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এবং রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের একজন বড় কর্তা। বর্মি শেল কালেক্টরকে তিনি কীভাবে মেহরেবানি করলেন, বোধগম্য হলনা। বিশ্বজিতের যে ধরনের দায়িত্ব তাতে তার আওতায় সমুদ্র থেকে শেল তোলার ব্যাপারটা আসে না।
বিশ্বজিৎ লা পোয়েকে বললেন, তোমরা এদিকে কতদিন শেল তুলবে?
দশ পন্দ্র রোজ তো জরুর।
হঠাৎ কিছু মনে পড়তে বিশ্বজিৎ বিনয়ের দিকে তাকালেন। জানেন এই লা পোয়ে নাইনটিন টোয়েন্টি ফাইভে বর্মায় মৌলমিন থেকে কালাপানির সাজা খাটতে আন্দামানে এসেছিল। লা পোয়েকে জিগ্যেস করলেন, কী ঠিক বলছি তো?
হাঁ, বড়ে সাহাব শাস্তি ভোগ করতে আসার কথায় নিজেকে গুটিয়ে নিল লা পোয়ে। মিনিমিনে গলায় বলল, ও সব পুরানা বাত ।
বোঝা যাচ্ছে অতীতে যা ঘটে গেছে তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হোক, সেটা একেবারেই চায় না লা পোয়ে। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
বিশ্বজিতের হয়তো একটু মজা করার ইচ্ছা হল। বললেন, কটা যেন মার্ডার করে এখানে এসেছিলে–তিনটে না চারটে?
জবাব না দিয়ে নীরবে ঘাড় চুলকাতে লাগল। এতকাল বাদে পুরানো দুষ্কর্মের ইতিহাস খুঁচিয়ে বার করার কি কোনও মানে হয়? বড়ে সাহাব তাকে কী ফ্যাসাদেই যে ফেলে দিয়েছেন!
বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, নাইনটিন থার্টি ফাইভে বর্মা ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হয়ে গেল। তারপর ইন্ডিয়া, বর্মা দুই কান্ট্রিই স্বাধীন হল। সাজার মেয়াদও ফুরিয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছা করলে লা পোয়ে নিজের দেশে মৌলমিনে ফিরে যেতে পারত। যায়নি। এখানেই বিয়েটিয়ে করে শেল-এর কারবার করছে। লা পেয়ে এখন পাকা জেন্টলম্যান। কী হে তা-ই তো? শেষ কথাটা লা পোয়েকে।
বর্মি শেল কালেক্টরের ঘাড় চুলকানি আরও বেড়ে গেল। বিশ্বজিৎ এমনিতে গম্ভীর প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কাজের সময় কারও পান থেকে চুন খসার উপায় নেই। কিন্তু অন্য সময় ভারী মজাদার মানুষ। অন্যের পেছনে লেগে রঙ্গ করতে ভালোবাসেন। নিছক নির্দোষ কৌতুক।
বিনয়ের মাথায় ঝিনুকের চিন্তাটা ঘুরছিলই। তার ইচ্ছে লা পোয়েরা যদি শেল তুলতে মিডল আন্দমানে যায় সে তাদের মোটর বোটে উঠে পড়বে। কিন্তু ওঠাটা সহজ নয়। বিশ্বজিৎ বললে লা পোয়েরা নিশ্চয়ই তাকে সঙ্গে নেবে। তবে আপাতত বিশ্বজিৎকে জানাবে না, সে মধ্য আন্দামানে যেতে চায় এবং এই যাওয়ার পেছনে রয়েছে ঝিনুক। বলা যাবে না সেখানে সমুদ্রের ধারে গহন বনভূমির ভেতর নতুন যেসব সেটেলমেন্টের পত্তন হচ্ছে সেই উপনিবেশগুলিতে হানা দিয়ে ঝিনুককে খুঁজে বার করবে। ঝিনুকের কথা লা পোয়েদেরও বলবে না। এ জন্য মনে। মনে একটা কৌশল মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে।স।
বিশ্বজিৎ বললেন, আমি এখন খুব ব্যস্ত। আর কথা বলতে পারব না। তোমরা তোমাদের কাজ কর গিয়ে। দরকার হলে আমার সঙ্গে পোর্ট ব্লেয়ারে গিয়ে দেখা করো।
জি বড়ে সাহাব
লা পোয়েরা সমুদ্রের দিকে পা বাড়াতে যাবে, ব্যগ্রভাবে বিনয় বিশ্বজিৎকে বলে, আমার একটা কথা আছে।
বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন কী কথা?
বিনয় বলল, লা পোয়ের কাছে শুনেছি ওরা সমুদ্র থেকে হাঙর বা অন্য ধরনের ফেরোশাস সি অ্যানিম্যালদের সঙ্গে লড়াই করে শেল তুলে আনে। এই নিয়ে আমাদের কাগজে দু একটা লেখা পাঠানো যায়।
বিশ্বজিৎকে বেশ উৎসাহিত দেখা গেল। বললেন, হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং। সেই সঙ্গে ভীষণ রিস্কিও। যে ডাইভাররা শেল তোলে তারা যদি একটু অসাবধান হয় হাঙরেরা তাদের ছিঁড়ে খাবে। এরকম দু চারটে ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। একটু থেমে ফের শুরু করেন, আন্দামানের ডাইভারদের পক্ষে ভীষণ বিপজ্জনক প্রফেশন। পেটের জন্যে মানুষকে কত কিছুই না করতে হয়।
বিনয়ের কৌতূহল হচ্ছিল। সে বলে, হাঙরটাঙরদের সঙ্গে ওরা কীভাবে লড়াই করে?
সেটা ঠিক বলা যাবে না। লড়াইয়ের নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি নেই। পরিস্থিতি বুঝে ওরা স্ট্রাটেজি ঠিক করে নেয়।
বিনয় বলল, আমার একটা বিশেষ অনুরোধ আছে।
হাঁ হাঁ, বলুন না—
আমি এই শেল কালেক্টিং সম্পর্কে নতুন ভারত-এ লেখা পাঠাতে চাই। কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে তো, মানে অভিজ্ঞতা না হলে শুনে শুনে এসব লেখা যায় না। আপনি যদি লা পোয়েদের বলে দেন, ওরা আমাকে ওদের বোটে ঘুরিয়ে সব দেখাবে।
অবশ্যই। বিশ্বজিৎ বিনয়কে দেখিয়ে লা পোয়েদের বললেন, উনি আমার বন্ধু। কলকাতার পত্রকার।
লা পেয়ে বলল, জানি বড়ে সাহেব। ওঁর মুখেই শুনেছি।
উনি তোমাদের কাজকর্ম দেখতে চান। তোমরা তো এখন এখানেই আছ। ওঁর যখন সময় হবে তোমাদের বোটে তুলে সব দেখিয়ে দেবে। যা জানতে চান, ভালো করে জানাবে। তোমাদের কথা উনি আখবরে লিখবেন। ইন্ডিয়ার হাজারো মানুষ তোমাদের নাম জেনে যাবে।
লা পোয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে জানায় বড়ে সাহেবের হুকুম নিশ্চয়ই তামিল করা হবে। কলকাতার পত্রকারজি যেদিন চাইবেন সেদিনই তাঁকে জাজিরার (দ্বীপের) চার পাশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখানোর বন্দোবস্ত করবে তারা।
বিনয়ের কৌশলের প্রথম ধাপটা মাপে মাপে খেটে গেল। বিশ্বজিৎ তাঁর কথায় রাজি হয়েছেন। পরের ধাপটা ঠিক করে নিতে হবে লা পোয়ের সঙ্গে। সেটা কোনওভাবেই বিশ্বজিৎকে জানানো হবে। না পরে তিনি নিশ্চয়ই জানতে পারবেন। তখন। ঝিনুকের ব্যাপারটা না বলে পারা যাবে না। সব শুনলে তিনি বিরক্ত তো হবেনই না, বরং সহানুভূতিই জানানে, এমন বিশ্বাস তার আছে।
লা পোয়েরা লম্বা সেলাম ঠুকে বিশ্বজিতের কাছ থেকে বিদায় নিল। অব যাতা হুঁ বড়ে সাহাব।
লা পেয়োদের এখন কোনওভাবেই ছাড়া যাবে না। তাদের সঙ্গে বোঝাঁপড়াটা ঠিক করে নিতে হবে। বিনয় বলল, আমিও যাই। কালকের সেই লেখাটা ইনৰ্মপ্লিট রয়েছে। ওটা শেষ করে ফেলি গিয়ে।
হ্যাঁ হ্যাঁ যান। আমি দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর একটু রেস্ট নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার ফিরে যাব। তার ভেতর যা যা দেবার সব রেডি করে রাখবেন।
বিনয় লা পোয়েদের সঙ্গে রিহ্যাবিলিটেশনের ক্যাম্প অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। চলতে চলতে সমানে বকরবকর করছে লা। পোয়ে। তার মুখে অনবরত একই কথা–বিশ্বজিৎ। দুনিয়ায় বিশ্বজিতের মতো মানুষ হয় না। তার কাছে বিশ্বজিৎ ঠিক স্বয়ং ফায়ার (বুদ্ধেদেবের) পরেই। অঢেল এই গুণগানের কারণটাও জানা গেল। ইংরেজ আমলের শেষ দিকে যখন লা পোয়ের সাজা শেষ হয়ে গেছে সেই সময় মধ্য আর দক্ষিণ আন্দামানের কোষ্ট লাইন ইজারা নিয়ে সে সিপিবা শেল তুলে আসছিল। স্বাধীনতার পরও নির্বিঘ্নেই চলছিল তার কাজকর্ম। কিন্তু মাদ্রাজ থেকে একজন শেলের কারবারী এসে দরিয়া ইজারা নেবার জন্য অনেক বেশি দর দিয়ে বসল। সে-ই শেল তোলার কাজটা পেয়ে যেত। এই কারবারের সঙ্গে লা পোয়ের পুরো ফ্যামিলি তো বটেই আর তিন ডাইভার এবং তাদের ঘরবাসী বাচ্চাকাচ্চাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। কাজটা হাতছাড়া হয়ে গেলে তাদের মহা সংকট। তারা গিয়ে রাহা সাহেবের পা জড়িয়ে ধরেছিল। তার জন্যই শেষ পর্যন্ত লিজটা পেয়ে যায় লা পোয়েরা। রাহা সাহেবের ওপর ও তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব আগেও কিছু কিছু বলেছে লা পোয়ে। বিনয় অন্যমনস্কর মতো শুনে যাচ্ছিল। তার ভাবনায় এখন একমাত্র ঝিনুক। বর্মিটাকে না থামালে বিশ্বজিৎ রাহার গুণকীর্তন শেষ হবে না। বিশ্বজিংকে শ্রদ্ধা করে বিনয়, ভালোবাসে। তিনি মার্কামারা রসকষহীন সরকারি আমলা এবং ম্যাজিস্ট্রেট নন, আগাগোড়া হৃদয়বান মানুষ। খুবই সহানুভূতিপ্রবণ। কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে যদি লা পোয়ে সমানে বলে যায়, আর বলতে বলতে সমুদ্রে গিয়ে মোটর বোটে উঠে পড়ে, তার কথাটাই জানানো যাবে না।
বিনয় লা পোয়ের বকবকানির মধ্যেই এক সময় বলে ওঠে, আমার একটা কথা ছিল–
এবার যেন বিনয় সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে লা পোয়ে। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হা-হা, বোলিয়ে।
আপনারা তো এই এলাকায় দশ পনেরো দিন থাকছেন?
হাঁ। সমুদরে চক্কর দিতে দিতে সিপি তুলতে হবে।
তারপর কোথায় যাবেন?
মিডল আন্দামানে।
আশায় উত্তেজনায় দুচোখ চকচক করে ওঠে বিনয়ের। সে জিগ্যেস করে, ওখানে কতদিন থাকবেন?
লা পেয়ে জানায়, গভগ দো হপ্তা। ওখানে গিয়ে সিপি তুলব।
গলা নামিয় বিনয় জিজ্ঞেস করে, আপনি কি জানেন মিডল আন্দামানে কোথায় কোথায় রিফিউজিদের সেটেলমেন্ট বসছে?
লা সোয়ের অহমিকায় বুঝি বা একটু বাঁধল। সে বলে, লগভগ তিশ সাল ইস জাজিরামে (দ্বীপপুঞ্জে) গুজর গেল। এখানকার না জানি কী? আমার আঁখকে ফাঁকি দিয়ে আন্দামানে কুছু হতে পারে না।
কতগুলো সেটেলমেন্ট বসছে?
একটু ভেবে লা পেয়ে জানায়, সবে মধ্য আন্দামানে উদ্বাস্তুদের উপনিবেশ পত্তনের কাজ শুরু হয়েছে। খুব সম্ভব তিনটে কি চারটে কলোনির জন্য জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। পাকিস্তানের। দু-তিন শো ফ্যামিলিকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লা পোয়ে খবর পেয়েছে, জাহাজ বোঝাই করে আরও অনেক উদ্বাস্তু আসবে। তাদের জন্য আরও জঙ্গল নির্মূল করা হবে, ইত্যাদি।
যেসব তথ্য লা পোয়ের কাছে পাওয়া গেল সেগুলো নতুন কিছু নয়, এই মুহূর্তে যেমন জরুরিও নয়। আগেই বিভাস নিরঞ্জন এবং বিশ্বজিৎ রাহার কাছে সে শুনেছে। একটু চুপ করে থেকে বলল, রাহাসাহেব বলে দিয়েছেন সময় পেলে আপনাদের বোটে করে ঘুরব।
হা-হা এই তো বললেন, দশ মিনিটও হয়নি। আমার ইয়াদ আছে। যেদিন বলবেন আপনাকে বোটে তুলে আমাদের কামকাজ দেখাব।
সে তো দেখবই। আমার একটা কথা রাখতে হবে কিন্তু।
হা-হা জরুর। আপনি বড়ে সাহাবের দোস্ত, আমাদের জাজিরার মেহমান। যা বলবেন তা-ই করব।
আপনারা দুসপ্তাহ পর যখন মিডল আন্দামানে যাবেন আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে।
কোই বাত নেহি। আলবত নিয়ে যাব।
আপনাদের কাজ তো দেখবই। মিডল আন্দামানে যেখানে যেখানে রিফউজি কলোনি বসছে সেই সব জায়গাতেও কিন্তু নিয়ে যেতে হবে।
ওখানকার সেটেলমেন্ট নিয়ে আপনাদের আখবরে লিখবেন বুঝি?
মূল উদ্দেশ্য দুটো। পুনর্বাসন নিয়ে লেখালেখি তো আছে ই, ঝিনুককে খুঁজে বার করাটা কম জরুরি নয়। বরং এই মুহূর্তে অনেক বেশি প্রয়োজন। যে মেয়েটা সেই কোন ছেলেবেলা থেকে তার জীবনে শ্বাসবায়ুর মতো জড়িয়ে আছে তাকে রস আইল্যান্ডে দেখার পর থেকে বুকের ভেতরটা কতখানি উতলা হয়ে রয়েছে সেটা শুধু সে-ই জানে।
লা পোয়েকে কাগজে লেখার কথাই শুধু বলল বিনয়। ঝিনুকের ব্যাপারটা পুরোপুরি গোপন রাখল। বিশ্বজিৎ বলেছিলেন, তাকে অবশ্যই মিডল আন্দামানে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। করতেনও। সেজন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে। কিন্তু অযাচিতভাবে এই সেল কালেক্টরগুলো এসে পড়েছে। এতবড় একটা সুযোগ কোনওক্রমেই হাতছাড়া করা যাবে না।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, মিডল আন্দামানে তো এক সপ্তাহ থাকবেন। তারপর?
লা পোয়ে বলল, ফির সাউথ আন্দামানে এসে সিপি তুলব। সে বুঝিয়ে দেয়, এইভাবে কয়েকদিন দক্ষিণ আন্দামান, কয়েকদিন মধ্য আন্দামানে ঘুরে ঘুরে তারা পুরো সিজন ধরে সমুদ্রের তলা থেকে শঙ্খ কড়ি টার্বো ট্রোকাসনটিনাস ইত্যাদি তুলে আনে। বিনয় বলল, ওখানে কলোনি বানানো হচ্ছে। নিশ্চয়ই সেসব কাজ দেখাশোনার জন্য সরকারি ক্যাম্প অফিস বসেছে।
জি, হাঁ। আমি ওখানকার সি এ-কে (কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট) চিনি। নাম বিজয় জেয়ারদার। বহুৎ আচ্ছা আমি।
বিনয় উৎসাহিত হয়ে ওঠে, শুধু মধ্য আন্দামানে গেলেই তো হয় না। গেলাম, গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুকের সন্ধান পেয়ে যাব তা তো আর হয় না। খোঁজাখুঁজি করতে দু-চার দিন কি তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। সেখানে থাকবে কোথায়? জেফ্রি পয়েন্টের ক্যাম্প অফিসের মতো ওখানকার ক্যাম্প অফিসই একমাত্র ভরসা। লা পোয়ে জানিয়েছে বিজয় জোয়ারদার মানুষটি ভালো। কিন্তু তার মতো অচেনা উটকো লোককে সে কি ক্যাম্প অফিসে থাকতে দেবে?
বিনয় বলল, আমাকে কিন্তু বিজয় জোয়ারদারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে।
লা পোয়ে মাথা হেলিয়ে দেয়।জরুর।
একটু ভেবে বিনয় বলল, আমি ওখানে কয়েকদিন থাকতে চাই। ওরা থাকতে দেবে কি?
এর চেয়ে বিস্ময়কর কথা আগে আর বুঝি কখনও শোনেনি লা পোয়ে। দুচার লহমা হা করে তাকিয়ে থাকে সে। তারপর যা বলে তা এইরকম। বিনয় রাহা সাহেবের দোস্ত, আখবরে কাজ করে, এসব শোনার পর তাকে মাথায় করে রাখবে বিজয় জোয়ারদার। চিন্তার কারণ নেই।
বিনয়ের দুর্ভাবনা কেটে যায়। সে বলে, আপনারা সিপি তুলবেন, আমি আমার কাজ সারব। তারপর আমাকে আবার এই জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে দিয়ে যেতে হবে।
আলবত।
কথায় কথায় ওরা বিচে চলে এসেছিল। লা পেয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে সেলাম ঠুকে বলল, আজ আমরা যাই। দশ-পন্দ্র রোজ বাদ এসে আপনাকে নিয়ে যাব।
বিনয় মাথা কাত করে একটু হাসে। বিশ্বজিৎ রাহার বন্ধু হওয়ার কারণে আন্দামানের লোকজন তাকে যথেষ্ট খাতির করছে।
লা পোয়েরা সমুদ্রের জলে নেমে তাদের মোটর বোটে নিয়ে ওঠে। আর বিনয় ফিরে আসতে থাকে।
ক্যাম্প অফিসের কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেছে; কোত্থেকে পরিতোষ দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির। বলল, আপনে সকালের খাওয়া খান নাই। আপনেগো ঘরে পাঠাইয়া দিমু?
ঘুমভাঙার পর সমুদ্রে মুখ ধুতে গিয়েছিল বিনয়, তারপর লা পোয়েদের সঙ্গে দেখা, তাদের নিয়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে দেখা করানো, নানারকম কথাবার্তা, এসবের মধ্যে বেলা অনেকটা চড়ে গিয়েছিল। খাওয়ার কথা একেবারেই খেয়াল ছিল না।
যে কদিন জেফ্রি পয়েন্টে বিনয় থাকবে তার সুবিধা-অসুবিধার দিকে পরিতোষকে নজর রাখতে বলেছিলেন বিশ্বজিৎ। যতটা সম্ভব বিনয়ের স্বাচ্ছন্দ্যের যেন ব্যবস্থা করা হয়। পরিতোষ সেটা ভোলেনি, অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। সকালে সবার খাওয়া হয়ে গেছে, শুধু বিনয়ই খেতে আসেনি। সেটা লক্ষ রেখেছিল পরিতোষ।
বিনয় বিব্রতভাবে বলল, নানা, পাঠাতে হবে না, আমি নিজে গিয়ে খেয়ে আসছি।
ক্যাম্প অফিসের সামনে যেখান থেকে উদ্বাস্তু এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের চারবেলা খাবার দেওয়া হয়, সেখানে চলে এল বিনয়। জায়গাটা প্রায় শুনশান। দুচারজন মুখ চেনা কৰ্মী ছাড়া অন্য কেউ নেই। পরিতোষ ব্যস্তভাবে তাদের বলল, বিনয়বাবুর খাওন হয় নাই। তেনারে খাইতে দাও।
সকালের খাবার হল হাতে-গড়া রুটি-তরকারি আর চা। কোনও কোনওদিন চিড়ে-গুড়-টুড়। আজ রুটি হয়েছিল। শালপাতার থালায় খাবার সাজিয়ে বিনয়কে দেওয়া হল।
তাড়াহুড়ো করে খাওয়া সেরে বিশ্বজিতের ঘরে এসে কালকের সেই লেখাটা নিয়ে বসে পড়ল সে। প্রতিবেদনটা শেষ করতে করতে ঘণ্টাদেড়েক লেগে গেল। সেটা একটা খামে পুরে মুখ আঠা দিয়ে আটকে দিল। খামের ওপর প্রসাদের নাম-ঠিকানা লিখে দিল।
আগেও দুটো প্রতিবেদন এবং সুধা আর আনন্দকে চিঠি লিখে খামে ভরে রেখেছিল। তিনটে প্রতিবেদন এবং দুখানা চিঠি–সব মিলিয়ে পাঁচটা খাম।
লেখালেখি শেষ হতে সূর্য মাথার ওপর সরাসরি উঠে এল। আর তখনই নানা মানুষের গলা কানে আসতে লাগল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিনয় দেখতে পায়, উদ্বাস্তু এবং পুনর্বাসনের কর্মীরা জঙ্গল থেকে ফিরে আসছে। সবাই একসঙ্গে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ফলে যে শব্দপুঞ্জের সৃষ্টি হচ্ছে সেটা লক্ষ কোটি মাছির ভনভনানির মতো শোনাচ্ছে। বিনয় বুঝতে পারে এ বেলার মতো জমি বিলি শেষ। চান-খাওয়া এবং খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেবার পর ওবেলা ফের সবাই জঙ্গলে গিয়ে দ্বিতীয় দফার কাজ শুরু করবে।
বিশাল জনতার সামনের দিকে রয়েছেন বিশ্বজিৎ। তিনি সোজা ঘরে চলে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কি লেখা শেষ?
বিনয় জানায়, এইমাত্র শেষ করলাম। চিঠি এবং রিপোর্টের থামগুলো আলাদা আলাদা করে রেখে দিয়েছি।
ফাইন। আমাকে দিন। সুটকেসে ভরে ফেলি।
.
চান-খাওয়া চুকিয়ে ঘণ্টা দেড়েক জিরিয়ে নিলেন বিশ্বজিৎ। এর মধ্যে একটা লম্বা ফর্দ দিয়ে গিয়েছিল পরিতোষ। এখানকার ভঁড়ার প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বুড়োধুড়ো বাচ্চাকাচ্চা, যুবকযুবতী ইত্যাদি নানা বয়সের কয়েকশো ছিন্নমূল মানুষ ছাড়াও রয়েছে। পুনর্বাসন এবং বনবিভাগের কর্মীরা। এতগুলো লোকের জন্য রোজ চারবেলা চুলো ধরাতে হবে। হিসেব করে পনেরো দিনের মতো চালডাল সবজি তেল মশলা চা চিনি গুঁড়ো দুধ, এমনি কতটা করে দরকার লিখে দিয়েছে পরিতোষ। রসদ ফুরবার দু-চার দিন আগে আবার পোর্ট ব্লেয়ারে নতুন তালিকা পাঠিয়ে দেবে সে। বেলা পড়ে এলে বিশ্বজিৎ তাঁর জিপে উঠে পড়লেন। সঙ্গে গেল বিভাস আর নিরঞ্জন। বিনয়, পরিতোষ এবং দু-তিনজন কর্মী। ওদের সঙ্গে সঙ্গে জিপটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেই পর্যন্ত গেল। বাকি সবাই জঙ্গলে আগেই চলে গিয়েছিল। জমি বিলির কাজ একবেলার জন্যও বন্ধ রাখা যাবে না। বিশ্বজিতের কড়া নির্দেশ দশ দিনের ভেতর মাপজোক করে সীমানা বরাবর বাঁশের খুঁটি পুঁতে প্রতিটি উদ্বাস্তু পরিবারকে বরাদ্দ জমি বুঝিয়ে দিতে হবে। কোনওরকম ঢিলেমি বরদাস্ত করা হবে না। দশ মানে দশ দিনই। তার বেশি একদিনও যদি দেরি হয় তার ফলাফল হবে মারাত্মক। পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা হাড়ে হাড়ে জানে রাহাসাহেব কী ধরনের জবরদস্ত অফিসার। এক সময় ড্রাইভার স্টার্ট দিল। বিশ্বজিৎদের গাড়িটা পাহাড়ের গা বেয়ে পেঁচানো রাস্তায় পাক খেতে খেতে একটা বাকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
২.০৬ বিশ্বজিৎ চলে যাবার পর
বিশ্বজিৎ চলে যাবার পর দিন তিনেক কেটে গেছে। এর মধ্যে বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষ তো বটেই, ছোট মাঝারি গাছগুলোর নামও ধনপতের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে বিনয়। শুধু তা-ই না, ঝোঁপঝাড় লতাগুল্ম সবই চিনিয়ে দিয়েছে ধনপত। সেই কতকাল আগে কালাপানির সাজা খাটতে এখানে এসেছিল সে। বনবিভাগে চেনম্যানের কাজ নিয়ে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরতে ঘুরতে আন্দামানের আদিম অরণ্যের নাড়িনক্ষত্র জেনে গেছে সে।
সেই সকাল থেকে বনদপ্তরের একদল কর্মী প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড করাত দিয়ে বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষ যেমন দিদু চুগলুম প্যাডক বা ঝাড়ালো রেনট্রি গুলো কেটেই চলেছে, কেটেই চলেছে। সমস্ত বনভূমি জুড়ে আওয়াজ উঠছে– ঘসর ঘস, ঘসর ঘস।
অন্যদিকে জমি মেপে উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিলির কাজও চলছে পুরোদমে। যারা যারা জমি পেয়েছে তারা কোদাল দা করাত ইত্যাদি হাতিয়ার দিয়ে ঝোঁপঝাড় ছোট গাছ টাছ নির্মূল করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। যার নামে জমি দেওয়া হল সে-ই শুধু নয়, তার ফ্যামিলির সবাই ছেলেমেয়ে বউ তার সঙ্গে হাত লাগিয়েছে। সব চেয়ে বেগ দিচ্ছে উদ্দাম জলডেঙ্গুয়া। অর্থাৎ বনতুলসীর ঝাড়গুলো। সেগুলোর শিকড় মাটির গভীরে বহুদূর অবধি ছড়িয়ে আছে। উপড়ে ফেলা কি মুখের কথা!
সেদিন যে চারটে হাতি নিয়ে তিরুর থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আজীব সিংরা এসেছিল তারাও হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। এখানে পৌঁছুবার পরদিন থেকেই হাতিগুলোকে সে এবং তার সঙ্গীরা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।
যে মস্ত মস্ত ট্রাকে চাপিয়ে হাতিগুলো আনা হয়েছিল সে দুটো ব্যারাকগুলোর ডান পাশে, খানিকটা দূরে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপর ট্রাকের পেছন দিকটা খুলে একটা কংক্রিটের ঢালু পাটাতন মাটিতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যেসব বড় গাছ আগেই কাটা হয়েছিল সেগুলোর খণ্ড খণ্ড গুঁড়ি, মোটা মোটা ডাল চারিদিকে উঁই করে রাখা আছে।
দুই মাহুত জিভ দিয়ে অদ্ভুত টকাস টকাস শব্দ করতেই তাদের দুই হাতি থামের মতো ভারী ভারী পা দিয়ে ধাক্কা মারতে মারতে ট্রাকের পাটাতন অবধি নিয়ে আসছে; তারপর গুঁড়ে পেঁচিয়ে পাটাতনের মসৃণ গড়ানে গায়ের ওপর দিয়ে ঠেলে ঠেলে ট্রাকে তুলে দিচ্ছে। ট্রেনিং পাওয়া শিক্ষিত হাতি। মাহুতের জিভের আওয়াজে কী সংকেত থাকে, সেটা নিমেষে তারা বুঝে ফেলে। বিনয় লক্ষ করেছে ট্রাক দুটো বোঝাই হলেই ড্রাইভার আর বনদপ্তরের চারজন কর্মী সে দুটো নিয়ে চলে যাচ্ছে। সে শুনেছে। সরকারি করাতকলে গাছের গুঁড়িটুড়ি পৌঁছে দিয়ে তারা ফিরে আসছে। এভাবে দুখেপ তারা গেল এবং এল। যতদিন গাছ কাটা হবে লরিগুলোকে যাতায়াত করতেই হবে।
দুটো হাতি গাছের গুঁড়ি ট্রাকে তোলে। বাকি দুটোর কাজ অন্যরকম। যেসব বড় গাছ কাটার পর শিকড়বাকড় সমেত খানিকটা অংশ মাটির ওপরে এবং নিচে থেকে গেছে সেগুলোও তাদের দিয়ে পুরোপুরি উপড়ে ফেলা হচ্ছে। পদ্ধতিটা এইরকম। কেটে ফেলার পর মাটির ওপরে তিন-চার হাত অংশটা থাকছে তাতে মোটা বঁড়শির মতো লোহার মস্ত হুক ঢুকিয়ে তার সঙ্গে স্টিলের শিকল আটকে হাতির গলায় সেই শিকলের একটা দিক বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। তারপর সহিস জিভ চকচক করে সুরেলা আওয়াজ করে চলেছে। এই শব্দটাও সংকেত। হাতি দুটো প্রবল শক্তিতে টানাটানি করে শিকড়টিকড় নিয়ে গাছের শেষ অংশটা তুলে ফেলছে। সেগুলো ট্রাকে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
জেফ্রি পয়েন্টের পাহাড় সমুদ্র এবং দুর্গম অরণ্যে ঘেরা এই এলাকাটা জুড়ে সকাল থেকে সন্ধের আগে পর্যন্ত তুমুল কর্মকাণ্ড চলছে। দক্ষিণ আন্দামানের এমন একটা এলাকায় নতুন সেটেলমেন্ট গড়ে তোলা কি সহজ কাজ!!
বিনয় রোজ সকালে রিহ্যাবিলিটেশনের কর্মী এবং উদ্বাস্তুদের সঙ্গে জঙ্গলে চলে যায়। জমি মাপামাপি দেখে। দুপুরে সবার সঙ্গে ফিরে চান-খাওয়া এবং বিশ্রাম। তারপর আবার জঙ্গলে গিয়ে ঢাকা। দিনের আলো যতক্ষণ থাকে সেখানেই কাটিয়ে আসে। রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্বজিতের ঘরে এসে সারাদিনে যা-যা দেখল তার প্রতিবেদন লিখতে বসে।
বিশ্বজিৎ পোর্ট ব্লেয়ার চলে গেছেন। পুরো ঘরখানা এখন একা বিনয়ের দখলে।
ওধারে ব্যারাক দুটোর সামনের দিকে মস্ত ফাঁকা চত্বরটায় কাঠের মোটা মোটা অগুনতি খুঁটি পুঁতে তার ওপর চেরা বাঁশের পাটাতন বসিয়ে বিরাট মঞ্চ বানিয়েছে মোহনবাঁশিরা। শখানেক মানুষ সেখানে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে পারে।
রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া চুকলে মোহনবাঁশি সহদেবরা একতারা দোতারা সারিন্দা, এমনি সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আজকাল রোজই গানবাজনার আসর বসাচ্ছে।
বিশ্বজিতের ঘরে বসে রিপোর্ট লিখতে লিখতে গান শোনে। বিনয়। এই নির্জন দ্বীপ মায়াবী সুরের দোলায় যেন অলীক কোনও স্বপ্নের দেশ হয়ে ওঠে। কী ভালো যে লাগে বিনয়ের।
.
বিশ্বজিৎ চলে যাবার তিন দিন বাদে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সবার সঙ্গে রোজকার মতো জঙ্গলে গেছে বিনয়। পুরোদমে কাজ চলেছে চারদিকে। হঠাৎ গাড়ির আওয়াজে ডান দিকে তাকায় সে। ওধারে উপত্যকার তলায় উদ্বাস্তুদের জন্য লম্বা লম্বা ব্যারাক আর সেটেলমেন্টের ক্যাম্প অফিস। সে সবের পেছন দিকে পাহাড়।
বিনয় দেখতে পেল, একটা জিপ পাহাড়টার গা বেয়ে নেমে আসছে। বিশ্বজিৎ বা পুনর্বাসন দপ্তরের অন্য কোনও অফিসারের তো আজ আসার কথা নয়। তারা এলে কলোনাইজেশন অ্যাসিস্টান্ট পরিতোষ বণিককে আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। পরিতোষের সঙ্গে প্রায় সারাক্ষণই তো কাটে বিনয়ের। কেউ আসবেন, এমন খবর পেলে সে নিশ্চয়ই জানিয়ে দিত। কে আসতে পারে তাহলে?
বিনয় লক্ষ করল, জিপটা ক্যাম্প অফিসের সামনে এসে থামল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তাঁর বয়স তিপ্পান্ন-চুয়ান্নর মতো। মাঝারি হাইট। মাথায় কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল, চোখে চশমা। পরনে পাজামা এবং খাটো ঝুলের শার্ট। দূর থেকে এর বেশি আর কিছু বোঝা গেল না।
ক্যাম্প অফিসের কাছাকাছি দু-তিনজন কর্মী কী করছিল, তারা দৌড়ে বয়স্ক লোকটির কাছে চলে এল। তাদের সঙ্গে দু-এক মিনিট কী কথা বললেন, তারপর জঙ্গলের দিকে লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কর্মী দুটি তার পিছুপিছু আসছিল। তিনি হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিলেন। বোঝা গেল, তিনি একাই। জঙ্গলে আসতে চান, পথ দেখাবার জন্য কারওকে দরকার নেই।
কর্মী দুজন আর এগুল না। মাঝবয়সি লোকটি সোজা জঙ্গলে চলে এলেন।
তাঁকে দেখে আমিন লাডিন, চেনম্যান ধনপত এবং পুনর্বাসনের অন্য কর্মীরা কাজকর্ম ফেলে দৌড়ে এল। সসম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে কেউ বলল, সালাম, কেউ বলল, নমস্তে- কেউ বলল, আপকা তবিয়ত ঠিক হ্যায় তো?
মধ্যবয়সি মানুষটি যে সামান্য লোক নন, লা ডিনদের সসম্ভ্রমে কথা বলতে দেখে সেটা আন্দাজ করতে পারছিল বিনয়।
কাছাকাছি আসায় মানুষটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রোগা, ক্ষয়াটে চেহারা, গাল ভাঙা, হাতের শিরাগুলো প্রকট। কণ্ঠার হাড় চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। আরও একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। তাঁর দুই হাতের কবজিতে মোটা কালচে দাগ। অনেকদিন হাতে গোলাকার ধাতুর জিনিস পরিয়ে রাখলে যেমন হয়, ঠিক সেইরকম আর কী।
মধ্যবয়সী, দেখা গেল, সবাইকে চেনেন। প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে জিগ্যেস করলেন, তুমি কেমন আছ লা ডিন? তুমি কেমন আছ ধনপত? ইত্যাদি।
সবাই জানায়, মাঝবয়সির মেহেরবানিতে তারা ভালোই আছে।
বয়স্ক মানুষটি বললেন, কাজ বন্ধ করে গল্প নয়। তোমরা যাও। পরে কথা হবে।
লা ডিনদের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর চোখ বারবার বিনয়ের দিকে চলে যাচ্ছিল। ভিড়টা হালকা হয়ে। গেলে তিনি এগিয়ে এলেন। একটু হেসে বললেন, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তুমি নিশ্চয়ই বিনয়। কলকাতার কাগজের রিপোর্টার?
বিনয় অবাক। বলল, আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?
আগে আমাদের কখনও দেখা হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
না, হয়নি। তবু তোমার কথা আমি জানি। আমার নাম শেখরনাথ রাহা; হয়তো নামটা শুনেছ। আমি বিশ্বজিতের কাকা। বিশুর কাছে তোমার কথা শুনেছি।
বোঝাই যায় বিশ্বজিতের ডাকনাম বিশু। এই মানুষটি ইংরেজ রাজত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। তারপর দ্বীপান্তরী সাজা দিয়ে তাঁকে আন্দামানে পাঠানো হয় উনিশশো পঁচিশে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে কত বিপ্লবী ভারতের মেনল্যান্ডে ফিরে গেছেন কিন্তু শেখরনাথ ফেরেননি। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জেই থেকে গেছেন।
সাভারকার, উল্লাসকর দত্ত থেকে শেখরনাথ পর্যন্ত কত বিপ্লবীর নামই তো শুনেছে বিনয়। এঁরা সবাই পরমাশ্চর্য রূপকথার সব নায়ক। অসমসাহসী, আদর্শবাদী, আদ্যোপান্ত দেশপ্রেমিক। ভারতকে স্বাধীন করাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। যে ইংরেজদের রাজত্বে কোনওদিন সূর্যাস্ত হত না সেই বিপুল অপরাজেয় শক্তির বিরুদ্ধে দুর্জয় মনোবলে এঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যু এঁদের কাছে ছিল নেহাতই ছেলেখেলার জিনিস। মহা কৌতুকে তিন তুড়িতে মৃত্যুর চিন্তাকে তারা উড়িয়ে দিতেন। বিচারক যাবজ্জীবন কারাবাস মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলে এঁরা হেসে হেসে গড়িয়ে পড়তেন। যেন এরচেয়ে মজার কথা ভূভারতে কেউ কোনওদিন শোনেনি।
এইসব মরণজয়ী বিপ্লবীদের একজন শেখরনাথ। মেনল্যান্ডে সত্যাগ্রহ করে জেল খেটেছে, এমন কয়েকজনকে আগে দেখেছে বিনয় কিন্তু কালাপানি পার হয়ে সেলুলার জেলে বন্দি ছিল, এমন কারও সঙ্গে কথাও হয়নি। অবাক বিস্ময়ে শেখরনাথের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরন; গায়ে যেন কাটা দিচ্ছিল তার।
বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগল। তারপর ঝুঁকে শেখরনাথের পা ছুঁতে যাচ্ছিল। শেখরনাথ তার দুধ ধরে তুলে। ধরে হেসে হেসে বললেন, থাক থাক। পায়ে ধুলো-ময়লা লেগে আছে। হাত দিলে নোংরা লেগে যাবে।
বিনয় বলল, বিশ্বজিৎবাবুর মুখে শুনেছিলাম, খুব শিগগিরই আপনি এখানে আসবেন। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। রোজই ভাবি, এই বুঝি এলেন।
বিশু বলেনি, আমি লিটল আন্দামানে গিয়েছিলাম।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, বলেছেন। সেই দ্বীপটা কত দূরে? পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ষাট-পঁয়ষট্টি মাইল হবে। ওটাই হল আন্দামানের সাদার্নমোস্ট আইল্যান্ড। ঔখানে কারা থাকে জানো?
