হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রেঙকিলান। তারপর জঙগুপি কাপড়ের গ্রন্থি থেকে বাঁশের চাচারি বার করে তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠল। সে শব্দটা টিজু নদীর ওপারে বনময় উপত্যকার ওধারে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্য! ওঙলেদের উত্তর এবার ভেসে এল না। আবারও শব্দ করল রেঙকিলান। এবারও ওঙলেরা নিরুত্তর।
রেঙকিলান তাকাল সেঙাইর দিকে। দেখল, সেঙাই তারই দিকে তাকিয়ে আছে।
আচমকা রেঙকিলান চিৎকার করে উঠল, আতঙ্কে তার গলাটা থরথর করে কাঁপছে, কী সর্বনাশ! হাঃ–আঃ–আঃ।
চুপ, একেবারে চুপ। আমিও দেখেছি। আয়, হুই আড়ালে লুকোই। রেঙকিলানকে টানতে চানতে একটা কাঁটাময় খেজাঙ ঝোঁপের মধ্যে চলে এল সেঙাই। খেজাঙ পাতার জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বুকসমান পাহাড়ী ঘাস সরিয়ে ভেরাপাঙ গাছের ফাঁক দিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে একদল নাগা। মাথায় হুন্টসিঙ পাখির পালক গোঁজা। দুচোখে আদিম হিংস্রতা তাদের। মুষ্টিবদ্ধ বর্শার ফলাগুলো পাহাড়ী ঘাসের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এরা সব সালয়ালা গ্রামের মানুষ। সেঙাইদের শত্রুপক্ষ।
খেজাঙের কাটাঝোপে রুদ্ধশ্বাসে উবু হয়ে বসেছে সেঙাই আর রেঙকিলান। তামাভ দেহ ধারাল কাটার আঘাতে আঘাতে ফালা ফালা হয়ে গিয়েছে। চিতাবাঘের সন্ধানে কখন যে একেবারে সালুয়ালা গ্রামের মধ্যে এসে পড়েছে দুজনে, খেয়াল ছিল না। সারা দেহের ওপর। রাশি রাশি সরীসৃপ কিলবিল করছে। এতটুকু নড়ছে না কেউ। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন পর্যন্ত থেমে গিয়েছে যেন। নিথর হয়ে গিয়েছে দুজনে। শরীরী নিশ্চেতনার মতো দাঁড়িয়ে রইল দু’টি তামাভ পাহাড়ী মানুষ।
খেজাঙ ঝোঁপের কাছাকাছি এসে পড়েছে মানুষগুলো। হাতের মুঠিতে তীক্ষ্ণধার বর্শা। পরনে সকলেরই পী মুঙ কাপড়। কৌমার্যের লক্ষণ। সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল মানুষগুলো। তারপর অনাবৃত বুকের ওপর চাপড় মেরে চিৎকার করে উঠল একসঙ্গে, হো-হো-ও-ও-ও–ও–
হো–ও–ও-য়া-য়া-য়া–
সে চিৎকারে পাহাড়ী অরণ্য চমকে উঠল। শিউরে উঠল টিজু নদীর নীল ধারা। আর খেজাঙের ঝোপে দু’টি হৃৎপিণ্ডে তীব্র আতঙ্কে রক্ত ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠতে লাগল। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে লাগল তাদের।
হো-ও-ও-ও–ও–স্বরগ্রাম আরো তীক্ষ্ণ হচ্ছে, প্রখর হচ্ছে।
এই মানুষগুলোও শিকারে বেরিয়েছে। তাদের চিৎকারে ভয়ার্ত শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে খুগু পাখির ঝাঁক, উড়ে যাচ্ছে লোটে আর শানিলা পাখির দল।
এখনও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সালুয়ালাঙের মানুষগুলো। মাঝে মাঝে সতর্ক চোখে এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছে। আর হঠাৎই সেঙাইর অস্ফুট স্মৃতির মধ্যে দোল খেয়ে উঠল একটা রক্তাক্ত অতীতের কাহিনী। যে অতীতের বর্শা এই সালুয়ালাঙ আর তাদের কেরি গ্রাম দু’টিকে টিজুনদীর দু’পারে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। যে অতীত টিজু নদীর দু’দিকে একটি অনিবার্য শত্রুতার জন্ম দিয়েছে।
.