না। আমি তো এই প্রথম আন্দামানে এসেছি। পোর্ট-ব্লেয়ারে নামার পরই তো জেফ্রি পয়েন্টে চলে এলাম। আর কোথাও যাবার সময়ই পাইনি।
তা ঠিক। লিটল আন্দামানে থাকে ওঙ্গেরা। আন্দামানের আদিম ট্রাইবদের একটা। এরা কালো কালো পিগমি। সাড়ে চার ফিটের মতো হাইট। সংখ্যায় কত জানো? মাত্র চারশো একান্ন। ক্রমশ এরা কমে আসছে। ভয় ছিল, হয়তো একদিন ট্রাইবটা আর থাকবে না। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ খবর পেলাম, ওদের দুটো বাচ্চা হয়েছে। শুনে ভীষণ আনন্দ হল, জেলেদের ট্রলারে চেপে চলে গেলাম। তাছাড়া যাবার আরও একটা কারণও ছিল।
বিনয় উৎসুক চোখে তাকিয়েই থাকে।
শেখরনাথ বলতে লাগলেন, হাজার হাজার ছোট কচ্ছপ সমুদ্র। সাঁতরে এই সময়টা লিটল আন্দামানে আর নিকোবরে বালির চড়ায় ডিম পাড়তে আসে। সে একটা আশ্চর্য দৃশ্য। একসঙ্গে এত কচ্ছপ, কল্পনাও করতে পারবে না। চোখ ফেরানো যায় না।
কচ্ছপের ঝাঁক দেখলেন?
দেখলাম তো।
এমন এক বিপ্লবী, যিনি বন্দুক পিস্তল হাতে ইংরেজ পুলিশের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করেছেন, তিনিই কিনা ওঙ্গেদের বাচ্চা আর কচ্ছপদের ডিম পাড়া দেখার জন্য জেলেদের ট্রলারে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেই কতদূরে চলে গিয়েছিলেন! বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না বিনয়ের। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় সে চকিত হয়ে ওঠে, আপনি যে ওঙ্গেদের ওখানে চলে গেলেন বিপদ হতে পারত তো?
একটু অবাক হয়েই শেখরনাথ জিজ্ঞেস করেন, কীসের বিপদ?
এখানকার ট্রাইবরা তো ভীষণ হিংস্র। তারা বিনয়কে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন শেখরনাথ। জানালেন ওঙ্গেরা খুবই নিরীহ। শান্ত। মাত্র কিছুদিন হল আগুন ব্যবহার করতে শিখেছে। তির দিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ শিকার করে আগুনে ঝলসে খায়। শেখরনাথ অনেকবার লিটল আন্দামানে গেছেন। তাকে দেখলে ওরা খুশি হয়।
হঠাৎ কয়েকদিন আগের সেই রাতের ভয়ংকর দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে আসে। বিনয় বলে, কিন্তু
কী?
এখানকার জঙ্গলে যে ট্রাইবটা আছে তারা কিন্তু ভীষণ হিংস্র।
তুমি জারোয়াদের কথা বলছ?
হ্যাঁ।
সেদিন রাতে আচমকা এই সেটেলমেন্টে হানা দিয়ে জারোয়ারা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল সেটা সংক্ষেপে জানিয়ে বিনয় বলল, রিফিউজিরা তো ওই ঘটনার পর জেফ্রি পয়েন্টে এক মুহূর্তও থাকতে চাইছিল না। পারলে সেই রাত্তিরেই সবাই কলকাতায়। ফিরে যায়। বিশ্বজিৎবাবু বিভাসবাবু নিরঞ্জনবাবুরা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের ঠান্ডা করেন।
একটু চুপ করে থাকেন শেখরনাথ। তারপর বলেন, জারোয়ারা ওঙ্গেদের মতো শান্তশিষ্ট নয়। ওরা খুবই উগ্র ধরনের। তার কারণও আছে।
বিনয় উৎসুক হল। কী কারণ?
শেখরনাথ বললেন, তুমি তো উদ্বাস্তুদের সঙ্গে এই খেপে কলকাতা থেকে এসেছ। প্রথমে রস আইল্যান্ডে নেমেছিলে। তারপর এসেছিল পোর্টব্লেয়ারের এবারডিন মার্কেটের সামনে। তাই তো? জারোয়াদের প্রসঙ্গে এসব কথা আসছে কেন! বুঝতে পারল না বিনয়। শুধু বলল, হ্যাঁ।
সেলুলার জেল তৈরি হবার আগে ইংরেজ পুলিশ প্রায় চল্লিশজন জারোয়াকে ধরে এনে গুলি করে মারে। সেই থেকে প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে উঠেছে ওরা। তারা চায় না, বাইরের থেকে সো কলড সভ্য জগতের কেউ এসে তাদের জঙ্গল পাহাড় দখল করে বসুক। অনেকদিনের সেই ঘটনা। কিন্তু জেনারেশনের পর। জেনারেশন তারা ক্রোধটা পুষে রেখেছে।
ইংরেজ পুলিশ জারোয়াদের খুন করেছিল কেন?
সেসব পরে শুনো। চল, সেটেলমেন্টের কাজ দেখি। সেই সঙ্গে তোমার কথাও শুনব। বিশু তোমার সম্পর্কে কিছু কিছু বলেছে, তবে আমি ডিটেলে সব শুনব।
কিন্তু তার আগে আপনার কথা শোনাতে হবে। সেই যে। বাইশ-তেইশ বছর আগে সেলুলার জেলে আপনাকে পাঠানো হল তখন থেকে
বিনয়কে থামিয়ে দিলেন শেখরনাথ।–তোমাকে নিয়ে সময় পেলেই একদিন সেলুলার জেলে যাব। তখন সব শুনো
সেলুলার জেল দেখতে যাবার কথা বিশ্বজিতের সঙ্গে আগেই হয়েছিল। চিফ রিপোর্টার প্রসাদদা, নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক তো বটেই নতুন ভারত-এর মালিক এবং সম্পাদক জগদীশ গুহঠাকুরতা বার বার বিনয়কে বলে দিয়েছিলেন, সেলুলার জেলের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ভারতবর্ষের বাস্তিল এই কুখ্যাত কারাগারের ইতিহাস, কী নির্মমভাবে কয়েদিদের, বিশেষ করে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালানো হত তা নিয়ে বিশদভাবে পাঁচ-সাতটা প্রতিবেদন যেন অবশ্যই পাঠায়।
সেলুলার জেলের ইতিহাস নিশ্চয়ই জানাতে পারবেন বিশ্বজিৎ, কিন্তু সেখানে নির্জন সেলে কাটানো এবং অকথ্য নিগ্রহ আর নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করার অভিজ্ঞতা তো তার নেই। সেই কষ্টকর, দুর্বিষহ জীবনের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিতে পারবেন শেখরনাথ। তার সময়ে আর কোন কোন বিপ্লবী সেখানে ছিলেন, ছিল কী ধরনের দুর্ধর্ষ খুনি ডাকাতের দল, সব জানা যাবে।
কুখ্যাত এই জেলখানা অপার রহস্যে ঘেরা। মেনল্যান্ডের মানুষজনের মনে এই কারাগার সম্পর্কে শুধুই ত্রাস আর আতঙ্ক। কত করম ভীতিকর জনশ্রুতি যে ভেসে বেড়াত। একজন বিপ্লবী যিনি জীবনের মহা মূল্যবান সময় অশেষ নির্যাতন সইতে সইতে এখানে ক্ষয় করে দিয়েছেন, তিনি তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাবেন, ভাবতেই স্নায়ুমণ্ডলীতে শিহরন খেলে যেতে থাকে বিনয়ের।
শেখরনাথ সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দূরের জঙ্গলে গাছ কাটা চলছে। ডানপাশে চলছে জমি মাপামাপি এবং বরাদ্দ জমির সীমানা বরাবর বাঁশের খুঁটি পোঁতার কাজ। আর যেধারে এর মধ্যেই জমি দেওয়া হয়ে গেছে সেই সব জায়গাতেও কাজ চলছে পুর্ণোদ্যমে। প্রতিটি উদ্বাস্তু পরিবারের লোকজন, দুধের শিশুরা বাদে, বুড়ো ধুড়ো মেয়েপুরুষ সবাই দা কোদাল। কুড়াল ইত্যাদি দিয়ে ঝোঁপঝাড়, ছোট-মাঝারি গাছ, জলডেঙ্গুয়ার। উদ্দাম জপল কেটে, উপড়ে সাফ করে ফেলছে।
প্রতিটি জমিতে গিয়ে ছিন্নমূল মানুষগুলোর সঙ্গে আলাপ করছেন শেখরনাথ। নিজের নাম জানিয়ে বলছেন, আমি তোমাদের কলোনির কর্তা বিশ্বজিতের কাকা। তোমার নাম কী?
যাকে জিগ্যেস করা হল, অচেনা প্রৌঢ়টি বিশ্বজিতের কাকা শুনে সসম্ভ্রমে বলে, আইজ্ঞা, বিন্দাবন সাহা
দেশ ছিল কোথায়?
বরিশাল। গেরামের নাম হরিশ্চন্দপুর।
দেশে কী করতে?
দোকানদারি। চাউল ডাইল মশল্লাপাতি বেচতাম। আন্ধারমানে জমি চষতে অইবে। ব্যাবসাদার থিকা চাষি বইনা গ্যালাম।
জমির পর জমি পেরিয়ে যান শেখরনাথ। তার পাশাপাশি হেঁটে চলেছে বিনয়।
শেখরনাথের প্রশ্নের উত্তরে উদ্বাস্তুরা কেউ জানায় তার নাম গণেশ পাল, বাড়ি ফরিদপুর, দেশে মাটির হাঁড়ি পাতিল বানাত, পুজোর মরশুমে গড়ত দুর্গা কালী সরস্বতীর মূর্তি। তারও খানিকটা আক্ষেপ, চোদ্দোপুরুষের কুলকর্ম ছেড়ে তাকেও কৃষক হতে হচ্ছে। দমদমের রিলিফ ক্যাম্পে পচে গলে মরার চেয়ে এ একরকম ভালোই।
কেউ বলল তার নাম রাধেশ্যাম কুণ্ডু, দেশ ছিল ঢাকা, গ্রাম মেদিনীমণ্ডল, পাইকারদের কাছ থেকে ধান চাল কিনে নিয়ে গঞ্জে বেচত। খুবই নগণ্য কারবারি কেউ ক্ষৌরকার বা নাপিত, সাবেক দেশ নোয়াখালি। কেউ ধোপা তার দেশ ছিল বগুড়া। খুলনা যশোরের দুজন রয়েছে, তারা দেশে বরজে পানের চাষ করে সংসার চালাত। এমনি নানা পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। তবে বেশিরভাগই কৃষিকর্ম করে এসেছে পুরুষানুক্রমে। ফলাত ধান, পাট, নানা ধরনের রবিশস্য।
উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আলাপ করার ফাঁকে ফাঁকে বিনয়ের সঙ্গেও কথা বলছেন শেখরনাথ। স্বাধীনতার চেহরাটা কেমন দেখছ বিনয়? বলে ভুরুদুটো ওপর দিকে তুললেন।
তিনি কী ইঙ্গিত দিয়েছেন মোটামুটি তা আন্দাজ করতে পারছিল বিনয়। তবে উত্তর দিল না।
শেখরনাথ বলতে লাগলেন, এই যে মানুষগুলো চোদ্দো পুরুষের ভিটেমাটি খুইয়ে সমুদ্র পেরিয়ে এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, এমনটা কি ওরা কোনওদিন ভাবতে পেরেছিল? এ কেমন স্বাধীনতা যার জন্যে নিজের দেশ থেকে উৎখাত হতে হবে? হঠাৎ কী খেয়াল হতে একটু চুপ করে থেকে এবার বললেন, আরে কাকে কী বলছি! বিশুর কাছে শুনেছি, তুমিও তো মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে চলে এসেছ। যন্ত্রণাটা কতখানি তা তুমি জানো।
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।
শেখরনাথ থামেননি, আন্দামানে যে কয়েকশো ফ্যামিলি এসেছে, আরও হাজারখানেক ফ্যামিলি আসবে–এরা হয়তো চাষ। আবাদ করে বেঁচে যাবে। কিন্তু কলকাতায় আর পশ্চিমবাংলার নানা জায়গায় রিলিফ ক্যাম্পে, রাস্তায়, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যে লাখ লাখ মানুষ পোকামাকড়ের মতো পড়ে রয়েছে তাদের কী হবে? পশ্চিমবাংলা কতটুকু স্টেট? তেত্রিশ হাজার স্কোয়ার মাইলের মতো এরিয়া। সেখানে এত লোকের জায়গা হবে কোথায়? কী হবে এদের ভবিষ্যৎ?
তিনি আরও যা বললেন তা এই রকম। ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষদের জন্য কিছু জমি দিতে চেয়েছে। কিন্ত কতটা জমি? কতজনের সেখানে পুনর্বাসন হবে? আসামে তো বহু উদ্বাস্তু চলে এসেছে। তাদের অনেককে খেদিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সব বিতাড়িত অসহায় মানুষ এসে ভিড় জমাচ্ছে কলকাতায়, নর্থবেঙ্গলে। বিহার ওড়িশায় যারা যাবে তাদেরও যদি কোনওদিন তাড়ানো হয়?
শেখরনাথ বললেন, লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে উৎখাত করে এই স্বাধীনতা এসেছে। পাঞ্জাবের সমস্যাটার সমাধান হয়ে যাবে। ওখানে টোটাল এক্সচেঞ্জ অফ পপুলেশন হয়ে গেছে। এখানকার মুসলমানদের ফেলে যাওয়া জমিতে এসে বসেছে ওপারের শিখ। আর জাঠেরা। ওপারের ফেলে আসা জমিতে গিয়ে বসেছে। এপারের পাঞ্জাবি মুসলমানরা। জমির জন্যে, পুনর্বাসনের জন্য ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়ায় কোনও সমস্যা নেই। তাছাড়া তাদের জন্য দরাজ হাতে টাকা ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। আর বাঙালিদের জন্যে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের হাত বড়ই কৃপণ। মুঠি খুলতেই চায় না। বলতে বলতে কণ্ঠস্বর তিক্ত হয়ে ওঠে, স্বাধীনতার স্বাদটা কেমন, বুঝতে পারছ? এই স্বাধীনতার জন্যেই কি হাজার হাজার সোনার ছেলে জেলের ঘানি ঘুরিয়েছে, ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছে?
একটু চুপচাপ।
তারপর শেখরনাথ বলেন, চুক্তিতে সই করে, দেশটাকে কেটেকুটে স্বাধীনতা এলে তার চেহারাটা কেমন হয় তা তো দেখতেই পাচ্ছ। মুক্তি সংগ্রামীদের এত আত্মত্যাগ সব বৃথাই গেল। ক্ষোভে, বেদনায় তার গলা বুঝে এল।
বিনয় অবাক হয়ে যাচ্ছিল। মেনল্যান্ড থেকে প্রায় হাজার মাইল দুরের এই দ্বীপপুঞ্জে থেকেও দেশের কত খবর রাখেন এই মানুষটি।
কথায় কথায় ওরা পশ্চিম দিকের শেষ জমিটায় এসে পড়ল। এরপর গভীর জঙ্গল। সেই জঙ্গল সাফ হলে আবার কিছু উদ্বাস্তুকে ভাগ করে দেওয়া হবে।
শেষ জমিটায় আসতেই চোখে পড়ল একটি যুবক, তিরিশের বেশি বয়স হবে না, ঢ্যাঙা, রোগাটে চেহারা, লম্বা ধরনের মুখ ধারালো বার্মিজ দা দিয়ে ঝোঁপঝাড় কাটছিল। একটা যুবতী, কপালে সিঁথিতে সিঁদুর, মাথায় ঘোমটা নেই–সেও দা দিয়ে বুনো লতা কেটে একধারে জড়ো করছে। এছাড়া আর কেউ নেই। তাদের দুজনকে নিয়েই খুব সম্ভব একটা ডি. পি (ডিসপ্লেসড) ফ্যামিলি।
বিনয়দের দেখে যুবকটি কাছে এগিয়ে আসে। বিনয়কে সে চেনে কিন্তু শেখরনাথ তার অপরিচিত। সে হাত জোড় করে বিনয়কে নমস্কার করে, শেখরনাথের দিকে তাকায়।–আপনারে তো চিনতি ফারলাম না।
বিনয় পরিচয় করিয়ে দিতে সে ঝুঁকে শেখরনাথের পা ছুঁয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনে বড় সারের কাকা। আপনেরে দেখে। বড় আনন্দ হতিচে। আমাগের নয়া কুলোনি দেখতি আসিছেন?
মাথা নাড়িয়ে শেখরনাথ বললেন, হ্যাঁ। তারপর জিগ্যেস করলেন, তোমার নাম কী?
ছিষ্টিধর বারুই।
দেশ ছিল কোথায়?
আইজ্ঞে, খুইলনে জিলা। গেরাম নেহেরপুর।
পাকিস্তান থেকে কতদিন আগে ইন্ডিয়ায় এসেছ?
তা হবে নে, বছর দেড়-দুই।
ছিলে কোথায়?
কলকেতায় এইসে ছয়-আট মাস শিয়ালদার ইষ্টিশানে। তার পরি (তারপর) কেম্পে। কেম্প থিকে বাবুরা আমাগেরে আন্ধারমান দ্বীপি আনিছে।
শেখরনাথ কী বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার নজরে পড়ল লতাটতা কাটা বন্ধ করে বউটি বসে বসে হাঁফাচ্ছে। সে গর্ভবতী। বাচ্চার জন্ম হতে বেশি দেরি নেই। সারা মুখে দানা দানা ঘাম। ঘামে ভিজে গেছে জামা। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়ছে।
বিনয়ের মতো ওদের দুজনের সম্পর্কটা আন্দাজ করে নিয়েছিলেন শেখরনাথও। ধমকের সুরে বললেন, বউয়ের এই অবস্থা। তাকে জমিতে খাটাতে নিয়ে এসেছ? মরে যাবে যে।
অপরাধী অপরাধী মুখ করে ছিষ্টিধর অর্থাৎ সৃষ্টিধর বলে, কী করবা নে সার? সরকারি বাবুরা বড় বড় গাছ কাটি দেছেন। ছোট ছোট জঙ্গল সাফ না করতি পারলে জমিন বারোবে (বেরুবে) ক্যামনে? ক্যাশ ডোল তো একদিন বন্ধ হয়ি যাবে। চাষবাস করতি না পারলে না খেয়ি মরতি হবে নে।
শেখরনাথ ভীষণ রেগে গেলেন। গলার স্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে বললেন, আর কক্ষনো বউকে জমির কাজে লাগাবেনা। ওর এখন বিশ্রাম দরকার।
ঢোক গিলে সৃষ্টিধর বলে, কিন্তুক সার, আমার ফেমিলিতে তো আর কেউ নাই। ক্যামন করি এত বড় জঙ্গল সাফা করব?
পরিতোষকে বলব একটা লোক দিতে। সে-ই তোমার সঙ্গে সাফসুফ করবে। যদি বাড়তি লোক পরিতোষের হাতে না থাকে, আমিই কাজে লেগে যাব।
লম্বা জিভ কেটে সৃষ্টিধর বলল, অমন কথা কতি নাই। আমার পাপ হবা। যা পারি আমি একাই করতি চ্যাষ্টা করব।
এ নিয়ে আর কিছু বললেন না শেখরনাথ। জিগ্যেস করলেন, বউকে ডাক্তারবদ্যি দেখিয়েছ?
এই জঙ্গুলি ডাক্তারবদ্যি কোয়ানে (কোথায়) পাবানে (পাব)?
একটু ভেবে শেখরনাথ বললেন, আজ আর কাজ করতে হবে না। বউকে নিয়ে চলে যাও কোথায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তোমাদের?
দুরের ব্যারাকগুলো দেখিয়ে দিল সৃষ্টিধর। এক পলক দেখে শেখরনাথ বললেন, দেখি ডাক্তারের কী বন্দোবস্ত করা যায়।
এতগুলো জমিতে ঘোরাঘুরি করতে করতে বেলা হেলে গেল। তিনদিকের পাহাড়ের ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে। সূর্যটা পশ্চিম পাহাড়ের আড়ালে নেমে গেছে। সেটাকে তখন আর দেখা যাচ্ছে না।
নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন শেখরনাথ। তারপর! স্বগতোক্তির মতো বললেন, রিফিউজি সেটেলমেন্টের জনা # জেফ্রি পয়েন্টটা বাছা হল তখন একবারই এখানে এসেছিলাম। সেইসময় সবে ক্যাম্প অফিস বসেছে, ব্যারাকগুলো তৈরি হচ্ছে। পরিতোষ, লা ডিন, ধনপত পুনর্বাসন আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের এমন কিছু লোকজনকে পাঠানো হয়েছে। চারিদিকে চাপ চাপ জঙ্গল। এখন এসে দেখছি সেই জঙ্গলের অনেকটাই সাফ করে ফেলা হয়েছে। রিফিউজিরা এসে তাদের জমিজমা বুঝে নিচ্ছে। বলে চুপ করে গেলেন।
জঙ্গল ধ্বংস হওয়াতে তিনি কি খুশি হননি, ঠিক এমনি বুঝতে পারল না বিনয়। কিন্তু বনভূমি নিমূল না হলে উদ্বাস্তুদের জমি দেওয়া হবে কী করে? তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনাই। তো বন্ধ করে দিতে হবে।
এখানে উত্তর দিকের জঙ্গলটাই সবচেয়ে ঘন, সবচেয়ে নিবিড়। সেটা অন্য দুধারের জঙ্গলের চেয়ে বেশি ঝাপসা হয়ে দল গেছে। তবু আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে ও দিকের বনভূমির মাথা ছাপিয়ে দুশ হাত দুরে দুরে বাঁশের তৈরি টও খাড়া হয়ে আছে। টঙগুলোকে ছুঁয়ে চলে গেছে কাল্পনিক পেরিমিটার রোড।
ওইসব উঁচু, উঁচু মাচা বা টঙ যে বুশ পুলিশের ঘাঁটি বা ওয়াচ টাওয়ার, শেখরনাথ তা জানেন। ওখানে বসেই বুশ পুলিশের দল জারোয়াদের গতিবিধির ওপর নজর রাখে। পেরিমিটার রোডের অস্তিত্ব তার অজানা নয়। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে একসময় জিজ্ঞেস করলেন, যেভাবে উত্তর দিকের জঙ্গল কাটা হচ্ছে তাতে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
বিনয় উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই শেখরনাথ জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি জানো রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের পরিকল্পনাটা কী? বিশু তোমাকে কিছু বলেছে?
বিনয় বলে, কীসের পরিকল্পনা?
ওরা কি বুশ পুলিশের ঘাঁটি আর পেরিমিটার রোডের ও ধারের জঙ্গলও রিফিউজি সেটেলমেন্টের জন্যে সাফ করে ফেলবে?
আমি জানি না। রাহা সাহেব এ নিয়ে আমাকে কিছু বলেননি।
চিন্তাগ্রস্তের মতো শেখরনাথ বললেন, ও পাশের জঙ্গলে হাত। দেওয়া ঠিক হবে না। ওটা যেমন আছে তেমনই থাক। কেন। জানো?
কেন? বিনয় উৎসুক হল।
শেখরনাথ জানালেন, দক্ষিণ আন্দামানের উত্তর দিকের ওই জঙ্গলটা জারোয়াদের নিজস্ব এলাকা। পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষজনের পুনর্বাসনের জন্য আন্দামানের আদিম বাসিন্দা জারোয়াদের উৎখাত করা খুবই অন্যায়। জঙ্গল গেলে ওদের রিহ্যাবিলিটেশন হবে কোথায়?
শেখরনাথ বললেন, সৃষ্টিধরের জমি পর্যন্ত জঙ্গল কাটা হয়ে গেছে। এই পর্যন্তই থাক। বিশুকে বলব এধারের ফরেস্টে যেন আর হাত না পড়ে। পরক্ষণে কী যেন খেয়াল হয় তার।–কিন্তু বিশুকে বলে কিছু হবে বলে মনে হয় না। যদি ওর ওপরের অথরিটি ঠিক করে থাকে উত্তরের বনবাদাড় শেষ করে ফেলবে, আমি কিন্তু ছাড়ব না। চিফ কমিশনার আন্দামান-নিকোবরের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হেড। আমি তার সঙ্গে দেখা করব। তাতেও যদি কাজ না হয়, ওঁর অফিসের সামনে ধর্নায় বসে যাব।
বিনয় লক্ষ করল, শেখরনাথের মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অদম্য, জেদি সেই পুরনো বিপ্লবীটি। সে একটু ধন্দে পড়ে যায়। শেখরনাথ যা বললেন তাতে এই দ্বীপে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা ধাক্কা খাবে। কুণ্ঠার সুরে সে। বলে, কিন্তু
কী? উত্তর পাহাড়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এনে শেখরনাথ। জিজ্ঞেস করেন।
বহু রিফিউজি এসে গেছে। তাদের সবাইকে এখনও জমি দেওয়া হয়নি। একমাসের ভেতর আরও অনেক রিফিউজি ফ্যামিলি এসে পড়বে। তাদেরও জমি দিতে হবে। জঙ্গল সাফ না করলে এত ল্যান্ড কোত্থেকে পাওয়া যাবে?
চোখ কুঁচকে একটু ভাবলেন শেখরনাথ। হ্যাঁ, সেটা একটা বড় সমস্যা। তবে তারও সলিউশন আছে। উত্তর দিকটা বাদ দিয়ে পুব আর পশ্চিমের জঙ্গল সাফ করা যেতে পারে। এই দুটো দিকে প্রচুর জমি বেরুবে। জারোয়ারাও নেই।
শেখরনাথের মনোভাবটা এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে তার অপার সহানুভূতি, ওদিকে জারোয়াদের ওপরেও অফুরান মমতা। এখানকার জনজাতি তাদের নিজেদের বাসস্থানে চিরকাল যেভাবে থেকে এসেছে তেমনি থাক। তাদের উচ্ছেদ করলে তার ফলাফল হবে মারাত্মক। জঙ্গলে হাত পড়ায় এমনিতেই জারোয়ারা খুশি নয়, যদি উৎখাত হতে হয় তাহলে আরও হিংস্র হয়ে উঠবে।
একদিকে উদ্বাস্তুরা থাক, অন্যদিকে জাবোয়ারা। কোনওরকম বিশৃঙ্খলা, অশান্তি যেন না ঘটে। সহাবস্থানই তার কাম্য।
আলো ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে।
শেখরনাথ বললেন, চল, ফেরা যাক।
দুজনে দক্ষিণে ক্যাম্প অফিসের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
এদিকে হাতিরা এ বেলার মতো গাছের গুঁড়ি ঠেলার পর ফিরে যাচ্ছে। সঙ্গে তাদের চালকেরা। উদ্বাস্তুরাও ঝোঁপ-জঙ্গল কেটে সার বেঁধে চলেছে। এদের মধ্যে অনেক বুড়োটুড়োও রয়েছে। বয়সের ভারে নুয়ে-পড়া, গায়ের কুঁচকানো চামড়া আলগা হয়ে ঝলঝল করছে, বেজায় দুর্বল। ধুকে ধুকে তারা হাঁটছে।
এই বয়স্ক, অশক্ত মানুষগুলোকে জমিতে কাজ করতে দেখেছেন শেখরনাথ। তখন সেভাবে লক্ষ করেননি। এখন তাদের ক্লান্ত বিধস্ত চেহারা দেখে বড় মায়া হল।
সৃষ্টিধরকেও দেখা যাচ্ছে। সে তার গর্ভবতী বউকে ধরে ধরে নিয়ে চলেছে মেয়েটির হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এলোমেলো পা ফেলছে। যদি কিছুতে টক্কর লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে। শেখরনাথ বললেন, এক জায়গা থেকে তুলে এনে এই মানুষগুলোকে বহুদুরের অচেনা দুর্গম একটা এলাকায় এনে ফেলা হল, কিছু জমিজমা দেওয়া হল। ব্যস, দায়িত্ব শেষ। বৃদ্ধেরা, প্রেগনান্ট মেয়েরা জঙ্গল সাফ করার মতো পরিশ্রমের কাজ কবে–এ কেমন কথা? এদের জন্যে কিছু একটা করতেই হবে। পুনর্বাসন বললেই পুনর্বাসন হয় না। দেশে যেভাবে তারা ছিল সেই পরিবেশ, সেই স্বাচ্ছন্দ্যটি তাদের তৈরি করে দিতে হবে।
» ২.০৭ ক্যাম্প অফিসের সামনে
ক্যাম্প অফিসের সামনের ফাঁকা মাঠটায় বিনয়রা যখন ফিরে এল, সন্ধে নামতে শুরু করেছে। অন্যদিনের মতোই উদ্বাস্তুরাও চলে এসেছিল। শ্রান্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে তারা বসে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। এলোমেলো, অসংলগ্ন। চারদিক থেকে ভনভনানির মতো গুঞ্জন উঠছে। এর মধ্যে পুনর্বাসনের কর্মীরা বড় বড় লণ্ঠন আর হ্যাঁজাক জ্বালিয়ে দিয়েছে। আলোর ভরে গেছে চারদিক।
জমি সাফাইয়ের কাজ করে এসে এই সময়টা খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয় উদ্বাস্তুরা। তারপর সমুদ্র থেকে হাতমুখ ধুয়ে আসে। আজও তা-ই করল তারা।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে এতক্ষণ একটানা খাটাখাটনির পর খিদেও পায় জবর। পেটে আগুন জ্বলতে থাকে। খাবারের ব্যবস্থাও অবশ্য রয়েছে-চিড়ে, গুড় আর চা। পুনর্বাসনের একদল কর্মী সেসব নিয়ে তৈরিই ছিল।
বিশ্বজিৎ পোর্ট ব্লেয়ারে চলে পেছেন। যে দুটো দিন ছিলেন, এখানকার কলোনাইজেশন অ্যাসিস্টান্ট একটা খাপের ভেতর যেন গুটিয়ে ছিল। এখন সে এই সেটেলমেন্টের হর্তাকর্তা। তার চেহারাটাই পালটে গেছে। হাঁকডাক করে উদ্বাস্তুদের চিঁড়েটিড়ে দেবার ব্যবস্থা করতে লাগল।
রাতে খাওয়ার সময় আরও ঘণ্টা দুই পর। তখন দেওয়া হয় রুটি, তরকারি আর দুধ।
উদ্বাস্তুরা খেতে খেতে গল্প করছিল। বিনয় আর শেখরনাথ এক গেলাস করে চা নিয়ে এসে অল্প অল্প চুমুক দিতে দিতে কথা বলছিলেন। তবে শেখরনাথের নজর ছিল পরিতোষের দিকে। খাবারটাবার বিলি হলে তিনি হাত নেড়ে তাকে ডাকলেন।
শেখরনাথ শুধু বিশ্বজিৎ রাহার কাকাই নন। কতটুকু সময়ই বা তাঁকে দেখেছে বিনয়। তবে তাঁর সম্বন্ধে অনেক কিছুই শুনেছে। ব্রিটিশ আমলের দুর্ধর্ষ বিপ্লবী আন্দামান দ্বীপমালার একজন লিজেন্ড। রূপকথার নায়কই বলা যায়। তাঁকে এখানকার মানুষজন শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।
পরিতোষ একরকম দৌড়েই চলে এল।–আমারে কিছু কইবেন কাকা। বিশ্বজিতের কাকা, সেই সম্পর্কের সুতো ধরে সে তাঁকে কাকাই বলে। খুব সম্ভব এখানকার সকলেই তা-ই। বিনয়ও ঠিক করে ফেলল সেও শেখরনাথকে কাকা বলবে। তাতে মানুষটিকে অনেক নিবিড়, অনেক আপন করে পাওয়া যাবে।
শেখরনাথ পরিতোষকে বললেন, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। এক এক করে বলি।
দুচোখে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল পরিতোষ। সেই সঙ্গে একটু শঙ্কাও। শঙ্কার হেতুটা এইরকম। সে জানে, শেখরনাথ এই দ্বীপপুঞ্জের ক্ষমতাবান কোনও আমলা নন, নন হর্তাকর্তাবিধাতা। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড়। এখানকার আদিম জনজাতি ওঙ্গে, জারোয়া, সেন্টিনালিস বা গ্রেট আন্দামানিসদের এতটুকু ক্ষতি বা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে সামান্য গাফিলতি হোক, তিনি তা রেয়াত করবেন না। প্রাক্তন বিপ্লবী এই দ্বীপপুঞ্জের চিফ কমিশনার, ডেপুটি কমিশনারদের গ্রাহ্য করেন না। তেমন কোনও ঘটনা ঘটলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়বেন।
শেখরনাথ বললেন, রিফিউজিদের এখন তো চিড়ে, গুড় আর চা দিলে। সকালে দুপুরে আর রাত্তিরে কী দাও?
পরিতোষ জানায়, সকালের খাবার হল রুটি-তরকারি বা খিচুড়ি, দুপুরে ভাত ডাল তরকারি। রাত্তিরে আবার রুটি তরকারি এবং ইউরোপ আমেরিকা থেকে আসা পাউডার মিল্ক গুলে এক গেলাস করে দুধ।
শেখরনাথ বললেন, রিফিউজিগুলোর চেহারা দেখেছ? হাড্ডিসার, সারাক্ষণ ঝুঁকছে। কলকাতার রিলিফ ক্যাম্প আর শিয়ালদা স্টেশনের চত্বর থেকে আধমরা হয়ে এসেছে। এখানে। এসে জঙ্গল সাফ করার অত খাটুনি, তার ওপর এই রাজভোগ খাওয়াচ্ছ। জমি বার করে ধান ফলাতে ফলাতে এদের ভবসাগর পাড়ি দেওয়াবার চমৎকার ব্যবস্থা করেছ দেখছি।
পরিতোষ ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। শেখরনাথ যা বললেন, মোটামুটি তা বুঝতে পারছে। ঢোক গিলে জড়ানো, আবছা গলায় কিছু একটা বলতে চাইল। তার একটি বর্ণও বোঝা গেল না।
শেখরনাথ কণ্ঠস্বর উঁচুতে তুলে বললেন, নিউট্রিশন নিউট্রিশন বোঝো? এদের পুষ্টিকর ভালো খাবারদাবার দরকার। নইলে একদিন দেখবে সেটেলমেন্টটা আছে, মানুষগুলো নেই।
ভয়ে ভয়ে পরিতোষ বলে, রিফিউজিগো খাওয়ানের লেইগা যে টাকা স্যাংসন হইছে হেয়াতে (তাতে) এইর বেশি কিছু দেওন (দেওয়া সম্ভব না।
বিদ্রুপের সুরে শেখরনাথ বলেন, যারা স্যাংশন করেছেন তাঁদের ঘাড় ধরে এখানে এনে দশ দিন এই নবাবি খানা খাওয়াও। বুঝুক রিফিউজিদের জন্যে কী ব্যবস্থা করেছে। ক্রুয়েলটির সীমা থাকা দরকার। কেন, সমুদ্রে মাছ নেই? দশবার জাল ফেললে এক মন মাছ উঠে আসবে। সেটা তো আর পয়সা দিয়ে কিনতে হচ্ছে না। সেই মাছ ওদের খাওয়াও। ম্যাল-নিউট্রিশনে আর ভুগবে না।
কিন্তুক
কপাল কুঁচকে গেল শেখরনাথের কীসের কিন্তুক?
মাছ রন্ধনের কেও নাই। এহানে যারা রান্ধে হেরা (তারা) বিহার, ইউ পির লোক, দুই চাইরজন বার্মিজও আছে।
বাঙালি রাঁধুনি রিক্রুট কর।
আমি ছুটোখাটো এমপ্লয়ি! হেই খ্যামতা আমার নাই।
ঠিকই বলেছে পরিতোষ। তার মতো একজন সামান্য কলোনাইজেশন অ্যাসিস্টান্ট কারও চাকরিবাকরি দিতে পারে না। একটু চুপ করে থেকে শেখরনাথ বললেন, এই ব্যাপারে বিশুর সঙ্গে আমি কথা বলব। এবার আমার দুনম্বর কথাটা শোন। জমিগুলো ডিস্ট্রিবিউট করা হয়েছে, সেসব জায়গায় ঘুরে ঘুরে কী চোখে পড়ল জানো?
পরিতোষ তাকিয়ে থাকে, কোনও প্রশ্ন করে না।
শেখরনাথ বলতে লাগলেন, প্রেগনান্ট বউ, বৃদ্ধের দল, ছোট ছোট বাচ্চা পর্যন্ত জঙ্গল সাফ করছে। এই পরিশ্রমের কাজ কি ওদের পক্ষে সম্ভব? জোয়ান ছেলেমেয়েরা করুক– ঠিক আছে। কিন্তু গর্ভবতী মেয়ে বা বুড়ো আর বাচ্চাদের দিয়ে এ কাজ করানো চলবে না। রিফিউজিদের মধ্যে যারা শক্তসমর্থ আছে তাদের সঙ্গে তোমাদের রিহ্যাবিলিটেশনের লোকজন দাও। তারাও হাত লাগাক।
হেইটা (সেটা) তো দিতে পারুম না কাকা।
কেন? শেখরনাথের স্বর রুক্ষ হয়ে ওঠে।
উপুর (ওপর) থিকা ঠিক কইরা দেওয়া আছে বড় বড় মোটা গাছগুলান হুদা (শুধু আমরা কাইটা দিমু। বাকি হগল (সকল) সাফসুতরা করব রিফুজিরা। হেয়া (তা) ছাড়া এহানে ওয়ার্কার এত কম যে অন্য কাম সাইরা জমিনে পাঠান যাইব না।
হু, তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। দেখা যাক, কী করা যায়। এবার আরেকটা কথা শোন– এখানে প্রেগনান্ট মেয়ে আমি একজনকেই দেখেছি। নিশ্চয়ই আরও কেউ কেউ আছে। শুনলাম এখানে কোনও ডাক্তার নেই।
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে পরিতোষ। –না
শেখরনাথ জিজ্ঞেস করেন, এদের যখন ডেলিভারি হবে, কে দেখবে! তাছাড়া যে রিফিউজিরা এসেছে, এবং আরও আসছে, তারা কেউ অজর অমর নয়, লোহার শরীর নিয়েও কেউ আসেনি, আসবে না। তাদের অসুখ-বিসুখ হলে বিনা চিকিৎসায় পোকার মতো মরবে? তোমাদের রাহাসাহেব কি তার কর্তারা সেটেলমেন্টে ওষুধপত্র, ডাক্তার পাঠানোর কথা ভাবেনি? মুখ নিচু করে পরিতোষ বলল, আমি ঠিক জানি না। ওদের ভাবা উচিত ছিল। এতগুলো মানুষের জীবন-মরণের ব্যাপার। আমি কয়েকদিন পর পোর্ট ব্লেয়ারে যাচ্ছি। বিশুদের ছাড়ব না। রিফিউজি বলে ওদের জীবনের কোনও দাম নেই? এটা শিয়ার ক্যালাসনেস। সিরিয়াস কিছু ঘটে গেলে কী হবে?
পরিতোষ চুপ করে থাকে।
শেখরনাথ বললেন, আরেকটা ইমপর্টান্ট কথা আছে। তোমরা উত্তর দিকে কতদূর পর্যন্ত জঙ্গল কাটার প্ল্যান করেছ?
শেখরনাথ সেটেলমেন্টের নানা বিষয়ে যেভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন তাতে মনে হয়, জঙ্গল কাটার ব্যাপারে তার আপত্তি বা ক্ষোভ থাকতে পারে। ভয়ে ভয়ে পরিতোষ জানায়, আপাতত বুশ পুলিশের উঁচু টংগুলো পর্যন্ত বনভূমি সাফ করা হবে। তবে আরও উদ্বাস্তু মেনল্যান্ড থেকে এসে পড়লে টংগুলোর ওধারে আরও মাইলখানেক জঙ্গল কাটার পরিকল্পনা আছে।
পরিতোষ বলল, উই ব্যাপারটা আমিন আর চেনম্যানরা ভালো জানে।
আমিন লা ডিন, হেড চেনম্যান ধনপত এবং পুনর্বাসন দপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মী বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। শেখরনাথ হাত নেড়ে তাদের ডাকলেন।
শশব্যস্ত লা ডিনরা দৌড়ে এল। শেখরনাথ বললেন, এসব কী শুনছি–আঁ?
তিনি কী শুনেছেন, লা ডিনরা কেমন করে জানবে? হতভম্বের মতো তারা তাকিয়ে থাকে।
পরিতোষ যা বলেছে, সব জানিয়ে শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, তার মানে তোমরা জারোয়াদের এলাকা দখল করতে চাও? তার চোখেমুখে অসীম বিরক্তি ফুটে বেরয়।
শেখরনাথের যে এ নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে সেটা আঁচ করতে পারছিল লা ডিন এবং তার সঙ্গীরা। লা ডিন ঢোক গিলে বলল, আমাদের ওপর অ্যায়সাই হুকুম হ্যায়। হামলোগ হুকুম কা নৌকর চাচাজি। শেখরনাথ খুব সম্ভব এই দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের সার্বজনীন চাচাজি অথবা কাকা। লা ডিনরা যে নিরুপায় তা বুঝতে পারছিলেন শেখরনাথ। স্বাধীনভাবে নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা অনুযায়ী কিছু করার উপায় নেই। সেদিক থেকে হাত-পা বাঁধা। মাথার ওপর যে অফিসাররা রয়েছেন তাঁরা যা বলবেন সেটাই তামিল করতে হবে।
শেখরনাথ বললেন, তা হলে পেরিমিটার রোড আর বুশ পুলিশের ক্যাম্পগুলোর কী হবে?
ঘোর জঙ্গলের ভেতর পেরিমিটার রোড হল একটা কাল্পনিক বিভাজন রেখা। তার ওধারে থাকবে এখানকার আদিম জনজাতি, এধারে অন্য মানুষজন।
ভয়ে ভয়ে লা ডিন বলল, জঙ্গল কাটা হলে পেরিমিটার রোড আর বুশ পুলিশের ক্যাম্পগুলো পিছিয়ে দেওয়া হবে।
একটা কথা ভেবে দেখেছ?
জি?
এমনিতেই এদিকে বাইরের লোকজন আসায় জারোয়ারা খেপে রয়েছে। নইলে সেদিন সেটেলমেন্টে হামলা করত না। তার ওপর যদি এখানকার পেরিমিটার রোডের ওধারের জঙ্গল কাটা পড়ে ওদের এলাকা আরও কমে যাবে। এটা ঠিক নয়। এতে ওরা আরও খেপে যাবে।
লেকেন চাচাজি
কী?
আমরা ছোটামোটা সরকারি নৌকর। আমরা কী করতে পারি?
একটু চুপচাপ।
তারপর শেখরনাথ বললেন, আচ্ছা, পুব আর পশ্চিম দিকে তো এখনও অনেক জঙ্গল রয়েছে।
জি
ওই দুধারের জঙ্গল কেটে কিছু জমি বার করে তো রিফিউজিদের বিলি করা হয়েছে। প্রচুর জমি বেরুবে ওই দুটো দিক থেকে। পুব-পশ্চিমের জঙ্গল সাফা কর। উত্তরটা বাদ দাও।
লেকিন চাচাজি, রাহাসাহেব উত্তর দিকের কাম খতম করে ফির পুব-পশ্চিম হাত লাগাতে বলেছেন। উনি আমার উপরবালা–বলতে বলতে থেমে গেল লা ডিন।
ধনপতও সায় দিল, জি চাচাজি। লা ডিন ঠিকই বলছে।
আমি তোমাদের রাহাসাহেবের সঙ্গে কথা বলব। সে যদি রাজি না হয় তখন দেখা যাবে। ততদিন তোমরা পুব-পশ্চিমের জঙ্গল থেকে জমি বার কর।
লা ডিন মুখ চুন করে বলল, লেকিন
তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়ে শেখরনাথ বললেন, তোমাদের রাহাসাহেব রেগে যাবে, তা-ই তো?
লা ডিন চুপ করে রইল।
শেখরনাথ বললেন, ওর ব্যাপারটা আমি সামলাব। ভয় পেও না।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হতে হল লা ডিন এবং তার সঙ্গীদের।
জি
বিশ্বজিতের ঘরে তিন দিন একা কাটিয়েছে। শেখরনাথকে এই ঘরেই থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। যে খাটে বিশ্বজিৎ শুতেন, তিনিও সেখানেই শোবেন। সঙ্গেকরে শেখরনাথ বিশেষ কিছুই আনেননি, একটা ঝোলায় পুরে খান তিনেক মোটা সুতোর ধুতি আর সাদামাঠা টুইলের ফুলশার্ট এবং দাড়ি কামানোর ক্ষুর, সাবান, ছোট আয়না আর সস্তা চিরুনি।
রাত্তিরে রিফিউজিদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরে শেখরনাথ বিশ্বজিতের ঘরে চলে এলেন। সঙ্গে বিনয়।
পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা সন্ধে নামতে না নামতেই দুটো লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। মশা এবং পোকা-মারা ধূপও জ্বলছে ঘরের কোনায় কোনায়। উগ্র ঝাঝালো গন্ধে ভরে গেছে ঘরের বাতাস।
শেখরনাথ তাঁর পোশাক পালটে লুঙ্গি আর হাফহাতা ফতুয়া ধরনের একটা জামা পরে নিলেন। বিশ্বজিতের খাটটায় বসে বললেন, বিশুর কাছে শুনেছি, রাত্তিরে তুমি তোমাদের পেপারের জন্যে রিপোর্ট লেখা শুরু করে দাও। আমি কথা বলে ডিসটার্ব করব না।
বিনয় উত্তর দিতে যাচ্ছিল, সেই সময় বাইরে থেকে গান ভেসে এল। তার সঙ্গে সারিন্দা আর দোতারার সুর। অন্য দিনের মতোই ব্যারাক দুটোর সামনের ফাঁকা মাঠে যে বাঁশের মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল সেখানে গানবাজনার আসর বসেছে। হ্যাঁজাকের তেজি আলোয় ভরে গেছে ওদিকটা। উদ্বাস্তুরা তাদের ঘিরে বসেছে।
হরিপদই শুধু নয়, ছিন্নমূল যে মানুষগুলো বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে চলে এসেছে তাদের মধ্যে আরও কয়েকজন চমৎকার গাইতে পারে। আজ গাইছে মাঝবয়সি হারাধন বিশ্বাস। রোজ শুনতে শুনতে কণ্ঠস্বরগুলো চেনা হয়ে গেছে বিনয়ের।
হারাধন গাইছিল–
জল ভরে সুন্দরী গো কইন্যা জলে দিয়া ঢেউ
হাসি মুখে কও না কথা হায় রে,
সঙ্গে নাই মোর কেউ রে
পরান আমার যায় যায় রে-
কঠিন তোমার মাতাপিতা কঠিন তোমার হিয়া
এমন যৈবনকালে হায় রে
না করাইছে বিয়া রে
পরান আমার যায় যায় রে
লজ্জা নাই রে নিলাজ ঠাকুর
লজ্জা নাই রে তর
গলায় কলস বাইন্ধা হায় রে
জলে ডুইবা মর রে
পরান আমার যায় যায় রে
কইবা পাইবাম কলস গো কইন্যা
কইবা পাইবাম দড়ি
তুমি হও গহিন গাঙ হায় রে–
আমি ডুইবা মরি
পরান আমার যায় যায় রে—
জানালার বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন শেখরনাথ। বললেন, কত কাল পর পূর্ববাংলার গান শুনছি। প্রাণমন ভরে যাচ্ছে। কী দরদ দিয়ে যে গাইছে লোকটা! আহা–
রাজদিয়ায় থাকতে এই ধরনের গান যুগলই প্রথম শুনিয়েছিল বিনয়কে। তারপর আরও কতজনের মুখেই না শুনেছে সে। মাঝি-মাল্লা বৈরাগী যাত্রাদলের গায়ক–এমনি অনেক। কলকাতায় আসার পর জীবনের ওপর দিয়ে কত ঝড়ঝাঁপটা গেছে। ঝিনুক যখন নিরুদ্দেশ ইল, মনে হয়েছিল আকাশ যেন খানখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। হৃদয় জুড়ে তখন শুধুই ক্ষত। চূর্ণবিচূর্ণ বিনয় উদভ্রান্তের মতো ঝিনুককে খুঁজে বেড়াচ্ছে কলকাতার অলিগলিতে, জনারণ্যে, চারদিকের রিফিউজি কলোনিগুলোতে। জীবন থেকে পূর্ববাংলার সেইসব মায়াবী স্বপ্নের গান বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
বহুকাল পর এই সেদিন, বিশ্বজিৎ তখন এখানে, জেফ্রি পয়েন্টের এই উদ্বাস্তু কলোনিতে আসার পর হরিপদর গান শুনে মনে হয়েছিল পূর্বজন্মের স্মৃতি আবার ফিরে এসেছে। তারপর থেকে রোজ গানবাজনার আসর বসে। হরিপদ হারাধন মোহনর্বাশি–এরা সবাই পাহাড় অরণ্য সমুদ্রে ঘেরা এই দ্বীপে। কিছুক্ষণের জন্য হলেওজাদুকরের মতো পূর্ববাংলার সজল কোমল মায়াময় ভূখণ্ডটিকে নামিয়ে আনে।
শেখরনাথ আপ্লুত। বললেন, লোকগুলোর কী এনার্জি, কী প্রাণশক্তি, দেখেছ। সারাদিন জঙ্গল কেটেছে, তারপর কোথায় খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বে, তা নয়। গানের আসর বসিয়ে দিয়েছে।
এসব তো আগেই দেখেছে বিনয়। কিছু বলল না। শুধু একটু হাসল।
শেখরনাথ বলতে লাগলেন, দূর থেকে শুনে জুত হচ্ছে না। যাই, আসরে গিয়ে ওদের পাশে বসি। তিনি চলে গেলেন।
বিনয় অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। শেখরনাথ উদ্বাস্তুদের এনার্জির কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের? সেই পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে, দুর্গম বনজঙ্গল ভেদ করে সেটেলমেন্টে এসেছেন। এসেই ছুটেছেন জমি বিলি দেখতে। ঠায় এক জায়গায় কি দাঁড়িয়ে থেকেছেন? হেঁটে হেঁটে একরের পর একর জমি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। উদ্বাস্তুদের ডেকে ডেকে আলাপ করেছেন, তাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজখবর নিয়েছেন। তারপর এই রাত্রিবেলা ছুটলেন কাছাকাছি বসে গান শুনতে। এই বয়সেও প্রাক্তন এই স্বাধীনতা-সংগ্রামীর কী অফুরান প্রাণশক্তি! একসময় টেবলের দেরাজ খুলে কাগজ কলম বার করে লিখতে শুরু করল বিনয়।
বঙ্গোপসাগরের এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে অবিরল হারাধনের সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়ছে।
২.০৮ এসেছেন শেখরনাথ
দিন পাঁচেক হল জেফ্রি পয়েন্টে এসেছেন শেখরনাথ। সারাদিন সারা রাত বিনয় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। সকালে উঠে চা রুটি-টুটি খেয়ে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে তারা জমিতে ছোটে। লা ডিন, ধনপতদের কাজকর্ম দেখে। রিফিউজিদের জঙ্গল সাফাই দেখে। শেখরনাথের কথায় কাজ হয়েছে। সৃষ্টিধর বারুইয়ের জমির ঝোঁপঝাড় কাটার জন্য একজন লোক দিয়েছে পরিতোষ। আজকাল আর তার গর্ভবতী বউটিকে জমিতে দেখা যায় না।
অদ্ভুত মানুষ এই প্রাক্তন বিপ্লবীটি। বড়ই মায়াময়, উদ্বাস্তুদের জন্য তার কী যে অপার সহানুভূতি! কোনও জমিতে হয়তো গিয়ে দেখলেন অশক্ত চেহারার বুড়ো-ধুড়ো কেউ বুনো উদ্দাম গাছপালার গায়ে দা চালাতে চালাতে হাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি তক্ষুনি দা-টি কেড়ে নিয়ে কাজে লেগে যান। চারপাশ থেকে সবাই!
হাঁ হাঁ করে ওঠে, তিনি কারও বারণ শোনেন না।
দুপুরে ফিরে এসে চান, খাওয়া, সামান্য বিশ্রাম। তারপর আবার জমিতে জমিতে ঘোরা। সন্ধের আগে আগে ক্যাম্পে এসে চা-টা খেয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া। তারপর রাতের খাওয়া চুকিয়ে শেখরনাথ চলে যান গানের আসরে, আর বিনয় লিখতে বসে।
রাতের এক প্রহর পেরুলে আসর ভাঙে। শেখরনাথ ঘরে এসে বিনয়ের পাশের খাটে শুয়ে পড়েন। ততক্ষণে বিনয়ের লেখাও শেষ। সেও শুয়ে পড়ে। এই হল দুজনের এখনকার দৈনন্দিন রুটিন।
এসবের ফাঁকে ফাঁকে নানা কথা হয়। তার বেশির ভাগটাই জুড়ে থাকে দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা, বিশেষ করে পূর্ববাংলার হিন্দুরা, কতভাবে যে বঞ্চনার শিকার হয়েছে, বার বার এই প্রসঙ্গগুলো চলে আসে। এগুলো নিয়ে তার কত যে ক্ষোভ, কত রোষ এবং উত্তেজনা।
কোনও দিন শেখরনাথ বলেন, পার্টিশনের ঠিক আগে জওহরলাল নেহরু লর্ড মাউন্টব্যাটেনরে যে একটা চিঠি লিখেছিলেন সেটা জানো?
বিনয় বুঝতে পারে না। কোন চিঠির কথা বলছেন শেখরনাথ। সে তাকিয়ে থাকে।
শেখরনাথ বলেন, দেশ জুড়ে শুধুই ভয়াবহ আতঙ্ক আর আতঙ্ক। সরকার তা থামাতে পারছে না। শুধু চরম বিপর্যয় আর বিপর্যয়। বিশেষ করে লাহোরে যে নারকীয় ঘটনা ঘটছে তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অমৃতসর গুরুগাঁও তো কার্যত যুদ্ধক্ষেত্র। অথচ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে কোনও বিশৃঙ্খলা সর্বশক্তি দিয়ে দমন করা হবে। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ বিনয়?
বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী?
ডাইরেক্ট অ্যাকশনের কল দেওয়ায় কলকাতায় যা ঘটেছে, নোয়াখালিতে যে গণহত্যা হয়েছে, সেসব নিয়ে নেহরু কতখানি বিচলিত তা জানা যায় না। আমি অন্তত জানি না।
একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করেন, বেঙ্গলে কী ঘটেছে তা নিয়ে ইন্ডিয়ার অন্য প্রভিন্সের নেতাদের চোখ থেকে রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছিল কি না, আমার জানা নেই। গান্ধীজি অবশ্য নোয়াখালি রায়টের–রায়ট কী বলছি, একতরফা মার্ডার, অ্যাবডাকশন, রেপ, কনভারশন– এসবের পর সেখানে। গিয়েছিলেন। তখন তো মহাসর্বনাশ ঘটেই গেছে। হ্যাঁ, এটাও বলতে হবে বিহারেও হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে বিরাট বিরাট গর্ত খুঁড়ে রাতারাতি পুঁতে দেওয়া হয়েছে।
কোনও দিন শেখরনাথ বলেন, দাঙ্গা যখন বাধে ভারতবর্ষের নানা প্রভিন্সে হাজার হাজার ব্রিটিশ সোলজার ছিল। খোদ ইংল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট কড়া হুকুম পাঠিয়েছিল দাঙ্গা থামাতে সেই ফৌজকে যেন কাজে লাগানো না হয়। এতদূরের ইন্ডিয়ান কলোনির শাসনকর্তাদের এমন বুকের পাটা ছিল না যাতে সেই হুকুম অমান্য করে। কলকাতায় ছেচল্লিশের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের সময় ফোর্ট উইলিয়ামে কম সৈন্য ছিল না। এই এলাকার ব্রিগেডিয়ার ম্যাকিনলে তাদের ব্যারাক থেকে বেরুতে দেননি। ভাবখানা এই স্বাধীনতা তো চাইছিস, তার মজাটা বোঝ।
বিমর্ষ সুরে শেখরনাথ কোনও দিন বলেন, ভারতীয় নেতারা পাঞ্জাবে মিলিটারি রুল জারি করার জন্যে যথেষ্ট কাকুতিমিনতি করেছেন। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। ইংরেজ সরকার তখন পুরোপুরি অন্ধ আর বধির। সব শুনেও তারা কিছুই শোনেনি, সব। দেখেও কিছুই দেখেনি। আবেদন নিবেদনে ফল না হওয়ায় তারা মুখে কুলুপ এঁটেছিল। অথচ সেদিন কংগ্রেস আর লিগের নেতারা রাস্তায় নেমে তুমুল আন্দোলন করতে পারতেন। দেশের সবাই হত্যাকারী বা নারীধর্ষক নয়। কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষ রয়েছে, তাদের ডেকে বলতে পারতেন সমস্ত কিছু স্তব্ধ করে দাও, ব্রিটিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে বলতে পারতেন, এত রক্তস্রোতের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। কিছুই তাঁরা করেননি। দেশের অনন্ত দুর্গতি আর চরম বিপর্যয়ের জন্যে ইংরেজ যতটা তার চেয়ে কম দায়ী নয় এইসব ক্ষমতালোভী নেতা। দেশ। স্বাধীন হলে রাজপাট তাঁদের দখলে আসবে, এই প্রলোভন ত্যাগ করার মতো মহত্ত্ব এঁদের ছিল না।
কখনও বা বলেন, আমরা যারা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করতাম, ইংরেজের চোখে তারা টেরোরিস্ট সন্ত্রাসবাদী। ভারতীয় নেতারাও তা-ই মনে করতেন। আমরা যে মুক্তি সংগ্রামী, দেশের জন্যে শত সহস্র বিপ্লবী যে প্রাণ দিয়েছে, জেলখানায় পচে পচে মরেছে তাদের আত্মত্যাগের কোনও মূল্য নেই। আমরা দেশের জন্যে কতটুকুই বা করেছি, নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ যখন ইম্ফল পর্যন্ত এসে নানা কারণে বিপর্যস্ত হল, হাজার হাজার সেনাকে বন্দি করে দিল্লিতে নিয়ে আসা হল, তখন কংগ্রেসের একজন সর্বভারতীয় নেতা বলেছিল, এরা গুন্ডাবাহিনী, কোনও বিচার নয়, এদের ধরে ধরে কঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দাও। যারা হাটু গেড়ে চুক্তিপত্রে সই করে হাত পেতে স্বাধীনতা নিল তারাই দেশপ্রেমী। আর যে বিপ্লবীরা জীবনদান করল বা মেনল্যান্ডের জেলখানায় জেলখানায় আর সেলুলার জেলে পচে গলে শেষ হল তারা টেরোরিস্ট। নেতাজির আই এন এ হল গুন্ডাবাহিনী! ভাবতে পারো? ক্রোধে-উত্তেজনায় তার চোখমুখ গনগন করতে থাকে।
এই মানুষটির মধ্যে কতখানি দাহ, কতটা ক্ষোভ জমা হয়ে আছে আন্দাজ করতে পারে বিনয়।
একদিন শেখরনাথ বললেন, ইন্ডিয়াকে স্বাধীনতা দেবার। সিদ্ধান্ত কীভাবে হয়েছিল, তুমি নিশ্চয়ই জানো। সেই সময়কার বড়লাটের বড়ই তাড়া। তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইংল্যান্ডে ফিরতে হবে। কেননা যিনি ভবিষ্যতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজ-রাজেশ্বরী হবেন তার সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের ভাইপোর বিয়ে। সেই ছাদনাতলার পাশে উপস্থিত না থাকলে চলে! তাছাড়া ব্রিটিশ নেভির প্রধানের পদটি শীঘ্রই খালি হতে চলেছে। মাউন্টব্যাটেনের নজর সেই মসনদের দিকে। পদটি কম লোভনীয় নয়। কাজেই। ইন্ডিয়ার ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাত ধুয়ে লন্ডনের প্লেনে উঠে বসো।
বিনয় জানে, মোটামুটি ঠিক হয়েছিল উনিশশো আটচল্লিশের মাঝামাঝি ভারতীয় উপমহাদেশের যাবতীয় দায়িত্ব এ দেশের নেতাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু মাউন্টব্যাটেনের ভীষণ তাড়া। তাঁর আর তর সইছিল না। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে তিনি বোঝালেন, এত দেরি করার প্রয়োজন নেই। সরকারও সেটা মেনে নিল। হঠাৎই ঘোষণা করা হল, সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট দেশটা কেটেকুটে দুটো ডোমিনিয়ন তৈরি করা হবে-ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান। একই দিনে স্বাধীনতা এবং দেশ ভাগ। সেদিনই এ দেশের নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। আশ্চর্যের ব্যাপারটা কী জানো বিনয়?
বিনয় নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিল। জিগ্যেস করেছে, কী?
শেখরনাথ বলেন, দেশটাকে ভাগ করার জন্যে র্যাডক্লিফের হাতে যে ছুরি তুলে দেওয়া হয়েছিল, মাটিতে সেই ছুরি চালিয়ে কোন কোন অংশ কোন কোন ডোমিনিয়ন পাবে তখনও তিনি স্থির করে উঠতে পারেননি। তার আগে ডোমিনিয়ন বানানো হয়ে গেল।
কখনও শেখরনাথ বলেন, এসবের নিট রেজাল্ট কী হল, আমরা যা পেলাম তা ছেঁড়াখোঁড়া পোকায় কাটা এক স্বাধীনতা।
কখনও বা তিনি বলেন, একটা কথা ভেবে দেখ, দুশ বছর রাজত্বের পর মাত্র সাত সপ্তাহের মধ্যে এত বিশাল একটা দেশের ট্রান্সফার অফ পাওয়ার হয়ে গেল। এত বড় হঠকারী, অবিবেচক, দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত আর কোথাও কবে হয়েছে, আমার জানা নেই। কলোনিয়াল মাস্টাররা অন্য কোনও দেশকে এভাবে হেলাফেলা করে ফেলে চলে গেছে, এমন নজির আর একটা তুমি দেখাতে পারো?
দাঙ্গা, দেশ বিভাজন, স্বাধীনতা টুকরো টুকরোভাবে এইসব নিয়ে তিনি যা বলেন তার মধ্যে এই মুক্তি সংগ্রামী মানুষটির কত যে ক্ষোভ, আক্ষেপ, যন্ত্রণা, ধিক্কার, নৈরাশ্য আর তীব্র ক্রোধ মিশে থাকে!
.
অন্য দিনগুলোর মতো আজও সকালে চা, চিড়ে-টিড়ে খেয়ে জমিতে এসেছেন। তার কথামতো উত্তর দিকের জঙ্গল কাটা আপাতত স্থগিত রয়েছে। পুবে পশ্চিমে সাফাইয়ের কাজ চলছে। যেমন যেমন জমি বার করা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সেসব উদ্বাস্তুদের ভাগ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
ওপর থেকে নির্দেশ ছিল, দশ পনেরো দিনের ভেতর জমির বিলিব্যবস্থা চুকিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু দেড়শো উদ্বাস্তু পরিবারকে অরণ্য নির্মূল করে জমি ভাগ করে দেওয়া কি মুখের কথা! একাশি বিরাশিটা পরিবার এখন অবধি জমি পেয়েছে। এখনও সত্তরটার মতো বাকি।
আগের কদিন উত্তর আর পুব দিকে ঘুরেছেন শেখরনাথরা। আজ গেলেন পশ্চিম দিকে। প্রথম চারটে জমিতে যে উদ্বাস্তুরা কাজ করছিল তাদের সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছে শেখরনাথের। ওদের সঙ্গে দু-একটা কথা বললেন, কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে কি না জিগ্যেস করলেন। হচ্ছে না জেনে পরের জমিটায় এলেন। এখানে ভারী সুন্দর চেহারার একটি যুবতী বয়স কুড়ি-একুশ, কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতে সিঁদুরের চওড়া রেখা, পাতলা নাকের পাটায় নাকছাবি, কানের লতিতে মাকড়ি, হাতে রুপোর চুড়ি, গলায় রুপোর গোট-হার, গাছকোমর করে পরা লাল-পাড় শাড়ি- ধারালো বর্মি দা দিয়ে জলডেঙ্গুয়া অর্থাৎ বনতুলসীর ঝাড় কাটছিল। তার সঙ্গী বছর তিরিশেকের একটি পুরুষ, যুবকই তাকে বলা যায়, লম্বা হিলহিলে চেহারা, তামাটে রং, মাথায় কঁকড়া চুল সেও একটা দা দিয়ে কাটাঝোঁপ সাফ করছিল। দেখেই আন্দাজ করা যায় স্বামী-স্ত্রী। পরিশ্রমে দুজনেই ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে।
আগে এদের লক্ষ করেনি বিনয়, শেখরনাথও। এত এত উদ্বাস্তু এসেছে। কয়েকজনের সঙ্গে ভালোই আলাপ হয়েছে তাদের, কিন্তু এত অল্প সময়ে সবাইকে আলাদা আলাদা করে চিনে, তাদের পরিচয় জেনে মনে করে রাখা সম্ভব নয়।
শেখরনাথ যুবকটিকে জিগ্যেস করলেন, কী নাম তোমার?
যুবকটি হাতের দা ফেলে কাছে এগিয়ে এল। শেখরনাথ তাকে না চিনলেও সে তাকে চেনে। হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বিনয়ের সুরে বলল, আইজ্ঞা, বিন্দাবন বসাক
দেশ ছিল কোথায়?
ঢাকা জিলা। গেরামের নাম বেতকা- মুন্সিগঞ্জের নাম নি হুনছেন (শুনেছেন)?
শুনেছি। বিক্রমপুরে।
আমাগো বেতকা অইল মুন্সিগঞ্জের কাছে।
দেশ থেকে কবে এসেছ?
বছর দ্যাড়েক।
কথায় কথায় জানা যায়, বিন্দাবন অর্থাৎ বৃন্দাবন আর বউ মাইল পনেরো দূরে সিরাজদিঘায় এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। বন্ধুরা শিগগিরই দেশ ছেড়ে চলে যাবে, এই খবর পেয়ে। সারা পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থাগতিক একেবারেই ভালো না, সর্বক্ষণ আতঙ্ক, সর্বক্ষণ দুর্ভাবনা। কখন কী ঘটে যাবে, কেউ জানে না। বন্ধুদের কাছে জানতে চেয়েছে কবে তারা দেশ ছাড়বে, ইন্ডিয়ার কোথায় গিয়ে উঠবে, ইত্যাদি। ঠিক হয়েছিল একসঙ্গেই তারা পাকিস্তান ছেড়ে ত্রিপুরায় যাবে। কেননা সিরাজদিঘা অঞ্চলের অনেকেই। ত্রিপুরায় যাচ্ছে। বহু মানুষ সঙ্গে থাকলে মনের জোর বাড়ে। বৃন্দাবন বন্ধুকে বলেছিল, বেতকায় ফিরে দু-একদিনের মধ্যে মা-বাবা-ভাইবোনদের নিয়ে চলে আসবে। তারপর এখান থেকেই ত্রিপুরায় রওনা হবে।
কিন্তু বেতকায় ফেরার পথে খবর পাওয়া গেল, বেতক একতরফা খুনখারাপি, আগুন, জোর করে নারীহরণ চলছে তাদের পরিবারের সবাই শেষ হয়ে গেছে। সিরাজদিঘায় ফিরবে তারও উপায় নেই, বেড়া আগুনের মতো দাঙ্গা সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে। বন্ধু এবং তার বাড়ির লোকজন বেঁচে আছে কি না, জানা যায়নি।
বৃন্দাবন আর বউ একটা বিরাট খালে পুরো একটা দিন ঠা কচুরিপানার ভেতর লুকিয়ে ছিল। তারপর রাত্তিরে খালের জ আর কচুরিপানা ঠেলে ঠেলে কীভাবে যে মুন্সিগঞ্জ স্টিমারঘাট চলে গিয়েছিল, তারাই জানে। না, ত্রিপুরা যাওয়া হয়নি। মুন্সিগ থেকে রিফিউজিদের জন্য নির্দিষ্ট স্টিমারে চেপে দমবন্ধ ভি চলে এসেছিল গোয়ালন্দে। সেখান থেকে ট্রেনে শিয়ালদা কদিন সেখানকার নরককুণ্ডে কাটিয়ে দমদমের রিলিফ ক্যাম্পে এক বছরেরও বেশি সেখানে কাটিয়ে আন্দামানে এসেছে।
প্রায় সব ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আতঙ্কে ইতিহাস। বৃন্দাবনের বেলায় আলাদা আর কী হবে?
সেই বউটি জলডেঙ্গুয়া কাটা বন্ধ রেখে কাছাকাছি এসে দাড়ি দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে গালগলা কপাল পুঁছে নিল। তার বড় বড় লাজুক চোখে শেখরনাথকে দেখতে লাগল। প্রাক্তন ও বিপ্লবী সম্পর্কে সে খুব সম্ভব কিছু কিছু শুনেছে।
শেখরনাথ বউটিকে কাছে ডেকে জিগ্যেস করলেন, তোম দেশ কোথায়, নাম কী?
চেহারার মতো মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভারী মিষ্টি। সে জানা তাদের বাড়িও ঢাকা জেলায়, মানিকগঞ্জের সোনাদিঘি গ্রামে। ত নাম মায়া।
কে কে আছে তোমার? বাবা মা ভাই বোন?
বিনয় লক্ষ করল, মেয়েটার চোখেমুখে কেমন যেন ভয়ের ছা। পড়েছে। মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল সে। তার কেউ নেই। একটু অবাকই হল বিনয়। এই ধরনের গ্রামের মেয়েরা লাজুকই হয়। কিন্তু শেখরনাথ ঝানু উকিলদের মতো জেরা করেননি, সাধারণ কৌতূহলে তার মা বাবা সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন, এতে এমন ভয় পাওয়ার কারণ কী থাকতে পারে? মেয়েটার আচরণ বেশ অস্বাভাবিকই মনে হল।
অথচ তার স্বামী বৃন্দাবনের কথায় কোনওরকম অস্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। খুব স্বাভাবিকভাবেই কোন পরিস্থিতিতে তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে তা বলেছিল।
শেখরনাথ মায়াকে খুব সম্ভব সেভাবে লক্ষ করেননি। সস্নেহে বললেন, যাও, তোমরা কাজ কর।
পরের জমিটা হরিপদর। সে তার বাবা, মা এবং একটি ছোট ভাই ফ্যামিলির সবাই মিলে জমি সাফ করছে।
হরিপদ এবং তার মা-বাবার সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছে বিনয়ের। শেখরনাথেরও। হরিপদর মা হল দুর্গা, বাপ রসময়, ছোট ভাইয়ের নাম গোপাল। হরিপদর এখনও বিয়ে হয়নি। ওরা খুলনা জেলার লোক।
হরিপদ একজন গুণী যুবক। শিল্পী। তার গানে g৪ বিশ্বজিৎ, শেখরনাথ, বিনয় থেকে শুরু করে সেটেলমেন্টের সবাই মুগ্ধ।
রসময় আর দুর্গা জমির এধারে আগাছা পরিষ্কার করছিল। খানিকটা দূরে একটা মাঝারি গাছের চারপাশে বুনো ঘাসের ঘন জঙ্গল। ধারালো বর্মি দা দিয়ে সেগুলো কাটছে গোপাল আর হরিপদ।
রসময় আর দুর্গা শেখরনাথ এবং বিনয়কে দেখে সসম্ভ্রমে এগিয়ে এসেছিল। কিছু বলতে যাবে, আচমকা গোপালের আর্ত তীক্ষ্ম চিৎকার ভেসে এল।
.
সবাই সচকিত হয়ে সেদিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে তাদের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়।
বিনয় এমন দৃশ্য আগে আর কখনও দেখেনি। যে গাছটার চারপাশের ঘাস কাটছিল দুই ভাই সেখানে একটা কালো কুচকুচে সাপ, প্রায় পাঁচ ফুটের মতো লম্বা, ল্যাজের ওপর ভর দিয়ে হরিপদর মুখোমুখি খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল ফণায় সাদা চক্রের মতো দাগ, তার হিংস্র চোখ দুটো জ্বলছে। হরিপদ আর সাপটার মাঝখানে দূরত্ব মাত্র ফুট তিনেক। বিনয় সাপ চেনে না, তবে তার মনে হল, ওটা সাংঘাতিক বিষাক্ত। বুকের ভেতরটা কনকনে ঠান্ডা, কিন্তু সারা শরীর লহমায় ঘামে ভিজে গেছে।
ওদিকে গোপাল চিৎকার করেই ঘাড়মুখ গুঁজে লুটিয়ে পড়েছে, এখন আর তার গলা থেকে এতটুকু আওয়াজ বেরুচ্ছে না। ঘাড় ফিরিয়ে শেখরনাথ, দুর্গা এবং রসময়ের দিকে যে তাকাবে, সেই বিনয়ের শক্তিটুকুও কেউ যেন হরণ করে নিয়েছে। জিভটা ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
প্রাক্তন বিপ্লবীটি, মৃত্যু যার কাছে কোনও ঘটনাই নয়, পাশ থেকে তাঁর ত্রস্ত, কাঁপা কাঁপা, শুষ্ক কণ্ঠস্বর বিনয়ের কানে এল, সর্বনাশ। ওটা কাল কেউটে। কপালে ছোবল মারলে কয়েক কউ সেকেন্ডে শেষ।
রসময় আর দুর্গার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছে, তাদের গুণী ছেলেটির আয়ু আর কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র।
সূর্য এর মধ্যে পুব দিকের পাহাড়ের মাথা ছাপিয়ে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে। হলকার মতো রোদের তাপ ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গম এই উপত্যকায়। রোদে সাপটার কালো পিছল শরীরটা ঝকঝক করছে। মাঝে মাঝে সেটার মুখ থেকে সরু লিকলিকে জিভটা বেরিয়ে আসছে।
বিনয়ের মনে হচ্ছিল সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। শরীরের সব হাড় যেন আলগা হয়ে গেছে। সে এবার হুড়মুড় করে আছড়ে পড়বে। তারই মধ্যে ঝাপসাভাবে যেন দেখতে পেল হরিপদ সাপটার চোখে চোখ রেখে অনড় দাঁড়িয়ে রয়েছে। পলকহীন একটা মানুষ এবং একটা বিষধর ভয়ংকর প্রাণীর মধ্যে চলছে প্রবল স্নায়ুযুদ্ধ।
একেকটা মুহূর্ত যেন একশো বছরের মতো দীর্ঘ, তা যেন ফুরোবে না। আচমকা, বিদ্যুৎ গতিতে আন্দামানের তীব্র, শানিত রোদ চিরে একটা ঝিলিক খেলে গেল।
হৃৎপিণ্ডে তীব্র ঝাঁকুনি খেল যেন বিনয়। শিথিল স্নায়ুমণ্ডলীতে আবার পুরানো জোর ফিরে এসেছে। সে দেখতে পেল সেই সাপটার মুণ্ডু গলার কাছ থেকে সাত আট হাত দূরে ছিটকে পড়েছে, ধড়টা মাটির ওপর মোচড় দিতে দিতে পাক খেয়ে চলেছে। আর হরিপদ ফের ঘাসবনে দা চালিয়ে যাচ্ছে।
শেখরনাথের খুব সম্ভব খাস আটকে গিয়েছিল। জোরে জোরে ফুসফুসে বারকয়েক বাতাস টেনে ব্যগ্র স্বরে বললেন, চল, হরিপদর কাছে যাই। বলে একরকম দৌড়াতে শুরু করলেন। বিনয়ও তার পাশাপাশি ছুটছে।
এদিকে দুর্গা আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে খেতে ছেলের কাছে। চলেছে। তার সঙ্গে রসময়। দুর্গা সমানে কাঁদছে আর জড়ানো জড়ানো বিকৃত স্বরে বলে চলেছে, হে ভগবান, হে মা মনসা তুমি আমার ছেইলেটারে বাঁচায়ি দেয়। তোমাদের দয়া, তোমাদের দয়া
বিনয়রা কাছে চলে আসতে ঘাস কাটা বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল হরিপদ। ঝকঝকে দাঁত মেলে ভারী সরল, নিষ্পাপ মুখে একটু হাসল। বলল, আপনিরা বড় ডরায়ি গেছিলেন–না? সে হয়তো সাপটাকে মারার পর দূর থেকে বিনয়দের ভয়ার্ত মুখগুলো লক্ষ করেছিল।
ওধারে গোপালও উঠে এসে বিহুলের মতো বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
দুর্গা ছেলেকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে তার বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে যাচ্ছে, ও আমার সোনা রে, যমের মুখ থিকি ফিরি আসছিস রে। আমি পরের পুন্নিমায় হরির লুট দেব।
অনেক কষ্টে মাকে শান্ত করে তার পাশে দাঁড় করাল হরিপদ। হইচই কান্নাকাটি শুনে পাশের জমিগুলো থেকে অনেকে ছুটে এসেছে। এবং ঘটনাটা জেনে ফেলেছে।
শেখরনাথ জিজ্ঞেস করলেন, সাপটা কোথায় ছিল– ঘাসের জঙ্গলে?