কিংবদন্তির মতো ব্যাপার। টিজু নদীর দু’পারে সালুয়ালাঙ আর কেলুরি–এই পাহাড়ী জনপদ দু’টির প্রতিটি মানুষের ধমনীতে বিষাক্ত রক্তকণার মতো মিশে রয়েছে সে অতীত। সে অতীতের কাহিনী সেঙাই শুনেছে কেলুরির প্রাচীনতম মানুষটির মুখে। শীর্ণ দুই হাঁটুর ফাঁকে ধূসর মাথাখানা গুঁজে বুড়ো খাপেগা বলেছিল আর মোরাঙের জোয়ান ছেলেরা খাপেগার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘন হয়ে বসে শুনেছিল।
বুড়ো খাপেগা কেলুরি গ্রামের সর্দার। আশ্চর্য মনোরম তার গল্প। কথার সঙ্গে উত্তেজনার মদ মিশিয়ে সে মোরাঙের জোয়ান ছেলেদের মাতাল করে তুলেছিল। সেদিন আকাশে ছিল ক্ষয়িত চাঁদ। নাগা পাহাড়ের ছড়ানো উপত্যকায় রহস্যময় জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই জ্যোৎস্নার সঙ্গে খাপেগার কাহিনী মিশে এক বিচিত্র প্রতিক্রিয়া ঘটে গিয়েছিল সেঙাই-এর চেতনায়। সেই সঙ্গে বোধহয় অন্য সব জোয়ানদেরও।
খাপেগা সর্দার শুরু করেছিল এইভাবে, সেই রাতটা এমনই ছিল সু খুঙতার (ক্ষয়িত চাঁদের) রাত। হু-হু, তা কত বছর আগের ব্যাপার ঠিক মনে নেই। তবে সেদিন আমার চুল এমনি আখুশি পাতার মতো হেজে যায়নি। গায়ে জোর ছিল বাঘের মতো। সেই রাত্তিরে হুই সেঙাই-এর ঠাকুরদা এসে ডাকল আমাকে। তখন এই মোরাঙ ছিল টিজু নদীর কিনারে। রাতে শুয়ে ছিলাম। এদিকে সেদিকে চিতার ডাক। বুনো মোষের ঘোঁতঘোঁতানি। টানাডেনলা পাখির চিৎকার। পেছনের খেজাঙ ঝোঁপ থেকে জেভেথাঙ ফিসফিস করে ডেকেছিল আমাকে।…
রূপকথার মতো অপরূপ সে কাহিনি। খাপেগার গল্প মোটামুটি এইরকম।
টিজু নদীর দু’পাশে ও বন আর ভেরাপাঙের ছায়ায় সেদিন সালুয়ালাঙ কি কেলুরি গ্রামের চিহ্নমাত্র ছিল না। দুইয়ে মিলিয়ে ছিল এক অখণ্ড জনপদ। তার নাম কুরগুলাঙ। টিজু নদীর দুধারে এক উপত্যকা থেকে দূরের পাহাড়চূড়া পর্যন্ত ছিল কুরগুলাঙের বিস্তার।
নদীর এপারে ছিল জোহেরি বংশ। ওপারে পোকরি বংশ। দু’টি বংশই সমাজকে সবগুলো ভোজ খাইয়েছে। নগদা উৎসবে মোষ বলি দিয়েছে। ভালুক উৎসর্গ করেছে টেটসে দেবতার নামে। দুই বংশের প্রাচীনতম মানুষটি গ্রামের পেনেসেঙ্গু (পুরোহিত)। এই দুই বংশের বর্শার প্রতাপে সমস্ত গ্রামের সম্মান নির্বিঘ্ন, মর্যাদা অক্ষুণ্ণ। দুই বংশের মধ্যে একটা আন্তরিকতার সেতু পাতা রয়েছে। সেই সেতু টিজু নদীর দু’টি কিনারাকে যুক্ত করে দিয়েছিল। সেই সেতু টিজু নদীর দু’পারে দু’টি বংশের হৃদয়ে পারাপার হবার অন্তরঙ্গ যোগপথ। জোহেরি আর পোকরি বংশ। দুইয়ে মিলিয়ে এক অখণ্ড সত্তা। একটি বংশ আর-একটি বংশের সম্পূরক। জা কুলি উৎসবের দিনে কি নতুন ফসল তোলার মরশুমে টিজু নদী পার হয়ে আসত পোকরি বংশের। প্রাচীনতম মানুষটি। জোহেরি বংশের প্রবীণ মানুষটির পাশে নিবিড় হয়ে বসে পরামর্শ করত। বাঁশের পানপাত্রে রোহি মধু। কাঠের বাসনে ঝলসানো বনমুরগি আর একমুঠো নুন এবং বড় টঘুটুঘোটাঙ পাতায় কাঁচা তামাক দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করা হত পাহাড়ী প্রথামতো। আবার গ্রামে নতুন মোরাঙ তৈরির দিনে জোহেরি বংশের প্রবীণ মানুষটি নদী পেরিয়ে ওপারে যেত। বাইরের ঘরে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে মনের কপাট খুলে দিত। ফিসফিস গলা। কিন্তু একটিমাত্র স্থির লক্ষ্য। কুরগুলাঙ গ্রামের মোরাঙ যেন দুই বংশের আভিজাত্যে আর মহিমায় উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে পারে। মোরাঙই হল গ্রামের মর্যাদা, গ্রামের প্রতিষ্ঠার স্বাক্ষর। বাঁশের পানপাত্রে তামাটে ঠোঁট ঠেকিয়ে দুজনেই ধূসর মাথা নাড়ত।