না। পাশের গাছটা দেখিয়ে হরিপদ বলল, ওই গাছের মাথাতি। হঠাৎ ঝপ করি একটা আওয়াজ হল। দেখি যম আমার সামনে খাড়োয়ি (দাঁড়িয়ে) আছে। হয় আমি মরব, না হলি ও। আমার এই বয়সে মরার সাদ (সাধ) লেই। দেলাম হাতের দা-খান চালায়ে। শালো নিপাতি হয়ে গেল।
সাপটার মুণ্ডু এক জায়গায়, ধড় আরেক জায়গায়। ধড়ের ধড়ফড়ানি এখন থেমে গেছে। বনবিভাগের একজন কর্মী দৌড়ে গিয়ে কেরোসিনের টিন নিয়ে এল। সাপটার গায়ে-মাথায় কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল সে। যারা ভিড় জমিয়েছে, তারা সাপের শেষকৃত্য দেখতে লাগল।
নিচু গলায় শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, ছেলেটার কী দুরন্ত সাহস। কী শক্ত নার্ভ। আমি এখন বিপদের মুখে হয়তো মরিয়া হয়ে দা চালিয়ে দিতাম, তারপরেই ফেন্ট হয়ে পড়ে যেতাম। আর হরিপদকে দেখলে, কেমন নির্বিকার হয়ে ঘাস কাটতে শুরু করেছিল। আমার ধারণা, কালাপনি পাড়ি দিয়ে যারা এই দ্বীপে এসেছে, সবাই ওরই মত। দে আর ইনভিনসিবল। এখানেই নতুন দেশ ওরা গড়ে তুলবে। বিনয় প্রায় এই কথাগুলোই একটু অন্যভাবে ভাবছিল। হরিপদ নামে যুবকটিকে এ কদিন দেখছে সে লাজুক, নম্র, বিনয়ী এবং একজন চমৎকার গাইয়ে। গানে গানে সবাইকে মোহিত করে দিয়েছে। কে ভাবতে পেরেছিল সে এভাবে দা চালাতে পারে। মানুষ সত্যিই অপরাজেয়।
» ২.০৯ কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ
দুদিন পর সন্ধের আগে আগে চাল, ডাল, আটা, আলু, তেল, মশলা, গুঁড়ো দুধ ইত্যাদি নিয়ে একটা লরি সরাসরি ক্যাম্প অফিসের সামনে এসে থামল। কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ বণিক খুবই চিন্তায় ছিল। কী কী জিনিস এখানে দরকার তার তালিকা নিয়ে বিশ্বজিৎ সেই যে পোর্ট ব্লেয়ার চলে গিয়েছিলেন তারপর তিনি একেবারে চুপচাপ। পরিতোষের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, বিশ্বজিৎ যেরকম ব্যস্ত মানুষ, অনেকগুলো দপ্তরের দায়িত্ব তাঁকে সামলাতে হয়–হয়তো সেটেলমেন্টের ব্যাপারটা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকবে। এদিকে দু-তিন দিনের ভেতর জেফ্রি পয়েন্টে রসদ এসে না পৌঁছুলে মহা সমস্যা হয়ে যাবে। কিন্তু না, বিশ্বজিৎ ভুলে যাননি। লরি বোঝাই করে ঠিক পাঠিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিনের মতো উদ্বাস্তুদের সঙ্গে জমি থেকে বিনয় আর শেখরনাথ ফিরে এসেছিলেন। সমুদ্র থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে সবাই চাটা খাচ্ছিল। লরি দেখে উদ্বাস্তুরা সেখানে চলে গেল। পায়ে পায়ে বিনয়রাও গেল।
পরিতোষ, লা ডিন, ধনপত এবং পুনর্বাসন আর বনদপ্তরের কর্মীরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। লরিতে অগুনতি চটের বস্তা, সারি সারি টিনের আর কার্ডবোর্ডের বাক্স। তক্ষুনি মাল নামানোর ব্যবস্থা হয়।
কর্মীরা কাঁধে পিঠে বস্তাটস্তা চাপিয়ে ক্যাম্প অফিসের পেছন দিকের গুদাম ঘরে নিয়ে রাখতে থাকে।
লরির ড্রাইভার শেখরনাথ আর পরিতোষের জন্য দুটো সাদা খামের চিঠি নিয়ে এসেছিল, বিনয়ের জন্য একটা বড় প্যাকেট বিশ্বজিৎ পাঠিয়েছেন। ড্রাইভার তিনজনকে সেগুলো বুঝিয়ে দিল।
পরিতোষ তক্ষুনি তার খামটা খুলে চিঠি বার করল। দ্রুত পড়ে নিয়ে বিনয়দের বলল, সারের সব দিকে খেয়াল আছে। এদিকে আমি চিন্তায় অস্থির হইয়া উঠছিলাম। সার লেখছেন এইবার কইলকাতা থিকা যে মাল আইছে, পোর্ট ব্লেয়ারের বিজনেসম্যানরা হেগুলান (সেগুলো) খালাস করতে তিন দিনের জাগায় (জায়গায়) নয় দিন লাগাইছে। হের পর সার চাউল ডাইলের অর্ডার দিছেন। মাল আইতে হেই লেইগা (সেজন্য) এত দেরি অইছে। যাউক, আমার ট্যানশান কমল।
শেখরনাথও তার চিঠিটি পড়ে ফেলেছেন। বিনয়কে বললেন, তোমার সম্বন্ধে বিশু অনেক কথা লিখেছে। রিফিউজি সেটেলমেন্ট কীভাবে গড়ে উঠছে তা তো তুমি নিজের চোখেই দেখছ। বিশুকে তুমি বলেছ, পেনাল কলোনি দেখাবে। সে সম্বন্ধে কাগজে লিখবে। বিশু লিখেছে আমি যেন তোমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাই। কাছেই, দুটো পাহাড়ের পর একটা বড় পেনাল কলোনি আছে। খুব শিগগিরই তোমাকে নিয়ে ওখানে যাব। লেখার প্রচুর মেটিরিয়াল পেয়ে যাবে।
এতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। উৎসুক সুরে বিনয় বলল, নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে যাব। বলল বটে, কিন্তু পরক্ষণে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। হাতের প্যাকেটটা বেশ ভারী। বোঝাই যাচ্ছে, প্রচুর কাগজপত্র রয়েছে ওটার ভেতর। প্যাকেটে বিশ্বজিতের চিঠি নিশ্চয়ই আছে; কিন্তু সে চিঠি আর কত বড় হতে পারে? তার মনে হল, কদিন আগে এখান। থেকে বিশ্বজিৎ যখন পোর্ট ব্লেয়ারে যান, তাঁর হাতে কলকাতা পাঠাবার জন্য শুধু রিপোর্টই নয়, কটা চিঠিও পাঠিয়েছিল। খুব সম্ভব সেগুলোর জবাব এসেছে। বিনয় উদগ্রীব হয়ে উঠল।
এদিকে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীরা আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বিনয় বলল, কাকা, মনে হচ্ছে আমার অনেকগুলো চিঠি এসেছে। মনে হচ্ছে কলকাতা থেকে। ঘরে গিয়ে দেখি
শেখরনাথ বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও। আমি এখানে এদের সঙ্গে একটু গল্প করি।
বিনয় তাদের ঘরে চলে এল। ঘরে জোরালো লণ্ঠন জ্বলছিল। যে কমিটির ওপর আলো জ্বালাবার দায়িত্ব তাদের কোনওদিনই ভুল হয় না; সন্ধে নামতে নামতেই জ্বেলে দিয়ে যায়।
হাতের প্যাকেটটার মুখ খুলে টেবলের ওপর রেখে চেয়ারে বসল বিনয়; তারপর প্যাকেটটার ভেতর থেকে পাঁচখানা খাম বার করল। পাঁচটা খামের ওপরেই তার নাম, পোর্ট ব্লেয়ারে বিশ্বজিৎ রাহার বাংলোর ঠিকনা এবং নিচে কোণের দিকে প্রেরকের নাম লেখা আছে। শুধু একটা খামে গোটা গোটা পরিচ্ছন্ন হরফে তার। আন্দামানের নাম-ঠিকানাই শুধু রয়েছে। কে চিঠিটা লিখেছে তার নাম নেই।
প্রথম চিঠি বিশ্বজিতের। তিনি লিখেছেন, প্রিয়বরেষু, কাকা জেফ্রি পয়েন্টে গেছেন। তার কাছ থেকে ব্রিটিশ আমলের আন্দামান সম্পর্কে যতটা পারেন জেনে নেবেন। এই দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে ওঁর মতো বিশেষজ্ঞ আর জীবিতদের মধ্যে কেউ নেই। আশা করি আপনার কাজকর্ম ভালো চলছে। কলকাতায় পাঠানোর জন্য চিঠি এবং প্রতিবেদন, যা-যা এর মধ্যে লিখেছেন, যে ড্রাইভারটি লরিতে মালপত্র নিয়ে গেছে তার হাতে দেবেন। পাওয়ামাত্র সেগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করব। আপাতত এখানেই শেষ করছি।-বিশ্বজিৎ।
দ্বিতীয় চিঠিটি নতুন ভারত-এর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ির। তিনি লিখেছেন
প্রিয় বিনয়, আন্দামান থেকে তোমার পাঠানো তিনটি প্রতিবেদন পেয়েছি। আমাদের কাগজে ছাপাও হয়ে গেছে। পাঠকদের রেসপন্স দুর্দান্ত। এডিটর জগদীশ গুহঠাকুরতা খুব খুশি। আমাকে এবং নিউজ এডিটর তারাপদদাকে তার চেম্বারে ডেকে নিয়ে তোমার লেখাগুলোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। অবিলম্বে আরও লেখা পাঠাও। তোমাকে যেমন বলে দিয়েছিলাম, নিশ্চয়ই সেসব মনে আছে। শুরু রিফিউজি সেটেলমেন্ট নয়, পেনাল কলোনি, ওখানকার ট্রাইবালদের লাইফ, সেলুলার জেলের বর্তমান অবস্থা, তার ইতিহাস, প্রাকৃতিক পরিবেশ-কোনও কিছুই বাদ দেবে না।
তোমার লেখাগুলোর সঙ্গে ছবি থাকলে গুরুত্ব আরও বাড়ত। রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে ফোটোটা খুব জরুরি। আমাদের একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে একটা ক্যামেরা দেওয়া উচিত ছিল। জগদীশবাবু বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। যতদিন না ওটা পৌঁছাচ্ছে, ওখানকার কারওকে দিয়ে যদি ফোটো পাঠাতে পার, সেই চেষ্টা করো।
এবার কলকাতার কথা জানাই। তুমি আন্দামানে যাবার আগেই রিফিউজিদের নিয়ে নানারকম মুভমেন্টে শহরটা অস্থির হয়ে উঠেছিল। এখন একেবারে উত্তাল। তুমি দেখে গেছ, লেফট পার্টিগুলোর অর্গানাইজেশন ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল (আর.এস.পি বাদে), সংক্ষেপে ইউসিআরসি, রিফিউজি সেন্ট্রাল রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল, সংক্ষেপে আর সি আর সি, দক্ষিণ কলিকাতা শহরতলি বাস্তুহারা সংহতি–এইসব সংগঠন রোজ সারা শহর জুড়ে কত যে মিছিল বার করছে তার লেখাজোখা নেই। শুধু রিফিউজিদের নিয়ে মিছিল, মিটিং আর স্লোগান।
কলকাতার চারপাশে জলাজমি পতিত জমি আর হোগলাবনে উদ্বাস্তুরা অগুনতি জবরদখল কলোনি বসিয়েছে, সেসব কলোনির নানা বিবরণ নতুন ভারত-এ দিনের পর দিন তুমি লিখে গেছ। গুন্ডাবাহিনী দিয়ে জমির মালিকরা তাদের উৎখাত করতে চেয়েছে। উদ্বাস্তুরা তাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে তাদের দখল কায়েম রেখে চলেছে। কিন্তু মালিকপক্ষ এবার অন্য পথ ধরেছে। সরকারের ওপর চাপ দিয়ে বাস্তুহারাদের কলোনিগুলো থেকে উচ্ছেদ করবে, এমন একটা বিল আনতে চলেছে। ইউ সি আর সি, আর সি আর সি এবং উদ্বাস্তুদের অন্য সংগঠনগুলো এই উচ্ছেদ বিলের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছে। কলকাতা খুব শিগগিরই বিশাল রণক্ষেত্র হয়ে উঠতে চলেছে। কত যে রক্তক্ষয় হবে, কে জানে। সুষ্ঠু পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেই, পোড় জমি, জলা উদ্ধার করে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষগুলো কোনওরকমে মাথা গোঁজার একটু জায়গা করে নিতে চাইছে সেটাও তাদের দেওয়া হবে না। তাহলে লক্ষ লক্ষ এই মানুষের কী ভবিষ্যৎ?
যা-ই হোক, কলকাতার এই রিফিউজি মুভমেন্টের অ্যাসাইনমেন্টটা পাওয়ার জন্য রমেন বিশ্বাস আমাকে আর তারাপদদাকে খুব ধরাধরি করেছিল। লোকটা ভালো নয়, তোমাকে ভীষণ ঈর্ষা করে, তুমি যে ভালো কাজ করছ সেটা ওর দুচোখের বিষ। আমরা ওকে অ্যাসাইনমেন্টটা দিইনি, দিয়েছি সুধেন্দুকে। জগদীশবাবু চান, তুমি ফিরে এলে তোমাকেই এটা দেওয়া হবে।
আশা করি ভালো আছ। তোমার চিঠি এবং প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করে থাকব।-হতি প্রসাদদা।
চিঠিটা পড়ে মন ভালো হয়ে গেল। তার লেখার সমাদর হয়েছে, পাঠকরা তার কাছ থেকে আন্দামান দ্বীপমালা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানার জন্য আগ্রহী, এটা তার উদ্দীপনাকে যেন উসকে দিতে লাগল।
সবচেয়ে বড় কথা, রমেন বিশ্বাসকে কলকাতার উদ্বাস্তু আন্দোলন কভার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এই কুচুটে, হিংসুটে ঈর্ষাকাতর লোকটাকে বিনয় যে আদৌ পছন্দ করে না প্রসাদদারা তা জানেন। ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল বিনয়ের।
তৃতীয় চিঠিটা আনন্দর। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি। সে লিখেছে, বিনয়ের জন্য তাদের দুশ্চিন্তা ছিল। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অতটা পথ গেছে! চিন্তাটা স্বাভাবিক। তার পৌঁছানো সংবাদ পেয়ে আনন্দদারা খুশি। বিনয়ের লেখা তারা কাগজে পড়ছে। খুব আন্তরিক লেখা, মনকে নাড়া দিয়ে যায়। তাদের বাড়ির সবাই ভালো আছে। সুধাদের সঙ্গে এর মধ্যে দেখা হয়নি। খুব শিগগিরই একদিন সুনীতিকে নিয়ে তাদের বাড়ি যাবে। বিনয় যেন নিয়মিত চিঠি লেখে ইত্যাদি ইত্যাদি।
চতুর্থ চিঠিটা সুধার। সে লিখেছে:
স্নেহের বিনু, তোর চিঠি আসতে বেশ কয়েকদিন লাগল। তুই বলে গিয়েছিলি, আন্দামান থেকে কলকাতায় চিঠিপত্র পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। তবু ভাবনা হয় বইকি। যাক, তোর চিঠি পেয়ে চিন্তা কাটল। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে আছিস। লিখেছিস চারদিকে জঙ্গল, পাহাড়, সাপখোপ, বড় বড় চেলা বিছে, জেঁক, সমুদ্রে হাঙর। এসব জেনে ভীষণ ভয় হয়। খুব সাবধানে থাকবি। সময়মতো খাওয়াদাওয়া করবি। অবশ্য ওই ঘোর জঙ্গলে খাবারদাবার কী জোটে, সে সম্বন্ধে কিছু লিখিসনি। মনে হচ্ছে, খাওয়া দাওয়ার খুব অসুবিধা হচ্ছে। কলকাতায় ভালো চাকরি নিয়ে কত আরামে থাকতে পারতিস কিন্তু ঘাড়ে ভূত চাপল, খবরের কাগজে কাজ করবি। এখন বোঝা কষ্ট কাকে বলে। নিজেই এমন একটা কাজ বেছে নিয়েছিস। কে আর কী করতে পারে?
এবার এখানকার খবর জানাচ্ছি। আমার দাদাশ্বশুর, তোদের। দ্বারিকদাদুকে নিয়ে কদিন যমে-মানুষে টানাটানি গেল। ধুম জ্বর, সেই জ্বর আর রেমিশন হয় না। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। মনে হচ্ছিল বাঁচানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত মা কালী, মা দুর্গা, মা লক্ষ্মীদের করুণায় ধাক্কাটা সামলে উঠতে পেরেছেন। এ-যাত্রা বেঁচেই গেলেন। তবে ভীষণ কাহিল হয়ে পড়েছেন। কাল ডাক্তার অন্নপথ্য দিতে বলেছেন। এই বয়সে শরীর পুরোপুরি সেরে উঠতে কতদিন লেগে যাবে, ভগবানই জানেন। আমার জেঠশাশুড়িকে যেমন দেখে গিয়েছিলি তেমনই আছেন। ওই ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে থাকা। তোর হিরণদার অফিসে কাজের চাপ ভীষণ বেড়েছে। তার ওপর দাদাখশুরের জন্য রাত জাগা। বেচারি একেবারে হিমশিম খেয়ে গেছে। আমার এবং উমারও একই হাল।
সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার, রাজদিয়া থেকে হেমদাদুর কোনও চিঠিপত্র পাচ্ছি না। দেশের কী হাল, ওঁরা কী অবস্থায় আছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। নিত্য দাসের মারফত দাদুর চিঠিটিঠি পাই। তুই আন্দামানে চলে যাবার পর থেকে সে একবারও আমাদের বাড়ি আসেনি। কসবায় ওদের ঠিকানা জানি। ভাবছি, তোর হিরণদাকে সামনের রবিবার নিত্য দাসের বাড়ি পাঠাব। দেখা যাক, রাজদিয়ার কোনও খবর পাওয়া যায় কিনা।
যুগল অবশ্য ফি সপ্তাহে একবার দেখা করে যায়। ওদের কলোনি নিয়ে খুব হুজ্জ্বত চলছে। সরকার নাকি বিল আনতে চলেছে জবরদখল কলোনি থেকে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করবে। এই নিয়ে রাজনৈতিক কটা দল তুমুল আন্দোলন শুরু করেছে। যুগলরাও সেই আন্দোলনে রয়েছে। তবে একটা সুখবর মুকুন্দপুরে আশু মাস্টারমশাইয়ের স্কুল খুব জমে উঠেছে। যুগলরা সবাই চায়। তাদের জীবন তো নিরক্ষর হয়েই কেটে গেল। তাদের। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক। পেটে বিদ্যা না থাকলে এদেশে এসে টিকে থাকা যাবে না।
আজ এখানেই শেষ করছি। তুই আমাদের বুকভরা স্নেহ-ভালোবাসা নিস। চিঠি পাওয়া মাত্র উত্তর দিবি। ইতি ছোটদি।
চিঠিটা ভাঁজ করে খামের ভেতর পুরে রাখল বিনয়।
বাকি রইল শেষ চিঠিটা। খামের ওপর সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম লেখা রয়েছে: শ্রীবিনয়কুমার বসু। অন্য খামগুলোর তলায় বাঁ দিকে প্রেরকের নাম রয়েছে। কিন্তু এটার তলায় সেরকম কিছু নেই। হাতের লেখাটাও চেনা চেনা মনে হচ্ছে না। কে হতে পারে? কার চিঠি?
রীতিমতো কৌতূহলই হল বিনয়ের। হাত বাড়িয়ে খামটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে খুলে ফেলল সে। খুব বড় চিঠি নয়। পুরোটা পড়ার আগে একেবারে তলার দিকটা দেখে নিল। সেখানে ঝুমার নাম লেখা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে তীব্র ঝংকারের মতো শিহরন খেলে গেল।
সুধা আনন্দ প্রসাদ লাহিড়িকে চিঠি লিখেছিল বিনয়। ঝুমা বাদ। কিন্তু সে যে তাকে চিঠি লিখবে, কে ভাবতে পেরেছিল। রুদ্ধশ্বাসে বিনয় পড়তে লাগল।
প্রিয়তম, তুমি আন্দামানে যাবার সময় কথা দিয়ে গিয়েছিলে, দু-তিনদিন পর পর তুমি আমাকে চিঠি লিখবে। তারই জন্য আশায় আশায় প্রতি মুহূর্ত কাটিয়ে গেছি। রোজ পোস্টম্যান আসে, বাড়ির অন্য সবার চিঠি দিয়ে যায়। যার চিঠির জন্য চোখ মেলে বসে থাকি সেটাই শুধু আসে না। ব্যর্থ আমার প্রতীক্ষা।
হঠাৎ একদিন শুনলাম, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবাইকে তুমি চিঠি লিখেছ, শুধু আমিই বাদ। শুনে আমার যে কী কষ্ট, কী যাতনা, মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর জ্বলন্ত শেল বিঁধে যাচ্ছে। কটা দিন ভালো করে ঘুমোতে পারিনি, খেতে পারিনি। উদ্ভ্রান্তের মতো কাটিয়ে দিয়েছি।
জানো না, তুমি রয়েছ আমার জীবনজুড়ে? তুমি যে আমার কতখানি, কী করে বোঝাই? চোখ মেললেও তোমাকে দেখতে পাই, চোখ খুললেও তুমি! আমার ছোট্ট ভুবনে শুধু তুমি, তুমি আর তুমি!
আন্দামান তো কলকাতা থেকে মাত্র আটশো পঞ্চাশ-যাট মাইল দূরে। অন্য কোনও গ্রহে নয়। এতটুকু দূরত্বে গিয়ে, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তুমি আমাকে ভুলে গেলে? অন্যদের চিঠি লেখার আগে আমাকেই তো তোমার লেখার কথা। কী আমার অপরাধ, কোথায় আমার ত্রুটি, তার তলকূল পাচ্ছি না।
শেষ পর্যন্ত কতরকম চাতুরি করে আনন্দমামার কাছ থেকে তোমার ঠিকানা জোগাড় করেছি তা আমিই জানি। ঠিকানাটা পেয়েই চিঠি লিখতে বসে গেলাম।
অন্যের চিঠিতে জানতে পেরেছি তুমি যেখানে আছ সেই জায়গাটায় গভীর জঙ্গল, পাশেই সমুদ্র। নিশ্চয়ই খুব অস্বাস্থ্যকর। এলাকা। খুব সাবধানে থাকবে। নিজের শরীরের ওপর যত্ন নিও।
একটাই মিনতি, আমাকে ভুলো না, ভুলো না, ভুলো না। তোমাকে ঘিরে, তোমাকে নিয়েই আমার একমাত্র স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন যদি পূরণ না হয়, আমি ভেঙে চুরমার হয়ে যাব।
তুমি চলে যাবার পর থেকে সারাক্ষণ আমি অস্থির হয়ে থাকি। আমাকে আর কষ্ট দিও না। এই চিঠি পেয়েই উত্তর দেবে। ইতি তোমার ঝুমা।
চিঠিটা পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে বিনয়। সারা শরীরে। কেমন একটা অসাড় অসাড় ভাব। জানালার বাইরে, একটু দূরে হ্যাঁজাক আর জোরালো লণ্ঠনের আলোয় শেখরনাথ উদ্বাস্তুদের সঙ্গে গল্প করছেন। এত আলো তবু তাদের যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সব যেন সারি সারি ছায়ামূর্তি। আরও দূরে পশ্চিম আর দক্ষিণ দিকের পাহাড়গুলোকে ঝাপসা দৈত্যের মতো মনে হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ অনভূতিশূন্যের মতো কেটে গেল বিনয়ের। তারপর, আচমকা সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলজুড়ে তুমুল আলোড়ন শুরু হয়ে গেল।
পূর্ব বাংলার সুদূর স্বপ্নের মতো এক ভূখণ্ডে সেই কোন অল্প বয়স থেকে দুই কিশোরীকে নিয়ে আরম্ভ হয়েছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর টানাপোড়েন। সেই কিশোরীরা এখন ভরপুর যুবতী, বিনয় নিজেও পূর্ণ যুবক। মনে হয় শত আলোকবর্ষ ধরে এই দুই নারীকে নিয়ে নিজের সঙ্গেই তার অবিরল যুদ্ধ চলেছে। কখনও চিরদুঃখী ঝিনুক নাড়ি ধরে টান দেয়, কখনও তীব্র আকর্ষণে তাকে যেন শিকড়সুদ্ধ উপড়ে তার কাছে নিয়ে যায় ঝুমা। এটাই বুঝিবা তার ভবিতব্য।
রস আইল্যান্ডে চকিতের জন্য চলুঙ্গা জাহাজে ঝিনুককে দেখার পর থেকে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে একদিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল সে। ভুলে গিয়েছিল ঝিনুক যখন নিরুদ্দেশ, জীবনের অপার শূন্যতাকে ধীরে ধীরে ভরিয়ে দিয়েছিল ঝুমা। অসীম আগ্রহে তারই জন্য প্রতীক্ষা করে আছে মেয়েটা। কোনওদিনই রূঢ়ভাবে তাকে সরিয়ে দিতে পারেনি, বলতে পারেনি ঝিনুক ছাড়া অন্য কোনও নারীর কথা সে ভাববে না, ভাবতে পারে না। বরং কলকাতা থেকে আসার সময় ঝুমার হাতে স্বপ্নের একটি ভূমণ্ডল তুলে দিয়ে এসেছিল। শুধু ঝুমাই নয়, তার বাবা-মা-ঠাকুরদা-ঠাকুমা, মামাবাড়ির সবাই তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
কিন্তু বহুদিন বাদে ঝিনুককে দেখার পর পৃথিবী ওলপালট হয়ে গেছে। যে মেয়েটা কোন ছেলেবেলা থেকে তার শ্বাসবায়ুতে মিশে আছে, তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না বিনয়। সে ভীরু, সে কাপুরুষ, একনিষ্ঠ হতে কোনও দিনই পারেনি। এজন্য নিজেকে আগেও ধিক্কার দিয়েছে, আজও দিতে লাগল। আর তারই মধ্যে একটা যুক্তি খাড়া করে নিজেকে শক্ত করে নিল।
ঝুমা রূপসী, শিক্ষিতা, বনেদি বংশের মেয়ে। তার বাবার অঢেল অর্থ, বিপুল প্রতিষ্ঠা। তারা চোখের পলকে ঝুমার ঝলমলে, চোখধাঁধানো ভবিষ্যৎ তৈরি করে দিতে পারবেন। একটা আঙুল তুলে ইশারা করলে কলকাতার সেরা সেরা বিত্তবান বংশের উচ্চশিক্ষিত, ঝকঝকে, রূপবান ছেলেরা তাদের বাড়ির সামনে ভিড় জমিয়ে দিত। নেহাত ঝুমা বিনয়ের জন্য জেদ ধরে বসেছিল সেজন্য হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশির রামকেশব হেমনলিনীরা রাজি হয়েছিলেন।
কিন্তু ঝিনুক? সে ধর্ষিত। অপমানে, অসম্মানে, অন্তহীন গ্লানিবোধে সে কুঁকড়ে থাকত। একদিন তো ক্ষোভে অভিমানে নিখোঁজই হয়ে গেল। যাদের সঙ্গে সে মিডল আন্দামানে গেছে, তাদের সন্ধান কীভাবে পেল, কে জানে। তারা যে উদ্বাস্তু তা নিয়ে, অবশ্য সংশয় নেই। তা না হলে আন্দামানে তাদের আসাই হত না। কিন্তু তারা কেমন মানুষ, তাদের মধ্যে কতটা মর্যাদা নিয়ে সে। আছে, তার আশ্রয়দাতারা কি তার বেদনাদায়ক ইতিহাসটা জানে? সেসব তার সঙ্গে দেখা না হলে জানার উপায় নেই।
ঝিনুক পা রাখার একটু জায়গা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু অন্যের আশ্রয়ে বাকি লম্বা জীবনটা কাটানো কি সম্ভব? যাদের কাছে সে আছে, একদিন তারা বোঝা মনে করে ছুঁড়েও তো ফেলে দিতে পারে। মানুষের পক্ষে কতটা মহানুভব, কত হৃদয়বান হওয়া সম্ভব? তখন?
না, আর ভাবতে পারে না বিনয়। কবে যে ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হবে। তার চারপাশ ঘিরে এখন শুধু ঝিনুক, ঝিনুক আর ঝিনুক।
ঝিনুককে নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেলে খুবই দুঃখ পাবে ঝুমা, কষ্টে তার বুক চৌচির হয়ে যাবে। কিছুদিন মুহ্যমানের মতো কেটে যাবে তার। খাবে না, ঘুমোবেনা। সবার সামনে না হলেও গোপনে অঝোরে কাঁদবে। তারপর? তারপর আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির মতো সব কিছু সহজ, স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তার জীবন থেকে একদিন দূর নীহারিকায় বিলীন হয়ে যাবে বিনয়।
কতক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে ছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ শেখরনাথের ডাকে চমকে ওঠে বিনয়।
বেশ রাত হয়েছে। খাবার দেওয়া শুরু হয়েছে। চল
খাওয়ার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না বিনয়ের। জীবনের দুই প্রান্তের দুই নারী তাকে ভেতরে ভেতরে এতটাই ব্যাকুল, এতটাই বিচলিত করে রেখেছিল যে খিদে-তেষ্টার বোধটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে নেই বললে শেখরনাথ ছাড়বেন না, তাঁকে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে। নিঃশব্দে চিঠিগুলো টেবিলের দেরাজে রেখে ধীরে ধীরে উঠে পড়ল বিনয়।
২.১০ বহু মানুষের চেঁচামেচি
তখনও ভালো করে ভোর হয়নি, হঠাৎ বহু মানুষের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল বিনয়, আর শেখরনাথের। বন্ধ দরজার বাইরে থেকে জোরে জোরে ধাক্কাও দিচ্ছে কেউ কেউ।
তারই মধ্যে পরিতোষের গলা শোনা গেল, কাকা, কাকা, তরাতরি দুয়ার খোলেন।
বিনয় এবং শেখরনাথ বিছানা থেকে নেমে পড়েছিলেন। বিনয় লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। শেখরনাথও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাইরে সারি সারি উদ্বিগ্ন মুখ। পরিতোষ এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে বেশ কিছু উদ্বাস্তুও রয়েছে। তারা সবাই বয়ষ্ক পুরুষ এবং মেয়েমানুষ। তাদের মধ্যে খুলনা জেলার সৃষ্টিধর বারুইকেও দেখা গেল। তার উৎকণ্ঠাই সবচেয়ে বেশি। ভেতরকার চাপা ত্রাসে ঘন ঘন ঢোক গিলছে।
বিনয়রা রীতিমতো অবাক তো হয়েছেই। এই ভোরবেলায় এতগুলো লোক আচমকা চলে এসেছে। তাদের মুখচোখের চেহারা দেখে দুজনের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।
শেখরনাথ ব্যগ্র স্বরে জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার, কী হয়েছে?
একটি মাঝবয়সি সধবা মেয়েমানুষ, কপালের আধাআধি অবধি ঘোমটা টানা- শেখরনাথকে বলল, ছিষ্টিধরের বউয়ের ব্যথা উঠছে। যন্তরনায় কাতরাইতে আছে। একজন ডাক্তর কি দাই না পাইলে মহা বিপদ অইয়া যাইব। আপনে এট্টা কিছু ব্যাবোস্তা করেন।
সেই পূর্ণগর্ভা বউটির কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। সেদিন সৃষ্টিধরের সঙ্গে কত কষ্ট করেই না তাদের জমির আগাছা সাফ করছিল। মনে আছে, শেখরনাথ এই সেটেলমেন্টে একজন ডাক্তার পাঠানোর জন্য বিশ্বজিৎকে খবর পাঠিয়েছিলেন। সেই ডাক্তার এখনও এসে পৌঁছায়নি। সরকারি ব্যাপার, অনেকরকম নিয়মকানুন আছে। মুখের কথা খসালেই ব্যবস্থা করা যায় না। এদিকে সৃষ্টিধরের বউটি প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এই মুহূর্তে কীভাবে নির্বিঘ্নে তার সন্তানটির জন্ম হবে ভেবে পেল না বিনয়। হতবুদ্ধির মতো সে তাকিয়ে রইল।
ওধারে শেখরনাথ চকিতে কিছু ভেবে নিলেন। তারপর পুবদিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ওই দিকের তিনটে পাহাড়ের ওধারে যে নতুন রিফিউজি সেটেলমেন্ট বসেছে, শুনেছি সেখানে। একজন দাই আছে। চাল ডাল আর অন্য সব মালপত্র নিয়ে সেই যে ট্রাকটা এসেছিল সেটা কি ফিরে গেছে?
পরিতোষ বলল, না কাকা
তাকে রেডি হতে বল, আমাকে নিয়ে ওই সেটেলমেন্টে যাবে। আমি মুখটুখু ধুয়ে বাসি কাপড়চোপড় পালটে নিই।
পরিতোষ নিজেই দৌড়ে চলে গেল।
বিনয় আগেই ওধারের উদ্বাস্তু কলোনি আর ব্রিটিশ আমলের পেনাল সেটেলমেন্টের খবর পেয়েছে। সেখানে যাবার এই সুযোগটা ছাড়তে চাইল না। আগ্রহের সুরে বলল, কাকা, আপনার। সঙ্গে যেতে চাই।
শেখরনাথ একটু হাসলেন।-বুঝেছি। জার্নালিস্ট তো। ওই দিকের সেটেলমেন্ট টেটেলমেন্ট দেখে কাগজে লিখতে চাও। কিন্তু এবার তো তোমার পক্ষে ওখানে থাকা যাবে না। আমি গিয়েই দাইকে নিয়ে ফিরে আসব। খানিক ভেবে বললেন, এত যখন ইচ্ছে, চল। ওখানকার মাতবরদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। পরে গিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে ভালো করে ইনফরমেশন। জোগাড় করে লিখো। নাও, এখন চটপট তৈরি হয়ে নাও। পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা মেয়েরা যে ব্যারাকে থাকে তার একধারে বাঁশের বেড়াটেড়া দিয়ে আঁতুড়ঘর করে রাখ। আমরা দুপুরের মধ্যে ফিরে আসব। প্রার্থনা কর, তার ভেতর বাচ্চা যেন না হয়ে যায়।
.
এমনই উৎকণ্ঠা যে বিনয়দের চাটা খাওয়া হল না। ট্রাকে ড্রাইভারের পাশে বসে বেরিয়ে পড়লেন।
পাহাড়ের পর পাহাড়। সেগুলোর কোমর বুক পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কালো মসৃণ পিচের রাস্তা। এই রাস্তা বিনয়ের চেনা। কদিন আগেই এই পথে ব্যাম্বু ফ্ল্যাট থেকে বিশ্বজিৎদের সঙ্গে সে জেফ্রি পয়েন্টে এসেছিল। ট্রাক কখনও চড়াইতে উঠছে, কখনও উতরাইতে নামছে। রাস্তার একধারে গভীর জঙ্গলে ভরা পাহাড়, অন্য দিকে খাদ। খাদের ওধারে আবার পাহাড়।
ঘণ্টাখানেক চলার পর রাস্তাটা দুভাগ হয়ে একটা চলে গেছে সোজা, অন্যটা ডান দিকে। ট্রাকটা ডান পাশের রাস্তাটা ধরল। এদিকটা বিনয়ের পুরোপুরি অচেনা।
খানিকটা যাবার পর দুই পাহাড়ের মাঝখানে অনেকখানি জায়গা মোটামুটি সমতল। তার একধারে টিন কি টালির চাল-দেওয়া কাঠের একতলা কি দোঁতলা। সব মিলিয়ে প্রায় ষাট-সত্তরটা। এই ধরনের বাড়ি বর্মায় দেখা যায়। বিনয় ছবিতে দেখেছে।
বাড়িগুলো পুরানো, কম করে তিরিশ চল্লিশ বছর আগের তৈরি।
শেখরনাথ বললেন, এটা হল পেনাল কলোনি। ব্রিটিশ আমলে গড়ে উঠেছিল। নাম কী জানো?
বিনয় ঘাড় নাড়ল।–না।
ওয়ান্ডুর। বর্মায় ওই নামে একটা ছোট শহর আছে। আন্দামানের কলোনিতে এইরকম নাম দেওয়া হল কেন, ভেবে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছ।
তা হচ্ছি।
নাইনটিন থার্টি ফাইভের আগে বর্মা ছিল ইন্ডিয়ার একটা অংশ বা প্রভিন্স। সেখান থেকে মার্কামারা ডাকাত, খুনিরা আন্দামানে জেল খাটতে আসত। এদের মধ্যে পুরুষও ছিল, মেয়েও ছিল। তারা আর দেশে ফিরে যায়নি। বিয়েটিয়ে করে এখানেই কলোনি বসিয়েছে। কিন্তু জন্মভূমির কথা ভুলতে পারেনি। তাই নিজেদের কলোনির নাম রেখেছে বর্মার কোনও গ্রাম কি শহরের নামে। সাউথ আন্দামানে এরকম আরও সাত-আটটা কলোনি রয়েছে– মেমিও, মৌলমিন, পোগো এমনি নানা নাম। অবশ্য এই ওয়ান্ডুর বর্মিতে বর্মিতেই শুধু বিয়ে হয়নি। অনেক বর্মি মেয়ে ইন্ডিয়ার অন্য প্রভিন্সের লোকজন, যেমন বাঙালি, শিখ, তামিল, মোপলাদের বিয়ে করেছে। বেশকিছু বর্মি পুরুষও তা-ই। তাদের স্ত্রীরা কেউ পাঠান, কেউ মারাঠি, কেউ বিহারি।
যেন আশ্চর্য এক রূপকথা শুনছিল বিনয়। অপার কৌতূহলে জিগ্যেস করে, এদের বিয়ে কী করে হত?
আমি আর কতটুকু বলতে পারব? পরে এসে যখন তুমি কিছুদিন পেনাল কলোনিতে থাকবে, সেই সময় ব্রিটিশ আমলের যে কয়েদিরা বিয়ে করেছে তাদের মুখে ডিটেলে শুনতে পাবে।
বিনয় আর প্রশ্ন করল না। উইন্ড স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল। পেনাল কলোনি থেকে বেশ খানিকটা দূরে সারি সারি অগুনতি টিন এবং টালির চালের ঘর চোখে পড়ল। অনেকটা পুববাংলার ঘরবাড়ির মতো। সেগুলোর গা ঘেঁষে মাইলখানেক, কি তারও বেশি জায়গা জুড়ে হাল-লাঙল চলছে। বোঝা যায় একসময় ওখানে ঘোর জঙ্গল ছিল; সেসব সাফ করে জমি বার করা হয়েছে। তার ডান পাশে সমুদ্র।
ঘরগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করল, মনে হচ্ছে, ওখানে নতুন একটা সেটেলমেন্ট হয়েছে।
হা ওটা রিফিউজি সেটেলমেন্ট। জেফ্রি পয়েন্টের সেটেলমেন্টের মাস ছয়েক আগে ওটা বসানো হয়েছে। দেখ এর মধ্যে চাষবাসও শুরু হয়ে গেছে। যে দাইয়ের জন্যে এসেছি, সে ওখানে থাকে।
কিন্তু উদ্বাস্তু সেটেলমেন্টে যাওয়া হল না। ট্রাক যখন ওয়ারের কাছাকাছি এসে পড়েছে হঠাৎ পাশের একটা কাঠের বাড়ি থেকে লুঙ্গি কুর্তা পরা একটা মাঝারি হাইটের লোক পেটানো মজবুত চেহারা, তামাটে রং, চুলের বেশির ভাগটাই ধবধবে, বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হইহই করতে করতে রাস্তার মাঝখানে এসে দুদিকে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।–রুখখা, রুখো। রুখ যাও
অগত্যা ট্রাকটাকে থামতে হল। রাস্তার লোকটা আরও কাছে এসে হিন্দি-উর্দু মেশানো হিন্দুস্থানিতে শেখরনাথকে বলল, চাচাজি আপ!
বিনয় আগেই জেনেছে শেখরনাথ আন্দামানের সার্বজনীন কাকা বা চাচা। তিনি বললেন, একটা জরুরি কাজে এখানকার রিফিউজি সেটেলমেন্টে যেতে হচ্ছে। তোরা কেমন আছিস, রঘুবীর সিং? মা ফুন ভালো আছে?
লোকটি অর্থাৎ রসুবীর তড়বড় করে বলে, আপনার মেহেরবানিতে ঠিক আছি। কিয়া খুশনসিব ম্যায় নে। কত রোজ বাদে আপনাকে দেখতে পেলাম। আইয়ে আইয়ে– উতারকে আইয়ে–
না রঘুবীর, আজ সময় হবে না। রিফিউজি সেটেলমেন্ট থেকে একজনকে নিয়ে আমাকে দুপুরের মধ্যে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যেতে হবে। তুই রাস্তা থেকে সর। গাড়ি যেতে পারছে না।
রঘুবীর সরল তো না-ই, সামনের বাড়িটার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁক পাড়তে লাগল, মা ফুন, এ মা ফুন। জলদি নিকালকে আ
প্রায় দৌড়েই একটি বর্মি মেয়েমানুষ বেরিয়ে এল। তারও যথেষ্ট বয়স হয়েছে, ষাটের কাছাকাছি তো বটেই। চুল কাঁচাপাকা। মঙ্গোলিয়ানদের মতো চেরা চোখ। এই বয়সেও শরীরের বাঁধুনি অটুট। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালে আঁতকে উঠতে হয়। লম্বা লম্বা কালো দাগ। এলোপাতাড়ি ছুরি চালাবার পর ক্ষত শুকোলে যেমন দেখায় সেইরকম। দেখলে চমকে উঠতে হয়। তার পরনে লুঙ্গি এবং কুর্তা। বর্মি মেয়েদের পোশাক।
রঘুবীর তাকে বলল, এই দ্যাখ, চাচাজি এখানে না নেমে সিধা রিফিউজিদের কলোনিতে চলে যাচ্ছে।
মা ফুন হুলুস্থুল বাধিয়ে দিল।-কভি নেহি, কভি নেহি। এতকাল পর এসেছেন। আমাদের কোঠিতে না গেলে রাস্তা ছাড়ব না।
শেখরনাথ বোঝান, দ্রুত জেফ্রি পয়েন্টে না ফিরলে একজনের মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
রঘুবীররা এবার একটু থমকে যায়। মা ফুন জিগ্যেস করে, কী হয়েছে?
এখানে আসার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দেন শেখরনাথ।
রঘুবীর বলে, ঠিক হ্যায়। রিফিউজি কলোনির ওই দাইকে আমরা চিনি। বাচ্চা পয়দা করায়। নাম মনসা। আপনারা আমাদের কোঠিতে বসুন। চায়-পানি খান। আপনার নাম করে তোক পাঠিয়ে তাকে ডাকিয়ে আনছি। উতারিয়ে উতারিয়ে
মা ফুনও তার সঙ্গে সুর মেলাল। শেখরনাথকে কিছুতেই ছাড়া হবে না। এতদিন বাদে এই এলাকায় এসে তিনি বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাবেন, তা-ই কখনও হয় নাকি? ট্রাকের সামনে তারা দাঁড়িয়ে থাকবে। শেখরনাথদের যেতে হলে তাদের চাপা দিয়ে যেতে হবে।
শেখরনাথ বিপন্ন মুখে একবার বিয়ের দিকে তাকালেন। তারপর হেসে ফেললেন। এদের হাত থেকে নিস্তার নেই। চল, নেমে পড়া যাক। অবশ্য যে জন্যে এখানে আসা, সেটা হয়ে যাবে। মনসা দাই এলেই তাকে নিয়ে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যাব।
বিনয় কিছু বলল না। শেখরনাথকে আন্দামানের মানুষজন কতটা ভালোবাসে, কতখানি শ্রদ্ধা করে, তা আরও একবার নিজের চোখেই দেখতে পেল।
রঘুবীররা শেখরনাথ আর বিনয়কে তাদের বাড়ির ভেতর একটা সাজানো গোছানো ঘরে এনে বসাল। সব আসবাব কাঠের আর বেতের। আলমারি, তক্তপোশ, গদিওলা মোড়া, চেয়ার কী নেই নেই! এক দেওয়ালে রেঙ্গুনের সোয়েডামিন প্যাগোডার ফ্রেমে বাঁধানো বিরাট ফটো অন্যদিকে তেমনি ফ্রেমে বাঁধানো শিউশঙ্করজির ছবি। বিনয় আন্দাজ করে নিল ফুন বৌদ্ধ এবং রঘুবীর হিন্দু।
মা ফুন অনর্গল, পরিষ্কার হিন্দুস্থানিতে শেখরনাথকে বলতে লাগল, আপনাকে দেখে কী খুশি যে হয়েছি! এখানে আরাম করে বসুন। চায়-পানি করে আনি।
এদিকে শেখরনাথের নাম করে মনসাকে ধরে আনার জন্য পেনাল কলোনির একটি বর্মি ছেলেকে রিফিউজি সেটেলমেন্টে পাঠিয়ে রঘুবীর বিনয়রা যে ঘরে বসে ছিল সেখানে ফিরে এল। কিন্তু চেয়ার বা মোড়ায় বসল না, নিচে কাঠের মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়ল।
শেখরনাথ বললেন, এটা কী হচ্ছে, উঠে একটা মোড়ায় বোস।
জিভ কেটে রঘুবীর যা বলল তা এইরকম। শেখরনাথের মতো একজন সম্মানিত মানুষ, যিনি, দেশের আজাদির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন, তাঁর সামনে উঁচু জায়গায় তার পক্ষে বসা সম্ভব নয়। তার উপযুক্ত জায়গা শেখরনাথের পায়ের তলায়।
শেখরনাথ হাসলেন। এদের নিয়ে পারা যায় না।
রঘুবীর জিগ্যেস করল, আপনার তবিয়ত আচ্ছা হ্যায় তো?
হ্যাঁ। তোরা কেমন আছিস?
আপনার মেহেরবানিতে ঠিক হ্যায়।কথা বলতে বলতে গভীর আগ্রহে রঘুবীর বারবার বিয়ের দিকে তাকাচ্ছিল।
শেখরনাথ বললেন, তোর ছেলেকে তো মাদ্রাজে পাঠিয়েছিলি। সেখানে ঠিকমতো পড়াশোনা করছে?
হ্যাঁ। রঘুবীর প্রাণ খুলে হাসল। ছেলেটা তার মাবাপের মতো বজ্জাত হয়নি। বিলকুল জেন্টলম্যান। পড়াশোনা ছাড়া আউর কুছু বোঝে না। জজ-ম্যাজিস্টর হবে।তারপরেই বিনয়কে দেখিয়ে জিগ্যেস করল, এই বাবুজিকে তো চিনতে পারলাম না চাচাজি।
শেখরনাথ বললেন, ওই দ্যাখ, তোদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে। দিতে ভুল হয়ে গেছে। ওর নাম বিনয় বসু। কলকাতার এক আখবরের পত্রকার? বিনয়কেও রঘুবীরদের সম্বন্ধে জানাল, ওরা একসময় কয়েদি হয়ে আন্দামানে এসেছিল। রঘুবীর ইন্ডিয়ার সেন্ট্রাল প্রভিন্স থেকে, আর মাফুন এসেছিল বর্মার ওয়ান্ডুর থেকে। তারপর ওদের বিয়ে হয়। একটাই ছেলে। মাদ্রাজে হোস্টেলে থেকে বি.এসসি পড়ছে। খুব ভালো ছাত্র।
বিনয় জানত কালাপানি পাড়ি দিয়ে জাহাজ বোঝাই করে শুধু পুরুষ কয়েদিদেরই সেলুলার জেলে নিয়ে আসা হত। মেয়ে কয়েদিদেরও যে একসময় এই দ্বীপে আনা হয়েছে, এটা তার জানা ছিল না। বর্মি মা ফুনের সঙ্গে কী করে সেন্ট্রাল প্রভিন্সের রঘুবীরের বিয়ে হল, তা নিয়ে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল কিন্তু সেটা প্রকাশ করা অভদ্রতা। সে চুপ করে থাকে।
এদিকে শেখরনাথের সঙ্গে একজন পত্রকার তাদের কোঠিতে এসেছে সেজন্য রঘুবীর খুবই উত্তেজিত। ভেতরের একটা দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, মা ফুন, চাচাজির সঙ্গে একজন আখবরের লোক এসেছে। জলদি ইধর
মা ফুনের গলা ভেসে এল। পন্দ্র মিনট পর যাচ্ছি। চায় হয়ে এসেছে।
রঘুবীর এবার বিনয়ের দিকে তাকায়।জানেন বাবুজি, আমরা গন্ধী আদমি। হত্যারা। রাগের মাথায় তিনটে খুন করে কালাপানি, এসেছিলাম। আমার বিবি হামসে কমতি নেহি। মা ফুন দোঠো খুন করে এসেছে। আমি যখন সেলুলার জেলে আসি তখন এই চাচাজি আজাদির জন্যে আংরেজদের সঙ্গে লড়াই করে কয়েদ খাটছেন। জেলখানার ছোট এক সেলে চাচাজিকে আটকে বাইরে। থেকে তালা দিয়ে রাখা হত। নাহানার (চান) জন্যে একবার আর খাওয়ার জন্যে দুবার বাইরে আনা হত। সেই সময় চাচাজির সঙ্গে আমার জানপয়চান। দেওতা য্যায়সা আদমি (দেবতার মতো মানুষ)।
হাত তুলে রঘুবীরকে থামিয়ে দিলেন শেখরনাথ।আমার কথা অত বলতে হবে না।
এর মধ্যে শেখরনাথের আসার খবরটা পেনাল কলোনিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানকার বাসিন্দারা একে একে এসে তার সঙ্গে দেখা করে যেতে লাগল। এদের বেশিরভাগই বর্মি। দু-চারজন ভারতের নানা প্রভিন্সের লোক। সেলুলার জেলে। শেখরনাথের সঙ্গে একসময় এরাও কয়েদ খেটেছে। রঘুবীরের। মতোই শেখরনাথের ওপর এদের অফুরান শ্রদ্ধা।
একজন সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামী ভারত এবং বর্মার কত মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন, নিজের চোখে না দেখলে ভাবতে পারত না বিনয়। সে ভেতরে ভেতরে অভিভূত হয়ে যাচ্ছিল।
শেখরনাথ সবাইকে নামে নামে চেনেন। তাদের ছেলেমেয়ে স্ত্রীর খবর রাখেন। যেই আসছে, কে কেমন আছে, কারও কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিচ্ছেন।
এর মধ্যে মা ফুন ভেতর দিক থেকে চলে এল। শুধু চাই না পরোটা এবং সবজিও বানিয়ে এনেছে। চিনামাটির কটা কাপ-প্লেট একটা নিচু টেবলের ওপর রেখে, একটা প্লেট এবং চায়ের কাপ ট্রাকের ড্রাইভারকে দিয়ে ফিরে এসে সে-ও মেঝেতে রঘুবীরের পাশাপাশি বসে পড়ে।
শেখরনাথ বললেন, এত সব করতে গেলি কেন? শুধু চা হলেই তো হত।
মা ফুন হাসল, স্রিফ চা দিলে কী চলে! কত মাহিনা বাদ আপনি এলেন বলুন তো?
শেখরনাথ হেসে বিনয়ের দিকে তাকালেন।-না, এরা কোনও কথা শুনবে। নাও, খেতে শুরু কর। তারপর মা ফুনের সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।
শেখরনাথ এবার বললেন, শোন, বিনয় তোদের এই পেনাল কলোনি নিয়ে তাদের আখবরে কিছু লিখতে চায়। তোদের কাছে যদি কিছুদিন এসে থাকে, অসুবিধে হবে না তো?
কীসের অসুবিধে। মা ফুন এবং রঘুবীর হইচই বাধিয়ে দিল, বাবুজি এলে আমরা মাথায় করে রাখব।
আসলে কলোনিতে যারা থাকে, তাদের সবার সঙ্গে বিনয় কথা বলবে। তারা কবে কোন অপরাধে ইন্ডিয়া আর বর্মা থেকে কালাপানিতে সাজা খাটতে এসেছিল, সেলুলার জেলে কীভাবে, কত নির্যাতন সহ্য করে তাদের দিন কেটেছে, মুক্তি পাওয়ার পর কীভাবে এখানে কলোনি বানিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাচ্ছে সব সে জানতে চায়। তারপর ওদের আখবরে সেই লেখা ছাপবে।
রঘুবীর এবং মা ফুন, দুজনেই প্রচণ্ড উত্তেজিত। রঘুবীর জিগ্যেস করল, বাবুজি কবে আসবে?
কিছুদিন পর। আমিই ওকে দিয়ে যাব।
ওঁদের কথাবার্তার মধ্যেই দূর থেকে চেঁচামেচি ভেসে এল। অনেকে একসঙ্গে কথা বললে যেমন শোনায় অনেকটা সেইরকম।
বাইরের দিকের খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল পঞ্চাশ-ষাটজনের একটা দঙ্গল রিফিউজি সেটেলমেন্টের দিক থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতেই এগিয়ে আসছে। পাঁচ সাত মিনিটের ভেতর রঘুবীরদের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। তাদের মধ্যে রয়েছে মাঝবয়সি, ভদ্র চেহারার একটি লোক, মাঝবয়সি, মাঝারি হাইটের মজবুত একটি মেয়েমানুষ। তার হাতে চটের একটা ব্যাগ জিনিসপত্রে বোঝাই। এছাড়া নানা বয়সের ক্ষয়টে চেহারার মানুষজন। দেখামাত্রই টের পাওয়া যায়– উদ্বাস্তু। ছিন্নমূল সর্বস্ব খোয়ানো মানুষগুলোর চোখেমুখে ক্লেশের, উৎকণ্ঠার একটা ছাপ থাকে। সেটাই তাদের নির্ভুল চিনিয়ে দেয়। যে বর্মি যুবকটি দাইয়ের খোঁজে গিয়েছিল, ভিড়ের মধ্যে তাকেও দেখা গেল।
দ্রুত খাওয়া চুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন শেখরনাথ। তার পেছন পেছন বিনয়, মা ফুন এবং রঘুবীর।
জনতার ভেতর থেকে সেই মাঝবয়সি লোকটি ক্ষোভের সুরে। বলল, কাকা, এত দূর তরি (পর্যন্ত) আইলেন, কিন্তু আমাগো সেটেলমেন্টে গ্যালেন না? মনসারে ডাকতে লোক পাঠাইলেন। মনে বড় দুঃখু পাইলাম।
এগিয়ে এসে লোকটির কাঁধে হাত রেখে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, রাগ করো না বিনোদ। মা ফুনরা কিছুতেই ছাড়ল না। শিগগিরই আবার আসছি। তখন আগে তোমাদের ওখানে যাব।
আইজ একবার পায়ের ধুলা দিবেন না?
উপায় নেই। একটি মেয়ের প্রসব বেদনা উঠেছে। জেফ্রি পয়েন্টে ডাক্তারটাক্তার নেই। তাই দাই নিতে এসেছি। দাই কি এসেছে?
এখানকার রিফিউজি সেটেলমেন্টের সবাই শেখরনাথের মুখচেনা; তবে অনেকের নাম জানেন না।
বিনোদ নামের লোকটি বলল, এসেছে। এই তো সেই মধ্যবয়সিনিকে দেখিয়ে দিল সে।এরই নাম মনসা। আপনি খবর পাঠাইছেন। মনসা এক্কেরে (একেবারে) তৈয়ার অইয়া আইছে।
শেখরনাথ মনসাকে জিগ্যেস করলেন, তোমার কে কে আছে?
মনসা জানায় সে অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছে। ছোট ভাই ৮ গোপাল আর তার বউ কমলার কাছে থাকে। তাদের সঙ্গেই আন্দামানে এসেছে। যুবতী বয়স থেকে দাইগিরি করছে।
শেখরনাথ বললেন, আমাদের সঙ্গে গেলে তোমার ভাই আপত্তি করবে না তো?
একটি বছর চল্লিশের ভালোমানুষ ধরনের লোক বলে উঠল, আমি গুপাল। আপনে দিদিরে লইয়া যাইবেন আমি আপত্ত করুম! আমার ঘেটিতে (ঘাড়ে) কয়ডা মাথা?
শেখরনাথ বিনোদের সঙ্গে বিনয়ের আলাপ করিয়ে দিল। বিনোদ বি.এ পাশ। ঢাকায় থাকত। ইচ্ছা করলে পার্টিশনের পর ইন্ডিয়ায় এসে চাকরিবাকরি জুটিয়ে নিতে পারত। নেয়নি। ওর খুব দুঃখের জীবন; বড় আঘাত পেয়েছে। কলকাতায় ভালো লাগছিল না। অন্য উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আন্দামানে চলে এসেছে।
পরিচয় করানো হলে শেখরনাথ বিনোদকে বললেন, কিছুদিন পর যখন আসব, বিনয়কেও সঙ্গে আনব। ওরঘুবীরদের বাড়িতে থাকবে, তোমাদের ওখানেও যাবে। খবরের কাগজে তোমাদের সেটেলমেন্টের কথা লিখবে। বিনয়কে একটু সাহায্য করো।
বিনয় সাংবাদিক শুনে রঘুবীরদের মতো বিনোদও রীতিমতো উত্তেজিত। বলল, নিচ্চয় করুম। উনি আমাগো লইয়া লেখবেন এয়াতো (এ তো) ভাইগ্যের কথা।
শেখরনাথ আর দেরি করলেন না। আজ আমরা চলি বলে বিনয় এবং মনসাকে নিয়ে ট্রাকে উঠলেন।
ড্রাইভার স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।
বেলা যখন সামান্য হেলতে শুরু করেছে সেই সময় জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে গেলেন শেখরনাথরা।
২.১১ মেয়েদের ব্যারাকের সামনে
মেয়েদের ব্যারাকের সামনে বিরাট ভিড়। নানা বয়সের মেয়েরা রয়েছে সামনের দিকে। পুরুষেরা একটু দুরে। তাদের মধ্যে পরিতোষ, লা ডিন এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা এসে জড়ো হয়েছে। সারি সারি উদ্বিগ্ন মুখ।
নিজেদের মধ্যে সবাই বলাবলি করছিল, সৃষ্টিধরের বউরে আর বুঝিন বাঁচান গেল না। হেই সকাল থিকা যায় কাতরাইতে আছে। অহনও কাকায় দাই লইয়া ফিরল না। খালাস না অইলে মায় (মা) আর প্যাটের বাচ্চা-দুইটারই মরণ।
কী যে অইব, ভগমানই জানে।
এই সময় ট্রাকের আওয়াজে সবাই ঘুরে তাকায়। উতরাইয়ের ঢাল বেয়ে বিশাল গাড়িটা নেমে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে।
আইয়া গ্যাছে, আইয়া গ্যাছে
আর চিন্তা নাই।
মা কালী বউডারে রক্ষা কর।
শেখরনাথদের ট্রাক মেয়েদের ব্যারাকটার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনসা আর বিনয়কে নিয়ে শেখরনাথ নেমে পড়লেন। জনতার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে, তোমরা সবাই এখানে? তার কণ্ঠস্বরে রীতিমতো উৎকণ্ঠা। সকালে সৃষ্টিধরের বউয়ের যে হাল দেখে গিয়েছিলেন তাতে খারাপ কিছু হয়ে গেল নাকি, এটাই তার ভয়।
মেয়েরা ভিড় করার কারণটা জানিয়ে দিল। পরিতোষ জানাল, শেখরনাথরা চলে যাবার পর পুরুষরা জমি সাফ করতে গিয়েছিল। সূর্য মাথার ওপর উঠে এলে চান-খাওয়া সারতে ক্যাম্পে এসে সব শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
শেখরনাথ জানতে চাইলেন, সৃষ্টিধরের বউ এখন কোথায়?
পরিতোষ বলল, ভিতরে। আশুচ (আঁতুড়) ঘরে।
শেখরনাথ দাই আনতে যাবার সময় ব্যারাকের এক কোণে চেরা বাঁশ দিয়ে এক ফালি জায়গা ঘিরে সন্তান জন্মের ব্যবস্থা করে রাখতে বলেছিলেন। পরিতোষের কথায় জানা গেল সেটি এর মধ্যেই করে ফেলা হয়েছে। এবং সৃষ্টিধরের বউকে সেখানে রাখা হয়েছে। কয়েকজন বয়স্কা উদ্বাস্তু মেয়েমানুষ তার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করছে।
যে শঙ্কাটা হঠাৎ পাষাণভারের মতো শেখরনাথের মাথায় চেপে বসেছিল সেটা আপাতত নেমে গেছে। না, মেয়েটা বেঁচেই আছে। তিনি ব্যস্তভাবে মনসাকে দেখিয়ে জমায়েতটাকে বললেন, এই যে দাইকে নিয়ে এসেছি। আর চিন্তা নেই। তোমরা সরে সরে পথ করে দাও। ও আঁতুড়ঘরে যাক।
মনসা ব্যারাকের ভেতর ঢুকে গেল।
কিন্তু বাইরের ভিড়টা অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। এতগুলো মানুষ খিদে-তেষ্টার কথা বোধহয় ভুলেই গেছে। এমনকী শেখরনাথ বিনয়কে নিয়ে একধারে অপেক্ষা করতে থাকেন।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ভেতর থেকে অনেকগুলো মেয়ে-গলার কলকলানি ভেসে আসে। –খালাস অইয়া গ্যাছে, খালাস অইয়া গ্যাছে। মা কালী গো, তুমার দয়া
তারপরেই পরিষ্কার ন্যাকড়া জড়ানো একটি মানবশিশুকে কোলে করে মনসা ব্যারাকের সামনে এসে দাঁড়ায়। মাখনের দলার মতো বাচ্চাটা কুঁই কুঁই, ক্ষীণ আওয়াজ করছিল। পৃথিবীর প্রথম আলো এসে পড়েছে তার চোখে। পিট পিট করে তাকাচ্ছিল সে।
বাইরে তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে গেল। এতক্ষণের উৎকণ্ঠা কেটে গেছে সবার। হুড়মুড় করে তারা মনসার কাছে ছুটে আসে।
কী অইচে, কী অইচে? পোলা, না মাইয়া? প্রতিটি উদ্বাস্তু জানার জন্য উদগ্রীব।
মনসা হেসে হেসে বলল, একহান সোনার চান্দ (চাঁদ) অইচে। পোলা–পোলা–
মেয়েদের ভেতর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, তরা খাড়ইয়া রইছস ক্যান? জোকার (উলু দে। শাখ বাজা
মুহূর্তে উলুধনি এবং শাঁখের আওয়াজে জেফ্রি পয়েন্টের ছিন্নমূল মানুষের উপনিবেশ সরগরম হয়ে ওঠে।
দক্ষিণ আন্দামানের এই সৃষ্টিছাড়া জঙ্গল-ঘেরা এই ভূখণ্ডে এই প্রথম একটি মানুষের জন্ম হল। আজকের দিনটা নিয়ে সবাই যেন অফুরান উৎসবে মেতে ওঠে।
মনসা বলে, বাইরে রইদের (রোদের) জবর ত্যাজ (তেজ)। বাচ্চাটার কষ্ট অইতে আছে। ভিতরে যাই। সে ব্যারাকে ঢুকে গেল।
এদিকে উদ্বাস্তুরা ঘিরে ধরে সৃষ্টিধরকে।–মিঠাই খাওয়াইতে অইব তুমারে
সৃষ্টিধরের চোখেমুখে লাজুক হাসি। সেটা সুখের এবং গর্বের। কঁচুমাচু মুখে বলে, আমার কি ট্যাকাপয়সা আছে যে খাওয়াতি পারি। খুলনে জিলায় আমাগের গেরামি থাকলি প্যাট ভইরে মোন্ডা মেঠাই খাওয়ায়ে দেতাম। শেখরনাথ হাসিমুখে সব শুনছিলেন। বললেন, সৃষ্টিধর কোত্থেকে খাওয়াবে? ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। বলে পরিতোষের দিকে তাকালেন। –তুমিই তো এই সেটেলমেন্টের কর্তা। তোমার হাতে টাকাপয়সা থাকে। সকলকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দাও
পরিতোষ বলল, এইটা কি কইলকাতার শহর! সন্দেশ রসগুল্লা পামু কই?
একটু ভেবে শেখরনাথ বললেন, সেটা অবশ্য ঠিক। এবার মালপত্রের সঙ্গে কয়েক টিন আমেরিকার মিষ্টি বিস্কুট এসেছে না?
হ, কাকা।
সবাইকে দুটো করে তা-ই খাইয়ে দে।
বিস্কুট বিলি করা হল। তারপর সমুদ্রে চান করে এসে ভাত খেতে খেতে বিকেল পেরিয়ে গেল। আজ আর কেউ এ বেলা জমিতে গেল না। মাঝরাত অবধি হইহই করে গানটান গেয়ে কেটে গেল।
২.১২ আনন্দটা ক্ষণস্থায়ী
আনন্দটা কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। দুদিন কাটতে না কাটতেই জারোয়ারা মারাত্মক কাণ্ড ঘটিয়ে দিল।
আজ সকালে অন্য দিনের মতোই জমিতে গিয়েছিল উদ্বাস্তুরা। উত্তর-পূর্ব দিকে মোহনবাঁশি কর্মকার তার বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে তার জমির জলডেঙ্গুয়ার ঝাড় সাফ করছিল। আচমকা ওধারের জঙ্গল ফুড়ে, বুশ পুলিশের নজর এড়িয়ে এক দঙ্গল কালো কালো জারোয়া তির-ধনুক নিয়ে হানা দিল। বেশ কয়েকদিন আগে, বিশ্বজিৎ তখন জেফ্রি পয়েন্টে ছিলেন, জারোয়ারা মাঝরাতে হামলা চালিয়েছিল। আজ একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে।
অদ্ভুত আওয়াজ করে, দুর্বোধ্য ভাষায় গজরাতে গজরাতে তারা এলোপাতাড়ি তির ছুঁড়তে থাকে। চোখেমুখে তাদের প্রচণ্ড আক্রোশ।
তিরগুলো এধারে ওধারে উড়ে যাচ্ছিল। তবে একটা এসে লাগল মোহনবাঁশির বুকের ডান পাশে। চারপাশের জমিতে যারা কাজ করছিল তারা তুমুল হুলস্থুল বাধিয়ে দিল। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। কেউ কেউ উদভ্রান্তের মতো ক্যাম্পের দিকে দৌড়াতে থাকে। ওদিকে বুশ পুলিশও পেরিমিটার রোডের উঁচু উঁচু টঙ থেকে জারোয়াদের দেখতে পেয়েছিল। তারা টিন বাজাতে বাজাতে তুমুল হইচই বাধিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে আকাশের দিকে বন্দুক তুলে ফায়ার করতে থাকে।
লহমায় জারোয়ারা গভীর জঙ্গলে উধাও হয়ে যায়। বিনয় আর শেখরনাথ উত্তর দিকের একটা জমিতে ছিলেন। বহু মানুষের চিৎকার শুনে দৌড়ে মোহনবাঁশিদের কাছে চলে আসেন। ওদিকে জমি মাপামাপি বন্ধ করে লা ডিনরা দৌড়ে এসেছে।
মোহনবাঁশির বুকে তিরটা অনেকখানি ঢুকে গেছে। সে বেহুঁশ মাটিতে পড়ে আছে। তিরের ফলার পাশ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসছে। তাকে ঘিরে তার বউ ছেলেমেয়েরা উন্মাদের মতো কাঁদছে। আর জড়ানো জড়ানো গলায় তার বউ বলে যাচ্ছে, ক্যান যে আন্ধারমান দ্বীপি আইছিলাম। মানুষটার পরানডা গেল! এই আছিল আমাগো কপালে!
ছেলেমেয়ে দুজনেই রুদ্ধশ্বাসে একটানা বলে যাচ্ছিল, বাবা, চৌখ মেইলা তাকাও। চৌখ মেল–
শেখরনাথ পলকহীন মোহনবাঁশিকে লক্ষ করছিলেন। বুঝতে পারছেন, তিটা টানাটানি করে খুলতে গেলে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসবে। জেফ্রি পয়েন্টের তো প্রশ্নই নেই, আশপাশে কোথাও ডাক্তার নেই। দ্রুত মোহনবাঁশির নাকের তলায় হাত রাখলেন তিনি। তির তির করে নিঃশ্বাস পড়ছে। তার মানে লোকটা বেঁচে আছে।
ওদিকে হইচই শুনে ক্যাম্পের দিক থেকে পরিতোষ এবং পুনর্বাসনের কর্মীরা দৌড়ে এসেছিল।
শেখরনাথ সংক্ষেপে ঘটনাটা জানিয়ে দিয়ে ব্যস্তভাবে বললেন, মোহনবাঁশিকে বাঁচাতে হলে এক্ষুনি পোর্ট ব্লেয়ারের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মালপত্র নিয়ে যে লরিটা এসেছিল সেটা কি ফিরে গেছে?
পরিতোষ বলল, হে তো আপনেরা যেইদিন উইধারের সেটেলমেন্টে গ্যাছিলেন হেইদিনই বিকালে চইলা গ্যাছে।
সর্বনাশ। এখন উপায়? বলতে বলতে হঠাৎ কিছু খেয়াল হল শেখরনাথের।
-আরে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ট্রাক দুটো তো রয়েছে। তার একটায় তুলে মোহনবাঁশিকে নিয়ে যাব।
কিন্তুক
শেখরনাথ বিরক্ত হলেন।-কীসের কিন্তু?
পরিতোষ ভয়ে ভয়ে জানায়, একটা লরি গাছের গুঁড়ি দিয়ে বোঝাই করা হয়েছে। আরেকটায় হাতি দিয়ে ভোলা হচ্ছে। সেটা ভর্তি হতে হতে বিকেল হয়ে যাবে। তারপর ট্রাক দুটো রওনা হবে ব্যাম্বু ফ্ল্যাটের দিকে। মাল খালাস করে ফিরে আসতে আসতে পরশু।
শেখরনাথ ধমকে উঠলেন, পরশু অবধি মোহনবাঁশি তির বেঁধা অবস্থায় পড়ে থাকবে? ওকে বাঁচানো যাবে? এক্ষুনি গিয়ে আমার নাম করে বল, যেটা এখনও ভর্তি হয়নি সেটায় গুঁড়ি তোলা বন্ধ রাখুক। যা তোলা হয়েছে নামিয়ে ফেলুক। ওই ট্রাকটায় আমরা মোহনবাঁশিকে নিয়ে যাব।
পরিতোষ ঊৰ্ধশ্বাসে ছুটে গেল।
.
ঘণ্টা দেড়েক বাদে একটা লম্বা পুরু চট দুভাজ করে তার ওপর মোহনবাঁশিকে খুব সাবধানে শুইয়ে ট্রাক দৌড় শুরু করল। শেখরনাথ তো গেলেনই, তার সঙ্গে বিনয়ও গেল। মোহনবাঁশির ছেলেমেয়ে বউ ট্রাকে উঠে পড়েছে। তারা মোহনবাঁশিকে ঘিরে বসেছে; তাকে অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে ওদের খুব সম্ভব ভরসা নেই। কেঁদে কেঁদে সবার গলা ভেঙে গেছে। মোহনবাঁশিকে ট্রাক থেকে ওঠানোনামানোর জন্য পুনর্বাসনের কর্মীকেও সঙ্গে নেওয়া হয়েছে।
ড্রাইভারের পাশে ফ্রন্ট সিটে বসেছেন শেখরনাথ। জানালার ধারে বিনয়।
শেখরনাথ ড্রাইভারকে তাড়া দিচ্ছিলেন।জোরে চালিয়ে যত তাড়াতাড়ি পার আমাদের ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে পৌঁছে দাও। পেছন ফিরে পুনর্বাসনের কর্মীদের বারবার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন, তারা যেন শক্ত করে মোহনবাঁশিকে দুদিক থেকে ধরে রাখে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে তির যদি তার বুকের আরও গভীরে ঢুকে যায়, মোহনবাঁশিকে হয়তো বাঁচানো যাবে না।
বেলা যখন অনেকখানি হেলে পড়েছে সেই সময় ট্রাক ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে এসে গেল। জেটিতে একটা লঞ্চ দাঁড়িয়ে ঘন ঘন ভো দিচ্ছিল। খুব শিগগিরই ছেড়ে দেবে।
লঞ্চটা বিনয়ের খুবই চেনা-সিগাল। এই জলযানেই কয়েকদিন আগে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে দেড়শো উদ্বাস্তু ফ্যামিলি এবং বিশ্বজিতের সঙ্গে সে জেফ্রি পয়েন্টে গিয়েছিল।
শেখরনাথরা নেমে পড়লেন। পুনর্বাসনের কর্মীরা শক্ত করে চটের চার কোনা ধরে মোহনর্বাশিকে নামিয়ে আনল। তাদের পেছন পেছন নামল মোহনর্বাশির বউ ছেলেমেয়েরা।
শেখরনাথ ট্রাকের ড্রাইভারকে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যেতে বলে একরকম দৌড়ে গিয়েই টিকেট কেটে ফেললেন। তারপর সবাই লঞ্চে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সিগাল লম্বা ভো দিয়ে চলতে শুরু করল।
লঞ্চে বেশ ভিড় ছিল। বিশ্বজিতের সঙ্গে উদ্বাস্তুদের নতুন সেটেলমেন্টে যাবার সময় যেমন বর্মি কারেন শিখ এমনি ইন্ডিয়ার নানা প্রভিন্সের প্যাসেঞ্জার দেখা গিয়েছিল, এখনও ঠিক তেমনটাই চোখে পড়ল। বিনয় আন্দাজ করে নিল এদের বেশিরভাগই ব্রিটিশ আমলের কয়েদি। কালাপানির সাজা খাটতে আন্দামানে এসেছিল। মুক্তি পাওয়ার পর স্বাধীন ভারতের নাগরিক। শেখরনাথকে দেখে তারা অনেকে এগিয়ে এসে সসম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, আদাব চাচাজি, কেউ বলে, নমস্তে–মোহনবাঁশিকে ডেকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে প্রাক্তন কয়েদিরা খুব একটা অবাক হল না।
একজন মোহনবাঁশিকে দেখিয়ে শেখরনাথকে জিগ্যেস করল, জরুর পাকিস্তানকা রিফিউজি-হ্যায় না চাচাজি? উদ্বাস্তুদের চেহারায় মার্কামারা একটা ছাপ থাকে, এতদিনে এখানকার পেনাল সেটেলমেন্টের পুরানো বাসিন্দারা তা চিনে ফেলেছে।
শেখরনাথ আস্তে মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।
গভীর জঙ্গলের খাঁজে কোথায় কোথায় উদ্বাস্তুদের উপনিবেশ গড়ে উঠছে, কোথায় জারোয়ারা তাদের পড়োশি, এবং এই আদিম জনজাতিটি কতটা হিংস্র, সব তাদের জানা। লোকটি বলল, জরুর জারোয়ারা তির মেরেছে!
এবারও শেখরনাথ আস্তে মাথা নাড়েন।-হ্যাঁ।
ওহি জংলি লোগ বহুৎ খতরনাক। রিফিউজিদের হেঁশিয়ারি থাকা দরকার। বলে লোকটা জানতে চাইল, তার এবং তার সঙ্গীদের কোনওরকম সাহায্যের প্রয়োজন আছে কি না?
শেখরনাথ জানালেন, প্রয়োজন নেই। তার সঙ্গে লোক আছে। বেশিক্ষণ লাগল না; মিনিট পনেরোর ভেতর সিগাল উপসাগর পেরিয়ে ও পারে পোর্ট ব্লেয়ারের চ্যাথাম জেটিতে গিয়ে ভিড়ল।
তড়বড় করে অন্য প্যাসেঞ্জাররা নেমে যাবার পর শেখরনাথদের সঙ্গে পুনর্বাসনের যে কর্মীরা এসেছিল, ধরাধরি করে তারা মোহনবাঁশিকে নামিয়ে জেটিতে শুইয়ে দিল। জানতে চাইল, এবার কী করতে হবে।
শেখরনাথ বললেন, এখান থেকে হাসপাতালে যেতে হলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। তোমরা একটু বসো। দেখি কোথায় পাওয়া যায়–
জেটির বাইরের রাস্তায় ছোট ছোট প্রাইভেট শিপিং কোম্পানির দু-তিনটে অফিস। শেখরনাথ বিনয়কে সঙ্গে করে সেখানে চলে এলেন।
শেখরনাথকে এইসব কোম্পানির লোকেরা ভালোই চেনে। শ্রদ্ধাও করে। একটা অফিস থেকে জানানো হল, তাদের একটা জিপ এবং একটা ভ্যান কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। বিব্রতভাবে ম্যানেজার বলল, কাকা, এখন কিছুই দিতে পারছি না। দু ঘণ্টা পর গাড়ি দুটো ফিরলে নিশ্চয়ই দেব।
শেখরনাথ জানালেন, যে মারাত্মকভাবে জখম লোকটিকে জেফ্রি পয়েন্ট থেকে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে অতটা সময় ফেলে রাখা যাবে না।
দ্বিতীয় শিপিং অফিস থেকে একটা লম্বা ভ্যান পাওয়া গেল। তবে ঘণ্টা দেড়েকের ভেতর সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে।
শেখরনাথ বললেন, অতটা সময় লাগবে না। তার আগেই ফিরিয়ে দেব।
ভ্যানটা লম্বা তো বটেই, ভেতরে অনেকটা জায়গা রয়েছে। মোহনবাঁশিকে তুলে পেছন দিকের পাটাতনে শুইয়ে তার। চারপাশে একটু ঘেঁষাঘেঁষি করে বাকি সবাই বসল। বিনয়কে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসেছেন শেখরনাথ। শিপিং কোম্পানিটা থেকে ড্রাইভারও দেওয়া হয়েছিল।
গাড়ি ছুটল উঁচুনিচু সড়ক ধরে। এই এলাকাগুলো বিনয়ের চেনা। এই রাস্তা দিয়েই কিছুদিন আগে বিশ্বজিতের সঙ্গে চ্যাথামে এসেছিল সে। তবে হাসপাতাল কোথায় সে জানে না। পোর্টের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে হ্যাঁডো, ডিলানিপুর, ফুদ্দি চাউঙ, মিডল পয়েন্ট, এবারডিন মার্কেট পেছনে ফেলে বাঁ দিকের মোড় ঘুরে অন্য একটা রাস্তায় এসে পড়ল ভ্যানটা। রাস্তাটা খাড়াই বেয়ে উঁচু টিলার দিকে চলেছে। আর টিলার মাথায় বিশাল দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেলুলার জেল।
বিনয় বুঝতে পারছে না, ভ্যানটা কেন জেলখানার দিকে চলেছে। শেখরনাথকে তা জিগ্যেস করে ফেলল।
চড়াই ভাঙছে, তাই ভ্যানের গতি অনেক কমে গেছে। শেখরনাথ বুঝিয়ে দিলেন। সেলুলার জেলের মাঝখানে রয়েছে একটা বিরাট উঁচু টাওয়ার। একসময় সাতটা মস্ত মস্ত তেতলা বিল্ডিং সেটার সাতদিকে চলে গেছে। এই সাতটা বিল্ডিংয়ে ছিল সবসুদ্ধ হাজারখানেক সেল বা কয়েদিদের আটকে রাখার কুঠুরি। দুটো টাওয়ার ভূমিকম্পে ভেঙে যায়, একটা জাপানি বোমায় ধংস হয়েছে। বাকি চারটে এখনও অটুট। এই ব্লকের একটায় এখন লোকাল জেল, একটায় হাসপাতাল। অন্য দুটোয় মিউজিয়াম। ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবীরা কে কোন কুঠুরিতে ছিলেন, কীভাবে তাদের এবং সাধারণ অন্য সব কয়েদির ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হত তার কিছু কিছু স্মারক ওই ব্লক দুটোয় সংরক্ষণ করা আছে। ভ্যান সেলুলার জেলের সামনে চলে এসেছিল। ঢোকার মুখ প্রথমেই গম্ভীর, থমথমে, ভয়ংকর গোলাকার চেহারার একজোড়া টাওয়ার। দুটোর দূরত্ব তিরিশ চল্লিশ ফিটের মতো। জোড়া টাওয়ারের মাঝামাঝি জায়গায় খানিকটা উঁচুতে দোতলা সমান হাইটে লম্বা করিডর। সেটা টাওয়ার দুটো জুড়ে রেখেছে। তার তলায় লোহার মজবুত ফটক। এটা দিয়েই যাতায়াত করতে হয়।
ফটকের দুটো পাল্লা খোলা রয়েছে। বিনয় কার একটা লেখায় পড়েছে ব্রিটিশ আমলে চব্বিশ ঘণ্টা রাইফেল হাতে খাস ইংরেজ পুলিশের একটা বাহিনী চব্বিশ ঘণ্টা ফটকের সামনে টহল দিতে দিতে নজরদারি চালাত। তাদের চোখে ধুলো ছিটিয়ে একটা মাছিও গলতে পারত না।
স্বাধীনতার পর দিনকাল বদলে গেছে। ফটক এখন হাট করে খোলাই থাকে। বন্দুকওয়ালা পুলিশবাহিনী তো দূরের কথা, একজন গার্ডও চোখে পড়ল না।
এখান থেকে অনেকটা নিচে ঘোড়ার খুরের আকারে সিসোস্ট্রেস বে-টাকে দেখা যাচ্ছে। তার ওধারে রস আইল্যান্ড। কিছুদিন আগে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে এস এস মহারাজা জাহাজে নেমেছিল বিনয়। সেখান থেকে ছোট মোটর বোটে এসেছিল পোর্ট ব্লেয়ারে।
ফটক দিয়ে ভ্যানটা ঢুকতে যাবে, কেউ ডেকে উঠল, আদাব চাচাজি—
লোকটাকে দেখতে পেয়েছিলেন শেখরনাথ। একটু অবাক হলেন। ব্যস্তভাবে ড্রাইভারকে ভ্যান থামাতে বলে লোকটার দিকে তাকালেন।-নসিমুল, তুমি এখানে?
মায়াবন্দর থেকে তোমাদের কোম্পানির জাহাজ নিয়ে এসেছ নাকি?
জি। একটু কাত হয়ে তেরছাভাবে ডান হাতের তর্জনীটা বাড়িয়ে দিল।
সেলুলার জেল যে টিলাটার মাথায় ঠিক তার পেছন দিয়ে সিসোস্ট্রেস বে বা উপসাগর ঘোড়ার খুরের আকারে পশ্চিম থেকে পুবে চলে গেছে। সেটার পাড়ে পোর্ট ব্লেয়ারের গা ঘেঁষে একটা জেটি। সেখানে একটা ছোট জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। এস এস সাগর। নসিমুলের আঙুল সেটার দিকে। তার ঠিক উলটো দিকে উপসাগরের ওপারে রস আইল্যান্ড। বিনয়ের খুবই পরিচিত এলাকা। এই তো সেদিন মহারাজা জাহাজে চেপে কয়েক শো রিফিউজি ফ্যামিলির সঙ্গে এসে নেমেছিল।
নসিমুলের বয়স পঞ্চাশবাহান্ন। তামাটে রং। মাঝারি হাইটের মজবুত চেহারা। লম্বাটে মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। পরনে ঢোলা নীলচে ফুলপ্যান্ট আর সাদা শার্ট। লোকটা এবার জানাল, কয়েকদিন আগে তারা এখানে এসেছে। আজই মায়াবন্দর ফিরে যাবে। তবে রাহাসাহেব অর্থাৎ বিশ্বজিৎ তাঁদের অনুরোধ করেছেন সপ্তাহখানেক আগে মধ্য আন্দামানের একজন বৃদ্ধ রিফিউজি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছিল। তার সঙ্গে পরিবারের দুজন এসেছে। বৃদ্ধ এখন রোগমুক্ত। তাকে আজ রিলিজ করে দেওয়া হবে। নসিমুলরা উত্তর আন্দামানের মায়াবন্দর যাবার পথে যেন এই উদ্বাস্তু পরিবারটিকে মিডল আন্দামানে নামিয়ে দিয়ে যায়। সেজন্য এস এস সাগর-এর বয়লারে যে কয়লা দেয় সেই স্টোকার রহমানকে হাসপাতালে পাঠিয়ে এখানে অপেক্ষা করছে নসিমুল। রহমানরা চলে এলে সে বৃদ্ধদের নিয়ে গিয়ে সে জাহাজ ছেড়ে দেবে।
ঠিক আছে, আবার দেখা হবে। আমার সঙ্গে একজন জখম লোক রয়েছে। তাকে এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আচ্ছা চলি
আদাব
শেখরনাথ হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানালেন। ভ্যানওলাকে বললেন, চল– কথা বলতে বলতে তিনি লক্ষ করেছিলেন বিনয় পলকহীন নসিমুলের দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই নসিমুল সম্পর্কে তার খুবই কৌতূহল হচ্ছে। তাকে বললেন, পোর্টব্লেয়ার থেকে একশো মাইল দূরে উত্তর আন্দামানের মায়াবন্দরে দত্তদের স-মিল এবং সামুদ্রিক শেল অর্থাৎ শঙ্খ, কড়ি, টার্বো, ট্রোকার্সের ফলাও কারবার। বাঙালি কোম্পানি সারা পৃথিবীতে তারা শেল চালান দেয়। তাদের দু দুটো জাহাজও রয়েছে। এস এস সাগর তো এই মুহূর্তে জেটিতে বাঁধা রয়েছে। অন্যটার নাম এস এস বরুণ।
ভ্যান ফটক পেরিয়ে বিরাট এক চত্বরে এসে পড়েছিল। কোনাকুনি খানিকটা গিয়ে একটা লম্বা ব্লকের সামনে এসে থেমে গেল। সেখানে দোতলার হাইটে মস্ত বোর্ডে লেখা: আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর হসপিটাল।
শেখরনাথের শেষ কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল না বিনয়। সেলুলার জেলের চৌহদ্দিতে ঢোকার পর থেকে সারা শরীর ছমছম করছে। ছেলেবেলায় রাজাজিয়ায় থাকার সময় ভারতের বাস্তিল এই জেলখানা সম্পর্কে কত বিভীষিকা, কত আতঙ্কের কাহিনিই না শুনেছে সে। শত শত বিপ্লবী থেকে সাধারণ কয়েদিকে অকথ্য অত্যাচারে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। অনেকে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে উন্মাদ হয়ে গেছে। ব্রিটিশ পুলিশ কতজনকে যে এই কয়েদখানায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছে তার লেখাজোখা নেই। আচ্ছন্নের মতো তিনদিকের উঁচু উঁচু দালানে অগুনতি সেলগুলো দেখতে থাকে বিনয়।
এদিকে ভ্যানটা থামতেই শেখরনাথ নেমে পড়েছিলেন। ব্যস্তভাবে বিনয়কে তাড়া দিলেন, চলচল আমার সঙ্গে। অন্যদের গাড়িতেই অপেক্ষা করতে বললেন।
হাসপাতালের তেতলা বিল্ডিংটার মাঝামাঝি জায়গা থেকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। এপাশে ওপাশে সারি সারি যে কুঠুরিগুলোতে ইংরেজ আমলে কয়েদিদের আটকে রাখা হত, এখন সেগুলোতে রোগীদের জন্য বেড় পাতা। এখন ভিজিটিং আওয়ার্স চলছে। পেশেন্টদের ঘিরে বসে আছে তাদের বাড়ির লোকজন।
বিনয়কে সঙ্গে করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে এলেন শেখরনাথ। নিচের তলার মতো এখানেও কুঠুরিতে কুঠুরিতে রোগীদের পাশে তাদের আত্মীয়স্বজন।
সেলগুলোর সামনে দিয়ে পনেরো ফিটের মতো চওড়া করিডর বহুদূরে শেষ প্রান্ত অব্দি চলে গেছে। দু চারজন নার্স, অ্যাপ্রন-পরা। জুনিয়র ডাক্তার এবং হাসপাতালের কর্মীদের দেখা যাচ্ছে।
সিঁড়ির ডানপাশে একটু এগুতেই দেখা গেল দেওয়ালের গায়ে পেতলের ঝকঝকে প্লেটে লেখা আছে: ডাঃ পি. চট্টরাজ। চিফ মেডিক্যাল অফিসার।–
দরজার সামনে দামি পরদা ঝুলছে। বাইরে থেকে শেখরনাথ গলার স্বর সামান্য উঁচুতে তুলে ডাকলেন, প্রণবেশ-প্রণবেশ আমি শেখরকাকা-ভেতরে আসতে পারি?
ডাঃ চট্টরাজ নিজেই উসে এঠে পরদা সরিয়ে বললেন, আপনি! আসুন, আসুন, ভেতরে
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে শেখরনাথ বললেন, এখন বসার সময় নেই৷ কী কারণে হাসপাতালে আসা, সংক্ষেপে তা জানিয়ে দিলেন। সেই জেফ্রি পয়েন্ট থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে। লোকটা খুব সম্ভব বেঁচে আছে। শিগগির ভর্তির ব্যবস্থা কর।
তক্ষুনি তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। ডাঃ চট্টরাজ একে ওকে ডেকে স্ট্রেচার, একজন জুনিয়র ডাক্তার এবং একজন নার্সকে নিচে পাঠিয়ে দেন। পাঁচ মিনিটের ভেতর মোহনবাঁশিকে দোতলাতেই এমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করে নেওয়া হয়। বাইরের করিডরে অপেক্ষা করতে থাকেন শেখরনাথ এবং বিনয়। তাদের সঙ্গে উৎকণ্ঠিত মোহনবাঁশির ছেলেমেয়ে বউ আর পুনর্বাসনের কর্মীরা।
ডাঃ চট্টরাজ এমার্জেন্সিতে মোহনর্বাশিকে দেখতে গিয়েছিলেন। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এসে বললেন, কেসটা ক্রিটিক্যাল। প্রথমে তিরটা বার করতে হবে। তারপর বড় একটা অপারেশন। অন্তত পনেরোকুড়ি দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। আশা করি, বাঁচাতে পারব।
ডাঃ চট্টরাজের দুই হাত ধরে গভীর স্বরে শেখরনাথ বললেন, যেভাবে তোক বাঁচাতে চেষ্টা কর।
আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না কাকা। আন্দামানের আরও অজস্ৰজনের মতো ডাঃ চট্টরাজও শেখরনাথকে কাকা বলেন।
শেখরনাথ তাঁর সঙ্গীদের দেখিয়ে বললেন, এঁরা মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়ে আর রিহ্যাবিলিটেশনের এমপ্লয়ি। তারপর বিনয়কে কাছে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলেন, এঁকে কি তুমি চেন?
ডাঃ চট্টরাজ কয়েক পলক বিনয়কে লক্ষ করলেন। তারপর বললেন, মুখটা চেনা চেনা লাগছে। ঠিক
ও কলকাতার একজন সাংবাদিক। বিনয়। রিফিউজিদের সঙ্গে এখানকার সেটেলমেন্ট দেখতে এসেছে।
এইবার মনে পড়ে গেল। ডাঃ চট্টরাজ বিনয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, রস আইল্যান্ডে রাহা সাহেব আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। অ্যাম আই রাইট?
বিনয় হেসে হেসে বলল, ওয়ান হানড্রেড পারসেন্ট।
উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন ডাঃ চট্টরাজ। তার আগেই শেখরনাথ বলে উঠলেন, সেই সকালে আমরা বেরিয়েছি। আর্টটা নাগাদ চা আর রুটি ছাড়া এখন অব্দি কারও পেটে একফোঁটা জল পড়েনি। সবার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি। তাছাড়া একটা শিপিং কোম্পানি থেকে গাড়ি নিয়ে চ্যাথাম থেকে মোহনবাঁশিকে এখানে এনেছি। গাড়িটা এক্ষুনি তাদের ফেরত দিতে হবে। বিশুকেও মোহনবাঁশির খবরটা দেওয়া দরকার। আমি মিনিট চল্লিশেকের ভেতর চলে আসছি।
বিনয় জিগ্যেস করল, কাকা, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব?
একটু ভেবে শেখরনাথ বললেন, না, তুমি এখানেই থাক। সেলুলার জেলটা যতটা প্রার, দেখ। পরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমস্ত দেখাব।
মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়েদের ভরসা দিয়ে বললেন, কোনও ভয় নেই। কেউ কান্নাকাটি কোরো না।
ডাঃ চট্টরাজ তার চেম্বারে চলে গেলেন। বিনয় শেখরনাথের সঙ্গে নিচের চত্বরে নেমে এল। বাকি সকলে এমার্জেন্সি বিভাগের সামনের করিডরে কয়েকটা বেঞ্চে বসে রইল।
নিচে এসে শেখরনাথ সেই ভ্যানটায় উঠে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে ফটকের দিকে ছুটল।
হাসপাতালের ব্লকটার ঠিক উলটো দিকে একই মাপের একই চেহারার বিশাল একটা ব্লক। একতলা থেকে তেতলা অব্দি লাইন দিয়ে কত যে সেল। সেসব দেখতে দেখতে পুরানো ভাবনাটা আবার ফিরে আসে। শত আলোকবর্ষ পেরিয়ে ইতিহাসের সেই উথালপাতাল দিনগুলোতে ফিরে গেল বিনয়। সারা দেশ জুড়ে, বিশেষ করে বাংলায় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইংরেজদের ওপর। বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ। চলছে গুলি, বোমা, ট্রেন,ডাকাতি। মরণজয়ী বিপ্লবীরা পণ করেছে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করবেই।
ওদিকে যাদের রাজত্বে কোনওদিন সূর্যাস্ত হয় না, সেই ব্রিটিশ প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে রইল না। তাদের বন্দুকের নল থেকে পালটা গুলি ছুটে গেল ঝুঁকে ঝাকে। চলল ধরপাকড়। চলল চরম দমননীতি। শত শত বিপ্লবীতে ভরে গেল কয়েদখানাগুলো। তাদের অনেককে ফাঁসিতে ঝোলানো হল। অনেককে নির্বাসন দেওয়া হল আন্দামানে।
ব্লকের ভেতরে ঢোকেনি বিনয়। সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে চেষ্টা করছিল কোন সেলে ছিলেন উল্লাসকর দত্ত, কোনটায় সাভারকার ভাইরা, কোনটায় গণেশ ঘোষ, কোনটায় উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
চলতে চলতে কখন যে ফটকের কাছাকাছি চলে এসেছে। খেয়াল নেই। পুরানো দিনের ইতিহাসে মগ্ন হয়ে ছিল বিনয়।
হঠাৎ একটি মেয়ে-গলা কানে এল। আস্তে আস্তে। বুড়োমানুষ, জোরে জোরে কি পা ফেলতে পারে?
চেনা কণ্ঠস্বর। লহমায় আচ্ছন্নতা কেটে যায় বিনয়ের। ব্যগ্রভাবে একটু কাত হয়ে তাকাতেই পা থেকে মাথা অব্দি সমস্ত শরীরে তড়িৎপ্রবাহ খেলে যায় ঝিনুক। একটি বৃদ্ধের একখানা হাত ঝিনুকের কাঁধে। ঝিনুক তার পিঠটা নিজের হাতে বেড় দিয়ে আছে। বৃদ্ধের অন্য হাতটা ধরে আছে নসিমুল। পেছন থেকে ধরে রয়েছে একটি যুবক। নিশ্চয়ই এস এস সাগর-এর স্টোকার। আরও একজন বৃদ্ধাও রয়েছে। তিনি খুব সম্ভব বৃদ্ধটির স্ত্রী। নসিমুল এদের জন্যই তাহলে গেটের কাছে অপেক্ষা করছিল।
বিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বিনয়। কী করবে সে যেন ভেবে পায় না।
ওদিকে বৃদ্ধকে নিয়ে ঝিনুকরা ফটক থেকে খানিক দূরের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। আরও মিনিট কয়েক হাঁটলেই সিসোস্ট্রেস বের কিনারে জেটিটায় পৌঁছে যাবে।
হঠাৎ স্নায়ুমণ্ডলীতে তীব্র একটা ঝাঁকুনি লাগল বিনয়ের। উদ্ভ্রান্তের মতো সেও ঢাল বেয়ে নামতে নামতে ডাকতে থাকে, ঝিনুক-ঝিনুক
নসিমুলরা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ততক্ষণে বিনয় তাদের কাছে চলে এসেছে। নসিমুল তাকে চিনতে পেরেছে। জিগ্যেস করল, ভাইসাব, আপ চাচাজিকা সাথ ভ্যানমে থে
তার কথাগুলো শুনতেই পেল না বিনয়। উতরোল আবেগে বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল তার। যেন লক্ষ কোটি, বছর পর ঝিনুককে সামনাসামনি দেখল সে। কী যে কষ্ট, কত যে সুখানুভূতি! কাঁপা গলায় বলতে লাগল, ঝিনুক ঝিনুক-তুমি বাকিটা আর শেষ করা গেল না। গলা বুজে এল।
ফটকের সামনে খুব সম্ভব বিনয়কে লক্ষ করেনি ঝিনুক। সে প্রথমটা হকচকিয়ে যায়। তারপর ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবলেশহীন। বিনয়কে সে আগে কোনও দিন বুঝিবা দেখেনি। সম্পূর্ণ অপরিচিত।
কণ্ঠস্বর আবার ফিরে পেল বিনয়। তুমি ভবানীপুরের বাড়ি থেকে চলে আসার পর কলকাতা আর চারপাশে কত যে তোমাকে খুঁজেছি! দিনের পর দিন। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি, মনে হত যন্ত্রণায় মৃত্যু হবে। কিন্তু মরতেও পারিনি।
সেই একদিন বুকের ভেতর আগলে আগলে বিনয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে মেয়েটিকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল দুঃখে গ্লানিতে আতঙ্কে সে একেবারে শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই ঝিনুক আর নেই। ঝলমলে স্বাস্থ্যে, লাবণ্যে সে এখন পরিপূর্ণ যুবতী।
ঝিনুক উত্তর দিল না। বিনয় যেন কথাগুলো তাকে নয়, অন্য কারওকে বলছে। উদাসীন মুখে ঝিনুক সমুদ্র, সি-গাল পাখি, আকাশ দেখতে থাকে।
উদ্বেল স্বরে বিনয় জিগ্যেস করে, খিদিরপুর ডকে আবছাভাবে তোমাকে যখন দেখি, মনে হয়েছিল হয়তো তুমি নও। তারপর রস আইল্যান্ডেও দেখলাম। অত মানুষের ভিড়ে তেমন ভালো করে নয়। কিন্তু চলুঙ্গা জাহাজে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। একই জাহাজে এতদূরে এসেছি, তুমি কি আমাকে দেখতে পাওনি ঝিনুক?
বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে ছিল।
বৃদ্ধটি এবার বলল, বাবা, আপনে কারে ঝিনুক কইতে আছেন?
ঝিনুকের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল বিনয়। একে—
আপনের ভুল অইছে বাবা। ও ঝিনুক না– সীতা।
বিনয় বুঝতে পেরেছে, নিরুদ্দেশ হবার পর ঝিনুক নাম পালটে ফেলেছে। সে জোর দিয়ে বলল, সীতা না, ও ঝিনুকই।
এতক্ষণে মুখ খুলল ঝিনুক, না, আমি সীতাই।
তুমি ঠিক বলছ না।
বিনয়ের চোখে চোখ রেখে ঝিনুক বলল, যদি আমি ঝিনুকই হই, কী এসে যায়? এই পৃথিবীর কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার দিকে ফিরল সে। মাসিমা মেসোমশাই চলুন, সন্ধে হয়ে আসছে, বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।
দলটা নেমে যেতে লাগল। চলতে চলতেই নসিমুল, রহমান, বৃদ্ধা ও বৃদ্ধ বার বার পেছন ফিরে বিনয়কে দেখতে লাগল। ঝিনুক ফিরেও তাকাল না।
বিনয় দাঁড়িয়েই আছে, দাঁড়িয়েই আছে। হতবুদ্ধি। বিহ্বল। এতকাল খোঁজাখুঁজির পর এ কোন ঝিনুককে দেখল বিনয়? যে মেয়েটা ছিল সারাক্ষণ ত্রস্ত, সারাক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত, এক পলক তাকে না দেখলে কী যে ব্যাকুল হয়ে পড়ত তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্য এক নারী। দৃঢ়, অবিচল, কঠিন।
বিহ্বলতা কাটলে বিনয় অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, আজ তুমি আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বললে না। না চেনার ভান করলে। কিন্তু তোমার ঠিকানা মোটামুটি জেনে গেছি। খুব শিগগির আমি মিডল আন্দামানে যাব। দেখব সেদিন আমাকে চিনতে পার কি না।
ঝিনুক এবারও তার দিকে তাকাল না।
দাঁড়িয়ে থাকতে বিনয়ের মনে হল, অসহ্য কষ্টে, তীব্র যাতনায় মাথার শিরা-স্নায়ু ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে, বুকের ভেতরের কোথায় যেন অবিরল রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
দিনের আলো কমে গিয়েছিল। ঝাপসা আঁধারে একসময় দেখা গেল ঝিনুকরা এস এস সাগর-এ উঠে পড়েছে। একটু পর ভোঁ বাজিয়ে উপসাগরকেচকিত করে জাহাজ চলতে শুরু করল।
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত
৩.০১ সেলুলার জেলের বাইরে
কয়েকদিন আগে ‘রস’ আইল্যান্ড থেকে ‘চলুঙ্গা’ জাহাজে মিডল আন্দামানে চলে গিয়েছিল ঝিনুক। আজ যাচ্ছে এস এস সাগর-এ। কলকাতা এবং তার চারপাশের জনারণ্যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই মেয়েটিকে খুঁজে বেড়িয়েছে বিনয় কিন্তু বৃথাই। তারপর একদিন ধীরে ধীরে সমস্ত আবেগ, সমস্ত উৎকণ্ঠা যখন থিতিয়ে এসেছে, তীব্র ব্যাকুলতা যখন জুড়িয়ে গিয়েছে, ঝিনুকের মুখ, তার স্মৃতি যখন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল সেই সময় তাকে স্পষ্টভাবে দেখা গেল রস আইল্যান্ডে। কিন্তু তা দূর থেকে। তখন কিছুই করার ছিল না।
আর আজ? আজ এই সেলুলার জেলের বাইরে, সমুদ্রের দিকে যাওয়ার ঢালু রাস্তায় কত আলোকবর্ষ পরে কয়েক লহমার জন্য ঝিনুককে সামনাসামনি পাওয়া গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ড তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল বিনয়ের। কিন্তু আশ্চর্য, প্রথমটা তাকে চিনতেই পারেনি ঝিনুক। কথাটা ঠিক হল না। চিনতে চায়নি। সমস্ত অতীত মুছে দিয়ে নিজের নামটাও বদলে ফেলেছে। রাজদিয়ার সেই জাপানি পুতুলের মতো মেয়েটা তার চোখের সামনে ক্রমশ কিশোরী, তারপর পূর্ণ যুবতী হয়ে উঠেছে। কখন যে জীবনের পরতে পরতে মিশে গিয়েছে অচ্ছেদ্য বন্ধনে, যা গিয়েছে তার প্রতি মুহূর্তের শ্বাসবায়ুতে, নিজেও টের পায়নি বিনয়। সেই ঝিনুক তার পুরনো জীবনটা পুরোপুরি বাতিল দিয়ে হয়ে উঠেছে সীতা। ঝিনুক বলে কেউ যেন কোনও পৃথিবীতে ছিল না।
অনেক পীড়াপীড়ির পরও সেভাবে মেনে নিতে চায়নি ঝিনুক। তবু তার কথায় সামান্য একটু স্বীকারোক্তি যে ছিল না তা নয়। বলেছে, কখনও যদি তার নাম ঝিনুক থেকে থাকে কার কী এসে যায়? এই নামটার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও লাভ বা ক্ষতি কিছুই হবে না। পৃথিবী যেমন চলছে নিজের নিয়মে তেমনই চলবে। তার আহ্নিক গতি বার্ষিক গতিতে লেশমাত্র বিঘ্ন ঘটবে না।
অথচ একদিন বিনয়কে বাদ দিয়ে কিছুই ভাবতে পারত না ঝিনুক। তাকেই ব্যগ্রভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। সেই চিরদুঃখী, আতঙ্কগ্রস্ত মেয়েটি আজ কী নিদারুণ উদাসীন, নির্বিকার, হয়তো একটু রূঢ়ও। অথচ তার জন্য কী না করেছে বিনয়? মহা সংকটের মধ্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বুকের ভিতর আগলে আগলে তাকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্তের এপারে নিয়ে এসেছিল। কলকাতায় পৌঁছবার পর তার গায়ে এতটুকু আঁচড় না লাগে সে জন্য ঢালের মতো তাকে রেখেছে। তবু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচাতে পারেনি। হেমনলিনী, অবনীমোহন এবং অন্যান্য আত্মীয়পরিজনরা অদৃশ্য আঙুল তুলে প্রতিটি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছে– তুমি ধর্ষিতা, তুমি ধর্ষিতা, তোমার মধ্যে শুচিতা নেই, তুমি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছ। এসব যারা বলেছে তাদের কতজনের মুখ চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব ছিল জড়িয়ে বিনয়ের পক্ষে? তারা কি জানে না ঝিনুকের জীবনে যে অঘটন ঘটে গিয়েছে সে জন্য তার দোষ কতটুকু?
ঝিনুককে নিয়ে বিনয় যখন দিশেহারা, চারপাশ থেকে একটা দিন এই আগুনের বলয় যখন মেয়েটাকে ঘিরে ধরছিল, তাকে বাঁচাবার জন্য সুধা আর হিরণ ছাড়া অন্য কারুকে পাশে পায়নি বিনয়। অনেকটাই করেছে বিনয়রা কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। আনন্দ আর সুনীতির ইচ্ছা থাকলেও হেমনলিনীর দাপটে তাদের মুখ বুজে থাকতে হয়েছে।
ঝিনুক অপমানে, অভিমানে, তীব্র গ্লানিবোধে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর বিনয় কতটা কষ্ট পেয়েছে, চারদিক উথালপাতাল করে তাকে কত খুঁজেছে, কতদিন কত রাত তার উদভ্রান্তের মতো কেটেছে সেসব এতকাল পর ঝিনুককে কাছে পেয়ে বলতে চেয়েছিল বিনয় কিন্তু সে সুযোগ পাওয়া যায়নি। তার কোনও কথাই কানে সম্পূর্ণ তোলেনি ঝিনুক। চরম উদাসীনতায় তাকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করেছে করিয়ে সে জাহাজঘাটার দিকে চলে গিয়েছিল। তার আচরণ এতটা কঠোর, এমন আবেগহীন হবে, কে ভাবতে পেরেছে!
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল বিনয়ের। বুকের ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ঝিনুক এতটা বদলে যাবে, কোনও দিন কি তা সে কল্পনা করেছে! নিদারুণ যাতনার মধ্যে হঠাৎ খেয়াল হল যে অসুস্থ বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধাটিকে নিয়ে ঝিনুক পোর্টব্লেয়ারের হাসপাতালে এসেছিল তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটল কী করে? এরা কারা? এদের খোঁজ কোথায় পেয়েছে সে? প্রথমটা এইসব প্রশ্নের তালকুল খুঁজে পাচ্ছিল না বিনয়। কেমন যেন ধন্দে পড়ে গেল। আচমকা বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে গেল নতুন ভারত-এ রিফিউজিদের জবরদখল কলোনিগুলি নিয়ে প্রতিবেদন লেখার জন্য কলকাতার চারপাশ যখন চষে বেড়াচ্ছে সেই সময় গড়িয়ার কাছাকাছি একটি কলোনির এক আধবুড়ো উদ্বাস্তু অধর ভুঁইমালীর কাছে খবর পেয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশনে সে ঝিনুককে একজন বৃদ্ধের সঙ্গে বনগাঁ কিংবা কাঁচরাপাড়া লাইনের ট্রেনে উঠতে দেখেছে। অধর রাজদিয়া অঞ্চলের লোক। ছেলেবেলা থেকেই সে ঝিনুককে চেনে।
সমস্ত ব্যাপারটা এতদিনে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল বিনয়ের কাছে। ভবানীপুরে প্রিয়নাথ মল্লিক, রোডের বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার পর ঝিনুক নিশ্চয়ই ঘুরতে ঘুরতে শিয়ালদহে চলে গিয়েছিল। সেখানেই খুব সম্ভব বৃদ্ধটির সঙ্গে তার দেখা হয়। বৃদ্ধটিও উদ্বাস্তু। ঝিনুক তাদের কাছে আশ্রয় পায়। তারপর পুনর্বাসনের জন্য যখন ছিন্নমূল মানুষদের আন্দামানে পাঠানো হয়, বৃদ্ধদের সঙ্গে ঝিনুকও এখানে চলে আসে।
বিনয় ঈশ্বরবিশ্বাসী কি না নিজের কাছেই সেটা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবু এই মুহূর্তে যে মেয়েটি তাকে ভেঙে খানখান করে দিয়ে চলে গেছে তার সম্বন্ধে তেত্রিশ কোটি অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশ্যে বুঝি বা নিঃশব্দে জানাল; তোমাদের অপার করুণায় ঝিনুক একটি ভালো মানুষের হাতে গিয়ে পড়েছিল। দেশভাগের পর কলকাতায় হিংস্র সরীসৃপের মতো মেয়ের দালালেরা আর লুচ্চার পাল চারদিকে ওত পেতে আছে। অরক্ষিত কোনও উদ্বাস্তু যুবতীকে দেখলেই ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে নরকের খাসতালুকে। ঝিনুকের সেই চরম দুর্ভাগ্য হয়নি। তোমরাই তাকে রক্ষা করেছ।
এদিকে বাঁ ধারে, অনেকটা দূরে, মাউন্ট হ্যারিয়েটের চুড়োটার ওপাশে সূর্য বেশ কিছুক্ষণ আগেই নেমে গিয়েছিল। দিনের শেষ মলিন আলোটুকু দ্রুত মুছে যাচ্ছে। ঝাপসা হালকা অন্ধকারের সঙ্গে নেমে আসছে ফিনফিনে কুয়াশা! আঁধারে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জ। যেটুকু আলো এখনও রয়েছে তাতে মাউন্ট হারিয়েটের মাথায় ধবধবে বিশাল ক্রশটা কিন্তু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
শয়ে শয়ে সি-গাল পাখি সারাদিন সমুদ্রের উপর চক্কর দিয়ে বেড়ায়। এখন তারা ডানা ঝাঁপটে পাড়ের দিকে চলেছে। এটা তাদের ঘরে ফেরার সময়। সেই ভোর থেকে সূর্যাস্ত অবধি উপসাগরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সার্ডিন, হাঙরের বাচ্চা কী ছোট ছোট চাদা মাছ ধারালো ঠোঁটে তুলে এনে খেয়েছে। পেট ভরতি। পরিতৃপ্ত সিন্ধুশকুনেরা নিত্যকর্ম সেরে এবার পাড়ের কোনও গাছের ডালে রাত কাটাবে। পরদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফের বেরিয়ে পড়বে উপসাগরের দিকে। সমস্ত দিন ধরে চলবে মাছ শিকার আর খাওয়া। পাখিগুলির পেটে রাহুর খিদে।
অন্য কোনও দিকে নজর ছিল না বিনয়ের। সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পলকহীন।
ঝিনুকদের জাহাজটা সিসোস্ট্রেস বে ছাড়িয়ে যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে সেখানে একদিকে অফুরান বঙ্গোপসাগর; অন্য দিকে ছোট-বড় অনেকগুলি দ্বীপ। স্টিমশিপ সাগর এক সময় ছোট হতে হতে একটি আবছা বিন্দুর মতো দ্বীপগুলির আড়ালে। মিলিয়ে গেল।
উপসাগরের দিক থেকে বিকালে বা সন্ধেয় প্রবল হাওয়া উঠে আসে। আজও আসছিল। ঠান্ডা, আরামদায়ক বাতাস। বিনয়ের খেয়াল হল, অনেকক্ষণ সে পাহাড়ের ঢালের এই রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে শেখরনাথ হয়তো ফিরে এসেছেন। তিনি বলে গিয়েছিলেন, বিনয় যেন আজ যতটা পারে সেলুলার জেলটা ঘুরে ঘুরে দেখে। ঘণ্টাখানেক বা ঘণ্টা দেড়েকের ভিতর বিশাল ওই বন্দিশালার কতটুকুই বা দেখা সম্ভব? পরে পুরো দু তিনটে দিন তাকে সঙ্গে নিয়ে যতগুলি ব্লক আছে সব দেখিয়ে দেবেন।
কিন্তু আজ প্রায় কিছুই দেখা হয়নি। অন্যমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে জেলের থমথমে ভীতিকর চেহারার গেট পেরিয়ে বিনয়। চলে এসেছিল বাইরের রাস্তায়। আর সেখানেই দেখা হয়ে গিয়েছে ঝিনুকের সঙ্গে। কতকালের চেনা এই ঝিনুক কিন্তু আজ মনে হল কত অচেনা। সে যেন অজানা গ্রহের কোনও মানুষ। অথচ তার সঙ্গে দেখা হোক, এই তীব্র বাসনাটা মনের কোনও নিভৃত কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখেছিল, এমনকী ঝুমা তার কাছাকাছি এসে পড়ার পরও। কত দুঃখ, কত যাতনাইনা এই মেয়েটির জন্য সে সয়েছে৷ কিন্তু এরকম একটা দেখা হবে সে জন্য সে কি আদৌ প্রস্তুত ছিল? টের পাচ্ছিল উতরোল বুকের তলদেশে অবিরল শেল বিধে যাচ্ছে৷
ক্লান্ত, বিপর্যস্ত বিনয় আর দাঁড়াল না; ঢালু রাস্তার চড়াই বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠে এল। তারপর সেলুলার জেলের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে সোজা হাসপাতালের দোতলায়।
এখন চারদিকে আলো জ্বলছে।
একপাশে সারি সারি কুঠুরি; এক সময় যা ছিল কয়েদিদের সেল। সেগুলির সামনে দিয়ে টানা চওড়া রেলিংগুলি প্যাসেজ দোতলার এক মাথা থেকে বহুদূরে শেষ মাথা অবধি চলে গেছে।
প্যাসেজে খানিকটা পর পর বসার জন্য বেঞ্চি পাতা। কিছুক্ষণ আগে এখানে প্রচুর লোকজন থিক থিক করছিল। তারা ছিল ভিজিটর; হাসপাতালে ভরতি রোগীদের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব। তাদের বেশিরভাগই চলে গিয়েছে, ভিড় এখন বেশ হালকা। এখানে-ওখানে সামান্য কয়েকজনকে দেখা যায়।
বিনয় যখন শেখরনাথের সঙ্গে নিচে নেমে যায় র স্ত্রী ছেলেমেয়েরা প্যাসেজের একটি বেঞ্চে যেমন বসে ছিল ঠিক তেমনি জড়সড় হয়ে বসে আছে। পাংশু, শীর্ণ, উৎকণ্ঠিত সারি সারি মুখ। শেখরনাথকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। জেফ্রি পয়েন্টের সেটলমেন্ট থেকে পুনর্বাসন দপ্তরের যে কর্মীরা কে ধরাধরি করে নিয়ে এসেছিল তারা শেখরনাথদের কাছাকাছি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একটা ফাঁকা বেঞ্চের উপর দুটো বড় ডেকচিতে ভঁই করা আটার রুটি আর আলু, কুমড়ো এবং নানারকম সবজি দিয়ে তৈরি ঘাট ছাড়াও রয়েছে শালপাতার একগোছা থালা।
বিনয় আন্দাজ করে নিল শেখরনাথ তার ভাইপো বিশ্বজিৎ রাহার সঙ্গে দেখা করে খাবারদাবার নিয়ে ফিরে এসেছেন। এতগুলি মানুষ সেই কোন সকালে মোহনবাঁশিকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছিল; সারাদিনে তাদের পেটে একফোঁটা জলও পড়েনি। খিদেয় নাড়ি চুঁইয়ে যাচ্ছে। একে দুর্ভাবনা, তার উপর সারাদিন না খাওয়া। ওরা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে– বিরাট সমসা। দেখা যাচ্ছে, শেখরনাথের সব দিকে নজর।
বিনয় ভেবেছিল, জারোয়াদের তিরে মারাত্মক জখম হওয়ার খবরটা পেয়ে বিশ্বজিৎ তক্ষুনি চলে আসবেন। কেননা ছিন্নমূল মানুষগুলির প্রতি তার কত যে সহানুভূতি! তিনি না আসায় রীতিমতো অবাকই হল বিনয়।
ওদিকে শেখরনাথের কথামতো পুনর্বাসনের একজন কর্মী শালপাতার থালায় রুটি-তরকারি সাজিয়ে মোহন বাঁশির স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
মোহনবাঁশির স্ত্রীর কপালের আধাআধি অবধি ঘোমটা টানা। করুণ সজল দৃষ্টিতে একবার শেখরনাথের দিকে তাকিয়ে তক্ষুনি চোখ নামিয়ে নিল। ছেলেমেয়েগুলি বোবার মতো তাকিয়ে রইল শুধু। তারা কেউ খাবারের থালাগুলি ধরল না। হাত গুটিয়ে সবাই বসে থাকে।
শেখরনাথ নরম গলায় বললেন, কী হল, নাও
ঢোক গিলে শুকনো গলায় মোহনবাঁশির স্ত্রী বলল, খাওনের ইচ্ছা নাই৷ জবর তরাস (ভয়) লাগতে আছে।
ছেলেমেয়েরা কিছু বলল না।
শেখরনাথ তাদের মনোভাব আঁচ করে নিয়েছেন। বললেন, ভয় পেলে চলবে? মনে জোর রাখতে হবে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, মোহনর্বাশি বেঁচে যাবে। শেষ কথাগুলি সাহস দেওয়ার জন্য। ডাক্তার চট্টরাজ ঠিক এতখানি ভরসা দেননি। তিনি বলেছেন, মোহনবাঁশির প্রাণরক্ষার জন্য তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। হয়তো লোকটা বেঁচে যাবে। তবে সবই নির্ভর করছে অপারেশনের পর। ব্যস, এটুকুই।
ডাক্তার চট্টরাজ যা বলেছেন হুবহু তা জানালে মোহনবাঁশির স্ত্রী ছেলেমেয়েরা আরও ভেঙে পড়বে। তারা কিছুতেই খাবে না; একরকম জোরজার করে নিজে তাদের হাতে খাবারের থালাগুলি ধরিয়ে দিলেন শেখরনাথখাও বলছি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও, নিঃশব্দে খাওয়া শুরু হল।
শেখরনাথ এবার পুনর্বাসন কর্মীদের দিকে ফিরলেন। সারাদিন তোমাদের যথেষ্ট ধকল গিয়েছে। না খাওয়া, না চান। তার উপর পাহাড়ি রাস্তায় ট্রাকের ঝাঁকুনি। নাও নাও, রুটিটুটি তুলে নিয়ে খেতে শুরু কর।
পুনর্বাসনের কর্মীরা সামান্য ইতস্তত করে বলল, কাকা, আপনে খাইবেন না?
আমার জন্য ভেবো না। বিশুর কাছে গিয়েছিলাম। সে আমাকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে আর তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। বলতে বলতে শেখরনাথের নজর এসে পড়ল বিনয়ের উপর।–আরে, তোমার কথা একেবারেই খেয়াল ছিল না। কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
ঝিনুকের ব্যাপারটা না জানিয়ে ভাসা ভাসা জবাব দিল বিনয়।–আপনি সেলুলার জেলটা দেখতে বলে গিয়েছিলেন। এধারে-ওধারে ঘুরে তাই দেখছিলাম।
কী দেখেছে তা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না শেখরনাথ। তাড়া দিয়ে বললেন, সারাদিনে তোমারও তো কিছু খাওয়া হয়নি। রুটি-তরকারি খেয়ে নাও
খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে শেখরনাথ পুনর্বাসন কর্মীদের বললেন, এবার তোমরা তোমাদের আস্তানায় চলে যাও। ভালো করে বিশ্রাম নাও। আর তোমাদের হাসপাতালে আসতে হবেনা। কাল সকালে উঠে সোজা জেফ্রি পয়েন্টের সেটলমেন্টে চলে যাবে। মোহনবাঁশির ব্যাপারটা আমরা দেখব।
বিনয় আগেই জেনেছিল, পোর্টব্লেয়ারের এবারডিন মার্কেটের পাশে রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্ট একটা বড় বাড়ি। ভাড়া নিয়েছে! কলকাতা থেকে নতুন উদ্বাস্তুরা এলে সেখানে তারা দু-এক দিন থাকে। তারপর তাদের সাউথ আন্দামানের নানা এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শুধু কলকাতা থেকে আসা উদ্বাস্তুরাই নয়, পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা সুদূর সেটলমেন্টগুলি থেকে কোনও প্রয়োজনে পোর্টব্লেয়ারে এলে তারাও এখানে কাটিয়ে যায়।
জেফ্রি পয়েন্ট থেকে মোহনবাঁশিকে নিয়ে যে কর্মীরা এসেছিল তারা চলে গেল। মোহনবাঁশির স্ত্রী ছেলেমেয়েরা যেখানে বসে আছে তাদের সেখানে অপেক্ষা করতে বলে শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, চল, ডাক্তার চট্টরাজের সঙ্গে দেখা করে পেশেন্টের এখনকার হাল জেনে নিই। এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই মোহনবাঁশির ট্রিটমেন্টের সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
ডাক্তার চট্টরাজের চেম্বারটি কোনাকুনি ডানধারে খানিকটা দূরে। সেদিকে যেতে যেতে বিনয় জিজ্ঞেস করল, এমন একটা মারাত্মক ঘটনার খবর পেয়েও রাহাসাহেব এলেন না কেন? ভেবেছিলাম– বাকিটা শেষ না করে থেমে গেল সে।
শেখরনাথ বললেন, ওর আসার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সন্ধেবেলায় চিফ কমিশনার রিহ্যাবিলিটেশনের কজন। অফিসারকে তার বাংলোয় ডেকেছেন। তাই আসতে পারল না। হাসপাতালের কাজ চুকলে মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়ে আর তোমাকে তার বাংলোয় নিয়ে যেতে বলেছে। যে কদিন পোর্টব্লেয়ারে আছি, তার বাংলোতেই থাকব।
বিনয় আর কোনও প্রশ্ন করল না।
ডাক্তার চট্টরাজ তার চেম্বারেই ছিলেন। মোহনবাঁশিকে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভরতি করা হয়েছিল। ডাক্তার চট্টরাজকে দেখে মনে হল, তাকে দেখে একটু আগে ফিরে এসেছেন। চুল এলোমেলো, কেমন একটু চিন্তাগ্রস্ত, অস্থির অস্থির ভাব। লক্ষণটা ভালো লাগল না বিনয়ের।
শেখরনাথ আর বিনয়কে দেখে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার চট্টরাজ। টেবিলের এধারে সারি সারি চেয়ারগুলি দেখিয়ে বললেন, বসুন বসুন–
শেখরনাথ জিজ্ঞেস করলেন, মোহনবাঁশিকে তোমার হাতে দিয়ে আমি বিশুর কাছে গিয়েছিলাম। এক ঘণ্টার বেশি কেটে। গেছে। ওর কন্ডিশন কীরকম বুঝছ?
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইলেন ডাক্তার চট্টরাজ। তারপর সোজা শেখরনাথের দিকে তাকালেন। খুবই সিরিয়াস কাকা।
দুর্ভাবনার ছায়া পড়ল শেখরনাথের চোখেমুখে। কীরকম?
ডাক্তার চট্টরাজ জানালেন, জারোয়াদের তির মোহনবাঁশির ফুসফুসে ঢুকে গেছে। সেটা ভীষণ বিপজ্জনক। তিরটা বার করতে গিয়ে যদি ভিতরে রক্তক্ষরণ হয় লোকটাকে বাঁচানো যাবে কি না বলা মুশকিল।
নীরবে বসে রইলেন শেখরনাথ। তার উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। বিনয়েরও।
বেশ কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, যে অবস্থায় মোহনবাঁশিকে নিয়ে এসেছিলেন তিরটা ঠিক সেইরকম বিধে আছে। ওটা বার না করলেই নয়। কিন্তু আজ তা সম্ভব না।
রুদ্ধশ্বাসে শেখরনাথ জানতে চাইলেন, কেন?
তিরটা বার করার জন্য আমার দুজন অ্যাসিস্টান্ট সার্জন দরকার। তেমন কেউ আপাতত হাসপাতালে নেই। ডাক্তার চট্টরাজ বলতে লাগলেন, আপনি তো জানেন কাকা, আমাদের এখানে প্রয়োজনের তুলনায় স্টাফ কম। বিশেষ করে ডাক্তার। কলকাতা বা মাদ্রাজ থেকে কোনও ডাক্তার এখানে চাকরি নিয়ে আসতে চায় না। মাত্র কয়েকজনকে নিয়ে এত বড় হাসপাতাল চালাতে হচ্ছে। আমার দুজন ব্রাইট ইয়াং সহকর্মী দুসপ্তাহ আগে কার নিকোবরে গেছে। সেখানে কটা ক্রিটিকাল অপারেশন সেরে কাল সকালে তাদের ফেরার কথা। ওরা এসে পৌঁছুলেই তিরটা বার করব।
যদি কোনও কারণে ওঁদের না আসা হয়, তা হলে?
সেটা বিরাট সমস্যা। আশা করছি এসে যাবে। না এলে আমাকেই যা করার করতে হবে। রিস্ক হবে ঠিকই, কিন্তু সেটা না নিয়ে উপায় নেই।
গভীর উদ্বেগের সুরে শেখরনাথ বললেন, আজ সকালের দিকে তির বিঁধেছে। সেই অবস্থায় সারাদিন কেটেছে, রাতটাও কাটবে। আমার কিন্তু একেবারেই ভালো মনে হচ্ছে না।
ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, যাতে ইনফেকশন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য দুটো ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। রাত্তিরে আরও দুটো। দেওয়া হবে। একটাই সুলক্ষণ, ফুসফুসের ফাংশন বন্ধ হয়ে যায়নি। মোহনবাঁশি বেঁচে আছে, তবে চেষ্টা করেও জ্ঞান ফেরাতে পারিনি! ভাববেন না কাকা, আজকের রাতটা আমি হাসপাতালে মোহনবাঁশির কাছে থাকব। কোয়ার্টারে ফিরব না।
একটু চিন্তা করে শেখরনাথ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী মনে হয়, আমার হাসপাতালে থাকা দরকার? তা হলে মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়ে আর বিনয়কে বিশুর বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসব।
মোহনবাঁশি পূর্ব পাকিস্তানের একজন সামান্য উদ্বাস্তু, যার সঙ্গে লেশমাত্র সম্পর্ক নেই, সম্পূর্ণ অনাত্মীয়, জেফ্রি পয়েন্টে আসার আগে তাকে কোনও দিন দেখেননি, তবু তার প্রতি কী গভীর মমতা শেখরনাথের। কতখানি তীব্র উদ্বেগ! বয়স তো কম হয়নি, তার উপর সেই সকাল থেকে শরীরের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। সেসব অগ্রাহ্য করে তিনি কি না মোহনবাঁশির জন্য হাসপাতালে রাত কাটাতে চাইছেন! অগ্নিযুগের এই বিপ্লবী মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা শতগুণ বেড়ে গেল বিনয়ের। অবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
এদিকে ডাক্তার চট্টরাজ ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।–না না কাকা, আপনাকে এখানে এসে রাত জাগতে হবে না। হাসপাতালে তো আপনার কিছু করার নেই। বাহা সাহেবের বাংলোয় গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়ুন। বয়স হয়েছে, ঘুমটা কিন্তু আপনার খুব দরকার। কাল বেলার দিকে এসে মোহনবাঁশির। খবর নেবেন।
ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, বিশুর ওখানে চলেই যাই। কিন্তু ঘুমোতে কি আর পারব? মোহনবাঁশির জন্য বড় চিন্তা হচ্ছে ডাক্তার। বলতে বলতে উঠে পড়লেন।
বিনয়ও আর বসে থাকল না। তাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরের প্যাসেজে বেরিয়ে এলেন শেখরনাথ। নিচু গলায় বললেন,ডাক্তারের সঙ্গে যা কথা হল, মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়েদের কিন্তু বোলো না। শুনলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। যা বলার আমিই ওদের বলব।
বিনয় আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল। আচ্ছা।
মোহনবাঁশির পুরো পরিবারটি যেখানে বসে ছিল সেখানে আসতেই তার স্ত্রী ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। শুষ্ক, শীর্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল, ডাক্তারবাবু কী কইল? মানুষটা কেমুন আছে?
মানুষটা বলতে মোহনবাঁশি। উত্তর দিতে গিয়ে একটু যেন থেমে গেলেন শেখরনাথ। তারপর বললেন, ইঞ্জেকশন, ওষুধ সবই দেওয়া হয়েছে। ভয়ের কারণ নেই।
মোহনবাঁশির স্ত্রী গেঁয়ো মেয়েমানুষ। দেশভাগের আগে পূর্ববাংলায় তাদের নিজেদের গ্রাম এবং তার চারপাশের কয়েকটি গ্রামগঞ্জের বাইরে কোনও দিন পা বাড়ায়নি। নিরক্ষর হলেও সে নির্বোধ নয়, মুখ দেখে মনের কথা হয়তো পড়তে পারে। একদৃষ্টে সে শেখরনাথকে লক্ষ করছিল। চোখের পাতা পড়ছিল না তার। বলল, আপনে ঠিক নি কন?
শেখরনাথ ভিতরে ভিতরে খুব সম্ভব বিব্রত বোধ করলেন। লহমায় তা সামলে নিয়ে বললেন, বেঠিক বলব কেন? এখন চল
না, আমাগো যাইতে কইয়েন না। মনে বড় কুড়াক ডাকতে আছে। আমরা এহানেই থাকুম। অন্য কুনোহানে যামু না।
এখানে কোথায় থাকবে?
এই কাঠের পাটায় বেঞ্চে) বইয়া (বসে) থাকুম।
খুব দরকার না হলে রোগীর বাড়ির লোকেদের হাসপাতালে রাত্তিরে থাকতে দেয় না। তেমন বুঝলে ডাক্তারবাবু তোমাদের থাকতে বলতেন৷ বলে একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ওপর তোমাদের ভরসা আছে তো?
নিয্যস (নিশ্চয়ই)। আপনেরা ছাড়া এই দ্বীপি আমাগো আপনাজন (আপনজন) আর কে আছে?
তা হলে চল।
অনেক বোঝানোর পর প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মোহনবাঁশির স্ত্রীকে রাজি করানো গেল। শেখরনাথ বিশ্বজিতের একটি জিপ নিয়ে এসেছিলেন। দোতলা থেকে নেমে নিচের বিশাল চত্বরে এসে মোহনবাঁশির গোটা পরিবার এবং বিনয়কে নিয়ে জিপে উঠে পড়লেন শেখরনাথ।
৩.০২ এবারডিন মার্কেট
জিপটা সেলুলার জেলের বিশাল চত্বর পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। খানিকটা এগিয়ে টিলার ঢাল বেয়ে নিচে নেমে সোজা এবারডিন মার্কেট। মার্কেটের দোকানপাট বেশ রাত অবধি খোলা থাকে। এখন তো সবে সন্ধে পেরিয়েছে। চারিদিকে আলো জ্বলছে। ইলেকট্রিক লাইট ছাড়াও রয়েছে গ্যাসের আলোও। লোকজনও প্রচুর চোখে পড়ছে। বিকিকিনি চলছে। পুরোদমে।
জিপ চালাচ্ছিল বিশ্বজিৎ রাহার ড্রাইভার কালীপদ। ফ্রন্ট সিটে তার পাশে বসে আছে বিনয় এবং শেখরনাথ। পেছনের মুখোমুখি দুটো লম্বা সিটে মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা উদ্বাস্তুরা সেটেলমেন্ট থেকে কোনও কারণে পোর্টব্লেয়ারে এলে এবারডিন মার্কেটের পাশে পুনর্বাসন দপ্তরের ভাড়া করা বাড়িতে রাখা হয়। কিন্তু মোহনবাঁশির পরিবারের লোকজন এতটাই কাতর, এতটাই উৎকণ্ঠিত যে রিহ্যাবিলিটেশনের কর্মীরা ওদের সামলাতে পারবে না; তাই শেখরনাথ বিশ্বজিতের বাংলোয় নিয়ে চলেছেন। খুব সম্ভব এই নিয়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। যে কদিন মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা পোর্টব্লেয়ারে আছে, বিশ্বজিতের বাংলোতেই থাকবে। ওদের চোখে চোখে রাখা একান্ত দরকার।
এবারডিন মার্কেট এবং তার চারপাশের এলাকাটা খুব ভালোই চেনে বিনয়। এই তো সেদিন উদ্বাস্তুদের সঙ্গে রস আইল্যান্ড থেকে মোটরবোটে পোর্টব্লেয়ারে নেমে এবারডিন মার্কেটের জিমখানা ময়দানে এসেছিল। সেখান থেকে বিশ্বজিতের সঙ্গে তার বাংলোয়।
মার্কেটের জমজমাট চৌহদ্দি পেছনে ফেলে পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরল জিপটা। উঁচু-নিচু টিলা পেরিয়ে সেটা চলেছে তো চলেছেই। দুধারে পরিচিত দৃশ্য। রাস্তার নিচের ঢালু জমিতে ধানখেত; দূরে দূরে ছাড়া ছাড়া ভাবে বাড়ি-ঘর। কাঠের বাড়িই বেশি; ক্কচিৎ দু-চারটে পাকা দালান।
এক সময় ফুঙ্গি চাউং বা বুদ্ধমন্দিরের কাছে এসে বাঁক ঘুরে জিপটা ডাইনে দৌড় শুরু করল। সামনে পাহাড়; তার ওধারের ঢালের মাঝামাঝি মিডল পয়েন্টে বিশ্বজিৎ রাহার বাংলো।
কদিন আগেই পূর্ণিমা ছিল। আকাশে ছিল পূর্ণ চাঁদের মায়া। সেই চাঁদ অনেকটা ক্ষয়ে গেলেও যেটুকু জ্যোৎস্না ঢালছে তাতে চরাচর যেন কোনও অপার্থিব রহস্যে ভরে আছে।
জিপের সবাই চুপচাপ। কেউ কোনও কথা বলছিল না। শুধু পেছনের সিট থেকে মোহনবাঁশির স্ত্রীর চাপা কান্নার ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
এক সময় পাহাড় পেরিয়ে বিশ্বজিতের বাংলোর সামনে এসে জিপ থামল। বিনয়কে নিয়ে শেখরনাথ নেমে পড়লেন। তারপর মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নামিয়ে আনলেন। –এসো এসো আমার সঙ্গে।
কাঠের দোতলা বাড়ি। রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে শেখরনাথ গলার স্বর উঁচুতে তুললেন। গোপাল, কার্তিক, ভুবন–আমরা এসে গেছি।
বিনয় জানে ওই তিনজন বিশ্বজিতের কাজের লোক। ওদের আগে থেকে খবর দেওয়া ছিল। তারা দৌড়ে দোতলার সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াল।
শেখরনাথ কার্তিককে জিগ্যেস করলেন, একটা ঘরে চারজনের মতো বিছানা-টিছানা ঠিক করে রাখতে বলেছিলাম। রেখেছিস তো?।
বাড়ি সাফ করা, ঘর গুছানো, বিছানা পাতা–এইসব কাজ কার্তিক করে। গোপাল তার সঙ্গে হাত লাগায়, তা ছাড়া নানা ফাইফরমাশও খাটে। কার্তিক বলল, হা, কাকা।
বিনয় আগেই লক্ষ করেছে যার সঙ্গেই শেখরনাথের দেখা হয়েছে, বাঙালি হলে তারা কাকা বলেছে, বাকিরা চাচা। এমনকী এই বাংলোর কাজের লোকেরাও তাই। বিশ্বজিতের কাকা, সেই সুবাদে তিনি আন্দামানের সব বাসিন্দারই কাকা।
শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, বিশু এসেছে?
না।
বিনয় আন্দাজ করে নিল চিফ কমিশনারের বাংলোয় মিটিং সারতে বিশ্বজিতের দেরি হচ্ছে। তাই এখনও তিনি ফিরতে পারেননি।
সবাই দোতলায় উঠে এল। এখানে বেতের সোফা-টোফা দিয়ে সাজানো মস্ত ড্রইং-রুমের তিন দিকে পাঁচখানা শোওয়ার। ঘর। এই বাংলোয় এক রাত কাটিয়ে গেছে বিনয়। এসব তার চেনা।
শেখরনাথ বললেন, কোন ঘরে ব্যবস্থা হয়েছে।
বাঁ পাশের কোণের ঘরটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল কার্তিক।
শেখরনাথ বললেন, ওটার লাগোয়া বাথরুম আছে। ওদের ওখানে নিয়ে যা। গরম জল করে দিস। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে ওরা চান-টান সেরে নিক ভুবনকে বললেন, তোর রান্নাবান্না হয়ে গেছে?
ভুবন জানাল, দু-একটা পদ বাকি আছে।
তাড়াহুড়ো করতে হবে না। হাসপাতালে ওরা রুটি-তরকারি খেয়ে এসেছে। এই তো সন্ধে পার হল৷ কটা আর বাজে! ঘণ্টা দেড়-দুই পরে ওদের ভাত দিস।
কার্তিক মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোণের ঘরে চলে গেল। শেখরনাথ বিনয়কে সঙ্গে করে ড্রইংরুমের সোফায় গিয়ে বসলেন। ওঁরা আজকের সারাদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে এলোমেলোভাবে কথা বলতে লাগলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে বিশ্বজিৎ ফিরে এলেন। তাঁর জিপে বিনয়রা হাসপাতাল থেকে এসেছিল। তিনি অন্য একটা গাড়িতে এসেছেন।
বিশ্বজিৎ সোজা বিনয়দের কাছে এসে বসলেন। জিগ্যেস করলেন, কাকা, মোহনবাঁশি কর্মকারের লেটেস্ট খবর কী? আমার অফিস থেকে হাসপাতালে গিয়ে কেমন দেখলেন?
শেখরনাথ যে ঘরটায় মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের পাঠানো হয়েছে সতর্কভাবে একবার সেদিকে তাকালেন। গলার স্বর যাতে সেখানে না পৌঁছায় সেভাবে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, দেখতে আর দিল কোথায়? ওকে এমার্জেন্সিতে রাখা হয়েছে। তারপর ডাক্তার চট্টরাজের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে, সব জানিয়ে দিলেন।
দুর্ভাবনার রেখাগুলো ফুটে ওঠে বিশ্বজিতের চোখে-মুখে।
-খুব সমস্যা হল কাকা। লোকটাকে যদি বাঁচানো না যায়, জেফ্রি পয়েন্টে সেটলমেন্টে তার ভীষণ খারাপ রি-অ্যাকশন হবে। কিছুদিন আগে জারোয়ারা একবার হানা দেওয়ার পর উদ্বাস্তুরা এত ভয় পেয়ে যায় যে কিছুতেই আন্দামানে থাকতে চাইছিল না। তখন কেউ খুন-জখম হয়নি। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের রাখতে পারা গিয়েছিল। কিন্তু মোহনবাঁশির মৃত্যু হলে ওরা কী যে করবে ভেবে পাচ্ছি না। দেখা যাক, কার নিকোবর থেকে দুই সার্জন ফিরে আসার পর কী হয়। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
শেখরনাথের হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল। –দ্যাখ বিশু, জেফ্রি পয়েন্টের উত্তর দিকটায় জারোয়ারা থাকে। আমার ধারণা, ওধারের জঙ্গল কাটা পড়ছে বলে ওরা খেপে গেছে। ওদের তাড়িয়ে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন করাটা ঠিক হচ্ছে না।
একটু নীরবতা।
তারপর শেখরনাথই ফের শুরু করলেন, উত্তর দিকটা বাদ দিয়ে তারা বরং পুব দিকের জঙ্গলগুলো আরও বেশি করে রিক্লেম কর।
বিশ্বজিৎ চকিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু
কী হল?
গভর্নমেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, উত্তর আর পুবের জঙ্গল সাফ করতে হবে। নইলে এত ভি পি ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া যাবে কী করে?
শেখরনাথ বললেন, আমি কিন্তু তোর লোকেদের উত্তর দিকের জঙ্গল কাটতে বারণ করে এসেছি।
সে কী! কয়েক লহমা হতবাক তাকিয়ে থাকেন বিশ্বজিৎ। তারপর ভয়ে ভয়ে বললেন, এটা কিন্তু ঠিক করেননি কাকা।
তার মানে? বেশ রেগেই গেলেন শেখরনাথ। যারা ওখানকার আদি বাসিন্দা, জঙ্গল কেটে তাদের এলাকা ছোট করে দেওয়া হচ্ছে, এটা কি ঠিক কাজ? তোরা জানিস না অনেকটা জায়গা জুড়ে জারোয়ারা ঘুরে বেড়ায়?
ঢোক গিলে বিশ্বজিৎ বললেন, গভর্নমেন্ট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের পক্ষে এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয় কাকা। ওপর থেকে যে নিয়ম বেঁধে দেবে সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমাদের তা না মেনে উপায় নেই।
এর ফলে জারোয়ারা কিন্তু আরও বেশি হোস্টাইল হয়ে উঠবে। ওদের ডিসটার্ব করা উচিত নয়।
বিশ্বজিৎ চুপ করে রইলেন।
স্থির দৃষ্টিতে ভাইপোকে লক্ষ করতে করতে শেখরনাথ বললেন, তোরা যে নিরুপায় তা বুঝতে পারছি। তোদের ওপর যে হুকুম জারি করা হয়েছে সেটা তামিল করতে তোরা বাধ্য। কিন্তু আমি গভর্নমেন্টের চাকর নই। আন্দামান-নিকোবরের হর্তাকর্তা বিধাতা হলেন চিফ কমিশনার। আমি দু-একদিনের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করে বলব, জেফ্রি পয়েন্টের উত্তর দিকের জঙ্গল কাটা বন্ধ করা হোক।
বিশ্বজিৎ তাঁর বিপ্লবী কাকাটিকে খুব ভালোই চেনেন। ভীষণ একরোখা। প্রচণ্ড জেদি। কোনও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেন না। যা সংগত মনে করেন সেটাই করবেন। একবার যখন গো ধরেছেন চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করবেন, তাকে কোনওভাবেই ঠেকানো যাবে না। চিফ কমিশনার ওঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করেন কিন্তু তাঁর কথা কতটা মানবেন, বিশ্বজিৎ সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। বরং যথেষ্ট সন্দিহান। কেননা একবার সরকারি স্তরে অনেক বিচার-বিবেচনা আর ভাবনা-চিন্তার পর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা মুশকিল। বিশ্বজিৎ বললেন, আপনার যখন মনে হয়েছে, দেখা করুন।
এবার শেখরনাথ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তোর সঙ্গে আরেকটা খুব জরুরি কথা আছে।
উৎসুক চোখে তাকালেন বিশ্বজিৎ।
জেফ্রি পয়েন্টের উদ্বাস্তু সৃষ্টিধরের বউয়ের বাচ্চা হওয়ার উদ্বেগজনক ঘটনাটার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে শেখরনাথ বললেন, আমি ওখানে ছিলাম তাই সমস্যাটার মোটামুটি সুরাহা হয়েছে। ডাক্তার নেই, ওষুধ-বিষুধ নেই, নার্স নেই। জেফ্রি পয়েন্ট থেকে তিনটে পাহাড় পেরিয়ে যে রিফিউজি সেটলমেন্ট বসানো হয়েছে সেখান থেকে একজন দাইকে নিয়ে এসে ব্যাপারটা সামাল দেওয়া গেছে। এভাবে তো চলতে পারে না। এতগুলো মানুষকে তোরা জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেছিস। তাদের অসুখ-বিসুখ আছে, অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে, বিষাক্ত কানখাজুরা যে কোনও সময় কামড়াতে পারে। এদের জন্যে ইমিডিয়েটলি ওখানে একটা হেন্থ সেন্টার খোলা দরকার। চবিশ ঘন্টার জন্যে ডাক্তার, কমপাউন্ডার থাকা চাই। নইলে রোগীদের চিকিৎসার জন্যে পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে পোর্টব্লেয়ারে আনতে হলে অনেকে রাস্তাতেই পরপারে চলে যাবে।
বিশ্বজিৎ বললেন, কাছাকাছি দু-তিনটে সেটলমেন্টের জন্যে একটা করে হেলথ সেন্টার খোলার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এখনও ফান্ডের ব্যবস্থা হয়নি।
তামাশা নাকি! এতগুলো মানুষকে ঘোর জঙ্গলে এনে ফেলে। দিলাম। তারপর মরলে মর, বাঁচলে বাঁচো। এতগুলো মানুষের লাইফ নিয়ে ছেলেখেলা! গনগনে মুখে বললেন শেখরনাথ।
একেবারে কাচুমাচু হয়ে গেলেন বিশ্বজিৎ। কাকা, আপনি ভাববেন না, খুব তাড়াতাড়িই সব হয়ে যাবে।
দেখা যাক। শেখরনাথ বলতে লাগলেন, সারা ভারতবর্ষ আজ যে স্বাধীনতার সুখ-ভোগ করছে তা এই মানুষগুলোর চরম স্যাক্রিফাইসের জন্যে। এটা সব সময় মনে রাখিস। ওয়েস্ট বেঙ্গলে, ত্রিপুরায়, আসামে বা অন্য কোথায় রিফিউজিদের জন্যে কী করা হচ্ছে, আমার পক্ষে নিজের চোখে তা দেখা সম্ভব নয়। শুনছি সর্বস্ব খুইয়ে যে লোকগুলো এপারে চলে এসেছে ওই সব জায়গায় তাদের হাল খুব শোচনীয়। সে যাক, আন্দামানে এদের জন্যে দায়সারা কিছু করে হাত ধুয়ে ফেললে আমি কিন্তু ছাড়ব না। তোমাদের চিফ কমিশনারকে জানিয়ে দিও, এই পোর্টব্লেয়ার শহরে তার অফিসের সামনে মুভমেন্ট শুরু করে দেব।
বিশ্বজিৎ চমকে উঠলেন। না না কাকা, মুভমেন্টের কথা একদম ভাববেন না। তাতে আন্দামান সেটলমেন্টের ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। এই দ্বীপে রিফিউজিরা আসতেই চাইবে না। একটু থেমে বললেন, এত বড় রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ এই দ্বীপে কেন, সারা দেশেই আগে কখনও হয়নি। শুরুতে অনেক ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। আমরা সব ঠিক করে নেব।
শেখরনাথ একটু নরম হলেন। দেখা যাক। তারপর জিগ্যেস। করলেন, চিফ কমিশনারের বাংলোয় রিফিউজিদের নিয়ে কী মিটিং হল তোদের?
আপনি তো আগেই শুনেছেন, মাস দেড়েকের ভেতর আরও আড়াইশো ভি পি ফ্যামিলিকে আন্দামানে নিয়ে আসা। হবে। তাদের বেশির ভাগকেই পাঠানো হবে মিডল আন্দামানে। একশোর মতো ফ্যামিলিকে নিয়ে যাওয়া হবে জেফ্রি পয়েন্টে। বিশ্বজিৎ জানাতে লাগলেন, এতগুলো পরিবারকে সাত একর করে দিতে হলে সাড়ে সতেরোশো একর জমি দরকার। মিডল আন্দামানে জঙ্গল কেটে সাতশো একরের মতো জমি বার করা হয়েছে। সেখানে আরও জমি দরকার। তাই জঙ্গল কাটা থেমে নেই। জেফ্রি পয়েন্টে যে জমি আছে তার ওপর অরণ্য নির্মূল করে আরও তিনশো সাড়ে তিনশো একর জমি চাই। মিটিংয়ে এইসব জমি সম্বন্ধে সবিস্তার জানতে চেয়েছেন চিফ কমিশনার। কীভাবে তা ডিস্ট্রিবিউট করা হবে তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।
শেখরনাথ কোনও প্রশ্ন করলেন না।
বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, তবে একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার আছে কাকা।
কী?
স্বাধীনতার পর আন্দামানে রিহ্যাবিলিটেশন প্রোজেক্ট শুধুমাত্র বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু যে উদ্বাস্তুরা কলকাতা থেকে আসতে চাইবে না তাদের জন্যে ঠিক করে রাখা জমি অনন্তকাল ফেলে রাখা হবে না। কিছুদিন। অপেক্ষা করে সে সব মোপলাদের দেওয়ার কথা ভাবা হবে। আসল ব্যাপারটা অন্য জায়গায়।
কীরকম।
পশ্চিমবাংলার বাইরে এটা সেকেন্ড বেঙ্গল হয়ে উঠুক চিফ কমিশনর খুব সম্ভব তা চান না।
চকিতে সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। রস আইল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে এবারডিন মার্কেটের সামনের মাঠে চলে এসেছিল বিভাস আর নিরঞ্জন। সঙ্গে ছিল বিনয় আর বিশ্বজিৎও। সেখানে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে চিফ কমিশনারকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তিনি তাদের আন্দামানে স্বাগত জানিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন। তার মুখ থেকে অবিরল। মধু ঝরে পড়ছিল। শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল বিনয়। মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধাও হয়েছিল খুব। পরে এই নিয়ে যখন বিশ্বজিতের সঙ্গে কথা হয়, রহস্যময় হেসে তিনি বলেছেন, লোকটার দুটো মুখ। আজ বোঝা গেল একটা মুখ দিয়ে তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য অপার সহানুভূতি ঢেলে দেন। কিন্তু আড়ালে যে। মুখটা রয়েছে সেটা ভীষণ চতুর। ফন্দিবাজ। উদ্বাস্তুরা হাজারে হাজারে এলে এই বিশাল দ্বীপপুঞ্জ বাঙালিদের দখলে চলে যাবে। সেটা তার কাম্য নয়। এই দ্বিতীয় মুখটা সম্পর্কে সেদিন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ।
এদিকে রীতিমতো চিন্তিত দেখাল শেখরনাথকে। বললেন, এটা ভীষণ দুর্ভাবনার কথা। মোপলাদের সম্বন্ধে আমার কোনওরকম বিদ্বেষ নেই। কিন্তু প্রায়োরিটি অবশ্যই বাঙালি উদ্বাস্তুদের রিহ্যাবিলিটেশন। ওয়েস্ট বেঙ্গল তো উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ বা বম্বে প্রেসিডেন্সির মতো বিশাল স্টেট নয়। এত উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন দেওয়ার মতো জমি-জায়গা সেখানে কোথায়? আন্দামান হাতছাড়া হয়ে গেলে মহা সর্বনাশ।
বিশ্বজিৎ উত্তর দিলেন না।
বিপ্লবী কাকা এবং আন্দামানের বড় অফিসার তার ভাইপোর কথা নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। প্রচুর অর্থ ঢেলে অরণ্য নির্মূল করে যে জমি পাওয়া যাচ্ছে, উদ্বাস্তুরা না এলে তার একটা ব্যবস্থা যে করা হবে এমন জনরব কিছুদিন ধরে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেভাবে কান দেয়নি বিনয়। কিন্তু স্বয়ং চিফ কমিশনার আজ যখন মোপলাদের কথা বিশ্বজিৎকে বলেছেন, তাতে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে বিনয়। চিফ কমিশনার হলেন। আন্দামান-নিকোবরের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তিনি যদি মনে করেন, ফাঁকা জায়গায় মোপলাদের বসাবেন, কেন্দ্রীয়। সরকার তার প্রস্তাব উড়িয় দেবে না; যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শুনবে।
শেখরনাথের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা-ক্ষোভ-অসন্তোষ ফুটে উঠছিল। তিনি থামেননি। আমি তো দু-চারদিনের মধ্যে চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তাকে জাবোয়াদের কথা তো বলবই, মোপলাদের প্রসঙ্গও তুলব। বলব, এখানকার তিনটে বড় দ্বীপ সাউথ, নর্থ আর মিডল আন্দামানে শুধু বাঙালি রিফিউজিদের রিহ্যাবিলেটেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই প্রোজেক্টে কিছুতেই অন্য কারুকে বসানো চলবে না। আন্দামানে আরও দুশোরও বেশি দ্বীপ আছে। তার কয়েকটায় সুইট ওয়াটার পাওয়া যায়, জমিও ফার্টাইল। গভর্নমেন্ট ইচ্ছা করলে মোপলাদের সেসব জায়গায় নিয়ে বসাক।
শুনতে শুনতে আঁতকে উঠলেন বিশ্বজিৎ। না না কাকা, চিফ কমিশনারকে মোপলাদের কথা একেবারেই বলবেন না। এ বাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। চিফ কমিশনার তার মনোভাব জানিয়েছেন শুধু। যদি তাকে এসব বলতে যান। ডেফিনিটলি ভাববেন আমিই আপনাকে এসব বলেছি। একজন সাব-অর্ডিনেট অফিসার হিসেবে এটা মারাত্মক বিশ্বাসভঙ্গ। এরপর হয়তো আমাকে কোনও গোপন মিটিংয়ে ডাকবেন না। উদ্বাস্তুদের জন্যে স্বাধীনভাবে যে কাজটুকু করতে পারছি তাও করতে দেবেন না; আমার ক্ষমতা ছেটে পেটোয়া অন্য কারুকে। দায়িত্ব দিয়ে দেবেন। রিফিউজিদের সম্পর্কে তার কতটা সহানুভূতি থাকবে কে জানে। এই প্রোজেক্ট তো লোহালক্কড়, মেশিন-টেশিন নিয়ে নয়। এর র মেটিরিয়াল হল উৎখাত হয়ে আসা, বিপন্ন মানুষ। জীবনে তাদের দাঁড় করিয়ে দিতে হলে ভালোবাসা, সহানুভূতি দরকার।
বিশ্বজিতের কথাগুলো যুক্তিসংগত মনে হল শেখরনাথের। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, ঠিক আছে, মোপলাদের কথা তুলব না।
হঠাৎ বিনয় বলে উঠল, কাকা, আমার কিছু বলার আছে।
শেখরনাথ তার দিকে ঘুরে বসলেন। –বেশ তো। বল—
এখানকার সেটলমেন্টের ব্যাপারে অন্য দিকেও কিন্তু ভীষণ প্রবলেম রয়েছে।
কীরকম?
কলকাতায় সরকার বিরোধী পার্টিগুলো উদ্বাস্তুদের নিয়ে, আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমেছে। রোজই সেখানে গোলমাল হচ্ছে। পুলিশের লাঠি, গুলি-টুলিও চলছে।
হ্যাঁ, জানি। শেখরনাথ বললেন, মেনল্যান্ড থেকে কাগজগুলো আসে, তার মধ্যে তোমাদের নতুন ভারতও আছে, সেগুলোতে এসব খবর থাকে। আত্মঘাতী মুভমেন্ট। এই হঠকারী পলিটিকসের দাম কিন্তু একদিন দিতে হবে।
এরপর কেউ আর কিছু বলল না। ড্রইংরুমের আবহাওয়া কেমন এক নৈরাশ্য এবং উৎকণ্ঠায় ভরে যেতে লাগল।
৩.০৩ উপসাগরের মুখোমুখি
এখন অনেক রাত।
ভুবনরা ঘণ্টা দুয়েক আগে মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে খাইয়ে দিয়েছিল। তারা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিনয়, শেখরনাথ এবং বিশ্বজিতেরও স্নান-খাওয়া হয়ে গেছে।
এই বাংলোয় উপসাগরের মুখোমুখি পরপর তিনটে বেডরুম৷ একেবারে পশ্চিম দিকের ঘরটায় সেদিন রাত কাটিয়ে গিয়েছিল বিনয়। আজও সেখানেই তার জন্য বিছানা করে দেওয়া হয়েছে। ওটা এই বাংলোর গেস্ট রুম। ঠিক হয়েছে বিনয় যখনই পোর্ট ব্লেয়ারে আসবে এখানেই থাকবে। তার পাশের ঘরটা শেখরনাথের আর পুব দিকের শেষ ঘরটা বিশ্বজিতের।
বিনয় তার ঘরে চলে এসেছিল। দুই দেওয়ালে জোরালো আলো জ্বলছে। তেজি আলোয় ভরে আছে ঘরটা।
গোপালের কাজে খুঁত নেই। খাটের পাশে জগ ভর্তি জল এবং কাচের ঝকঝকে গেলাস রেখেছে। তাছাড়া এলাচ-লবঙ্গ ভর্তি একটা ছোট কৌটোও। এখন মশারি খাটিয়ে বিছানার চারপাশে পরিপাটি করে গুঁজে দিচ্ছে।
শিয়রের দিকে খোলা জোড়া জানলা। তার পাশে পড়াশোনার জন্য ছোট টেবিল এবং চেয়ার। বিনয় চেয়ারে বসে তড়িৎ গতিতে গোপালের হাত চালানো দেখছিল। সেই সকালের দিকে জেফ্রি পয়েন্ট থেকে মোহনবাঁশিকে ট্রাকে চাপিয়ে তারা চলে এসেছে। সারাদিন শরীরের ওপর প্রচণ্ড ধকল গেছে। স্নানের পর পেটে ভাত পড়তেই অসীম ক্লান্তিতে দুচোখ জুড়ে আসছিল। গোপাল তার কাজ শেষ করা মাত্র সে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়বে।
বিশ্বজিৎ ঘরে এসে ঢুকলেন। তার হাতে পুরু ব্রাউন কাগজের একটা প্যাকেট। একটু অবাক হয়েই উঠে দাঁড়াল বিনয়। খানিক আগেই খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে তিনি শুতে চলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ কী এমন হল যে এ সময় তাকে আসতে হয়েছে!
বিশ্বজিৎ বললেন, নানা কথায় একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে কাল আপনার কয়েকটা চিঠি এসেছে। এর ভেতর সব রেখে দিয়েছি। ভেবেছিলাম জেফ্রি পয়েন্টে পাঠিয়ে দেব। ভালোই হল আপনি পোর্টব্লেয়ারে চলে এসেছেন। এই নিন। প্যাকেটটা বিনয়ের হাতে দিলেন।
গোপালের মশারি গোঁজা হয়ে গিয়েছিল। সে চলে গেল। বিশ্বজিৎ কিন্তু গেলেন না। ঘরে বাড়তি একটা চেয়ার রয়েছে সেটা টেনে এনে বসতে বসতে বললেন, কী হল, দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। আপনার সঙ্গে জরুরি একটা কথা আছে। আর্জিও বলতে পারেন।
বিনয়ের বিস্ময় বাড়ছিলই। এতক্ষণ ড্রইংরুমে বসে কত আলোচনা হয়েছে। একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে তারা খেয়েছে। তখনও কিছু কথাবার্তা যে হয়নি তা নয়। তারপরও বিশ্বজিতের কী এমন কথা থাকতে পারে, সে ভেবে পেল না। তাছাড়া আর্জি শব্দ কেমন ধন্দের মতো মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে বসে পড়ল বিনয়। কোনও প্রশ্ন করল না।
বিশ্বজিৎ বললেন, মোহনবাঁশি কর্মকারের ব্যাপারটা খুবই আনফরচুনেট ঘটনা। আপনি নিজে তার প্রত্যক্ষদর্শী। আমার বিশেষ অনুরোধ এই নিয়ে কোনও রিপোর্ট কলকাতায় পাঠাবেন না। বিনয় চমকে উঠল। –এ কী বলছেন! আমি একজন সাংবাদিক। এখানে যা ঘটছে, নিজের চোখে যা যা দেখছি তা লেখার জন্যেই তো আমাকে আন্দামানে পাঠানো হয়েছে। সঠিক তথ্য পাঠকের কাছে তুলে না ধরাটা তো অন্যায়। ডিসঅনেষ্টি।
বিশ্বজিৎ প্রায় অনুনয়ের সুরে বললেন, আপনি যা বললেন তা হান্ড্রেড পারসেন্ট ট্র। কিন্তু বেঙ্গল, বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের স্বার্থে দয়া করে এই ইনসিডেন্টটার কথা লিখবেন না। তিনি বোঝাতে লাগলেন, কলকাতায় উদ্বাস্তুদের নিয়ে মারমুখি আন্দোলন চলছে, এই রিপোর্টটা বেরুলে পার্টিগুলো মারাত্মক একটা অস্ত্র হাতে পেয়ে যাবে। রিফিউজিরাও ভীষণ ভয় পাবে। আন্দামানের জাহাজে তাদের তোলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এদিকে জঙ্গলের ফাঁকা জমিগুলোতে মোপলাদের বসানোর ভাবনাচিন্তা চলছে। সেটা বিপজ্জনক ব্যাপার।
কত ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন এই দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। পুরোদমে বিশাল কর্মকাণ্ড চলছে। উদ্বাস্তুরা না তাদের নতুন করে বাঁচার সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করে ফেলে। একটা ঘটনা যদিও সেটা খুবই মর্মান্তিক গোপন করলে যদি হাজার হাজার মানুষের কল্যাণ হয় সেটা বিরাট ব্যাপার। আন্দামান নামে এই জিয়নকাঠিটি কখনওই ছাড়া ঠিক হবে না।
বিশ্বজিৎ আরও বললেন, জেফ্রি পয়েন্টে জারোয়ারা আর যাতে হামলা চালাতে না পারে সে জন্য সিকিউরিটি বন্দোবস্ত আরও জোরদার করা হবে। তাছাড়া আরও কিছু কিছু ব্যবস্থার কথাও ভাবা হবে।
শুনতে শুনতে অভিভূত হয়ে পড়েছিল বিনয়। বিশ্বজিৎকে যত দেখছে তার শ্রদ্ধা যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। এই মানুষটির লেশ মাত্র স্বার্থ নেই। তিনি অজস্র টাকা মাইনে পান, প্রচুর পার্কস, সেই সঙ্গে বিপুল ক্ষমতা। রিফিউজিরা যদি না আসে, ফাঁকা জমিতে যদি মোপলাদের বসিয়ে দেওয়া হয় তাতে তার এতটুকু ক্ষতি হবে না। বরং যেভাবে পুনর্বাসনের কাজে জঙ্গলে জঙ্গলে ছোটাছুটি করেন, যেভাবে দিন রাত পরিশ্রম করেন তার কিছুই করতে হবে না। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ফুরফুরে হালকা মেজাজে তিনি বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন। অথচ উদ্বাস্তুদের জন্য তার কী অফুরান মমতা, তার জন্য তিনি কত ভাবেন। নিঃস্বার্থ এই মানুষটি বহুজন হিতে নিজের সমস্ত অস্তিত্ব সঁপে দিয়েছেন।
বিনয় কয়েক লহমা তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গাঢ় গলায় বলল, ঠিক আছে, মোহনবাঁশির কথা লিখব না।
বিশ্বজিৎ উঠে পড়লেন। কৃতজ্ঞ সুরে বললেন, অনেক ধন্যবাদ। আমি চলি। আপনি শুয়ে পড়ুন।
তিনি চলে যাবার পরও বসে রইল বিনয়। এখন চারিদিক নিঝুম। শুধু সিসোস্ট্রেস বের ঢেউগুলো অবিরল ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাড়ের পাথরের চাইগুলোর ওপর। দূর সমুদ্র থেকে ঝেড়ো হাওয়া উঠে এসে পোর্টব্লেয়ারের সবগুলো বিশাল বিশাল গাছের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে চলেছে। ঢেউ আর বাতাসের আওয়াজ ছাড়া কোথাও অন্য কোনও শব্দ নেই।
এক সময় উঠে পড়তে যাচ্ছিল বিনয়। তখনই খেয়াল হল হাতের ভেতর চিঠির প্যাকেটটা ধরা রয়েছে। না, এখন আর শোওয়া হবে না। প্যাকেটটা টেবিলে রেখে চিঠিগুলো বার করল সে৷ গুনে দেখল মোট চারটে সবই খামের চিঠি।
প্ৰথম খামটা খুলতেই নতুন ভারত-এর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ির চিঠি বেরিয়ে পড়ল। তাঁর চিঠিতে ফেনানো ব্যাপার থাকে না। কাজের কথাগুলো গুছিয়ে সংক্ষেপে লিখে পাঠান।
প্রসাদদা আগের চিঠির মতোই এবারও লিখেছেন বিনয়ের রিপোর্টগুলো পাঠকদের মধ্যে তুমুল সাড়া জাগিয়েছে। তবে লেখার সঙ্গে আন্দামানের রিফিউজি সেটলমেন্ট, সেখানকার মানুষজন, এবং অন্যান্য বাসিন্দা, বিশেষ করে পেনাল কলোনির লোকজন, সেলুলার জেল, রস আইল্যান্ড ইত্যাদি এলাকায় যারা থাকে তাদের ফোটো থাকাটা ভীষণ জরুরি। তাছাড়া আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া, ওঙ্গে এবং গ্রেট আন্দামানিজদের ছবি যেভবে হোক জোগাড় করে পাঠাতে হবে। মনে রাখা দরকার খবরের কাগজে চার কলম একটা প্রতিবেদনের চাইতে প্রাসঙ্গিক একটা ভালো ফোটো পাঠকের কাছে বিরাট ছাপ রাখে। রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দেয়। আপাতত আন্দামান থেকেই একটা ক্যামেরা জোগাড় করে কাজ চালিয়ে নিক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অফিস থেকে ক্যামেরা পাঠানো হচ্ছে।
প্রসাদদা লিখেছেন, আগের চিঠিতে তিনি যা জানিয়েছিলেন, কলকাতার অবস্থা এখন তার চেয়ে অনেক বেশি অগ্নিগর্ভ। হাজরা.পার্ক, শ্ৰদ্ধানন্দ পার্ক, দেশবন্ধু বা দেশপ্রিয় পার্ক– সর্বত্র রোজ উদ্বাস্তুদের নিয়ে মিটিং চলছে। তার ওপর রয়েছে মিছিল। মহানগরের উত্তর বা দক্ষিণ কিংবা পুব, যেদিকেই যাওয়া যাক বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিল শুরু হয়ে যায়। মিছিলে মিছিলে যান চলাচল ঘণ্টার পর ঘণ্টা থমকে যায়। শহরের নাভিশ্বাস উঠতে থাকে।
এদিকে জবরদখল কলোনিগুলো থেকে উদ্বাস্তুদের তুলে দেবার জন্য জমি মালিকদের চাপে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উচ্ছেদ বিল আনতে চলেছে। বিরোধী দলগুলো কিছুতেই বিল পাশ করতে দেবে না। ফলে বিরাট সংঘাত অনিবার্য।
সীমান্তের ওপার থেকে উদ্বাস্তুরা যেমন আসছিল তেমনই আসছে। যে সব ছিন্নমূল মানুষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসামে গিয়েছিল উৎখাত হয়ে তারাও আসছে। তাদের আসাটা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
শুধু উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলনই নয়, ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টও দ্রুত বিরাট আকার নিচ্ছে। কলকাতার চারপাশে যত কলকারখানা, বিশেষ করে জুট মিল আর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটগুলোর কোনও না কোনওটায় রোজই প্রায় ডাকা হচ্ছে স্ট্রাইক, মালিকপক্ষ ঝুলিয়ে দিচ্ছে লক-আউটের নোটিস। উদ্বাস্তুদের মতো কারখানার শ্রমিকদেরও নিয়ে বেরুচ্ছে মিছিল। জওহরলাল নেহরু বলেছেন, কলকাতা এখন মিছিল নগরী– সিটি অব প্রশেসনস।
কলকাতার পরিস্থিতি জানানো হল। বিনয় যেন যত শিগগির পারে চার পাঁচটা প্রতিবেদন একসঙ্গে পাঠিয়ে দেয়।
প্রসাদদার আগের চিঠির বয়ান প্রায় একইরকম ছিল। তবে উদ্বাস্তুদের আন্দোলনটা আরও ঘোরালো হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট।
অন্যমনস্কর মতো চিঠিটা ভাঁজ করে খামে পুরতে পুরতে বিনয় আন্দাজ করতে চেষ্টা করল কলকাতা যেন একটা আগ্নেয়গিরির মাথায় বসে আছে।
এবার দুনম্বর চিঠি। সেটা সুনীতির। মাত্র কয়েকটা লাইন। তার মধ্যে নিজের যাবতীয় ক্ষোভ এবং অভিমান ঢেলে দিয়েছে। কারণও আছে। আন্দামানে আসার পর অনেককেই চিঠি লিখেছে, বিনয়। আনন্দকে লিখেছে বলে সুনীতিকে লেখার কথা ভাবেনি।
সুনীতি লিখেছে অতি অবশ্য বিনয় যেন তার চিঠির জবাব দেয়। বিনয়ের জন্যে সারাক্ষণ সে চিন্তায় থাকে। অথচ তার কথা ভাইয়ের মনে পড়ে না। এরপর লিখেছে— হেমনলিনী, আনন্দ, তার দেওর এবং জা দীপক আর মাধুরী সবাই ভালো আছে। পারিবারিক নানা ব্যস্ততার কারণে সুধাদের বাড়ি এর মধ্যে যাওয়া হয়নি। তবে সামনের রবিবারের পরের রবিবার সে আর আনন্দ অবশ্যই যাবে। সারাটা দিন তাদের সঙ্গে কাটিয়ে আসবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনেকের কথাই লিখেছে সুনীতি কিন্তু ঝুমা সম্পর্কে একেবারেই নীরব। ঝুমা নামে কোনও তরুণীকে সে চেনে বলেই মনে হয় না।
চিঠিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে বিনয়। আটশো মাইল দূরে বসে ঝুমা সম্পর্কে তার নতুন মনোভাবটা কি আঁচ করে ফেলেছে সুনীতিরা? বোঝা গেল না।
এক সময় তিন নম্বর খামটা খুলল বিনয়। সুধার চিঠি। খুদি খুদি অক্ষরে পাক্কা তিনটি পাতা বোঝাই। এর কমে সে চিঠি লিখতে পারে না।
বিনয় যে তার আগের চিঠির জবাব দিয়েছিল সেটা পেয়ে সুধা ভীষণ খুশি। তার আবদার, বিনয়ের যত কাজই থাক, সে যেন অবশ্যই, অবশ্যই সময় করে নিয়মিত তাকে চিঠি লেখে। সে তাদের একমাত্র ভাই। কলকাতায় তাদের নতুন বাড়িতে না থাকায় কত দুঃখ যে পেয়েছিল সুধা। এই কষ্ট তার ইহ জীবনে ঘুচবে না।
বিনয় উঠল গিয়ে কিনা একটা নোংরা বারোয়ারি মেসে। সেখানে রাজ্যের মানুষ, সারাক্ষণ হইচই, হট্টগোল৷ এই সব জায়গায় খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কোনওভাবেই মনের মতো হতে পারে না। আধো-অন্ধকার চাটাইয়ের ময়লা আসনে বসে কী যে খায় বিনয়! তবু একটু সান্ত্বনা, ইচ্ছা করলে যখন তখন শান্তিনিবাস মেসে গিয়ে তাকে দেখে আসা যায়। বিনয়ও আসতে পারে তাদের কাছে। ট্রামে বা বাসে বড়জোর মিনিট কুড়ি পঁচিশেকের ব্যাপার। কিন্তু কালাপানি পাড়ি দিয়ে আন্দামানের কোন ভয়ংকর বিজন অরণ্যে গিয়ে বসে আছে বিনয়। আতঙ্কে সারাক্ষণ সুধার বুক কাপে।
সুধার আরও একটা দুর্ভাবনার কারণ হেমনাথ। তিনিও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে-বহুদূরে। অন্য কোনও গ্রহে। নিত্য দাস-এর মধ্যে তাদের বাড়ি আসেনি, দাদুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। কাগজে রোজই খবর থাকে পূর্ব পাকিস্তানের হাল ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছে। হেমনাথের জন্য ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। সুধা।
সে আরও জানিয়েছে, এর মধ্যে তার দাদাশ্বশুর দ্বারিক দত্তকে নিয়ে কম ভোগান্তি যায়নি। হঠাৎই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। এই বয়সে টাইফয়েড। স্পেশালিস্ট ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। রাত জেগে হিরণ, সুধা আর উমাকে শুশ্রূষা করতে হয়েছে। প্রাণের আশা প্রায় ছিলই না। নেহাত আয়ুর জোরে দ্বারিক দত্ত এ যাত্রা সামলে উঠেছেন। একটা মারাত্মক ফঁড়া কেটে যাওয়ায় আপাতত স্বস্তি। সুধার জেঠিশাশুড়ি সরস্বতী যিনি বারো মাস কোনও না কোনও রোগে ভোগেন– ঈশ্বরের করুণায় ভালো আছেন।
এবার যুগলের কথা। সে এখন মুকুন্দপুর কলোনিরই নয়, ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটা জবরদখল কলোনিরও ছোটখাট নেতা। বিরোধী পার্টিগুলোর ডাকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে এসে সে কলকাতায় মিছিল করে। ক্রমশ সে রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। কলকাতায় এলে সে সুধাদের বাড়ি আসবেই। যুগল জানায় একবার তারা উদ্বাস্তু হয়ে এ দেশে এসেছে। সরকার যদি জোর করে উচ্ছেদ আইন পাশ করায়ও, জান গেলেও তারা কলোনির দখল ছাড়বে না। কোনওভাবেই দ্বিতীয়বার তারা বাস্তুহারা হবে না।
এসবের মধ্যে একটা সুখবরও দিয়েছে সুধা। অফিসে হিরণের একটা ভালো প্রোমোশনও হয়েছে। মাইনে বেড়ে গেছে। অনেকটাই।
সবশেষে একটা কথা জানতে চেয়েছে সুধা। বিনয় তার প্রথম চিঠিতে লিখেছিল আন্দামানে আসার পর তার জীবনে একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। সেটা এমনই যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ঘটনাটা কী, তা জানায়নি। শুধু লিখেছিল কলকাতায় ফিরে সে সবাইকে হতবাক করে দেবে।
সুধা লিখেছে, কবে বিনয় ফিরবে সে জন্য ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারবে না। হেঁয়ালি না করে বিনয় যেন সব খুলে বিশদভাবে জানায়। তাদের বাড়ির সবাই সে জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।
পড়া শেষ করল বিনয়। তার চিঠিতে ঝিনুক সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিল সে। কিন্তু না, ঝিনুকের কথা এখন কিছুতেই সুধাকে জানানো যাবে না।
বিনয় ভেবেছিল, ঝিনুককে কলকাতায় নিয়ে গেলে একটা চমক লাগানো যাবে। কিন্তু আজ সেলুলার জেলের সামনের ঢালু রাস্তায় ঝিনুক তার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছে, যে ধরনের আচরণ করেছে, চিনেও না-চেনার ভান করেছে তাতে দমে গিয়েছিল সে। তার বিশ্বাস ছিল, একবার তারা মুখোমুখি দাঁড়ালে ঝিনুকের সব অভিমান, সব দুঃখ ঘুচে যাবে। সেই কোন কিশোর বয়স থেকে এই মেয়েটির সঙ্গে পাশাপাশি বড় হতে হতে তার ওপর বিপুল অধিকার জন্মে গিয়েছিল। অন্তত তেমনটাই তার ধারণা। কিন্তু এতকালের সম্পর্কটা আজ একরকম অস্বীকারই করেছে ঝিনুক
মনে মনে একটা ধাক্কা খেলেও বিনয় কিন্তু আশা ছাড়েনি। তার সংকল্প আরও দৃঢ় হয়েছে৷ রস আইল্যান্ডে ঝিনুককে দেখার পর থেকেই সে স্থির করে রেখেছে মধ্য আন্দামানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করবে। জেফ্রি পয়েন্টে বর্মী–শেল কালেক্টর লা পোয়ের সঙ্গে তার কথাও হয়ে গেছে। বিনয় তাদের মোটরবোট সি-গাল-এ চেপে মিডল আন্দামানে চলে যাবে। লা পোয়ে সেখানকার সবকটা রিফিউজি সেটলমেন্ট চেনে। একবার। পৌঁছুতে পারলে লা পোয়ে ঠিক খুঁজে খুঁজে ঝিনুককে বার করে ফেলবে। বিনয় বলবে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়ি থেকে। নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে একবারও তার কথা মনে পড়ল না ঝিনুকের? আত্মীয়-পরিজন, বিশেষ করে অবনীমোহন তার সঙ্গে যে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন, তার জন্য বিনয় কি দায়ী? সে যে কত কষ্ট পেয়েছে তা কি একবারও ভাবল না ঝিনুক?
ঝিনুককে বোঝাবে ঠিকই কিন্তু ঝিনুক কি শেষ পর্যন্ত কলকাতায় যেতে আদৌ রাজি হবে? যে বিশ্বাসের জোরে বিনয় তাকে নিয়ে যাবার কথা ভেবেছে তার ভিতটা যেন অনেকখানি ধসে পড়েছে। অদ্ভুত এক সংশয়ে তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে যেতে থাকে।
এর মধ্যেই চার নম্বর অর্থাৎ শেষ খামটা হাতে তুলে নিতেই বিনয়ের সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল৷ শিহরন না বলে বিদ্যুৎপ্রবাহ বলা যেতে পারে। খামের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম লেখা। হাতের লেখাটা তার চেনা– ঝুমা।
এর আগেও ঝুমা চিঠি লিখেছে। কিন্তু রস আইল্যান্ডে ঝিনুককে দেখার পর সে চিঠির উত্তর দেয়নি বিনয়।
আশ্চর্য, আজও ঝিনুকের সঙ্গে সেলুলার জেলের সামনে দেখা হয়েছে। আর আজই কিনা ঝুমারও চিঠি এল। এই দুই নারী অদৃশ্য কোনও সুতোয় তার জীবনে বাঁধা রয়েছে। অন্ততকাল ধরে। সেই গিট যেন ছেঁড়া যায় না। কখনও ঝিনুক সামনে এসে দাঁড়ায়, কখনও ঝুমা। আচ্ছন্নের মতো, খানিকটা নিজের অজান্তেই যেন খাম খুলে চিঠিটা বার করল বিনয়। খুব ছোট্ট চিঠি। সামান্য কয়েকটি লাইন।
একটা মেয়ে প্রাণভরে তোমাকে ভালোবেসেছে। সে সারাদিন তোমার চিঠির আশায় অপেক্ষা করে থাকে। এই মহানগরে কত মানুষ তোমার চিঠি পায়। শুধু সেই মেয়েটা বাদ। তার অপরাধ কী?
লাইনগুলোর মাথায় কোনও সম্বোধন নেই, নিচে কারুর নামও না।
ঝুমার অভিমান, ঝুমার মানসিক যাতনা এর মধ্যেই তীব্র ব্যাকুলতা নিয়ে ফুটে উঠেছে। কদিন আগেই এই মেয়েটাকে নিজের জীবন থেকে খারিজ করে দেবার কথা ভেবেছিল বিনয়। কিন্তু ঝিনুকের মতো সেও যেন শতপাকে তাকে জড়িয়ে রেখেছে। সরিয়ে দিতে গেলেও বুঝি বা তাকে সরানো যায় না। ঝিনুক আর ঝুমা, এই দুই নারী যেন তার অনিবার্য নিয়তি।
চিঠিটা ফের খামের ভেতর পুরে উঠে পড়ল বিনয়। সোজা গিয়ে দাঁড়াল খোলা জানলার পাশে।
সেই সন্ধে থেকে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। এখন তা অনেক গাঢ় হয়েছে। কুয়াশার স্তর ভেদ করে ক্ষীণ চাঁদের যে আলোটুকু চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমে আসছে তাতে চরাচরের কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়। দূরের দ্বীপগুলো একেবারে ঝাপসা। মাউন্ট হ্যারিয়েটের যে সাদা ক্রসটা আকাশের দিকে মাথা তুলে থাকে। সেটাও দেখা যাচ্ছে না। শুধু আগের মতোই ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ আর তুমুল ঝোড়ো হাওয়া। বিনয় টের পেল তার বুকের ভেতর তেমনই কিছু চলছে। অবিরল।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। বিমূঢ়। বুদ্ধিভ্রষ্ট। তারপর কখন এসে শুয়ে পড়ল নিজেরই খেয়াল নেই।
.
পরদিন কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল বিনয়ের। এক টানা নয়, থেমে থেমে আর্ত, করুণ সুরে কেউ কেঁদে চলেছে।
৩.০৪ চোখে ঘুমের ঘোর
চোখে ঘুমের ঘোর লেগে আছে। বিনয় প্রথমটা বুঝতে পারল না কান্নার আওয়াজটা কোত্থেকে আসছে। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। একটু খেয়াল করতেই সবটা স্পষ্ট হয়ে এল। এই বাংলোতেই কেউ কাঁদছে। কোনও বয়স্ক মেয়েমানুষ।
কাল রাতে সেলুলার জেলের হাসপাতাল থেকে মোহনবাঁশির স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা হয়েছিল। নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর কান্না। এই সকালবেলায় কী এমন ঘটতে পারে যে সে কেঁদে চলেছে।
বিছানা থেকে বাইরে নেমে এল বিনয়। ভেতর দিকের দরজা খোলা রয়েছে। সেটা পেরিয়ে বিশাল ড্রইং-কাম-ডাইনিং হল-এ আসতেই দেখা গেল মেঝের একধারে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে চলেছে মোহনবাশির বউ। তার গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে ছেলে-মেয়েরা। তারা অবশ্য কাঁদছে না। কেমন যেন জড়সড়, ভয়াতুর।
ওদিকে বিশ্বজিৎ এবং শেখরনাথও তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ভুবন কার্তিক আর গোপালকেও দেখা যাচ্ছে।
বিনয় বিশ্বজিতের কাছে চলে এল। কৌতূহলের চেয়ে উৎকণ্ঠাই হচ্ছে তার বেশি। নিচু গলায় জিগ্যেস করল, কী হয়েছে, মহিলা এত কাঁদছে কেন? হাসপাতাল থেকে কোনও খারাপ খবর এসেছে?
বিশ্বজিৎ মাথা নাড়লেন।–না তো
তাহলে?
কী জানি–।
বিশ্বজিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই শেখরনাথ মোহনবাঁশির স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন। জানতে চাইলেন। কী হল তোমার? কেঁদো না, কেঁদো না।
কাঁপা কাঁপা হাতে মুখ থেকে শাড়ির আঁচল সরাল মোহনবাঁশির বউ। চোখ দুটো ফোলা ফোলা, লাল, জলে ভর্তি। বোঝা যায় অনেকক্ষণ কাঁদছে সে।
শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, কান্নার কী হল?
ধরা ধরা, ভারী গলায় মোহনবাঁশির বউ বলল, আমার মনে জবর কু-ডাক ডাকতে আছে। সারা রাইত কাইল ঘুম হয় নাই। হ্যায় (সেটা) কি অহনও বাইচা রইছে?
তেমন কিছু হলে হাসপাতাল থেকে তোক চলে আসত। চিন্তা কোরো না। নরম, সহানুভূতির সুরে বললেন শেখরনাথ।
ব্যাকুলভাবে মোহনবাঁশির বউ বলল, আমাগো হাসপাতলে লইয়া চলেন
কিছুক্ষণ পরেই যাব। তোমরা চানটান করে খেয়ে নাও। আজ সারাদিন হাসপাতালেই থাকতে হবে।
.
ঘণ্টাখানেক বাদে মোহনবাঁশির বউছেলেমেয়ে এবং বিনয়কে নিয়ে একটা গাড়িতে বেরিয়ে পড়লেন শেখরনাথ। বিশ্বজিতের পক্ষে এবেলা যাওয়া সম্ভব নয়। পুনর্বাসন দপ্তরের অনেকটা দায়িত্ব তার কাঁধে। তা ছাড়া তিনি একজন ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটও তার কোর্টে নানারকম মামলা লেগেই থাকে। আজ একটা জটিল কেসের শুনানি আছে। সেসব ঝক্কি সামলাতে সামলাতে তিনটে বেজে যাবে। তারপর আদালত থেকে সোজা হাসপাতালে যাবেন।
সাড়ে নটার মতো বাজে। দিনটা বেশ ঝলমলে। ভোরের দিকে যে কুয়াশা পড়েছিল তা কেটে গিয়ে উজ্জ্বল রোদে ভেসে যাচ্ছে শহর পোর্টব্লেয়ার। রোদটা খুব একটা তেজি নয়, বেশ আরামদায়ক। কোথাও ছিটেফোঁটা মেঘও নেই। পরিষ্কার, ঝকঝকে নীলাকাশ। উপকূলের কিনার ঘেঁষে অজস্র পাখি উড়ছে। সবই সি-গাল।
কোনও দিকে লক্ষ ছিল না বিনয়ের। চড়াই-উতরাই ভেঙে যতই গাড়িটা হাসপাতালের দিকে এগচ্ছে ততই উৎকণ্ঠার মাত্রাটা বেড়েই চলেছে। নিকোবর থেকে সেই দুই ডাক্তার কি ফিরে আসতে পেরেছেন? চিফ মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ কাল জানিয়েছিলেন, এঁরা না এলে মোহনবাঁশির অপারেশন করাটা খুবই কঠিন হয়ে উঠবে। হয়তো করা সম্ভবই হবে না। তখন কী হবে?
গাড়িটা সেলুলার জেলের প্রকাণ্ড গেট পার হয়ে সোজা হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল।
দোতলায় উঠতেই দেখা গেল, এর মধ্যেই বেশ ভিড় জমেছে। নতুন রোগী তো আছেই, পুরানো রোগীদের সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়ির লোকজনও হাজির।
লম্বা প্যাসেজে ভিজিটরদের জন্য যে সারি সারি বেঞ্চ পাতা রয়েছে সেখানে মোহনবাঁশির বউছেলেমেয়েদের বসিয়ে বিনয়কে সঙ্গে করে ডাক্তার চট্টরাজের চেম্বারে চলে এলেন শেখরনাথ।
ডাক্তার চট্টরাজ একাই রয়েছেন। কোনও পেশেন্টের এক্স-রে প্লেট খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। শেখরনাথদের বসার জন্য হাতের ইশারা করলেন।
প্লেটটা দেখা হলে সেটা টেবিলের একধারে নামিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে বললেন, ভীষণ মুশকিল হয়ে গেল কাকা। তাকে বেশ চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে।
শেখরনাথ সামনের দিকে একটু ঝুঁকে জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার, নিকোবর থেকে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনরা কি এখনও আসেনি?
আস্তে মাথা নাড়লেন ডক্টর চট্টরাজ।
শেখরনাথের দুই চোখে উদ্বেগ ফুটে বেরয় জিগ্যেস করলেন, মোহনবাঁশির কন্ডিশন আজ কেমন? আরও ডেটারিওরেট করেছে?
ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, মনে হয় না। তবে রাত্তিরে অনেক চেষ্টা করেও জ্ঞান ফেরানো যায়নি৷ আসলে ফুসফুস থেকে তিরটা বার করা দরকার। ওটা বেশিক্ষণ বিধে থাকলে বিপদ হবে।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর ডাক্তার চট্টরাজই ফের শুরু করলেন, ইন্টার আইল্যান্ড শিপ সারভিসের যে জাহাজটা দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে বেড়ায় এখন সেটা নিকোবরে যাবার কথা নয়। কদিন আগে সুকুমার আর তাপস ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জাহাজে গিয়েছিল। আজ। সকালে সেই জাহাজেই তাদের ফেরার কথা। ঘড়ি দেখে বললেন, দশটা বেজে গেল! কেন জাহাজটা আসছে না, বুঝতে পারছি না।
যে বিপ্লবী একদ